২৬. দ্য কেভ

২৬. দ্য কেভ

হ্যারি সেই ঠান্ডা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নোনা হাওয়ার গন্ধ পেলো, সমুদ্রের ঢেউ, সামান্য আলো, ঠান্ডা হাওয়া ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে লাগলো। দেখতে পেলো, সামনে রয়েছে চন্দ্রালোকিত সমুদ্র, আর মাথার ওপর তারকাখচিত আকাশ। সমুদ্রের কোলে ও একটা শ্যাওলা ধরা বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার তলায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে, ফ্যানার সৃষ্টি করছে। ও পিছনে তাকালো, দেখলো একটা বিরাট লম্বা খাড়া ঋজু পাহাড়, তার চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে গভীর কালো অন্ধকার, একটুও আলো নেই, শুধু অন্ধকার। ডাম্বলডোর আর হ্যারি যে বড় পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে তার চারপাশে নানা আকারের ছোট বড় পাথর। মনে হয় সেগুলো কোনো পাহাড় থেকে ভেঙ্গে পড়েছে সমুদ্রতটে। ঝাপসা ঝাপসা সবকিছু, শুধু ঢেউ তোলা গর্জিত সমুদ্র। আশপাশে একটাও গাছপালা নেই, বালুকণাও নেই।

এখানকার পরিবেশ তোমার কেমন মনে হচ্ছে হ্যারি? ডাম্বলডোর জিজ্ঞেস করলেন। হয়তো হ্যারির কাছে জানতে চাইছেন পিকনিক করার উপযুক্ত জায়গা কি না। এই স্থানেই টম ও অনাথ আশ্রমের অন্যান্য বাচ্চারা এসেছিলো পিকনিক করতে।

এই দুর্গম জায়গায় অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের এখানে নিয়ে আশা হয়েছিলো? হ্যারি বললো। আমি ভাবতে পারি না এমনকি দিনের বেলায়ও বেড়াবার জায়গা হিসেবে এটা হতে পারে?

ঠিক এখানে নয়, সামান্য দূরে একটা ছোট গ্রামের মতো আছে। মনে হয় বাচ্চাদের এখানে সমুদ্রের হাওয়া খাওয়াতে আর সমুদ্রের ঢেউ দেখাতে নিয়ে আসতো। না, আমার মনে হয় ওই একবারই টম রিডিল আর ওর শিকার ছোট ছেলে-মেয়েরা এখানে এসেছিলো। কোনো মাগলদের পক্ষে এখানে ঢু মারা সম্ভব নয়, যদি তারা দুর্ধর্ষ পর্বতারোহী না হয়।

লুমাস, ডাম্বলডোর বলতেই হাজার হাজার আলোর কিরণ পাহাড়টাকে ঝলসে দিলো।

হ্যারি দেখলো সেই গগণচুম্বি কালো পাথরের মধ্য দিয়ে একটা শীর্ণ নদীর মতো জল বয়ে যাচ্ছে।

তুমি নিশ্চয় জলে ভিজতে অরাজি হবে না, ডাম্বলডোর বললেন।

না।

বেশ তাহলে তোমার অদৃশ্য হবার ক্লোক খুলে ফেলো। এসো আমরা নদীতে ঝাঁপ দেই।

বরফের মতো ঠান্ডা জল। জলে ওর সর্বাঙ্গ, বেশ ভুষা ভিজে সপসপ করতে লাগলো। ডাম্বলডোর জলের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলেন। ডাম্বলডোরেরও সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। দাড়িগুলো ভিজে বুকের ওপর পড়েছে, বললেন, ও হ্যাঁ এই সেই জায়গা। আমার দৃঢ় ধারণা এই পাহাড়টায় ও এসেছিলো, এখানে এসে ওর কালো হাতের ছাপ রেখে গেছে। বিড় বিড় করে কিছু বললেন ডাম্বলডোর। কথাগুলোর মর্মার্থ হ্যারি এক বর্ণও বুঝতে পারলো না। তারপর ডাম্বলডোর এধার ওধার তাকিয়ে পিছন ফিরে জলস্রোতের দিকে তাকালেন। হ্যারি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

দু দুবার ডাম্বলডোর কালো পাহাড়টার কাছে গিয়ে যতোটা হাত যায় ততোটা উঁচুতে তার হাত ছোঁয়ালেন। মাঝে মাঝে সেই এবড়ো থেবড়ো কালো পাথরের একই জায়গায় হাতের কয়েকটি আঙ্গুল ছোঁয়াতে লাগলেন। অনেকটা সময় একইভাবে পাহাড়ের পাথরে আঙ্গুলগুলো চালাচালি করার পর হঠাৎ এক জায়গায় স্থির হয়ে ছুঁইয়ে রাখলেন। এধার ওধার করলেন না বা হাতটা টেনে নিলেন না।

এখানে, ডাম্বলডোর বললেন, এখান থেকেই আমাদের ভেতরে যেতে হবে। মনে হয় ভেতরে ঢোকার পথও লুকিয়ে রেখেছে।

হ্যারির মনে একটুও প্রশ্নের উদয় হলো না, প্রফেসর কেমন করে জানলেন। শুধুমাত্র স্পর্শ করেই কি বুঝতে পারলেন? হ্যারি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।

ডাম্বলডোর তার ম্যাজিক ওয়ান্ডটা দেয়ালে ছোঁয়াতেই পাথরের গায়ে একটা ধনুর মতো রেখা ফুটে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে হ্যারির মনে হলো পাথরের পেছনে তীব্র আলো জ্বলছে। পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে ফাটল ধরেছে জাদুদণ্ড স্পর্শ করার পর সেখান থেকেও তীব্র আলোর রশ্মি ঠিকরে বেরোচ্ছে।

তীব্র ঠান্ডায় হ্যারির দাঁতগুলো ঠকঠক করছিলো। ও সেই অবস্থাতেই বললো, কোথা থেকে এতো আলো আসছে, আপনি কি করেছেন?

হ্যারির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে যা কিছু দেখছে সব মিলিয়ে গেল। আগের মতো ঘন অন্ধকার। ও ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো, আগের মতোই তীব্র ঠান্ডা হাওয়াতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো।

হ্যারি আমি খুব দুঃখিত, তুমি যে ভিজে গিয়ে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে, খেয়াল করিনি। কথাটা বলার পর ডাম্বলডোর হ্যারির গায়ে সিক্ত বসন দণ্ডটা স্পর্শ করাতেই সেগুলো শুকিয়ে গিয়ে গরম হয়ে গেলো। মনে হলো যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখার সামনে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ধন্যবাদ আপনাকে, হ্যারি কৃতজ্ঞচিত্তে বললো। ডাম্বলডোরের দৃষ্টি সেই পাহাড়ের শক্ত পাথরের ওপর। ডাম্বলডোর সেই পাথরের গায়ে আর কোনো রকম ম্যাজিক প্রয়োগ না করে সেইদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তাকানো দেখে মনে হয় পাথরের দেয়ালে এমন একটা লেখা আছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যারি সেইদিকে তাকিয়ে রইলো, কোনো প্রশ্ন করে ডাম্বলডোরের একাগ্রতা ভঙ্গ করতে চাইলো না।

দুমিনিট ওইরকমভাবে তাকিয়ে থাকার পর ডাম্বলডোর খুব আস্তে বললেন, না হতে পারে না, এতো নোংরা মনোবৃত্তি!

কি বলছেন প্রফেসর?

আমার মনে হয়, ডাম্বলডোর তার অক্ষত হাতটা রোবসের পকেটে ঢুকিয়ে ছোট একটা রূপোর ছুরি বার করলেন, ছুরি অনেকটা হ্যারির পোশানের জন্য জড়ি বটি টুকরো টুকরো করার ছুরির মতো। আমাদের ভেতরে যাবার জন্য কিছু দক্ষিণা দিতে হবে।

দক্ষিণা দিতে হবে? হ্যারি বললো। দরজা খোলার জন্য কিছু দিতে হবে আপনাকে?

হ্যাঁ হ্যারি, ডাম্বলডোর অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ হ্যারি রক্ত, দরজাকে রক্ত দিতে হবে।

রক্ত?

তাইতো বলছিলাম, বড়ই স্কুল, ডাম্বলডোর বললেন। তার কথা শুনে মনে হলো নিদারুণ হতাশ আর মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে। ভোর্স্টেমর্টের মান এতটা নিচু ডাম্বলডোর আশা করেননি। তার ইচ্ছা শত্রুরা ভেতরে ঢোকার আগে শক্তিক্ষয় করে যাবে। আবার লর্ড ভোল্ডেমর্ট বুঝতে পারছে না যে দৈহিক ক্ষত বা আঘাতের বেশি আরো কিছু থাকতে পারে।

হতে পারে, কিন্তু আপনি তো সেটা অবজ্ঞা করতে পারেন, হ্যারি বললো। ও আজ পর্যন্ত অনেক ব্যথা বহন করে চলেছে, আরো নতুন করে কোনো ব্যথা চায় না।

কখনো কখনো সেটা এড়ানো যায় না হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন। কথাটা বলার পর যে হাতটায় দগ দগ করছে, সেই হাতটা রোবসের হাত থেকে বার করে ছুরিটা ধরলেন।

প্রফেসর, প্রফেসর ছুরিটা ফেলে দিন, হ্যারি ডাম্বলডোরকে বাধা দেবার জন্য এগিয়ে গেল। আমি, আমি রক্ত দেব।

ও জানে না এর উত্তরে ডাম্বলডোর কি বলবেন। ক্ষুদ্র বালক, খুবই ক্ষুদ্র! ডাম্বলডোর কিছু না বলে হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসলেন। হ্যারি দেখলো রূপালী এক ঝলক আলো, চতুর্দিক টকটকে লাল হয়ে গেছে, পাহাড়ের গা ঘন, চকচকে লাল বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

হ্যারি তুমি খুব ভাল ছেলে, ডাম্বলডোর বললেন। বলার পর তার দণ্ডের মুখটা তার ক্ষত থেকে লাভার মতো বেরিয়ে আসা রক্তস্রোতের মুখে ধরলেন, যাতে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যায় যেমন করে স্নেইপ ম্যালয়ের রক্ত পড়া বন্ধ করেছিলেন।

তোমার দেহের রক্ত আমার রক্তের চাইতে মূল্যবান হ্যারি। আহ এখন ওর ট্রিক সফল হয়েছে, তাই না?

আবার রূপালী আলো পাহাড়ের দেয়ালে তোরণের মতো রূপ নিলো, এবার সেই ধনুকাকৃতি রূপালী রেখা পাহাড়ের গা থেকে অন্তর্হিত হলো না। রক্ত মাখা পাহাড়ের অংশ আবার যেমন কালো বর্ণের ছিলো তেমনই হয়ে গেল, চতুর্দিক ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ডাম্বলডোর ভেতরে ঢুকলেন।

এসো আমার পিছু পিছু, ডাম্বলডোর বললেন। নিজের দণ্ড দিয়ে আলো জ্বালিয়ে সেই রূপালী ধনুকাকৃতির ভেতরে ঢুকে হাঁটতে লাগলেন হ্যারির হাত ধরে। খুব দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। খানিকটা হাঁটার পর…

হ্যারি দেখলো ও ডাম্বলডোরের হাত ধরে একটা কালো রঙের জল ভর্তি হ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতো চওড়া সেই কালো হ্রদ অপর পার দেখা যায় না। হ্রদের বহু দূরে মাঝখান থেকে অদ্ভুত এক সবুজ আলো জ্বলছে। তারই এক প্রতিবিম্ব পড়েছে হ্রদের জলে।

ডাম্বলডোর বললেন, চলো এগোনো যাক। খুব সাবধানে চলবে, অন্ধকার পথ, হ্রদের জলে পড়ে না যাও। আমার হাত ধরে চলো।

হ্যারি ডাম্বলডোরের হাত না ধরে হ্রদের পাশ দিয়ে অতি সন্তর্পণে পা ফেলে ডাম্বলডোরের পিছু পিছু চললো। চুতর্দিক এতো নিস্তব্ধ যে ওদের প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। পথের ধারে হ্রদ থেকে উপচে পড়ে যে জল জমেছিলো তাতে পা পড়ে শপ শপ শব্দ হতে লাগলো।হ্রদের এক পাশে সারি সারি পাহাড় অন্যদিকে কালো কালো ঘাস আর গাছপালা। সেই নিঃস্তব্ধতা আর অন্ধকার হ্যারির খুবই অস্বস্তিকর মনে হতে লাগলো।

প্রফেসর, হ্যারি নীরবতা ভঙ্গ করে বললো। হরক্রাকস কি এখানে পাওয়া যাবে মনে করেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, ডাম্বলডোর বললেন। আমি নিশ্চিত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন। হলো কেমন করে আমরা পাবো।

বোধহয় পাবো না, একটা সামোনিং চার্ম করলে কেমন হয়? হ্যারি বললো।

মতো প্রশ্ন করেছে, বোকার মতো সাজেশন দিয়েছে। আসলে ওই পরিবেশ ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে আসার তাগিদ থেকে ওই কথা বলেছে। কেন পাবো না, নিশ্চয়ই পাবো, ডাম্বলডোর চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে অন্ধকারে হ্যারির মুখের দিকে তাকালেন। কেন তুমি এই প্রশ্ন করলে?

আমি… আমি… ঠিক আছে, ঠিক আছে চলুন।

হঠাৎ হ্যারি একটু কেসে গলা পরিষ্কার করে দণ্ডটা তুলে খুব জোরে বললো, একিও হরক্রাকস!

হ্যারির থেকে প্রায় কুড়ি ফিট দূরে হ্রদের কালো জলে বিরাট এক বিস্ফোরণ হলো, গগণভেদী সেই বিস্ফোরণের শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো যেন। হ্রদের শান্ত জল দারুণ অশান্ত হয়ে বড় বড় ঢেউ তুলে তীরে আছড়ে পড়তে লাগলো। হ্যারি আচমকা সেই বিস্ফোরণের শব্দে হতভম্ব হয়ে পেছনে তাকাতেই পাহাড়ে ধাক্কা খেলো। তখনো সেই শব্দের বিভীষিকায় থরথর কাঁপছে। তারই সঙ্গে পাহাড়ের দেয়ালে সজোরে ধাক্কা খাওয়ার যন্ত্রণা সামলে নিয়ে ও ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো।

কিসের শব্দ প্রফেসর?

কিছু একটা, মনে হয় আমরা হরক্রাকসের কাছে চলে এসেছি এবং উত্তর দিচ্ছে।

হ্যারি কথাটা শুনে পিছন ফিরে হ্রদের দিকে তাকালো। দেখলো গভীর কালো জল শান্ত হয়ে গেছে। স্থির অচঞ্চল, কালো কাঁচের মতো চকচক করছে। হ্যারির বুকের ভেতরটা তখনো দুরু দুরু করছে।

এমন একটা কিছু হবে বুঝতে পেরেছিলেন, স্যার?

হরক্রাকস আমাদের হাতের মুঠোতে আনতে গেলে এমনই হবার কথা। আমার মনে হয় তোমার প্রচেষ্টাই সঠিক ছিলো এবং এটাই সহজ পথ।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, লেকের জলে সমুদ্রের মতো ঢেউ! হ্যারিদের কালো জলের দিকে তাকিয়ে বললো।

কেন এমন হলো, জানতে চাইছো হ্যারি? ডাম্বলডোর অবিচল কণ্ঠে বললেন। আমার মনে হয় একটা নয়, আরো অনেক হরক্রাকস এখানে লুকোনো আছে। চলো, আরেকটু এগোই।

প্রফেসর? হ্যাঁ, বলো হ্যারি। আপনার কি মনে হয় লেকের তলদেশে আমাদের যতে হতে পারে?

ভেতরে? যদি দুর্ভাগ্যবশত না পাই।

হরক্রাকস তাহলে…।

না একেবারে জলের তলায় নয়, মাঝামাঝি কোথাও থাকতে পারে। আমাদের তো তাহলে জলে নামতে হবে। ডাম্বলডোর হ্যারিকেহ্রদের জলের মাঝখানে সবুজ আলোটা আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন।

আমারও তাই মনে হয়, জলে নামতে হবে, ডাম্বলডোর বললেন।

হ্যারি চুপ করে রইলো। ও ভাবতে লাগলো জল-দানব, বড় বড় সাপ, দৈত্য, সামুদ্রিক গাছ গাছড়া আর প্রেতাত্মার কথা।

আহ, ডাম্বলডোর কথাটা বলে আচমকা থামলেন। হ্যারি ডাম্বলডোরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লেকের জলে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। ডাম্বলডোর ওকে ধরে ফেললেন। দুঃখিত হ্যারি, থামার আগে তোমাকে বলা উচিত ছিলো তাহলে ধাক্কা লাগতো না। মনে হয় আসল জায়গাটা পেয়ে গেছি।

ডাম্বলডোর কি বলতে চাইলেন হ্যারি ঠিক ধরতে পারলো না। হ্রদের কালো জলে কোথায় লুকোনো রয়েছে হরক্রাকস? পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর দক্ষিণ যেখানে তাকায় সেখানেই তো আলকাতরার মতো হ্রদের কালোজল। তার মধ্যে কোথায় হরক্রাকসের সন্ধান পেলেন ডাম্বলডোর।

হ্যারি দেখলো ডাম্বলডোর এবার পাহাড়ের কালো পাথরের দেয়ালের মতো হাত বোলাচ্ছেন না, হাতটা বাড়িয়ে হাওয়া থেকে কিছু ধরবার চেষ্টা করে চলেছেন। মনে হয় সে অদৃশ্য বস্তুটা ধরার চেষ্টা করছেন সেটা তার সামনে হাওয়াতে ভাসছে। সেভাবেই ধরার চেষ্টা করতে করতে জলের খুব কাছে চলে এলেন; হ্যারির বুকটা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। ডাম্বলডোর এগোতে এগোতে হ্রদের জলে পা রেখেছেন। আরো একটু এগোলে জলের মধ্যে ডুবে যাবেন। ডাম্বলডোরের কোনো কিছুতে খেয়াল নেই। একটা হাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুললেন, অন্য হাতে তুললেন তার দণ্ডটা, দণ্ডের মুখটা চেপে ধরে রেখেছেন হাতের

সহসা হ্রদের জলের ভেতর থেকে পেতল রঙের একটা মোটা শিকল উঠে এলো। ডাম্বলডোর সেই শিকলটা শক্ত করে ধরলেন। সেই শিকলটা এমনভাবে হেলতে দুলতে লাগলো যেন ডাম্বলডোর একটা মোটা সাপকে ধরে রেখেছেন। মাটিতে পড়ে সেই শিকলটা সাপের মতো ছটফট করতে লাগলো এবং অদ্ভুত এক শব্দ করতে লাগলো, সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো হ্রদের এক ধারের গগণচুম্বি কালোপাহাড়ের গায়ে লেগে। তারপর সেই শিকলটাদের কালো জলের ভেতর থেকে ছোট একটা নৌকো টেনে তুলে জলের কিনারায় নিয়ে এলো। নৌকোটা শিকলের রঙের মতোই পেতল-সবুজ মেশানো। হ্যারি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সেই ছোট নৌকোটার দিকে তাকিয়ে রইলো। নৌকোটা কিনারায় ভাসছে, কিনারার এতো কাছে যে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।

হ্যারি বিস্ফোরিত চোখে নৌকোটার দিকে তাকিয়ে বললো, ওটা জলের ভেতরে রয়েছে কেমন করে জানেন প্রফেসর?

ম্যাজিক, ম্যাজিক দিয়ে সবকিছু ধরা যায়, জানা যায়, ডাম্বলডোর বললেন।

নৌকোটা হ্রদের কিনারায় এসে জলেতে দুলতে লাগলো। মনে রেখো টম রিডিল আমার ছাত্র ছিলো। ম্যাজিক ওকে আমি শিখিয়েছি। আমি ওর ম্যাজিকের স্টাইল জানি হ্যারি।

নৌকোটা, ওটাতে ওঠা নিরাপদ প্রফেসর?

ও হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই কোনো ভয়ের ব্যাপার নেই।হ্রদ পারাপারের জন্য ভোস্টেমর্টের এটা দরকার। জলের ভেতর আরো অনেক হরক্রাকস লুকোনো আছে। তারা ওকে যে আক্রমণ করবে না তা ও বলতে পারে না। তবু মাঝে মাঝে নিজের হরক্রাকসটা দেখতে আসে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নৌকোটা ব্যবহার করে। হয়তো, চেষ্টা করে নিজের হরক্ৰকিসটা এখান থেকে সরিয়ে। ফেলতে।

তো ওরা আমাদের ভোল্টেমর্টের নৌকোতে চাপতে দেখলে কিছু করবে না তো? আমাদের তাড়া করবে না তো?

আমার মনে হয়, ওরা করবে কি করবে না সে সম্বন্ধে চিন্তা করার এখন কোনো প্রয়োজন নেই। মনে করো নৌকোটা ভোল্ডেমর্টের নয়। নৌকোটা জলের ভেতর থেকে তোলার সময় ওরা আমাদের তুলতে বাধা দেয়নি। যাহোক। মোটামুটি আমরা ঠিক পথে চলছি।

আমাদের কেন ওরা নৌকো বাধা দেয়নি? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। ওর চোখের সামনে জলের ভেতর থেকে সাপের মতো বেরিয়ে আসা শিকল আর নৌকো টেনে তোলার দৃশ্য ভাসছে।

ভোল্ডেমর্ট মোটামুটি জানে একজন বড় মাপের জাদুকর ছাড়া আর এই নৌকোটা খুঁজে পাওয়া অসাধ্য, ডাম্বলডোর বললেন। তাহলেও সেই বিপদাশঙ্কার সম্মুখীন হতে ও নানা রকমের বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, যেন একমাত্র ও সেই বাধাগুলো অপসারণ করতে পারে, দেখা যাক ও কতোটা কতকার্য হয়েছে।

হ্যারি আবার নৌকোটার দিকে তাকালো। নৌকোটা খুবই ছোট একজনের বেশি বসা সম্ভব নয়। বললো, আমরা দুজনে কী ওটাতে বসতে পারবো? ভারি হয়ে যাবে না?

ডাম্বলডোর মুখ টিপে হাসলেন।

ভোন্ডের্ট কতোটা ওজোন হলো বা না হলে সেটা নিয়ে ভাবে না। ও ভাবে কতোটা ম্যাজিক শক্তির সাহায্যে লেকটা পার হতে পারবে। আমার মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। নৌকোতে এমন এক ম্যাজিক প্রয়োগ করে রেখেছে যাতে একজনের বেশি দুজনে চাপতে পারবে না।

তা হলে কি হবে?

আমার মনে হয় না তুমি তার হিসেবের মধ্যে আসো না। তুমি ছেলে মানুষ ও অপরিণত। ভোল্ডেমর্ট কোনোদিন ভাবতে পারেনি মাত্র যোল বছর বয়সের একটি ছেলে এখানে আসতে পারে। আমার মনে হয় আমার শক্তির চাইতে তোমার শক্তি বেশি হতে পারে।

ডাম্বলডোর জানেন ওই কথা বলে হ্যারির আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যাবে না, তবু তিনি বললেন, হ্যারি, ভুল ভুল ভোস্টেমর্টের ভুল। যাকগে ওসব কথা, সাবধান, দেখো যেনো জল না লাগে।

হ্যারি ডাম্বলডোরের নির্দেশ মতো খুব সাবধানে নৌকোতে পা রাখলো। হ্যারি নৌকোতে ওঠার পর ডাম্বলডোর নৌকোতে উঠে শিকলটা গোটাতে গোটাতে নৌকোর মেঝেতে রাখলেন। তারপর গাদাগাদি করে হ্যারির পাশে বসলেন, অপরিসর জায়গাতে হ্যারির বসতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল, কুঁজো হয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো। নৌকো ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, শুধু শান্ত জলের ওপর দিয়ে নৌকো ভেসে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো হ্যারি। হাল ছাড়াই নৌকো কালো জলের ওপর দিয়ে তির তির করে ভেসে চললো। মনে হয় একটা অদৃশ্য দড়ি নৌকোটাকে টেনে নিয়ে চলেছে হ্রদের মধ্যস্থলে আলোর দিকে। একটু পর হ্যারি আর গুহার দেয়ালগুলো দেখতে পেলো না, ওরা এমন একটা অসিম জলে ভাসমান, যার কোনো ঢেউ নেই, একুল ওকুল নেই। নৌকো আপন গতিতে আলোর দিকে চলেছে। হ্যারির চোখ পড়ে গেলো কালো জলে। দেখলো ওর হাতের সোনালী দণ্ডটার প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে, চকচক করছে। নৌকাটা চলার সময় তার দুপাশের জলের ওপর ছোটো ছোটো ঢেউ তুলছে।

সেই সময়ে হ্যারির চোখে পড়ে গেল, শ্বেত পাথরের মতো সাদা একটা কিছু জলের ওপরের স্তর দিয়ে ভেসে চলেছে।

প্রফেসর! হ্যারি বললো। ওর গলার স্বর শান্ত জলে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হলো।

হ্যারি? আমি, আমি জলের ওপর মানুষের একটা সাদা হাত ভাসতে দেখলাম। হা, জানি আমি দেখেছি হ্যারি, ডাম্বলডোর শান্ত স্বরে বললেন। হ্যারি জলের দিকে তাকালো। সেই সাদা হাতটাকে আর ও দেখতে পেলো, অদৃশ্য হয়ে গেছে। হ্যারির গলাটা জ্বালা করতে লাগলো।

হঠাৎ হাতটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল প্রফেসর?

প্রশ্নের জবাব হ্যারি পেয়ে গেল, ডাম্বলডোরের জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। ও ওর দণ্ডের আলোতে দেখতে পেলো অদূরে জলস্তরের ইঞ্চি কয়েক তলায় একটা মৃতদেহ ভেসে চলেছে। মৃতদেহের চোখ দুটি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর খোলা দুচোখের ওপর মাকড়সার সূক্ষ্ম জাল, ওর মাথার চুল ও আলখেল্লা ধোয়ার মতো ঘুরছে।

হ্যারি বলে উঠলো, এখানেও মৃতদেহ ভেসে চলেছে! ওর গলার তীব্র নির্জনতা ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিলো। অদ্ভুত ওর গলার স্বর, যেন অন্য কেউ ওর গলা দিয়ে বললো।

হ্যাঁ, এখানে অনেক মৃতদেহ দেখতে পাবে, ডাম্বলডোর বললেন। আপাতত এই মুহূর্তে মৃতদেহ নিয়ে মাথা ঘামিও না।

এই মুহূর্তে? হ্যারি ডাম্বলডোরের কথাটা বললো। মৃতদেহ থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকালো।

ওরা এখন শান্ত হয়ে জলের তলায় ভেসে চলেছে, ডাম্বলডোর বললেন। একটা প্রাণহীন দেহকে দেখে ভীত হবার কিছু নেই হ্যারি, এই অন্ধকারে কোনো কিছুতেই ভয়ের কারণ নেই। লর্ড ভোল্ডেমর্ট ও ভয় পায়, কিন্তু কাউকে জানাতে চায় না। তাতে ওর যে জ্ঞানের অভাব আছে তা প্রকাশ হয়। অজানাকে আমাদের ভয়, যখন মৃত্যু ও অন্ধকার দেখি তখন তা-ই, এছাড়া কিছু নয়।

হ্যারি তর্ক করতে চায় না, চুপ করে রইলো। কিন্তু এ কথা সত্য যে ওদের চারপাশের জলে মৃতদেহ ভেসে চলেছে, তাদের তলায় আরো বীভৎস কিছু থাকতে পারে, ডাম্বলডোর যাই বলুন না কেন ওই মৃতদেহগুলো মারাত্মক নয় এমন কথা ও বিশ্বাস করতে চায় না।

কিন্তু মৃত হলেও একজন তো নড়াচড়া করছিলো, ডাম্বলডোরের চাইতেও গলার স্বর আরো শান্ত ও নামিয়ে বললো। যখন আমি হরক্রাকস ডাকার চেষ্টা করে ছিলাম, লেকের জলের ভেতর থেকে একটা দেহ প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে উঠেছিলো।

ঠিক বলেছো, ডাম্বলডোর বললেন। হরক্রাকসরা সাধারণত কোনো উৎপাত করে না, চুপচাপ থাকে। যারা অতিশীতল আর অন্ধকারে বসবাস করে তারা উষ্ণতা আর উজ্জ্বলতাকে ভয় পায়। ডাম্বলডোর হাসলেন, প্রয়োজন হলে আমরাও তাদের কাজে লাগাতে পারি।

হ্যারি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ওহ এখনই। ও মুখটা ঘুরিয়ে সেই লেকের মাঝখানে সবুজ উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে বললো। নৌকোটা সেইদিকে অবাধগতিতে ভেসে চলেছে। ও যে ভয় পাচ্ছে না তা গোপন করতে পারছে না। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আলোর দিকে ও তাকিয়ে রইলো। কালো লেকের জলে মাছের মতো মৃতদেহগুলো নৌকোর সাথে সাথে ভেসে চললল। ওর মনে হলো কিছুক্ষণ আগে নয়, অনেক অনেক দিন আগে ও ট্রিলনির সঙ্গে করিডরে কথা বলেছিলো, তারও আগে রন আর হারমিওনকে ফেলিক্স ফেলিসিস দিয়েছিলো, হঠাৎ মনে হলো ওদের সঙ্গে তো বিদায় জানিয়ে আসা হয়নি, অনেকদিন তো জিনির সঙ্গে দেখা হয়নি। নানা অসংলগ্ন চিন্তা আর কথা হ্যারির মনে। মাথার ভেতরটা যেনো শূন্য হয়ে গেছে।

আমরা প্রায় এসে গেছি, দারুণ উৎসাহে ভালভোর বললেন।

ওরা সেই প্রজ্জ্বলিত সবুজ আলোর অনেক কাছে এসে গেছে। সেই সবুজ আলো আর ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে না, সম্ভবত মিনিট খানেকের মধ্যে নৌকোটা পৌঁছে যাবে। হঠাৎ ওদের নৌকোটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে দুলতে লাগলো। হ্যারি ওর টর্চের মতো দণ্ডটার আলো দিয়ে দেখলো ওরা একটা পাহাড়ি দ্বীপের কাছে পৌঁছেছে। খুবই ছোট। নৌকোটা দ্বীপের একধারে মসৃণ চকচকে পাথরে খট খট ধাক্কা দিয়ে চলেছে।

আবার ডাম্বলডোর হ্যারিকে বললেন, নৌকো থেকে দ্বীপে নামার সময় সাবধানে নামবে, দেখো জল যেন না লাগে। হ্যারি সাবধানে সেই ছোট দ্বীপে পা দিলো। দ্বীপটা ডাম্বলডোরের অফিসের চাইতে ছোটো মনে হলো হ্যারির। দ্বীপের ওপরটা চেটালো এক চকচকে কালো পাথরের, ওখান থেকেই উজ্জ্বল সবুজ আলোটা বেরোচ্ছে। হ্যারি সামান্য একটু এগোলে আলোটা আরো তীব্র মনে হলো। হ্যারি তীর্যক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো এক রকমের ল্যাম্প; কিন্তু সেটা কোনো ল্যাম্প নয় কাঁচের পাত্র। অনেকটা পেনসিভের মতো একটা বেসিন থেকে আলোটা বেরোচ্ছে। বেসিনটা পেডেস্টাল পাখার মতো একটা স্ট্যান্ডে রয়েছে।

ডাম্বলডোর বেসিনটার দিকে এগোতে লাগলেন। হ্যারি তার পেছনে পেছনে চললো। ওরা দুজনে পাশাপাশি বেসিনটা দেখতে লাগলো। দেখতে পেলো বেসিনটা ভর্তি রয়েছে সবুজ রং-এর তরল পদার্থে। তার থেকে মৃদু আলোর সৃষ্টি করছে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ডাম্বলডোর বললেন। রক্ত আর ওই মৃতদেহের চাইতে উপদ্রবকর মনে হচ্ছে, যাকগে। কথাটা বলে ডাম্বলডোর তার আলখেল্লার হাতাটা গুটিয়ে কনুইয়ের কাছে তুললেন। হ্যারি খোলা হাতের দিকে তাকালো। হাতটার কালো কুচকুচে ক্ষত এখনো শুকোয়নি। তারপর ডাম্বলডোর তার সেই হাতের আঙ্গুলের ডগাগুলো বেসিনের পোশানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

স্যার, ওটা ছোঁবেন না, ছোঁবেন না।

ডাম্বলডোর হ্যারির আতঙ্কিত মুখ দেখে মৃদু হেসে বললেন, চেষ্টা করলেও আমি ওটা ছুঁতে পারবো না, হ্যারি। দেখো আমি একটুও এগোতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখো তুমিও আর এগিয়ে পোশানটা ছুঁতে পারবে না।

সচকিত হয়ে হ্যারি বেসিনটায় হাত দিয়ে পোশানটা ছোবার চেষ্টা করলো। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার হাত বাড়িয়ে হ্যারিকে আটকে দিলো।

হ্যারি প্রাণপণে পোশানে হাত ছোঁয়াবার চেষ্টা করলো কিন্তু এক ইঞ্চিও এগোতে পারলো না। হ্যারি বার বার চেষ্টা করেও অসফল হলো। পোশান আর ওর মাঝে একটা অদৃশ্য পাথর রয়েছে।

থাক আর হাত দেবার চেষ্টা করো না হ্যারি, ডাম্বলডোর হাতের দণ্ডটার দিকে তাকিয়ে বললেন।

তারপর ডাম্বলডোর জাদুদণ্ডটা নিয়ে পোশানের সামান্য ওপরে আর ধারে ঘোরাতে ঘোরাতে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। হ্যারি সেই মন্ত্রের একটা অক্ষরও বুঝতে পারলো না। ডাম্বলডোরের দণ্ড ঘোরাবার পর সবুজ আলোটা আরো তীব্র হয়ে গেলো। হ্যারি এক পাশে দাঁড়িয়ে ডাম্বলডোরের প্রচেষ্টা দেখতে লাগলো। ডাম্বলডোর অনেক চেষ্টার পর যখন পোশানটা ছুঁতে পারলেন না তখন হাতটা সরিয়ে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি নীরব হয়ে ডাম্বলডোরের দিকে তাকিয়েছিলো। ডাম্বলডোর হাতটা সরিয়ে নেবার পর হ্যারি কথা বললো।

স্যার আপনার কি মনে হয় হরক্রাকস ওই বেসিনটায় আছে? ডাম্বলডোর আবার পোশানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। হ্যারি দেখতে পেলো বেসিনের মধ্যে রাখা পোশানে ডাম্বলডোর মুখ নামিয়ে দেখার জন্য তার মুখের প্রতিবিম্ব পড়েছে, অনেকটা কাঁচের ওপর যেমন হয়। কিন্তু ভেতরে যাই কেমন করে বলতে হ্যারি, পোশানটাতে হাত দিয়ে সরানো যাচ্ছে না। আমার আর পোশানের মাঝে বাধার সৃষ্টি করেছে। কোনো ম্যাজিক প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না।

অন্যমনস্ক হয়ে ডাম্বলডোর মৃদুস্বরে জাদুমন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে আবার পোশানের ওপর হাত তুললেন, পোশানে হাত লাগাতে পারলেন না। তারপর খপ করে যেখান থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো সেই কাঁচের গবলেটটা ধরে ফেললেন। বললেন, আমার কি মনে হয় জানো, পোশানটাকে ডুবিয়ে রেখেছে।

কী, কী বললেন স্যার? তা কখনো হতে পারে? হতে পারে না।

হ্যাঁ ঠিকই বলছি। এখন একমাত্র উপায় আমি যদি বেসিনটা খালি করতে পারি তাহলে দেখতে পারি ভেতরে কি আছে।

স্যার অমন কাজ করবেন না, পান করলে আপনার যদি কিছু হয়। একমাত্র উপায়, আর তো কোনো পথ দেখছি না, ডাম্বলডোর স্বাভাবিকভাবে বললেন। এই দ্বীপে যারা পৌঁছতে পারে ভোল্ডেমর্ট তাদের হত্যা করতে চায় না।

হ্যারির মনে হয় ডাম্বলডোর কি পাগল হয়ে গেছেন! পৃথিবীর সকলের মঙ্গল চান তাই বলে শয়তান ভোন্ডেমক্টের।

স্যার, স্যার আপনি ভোল্ডেমর্টকে বিশ্বাস করেন? হাতের মুঠোতে আমাদের পেয়েও হত্যা করবে না?

দুঃখিত হ্যারি, আমার কথাটার মানেটা ঠিক ধরতে পারলে না। যারা এই দ্বীপে পা রাখবে তাদের তৎক্ষণাৎ ও হত্যা করতে চায় না। ডাম্বলডোর নিজের কথা সংশোধন করলেন। ও তাদের বাঁচিয়ে রেখে জানতে চাইবে কেমন করে তারা ওর প্রতিরোধ ম্যাজিক ভেদ করে এই দুর্ভেদ্য দ্বীপে এসেছে। তাছাড়া সবচেয়ে জরুরি, কেন তারা এখানে এসেছে, কেনোই বা বেসিনের পোশানটা নষ্ট করতে চায়। জেনে রেখো, ভোল্ডেমর্ট খুব সাবধানী, ও চায় না আর কেউ তার হরক্রাকসের সম্বন্ধে কিছু জানুক। তাই যারা জানতে আসে তাদের ও আটকে রেখে অত্যাচার করে জেনে নেয় জানার সূত্রটা।

হ্যারি কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো ডাম্বলডোর হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলেন। নিশ্ৰুপ হয়ে সবুজ তরল পদার্থের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন কি করবেন।

আমার কোনো সন্দেহ নেই, ডাম্বলডোর নীরবতা ভাঙলেন। এই তরল পদার্থটা আমাকে হরক্রাকস নিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করছে, কি কারণে এখানে এসেছি সেটাও ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছে অনবরত। শোনো হ্যারি এখন তোমার কাজ হচ্ছে আমি যাতে নির্বিঘ্নে পোশানটা পান করতে পারি তুমি সেটা দেখবে, দরকার হলে পোশানটা জোর করে আমার গলায় ঢেলে দেবে, ঢেলে দেবার সময় আমার গলায় অসহ্য ব্যথা হতে পারে।

ভোল্ডেমর্ট আর হ্যারি দুজনেই সেই তরল পদার্থের দিকে তাকালেন। দুজনের মুখ সেই সবুজ আলো যেন ঝলসে দিলো। হ্যারি গম্ভীর, ওর মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোলো না। ভাবলো এই কাজের জন্যই কি ডাম্বলডোর ওকে এই দুর্গম জায়গায় নিয়ে এসেছেন!

ডাম্বলডোর অন্য কিছু ভাবছিলেন, একটু থেমে বললেন, তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছো হ্যারি, আমি যা বলবো তুমি তাই করবে, মনে আছে?

হ্যারি, ডাম্বলডোরের দুই নীল চোখের দিকে তাকালো। দেখলো নীল চোখ দুটো বেসিনের আলো পড়ে সবুজ হয়ে জ্বল জ্বল করছে।

কিন্তু যদি?

তুমি তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমি যা বলবো তুমি তাই করবে? হ্যাঁ, কিন্তু। তোমায় তো আমি বলেছিলাম বিপদের সম্ভাবনা থাকতে পারে, তাই না? হ্যাঁ, বলেছিলেন, কিন্তু, হ্যারি বললো।

ওয়েল, রোসের হাতাটা গুটিয়ে কাঁচের পাত্রটা তুলতে তুলতে ডাম্বলডোর বললেন। তাহলে আমি তোমায় যা বলেছি তাই করো।

আপনার বদলে আমি কি পোশানটা খেতে পারি? হ্যারি বাধা দেবার শেষ চেষ্টা করলো।

কারণ আমি এখন বৃদ্ধ, যথেষ্ট বুদ্ধি আছে এবং এখন আমার জীবনের মূল্য কম, ডালডোর বললেন। আমি এই শেষবার বলছি হ্যারি তুমি তোমার যথাসাধ্য শক্তি দিয়ে আমাকে পোশানটা পান করতে সাহায্য করবে, কারণ তুমি কথা দিয়েছে।

আমি পারবো না।

যা বলছি তাই করো।

কিন্তু।

তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ হ্যারি।

কিন্তু।

হ্যারিকে আর কিছু বলার বা বাধা দেবার সুযোগ না দিয়ে ডাম্বলডোর কাঁচের পাত্রটা পোশানে ডোবালেন। ক্ষণিকের জন্য হ্যারির মনে হয়েছিলো ডাম্বলডোর হয়তো কাঁচের পাত্রটা পোশানে ডুবোতে পারবেন না। কিন্তু হ্যারি দেখলো বাধাবিঘ্ন অপসারিত করে ডাম্বলডোর সেই কাঁচের পাত্রে পোশান ভর্তি করে, মুখের সামনে ধরলেন।

তোমার স্বাস্থ্যের জন্য… উল্লাস হ্যারি। একটু একটু করে ডাম্বলডোর কাঁচের পাত্রের পোশান খেয়ে ফেললেন।

হ্যারি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কাঁচের পাত্রের কানাটা শক্ত করে ধরে রইলো। হ্যারি কাঁচের পাত্র শক্ত করে চেপে ধরে পোশানটা ডাম্বলডোরের মুখের মধ্যে ঢেলেছিলো।

হ্যারি শূন্য পাত্রটার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রফেসর আপনার শরীর ভালো তো? এখন কেমন মনে হচ্ছে?

ডাম্বলডোর দুচোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন। হ্যারি বুঝতে পারলো না ডাম্বলডোরের শরীরে কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা-ব্যথা বা কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না।

ডাম্বলডোর পাত্রটা আবার বেসিনে ডুবিয়ে পোশান ভর্তি করলেন। চোখ তখন বন্ধ। হ্যারির সাহায্যে সেটাও খেয়ে ফেললেন।

নিঃশব্দে ডাম্বলডোর কাঁচের পাত্র ভর্তি পোশান তিন বার খেয়ে চতুর্থবার খাবার আগেই কাঁপতে কাঁপতে বেসিনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। চোখ তখনো তার বন্ধ, জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

হ্যারি কাঁপা কাঁপা গলায় ডাম্বলডোরকে ছুঁয়ে বললো, প্রফেসর, প্রফেসর ডাম্বলডোর, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

ডাম্বলডোর ওর কথার কোনো জবাব দিলেন না। গভীর ঘুমে যেন তিনি আচ্ছন্ন। মনে হয় কোনো বীভৎস স্বপ্ন দেখে চমকে চমকে উঠছেন। ওর হাতে তখনো কাঁচের পাত্রটা শক্ত করে ধরা ছিলো। পাত্রটা কাঁপতে লাগলো। পাত্রের মধ্যে যেটুকু পোশান ছিলো প্রায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। হ্যারি পাত্রটা ধরে রইলো।

হ্যারি আবার বললো, প্রফেসর আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যারির কথাগুলো গভীর গিরিগুহাতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।

ডাম্বলডোর হাঁফাতে হাঁফাতে কিছু বললেন, ব্যারির মনে হলো গলাটা তার নয়। আজ পর্যন্ত কখনো ডাম্বলডোরকে ভীত গলায় কথা বলতে শোনেনি।

আমি চাই না, আমাকে বাধ্য করবে না।

হ্যারি তার চির পরিচিত ডাম্বলডোরের শুভ্র মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালো, হালকা উজ্জ্বল চোখ, নাক থেকে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি চশমা ঝুলে পড়েছে। হ্যারি কি করবে বুঝতে পারে না। এ যেনো নতুন এক ডাম্বলডোর।

আমি চাই না, আমি আর খেতে পারছি না, ডাম্বলডোর গোঁ গোঁ করে বললেন।

না প্রফেসর, আপনাকে সবটুকু খেতে হবে, হ্যারি বললো। আপনি তো আমাকে বলেছিলেন পোশানটা নিঃশেষ করতে হবে, মনে নেই?

হ্যারি এতো বেশি ঘাবড়ে গেছে সে কি বলছে, কি করছে জানে না। হ্যারি জোর করে পাত্রের বাকি পোশানটা ডাম্বলডোরের গলায় ঢেলে দিলো।

হ্যারি শূন্য পাত্রটা বেসিনে ডোবাতে গেলে ডাম্বলডোর গুঙিয়ে গুঙিয়ে বললেন,, না, আমি পারছি না, আমাকে আর দিও না, আমাকে ছেড়ে দাও।

ঠিক আছে, প্রফেসর, হ্যারি বললো। ওর হাতে তখন পাত্রটা কাঁপছে। আমি তো এখানে রয়েছি প্রফেসর, আমি তো আপনার পাশে রয়েছি।

বন্ধ করো, আর দিও না, ডাম্বলডোর কাতরাতে কাতরাতে বললেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই শেষবার, মিথ্যে বললো হ্যারি। হ্যারি পাত্র ভর্তি পোশান ডাম্বলডোরের গলায় ঢেলে দিলো।

ডাম্বলডোর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করলেন। কালো হ্রদের জল বেয়ে তার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করে আবার ফিরে এলো ক্ষুদ্র দ্বীপে।

না, না, না, আমি আর খেতে পারছি না, আমাকে আর এক বিন্দুও দিও না। আমাকে জোর করো না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, সব ঠিক আছে প্রফেসর, হ্যারি ভীষণ জোরে, গলা ফাটিয়ে বললো। ওর হাত এতো জোরে কাঁপছে যে পাঁচের শেষ ছনম্বর পোশান ভর্তি পাত্রটা ধরে রাখতে পারছে না। বেসিনের মধ্যের পোশান তখন অর্ধেকও শেষ হয়নি। আপনার কিছু হবে না প্রফেসর, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন, সত্যি কথা বলছি, এটা কোনো বিষয় নয়, বাকি পোশান খেয়ে ফেলুন।

ডাম্বলডোর যেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোধ করার জন্য ওষুধ খাচ্ছেন এমন এক ভাব করে বাকিটা খেয়ে ফেললেন।

হ্যারির পা ভীষণ কাঁপছে, পাত্রটা বেসিনে ডোবাতে গিয়ে হাঁটু বেকে গেল। থর থর করে হ্যারিও কাঁপতে লাগলো।

আমার দোষ, সম্পূর্ণ আমার দোষ হ্যারি, আর কখনো তোমাকে কিছু করতে বলবো না, ডাম্বলডোর শিশুর মতো ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন। বন্ধ করো হ্যারি, বন্ধ করো, আর আমাকে দিও না।

হ্যারি আটবার শেষ করে নবার পাত্রে পোশান ভর্তি করলো। ডাম্বলডোর তখন পড়ে গিয়ে সজোরো মাটিতে ঘুষি মারতে মারতে বললেন, দোহাই হ্যারি আর খেতে পারছি না, আর দিও না। ওটা ফেলে দাও, আর আমার মুখের কাছে এনো না। এবার যদি দাও…।

খেয়ে ফেলুন প্রফেসর, খেয়ে ফেলুন।

ছোট একটা বাচ্চা ছেলে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যেমন জল খায় তেমনি ভাবে নবার পোশান ভর্তি পাত্রটা গিলে ফেললেন ডাম্বলডোর। খাবার পর এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন যেন শরীরের ভেতর সবকিছু আগুনে জ্বলছে।

এটা দশ, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে প্রফেসর, খেয়ে নিন।

হ্যারি, ডাম্বলডোরের কাধ ধরে দাঁড়িয়ে পাত্রের পোশানটা তার গলায় ঢেলে দিলো।

প্রফেসর আপনি তো বলেছেন এটা বিষ নয়, তাহলে খাবেন না কেন?

আপনি তো এখনো জীবিত, আপনি তো মৃত নন। ঘুমোবেন না উঠে বসুন। তারপর হ্যারি সশব্দে বলে উঠলো, রেনারভেট, স্যার, প্লিজ।

ডাম্বলডোর চোখ পিট পিট করলেন : হ্যারির বুক দুরু দুরু করতে লাগলো। স্যার, আপনি?

আমাকে জল দাও, ডাম্বলডোর কোঁকাতে কোকাতে বললেন, হ্যারি, হা হা, আমাকে জল দাও।

হ্যারি অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। মাটি থেকে কাঁচের পাত্রটা তুলে নিয়ে বেসিনে রাখতে যাবে এমন সময় দেখতে পেলো একটা সোনার লকেট বেসিনের তলায় পড়ে রয়েছে।

এগুয়ামেন্টি, হ্যারি উচ্চস্বরে বলে উঠলো। এক সেকেন্ড দেরি না করে বেসিন থেকে সোনার লকেটটা তুলে নিলো।

একটা শূন্য কাঁচের গ্লাসে কানায় কানায় জল পূর্ণ হয়ে উঠলো। হ্যারি জলভর্তি গেলাসটা দুহাতে ধরে ডাম্বলডোরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ডালডোর মুখটা তুললেন, কাঁচের গ্লাসটা ঠোঁটে ঠেকাতেই গেলাসের জল উবে গেল। ডাম্বলডোর তৃষ্ণায় ছটফট করতে লাগলেন।

ডাম্বলডোর শূন্য গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যারি আমাকে একটু জল। দাও।

হ্যারি গ্লাস ভর্তি জল আনার জন্য দণ্ডটা তুলে বললো, এগুয়ামেন্টি। আবার জলেভর্তি হয়ে গেল গ্লাস। হ্যারি এক সেকেন্ড দেরি না করে জলটা ডাম্বলডোরের মুখের কাছে ধরতেই গ্লাসের জল উবে গেল।

স্যার, আমি চেষ্টা করছি, আমি চেষ্টা করছি, হ্যারি বেপরোয়া হয়ে বললো। তবে ডাম্বলডোর ওর কথা শুনতে পেলেন কি না জানে না। হ্যারি মরিয়া হয়ে জাদুদণ্ড তুলে বললো, এগুয়ামেন্টি–এগুয়ামেন্টি!

কাঁচের পাত্র জল ভর্তি হলো, আবার সেটা উধাও হয়ে গেলো।

হ্যারি ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকালো। ডাম্বলডোর জলের জন্য তখনো ছটফট করছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন, মনে হয় দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবে যেকোনও মুহূর্তে। হ্যারি এধার ওধার তাকালো। সামনেই লেকের কালো জল, সেই জল ডাম্বলডোর ওকে ছুঁতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু ডাম্বলডোরকে বাঁচাতে গেলে কোনো এক উপায় অবলম্বন করে লেক থেকেই আনতে হবে। কিন্তু কেমন করে?

একটি মাত্র পথ, ও কালো জলে টইটুম্বুর বিশাল হ্রদের দিকে তাকালো। ভোল্টেমর্টের পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে হবে।

ও এক দৌড়ে জলের ধারে গিয়ে পাত্রটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো লেকের বরফশীতল জলে। কোথা থেকে ল্যাকপ্যাকে সাদা হাত ওর কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরে ওকে টেনে নিয়ে চললো পাহাড়ের দিকে। হ্যারি জলের দিকে তাকালো, জল আর আয়নার মতো চক চক করছে না। অশান্ত চরকির মতো ঘুরছে। হ্যারি দেখলো, অনেক অনেক সাদা মাথা, সাদা হাত হ্রদের জল থেকে উঠে আসছে, পুরুষ, মহিলা আর শিশুর দল। ওদের দৃষ্টিহীন চোখগুলো ঘুরছে। ওরা সকলেই মৃত; কিন্তু হাত তুলে নাচানাচি করছে।

হ্যারি চিৎকার করে বললো, পেট্ৰিফিকাস টোটালাস! পেট্ৰিফিকাস টোটালাস! জাদুদণ্ডটা বাড়িয়ে দিলো ইনফেরির দিকে (এক রকম পিশাচ মৃতদেহ)। ওরা সবাই অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো হ্রদের জলে ভাসছে, ওদের হাত খোলা।

সঙ্গে সঙ্গে যে পিশাচ মৃতদেহ (ইনফেরি) ওর কব্জিটা শক্ত করে ধরেছিলো সে ছেড়েদিলো এবং জলের ওপর ছিটকে পড়লো। ইনফেরিটা জলের ওপর দাঁড়াতে চেষ্টা করলো, হ্যারি দেখলো আরো অনেক ইনফেরি ছোট পাহাড়ি দ্বীপে জল থেকে উঠছে। ওদের বরফ শীতল কুয়াশার মতো চোখগুলো ওর দিকে নিবন্ধ, ওকে তাড়া করেছে।

হ্যারি আবার বললো, পেট্ৰিফিকাস টোটালাস! হাতের দণ্ডটা ছড়ির মতো ঘোরাতে লাগলো। ওদের মধ্যে সাত-আটজন ইনফেরি পড়ে গেলো; কিন্তু আরো অনেক ইনফেরি ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। হ্যারি তার স্বরে বললো ইমপেডিমেন্ট! ইনকারকেরাস! ওদের মধ্যে কয়েকজন হোঁচট খেলো, দুএকজনকে শূন্য থেকে মোটা দড়ি এসে বেধে ফেললো, বাকি যারা পাথর বেয়ে দ্বীপে উঠছিলো তারা যে সমস্ত ইনফেরি পড়ে গিয়েছিলো তাদের ওপর পড়লো। কিন্তু তখনো তারা হাত-পা ছুঁড়ছে। হ্যারিও তার জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে চললো। তারপর বাধ্য হয়ে চিৎকার করে বললো, সেকটামসেমপ্রা! সেকটামসেমপ্রা!

ইনফেরিরা যেসব ছেঁড়া খোড়া জামা পরেছিলো, বরফের মতো তাদের চামড়ায় গ্যাস বেরোতে লাগলো, কিন্তু তাদের শরীরে কণামাত্র রক্ত নেই, তাই কোনো রক্ত বেরোলো না। ওরা তাদের কঙ্কালসার সাদা হাত হ্যারির দিকে বাড়িয়ে এগোতে লাগলো। হ্যারি ওদের স্পর্শ এড়াতে পিছু হটতে লাগলো। ওদের অনেকেই মাটিতে পড়ে গেছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে, কারও কারও সর্বাঙ্গ দড়ি দিয়ে বাধা। হ্যারি খুব বেশি পিছু হটতে পারলো না, কেউ যেন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, হাতে তার মাংস নেই, মৃত্যুর মতো শীতল। একজন ওকে তুলে ধরে জলের ধারে চললো, আর একটু হলেই জলে ওকে ফেলে দেবে। হ্যারি বুঝতে পারলো ইনফেরিদের (ভোল্টেমর্টের পিশাচ সৈন্যদল) হাত থকে নিস্তার নেই, ঠান্ডা জলে ওকে ডুবিয়ে দেবে। তারপর মৃত্যু, মৃত্যুর পর ভোল্টেমর্টের খণ্ডিত আত্মার অন্যতম পাহারাদার হতে হবে।

তারপর, তারপর অন্ধকার থেকে আগুন জ্বলে উঠলো, আগুনের রং গাঢ় লাল আর সোনালী। সেই আগুন ছোট দ্বীপটাকে গোল করে ঘিরে ফেললো। যে ইনফেরিটা হ্যারিকে ধরে কালো শীতল জলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল চতুর্দিকে আগুন দেখে সে থমকে দাঁড়ালো, ভয়ে আবার পিছনে ফিরে এলো, বহ্নিশিখার মধ্য দিয়ে যেতে পারলো না। হ্যারিকে ওরা মাটিতে ফেলে দিলো। কাছেই ছিলো শ্যাওলা ধরা পাথর, হ্যারি পা পিছলে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে দণ্ডটা তুলে চতুর্দিক দেখতে লাগলো।

ডাম্বলডোর এখন অনেকটা সুস্থ, ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন, মুখটা তার ফ্যাকাশে অনেকটা আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইনফেরিদের মতো। কিন্তু তাদের চেয়ে দীর্ঘ তার দেহ। বহ্নিশিখার মতো তার চোখে আগুন নৃত্য করছে, হাতে মশালের মতো দণ্ড ধরে রয়েছেন। সেই দণ্ডের মুখ থেকে অগ্নিশিখা স্রোতের মতো বেরিয়ে। আছে, অনেকটা ল্যাফসোর মতো (বন্য জন্তুদের ধরার জন্য দড়ির ফাঁস)। সেই আগুনের ফাসগুলো ওদের জড়িয়ে ধরতে শুরু করলো।

ইনফেরিরা নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে লাগলো। আর ওদের ঘিরে ধরা বহ্নিশিখা থেকে পালাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো।

ডাম্বলডোর বেসিনের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে লকেটটা নিয়ে তার আলখেল্লার পকেটে রেখে দিলেন। তারপর কোনো কথা না বলে হ্যারিকে কাছে চলে আসার ইঙ্গিত করলেন। ইনফেরিদের তখন গোলাকৃতি আগুন ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলেছে। ডাম্বলডোর হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে কখন যে নৌকোতে উঠে পড়েছেন, ভয়বিহ্বল বিক্ষিপ্তচিত্ত ইনফেরিরা জানতে পারলো না। অগ্নিশিখা নৌকোটাকে ঘিরে ঢেকে রাখলো। হতভম্ব ইনফেরিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো কালো জলের হ্রদে।

হ্যারি আসন্ন বিপদগুলো থেকে মুক্ত হয়ে তখনো বাশপাতার মতো থর থর করে কেঁপে চলেছে। ও ভেবেছিলো ডাম্বলডোর হয়তোবা নৌকোতে চাপতে পারবেন না। ডাম্বলডোর ব্যস্ত হয়ে রইলেন, ওদের ঘিরে ধরা প্রতিরোধ আগুন যেন নৌকোকে হ্রদের ওপারে ধীরে সুস্থে নিয়ে যায়। হ্যারি ডাম্বলডোরকে ধরে বসে রইলো। কালো জলের ওপর দিয়ে নৌকো তির তির করে ভেসে চললো। পেছনে পড়ে রইলো পাহাড়ি ছোট দ্বীপ। আগুন তখনো ওদের নৌকোকে ঘিরে রেখেছে। ইনফেরিরা নৌকোর চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে অগ্নিবলয়ের জন্য কাছে আসতে সাহস করছে না।

স্যার আমি আগুন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো।

খুবই স্বাভাবিক, ডাম্বলডোর ক্ষীণ স্বরে বললেন।

হ্যারি ভাম্বলডোরের গলার স্বর শুনে আরো ভয় পেয়ে গেলো। ডাম্বলডোরের এত দুর্বল কণ্ঠস্বর হ্যারি আগে কখনো শোনেনি।

ধীরে ধীরে নৌকো তীরে পৌঁছলো। হ্যারি ডাম্বলডোরকে হাত ধরে নৌকো থেকে নামালো। ডাম্বলডোর নৌকো থেকে নেমে হাতের দণ্ডটা মাটিতে রাখতেই ওদের ঘিরে রাখা আগুন নিভে গেলো। কিন্তু ইনফেরিরা আর সাহস করে জল থেকে তীরে এলো না। ওরাও আগুনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। যে নৌকোটায় চেপে ওরা পারাপার করেছেন সেটাও সে করে হ্রদের জলে ডুবে গেল। লোহার শিকলটাও টিং টিং শব্দ করতে করতে টলটলিয়ে হ্রদের জলে নৌকোর মতো ডুবে গেল।

ডাম্বলডোর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে গিরিগুহার পাথরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলেন।

ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, হ্যারি আমি খুব দুর্বল, খুব কষ্ট হচ্ছে।

কিছু চিন্তা করবেন না স্যার, হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বললো। কিন্তু কথাটা বললেও ডাম্বলডোরের শরীরের অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে খুবই ভয় পেয়ে গেল। আমার কাঁধে মাথা রাখুন, আমরা ঠিক ফিরে যেতে পারবো।

ডাম্বলডোরের যে হাতটায় পোড়া দাগ নেই সেটা নিজের কাঁধে রেখে, ওর প্রিয় হেডমাস্টারকে একরকম কাঁধের ওপর চাপিয়ে চললো।

যেতে যেতে ডাম্বলডোর আরো ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমাদের নিরাপত্তা খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করেছে, কি বলো হ্যারি। আমি একা কাজটা করতে পারতাম না, তুমি আমাকে সবদিক থেকে খুবই সাহায্য করেছে।

এখন বেশি কথা বলবেন না স্যার, হ্যরি বললো।

ডাম্বলডোর হাঁটতে পারছেন না, শরীরের সব শক্তি যেন নিঃশেষিত হয়েছে, কোনো রকমে পা টেনে টেনে হ্যারির কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। স্যার, দুর্বল হবেন না, আমরা শিগগির হোগার্টসে ফিরে যাবো।

আর্চওয়েটা আবার বন্ধ হয়ে থাকতে পারে হ্যারি, আমার ছুরিটা কোথায়। দরকার নেই স্যার, আমি রক্ত দিয়ে খুলে দেবো। শুধু বলুন, কোথায়। এখানে…

হ্যারি পাথরের ওপর ওর হাতটা রাখলো। ওর হাতের রক্তের স্বাদ পেয়ে। আর্চওয়ে সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো। ওরা গুহা অতিক্রম করে আবার সেই বরফশীতল সমুদ্রে যেখানে উঁচু পাহাড়ের চিড় অংশ জলে ভরে দিচ্ছে, সেখানে দাঁড়ালো।

হ্যারি বার বার বলে যেতে লাগলো। ভাববেন না স্যার আপনি শিগগিরই সেরে উঠবেন, কিন্তু মনের মধ্যে দারুণ এক আতঙ্ক জমাট বেধে রইলো ডাম্বলডোরকে নীরব দেখে।

কোনো চিন্তা করবেন না স্যার আমি অ্যাপারেট করতে পারি, আমি আপনাকেও নিয়ে যেতে পারবো। আমি একটুও উদ্বিগ্ন নই হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন। হ্যারির মনে হলো ডাম্বলডোরের গলার স্বর একটু বলিষ্ঠ যদিও জল ছিল বরফ শীতল। আমি তো তোমার সঙ্গে রয়েছি হ্যারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *