২৪. সেকটামসেম্প্রা

২৪. সেকটামসেম্প্রা

হেডমাস্টার ডাম্বলডোরের অফিস ঘরে সারারাত ভোল্টেমর্টের ছটি হরক্রাকস প্রসঙ্গে আলোচনা করার পর খুব ক্লান্ত হলেও প্রসন্ন চিত্তে হ্যারি, রন আর হারমিওনকে পরের দিন সকালে চার্মস লেসন ক্লাসে (মাফলিয়াটো স্পেল সম্বন্ধে) গত রাতের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত বললো। স্লাগহর্নের কাছ থেকে মেমরি সংগ্রহ করার খবরটি শুনে ওরা দুজন দারুণ খুশি, তারপর ভোল্টেমর্টের হরক্রাকসের কথা আর ডাম্বলডোরের হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে আর একটি খুঁজতে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে খুবই ভয় পেয়ে গেল।

বাঃ, হ্যারির সব কথা শেষ হলে রন বললো। রন অনাবশ্যকভাবে হাতের জাদুদণ্ডটা ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাক করে দোলাতে লাগলো। কেন দোলাচ্ছে ও জানে না। ও হ্যারির দিকে না তাকিয়ে বললো, ওয়াও, সত্যিই তুমি ডাম্বলডোরের সঙ্গে যাচেছা, …খুঁজে বের করে ধ্বংস করার চেষ্টা চালাবে, ওয়াও, …দারুণ ব্যাপার।

রন, তুমি সিলিংয়ে স্নো জমাচ্ছো কেন? কথাটা বলে হারমিওন রনের কব্জি চেপে ধরে ম্যাজিক ওয়ান্ডটা ঘুরিয়ে দিলো। ততক্ষণে গাদাগাদা সাদা গো ল্যাভেন্ডার ব্রাউনের মাথায় গায়ে ছড়িয়ে পড়লো, হ্যারির চোখে পড়তেই লাল চোখে হারমিওনের দিকে তাকালো, হারমিওন তখনি রনের হাতটা ছেড়ে দিলো।

ওহো, রন ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে ল্যাভেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু মনে করো না, সত্যি দুঃখিত, তোমার মাথায় মনে হচ্ছে দারুণ খুসকি। কথাটা বলে রন, হারমিওনের কাঁধের ওপর জমে থাকা স্লো সরিয়ে দেয়ার ভান করতে লাগলো। ল্যাভেন্ডার চোখে তখন অশ্রু। রন জানে দোষ করে ফেলেছে, তাই ল্যাভেন্ডারের কান্না দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

আমি আর হারমিওন যখন ডরমেটরি থেকে আসছিলাম তখনো আমাদের দেখতে পেয়েছিলো, আমরা তখন দুজনে দুধারে চলে গেলাম। তোমাকে নিশ্চয়ই সে দেখেনি, তাই ল্যাভেন্ডার মনে করেছে আমি আর হারমিওন, রন হ্যারিকে বললো।

অ্যা, তাই নাকি, হ্যারি বললো। যাকগে, ওসব কথা বাদ দাও, যা হয়েগেছে তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

মোটেই না, রন বললো। ওর ওই ফাঁচ ফ্যাচ করে কাঁদা আমার বিশ্রি লাগে, তাছাড়া আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।

ভীতুর ডিম কোথাকার, হারমিওন রনকে বললো, তবে হাসতে হাসতে। যা বলেছো, প্রেম করার পক্ষে রাতটা সুবিধের ছিলো না; হ্যারি জানো তো জিনি আর ডিনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

হ্যারি, হারমিওনের চোখের দিকে তাকালো। মনে হলো ও অনেক কিছু খবর রাখে। খবরটা পেয়ে ওর মনের ভেতরটা আনন্দে নৃত্য করে উঠলো। যেন ব্যাপারটা কিছুই নয় এমন একটা আকর্ষণ শূন্য গলায় বললো, কেমন করে?

ধ্যাৎ একেবারে ছেলে মানুষী ব্যাপার, জিনি বলেছে, ডিন নাকি সব সময়ে ওকে পোট্রট হোলের ভেতর দিয়ে যেতে সাহায্য করতে চায়, ভাবটা এমন যে জিনি একেবারেই ছেলেমানুষ, নিজে উঠতে পারে না, কিন্তু এটা সত্য যে, অনেক কালের পুরনো গর্তটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে।

হ্যারি ক্লাসরুমে এক ধারে বসে থাকা ডিনের দিকে তাকালো। মুখটা দেখে হ্যারির মনে হলো খুবই ভারাক্রান্ত।

হারমিওন, হ্যারিকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো, তুমি উভয় সঙ্কটে পড়েছে, তাই না?

কি বলছো? হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বললো।

কিডিচ টিম, হারমিওন বললো। যদি খেলার মাঠে ওরা দুজনে কেউ কারও সঙ্গে কথা না বলে।

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছো, হ্যারি বললো।

ফ্লিটউইক, রনের গলায় সতর্ক সংকেতের সুর। ছোটোখাটো চার্মসের শিক্ষক ফ্লিটউইককে মাথা দোলাতে দোলাতে হেলে দুলে আসতে দেখলো ওদের দিকে। হারমিওন তখন সবেমাত্র ওয়াইনের পাত্রে ভিনিগার ঢেলেছে। ওর কাঁচের ফ্লাক্সটা টকটকে লাল তরল পদার্থে ভর্তি। ওদিকে হ্যারি আর রনের পদার্থ তখনো ঝাপসা ঝাপসা বাদামি রঙের।

ছেলেমেয়েরা আর দেরি করবে না, অনেক সময় নিয়ে ফেলেছে, ফ্লিটউইক একটু ঝাঁঝিয়ে বললেন। কথা কম, কাজ বেশি করো, দেখি দেখি তোমরা সব কে কি রকম বানালে। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ফ্লিটউইকের কথা শুনে তটস্থ হয়ে ওদের দণ্ডটা তুলে ফ্লাক্সের মুখে রাখলো। হ্যারির ভিনিগার এখন আর তরল নেই, বরফ হয়ে গেছে। রনের ফ্লাক্স ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

হ্যাঁ, হোমওয়ার্ক, প্রফেসর ফ্লিটউইক টেবিলের তলা থেকে মাথা তুলে কাঁচের টুকরোগুলো তার টুপির ওপর থেকে ঝাড়ুতে ঝাড়ুতে বললেন–প্র্যাকটিস।

চার্মস ক্লাসের পর কোনো ক্লাস নেই, একটা পিরিয়ড ফাঁকা। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে কমনরুমের দিকে চললল। ল্যাভেন্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়ার জন্য রনের মন হালকা ও প্রশান্তি লাগছে এবং হারমিওনও এতে খুশি। ওকে হাসতে দেখে একজন বললো, এতো হাসির কি আছে? হারমিওন বললো, খুব সুন্দর দিন, তাই। ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি হ্যারির মাথায় তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে।

ও রনের বোন,..
ডিনকে কিন্তু ও ধোকা দিয়েছে।
এখনো ও রনের বোন
আমি ওর সবচেয়ে প্রিয় সখা!
 হ্যাঁ সেই সম্পর্ক গুবলেট করবে
যদি আমি ওর সঙ্গে প্রথমে কথা বলি
ও তোমাকে আঘাত করতে পারে
আমি যদি পরোয়া না করি তো কি করতে পারে?
ও যে তোমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু!

হ্যারি খেয়ালই করেনি কখন সে পোট্রট হোলের কাছে পৌঁছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল কমনরুমে এসেছে। ভাসা ভাসাভাবে দেখলো সপ্তম ক্লাসের কয়েকটা ছেলে ঘরের এক কোনায় জটলা করছে, হঠাৎ ওর ধ্যান ভগ্ন হলো হারমিওনের উচ্চকণ্ঠের ডাক শুনে, কেটি! আরে তুমি এসেছো! তুমি ভালো আছো তো?

হ্যারি স্বচ্ছদৃষ্টিতে তাকালো। হ্যাঁ, কেটি বেল দাঁড়িয়ে রয়েছে অদূরে। শরীর স্বাস্থ্য ফিরেছে, ওর সব বন্ধুরা খুশিতে উপচে পড়ে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সত্যি খুব ভাল আছি, কেটিবেল হাসতে হাসতে বললো। সোমবার সেন্ট মাংগোস আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে দুদিনের জন্য বাড়িতে কাটিয়ে এলাম, বাবা আমাকে হাসপাতাল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। আজকে সকালে স্কুলে এসেছি। লীনে এইমাত্র আমাকে ম্যাকলোগেন ও শেষ ম্যাচটার কথা বলেছিলো।

ভাল, সব তাহলে জেনেছো? হ্যারি বললো। যাকগে তুমি ফিরে এসেছে, রনও ঠিক আছে। হা শোনো তোমরা টিমে ফিরে আসার ফলে র‍্যাভেন কু-কে হারাবার দারুণ সুযোগ হয়েছে। তার মানে আমরা এখনো ঝাপের জন্য প্রতিযোগিতায় থাকবো।

এখন ওর মাথা থেকে জিনি চলে গেছে। কেটির কাছ থেকে এখনই কিছু খবর নিতে হবে। কেটির বন্ধু-বান্ধবরা ব্যাগ, বই, খাতাপত্র নিয়ে চলে এসেছে। হ্যারি বললো, ও সেই নেকলেস, মনে করে বলতে পারো কে তোমাকে ওটা দিয়েছিলো?

না, কিছুতেই মনে করতে পারছিনে, সকলেই আমাকে এক প্রশ্ন করছে। হ্যাঁ এইটুকু মনে আছে থ্রি মস্টিকের লেডিস বাথরুমে যাচ্ছিলাম।

 ঠিক মনে আছে বাথরুমে যাচ্ছিলে, হারমিওন বললো।

হ্যাঁ মনে আছে, কেন মনে থাকবে না, আমি দরজা ঠেলে খুলে বাথরুমে গেলাম, তারপর… কেটি বললো। তাহলে মনে হয় যে আমাকে কাবু করেছিলো, খুব সম্ভব সে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলো। তারপর কিছু মনে নেই। দুসপ্তাহ পরে আমার জ্ঞান ফেরে, তখন আমি সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে শুয়ে রয়েছি। যাকগে এখন আমি ম্যাকগোনাগলের ক্লাসে চলি। আজ থেকেই মনে হয় আমাকে হোমওয়ার্ক দেবেন।

কথাগুলো কেটি এক নিঃশ্বাসে বলে বইখাতা ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কমনরুম থেকে চলে গেল।

না, কোনো পুরুষের কাজ নয়। বাথরুমে ঢোকার পথে মেয়ে ছাড়া কে দাঁড়াবে, হারমিওন বললো। লেডিজ বাথরুম!

এমনও হতে পরে তার চেহারাটা মেয়েদের বা মহিলাদের মতে, হ্যারি বললো। মনে থাকে যেন হোগার্টসে কলড্রন ভর্তি পলি জুস পোশানের কোনো অভাব নেই। আমরা তো জানি ওর থেকে বেশ খানিকটা চুরি গেছে।

কথা বললেও ও মানস চোখে দেখলো। ক্রাবে আর গোয়েলে মেয়েতে রূপান্ত রিত হয়ে ঘোড়াদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে।

মনে হচ্ছে আর এক ডোজ ফেলিক্স আমাকে খেতে হবে, হ্যারি বললো। রুম অফ রিকোয়ারমেন্টে যাওয়া দরকার মনে হয়।

তার মানে পোশানটা নষ্ট করবে, হারমিওন স্পেলম্যান সিলেবেরি বইটা ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রেখে বললো। হ্যারি ভাগ্য ভালো হলে তুমি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারো। স্লাগহর্নের ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, তার কাছ থেকে তোমার জানার সুযোগ ছিল, শুধু তোমাকে সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়েছে মাত্র।

শোনো বাকি পোশানটা অযথা নষ্ট করবে না! ডাম্বলডোর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে হরক্রাকসের খোজে বেরোবার সময় তোমার ওটা কাজে লাগবে, কথাগুলো হারমিওন ফিস ফিস করে বললো।

আমরা কি আর একটু বেশি বানাতে পারি না? রন হ্যারিকে বললো। বলার সময় একবারও হারমিওনের দিকে তাকালো না। আমাদের কিছু স্টক করে রাখা দরকার, বইটা আর একবার পড়ে নাও।

হ্যারি, রনের কথাটা শুনে ব্যাগ থেকে অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং-এর কপিটা বার করে ফেলিক্স ফেলিসিস পড়তে লাগলো।

রিমে, দারুণ গোলমেলে, ইনগ্রেডিয়েন্টসের লিস্ট দেখতে দেখতে বললো। ছমাস লাগবে ভিজিয়ে রাখার পর।

সব একই রকম, রন বললো।

হ্যারি বইটা রেখে দেবার সময় চোখে পড়লো বইটার শেষের দিকে একটা পৃষ্ঠার কোনা সামান্য দোমড়ানো। পৃষ্ঠাটায় ঝুঁকে পড়ে দেখলো, শক্রদের জন্য, ক্যাপশন দিয়ে তার তলায় রয়েছে সেট্রামসে স্পেল, কয়েক সপ্তাহ আগে ওর স্পেলটা হঠাৎ চোখে পড়েছিলো, কিন্তু পড়া হয়ে উঠেনি। এখনো জানে না স্পেলটা কি, তার কারণ ও হারমিওনকে আর এ বিষয়ে কিছু জানাতে চায় না। মন দিয়ে পড়লেই হারমিওনের চোখে পড়বে এবং সে নানা প্রশ্ন করে নিরুৎসাহিত করবে। মাঝে একবার পড়তে গিয়েছিলো, তখন আবার ম্যাকলেগেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো বলে পড়তে পারেনি।

কেটি বেল মাংগোস থেকে ফেরার পর একটি মাত্র ছেলে খুশি হয়নি, সেটি ডিন থমাস! খুশি না হওয়ার কারণ, কেটি বেল এসে গেছে, তাহলে ও আর কিচি খেলায় চেজার হতে পারবে না। কথাটা হ্যারি যে ম্যাকলেগেনকে বলেনি যে তা নয়, বলেছিলো। ও শ্রাগ করে চলে গিয়েছিলো। ও চলে যাবার পর হ্যারি ডিন আর সিমাসকে ওর সম্বন্ধে বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুনেছিলো।

দিন পনের পরে, কিডিচ ম্যাচের প্র্যাকটিস দেখে ক্যাপ্টেন হ্যারি দারুণ খুশি। ম্যাকলেগেন বাদ পড়াতে ওর টিমের সকলেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, কেটি এসে গেছে আর ওদের ভাবনা নেই। সকলেই দ্বিগুণ উৎসাহে ফ্লাই করতে লাগলো। ডিন ওর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করায় জিনি একটুও ব্যথিত নয়।

হ্যারির মাথায় তখন জিনি না রন? ল্যাভেন্ডারের সাথে সম্পর্কের অবনতির পর রন হয়তো কিছু মনে করবে না হ্যারি যদি জিনির সাথে সম্পর্ক করে। কিন্তু ওর মনে পড়লো জিনিকে একদিন ডিনকে চুমু খেতে দেখে রন খুব্ধ হয়েছিলো। জিনি একটু একটু করে হ্যারির জীবনে ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। ওদিকে রন? রনের ছোট বোন জিনি, জিনির হাত ধরলে রন হয়তো অন্য কিছু ভাবতে পারে। তা হলেও হ্যারি জিনির সঙ্গে কথা বলা থামালো না। মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে কথা বার্তা হতো। প্র্যাকটিসের পর এক সাথে ফেরা, অবশ্য সকলের সামনে। জিনিকে ও বলতে গেলে কখনো একলাটি পায় না। হঠাৎ মনে হলো স্লাগহর্ন অনেকদিন পার্টি দেননি। স্লাগহর্নের পার্টিতে রন নিমন্ত্রিত হয় না। সেই সময়ে ও জিনিকে রনের চোখের আড়ালে পেতে পারবে। মাঝে মাঝে ও হারমিওনের সাহায্য নেওয়ার কথা মাথায় আসে; কিন্তু তক্ষুণি আবার মনে ভেসে ওঠে হারমিওনের কটু দৃষ্টি। সে জানে হারমিওন জিনির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা পছন্দ করে না। কথাবার্তায় পরিষ্কার সে তা বুঝতে পারে।

দেখতে দেখতে কিডিচ ফাইনালের দিন এসে পড়লো। গ্রিফিন্ডর আর ব্ল্যাভেন কু-র খেলা। রন সব সময় খেলাতে কি রকম কৌশল নিতে হবে সে সম্বন্ধে সুযোগ পেলেই হ্যারির সঙ্গে আলোচনা করে। অতএব রন বিহীন জিনিকে একা পাওয়া যায় না। স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের একই আলোচনা–র্যাভেন কু না গ্রিফিন্ডর চ্যাম্পিয়ন। হ্যারি জানে র‍্যাভেন কু-কে অন্তত ৩০০ পয়েন্টে না হারাতে পারলে চ্যাম্পিয়ন হবার আশা নেই। তার কম পেলে র‍্যাভেন কু-র পরে স্থান হবে। একশ পয়েন্টে হারলে হাফলপাফ হবে দ্বিতীয়, একশ পয়েন্টের কম পেলে গ্রিফিন্ডর হবে চতুর্থ। তার অধিনায়কত্বে গ্রিফিন্ডরের অধঃপতন সকলের মনে বহুদিন মনে থাকবে। কম করে হলেও দুশ বছর তো নিশ্চয়ই।

যা অতীতে হতো তাই হতে লাগলো। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের ছেলেমেয়েদের করিডরে মুখোমুখি হলেই ব্যাঙ্গ, টিটকিরি, গান, অপ্রিয় সব কথাবার্তা। কখনো উচ্চ গ্রামে কখনো বা চাপা গলায়। বাথরুমে যাবার সময়ও রেহাই নেই। খেলার জেতা হারায় জিনির সঙ্গে সম্পর্ক জড়িত বলে মনে হয় হ্যারির। হ্যারি ভাবে ওরা যদি তিনশ পয়েন্টের বেশি জেতে তাহলে সকলেই আনন্দে লাফালাফি করবে, অনেকটা ফেলিক্স ফেলিসিস খাবার পরের অবস্থা।

ওইসব কাণ্ডকারখানার মধ্যে হ্যারির মধ্যে একটা কথা বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় ম্যালফয় কেন রুম অফ রিকোয়ারমেন্টে এসেছিলো। মারাইডার্স মানচিত্রে বারবার ভাল করে দেখেও ম্যালফয়কে কোথাও পায়নি। কিন্তু ম্যালফয় বারবার সেই ঘরে ঢুকে সময় ব্যায় করছে কেন?

র‍্যাভেনক্লর বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে হ্যারি একাই কমনরুম থেকে ডিনার খেতে যাচ্ছিলো। রন গেছে বাথরুমে আর হারমিওন গেছে প্রফেসর ভিক্টরের কাছে অ্যারিথমেসির একটা প্রবন্ধে ভুল সংশোধন করতে। হ্যারি রোজকার মতো সেভেনথ ফ্লোরে গিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে মানচিত্র খুলে ম্যালফয়কে খুঁজেছে, ওকে দেখতে পেল না। তাহলেও ওর মনে হলো ম্যালফয় ওই ঘরের মধ্যে নিশ্চয়ই ঘোরাফেরা করছে। তারপর হঠাৎ সেই মানচিত্রে ম্যালফয়ের ছোট মূর্তি দেখতে পেলো। ও নিচের ফ্লোরের ছেলেদের বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ওর সঙ্গে ক্রাবে অথবা গোয়েলে নেই। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোনিং মার্টল।

হ্যারি মানচিত্রে ম্যালফয়কে দেখা বন্ধ করে দিয়ে করিডর থেকে মার্বেলের সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালো নিচে যাবার জন্য। তারপর যে বাথরুমে ম্যালফয়কে ঢুকতে দেখেছিলো সেই বাথরুমের বন্ধ করা দরজায় কানটা চেপে রইলো ভেতর থেকে কিছু শোনার আশায়। ভেতরের কোনো শব্দও শুনতে না পেয়ে ও খুব সন্তর্পণে দরজাটা খুললো। ড্র্যাকো ম্যালফয়কে দেখলো দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে, ঘরের মধ্যে যে সিংকটা রয়েছে তার দুধারে ওর হাত দুটো, সাদা চুলে ভর্তি মাথাটা সিংকের মুখে নামানো।

চুপ করো, মোনিং মার্টলের গাঁ গাঁ গলা একটা কিউবিকল থেকে ভেসে এলো। বলছি চুপ করো, বলো কি অসুবিধে, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না, ম্যালফয় বললো। হ্যারি দেখলো ম্যালফয় থরথর করে কাঁপছে। আমি করতে পারবো না…, আমি পারবো না, ওটাতে কোনো কাজ হবে না…, আর আমি যদি কাজটা খুব তাড়াতাড়ি না করি, তাহলে বলেছেন, আমাকে হত্যা করবেন…।

হ্যারি যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলো, ম্যালফয় কাঁদছে, সত্যি কাঁদছে, ওর ফ্যাকাশে ম্লান মুখের দুগাল বেয়ে চোখের জল অতি নোংরা বেসিনে টসটস করে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে বেশ বড় রকম এক ঝাঁকুনি দিয়ে মুখটা তুলে ভাঙ্গা চিড় খাওয়া আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো পেছনে হ্যারি ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ম্যালফয় হ্যারিকে দেখে ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো, পকেট থেকে জাদুদণ্ডটা তুললো। হ্যারি এক সেকেন্ড দেরি না করে নিজের দণ্ডটা বার করলো। ম্যালয়ের জাদুমন্ত্র হ্যারির কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়ে দেয়ালের বাতিতে লাগতেই সেটা কাঁপতে লাগলো। হ্যারি সামান্য পাশে সরে গিয়ে ভেবেচিন্তে লেভি করপাস ছুঁড়লো। তার আগেই ম্যালফয় সেই জিংকসটাকে ওর জাদুদণ্ড দিয়ে আটকে দিলো। নতুন একটা ছুঁড়তে যাবে

তখন মোনিং মার্টল বাধা দিয়ে খুব জোরে জোরে বললো, না, না থামাও। ওর কণ্ঠস্বর টালি লাগানো সমস্ত ঘরটায় প্রতিধ্বনিত হলো, থামো, থামো।

হ্যারির অদূরে একটা আবর্জনা ফেলার পাত্র ভীষণ এক শব্দ করে ফেটে চৌচির হয়ে গেলো। হ্যারি এক সেকেন্ড দেরি না করে লেগ-লকার-কার্স ম্যালয়ের দিকে ছুঁড়লো। কার্সটা ম্যালফয়কে আঘাত না করে মোনিং মার্টলের জল রাখার গামলায় লাগতেই ওটা ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। মোনিং মার্টল ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো। সমস্ত ঘরটায় জলে ভরে গেলো। হ্যারি ম্যালয়ের মতোই পিছলে পড়ে গেলো। ম্যালয়ের মুখটা কুঁচকে গেল, ভীষণ জোরে বললো, কুসিও।

হ্যারি জলসিক্ত মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থাতে জাদুদণ্ডটা প্রবলভাবে ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, সেকটামসে।

ম্যালয়ের সারা শরীর থেকে গল গল করে রক্ত ঝরতে লাগলো, এমনভাবে যেন কেউ ওকে একটা ধারালো তলোয়ার দিয়ে কুপিয়েছে। ও জলসিক্ত মেঝে থেকে ওঠবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো; উঠতে গিয়ে আবার ধপাস করে পড়ে গেল, চতুর্দিকে জল ছিটকে পড়লো। ওর ডান হাতে ধরে থাকা জাদুদণ্ডটা ছিটকে পড়লো।

না, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো। হ্যারি কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো, ম্যালফয়ের দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে গিয়ে বললো, না, আমি করিনি।

ম্যালয়ের মুখ রক্তবর্ণ, ওর ফ্যাকাশে সাদা হাত দুটো দিয়ে বুকের রক্তস্রোতকে চেপে ধরেছে।

হ্যারি জানে না ও কি বললো, ও ম্যালয়ের পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো। ম্যালফয় তখনো থরথর করে কাঁপছে, ওর রক্ত ঝরে চলেছে, মোনিং মার্টল সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো।

খুন, খুন, বাথরুমে খুন হয়েছে!

ঠিক সেই সময়ে হ্যারি তার পেছনে দরজা খোলার শব্দ হওয়ায় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। স্নেইপ দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে এক ধাক্কায় হ্যারিকে এক ধারে ঠেলে দিয়ে ম্যালফয়ের দিকে হাঁটুগেড়ে বসে জাদুদণ্ডটা বার করে ম্যালয়ের রক্তাক্ত শরীরে বোলাতে লাগলেন। ওর সারা দেহে হ্যারির ভয়াল, ভয়ঙ্কর কার্সে গভীর ক্ষত হয়ে গেছে। স্নেইপ সেই কার্স নির্বাপিত করার জন্য বিড় বিড় করে কিছু বলতে লাগলেন। হ্যারির মনে হলো স্নেইপ যেন মিষ্টি এক সুরে গান গাইছেন। রক্তপড়া একটু একটু করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। ম্যালয়ের রক্ত স্নেইপ হাত। দিয়ে মুছে দিতে দিতে মিষ্টি সুরে গান গেয়ে চললেন। গায়ের কাটা জায়গাগুলো।

কোন এক অদশ্য হত সেলাই করে দিতে লাগলো।

হ্যারি ভয়ার্ত মুখে ম্যালফয়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, বুঝতেই পারছে না কেমন করে দুর্ঘটনাটা হলো। ম্যালয়ের মতো ওর শরীরও রক্ত আর জলে, লালরঙে সিক্ত হয়ে গেছে। মোনিং মার্টল তখনো একঘেয়ে বিলাপ করে চলেছে। স্নেইপ তৃতীয়বার বিপরীত কার্স করে ম্যালফয়কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে, ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

তোমার হসপিট্যাল উইং-এ যাওয়া দরকার, তবে তুমি যদি এখুনি ডিটানি খাও তাহলে হয়তো হসপিট্যালে নাও যেতে হতে পারে, তাহলেও কোনো চান্স নিতে চাই না, এসো।

স্নেইপ, ম্যালয়কে যত্নের সঙ্গে হাত ধরে বাথরুমের বাইরে যেতে যেতে হ্যারির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, পটার আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি কোথায়ও যাবে না। এখানেই অপেক্ষা করবে।

স্নেইপের আদেশ অমান্য করার ইচ্ছে হ্যারির হলো না। জলের ওপর ভেসে বেড়ানো রক্তের ডেলাগুলোকে দেখে হ্যারির মনে হলো জলের ওপর ছোট ছোট লাল রঙের ফুল, ওদিকে মোনিং মার্টলের বিলাপ যেন শেষ হয় না, বেড়েই চললো তার উচ্চ কণ্ঠের বিলাপ।

প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে স্নেইপ ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

তুমি যাও, স্নেইপ কড়া স্বরে মোনিং মার্টলকে বললেন। মার্টল ঘর ছেড়ে চলে গেল। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় পূর্ণ হয়ে গেল ঘরটা।

আমি চাইনি ওকে ওইরকমভাবে আঘাত করতে, হ্যারি বিন্দুমাত্র দেরি না করে বললো। ওর কথাগুলো নিস্তব্ধ জলমগ্ন ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।

আমি জানি না ওই স্পেলটা কি, হ্যারি বললো। কিন্তু স্নেইপ ওর কথায় বিন্দুমাত্র কান দিলেন না।

মনে হয় তোমাকে আমি বুঝতে পেরেছি, পটার, স্নেইপ খুব আস্তে বললেন। কে জানে কোথা থেকে তুমি ওই ডার্ক ম্যাজিক শিখলে? কে তোমাকে ওই মারাত্মক স্পেল শিখিয়েছে হ্যারি পটার?

আমি একটা বই পড়ে শিখেছি।

কোথায়, কোন বই?

লাইব্রেরিতে বইটা আছে, হ্যারি বানিয়ে বললো। আমি মনে করতে পারছি না বইটার নাম।

মিথ্যাবাদী, স্নেইপ ধমকে উঠলেন। হ্যারির গলাটা শুকিয়ে গেল। ও জানে স্নেইপ কি করতে চান, কোনোদিন সেগুলো বাধা দিতে পারেনি।

বাথরুমটা ওর চোখে অন্ধকার হয়ে আসছে, ও সকল চিন্তা থেকে মুক্ত হতে চাইলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো। ওর মনের আয়নাতে হাফ-ব্লাড-প্রিন্সের বই অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং ভেসে উঠলো।

জলে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুমে বসেও আবার স্নেইপের কঠোর মুখের দিকে তাকালো। নিরাশার মধ্যে আশা করলো স্নেইপ হয়তো বুঝতে পারেননি ও ভয় পেয়েছে।

তোমার স্কুল ব্যাগটা নিয়ে এসে আমাকে দাও, স্নেইপ একটু নরম সুরে বললেন। স্কুলের সব বই যেন ব্যাগে থাকে। যাও, এখুনি নিয়ে এসো তোমার স্কুল ব্যাগ।

তর্ক করে কিছু লাভ হবে না হ্যারি ভালো করেই জানে। হ্যারি বাথরুম থেকে বেরিয়ে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে এক রকম ছুটতে লাগলো। ওর সর্বাঙ্গে রক্ত, আলখেল্লা সিক্ত, সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। অনেকেই প্রশ্ন করতে লাগলো, হ্যারি সেই প্রশ্নগুলোর একটারও জবাব দিলো না।

ও এমনিভাবে ছুটছে যেন একটা অতি আদরের পালিত কুকুর পাগল হয়ে গেছে। কেন যে প্রিন্স ওই বইতে এই স্পেলটা লিখেছিলেন? স্নেইপ সেটা দেখতে পেলে কি করবেন? তাহলে কি স্লাগহর্নকে নালিশ করবেন, হ্যারি সেইসব কথা ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেল, পেটের ভেতরটা অসম্ভব ব্যথা করতে লাগলো। হ্যারি কেমন করে সারা বছর ধরে পোশানে ভালো রেজাল্ট করেছে সে তথ্য স্লাগহর্ন পেয়ে যাবেন। যে বইটা পড়ে হ্যারি অনেক কিছু শিখতে পেরেছে, তাহলে কী সেই বইটা পুড়িয়ে ফেলা হবে, বাজেয়াপ্ত করা হবে! বইটিতো ওর পরম বন্ধু, গাইড। হ্যারি কিছুতেই সেই বইটা হাত ছাড়া করবে না, কিছুতেই দেবে না।

রন সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়েছিলো, হ্যারির দিকে অদ্ভুত আতঙ্কের দৃষ্টিতে তাকালো। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার গায়ে লাল দাগ, জলে ভেজা রক্ত!

তোমার পোশান, তোমার পোশান বইটা দিতে পারবে, আমার ওটা দরকার, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে রনের দিকে তাকিয়ে বললো। দাও, দাও, প্লিজ তাড়াতাড়ি দাও।

হাফ-ব্লাড…? পরে তোমাকে সব বলবো।

রন ব্যাগ থেকে ওর অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং-এর কপিটা বার করে হ্যারির হাতে দিলো। বইটা হাতে নিয়ে প্রায় আগের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে কমনরুমে এসে স্কুল ব্যাগটা কাঁধে তুলে পোর্ট্রেট হোল দিয়ে বেরিয়ে সেভেন্থ ফ্লোরের করিডরে চলে এলো। ওর দিকে যে স্কুলের সব ছেলেমেয়েরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো সেদিকে খেয়াল নেই।

ও মনে মনে বললো,

আমার বইটা লুকিয়ে রাখার একটা জায়গা দরকার, বইটা লুকিয়ে রাখবার একটা জায়গা দরকার। আমার একটা জায়গার দরকার…

ও রুম অফ রিকোয়ারমেন্টের সামনে পায়চারি করতে লাগলো। শুধু লম্বা দেয়াল ভেতরে যাবার দরজা নেই। ও চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো, চোখ খুলতেই দরজা। এই তো রুম অব রিকোয়ারমেন্টের দরজা সে সামান্য খুলে দ্রুত ভেতরে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

হ্যারি হাঁপাতে লাগলো। ওর মনের মধ্যে ভয় উল্কণ্ঠা, কে জানে বাথরুমে স্নেইপ কি মুর্তিতে অপেক্ষা করছেন, ও আতঙ্কপীড়িত হয়ে সামনে তাকাতেই থোমতো খেয়ে গেল। কি দেখছে, এখন কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে? বিরাট আকারের ক্যাথিড্রালের মতো বা বড় বড় জানালাগুলো দিয়ে বাইরে থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে বিরাট ঘরটায়। ঘরটা যেন একটা অতি পুরনো দিনের শহর। অতীতের স্থাপত্যে তৈরি ঘর। জানালা, দরজা, দেয়াল, ক্যালপি সবকিছুই অতীত কালের। ঘরটায় পড়ে রয়েছে অনেক জীর্ণ-ভগ্ন ফার্নিচার। ঘরের মধ্যে তাকে সাজানো রয়েছে হাজার হাজার বই। কে বা কারা বইগুলো রেখে গেছে হ্যারি জানে না। দেয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে পাথরের তীর আর অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র, চারদিকে দাঁতওয়ালা খেলার জন্য গোলাকার ফ্রিসবীস। তাছাড়া পর্বতপ্রমাণ অতীত কালের নানা রকম জিনিসপত্র, বোতল, টুপি, জুয়েলস, ঘড়ি, ড্রাগনের চামড়া, ডিম, বোতল ভর্তি পোশান, ছিপ আঁটা নানা সাইজের বোতল, ভোতা বা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র, রক্তমাখা কুঠার! নিশ্চয়ই এসব নিষিদ্ধ বস্তু। বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো নিষিদ্ধ ম্যাজিক বস্তু ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়েছে এখানে বা হোগার্টসের হাউজ এলফরা এখানে এনে রেখেছে।

হ্যারি অনেক কানাগলির মধ্যে একটাতে পা রাখলো। কে জানে আরো হয়তো অনেক লুকোনো ধনসম্পত্তি দেখতে পাবে সেই গলির দুপাশে। অনেক গলির মধ্য দিয়ে হ্যারি হাঁটতে লাগলো। যেখানে তার ইচ্ছে, ডাইনে-বাঁয়ে, খানিকটা এগিয়ে ও অ্যাসিডে দগ্ধ একটা কাবার্ডের সামনে দাঁড়ালো। সেটা ছাড়া আরো অনেক ছোট বড় কাবার্ড রয়েছে। ও একটা ভাঙ্গা পাল্লার কাবার্ড খুললো। দেখে মনে হলো তার মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে; লুকিয়ে রাখার উপযুক্ত কাবার্ড সন্দেহ নেই। তার মধ্যে ও একটা খাঁচা দেখতে পেল। খাঁচার মধ্যে রয়েছে বহু বছরের মৃত একটি পাঁচ-পা-ওয়ালা পাখি বা জম্ভর কঙ্কাল। ও হাফ-রাড-প্রিন্সের বইটা খাঁচার মধ্যে চালান করে পাল্লাটা বন্ধ করে দিলো। ওর বুকটা তখন ধড়াম ধড়াম করছে। বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাখা জিনিসপত্রগুলো বেশ কয়েকবার দেখে নিলো যাতে বইটা খুঁজে পায়। কে জানে খুঁজে পাবে কি না। না, ওই রকমভাবে রাখলে চলবে, খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না। তারপর সময় নষ্ট না করে দরজা খুলে বাইরে এসে করিডরে দাঁড়ালো।

হ্যারি, রনের বইটা স্কুলব্যাগের মধ্যে রেখে বাথরুমের সামনে দাঁড়ালো। তারপর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে স্নেইপের সামনে দাঁড়ালো। স্নেইপের হাতে ব্যাগটা দিলে স্নেইপ একটার পর একটা বই টেনে বার করতে লাগলেন। সবশেষে বার করলেন রনের দেয়া কপিটা। বইটা হাতে নিয়ে স্নেইপ হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে এই বইটাতে আছে? এটাই অ্যাডভান্স পোশান মেকিংয়ের কপি?

হ্যাঁ, হ্যারি বললো বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে। এটাই তুমি ফুরিয়ে অ্যান্ড বুটস থেকে কিনেছো? হ্যাঁ, হ্যারি জোর দিয়ে বললো। তাই যদি হয়, তাহলে বইতে মালিকের নাম রুনিল ওয়াজলিব কেন? হ্যারির বুকের স্পন্দন প্রায় থেমে গেলো। আমার ডাক নাম স্যার, হ্যারি বললো। তোমার ডাকনাম, স্নেইপ বললেন। হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা আমাকে ওই নামে ডাকে, হ্যারি বললো। আমি জানি ডাকনাম কি হয়, স্নেইপ বললেন।

হ্যারি স্নেইপের ঠান্ডা কালো চোখ থেকে তার চোখ ফিরিয়ে এনে, মনে মনে উচ্চারণ করলো, ক্লোজ ইওর মাইন্ড… ক্লোজ ইওর মাইন্ড, কিন্তু কখনো সে সম্পূর্ণ সফল হয়নি।

হ্যারি তোমার সম্বন্ধে আমার কি ধারণা জানো? স্নেইপ বললেন। আমি মনে করি তুমি একটি ডাহা মিথ্যাবাদী, ও চিট। তোমার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে কয়েদ হয়ে থাকা। প্রতিটি শনিবার, তোমার টার্ম শেষ হওয়া পর্যন্ত। কি মনে করছে, পটার? এছাড়া অন্য কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে?

আ… আ… আমি আপনার সঙ্গে একমত নই স্যার, হ্যারি বললো। তখন হ্যারি স্নেইপের কালো ঠান্ডা চোখের দিকে তাকানো এড়িয়ে বললো।

বেশ, তোমার ডিটেনসনের পর মনের অবস্থাটা বোঝা যাবে, কেমন? মনে থাকে যেন প্রতি শনিবার সকাল দশটায় আমার অফিসে, পটার। স্যার, হ্যারি বললো। কিডিচের শেষ ম্যাচ। হ্যারির গলার স্বর আটকে গেল।

বললাম, সকাল দশটায় স্নেইপের হলুদ বর্ণের দাঁত বেরিয়ে এলো হাসির সঙ্গে। বেচারা গ্রিফিন্ডর, এই বছর তাদের পজিশন হবে চার, তাইতো আমার মনে হয়।

আর একটিও কথা না বলে স্নেইপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হ্যারি চিড় খাওয়া ভাঙা আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবলো রনের জীবনে এই রকম অবস্থা কখনো কি হয়েছে।

বলেছি তো আমি কিছু বলতে চাই না, ঘণ্টাখানেক পরে কমনরুমে বসে হারমিওন বললো।

ছাড়োতো হারমিওন, রন রেগে গিয়ে বললো। বাথরুমে যা যা ঘটেছিলো রন, হারমিওন আর জিনিকে বললো হ্যারি। ডিনার খাবার ওর কণামাত্র ইচ্ছে নেই। ওদিকে মোনিং মার্টল প্রতিটি বাথরুমে ঢুকে সবিস্তারের যা যা দেখেছে বলে বেড়াতে লাগলো। ম্যালফয় প্যানসি পারকিনসনকে সঙ্গে নিয়ে হসপিটাল উইং-এ যেতে বাধ্য হলো।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ওকে কমনরুম থেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোমার ভাগ্য ভালো হ্যারি। তুমি যা করেছে তার জন্য স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা ছিলো। ম্যাকগোনাগল আগাগোড়া স্নেইপকে সমর্থন করে যাওয়ায়। হ্যারি ব্যাথিত হলো শাস্তির ব্যাপারে প্রতিবাদও করলেন না।

হারমিওন বলেছিলো ম্যালয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে ওই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলবে না সে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারলো না।

হ্যারি, তোমাকে আমি সবসময়ই বলেছি, প্রিন্সের ওই বইটা না পড়ার জন্য। বলো আমি কথাটা বলেছিলাম কি না?

না, তুমি ঠিক বলোনি, হ্যারি একগুঁয়ের মতো বললো। 

খুব খারাপ সময় চলছে। একদিকে হারমিওনের সঙ্গে কথা বন্ধ, অন্যদিকে কিডিচ খেলতে পারবে না। টিমের প্লেয়াররা ক্যাপ্টেনের কাহিনী শুনে চুপসে গেল। হ্যারি না খেললে ওরা নির্ঘাত হারবে।

হ্যারি, জিনিকে ডেকে বললো, শনিবার তুমি সিকার হয়ে খেলবে, আর ডিন হবে চেজার তোমার জায়গায়।

ব্যবস্থাটা বাধ্য হয়ে হ্যারিকে করতে হলো। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ঠান্ডা ধারালো ছুরির ফলা শরীরে প্রবেশ করানোর মতো যন্ত্রণা বোধ করতে লাগলো। যদি গ্রিফিন্ডর খেলায় জেতে তাহলে তো জিনির সঙ্গে ডিনের আবার ভাব হয়ে যেতে পারে। আবার হয়তো ডিন জিনিকে একলা পেয়ে জয়ের আনন্দে চুমু খাবে!

হ্যারি, এতবার বলেছি না পড়ার জন্য, তারপরও, কেন তুমি বইটা পড়ো বলতো, হারমিওন আবার ওকে মাস্টারি ভঙ্গিতে বললো। তুমি যখন জানতে স্পেলটা মারাত্মক!

কথাটা শুনে হ্যারি দারুণ চটে গেল। বললো, বার বার তুমি এক কথা বলবে না হারমিওন। ওটা প্রিন্সের কপি রাইট নয়। প্রিন্স ওটা অন্য কোনো বই থেকে ওর বইতে নোট করেছে মাত্র। থোরাই ও কাউকে ওটা ব্যবহার করতে উপদেশ দিয়েছে। কেউ হয়তো ওই সেকটামসে ওর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলো।

 আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি না, হারমিওন বললো। তুমি অযথা নিজেকে ডিফেন্ড করতে চাইছো, হ্যারি।

না, মোটেই না। তোমার ধারণা ভুল, হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বললো। আমি অনিচ্ছার সঙ্গে করেছিলাম, এমন নয় যে বারোটা ডিটেনসন পাবার কারণে কথাটা বলছি। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কখনই ওই রকম মারাত্মক স্পেল ম্যালফয়ের ওপর প্রয়োগ করতে চাইনি। অযথা তুমি প্রিন্সকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। ও বইতে লেখেনি, এই স্পেল তুমি ব্যবহার করতে পারো, সত্যই এটা অতি উত্তম স্পেল। ও শুধুমাত্র নিজের বইতে নোট করেছে, তাই না? একমাত্র নিজের জন্য, অন্য কারও জন্য নয় বুঝলে।

তাহলে বইটা তুমি নিয়ে আসবে, হারমিওন ঝেঝে উঠে বললো।

হা যাচ্ছি সেটা নিয়ে আসতে। ঠিক ধরেছো, হ্যারি একগুয়ে মুখের ভাব করে জোরে জোরে বললো। শোনো প্রিন্সের লেখা বই পড়েছি বলেই ফেলিক্স ফেলিসিস করতে পেরেছি, রন যখন বিষে আক্রান্ত হয়েছিলো তখন জানতাম না কেমন করে ওকে বাঁচানো যায়, কোনো দিনই সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হতো না।

পোশান তৈরির উৎকর্ষতার যে সুনাম তুমি পেয়েছে সেটা পেতে না, হারমিওন ওর স্বভাব বিরুদ্ধ বিশ্রীভাবে কথাটা বললো।

হারমিওন, তুমি একটু থামবে, অনেক তো বলেছে, জিনি বললো। কথাটা শুনে হ্যারি কৃতজ্ঞচিত্তে জিনির মুখের দিকে তাকালো। বুঝলে ম্যালফয় এখন আনফরগিভেবল কার্স প্রয়োগের চেষ্টায় রয়েছে, হ্যারি ওকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে।

হ্যাঁ, ওয়েল, আমি অবশ্যই খুশি হয়েছি, হ্যারিকে ও কার্স করতে পারেনি, হারমিওন মনে কোনো দ্বিধা না রেখে বললো। তাহলেও তোমাদের মনে রাখা উচিত সেকটামসে খুব ভালো স্পেল। জিনি তুমি তো দেখছো সেটা ব্যবহার করার পর ওর অবস্থা, তাছাড়া বুঝতেই পারছো ওকে ছাড়া এখন তোমাদের ম্যাচের অবস্থা কি হবে।

থামোতো, এমনভাবে তুমি কথাটা বললে যেন কিডিচ খেলার সবকিছু তুমি জেনে বসে আছো, জিনি হারমিওনকে কটকট স্বরে বললো। এসব কথা বলে তুমি নিজেকে নিজেই ব্ৰিত করছে।

হ্যারি আর রন ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দেখলো, দুজনেই বুকে দুহাত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। অথচ তারা খুবই ঘনিষ্ঠ। রন হ্যারির মুখের দিকে বিচলিত হয়ে তাকিয়ে এলোপাতাড়ি বই ঘাটতে লাগলো, একটা বই নিয়ে পিছনে হাত ঘুরিয়ে রেখে দিলো। যদিও জানে না এতটা তারপ্রাপ্য কিনা, হ্যারি খুশি আর আনন্দে ফেটে পড়লো। যদিও সন্ধ্যায় এরপর আর কথাবার্তা হয়নি।

হ্যারির আনন্দে ফুরফুরে মন খুব সংক্ষেপ হয়েছিলো কারণ পরের দিন স্নিদারিনদের হাসি ঠাট্টা ব্যাঙ্গাত্মক গানে ও মিইয়ে গেল। তাছাড়া ওর টিমের প্লেয়ারদের ক্ষোভ না উল্লেখ করলেই ভাল। ফাইনাল ম্যাচেও ওর খেলা নিষিদ্ধ করেছেন প্রকারান্তরে স্নেইপ। ও শনিবারের সকাল পর্যন্ত হারমিওনকে যাই বলে থাকুক না কেন ও চাইলো পৃথিবীর সকলকে খুশি মনে ফেলিসিস বিলিয়ে দিতে  

যদি সে রন-জিনি আর অন্যদের সঙ্গে কিডিচ পিচে যেতে পারে। হাজার হাজার দর্শকদের আড়ালে থাকা কতোটা মর্মান্তিক সে ছাড়া আর কে বুঝবে। ওরা চেঁচাবে, হৈহৈ করবে, হাততালি দেবে, সমবেত কণ্ঠে গান গাইবে আর ও স্নেইপের ঘরে কয়েদ হয়ে থাকবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হ্যারি ডানজিওনের দিকে এগোতে লাগলো। একটু একটু করে কিডিচ খেলার মাঠের হৈ চৈ ও আর শুনতে পেল না।

হ্যারি দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে স্নেইপের ঘরের দরজায় টোকা মারলো। কানে এলো স্নেইপের হালকা কণ্ঠস্বর, আহ পটার, এসো ভেতরে এসো।

হ্যারি অস্বস্তিকর ঘরে গোমড়া মুখে ঢুকলো। ঘরের পরিবেশটা মোটেই ভাল লাগার মতো নয়। ঘরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। দেয়ালের র‍্যাকে রঙিন পোশানের মধ্যে কিলবিল করা মৃত পোকামাকড় ডোবানো রয়েছে। টেবিলের ওপর রয়েছে ছোটো ছোটো কাঁচের কৌটোতে মাকড়সা আর মাকড়সার জাল। সেই গা ঘিন ঘিন করা টেবিলের সামনে হ্যারিকে বসতে হলো।

স্নেইপ বহু বছরের পুরনো, ধূলি ধূসরিত–জীর্ণ অনেকগুলো ফাইল দেখিয়ে বললেন, ফিলিচ ওই ফাইলগুলো ক্লিয়ার করার জন্য একজন সাহায্যকারীর কথা বলছিলেন। হোগার্টস স্কুলে যারা অন্যায় কাজকর্ম করেছিলো ফাইলগুলো তাদের রেকর্ড। অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজ করার জন্য কি ধরনের শাস্তি পেতে হয়েছিলো তা এতে লেখা আছে। রেকর্ডে কোনো কোনো জায়গায় কালি ঝাপসা হয়ে গেছে, ইঁদুরে ও পোকায় কেটেছে। এখন ওই রেকর্ডগুলো বর্ণমালা অনুযায়ী সাজিয়ে বাক্সের মধ্যে রেখে দিতে হবে। রাখার সময় কিন্তু ম্যাজিকের আশ্রয় নিতে পারবে না।

ঠিক আছে প্রফেসর, হ্যারি, প্রফেসর কথাটায় বেশ জোর দিয়ে বললো।

তাহলে কাজ শুরু করো, স্নেইপ বললেন। তার মুখে বিদ্বেষপূর্ণ হাসি। যে বাক্সে ১২০০ থেকে ১২৫৬ লেখা আছে, তার মধ্যে তুমি অনেক পরিচিত নাম দেখতে পাবে, দেখলে তোমার কাজের প্রতি ইন্টারেস্ট বাড়বে, এই দেখো।

যে বাক্সটা সবচেয়ে ওপরে ছিল তার মধ্য থেকে একটা কার্ড বার করে গদগদ হয়ে পড়তে লাগলেন, জেমস পটার ও সিরিয়াস ব্ল্যাক। বেরটাস অন্ত্রের ওপর বেআইনি হেক্স ব্যবহার করার জন্য শাস্তি। অন্ত্রের মাথার আকার দ্বিগুণ হয়েছিলো। ডবল ডিটেনসন। কথাটা বলে স্নেইপ অবজ্ঞা করার মতো মুখভঙ্গি করলেন। ওরা দুজন এই পৃথিবীতে আর নেই, কিন্তু তাদের মহান কর্মের রেকর্ড রয়ে গেছে।

বিক্ষুব্ধ হ্যারির পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংবরণ করলো।

হ্যারিকে ওই রকমই একটা আজেবাজে বিরক্তিকর, বেকার কাজ দেবেন স্নেইপ ধরে নিয়েছিলো (স্নেইপও ওইরকম পরিকল্পনা করেছিলেন) তাহলে তো ওকে ওর বাবার ও সিরিয়সের বিভিন্ন রকম তথ্য পড়তে হবে। সাধারণত ও দেখেছে সব ব্যাপারে দুজনের নাম এক সঙ্গে জড়িত। মাঝে মাঝে রেমাস লুপিন আর পিটার পেটির নামও আছে। ও তাদের বিভিন্ন অন্যায় কাজ ও শাস্তির তথ্য কপি করতে লাগলো কিন্তু মন পড়ে রইলো কিডিচ খেলার মাঠে। খেলা তো শুরু হয়েছে, কে জানে ওখানে কি করছে ওর দলের প্লেয়াররা। জিনি তাহলে সিকার।

হ্যারি কপি করতে করতে মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকায়। বিরাট দেয়াল ঘড়িটা টিক টিক শব্দ করে চলছে। মনে হয় স্বাভাবিক যেমন চলে এখন যেন তার অর্ধেক চলছে। সময় যেন শেষ হতে চায় না। কে জানে স্নেইপতো ওকে বেশি সময় আটকে রাখার জন্য ঘড়িটাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেননি। না করলে এতো কম গতিতে চলছে কেন? ওর মনে হয় স্নেইপের ঘরে এসেছে এক ঘণ্টা তো হবেই; কিন্তু ঘড়িতে দেখছে মাত্র আধঘন্টা।

ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজলে হ্যারির পেটের ভেতর গুড় গুড় করে উঠলো। হ্যারি ঘরে আসার পর কি কাজ করতে হবে নির্দেশ দিয়ে স্নেইপ একবারও ঘড়ির দিকে বা হ্যারির দিকে তাকাননি। মুখ তুললেন ঘড়ি কাঁটা যখন একটা বেজে দশ মিনিটে পৌঁছেছে।

বেশ আজ এই পর্যন্ত থাক, স্নেইপ শীতল কণ্ঠে বললেন। যতোটা কপি করেছে সেখানে একটা মার্কিং করে রাখো। তাহলে আবার আগামী শনিবার সকাল দশটার সময় আসছো?

ইয়েস স্যার।

হ্যারি বাক্সের মধ্যে একটা দোমড়ানো কার্ড ইচ্ছেমতো গুঁজে দিয়ে বলতে গেলে ঘর থেকে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। স্নেইপকে আর একটা কথা বলার সুযোগ দিলো না। ওর কান পড়ে রইলো কিডিচ মাঠে। আশ্চর্য! সব চুপচাপ, সেখান থেকে কোনো কলরব হ্যারির কানে এলো না। তাহলে কি ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে?

ও গ্রেট হলের সামনে দাঁড়ালো। হলে ঢোকা যায় না এতো ভিড়। সেখান থেকে পাথরের সিঁড়ির দিকে দৌড়ালো। ওখানে গেলে জানতে পারবে গ্রিফিন্ডর হেরেছে না জিতেছে। যারা জেতে তারা তাদের কমনরুমে সাধারণত বিজয় উৎসব করে।

কুইড এগিস? ফ্যাটলেডির কাছ থেকে ও হলের ভেতরের খবর জানতে চাইলো। ভাবলেশহীন কণ্ঠে ফ্যাটলেডি বললো, গিয়েই নিজের চোখে দেখো। হ্যারি গর্ত দিয়ে দেখতে পেল ভেতরে দারুন হই-হুঁল্লোড় হচ্ছে। হ্যারি ভেতরে ঢুকলে ছেলেমেয়েরা ওকে ঘিরে ধরলো। অনেকেই ওর হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। চেহারায় তাদের আনন্দ উপচে পড়ছে।

জিতেছি, আমরা জিতেছি, রন চিৎকার করে বললো। হাতে ওর রূপোর কাপ। কাপটা হ্যারির সামনে দোলাতে লাগলো। জানো আমরা চারশ পঞ্চাশ আর ওরা মাত্র একশ চল্লিশ পেয়েছে। জিতেছি, আমরা জিতেছি। হ্যারি আনন্দে অধীর হয়ে এধার ওধার তাকাতেই দেখলো জিনি ওকে দেখে একরকম ছুটতে ছুটতে ওর দিকে আসছে। জিনি দারুণ এক উত্তেজনায় দুহাত প্রসারিত করে হ্যারিকে জড়িয়ে ধরলো। কে ওকে দেখছে না দেখছে কোনো রকম ধার না ধেরে সকলের সামনে হ্যারিকে চুম্বন করলো। হ্যারিও ওকে চুম্বন করলো।

ওরা দুজনে দুজনকে কতোটা সময় চেপে ধরেছিলো খেয়াল নেই, অনেকটা সময়, অথবা আধঘণ্টা, অথবা সম্ভবত রৌদ্র উজ্জ্বল কয়েকটা দিন, তারপর ওরা আলাদা হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে নীরবতা। তারপর কয়েকজন চ্যাংড়াদের মতো শিস দিলো, অনেকেই দাঁত বার করে হাসতে লাগলো। হ্যারি জিনির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে তাকালো। দেখলো ডিনের হাতে একটা ভাঙ্গা গ্লাস আর রোমিল্ট ভানের মুখ দেখে মনে হলো একটা কিছু হাতে আছে সেটা ছুঁড়ে ওকে মারবে। হারমিওন হাসিতে উপচে পড়ছে। হ্যারি রনকে খুঁজতে লাগলো। রন কাপটা দেখিয়ে অন্যদিকে গেছে। শেষ পর্যন্ত রনকে দেখতে পেলো। রন তখনো কাপটা মাথায় তুলে ছুটোছুটি করছে।

হ্যারি রনকে দেখে মুচকি হেসে জিনিকে নিয়ে পোর্ট্রেট হোল দিয়ে ঘরের বাইরে এলো। সেখান থেকে উন্মুক্ত মাঠে। এখন ওরা মাঠে বসে বসে…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *