১৮. বার্থডে সারপ্রাইজেস

১৮. বার্থডে সারপ্রাইজেস

ডাম্বলডোর যে বিশেষ কাজ হ্যারিকে দিয়েছেন পরদিনই সে রন আর হারমিওনকে বিস্তারিত বললো। তবে দুজনকে এক সাথে নয় পৃথকভাবে, কারণ হারমিওন তখনো রনের সামনে দীর্ঘ সময় থাকতে চায় না।

ব্রেকফাস্টের সময় রন বললো, তোমাকে স্লাগহর্ন খুব ভালোবাসেন। হয়তো তোমাকে না করবেন না, করবেন কি? তার ছোট্ট পোশান প্রিন্সকে তো নয়ই। লেগে থাকো, ক্লাশ শেষ হবার পর জিজ্ঞেস করতে পারো।

হারমিওন অবশ্য একটু ভিন্নমত পোষণ করলো। আসল ঘটনা হয়তো তোমাকে বলবে না, ডাম্বলডোর যতোই চেষ্টা করুন না কেন, হারমিওন চাপা গলায় বললো। ওরা তখন বরফে ঢাকা উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। হরক্রাকসেস আমিতো আগে কখনো শুনিনি।

তুমি শোননি? হারমিওনের কথা শুনে হ্যারি নিরাশ হলো। ও ভেবেছিলো হয়তো হারমিওন হরক্রাকসেস সম্পর্কে সামান্য কিছু সূত্র দিতে পারবে।

ওটা নিশ্চয়ই অ্যাডভান্সড ডার্ক ম্যাজিকের কিছু হবে, না হলে ভোল্ডেমর্ট সেটা সম্পর্কে জানতে চাবেন কেন? আমার মনে হয় এ বিষয়ে খবর পাওয়া কঠিন হ্যারি। তোমাকে কিন্তু স্লাগহর্নের কাছ থেকে জানতে হলে খুব সাবধানে এগোতে হবে, চিন্তা করো কেমন করে সম্ভব হবে।

রন বলছিলো পোশান ক্লাসের পর জানার জন্য লেগে থাকতে হবে।  

হ্যাঁ, অবশ্য ওন-ওন যদি সে রকম কিছু মনে করেন তাহলে তুমি তাই করবে, রনের নাম শুনে, রনকে, ওন উচ্চারণ করে হারমিওন ক্রুদ্ধ হয়ে বললো। ওন ওনের তো ভুল হতে পারে না কোনভাবেই।

হারমিওন তুমি কি ওকে ক্ষমা করে দিতে পারো না?

না, কখনই না, বলেই হারমিওন রেগেমেগে চলে গেলো। হ্যারি বরফের ওপর একা দাঁড়িয়ে রইলো।

পোশান ক্লাস এখন ওদের জন্য অস্বস্তিকর।

পোশান ক্লাসে হ্যারি, রন, হারমিওন একই ডেস্কে কাজ করে। হারমিওন ওর কলড্রন একটু সরিয়ে টেবিলের এরনির কাছেই যেয়ে বসলো যাতে এরনির কাছেই থাকে। বসার সময় হ্যারিও রনের দিকে তাকালো না।

হারমিওন ওদের পাশাপাশি না বসে অন্যদিকে সরে বসাতে রন হ্যারিকে ফিসফিস করে বললো, ঘটনা কি? কথাটা বলে আড়চোখে হারমিওনের দিকে তাকালো।

হ্যারি কিছু বলতে যাবার আগেই স্লাগহর্ন ক্লাসরুমের দরজার গোড়ায় দাঁড়ালেন। সাইলেন্স। বসো, বসো, সকলে বসো। আজ আমাদের অনেক কাজ করতে হবে, গলপালটসের-থার্ড-ল… কে আমাকে বলতে পারে? মিস গ্রেঞ্জার অবশ্যই পারবে।

হারমিওন গরগর করে বলে গেলো, গলপালটসের-থার্ড-ল-স্টেটস-দ্যাট-দ্যা এন্টিডট-ফর-অ্যা-ব্লেন্ডেড-পয়জন-উইল-বি-ইকোয়েল-টু-মোর-দ্যান-দ্যা-সাম অফ-দ্যা-এন্টিডটস-ফর-ইচ-অফ-দ্যা-সেপারেট-কম্পোনেন্টস।

একেবারে ঠিক, স্লাগহর্ন উৎফুল্ল হয়ে বললেন। দশ পয়েন্ট গ্রিফিরদের। এখন যদি আমরা গলপালটসের থার্ড ল সত্য বলে ধরে নিই…।

হ্যারি গলপালটসের থার্ড ল সম্পর্কে কিছুই বোঝেনি তাই স্লাগহর্নের বক্তব্য বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলো। পরে স্লাগহর্ন যা বলে গেলেন তা হারমিওন ছাড়া কারো বোধগম্য হলো না।

রন, হ্যারির পাশে বসেছিলো অর্ধেক হাঁ করে। হাতে ওর অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং-এর নতুন কপি। রন একেবারেই ভুলে গিয়েছিলো যে এখন থেকে অসুবিধে হলে হারমিওনের সাহায্য পাবে না।

স্লাগহর্ন ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি চাই তোমরা এক এক করে এসে আমার ডেস্কের ওপরে রাখা একটা করে শিশি নিয়ে যাও। আজকের ক্লাস শেষ হবার আগে এর মধ্যে যে পয়জন রয়েছে তা দিয়ে এন্টিডট বানাবে। গুডলাক, হাতে প্রোটেকটিভ দস্তানা পরতে কিন্তু ভুলবে না।

হারমিওন ওর শিশির মধ্যে রাখা পয়জনটা কলড্রনে ঢেলে আগুনের উপর রাখল। তখনো হ্যারি, রন, এরনি ওদের টেবিলে ফিরে যায়নি শিশি হাতে নিয়ে।

হারমিওন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যারি লজ্জার বিষয় হলো, এবার বোধহয় তোমার প্রিন্স তোমাকে এন্টিডট বানাতে সাহায্য করতে পারবে না। তোমাকে এবার নিজেকেই বানাবার পদ্ধতি জানতে হবে।

হ্যারি, হারমিওনের ব্যাঙ্গ শুনে খুব রেগে গিয়ে কলড্রনে চটকদার গোলাপি রং এর তরল পদার্থটা ঢেলে তার তলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো। ও কিন্তু জানে না তারপর ওকে কি করতে হবে। ও রনের দিকে তাকালো। রনও কিছু জানে না। ওর ভরসা হ্যারি, তাই হ্যারি কি করছে দেখে ও তাই করলো।

রন, হ্যারিকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি তোমাকে প্রিন্স এটা বানাবার কোনো টিপস দেয়নি?

কথাটা শোনার পর হ্যারি ওর সেই পুরনো অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং-এর কপিটা বের করে এন্টিডটসের (প্রতিষেধকের) অধ্যায়টা বের করলো। দেখলো হারমিওন গলপালটসের থার্ড ল সম্পর্কে যেমন বলেছিলো তা হুবহু লেখা রয়েছে। কিন্তু প্রিন্স সে সম্পর্কে নোট লেখেনি। মনে হয় প্রিন্সের বুঝতে হারমিওনের মতো কিছু অসুবিধে হয়নি।

ধ্যাৎ কিছু নেই দেখছি, হ্যারি বিষণ্ণ মুখে বললো। দেখলো হারমিওন ওর। দণ্ডটা খুব উৎসাহের সঙ্গে কলড্রনের উপর ঘোরাচ্ছে। ও বিড়বিড় করে কি স্পেল। বলছে তাও বুঝতে পারলো না দুজনেই। ও শুনতে পেলো এরনি ম্যাকমিলান ওর কলড্রনের উপর মুখ নামিয়ে বলছে স্পেশালিস রিভেলিও। কিছু শব্দ তরঙ্গ হলো স্পেলটা বলার পর। রন, হ্যারি ঠিক সেই রকম করলো।

হ্যারির বুঝতে পাঁচ মিনিটও সময় লাগলো না, সবচাইতে উত্তম পোশান মেকার হিসেবে ওর যে নাম হয়েছিলো তা ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাবে। সেই ভাঙার শব্দ যেনো ওর কানে ঝন ঝন করতে লাগলো। স্লাগহর্ন যেমন সবাইকে উৎসাহদানের জন্য প্রত্যেকের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ান, তেমনি দাঁড়ালেন। দেখতে লাগলেন কে কি রকম বানাচ্ছে। বলতে লাগলেন সুন্দর, সুন্দর। হ্যারির কলড্রনের। কাছে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে কেমন বানাচ্ছে দেখতে গিয়ে পঁচা ডিমের গন্ধ নাকে লাগতেই কাশতে শুরু করলেন। নাকে হাতচাপা দিয়ে মুখটা কলড্রন থেকে সরিয়ে নিলেন। হারমিওনের মুখ হাসিতে ভরা–প্রতিটি পোশান ক্লাসে ও সকলকে হারিয়ে দেয়… ও তখন পোশান তৈরি করে দশটা কাঁচের শিশিতে ভরতে শুরু করেছে। হ্যারি সেদিকে না তাকিয়ে হাফব্লাড প্রিন্সের বইতে ঝুঁকে পড়ে কয়েকটা পৃষ্ঠা শব্দ করে ওল্টাতে লাগলো।

পাতা উল্টাতে উল্টাতে হিজিবিজি করে লেখা এন্টিডটের বিরাট লিস্ট দেখতে পেলো। গলার নিচের দিকে বেজোয়ার দিয়ে প্রবলভাবে চেপে ধর।

হ্যারি সেই লেখাটার দিকে কয়েক মুহূর্ত আপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুদিন আগে বেজোয়ার শব্দটা শুনেছে সে। স্নেইপ তার পোশান ক্লাসে অদ্ভুত এই শব্দটা উল্লেখ করেছিলেন। ছাগলের পাকস্থলী থেকে একটা পাথর বার করে নাও, সেই পাথর তোমার অনেক বিষের হাত থেকে বাঁচাবে। গলপালটস সমস্যার সেটা জবাব নয়। স্নেইপ, যদি এখনো তাদের এই বিষয়ের শিক্ষক থাকতেন তা হলেও হ্যারি সাহস করে সেটা করতো না। কিন্তু ভয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। বিষের প্রতিষেধক যা করেই হোক বানাতেই হবে। হ্যারি স্টোরের আলমারির দিকে গেলো, ভেতরে অনেক জিনিস–ইউনিকর্নের শিং, শুকনো জড়িবুটি ইত্যাদি রয়েছে। ও এলোপাতাড়ি হাতড়াতে হাতড়াতে একটা ছোট বাক্স পেয়ে গেলো। বাক্সের ওপর দেখলো লেখা রয়েছে বেজোয়ারস।

হ্যারি বাক্সের ঢাকনাটা খুললো। ঠিক সেই সময় স্লাগহর্ন বললেন, আর মাত্র দুমিনিট বাকি আছে।

হ্যারি দেখলো বাক্সের মধ্যে ব্রাউন রং-এর কোঁচকানো কোঁচকানো ছটা জিনিস রয়েছে। অনেকটা শুকিয়ে যাওয়া কিডনির মতো অথচ পাথরের মতো নয়। হ্যারি তার মধ্যে থেকে একটা তুলে নিয়ে কালো বাক্সটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে দ্রুতপায়ে নিজের কলড্রনের সামনে এসে দাঁড়ালো।

সময় শেষ হয়ে গেছে, স্লাগহর্ন মিষ্টভাবে বললেন।

দেখি তোমরা আমার জন্য কে কি বানিয়েছে। অনেকেই কিছুই করতে পারেনি। হারমিওন তখন আরো কিছু উপাদান ওর শিশিতে ঢোকাবার চেষ্টা করে চলেছে। স্লাগহর্ন ওর কাছে এসে দাঁড়ালেন। রন হাল ছেড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলড্রনের পদার্থের গন্ধ যাতে নাকে না আসে তার জন্য নাকে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হ্যারি ভেজা তার মুঠোর মধ্যে বেজোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

স্লাগহর্ন চারজনের টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। এরনির বানানো পোশানের গন্ধ শুকে রনের টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। রনের কলড্রনের সামনে বেশি সময় দাঁড়াতে পারলেন না বমি-বমি ভাব আসতেই সেখান থেকে সরে গেলেন।

হ্যারি, হ্যারির পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন। দেখি তুমি কি করেছো? কথাটা শুনে হ্যারি বেজোয়ার রাখা হাতের মুঠোটা এগিয়ে দিলো।

স্লাগহর্ন প্রায় দশ সেকেন্ড মুখ নামিয়ে হ্যারির মুঠোতে রাখা জিনিসটা দেখলেন। হ্যারির আশঙ্কা হলো ওটা দেখে স্লাগহর্ন তো রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠবেন না! কিন্তু স্লাগহর্ন মাথাটা সরিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লেন।

হ্যারির হাত থেকে বেজোয়ারটা নিয়ে ক্লাসের ছেলেদের দেখাবার জন্য তুলে ধরে বললেন, সত্যি তোমার নার্ভ আছে, সাহস আছে! সত্যি তুমি তোমার মায়ের মতো হয়েছে, তুমি একটুও ভুল করোনি, সকল পোশানের বিরুদ্ধে… এই বেজোয়ার অবশ্যই এন্টিডটের কাজ করবে।

হারমিওনের মুখ ঘর্মাক্ত… নাকে ময়লা জমে গেছে… বিবর্ণ মুখ। ওর অর্ধসমাপ্ত এন্টিডট… বায়ান্নটা ইনগ্রেডিয়েন্টস শুধু নয় ওর কিছু চুলও পড়েছে সেখানে, কলড্রনে টগবগ করে ফুটছে। পিছনেই স্লাগহর্ন দাঁড়িয়ে, কিন্তু তার দৃষ্টি শুধু হ্যারির দিকে। হারমিওন বিস্ময়ে হ্যারিকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, বেজোয়ার যে এন্টিডটের কাজ করবে এটা কি তুমি নিজে নিজেই ভেবেছো।

স্লাগহর্ন বললেন, হ্যারি অনেকটা ওর মায়ের মতো। তারও ঠিক হ্যারির মতোই পোশান বানানোর ক্ষমতা ছিলো, মনে হয় গুণটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে।

হারমিওন ছাড়া ঘরে আর কেউ যদি কুব্ধ হয়ে থাকে সে হলো ম্যালফয়। ম্যালফয় এন্টিডট বানাতে বানাতে বেড়ালের বমির মতো একটা কিছু করেছে দেখে হ্যারি খুব খুশি হলো। আশ্চর্য! হ্যারি কোন পরিশ্রম না করেই এ্যান্টিডট বানিয়ে ক্লাশের মধ্যে সেরা হয়ে গেলো? ওদের উত্মা কমার আগেই ঘণ্টা বেজে গেলো।

এখন তোমাদের ক্লাশ শেষ, যে যার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, স্লস্লাগহর্ন বললেন। আরো দশ পয়েন্ট গ্রিফিন্ডরদের।

হ্যারি খুব ধীরে ধীরে ওর জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো। না হারমিওন, না রন ক্লাসরুম থেকে যাবার সময় ওর সঙ্গে কথা বললো। দুজনের মুখে বিরক্তির ছাপ। সকলেই চলে গেলে ঘরে রয়ে গেলেন স্লাগহর্ন আর হ্যারি।

স্লাগহর্ন হ্যারিকে তাড়া দিয়ে বললেন, দেরি করো না, তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে নাও, পরের লেসনের জন্য তোমার লেট হয়ে যাবে। কথাটা শেষ করে ড্রাগন চামড়ার ব্রিফকেসটা সোনা রঙের ক্লিপ দুটো দিয়ে বন্ধ করলেন।

স্যার, আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। করো, করো… তাড়াতাড়ি। স্যার… আপনি হরক্রাকসেস সম্পর্কে কিছু জানেন?

কথাটা শুনে স্লাগহর্ন স্থির হয়ে গেলেন। ওর গোল মুখটা চুপসে গেলো। ঠোঁট দুটো চেটে কর্কশ স্বরে বললেন, কী বললে তুমি?

স্যার আমার প্রশ্নটা ছিল, আপনি হরক্ৰাকস সম্পর্কে কিছু জানেন?

স্লাগহর্ন ফিস ফিস করে বললেন, ডাম্বলডোর তোমাকে এই প্রশ্ন করতে বলেছেন?

স্লাগহর্ন যেনো অন্য মানুষ। গলার স্বর, ভিন্ন শান্ত চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে মনে হলো তিনি ভীষণ উত্তেজিত। দুএকবার চেষ্টা করে বুক পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছলেন।

ডাম্বলডোর তোমাকে মেমরিতে সেই দৃশ্য দেখিয়েছেন তাই না? স্লাগহর্ন বললেন। সত্যি বলো, দেখান নি?

মিথ্যে বলা ঠিক হবে না ভেবে হ্যারি বললো, হ্যাঁ স্যার।

হা হা ঠিক আছে, স্লাগহর্ন শান্ত স্বরে বললেন। তুমি যদি সেই মেমরিটা দেখে থাকো হ্যারি, তুমি এই কথাটি জানবে যে আমি কিছুই জানি না, কিছুই না। কথাটা খুব জোর দিয়ে বললেন।

আমি হরক্রাকস সম্পর্কে কিছুই জানি না।

কথাটা বলে স্লাগহর্ন তার ড্রাগনের চামড়ার ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে রুমালটা পকেটে গুঁজে ডানজিওনের দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

স্যার, হ্যারি শেষ চেষ্টা করল, আমার মনে হয়েছে মেমরিতে সব কিছু আসেনি।

তাই? স্লাগহর্ন বললেন, মনে হয় তুমি ভুল করছো–তাই না? ভুল!

হ্যারি সেই কথা শুনে কিছু বলার অপেক্ষা না করে স্লাগহর্নের ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন। রন বা হারমিওন দুজনের কেউই স্লাগহর্নের সঙ্গে ওর সর্বনাশা সাক্ষাৎকার শুনে একটুও সমব্যাথি হলো না। হারমিওনের মাথায় তখনো দুশ্চিন্তা, হ্যারি কোনো কিছু না করে ক্লাসে বাজিমাতের বিষয়ে। রন দুঃখিত, হ্যারি ওকে বেজোয়ার না দেওয়াতে।

কথাটা রন বলতেই হ্যারি রেগে গিয়ে বললো, দুজনেরই একই রকম কাজ… তা হয় নাকি? শোনো আমি ভান্ডেমর্ট সম্পর্কে কিছু জানার জন্য তার মনকে নরম করেছি, বলতে পারবে না যে আমি করিনি! রন ভোল্ডেমর্টের নাম শুনে পিছিয়ে গেলো।

তারপর বেশ কয়েকদিন রন আর হারমিওনের ওপর হ্যারি রুষ্ট হয়ে থাকলো। ভাবতে লাগলো স্লাগহর্নের সঙ্গে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কেমনভাবে কথা বলবে। তারপর ঠিক করলো বেশ কিছুদিন হরক্রাকসেসের প্রসঙ্গ তুলবে না, তাহলে তিনি সব ভুলে যাবেন সেই সম্পর্কে। তাকে মোক্ষমভাবে আঘাত করার আগে সময় দিতে হবে।

হ্যারি ওই প্রসঙ্গ না খোলাতে স্লাগহর্ন আবার হ্যারির সঙ্গে স্বাভাবিক স্নেহের দৃষ্টিতে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। মনে হলো স্লাগহর্নও সব ভুলে গেছেন। হ্যারি তাই অপেক্ষা করতে লাগলো স্লাগহর্নের ছোটখাটো পার্টির প্রয়োজন হলে কিডিচ খেলা বাদ দিয়েও স্লাগহর্নের সন্ধ্যাকালীন পার্টিতে যাবে সে। প্রয়োজনে কিডিচ প্র্যাকটিসের দিন পরিবর্তন করবে। দুঃখের বিষয় স্লাগহর্নের তরফ থেকে নিমন্ত্রণ এলো না। হারমিওন খোজ নিয়ে জানতে পারলো স্লাগহর্ন আপাতত কোন সন্ধ্যাকালীন পার্টি দিচ্ছেন না।

পার্টি দিলেই হ্যারি আসবে, সেখানে হ্যারি হয়তো আবার সেই প্রশ্ন করবে। এই কথাটা ভেবে হয়তো পার্টির ব্যবস্থা করছেন না, হ্যারি ভাবলো।

ইতোমধ্যে হারমিওন হোগার্টসের লাইব্রেরিতে লিভিং মেমরিতে এই প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হলো। এতো বেশি আঘাত পেলো যে ভুলেই গেলো হ্যারির বেজোয়ার বিষয়টি।

হারমিওন, হ্যারিকে বললো, আমি আঁতিপাঁতি করে খুঁজে লাইব্রেরিতে হরক্রাকসের বিষয়ে কোনো বই পেলাম না। রেস্ট্রিকটেড সেকশনে আতিপাতি করে খুঁজেও পেলাম না, এমনকি সেসব বইগুলোতেও না যেখানে ভয়ঙ্কর ধরনের পোশানের বিষয়ও আছে। শেষ পর্যন্ত একটা বই পেলাম ম্যাজিক মোস্ট ইভিল হরক্ৰাকস, সবচাইতে খারাপ ম্যাজিক্যাল ইনভেনসানসের, আমরা বলবো না অথবা পরিচালনাও করবো না।

ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হতেই স্কুলের চারধার থেকে বরফ গলতে শুরু করলো। তারপরই তার জায়গায় এলো কনকনে শীত আর বিষণ্ণ শ্যাতশেতে পরিবেশ। বেগুনী-ধূসর মেঘ ক্যাসেলের ওপর ঝুলে রইলো আর অবিরাম কনকনে ঠাণ্ডা বৃষ্টি স্কুলের লনকে কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল করেছে। বাইরের আবহাওয়া খুবই খারাপ। ঠিক ছিলো শনিবার সকালে অ্যাপারেসন লেসন বাইরের মাঠে হবে যাতে নিয়মিত ক্লাসের ব্যাঘাত না ঘটে। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য বাইরের মাঠে না হয়ে সিদ্ধান্ত হলো গ্রেট হলে হবে।

হ্যারি আর হারমিওন হলে (রন অবশ্য ল্যাভেন্ডারের সঙ্গে এসেছে) এসে দেখলো সেখানে একটাও টেবিল নেই। বাইরে থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হলের ওপরের কাঁচের জানালায় চাবুকের মতো কশাঘাত করছে, মন্ত্র করা হলের সিলিং-এর ওপর গভীর কালো মেঘ ভেসে চলছে। হলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, স্নেইপ, ফ্লিটউইক আর স্প্রাউট-হাউজের হেডেরা–আর রয়েছেন ছোটখাটো শরীরের একজন যাদুকর। হ্যারি বুঝতে পারলো জাদুকরটি মিনিস্ট্রি। থেকে এসেছেন–ওদের অ্যাপারেসন শেখাবেন। চেহারাটি তার অদ্ভুত। স্বচ্ছ চেহারা হালকা পাতলা গড়ন। হ্যারির মনে হলো, যে কোনো সময় দমকা হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। হ্যারি অনুমান করলো অবিরত অন্তর্ধান আর পুনঃ আগমনের ফলে তার ওইরকম দেহের অবস্থা হয়েছে। তবে ছোটখাটো হালকা পাতলা চেহারা অ্যাপারেসনের জন্য উপযুক্ত।

ছেলে-মেয়েদের উপস্থিতির পর মিনিস্ট্রির জাদুকর ভাবে বললেন, সুপ্রভাত। বিভিন্ন হাউজের প্রধানেরা সকলকে কথাবার্তা বন্ধ করতে নির্দেশ করলেন।

জাদুকর বললেন, আমার নাম উইলকি টুইক্ৰশ। আমি মিনিস্ট্রি থেকে তোমাদের অ্যাপারেসনের শিক্ষক হিসেবে এসেছি, আগামী বারো সপ্তাহ শিক্ষা চলবে। আমি আশা করছি তোমরা এই সময়ের মধ্যে শিখবে ও পরীক্ষা দিতে সক্ষম হবে।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল গর্জে উঠলেন ম্যালফয়। কথা বন্ধ করে ইন্ট্রাকটর যা বলছেন মনোযোগ দিয়ে শোনো। কথাটা শুনে ম্যালয়ের মুখ লাল হয়ে গেলো, ক্রাবের সঙ্গে কথা বন্ধ করে ওর পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। হ্যারির মনে হলো ম্যাকগোনাগল ওকে ধমক দিয়ে ভালই করেছেন।

আশা করছি তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সে সময়ে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত হবে, টুইক্রশ বলে চলেছেন কোনো বাধাগ্রস্থহীনভাবে।

তোমরা হয়তো সকলেই জানো হোগার্টস থেকে অ্যাপারেট ও ডিসঅ্যাপারেট করা সম্ভব নয়। গ্রেট হলের বাইরে থেকে তোমরা কেউ করতে চাইলে কিন্তু সক্ষম হবে না। চেষ্টা করা বৃথা হবে। এখন তোমরা সকলে এমনভাবে দাঁড়াও যাতে কম করে সামনে পাঁচ ফিট জায়গা খালি থাকে।

ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের সেইরকম দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। ধাক্কাধাক্কি চললো। সকলেই চেষ্টা করছে সামনে পাঁচ ফিট খালি জায়গা রাখতে। হাউজের প্রধানগণ তাদের হাউজের ছেলেমেয়েদের কথা থামিয়ে সঠিকভাবে দাঁড়াবার জন্য নির্দেশ করতে লাগলেন।

হ্যারি তুমি কোথায় যাচ্ছো? হারমিওন জানতে চাইলো। হ্যারি হারমিওনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলো। সেখানে প্রফেসর ফ্লিটউইক কিছু র‍্যাভেনক্লদের নিয়ন্ত্রিত করবার চেষ্টা করছিলেন, সকলেই পেছনে

দাঁড়িয়ে প্রথম সারিতে দাঁড়াতে চাইছে। ওদিকে প্রফেসর স্প্রাউট হালপাফদের ঠিকমতো লাইনে দাঁড় করাবার জন্য হিমশিম খাচ্ছেন। হ্যারি শেষ পর্যন্ত এরনি ম্যাকমিলানকে ঠেলে ঠিক ম্যালফয়ের পেছনে দাঁড়ালো। ম্যালফয় তখনো ক্রাবের সঙ্গে বিতর্ক করে চলেছে হ্যারির থেকে পাঁচ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে।

কে জানে আরো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ঠিক আছে? ম্যালফয়, ক্রাবের দিকে তাকিয়ে বললো, যদিও ওর পেছনেই ছিল হ্যারি। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি সময় নেবে মনে হয়।

ক্রাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো… ম্যালফয় ওকে থামিয়ে দিলো।

দেখো, আমি কি করছি না করছি তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না ক্রাবে। তোমাকে আর গোয়েলকে যা বলেছি তাই করো। চারদিকে নজর রাখো!

হ্যারি ম্যালফয়কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, আমি যদি আমার বন্ধুদের সাহায্য চাই তাহলে কি করতে যাচ্ছি তাদের তা বলি। কথাটা কানে যেতে ম্যালফয় পেছনে তাকালো, ওর জাদুদণ্ডের ওপর হাত রাখলো; কিন্তু হাতটা সরিয়ে নিলো চার হাউজ প্রধানের চিৎকার শুনে, সবাই চুপ করো! সঙ্গে সঙ্গে সকলে কথা বন্ধ করলো, ম্যালফয় ধীরে ধীরে সামনের দিকে তাকালো।

ধন্যবাদ তোমাদের, টুইক্রশ বললো। এখন তাহলে…।

হাত দোলাতেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামনে পুরনো স্টাইলের কাঠের গোল চাকা (সার্কাসের যে বৃত্ত চক্রের মধ্যে দিয়ে অশ্বারোহীরা লাফ দেয়) এসে পড়লো।

এপারেটিং করবার সময় তোমাদের অবশ্যই তিনটে ডি মনে রাখতে হবে। টুইক্রশ বললো, ডেস্টিনেসন (দূরত্ব), ডিটারমিনেসন (সংকল্পের দৃঢ়তা), ডেলিবারেসন (বিচক্ষণতা)!

প্রথম স্টেপ কোথায় যাবে সেটা মনস্থির করো, টুইক্রশ বললো। এবার চক্রের মধ্যে দাঁড়াও।

সকলেই ভেতরে না দাঁড়িয়ে আড়চোখে বন্ধুদের দিকে তাকালো। দেখে নিলো সকলে চক্রের মধ্যে দাঁড়াচ্ছে কিনা। তারপরই যেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তেমনই করলো। হ্যারিও চেষ্টা করলো কোনো কিছু না ভাবার। কিন্তু তা সম্ভবও নয়, কারণ ওর মন পড়ে রয়েছে ম্যালফয়ের দিকে।

স্টেপ দুই  : টুইক্রশ বললো। দৃঢ়ভাবে সংকল্পের কথা ভাবো, হ্যাঁ এবার তোমার মনের ইচ্ছে, তোমার শরীরের প্রতিটি অণু থেকে স্রোতের মতো সেই জায়গায় যাওয়া পূর্ণ করতে থাকো!

হ্যারি লুকিয়ে চারদিকে তাকালো। ওর বাঁ দিকে সামান্য দূরে এরনি ম্যাকমিলানকে দেখলো শক্ত করে বৃত্তটাকে চেপে ধরে রয়েছে। মুখ লাল, মনে হয় ও একটা পর্বত প্রমাণ ডিম দেবার চেষ্টা করছে। হ্যারি সেই দৃশ্য দেখে হেসে ফেলে ওর নিজের বৃত্তের দিকে তাকালো।

স্টেপ তিন  : টুইক্রশ সকলকে বললো, আমি আদেশ দিলেই সামনে তাকাবে, শূন্যতার পথে মন দেবে, সুচিন্তিত পথ ধরবে! হ্যাঁ, মন দাও আমার নির্দেশে, এখন… এক…।

হ্যারি আবার চারদিকে তাকালো। মনে হলো অনেকেই ঘাবড়ে গেছে এতো তাড়াতাড়ি এপারেট করতে বলায়।

দুই…

হ্যারি ওর বৃত্তের দিকে মনোসংযোগ করার চেষ্টা করলো। ও বেমালুম তিন ডির কথা ভুলে গেছে।

তিন!

কেউ ধপাস করে পড়ে গেলো, কেউ কাত হয়ে পড়লো। হ্যারির অবস্থা অন্যদের মতোই। সমস্ত হলটায় শিক্ষার্থীদের টলটলানিতে পূর্ণ হয়ে গেলো।

নেভিলে চিৎপটাং, এরনি ম্যাকমিলান অন্যদিকে হুপের মধ্যে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে লাফ-ঝাফ করছে। মুখ দেখে মনে হয় খুব রোমাঞ্চিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ডিন থমাসকে ওর দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে দেখে থেমে গেলো।

টুইক্রশ বললো, ঠিক আছে… সব ঠিক আছে… প্রথম প্রচেষ্টা এরকমই হবে। আবার তোমরা যে যার বৃত্তের মধ্যে দাঁড়াও।

দ্বিতীয় প্রচেষ্টা প্রথম প্রচেষ্টার মতোই হলো, ভালো কিছু বলা যায় না। তৃতীয়টাও তাই। চতুর্থটাও এমন কিছু নয়। ভীষণ যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শুনে সকলেই দেখলো হাফপাফের সুসান তার হুপের মধ্যে টলমল করছে। বাম পা টা ও যেখান থেকে শুরু করেছিল (পাঁচফিট দূরে) সেখানে পড়ে আছে।

হাউজের প্রধান দৌড়ে এসে সুসানকে উদ্ধার করলেন। সুসানের চারদিকে তখন বেগুনি ধোঁয়াতে ভরে গেছে, সেই সঙ্গে শব্দ। ধোয়া পরিষ্কার হয়ে গেলে সকলে দেখলো সুসান ভয়ে থর থর করে কাঁপছে আর হাউমাউ করে কাঁদছে। পা দুটো তো ঠিক হলো, কিন্তু ওর কান্না থামলো না।

শিক্ষক টুইক্রশ বললেন, শরীরের বিভিন্ন অংশ খণ্ডিত হয়ে যায় যদি মনের দৃঢ়তা কম হয়। তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে যাবার জন্য লাগাতার মনোসংযোগ করবে, এবং কোনো তাড়াহুড়ো না করে মুভ করবে; কিন্তু বিচক্ষণতার (ডেলিবারেসনের) সঙ্গে, অতএব…।

কথাটা বলে টুইক্রশ দুহাত মেলে এগিয়ে গিয়ে রোবটাকে দোলাতে দোলাতে অদৃশ্য হয়ে আবার হলে ফিরে এলো।

মনে রাখবে তিন ডির কথা, টুইক্রশ বললেন, হ্যাঁ আবার তোমরা চেষ্টা করো। স্টার্ট এক… দুই… তিন।

এক ঘণ্টা ধরে চললো সুসানের শরীর থেকে পা ছিন্ন হবার ব্যাপারটা। টুইক্রশ তার জন্য একটুও হতাশ হয়েছেন বলে মনে হলো না। হল ছেড়ে যাবার আগে বললেন, তাহলে আবার আসছে শনিবার তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। তবে তিনটে ডির কথা মনে রাখবে… ডেস্টিনেসন, ডিটারমিনেসন, ডেলিবারেসন।

তারপর হাতের জাদুদণ্ড দোলাতেই সব হুপগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলে প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের সঙ্গে হল ছেড়ে চলে গেলো।

আবার কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো। হলের সকলে এনট্রেন্স হলের দিকে চললো।

হ্যারির দিকে এগিয়ে গিয়ে রন জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেমন করেছো?

আর আমি শেষবার যখন চেষ্টা করেছিলাম… পায়ের তলায় অসম্ভব ব্যাথা লেগেছিল।

আমার মনে হয়েছিলো তোমার প্রশিক্ষক আরো ছোট হবে, ওন… ওন!

হারমিওন বলে ভেংচি কেটে চলে গেল।

হ্যারি বললো, আমার তো তেমন অনুভব হয়নি। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

তুমি কী বলছো, যায় আসে না? তুমি এপারেট করা শিখতে চাও না? রন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললো। হতেই পারে না।

আমি ফাজলামো করছি না, আসলে আমি উড়তে চাই, হ্যারি বললো। পেছন ফিরে দেখলো ম্যালফয় কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা বলে রনকে বললো, তাড়াতাড়ি চলো ম্যালফয়কে ধরতে হবে। একটা কিছু করার আমার ইচ্ছে আছে।

রন ব্যাপারটা কিছু বুঝতে না পেরে হ্যারির সঙ্গে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। মাঝপথে পিভস ওদের আটকে দিলো। পাঁচতলার দরজা আটকে রাখলো। বললো, প্যান্টে আগুন না লাগালে দরজা খুলবো না। হ্যারি, রন সেখান থেকে সরে গিয়ে তাদের পরিচিত শর্টকার্ট পথ ধরলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা পোর্ট্রেট হোলে চলে এলো।

আমরা কি করতে যাচ্ছি? রন হাঁফাতে হাঁফাতে বললো।

হ্যারি রনকে নিয়ে ওদের কমন রুমে ঢুকলো। সেখান থেকে ছেলেদের সিঁড়ি দিয়ে ওদের ডরমেটরিতে গেলো। ডরমেটরি ফাঁকা… হ্যারি ট্রাঙ্কটা টেনে নিয়ে ডালা খুলে জিনিসপত্র ঘাঁটতে লাগলো। রন ওর কাণ্ডকারখানা অধৈর্য হয়ে দেখতে লাগলো।

ম্যালফয় আমার বিরুদ্ধে ক্রাবে আর গোয়েলকে লাগিয়েছে। একটু আগে ও ক্রাবের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিলো, ওরা কি করবে জানার দরকার… আহ…।

হ্যারি একটা কিছু না লেখা পার্চমেন্ট হাতে নিয়ে ওর দণ্ড ছোঁয়ালো। আমি ম্যালফয়কে দেখে নেবো, আর ওকে ছাড়ছি না।

মুহূর্তের মধ্যে ওর হাতের পার্চমেন্টের ওপর মারাওডার্স ম্যাপটা এসে পড়লো। ওই ম্যাপে ক্যাসেলের মধ্যে যা যা রয়েছে তারা কোথায় ঘুরছে ফিরছে কালো একটি বিন্দু সেটা জানিয়ে দেয়। ছোট অথচ স্পষ্ট কালো বিন্দু।

এই এদিকে এসো… ভালো করে দেখো ম্যালফয় এখন কোথায় রয়েছে, হ্যারি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললো।

ম্যাপটা ওরা বিছানার ওপর পেতে ঝুঁকে পড়ে ম্যালফয় কোথায় রয়েছে খুঁজতে লাগলো।

এইতো ওরা! সে তো স্নিদারিনদের কমনরুমে, দেখ… পার্কিনসন ও জাবিনি এবং ক্রাবে ও গোয়েলকেও দেখছি…. রন বললো।

এখন থেকে আমি ওর ওপর চোখ রাখবো, হ্যারি দৃঢ় স্বরে বললো। যখনই আমি ওকে ক্রাবে আর গোয়েলের সঙ্গে ঘুরতে দেখবো তখন অদৃশ্য হবার রোব পরে ওর পিছু নেবো, দেখবো ও কি বলছে, কি করছে। আমাকে জানতেই হবে!

নেভিল ঘরে ঢুকতেই হ্যারি ম্যাপটা গুটিয়ে রাখলো। দেখলো ওর প্যান্টটা পুড়ে গেছে। ও ট্রাঙ্ক থেকে নতুন প্যান্ট বের করে পরলো।

ম্যালফয়কে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেও হ্যারি ওকে পরবর্তী দুসপ্তাহের মধ্যে ধরতে পারলো না। যখনই সময় পেলো তখনই ম্যাপটা খুলে কোথায় রয়েছে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। মাঝে মাঝে লেসন ছেড়ে বাথরুমেও ঢু মারতে লাগলো ওকে খোজার জন্য। কিন্তু কোথাও ম্যালফয়কে সন্দেহজনকভাবে ঘুরতে ফিরতে দেখতে পেলো না। ম্যালফয়কে না পেলেও ক্রাবে আর গোয়েলকে ক্যাসেলে একটু যেনো বেশি মাত্রায় ঘুর ঘুর করতে দেখলো, কখনো জনমানব শূন্য করিডরে দেখলো চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে; কিন্তু ম্যালফয় ওদের ধারে কাছে নেই, ম্যাপেও ওর হদিস পাওয়া গেলো না। খুবই রহস্যজনক ব্যাপার সন্দেহ নেই। হ্যারির মনে হলো ম্যালফয় নিশ্চয়ই স্কুলের মাঠে কোথায় লুকিয়ে আছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব; ক্যাসেলের ভেতর তো কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা। আবার ভাবলো, ম্যাপে অনেক অনেক কালোবিন্দুর মধ্যে হয়তো ম্যালফয়কে দেখতে পাচ্ছে না। আবার এমনও হতে পারে ওরা যে যার তালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট বেলায় একসঙ্গে চলাফেরা করতো। এখন বড়ো হয়েছে তাই নিজেদের খুশিমতো থাকে। যেমন রন আর হারমিওন ওরাও তো এখন বিচ্ছিন্ন।

দেখতে দেখতে মার্চ মাস এসে গেলো। আবহাওয়ার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। একটাই পরিবর্তন ঘন কুয়াশা আর তুষারপাতের বদলে দিনরাত ঘূর্ণিঝড়ের মতো কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আর বাতাসে আর্দ্রতা।

তবে একটা পরিবর্তনে ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব ক্ষিপ্ত হলো। প্রত্যেকটি কমনরুমের নোটিশবোর্ডে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামী হগসমিডের ট্রিপ বাতিল করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হলো রন।

ওই দিন আমার জন্মদিন, ও বললো। কতোদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি এই দিনটির জন্য, ধ্যাৎ সব ভণ্ডুল হয়ে গেলো।

এটা রাগ করার ব্যাপার নয়, কোনো বিস্ময়ের বিষয়ও নয়, কেটির ব্যাপারটা মনে আছে তো? হ্যারি বললো।

কেটি তখনো সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে পড়ে আছে। এছাড়া ডেইলি প্রফেটে হোগার্টসের ছাত্রছাত্রীদের নিকট আত্মীয়-স্বজনদের অন্তর্ধানের খবর ছাড়াও অন্যদের অন্তর্ধানের খবর ছাপা হচ্ছে প্রায়ই।

এখন তো আমাদের সে-ই ফালতু এপারেসনের প্রশিক্ষণ নিতে হবে, এছাড়া আর কি আছে! রন মুখ ভার করে বললো। আমার জন্মদিনের বিরাট ভোজ।

তিন তিনটে লেসন হয়ে যাবার পরও একই রকম সমস্যা প্রায় সকলের, তবে এর মধ্যে দুএকজন ছেলে মেয়ে, কিছুটা আয়ত্ত করেছে। হতাশ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক… তাছাড়া টুইক্রশের তিন-তিনটে ডির ব্যাপারতো আছেই। সেই ডি নিয়ে অনেক কৌতুক হচ্ছে তার মধ্যে পরিশিলীত হলো–ডি মানে ডগ ব্ৰিথ (কুকুরের নিঃশ্বাস) এবং ডাংগ হেড। ওই দুটি লেখা যায়, বাকি সব অশ্রাব্য।

শুভ জন্মদিন রন, মার্চের পয়লা তারিখে হ্যারি ঘুম থেকে উঠেই বললো। তখন সিমাস ও ডিন ভিষণ শব্দ করে ব্রেকফাস্ট খেতে গেল। নাও তোমার জন্মদিনের উপহার। বলেই হ্যারি একটা প্যাকেট রনের বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। তার আগেই অনেক উপহার রন পেয়েছে, সেগুলো দেখলো ওর খাটের ওপর ছড়ানো। খুব সম্ভব রাতের বেলায় গৃহ ডাইনীরা দিয়ে গেছে। রন ঝিমুতে ঝিমুতে বললো, চিয়ার্স। রন প্যাকেটটা খুলছে তখন হ্যারি ট্রাঙ্ক থেকে ম্যাপটা গোটানো মোজার ভেতর থেকে টেনে বার করলো। প্রতিবার ব্যবহারের পর হ্যারি ম্যাপটা ট্রাঙ্কে সযত্নে রেখে দেয়। তবুও সেটা অনেক জিনিসের তলায় লুকিয়ে রাখার জন্য খুঁজে পেতে সময় লাগে। ট্রাঙ্কের মধ্যে তখনো ও লাকি পোশান ফিলিক্স ফিলিসিস রেখে দিয়েছে।

ঠিক আছে, হ্যারি রনের বিছানায় বসে ম্যাপটা খুলতে খুলতে খুব চাপা গলায় বললো। বিশ্বাস করো, অনেক চেষ্টা করেও কিছু এগোতে পারছি না। ও কথাটা এতো আস্তে বললো যে নেভিল ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেও শুনতে পেলো না।

হ্যারি ওকে একজোড়া কিডিচ কীপার্স দস্তানা উপহার দিয়েছে। রন দস্তানা দুটো দোলাতে দোলাতে বললো, দারুণ হ্যারি!

ঠিক হবে তো… সমস্যা নেই, হ্যারি অন্যমনস্ক হয়ে বললো। ওর চোখ তখন ম্যাপের স্নিদারিন ডরমেটরির দিকে। ম্যালফয় ওখানে থাকতে পারে। আমার মনে হয় এখনো ও আর ঘরে শুয়ে নেই।

রনের ওদিকে হ্যারির কথা শোনার সময় নেই। বিছানায় বসে একের পর একটা প্যাকেট খুলে জন্মদিনে পাঠানো উপহার দেখে আনন্দে আত্মহারা।

এইবার দারুণ দারুণ অনেক উপহার পেলাম। এই দেখ, বাবা-মা এই সুন্দর ঘড়িটা পাঠিয়েছেন। সোনার ঘড়ি… চারধারে ছোট ছোট তারা, কিম্ভুতকিমাকার সব দৃশ্যমান চিহ্ন… কাটা নেই। মনে হয় আগামী বছর আর পাবো না।

শান্ত হও, হ্যারি ম্যাপের দিকে চোখ রেখে বললো। দেখছি গ্রেট হলের টেবিলের আশপাশে নেই, তাহলে কোথায় আছে ম্যালফয়? তাহলে কি ব্রেকফাস্টে গেছে… স্নেইপের কাছেও তো নেই। উনি তো দেখছি স্টাডিতে বসে রয়েছেন। হাসপাতালে, বাথরুমেও নেই, গেলো কোথায়?

রন এক বাক্স কলড্রন চকলেট হ্যারির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, নাও।

ধন্যবাদ, হ্যারি চকলেট নিলো না। ম্যাপের দিকে চোখ রেখে বললো, আবার কোথায় গেলো?

পাবে না বন্ধু, রন একটা চকোলেট মুখে পুরে বললো। তারপর বিছানা থেকে উঠে বাইরে যাবার জন্য জামাকাপড় পরলো। চলো, তাড়াতাড়ি চলো। ব্রেকফাস্ট মিস করলে খালি পেটেই অ্যাপারেট করতে হবে… হয়তো খালিপেট থাকলে সহজ হবে, কি বলো?

রন চকোলেটের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আরো একটা চকোলেট তুলে নিয়ে মুখে পুরলো। এই নিয়ে ও তিনটে চকোলেট খেলো।

হ্যারি ওর জাদুদণ্ডটা ম্যাপে দেখিয়ে বললো, মহা চালাক, ধূর্ততার সঙ্গে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার তা নাও হতে পারে। অনেক সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে ও বাইরে যাবার জন্য ড্রেস পরে নিলো। ম্যালয়ের মাঝে মাঝে অন্তর্ধানের একটা অজুহাত বা সম্ভাবনা থাকতে পারে; কিন্তু সেটাই কেন এবং কোথায় যেতে পারে ওর মাথায় ঢুকছে না। সবচাইতে ভালো হবে ওকে দেখতে পেলে ওর পেছনে পেছনে যাওয়া, কিন্তু অদৃশ্য হবার ক্লোক না পরলে সেটা সম্ভব নয়। সেটাও এখন সম্ভব নয়… একটু পরই অ্যাপারেট ক্লাস শুরু হবে… তাছাড়া কিডিচ প্র্যাকটিস, হোমওয়ার্ক তো আছেই। সময় কোথায়? তাছাড়া ক্লাশের পড়া ছেড়ে ওর পিছু পিছু ঘুরাও সম্ভব নয়। খাতায় অনুপস্থিত মার্ক হবে!

রেডি চল, চল? ও রনকে বললো।

কপা এগোবার পর দেখলো রন তার খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা জানালার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

রন, ব্রেকফাস্ট খাবে না? আমার ক্ষিদে নেই। হ্যারি ওর দিকে আবার তাকালো। আরে, এই না তুমি ব্রেকফাস্ট খাওয়ার কথা বললে? ঠিক আছে, চলো যাই, তবে আমার কিছু খাবার ইচ্ছে নেই।

হ্যারি রনকে ভাল করে দেখলো।

এই মাত্র তো তুমি আধ-বাক্স চকোলেট গলায় পুরেছো, ক্ষিধে না থাকাই স্বাভাবিক।

রন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, তা নয়… তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।

পারছি, হ্যারি বললো। না বোঝার কোনো কারণ নেই, হ্যারি ঘরের দরজাটা খোলার জন্য হাত বাড়ালো।

হ্যারি! রন একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বললো।

কী হলো?

হ্যারি, আমি সহ্য করতে পারছি না? হ্যারি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। রনের মুখ চোখ ফ্যাকাশে, দেখে মনে হলো হঠাৎ ও খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

আমি ওর কথা না ভেবে থাকতে পারছি না, রন ধরাধরা গলায় বললো। হ্যারি রনের মুখের দিকে তাকালো। ও রনের মুখ থেকে ওইরকম কথা শোনার আশা করেনি। ওরা বন্ধু হতে পারে, কিন্তু রনের মুখে সবসময়ে ল্যাভেন্ডারকে ল্যাভ ল্যাভ বলে ডাকা ও একটুও পছন্দ করে না।

তার জন্য তুমি ব্রেকফাস্ট খাবে না কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। ওর মাথার মধ্যে সাধারণ বুদ্ধি গোজবার চেষ্টা করলো।

আমার মনে হয় ও আমার অস্তিত্বের কথা ভুলে গেছে, রন উন্মত্ত ভঙ্গিতে বললো।

ও খুব ভালো করেই জানে তুমি আছো, হ্যারি বললো। ও তোমার সঙ্গে ছলনা করতে আরম্ভ করেছে তাই না?

রন চোখ পিট পিট করলো। তুমি কার কথা বলছো? কার কথা বলছি মানে? আলোচনা বন্ধ করার জন্য বললো ও।

রোমিলদা ভানে, রন নরম সুরে বললো। নামটা বলতে ওর সমস্ত চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যেনো ওর মুখে ভোরের সূর্যালোক আনন্দে উপচে পড়েছে।

ওরা পরস্পরের মুখের দিকে প্রায় মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলো। হ্যারি নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, ঠাট্টা… তুমি ঠাট্টা করছো?

হ্যারি, আমার মনে হয় আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি, রন জড়িত কণ্ঠে বললো।

খুব ভালো, হ্যারি রনের উদ্ভাসিত চোখ মুখ আরো ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে গেল। ঠিক আছে, কথাটা মুখ নিচু করে নয় মুখ উঁচু করে বলো।

রন আবার বললো, হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবাসি। তুমি কী ওর চুলগুলো দেখেছো? কালো চকচকে রেশমের মতো চুল… আর ওর চোখ? ওর গভীর বড়ো বড়ো চোখ দুটো? আর ওর…।

সত্যি তুমি এখন হাস্যকর কথা বলছো, হ্যারি অধৈর্য হয়ে বললো। ওসব তামাশার কথা এখন বাদ দাও, ঠিক আছে?

হ্যারি ঘর ছেড়ে যাবার জন্য এগিয়ে গেলো, তখন ওর ডান কানের কাছে কেউ সজোরে আঘাত করলো। দেখলো রন দ্বিতীয় ঘুষিটা মারার জন্য মুঠো বন্ধ করে রয়েছে।

হ্যারি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে ওর জাদুদণ্ডটা বের করলো। একটুও দ্বিধা না করে বললো, লেভিকরাপস।

রনের পা দুটো ওপরে আর মাথা নিম্নমুখী হয়ে গেল। ওর রোবস নিচে ঢলে পড়লো। ও অসহায়ভাবে দুলতে লাগলো।

হ্যারি বললো, আমাকে তুমি হঠাৎ কানের পাশে ঘুষি মারলে কেন?

তুমি, ওকে অপমান করেছো হ্যারি। তুমি বললে তামাশা! রন ঝুলতে ঝুলতে চিৎকার করে বললো। ওর শরীরের সব রক্ত মুখে নেমে এসেছে। মুখটা লাল হয়ে গেছে।

তুমি পাগলামী করছো! হ্যারি বললো।

হ্যারি তারপর রনের বিছানার ওপর ছড়ানো খোলা বাক্সগুলো দেখলো। এখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।

তুমি কোথা থেকে কলড্রন চকোলেট পেয়েছো?

রন খুব জোরে জোরে বললো, আমার জন্মদিনের উপহার! শূন্য থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি তো তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম… চাইনি?

তুমিতো ওগুলো মেঝে থেকে তুলেছিলে, তোলনি?

না, আমার বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিলো, আমাকে এবারে নামিয়ে দাও।

ওগুলো অবশ্যই তোমার বিছানা থেকে পড়ে যায়নি, তুমি মিথ্যে বলছো ভালো করেই জানো। ওগুলো ছিলো আমার, আমি ম্যাপটা বার করার সময়ে ট্রাঙ্ক থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। ওগুলো চকোলেট কলড্রন। রোমিলদা আমাকে ক্রিসমাসের আগে দিয়েছিলো, সবগুলোই লাভ পোশানে মাখানো…।

একটি মাত্র শব্দ রনের মাথায় ঢুকলো।

রোমিলদা? ও বললো। তুমি রোমিলদা বললে না? হ্যারি তুমি কি ওকে চেনো? আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে?

হ্যারি ঝুলন্ত রনকে দেখলো। ওর মুখে দারুণ আশার ছাপ, ভীষণ জোরে হাসতে চেষ্টা করলো। ওকে নামিয়ে আনার কথা ভাবলো। কিন্তু পোশানের প্রতিক্রিয়া এখনো রয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেলে ওকে নামিয়ে আনা ঠিক হবে। হ্যারি তো ইচ্ছে করে ওকে মারেনি। হ্যারি জানে রনকে নামিয়ে আনলে আবার ও রোমিলদা ভানের প্রতি ওর ভালোবাসার কথা বলবে।

হা হা ঠিক, তোমার সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবো, হ্যারি বললো। বেশ এখন তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি।

ও রনকে নামিয়ে দিলো, হ্যারির কানটা তখনো দপদপ করছে। রন আবার হাসতে লাগলো।

সম্ভবত ও স্লাগহর্নের অফিসে আছে, হ্যারি দরজার কাছে যেতে যেতে বললো।

ওখানে কেন ও থাকবে? রন সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলো।

খুব সম্ভব ওখানে ও এক্সট্রা পোশানের লেসন নিচ্ছে, হ্যারি বানিয়ে বললো। আমি কি ওকে আমার সঙ্গে আসতে বলতে পারি? রন বললো। দারুণ বলেছে, হ্যারি বললো।

ল্যাভেন্ডার যে পোর্ট্রেট হোলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা হ্যারি দেখেনি। তুমি দেরি করে ফেলেছে ওন-ওন! ল্যাভেন্ডার রনকে দেখে বললো। আমি তোমার জাদিনে…।

তুমি এখন এখান থেকে যাও, রন বললো। হ্যারি আমাকে রোমিলদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছে।

কথাটা বলে রন ল্যাভেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল।

রনের খারাপ আচরণের জন্য ল্যাভেন্ডারকে দুঃখ প্রকাশ করতে পারলো না। হ্যারি। তার আগেই ল্যাভেন্ডার বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে চলে গেলো।

হ্যারি আশঙ্কায় ছিলো হয়তো প্রফেসর স্লাগহর্নকে তার ঘরে পাবে না… সম্ভবত ব্রেকফাস্ট করতে গেছেন; কিন্তু ঘরের দরজায় নক করতেই সাড়া দিলেন।

বললেন, হ্যারি এতো সকালে? আমি তো শনিবার সকালে অনেকটা সময় শুয়ে থাকি।

প্রফেসর আপনাকে সকালে এসে বিরক্ত করার জন্য খুবই লজ্জিত, হ্যারি একদমে কথাগুলো বললো। ওদিকে রন পায়ের আঙ্গুলের তলায় ভর দিয়ে স্লাগহর্নের ঘর দেখতে চেষ্টা করতে লাগলো। স্যার আমার বন্ধু রন ভুল করে লাভ পোশান খেয়ে ফেলেছে। আপনি কি স্যার ওকে এন্টিডট দিতে পারবেন? আমি অবশ্য ওকে মাদাম পমফ্রের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম… ভাবলাম সেখানে হয়তো সেরকম কিছু পাওয়া যাবে না। ওর অবস্থা খুবই খারাপ স্যার।

আমি তো মনে করি তুমিই ওকে ওইরকম কিছু একটা দিতে পারবে হ্যারি, তুমি তো একজন দক্ষ পোশানিয়র? স্লাগহর্ন বললেন।

হা স্যার, হ্যারি বললো। কিন্তু পেছন থেকে স্লাগহর্নের ঘরে ঢোকার জন্য রন ক্রমাগত কনুইয়ের ধাক্কা দিতে লাগলো হ্যারিকে। ও হ্যাঁ আমি তো লাভ পোশানের এন্টিডট বানাই না… বলতে পারেন কখনো বানাইনি, চেষ্টা করে বানাতে বানাতে রনের অবস্থা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।

রন মাঝখান থেকে বলে উঠলো, আমি ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না হ্যারি… নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে?

প্রফেসর স্লাগহর্ন বনের দিকে পেশাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যারিকে বললেন, যে পোশানটা ও খেয়েছে সেটা কি নতুন না পুরনো? পুরনো হলে ভুগতে হবে ওকে। যতো পুরনো হবে পোশানের শক্তি ততো বাড়বে।

আপনাকে সব কথা বলতে অনেক সময় নেবে স্যার, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো। রন যাতে ঘরে না ঢুকতে পারে তার জন্য প্রচণ্ডভাবে বাধা দিতে লাগলো। আজ ওর জন্মদিন প্রফেসর, হ্যারি অনুনয়ের সুরে বললো।

ঠিক আছে, ঠিক আছে ওকে ভেতরে আসতে দাও, স্লাগহর্ন বললেন। আমার ব্যাগে আছে, খুব অসুবিধাজনক অ্যান্টিডট নয়।

রন ঘরে ঢুকে যা-ইচ্ছে তাই কাণ্ডকারখানা করতে লাগলো। ঘরের সব জিনিসপত্র টেনে টেনে দেখতে লাগলো, টুলের ওপর দাঁড়ালো, হ্যারিকে পড়তে পড়তে জড়িয়ে ধরলো, বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, ওকেতো দেখিনি দেখেছি

কি?

ও এখন এখানে নেই, হ্যারি বললো। আড়চোখে দেখলো প্রফেসর শ্রাস্লাগহর্ন তার পোশান তৈরির কিট বার করে, এটা ওটা মিশিয়ে, ছোট একটা কাঁচের শিশিতে মিশ্রিত পদার্থ রাখলেন।

খুব ভালো, রন ব্যগ্রতার সঙ্গে বললো। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

দারুণ সুন্দর, স্লাগহর্ন সাধারণভাবে কথাটা বলে রনকে একটা গ্লাসে জলের সঙ্গে মিশিয়ে পোশানটা দিলেন। এখন এটা চট করে খেয়ে নাও। এটা টনিক, তোমার নার্ভ শক্ত করবে, ও যখন তোমার কাছে আসবে, এই পোশানটা তোমাকে শান্ত করে রাখবে… বুঝলে?

দারুণ, রন অ্যান্টিডটটা চুক চুক শব্দ করে এক চুমুকে শেষ করে দিলো।

হ্যারি আর স্লাগহর্ন রনকে দেখতে লাগলেন। রন ক্ষণিক ওদের দিকে তাকালো, তারপর খুব ধীরে ধীরে। ওর হাসি থেমে গেলো। চোখ মুখের চেহারা স্বাভাবিক হয়ে এলো।

মনে হয়, স্বাভাবিক হয়ে আসছে, হ্যারি হাসতে হাসতে বললো। স্লাগহর্ন মৃদু চাপা হাসলেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রফেসর।

ওসব বলো না, আমার প্রিয় পুত্র, স্লাগহর্ন বললেন। রন একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো। ওকে দেখে মনে হয় সবকিছু ওর ধ্বংস হয়ে গেছে। স্লাগহর্ন রনকে দেখে বললেন, এখন ওর দরকার কিছু উত্তেজক জিনিস। তারপর ব্যস্ত হয়ে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। টেবিলে সাজানো রয়েছে নানারকমের ড্রিঙ্কস। আমার কাছে আছে বাটার বিয়র, ওয়াইন, ওক ম্যাচিওর্ড মীড (মধু দিয়ে তৈরি মদ)।

ওটা অবশ্য ডাম্বলডোরকে ক্রিসমাসে দেবো ভেবেছিলাম। তা দেওয়া হয়নি, স্লাগহর্ন শ্রাগ করলেন। যা তিনি পাননি সেটা হারাবার কথা না। তাহলে দেওয়া যখন হয়নি তখন ওটা খুলে মি. উইসলির জন্মদিন পালন করা যাক। ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা নিরাময়ে এর চাইতে বড় ওষুধ কি থাকতে পারে বলো?

স্লাগহর্ন হাসলেন, হ্যারিও হাসলো।

স্লাগহর্নের কাছ থেকে সত্য মেমরি বের করার জন্য যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিল, তারপর বলতে গেলে এই প্রথম সে একা স্লাগহর্নের মুখোমুখি হলো।

হ্যারি ভাবলো, দ্বিতীয়বার সেই চেষ্টাটা করলে কেমন হয়। বিশেষ করে যখন মীড পান করার পর দারুণ সুন্দর মেজাজে থাকবেন।

স্লাগহর্ন, হ্যারি ও রনকে মীডের গ্লাস দিয়ে হাত তুলে বললেন, চিয়ার্স… হ্যাপি বার্থ ডেরালফ।

রন, হ্যারি ফিসফিস করে শুধরে দিয়ে বললো।

কিন্তু রন, মনে হয় না ওর কানে কিছু যাচ্ছে। হ্যারি ও স্লাগহর্নের শুভ কামনার টোস্ট শেষ হবার আগেই ও মীড মুখের মধ্যে নিয়ে গিলে ফেললো। এক সেকেন্ড… বা তারও কম, একটা হার্ট বিটের চেয়েও কম। হ্যারির মনে হলো দারুণ একটা ভুল হয়েছে… স্লাগহর্ন নিশ্চয়ই জানতেন না।

এই দিনটা তোমার জীবনে বার বার ফিরে আসুক…। রন!

রনের হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেছে… চেয়ার থেকে সামান্য একটু উঠেই ও পড়ে গেলো, প্রবলভাবে কাঁপতে লাগলো, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতে লাগলো। দুটো চোখ কোটর থেকে ছিটকে যেনো বেরিয়ে আসতে চাইছে।

হ্যারি আর্তনাদ করে উঠলো, প্রফেসর একটা কিছু করুন।

কিন্তু আচমকা রনের ওই অবস্থা দেখে স্লাগহর্ন যেনো অবশ হয়ে গেছেন। রন হেঁচকাতে লাগলো, দম যেনো ওর বন্ধ হয়ে আসছে, গায়ের চামড়ার রঙ নীল হয়ে গেছে।

স্লাগহর্ন অস্পষ্টভাবে বললেন, কেন… কি হয়েছে… কিন্তু…।

হ্যারি একটা নিচু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে স্লাগহর্নের পোশানের কিট হাতে নিয়ে তার ভেতর থেকে জার, পাউচ টেনে বার করলো, রন তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর… গলা দিয়ে ঘর ঘর শব্দ বেরিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত হ্যারি যেটা চেয়েছিলো সেটা খুঁজে পেলো। সেই শুষ্ক কিডনির মতো পাথরটা যেটা স্লাগহর্ন পোশানের জন্য ওর কাছ থেকে নিয়েছিলেন।

ওটা হাতে নিয়ে ও রনের কাছে গিয়ে বন্ধ মুখটা জোর করে খুলে বেজোয়ারটা মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তারপরই রন প্রবল ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠলো… ওর দেহটা অসার হয়ে গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *