১১. হারমিওনস হেল্পিং হ্যান্ড

১১. হারমিওনস হেল্পিং হ্যান্ড

হারমিওন যা অনুমান করেছিলো সেটাই প্রমাণিত হলো, সিক্সথ ইয়ারে ফ্রি পিরিয়ড আসলে অবসর নয়। রন প্রথমে যা ভেবেছিলো, প্রতিদিনের ক্লাশে যে হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় ফ্রি-পিরিয়ডে সে কাজগুলো তাদের করতে হয়। তাছাড়া প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে। ম্যাকগোনাগল ক্লাশে যা পড়ান হ্যারি তার খুবই সামান্য বুঝতে পারে। হারমিওন অত্যন্ত সিরিয়স তাই বুঝতে না পারলে হাত তুলে আবার বলার জন্য অনুরোধ করে। একবার নয়, কখনো কখনো দুবার সে বলতে অনুরোধ করে। অবিশ্বাস্য, হারমিওনের অসম্ভষ্টির মধ্যেও হ্যারির সবচেয়ে মনোমতো সাবজেক্ট হয়ে গেছে পোশান… হাফ-ব্লাড প্রিন্সকে ধন্যবাদ।

ভার্বাল স্পেলস শুধুমাত্র ডাকআর্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নয়, চার্মস ও ট্রান্সফিগারেশনের জন্যও এখন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। হ্যারি কমনরুমে অথবা খাবার সময়ে ক্লাসের বন্ধুদের লক্ষ্য করে। তাদের মুখাবয়ব রক্তবর্ণ ও নীলাভ। মনে হয় তাদের যেন ইউ-নো-হুর ব্যাপারে বড়ো বেশি ভারাক্রান্ত সকলে। সে জানে তারা নিশব্দে জাদুমন্ত্র প্রয়োগের দারুণ চেষ্টা করে চলেছে। তারা এখন হারবোলজিতে বিপজ্জনক গাছ-গাছরা নিয়ে কাজ করছে। গ্রিন হাউজে হারবোলজির কাজ করার সময় যখন বিষাক্ত টেনটেকুল পেছনে থেকে তাদের অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরে, তখন নিজেদের মুক্ত করার জন্য উচ্চস্বরে অভিশাপ দেওয়ার অনুমতি যে তাদের দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই স্বস্তিদায়ক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নানা কাজ, হোমওয়ার্ক, নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাওয়া, পড়াশুনার পর হারমিওন, রন, হ্যারি একটুও সময় পায় না হ্যাগ্রিডের কাছে যাবার। ইদানিং হ্যাগ্রিড স্টাফ টেবিলে বসে খেতে আসা বন্ধ করছেন, কারও সঙ্গে বেশি কথাও বলেন না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার কদাচিৎ করিডরে ওদের দেখলে কথাতো বলেনই না, উপরন্তু এমনভাব করেন যেনো ওদের দেখেননি। এমন কী সামান্য হ্যালোও বলেন না। শনিবার ব্রেকফাস্টের সময় স্টাফ টেবিলে হ্যাগ্রিডকে না দেখতে পেয়ে হারমিওন বললো, আমাদের কিন্তু এর কারণ জানার জন্য হ্যাগ্রিডের কোয়াটারে একবার যাওয়া উচিত।

রন বললো, তা কি করে হবে বলো, শনিবার আমাদের কিডিচ টিম নির্বাচন আছে। ফ্লিট উইকের জন্য আগামেন্টি চার্ম প্রাকটিসের দরকার। আর তা ছাড়া তাকে কি বলবো! বলবো যে তোমার সাবজেক্ট আমাদের পছন্দ নয়। আমাদের ওর বিষয়টি খুব অস্বছন্দেরও নয়, হারমিওন বললো।

তুমি তোমার কথা বলতে পারো, আমি কিন্তু টেস-এর কথা ভুলিনি, রন কালো মুখে বললো। আমরা কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে গেছি, তাছাড়া ওর নির্বোধ ভাইয়ের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। আমরা ওখানে থাকলে ওর সেই নির্বোধ ভাই গ্রুপকে কেমন করে জুতোর ফিতে বাঁধতে হয় তাও হয়তো শেখাতে হতো।

আমি হ্যাগ্রিডের সাথে কথা না বলাটা একদম পছন্দ করছি না, হারমিওন ব্যথিত চিত্তে বললো।

আচ্ছা আচ্ছা আমরা সবাই কিডিচ খেলার পরেই যাবো, হ্যারি হারমিওনকে আশ্বস্ত করলো। শুধু হারমিওন নয় ও নিজেও হ্যাগ্রিডের সঙ্গে দেখা হয় না বলে দুঃখিত। তবে গ্রুপের ব্যাপারে ও রনের সঙ্গে একমত, বিরক্তিকর গ্রপ ওদের ধারে কাছে না থাকলেই ভাল। কিন্তু ট্রায়াল নিতে নিতে তো সারা সকালটা কেটে যাবে। অনেক লোক আসবে, যারা যারা অ্যাপ্লাই করেছে। জীবনে ও প্রথম ক্যাপ্টেনসি করছে, তাই মুখে না বললেও, ভেতরে ভেতরে হ্যারি খুবই নার্ভাস।

ঈশ্বর জানেন, হঠাৎ এই কিডিচ খেলাটা কেন এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, হ্যারি বললো।

ওহো বাজে কথা ছাড়ো হ্যারি। আসলে কিডিচ খেলাটা বিষয় নয়, আসল বিষয় তুমি… তুমিই জনপ্রিয়, কিডিচ খেলা নয়। সত্যি বলতে কী, তুমি তো কখনো এতো আকর্ষণীয় ছিলে না, এটাই হলো আসল কথা। হারমিওন সামান্য অধৈর্য হয়ে বললো।

রন বড়ো করে একটা কিপারে কামড় দিলো। হারমিওন ওর দিকে একবার দলছুটের দৃষ্টি দিয়ে হ্যারির দিকে মুখ করে বললো

সকলেই জানে তুমি এক বর্ণও মিথ্যে বলছে না, তাই না? সারা জাদুকর সম্প্রদায় জানে, তুমি ঠিক বলছো ভোল্ডেমর্ট ফিরে আসছে… তুমি গত দুবছরে দুবার ওর বিরুদ্ধে লড়েছিলে, দুবারই তুমি বেঁচে ফিরে এসেছে। এখন তাই তোমাকে সকলে বলে দ্য চুজেন ওয়ান। বলতে পারো সবাই তোমার প্রতি

এখন ফেসিনেটেড, তুমি কি তা অনুভব করো না।

হ্যারির মনে হলো গ্রেট হলের ভেতরটা অসহ্য গরম। যদিও বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, হলের ছাদটিও ঠান্ডা।

মিনিস্ট্রির বিরোধিতা, তুমি অসত্য কথা বলে বেড়াচ্ছো, তুমি মিথ্যাবাদী ও ভারসাম্যহীন–আজ তুমি সে সব কে অতিক্রম করে এসেছে। যে দুবৃত্ত মহিলা তোমার রক্ত দিয়ে তোমাকে লিখতে বাধ্য করেছিলো সেই কাটা দাগ এখনও তুমি দেখাতে পারো, কিন্তু তুমি তোমার বিষয় থেকে সরে আসোনি থাকগে…।

মিনিস্ট্রিতে মগজগুলো আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিলো তার দাগ এখনও যায়নি, রন জামার হাতা গুটিয়ে হাতাটা দেখিয়ে বললো।

হারমিওন কিন্তু রনের কথায় কান দিলো না।

ডাক বিলি করা পেঁচা এসে গেছে। বৃষ্টি ভেজা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে এসে সকলের গায়ে ডানা ঝটপট করে ফোঁটা ফোঁটা জল ছিটোতে লাগলো। সকলেই আগের চেয়ে এবার অনেক বেশি চিঠিপত্র পেয়েছে। উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের খবর জানতে চান এবং আশ্বস্ত করতে চান যে তারাও ভাল আছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। টার্ম শুরু হওয়া থেকে হ্যারি কোনো চিঠিপত্র পায়নি। ওকে যে নিত্য চিঠি লিখতেন তিনি আর পৃথিবীতে নেই, তাহলেও আশা করে লুপিনের চিঠির। হয়তো লুপিন ওকে চিঠি লিখবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটাও লেখেননি। ও বিমর্ষ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলো ওর তুষার শুভ্র হেডউইগ ঘরে ঢুকে বাদামী-পেঁচাগুলোর ওপর দিয়ে পাক খাচ্ছে। হেডউইগ ওর টেবিলে মাঝারি আকারের চৌকো একটা প্যাকেটে ফেললো। ওদিকে রনকে একই রকমের একটা প্যাকেট দিলো ওর পেঁচা পিগউইজন। রনের মনে হলো পিগউইজন খুবই ক্লান্ত।

হ্যারি প্যাকেটে ফ্লাওয়ারিশ অ্যান্ডস বুটস থেকে পাঠানো নতুন একটি কপি অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং পেয়ে খুব খুশি। বইটা নিয়ে হাত তুলে বললো, দারুণ!

হারমিওন বইটা দেখে খুশিতে উপচে পড়ে বললো, তাহলে তো তুমি এখন সেই পুরনো ছেঁড়া খোড়া গাদাগাদা নোট লেখা বইটা ফেরত দিতে পারো।

তুমি পাগল হয়েছে? হ্যারি বললো। ওটা আমার কাছে থাকবে। শোনো ওই বিষয়ে আমি আগেই ভেবে রেখেছি।

হ্যারি পুরনো বইটা ব্যাগ থেকে বার করে ওর কভারে জাদুদণ্ড ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে বললো–ডিফিল্ডর, বলার সঙ্গে কভার খুলে পড়ে গেলো। নতুন বইটাতেও সেই রকম করলো, হারমিওন থ হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর ও নতুন বইয়ের মলাটটা পুরনো বইয়ের ওপর রেখে বললো–রিপারো, মলাট বদলে গেল। প্রিন্সের বইতে লেগে গেলো নতুন মলাট।

আমি স্লাগহর্নকে পুরনো মলাট দেওয়া নতুন বইটা দেবো–তখন তিনি কোন প্রশ্ন করবেন না। এর মূল্য নয় গেলিয়নস।

সব দেখে হারমিওনের মুখে কোন কথা নেই। ঠোঁট দুটো চেপে রইলো, মুখ দেখে মনে হয় খুবই রেগে গেছে। যা হ্যারি করলো তাতে ওর একটুও সমর্থন নেই। তারপরই তৃতীয় পেঁচা এসে ওর টেবিলের ওপোর এক কপি ডেইলি প্রফেট ফেলে দিলো। ও তাড়াতাড়ি পেপারটাকে খুলে প্রথম পাতায় চোখ বুলোতে লাগলো।

হারমিওন ডেইলি প্রফেট পেলেই রন ঠাট্টা করে বলে, কী হে কারও মৃত্যু সংবাদ আছে? একই প্রশ্ন কলের গানের মতো বলে যায়।

না, কিন্তু ডিমেন্টরদের আক্রমণ বেড়েছে, হারমিওন বললো। একজন অ্যারেস্ট হয়েছে।

চমৎকার, কে? হ্যারি বললো। ওর হঠাৎ বেল্লাট্রিকস লেস্টরেঞ্জের কথা মনে পড়ে গেলো।

স্ট্যান লেশানপাইক; হারমিওন বললো।

কে? হ্যারি হকচকিয়ে বললো। কার নাম বললে।

জনপ্রিয় উইজার্ডিংদের নাইট বাসের কন্ডাক্টর স্ট্যানলে শানপাইককে ডেথইটারদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্লাপহামের তার নিজ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গত রাতে মি. শানপাইককে (২১) আটক করা হয়…

শানপাইক একজন ডেথইটার? হ্যারি বললো। তিন বছর আগে ওই প্রাণ উচ্ছল ছেলেটির সঙ্গে রাতের বাসে প্রথম পরিচয় হয়েছিল হ্যারির। অদ্ভুত ব্যাপার।

এমনও হতে পারে যে ওকে বোধহয় ইমপেরিয়স কার্স করে রাখা হয়েছিল, রন বললো।

কাগজ পড়ে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না, হারমিওন বললো। মুখের সামনে ওর কাগজটা মেলা।

হারমিওন কাগজ থেকে মুখ না তুলে বললো, কাগজে লিখছে ও কিছু একটা পাবে। ও ডেথইটারদের গোপন পরিকল্পনার কিছু কথা বলছিলো। সেটা জানার পর ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

হারমিওন উদ্বিগ্ন মুখে তাকালো–যদি ইমপেরিয়স কার্স হয় তাহলে ও কেমন করে পাবে গিয়ে সেই গোপন প্ল্যান সম্বন্ধে কথা বলতে পারে, সম্ভব কি?

রন বললো, স্ট্যানলে মনে হয় বেশি কথা বলছিলো, বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলতে গিয়েই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। মনে আছে একবার এক ভিলায় আড্ডা দেবার সময় বলেছিলো যে সে ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হতে যাচ্ছে।

মন্ত্রণালয় দেখাতে চায় তারা কিছু একটা করছে, হারমিওন ভুরু কুঁচকে বললল। লোকেরা আতঙ্কিত–পার্বতী ও তার জমজ বোনকে ওদের বাবা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ইলোইজে মিডজেয়ন অনেক আগেই চলে গেছে। ওর বাবা ওকে নিয়ে গেছেন।

কি বললে! রন চোখ ঘুরিয়ে হারমিওনকে প্রশ্ন করলো। কিন্তু হোগার্টস ওদের বাড়ির চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ জায়গা! আমাদের অরর আছে, আরো অনেক একস্ট্রা প্রোটেকটিভ স্পেলস আছে, সবার ওপর আমাদের ডাম্বলডোর আছেন!

হারমিওন বললো, আমরা কি সব সময় তাকে পাবো বলে মনে হয় না? হারমিওন স্টাফ টেবিলের দিকে তাকালো, হাতে তখনও প্রফেট। তোমরা কি লক্ষ্য করেছো? গত সাতদিন হ্যাগ্রিডের মতো তিনিও তার চেয়ারে বসছেন না।

হ্যারি, রন দুজনেই স্টাফ টেবিলের দিকে তাকালো। হেডমাস্টার স্যারের চেয়ার সত্য সত্যই খালি। হ্যারি একটু চিন্তায় পড়লো, সত্যিই তো গ্যনটের ওখান থেকে ফেরার পর, আর ডাম্বলডোরের সঙ্গে ওর দেখা হয়নি গত এক সপ্তাহ।

আমার মনে হয় অর্ডারের কাজের জন্য স্কুলের বাইরে কোথায়ও গেছেন, হারমিওন চাপা গলায় বললো, আমি বলতে চাইছি ওনার অনুপস্থিতির কারণ গুরুতর কিছু হতেও পারে, তাই না?

হ্যারি বা রন কেউই কোনো জবাব দিলো না। কিন্তু হ্যারি জানে ওরা তিনজনেই এই কথাটাই ভাবছে। তাছাড়া গত পরশু আরো একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছে। হারবোলজি ক্লাশে খবর আসে হান্না অ্যাবটের মাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। খবরটা পেয়ে হান্না চলে যাবার পর থেকে আর ওকে পাওয়া যায়নি।

পাঁচ মিনিট পর ওরা গ্রিফিন্ডর টেবিল ছেড়ে এক সঙ্গে কিডিচ মাঠে চললো। ওরা ল্যাভেন্ডার আর পার্বতী পাতিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় হারমিওনের একটা কথা মনে পড়ে।

প্রফেট লিখেছে ওদের দুই বোনকে ওদের বাবা-মা হোগার্ট থেকে নিয়ে যেতে চান। হ্যারি দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ফিস ফিস করতে দেখতে পেয়ে অবাক হলো না। দুজনেই খুব চিন্তিত। কিন্তু যেটা অবাক করেছে, রন যখন ওদের খুব কাছাকাছি এসেছে, পার্বতী হঠাৎ ল্যাভেন্ডারকে কনুইয়ের খোঁচা দিতেই ল্যাভেন্ডার রনের দিকে তাকিয়ে তখন একগাল হাসলো। রন ওকে চোখ টিপলো, ওরই মতো হাসলো। ও হাঁটার সময় যেন গর্বে ফেটে পড়তে লাগলো। হ্যারি অনেক কষ্টে হাসি দমন করে এবং তার মনে পড়ে হ্যারির নাক ম্যালফয় ভেঙে দেবার পর রন ল্যাভেন্ডারের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত ছিলো। হারমিওন অবশ্য গম্ভীর মুখে। ওদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে স্টেডিয়ামের দিকে চললো। তখন বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, কুয়াশার সঙ্গে হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে। স্টেডিয়ামের কাছে এসে রন আর হ্যারিকে ছেড়ে বসার স্থানের সন্ধানে যায় হারমিওন। যাবার সময় রন বা হ্যারি কাউকেই গুড উইশেস জানিয়ে গেলো না।

হ্যারি যা ভেবেছিলো, বলতে গেলে পুরো সকালটাই ট্রায়াল দিতে পার হলো। গ্রিফিন্ডরের প্রায় অর্ধেক ছেলে অংশ নিতে এসেছে। প্রথম বর্ষের ছেলেরা সিলেকসনের জন্য স্কুলের পুরনো ঝাড়ু হাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেভেনথ-ইয়ারের ছাত্ররা সব ছেলে-মেয়েদের দিকে নিরুত্তাপ ভয় দেখানো চোখে দেখছে। ওদের মধ্যে একজন বেশ লম্বা-চওড়া মাথায় ঝাটার কাঠির মতো চুলওয়ালা, ছেলেটি হোগার্টস এক্সপ্রেসে হ্যারিকে দেখেছিলো।

ভিড়ের মধ্যে থেকে ছেলেটি বেরিয়ে এসে হ্যারির হাতে হাত মিলিয়ে বললো, আমাদের তো ট্রেনের ওল্ড স্লগি কমপার্টমেন্টে আগেই দেখা হয়েছে ক্যাপ্টেন। আমার নাম করম্যাক ম্যাকলেগেন।

গত বছরে ট্রায়ালে তুমি ছিলে? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। হ্যারির ওর ইয়া বড় দেহ দেখে মনে হলো ছেলেটি এক চুলও না সরলে কারও ফাঁকা জায়গা পেয়ে গোল দেওয়া অসম্ভব।

ছেলেটি বললো, গত বছর ট্রায়ালের সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম, বাজি ফেলে এক পাউন্ড ডক্সি এগ খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছিলাম।

ঠিক আছে তুমি ওই দিকটায় বসে অপেক্ষা করো, যেদিকে হারমিওন বসে রয়েছে হ্যারি ওকে সেদিকটা দেখালো।

হ্যারির কথাটা শুনে ম্যাকলেগেন বিমর্ষ হলো। হয়তো ভেবেছিলো দুজনেই ওল্ড স্যাগির প্রিয় বলে একটু আলাদা রকমের ট্রিটমেন্ট পাবে।

হ্যারি ঠিক করলো টিম সিলেকসনের আগে একটা বেসিক টেস্ট দরকার। যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা আবেদন করেছে তাদের দশজন করে এক একটা দল করলো। তাদের বললো, পিচের চারধারে ফ্লাই করো। নির্ণয়টা ভালো বলতে হবে। প্রথমবর্ষের ছাত্রদের থেকে প্রথম দশ জনের দল ফ্লাই করতে বললো। এর আগে ওরা কখনো ফ্লাই করেনি। ওদের মধ্যে একজন মাত্র কয়েক সেকেন্ড উড়তে পারলো এবং গোলপোস্টে ধাক্কা খেয়ে হকচকিয়ে গেলো।

দ্বিতীয় দল দশটি মেয়েকে নিয়ে। ওদের মতো বোকারাম কমই দেখেছে। হুইসেল বাজাতেই ওরা উড়তে তো পারলোই না, মাঠেই জড়াজড়ি করে পড়ে গেলো। হ্যারি তখন ওদের মাঠ ছেড়ে চলে যেতে বললে ওরা খুশি মনেই স্ট্যান্ডে গিয়ে বসে অন্যদের পেছনে লাগা শুরু করলো।

তৃতীয় দলের সেই একই অবস্থা। চতুর্থ দলের তো কেউ ঝাড়ু আনেইনি। হাফল পাফদের নিয়ে পঞ্চম দল।

হ্যারি বললো, এখানে যদি গ্রিফিন্ডর ছাড়া অন্য হাউজের কেউ থাকে তাহলে তারা মাঠ ছেড়ে যাও। এখনই প্লিজ! শেষ বাক্যটি নির্দেশের স্বরে।

প্রথমে সকলেই চুপচাপ, তারপর দুএকজন র‍্যাভেনকু হাসতে হাসতে লাফাতে লাফাতে পিচ ছেড়ে চলে গেলো।

তারপর ট্রায়ালের ঘণ্টা দুই সময় খুব হৈ চৈ হট্টগোল, কেউ আছড়ে পড়লো, হাত-পা মোচকালো, দাঁত ভাঙলো, আরো অনেক কাণ্ড। সবই হ্যারিকে সামলাতে হলো।

হ্যারি তিনজন ভালো চেজার পেলো। কেটিবেল, ডেমেলজা রবিন্স আর জিনি উইসলি। জিনি ট্রায়ালে একাই সতেরটা গোল করলো। ডেমেল দলে নবাগত। কেটিবেল আগেও খেলেছে।

হ্যারি এক সময় যা নিজেও করেছে, এখন অনুত্তীর্ণ বিটারদের কাছ থেকে নানা চিৎকার অভিযোগ শুনতে হলো।

তোমরা কোনোরকম হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি না করে মাঠ ছেড়ে চলে যাও। আর তা করলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। নির্দেশের স্বরে হ্যারি বললো।

নতুন বিটারের মধ্য থেকে কেউ জর্জ ফ্রেডের কাছাকাছি পৌঁছতে পারলো না। ওরা ছিলো সেরা বিটারস। তাহলেও নতুন যারা এলো তাদের খেলায় হ্যারি খুবই খুশি হলো। নতুনের মধ্যে ব্রাজার রিচি কূট। ওরা কেটি, ডেমেল আর জিনির সঙ্গে যোগ দিলো।

হ্যারি ইচ্ছে করেই কীপার সিলেকসন সবার শেষে রেখেছিলো। ভেবেছিলো স্টেডিয়াম প্রায় খালি হয়ে যাবে, আর চাপ সৃষ্টি কম হবে। দূর্ভাগ্যবসত: তা হলো না। ছাঁটাইরা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ করে ভিড় জমালো। হ্যারি রনের দিকে তাকালো। রনের একটাই প্রবলেম নার্ভের। গত বছরে খেলাতে জেতার পর হ্যারি ভেবেছিল রনের নার্ভের প্রবলেম মোটামুটি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা নয়, রন আগের মতোই নার্ভাস।

প্রথম পাঁচজনের কেউই কীপারস ট্রায়াল গেমে ভালো খেলতে পারলো না। কেউই দুটো গোলের বেশি বাঁচাতে পারলো না। হ্যারি হতাশ হলো, করম্যাক ম্যাকলেগেন পাঁচটা পেনাল্টির মধ্যে চারটে বাঁচাতে পেরেছে দেখে।

বোঝা গেলো রন এগার জনের মধ্যে একজন হয়ে যাবে ফাইনাল সিলেসনে। গুডলাক! কে যেন দর্শকদের থেকে বলে উঠলো। হ্যারি ভেবেছিলো হারমিওন হবে হয়তো। না সেটা ছিল ল্যাভেন্ডার ব্রাউন। ও ল্যাভেন্ডারকে দেখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে পারতো, ল্যাভেন্ডার অবশ্য পরমুহূর্তে তাই করলো। কিন্তু হ্যারি কিডিচের ক্যাপ্টেন, তা সে করতে পারে না, রনের ট্রায়াল খেলা দেখতে লাগলো।

না, রনকে নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই, ও পর পর সবকটা পেনাল্টি রুখে দিলো। হ্যারি ম্যাকলেগেনকে পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে দিলো রন ওকে হারিয়ে দিয়েছে। কথাটা শুনে ম্যাকলেগেনের মুখ ঝুলে পড়লো। সে দ্রুত সেখান থেকে সরে গেলো। ম্যাকলেগেন ওর পেছনে পেছনে গেল।

ওর বোন তো ঠিক মতো কিক করেনি, ম্যাকলেগেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে বললো। ম্যাকলেগেন টিমে রনের জায়গায় স্থান জোটানোর জন্য নাছোড়বান্দা। বললো, ওর বোন তো ওকে সহজ কিক দিয়েছে।

ওর বোনের কিকটায় সে প্রায় হারতে বসেছিলো, হ্যারি জবাব দিলো। তুমি চারটে বাঁচিয়েছো, রন বাঁচিয়েছে পাঁচটা। রন জিতেছে, অযথা তুমি বাজে কথা বলবে না, পথ ছাড় আমাকে যেতে দাও।

হ্যারি ভেবেছিলো হয়তো ম্যাকলেগেন ওর মুখে একটা ঘুষি মারবে। তার জন্য ও নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিল। কিন্তু ম্যাক সেরকম কিছুই করলো না। বদখত মুখ করে ঘোৎ ঘোঁৎ করতে করতে চলে গেলো। ভয় দেখানোর প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত ছিল অবশ্য।

হ্যারি পিছনে তাকিয়ে দেখলো নবগঠিত টিম ওর দিকে উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

খুউব… খুউব ভালো করেছো তোমরা… সকলেই সত্য সত্যই ভালো করেছো।

রন তুমি অসামান্য খেলেছো!

হ্যারির চোখ পড়ে গেলো স্টেডিয়ামের এক অংশে। দেখলে হারমিওন দুহাত তুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওদের দিকে ছুটে আসছে। ওদিকে ল্যাভেন্ডর পার্বতীর। হাত ধরে পিচ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওর মুখে বদমেজাজের ছাপ। রন যেনো খুশিতে ফেটে পড়ছে। ও নিজেকে আরো দীর্ঘকায় মনে করছে। ও নতুন টিমের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, হারমিওনের দিকেও।

হ্যারি প্রথম ফুল প্র্যাকটিস আগামী বৃহস্পতিবার ঠিক করলো। হ্যারি, রন, হারমিওন নতুন দলের সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হ্যাগ্রিডের কুটিরের দিকে চলতে লাগলো। আকাশ কালো মেঘে ভরা, তারই ফাঁক থেকে মাঝে মাঝে সূর্য মুখ দেখাচ্ছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়াও বন্ধ হয়েছে। হ্যারির তখন প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। ভাবলো হ্যাগ্রিডের কাছে গেলে অবশ্যই কিছু খেতে পাবে।

রন যেতে যেতে আনন্দের সঙ্গে বললো, আমি ভেবেছিলাম ফোর্থ পেনাল্টিটা বাঁচাতে পারবো না। ডেমেলজা ট্রিকি শট করেছিলো, লক্ষ্য করেছ। বলটা স্পিন করছিলো?

হারমিওন বললো, জানি জানি তোমাকে আর বলতে হবে না। তুমি একটি উজ্জ্বল তারকা। ওর মুখে মজা পাবার হাসি।

আমি ম্যাকলেগেনের চাইতে ভাল করেছি, বলতেই হবে। তোমরা কি দেখেছো পঞ্চম গোলটি ও নিজের দোষেই খেলো। কাঠের পাটাতন থেকে ভুল দিকে লাফ দিয়ে গোলটি খেলো।

ওরা হ্যাগ্রিডের কেবিনের সামনে গিয়ে দেখলো বিরাট ধূসর বর্ণের হিপ্পোগ্রাফ বাকবিক শেকল দিয়ে বাঁধা। ওদের দেখে বাকবিক মহাখুশি, লম্বা জিব বার করে চাটতে এলো। ওহ, ডিয়ার! হারমিওন ভীত হয়ে বললো, এখনো এটা ভয় পাইয়ে দেয়।

কেমন আছো তুমি? হ্যারি বাকবিককে খুব আস্তে জিজ্ঞেস করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, একা আছো, ভালো লাগছে না? হ্যাগ্রিড তো তোমার দেখাশুনো করছেন তাই না?

ওহ! ওরা শুনতে পেলো এক বাজখাই গলা।

ওরা দেখলো হ্যাগ্রিড ওর কেবিনের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরণে বহু রঙের অ্যাপ্রোন, পিঠে এক বস্তা আলু। ওর প্রিয় বাঘের মতো বিরাট কুকুর ফ্যাংগ ওদের দেখে ভীষণ চিৎকার করতে লাগলো।

ওর কাছে আসবে না ও তোমাদের কামড়ে দিতে পারে, বলে দরজা দড়াম করে লাগিয়ে ভেতরে চলে গেল।

ফ্যাংগ হারমিওন আর রনের কাছে লাফাতে লাফাতে ওদের কান চাটতে চাচ্ছে। হ্যারি ওদের দিকে ক্ষণিক তাকিয়ে কেবিনের দিকে অগ্রসর হলো। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই।

আপনি যদি দরজা না খোলেন তো আমরা দরজা ভেঙে ফেলবো, হ্যারি পকেট থেকে জাদুদণ্ড বের করে বললো। হারমিওন হ্যারিকে থামাবার চেষ্টা করলো, তুমি এটা করতে পারো না। হ্যাঁ পারি, কিছুটা পেছনে হটে হ্যারি বললো।

দরজা খুলে হ্যাগ্রিড দাঁড়ালেন। মুখ দেখে মনে হলো অসম্ভব রেগে রয়েছেন।

কি বললে? আমি তোমাদের টিচার মনে রেখো! হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে লাল চোখে তাকালেন। পটার! কোন সাহসে তুমি তোমার টিচারকে… দরজা ভেঙে দেয়ার ভয় দেখাচ্ছো!

আমি দুঃখিত স্যার, হ্যারি বললো। ও স্যার কথাটায় ইচ্ছে করে জোর দিয়ে বলে জাদুদন্ডটা ওর রোবের ভেতরে রেখে দিলো। হ্যাগ্রিড অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন।

কখন থেকে তুমি আমাকে স্যার ডাকতে শুরু করেছো? যখন থেকে আমাকে পটার বলে ডাকছেন? হ্যাগ্রিড ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন, খুব দেখি চালাক হয়েছো দুষ্টু ছেলে, আর আমি চালাক-চতুরহীন বোকা লোক, এসো তোমরা ভেতরে এসো।

হ্যাগ্রিড দরজার এক পাশে সরে গিয়ে ওদের ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলেন। হারমিওন হ্যারির পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো। মুখ দেখে মনে হয় ও ভয় পেয়েছে।

মেজাজী সুরে ওর বিরাট টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে এনে বললেন, তারপর?

ফ্যাংগ ছুটে এসে হ্যারির হাঁটুতে মাথা চেপে ধরলো।

কি বিষয়? আমাকে করুণা করতে এসেছে, না? নিঃসঙ্গ বা অনাবশ্যক একজনকে…।

একদম না। আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। হারমিওন কম্পিত স্বরে বললো, আপনাকে আমরা খুব মিস করছি।

হাঃ হাঃ মিস করছো… ও হ্যাঁ ঠিক আছে, হতেও পারে।

কথাটা বলে চেয়ার থেকে উঠে ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগলেন–বিরাট তামার কেটলিতে চায়ের জন্য জল গরম করতে দিলেন। তারপর আপন মনে কিছু বলতে লাগলেন।

তারপর মেহগিনি রঙের চা বানিয়ে মগের মতো বিরাট তিনটে কাপে চা ঢাললেন আর প্লেটে রক কে রাখলেন।

হ্যারির অসম্ভব ক্ষিদে পেয়েছে, এমনকি হ্যাগ্রিডের তৈরি খাবার হলেও হয়, ছোঁ মেরে এক পিস কেক প্লেট থেকে তুলে নিয়ে ও মুখে পুরলো।

হ্যাগ্রিড, হারমিওন ভীরু ভীরু কণ্ঠে বললো, বিশ্বাস করুন আমরা আপনার কেয়ার টু ম্যাজিক্যাল ক্রিচারস ক্লাস বন্ধ না করে চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আপনি তো সব জানেন।

হ্যাগ্রিড তখন চাকু দিয়ে আলুর থোষা ছাড়াচ্ছিলেন। বিরাট শব্দ করে হাঁচলেন। হ্যারির মনে হলো কয়েকটা বড়ো বড়ো পাথর যেনো ছড়ানো আলুর ওপর শব্দ করে পড়লো। ওরা তখন মনে মনে শঙ্কিত হলো হ্যাগ্রিড না আবার ওদের ডিনার খেয়ে যেতে বলেন।

আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু টাইম টেবিলে মেলাতে পারলাম না, হারমিওন ভয়ে ভয়ে বললো।

ভালো ভালো বেশ ভালো, হ্যাগ্রিড বললেন।

হঠাৎ ওদের কানে এলো অদ্ভুত এক শব্দ। কোথা থেকে চিক্কার আসছে দেখার জন্য এধার ওধার তাকালো। রন চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবিলের অদূরে রাখা একটা বিরাট ব্যারেলের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। ব্যারেলের ভেতরে দেখলো প্রায় ফুট খানেক লম্বা কীটপতঙ্গের শূক কিলবিল করছে। সাদা সাদা কিলবিলে সেই শূকগুলো নিজেদের শরীরে মোচড় দিচ্ছে।

ওগুলো কি হ্যাগ্রিড? হ্যারি শূকগুলোকে দেখে খুবই উৎসাহিত হয়েছে এমন এক মুখোভাব করে বললো।

ওগুলো বড় বড় কীটপতঙ্গের শূক, হ্যাগ্রিড বললেন। তারপর ওগুলো বড় হলে…। রন একটু অজানা আশঙ্কায় বললো। ওগুলো বড়ো হবে না। অ্যারাগগকে খাওয়াবার জন্য এনেছি।

হঠাৎ হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে রন বললো, কাঁদছেন কেন, কি হয়েছে?

অ্যারাগগ (মাকড়সা) খুব অসুস্থ, হ্যাগ্রিডের দুচোখ জলে ভরা। ভেজা মুখটা অ্যাপ্রণ দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, ও বাঁচবে না… গত সামার থেকে ও অসুস্থ… একটুও সারছে না। ও যদি! ও যদি… তাহলে আমি কি করবো। আমরা এতোদিন একসঙ্গে রয়েছি।

হারমিওন সান্ত্বনা দেবার জন্য হ্যাগ্রিডের পিঠে হাত বোলাতে লাগলো। কি বলবে ভেবে পায় না। হ্যাগ্রিডের বিরাটকায় অ্যারাগগের চেহারাটা হ্যারির চোখের সামনে ভেসে উঠলো। লোকচক্ষুর বাইরে নিষিদ্ধ অরন্যের ভেতরে থাকে। বছর চারেক আগে ও আর রন ওর হাতে প্রায় মরতে গিয়ে একচুলের জন্য বেঁচে গিয়েছিলো।

আমরা… আমরা ওর জন্য কিছু করতে পারি? বনের নানা ছলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা জক্ষেপ না করে হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।

আমার মনে হয় সম্ভব নয়, রুদ্ধ কণ্ঠে হ্যাগ্রিড বললেন, চোখের জল বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমার মনে হয় এই সময় কারও ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি অ্যারাগগকে নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি, যাকগে প্রফেসর গ্রাবলি প্ল্যাংক তোমাদের পড়াচ্ছেন তো।

ওরা হ্যাগ্রিডের কেবিন থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো। অন্ধকার মেঠো পথ জনমানব শূন্য। হ্যারির খুব ক্ষিধে পেয়েছে। রককেক কামড়াতে গিয়ে খটাস করে ওর দাঁতে লাগায় আর খেতে পারেনি।

হ্যারি বললো, তাড়াতাড়ি যেতে হবে রাতে আবার স্নেইপের ঘরে ডিটেনসন। আমার ডিনারে দেরি করলে চলবে না।

ওরা ক্যাসেলের কাছে এসে দেখলো করম্যাক ম্যাকলেগেন গ্রেট হলে ঢুকছে। ঢোকার সময় প্রথমে সে ঠোকর খেলো। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার পর ঢুকতে পারলো ম্যাকলেগেন। রন ওর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো।

হারমিওন ভেতরে যেতে গেলে হ্যারি ওর হাত ধরে ঢুকতে দিলো না।

কী ব্যাপার? হারমিওন প্রশ্ন করলো।

হ্যারি শান্তভাবে বললো, আমার মনে হয় নিজের অযোগ্যতায় সে একেবারে হতাশ। ও ঠিক তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল খেলার মাঠে।

কথাটা শুনে হারমিওনের গাল দুটো লাল হয়ে গেলো।

ঠিক আছে, আমিই করেছি, ও চাপা গলায় বললো। কিন্তু তোমার জানা উচিত যে রন আর জিনিকে কী বলছিলো? তার বাজে ধরনের মাথা গরম, দলে নির্বাচিত না হতে পেরে কি বাজে আচরণ করেছে সে।

রন হঠাৎ ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, তোমরা কি আলাপ করছো? কিছু না। চলো ভেতরে যাই, হ্যারি বললো।

ওরা গ্রিফিন্ডরের টেবিলে বসতে যাবে ঠিক সেই সময়ে স্লাগহর্নের আবির্ভাব। ওদের বসতে দিলেন না। বলতে লাগলেন

হ্যারি, হ্যারি কোথায় গেলো ছেলেটা, আমি যে ওকেই খুঁজছি। বিরাট বপু নিয়ে গোঁফ পাকাতে পাকাতে দাঁড়ালেন।

আমি তোমাকে ডিনারের আগে পাকড়াওয়ের চেষ্টায় রয়েছি। চলে এসো আমার ঘরে, রাতের খাবারটা তোমার সঙ্গেই সারি। আমার ঘরে ছোট একটা পার্টি হবে। ছোট ছোট অনেক উদিয়মান তারকা ছেলে-মেয়ে আসবে, ম্যাকলেগেন আসবে এবং জাবিনিও। চার্মিং মেলিন্ডা ববিন। তুমি কি মেলিন্ডাকে চেনো? ওদের পরিবার ওষুধের কারবার করে… চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে ওদের ব্যবসা। ও হ্যাঁ মিস গ্রেঞ্জার তুমি যদি পার্টিতে আসো তাহলে খুবই আনন্দিত হবো।

স্লাগহর্ন এমন ভাব দেখালেন যেনো টেবিলে হ্যারি আর হারমিওন ছাড়া কেউ নেই। রনের দিকে একবারও তাকালেন না।

হ্যারি বললো, প্রফেসর আমি তো যেতে পারবো না। স্নেইপের ঘরে আমার ডিটেনসন আছে।

ওহ ডিয়ার, দুষ্টুছেলে, আমি যে তোমার আশায় এসেছি। ঠিক আছে স্নেইপকে আমি এখনই জানিয়ে দিচ্ছি। বললেই সেভেরাস বুঝতে পারবে। পরে অন্য একদিন করবেন। অবশ্যই তোমরা দুজনে আসবে।

স্লাগহর্ন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি বললো, কোনো আশা নেই। গত সপ্তাহে ডাম্বলডোরের কথায় পিছিয়ে দিয়েছেন। এবার অন্য কারো অনুরোধ রাখবেন না।

হারমিওন বললো, তুমি না গেলে আমিও যাবো না! হ্যারি জানে হারমিওন ম্যাকলেগেনের কথা ভাবছে।

একা কোথায়? জিনিও হয় তো থাকবে। রন বললো। মনে হলো স্লাগহর্ন ওকে বাদ দেওয়াতে বিষয়টি সহজ নেয়নি রন।

ডিনারের পর হ্যারি, হারমিওন গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে গেলো। কমনরুম জমজমাট। অধিকাংশের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে, এখানে এসে গল্প-গুজব করার জন্য চেয়ার দখল করে বসে আছে। রন দুহাত বুকে চেপে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে। স্লাগহর্ন আসার পর থেকেই খুবই মেজাজ খারাপ ওর।

হারমিওন কারো ফেলে যাওয়া এক কপি ইভিনিং ডেইলি প্রফেট চেয়ার থেকে তুলে নিল। কাগজটা চোখের সামনে মেলতেই হ্যারি বললো, নতুন কোনো স্টোরি?

হারমিওন পত্রিকা খুলে চোখ বোলাতে বোলাতে বললো, তেমন কোন খবর আছে বলে মনে হয় না। ও হ্যাঁ এইতো আছে, রন দেখো তোমার বাবার ছবি! লিখেছে উনি ম্যালয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বার ডেথইটারদের বাড়ি সার্চ করে সম্ভবত কিছু পাওয়া যায়নি। আর্থার ডেথ ইটারদের বাড়ি সার্চ করে সম্ভবত কিছু পাননি। আর্থার উইসলি ডিটেকসন অ্যান্ড কনফিসকেসন অফ কাউন্টার ফিট ডিফেন্স স্পেলস অ্যান্ড প্রোটেকটিভ অবজেকটস অফিস থেকে জানিয়েছেন যে তার টিম গোপন সূত্রে খবর পেয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।

তাইতো, এই বিষয়ে তো আমিই খবর দিয়েছিলাম, হ্যারি বললো। আমি ওনাকে কিংক্রশ রেলওয়ে স্টেশনে ম্যালফয়ের বরগিনের বিষয়ে বলেছিলাম! খুব সম্ভব আমি বাজি রেখে বলতে পারি ওসব জিনিসপত্র হোগার্টসে এনে রেখেছে সে।

কিন্তু কেমন করে ও আনবে হ্যারি? হারমিওন কাগজটা পাশে সরিয়ে রেখে সগ্নিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো। আমরা যখন এসেছি তখন আমাদের মালপত্ৰতো খুব কড়াকড়ি সার্চ করা হয়েছিলো।

তাই? কিন্তু আমার তো করেনি। হ্যারি আশ্চর্য হয়ে বললো। তুমি তো আমাদের সঙ্গে আসোনি, পরে এসেছে। আমরা এনট্রেন্স হলে ঢুকতেই ফিলচ সিক্রেসি সেনসর কাছে নিয়ে এলো। ক্র্যাবের কাছে একটা কালো কুঁচকোনো মুণ্ডু ছিলো সেটা বাজেয়াপ্ত করলো। তাহলে ভাবো ম্যালফয় কেমন করে ওইরকম মারাত্মক জিনিস হোগার্টসে আনতে পারে?  

হ্যারি দেখলো জিনি উইসলি আর্নভ দ্য পিগমী পাফের সঙ্গে খেলা করছে।

হতে পারে পেঁচা মারফৎ এনেছে, হ্যারি বললো। এমনও হতে পারে ওর মা আগেভাগে পাঠিয়েছে।

হারমিওন বললো, অতো সোজা নয় পেঁচাঁদের পাঠানো জিনিস সব চেক হয়।

ম্যালফয় তাহলে কোনো ডার্ক অবজেক্ট বা মারাত্মক জিনিস হোগার্টসে আনতে পারেনি। হ্যারি রনের দিকে তাকালো। দেখলো রন বুকে হাত জড়ো করে ল্যাভেন্ডার ব্রাউনের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ভাবতে পারা যায় অন্য কোনো উপায়ে ম্যালফয়…? রন বললো, ছাড়ো তো, ওসব কথা বাদ দাও, হ্যারি।

হ্যারি বুঝতে পারলো রনের রাগের আসল কারণ। বললো, রন শোনো, আমি তো যেচে নিজেদের নেমন্তন্ন করে স্লাগহর্নের ফালতু পার্টিতে যেতে চাইনি। আমরা কেউ তো যেতে চাইনি।

যেহেতু পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়নি, আমি তাহলে ঘুমোতে যাই। রন দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো। কথাটা বলে রন ডরমেটরির দিকে রওনা দিল আর হ্যারি ও হারমিওন ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

হ্যারি। হ্যারি পেছনে ফিরে দেখলো কিডিচ দলের নতুন চেজার ডেমেলজা রবিন্স।

তোমার জন্য একটা খবর এনেছি।

স্লাগহর্নের কাছ থেকে? হ্যারি বললো।

স্নেইপের কাছ থেকে? ডেমেলজা বললো।

হ্যারি দারুণ দমে গেলো।

স্নেইপ খবর দিয়েছেন আজ রাত সাড়ে-আটটায় তোমাকে তার ঘরে যেতে। তোমার ডিটেনসনের ব্যাপারে কোনো পার্টির ব্যাপার আর চলবে না। উনি জানতে বলেছেন তোমাকে রওয়ার্মস থেকে পচাগুলো বাছতে হবে পোশান বানানোর জন্য। আরো বলেছেন প্রোটেকটিভ দস্তানা আনার প্রয়োজন নেই।

ঠিক আছে, হ্যারি মুখ বেঁকিয়ে বললো। অসংখ্য ধন্যবাদ ডেমেলজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *