১০. দ্য হাউজ অফ গনট

১০. দ্য হাউজ অফ গনট

সপ্তাহের বাকি কটা দিন হ্যারি পোশান লেসনের জন্য হাফ-ব্লাড প্রিন্সের নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে লাগলো। বিশেষ করে যখনই লিবেটিয়াস বোরাজের নির্দেশের সঙ্গে গড়মিল দেখা দিলো। চতুর্থ লেসনের পর স্লাগহর্নতো রীতিমতো হৈচৈ করে বলতে লাগলেন, জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছেন, কিন্তু হ্যারির মতো প্রতিভাশালী ছাত্র খুবই কম দেখেছেন। স্বভাবতই রন বা হারমিওন স্লাগহর্নের কথাতে একটুও খুশি হতে পারে না। হ্যারি কিন্তু অনেকবার ওর বই ওদের দিয়েছে। রনের মুস্কিল হলো এতো ঘিঞ্জি হাতের লেখা হ্যারির মত পাঠোদ্ধার করতে পারে না। হ্যারি সেই লেখাগুলো জোরে জোরে পড়তে বা বলে ওকে শোনাতেও পারে না, পাছে অনন্যরা সন্দেহ করে হ্যারি ওকে সাহায্য করছে। হারমিওন দারুণ একগুঁয়ে অফিসিয়াল নির্দেশ যা টেক্সট বইতে আছে তার বাইরে কোনো কিছু করতে চায় না। ফলে পোশান ঠিকমতো করতে পারে না। নিম্নমানের রেজাল্টের জন্য ও বেশ বদমেজাজী হয়ে যেতে লাগলো। হ্যারি, প্রয়োজন মতো প্রিন্সের নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে লাগলো। স্লাগহর্ন খুবই তারিফ করতে লাগলেন।

হ্যারি অনেক ভেবে কুলকিনারা পায় না কে হাফ-ব্লড প্রিন্স, আর কি তার আসল নাম পরিচয়। প্রচুর হোমওয়ার্কের জন্যও অ্যাডভান্সড পোশান মেকিং আদ্যপ্রান্ত পড়ার সময় পায় না, তাহলেও প্রিন্সের দুর্বোধ্য হাতে লেখা পাতার পর পাতায় অতিরিক্ত নোট পড়লেই ওর কাজ হয়ে যায়। হ্যারি লক্ষ্য করে, অনেক নোট আছে যা পোশান তৈরির আওতায় পড়ে না। হ্যারি তার কাজের জন্য যেটুকু দরকার ওখান থেকে নেয়। এখানে সেখানে অনেক নির্দেশের ছড়াছড়ি যেগুলো পড়লে মনে হয় স্পেলস। খুব সম্ভব তার নিজের জন্য লিখে রেখেছে পোশানের। জন্য নয়।

হ্যারি রনকে শনিবার সন্ধ্যায় কমনরুমে বসে বসে বইটা আর তার নোটগুলো দেখাচ্ছিলো তখন হারমিওন বিরক্তির সুরে বললো, প্রিন্স না ছাই হাতের লেখা। দেখে মনে হয় কোনো মেয়ের হাতের লেখা, ছেলেদের হাতের লেখা সাধারণত ওই রকম হয় না।

হাফ-রাড প্রিন্স ও লিখেছে, হ্যারি বললো। কজন মেয়ে প্রিনসেস ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর হারমিওন খুঁজে পায় না। ও তখন ওর লেখা প্রবন্ধ প্রিনসিপলস অফ রি-মেটেরিয়ালাইজেসান রনের সামান্য দুরে বসে ভুরু কুঁচকে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। হারমিওন কি লিখেছে রন তা দেখার জন্য উঁকি-ঝুঁকি দেয়।

হ্যারি হাতঘড়িতে সময় দেখলো এবং দেরি হয়ে যাবে দেখে দ্রুত অ্যাডভান্সড পোশান মেকিংর পুরনো কপিটা ওর ব্যাগের মধ্যে রাখে।

এখন আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আমাকে এখন যেতে হবে… তা না হলে ডাম্বলডোরের কাছে যেতে দেরি হয়ে যাবে, হ্যারি মনে মনে বললো।

উচ! হারমিওন সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে চাপা গলায় বললো। গুড লাক! তোমায় নতুন কি শেখালেন জানার জন্য অপেক্ষা করবো।

কামনা করি সবকিছু ভালভাবে যাবে, হ্যারিকে রন বললো। হ্যারি ওদের দিকে একবার তাকিয়ে পোর্ট্রেট হোল দিয়ে চলে গেলো ডাম্বলডোরের কাছে।

শূন্য করিডর দিয়ে ও এগিয়ে চললো, পা না চালিয়ে চললে দেরি হয়ে যাবে। একটা স্ট্যাচুর কাছে পৌঁছেছে ঠিক সেই সময় দেখলো প্রফেসর ট্রেলাওয়েনে আপন মনে কথা বলতে বলতে আসছেন, হাতে এক প্যাকেট তাস। তাসগুলো বেশ পুরানো ও নোংরা। মাদার ট্রেলাওয়েনে মাঝে মাঝে হাতের তাসগুলো দেখছেন।

দুই স্পেডের (ইসকাবনের) মধ্যে সংঘর্ষ, বিড়বিড় করে বললেন। হ্যারি ট্রেলাওয়েনকে দেখে গুটিসুটি মেরে লুকিয়েছিলো। সাতটা স্পেড মানে অমঙ্গল, দশটা হচ্ছে হত্যা-মারামারি। স্পেডসদের গোলাম, একজন কালো যুবক, সম্ভবত বিপদে পড়েছে, এমন একজন প্রশ্ন করা পছন্দ করে না।

যেতে যেতে থেমে গেলেন, ঠিক হ্যারি যেখানে লুকিয়ে রয়েছে সেই স্ট্যাচুর ডানধারে।

তা তো হতে পারে না, ট্রেলাওয়েনে বললেন, বিরক্ত হয়ে, হ্যারির কানে এলো প্রচণ্ডভাবে তাসের নতুন করে শাফলিং করে আবার হাঁটতে লাগলেন। যতক্ষণ না ট্রেলাওয়েনে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন হ্যারি ততক্ষণ লুকিয়ে বসে রইলো, তারপর এই দিকে ট্রেলাওয়েনে আর আসবেন না নিশ্চিন্ত হয়ে আটতলার করিডরে পৌঁছলো। ওখানে দেওয়ালে একটা মাত্র গারগয়েল রয়েছে।

অ্যাসিড পপস, হ্যারি বললো। বলার সাথে সাথে গারগয়েল লাফ দিয়ে সরে যেতেই ওর পেছনের দেওয়ালটা একধারে সরে গেলো। সেখান থেকে দেখতে পেলো একটা চলমান পাথরের তৈরি ঘোরানো সিঁড়ি (অনেকটা এসক্যালেটারের মতো)। হ্যারি সিঁড়ির পাদানিতে পা রাখলো। ধীরে ধীরে ওকে নিয়ে সিঁড়ি পাক খেতে খেতে এসে থামলো একটি দরজার সামনে। দরজাটা বন্ধ। দরজায় রয়েছে একটা পিতলের নকার। সেই দরজা খুললেই ডাম্বলডোরের অফিস।

হ্যারি দরজায় নক করলো। ও ডাম্বলডোরের গলা শুনতে পেলো, ভেতরে এসো।

শুভ সন্ধ্যা স্যার, হ্যারি বললো, হেডমাস্টারের কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে।

আহ, শুভ সন্ধ্যা, হ্যারি, বসো। ডাম্বলডোর হাসিমুখে বললেন। লম্বা ছুটির পর স্কুলে প্রথম সপ্তাহটা নিশ্চয়ই তোমার ভাল কেটেছে?

হা স্যার, ধন্যবাদ, হ্যারি বললো। তোমার আজ স্নেইপের ঘরে ডিটেনসন ছিলো তো!

ও হ্যাঁ, হ্যারি থতমত খেয়ে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকালো কিন্তু তাকে রুষ্ট মনে হলো না।

আমি স্নেইপকে বলেছি তোমার ডিটেনসন আগামী শনিবার পর্যন্ত মুলতবি রাখতে।

ঠিক আছে স্যার, হ্যারি বললো। ওর তখন স্নেইপের দেওয়া শাস্তির চাইতে তাকে ভাবিয়ে তুলছে ডাম্বলডোর কেন ডেকেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই বলছেন না। ডাম্বলডোরের গোলাকার অফিস ঘরটা আগে যেমনটি ছিলো এখনো তেমনই আছে। সরু পাওয়ালা টেবিলের ওপর দামী রূপোর যন্ত্রপাতি সাজানো–টেবিলটা ঘুরছে আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো স্কুলের অতীতের হেড মাস্টার আর হেডমিসট্রেসদের তন্দ্রাচ্ছন্ন পোর্ট্রেট। রয়েছে ডাম্বলডোরের চোখ ধাঁধানো অতি মনোহর ফিনিক্স পাখি ফকেস, দরজার পেছনে দাঁড়িতে ল্যাজ ঝুলিয়ে দোলা খেতে খেতে হ্যারির দিকে উজ্জ্বল দুই চোখে তাকিয়ে। ডাম্বলডোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ অনুশীলন করার জন্য যে স্থানটুকু খালি করে রেখেছেন সেদিকে হ্যারি তাকালো না।

অতএব হ্যারি, ডাম্বলডোর কাজের কথায় ফিরে যাওয়ার কণ্ঠে বললেন। তুমি হয়তো নিশ্চয়ই ভাবছো, তোমার জন্য আমার কি পরিকল্পনা তাই না? আরো স্পষ্ট করে বললে তোমার লেসনের জন্য আমার পরিকল্পনা।

হ্যাঁ, স্যার।

আমি ভেবে দেখলাম পনের বছর আগে ভোল্ডেমর্ট কি কারণে তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো তার কিছু তথ্য তোমাকে জানানো প্রয়োজন কিছু তথ্য।

ঘরে নীরবতা দুজনেই চুপচাপ।

গত টার্মের শেষে আপনি আমাকে সবকিছু জানাবেন বলেছিলেন, হ্যারি বললো। ওর গলায় কিছু অভিমানের সুর সে সময়ে বলেননি সেই কারণে। স্যার… ও বললো।

যতটুকু জেনেছি তখন তোমাকে বলেছিলাম, ডাম্বলডোর ধীর-স্থির শান্ত গলায় বললেন। সেই কথাগুলো মনে রেখে আমরা সেই সত্যের দৃঢ় ভিত্তিকে পাথেয় করে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্মৃতি বিজড়িত খালবিল পেরিয়ে একসঙ্গে উন্মত্ত অনুমানের ভিত্তিতে গভীর জঙ্গল হেঁটে যেতে হবে। দেরি আর নয় হ্যারি। আমি হয়তো হামফ্রে বেলচের মতো অতিশয় ভুল করবো, যিনি ভেবেছিলেন পনিরের কলড্রন বানানোর সময় হয়েছে।

কিন্তু আপনি মনে করেন আপনি সঠিক? হ্যারি বললো।

অবশ্যই করি, তবে আমি তো মানুষ, মানুষ মাত্রই ভুল করে। সত্যি কথা বলতে কি, কিছু মনে করবে না, অন্য মানুষদের চাইতে আমি চালাক। তবে আমার সামান্য ভুলের পরিণতি বিশাল হয়।

স্যার, হ্যারি জের টেনে বললো। আপনি যা আমাকে বলবেন তাকি প্রফেসির সঙ্গে সংযুক্ত? সেটা কি আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করবে?

প্রফেসির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, ডাম্বলডোর এমনভাবে বললেন যেন আগামীকালের আবহাওয়া কেমন যাবে হ্যারি প্রশ্ন করেছে। অন্তত আমি অবশ্যই আশা করছি যে, তোমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে।

ডাম্বলডোর চেয়ার ছেড়ে উঠে ডেস্কের চারপাশ পায়চারি করলেন, হ্যারিকেও প্রদক্ষিণ করলেন। হ্যারি দেখলো ডাম্বলডোর দরজার পাশে রাখা ক্যাবিনেটের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন হাতে রয়েছে অতি পরিচিত চেটালো পাথরের বেসিন, তার প্রান্তে সর্বত্র অদ্ভুত কিছু খোদাই করা। হ্যারি জানে, বেসিনটার নাম পেনসিভ। ডাম্বলডোর হ্যারির সামনে ডেস্কের ওপোর পেনসিভ রাখলেন।

তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, ডাম্বলডোর প্রশ্ন করলেন।

হ্যারি অজানা আশঙ্কায় পেনসিভের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলো। পেনসিভ সম্বন্ধে ওর আগের অভিজ্ঞতা ওর স্মৃতিতে এখনো আছে। যেসব চিন্তা আর স্মৃতি খুবই শিক্ষামূলক হলেও অস্বস্তিকর ছিল। গতবারে পেনসিভ ওকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছিলো। যেসব জিনিস দেখতে বাধ্য হয়েছিল তা ও দেখতে চায়নি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু দেখিয়েছিল। ডাম্বলডোর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।

এইবারে তুমি আমার সঙ্গে পেনসিভে যাবে। বেশ অস্বাভাবিকভাবে হলেও অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।

আমরা কোথায় যাবো স্যার,

এই বব ওগডেনের মেমোরি লেনে, পকেট থেকে একটা কাঁচের বোতল বার করলেন। তার ভেতরে রূপালি সাদা পাথর ঘূর্ণির মতো ঘুরছে–ডাম্বলডোর বললেন।

বব ওগডেন কে স্যার?

উনি আগে ডিপার্টমেন্ট অফ ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্ট বিভাগে কাজ করতেন, ডাম্বলডোর বললেন। কিছুদিন হলো তিনি প্রয়াত। তার অভিজ্ঞতা শোনার জন্য আমি তাকে অনেক বলেছিলাম, দুঃখের বিষয় আমাকে বলার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমরা এখন তার আগের একটা অফিসিয়াল ডিউটির সাথি হবো। যদি তুমি একটু সহ্য করতে পারো, হ্যারি।

ডাম্বলডোরের আহত হাত দিয়ে কাঁচের বোতলটার ছিপি টেনে খুলতে হ্যারির মনে হলো খুব অসুবিধে হলো। খুবই ব্যথা পেলেন সন্দেহ নেই।

আপনার… আপনার কি… স্যার? নানা ঠিক আছে, হ্যারি…। ডাম্বলডোর ম্যাজিক ওয়ান্ডটা ছিপিতে ঠেকাতেই ছিপিটা খুলে উড়ে গেল।

স্যার আপনার হাতে আঘাত লাগলো কেমন করে? হ্যারি ডাম্বলডোরের পুড়ে যাওয়া ডান হাতের ক্ষতের ও কালো কালো আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, কেননা ডাম্বলডোর ক্ষতটায় কষ্ট পেলেও ঠিক মতো পমফ্রের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন না।

 হ্যারি এখন আমাদের বব ওগডেনের কাছে যেতে হবে, ওসব আলোচনা করার সময় হাতে নেই। ওনার কাছে আমার এপয়েন্টমেন্ট আছে।

কথাটা শেষ করে ডাম্বলডোর শিশির মুখটা খুলে ভেতরে রূপালি তরল পদার্থ পেনসিভে ঢেলে দিতেই সেটা পেনসিভের ভেতরে ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে চকচক করতে লাগলো… না লিকুইড না গ্যাসে রূপান্তরিত হলো।

প্রথমে তুমি, পাত্রটা দেখিয়ে হ্যারিকে বললেন। হ্যারি ওর মাথাটা পাত্রের দিকে নামিয়ে খুব বড়ো দেখে একটা শ্বাস নিয়ে মুখটা রূপালি পদার্থে ডুবিয়ে দিলো। তারপর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলো ওর পা দুটো আর অফিস ফ্লোরে নেই।

ও নেমে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘূর্ণি হাওয়ার মধ্য দিয়ে। তারপরই চোখ। খুলে দেখলো উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতো আলো যে তাকানো যায় না। চোখ দুটো রগড়ে ঠিক করার আগেই দেখলো ডাম্বলডোর ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামের একটি রাস্তাতে। রাস্তার দুধারে বড়ো বড়ো ঝোঁপ ঝাড়ু। মাথার ওপোর গ্রীষ্মের সূর্যালোক… উজ্জ্বল ও সবুজ অনেকটা ফরগেট মি নটের মতো। প্রায় ওদের থেকে দশ ফিট অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বেঁটে খাটো ফুলো ফুলো চেহারার একজন পুরুষ। চোখে মোটা কাঁচের চশমা… সেই পুরু কাঁচের চশমা ওর চোখ দুটোকে দুটি ছোট ছোট বিন্দুতে পরিণত করেছে। লোকটি একটি রাস্তার ধারে পোঁতা কাঠের সাইনবোর্ড দেখছেন। হ্যারি লোকটিকে দেখেই বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই ওগডেন, কাছে পিঠে ওই একমাত্র মানুষ। কিছু কিছু জাদুকররা মাগলদের জামাকাপড় পরে নিজেদের মাগল পরিচয় দিতে চায় হ্যারি জানে। ওগডেন ওইরকমই মাগলদের পোশাক পরেছেন। ওর অদ্ভুত পোশাক হ্যারির ভাল করে দেখার আগেই ওগডেন গ্রামের সরু পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।

ডাম্বলডোর ও হ্যারি ওগডেনের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। সামান্য হাঁটার পর ওরা সেই কাঠের সাইনবোর্ডের কাছে পৌঁছলো। হ্যারি সেই সাইনবোর্ডের দুটো হাতের দিকে তাকালো। একটা হাতে ওরা যে পথটা ধরে হেঁটে এসেছে সেদিক দেখানো। তাতে লেখা রয়েছে গ্রেট হ্যাঙ্গেলটন, মাইলস। অন্য হাতটির দিকে তাকিয়ে ওগডেন বললেন, লিটিল হ্যাঙ্গেলটন, ১ মাইল।

ওরা হাঁটতে লাগলেন। রাস্তার দুধারে লম্বা লম্বা ঝোঁপঝাড়ু ছাড়া দেখার কিছুই নেই, তাছাড়া মাথার ওপর নীল আকাশ, শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ, সামনে চলেছেন ওগডেন পরণে ডবল ব্রেসট লম্বা ঝুলের কোট, খানিকটা হাঁটার পর। রাস্তাটা বাঁ-ধারে বাঁক খেলো, রাস্তাটা ধীরে ধীরে বিরাট একটা পাহাড়ের কোলে চলে গেছে। ওদের সামনে বিস্তৃত এক সুন্দর উপত্যকা। এতো সুন্দর ভ্যালি সামনে আছে হ্যারি সরু গ্রাম্য রাস্তাটা দেখে আগে কল্পনা করতে পারেনি। পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, কোনো সন্দেহ নেই সেটাই হবে লিটিল হ্যাঙ্গলটন। গ্রামের দুপাশে দুটি পাহাড়, সোজা উঠে গেছে। গ্রামের চার্চ আর কবরস্থান পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। উপত্যকার শেষ প্রান্তে পাহাড়ের গায়ে অতি সুন্দর একটি ম্যানর (সম্রান্ত ইংরেজদের খাস জমিদারী) হাউজ। বাড়ির চতুর্দিক ভেলভেটের মতো সবুজ ঘাসে মোড়া। দূর থেকে মনে হয় শিল্পীর হাতে আঁকা সুন্দর একটি ছবি।

হ্যারি দেখলো মেনরের বাংলোতে যাবার রাস্তাটা খাড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে। ও ভাবলো লিটিল হ্যাঙ্গেলটন ওদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল। একটা কথা ওর মাথায় ঢুকলো না কারও সঙ্গে দেখা করতে এলে এতো দূরে আসতে হবে কেন।

স্লাগহর্নের বাড়ি যেতে একই হাল হয়েছিলো।… রাস্তাটা ডানধারে বেঁকে গেছে… সেই রাস্তা ধরে চলতে চলতে শেষ সীমানায় এসে ওগডেনকে আর দেখতে পেলো না। ওগডেন তখন রাস্তার ধারে একটা ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেছেন। ডাম্বলডোর আর হ্যারি ঝোঁপঝাড়ু সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে রাস্তাটা পাথুরে, এবড়ো থেবড়ো আর মাঝে মাঝে গর্ত। রাস্তাটা নিচে নেমে গেছে। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ সূর্যের আলো ঢেকে রেখেছে। সূর্যের আলো না থাকার জন্য শুধু নয় কুলু কুলু ঠাণ্ডা হাওয়া আরো ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। যেখানে ওরা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো সেখান থেকে ভ্যালির নেমে আসা শেষ ভাগটা দেখা যায় না। এমন এক জায়গায় ওগডেন বাড়ি করেছেন কেন হ্যারি বুঝতে পারলো না। বাড়িতে কেউ থাকে বলে ও মনে হলো না। বাড়ির বাইরের দেওয়ালে শ্যাওলা পড়ে গেছে, ছাদের প্রায় সব টালি ভেঙে পড়েছে। ছাদের ঢালু বরগাগুলো টালি না থাকায় দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে কাঁটা গাছ, আর বিছুটি গাছে ভর্তি। কোনো জানালাই বন্ধ নেই, সব খোলা। সেই খোলা জানালা দিয়ে চিলতে চিলতে ধোঁয়া থমকে থমকে বেরিয়ে আসছে যেনো ঘরের মধ্যে কেউ রান্না করছে।

ওগডেন বাড়িটার দিকে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন। হ্যারি ওর কৌতূহল দমন করে রইলো। হ্যারি দেখলো বড়ো বড়ো গাছের কালো ছায়া ওগডেনের গায়ে পড়ছে। দরজার সামনে গিয়ে ওগডেন দাঁড়ালেন। দরজার কপাটে কেউ একটা মরা সাপ পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে।

তারপরই হ্যারির কানে এলো ঝটপট শব্দ। সামনে তাকিয়ে দেখলো সামনের গাছ থেকে একজন লোক লাফিয়ে পড়ে ওগডেনের সামনে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে ওগডেন পিছু হটলেন।

তোমাকে তো আমি আসতে বলিনি।

ওদের সামনে দাঁড়ানো লোকটার চেহারা অদ্ভুত। ধূলিধূসরিত মাথার সব চুল। এতো বেশি ধূলো জমেছে যে চুলের যে কি রঙ বোঝার উপায় নেই। মুখে অনেকগুলো দাঁত নেই, চোখ দুটো ছোটছোট এবং কালো। সামনে না তাকিয়ে পাশে তাকিয়ে রয়েছে। প্রথম দর্শনে ওকে ভাড় মনে হলেও পরে হ্যারি বুঝতে পারলো ও তা নয়। সব দেখে শুনে হ্যারি একটু ভয় পেয়ে গেলো। ওগডেনের ওকে দেখে সভয়ে দুপা পিছিয়ে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না হ্যারির।

হেঁ হেঁ–সুপ্রভাত! আমি মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক থেকে এসেছি। আপনি এখানে অনাকাক্ষিত।

হেঁ হেঁ… আমি অতি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলতে চান, ওগডেন নার্ভাস হয়ে বললো।

হ্যারির ওগডেনকে দেখে মনে হলো খুবই দুর্বল প্রকৃতির যে লোকটা গাছ থেকে লাফিয়েছে সে ওগডেনের চাইতে অনেক বেশি সজাগ, বিশেষ করে লোকটার একহাতে ওয়ান্ড আর অন্যহাতে ছোট একটা রক্তমাখা চাকু।

তুমি ওর কথা বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই হ্যারি? ডাম্বলডোর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন।

হা হা নিশ্চয়ই, হ্যারি বললো ওর গলার স্বর সামান্য হতবুদ্ধির। ওগডেন কেন বুঝতে পারছেন না?

হ্যারির চোখ পড়ে দরজার মৃত সাপটার ওপোর। ও তক্ষুণি বুঝতে পারলো। ও পার্সেলটাং (সাপের ভাষা) বলছে। ঠিক বলেছো, ডাম্বলডোর হাসতে হাসতে বললেন।

ছেঁড়া-খোড়া পোশাক পরা লোকটা তখন একহাতে চাকু, অন্যহাতে জাদুদণ্ড ধরে ওগডেনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।

আমার কথা শোনো বলেছি- ওগডেন বলতে গেলেন, কিন্তু খুব দেরি হয়ে গেছে ব্যাংগ, ওগডেন ভুলুণ্ঠিত হলেন, হাত দিয়ে নাকের কাছটা চেপে ধরলেন, তার আগুনের ফাঁক দিয়ে হলুদ রঙের আঠাল এক পদার্থ বেরিয়ে এলো।

মরফিন! বাজখাই গলায় কেউ বললো। একজন অতি বৃদ্ধ লোক সেই জীর্ণ ভাঙা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, দরজাটা এমন জোরে লাগালেন মরা সাপটি প্রায় পর পর অবস্থায় ঝুলতে লাগলো। আগের লোকটির চেয়ে লম্বায় ছোট আর অদ্ভুত তার দেহের গঠন। কাঁধ দুটো খুব চওড়া, দুটো হাত খুব লম্বা বাদামি রঙের, চোখ দুটো উজ্জ্বল, কদমছাট চুল আর কুঁচকানো মুখের চামড়া। ও সেই চাকু হাতে ধরা লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো, ওগডেনকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো।

মিনিস্ট্রি, তাই না…? বৃদ্ধলোকটি ওগডেনের দিকে তাকিয়ে বললো।

ঠিক বলেছেন, ওগডেন রেগে মেগে বললো, আঙ্গুল দিয়ে মুখ ঘষতে ঘষতে। আর তুমি, আমার মনে হয় তুমি মি. গ্যনট?

তোমাকে সামনাসামনি পেয়েছিলো! হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, গ্যানট বললেন।

তোমার এখানে আসার কথা আগে জানানো উচিত ছিল, গ্যনট রাগত স্বরে বললেন। এই জায়গাটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। নিজের খেয়াল মাফিক এখানে আসা যায় না। আর আমার ছেলে আত্মরক্ষার জন্য কিছু করবে না আশা করাটা ভুল হবে।

কিসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা, লোকটি কে? ওগডেন বললেন মাটি থেকে উঠতে উঠতে।

নানা রকমের অনুপ্রবেশকারী, মাগলস আর নোংরা সব লোক। তারপর ওগডেন তার জাদুদণ্ডটা নিজের নাকে ঠেকালেন… তখনও নাক দিয়ে হলুদ হলুদ পুঁজের মতো বেরোচ্ছিলো। দণ্ড ছোঁয়াবার সঙ্গে সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। মি. গ্যনট তার মুখের একটা কোন থেকে মরফিনকে বললেন।

বক বক না করে ভিতরে নিয়ে চলো।

হ্যারি বুঝতে পারলো ওদের কথাবার্তা পার্সেলটাং হচ্ছে এবং কি কথাবার্তা হচ্ছে বুঝতে পারলো। সেসব ভূতুরে হিসহিস শব্দ সবই ওগডেন শুনছে বুঝতে পারলো। কথাগুলো হচ্ছিলো মরফিন সম্বন্ধে, মরফিন সেগুলো মানছে না; কিন্তু যখন ওর বাবা ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তখন ও মত পরিবর্তন করলো। সেই বাড়িটার দিকে পা টেনে চললো, দরজাটার সামনে গিয়ে সজোরে ধাক্কা দিতে লাগলো ফলে মৃত সাপটি আবার হেলতে দুলতে থাকে।

ওগডেন নাক থেকে শেষ পুঁজের ফোঁটাটা ওর কোটের হাতা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, মি. গ্যনট আমি আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। এটাই তো মরফিন!

আহা! ও মরফিন, বৃদ্ধ উদাসীনভাবে বললেন। তুমি কী পিওর ব্লাড? হঠাৎ করে জোর দিয়ে বললেন।

কোনটাই না, ওগডেন বললেন তিক্তভাবে। ওগড়েনের কথা শুনে হ্যারির ওগডেনের ওপর শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।

মনে হলো গ্যনটের ওগডেনের উত্তরটা মনপুত হলো না। ওগডেনের মুখের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন, বিড় বিড় করে কিছু বললেন, সেটা খুবই আপত্তিকর গলায়, আমি এখন সব বুঝতে পারছি, চিন্তা করতে হবে। আমি গ্রাম থেকে নিচে নামলে তোমার মতো মানুষদের নাক চোখে পড়ে।

দেখাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। যদি আপনি আপনার ছেলেকে ছেড়ে দেন তার যা ইচ্ছে তাই করতে তাহলে ওরকম নাক অনেক দেখবেন, ওগডেন বললেন। আমার মনে হয় কথাবার্তা আমরা ভেতরে গিয়ে করতে পারি।

ভেতরে?

হ্যাঁ, মি. গ্যনট। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমি এখানে মরফিনের বিষয়ে এসেছি। আমরা পেঁচার মারফৎ আপনাকে খবর পাঠিয়েছিলাম।

আমি পেঁচার ধার ধারি না, গ্যনট বললেন। তাছাড়া পঠালেও আমি কোনো চিঠি-টিঠি পড়ি না।

তাহলে বলতে হবে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে আপনি আমাদের নোটিশ পাননি? ওগডেন চাঁচাছোলা শব্দে বললেন, আজ সকালেই আপনার এখানে একটা মারাত্মক রকমের জাদুকরী আইন ভঙ্গের খবর পেয়ে এসেছি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে! গ্যনট মুখ বেঁকিয়ে বললেন। তাহলে রক্তঝরা বাড়ির ভেতরে আসুন… তাহলে সরজমিনে সব দেখতে পাবেন। আপনার কর্তব্য পালনে সুবিধে হবে!

গ্যনটের সেই ভাঙা বাড়ি বলুন, বাংলো বলুন, কটেজ বলুন, সেখানে মাত্র তিনটি অতি ছোট ছোট ঘর। মেইন রুমে যাবার জন্য দুটি দরজা। সেটা কিচেন এবং লিভিং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মরফিন একটা অতি নোংরা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেছিল। পাশেই ফায়ারপ্লেস, সেখান থেকে কাঠের আগুনের ধোয়া বেরোচ্ছে। মাঝে মাঝে ও মোটা আঙ্গুলগুলো মটকাঁচ্ছে আর পারসেলটাং-এ বলছে:

হিসসি হিসসি, ছোট সোনা সাপ
 টলটলিয়ে চলো বেতাল
কথা শুনবে মরফিনের, নইলে
পেরেক দিয়ে দরজায় গেঁথে
করবে নাজেহাল।

ঘরের ভেতর খোলা জানালার কোণে সরাসরি ধাক্কাধাক্কির শব্দ শোনা গেলো। হ্যারির মনে হলো ঘরের মধ্যে আর কেউ রয়েছে। কে রয়েছে? ও দেখতে পেলো একটি মেয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। ছেঁড়া ময়লা ধূসর তার পোশাক। পোশাকের রঙ আর দেওয়ালের রঙ মিলেমিশে গেছে। ওর পাশেই একটা কালো স্টোভে জল। বসানো রয়েছে, জলটা টগবগ করে ফুটছে। ওর ধারে দেওয়ালে একটা তাকে রয়েছে অনেকগুলো রঙচটা ভাঙা প্যান। মেয়েটি সেই তাকের দিকে অলসনেত্রে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি দেখতে সাধারণ, ফ্যাকাশে গোল মুখ। ওর ভাইয়ের মতোই চোখ দুটি সামান্য ট্যারা। তবে বাবা ও দাদার চেয়ে পরিচ্ছন্ন বলা যায়। হ্যারির ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর মতো জীবনে সবদিক থেকে পরাজিত মেয়ে ও কখনো দেখেনি।

ওগডেন মেয়েটির দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালে গ্যনট বললেন, আমার মেয়ে সেরোপ। গ্যনটের গলায় অভিযোগের সুর।

সুপ্রভাত, ওগডেন বললো।

মেয়েটি ওগডেনের কথার কোনো জবাব দিলো না। বাবার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিছন ফিরে তাকে রাখা বাসনপত্র গোছাতে লাগলো।

হ্যাঁ, মি. গ্যনট এখন আমরা কাজের কথায় আসি। আমাদের বিশ্বাস আপনার ছেলে মরফিন গতরাতে একজন মাগলের সামনে ম্যাজিক করেছিল, ওগডেন বললেন।

সেই সময় ঝন ঝন করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে ওগডেন দেখলেন মেরোপের হাত থেকে একটা পাত্র পড়েছে আর সে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

গ্যনট ধমকে বললেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? ভাঙা জিনিসগুলো তুলে ফেলো, মেঝেটা পরিষ্কার করে দাও, নোংরা মাগলদের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ম্যাজিক ওয়ান্ডটা ব্যবহার করতে পারো না?

ওগডেনের গ্যনেটের কথা শুনে খারাপ লাগলো, বললেন, মি. গ্যনট দয়া করে আমার সামনে আপনার মেয়েকে বকাঝকা করবেন না। মেরোপ ভাঙা পাত্রটা জাদুদণ্ড দিয়ে তুলে ফেললেও আবার হাত থেকে পড়ে যায়। তখন বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতেই পাত্রটা তাকে চলে যাবার সময় দেওয়ালে ধাক্কা লেগে মেঝেতে পড়ে ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেলো। ভয়ে মোরপের মুখটা লাল হয়ে যায়।

মরফিন হাসিতে ফেটে পড়লো। গ্যনট দাঁত খিচিয়ে বললেন, অপদার্থ, ওটাকে মেরামত করে ফেলো অকর্মন্য মেয়ে, মেরামত করে ফেলো।

মেরোপ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। জাদুদণ্ড তোলার আগেই ওগডেন নিজের দণ্ডটা তুলে দৃঢ় স্বরে বললেন, রিপ্যারো। ভাঙা বাসনটা মুহূর্তের মধ্যে জোড়া লেগে তাকে চলে গেলো।

গ্যনট ওগডেনের দিকে তাকালেন। ওগডেনকে কিছু বলতে যেয়েও থামলেন; কিন্তু রাগটা দেখালেন আবার অসহায় মেয়ের ওপর। ঝাঁঝিয়ে বললেন, তোমার সৌভাগ্য, এই দ্রলোকটি মিনিস্ট্র অফ ম্যাজিক থেকে এসেছেন, ঠিকতো, এটাই আপনি বললেন না? তা তোমাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে আমাদের মুক্তি দিলে ভালো হয়, মনে হয়, উনি তোমার মতো নগন্য মেয়েকে তেমন অপছন্দ করবেন না।

মোরপে কারও দিকে না তাকিয়ে, এমনকি ওগডেনকে কিছু না বলে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সামনে জানালা, পেছনে স্টোভ ওগডেনের মনে হলো মেয়েটি যেন দেয়ালের পাথরের মধ্যে নিজেকে বিলীন করার চেষ্টা করছে।

মিস্টার গ্যনট ওগডেন আবার বলতে শুরু করলেন। আমার এখানে আসার কারণ আপনাকে বলেছি।

আপনার কাছে আমি প্রথম শুনলাম। কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বললেন গ্যানেট। হ্যাঁ যদি করেই থাকে তাতে কি হয়েছে? প্রয়োজন হয়েছিলো তাই একটা মাগলকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে মরফিন।

মরফিন উইজার্ডিং আইন ভঙ্গ করেছে, ওগডেন কঠিন স্বরে বললেন।

মরফিন উইজার্ডিং আইন ভেঙেছে, ওগডেনকে ভেঙচি কেটে বললেন গ্যনট। মরফিন বললো, নোংরা একটা মাগলকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি… এটাই এখন আইন… তাই না?

হ্যাঁ, ওগডেন বললেন, তাই হয়তো ঠিক, কথাটা বলে ওগডেন পকেট থেকে একটা পাকানো ছোট পার্চমেন্ট বের করে সেটা খুললেন।

ওটা কী, ওকে শাস্তির আদেশ? গ্যনট বললেন, গলায় অসম্ভব রাগের ঝঝ। তা নয়। মিনিস্ট্রিতে শুনানির সমন।

সমন! সমন! সমন, আপনি নিজেকে কি মনে করেছেন, আমার ছেলেকে যেখানে খুশি সমন দিয়ে ডেকে পাঠাচ্ছেন? গ্যনট বললেন।

আমি ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্ট স্কোয়াডের প্রধান। ওগডেন শান্তভাবে বললেন।

আর আমরা হলাম আবর্জনা? তাই-না? গ্যনট ঘেঁকিয়ে উঠে হলুদ বর্ণের বড় বড় হাতের নখগুলো ওগডেনের বুকের কাছে নিয়ে এলেন। মিনিস্ট্রির প্রয়োজনে কারা ছুটে যায়? আপনি জানেন কার সঙ্গে কথা বলছেন? হতভাগা নোংরা মাডব্লড?

আমি তা জানি, আমি মি. গ্যনটের সঙ্গে কথা বলছি, ওগডেন বললেন, খুবই উত্তেজিত… কিন্তু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন! গ্যনট গর্জন করে উঠলেন। হ্যারির মনে হলো গ্যনট অতি নোংরা, অসভ্যভাবে হাতটা তুললেন, হাতের মধ্যে আঙ্গুলে কালো পাথরের একটি আংটি দেখিয়ে ওগড়েনের মুখের সামনে দোলাতে লাগলেন। এটা দেখুন? এটা দেখছেন? জানেন এটা কী? জানেন এটা কোথা থেকে এসেছে? শত শত বছর ধরে এটা আমাদের পরিবারে আছে। বুঝলেন আমরা মাডব্লাড নই পিওর ব্লাড… কোথাও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জানেন কৎ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে লোকেরা এটা কিনতে চেয়েছে? এই পাথরটার গায়ে পিভেরাল কোট অফ আর্মস খোদাই করা আছে জানেন?

ওগডেন বললেন, এ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই। চোখের সামনে কালো পাথরটা দেখে চোখ পিট পিট করতে লাগলেন। তাছাড়া এর সঙ্গে ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই মিস্টার গ্যনট। আপনার ছেলে বেআইনী কাজকর্ম করেছে।

গ্যনট রেগে উন্মাদের মতো তার মেয়ের দিকে ছুটে গেলেন। হ্যারির মনে হলো গ্যনট তার মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলবেন। কিন্তু গলা না টিপে মেরোপের গলার মোটা সোনার চেনটা ধরে ওগডেনের কাছে নিয়ে এলেন।

এটাও দেখুন–দেখেছেন? ওগডেনের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে একটা মোটা সোনার লকেট দেখালেন। মেরোপ ব্যথায় গলায় হাত দিয়ে হাঁফাতে লাগলো, খুব সম্ভব ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো।

হ্যাঁ, দেখলাম, দেখলাম, ওগডেন দ্রুত বললেন।

স্নিদারিন! গ্যনট জোর গলায় বললেন, সালাজার স্নিদারিনের! আমরা তার শেষ জীবিত বংশধর, এবার কি বলবেন বলুন… হে?

মি. গ্যনট আপনার মেয়ের গলা থেকে হাত দুটো দয়া করে সরিয়ে নিন! ওগডেন বললেন। গ্যনট হাত সরিয়ে নিতেই মেরোপ দেওয়ালের দিকে দৌড়ে চলে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে গলায় হাত বোলাতে লাগলো। যেনো ও মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে।

অতএব। গ্যনট জয় উল্লাসে বললেন, তর্কের মাঝে যেন সমস্যা সমাধানের একটা যুক্তি পেলেন। আমরা আপনার জুতোর ময়লা, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। উচ্চবংশজাত পিওর ব্লাড, সকলেই জাদুকর–মনে হয় আপনার থেকেও বেশি, আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

কথাটা বলে গ্যনট ওগডেনের পায়ের কাছে থুতু ফেললেন। মরফিন আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মেরোপ জানালার ধারে চলে গেলো, মাথাটা নামিয়ে লম্বা লম্বা চুল দিয়ে মুখ ঢাকলো। একটি শব্দও ওর মুখ দিয়ে বেরোলো না।

ওগডেন গলার স্বর কঠিন করে বললেন, মি, গ্যনট, এ বিষয়ে আপনার বা আমার বংশ পরিচয়ের কিছু করার নেই। এখানে এসেছি মরফিনের জন্য সে যে এক মাগলকে গত রাতে আক্রমণ করেছে সে বিষয়ে। ওগডেন তার হাতের পার্চমেন্ট খুলে দেখে বললেন, গত রাতে মরফিন মাগলদের সঙ্গে মারামারি করেছে। বেআইনিভাবে জাদু প্রয়োগ করেছে। আমাদের কাছে খবর–মরফিন জিনক্স অথবা হেক্স প্রয়োগ করেছে একজন নিরীহ মাগলের ওপোর… এই তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।

মরফিন বত্রিশপাটি দাঁত বার করে হা হা করে হাসতে লাগলো। গ্যনট মরফিনকে পার্সেল টাং-এ বললেন, চুপ করো বোকা ছেলে।

ধমক খেয়ে মরফিন চুপ করে গেলো।

গ্যনট বললেন, কি অন্যায় কাজ করেছে আমি বুঝলাম না। আমি জানি আপনিও মাগলদের নোংরা মুখ পরিষ্কার করবেন, ওর মতোই।

ওগডেন বললেন, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আনছেন। গতরাতে কোনোরকম উস্কানি ছাড়া আপনার ছেলে আক্রমণ করেছে। সেই লোকটি প্রতিরোধ করতে পারেনি।

ওহো, মিস্টার ওগডেন প্রথম দর্শনেই বুঝে নিয়েছি আপনি একজন মাগল প্রেমিক, গ্যনট কথাটা বলে আবার ঘরের মেঝেতে শব্দ করে থুতু ফেললেন।

ওগডেন দৃঢ়ভাবে বললেন, এই রকম অবাঞ্ছিত আলোচনায় আমরা বোধহয় সঠিক ঠিকানায় পৌঁছতে পারবো না। আপনার ছেলের চেহারা আর কথা শুনে মনে হয় গতরাতের ঘটনার জন্য একটুও লজ্জিত নয়! আবার ওগডেন হাতের পার্টমেন্টের দিকে তাকালেন, ১৪ই সেপ্টেম্বর মরফিনকে ওর বিরুদ্ধে চার্জের জবাব দিতে হবে। চার্জ হচ্ছে বেআইনীভাবে ম্যাজিক প্রয়োগ। এবং সেই কারণে একজন মাগল বিনা দোষে অতিশয় কষ্ট পেয়েছে।

কথাগুলো বলতে বলতে ওগডেন হঠাৎ থেমে গেলেন। ঝন ঝন শব্দ ঘোড়ার পায়ের খট খট শব্দ এবং উচ্চস্বরে চীকার ও হাসি বাইরের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ভেসে এলো। গ্যনটের বাড়ির অদূরেই গ্রামের রাস্তাটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে চলে গেছে। গ্যনট স্থির হয়ে গেলেন। বড় বড় চোখ করে সেই আওয়াজ শুনতে লাগলেন। মরফিন হিস শব্দ করে যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিলো সেই দিকে তাকালো, মনে হয় সে ক্ষুধার্ত। মেরোপ মুখটা তুললল, হ্যারি দেখলো মেরোপের মুখটা ভয়ে সাদা, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

হা ঈশ্বর, কি জ্বালা! শুনতে পেলো একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর, জানালার বাইরে থেকে ঘরে ভেসে এলো। মেয়েটি যেনো বাইরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললো। তোমার বাবা কি এই ভাঙা বাড়িটা ভেঙে ফেলতে পারেন না টম?

এটা আমাদের বাড়ি নয়, একটি ছেলে বললো। ভ্যালির ওধারে যা সব দেখছো সবই আমাদের, কিন্তু এই ভাঙা বাড়িটা এক বুড়ো ভবঘুরে গ্যনট আর ওর ছেলে-মেয়ের, ছেলেটা বদ্ধ পাগল, গ্রামে গেলে শুনতে পাবে ওর সম্বন্ধে মজাদার সব গপপো।

মেয়েটা হিহিহি করে হেসে উঠলো। ঝন ঝন, খট খট শব্দ আরো জোরে শোনা যেতে লাগলো। মরফিন ওর চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করলো।

যেখানে বসে আছে সেখানে চুপ করে বসে থাকো। পারসেলটাং-এ ওর বাবা ধমক দিয়ে বললেন।

টম, মেয়েটির গলা আরো পরিস্কার শোনা গেলো, একেবারে দরজার গোঁড়ায়। আমি হয়তো ভূল বলছি–কিন্তু কেউ কি দরজায় একটা মৃত সাপ গেঁথে রেখেছে?

হায় ঈশ্বর, তুমিই ঠিক বলেছো! ছেলেটি বললো। খুব সম্ভব ওর ছেলে। আমি তোমায় আগেই বলেছি ওর মাথায় একটু ছিট আছে। থাকগে সিসিলিয়া তোমার ওদিকে তাকানোর দরকার নেই ডার্লিং!

শব্দগুলো আরো জোরে হতে লাগলো।

ডার্লিং? কথাটা মরফিন পারসেলটাং-এ বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, ওই মেয়েটাকে ডার্লিং বলেছে ছেলেটা, তোমাকে বলার আর কোনো সুযাগ নেই।

মেরোপের বরফের মতো সাদা মুখ দেখে ব্যারির মনে হলো ও জ্ঞান হারাবে।

তোমরা কি কথা বলছে? গ্যনট তীক্ষ্ণ স্বরে বললো (পারসেলটাং-এ) ছেলে ও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। তুমি কি বলছিলে মরফিন?

বলছিলাম ওই মাগলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে সে ভালোবাসে, মরফিন দারুণ ঘৃণার দৃষ্টিতে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো। মেরোপকে খুব ভীত দেখাচ্ছিল তখন। যখনই দেখি ও বাগানের পাশ দিয়ে যায় ও হেজের ফাঁক দিয়ে দেখে। ঠিক না? গতকাল রাতে ওই মাডব্লাড…।

মেরোপ প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকালো, মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, কিন্তু মরফিন সেদিকে না তাকিয়ে নিষ্ঠুরের মতো বলে চললো, জানালা দিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছো, ভাবছো ও তোমায় ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যাবে।

গ্যনট শান্তভাবে বললেন, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওই মাগলটাকে দেখিস?

ওরা বাবা, ছেলে, আর মেয়ে (পারসেলটাং-এ কথা বলে চললো। ঘরে ওগডেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেদিকে তাদের হৃক্ষেপ নেই। ওদের হিসিং এবং কর্কশ কণ্ঠে কথা শুনে অসম্ভব বিরক্ত হলেন, রেগেও গেলেন।

ভয়ার্ত মেয়ের দিকে দুএক পা এগিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, মরফিন যা বলছে সব সত্যি? তুই আমার মেয়ে সালজার স্নিদারিনের বংশধর হয়ে একটা নোংরা মাগলের জন্য আকুল হোস?

কথাটা শুনে মেরোপ দেওয়ালে প্রচণ্ডভাবে মাথা ঠুকতে লাগলো, মনে হয় কথা বলার শক্তি সে হারিয়েছে।

আমি ওকে ধরেছিলাম বাবা! মরফিন খক খক করে হেসে বললো। ধরেছিলাম ও যখন যাচ্ছিল, মুখে মৌমাছির চাকের মতো গাদাগাদা দাড়ি, কদাকার দেখাচ্ছিলো… তাই না মেরোপ? পাজি ছুঁচো বংশের বিশ্বাসঘাতক নোংরা মেয়ে, গর্জন করে উঠলেন গ্যনট। নিজেকে সংযত না করতে পেরে দুহাতে মেয়ের গলাটিপে ধরলেন।

কাণ্ডকারখানা দেখে হ্যারি আর ওগডেন সমস্বরে বলে উঠলো, না! সঙ্গে সঙ্গে ওগডেন তার জাদুদণ্ড তুলে খুব জোরে বললেন রিলাশিও! গ্যনট পিছনে উল্টে পড়লেন, মেয়ের থেকে বেশ দূরে। পড়ার সময়ে একটা চেয়ারে ধাক্কা লাগলো, মেঝেতে কুপোকাৎ হয়ে পড়লেন। মরফিন গর্জে উঠে চেয়ার থেকে উঠে ওগডেনের দিকে হাতে চাকু ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে এলো শুধু নয় জাদুদণ্ড দিয়ে এলোপাতাড়ি হেকস প্রয়োগ করতে লাগলো।

ওগডেন প্রাণ ভয়ে পালালেন। ডাম্বলডোর গ্যনটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য ওগডেন, হ্যারিকে ইশারা করলেন। হ্যারি ডাম্বলডোরের পাশে এসে দাঁড়ালো। হ্যারির কানে ভেসে আসতে লাগলো নির্যাতিত মেরোপের আর্তচিৎকার।

ওগডেন সভয়ে দৌড়তে দৌড়তে মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। দৌড়ে আসার সময় একটা চকচকে বাদামি রঙের ঘোড়ার সঙ্গে ধাক্কা খেলেন, ঘোড়ার চালক অতিসুন্দর একটি তরুণ। সেই সুশ্রী সুন্দর তরুণের পাশে একটা বাদামি রঙের ঘোড়র ওপোর একটি অতি সুশ্রী মেয়ে। ঘোড়ার সঙ্গে টক্করে ওগডেনের মাথায় আঘাত লাগাতে হাত দিয়ে চেপে ধরে রইলেন। ধাক্কা খেয়ে ওগডেন মাটিতে পড়ে যাওয়াতে বেশভূষার অবস্থা তথৈবচ–ধূলোয় মাখামাখি। লংকোটটা প্রায় খুলে গেছে। তারপরই মাথাটা চেপে ধরে সরু রাস্তা ধরে দৌড়াতে লাগলেন।

এখন থামা যেতে পারে, হ্যারির কনুইটা ধরে টান দিয়ে ডাম্বলডোর বললেন। তারপরই ওরা শূন্যে ভেসে চললো। চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন, শরীরে কোনো ওজন নেই, অনেকটা পাখির পালকের মতো। ভাসতে ভাসতে ওরা দুজনে একটা খোলা মাঠে এসে দাঁড়ালো। তারপরই হ্যারি চলে এলো ডাম্বলডোরের আলোকিত অফিসে।

ডাম্বলডোর জাদুদণ্ড দিয়ে ঘরে একটা অতিরিক্ত বাতি জ্বালাবার সময় হ্যারি জিজ্ঞেস করল, ওই বাড়ির মেয়েটার শেষপর্যন্ত কি হলো জানতে পারলাম না স্যার মেরোপ বা ওই রকম কি একটা নাম যেনো।

ওই মেয়েটা বেঁচে গেছে, ডাম্বলডোর তার নিজস্ব চেয়ারে বসতে বসতে হ্যারিকেও বসতে বললেন। যা হবার তাই হয়েছে, ওগডেন এক সেকেন্ড দেরি না করে অ্যাপারেট করে মিনিস্ট্রিতে ফিরে মিনিট পনেরোর মধ্যে অনেক লোকজন নিয়ে ফিরে সেই বাড়িতে ঢুকলেন। মরফিন আর ওর বাবা সহজে ছাড়বার পাত্র নয় তারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু দুজনকেই কাবু করে কটেজ থেকে ধরে নিয়ে গেছেন। ওয়াইজেনগেমট ওদের বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করলেন। মরফিনের নামে মাগল অত্যাচারের অনেক অভিযোগ ছিলো তাই সে নিস্কৃতি পেলো না। তিন বছরের জন্য আজকাবানে পাঠালেন। মারতোলোকে মিনিস্ট্রির লোকজন ওগডেনকে মারধোর করার অপরাধে ছমাস থাকতে হয়েছে আজকাবানে।

মারভোলো? মারভোলো কে? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো।

হু তুমি দেখছি এখন খুব সজাগ হয়েছে। খুশি হলাম, ডাম্বলডোর হাসলেন।

সেই বৃদ্ধ মারভোলো…?

ভোল্টমর্টের গ্রান্ডফাদার ডাম্বলডোর বললেন, মারভোলো, ওর ছেলে মরফিন আর মেয়ে মেরোপ গ্যনট পরিবারের শেষ বংশধর। খুবই পুরানো জাদুকর পরিবার–খুন, হত্যা, হানাহানি ইত্যাদির জন্য ওদের কুখ্যাতি। ওইসব জঘন্য কাজ কর্ম সীমাবদ্ধ ছিলো তাদের পরিবারে তার একমাত্র কারণ ওর নিজের চাচাতো (কাকার মেয়ে) বোনকে বিয়ে করার জন্য। বাইরের কোনো পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ ছিল না। ওদের জীবনযাত্রা ছিলো খুবই জাকজমকপূর্ণ, প্রচুর সোনা দানা খরচ করতেন বিলাশবহুল জীবনযাত্রার জন্য। বুদ্ধি আর চিন্তা শক্তির অভাবে যা হবার শেষ পর্যন্ত তাই হলো, এসব অবশ্য মারভোলো জন্মাবার আগের ঘটনা। তুমিতো দেখেই এসেছ বর্তমানে কি নিদারুণ দারিদ্র নিয়ে জীবন কাটায়। দারিদ্রের সঙ্গে রয়েছে ঔদ্ধত্ব, নোংরা মেজাজ, অর্থহীন গর্ব আর হামবড়াই। অবশ্য কিছু কিছু আসবাবপত্র, ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পত্তি, পুরুষানুক্রমে পাওয়া কিছু সম্পত্তি যেমন সোনার চেন, দামী কালো পাথরের আংটি, তৈজসপত্র সেতো তুমি স্বচক্ষে দেখেই এসেছে।

তাহলে মেরোপ, হ্যারি বললো চেয়ারে বসে সামান্য ঝুঁকে পড়ে ডাম্বলডোরের দিকে তাকিয়ে। তো মেরোপ… মানে স্যার, তাহলে কী সে ভোল্ডেমর্টের মা?

ঠিকই ধরেছো, ডাম্বলডোর বললেন। সৌভাগ্যবশত আমরা ভোল্টেমর্টের বাবারও কিঞ্চিৎ দর্শন পেয়েছি।

ঘোড়ার সওয়ার মাগল, তাহলে মরফিন যাকে মারধোর করেছিলো?

বাঃ চমৎকার, ঠিক ধরতে পেরেছো দেখছি, ডাম্বলডোর বললেন, খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে। হ্যাঁ ওই টম-রিডিল সিনিয়র, সুন্দর সুশ্রী মাগল ও মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চেপে গ্যনট কটেজের পাশ দিয়ে যেতো… যাকে মেরোপ গ্যনট গোপনে ভালোবাসতো…।

তারপর তাদের বিয়ে হয়? হ্যারি কথাটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললো। ওর বিশ্বাস করতে মন চায় না, একজন মাগল যাকে মনে প্রাণে গ্যনট ঘৃণা করে সে। কেমন করে দিারিনের শেষ বংশধর জাদুকর গ্যনট পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো!

ঠিক তা নয় হ্যারি। ওদের বিয়ে হয়েছিলো যখন মরফিন আর মারভোলো গ্যনট আজকাবানে কারাবাস করছিলো। সেটাই ছিলো ওদের সুবিধে। সেই সময়টা ছিলো মেয়েরাপর জীবনে স্বাধীনতার। ও তার আঠার বছরের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে, গ্যনট কটেজ ছেড়ে পালিয়ে, সিনিয়র টম রিডিলকে বিয়ে করেছিলো।

এটা সত্য যে মেরোপ একজন জাদুকরী। আমি কিন্তু মনে করি না ওর ম্যাজিক্যাল ক্ষমতা কোনো কাজে এসেছিলো, বিশেষ করে যখন ওর বাবা ওকে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাতেন ও অত্যাচার করতেন।

মেরোপ তো তার মাগল স্বামী টম রিডিলকে তার মাগল বান্ধবীর কাছ থেকে সরিয়ে আনতে পারতেন, টমকে সেই মাগল মেয়েটির কাছে যাওয়া বন্ধ করতে পারতেন।

দ্য ইমপেরিয়সকার্স! অথবা লাভ পোশান। হ্যারি বললো।

খুব ভালো কথা বলেছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না মেরেপ লাভপোশান ব্যবহার করেছিলো। যদি করতো তা হলে ব্যাপারটা খুবই রোমান্টিক হতো। গরমের দিনে টম জল খেতে চাইলে সেই জলে লাভপোশান মিশিয়ে দেওয়া… তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না! কিছুদিনের মধ্যেই লিটিল হ্যাঙ্গেল গ্রামে খুবই কানাকানি চললো। আরো তুঙ্গে উঠলো অখ্যাত মাগল নন্দন টম রিডিল যখন ভবঘুরের মেয়ে মেরোপকে নিয়ে পালিয়ে গেলো।

কিন্তু গ্রামবাসীদের বেদনা মারভোলোর মতো তীব্র নয়। ও আজকাবান থেকে ফেরার সময় ভেবেছিলো ওর মেয়ে কটেজের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে অভ্যর্থনা করবে, গরম গরম উপাদেয় খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখবে। কিন্তু দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দুরের কথা, খাবার টেবিলে দেখলো সাত-পুরুষে পুরুধুলো ময়লা জমেছে, একটা ছোট চিঠিও লিখে গেছে মাগল টম রিডিলের সঙ্গে চলে যাওয়ার কথা জানিয়ে।

তারপর থেকে মারভোলো আর মেরোপের নাম মুখে আনেনি, বেঁচে রয়েছে কি মরেছে সে খবরও নেয়নি। ওই রকম অপ্রত্যাশিত মানসিক আঘাতপাবার পর মারভোলো আর বেশিদিন বাঁচেনি। অনেকে বলে, সে একেবারে খাওয়া বন্ধ করে মারা গেছে। আজকাবান জেলে থাকার জন্য ওর শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। মরফিন ফেরার আগেই ও মারা যায়।

আর মেরোপ? উনি তো মারা গেছেন। ভোল্ডেমর্ট তো অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছেন।

ঠিকই বলেছো, ডাম্বলডোর বললেন। যাহোক সবকিছু শুনে আর দেখে আমাদের কিছু অনুমান করতে হবে, আসল ঘটনাটা কি? তাহলেও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য। তারপরে শোনো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কয়েক মাস পর টম রিডিল লিটিল হ্যাঙ্গেলটনে ওর ম্যানর হাউজে একাই ফিরে এলো, সঙ্গে স্ত্রী নেই। গুজব ছড়াতে লাগলো গ্রামে যে টম বলছে তাকে প্রতারণা ও ঠকানো হয়েছিলো। ও বলে ছিলো যে তাকে যাদুমুগ্ধ করা হয়েছিলো এখন তা অপসারিত হয়েছে। যাই হোক টম কিন্তু ওই কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলেনি, পাছে লোকে ওকে উন্মাদ ভাবে। যাই হোক গ্রামের লোকেরা ধারণা করেছিলো মেরোপ টম রিডিলের কাছে মিথ্যে বলেছিলো যে তার একটি সন্তান ওর গর্ভে এবং সেই জন্যই টমকে বিয়ে করেছে।

কিন্তু মেরোপের তো সন্তান হয়েছিলো। সেই সন্তানের পিতা তো টম রিডিল…।

হ্যাঁ, কিন্তু ওদের বিয়ের প্রথম বছরে নয়। টম রিডিল ওকে যখন ছেড়ে চলে যায়, তখন মেরোপ গর্ভবতী ছিল।

কেন, কি কারণে? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। তাহলে লাভ পোশান কাজ করলো কেন?

আবার অনুমান, ডাম্বলডোর বললেন। আসলে মেরোপ ওর স্বামীকে খুবই ভালোবাসতো, তাই ওইসব জাদুটোনা দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়নি। তাই লাভ পোশান ব্যবহার করেনি। মেয়েরাপ ভেবেছিলো টম রিডিলও তাকে এখন ভালবাসতে শুরু করেছে। ও আরো ভেবেছিলো যে শিশুটি পৃথিবীতে আসছে তার জন্যও টম রিডিল ওকে ছেড়ে কোনোদিনই যাবে না। দুঃখের বিষয় দুটো ব্যাপারেই ও ভুল করেছিলো। টম একদিন উধাও হয়ে গেলো, আর কোনো দিন মেরোপের কাছে আসেনি, ও জানেওনি তার ছেলে দেখতে কেমন হয়েছে।

আকাশ হঠাৎ গভীর কালো হয়ে গেলো। বাতির আলোর তেজ আরো বেড়ে গেলো। ঘরটা আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেলো আগের চেয়ে।

 হ্যারি তাহলে আজ এই পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর ডাম্বলডোর হ্যারিকে বললেন।

আচ্ছা স্যার, হ্যারি বললো। ও দাঁড়ালো কিন্তু ঘর ছেড়ে গেলো না। বললো, স্যার ভোল্টেমর্টের ইতিবৃত্ত জানা সত্যই কি খুবই প্রয়োজনীয়?

খুবই প্রয়োজনীয়, আমি মনে করি, ডাম্বলডোর বললেন। এর সঙ্গে প্রফেসির কি সম্পর্ক? সবকিছুই তো প্রফেসির ওপর…। ঠিক আছে, একটু যেনো গোলমেলে পড়ে গেলো।

স্যার, হ্যারি চলে যাবার জন্য পা বাড়ানের সময় আরো একটি প্রশ্ন মাথায় এলো।

স্যার, আপনি ভোল্ডেমর্ট সম্বন্ধে আমাকে যা যা বললেন তা কি রন আর হারমিওনের সঙ্গে আলাপ করতে পারি?

ডাম্বলডোর হ্যারির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। কি বলবেন ভাবতে লাগলেন। বললেন, আমার মনে হয় মিস্টার উইসলি আর মিস গ্রেঞ্জার দুজনেই যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এবং তারা অনেক বার তার প্রমাণ দিয়েছে। তবে হ্যারি তোমাকে আগেই বলি, ওরা যেনো অন্য কারও কাছে কথাগুলো প্রকাশ না করে। আমি ভোল্টেমর্টের অতীত সম্বন্ধে বা তার গোপন বিষয়ে কতোটা জানি তা অন্যদের জানাই ভালো।

আমি আশ্বস্ত করছি স্যার, রন ও হারমিওন ছাড়া আর কেউ জানবে না। শুভ রাত্রি।

হ্যারি যেতে যেতে দরজার গোড়া থেকে আবার ঘরের ভেতরে ফিরে তাকালো, ও দেখলো যে লম্বা-সরু পাওয়ালা টেবিলে, যেখানে ডাম্বলডোরের অনেক রকমের রূপোর যন্ত্রপাতি, সেখানে একটা বড়ো ভাঙ্গা কালো পাথর সেট করা একটা কুৎসিত স্বর্ণের আংটি।

স্যার, হ্যারি সেই আংটিটার দিকে তাকিয়ে বললো, ওই আংটিটা…। হ্যাঁ, ডাম্বলডোর বললেন।

সেবার যখন রাতের বেলায় আমরা স্লাগহর্নের কাছে গিয়েছিলাম আংটিটা আপনাকে পরে থাকতে দেখেছিলাম।

হ্যাঁ পরেছিলাম, ডাম্বলডোর বললেন। মারভোলো গ্যনট ওগডেনকে যেটা দেখিয়েছিলেন সেটা কি এই রকমের আংটি?

ডাম্বলডোর মাথা নিচু করলেন।

একই…। তাহলে আপনি কি সব সময় এই আংটিটা পড়েন?

না, আমি মাত্র কয়েকদিন হলো এটা সংগ্রহ করেছি, ডাম্বলডোর বললেন, তোমাকে নিয়ে আসার জন্য যেদিন তোমার আন্টিদের বাড়ি থেকে গিয়েছিলাম…

সেদিনই…।

সেই সময়টা যখন আপনার হাতে আঘাত লেগেছিল… স্যার? হ্যাঁ, ওই কাছাকাছি সময়ে হ্যারি। হ্যারি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না, ডাম্বলডোর মৃদু হাসলেন। স্যার… কিভাবে ঘটলো…

আজ অনেক রাত হয়েছে। অন্য একদিন তোমাকে এর কাহিনী বলা যাবে। শুভরাত্রি।

শুভ রাত্রি, স্যার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *