০১. দ্য আদার মিনিস্টার

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ-ব্লাড প্রিন্স
জে. কে. রাওলিং

০১. দ্য আদার মিনিস্টার

তখন প্রায় মধ্যরাত্রি। প্রধানমন্ত্রী তার অফিস ঘরে একা বসে, হাতে তার লম্বা একটা সরকারি নথি। নথিটা বার বার পড়ার পরও বিষয়বস্তু তার মগজে ঢুকছে না। মন তার পড়ে রয়েছে টেলিফোন যন্ত্রটির ওপর। প্রতিক্ষা করছেন একটা ফোন কলের। দূরদেশের এক প্রেসিডেন্ট তাকে ফোন করবেন। অপেক্ষা করছেন ওই বিরক্তিকর মানুষটি কখন তাকে ফোন করবেন। সেই অপেক্ষার সাথে গত সপ্তাহে এক নাগাড়ে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা মন থেকে সরিয়ে ফেলার বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন। এতসব চিন্তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তার হাতের সেই লম্বা ছাপার কাগজের লেখা পড়ার চেষ্টা করছেন। পড়ার সময় সেই কাগজের ওপর ভেসে উঠছে একজনের বিদ্রূপ মাখানো মুখ। তিনি আর কেউ নন–তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী! সেই মানুষটির বক্তব্য ওই দিনের সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। তিনি শুধু গত সপ্তাহের ভয়ঙ্কর ঘটনার বিশ্লেষণ করেননি (যেনো পাঠকরা কিছুই জানে না) তাদের আবার নতুন করে সে সকল ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই না, তিনি আবার প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি প্রতিটি দুঃখজনক ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে দায়ী করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।

ঘটনাগুলো ভাবতেই প্রধানমন্ত্রীর নাড়ি অতি দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করলো। বিরোধীপক্ষ যাই বলুক না কেন তার জন্য তার সরকার এসব ঘটনার জন্য কোনো মতেই দায়ী নয়। হঠাৎ করে ব্রিজটি দু টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়া থেকে কেমন করে তার সরকার রুখতে পারতো? এটা ভাবা খুবই অন্যায় হবে যে তার সরকার ওই ব্রিজের তদারকি ও নিয়মিত মেরামতের জন্য যথেষ্ট ব্যয় করেনি। ব্রিজটি মাত্র দশ বছর আগে বানানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভেবে কিনারা করতে পারছেন না হঠাৎ কেন পাকাপোক্ত নতুন ব্রিজটা সমান দুভাগে বিভক্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়লো। আর সে সময় ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়াকালীন বার-চৌদ্দটা গাড়ি নদীতে তলিয়ে গেল। আর কেউ অভিযোগ করতে পারবে না যে পুলিশের গাফিলতি বা অকর্মন্যতার জন্য দুটি জঘন্যতম হত্যা হয়েছে। তাছাড়া দেশের পশ্চিম ভাগে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের কথা। সেই ঝড়… আকস্মিক, ঝড় তো আগাম সংবাদ দিয়ে আসেনি? ঝড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে, ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জুনিয়র মন্ত্রী হারপট চোরলের ব্যাপারটা? এর জন্য তিনি কী দায়ী, মন্ত্রী হারপট প্রতি সপ্তাহের কাজের পরিকল্পনা এমনভাবে করেন, যেন বেশিরভাগ সময় তিনি তার পরিবারের সাথে থাকতে পারেন।

দেশ, নিদারুণ এক পরিস্থিতির কবলে, বিরোধী নেতা তার সুখের হাসি চেপে এই কথা বলে তার বক্তব্য শেষ করেছেন।

দুর্ভাগ্যবশত কথাটা নির্ভেজাল সত্য। প্রধানমন্ত্রী হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন জনগণের এখন মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়, তারা শঙ্কিত। ভয় না পাবার কোনো কারণ নেই। এমনকি আবহাওয়া ও দুর্যোগে ভরা; মধ্য জুলাইতে শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশাচ্ছন্ন–এমন তো হওয়ার কথা নয়, স্বাভাবিক তো নয়ই।

প্রধানমন্ত্রী মেমোর দ্বিতীয় পাতা উল্টালেন, উঃ লেখার যেনো শেষ নেই! পড়ার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একপাশে সরিয়ে রাখলেন। একটু স্বস্তি পাবার জন্য মাথার ওপর হাত দুটো তুলে দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে তার ঘরের চারদিকে তাকালেন। তার অফিস ঘরটি অতি সুন্দরভাবে সাজানো। লম্বা জানালার পাল্লাগুলো কাঁচের সার্শি দেয়া। তারই বিপরীতে রয়েছে চকচকে কালো পাথরের ফায়ার প্লেস। বাইরের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে তার জন্য জানালার কাঁচ ভালভাবে আটা। আবহাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। হঠাৎ ঠান্ডাতে তার গাটা শির শির করে উঠলো। চেয়ার থেকে উঠে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। দেখলেন বাইরে থেকে হালকা কুয়াশা জানালার কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছে। তখনই শুনতে পেলেন, পেছন থেকে কে যেন খুক খুক করে কাশলো। ঘন কালো কাঁচের সার্শিতে তার ভয় পেয়ে যাওয়া প্রতিবিম্বের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সমস্ত শরীর যেন জমে বরফ হয়ে গেছে। একটুও যেন নড়বার শক্তি নেই। সেই কাশির শব্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে অপরিচিত নয়। আগেও অনেকবার শুনেছেন। ধীরে ধীরে পিছন ফিরে শূন্যঘরের দিকে তাকালেন।

হ্যালো? একটু সাহস সঞ্চয় করে বললেন।

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ভাবলেন কেউ তার প্রশ্নের জবাব দেবে না। কিন্তু পরক্ষণেই শুনতে পেলেন তার প্রশ্নের জবাব চিড় চিড়ে, কিন্তু গলার শব্দ স্থির অনেকটা লিখিত বয়ান পড়ার মতো। প্রথম কাশির শব্দেই প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন কে আসছে। লোকটি বেঁটে খাটো ব্যাঙের মতো মানুষ, মাথায় তার লম্বা রূপালী উইগ। সেই মানুষটির ছোট নোংরা তৈলচিত্র দেয়ালের এক কোণে ঝোলানো রয়েছে। সেই তৈলচিত্রের মানুষটি গড়গড় করে বললো,

প্রিয় মাগলদের প্রধানমন্ত্রী, আপনার সঙ্গে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সাক্ষাতে কথা বলতে চাই, অনুগ্রহ করে জবাব দেবেন। আপনার বিশ্বস্ত, ফাজ।

.

তৈলচিত্রের মানুষটি কথাটা শেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে জবাবের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে রইলো।

হুঁ  : প্রধানমন্ত্রী বললেন, শোনো, আমার পক্ষে সময় দেয়া সম্ভবপর নয়, আমি একটা টেলিফোন কলের অপেক্ষা করছি, কলটা করবেন একটি দূর দেশের প্রেসিডেন্ট।

সেটা আপাতত মুলতবী রাখুন, পরে দেখা যাবে, ফ্রেমের তৈলচিত্র জোর দিয়ে বললো। প্রধানমন্ত্রী চুপসে গেলেন কথাটা শোনার পর। এই ভয়ই তিনি পাচ্ছিলেন।

কিন্তু আমার যে তার সঙ্গে কথা বলা দরকার, তার ফোনেরই অপেক্ষা করছি।

আমরা সেই দূর দেশের প্রেসিডেন্টকে, টেলিফোন করার ব্যাপারটা তার মন থেকে ভুলিয়ে দেবো। দেখবেন আজ নয় কাল রাত্রে তিনি ফোন করবেন, ছবির ছোট মানুষটি বললো। অনুগ্রহ করে মি, ফাজকে এখনই আপনার উত্তর জানান।

আমি, ওহো… আচ্ছা, ঠিক আছে, চুপসে যাওয়া গলায় প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হয়েই বললেন; বেশ, মি, ফাজ আসতে পারেন।

কথাটা বলে প্রাইম মিনিস্টার হন্তদন্ত হয়ে চেয়ারের দিকে যেতে যেতে গলার টাই ঠিকঠাক করে নিলেন। গোমড়া মুখ করে চেয়ারে সবেমাত্র বসেছেন তখনই ফায়ার প্লেসে উজ্জ্বল সবুজ রঙের শিখা দপ দপ করে উঠলো। প্রধানমন্ত্রী সেই জ্বলন্ত উজ্জ্বল সবুজ শিখার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরেই সেই আগুনের ভেতর থেকে লাড়ুর মত বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে একজন বেরিয়ে এলেন। পরক্ষণেই বহু পুরাতন ঘরের কার্পেটের ওপর দাঁড়িয়ে তার ঢলঢলে ডোরাকাটা ক্লোকের আস্তিন থেকে ছাই ঝাড়ুতে লাগলেন। তার হাতে লেবু রঙের একটা বাউলার টুপি।

আহা… প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, কর্নেলিয়াস ফাজ বললেন। এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালেন। আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে।

সত্যি কথা বলতে কি প্রধানমন্ত্রী কর্নেলিয়াস ফাজের (ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী) কথার আন্তরিকভাবে কোনো জবাব দিলেন না, চুপ করে রইলেন। ফাজকে দেখে একটুও খুশি হননি। মাঝে মধ্যেই ফাজ তার ঘরে আসেন, তার আসাটাও ভালো লাগে না। বেশিরভাগ সময় ফাজ সুখবর নয়, দুঃসংবাদ বহন করে আনেন। এবারও সেধরনের কোন সংবাদ শোনার জন্য ফাজের মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন ফাজ খুবই চিন্তিত। ফাজ আগের মত নেই, মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, অনেক রোগা হয়ে গেছেন। এলোমেলো ভাব। রাজনৈতিক নেতাদের বা পলিটিসিয়ানদের ওই রকম মুখোভাবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী খুবই পরিচিত এবং তিনি জানেন এটা শুভ লক্ষণ নয়।

আপনার কি সাহায্যে আসতে পারি? উনি ফাজের হাত আলতো করে ধরে বললেন। তারপর তার সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে ফাজকে বসতে অনুরোধ করলেন।

কোথা থেকে শুরু করি বুঝতে পারছি না। ফাজ চেয়ারটা টেনে হাঁটুর ওপরে সবুজ বাউলার হ্যাটটা রেখে বিড় বিড় করে বললেন। বলুন তো… উঃ কি ভীষণ খারাপভাবে গত সপ্তাহটা গেলো।

তাহলে আপনারও খারাপ সময় গেছে? বেশ গম্ভীর গলায় বললেন প্রধানমন্ত্রী। বলতে চাইলেন তারও সপ্তাহটা সুখকর হয়নি, তার জন্য ফাজ কি-ই-বা করতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর দিকে বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে ফাজ বললেন, হ্যাঁ, তা যা বলেছেন। আপনারই মতো সারা সপ্তাহটা আমার গেছে, প্রাইম মিনিস্টার। ব্রুকডেল ব্রিজ…, বোনস, ভানসের হত্যা, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কথা, সবই তো জানেন।

ওহো আপনি যখন এসেছেন, আমি বলতে চাই আপনাদের কিছু লোক ওই সব দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত, ভুল বললাম?

ফাজ প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকালেন।

অবশ্যই, অবশ্যই, ফাজ বললেন। আপনি মনে হয় সবই জানেন, বুঝতে পারছেন সমগ্র ব্যাপারটা?

আমি, প্রধানমন্ত্রী তো তো করে বললেন।

ফাজ চাঁচাছোলা কথা বলেন, তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ফাজকে অপছন্দ করেন। তিনি তো একজন প্রধানমন্ত্রী তাকে কী ফাজ একটা বাচ্চা ছেলে বা স্কুলে পড়য়া ছেলের মতো অনভিজ্ঞ মনে করেছে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট মনে আছে, যেদিন তিনি প্রধামন্ত্রী হয়েছেন, সেইদিনই সন্ধে বেলা তার সঙ্গে ফাজের দেখা হয়েছিলো। সেই দিন থেকেই তিনি ফাজকে অপছন্দ করেন। সেদিনটা তিনি কখনো ভুলতে পারবেন না, মনে হয় যেন সেটা গতকালের কথা। সেই সন্ধে বেলার কথা তার জীবনের বাকি দিনগুলো তাড়া করে বেড়াবে। কখনো ভুলবেন না।

তার মনে আছে এই ঘরেই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম দিন। জীবনের বহু বছরের আশা-আকাক্ষা-স্বপ্নের পরিকল্পনা সার্থক হবার পর। সেই সময়ে, ঘরে খুক খুক কাশির শব্দ, আজকের রাতের মতো। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন ঘরের দেয়ালে ঝোলান ছোট তৈলচিত্রের মানুষটি তার সঙ্গে কথা বলছে বলছে, মিনিস্টার অফ ম্যাজিক এখনই আপনার ঘরে এসে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করবেন।

স্বভাবতই প্রধানমন্ত্রী ভাবলেন, নির্বাচনের জন্য অতি পরিশ্রম, ভাবনাচিন্তা ইত্যাদির জন্য তার মাথার ঠিক নেই। তা না হলে ঘরের মধ্যে দেয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেট তার সঙ্গে কথা বলেছেন শুনবেন কেন? আরো অস্বাভাবিক কান্ড ঘঠলো যখন তার ঘরের ফায়ার প্লেসের ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এসে তার সঙ্গে করমর্দন করে ঢাক পিটিয়ে বলবে কেন, আজও পৃথিবীতে অসংখ্য জাদুকর আর ডাইনি বেঁচে রয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রধানমন্ত্রী হতবাক হয়ে সেদিন ফাজের ওই কথাগুলো শুনেছিলেন। ফাজ তাকে আরো বলেছিলেন, তাদের সম্বন্ধে তার মাথা ঘামাবার কোনো কারণ নেই। সেই সব জাদুকর সম্প্রদায়ের দায়িত্বে রয়েছে ম্যাজিক মন্ত্রণালয়। আর নন-ম্যাজিকেল সম্প্রদায় তাদের যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে তার দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে। ফাজ আরো বলেছিলেন, হ্যাঁ কাজটা খুবই কঠিন কাজ, যেমন আইন মেনে নিজের বিচার বুদ্ধিতে জাদু ঝাড়ু প্রয়োগ করে ড্রাগন সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণে রাখা (প্রধানমন্ত্রীর মনে আছে সেই কথা শুনে চেয়ারের হাতলটা শব্দ করে চেপে ধরেছিলেন)। ফাজ কথাটা বলার পর বাবা যেমন সন্তানের পিঠে চাপড় দিয়ে উৎসাহ দেন ঠিক তেমনভাবে হতবাক প্রাইম মিনিস্টারের পিঠ চাপড়েছিলেন।

না, না ভাবনার কিছু নেই, ফাজ বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে আবার কোনো এক সময় দেখা না হলে খুবই অসঙ্গত হবে। আমি অবশ্যই আসবো, এসে আপনাকে বিরক্ত করবো, যখন আপনাদের সত্যই কোনো সাংঘাতিক বিপদ-আপদ হবার আশঙ্কা দেখা দেবে, যেমন ধরুন এমন কোনো ব্যাপার, যাতে মাগলস মানে নন-ম্যাজিকেল সম্প্রদায় বিপদে পড়তে পারে। আমি অন্যভাবে বলতে পারি নিজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচুন, অন্যদেরও বাঁচতে দিন সেইভাবে। আমি আশা করছি আগে যে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তার চাইতে আপনি এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেবেন। তিনি প্রথমে আমাকে ভেবেছিলেন আমি একটি ধোকাবাজ, তাই আমাকে ধরে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন।

কথাগুলো শোনার পর হতবিহ্বল প্রাইম মিনিস্টার তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেলেন, তাহলে আপনি, তাহলে আপনি ধোঁকাবাজ নন?

সেটাই ছিল তার হতাশার মধ্যে আশা।

অবশ্যই না, ফাজ অতি ভদ্রভাবে বললেন। আমি অবশ্যই ধোকাবাজ নই। তাহলে দেখুন।

ফাজ পকেট থেকে জাদুদণ্ড বার করে প্রধানমন্ত্রীর চায়ের কাপটা গারবিল বানিয়ে দিলো।

প্রধানমন্ত্রী রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, কিন্তু, কেন, কেন আমাকে আগে কেউ বলেনি?

মিনিস্টার অফ ম্যাজিক শুধু যিনি মাগলদের প্রধানমন্ত্রী হন তাকেই কথাটা জানায়, তা তিনি পুরুষ বা মহিলা হোন, ফাজ বললেন। তারপর ম্যাজিক ওয়ান্ডটা পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, গোপনীয়তা রক্ষার এটাই একমাত্র পথ।

কিন্তু তাহলে, প্রধানমন্ত্রী মিন মিন করে বললেন, আমার আগে যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি আমাকে এ বিষয়ে বলেননি কেন?

কথাটা শুনে ফাজ হেসে উঠলেন।

প্রাইম মিনিস্টার, আপনার সঙ্গে আজ যে আমার কথাবার্তা হলো তা কি আপনি কাউকে বলবেন?

ফাজ তার খিল খিল হাসি না থামিয়ে ফায়ারপ্লেসের আগুনে সামান্য পাউডার ছুঁড়ে ফেলে পান্না রঙের আগুনের দিকে এগিয়ে গেলেন, হুস শব্দ করে জ্বলন্ত আগুনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, মনে মনে বললেন, যতো দিন বেঁচে থাকবো আজকের এই ঘটনা কারও কাছে বলবো না। এই বিরাট বিপুলা পৃথিবীতে কে আমায় বিশ্বাস করবে?

যে ধাক্কাটা খেয়ে প্রধানমন্ত্রী বিভ্রান্ত হলেন সেটা কাটিয়ে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। প্রথম চোটে মনে হলো, ও নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন বেশ কয়েক মাস ধরে নির্বাচনের খাটা-খাটুনিতে রাত্রে ভালো করে ঘুম হয়নি, তারই প্রতিক্রিয়া বা অলীক কিছু। অদ্ভুতভাবে তার ঘরে ফাজের আবির্ভাব, উপদেশ, কথাবার্তা, তারপর আগুনের ভেতরে ঢুকে উধাও হয়ে যাওয়া হাজারো চেষ্টা করে বিষয়টি মন থেকে সরাতে পারলেন না। প্রথমেই চায়ের কাপ থেকে রূপান্তরিত হওয়া গারবিল তার প্রিয় ভাইজিকে উপহার দিলেন, তারপর তার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে ডেকে ঘর থেকে কুৎসিত বেঁটে লোকটার পোট্রটটা সরিয়ে ফেলতে বললেন। ওই বেঁটে লোকটাই তো ফাজের আবির্ভাবের কথা বলেছিলো। প্রধানমন্ত্রী খুবই আতঙ্কিত হলেন যখন দেওয়াল থেকে সেই পোর্ট্রেট সরিয়ে নেয়া গেল না। অনেক ছুতোর, একজন আর্ট সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক এবং সবশেষে চ্যান্সেলর অফ দি এক্সচেকার অনেক পরিশ্রম, চেষ্টা করেও সেই পোর্ট্রেটটা দেওয়াল থেকে খুলতে পারলো না। তখন প্রধানমন্ত্রী ওটা সরিয়ে ফেলার আশা ত্যাগ করলেন। আশা করতে লাগলেন, যতদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘরটাতে বসে কাজকর্ম করবেন, পোট্রট যেন চুপচাপ থাকে। মাঝে মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বাঁকা চোখে দেখেন সেই ছবিটা হাই তুলছে, নাক চুলকোচ্ছে, শুধু তাই নয় ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে ঘরে পায়চারি করছে। তখন ফ্রেমের ভেতর শুধু থাকে ধুলি ধুসরিত অতি পুরনো রংচটা ক্যানভাস। যাহোক, সেই ছবিটার দিকে আর তাকাবেন না ঠিক করলেন। মনকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, যা কিছু দেখছেন তা শুধু দৃষ্টিভ্রম, বাস্তবে কিছুই নয়। এমন ভ্রম অস্বাভাবিক নয়।

তার বছর তিনেক আগে, আজকের মতো এক রাতে, প্রধানমন্ত্রী তার অফিস ঘরে বসে কাজ করছিলেন তখন সেই পোর্ট্রেট আবার খুক খুক করে কেশে জানিয়েছিলো, ফাজ এখনই তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। ফাজ ঠিক এবারের মতো সে সময়েও ফায়ারপ্লেসের আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। সর্বাঙ্গ ভিজে শপশপ করছে, চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ফাজকে কিছু প্রশ্ন করার আগেই ফাজ খুব জোরে জোরে একটা জেলখানার কথা বলতে লাগলেন। প্রধানমন্ত্রী বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলেন জেলখানায় আটক সিরিয়স ব্ল্যাকের নাম শুনে। আগে তো কখনো তিনি সেই জেলখানার নাম শোনেননি; তাছাড়া আরো দুটি নাম হোগার্টস ম্যাজিক স্কুল, আর হ্যারি পটার! ফাজের কথাবার্তার কিছু মানে বুঝতে পারলেন না।

আমি এই মাত্র আজকাবান থেকে এসেছি, ফাজ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন। তার পকেটে রাখা বাউলার হ্যাট থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়তে লাগলো। নর্থ সী-র মধ্যবর্তী জায়গা, আপনি শুনেছেন, সেখান থেকে পালিয়ে আসা ডিমেন্টরেরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করছে (ফাজ কেঁপে উঠলেন)। এর আগে তারা কখনো জেল ভেঙ্গে, এমন ঘটনা ঘটায়নি। যাহোক, প্রাইম মিনিস্টার আপনার কাছে আমি আসতে বাধ্য হয়েছি। ব্ল্যাক একজন অতি সুপরিচিত মাগল হত্যাকারী, আবার ইউ-নো-হুর দলে যোগ দেবার পরিকল্পনা করছে, তাহলেও… সে যাকগে মনে হয় ইউ-নো-হুকে তা আপনি জানেন না! কথাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বলার পর ফাজ প্রধানমন্ত্রীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে আপনি বসুন, আসুন হুইস্কি খাওয়া যাক। এর আগে কেউ তার ঘরে ঢুকে তাকেই বসুন বলতে কখনো শোনেননি, বিরক্ত হলেন, তার ওপর সে নিজেই হুইস্কি পান করার কথা বলছে! যাহোক প্রধানমন্ত্রী তার চেয়ারে বসলেন। ফাজ পকেট থেকে তার জাদু-দণ্ডটা বার করে জাদুর প্রভাবে দুগ্লাস ভর্তি হলুদ রঙের হুইস্কি আনালেন, একটা গ্লাস প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার সামনে বসলেন।

ফাজ প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। তারই মাঝখানে দুএকবার একজনের প্রসঙ্গ তুললেন; কিন্তু তার নাম মুখে না এনে এক খণ্ড পার্চমেন্টে লিখে প্রধানমন্ত্রীর যে হাতে হুইস্কির গ্লাস নেই সেই হাতে দিলেন। তারপর কথাবার্তা শেষ হলে ফাজ চেয়ার ছেড়ে বিদায় নেবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। প্রধানমন্ত্রীও দাঁড়ালেন।

তো আপনি মনে করেন যে… বাঁ-হাতে ধরা পার্চমেন্টে তেরছা চোখে নামটা পড়ে বললেন, লর্ড ভোল…।

ফাজ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন, যার নাম মুখে আনতে নেই!

আমি দুঃখিত, তাহলে আপনার স্থির বিশ্বাস হি-হু… যার নাম মুখে আনতে নেই সে আজও বেঁচে আছে, তাহলে?

হ্যাঁ, তাই তো ডাম্বলডোর আমাকে বলেছেন, ফাজ পিনস্ট্রাইপড ক্লোকটার বোম লাগাতে লাগাতে বললেন, কিন্তু আমরা তাকে কোথায়ও দেখতে পাইনি। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলতে পারি ও খুব মারাত্মক নয় যদি না তাকে কেউ সাহায্য করে, আমাদের এখন ব্ল্যাক সম্বন্ধে সজাগ থাকতে হবে। তা হলে আপনি ওই সাবধান বাণী জারি করছেন, কী বলেন? চমৎকার। আশা করছি, খুব শিগগির আপনার-আমার দেখা আর হচ্ছে না, তো প্রাইম মিনিস্টার শুভ রাত্রি।

কিন্তু আবার তাদের দেখা সাক্ষাৎ হলো। প্রায় এক বছর পরে পরিশ্রান্ত মুখে ফাজ হাওয়ার মধ্য থেকে ক্যাবিনেট রুমে উদয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খবর দিলেন কিডিচ খেলার ওয়ার্ল্ড কাপে গোলমাল হয়েছে (উচ্চারণ করলেন কুইডিচ)। সেই গোলমালে কিছু মাগলরা জড়িত; তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারও কারও হাতে ইউ-নো-হুর ছাপ আবার দেখা গেছে। ফাজের মতে ওটা একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা, মাগল লিয়াজো অফিস যথারীতি মেমোরী মডিফিকেশনস করছে বলে জানিয়েছে।

ওহো দুঃখিত, আমি একদম ভুলে গেছি, আমরা তিনটে বিদেশী ড্রাগন আমদানি করছি আর একটি স্ফিংকস। (দানবী বিশেষ: ওদের মাথা ছিলো নারীর মতো আর শরীরটা সিংহিনীর মতো। তারা তাদের সামনে দিয়ে মানুষজন গেলে ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো, উত্তর দিতে না পারলে তাদের হত্যা করতো) ট্রি-উইজার্ড টুর্নামেন্টের জন্য। কিন্তু এখন ডিপার্টমেন্ট ফর দ্য রেগুলেশন অ্যান্ড কাউন্সিল অফ ম্যাজিকেল ক্রিচারস আমাকে বলছে যে রুল বুকে লেখা আছে ওই রকম মারাত্মক জন্তু-জানোয়ার দেশে আনার আগে আপনাকে জানাতে হবে।

আমাকে, কী বললেন, ড্রাগন? প্রধানমন্ত্রী তোতলাতে তোতলাতে বললেন।

হ্যাঁ তিনটে, ফাজ বললেন। আরো একটা স্ফিংকস। ভালো থাকুন…।

প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন ড্রাগন আর স্ফিংকস মারাত্মক জন্তু, ওদের চেয়ে আর কিছু মারাত্মক হতে পারে না, কিন্তু তার ভাবাই সার; দুবছরের মাথায় ফাজ আবার আগুন থেকে বেরিয়ে এসে খবর দিলেন, বহু কয়েদী আজকাবান জেল ভেঙ্গে পালিয়েছে।

জে.. জে. জেল ভেঙ্গে পালিয়েছে? প্রধানমন্ত্রী কর্কশ কণ্ঠে বললেন। না না তার জন্য উদ্বিগ্নের কোন কারণ নেই!

ফাজ জোর দিয়ে বললেন, (ফিরে যাবার জন্য ফায়ারপ্লেসের আগুনের শিখায় এখন একটা পা রেখেছেন) ওদের ঠিকই ধরতে পারা যাবে, সময় লাগবে না। শুধুমাত্র খবরটা আপনাকে জানাতে এসেছিলাম। মানে আপনার জানা উচিত বলেই!

প্রধানমন্ত্রী উত্তেজিত গলায় কিছু বলার আগেই ফাজ বললেন, এখন, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। ফাজ লেলিহান অগ্নিশিখার মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। খবরের কাগজ আর তার বিরোধীরা যাই বলুক না কেন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু মোটেই মূর্খ বা মোটা মগজের লোক নন। তিনি একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন, ফাজ তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে যাই আশ্বাস দিয়েছিলেন না কেন, এখন দেখা যাচ্ছে তিনি ঘন ঘন আসছেন আর প্রতি মিটিংয়ে বেশ হৈ চৈ করছেন, আর চঞ্চলতা দেখাচ্ছেন। তবে ফাজকে ভালো লাগুক চাই না লাগুক, তাকে ম্যাজিক মন্ত্রী বলুন বা না বলুন, প্রধানমন্ত্রীর মনের মধ্যে এক ভয়ের বাসা দানা বেঁধে রইলো হয়তো ফাজ আগামীবার আরো এক গুরুতর সংবাদ দেয়ার জন্য আসতে পারেন। আবার ফাজ এলেন সেই একই রকমভাবে ফায়ারপ্লেসের আগুনের ভেতর থেকে। প্রধানমন্ত্রী ফাজের উদভ্রান্ত চেহারা উসখো-খুসকো ভাব দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী জানেন না কেন তিনি এসেছেন, গত সপ্তাহে কত দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, দারুণ এক বিষাদপূর্ণ সপ্তাহ!

আপনাদের জাদুকর সম্প্রদায়ের মধ্যে কি ঘটছে না ঘটছে তা আমি কেমন করে জানবো? প্রধানমন্ত্রী তীক্ষ্ণস্বরে বললেন। শুনুন আমাকে একটা দেশ চালাতে হয়, এখন অনেক সমস্যা রয়েছে, সেগুলো দেখতে হবে।

ফাজ বাধা দিয়ে বললেন, আমাদেরও ওই একই সমস্যা। ব্রুকডেল ব্রিজ আসলে জীর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পড়েনি, পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপারটা ঘূর্ণিঝড় নয়। হত্যা দুটো মাগলরা করেনি, হাবার্ট চোরলের পরিবার আপাতত নিরাপদে থাকবে আশা করা যায়। আমরা বর্তমানে তাকে সেন্ট মাংগোজ হসপিটাল ফর ম্যাজিকেল ম্যালাডিজ অ্যান্ড ইনজুরিস-এ স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করছি। পাঠানো হবে আজ রাতেই।

আপনারা কি করবেন না করবেন তার ব্যাপারে আমি…? প্রধানমন্ত্রী বিরক্তিমাখা স্বরে বললেন।

ফাজ সামান্য নীরব থেকে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনাকে গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে তিনি ফিরে এসেছেন। হি হু, যার নাম অবশ্যই মুখে আনা যায় না, ফিরে এসেছেন।

ফিরে এসেছেন? আপনি বলছেন ফিরে এসেছেন, তার মানে বেঁচে আছেন, মরেননি?

বছর তিনেক আগের কথাবার্তার স্মৃতির ভাণ্ডার প্রধানমন্ত্রী হাতড়াতে লাগলেন, ফাজ তাকে বলেছিলেন, এক ভয়ঙ্কর জাদুকরের কথা, যাকে সকলে ভয় পেতো, সেই জাদুকর হাজার হাজার ভয়ঙ্কর অপরাধ করে পনের বছর আগে হঠাৎ রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, বেঁচে আছে, ফাজ বললেন। সত্য কথা, অবশ্য আমি জানি না, একজন মানুষ নিহত হলেও কি করে সে বেঁচে থাকে, বা তাকে হত্যা করা যায় না। আমি যথার্থভাবে এর মানে বুঝি না, ডাম্বলডোরও এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেন না, কিন্তু সে যাহোক–তার এখন নিশ্চিত একটি দেহ আছে, সে এখন হাটছে, কথা বলছে, হত্যা করে চলেছে। তাই আমি মনে করি, মানে আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য বলতে পারি, হ্যাঁ অবশ্যই সে বেঁচে আছে।

প্রধানমন্ত্রীর মাথায় এলো না, কি বলার আছে সেই সম্বন্ধে, কিন্তু তার চরিত্রের একটি স্বভাব সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা। তবে অতীতে তার সঙ্গে কী কী বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন মনে করতে পারলেন না।

ওহ তাহলে সিরিয়স ব্ল্যাক ওর সঙ্গে, না না, হি-হুর নামতো করতে নেই?

ব্ল্যাক? ব্ল্যাক? ফাজ বিক্ষুব্ধ চিত্তে বললেন, তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাউলার হ্যাট ঘন ঘন ঘোরাতে লাগলেন। সিরিয়স ব্ল্যাকের কথা আপনি বলতে চাইছেন? যার ছোট দাড়ি, না। ব্ল্যাক মারা গেছে, আমাদের ধারণা বদলে গেছে, ব্ল্যাক সম্বন্ধে ভুল করেছি। বেচারা নির্দোষ ছিল। ও কোন ভাবেই হি-হু যার নাম অবশ্যই মুখে আনতে নেই তার সঙ্গে ছিলো না। ফাজ সিরিয়স ব্ল্যাককে সমর্থন করে, আঙ্গুল দিয়ে বাউলার হ্যাট আরো জোরে ঘোরাতে ঘোরোত বললেন, সে যে নির্দোষ ছিলো তার অন্তত পঞ্চাশজন সাক্ষী আছে, বলতে পারেন চাক্ষুস সাক্ষী, কিন্তু সে যাহোক, আগেই বলেছি ও বেঁচে নেই, বলতে পারেন ওকে হত্যা করা হয়েছে। ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের চত্বরেই। সেই সম্বন্ধে একটা তদন্ত হবে, আসলে…।

প্রধানমন্ত্রী ফাজের দিকে তাকালেন, ফাজের জন্য হঠাৎ তার মনে করুণার ভাবে ছেয়ে গেলো। কিন্তু সেই করুণা দপ করে অন্তর্হিত হলো। মনে হলো কাজের মতো ফায়ারপ্লেসের জ্বলন্ত আগুনের মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়ার ক্ষমতার অভাব থাকলেও তার অধীনস্থ সরকারের অন্তর্গত কোনো ডিপার্টমেন্টে এখনও পর্যন্ত কোনো হত্যা-টত্যা হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী তার ডেস্কের কাঠে হাত রাখলেন, ফাজ বলে চললেন, কিন্তু বর্তমানে ব্ল্যাকের প্রসঙ্গ না এনে বলতে পারি আমাদের যুদ্ধ চলছে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।

যুদ্ধ? প্রধানমন্ত্রী একটু যেন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন। একটু অতিরঞ্জিত করছেন। কি?

ফাজ বললেন, যে সমস্ত অনুগামীরা আজকাবানের জেল ভেঙ্গে হি-হু মাস্ট নট-বি-নেইমডের দলে যোগ দিয়েছে। ফাজ খুব দ্রুত কথাগুলো বললেন। বলার সময় হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাউলার হ্যাটটা এমনভাবে মোচড় দিতে লাগালেন যেন হ্যাটটা লেবু চেপরাচ্ছেন। এরা বাইরে আসার পর থেকে তারা সবাই যাচ্ছেতাই কাণ্ডকারখানা করে চলেছে, ব্রকডেল ব্রিজ ভেঙ্গেছেন, স্যার তিনি ভয় দেখাচ্ছেন যদি আমি তার এসব কাজে বাধা দেই, আরো মাগল গণহত্যা করবেন…।

প্রধানমন্ত্রী ফাজের কথা শুনে রেগে টং হয়ে বললেন, ওহো আপনি সেই ব্যক্তি… ওহ গড… আপনার জন্যই আমাকে মরচেধরা খুঁটি আর ক্ষয়ে যাওয়া এক্সপানসন জয়েন্টের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, তাছাড়া আরো হয়তো কিছু আছে, আমি জানি না!

আমার দোষ! আজও রেগে গেলেন। আপনি কি বলতে চান, নানাভাবে আপনাকে ফাঁদে ফেলছি, ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চালাচ্ছি।

নাও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে উঠে ঘরময় পায়চারি করতে করতে বললেন, আমাকে দেখছি ওই ব্ল্যাকমেইলারদের আরো নতুন অত্যাচার, বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা করার আগে মোকাবেলা করার সবরকমের প্রস্তুতি নিতে হবে।

আপনি কি সত্যই মনে করেন আমি তার জন্য কিছু করিনি, ঘুমিয়ে রয়েছি? ফাজ মর্মাহত হয়ে বললেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি গুপ্তচর অতিশয় সজাগ, সেসব জেলভাঙ্গা কয়েদীগুলোকে শুধু নয় তার সকল অনুগামীদের ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু মনে রাখবেন আমরা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন মহাশক্তিশালী জাদুকরকে নিয়ে আলোচনা করছি। সেই মহাশক্তিশালী জাদুকর গত তিরিশ বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

তাহলে আপনি একথা বলতে চান পশ্চিম অঞ্চলের প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের জন্য তিনি দায়ী, তিনিই ঘটিয়েছেন? প্রধানমন্ত্রী বললেন। প্রতিটি মুহূর্তেই তার উম্মা যেন বেড়েই চলেছে। জনসাধারণ তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না। তাদের মতে যা কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে তার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার দায়ী, সরকারের অমনোযোগ ও ব্যর্থতা।

ফাজ দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, প্রবল সামুদ্রিক ঝড় তো হয়নি!

আমাকে ক্ষমা করবেন, প্রধানমন্ত্রী প্রবলভাবে পায়ের শব্দ করতে করতে পায়চারি করতে লাগলেন। গাছ পড়ে গেছে, ছাদ উড়ে গেছে, রাস্তার আলোর পোস্ট দুমড়ে-মুচড়ে গেছে, মারাত্মক ও করুণভাবে লোকজন আহত হয়েছে।

ওইসব কাণ্ড ঘটিয়েছে রক্তচোষারা, ফাজ বললেন। তারা সব হি-হু যার নাম উচ্চারণ করতে নেই, তার অনুগামীরা। তাছাড়া আমরা মনে করছি ওই ব্যাপারে দানবদেরও হাত আছে।

পায়চারি করতে করতে কাজের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী আচমকা থেমে গেলেন। এমনভাবে হঠাৎ করে থামলেন যেন চলার সময় মাথাটা অদৃশ্য এক দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কাদের হাত রয়েছে!

ফাজ মুখ বিকৃত করলেন, গতবারে তিনি দানবদের কাজে লাগিয়ে ছিলেন, তখন তিনি আনন্দ উৎসব করার মনস্থির করেছিলেন। আমাদের মিস-ইনফরমেশন দপ্তর ঘড়ির কাঁটার মতো দিন রাত্রি কাজ করে চলেছে। আমাদের পর্যবেক্ষক দল সব মাগলদের যারা এ সকল দুর্ঘটনায় আহত নিহত হয়েছে তার সঠিক বৃত্তান্তের ডেটা সংগ্রহ করছে তাদের স্মৃতি থেকে বা যা যা দেখেছে তা থেকে। আমাদের রেগুলেশন অ্যান্ড কাউন্সিল অফ ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচার চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজছে দৈত্যদের পাকড়াও করার জন্য, এরপরও এসকল দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। দুর্বিপাক ছাড়া আর কি।

প্রধানমন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ওসব ছেঁদো কথা ছাড়ুন।

আমাদের মন্ত্রণালয়ের সকলের আত্মবিশ্বাস খুবই কমে গেছে, ফাজ বললেন। তার ওপর অ্যামেলিয়া বোনসের হত্যা।

তিনি কে?

অ্যামেলিয়া বোনস, ম্যাজিকেল ল এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রধান। আমাদের মনে হয় হি-হু যার নাম উচ্চারণ করা ঠিক না, সম্ভবত তিনি তাকে হত্যা করেছেন, কারণ তিনি খুবই উঁচুমানের ডাইনি ছিলেন, আর যেটুকু খবর পেয়েছি তাতে যা বোঝা যায়, সহজে তিনি হার মানেননি।

কথাটা বলে ফাজ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন, আর হাতের হ্যাটটা ঘোরানো বন্ধ করলেন।

হত্যার খবরটা খবরের কাগজে বেরিয়েছিলো, প্রধানমন্ত্রী সামান্য সময় তার উম্মা প্রশমিত করে বললেন। আমাদের কাগজে অ্যামেলিয়া বোনস সম্পর্কে এটুকু বলেছে তিনি ছিলেন মধ্যবয়স্কা এক মহিলা, একা থাকতেন। সত্যি, খুবই ঘৃণ্য হত্যা, তাই না? হত্যার খবরটা খুবই প্রচারিত হয়েছে। পুলিশও বিভ্রান্ত।

ফাজ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ঠিকই বলেছেন। যে ঘরে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো, তাই না? আমরা খুব ভালো করেই জানি কে তাকে হত্যা করেছে, তাকে ধরার কোনো পথও রাখেনি। তারপর এম্মেলাইন ভানসের হত্যা, মনে হয়, সে খবরটা আপনার কানে আসেনি।

হা হা এসেছে! প্রধানমন্ত্রী বললেন। ঘটনাটা ঘটেছে তো আমাদের খুবই কাছাকাছি, তাই তো! খবরের কাগজওয়ালাদের তো পোয়াবারো, ছেপেছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পেছনের বাগানে আইন শৃঙ্খলার অবনতি।

কথাটার কোন গুরুত্ব না দিয়ে ফাজ নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে বললেন, ডিমেন্টররা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডাইনে বাঁয়ে যাকে পাচ্ছে তার ওপর চড়াও হচ্ছে।

আগে কোনো এক সময় ডিমেন্টরদের ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভাল বুঝতে পারতেন না, দুর্বোধ্য মনে হতো, কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ।

আমি তো জানি ডিমেন্টরেরা আজকাবান জেল রক্ষার দায়িত্বে আছে। খুবই সাবধানে কথাটা প্রধানমন্ত্রী বললেন।

ঠিকই বলেছেন, এককালে তাই তো তারা করতো, ফাজ ক্লান্তস্বরে বললেন। কিন্তু এখন আর করছে না, হি-হু-র দলে যোগ দিয়েছে। আমি কোনো লুকোচুরি না করে বলছি না, ব্যাপারটা মোটেই আকস্মিক নয়।

কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী একটু যেন ভয়ার্ত সুরে বললেন, আপনি তো বলছেন তারা জন্তু-জানোয়ারের মতো আমাদের জনসাধারণের আশা এবং শান্তি চুষে নিচ্ছে?

ঠিকই বলেছেন, তাদের সংখ্যাও দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। সেই জন্যই তো অকালে কুয়াশার আবির্ভাব।

প্রধানমন্ত্রী তার চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসলেন। হাঁটুতে যেন জোর নেই। ওই সব অদৃশ্য জম্ভরা গ্রামে শহরে বিচরণ করছে, তার ভোট দাতাদের মধ্যে হতাশা আর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, কথাটা ভাবতেই তার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন।

তাহলে তো এখন কিছু একটা স্টেপ নেয়া দরকার ফাজ! আমার তো মনে হয় আপনার ম্যাজিক মন্ত্রী হিসেবে এর দায়িত্বটা নিতে হবে, তাই না?

প্রধানমন্ত্রী, সত্যই কী আপনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এই সব ঘটনার পরও আমি ম্যাজিক মন্ত্রী আছি? আমার তিনদিন আগে চাকরি গেছে! জানেন না, সমস্ত জাদুকর সম্প্রদায় গত পনের দিন ধরে আমার পদত্যাগের জন্য দাঁত কিড়মিড় করে চলেছে। আমি আজ পর্যন্ত তাদের এতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখিনি! ফাজ হাসার চেষ্টা করেও হাসতে পারলেন না।

প্রধানমন্ত্রী এক সময় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, কি বলবেন ভেবে পেলেন না।

তার সামনে হতাশ ও বিষণ্ণ মুখে বসে থাকা মানুষটিকে অপছন্দ করলেও তার জন্য দুঃখ হলো, খুব খারাপ লাগলো।

আমি সত্যই খুব দুঃখিত তিনি ধীরে ধীরে বললেন। আমি কী আপনার জন্য কিছু করতে পারি?

ধন্যবাদ আপনার সহানুভূতির জন্য প্রাইম মিনিস্টার, এখন আর কিছু করার নেই। এখনও পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তা আপনাকে জানানোর, আর আমার জায়গায় যিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তার তো এর মধ্যে আসার কথা, কিন্তু তিনি খুবই ব্যস্ত মানুষ, যা সব কাণ্ডকারখানা হচ্ছে তার জন্য সম্ভবত ব্যস্ত রয়েছেন।

কথাটা বলে ফাজ দেওয়ালে ঝোলানো কুৎসিৎ বেঁটে লোকটার দিকে তাকালেন। দেখলেন ও মাথার কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো পাকা চুল কানের ওপর থেকে সরিয়ে একটা পাখির পালকের কলম দিয়ে কান চুলকে চলেছে।

ফাজের মুখের দিকে ওর চোখ পড়তেই বললো, এসে যাবেন, এখনই এসে যাবেন। এই মাত্র তো ডাম্বলডোরকে একটা চিঠি লেখা শেষ করলেন।

ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন, ফাজ বললেন, এই প্রথম তার গলায় তিক্ততার সুর। গত পনেরো দিন ধরে আমি ডাম্বলডোরকে রোজ অন্তত দুটো করে চিঠি লিখে চলেছি, কিন্তু একচুলও নড়ছে না, যাকগে, হয়তো আমার জায়গায় এসে স্ক্রিমগৌর আরো ভালো কাজ করবেন, কৃতকার্য হবেন।

কথাটা বলে ফাজ মুখ গোমড়া করে রইলেন। মুখ দেখে বোঝা যায় খুবই বেদনাহত। কিন্তু ঘরের নীরবতা ভঙ্গ করলো পোর্ট্রেট। হঠাৎ দপ্তরী মেজাজ সুলভ কণ্ঠে বললো।

মাগলদের প্রধানমন্ত্রী অবহিত হোন, একটি জরুরি সাক্ষাতের অনুরোধ রুফাস স্ক্রিমগৌর ম্যাজিক দপ্তরের মন্ত্রী, আশাকরি দ্রুত অনুরোধের জবাব দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী হকচকিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। সবেমাত্র কথাটা শেষ করেছেন ঠিক সেই সময় ফায়ারপ্লেসে পান্নার মতো সবুজ আগুন জ্বলে উঠলো, তার ভেতর থেকে লাটুর মত বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় জাদুকর প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকলেন। গা ঝাড়া দিয়ে পুরানো কার্পেটের ওপর দাঁড়ালেন। ফাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। প্রধানমন্ত্রীও ইতস্তত করে চেয়ার ছেড়ে একই রকমভাবে উঠে দাঁড়ালেন। নতুন অতিথি তার লম্বা কালো আলখেল্লার গা থেকে ধুলো ঝেড়ে চারদিকে তাকালেন।

প্রধানমন্ত্রীর মনে হলো ক্লাস স্ক্রিমগৌর একটা বুড়ো সিংহের মতো। তার সিংহের কেশরের মতো মাথার লম্বা লম্বা তামাটে রঙ-এর ভোরাকটা চুল, মোটা ঘন ভুরু, হলুদ বর্ণের চোখ। চোখে তারের ফ্রেমের চশমা, লাফিয়ে চলার মতো লম্বা লম্বা দুটি পা। তাহলেও হাঁটার সময় সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটেন। চোখে মুখে ধূর্ততা ও দৃঢ়তার ছাপ; প্রধানমন্ত্রীর বুঝতে একটুও সময় লাগলো না কেন জাদুকর সম্প্রদায় এই নিদারুণ বিপদের সময় কাজের বদলে তাকে তাদের নেতা করে নিলো।

প্রধানমন্ত্রী মার্জিতভাবে তার হাত ধরে বললেন, কেমন আছেন? স্ক্রিমগৌর প্রধানমন্ত্রীর হাত কিছুক্ষণ ধরে রেখে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করে নিলেন তারপর তার আলখেল্লার ভেতর থেকে একটা জাদুদণ্ড টেনে বার করলেন।

ফাজ অবশ্যই আপনাকে বিস্তারিতভাবে সব বলেছে? দরজার কাছে গিয়ে জাদুদণ্ড দিয়ে দরজার চাবির ছিদ্রটায় মৃদু টোকা মারতে মারতে বললেন। প্রধানমন্ত্রী শুনতে পেলেন তালা ক্লিকের শব্দ।

ও হ্যাঁ, ফাজ আমাকে সব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বললেন। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে দরজায় তালা না দেওয়াই ভালো।

আমি চাই আমাদের কথা-বার্তায় কেউ যেন বাধা না দেয়, স্ক্রিমগৌর সংক্ষেপে বললেন, অথবা আমার প্রতি কেউ লক্ষ্য রাখে, কথাটা বলে জাদুদণ্ডটা জানালার দিকে প্রসারিত করতেই খোলা পরা বন্ধ হয়ে গেলো। হ্যাঁ কি বলছিলাম, আমি খুবই ব্যস্ত মানুষ, আসুন প্রয়োজনীয় কথাবার্তা দ্রুত সারি। প্রথমত আপনার নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনায়।

প্রধানমন্ত্রী যতোটা পারলেন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, বললেন আমার নিরাপত্তা সম্বন্ধে আমি খুবই নিশ্চিন্ত। সব রকমের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ভালো, আপনি নিরাপদ ভাবতে পারেন; কিন্তু আমরা তা ভাবছি না, স্ক্রিমগৌর বাধা দিয়ে বললেন। মাগলরা নিজেদের খুবই অসহায় ভাবতে পারে যদি তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমপেরিয়াস কার্সে আক্রান্ত হন। আপনার আউটার অফিসের নতুন সেক্রেটারি।

সত্যি কথা বলতে কি আমি কিংগশ্নে শ্যাকল বোল্টকে বাদ দিতে চাই না, আপনি কী সেটাই বলতে চাইছেন! প্রধানমন্ত্রী একটু উদ্ধত স্বরে বললেন। তিনি খুবই এফিসিয়েন্ট, অন্যসব অফিসারদের চাইতে দুগুণ কাজ করেন।

কারণ তিনি একজন জাদুকর, স্ক্রিমগৌর বললেন। বলার সময় একটুও হাসলেন না। উনি একজন উচ্চ-শিক্ষাপ্রাপ্ত অউরর, আপনার নিরাপত্তার ভার তাকে দেয়া হয়েছে।

দাঁড়ান, দাঁড়ান এক মিনিট! প্রধানমন্ত্রী বললেন। শুনুন আপনি আপনার লোক আমার অফিসে নিযুক্ত করতে পারেন না, আমি ঠিক করব কে বা কারা আমার

অফিসে কাজ করবে, আমি ঠিক করবো কে আমার কাজ করবে।

আমি ভেবেছিলাম শ্যাকেল বোল্টের কাজকর্মে আপনি সন্তুষ্ট। স্ক্রিমগৌর বীতরাগ হয়ে বললেন।

অবশ্যই, তবে…। তাহলে তো কোনো সমস্যা দেখছি না, কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে?

আমার, না কোনো সমস্যা নেই, খুবই ভাল কাজকর্ম করেন শ্যাকেল বোল্ট, প্রধানমন্ত্রী বললেন, কিন্তু মনে হয় ম্যাজিকমন্ত্রী তার কথায় তেমন কান দিলেন না।

তা হলে শুনুন হারবার্ট চোরলের ব্যাপার, আপনার জুনিয়র মিনিস্টার, তিনি বলে চললেন। ওতো হাস সেজে জনসাধারণকে মজা দিচ্ছে।

কি বলছেন আপনি? প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করলেন।

ও খুবই সাধারণ ইমপেরিয়াস কার্সের রিঅ্যাক্ট করেছে, স্ক্রিমগৌর বললেন। সেই কার্সে তার মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না সেই কারণে মারাত্মক কিছু হতে পারে।

ওতো পাতিহাঁসের মতো প্যাক প্যাক করছে! প্রধানমন্ত্রী মিন মিন করে বললেন। একটু বিশ্রাম নিলে, ওষুধ খেলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবেন।

আমরা বলার পর একদল হিলার, সেন্ট মাংগোস হসপিট্যাল ফর ম্যাজিকেল ম্যালডিজ অ্যান্ড ইনজুরিস ওকে পরীক্ষা করছে। খবর পেয়েছি ও তিনজনকে গলাটিপে মারবার চেষ্টা করেছিলো, স্ক্রিমগৌর বললেন। আমার মনে হয় ওকে কিছুদিনের জন্য মাগলদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখলে ভাল হবে।

আমি বলছিলাম কি, ও ভাল হয়ে যাবে না? প্রাইম মিনিস্টার বললেন। কথাটা শুনে স্ক্রিমগৌর শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন, চলে গেলেন ফায়ারপ্লেসের কাছে।

হ্যাঁ এই কথাটাই আমি আপনাকে বলতে চাই। যাকগে ওর চিকিৎসার ব্যাপারে আপনাকে যথারীতি জানানো হবে প্রাইম মিনিস্টার, আমি কাজে খুব ব্যস্ত থাকবো তাই ব্যক্তিগতভাবে নাও আসতে পারি, সেক্ষেত্রে কাজকে আপনার কাছে পাঠাবো। উনি আমাদের সঙ্গে উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হয়ে থাকতে সম্মত হয়েছেন। নতুন ম্যাজিকমন্ত্রীর কথা শুনে ফাজ হাসবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হাসি এলো না মুখে। এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন দাঁতে ব্যথা হয়েছে। স্ক্রিমগৌর তখন মিসটেরিয়স পাউডারের জন্য পকেট হাতড়াচ্ছেন, সেটা ফায়ারপ্লেসের আগুনে নিক্ষেপ করলেই সবুজ হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী কয়েক মুহূর্ত ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সারা সন্ধে সে কথাগুলো দমবন্ধ করে আটকে রেখেছিলেন মুখের মধ্যে, সেই কথাগুলো সহসা ছিটকে বেরিয়ে এলো।

ঈশ্বরের দোহাই আপনারা দুজনেই জাদুকর! আপনারা জাদু করতে পারেন। তাহলে কি করতে হবে না করতে হবে দুজনে একসঙ্গে বসে ঠিক করতে পারেন, সবই তো পারেন!

স্ক্রিমগৌর ফাজের মুখের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকালেন, এইবার হাসি চেপে রাখতে পারলেন না, হাসলেন কোনোরকমে। বললেন, সমস্যাটা কোথায় জানেন, অন্যেরাও তো ম্যাজিক জানে মি. প্রাইম মিনিস্টার।

তারপর দুজনে এক এক করে সবুজ আগুনের শিখার মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *