৩৭. দ্য লস্ট অব প্রফিসি

৩৭. দ্য লস্ট অব প্রফিসি

আকাশ থেকে হ্যারি পৃথিবীর বুকে পা রাখলো। ও পোর্ট-কী থেকে বেশ জোরে গোড়ালিতে বেশ ব্যথা লেগেছে। ও পড়ার সঙ্গে জাদু করা সোনার মুণ্ডুটাও পড়েছে। সামান্য ভেঙে গেছে। ও তাকিয়ে দেখল হেডমাস্টার ডাম্বলডোরের অফিস রুমে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হেড মাস্টার ডাম্বলডোরের অনুপস্থিতে ঘরের অনেক কিছু বদলানো হয়েছে। সেই ক্ষণে ভঙ্গুর রূপোলি ইনস্ট্রমেন্টটা আবার স্পিন্ডল-লেগড টেবিলের ওপর শোভা পাচ্ছে। মৃদু মৃদু ঘুরছে আর বাম্প ছড়াচ্ছে। অতীতের হেডমাস্টার হেডমিস্ট্রেসরা তাদের ফ্রেমের মধ্যে ঝিমুচ্ছেন। আর্ম চেয়ারের পিছনে তাদের মাথা ঠেকানো, নয়তো ছবির ফ্রেমে। হ্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশের সীমান্তে হালকা সবুজ মেঘের রেখা, একটু পরই ভোর হবে।

ঘরে-বাইরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে ঘুমন্ত প্রোট্রেটের (অতীতের শিক্ষকদের) মৃদু মন্দ নাকের ডাক, নয়তো এপাশ-ওপাশ করার শব্দ। যদি আশপাশের পরিবেশ ওর মনের কথা বুঝতে পারত তাহলে তারাও ব্যথা পেত। ও সুন্দরভাবে সজ্জিত অফিস ঘরে মনটা হালকা করার জন্য ধীরে ধীরে পায়চারী করতে করতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। কোনো জিনিস ভাববে না চিন্তা করল। কিন্তু সেই একই চিন্তা-ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, পরিত্রাণের পথ নেই বুঝতে পারল।

ওরই দোষে সিরিয়স মারা গেছেন, হ্যাঁ সবই ওর দোষ। মূর্খ হ্যারি ভোমের্টের ফাঁদে পা না দিলে হয়তো সিরিয়স বেঁচে থাকতেন। ও যা স্বপ্নে দেখেছিলো সেটা বাস্তব না ভাবলে হয়তো বিপদের ঝুঁকি নিতো না। হারমিওন ঠিক বলেছিল–হ্যারি সব সময় হিরো বনতে চায়।

যতোবার ভাবে সিরিয়সের মৃত্যুর কথা ভাববে না; কিন্তু একই দৃশ্য ওর সামনে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে গভীর অন্ধকার এক গর্ত, যেখানে সিরিয়স দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেখান থেকে সিরিয়স বিলীন হয়ে গেছেন। ও একা থাকতে চায় নীরবতার মাঝে। ও কিছু সহ্য করতে পারছে না।

শূন্য ফায়ার প্লেসটা হঠাৎ পান্তার মতো সবুজ আগুনের রশ্মিতে ভরে গেলো। হ্যারি দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে আগুনের দিকে তাকালো। দেখলো আগুনের ভেতর থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে আসছেন। একটু একটু করে ডাম্বলডোর তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে তার ঘরে পা রাখলেন। ঘরের দেয়ালের ফ্রেমের জাদুকর-জাদুকরীরা সচকিত হয়ে ডাম্বলডোরকে স্বাগত জানালেন।

ডাম্বলডোর তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ধন্যবাদ!

ডাম্বলডোর হ্যারির দিকে তাকালেন। দরজার পাশে রাখা পাখির দাঁড়ের কাছে গিয়ে আলখেল্লার পকেট থেকে পালকবিহীন ছোট, দৃষ্টিকটু তার প্রিয় ফকেসকে বার করলেন। তারপর ট্রেতে রাখা নরম ছাই সোনার দাঁড়ের তলায় রাখলেন। দেখতে দেখতে সেই সোনার দাঁড়ে হৃষ্টপুষ্ট ফকাস দোল খেলো।

তারপর পাখি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হ্যারিকে দেখে বললেন–ওহ হ্যারি। তুমি শুনে খুশি হবে তোমার কোনো বন্ধুদের তেমন মারাত্মক আঘাত লাগেনি। ম্যাডাম পমফ্রের পোসানে তারা সবাই সুস্থ হয়ে উঠছে।

হ্যারি বলতে চেষ্টা করলো সুখবর! কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোলো। ওর মনে হলো হয়তো ডাম্বলডোর বলতে চাইছেন তিনি নিজে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু চোখে মুখে তার কোনো খেদ নেই। শান্ত-প্রশান্ত মুখ। কাউকে কোনো দোষ বা ব্যথা দিতে চান না, নিজেরও কষ্টের কথা কাউকে বলতে চান না। হ্যারি চোখ ফিরিয়ে নিলো, ডাম্বলডোরের দিকে তাকাতে পারছিলো না।

ডাম্বলডোর বললেন–ম্যাডাম পমফ্রে চিকিৎসা করছেন। মনে হয় টোংকসকে বেশ কিছুদিন সেন্ট মাংগোসে থাকতে হতে পারে। তবে বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই।

হ্যারি কার্পেটের দিকে মুখ নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আকাশের রং বদলে যাবার সঙ্গে কার্পেটের রং বদলে যাচ্ছে। ওর মনে হলো ঘরের যত প্রোট্রেট আছে তারা উর্ণ হয়ে ডাম্বলডোরের কথা শুনছে। হয়তো ভাবছে ডাম্বলডোর, হ্যারি কোথায় গিয়েছিলো, তাদের সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন কেন?

ডাম্বলডোর খুব আস্তে আস্তে বললেন, হ্যারি, তুমি কি ভাবছো আমি সবই বুঝতে পারছি।

কিন্তু হ্যারি হঠাৎ উদ্ধত হয়ে বললো, না, পারছেন না।

ডাম্বলডোর ওর মনের ভেতর কি হচ্ছে জানবেন কেমন করে? ফিনিয়েস নিগোলাস বলে উঠলো–ছাত্রদের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করবেন ডালডোর। ওদের যারা ভালোবাসে তাদের ওরা ভালবাসে না। ভালো করলে মন্দ বলে, নিজেদের দুঃখ–বেদনা সবকিছুই বড়ো করে দেখে।

ডাম্বলডোর বললেন–এবারে আপনি চুপ করুন অনেক বলেছেন।

হ্যারি ডাম্বলডোরের দিকে না তাকিয়ে জানালায় বাইরে তাকিয়ে রইলো। ওখান থেকে ও কিডিচ স্টেডিয়াম দেখতে পাচ্ছে। মনে পড়ে গেলো সিরিয়স একবার ছদ্মবেশে ওখানে গিয়েছিলেন, লোমওয়ালা কুকুর হয়ে। হ্যারি জানে, মৃত্যু হাতের মুঠোয় করে হ্যারির খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। সে কথা মনে পড়তেই ওর দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে গেলো। এমনও হতে পারে কে ভাল খেলে দেখতে গিয়েছিলেন–হ্যারি না জেমস। হ্যারি কিন্তু কখনও সিরিয়সকে নিজের কথা বলেনি।

তোমার মনে যা হচ্ছে, যা ভাবছো, তার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন। কিন্তু সব সময় মনে রেখো, তোমার মানসিক দৈহিক যন্ত্রণাই হচ্ছে তোমার শক্তির উৎসস্থল।

হ্যারির মনে হলো ওর রাগের তীব্র দহন ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, দাউ দাউ করছে শূন্যতা। ডাম্বলডোরের নীরবতা আর ফাঁকা বুলি ও সহ্য করতে পারছে না। প্রতিঘাতের কামনায় মন-প্রাণ ছটফট করে উঠলো।

–আমার শক্তি, তাই? হ্যারি বললো। হ্যারির গলার স্বর কাঁপতে লাগলো। কিডিচ স্টেডিয়ামের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, আপনার জানার মন নেই।

–আমি কি জানি না, না জানতে চাই না? ডাম্বলডোর হেসে বললেন, হ্যারি তুমি যে যন্ত্রণা পাচ্ছো তাতেই প্রমাণীত হয় তুমি মানুষ! দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা মানুষের জীবনের অঙ্গ।

তাহলে, আমি মানুষ হতে চাই না! হ্যারি প্রায় গর্জন করে বললো। কথাটা শেষ করেই ও ডাম্বলডোরের টেবিলের ওপোরে রাখা ক্ষণ ভঙ্গুর সূক্ষ্ম যন্ত্রটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। দেয়ালে সেটা লেগে খান খান হয়ে গেলো। দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলো হ্যারির রাগ দেখে তারাও রেগে গেলো। আর মান্ডো ডিপেট বললো সত্যি!

হ্যারি তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তোয়াক্কা করি না!

–একটা লুনাস্কোপ তুলে নিয়ে ফায়ার প্লেসে ছুঁড়ে দিলো। আমি অনেক সহ্য করেছি, আমি আর পারছি না, আমি এর শেষ চাই, আমি আর কিছু পরোয়া করি না।  

টেবিলটাও হ্যাচকা টান মেরে ফেলে দিলো। টেবিলটা শুধু ভাঙলো না, ওর একটা পায়া ছিটকে পড়লো।

ডাম্বলডোর বললেন, কে বললো তুমি গ্রাহ্য করো না।

ডাম্বলডোরের মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ধীর-স্থির শান্ত চিত্তে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যারি তার অফিস তছনছ করছে তবু কোনও রাগ নেই, ধীর স্থির শান্ত। তুমি এতো বেশি ভাবছে যে যন্ত্রণায় প্রচুর রক্তপাত হতে হতে তুমি শেষ হয়ে যাবে।

–না আমি ভাবতে চাই না! হ্যারি এতো জোরে কথাটা বললো–তাতে মনে হলো ওর কণ্ঠনালী ছিন্ন হবে। পরমুহূর্তে ও চাইলো ডাম্বলডোরের কাছে ছুটে গিয়ে তাকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করতে। শান্ত মানুষটির প্রশান্ত মুখ কাঁপিয়ে দিতে, আঘাত করতে, ওর মনের মধ্যে যে বিভীষিকা বহন করে চলেছে তার অংশীদার হতে।

–হ্যাঁ তুমি ভাবো, ডাম্বলডোর বললেন। আরও বেশি যেনো শান্ত তিনি। তুমি তোমার বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। তাদের অন্তরের স্নেহ–ভালোবাসা কতোটাই বা পেয়েছো, তুমি তো জানো না বাবা-মার স্নেহ ভালোবাসার স্বাদ। তার মূল্য অনেক।

–আপনি আমার মনের দুঃখের গভীরতা জানেন না, হ্যারি বললো। আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাচ্ছেন, আপনি…।

কিন্তু কথা বাড়িয়ে কিছু হবে না বা জিনিসপত্র ভাঙলেও। ও দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে চাইলো। ও দৌড়াবে সেদিকে মন চায় যেদিকে। আর পিছন ফিরে তাকাবে না। শেষে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াবে যেখানে ও দিকে নীল চোখের দৃষ্টিপাত দেখতে পাবে না, সামনে দাঁড়ানো শান্ত, দুর্বোধ্য বৃদ্ধকেও না। ও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দরজা পর্যন্ত একরকম দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খোলার জন্য দরজার নব ঘোরালো, ঘোরাতেই লাগলো…।

কিন্তু সেই বন্ধ দরজা খুললো না। হ্যারি, ডাম্বলডোরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।

–আমাকে বাইরে যেতে দিন, ও কাঁপতে কাঁপতে বললো। ডাম্বলডোর শুধু বললেন, না। এখন তুমি বাইরে যাবে না। কয়েক মুহূর্ত দুজনে দুজনের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

–আমাকে বাইরে যেতে দিন, হ্যারি অধৈর্য হয়ে আবার বললো। ডাম্বলডোরের মুখে একই কথা, না।

–আপনি যদি না দেন, যদি এখানে আটক করে রাখেন…।

–তুমি চাইলে আমার সব জিনিসপত্র ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করতে পারো, ডাম্বলডোর অচঞ্চল কণ্ঠে বললেন।

কথাটা বলে ডাম্বলডোর চেয়ারে বসে হ্যারির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন ওর মুখের ভাব।

ডাম্বলডোরের মতে শান্ত স্বরে হ্যারি তখন বললো, অনুগ্রহ করে আমাকে যেতে দিন। হ্যারি অনেক শান্ত হয়ে গেছে।

–আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি যেতে পারবে না, ডাম্বলডোর বললেন।

–আপনি মনে করেন আপনার কথা শোনার জন্য আমি খুবই ব্যাগ্র? আপনি কি বলতে চান তাতে আমার মাথা ব্যথা নেই, আমি শুনতে চাই না। হ্যারি বললো আপনার কোনও কথা আমি শুনতে চাই না, চাই না।

-হা শুনতে হবে, ডাম্বলডোর অবিচল চিত্তে বললেন। আমার ওপোর তোমার যতোটা রাগ-অভিমান হওয়ার কথা তা তুমি দেখাচ্ছো না। তুমি যদি আমাকে আঘাত করো, যা তুমি এখন করে চলেছে, তার জন্য আমি কিছু মনে করছি না, এই ভেবে যে সেটা আমার প্রাপ্য।

–আপনি কী বলছেন?

ডাম্বলডোর ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করে সোজা বললেন–আমার দোষেই সিরিয়স মারা গেছে, অথবা আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, ওর মৃত্যুর জন্য সম্পূর্ণ আমি দায়ি। তাহলেও বলছি–সম্পূর্ণ দায়ভার আমার নয়। সিরিয়স সাহসী, চতুর ও প্রাণচঞ্চল মানুষ ছিলেন। তার মতো প্রকৃতি বা চরিত্রের মানুষের গৃহকোণে বন্দি হয়ে থাকা, লুকিয়ে থাকতে সম্ভব না, যখন জানে তার আপনজন কেউ বিপদগ্রস্ত। একটা উদাহরণ দিলে ভালো হবে, তুমি জানবে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না যে আজ রাতে তোমার অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজে যাবার কোনও প্রয়োজন ছিলো না। হ্যারি আমার মতোই অনেক আগেই তোমার জানা উচিত ছিল যে, ভোল্ডেমর্ট তোমাকে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজে আনার জন্য ফাঁদ পেতেছে! তাই আজ রাতে তোমার সেখানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। তোমাকে বাঁচানোর জন্য সিরিয়সকে যেতে হতো না। তাই আমি একাই সম্পূর্ণ দোষটা আমার ঘাড়েই নিচ্ছি।

হ্যারি জানেনা ওর একটা হাত তখনও দরজার নবে রাখা। ও ভুলে গেছে হাত সরিয়ে নিতে। ও ডাম্বলডোরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর নিঃশ্বাস ঠিক মতো পড়ছে না। কিছু কথা কানে আসছে, কি কি শুনছে তা ও জানে না।

–বসো হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন। আদেশ নয়, অনুরোধ মাত্র।

হ্যারি ঘরময় স্তুপাকার করা ভাঙা ছড়ানো জিনিসপত্র ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ডাম্বলডোরের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো।

ফিনিয়েস নিগেলাস হ্যারির বা ধার থেকে ধীরে ধীরে বললো, তাহলে আমার গ্রেট–গ্রেট গ্র্যান্ডসন, ব্ল্যাক পরিবারের শেষ সদস্য আর নেই, মারা গেছে?

ডাম্বলডোর বললেন, হ্যাঁ ফিনিয়েস, সিরিয়স আর নেই। ফিনিয়েস বললেন, আমার বিশ্বাস হয় না।

হ্যারি দেখলে, নিজের প্রোট্রেট থেকে ফিনিয়ে বেরিয়ে এসে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই গ্রিমন্ড প্লেসে গেলেন খবরটা যাচাই করতে।

ডাম্বলডোর জবাবদিহির সুরে বললেন, আমার তোমার কাছে জবাবদিহি বাকি আছে। এক বৃদ্ধ মানুষের ভুলের জবাবদিহি। এখন আমার মনে হয় তোমার সম্বন্ধে যা করেছি, বা করিনি, সবই আমার বয়সের ছাপের জন্য। যৌবন কখনও বয়সের কথা ভাবে না, সে সম্বন্ধে মাথা ঘামায় না; কিন্তু একজন বৃদ্ধ মানুষ সত্যই দোষী হয় যদি তারা বয়সের কথা না ভেবে কাজ কর্ম করে।

দিন বাড়ছে, সূর্য মধ্যগগনে উঠছে তার প্রখর রৌদ্র ছড়িয়ে পর্বতের ওপোর কমলা রঙ ছেয়ে গেছে। আকাশে কোনো রঙ নেই, উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

বাইরে থেকে সূর্য কিরণ ডাম্বলডোরে শুভ্র ভুরুযুগলে আর ঝোলানো দড়িতে এসে পড়েছে। মুখের বলি রেখা গুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

–ডাম্বলডোর বললেন, যত দূর মনে হয় পনের বছর আগে, যখন তোমার কপালের কাটাদাগ দেখেছিলাম, কিসের জন্য তা জানতাম না। মনে হয়েছিল সেটা তোমার আর ভোল্টেমর্টের সম্পর্কের জন্য হয়েছে।

হ্যারি বললো, আগেও অনেকবার এই কথাটা বলেছেন প্রফেসর। রূঢ়ভাবে না, শান্তভাবে বললো ও এখন তার ধারও ধারে না। ও এখন কোনো কিছুরই ধার ধারে না।

–হ্যাঁ বলেছি; ডাম্বলডোর বললেন, কিন্তু তোমার ওই কাটা দাগের প্রসঙ্গ খোলা দরকার। আমার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে। তুমি জাদুর জগতে প্রবেশ করার পর যখনই ভোল্ডেমর্ট তোমার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করে তখন তোমার কাটা দাগে জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়। এটা একটা সতর্ক বার্তা বলতে পারো। অথবা যখন তুমি অতি ভাবাবেগে আপ্লুত হও।

হ্যারি সংক্ষেপে বললো, আমি জানি।

–ভোটে ফিরে আসবার পর তোমার ওটা বেড়েছে। হ্যারি চুপ করে রইলো। এসব কথা ও আগেই জানে।

–ইদানীং বেশি দূরে যেতে হবে না, ডাম্বলডোর বললেন। আমি বিশেষভাবে উদবিগ্ন হলাম, যখন বুঝতে পারলাম ভোল্ডেমর্ট চায় তোমার আর ওর মধ্যে ওই সম্পর্কটা থাকুক। একেবারে স্থিরভাবে বুঝলাম কোনো কোনোও সময়ে যখন তুমি ওর মন আর চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করো, ও তোমার উপস্থিতি ধরতে পারে। অবশ্য আমি বলছি সেই ঘটনাটা, যখন তুমি উইসলির ওপোর আক্রমণের স্বপ্ন দেখেছিলে।

হ্যারি বললো, হ্যাঁ, স্নেইপ আমাকে বলেছিলেন।

–প্রফেসর স্নেইপ, ডাম্বলডোর হ্যারির ভুল ধরিয়ে দিলেন। তোমার কী একবারও মাথায় আসেনি কেন আমি নিজে তোমাকে সরাসরি অকলামেন্সি শেখালাম না? কেন মাসের পর মাস তোমাকে দেখলাম না, কথা বললাম না?

হ্যারি ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো। তাকে বড়ই ক্লান্ত ও বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। –হা হা, আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।

–হ্যাঁ, আমার মনে হয় খুব একটা বেশি দিনের ব্যাপার নয় ভোল্ডেমর্ট তোমার মনের মধ্যে জোর করে প্রবেশ করে, তোমাকে ম্যানিপুলেট করে ভুল পথে তোমার চিন্তাতে হস্তক্ষেপ করছে। আমি অবশ্য সেই ব্যাপারে ওকে কোনও উৎসাহ বা বাহবা দিতে চাই না। ও ভেবেছিলো, তোমার আমার সম্পর্কটা মাস্টার আর তার ছাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকতে পারলে তোমাকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতে পারবে। হ্যাঁ, ওর গতিপথ দেখে আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো তোমাকে কবলস্থ করতে পারে। আমি সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। কোনও এক অবস্থায় যখন আমার তোমার কাছে, খুব কাছাকাছি আসার অবকাশ হয়েছিলো, তখন আমার মনে হয় আমি ভোল্ডেমর্টের কালোছায়া তোমার চোখের মধ্যে দেখেছিলাম।

হ্যারির সেই সাপের কথা মনে পড়ে গেলো একটা শুয়ে থাকা সাপ মাথা তুলেছে ছোবল মারার জন্য। যখন ডাম্বলডোর আর ও খুব কাছে চোখের দিকে চোখ রেখে তাকিয়েছিলেন।

ভোল্ডেমর্টের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তোমাকে আয়ত্বে আনা, আজ রাতে যেমন হয়েছিলো। আমার মৃত্যু নয় ও তোমার মৃত্যু চেয়েছিলো।

এইসব কারণেই আমি সর্বদা তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে চেয়েছি। তোমাকে দূর থেকে রক্ষা করার জন্য হ্যারি। এক বৃদ্ধের দোষে, সিরিয়স…।

দুমাস আগেও হ্যারি ওইসব ঘটনা জানতে খুবই উৎসাহী ছিলো। এখন আর তেমন উৎসাহ নেই। তাই বৃদ্ধ ডাম্বলডোরের কথায় তেমন কান দিতে চাইলো না, মন থেকে মুছে ফেলতে পারলে যেনো বাঁচে। সিরিয়স, সিরিয়সের মৃত্যুর সঙ্গে অন্য কিছু মেশানোর ব্যাপারটা এখন সম্পূর্ণ অর্থহীন ওর কাছে।

–সিরিয়স আমাকে বলেছিলো, তুমি নাকি ভোল্টেমর্টের জাগরণ তোমার মনের মধ্যে অনুভব করেছিলো, উইসলিকে আক্রমণ সম্বন্ধে অগ্রিম স্বপ্নে দেখেছিলে। তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ভয়টা সত্য হবে। ভোল্ডেমর্ট বুঝতে পেরেছিলো তোমাকে ব্যবহার করতে পারে। তোমার মনের মধ্যে ভোল্টেমর্টের তোমার ওপোর সহসা আক্রমণ করার প্রতিরোধের জন্য প্রফেসর স্নেইপকে তোমাকে অকলামেন্সি শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলাম।

এইটুকু বলে ডাম্বলডোর থামলেন। হ্যারি দেখলো সূর্যালোক, ডাম্বলডোরের ডেস্কের ওপোর থেকে ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে। খানিকটা আলো রূপোর কালির দোয়াত আর অতি মনোরম টকটকে লাল কুইলের ওপোর পড়ে চকচক করছে। হ্যারি জানে যে সব প্রোট্রেট দেয়ালে টাঙানো রয়েছে তারা আগ্রহ ভরে ডাম্বলডোরের কথা এক্সপ্লানেসনগুলো শুনছে। মাঝে মাঝে তাদের আলখেল্লার খস খস শব্দ হচ্ছে। ফিনিয়েস নিগেলাস তখনও ফিরে আসেনি।

–প্রফেসর স্নেইপ জানতে পেরে আমাকে বলেছিলেন, তুমি মাসের পর মাস মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকের অন্ধকার করিডরে আর একটা চকচকে কালো দরজার স্বপ্ন দেখে চলেছে। ভোল্ডেমর্ট, যখন থেকে মৃত্যুর পর পুনরায় তার দেহ ধারণ করেছে, তখন থেকেই সম্ভবত: প্রফিসির কথা শোনার চেষ্টা করে চলেছিলো। ও দরজার আশেপাশে ঘুরে বিস্তারিত জানার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলো, তুমিও করেছিলে। কিন্তু সেই দরজাটি কি এবং কি তার মানে তুমি জানতে পারোনি।

–তারপর তুমি জানো রকউড গ্রেফতার হবার আগে, ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজে কাজ করতো। ভোল্ডেমর্টকে খবর দিয়েছিলো প্রফিসি মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকে খুবই সুরক্ষিতভাবে রাখা আছে যা আমরা জানতাম।

একমাত্র মিনিস্ট্রির লোক, যাদের ওরা বলবে তারা সেই গোপন জায়গা থেকে সেটা হাত দিতে পারবে, কোনরকম অসঙ্গতি ছাড়া। এই ব্যাপারে ভোটে নিজে মিনিস্ট্র অফ ম্যাজিকে গিয়ে এবং মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে, অথবা তার জন্য তুমি সংগ্রহ করবে ঠিক করেছিলো। সেই কারণে তোমার অকলামেন্সি শেখা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো।

–কিন্তু আমি তো তা করতে পারিনি। আমি শেখার ব্যাপারে তো তেমন উৎসাহ দেখাইনি। অতীতের সব স্বপ্ন দেখার জন্য আমি অকলামেন্সি শেখা বন্ধ করেছিলাম; কিন্তু হারমিওন আমাকে বন্ধ করতে মানা করেছিলো। বার বার বলেছিলো। তাহলে কোথায় যাবো… আর সিরিয়স, সিরিয়সকে আটকে রেখে অত্যাচার করছে জানতে পারতাম না।

–স্বপ্ন দেখার পর আমি চেষ্টা করেছিলাম সিরিয়সকে ধরেছে কিনা তা সত্যি কিনা জানার। তাই আমি আমব্রিজের অফিসে কৌশল করে গিয়েছিলাম। গ্রিম প্লেসে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ক্রেচারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। ও বললো সিরিযস বাড়িতে নেই কোথায় গেছেন তা ও জানে না!

ডাম্বলডোর খুব সহজভাবে বললেন, ক্রেচার সত্যি কথা বলেনি, তুমি তো তার মাস্টার নও। তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়লে তো শাস্তি পাবার ভয় নেই। ক্রেচার চেয়েছিলো তুমি মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকে যাও।

–তাহলে ক্রেচার আমাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জাদু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলো?

–আমার তো তাই মনে হয়, সত্যি সত্যি উদ্দেশ্য ছিলো। ও তো অনেকের বাড়িতে কাজ করেছে।

ডাম্বলডোর বললেন–খ্রিস্টমাসের কিছু আগে ক্রেচার সুযোগটা নিয়েছিলো। মনে হয় যখন সিরিয়স ওকে বলেছিলো, চলে যাও। ক্রেচার সিরিয়সের ধমকের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি, তাই ও ভেবেছিলো সিরিয়স ওকে সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। ওটা ওর ইন্টারপ্রিটেসন বলতে পারো। ও ব্ল্যাক পরিবারের অনেকের বাড়িতে, যেমন নার্সিসা ওর কাজিন। (বেল্লাট্রিক্সের বোন, লুসিয়াস ম্যালফয়ের স্ত্রী) অনেক কারণে ওদের ওপোর ওর খুব একটা রেসপেক্ট ছিলো না।

হ্যারি বললো–এতো কথা আপনি জানলেন কেমন করে? ডাম্বলডোরের কথা শুনে উত্তেজনায় ওর নিঃশ্বাস জোরে জোরে পড়ছিলো। ওর মাথাটা কেমন কেমন করতে লাগলো কিছু একটা মনে করার জন্য। মনে পড়ে গেলো ক্রিস্টমাসের সময় ওর লুকিয়ে থাকার কথা। অ্যাটিকে (চিলে কোঠায়) লুকোনোর কথা।

ডাম্বলডোর বললেন, গতকাল ক্রেচার আমায় সব বলেছিলো, ও বুঝতে পেরেছিলো তুমি স্বপ্নে আগাম দেখেছো সিরিয়স ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজের একটা গর্তে ফাঁদে পড়েছে। কথাটা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ ও সিরিয়সের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো। শোনো একটা কথা তোমাকে বলতে চাই, ডলোরেস আমব্রিজের অফিসের আগুনের চাইতে, অর্ডার অফ ফনিক্সের সদস্যদের যোগাযোগ করার আরও অনেক পন্থা আছে। প্রফেসর স্নেইপ জানতে পেরেছিলেন যে সিরিয়স বেঁচে আছে ও গ্রিমন্ড প্যালেসে সুরক্ষিত আছে।

যখন ডলোরেস অ্যামব্রিজকে নিয়ে নিষিদ্ধ অরণ্যে গিয়েছিলে তখন স্নেইপ বুঝতে পেরেছিলেন, তুমি ভোল্টেমর্টের ফাঁদে পা দিয়েছে, বিশ্বাস করে বসে আছে সিরিয়স ভোল্ডেমর্টের কাছে বন্দি। স্নেইপ তখন আমাদের অর্ডারের বিশেষ বিশেষ সদস্যদের তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিল। কথাটা শেষ করে ডাম্বলডোর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, অ্যালস্টর মুডি, নিমফাডোরা টোংকস, কিংগসলে শ্যাকেলবোল্ট, রেমাম লুপিন সেই সময় আমাদের হেড কোয়ার্টারে (অর্ডার অফ ফনিক্সের সদর দপ্তর গ্রিমন্ড প্লেস) বসে ছিলেন যখন স্নেইপ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সকলেই তৎক্ষণাৎ তোমাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হলেন। প্রফেসর স্নেইপ অনুরোধ করেছিলেন, সিরিয়সের যাবার দরকার নেই। আমার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার হেডকোয়ার্টারে থাকা প্রয়োজন। খবরাখবর দেওয়াও বটে। কারণ সেখানে যেকোন মুহূর্তে আমার যাবার কথা ছিলো।

–কিন্তু সিরিয়সকে গ্রিমন্ড প্লেসে রেখে অন্যদের তোমাকে বাঁচাতে যাওয়া একদম চাইলেন না কারণ তুমি বিপদে পড়লে ও ঠিক থাকবে কেমন করে। তাই ক্রেচারকে দপ্তরে থাকতে বললেন, আরও বললেন, আমি ওখানে পৌঁছলে সব যেনো আমায় জানায়। ক্রেচার অব্যশই আমাকে সব জানিয়েছিলো, তবে বলতে গেলে হাসিতে ফেটে পড়ে। কোথায় সিরিয়স গেছে সে কথাও বলেছিলো।

–ও হাসছিলো? হ্যারি ফাঁকা ফাঁকা গলায় বললো।

ডাম্বলডোর বললেন, অবশ্যই হা। তবে ক্রেচার ঠিক আমাদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে সমর্থ ছিলো না। ওতো আমাদের গোপন কীপার নয় (সিক্রেট কীপার) ও ম্যালফয়কে আমাদের গতিবিধির কথা যেমন বলতে পারে না, তেমনি আমাদের গোপনীয় পরিকল্পনা ওর কাউকে জানানোর অধিকার নেই। আরও ওকে বলা হয়েছে ও কখনোই যেনো সিরিয়সকে অমান্য না করে। তবে নারসিসাকে ও খুব দামি তথ্য দিয়েছিলো–সেই তথ্য ভোল্ডেমর্টের কাছে খুবই প্রয়োজনীয় হয়েছিলো।

–কী রকম তথ্য?

পৃথিবীর মানুষের মধ্যে তোমাকেই সিরিয়স বেশি ভালোবাসে আপনভাবে। আর তুমি সিরিয়সকে বাবা, ধর্মপিতা হিসেবে সম্মান করো। ভোল্ডেমর্ট জানতে সিরিয়স আমাদের অর্ডারের সঙ্গে জড়িত। আর তুমি তার ঠিকানা জানো এবং কোথায় থাকে। ভোল্ডেমর্ট বুঝতে পারলো ক্রেচারের দেওয়া তথ্য থেকে সিরিয়স হচ্ছে একটি লোক যাকে উদ্ধার করার জন্য তুমি স্বর্গ-মর্ত পাতাল এক করে দিতে পারো, এমনকী প্রাণও দিতে পারো।

হ্যারির দুঠোঁট ঠাণ্ডা, অষাড় হয়ে গেলো।

–সেই জন্য যখন আমি গতরাতে ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম সিরিয়স বাড়িতে আছেন কি নেই।

–কোনও সন্দেহ নেই ম্যালফয় ভোল্টেমর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ওকে বলেছিলো যেমন করেই হোক সিরিযসকে সরিয়ে রাখতে। বিশেষ করে তোমার ভিসনেও যখন এসেছিলো যে–সিরিয়সকে অত্যাচার করা হচ্ছে। তাই তুমি যখন ক্রেচারের কাছে সিরিয়স বাড়িতে আছে কি নেই খোঁজ করেছিলে ও বেমালুম মিথ্যে বলেছিলো। গতকাল ক্রেচার বাকবিক আহত করেছিলো। সেই সময় তুমি যখন সশরীরে আগুনে দেখা দিয়েছিলে… সিরিয়স তখন দোতলায় হিপোফিকে পরিচর্যা করছিলো।

কথাটা শুনে হ্যারি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো। ফুসফুঁসে এক কণাও যেনো বাতাস নেই।

–ক্রেচার, ম্যালফয়ের কথা শুনে আপনাকে মিথ্যে কথা বলেছিলো, কর্কশ স্বরে বললো হ্যারি।

–কিন্তু আমাকে তো বোকা বানানো সহজ নয় সে কথা ভালো করেই জানো। ওকে জেরা করে আসল ব্যাপারটা জানার পর আমি মিনিস্ট্রিতে গিয়েছিলাম।

–আশ্চর্য! বুঝতে পারছি না হারমিওন কেন ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে বলে।

–সম্ভবত ও ঠিক কথা তোমাকে বলেছিলো। ডাম্বলডোর বললেন, আমরা যখন বারো নম্বর গ্রিমন্ড প্লেসে আমাদের সদর দপ্তর খোলার কথা সিরিয়সকে বলেছিলাম তখন এ কথাও ওকে বলেছিলাম, ক্রেচারের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে, ওকে দয়া করতে ও সম্মান করতে। অবশ্য ওকে সাবধান করে দিয়েছিলাম ক্রেচার হয়তো আমাদের কাছে সাংঘাতিক হয়ে যেতে পারে। আমার ধারণা, সিরিয়স আমার কথাগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণভাবে নেয়নি অথবা ক্রেচারকে ঠিক মানুষ হিসেবে মনে করেনি।

হ্যারি মুখ লাল করে বললো–দয়া করে সিরিয়স সম্বন্ধে এমন কথা বলবে না। ডাম্বলডোরের ক্রেচারকে দয়া দেখাবার ব্যাপারটাও মেনে না নিয়ে বললেন ক্রেচার মিথ্যাবাদী, নোংরা, ওর শাস্তি পাওয়া উচিত।

–হ্যারি, ক্রেচারের অবস্থার জন্য জাদুকররা দায়ি, তারাই ওকে ওই রকম বানিয়েছে। ডাম্বলডোর বললেন, আমি মনে করি ওকে দয়া করা দরকার। তোমার বন্ধু ডব্বির মতো ওর অবস্থা। সিরিয়সের হুকুম তামিল করতে ওকে বাধ্য করা হয়েছে, কারণ সিরিয়স তাদের পরিবারে শেষ জীবিত সদস্য ছিলো। ও সেই পরিবারে ক্রীতদাসের মতো কাজ করে। তাই এই পর্যন্ত ব্ল্যাক পরিবারের প্রতি পারতপক্ষে ওর কোনও অটল আনুগত্য ছিলো না। আমি অন্তত একথা মানি সিরিয়স এমন কিছু করেনি যার জন্য ক্রেচারের জীবনযাত্রা সুখকর হতে পরতো।

–সিরিয়স সম্বন্ধে এমন কথা বলবেন না, হ্যারি প্রতিবাদ করলো বেশ জোরে জোরে।

কথাটা বলে হ্যারি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো, রেগে আগুন হয়ে ডাম্বলডোরের ঘর ছেড়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। ওর মনে হলো সিরিয়সকে ডাম্বলডোর সোজা কথায় একটুও বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি সিরিয়স কতোটা সাহসী ছিলেন, কতো কষ্ট পেয়েছেন জীবনে। 

হ্যারি ঘেন্নায় নাক সিঁটিয়ে বললো, আর স্নেইপ? তার সম্বন্ধে আপনার মতামত? তার সম্বন্ধে কিছু বলছেন না কেন? আমি যখন তাকে বলেছিলাম ভোল্ডেমর্ট, সিরিয়সকে আটকে রেখেছেন তখন তিনি আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। যেনো সেটা কোনও ব্যাপারই নয়।

–তুমি কী জানেন না প্রফেসর স্নেইপ অ্যামব্রিজের সামনে তোমার কথার গুরুত্ব না দেওয়ার ভান করা ছাড়া আর কোনও গতি ছিলো না, ডাম্বলডোর বললেন। কিন্তু তুমি জানো না.. স্নেইপ তোমার কথা শোনার পর একটুও দেরি না করে অর্ডারকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। তুমি যখন নিষিদ্ধ অরণ্যে অ্যামব্রিজের সঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে সময় পার হয়ে যাবার পরও ফেরোনি, সেই খবরটা আমাদের স্নেইপ জানিয়েছিলেন। স্নেইপ প্রফেসর আমব্রিজকে বলেছিলেন, তার কাছে যে ভেরিটাসেরাম আছে সেগুলো ভুয়া। আমব্রিজ সেই সিরাম তোমার ওপোর প্রয়োগ করে সিরিয়সের আতাপাতা জানতে চেয়েছিলেন।

ডাম্বলডোরের প্রফেসর স্নেইপকে ক্লিনচিট দেওয়া হ্যারির মনে একটুও দাগ কাটালো না। ওর দৃঢ় ধারণা স্নেইপ সোজা লোক নয়, সিরিয়সের ব্যাপারে স্নেইপ জড়িত।

ও সামান্য তোতলাতে তোতলাতে বললো, স্নেইপ, স্নেইপ! সিরিয়সকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিলেন এবং সিরিয়সকে ভীতু বলেছিলেন।

ডাম্বলডোর বললেন, সিরিয়সের যথেষ্ট বয়স এবং বুদ্ধিও ছিলো। স্নেইপের ব্যবহারেও হেসেছিলো।

–স্নেইপ আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন, অকলামেন্সি শেখানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন, হ্যারি বললো।

–থাক সে কথা। আমি সব জানি। বলেছিই তো তোমাকে আমার নিজের হাতে অকলামেন্সি না শেখানোটা ভুল হয়েছে। আমার অফিসে, আমার উপস্থিতিতে। আমি ভালো করেই জানি, ভোল্টেমর্টের কাছে তোমার মনকে ফাঁকা রাখা মারাত্মক ভুল হয়েছিলো।

–স্নেইপের লেসনের পর, প্রত্যেকদিন আমার কপালে যন্ত্রণা হতো, কাটাদাগে চুলকুনি হতো, আমার খুবই কষ্ট হতো। (ওর রনের কথা মনে পড়ে গেলো)। রন বলেছিলো, তুমি কেমন করে জানবে স্নেইপ যা কিছু করছে তা সবই ভোল্টেমর্টের সুবিধে, মানে যাতে ও তোমার মনের মধ্যে ঢুকতে পারে?

ডাম্বলডোর খুব সহজভাবে খোলাখুলি বললেন, আমি সেভেরাস স্নেইপের ওপোর আস্থা রাখি। কিন্তু আমি বলতে ভুলে গেছি এই বৃদ্ধ মানুষটির ভূলের কথা বলতে। কোনও কোনও ক্ষত সারবার মুখে এলে যন্ত্রণা হয়, রক্তপাতও হয়। আমি ভেবেছিলাম প্রফেসর স্নেইপের হয়তো তোমার বাবার বিরুদ্ধে তার ভুল বোঝাবুঝি শেষ হয়েছে। ভাবাটা হয়তো আমার দোষ।

–আমার বাবার প্রতি তার বিদ্বেষ! তাহলে সিরিয়সের ক্রেচারের প্রতি বিদ্বেষ কেন দোষের হবে?

ডাম্বলডোর বললেন, কে তোমাকে বলেছে, সিরিয়স ক্রেচারকে ঘৃণা করতেন? তাকে ভূত্য ছাড়া আর কিছু মনে করতেন না? সব ব্যাপারে সিরিয়স উদাসীন থাকতেন। সরাসরি বিদ্বেষের চেয়ে উপেক্ষা আর উদাসীনতা অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হয় হ্যারি। যে ফোয়ারেকে আজ আমরা ধ্বংস করেছি, সে প্রচণ্ড একটি মিথ্যে কথা বলেছিলো। আমরা, মানে আমাদের সমগ্র জাদুকর সমপ্রদায় আমাদের লোকদের সঙ্গে দিনের পর দিন খারাপ ব্যবহার করেছি, গালিগালাজ করেছি, আজ তার ফল ভোগ করছি।

–তাহলে সিরিয়স তার ভুল দোষের শাস্তি পেয়েছেন? তাই বলতে চান? হ্যারি বললো।

–শোনো, আমি তা বলিনি, কখনও আমার মুখ থেকে একথা শুনতে পাবে। ডাম্বলডোর উত্তেজনাবিহীন কণ্ঠে বললেন, সিরিয়স তো নিষ্ঠুর ছিলেন না। হাউজ এলফদের প্রতি দয়াবান ছিলেন সাধারণভাবে বলা যায়। কিন্তু ক্রেচারের প্রতি তার কোনও ভালবাসা ছিলো একথা বলতে পারি না। কারণ যে পরিবারকে সিরিয়স ভালোবাসতেন না ক্রেচার তাদেরই জীবিত এক সত্তা ছিলো।

হ্যারি ডাম্বলডোরের দিক পিছন ফিরে ঘর ছেড়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো, হ্যাঁ, তিনি ঘেন্না করতেন।

ঘরে রোদ এসে শুধু উষ্ণ নয় ঘরটাকে ঝলমল করে দিয়েছে। যতো সব প্রোট্রেট রয়েছে তারা হ্যারির গতিপথের দিকে তাকালো। হ্যারি বুঝতে পারলো না ও কি বলেছে, অফিসের দিকে একবারও তাকালো না। বললো, আপনি তাকে বিনা কারণে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলেন, বাইরে বেরোতে অনুমতি দেননি। তিনি আপনার ব্যবহার মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি বলেই গতরাতে আমাকে বাঁচাবার জন্য যেতে চেয়েছিলেন।

–ডাম্বলডোর নির্বিকারভাবে বললেন, আমি সিরিয়সকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলাম।

–কোনও জীবন্ত মানুষ গৃহবন্দি থাকতে চায় না! হ্যারি ডাম্বলডোরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো। গতবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে আপনি আমাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন বলা যায়, আমার সঙ্গে একই ব্যবহার করেছিলেন।

ডাম্বলডোর হ্যারির কথা শোনার পর তার লম্বা লম্বা দশটা আঙ্গুল দিয়ে মুখ ঢাকলেন। হ্যারি তাকালো, কিন্তু ডাম্বলডোরের ক্লান্তি, দুঃখ যা কিছু হোক হ্যারির মন নরম হলো না। তার বদলে ও আরও যেনো উত্তপ্ত হয়ে গেলো। আশ্চর্য হয়ে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকালো। মুখে চোখে ক্লান্তি দূর্বলতার ছাপ। হ্যারি যখন শক্ত, রাগের ঝড় বইয়ে দিচ্ছে তখন দুর্বলের মতো শান্ত থাকার অর্থ?

ডাম্বলডোর হাত সরিয়ে তার অর্ধচন্দ্রের মতো চশমার কাঁচ দিয়ে হ্যারিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বললেন, হ্যারি পাঁচ বছর আগে তোমাকে যে কথাটা বলেছিল সেটা আবার বলার সময় হয়েছে হ্যারি। যেওনা বসো। আমি তোমাকে সব বলছি। আমার অনুরোধ এইটুকু, তুমি একটু ধৈর্য ধরে শোনো। সব শোনার পর তুমি আমার ওপোর তোমার রাগের ঝড় বইয়ে দিও। যা তোমার ইচ্ছে তাই বললো। আমার কথা শেষ না হলে আমাকে বাধা দেবে না। তখন আমিও তোমার প্রশ্ন শুনবো, বাধা দেবো না।

হ্যারি সামান্য সময় ডাম্বলডোরের দিকে তাকিয়ে আবার ডাম্বলডোরের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো।

ডাম্বলডোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। সূর্যের আলোতে সবুজ ঘাসের মাঠ ঝলমল করছে। তারপর জানালা থেকে মুখ সরিয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–কথা শেষ না হলে বাধা দেবে না, তোমার প্রশ্নগুলি মনে রাখবে হ্যারি।

হ্যারি, আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঁচ বছর হলো তুমি হোগওয়ার্টসে এসেছো। সব ঠিক, কোনও বাধা হয়নি। আবার সম্পূর্ণভাবে বাধাহীনও নয়। এই পাঁচ বছরে তুমি কিছু কষ্টও ভোগ করছে। আমি জানতাম, তুমি পারবে তাই আমার নির্দেশে হ্যাগ্রিড তোমার আন্টির আর আঙ্কলের বাড়ির দরজার গোড়ায় তোমাকে রেখে এসেছিলে। দশ–দশটা বছর খুবই কষ্টদায়ক অবস্থায় তুমি রয়েছে আমি স্বীকার করছি।

ডাম্বলডোর থামলেন। হ্যারি চুপ করে রইলো।

–তোমার অবশ্যই জানার অধিকার আছে কেন আমি ওই ব্যবস্থা করেছিলাম, কেন তোমাকে আমি জাদুকর সম্প্রদায়ের পরিবারের কাছে পাঠাইনি। অনেকেই আমার অনুরোধ রাখতে পারলে শুধু খুশি নয়, তোমাকে নিজেদের সন্তানের মতো লালন-পালন করতে পারলে অবশ্যই নিজেদের ধন্য মনে করতো।

 –কেন রেখেছিলাম জানো? আমার সর্বপ্রথম প্রয়োজন ছিলো তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা। তুমি অনেকের চাইতে অনেক বেশি বিপদের মধ্যে ছিলে। ভোল্ডেমর্ট তার আগে মারা গেছে, কিন্তু তার অনুগামীরা? ওদের মধ্যে অনেকই ভোল্টেমর্টের চেয়ে বেশি বই কম নৃশংস ছিলো না। তারা তখন পলাতক, কূপিত, বেপরোয়া আর হিংস্র। তাই সামনের দিকে তাকিয়ে আমার এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো। আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি ভোল্ডেমর্ট একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আমি অবশ্য জানতাম

ওর ফিরে আসাটা কখন–দশ, কুড়ি বা পঞ্চাশ বছর পর হবে। কিন্তু ওর ফিরে আসার ব্যাপারে কিন্তু আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত ছিলাম। একথা জানতাম তোমাকে হত্যা না করে ও শান্ত হবে না, পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে না।

–আমি জানতাম, ভোল্টেমর্টের ম্যাজিক সম্বন্ধে জ্ঞান খুবই বিস্তারিত, আর যে কোনও জীবিত জাদুকরের চেয়ে জানে অনেক বেশি। আমি আরও জানতাম ও যদি এই পৃথিবীতে আরও শক্তিমান হয়ে ফিরে আসে তাহলে আমার অতি শক্তিশালী জাদুমন্ত্র, (স্পেল) চার্মস দিয়ে ওকে পরাস্ত করা হয়তো সম্ভব হবে না।

–কিন্তু ভোল্ডেমর্টের কোথায়, কতটুকু দুর্বলতা আছে তা আমি জানি। তোমায় পরাস্ত করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ তুমি অতি এক পৌরাণিক জাদুর দ্বারা সুরক্ষিত। সেটা ও জানতো। কিন্তু আত্মদ আর অহংকারের জন্য সেই সুরক্ষিত জাদুকে সর্বদাই হেয় ও তুচ্ছ করেছে, অবশ্য নিজের ক্ষতি সাধন করে। তুমি বোধহয় শুনেছো তোমার মা তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। তিনি তোমাকে একটা দীর্ঘকাল স্থায়ী সুরক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন। ও সেটা চিন্তাই করেনি। সেই সুরক্ষার অস্ত্র তোমার ধমনীতে আজ পর্যন্ত বইছে। আমি তোমার মায়ের মৃত্যুর পর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তোমারই মায়ের রক্তের সম্পর্কের সহোদরা, তার একমাত্র আত্মীয় পেটুনিয়া, তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

–আমাকে তিনি ভালোবাসে না, আমি তার কাছ থেকে কিছু পাই না, সর্বদাই তারা আমাকে হেয় করে, লাঞ্ছনা করে এমনকি ভালো খেতে পরতে দেয় না। হ্যারি প্রফেসরের কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে রাগ মিশ্রিত অভিমানের সুরে বললো।

ডাম্বলডোর বললেন–তার স্বামী (ভার্নন), একমাত্র ছেলের প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এইটুকু জানবে তিনি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয় তোমাকে রক্ষার যে চার্ম আমি দিয়ে ওদের কাছে পাঠিয়েছিলাম পেটুনিয়া সেটা সিল করে রেখেছে। তোমার মায়ের আত্মদান, রক্তের সম্পর্কটা আরও দৃঢ় করে রেখেছে এইটুকু বলতে পারি।

–আমি সেটা বিশ্বাস করি না, হ্যারি ক্ষোভের সঙ্গে বললো।

–যেখানে, যে বাড়িতে তোমার মায়ের রক্তের সম্পর্কের মানুষ রয়েছেন, যেটা তোমার বাসস্থান বলতে পারো, সেখানে গিয়ে হাজার চেষ্টা করেও ভোল্টেমর্টের তোমাকে ছোঁয়া তার পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। কিন্তু সেই রক্ষা কবচ তোমার আর তোমার মায়ের বোনের আছে। তার রক্ত তোমার আশ্রয়স্থল হয়েছে। তোমাকে তো বছরে একবার মাত্র যেতে হয়। যতোদিন সেখানে তুমি থাকবে নিজের মনে করবে। তুমি সেখানে ছিলে বলেই ভোল্ডেমর্ট তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। তোমার আন্টি ব্যাপারটা জানেন। আমি যে চিঠিটা তোমার পায়ের কাছে রেখে চলে আসতে বলেছিলাম তাতে সব লিখেছিলাম। ওখানে থাকার জন্যই তুমি পনের পনেরটা বছর বেঁচে আছে তা তোমার মায়ের সহদোরা জানেন।

–থামুন, এক মিনিট থামুন; হ্যারি বললো। ও সোজা হয়ে বসে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকালো।

–আপনি হাউলার গর্জনকারী পাঠিয়ে ছিলেন। আন্টিকে বলেছিলেন, গলাটা আপনার, কথাটা মনে রাখতে।

–আমি ভেবেছিলাম, তোমার আন্টির হয়তো মনে থাকা উচিৎ কেন তোমাকে তার কাছে রাখা হয়েছে। আমি সন্দেহ করেছিলাম, ডিমেন্টরসদের আক্রমণ হয়তো ওকে ভীত করবে, শত্রুর সন্তানকে আশ্রয় দেয়ার বিপদের আশঙ্কা করবে।

–করেছিলো, হ্যারি শান্তভাবে বললো, কিন্তু আঙ্কল তো আন্টি পেটুনিয়ার চাইতে আরও বেশি। তাই আমাকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাউলার শোনার পর আন্টি বলেছিলেন, আমি এখান থেকে ওকে কোথাও পাঠাবো না।

–পাঁচ বছর আগে, তারপর, ডাম্বলডোর বলে যেতে লাগলেন এমনভাবে যেনো তার গল্প শেষ হয়নি; একটু থামলেন বাকিটা বলার জন্য।

–তো তুমি হোগওয়ার্টে এলে, মন তোমার বিষণ্ণ, খুবই রুগ্ন চেহারা। আমি চেয়েছিলাম তুমি বেশ সুন্দর স্বাস্ত্যবান হয়ে এখানে আসবে। সবকিছু বুঝতে পার লাম, পরিস্থিতিতে পড়ে তোমার ওই হাল। তুমি ওখানে থেকে প্রিন্সের মতো হবেই বা কেমন করে। তাহলেও বুঝলাম মোটামুটি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছে।

–আমি যেমনটি চেয়েছিলাম, আশা করেছিলাম, তেমনভাবে তুমি প্রথম বর্ষটা পার করলে। তুমি অনেক বাধা-বিঘ্ন-সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে অতিক্রম করে বেশ সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে লাগলে। ভোল্টেমর্টের মুখোমুখি হয়েও ঠিক থাকলে তুমি একজন শক্ত সামর্থ ছেলের মতো লড়াই করলে, আমার ভালো লাগলো।

–তাহলেও দেখলাম আমার সুন্দর পরিকল্পনার মধ্যে ত্রুটি রয়েছে। ডাম্বলডোর বললেন, খুবই মারাত্মক ক্রটি। আমি সব কিছু আগাগোড়া পর্যালোচনা করে দেখলাম ওই রকম ক্রটি না শোধরালে তোমাকে নিয়ে যেসব পরিকল্পনা করেছি তা সব বানচাল হয়ে যাবে। সেই কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে হবে না, আমাকে একাই করতে হবে। আমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি যখন ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে লড়াই করে আহত হয়ে হসপিটালে ছিলে, দুর্বল, অতি দুর্বল, সেটাই ছিলো আমার প্রথম পরীক্ষা।

হ্যারি বললো, আপনি কি বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে।

–তোমার কী মনে নেই হসপিটাল থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, কেন ভোল্ডেমর্ট তোমাকে হত্যা করতে চায়?

হ্যারি মাথা নাড়লো; হ্যাঁ মনে পড়েছে।

–তুমি কী এখন আমার পরিকল্পনার ক্রটি ধরতে পারলে? খুব সম্ভব না। বেশ, তুমি জানো, আমি ঠিক করেছিলাম তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো না। মাত্র এগার বছর বয়স, আমি ভেবেছিলাম এই কম বয়সে সবকিছু জানার উপযুক্ত নয়। ওই বয়সে তোমাকে কিছু জানাবার আমার একটুও ইচ্ছে ছিলো না। তোমার বয়সের অনুপাতে সেটা ভারি হয়ে যাবে।

–আমার উচিত ছিলো সেই সময় বিপদ সংকেত জানা। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে পারতাম, আমি কেন একটু ডিসটার্ব হইনি। যে প্রশ্নটা তুমি করেছিলে তার জবাব আমি জেনেও কেন তোমায় দিইনি। একদিন তো সেই ভয়ঙ্কর প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। একটি বিশেষ সময়ে যখণ তুমি খুবই নাবালক, আমি ভেবে খুশি হয়েছিলাম, তোমার সেই ছোট বয়সে আমি জবাব দিইনি।

–তারপর হোগওয়ার্টে প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষ শুরু করলে আবার একটা চ্যালেঞ্জ। এমন এক চ্যালেঞ্জ যার মুখোমুখি পাকাপোক্ত জাদুকরদেরও হয়নি। আবার তুমি সসম্মানে বাধা পেরোলে যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

তুমি এবারও আমাকে জিজ্ঞেস করোনি ভোল্ডেমর্ট কেন তোমার শরীরে চিহ্ন রেখেছে। একবার আমরা কথা বলতে বলতে বিষয়টির খুব কাছাকাছিই চলে এসেছিলাম। এরপরও আমি তোমাকে বলিনি। কেন বলিনি? কারণ তোমার বয়স তখন মাত্র বারো। যদিও আগের বছর থেকে এক বছর বেশি, তবুও মনে করিনি তোমাকে বলা যায়। না বলেই তোমাকে ফিরে যেতে দিলাম, রক্তাক্ত ও পরিশ্রান্ত এবং কিছুটা উদভ্রান্ত, কিন্তু বিজয়ী। কথা প্রসঙ্গে তুমি বিষয়টির একেবারে কাছেই চলে এসেই আবার থেমে গিয়েছিলে, আমিও কথা বাড়াইনি। ভেবেছিলাম তোমার মন খারাপ হবে, তুমি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে, আমি তোমার রাতটাকে নষ্ট করতে চাইনি, তোমার বিজয়কেও নয়।

এখন বুঝতেই পারছো আমার মহাপরিকল্পনায় কোথায় ভুল ছিলো, যা ছিল আমার ইচ্ছাকৃত ভুল। অনেক হয়েছে, আর এই ভুল করা যাবে না, আমাকে সংশোধন করতে হবে।

হ্যারি বললো, আমি এখানে ভুল দেখতে পাচ্ছি না…।

ডাম্বলডোর বললেন, হ্যারি তোমার বিষয়ে আমি বেশি ভাবি। সত্য জানার চেয়ে তোমার সুখকেই আমি বড় করে দেখেছি, আমার পরিকল্পনার থেকে বড় করে দেখেছি তোমার মনের শান্তি, তোমার জীবনকে বেশি মূল্য দিয়েছি। আমার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে অনেকের জীবন যাবে জেনেও।

প্রশ্ন আসবে না বলার কারণ কি? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না আমি তোমার কত কাছে থেকে সারাক্ষণ নজরে রেখেছি যেন আমার দুঃখ–বেদনা আর না বাড়ে এবং পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তুমি যদি না বেঁচে থাকো বা না সুখী থাকো, তাহলে অচেনা-অজানা মানুষ বা প্রাণীর অজানা ভবিষ্যতের জন্য জীবন দিয়ে কী হবে? আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তোমার মতো কাউকে পাবো। তুমি তোমার তৃতীয় বর্সে গেলে। আমি একটু দূর থেকেই দেখলাম ডিমেন্টসদের সঙ্গে তোমার লড়াই, তুমি সেখানে সিরিয়সকে পেলে, তাকে রক্ষা করলে এবং জানতে পারলে তিনি তোমার কী হন! আমার কি সে সময় তোমাকে সব বলা উচিত হতো, তুমি যখন বিজয়ী হয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তোমার গডফাদার সিরিয়সকে ছিনিয়ে আনলে। তোমার বয়স তখন তের। তোমাকে না জানানোর কারণ কিন্তু ক্রমশই কমে আসছিলো…।

আর গত বছর তুমি যখন অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং সেডরিক ডিগরির মৃত্যু দেখেছো… তখনও তোমাকে বলিনি… যদিও নিঃসন্দেহ হয়েছি যে, সে ফিরে এসেছে। আমার বোঝা উচিত ছিল, তোমার বয়স কম হলেও তুমি যেহেতু এত সকল বিপদ অতিক্রম করছো, এর ভার সহ্য করার মতো মানষিক শক্তি ও দৃঢ়তা তোমার আছে।

আমার দিক থেকে বলার এটাই। তোমাকে এসকল বিপদ–সঙ্কুল অবস্থায় যে দায়িত্ব ও ভার কাধে নিয়ে তুমি লড়েছো আমি আমার জীবনে কোন ছাত্রকেও তোমার সাড়িতে দাঁড় করাতে পারবো না।

ডাম্বলডোর না থামা পর্যন্ত হ্যারি অপেক্ষা করে, তারপর ডাম্বলডোর একটু থেমে বললেন, এরপরও আমি বুঝছি না… তোমাকে শিশু অবস্থায় মেরে ফেলতে চেয়েছিলো একটি ভবিষ্যত্বাণীর জন্য। তোমার জন্মের অল্প কিছু আগেই এই ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছিল, যদিও সে বিষয়ে তার কাছে পুরো তথ্য ছিলো না। শিশু অবস্থায়ই তিনি তোমাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন সেটাই হবে ভবিষ্যৎবাণীর অঙ্গীকার রক্ষা। তিনি যে ভূল করেছিলেন, প্রমাণিত করলেন তোমার প্রতি তার নিক্ষিপ্ত মৃতু্যবান যাদু ফিরে এসে উল্টো তাকেই আঘাত করলো। তিনি যখন তার শরীরে আবার ফিরে এলেন এবং বিশেষ করে তুমি যখন গতবছর তার কাছ থেকে পালিয়ে এলে, তখন তিনি ভবিষ্যৎবাণীর সম্পূর্ণ বিষয় জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই অস্ত্রটি পাওয়ার জন্য মনোযোগী হয়: তোমাকে ধ্বংস করার জ্ঞানের অস্ত্র।

সকাল আরো ফর্সা হলো। সূর্যের আলো ডাম্বলডোরের কক্ষে লুটিয়ে পড়লো। আলমারির ভেতরে রাখা গর্ডিক গ্রিফিন্ডরের তলোয়ার চকচক করছে। হ্যারি হঠাৎ করে উচ্চস্বরে বললো, ভবিষ্যৎ বাণী টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আমি নেভিলকে বেঞ্চে টেনে তোলার সময় ওর রোব ধরে টান দিতেই ওটা মাটিতে পড়ে…

ভবিষ্যত্বাণী ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হলেও ভবিষ্যত্বাণীটি যার কাছে করা হয়েছে তার ঐ বাণীটি এখনও স্মরণ আছে, ডাম্বলডোর বললেন।

–কে সে? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো, যদিও সে জানে তার উত্তর।

–আমি, ডাম্বলডোর বললেন। ষোল বছর আগে এক বৃষ্টিভেজা শীতের রাতে হগ হেডের এক বারের ওপর তলায় শিক্ষকতার জন্য এক প্রার্থীর সাক্ষাতের জন্য যাই। যদিও এটা আমার রীতি বিরুদ্ধ। আমি গিয়েছিলাম কারণ আবেদনকারীনী প্রপিতামহ ছিল এক বিখ্যাত ভবিষ্যদ্রষ্টা। আমি হতাশ হয়েছিলাম। আবেদনকারীর তেমন কোন যোগ্যতা ও গুণাবলী ছিল না। আমি তখন বেশ ভদ্রভাবেই জানাই সে কাজটির জন্য উপযুক্ত নয়। কথা বলতে বলতে ডাম্বলডোর হ্যারির পেছন দিকে কপা এগিয়ে আলমারী থেকে জাদুর গামলা বের করে টেবিলে রাখলেন। এরপর গামলায় পেনসিভ রাখলেন এবং তার যাদুদণ্ড কপাল পর্যন্ত উঁচু করলেন এবং তার সকল চিন্তার রূপালী পদার্থ গামলায় রাখলেন। তিনি চেয়ারে বসে তার সকল চিন্তা ঘূর্ণাকারে দ্রুত পেনসিভের ভেতরে ঢুকে যেতে দেখলেন। এর পর তিনি স্থির হলেন, যাদুদণ্ড অল্প একটু উঁচু করলেন এবং রূপালী পদার্থে খোচা দিয়ে দণ্ডের মাথায় কিছুটা লাগালেন।

একটা শরীরের অবয়ব ভেসে আসলো–একজন মহিলা এবং তার গায়ে শাল জড়ানো। তার বড় আয়ত চোখ দুটো মোটাভারি লেন্সের চশমার ভেতর দিয়েও ছিল আকর্ষণীয়। তার পা গামলার ওপর তখনও। যখন শিবিল টেরেলনি কথা বলা শুরু করলেন তার কণ্ঠস্বর আগের মতো সুমধুর ও সুকণ্ঠী ছিল না বরং শুষ্ক, কঠিন ও কর্কশ।

ডার্কলর্ডকে যে পরাভূত করবে তার আগমণ ঘটেছে… তার জন্ম হয়েছে এমন এক দম্পতির ঘরে যারা তিনবার ডার্কলর্ডকে বিরোধীতা করেছে… শিশুটির জন্ম সপ্তম মাসের শেষে হবে… এবং ডার্কলর্ড তাকে তার সমতুল্য শক্তিশালী হিসেবে চিহ্নিত করবেন, কিন্তু সে যে কত শক্তিধর হবে তা ডার্কলর্ডের অজানাই থাকে যাবে,.. এবং তারা দুজনের একজনের অপরজনের হাতে মৃত্যু ঘটবে, তাদের কেউ একজন বেঁচে থাকলে অপরজন বেঁচে থাকবে না। সপ্তম মাসের শেষ প্রহরে তার জন্ম হবে যে ডার্কলর্ডকে পরাভূত করবে। প্রফেসর ট্রিলনী আবার রূপালি পদার্থের ভেতরে আবার ডুবে গেলেন।

হ্যারি অনুভব করে কোন কিছু তার সংস্পর্শে আসছে। আবার তার নিঃশ্বাস নেওয়ায় সে কষ্ট পাচ্ছে।

–সে বললো–তার মানে–আমি? ডাম্বলডোর হ্যারিকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেন।

–খারাপ বিষয় হ্যারি, ডাম্বলডোর বললেন, তবে এমনও হতে পারে তোমাকে নির্দেশ করা হয়নি, শিবিলের ভবিষ্যত্বাণী দুজনের ওপর বর্তায়। দুই জাদুকরের পুত্র সে বছরে জুলাই-এ জন্মগ্রহণ করেছে। এ দুজন পুত্রের বাবা-মারা আবার অর্ডার অব ফনিক্সের সদস্য। আবার এই দুই দম্পত্তিই তিনবার ভোল্টেমর্টের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করেছেন। তাদের মধ্যে অবশ্যিই তুমি একজন এবং আরেকজন হলো নেভিল লংবটম।

–কিন্তু তাহলে… ভবিষ্যত্বাণীতে আমার নাম কেন, কেন নেভিল নয়?

–অফিসিয়াল রেকর্ড নামকরণ নতুন করে করা হয়। যখন ভোল্ডেমর্ট তোমাকে শিশু অবস্থায় আক্রমণ করে। তখন এটা ধারণা করা হয়েছে যেহেতু তোমাকে আক্রমণ করেছে সেহেতু শিবিল তোমার কথাই বলেছেন এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন।

–আমিও তো না হতে পারি।

–আমার মনে হয় তা না, কোন সন্দেহ নেই যে, এটা তুমিই। ডাম্বলডোর বললেন।

–তা হলে যে বললেন নেভিলও সে সময় জন্মগ্রহণ করেছে।

–তুমি ভবিষ্যত্বাণীর পরবর্তী অংশটা ভুলে যাচ্ছ, ভবিষ্যতবাণী চূড়ান্ত পর্বে বলা হয়, যে সে পর্যদুস্ত করবে… এবং তাকে তার সমতুল্য হিসেবে তাকে তার দেহে চিহ্নিত করবে। তাই সে করেছে তোমাকে, হ্যারি। নেভিলকে নয়।

–তিনি তো ভুল করেও তা করতে পারেন।

–তিনি তোমাকেই মনে করেছেন বিপদ হিসেবে। লক্ষ্য কর, তিনি কিন্তু পিয়র ব্লাডকে চিহ্নিত করেননি, করেছেন হাফ ব্লাডকে। তিনি তোমার মধ্যে নিজেকে দেখেছেন, তোমাকে চাক্ষুস দেখার আগেই তিনি তোমাকে চিহ্নিত করেছেন। যদিও তার লক্ষ্য তোমাকে হত্যা করার, তিনি তা করেননি। কিন্তু উনি তোমাকে দিয়েছেন শক্তি ও এক ভবিষ্যতের, যে কারণে তুমি বার বার তার আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছো–যা তোমার বা নেভিলের পিতা মাতার কারোরই ছিল না। ডাম্বলডোরের কথা শুনে হ্যারি হতভম্ব ও বাক্যহারা হল, কিছু সময় থমকে থেকে সে জিজ্ঞেস করলো, তা হলে তিনি এটা করলেন কেন? শিশু অবস্থায় আমাকে মেরে ফেললেন না কেন? তিনি কি অপেক্ষা করেছেন, দেখতে, যে বড় হয়ে নেভিল না আমি, কে তার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠবো।

–হতে পারে, সেটা হলে তো বাস্তবসম্মত হতো; ডাম্বলডোর বললেন, তবে ভোল্ডেমর্টের কাছে ভবিষ্যতবাণীর পুরো খবর ছিল না। আমার যখন শিবিল ট্রিলনির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো হগস হেডে সেখানে কান পেতে শোনার কেউ ছিল না। কিন্তু কথা বলার সময়ই আড়িপাতা আবিষ্কার হয় এবং ওটাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

–তাই সে সবটুকু শুনতে পায়নি?

সে শুধু শুরুটা শুনেছে এবং আড়িপাতা তার মাস্টারকে এটা বলতে পারেনি যে, তোমাকে শক্তি হস্তান্তর ও তার সমতুল্য করলে তার নিজের বিপদ ডেকে আনবে। তাই ভোল্ডেমর্ট জানেনি যে তোমাকে আক্রমণ করে তার বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার উচিত ছিলো অপেক্ষা করা এবং আরো জানা। জানতোই না যে তোমার এমন শক্তি হবে যা ডার্কলর্ড জানে না।

–কিন্তু না আমার তো সে রকম শক্তি নেই। আমার এমন কোন শক্তি নেই যা তার নেই। এমনকি আজকে যেভাবে উনি লড়েছেন, সে শক্তিও আমার নেই।

আমার, তার মতো মানুষকে আটকানো বা হত্যা করার ক্ষমতা নেই।

ডাম্বলডোর হ্যারির কথা থামিয়ে বললেন, ডিপার্টমেন্ট অব মিস্ট্রিজে একটা কক্ষ আছে, যেটা সবসময় তালা লাগিয়ে রাখা হয়। এখানে এমন এক শক্তি আছে যা খুবই আশ্চর্যজনক এবং মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। মানুষের জ্ঞান ও প্রকৃতির শক্তির চেয়েও শক্তিশালী। এটা হতে পারে অনেক অজেয় ও অজানা বিষয়ের অনেক পাঠ সেখানে রক্ষিত আছে। এই শক্তি যে তোমার করায়ত্তে যা তার জানা নেই। এই শক্তিই তোমাকে সিরিয়সকে রক্ষা করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। এই শক্তিই তার করায়ত্ব থেকে তোমাকে রক্ষা করেছিল। তিনি তার তীব্র বিরোধী শক্তির শরীরকে অধিগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। সব শেষে তোমাকে রক্ষা করেছে তোমার সদা জাগ্রত মন নয়, এটা তোমার হৃদপিণ্ড যা তোমাকে রক্ষা করেছে।

হ্যারি তার চোখ বন্ধ করে। সে যদি সিরিয়সকে বাঁচাতে না যেত তা হলে সিরিয়সের মৃত্যু হতো না। সেখান থেকে তার চিন্তা ছুটে চলে ভবিষ্যতবাণীর দিকে, ভবিষ্যত বার্তার শেষের অংশে… বেঁচে থাকতে পারবে না… অন্য একজন বেঁচে থাকতে..

তাহলে হ্যারি বললো, তীব্র হতাশা ও বেদনা থেকে, তার অর্থ আমাদের একজনকে অপরজনকে মেরে ফেলতে হবে।

হা–ডাম্বলডোর বললেন।

দীর্ঘ সময় কেউ কোন কথা বললো না। নিস্তব্ধতা। বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের কল কুঞ্জন। গ্রেট হলে ব্রেকফাস্ট খেতে এসেছ। মনে হয়, এমন লোক একেবারেই পাওয়া যাবে না যে খাবে না বা হাসবে না, তারা কেউ জানে না, জানলেও তাদের কিছু আসে যায় না–যে সিরিয়স ব্ল্যাক আর নেই, চিরতরে চলে গেছেন। সে এখন সহস্র যোজন দূরে। হ্যারির মতো তারা কেউ নয় যে এখনো বিশ্বাস করবে মুখের পর্দাটা সড়ালেই সিরিয়স হেসে উঠবে, তাকে সম্ভাষণ করবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে।

ডাম্বলডোর হ্যারির চিন্তা থামিয়ে বললেন, হ্যাঁ আমার আরেকটি কথা বলার আছে। তুমি নিশ্চয়ই অবাক হও, কেন আমি তোমাকে প্রিফেক্ট বানাইনি। আমি চাইনি, তুমি যে ভার বহন করে চলেছে তার সাথে নতুন কোন ভার সংযোজন হোক। তোমার ভার এমনিতেই যথেষ্ট। হ্যারি লক্ষ্য করলো ডাম্বলডোরের চোখে অশ্রু ঝড়ছে মুখ গড়িয়ে, শুভ্র লম্বা দাঁড়ি বেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *