৩১. আউলস

৩১. আউলস

গ্রিফিল্ডর হাউজের হয়ে খেলে কিডিচ কাপ পাওয়ার আনন্দ রনের মনের অবস্থা এতো বেশি উছুল হয়েছিল যে স্বাভাবিক হতে পুরো একটা দিন কেটে গেলো। সারাদিন ও খেলার কথা নিয়ে এতো ব্যস্ত যে হ্যারি আর হারমিওনও গ্রয়পের কথা শোনার সময় পেলো না। তবে রনকে বলার ওদেরও খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা এবং পড়াশুনা করার আদর্শ স্থান লেকের। ধারে বিচ গাছের ছায়াতল। সেখানে বসে ওরা কথা-বার্তা বললে অন্যেরা শুনতে পায় না। কমনরুমে বসে আলাপ-আলোচনা করলে অন্যরা শুনতে পায়। ওরা সেটা চায় না। কিন্তু রন একটু আলাদা, ও কমনরুমে বসে বন্ধু-বান্ধবদের পিঠ। চাপড়ানোতে আনন্দ পায়। হ্যারির হারমিওনকে ছেড়ে কমনরুমে বসে থাকতে ভালো লাগে না। খোলা হাওয়াতে বসলে অনেক ভালো লাগে।

রন হ্যারি, হারমিওনকে দেখতে না পেয়ে কমনরুম ছেড়ে বিচগাছের তলায় চলে এলো। ওরা বই-পত্র ঘাসের উপর ছড়িয়ে কিডিচ খেলার গল্প করতে লাগলো। বক্তা রন, শ্রোতা হ্যারি-হারমিওন।

রনও বললো–আশ্চর্য! তোমরা ডেভিসের প্রথম গোলটা ছাড়া আর কিছু দেখলে না? রনের গলায় হতাশার ছাপ! আমার গোল বাঁচানও না?

–না, দেখলাম কই, হারমিওন রনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বললো।

–কিন্তু রন আমরা মাঠ ছেড়ে সত্যি চলে আসতে চাইনি, বাধ্য হয়েছিলাম।

 –তাই? রনের মুখটা লাল হয়ে গেলো। কেন?

হ্যারি বললো–হ্যাগ্রিড! হ্যাগ্রিড আমাদের ওর মুখের ক্ষত কেমন করে হয়েছে, দেখাতে চেয়ে। আমাদের নিয়ে অরণ্যে গিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছে হ্যাগ্রিডের কথা আমরা অবহেলা করতে পারি না।

রনকে সব ঘটনা বলতে বেশি সশয় লাগলো না। তবে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো।

একজন দানবকে এনে জঙ্গলে রেখেছেন? রন বললো

। –হা, হ্যারি বললো। বলার মধ্যে কোনও উৎসাহ নেই।

–হতে পারে না, এই কথার মধ্যে ও যেন বলতে চাইলো–না তা কি করে সম্ভভ।

হারমিওন বললো, সত্যি বলছি, উনি এনেছেন। গ্ৰয়প কম করে ষোল ফিট লম্বা, কুড়ি ফুট লম্বা পাইন গাছ গোড়া থেকে উপড়ে তুলতে ভালোবাসে, আমাকে মোটামুটি চিনে নিয়েছে। কিন্তু হ্যারি…।

রন হাসলো। তবে হাসিটা স্বচ্ছন্দের নয়।

–হ্যাগ্রিড আমাদের কী করার কথা বলেছেন?

–ওকে ইংরেজি শেখাতে হবে, হ্যারি বললো।

রন অদ্ভুত স্বরে বললো, মনে হয় হ্যাগ্রিড তার ভারসাম্য হারিয়েছেন।

হারমিওন খিটখিটে স্বরে বললো, তাই মনে হয়। কথাটা বলে ও ইন্টারমিডিয়েট ট্রান্সফিগারেশন বই এর একটা পাতা উল্টে প্যাচাঁদের অনেক রকম ডায়াগ্রাম অপেরা গ্লাস নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। দুঃখের সঙ্গে তাই ভাবতে হয়, তবে দুর্ভাগ্য। উনি আমাকে আর হ্যারিকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে নিয়েছেন।

রন বেশ জোর দিয়ে বললো, সোজা সাপটা কথা তোমরা ওইসব প্রমিজটমিজের মধ্যে যাবে না। ওসব চিন্তা ছাড়া এখন আমাদের সামনের পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হবে। যাই হোক নরবেট, অ্যারগেগের কথা মনে আছে? হ্যাগ্রিডের দানব বন্ধুদের সঙ্গে মিশলে কি আমরা ভালো রেজাল্ট করতে পারবো?

হারমিওন সংক্ষেপে বললো, আমি জানি, সব জানি। তবুও আমরা তো কথা দিয়েছি।

রন ওর এলোমলো চুল ঠিক করতে লাগলো।

-হুঁ, রন দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, হ্যাগ্রিড এখনও ছাঁটাই হননি। এখন এই নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, টার্ম শেষ হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন। আমাদের তাই গ্ৰয়পের কাছে যেতে হবে না।

***

ক্যাসেলের মাঠ রোদ পড়ে ঝক ঝক করছে, যেনো নতুন করে রং করা হয়েছে। মেঘশূন্য আকাশ আনন্দে হাসছে। আকাশের ছায়া লেকের ওপর পড়েছে। লেকের জলও রোদে ঝলমল করছে। জুন মাসের মৃদুমন্দ বাতাস লেকের জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলছে। কিন্তু পঞ্চম বার্ষিকের ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র ভাবনা চিন্তা প্যাঁচা নিয়ে। [অর্ডিনারি উইজার্ভিং লেভেল]

ওদের শিক্ষকরা আর হোমওয়ার্ক চাপিয়ে দিচ্ছেন না। যা পড়িয়েছেন সেগুলো ভালো করে রিভাইজ করতে বলেছেন। পরীক্ষায় কি রকম প্রশ্ন আসতে পারে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। গভীরভাবে পড়াশুনা করা ছাড়া হ্যারির মন থেকে সবকিছু উধাও হয়ে, রয়ে গেছে প্যাঁচার চিন্তা।

মাঝে মাঝে মনে হয় লুপিন তার পোসান লেসনের সময়, স্নেইপকে হয়তো বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, হ্যারিকে অকলামেন্সি শেখানোর কথা। যদি সত্যি মনে করিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে সম্ভবত স্নেইপ লুপিনের কথায় কান দেননি। হ্যারিকেও এড়িয়ে চলেছেন। একপক্ষে ভাল হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা স্নেইপের ঘরে গিয়ে অতিরিক্ত ক্লাসে অকলামেন্সি শিখতে হচ্ছে না। হারমিওনও ওর পড়াশুনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। হ্যারিকে তাগাদা দিচ্ছে না, এমনকি এলফদের জন্য মোজা বোনা, জামাকাপড় সেলাই করবার ও সময় পাচ্ছে না।

প্যাঁচা যতোই কাছে আসছে, তার জন্য ও একাই চিন্তিত নয়। এরনি ম্যাকমিলান যার সঙ্গে মুখোমুখি হয় তাকেই তাদের রিভিসনের ব্যাপারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে চলেছে।

ও প্রশ্ন করে হ্যারি আর রনকে–আচ্ছা কতো ঘণ্টা তোমরা পড়াশোনা করছো?

রন বললো, ঠিক বলতে পারছি না, এই কয়েকঘণ্টা হবে।

–নিশ্চয়ই আট ঘণ্টার কম নয়?

রন সামান্য বিরক্ত হয়ে বললো, কমই হবে।

এরনি বললো, আমি আট ঘণ্টা পড়ছি। অ্যাভারেজ আট ঘণ্টা তো হবেই। শনিবার, আমি দশ ঘণ্টা পড়ি, সোমবার সাড়ে ন ঘণ্টা। মঙ্গলবার তেমন নয়। এই সাত ঘণ্টার একটু বেশি। তারপর বুধবার…।

প্রফেসর স্প্রাউট, হ্যারি-রনকে এরনির হাত থেকে বাঁচালেন। তিনজনকে কথা বলতে দেখে তার গ্রীন হাউজে ডেকে নিলেন। এরনির আর কতো ঘণ্টা পড়ছে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলো না। হ্যারি রনের এরনির একঘেয়ে প্রশ্নে মাথা ধরে গেছে।

ইতোমধ্যে ড্রেকো ম্যালফয় প্যানিক সৃষ্টি করার নতুন এক পন্থা পেয়ে গেলো। ওদের স্বভাব চুপ করে থাকা নয়। তার ওপোর আমব্রিজের সুনজর এখন স্কোয়াডের উপর!

পরীক্ষা শুরু হবার কয়েকদিন আগে পোসান শেখার ঘরের বাইরে বেশ জোরে জোরে ক্র্যাবে আর গোয়েলেকে বলতে শোনা গেলো, তোমরা জানো বাবার উইজার্ডিং পরীক্ষার অথরিটির সঙ্গে বহু বছরের বন্ধুত্ব–বুড়ো গ্রিসেল্ডা মার্চ ব্যাংকসের হেড। আমরা তাকে ডিনারে নেমন্ত্রণ করেছি। হাঃ হাঃ বুঝতেই পারছো।

হারমিওন ওর ফাঁকা আওয়াজ শুনে হ্যারি-রনকে বললো, স্রেফ বাজে কথা বলছে?

রন বিষণ্ণ মুখে বললো, যদি সত্যি কথা নাও হয়, তাহলেও আমাদের করবার কিছু নেই।

নেভিল শান্ত স্বরে বললো, আমারও কিন্তু মনে হয় না ও সত্যি কথা বলছে, কারণ সেল্ডা মার্চ ব্যাংকস আমার দাদুর বন্ধু। কখনও তো তাকে ম্যালয়ের নাম বলতে শুনিনি।

–কেমন মানুষ সেই মহিলা নেভিল? হারমিওন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, খুব কড়া?

নেভিল গলার স্বর নামিয়ে বললো, অনেকটা আমার দাদুর মতো।

রন উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললো, তার সঙ্গে জানাশুনা থাকলে, তোমার রেজাল্ট ভালো হবে না তার কোনো মানে নেই।

নেভিল বললো, আমারও তো মনে হয় জানাশোনা থাকলে কিছু যায় আসে। দাদু সবসময়ে মার্চব্যাংকে বলেন, আমি নাকি বাবার মতো পড়াশুনোয় ভালো নই। তোমরাতে তাকে মেস্ট মাংগোসে দেখেছো।

ইতোমধ্যে বাজারে একাগ্রতা, মানসিক শক্তি বর্ধন, দুর্বলতা থেকে মুক্তি ইত্যাদির নানা রকম টনিক বিক্রি শুরু হয়ে গেলো। বিশেষ করে পঞ্চম আর সপ্তম বার্ষিকীর ছেলে-মেয়েরা সেগুলো কেনার জন্য হামলে পড়লো। র‍্যাভেন ক্লর ষষ্ঠ বার্ষিকের ছাত্র এডি কার্মিক্যায়েল, বারুফিওস ব্রেন এলিজারের নাম বলাতে রন হ্যারি সেই টনিক খাবার জন্য দারুণ ক্ষেপে গেলো। এডি বললো, গত বছর ওই টনিকটা খেয়ে আমি নটা আউট স্ট্যান্ডিং পেয়েছি। দাম মাত্র বারো গেলিয়ন। রনের হাতে গেলিয়ন নেই, হ্যারিকে বললো, হোগওয়ার্টস ছেড়ে একটা কাজ-কর্ম পেলেই তোমার ধার শোধ করে দেবো, অর্ধেকটা আমাকে দাও।

হারমিওন হাত থেকে শক্তি বর্ধকটা কেড়ে নিয়ে টয়লেটে ফেলে দিলো।

রন চিৎকার করে বললো, এই ওটা ফেলে দিচ্ছো কেন, আমরা তো ওটা কিনবো।

–হারমিওন বললো, বোকার মতো ব্যবহার করবে না, তাহলে তোমরা হেরল্ড ডিংগলের ড্রাগনের থাবার গুড়ো পাউডার খাও, তাহলেই বুদ্ধি বাড়বে।

রন কৌতূহলী কণ্ঠে বললো, সেটা আবার কী?

হারমিওন বললো, সেটাও আমি বাজেয়াপ্ত করেছি। ওই দুটো টনিক আসলে কোনও কাজ করে না। তোমরা এক নম্বরের গর্দভ।

রন বললো, তুমি জানো না হারমিওন ড্রাগন ক্ল দারুণ কাজ করে? তোমার ব্রেনকে শক্তিশালী করে, কয়েকঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরু করে দেয়।

–হারমিওন প্লিজ আমাকে এক পিস দাও, কোনও ক্ষতি করবে না।

–কে বললে করবে না? করতে পারে, হারমিওন বললো। আমি ওটা দেখেছি, আসলে ওটা শুকনো ডক্সি ড্রপিংগস।

রন আর হ্যারির মস্তিষ্ক শক্তিশালী করার পরিকল্পনা উধাও হয়ে গেলো।

পরবর্তী ট্রান্সফিগারেসন লেসনে পরীক্ষার নিয়মকানুন ও টাইম টেবিলে পাচার প্রসিডিওর ওরা পেয়ে গেলো।

ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার তারিখ, সময় ইত্যাদি ব্ল্যাকবোর্ড থেকে কপি করার সময় প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন, তোমরা টাইম টেবিল থেকে আশাকরি বুঝতে পারছো। তোমাদের প্যাঁচা পর পর দুসপ্তাহ ধরে হবে। মনিং সেশনে থিয়োরি ও দুপুরে প্র্যাকটিস। তোমাদের অ্যাস্ট্রোনমি পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল রাতে হবে।

–এখন তোমরা মনে রাখবে প্রতিটি প্রশ্নপত্রে এন্টি চিটিং চার্ম (নকল যাতে করতে না পারে তার জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে। পরীক্ষার হলে অটো আনসার কুইন নিষিদ্ধ (যে কলমের সাহায্যে সহজেই প্রশ্নের উত্তর লেখা যায়) করা হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে রিমেন্ট্রালস, ডিটাচেবল, ক্রিবিং ও সেলফ কারেক্টিং ইনক। প্রতিবছরই দুএকটি ছাত্র-ছাত্রী নিয়ম ভঙ্গ করে। ভাবে উইজার্ডিং একজামিনেসন্স অথরিটিস রুল সহজেই ভাঙতে পারবে। আমি আশাকরি, এই রকম গ্রিফিন্ডরের ছাত্র-ছাত্রীরা করবে না। আমাদের নতুন হেডমিস্ট্রিস প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন, (তার মুখটা আন্টি পেটুনিয়ার মতো মনে হলো হ্যারির) সেই রকম কোনও নিয়ম বিরুদ্ধ কিছু হলে তার রিপোর্ট যেনো হাউজ হেডদের দেওয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা জানবে পরীক্ষায় চিটিং করলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে, কারণ তোমাদের পরীক্ষার ফলাফল নতুন হেডমিস্ট্রেসের কর্মক্ষমতার নিদর্শন হবে।

কথাগুলো একটানা বলে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললেন, যাইহোক তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের দিকে তাকিয়ে যথাসাধ্য ভালো করতে চেষ্টা করবে।

হারমিওন হাত তুলে বললো, প্রফেসর, কবে নাগাদ আমাদের পরীক্ষার ফল বেরোবে?

–আশা করছি, জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে প্যাঁচা মারফত তোমাদের জানানো হবে। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন।

–খুব ভালো, তাহলে আমরা ছুটির আগেই জেনে যাবো, ডিন টমাস বললো। হ্যারি তখন মানস চোখে প্রাইভেট ড্রাইভের কথা ভাবছিল। ছ ছটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে ফলাফলের জন্যে পাচার প্রতীক্ষায়!

ওদের প্রথম পরীক্ষা, থিয়োরি অফ চার্মস, সোমবার সকালে হবার কথা। রোববার লাঞ্চের পর হ্যারি হারমিওনকে টেস্ট করতে রাজি হলো। তারপরই হারমিওন খুব রেগে গিয়ে সঠিক উত্তর দিয়েছে জেনে ওর হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে, ওর নাকে অ্যাচিভমেন্ট ইন চার্মিং-এর কোনা দিয়ে মারলো।

যে বইটা হারমিওন ওকে টেস্ট করার জন্য দিয়েছিলো সেটা ফেরত দিয়ে বললো, তুমি নিজের পরীক্ষা নিজেই নিতে পারো। নাকে আঘাত থেকে হ্যারির চোখে জল এসে গেছে।

রন কানে আঙ্গুল দিয়ে চার্মসের দুবছরের পুরনো নোটস পড়ে চলেছে, সিমাস ফিনিগন মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ডিন, পার্বতী, ল্যাভেন্ডার পড়ছে, স্ট্যান্ডার্ড বুক অফ স্পেল আর বেসিক লোকোমেসন চার্মস।

ডিনার অন্যান্য দিনের মতো গপ গপ করে না খেলেও কেউ কম খেলো না। হ্যারি–রন চুপচাপ। হারমিওন ব্যাগ থেকে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলো, ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগার চেক করার জন্য। ও ঠিক করেছে কম খেয়ে সারারাত ধরে পড়বে।

হারমিওন এনট্রেন্স হলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো, ওরা, ওরা তাহলে আমাদের পরীক্ষক হবে?

সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি ও রন তাকালো। গ্রেট হলের খোলা দরজা দিয়ে দেখলো প্রফেসর আমব্রিজ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার পাশে কিছু জরা-জীর্ণ জাদুকর জাদুকরি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমব্রিজের মুখ দেখে হ্যারির মনে হলো খুব একটা স্বস্তিতে নেই তিনি। রন খুব আস্তে আস্তে বললো, চলো আমরা কাছ থেকে দেখে আসি।

হ্যারি আর রন পা টিপে টিপে এনট্রেন্স হলের দিকে এগুতে লাগলো। পরীক্ষকদের দেখার দারুণ কৌতূহল ওদের। হ্যারি ভেবেছিলো প্রফেসর মার্চ ব্যাংকস একজন বেঁটে, কুজ দেহের জাদুকরি মুখের–দেহের চামড়া কুঁচকানো, যেন মুখে মাকড়সার জালে ঢাকা।

প্রফেসর আমব্রিজ তার সঙ্গে বেশ জোরে জোরে কথা বলছেন, খুব সম্ভব মার্চ ব্যাংক কালা। কারণ এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে খুব জোরে কথা বলার দরকার হয় না।

–যাত্রা আমাদের ভালই হয়েছে, খুবই আরামদায়ক। এর আগে এখানে আসার অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম। ইদানিং তো আমি ডাম্বলডোরের কথা শুনতে পাই না। কথাটা বলে এমনভাবে হলের দিকে তাকালেন হঠাৎ যেন তিনি কাবার্ডে রাখা একটা ঝাড়ুতে ভর দিয়ে হলে চলে আসবেন। বেশ কিছুদিন ডাম্বলডোরের খবর পাইনি। কোথায় আছেন, কেমন আছেন?

–কোনও খবর নেই। আমব্রিজ-রন, হ্যারি আর হারমিওনের দিকে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে বললেন। (ওরা তখন আমব্রিজের কথা শুনতে পায়নি এমনি ভান করলো। কেন সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে জানানোর জন্য বাঁধা জুতোর লেশ আবার টেনে টুনে বাঁধতে লাগলো। তবে কোথায় আছেন খুব শিগগিরি জানতে পারবো।

–আমার মনে হয় ও যদি নিজে কোথায় আছে না জানায়, তো আপনাদের সাধ্য নেই কোথায় আছে জানার। তখন আমি ট্রান্সফিগারেশন চার্মে পরীক্ষা নিয়েছিলাম, মানে যখন ও NEWT করেছিলো। আমার অন্তত একটা জাদুদণ্ড ওই কাজ করতে অক্ষম আগে কখনও দেখিনি।

আমব্রিজ বললেন, ও হ্যাঁ তাই বটে।

রন, হারমিওন, হ্যারি পাথরের সিঁড়ি দিয়ে পা টেনে টেনে উঠতে লাগলো। চলুন স্টাফ রুমে যাই।

সেদিনের সন্ধেবেলাটা আগামী পরীক্ষার জন্য সব ছাত্রছাত্রীদের মনে দারুণ চিন্তা আর ভয়। সকলেই শেষবারের মতো রিভিসন করে নিচ্ছে। হ্যারি একটু আগেই বিছানায় শুয়ে পড়লো কিন্তু চোখে ঘুম এলো না। শুয়ে শুয়ে ওর কেরিয়র কনসালটেসন আর ম্যাকগোনালের সদম্ভ ঘোষণা, ওকে তিনি অউরর হতে সব রকমের সাহায্য করবেন, কথাগুলো বার বার মনে আসতে লাগলো। কে জানে শেষ পর্যন্ত কি হবে। কিন্তু ও যে একাই নিদ্রাহীন হয়ে বিছানায় শুয়ে রয়েছে তা নয়, প্রায় সব ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা একই। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরের দিন সকালে পঞ্চম বার্ষিক ছাত্রছাত্রীরা চুপচাপ ব্রেকফাস্ট খেতে লাগলো। সকলেরই মুখ চোখ দেখে মনে হয় দারুণ চিন্তিত ও মনের ভেতর ভয় তো আছেই। বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে, খাবার সময় হাত থেকে ছুরি কাঁটামাচ পড়ে যাচ্ছে, মুখ থেকে খাবারও।

ব্রেক ফাস্ট শেষ হলে পঞ্চম আর সপ্তম বার্ষিকের ছাত্র-ছাত্রীরা এনট্রেন্স হলের মুখে একত্রিত হলো। অন্য ছাত্রছাত্রীরা তাদের লেসন ক্লাসে চলে গেলো। তারপর সাড়ে নটার সময় তাদের গ্রেট হলে যাবার জন্য ডাক পড়লো। হ্যারি দেখলো পেনসিভে যেমনটি দেখেছিলো ঠিক তেমনিভাবে পরীক্ষার্থীদের টেবিল সারি সারি করে সাজানো হয়েছে। যাতায়াতের পথও ঠিক তেমনই। স্নেইপ, ওর বাবা, সিরিয়স তাদের প্যাঁচা পরীক্ষা দিচ্ছেন। হলের শেষ প্রান্তে প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের বসবার জায়গা। ছাত্র-ছাত্রীরা যে যার জায়গায় শান্তভাবে বসে পড়লে ম্যাকগোনাগল তাদের দিকে গম্ভীর মুখে তোকালেন। প্রথেম সামান্য গুঞ্জন, তারপর সবাই শান্ত। তখন ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাঁ এবার তোমরা শুরু করতে পারো।

কথাটা বলে তার ডেস্কের ওপর রাখা আওয়ারগ্লাস ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ি ছাড়া ডেস্কের ওপোর রয়েছে কিছু অতিরিক্ত কুইল, কালির বোতল আর পার্চমেন্ট।

হ্যারি দুরু দুরু বক্ষে ওর পেপার দেখলো। চারটে সিট আগে বসেছে হারমিওন। একবার ওর দিকে তাকালো, দেখলো ও লিখতে শুরু করে দিয়েছে। ও প্রথম প্রশ্নটি পড়লো। কঃ জাদুমন্ত্র সম্বন্ধে লেখো, এবং খঃ কোনও কিছু উড়িয়ে দিতে গেলে জাদুদণ্ডের কি রকম মুভমেন্ট প্রয়োজন হবে, তা বর্ণনা করো। হ্যারির স্মৃতিতে আছে একটা মুগূড় অনেকটা ওপোরে ওঠার পর বিকট শব্দ করে এক দানবের মাথার মোটা খুলির ওপোর পড়ে যাওয়া। ও মৃদু হেসে দুটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করলো।

***

কী বলল খুব একটা শক্ত প্রশ্ন আসেনি? দুঘণ্টা পর হারমিওন এনট্রেন্স হলের মুখে দাঁড়িয়ে বললো। হাতের মুঠোয় তখনও প্রশ্নপত্র রয়েছে। আমার মনে হয় চীরিং চার্মস ঠিকমতো লিখতে পেরেছি। একদম হাতে সময় ছিলো না। হিককাপের (হেঁচকির) কাউন্টার চার্জ ঠিকমতো লিখতে পেরেছে তো? মনে হয় আমি ঠিক মতো পারিনি। তেইশ নম্বর প্রশ্নটাও…।

রন গম্ভীরভাবে বললো, হারমিওন এই রকম প্রশ্ন আগেও এসেছে। এরপরে আমরা বার বার একই প্রশ্নের জবাব দিতে চাই না, একবারই যথেষ্ট।

পঞ্চম বার্ষিক ছাত্র-ছাত্রীরা লাঞ্চ খেতে শুরু করেছে তাদের হাউজের টেবিলে পরীক্ষার পর টেবিল আগের মতো ভাগ ভাগ করে রাখা হয়েছে। তারপর ওদের সকলকে গ্রেটহলের পাশে ছোট ঘরের সামনে এলফাবেটিক অর্ডারে ছোট ছোট দল করে জমায়েত হতে হবে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্যে। এক এক করে তাদের ডাক পড়বে। কেউ ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাদুমন্ত্র উচ্চারণ আর জাদুদণ্ড ঘোরানো প্র্যাকটিস করতে লাগলো। মাঝে মাঝে কারও কারও চোখে, পিঠে ভুল করে যাদুদণ্ড লেগে যাচ্ছে।

হারমিওনের ডাক পড়লো। ও অ্যানথনী গোল্ডস্টেইন, গ্রেগরী গোয়েলে আর ডফনে গ্রীন গ্রাসের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে ঘরে ঢুকলো। যেসব ছাত্র ছাত্রীদের আগে ডাক পড়েছিলো তারা আর ফেরেনি গ্রেটহলে। তাই রন আর হ্যারি হারমিওনের পরীক্ষা কেমন হলো জানতে পারবে না।

রন বললো, ওতো ভালো করবেই। মনে আছে, আমাদের একবার চার্মস টেস্টে একশ বারো পার্সেন্ট পেয়েছিলো?

দশ মিনিট পরে প্রফেসর ফ্লিটউইক ডাকলেন, এবারে পারকিনসন, প্যালসি, পদ্মাপাতিল, পার্বতী পাতিল আর হ্যারি পটার ভেতরে যাও।

রন বললো–গুডলাক হ্যারি। হ্যারি জাদুদণ্ডটা শক্ত করে কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে চেম্বারে ঢুকলো।

–প্রফেসর টফটি এখন খালি আছেন পটার, প্রফেসর ফ্লিটউইক বললেন, উনি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। হ্যারি দেখলো ঘরের এক কোণায় প্রফেসর মার্চ ব্যাংকের পাশে ছোট একটা টেবিলের সামনে বসে রযেছেন রোগা ডিগডিগে, মাথা ভর্তি টাকওয়ালা অতি বৃদ্ধ এক জাদুকর। মনে হলো ড্রাকো মালফদের পরীক্ষা নিচ্ছেন মার্চব্যাংক।

যথা সময়ে পটার সেই বৃদ্ধের সামনে দাঁড়ালে তিনি চোখের ছোট চশমাটা নাকের ডগা থেকে তুলে হ্যারিকে দেখতে দেখতে বললেন, তুমি পটার? বিখ্যাত পটার?

হ্যারি আড়চোখে দেখলো ম্যালফয় ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যে মদের গেলাসটা ম্যালফয় শূন্যে ওঠাবার চেষ্টা করেছিলে সেটা মাটিতে পড়ে ভেঙে রয়েছে। অবস্থাটা দেখে হ্যারি পরীক্ষক টফটির সামনে হাসি চেপে থাকতে পারে না। টফটিও হেসে ফেললেন, খুব সম্ভব হ্যারিকে উৎসাহ দেবার জন্য।

–ঠিক আছে, ওদিকে চোখ দেবার দরকার নেই। বৃদ্ধ পরীক্ষক কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি যদি তোমাকে ডিমের কাপটা নিয়ে আসার জন্য কিছু কার্ট হুইল বানাতে বলি পারবে?

সবদিক ভেবে, হ্যারি চিন্তা করলো ওর পরীক্ষা ভালই হয়েছে। ওর লেভিটেসন চার্ম অবশ্যই ম্যালফয়ের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে, যদিও কলার চেজ আর গ্রোথ চার্মে জাদু মন্ত্র চারণ করে না মিশিয়ে করা ভালো ছিলো। তাহলে ইঁদুরটা কমলা রং-এ পরিবর্তিত ও খুব ফোলাফোলা হতো না, শুধু তাই নয় ভোঁদড়ের রূপও নিতো না। হ্যারি অবশ্য ওর ভুলটা শুধরে নিতে পারতো। হারমিওন সেই সময় হলে না থাকা এক পক্ষে ভালো দিছ, পরে পরীক্ষার কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। রনকে বললেও বলতে পারতো। রন একটা ডিনার প্লেটকে টি মাশরুমে পরিবর্তন করেছিল, আবার জানেও না কেমন করে সেটা করতে পেরেছিল।

সেদিনের পরীক্ষার পর রেস্ট নেওয়ার কোনও সুযোগ ছিলো না। ডিনারের পর ফিগারেশন রিভিসন নিয়ে পড়তে হলো। পরের দিন সেটার পরীক্ষা। হ্যারি মাথাভর্তি জটিল স্কেলমডেল আর থিয়োরি বোঝাই করে শুয়ে পড়লো। পরের দিন সকালের পরীক্ষায় ও সুইচিং স্পেলের ডেফিনেসন লিখতে ভুল করলো। শুধু তাই নয় ধরে নিলো ওর প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা যাচ্ছে তাই হবে। তো যাই হোক ও কোনোরক পুরোপুরিভাবে ইগুয়ানা (আমেরিকার গোসাপ জাতীয় বৃক্ষচর সরিসৃপ বিশেষ) অদৃশ্য করতে পারলো। পাশের টেবিলে দেখলো হান্ন অ্যাট ওকে দেওয়া ফেরেট (বেজির মতো সাদা ধবধবে জ), একগাদা ফ্লেমিংগোতে রূপান্তরিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। (ফ্লেমিংগ–ফ্ল্যানডার্সবাসী পাখি বিশেষ) শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো কিন্তু পাখিদের ঝটপটানির জন্য প্রায় দশ মিনিট পরীক্ষা বন্ধ রইলো। তারপর ফ্লেমিংগ পাখি ধরে হলের বাইরে নিয়ে যাবার পর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা আবার শুরু হলো।

বুধবার হার্বোলজি পরীক্ষা। এধার ওধার সামান্য ভুল ছাড়া হ্যারির দৃঢ় বিশ্বাস, আগের সব পরীক্ষা মোটামুটি ভালো হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রথম শুরু হবে ডার্ক আর্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পরীক্ষা।

আমব্রিজ এনট্রেন্স হলের দরজার গোড়ায় বসে ছাত্র-ছাত্রীদের ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা কেমন দিচ্ছে লক্ষ্য রেখে চলেছেন। আমব্রিজ বিশেষ করে কাউন্টার জিনস আর ডিফেনসিভ স্পেল ভালো করেই দেখলেন। প্রফেসর টফটি পরীক্ষার শেষে হ্যারির পিঠে হাত দিয়ে বললেন, সাবাস পটার! সব পরীক্ষায় তুমি ভালোভাবেই উতরে গেছে, সত্যি খুব ভালো; কিন্তু একটা কথা, যদি পটার…।

কথাটা বলে ডেস্কে একটু ঝুঁকলেন। আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু টিবেরিয়স অগড়েনের মুখে শুনেছি তুমি পেট্রোনাম তৈরি করতে পারো। বোনাস পয়েন্টের জন্য…?

হ্যারি ওর জাদুদণ্ডটা তুললো, আমব্রিজের দিকে সোজা তাকালো, ধরে নিলো তাকে ছাঁটাই করার মতলব হচ্ছে।

এক্সপেট্রো পেট্রোনাম!

ওর জাদুদণ্ড থেকে রূপালি রঙের হরিণের দল বেরিয়ে এসে হলের ভেতর স্বচ্ছন্দগতিতে ঘুরতে লাগলো। সমস্ত পরীক্ষকরা অবাক হয়ে তাদের গতিবিধি দেখতে লাগলেন, তারপর তারা রূপালী কুয়াশায় মিশে গেলে প্রফেসর টফটি তার। সরু সরু হাড় বের করা। গিট ওয়ালা ফোলা ফোলা শিরওয়ালা হাতে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, বাঃ বাঃ অতি সুন্দর। পটার এবার তুমি যেতে পারো।

হ্যারি ঘর ছেড়ে যাবার সময় আমব্রিজের দিকে তাকালো। আমব্রিজের ব্যাঙের। মত ফোলা ফোলা মুখে দেখলো বিশ্রি হাসি। হ্যারি কোনও ক্ৰক্ষেপ করলো না আমব্রিজকে! যদি না ও ভুল করে থাকে, তাহলে জানে ও নিশ্চিত আউটস্ট্যান্ডিং আউল পেয়েছে।

শুক্রবার হ্যারি রনের ছুটি, কোনো পরীক্ষা নেই। হারমিওন ওর অ্যানসিয়েন্ট রুনেস নিয়ে ব্যস্ত। সামনে এক সপ্তাহ পড়ে রয়েছে, রিভিসন করতে আর ভালো লাগছে না। ওরা ঘরের জানালা খুলে হাত-পা ছড়িয়ে উইজার্ড চেশ খেলতে বসলো। খোলা জানালা দিয়ে গরম হাওয়া আসছে। হ্যারি দেখতে পেলো হ্যাগ্রিড অরণ্যের মূখে ক্লাস নিচ্ছেন। ও দেখতে চেষ্টা করলো কোন জন্তুদের হ্যাগ্রড পড়ুয়াদের দেখাচ্ছেন। নিশ্চয়ই ইউনিকর্ণ হবে। কারণ ওরা কোন দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঠিক সেই প্রোট্রেট হোল দিয়ে হারমিওন ওর ঘরে ঢুকলো। মুখ দেখেই বুঝলো ওর মেজাজ ক্ষিপ্ত।

রন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো, তোমার রুনস কেমন হচ্ছে হারমিওন?

–আমি এহোয়াজের ভুল অনুবাদ করেছি; হারমিওন রেগেমেগে বললো–ওর মানে পার্টনারশিপ, ডিফেন্স (আত্মরক্ষা) নয়। আমি এহোয়াজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছি।

রন কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে বললো, বাঃ বেশ করেছে। একটা মাত্র ভুল করেছো, তাই না? তাহলেও তুমি পাবে।

হারমিওন ভীষন রেগে বললো–চুপ করবে! জানো ওই একটা ভুলের জন্য পাস ফেলের সমস্যা আছে। তাছাড়া আরও কি জানো? আমব্রিজদের অফিসে আরও একটা নিফলার (মারাত্মক এক জঙ) কেউ রেখেছে। সত্যি আমি বুঝতে পারছি না নতুন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো কেমন করে। আমি ওদিক দিয়ে আসতে আসতে আমব্রিজের চেঁচামেচি কানে এলো। গলা শুনে মনে হয় ওটা তার পায়ের খানিকটা মাংস খেয়ে ফেলেছে।

হ্যারি আর রন একসঙ্গে বললো, বাঃ বাঃ চমৎকার।

হারমিওন বললো–মোটেই চমৎকার নয়। উনি ভাবছেন নিফলার রেখে যাওয়া একমাত্র হ্যাগ্রিডের কাজ। আমরা চাই না একটা অজুহাত দিয়ে হ্যাগ্রিডের স্কুল থেকে ছাঁটাই করার মতলব ভাজছেন আমব্রিজ।

–বাঃ উনি তো এখন ক্লাস নিচ্ছেন, ওকে দোষ দিতে পারে না। হারমিওন জানালা দিয়ে হ্যারিকে দেখিয়ে বললো।

–ওহ্ মাঝে মাঝে তুমি এতো হাস্যকর সাদাসিদে হয়ে যাও যে বলার নয়। তুমি কী মনে করো আমব্রিজ প্রমাণের অপেক্ষায় বসে থাকবেন? হারমিওন রাগে ফেটে পড়ে গজ গজ করতে করতে মেয়েদের ডরমেটরির দিকে চলে গেলো। যাবার সময় ওদের ঘরের দরজাটা সে শব্দ করে বন্ধ করে দিলো।

রন খুব সন্তর্পণে হ্যারির লাইটের দিকে যাবার জন্য কুইন এগিয়ে দিতে দিতে বললো, দারুণ মিষ্ট স্বভাবের, সুন্দর মেয়ে।

 হারমিওনের ব্যাড মুন্ড সপ্তাহ, শেষের দুদিনই রয়ে গেলো। রন আর হ্যারি সোমবারের পোসান পরীক্ষার ব্যাপারে রিভাইস করতে মোটেই হারমিওনকে পাত্তা দেবার সময় পেলো না। হ্যারি খুব ভালো করে জানে পরীক্ষা খারাপ হলে অউরর হবার কোনও আশা নেই। যা ভেবেছিলো তাই, লেখার পরীক্ষা বেশ শক্ত মনে হলো। যদিও ও ধরে নিয়েছে, পলিজুস পোসানের প্রশ্নে ওর ফুল মার্কস পাবার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

দুপুরের প্র্যাকটিক্যাল খুব ভয়ঙ্কর হবে ভেবেছিলো। তা কিন্তু হলো না। স্নেইপ অনুপস্থিত থাকাতে ওর পোসান বানানো বেশ সহজ হয়ে গেলো। নেভিল হ্যারির কাছেই রয়েছিলো পোসান ক্লাসে। হ্যারি দেখলো ও খুব চনমনে হয়ে গেছে… এর আগে ওকে পোসান ক্লাসে এরকম হাসিখুশি দেখেনি। প্রফেসর মার্চ ব্যাংকস যখন সকলকে বললেন, তোমরা সবাই যে যার কলড্রন থেকে দূরে বসো প্লিজ, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। টাইম ইজ আপ। হ্যারি ওর তৈরি পোসান বোতলে ঢেলে ছিপি আঁটতে আঁটতে ভাবলো, হয়তো ও ভালো গ্রেড পাবে না, যদি না ভাগ্যে ফেল থাকে। পার্বতী পাতিল গ্রিফিন্ডরের কমনরুমে যেতে যেতে বললো, যাক গে, আর মাত্র চারটে পরীক্ষা বাকি আছে।

–চারটে মাত্র! হারমিওন সামান্য আশ্চর্য হয়ে বললো, আমার তো সবচেয়ে শক্ত সাবজেক্ট অ্যারিথমেন্সি বাকি আছে।

হ্যারির মঙ্গলবারের পরীক্ষা কেয়ার অফ ম্যাজিক্যাল ক্রিচারস।

ভালো করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ, যাতে হ্যাগ্রিডের ওপোর দোষারোপ না হয়। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা নিষিদ্ধ অরণ্যের মুখে। ওখানে ছাত্র-ছাত্রীদের নারল ঠিক মতো শনাক্ত করতে হয়। ওদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে বাবোটন কাঁটা চুয়ার মধ্যে তাদের কৌশল করে দুধ দিতে হবে পালা করে। ওরা অত্যন্ত স্পকাতর সন্দেহবাজ জg। ওদের পালকের মধ্যে অনেক জাদুর প্রপার্টিজ থাকে, ভাঙচুর করতে থাকে। ক্ষেপে যায় যদি তারা মনে করে ওদের বিষ খাওয়ানো হচ্ছে। তারপর রয়েছে বাউট্রাকলদের ঠিকমতো পরিচালনা করা ফায়ার ক্র্যাবদের খাওয়ানো, পরিষ্কার করা। খুব সাবধানে যাতে আগুনে দেহ পুড়ে না যায় এবং অনেক খাবারের মধ্যে থেকে ঠিক মতো খাবার ঠিক করা, অসুস্থ ইউনিকনের ডায়েটের ব্যবস্থা।

হ্যারি সেখান থেকে দেখলো হ্যাগ্রিড তার কেবিনের জানালা দিয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছেন। হ্যারির পরীক্ষক, একটি মোটাসোটা ছোট চেহারার উইচ ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, এবার তুমি যেতে পারো। হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ক্যাসেলে চলে গেলো।

বুধবার সকালে অ্যাস্ট্রোনমির থিয়োরি পরীক্ষা মোটামুটি ভালই হলো। হ্যারি শুক্রগ্রহের ডানধারে চাঁদের যথাযথ নাম জানে না। কিন্তু একটা বিষয়ে সুনিশ্চিত, ওদের মধ্যে একটাতেও ইঁদুর বসবাস করে না। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমির জন্য ওদের সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। সেদিন আর ডিভিয়েসন হলো না।

হ্যারির ডিভিয়েসন সম্বন্ধে জ্ঞান খুব একটা ভালো নয়, তাই পরীক্ষা ভালো হলো না। রনেরও নয়। ওদের মতে বোকাবোকা পরীক্ষাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো।

–এখনও তো আমরা ছেড়ে দিতে পারি।

–হ্যাঁ, তা পারি, হ্যারি বললো, জুপিটার আর উরানস বন্ধু হয়ে যেতে পারে, তেমন কিছু ভান করার কোনও কারণ নেই।

–এখান থেকে, আমার মন্দ্রপুত চায়ের পাতা মরলেও কিছু যায় আসে না। আমি ওগুলোকে ময়লা ফেলার বিনে ফেলে দিচ্ছি।

হ্যারি হেসে উঠলো, হারমিওনকে আসতে দেখে হাসি থেমে গেলো। দেখলো হারমিওন একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। হাসতে দেখলে হারমিওন রেগে যেতে পারে, পছন্দ নাও করতে পারে।

হারমিওন বললো, মনে হয় আমার অ্যারিথসেন্সি ভালই হয়েছে। কথাটা শুনে হ্যারি রন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তাহলে ডিনারের আগে আমরা স্টার চার্টটাতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারি?

তারপর ওরা রাত এগারোটায় অ্যাস্ট্রোনমি টাওয়ারের ছাদে উঠে দেখলো পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। মেঘশূন্য আকাশে তারা দেখে, চিনে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। রূপালী চাঁদের আলো পড়ে মাঠটাকে কেমন যেন স্বপ্নময় মনে হয়। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।

সকলেই যে যার নিজের টেলিস্কোপ নিয়ে দাঁড়াতেই প্রফেসর মার্চব্যাংকস প্রত্যেকের হাতে একটা ব্ল্যাংক স্টারচার্ট দিলেন যাতে ওরা আকাশের তারা দেখে চার্টে তাদের অবস্থান দেখাতে পারে।

প্রফেসর মার্চব্যাংকস আর টফটি নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আস্তে আস্তে কিছু কথা বলে নির্মল আকাশের দিকে তাকালেন। পরীক্ষার্থীরা টেলিস্কোপ সেট করে পার্চমেন্ট আর কুইল হাতে নিয়ে দাঁড়ালো, প্রায় নির্জন ছাদে তাদের টেলিস্কোপ সেট করা, পার্চমেন্ট হাতে নেওয়ার শব্দ শোনা গেলো। পরীক্ষার্থীরা শুধু নীরব। আধঘণ্টা, একঘণ্টা কেটে গেলো। ক্যাসেলের ঘরের আলো বন্ধ হয়ে যেতেই মাঠ অন্ধকার হয়ে গেলো, মাঠটা আর সোনার আলোতে ঝলমলে মনে হলো না।

হ্যারি আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে চার্টে কোথায় তারা রয়েছে দেখলো। ওর মুখোমুখি ক্যাসেলের সামনের দরজাটা খোলা, পাথরের সিঁড়ির আলো লনের দিকে ঠিকরে পড়েছে। হ্যারি টেলিস্কোপটা ঠিক পোজিসনে রাখতে গিয়ে দেখলো পাঁচ-ছটা লম্বা লম্বা ছায়া লনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরজাটা খোলা থাকার জন্য লনে আলো পড়ে ছিলো। দরজা বন্ধ হতেই লনটা আগের মতো অন্ধকার হয়ে গেলো।

 হ্যারি টেলিস্কোপের চোঙায় চোখ রেখে ভেনাসের অবস্থান দেখে চার্টে মার্ক করতে যাবার সময় হাতটা কেঁপে উঠলো। কুইলটাও যেনো আর চলতে চাইলো না, পার্চমেন্টের ওপোর স্থির হয়ে রইলো। আবার ও লনের দিকে তাকালো। দেখলো কম করে ছজন অন্ধকারাচ্ছন্ন লনে যোরাফেরা করছে। চাঁদের সামান্য আলো ওদের মাথার ওপোর পড়ছে না, তাই তাদের মুখ দেখতে পেলো না। মুখ দেখতে না পেলেও তাদের হাঁটা-চলার মধ্যে চেনা চেনা মনে হলো তাদের, বিশেষ করে যে সকলের আগেভাগে হাঁটছে।

আমব্রিজ!

ও বুঝতে পারলো না আমব্রিজ মাঝরাতে অন্ধকার লনে ছসাতজন লোক নিয়ে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কে যেন পেছন থেকে খুক খুক করে কাসলো। কিন্তু তখনও তো ওর পরীক্ষা শেষ হয়নি।

অর্ধেকটা হয়েছে। ও দেখতে পেলো না আকাশে কোথায় ভেনাস বিচরণ করছে। তারপর আবার টেলিস্কোপে ও চোখ রাখলো, ভেনাসকে দেখতে পেলো। চার্টে তার অবস্থান দেখাতে যাবার সময় আবার সেই খুক খুক কাসির শব্দ যেনো কানে না আসে তার জন্য সতর্ক হলো। কিন্তু তারপরই শুনতে পেলো অনেক দূর থেকে কারও বাড়ির দরজায় নক করার ঠকঠক শব্দ। সেই শব্দ বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। তারপরই কানে এলো বিরাট এক কুকুরের বিকট ঘেউ ঘেউ চিৎকার।

ও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অরণ্যের দিকে তাকালো। হঠাৎ ওর বুকটা টিপটিপ করতে লাগলো। ও দেখলো হ্যাগ্রিডের কেবিনের জানালা দিয়ে আলো বাইরে আসছে। তারপর বাইরে তাকিয়ে দেখলো সেই ছায়াগুলো ওর কেবিনের দরজার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়ালো। দরজাটা খুলতেই তারা গটগট করে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো আবার নিস্তব্ধতা।

হ্যারি অসম্ভব অস্বস্তির মধ্যে পড়লো। ও রন আর হারমিওনের দিকে তাকালো। বুঝতে পারলো না হ্যাগ্রিডের কেবিনের দরজায় কেন ঠক ঠক শব্দ, তার কুকুরের বিকট ডাক, আর সেই ছ-সাতটা লোকের হ্যাগ্রিডের কেবিনে ঢোকা! ঠিক সেই সময় প্রফেসর মার্চব্যাংক ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। তবু চোখ দেখে মনে হয় সকলের দিকে সকলের কাজের দিকে গুপ্তচরের মতো তাকাচ্ছেন। হ্যারি তাড়াতাড়ি স্টার-চার্টের দিকে হেঁট হয়ে এমন একটা ভাব করলো যেনো কাজ করছে; কিন্তু চোখ ওর হ্যাগ্রিডের কেবিনের দিকে। সেই লোকগুলো ঘরের ভেতর থেকে জানালার ধারে দাঁড়াতেই জানালা দিয়ে বাইরের আলো আসা বন্ধ হয়ে গেলো।

হ্যারি বুঝতে পারলো প্রফেসর মার্চব্যাংক ওর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ও আবার টেলিস্কোপে চোখ রেখে তারাগুলো দেখতে লাগলো। কিন্তু অনেক আগেই তাদের পজিসন ওর চার্টে মার্ক করা হয়ে গেছে। তারপরই ও শুনতে পেলো কেবিন থেকে বিরাট গর্জনের শব্দ। সেই শব্দ আকাশে, বাতাসে, অরণ্যে, অ্যাস্ট্রোনমির টাওয়ারের ছাদে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে এলো। যারা পরীক্ষা দিচ্ছিলো তারা টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ভয়াতুর চোখে হ্যাগ্রিডের কেবিনের দিকে তাকালো।

প্রফেসর টফটি আবার খক খক করে কাসলেন।

টফটি খুব স্নেহভরে বললেন, ওদিকে কান না দিয়ে তোমরা তোমাদের কাজ করো ছেলে–মেয়েরা। সকলেই আবার তাদের টেলিস্কোপে চোখ রাখলো। হ্যারি সেই সময় পাস ফিরে দেখরো হারমিওন অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে হ্যাগ্রিডের কেবিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

প্রপেসর টফটি বললেন, আর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকি আছে।

কথাটা শুনে হারমিওন একরকম লাফিয়ে উঠে ওর স্টার চার্টে মুখ ডোবালো। হ্যারি ওর চার্টের দিকে তাকালো। দেখলো, ভেনাসের জায়গায় মার্স লেবেল করেছে। ও মাথা নিচু করে সেটা সংশোধন করলো।

আবার মাঠ থেকে ভীষণ জোরে শব্দ হলো, বেশ কয়েকজন ভয় পেয়ে আউচ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ওরা টেলিস্কোপ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে নিচের মাঠের দিকে তাকালো।

হ্যারি ছাদ থেকে দেখলো হ্যাগ্রিডের কেবিনের দরজাটা খুলে গেলো। কেবিনের বাইরে লাল আলোতে দেখলো চার-পাঁচজন আর এক ষণ্ডা মার্কা লোক ভীষণ গর্জন করছে আর ওকে ঘুষি মারবার চেষ্টা করছে। যেটুকু আলো বাইরে আসছে তাতে বুঝতে পারলো হ্যাগ্রিডকে ওরা স্টান করবার প্রচেষ্টা করছে। হারমিওন চিৎকার করে উঠলো–না।

প্রফেসর টফটি হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিন্তু এখানে পরীক্ষা দিতে এসেছে। চেঁচিও না, অন্যদের অসুবিধে হবে।

কিন্তু কেউ আর তাদের স্টার চার্টের দিকে তাকাচ্ছে না। তখনও তীব্র একটা লাল আলো হ্যাগ্রিডের কেবিনের চারপাশে ঘুরছে। ওকে কাবু করার জন্য প্রবল চেষ্টা করেও পেরে উঠছে না। হ্যারির মনে হলো তুমুল দুই শক্তির লড়াই চলেছে। চিত্তার, চেঁচামেচি, কান্নাতে সমস্ত জায়গাটা থর থর করে কাঁপছে।

একজন দারুণ জোর গলায় বলে উঠলো, হ্যাগ্রিড গোঁয়ার্তুমি করো না।

কথাটা শুনে হ্যাগ্রিড গর্জন করে উঠলো–নিকুচি করেছে তোমার কথা মেনে নেওয়া। ডলিশ এমনিভাবে তোমরা আমাকে কাবু করতে পারবে না বলেদিলাম।

হ্যারি দেখলো ফ্যাংগ ঝাঁপিয়ে পড়ছে বারবার হ্যাগ্রিডকে ওদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। উইজার্ডরা ওকে স্টানিং স্পেল দিয়ে অকর্মন্য করতেই ও মাটিতে পড়ে গেলো। হ্যাগ্রিড এক মুহূর্ত দেরি না করে যে স্ট্যানিং স্পেল ছুঁড়েছিলো তাকে শক্ত করে চেপে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। প্রায় দশফিট লম্বা লোকটার মাটি থেকে ওঠার আর শক্তি রইলো না। হারমিওন সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মুখে হাতচাপা দিলো। হ্যারি রনের দিকে তাকালো, দেখলো রনেরও মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আগে কেউ হ্যাগ্রিডকে ওই রকমভাবে রাগতে, গর্জনশক্তি প্রয়োগ করতে দেখেনি। পার্বতী ছাদ থেকে আঙ্গুল দিয়ে লনটা দেখিয়ে বললো, দেখেছো?

ওরা দেখলো সামনের দরজাটা আবার খুলে গেছে, খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার লনে আবার আলো ঠিকরে পড়েছে। সেই আলোতে দেখলো একটা লম্বা কালো ছায়া মাঠ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রফেসর টফটি ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন–শোনো, আর মাত্র ষোল মিনিট আছে।

কেউ তেমন টফটির কথায় কান দিলো না। ওরা দেখলো সেই কালো ছায়াটা হ্যাগ্রিডের কেবিনের দিকে খুব জোরে জোরে হেঁটে চলেছে। সেই ছায়ামূর্তিটা গর্জন করে উঠলো, আশ্চর্য! তোমাদের সাহসতো কম নয়! ঘূর্ণিটা হ্যাগ্রিডের কেবিনের কাছে পৌঁছলো।

হারমিওন ফিসফিস করে বললো, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল!

অন্ধকার ভেদ করে ম্যাকগোনাগলের তীব্র স্বর কানে এলো ওদের, ছেড়ে দাও, ওকে ছেড়ে দাও বলছি। কেন, কিসের জন্য তোমরা ওকে আক্রমণ করছো? ওতো এমন কিছু করেনি যাতে তোমরা এইরকম নৃশংস ব্যবহার করতে সাহস করো।

হারমিওন, পার্বতী, ল্যাভেন্ডর ভয়ে চিৎকার করে উঠলো–কেবিনের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন স্টানারের ম্যাকগোনাগলকে কাবু করা শক্ত ব্যাপার ছিল না। ক্যাসেল আর কেবিনের মাঝপথে লাল আলো রশির সঙ্গে ম্যাকগোনাগল ধাক্কা খেলেন, পরমুহূর্ত দেখা গেলো তার সর্বাঙ্গ ভূতুড়ে লাল আলোতে ঝলকে উঠলো।

ম্যাকগোনাগল ডানপাটা তুলে শক্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন তারপর একচুলও। নড়তে পারলেন না।

প্রফেসর টফটি পরীক্ষার কথা ভুলে গিয়ে ভীষণ জোরে (তার শক্তি অনুযায়ী) বলে উঠলেন, গ্যালপিং গারগয়েল! কোনও সতর্ক করেনি, সাংঘাতিক কাজকর্ম দেখছি।

–ভীরুর দল! হ্যাগ্রিডের তীব্রস্বর ভেসে এলো টাওয়ারের ওপোরে। ক্যাসেলের কিছু আলো ভাইব্রেসনে নিভু নিভু হয়ে গেলো।

জংগলী ভীরু, না জানিয়ে আক্রমণ। হারমিওন হাঁফাতে হাফাতে বললো, হা ঈশ্বর…। হ্যাগ্রিড জানেন তার দুই নিকটবর্তী আক্রমণকারীরা সংজ্ঞা হারিয়েছে, তবু দুটো প্রচণ্ড রকমের ঝটকা দিলেন। ওরা এখন ঠাণ্ডা হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। হ্যারির হ্যাগ্রিডকে দেখে মনে হলো তার ওপোর ওদের স্পেলের কোনও প্রভাব পড়েনি। দেখল হ্যাগ্রিড সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তার পিছে থলের মতো একটা কিছু। তারপরই ভালো করে দেখলো সেটা ফ্যাংগ-এর নিস্তেজ দেহ বেঁধে রেখেছেন।

অ্যামব্রিজ দাঁত খিচিয়ে বললেন, তোমরা করছো কি, ওকে ধরো দেরি করো। কিন্তু ওর বাকি সাহায্যকারীরা হ্যাগ্রিডের ধারে কাছে দাঁড়াতে সাহস করলো। দৌড়ে পালাতে গিয়ে তার এক অচৈতন্য সহকর্মীর ওপোর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। হ্যাগ্রিড পেছন ফিরে একবার ওদের দেখে ফ্যাংগকে পিঠে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। আমব্রিজ শেষ চেষ্টা করলেন হ্যাগ্রিডের ওপোর একটা স্টানিং স্পেল ছুঁড়তে, কিন্তু সেটা ঠিক লাগলো না। হ্যাগ্রিড পেছনে না ফিরে দৌড়াতে দৌড়াতে নিষিদ্ধ অরণ্যের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো।

ওই ঘটনা দেখে সকলেই নির্বাক। চতুর্দিকে নিস্তব্ধতা। তখন প্রফেসর টফটির গলা শোনা গেলো। আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে, সবাই শুনেছো তো?

হ্যারি চার্টটা তখনও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ করতে পেরেছে। কখন পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বাজবে তারই অপেক্ষায় বসে রইলো। ঘণ্টা বাজতেই হ্যারি, রন, হারমিওন টেলিস্কোপগুলো কোনও রকমে হোল্ডারে রেখে দিয়ে স্পাইরেল সিঁড়ির কাছে ছুটলো। তখন কোনো ছাত্র-ছাত্রী শুতে যায়নি। সকলেই উত্তেজিত হয়ে সিঁড়ির মুখে হ্যাগ্রিডকে আক্রমণের যা যা দেখেছে সেইসব যার যেমন খুশি আলোচনা করে চলেছে।

–ওই শয়তান মহিলা, হারমিওন হাঁফাতে হাফাতে বললো–(কথা বলতে পারছিলো না) গভীর রাতে হ্যাগ্রিডের বাড়িতে ওকে আহত করতে গিয়েছিলো।

এরনি ম্যাকমিলান বললো, খুব সম্ভব ট্রিলনীর মত নতুন একটা নাটক করতে চাননি।

রন বললো–হ্যাগ্রিড যা করেছেন ভালই করেছেন, তাই না? কিন্তু কি করে অতোগুলো স্পেল থেকে বাঁচলেন ভাবা যায় না।

হারমিওন বললো, ওর শরীরে দানবের রক্ত আছে। একজন দানবকে সহজে আয়ত্তে আনা সহজ ব্যাপার নয়। চারজন স্টানার প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে আক্রমণ করেছিলো। বয়স হয়েছে, দেখি সামলাতে পেরেছেন কি না।

এরনি বললো, দারুণ ভয়ঙ্কর ব্যাপার, আমার মাথা ঘুরছে, আমি শুতে চললাম।

একটু একটু করে সিঁড়ির তলা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেলো। রন বললো, যাকগে অনেক চেষ্টা করেও হ্যাগ্রিডকে ধরে বেঁধে আজকাবানে পাঠাবার সব নোংরা মতলব বানচাল হয়ে গেলো! আমার মনে হয় হ্যাগ্রিড, ডাম্বলডোরের কাছে গেছেন। তোমাদের কী মনে হয়? হারমিওন ছলছল চোখে বললো, হতে পারে। ডাম্বলডোর হয়তো শিগগিরই ফিরে আসবেন। কিন্তু মনে হয় প্রথম যুদ্ধে আমরা হেরে গেছি।

ওরা গ্রিফিন্ডর কমনরুমে এসে দেখলো, বেশ ভিড়। সেখানেও ওরা হ্যাগ্রিডের ব্যাপারে আলোচনা করছে। হ্যারি, রন, হারমিওন যা যা দেখেছে, শুনেছে অ্যাস্ট্রোনমি টাওয়ার থেকে, সব ওদের বললো।

অ্যাঞ্জেলিনা জনসন বললো, ট্রিলনী হয়তো ঠিকমতো পড়াতে পারতেন না; কিন্তু হ্যাগ্রিড তো তা নয়। ভালো পড়ান।

হারমিওন একটা আর্মচেয়ারে বসে দুলতে দুলতে বললো–আমব্রিজ অনেক মানুষকে ঘেন্না করেন। কেমন করে হ্যাগ্রিডকে তাড়ানো যায় সবসময় তাই চেষ্টা করে চলেছেন।

ল্যাভেন্ডর বললো, কে জানে প্রফেসর ম্যাগগোনাগল কেমন আছেন, মনে হচ্ছে ঠিক আছেন কি বলো?

–ওরা ম্যাকগোনাগলকে ধরে ক্যাসেলে নিয়ে গেছে, আমরা ডরমেটরির জানালা থেকে দেখেছি। কলিন কার্ভে বললো, দেখে মনে হচ্ছিল খুব একটা ভালো নেই।

অ্যালিসিয়া স্পিনের বললো, ম্যাডাম পমফ্রে ঠিক করে দেবেন ভেবো না।

প্রায় সকাল চারটে বেজে গেলো সে রাতের ঘটনা সবাই বসে আলোচনা করতে করতে। চোখের সামনে হ্যাগ্রিডকে আক্রমণ, হ্যাগ্রিডের আক্রমণের বিরুদ্ধে আক্রমণ, তারপর ফ্যাংগকে কাঁধে চাপিয়ে চলে যাবার দৃশ্য বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো হ্যারির। ঘুমোতে পারলো না। তবু চোখে ঘুম এসে গেলো। ঘুমিয়ে পড়লো, ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে।

ওদের শেষ পরীক্ষা, হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক, সেদিন দুপুরের আগে শুরু হলো। হ্যারির ইচ্ছে হলো ব্রেকফাস্টের পর একটু ঘুমিয়ে নেয়, কিন্তু আগেই মনস্থির করেছিলো ব্রেকফাস্টের পরও শেষ রিভিসন করবে। তো কমনরুমে জানালার ধারে বসে সময় নষ্ট না করে চোখ থেকে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করলো। তারপর হারমিওনের দেওয়া প্রায় সাড়ে তিন ফিট উঁচু জমা করা নোটগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করলো।

দুটোর সময় পঞ্চম বার্ষিকের ছাত্রছাত্রীরা গ্রেট হলে এসে তাদের সিটে মাথা নামিয়ে প্রশ্ন পত্র দেখতে লাগলো। হ্যারির মনে আনন্দ পরীক্ষা শেষ হলেই ঘুমুতে চলে যাবে। তারপর আগামীকাল রনের সঙ্গে কিডিচ খেলার মাঠে যাবে, রনের ঝাড়ুতে চেপে আকাশে উড়বে। কিছুদিন অন্তত পড়া, রিভিসনের হাত থেকে রেহাই পাবে।

প্রফেসর মার্চব্যাংক তার ডেস্কের সামনে রাখা বড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে গুরু গম্ভীর গলায় বললেন, এবার তোমরা শুরু করতে পারো।

হ্যারি প্রশ্নপত্রের প্রথম প্রশ্নের দিকে তাকালো। বেশ সময় লেগে গেলো পড়তে, অনেকবার চোখ বুলিয়ে একটা শব্দও পড়তে পারেনি। ঘরের কাঁচের জানালাতে দেখলো একটা বড় বোলতা বুজবুজ শব্দ করে কাঁচে ধাক্কা লাগাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওর চোখ আর ধাঁধালো না, প্রথম প্রশ্নটির উত্তর লিখতে শুরু করলো।

কিন্তু লিখতে বসলে কি হবে, কিছুতেই ওর নাম আর সঠিক তারিখ মনে পড়ছে না। প্রথম প্রশ্নটা ছেড়ে ও চার নম্বর প্রশ্নটা দেখলো। তোমার কি মনে হয় ম্যাজিক ওয়ান্ড সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন সাহায্য করেছিল, অথবা অষ্টাদশ শতাব্দীর গবলিনদের দাঙ্গা দমন করতে বেশি সহায়ক হয়েছিল)।

প্রশ্নটা কয়েকবার পড়ার পর ঠিক করলো, বাকি প্রশ্নের উত্তর লেখার পর হাতে সময় থাকলে ওটা ধরবে। পাঁচ নম্বর প্রশ্নের দিকে তাকালো (১৭৯৪ সালে স্ট্যাটুট অফ সিক্রেসি কেমন করে ফাটল ধরেছিলো এবং সেটা পুনরায় যাতে সেই অবস্থায় উপনীত না হয় তার কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলো?) সেটা দেখার পর মনে হলো ও প্রধান প্রধান বিষয়গুলো মনে করতে পারছে না। কিছু একটা মনের মধ্যে ঢুকে সব ওলোট-পালোট করে দিচ্ছে। ঘটনা মনে পড়ছে না। তারপর সঠিক ও ভালোভাবে উত্তর লিখতে পারবে এমন একটি প্রশ্ন ও দেখতে লাগলো। যাকগে, দশ নম্বর প্রশ্নটা খুবই সুন্দরভাবে লিখতে পারবে বলে ওর মনে হলো। প্রথম সুপ্রিম ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অফ উইজার্ডস ছিলেন বেনোকর্ডস। কোন পরিস্থিতিতে এটি গঠিত হয়েছিলো তার বৃত্তান্ত লেখো এবং কেন ওয়ারলকস অফ লিচেনস্টেইন তাতে যোগদান করতে অস্বীকার করেছিলেন, ব্যাখ্যা করো।

হ্যারির মাথার ভেতরটা অবশ অসাড় হয়ে গেছে মনে হলেও অস্ফুট স্বরে বললো, আমি এর উত্তর জানি। হারমিওনের দেওয়া নোটে সেদিন সকালে ওটা বেশ কয়েকবার পড়েছে মনেও আছে।

ও চটপট উত্তর লিখতে শুরু করলো। লিখতে লিখতে বারবার মার্চব্যাংকের ডেস্কের ওপোর রাখা বড় ঘড়িতে সময় দেখতে লাগলো। ও পার্বতী পাতিলের ঠিক পেছনে বসেছে। ওর কালো লম্বা লম্বা মাথার চুল চেয়ারের পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে ও মাথা নাড়লে, মাথায় গোঁজা সোনালী ক্লিপগুলো চমকে উঠছে।

নাল পিয়ারে বোনাকর্ডস, ইন্টারন্যাশানাল কনফেডারেশন অফ উইজার্ডসর প্রথম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্রবহীন বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন সর্বোচ্চ প্রধান ছিলেন। কিন্তু তার নিয়োগে উইজার্ডিং সম্প্রদায়ের লিয়েচস্টেইন স্টিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কারণ তাড়া করা হঁদুরের মতো হ্যারির কুইল পার্চমেন্টের ওপোর দৌড়াতে লাগলো। জানালা থেকে গরম রোদ ওর মাথার ওপোর এসে পড়েছে। কি কারণে লিয়েচস্টেইন বিরোধীতা করেছিলেন, আর বোনাকর্ডস তাকে কেন চটিয়েছিলেন? হ্যারির এমন একটা মনের মধ্যে ধারণা হয় যে ট্রোলদের (রূপকথার বামনাকার ভূত) নিয়েই দুজনের মধ্যে মতান্তর হয়েছিলো। হ্যারি ওর জ্বালা জ্বালা করা চোখ ঠাণ্ডা করার জন্য দুচোখের পাতা বন্ধ করে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। একটু একটু করে চোখ জ্বালা কমে গেলো।

ও আবার সাদা পার্চমেন্টের দিকে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে ট্রোলদের সম্বন্ধে দুলাইন লিখলো। খুব একটা মনোগ্রাহী লেখা হয়েছে বলে মনে হলো না। তাহলেও হারমিওনের নোটের ভিত্তিতে পাতার পর পাতা লিখেছে।

ও আবার চোখ বন্ধ করলো। মনে করতে চেষ্টা করলো প্রথমবার ফ্রান্সে গিয়ে কনফেডারেশন সম্বন্ধে তার আলাপ-আলোচনা। হ্যাঁ তার বিবরণ তো ও বাদ দেয়নি। আগেই লিখেছে।

লিয়েচস্টেন স্টেইন থেকে কেউ আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

মন দিয়ে ভাবো, ও নিজেকে নিজে বললো। দেখলো সতীর্থরা মাথা হেট করে পার্চমেন্টে খমখস করে কুইল দিয়ে লিখে যাচ্ছে। দেখলো ঘড়ির ওপোর থেকে বালি ধীরে ধীরে পড়ছে, সময় চলে যাচ্ছে। ও আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা করিডর দিয়ে হেঁটে চলেছে, হাঁটাতো নয় দৌড়। ঘরের ভেতরের মিস্ট্রিজ ওকে জানতেই হবে, ডেস্টিনেসনে পৌঁছতে হবে। কালো দরজাটা খুলে গেলো যেমন খুলে যায় তেমনভাবে। ও পৌঁছে গেলো সেই গোলাকার ঘরে, ঘরের চারদিকে রয়েছে দরজা।

পাথরের মেঝে দিয়ে হেঁটে দ্বতীয় দরজায় দেওয়ালের মাঝে মাঝে আলোর রশি নাচছে। ম্যাকানিক্যাল ক্রিং ক্রিং শব্দ! কোথা থেকে আসছে, কেন আসছে দেখার-জানার সময় নেই, ওকে তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে।

ও তিন নম্বর দরজার দিকে গেলো। অন্যান্য দরজার মতো সেটাও খুলে গেলো।

আবার ও সেই ক্যাথিড্রল সাইজের মতো ঘরে ঢুকলো। ঘরের তাকে কাঁচের সলিড গোলাকার জিনিস। ওর বুকের ভেতর অসম্ভব ধুক ধুক করছে, এইবার ও সেখানে পৌঁছবেই। ও সাতানব্বই নম্বরে পৌঁছে বা দিকে ঘুরলো। দুটো সারির মাঝের ফাঁকা অংশ দিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো।

ঘরের শেষ প্রান্তে দেখলো একটা কালো মতো জিনিস নড়ছে, একটা আহত প্রাণীর মতো। হ্যারির পেটের ভেতরটা উত্তেজনায় গুড় গুড় করে উঠলো।

ওর নিজের মুখ থেকে ঠাণ্ডা, উচ্চকণ্ঠের একগুচ্ছ কথা বেরিয়ে এলো, মনে হয় মানুষের দয়া-ভালবাসার।

এটা… আমার জন্য নাও। এখনই… আমি যে ওটা স্পর্শ করতে পারি না,.. কিন্তু তুমি পারে…।

সেই কালো মতো জিনিসটা সামান্য সরে গেলো, ও দেখলো ওর নিজের হাত। বড় বড় আঙ্গুলওয়ালা সাদা হাত দিয়ে একটা দণ্ড ধরে রয়েছে, একটা অতিশীতল শিরশিরে কণ্ঠ শুনতে পেলো ক্রসিও!

যে লোকটা মেঝেতে বসেছিলো সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো। দাঁড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই পড়ে গেলো এবং ছটফট করতে লাগলো। হ্যারি হাসতে লাগলো। ও জাদুদণ্ড তুললো, কার্স তুলে নিলো, সেই কালো মূর্তিটা গোঙাতে গোঙাতে নিস্তেজ হয়ে গেলো।

লর্ড ভোল্ডেমর্ট অপেক্ষা করছেন মেঝেতে পড়ে থাকা আহত লোকটা ধীরে ধীরে মাথা তুললো। ওর মুখটা রক্তাক্ত ও অতি কৃশ, যন্ত্রণায় কাতরালেও প্রতিরোধ করার জন্য উন্মুখ।

সিরিয়স বললেন, আমাকে তোমায় হত্যা করতে হবে।

সেই ঠাণ্ডা শীতল কণ্ঠ বললো, অবশ্যই সবশেষে। কিন্তু তার আগে তুমি ওটা আমাকে এনে দেবে। ব্ল্যাক তুমি কী মনে করছে তোমার যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেছে? আবার ভাবো আমাদের এখনও অনেক সময় আছে। শোনো, ভালো করে শোনো তোমার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ কেউ শুনতে পাবে না।

ভোল্ডেমর্ট তার হাতের দণ্ড আবার নামালে কেউ যেনো আর্তনাদ করে উঠলো। একজন একটা গরম ডেস্ক থেকে পাথরের ঠাণ্ডা মেঝেতে পড়ে গেলো। মেঝেতে পড়ে যেতে হ্যারির ঘুম ভঙে গেলো, তখনও ও চিৎকার করছে।

ওর কাটা দাগ আগুনের মতো জ্বলছে, গ্রেট হলের সকলে ওকে ঘিরে ধরেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *