৩০. গ্রপ

৩০. গ্রপ

ফেড আর জর্জের পলায়ন কাহিনী হোগওয়ার্টস স্কুলে সাতদিন ধরে সকলের মুখে মুখে। হ্যারির মনে হলো, ঘটনাটা হোগওয়ার্টসের ইতিহাসে লোক কাহিনী হয়ে থাকবে। যারা যারা দেখেছে তারা সকলেই ফ্রেড ও জর্জের বীরত্বে আনন্দে অধীর। ফ্রেড আর জর্জ আকাশ থেকে আমব্রিজের দিকে ডাইভবোমা ছুঁড়েছে সাথে ডাংগবোম। শুধু তাই নয় সকলেই ওদের ঝাড়ু চেপে পলায়ন নকল করে দেখাতে লাগলো। হ্যারির কানে এলো কেউ কেউ বলছে–আমাদেরও একদিন ফ্রেড আর জর্জের মতো ঝাড়ুতে চেপে পালাতে ইচ্ছে করে।

ফ্রেড ও জর্জ জানে ওদের কেউ তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে না। একটা মস্ত ভুল করেছে ছতলায় করিডোরে ইস্ট উইংগের থেকে জমাজল কেমন করে সরাবে তার পদ্ধতি জানাতে। আমব্রিজ আর ফিলচ নানা পন্থা অবলম্বন করে জল সরাবার চেষ্টা করে যেতে লাগলো, কিন্তু কার্যকরী হলো না। হ্যারি অবশ্য জানে ম্যাকগোনাগল বা ফ্লিটউইক জমাজল এক মুহূর্তের মধ্যে হটিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু আমব্রিজের ব্যর্থ প্রয়াস দেখে যেতে লাগলো।

তারপর আরও একটা ঘটনা।

আমব্রিজের ঘরের দরজায় দুটো ঝাড়ু ঢোকার মতো বড় বড় গর্ত! সেই গর্ত করে ফ্রেড আর জর্জ যে দুটো ঝাড়ু নিয়েছিলো তারা ফিরে এসেছে ওদের প্রভুর ঘরে। ফিলচ গর্তওয়ালা দরজা বদলে নতুন দরজা লাগালো, শুধু তাই নয় হ্যারি পটারের ফায়ার বোল্ট, পাতালঘরে রেখে দিলো। আমব্রিজ সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন করলেন। কিন্তু তা হলেও আমব্রিজের উৎপাতের যেনো শেষ হয় না।

জর্জ আর ফ্রেডের সেই কাজে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে, গোলমাল পাকানোর নেতাদের শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করতে লাগলো। নতুন দরজা লাগাবার পরও অনেকেই আমব্রিজের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলো।

ওদিকে ফিলচ ট্রাবল মেকারসদের ধরে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে তাদের শায়েস্তা করার জন্য করিডোরে চাবুক হাতে ঘোরাফেরা করতে লাগলো। আমব্রিজের নতুন স্কোয়াড ফিলচকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো; কিন্তু সেই স্কোয়াডের সদস্যদের নিত্য নতুন অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো। ওয়ারিংটন, স্লিদারিন হাউজের ভালো কিডিচ প্লেয়ার হঠাৎ চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। ওর গায়ের চামড়া দেখে মনে হতে লাগলো কেউ যেন কর্নফ্লেকস চিপকে দিয়েছে ওর গায়ে। প্যানসি পারকিনসনের গায়ে ছোট ছোট হরিণের শিঙ গজানোর জন্য দুদিন ক্লাস করতে পারলো না। হারমিওন সব দেখে খুব খুশি হলো।

ছাত্রছাত্রীদের নিত্য নতুন ঝামেলা, স্কুলের ভেতর উদভট কাণ্ড কারখানায় হেডমাস্টার আমব্রিজ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

হারমিওন বললো, হ্যারিকে, জিজ্ঞেস করতে হবে কবে থেকে আবার ও স্নেইপের কাছে অকলামেন্সি লেসন নিতে যাবে।

হ্যারির মন খুব খারাপ। ফ্রেড–জর্জের কাণ্ডকারখানার গল্প সল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে। সকলেই পড়াশুনোয় ব্যস্ত। রন, হারমিওন আশা করে বসে রয়েছে আবার কবে সিরিয়সের খবর পাবে। হ্যারি সিরিয়সের সঙ্গে ওর কথাবার্তার সবকিছু খোলাখুলি বলেনি রন–হারমিওনকে। সিরিয়স যে ওকে স্নেইপের কাছে গিয়ে অবশ্যই অকলামেন্সি লেসন নিতে বলেছেন তাও বলেনি। হ্যারি জানে, হারমিওনও চায় ও স্নেইপের কাছে নিয়ম করে গিয়ে অকলামেন্সির লেসন নিক।

হারমিওন বললো, তুমি কিন্তু বলতে পারবে না যে আজকাল তুমি অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখো না। দেখো, অবশ্যই দেখো। রন আমাকে বলেছে প্রায়ই তুমি ঘুমের ঘোরে বকবক করো। এইতো গত রাতেও করেছিলে।

হ্যারি রনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। রন, হারমিওনের কাছে হ্যারির স্বপ্ন দেখা আর বকবকানির কথা বলাতে হ্যারি যে চটেছে সেটা বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো।

রন বললো, খুব একটা বেশি না। এই সামান্য বকবক করছিলে, কি দেখেছিলে তা জানি না।

হ্যারি ধামাচাপা দেয়ার জন্য মিথ্যে বললো–আমি তোমাকে কিডিচ খেলতে দেখছিলাম, তোমাকে কোয়াফিলে (বল) ধরবার জন্য ছোটাছুটি করতে বলছিলাম তারই বকবকানি!

কথাটা শুনে রনের কান লাল হয়ে গেলো। হ্যারি রনের মুখচোখ দেখে দারুণ খুশি হলো। প্রতিশোধ নিতে পেরেছে, সেই রকম ভেবে খুব খুশি হলো।

একথা সত্যি, গতরাতে আবার ও একই স্বপ্ন দেখেছে। ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজ-এর করিডোর ধরে ও হেঁটে চলেছে। তারপর গোল মতন ঘর থেকে আর একটা ঘরে ঢুকলো। আগের মতোই সারা ঘরটায় ক্লিক ক্লিক শব্দ, আলোর নৃত্য। সেখান থেকে অন্য একটা গুহার মতো ঘরে। সেই ঘরে দেওয়াল ভর্তি তাক। তাকে সাজানো রয়েছে ময়লা ধূলো লাগা আদ্দিকালের কাঁচের গোলাকার সব অজানা জিনিস।

ও সাতানব্বই সারির দিকে তাড়াতাড়ি এগোলো, বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে লাইন ধরে ছুটলো। তখনই হয়তো ও জোরে জোরে কিছু কথা ঘুমের ঘোরে বলেছিলো, আর একটু এগিয়ে যাও। শেষ সারিতে পৌঁছানোর আগেই ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। চোখ খুলে দেখলো ও বিছানায় শুয়ে রয়েছে ও চারটে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

–তুমি তোমার মনের ভেতরটা বন্ধ করবার চেষ্টা করছে বলো, সত্যি চেষ্টা করছো না? হারমিওন বললো, হ্যারির দিকে ছোটো ছোটো উজ্জ্বল দৃষ্টিতে–তোমার অকলামেন্সির প্রভাব এখনও শেষ হয়নি! সেইভাবে চলছো?

–অবশ্যই চলছি, হ্যারি বললো। হারমিওনের প্রশ্নটা ওর কাছে খানিকটা অপমানজনক মনে হলো। কিন্তু কথাটা বলার সময় হারমিওনের দিকে তাকালো না। আসলে ওর মনের মধ্যে সর্বদাই ঘুরছে স্বপ্নে দেখা সেই ধূলি-ধূসর ভর্তি গোলাকার ঘরের মধ্যে কি আছে জানার, তাই ও চায় স্বপ্ন দেখা যেন বন্ধ না হয়।

সমস্যা, সামনে পরীক্ষা। প্রচুর পড়া, রিভিসন, সমস্ত মাথার ভেতরটা তারই ভাবনাতে ভরে রয়েছে। তাই ঘুমুতে যাবার সময় পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া অন্য কিছু মাথায় থাকে না। মাথা থেকে সেই চিন্তা হটাতে পারে না। স্বপ্নে শুধু দেখে আসন্ন পরীক্ষার ভীতি। সবই বোকা বোকা স্বপ্ন। মনের ভেতর একটা অংশ অবশ্যই থেকে যায় হারমিওনের অকলামেন্সি সম্বন্ধে প্রশ্ন আর তাগিদেও। তবু মাঝে মধ্যে সেই স্বপ্নে আসে, করিডোরের শেষ প্রান্তে কালো দরজা কিন্তু সেখানে পৌঁছবার আগেই যে ওর ঘুম ভাঙে।

রন বললো, স্লিদারিন আর হাফলপাফের খেলার আগে মন্টেগু যদি সেরে না ওঠে তাহলে আমাদের কাপ জেতা মারে কে!

একঘেয়ে চিন্তা থেকে খেলার জগতের কথাবার্তাতে ওর মন অনেকটা হালকা হয়।

–আমি বলছি, আমরা একটা ম্যাচে হেরেছি, আর একটা ম্যাচে জিতেছি। যদি আগামী শনিবারের ম্যাচে হাফলপাফের কাছে স্নিদারিয়ন হারে…।

–ঠিক বলেছো, হ্যারির বলার সময় চোখ পড়ে গেলো চো–চ্যাং কোর্ট ইয়ার্ড দিয়ে যাচ্ছে। ও কিন্তু একবারও হ্যারির দিকে তাকালো না।

সিজিনের কিডিচের ফাইনাল ম্যাচ গ্রিফিল্ডর ভার্সেস র‍্যাভেনক্ল ঠিক হয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহের শেষে হবে।

স্নিদারিন অবশ্য কোনওরকমে শেষ ম্যাচে হাফেলপাফকে হারিয়েছে, তাহলেও গ্রিফিন্ডরের জেতার আশা কম। তার কারণ রনের অগাধ–অতল গোল কিপিং রেকর্ড! তাহলেও রনের মনে নতুন আশার উদ্রেক হয়েছে।

রন ব্রেকফাস্ট খাবার সময় হ্যারি আর হারমিওনকে বললো, আমি হেরে যাওয়ার কথা ভাবতে চাই না। চান্স আছে কী?

হ্যারির সঙ্গে মাঠের পিচের ওপোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হারমিওন বললো, আমার কিন্তু মনে হয় দলে ফ্রেড় আর জর্জ না থাকার জন্য রন বেশ স্বাধীনভাবে খেলবে। ওর আস্থার অভাব হবে না।

খেলার মাঠ লোকে লোকারণ্য! ওরা দেখলো লুনা লাভগুড একা একা চলেছে, ওর মাথার ওপোর একটা আঁচা তার মধ্যে জীবন্ত ঈগল পাখি চাপানো রয়েছে।

–হায় ঈশ্বর! আমি একদম ভুলে গেছি! লুনার মাথার ওপোর ঈগল পাখার ডানা ঝাঁপটানি দেখে বললো, চো আজ খেলবে না?

হ্যারি কথাটা শুনে কোনও জবাব দিলো না।

ওরা দুজনে স্ট্যান্ডের ওপরের দিকে শেষ সারিতে বসবার জায়গা পেয়ে গেলো। আকাশ সেদিন পরিষ্কার, কোথাও একটুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছে না। রন আর বেশি কী চায়? হ্যারি ভাবতে লাগলো–স্নিদারিনকে উইসলি আমাদের রাজা–সমবেত কণ্ঠে গান গাইবার সুযোগ দেবে না। ফ্রেড আর জর্জ চলে যাওয়াতে লি-জোর্ডানের মন খুব খারাপ হলেও যেমনভাবে ধারা বিবরণী বলে তেমনভাবেই বলে চলেছে। দুদল প্লেয়ার মাঠে নামতেই ও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাদের নাম বলতে বলতে শুরু করলেও আগের মতো যেনো উচ্ছ্বাস নেই তার।

–ব্রেডলে, ডেভিস, চ্যাং নাম বললো। চো–চ্যাংকে মাঠে নামতে দেখে হ্যারির পেটের মধ্যে গুড় গুড় শব্দ হতে লাগলো। চোর চকচকে কালো চুল হাওয়াতে উড়ছে, ঝাড়ুতে বসবার আগে ওকে রোজারের সঙ্গে কথা কইতে দেখে একটু হিংসে হয়েছিলো বৈকি।

–হা হা, দুটিমের প্লেয়াররা আগেই মাঠে নেমে পড়েছে। জোর্ডান বলতে লাগলো, ডেভিস কোয়াফল হাতে নিয়েছে, র‍্যাভেনক্লর ক্যাপ্টেন ডেভিস। কোয়াফল হাতে নিয়ে জনসন, বেল, স্পিনেটকে ডজ করে ও সোজা গোলের দিকে এগোচ্ছে!, ও এবার বলটা গোলে মারবে…মারবে… মেরেছে, দারুণভাবে মেরেছে। হা হা, গো…ও..ল। দর্শকদের হর্ষধ্বনির মধ্যে ওর গলা প্রায় শোনা গেলো না।

গ্রিফিন্ডর গোল খাবার পর হ্যারি, হারমিওন স্তব্ধ! যা আশা করেছিলো তাই হলো। স্লিদারিনরা সমবেত কণ্ঠে গাইতে লাগলো।

উইসলির কিছু ধরার ক্ষমতা নেই
ও একটা ছোট রিং ও ধরতে পারে না

হ্যারি!, হারমিওন! হ্যারি শুনতে পেলো কর্কশ এক কণ্ঠস্বর।

হ্যারি পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো হ্যাগ্রিড তার বিরাট দাড়ি ঝুলিয়ে সামনের সিটে বসে রয়েছেন। মনে হয় প্রথম আর দ্বিতীয় বার্ষিক ছাত্র-ছাত্রীদের ঠেলে ঠুলে একটা সিটে বসেছেন। ছেলেমেয়েরা খুব খুশি হয়নি, ধাক্কাটাক্কা মেরে সিট দখল করে বসার জন্য।

–শোনো, সকলেই এখন খেলা দেখায় মত্ত, তোমরা এখন আমার সঙ্গে আসতে পারবে? হ্যাগ্রিড ফিসফিস করে ওদের বললেন।

–একটু পরে গেলে হয় না হ্যাগ্রিড! ম্যাচটা শেষ হতে দিন, হ্যারি অনুনয় করে বললো।

–অপেক্ষা করা যায় না হ্যারি। সকলে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, এখনই যেতে হবে।

হ্যারি অনেকদিন হয়ে গেলো হ্যাগ্রিডকে খুব কাছ থেকে দেখেনি। দেখলো হ্যাগ্রিডের নাক দিয়ে তখনও রক্ত পড়ছে, চোখের তলা দুটো কালো। ও হতভম্ব হয়ে হ্যাগ্রিডের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

–না না দেরি করবো না, চলো তোমরা, হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যাগ্রিড হারমিওন যে সারিতে বসেছিলো সেখানে বসে থাকা ছেলে–মেয়েদের সরে বসতে বা দাঁড়াতে হবে ওদের পথ করে দিতে। তাই ওরা একটু রেগে গেলেও ওরা দুজন হ্যাগ্রিডের সঙ্গে মাঠের বাইরে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা দিলো। হ্যারি দেখলো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হ্যাগ্রিডের পা দুটো স্থির নয়, সামান্য কাঁপছে।

হ্যাগ্রিড মাঠের দিকে চলতে চলতে বললেন, তোমাদের খেলা ছেড়ে আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য তারিফ করছি। কে জানে ও আমাদের দেখতে পেয়েছে কি না।

–কার কথা বলছেন আমব্রিজ? সমস্ত স্কোয়াড ওকে ঘিরে বসে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছেন না মনে হয়। খেলার শেষে মনে হয় গোলমালের আশঙ্কা করছেন।

–একটু আধটু গোলমাল হলে কোনও ক্ষতি নেই, হ্যাগ্রিড খেলার মাঠ থেকে তার কেবিন পর্যন্ত খোলা বিস্মৃত মাঠ ধরে চলতে চলতে বললেন। চলো, আস্তে আস্তে যাই।

অরণ্যের দিকে চলতে চলতে হারমিওন হ্যাগ্রিডের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার মুখে…।

–যেখানে যাচ্ছি সেখানে গেলে দেখতে পাবে, হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যারি শুনতে পেলো চিৎকার চেঁচামেচি, মনে হয় কেউ গোল করেছে।

হ্যারি বললো, হয়তো র‍্যাভেনক্ল গোল করেছে।

হ্যাগ্রিডের কোনো উৎসাহ নেই। বললেন–হতে পারে, ভালো ভালো।

হ্যাগ্রিড বেশ জোরে জোরে হাঁটছেন। তার চলার সঙ্গে ওরা দুজনেই তাল রেখে হাঁটতে পারছে না, বার বার পিছিয়ে পড়ছে।

হ্যাগ্রিডের কেবিনের সামনে পৌঁছে ওরা জঙ্গলের বাঁ দিকে ক্লিয়ারিং-এর দিকে তাকালো। হ্যাগ্রিড সোজা হেঁটে অরণ্যের শেষ প্রান্তে গাছে ঝুলিয়ে রাখা একটা আড়ধনু তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে হ্যাগ্রিডের মনে হলো হারমিওন–হ্যারি তার কাছাকাছি নেই। তিনি পিছন ফিরলেন।

হারমিওন যেনো ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলো, অরণ্যের মধ্যে রয়েছি।

–দেরি করো না; ওরা যেনো দেখতে না পায়, তাড়াতাড়ি এসো তোমরা।

হ্যারি–হারমিওন গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ু ঠেলে একরকম নাকানি চোবানি খেতে খেতে শ্যাগ্রিডের কাছে পৌঁছলো।

হ্যাগ্রিড হাতে সেই আড়ধনুটা নিয়ে সবুজ জঙ্গলের ভেতরে চললেন, পেছনে হ্যারি আর হারমিওন।

হ্যাগ্রিড খুব জোরে হাঁটছেন, হারমিওন হ্যারি যাতে পিছিয়ে না পড়ে তাই এরকম দৌড়াতে লাগলো।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের হাতে আড়ধনুটা দেখে বললো, আপনার হাতে অস্ত্র কেন হ্যাগ্রিড?

বিরাট কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বললেন, আত্মরক্ষার জন্যে।

হারমিওন হেসে বললো–আমাদের থেসটাল দেখানোর সময়তো আপনার। হাতে কোনও অস্ত্র ছিলো না?

–না না, এখন আমরা ওদিকে যাচ্ছি না, হ্যাগ্রিড বললেন। সেটা ফিরেঞ্জ জঙ্গল ছাড়ার আগে ছিলো, তাই না?

হারমিওন বললো, ফিরেঞ্জের থাকা না থাকাতে কি আসে যায়?

–অনেক ব্যাপার আছে, এখন বলার সময় নেই। কোনও কথা না বলে আমার সঙ্গে চলো।

হ্যারি বললো, সেদিন ক্লাশে ফিরেঞ্জ বললেন, ডাম্বলডোরের কাছে কাজ করার জন্য ওর দল খুব চটে আছে? কথাটা বলে হ্যারি হ্যাগ্রিডের মুখের ভাব লক্ষ্য করলো।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক বলেছো। রাগ সব কিছু প্রকাশ করে না, আমি যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছতাম তাহলে ওরা ফিরেঞ্জকে লাথি মেরে, মেরে ফেলতো।

–ওরা ফিরেঞ্জকে আক্রমণ করেছিলো? হারমিওন ভয় পেয়ে বললো।

 –ঠিক বলেছো, হ্যাগ্রিড জঙ্গলের ছোট চোট গাছের শাখা-প্রশাখা হাত দিয়ে ঠেলে ঠুলে ভেতরে যেতে যেতে বললেন। ওদের দলের এখন অর্ধেক ওর সাপোর্টার।

–আপনি আক্রমণের সময় বাধা দেননি? একা ছিলেন? হ্যারি বললো। হ্যাগ্রিড একটু রেগে রেগে বললেন, না। বাধা দিলে ওরা ফিরেঞ্জেকে তো মেরে ফেলতো। ওর ভাগ্য ভালো, সেই সময় আমি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।

–আমি ভাবছি আমাকে ওর আগাম সতর্ক করে দেওয়ার সব কথাবার্তা! হ্যারি, হারমিওন, হ্যাগ্রিডের কুটি দেখে আর কথা বাড়ালো না।

হ্যাগ্রিড বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–যাকগে সেসব কথা। তারপর বাকিসব সেনট্যারেরা আমার তত্ত্বাবধানে থাকে। অসুবিধে হচ্ছে, অরন্যের মধ্যে ওদের বেশ আধিপত্য আছে, খুব চালাক জন্তু বলতে হয়।

–আমাদের কি ওদের কাছে নিয়ে যেতে চলেছেন হ্যাগ্রিড হারমিওন জিজ্ঞেস করলো, সেনট্যারসদের কাছে?

–না না মোটেই না, একটু পরে জানতে পারবে তোমাদের কেন এখানে ডেকে এনেছি।

খুব একটা বিপদের মধ্য দিয়ে চলেছেন হ্যাগ্রিড, এমনিভাবে খুব সাবধানে ওদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে থাকলেন।

যতো ওরা এগোয় ততোই গভীর জঙ্গল। এগোতে পারে না ওরা। কোনও রাস্তা নেই। বড় ছোট গাছ আকাশ ঢেকে রেখেছে। গভীর অরণ্যে, গভীর অন্ধকার। কোনও রকমে হাঁতরে হাঁতরে চলেছে ওরা হাগ্রিডের সঙ্গে।

সত্যি কথা বলতে কি হ্যারি-হারমিওনের হাঁটতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। হ্যাগ্রিড কিন্তু বেশ স্বচ্ছন্দে চলেছেন। অন্যান্যবার গভীর অরন্যের ভেতরে যাবার সময় হ্যারি এই রকম অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছিলো।

–আমরা কোথায় যাচ্ছি হ্যাগ্রিড?

–আরও একটু হাঁটতে হবে, আমি জানি তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে। দেখো দলছুট হয়ে না যাই, একই সঙ্গে চলল।

হ্যাগ্রিডের সঙ্গে যেতে ওদের খুব কষ্ট হতে লাগলো। গ্রিডের কোনও পরোয়া নেই, কাঁটাগাছ, ছোট বড় গাছের শাখা-প্রশাখা, ঝোঁপঝাড়ু, মাকড়সার জাল ঠেলেঠুলে হ্যাগ্রিড স্বচ্ছন্দ গতিতে চলেছেন। হ্যাগ্রিড, হারমিওন তাল রাখতে পারছে না। বার বার কাঁটাগাছে ওদের রোব আটকে যাচ্ছে। কাটা খোলার জন্য থামতে হচ্ছে। হ্যারির হাত-পা কাটাতে লেগে ছিঁড়ে যাচ্ছে, কেটে যাচ্ছে তাতে তার খেয়াল নেই। এতে অন্ধকার যে আশপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু দেখতে পাচ্ছে, গভীর অন্ধকারের সামনে বিরাট দেহ নিয়ে থপ থপ করে হেঁটে চলেছেন হ্যাগ্রিড। শুধু কালো একটা দেহ। অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মাঝে সামান্য একটু শব্দ যেনো ওদের চোখ পাকিয়ে তেড়ে আসছে। ছোট একটা গাছের ডাল ভেঙে ফেলার শব্দ চতুগুণ শব্দ করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ছোট একটা পাখি সামান্য নড়াচড়া করলে তারও শব্দ যেন মনে হয় আকাশ ভাঙা শব্দ। অপরাধী ওরা, অরণ্যের শান্তি বিঘ্ন করে চলেছে হ্যাগ্রিডের পিছু পিছু। গন্তব্যস্থল ওরা জানে না। কেন, কোথায়, কিসের জন্য তাও জানে না। চলেছে তো চলেছে। একটা জিনিস ওদের কাছে অদ্ভুত মনে হলো, এতোটা পথ অতিক্রম করে একটাও জন্তু জানোয়ার ওদের চোখে পড়লো না।

হারমিওন শান্তভাবে আস্তে আস্তে বললো, হ্যাগ্রিড, আমরা কী ম্যাজিক ওয়ান্ডটা জ্বালাতে পারি?

–ওহ, ম্যাজিক ওয়ান্ড? আচ্ছা পারো, হ্যাগ্রিড পিছনে তাকিয়ে বললেন। –আসলে আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না, হারমিওন বললো।

চলতে চলতে হ্যাগ্রিড হঠাৎ থেমে যেতেই হারমিওনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলো। হারমিওন জঙ্গলের মাটিতে পড়ে যাবার আগেই হ্যাগ্রিড ওকে ধরে ফেললেন।

হ্যাগ্রিড বুঝতে পেরেছেন ওরা খুব ক্লান্ত। তাই বললেন, দাঁড়াও একটু বিশ্রাম করা যাক। খুব ক্লান্ত হয়ে সেখানে আমরা যাচ্ছি সেখানে না যাওয়া ভাল দেখাবে।

হ্যাগ্রিড হারমিওনকে ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলেন। ওরা দুজনেই বিড় বিড় করে বললো, লুমস বলার সঙ্গে সঙ্গে ওদের জাদুদণ্ডের মুখটা টর্চের মতো জ্বলে উঠলো। টর্চের আলো হ্যাগ্রিডের মুখে পড়তে হ্যারি দেখলো হ্যাগ্রিডের মুখটা খুব গম্ভীর, একটু ভয়-ভীত ও দুঃখ ভরাক্রান্ত!

–ঠিক আছে, খুব বড় দেখে একটু নিঃশ্বাস ফেলে হ্যাগ্রিড বললেন। মনে হয় আমব্রিজ আমাকে শিগগিরই ছাঁটাই করবেন।

–কেন একথা বলছেন? হারমিওন বললো।

–আমি নাকি ওর ঘরের মধ্যে নিলার (দুর্গন্ধ) রেখেছিলাম।

–সত্যই কী ঘরের মধ্যে কেউ রেখেছিলো? হ্যারি ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো।

–হ্যাগ্রিড একই রকম সুরে বললেন–স্রেফ বাজে কথা। আমার নামে দোষ চাপিয়ে স্কুল থেকে তাড়াবার মতলব। নানা রকম ছুতো খুঁজছে। আমি স্কুল ছেড়ে দেবো, কিছুতেই ট্রিলনীর মতো অপমানিত হতে দেবো না আমাকে।

হ্যারি, হারমিওন দুজনেই আমব্রিজের নোংরা প্ল্যানের জন্য ধিক্কার দিলো। হ্যাগ্রিড তার একটা মোটা বড় হাত তুলে বললেন, চুপ।

–পৃথিবীর সবকিছুর শেষ এখন নয়। যতোদিন আমি বেঁচে থাকবো, ডাম্বলডোর আর অর্ডারের সেবা করে যাবো–তোমরা তোমাদের পড়াশুনো করে যাও। ভালোভাবে পাশ করো এটাই আমি আশা করি।

কথা বলতে পারছেন না হ্যাগ্রিড ভালো করে। মুখ–চোখ থমথমে, গলার স্বর আটকে যাচ্ছে।

হারমিওন, হ্যাগ্রিডের হাতটা ধরলে হ্যাগ্রিড বললেন, আমার জন্য তোমরা ভেবো না, ওয়েস্ট কোটের পকেট থেকে বড় একটা রুমাল বার করে ভিজে চোখ মুছলেন। আমি যদি আজ মরে যাই তো ভালো; কিন্তু আমার অনেক কথা আছে সেসব কথা কাউকে বলে যেতে চাই। তার আগে আমি তোমার আর রনের সাহায্য চাই।

–হ্যারি বললো, আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবো, বলুন আমাদের কি করতে হবে?

হ্যাগ্রিড খুশি হয়ে এমন জোরে হ্যারির পিঠ চাপড়ালেন যে, হ্যারি একটা গাছের ওপোর পড়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো।

–আমি কখনও তোমাদের বন্ধুত্ব, ভালোবাসার কথা ভুলবো না। চলো, আর একটু হাঁটতে হবে। খুব সাবধানে হাঁটবে কিন্তু, চারধারে বিছুটি গাছ আছে।

আরও মিনিট পনের হাঁটার পর হ্যারি বললো, আরও কতটা পথ হাঁটতে হবে, হ্যাগ্রিড? মোটা মোটা ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে হ্যাগ্রিড বললেন–দাঁড়াও প্রায় এসে গেছি।

ওরা দুএক পা এগিয়ে গিয়ে দেখলো সামনেই মাটি দিয়ে জমানো পাহাড়ের মতো একটা টিপি। প্রায় হ্যাগ্রিডের সমান সেই মাটির পাহাড়ের উচ্চতা। সেই মাটির টিপির কাছে গিয়ে মনে হলো ওটা মাটির স্তূপ নয়, বিরাট আকারের অনেক জদের মৃতদেহ পাকার করে রাখা হয়েছে। সেই ঢিপির চারধারে ছোট-বড়ো গাছ, সেগুলো যেনো টিপিটার ঘের। হারমিওন, হ্যারি আর হ্যাগ্রিড ঢিপির সামনে চুপ করে দাঁড়ালো।

হ্যাগ্রিড বললেন, ও এখন ঘুমুচ্ছে।

হ্যারির কানে এলো শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। খুব বিরাট দুটো ফুসফুস হাওয়া টানছে আর বার করছে সন্দেহ নেই। অনেকটা বিরাট আকারের হাপরের মতো।

হ্যারি পাশ ফিরে দেখলে হারমিওন ভয়-বিহ্বল চোখে সেই ঢিপিটার দিকে। তাকিয়ে রয়েছে।

হারমিওন খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, ওটা কী?

হ্যারিরও সেই একই প্রশ্ন।

হ্যাগ্রিড সেই ঢিপির দিকে তাকালেন। ওরা দুজনেই ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালো। ওরা দেখলো বিরাট মাটির ঢিপিটা একটু নড়ছে। উঁচু নিচু হচ্ছে প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলার সাথে সাথে।

তাহলে ঢিপিটা কোনও জীবন্ত প্রাণী? ওর পিঠ অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো।

–আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি, ও নিজের ইচ্ছেতে আসেনি।

–কিন্তু কেন? হারমিওন ভাঙা ভাঙা গলায় বললো।

–আমি ওকে সভ্যতা শেখানোর জন্য জঙ্গলের বাইরে নিয়ে যাবো। ও কিন্তু নিরীহ জীব। কারও ক্ষতি করে না, আক্রমণ করে না।

–নিরীহ, কারও ক্ষতি করে না? হারমিওন তীক্ষ্ম গলায় বললো।

হ্যাগ্রিড সেই বিরাট জন্তুটার কাছে গিয়ে হিস হিস শব্দ করে হাততালি দিতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। বুঝেছি, তোমাকে ওটা আঁচড়ে কামড়ে দেয় বলে তোমার মুখে চোখে ক্ষত, আঘাতের চিহ্ন?

হ্যাগ্রিড ওদের বোঝাবার জন্য বললেন–দেহের শক্তি সম্বন্ধে ওর কোনও ধারণা নেই। অনেক শান্ত হয়ে গেছে এখন আর কারও সঙ্গে ও লড়াই করে না।

–ওহ এরই জন্য আপনি দুমাস নিরুদ্দেশ ছিলেন? তা ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওকে নিয়ে এলেন কেন? নিজেদের দলের মধ্যে থাকলে তো ভালই থাকতো।

–ও খুব ছোটো তাই সকলে ওর পেছনে লাগে, উত্যক্ত করে, বুঝলে ও আমার ভাইয়ের মতো, হ্যাগ্রিড একরকম কেঁদে ফেলে বললেন।

–ছোটো?… দারুণ ছোটো? হারমিওন বললো। হারমিওন হাঁ করে সেই জটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

–হ্যাগ্রিড, ওকে আপনি ভাই বলছেন কেন? হ্যারি বললো।

–সৎ ভাই। হ্যাগ্রিড ভুল শুধরে নিলেন। আমার মা, আমাকে আর বাবাকে ছেড়ে দিয়ে গ্রুপকে নিয়ে সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন।

-এপ? হ্যারি প্রশ্ন করলো।

–হ্যাঁ ওর নাম গ্রুপ, ও ঠিক মতো ইংরেজি বলতে পারে না, আমি ওকে শেখাবার অনেক চেষ্টা করছি। মনে হয় মা আমার চেয়ে ওকে বেশি পছন্দ করতেন। দানবীরা কেমন সন্তানের জন্ম দেয় সেটাই বিচার্য। ও খুব বেশি লম্বা নয় মাত্র ষোল ফিট।

হারমিওন বললো–ওহো তাহলেও খুব ছোটো বলতে হবে!

–ওকে সকলে দেখতে পারে না, আমার তাই খুব খারাপ লাগে। সত্যি ওকে ছেড়ে থাকতে খারাপ লাগে।

হ্যারি বললো, ম্যাডাম ম্যাক্সিম ওকে নিয়ে যেতে চান? –না মানে! হ্যাগ্রিড তার মোটা বিরাট হাত কচলে বললেন, ঠিকই ছিলো সব, কিন্তু বেশিদিন ভালো লাগেনি। বাড়ি যাবার পথে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।

–কারও নজরে পড়লো না? হ্যারি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললো।

–সেই জন্যই তো দেরি হলো।

–ইদানীং ও একটু মারকুটে হয়ে গেছে। হ্যাগ্রিড বললেন–মেজাজ ভালো না থাকলে আমাকে তেড়ে আসে। তবে এখন একটু একটু করে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

হ্যারি ওর পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো বড় বড় গাছের গোড়ায় আর শাখাতে মোটা মোটা দড়ি ঝোলানো রয়েছে। দড়ির অনেকটা অংশ মাটিতে গুটিয়ে রয়েছে।

হারমিওন দেখতে দেখতে বললো, ওকে বেঁধে রাখতে হয় বুঝি?

–হ্যাঁ, ও ঠিক ওর গায়ের শক্তি বুঝতে পারে না।

আসার সময় অরন্যের পথে কোনও প্রাণী চোখে পড়েনি কেন তা হ্যারি বুঝতে পারলো।

কিছুটা সময় চুপ থেকে গ্রুপকে দেখতে দেখতে হারমিওন বললো–আপনি আমাদের কি করতে বলছিলেন।

হ্যাগ্রিড বললেন, ওকে একটু দেখাশুনা। সব সময় না, আমি না থাকলে।

হ্যারি কথাটা শুনে ঘাবড়ে গেলো। এদিকে ভয় পেলে, ঘাবড়ালে তো চলবে, হ্যাগ্রিডকে সব রকম সাহায্য করার কথা দিয়েছে ওরা।

হারমিওন বললো, ঠিক ওর জন্য কি করতে হবে বলুন!

–খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তোমাদের ভাবতে হবে না। ক্ষিধে পেলে ও অরণ্যের জন্তু-জানোয়ার, পাখিটাখি ধরে খায়। ভাবলাম তোমরা ওকে নিশ্চয়ই ঠিক দেখাশুনো করবে, ইংরেজি শেখাবে, সহবৎ শেখাবে। হ্যারি দেখলো পরমানন্দে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে এপ।

হ্যারি সেই বিরাট মাটির ঢিপি, গায়পের দিকে তাকালো। ওর বাঁ ধারে বড় পাথরের মতো কিছু একটা দেখতে পেলো। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো শ্যাওলা শ্যাওলা প্রস্তর খণ্ডটা গ্রপের তুলনায় বেশ বড়ই বলতে হবে। মাথার চুল। কোঁকড়ানো ছোট ছোট পাহাড়ে ছোট ছোট তৃণ হয় সেই তৃণের মতো সবুজ রঙ। পাশ থেকে ওর বিরাট কানের একাংশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আঙ্কল ভার্ননের মতো গ্রপের ঘাড় নেই বললেই চলে।

পরণে একটা বাদামি রং-এর ঢিলেঢালা পোশাক। দেখে মনে হয় অনেক বন্য প্রাণীর চামড়া শুকিয়ে সেগুলো কেটে কেটে সেলাই করা। ওর পেটের কাছে পা দুটো গুটিয়ে রেখেছে। শুধু দেখা যাচ্ছে নোংরা–ময়লা–স্লেজ গাড়ির চাকার মতো বিরাট আকারের দুটি পায়ের পাতা, একটার ওপার অন্যটা ন্যস্ত।

হ্যারি ফাঁকা ফাঁকা গলায় বললো, আপনি চান আমরা ওকে শিক্ষা দেবো? বুঝতে পারলো ফিরেঞ্জের সতর্কবাণী! ওর প্রচেষ্টা ব্যর্থ। ভালয় ভালয় ছেড়ে দেওয়া উচিত। অরণ্যের অন্যান্য জরা নিশ্চয়ই হ্যাগ্রিডের গ্রুপকে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার অসফলতা শুনেছে।

–মনে হয় তোমরা ওর সঙ্গে একটু একটু ইংরেজিতে কথা বললেও তাড়াতাড়ি শিখে যাবে, হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যারি আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ আমরা চেষ্টা করবো। হ্যাথিড রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, আমি জানতাম তোমরা না করবে না।

ওরা দেখলো হ্যাগ্রিড বড় রুমালটা দিয়ে মুখের ঘাম মোছার সময় রক্তে ভিজে জব জব করছে।

হ্যাগ্রিড ধীরে ধীরে গ্ৰয়পের কাছে এগিয়ে যেতে লাগলেন। যখন ওর থেকে প্রায় দশ ফুট দূরে রয়েছেন তখন মাটি থেকে লম্বা দেখে একটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে হ্যারি আর হারমিওন মৃদু হাসতে হাসতে গ্ৰয়পের হাঁটুতে খুব আস্তে খোচা দিতেই গ্রপ মাথা তুলে দেখলো কে ওকে বিরক্ত করছে।

তারপর বিরাট গর্জন উঠতেই শান্ত অরণ্য অশান্ত হয়ে উঠলো, বন্যজন্তু, পাখি, গাছের পাতার কলরবে। তারই প্রতিধ্বনি হতে লাগলো চতুর্দিকে।

হ্যাগ্রিড আদরের সুরে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে এপ? কথাটা বলে পিছিয়ে এসে সেই রকম সুরে বললেন, তোমার ভালো ঘুম হয়েছে তো গ্ৰয়পি?

হ্যারি, রন বেশ কিছু দূরত্ব রেখে গ্রুপকে দেখতে লাগলো। গ্রপ দুটো বড় বড় গাছের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসলো। গাছ দুটোকে খুব সম্ভব ও রেগে মেগে গোড়া থেকে উপড়ে দেয়নি। ওরা ওর বিরাট গোল মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো। মনে হলো, অরণ্যের গভীর অন্ধকারে একটা ধূসর বর্ণের গোলাকৃতি চাঁদ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। মনে হয় বড় একটা গোল পাথর কেটে মুখটা তৈরি হয়েছে। বিরাট নাকটার কোনও ছিরি নেই, শুধু থ্যাবড়া দুটো বড় বড় ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। বড় বড় ফোলা ফোলা দুই ঠোঁটের ফাঁকে এবড়ো থেবড়ো হলুদ বর্ণের দাঁত। ঠিক ইটের মতো বড় বড়। কিন্তু চোখ দুটো দানবের আকারের মতো নয়, ঘোট ঘোট শ্যাওলা রংয়ের। ঘুম থেকে উঠার জন্য ছোট ছোট চোখ দুটো ফোলা ফোলা। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে দেবার জন্য ও রেগে গেছে। ক্রিকেট বলের মতো চোখ দুটো রগড়ে ও প্রায় ঝড় বইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

–হ্যারির পাশে হারমিওন দাঁড়িয়েছিলো। শুনতে পেলো ওর ভয় মিশ্রিত অস্ফুট আর্তনাদ! উঃ উঃ।

যে মোটা দড়িটা দিয়ে গ্ৰয়পের পা আর হাতের কব্জিতে গাছের সঙ্গে শক্ত করে বাধা ছিলো–তাতে কট কট শব্দ হলো। হ্যাগ্রিড ঠিক বলেছে সত্যি সে প্রায় যোল ফিট লম্বা। এপ ছাতার মত হাত বাড়িয়ে বড় একটা পাইন গাছ থেকে পাখির বাসা খাবলে নিলো। সঙ্গে কিছু গাছের বড় বড় ডালও। ডালগুলো মাটিতে ফেলে গর্জন করে উঠলো। পাখির বাসাতে পাখির ছানা ছিলো না। ছিলো কিছু ডিম। ডিমগুলো গ্রেনেডের মতো গাছের তলায় ছত্রকার হয়ে পড়ে গেলো। ওর মাথায় পড়তে পারতো কিন্তু তার আগেই ছাতার মতো হাতটা মাথার ওপোর রেখেছে গ্রুপি।

হ্যাগ্রিড বললেন, গ্ৰয়পি কি করছো তুমি? যাতে আর গাছের পাখির বাসা থেকে ডিম না পড়ে তার জন্য বললেন, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য আমার বন্ধুদের এনেছি, তোমাকে বলেছিলাম না আমি কাজের জন্য বাইরে গেলে ওরা এসে তোমার সঙ্গে গল্প করবে, দেখাশুনো করবে, মনে আছে সে কথা?

গ্ৰয়পি আবার বিরাট হুংকার দিলো। সেই হুংকার শুনে ওরা বুঝতে পারলো গ্ৰয়পি, হ্যাগ্রিডের কথা শুনলো না, অথবা কিছু বলতে চাইলো। তারপর তার হাত দিয়ে একটা পাইন গাছের আগা ধরে নিচে নুইয়ে দিতে লাগলো। মনে হয় ও গাছটা নিয়ে খেলা করছে। টেনে নামাচ্ছে আবার ছেড়ে দিলেই সোজা হয়ে যাচ্ছে সেই গাছটা।

হ্যাগ্রিড বললেন, গ্ৰয়পি গাছ ধরে টানাটানি করো না, ওটা ভেঙে যাবে।

হ্যারি দেখলো টানাটানি করার সময় সব গাছের গোড়াগুলো জমি থেকে আলগা হয়ে বড় বড় শেকড় বেরিয়ে গেছে।

হ্যাগ্রিড আবার বললেন, গ্ৰয়পি গাছ টানাটানি করো না, এদিকে দেখো তোমার বন্ধুরা তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

হ্যাগ্রিড গাছের ভাঙা ডালটা নিয়ে আবার গ্রয়পির হাঁটুতে খোঁচা দিতেই হারমিওন ভয়ার্ত স্বরে বললো–না না হ্যাগ্রিড ওকে খোঁচা দেবেন না।

দানব গ্রপ যে দুএকটা পাইন গাছ টেনে ধরেছিলো সেগুলো ছেড়ে দিতেই টপটপ করে পাইন-নিডিল (সরু সরু নতুন সবুজ পল্লব) মাটিতে বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

হ্যাগ্রিড, হ্যারির পিঠে হাত দিয়ে গ্ৰয়পিকে বললেন–শোনো, এর নাম হ্যারি, হ্যারি পটার। আমি চলে যাবার পর ও তোমাকে দেখতে আসবে, বুঝতে পেরেছো?

হ্যারি-হারমিওন দেখলো গোল পাথর সদৃশ মাথাটা এয়পি ঈষৎ নোয়ালো, ঝাঁপসা ঝাঁপসা অর্ধনিমিলীত চোখে ওদের দিকে তাকালো।

–আর এর নাম হচ্ছে হারমিওন। একে দেখো, হ্যাগ্রিড ইতস্তত করে হারমিওনকে বললেন–তুমি কী কিছু মনে করবে গ্রপি যদি তোমাকে হার্মি বলে ডাকে, তোমার নামটা বেশ বড়, হয়তো মনে করে বলতে পারবে না।

হারমিওন বললো, না না ঠিক আছে, যেমন ইচ্ছে তেমন ডাকুক।

 –হাঃ হাঃ গ্ৰপ, এখন তোমার দুজন বন্ধু, হ্যারি আর হার্মি।

গ্ৰয়পি ওর প্রকাণ্ড হাতটা হারমিওনের দিকে বাড়াতেই হ্যারি হারমিওনকে টেনে ধরে গাছের পেছনে নিয়ে গেলো, যাতে গ্রপ ওকে ছুঁতে না পারে।

হারমিওনকে হ্যারির সঙ্গে গাছের আড়ালে বিবর্ণ মুখে ভয়ে কাঁপতে দেখে হ্যাগ্রিড বললেন, গ্রয়পি তুমি অতি দুষ্টু ছেলে! খুউব দুষ্ট ছেলে। কখনও ওদের টানাটানি করতে যেও না।

হ্যাগ্রিডকে দেখে হ্যারির চোখ ছানাবড়া! হ্যাগ্রিড তখন গ্ৰয়পির পিঠে চেপে বসেছেন ও নাকে হাত দিয়েছেন। গ্ৰয়পির মনে হলো ওর ওপোর কারও কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আগের মতোই লম্বা লম্বা পাইন গাছগুলো টানাটানি করতে লাগলো।

গ্রপের কাণ্ডকারখানা দেখে হ্যারি, হারমিওন ভয় পেয়ে গেলো। ভাবলো পকে আগে দেখলে হ্যাগ্রিডের প্রস্তাবে সায় দিতো না।

হ্যাগ্রিডের সামনে হ্যারি, হারমিওন দাঁড়িয়েছিলো। ঠিক সেই সময় ওদের কানে এক পুরুষালী কণ্ঠের সতর্কবাণী শুনতে পেলো আমার মনে হয় তোমাকে আগেই বলেছি আবার বলছি হ্যাগ্রিড। এখানে তোমাকে কেউ চায় না। তুমি এখানে স্বাগত নয়।

ওরা দেখলো একটি মানুষের অর্ধাঙ্গ নগ্ন দেহ ওদের দিকে ভেসে আসছে। সেই অর্ধাঙ্গদেহ একটা বাদামী রঙের ঘোড়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে জুড়ে গেলো। সেন্টার হয়ে গেলো সেই নগ্নদেহ। সেন্টারের মুখ গর্বে ভরা, শক্ত চোয়াল। মাথার চুল কালো চকচকে। হ্যাগ্রিডের মত তার কাঁধে ঝুলছে বিরাট এক ধুনু আর পিঠে এক ঝাঁক তীর।

হ্যাগ্রিড সতর্ক হয়ে বললেন–কেমন আছ ম্যাগোরিয়ন? ম্যাগোরিয়নের পেছনে কয়েকটা গাছ নড়ে উঠতেই আর তিন-চারজন সেনট্যার সেখানে এসে দাঁড়ালো। ওদের মধ্যে থেকে হ্যারি, দাড়িওয়ালা বেনকে চিনতে পারলো। চার বছর আগে ওর সঙ্গে পরিচয়। বেনের মুখ দেখে মনে হলো ও যেন হ্যারিকে চেনে না।

বেন ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে ম্যাগোরিয়নকে বললো–তোমার বোধহয় মনে থাকা উচিত ওই কুৎসিত মানুষটা যেন কোনো দিন আমাদের এই অরণ্যে ওর মুখ না দেখায়।

–ওই মানুষটা! হ্যাগ্রিড বললেন। ও তোমাদের অকারণে খুন খারাবি বন্ধ করতে বলে অন্যায় করেছি তাই না?

মাগোরিয়ন বললো–আমরা কি করবো না করবো তার ভাবনা আমাদের। তুমি সব ব্যাপারে তালগোল পাকিয়েছে… আমাদের আইন আমাদের। ফিরেঞ্জ বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়াও আমাদের অপমান করেছে।

–আমি বুঝতে পারছি না তোমরা এমন কথা ভাবতে পারলে কেমন করে, ফিরেঞ্জ ডাম্বলডোরকে সাহায্য করার জন্য গেছে?

–ফিরেঞ্জ মানুষদের কাছে ক্রীতদাসত্ত্ব মেনে নিয়েছে। একজন ধূসর চুলওয়ালো। কুঞ্চিত চামড়ার সেনট্যার বললো।

–ক্রীতদাস, হ্যাগ্রিড কঠিন স্বরে বললেন, ডাম্বলডোরকে উপকার করেছেন, আর কিছু নয়।

–ও মানুষদের কাছে আমাদের জ্ঞান আর গোপনীয়তা বিলিয়ে দিচ্ছে, ম্যাগোরিয়ন শান্তভাবে বললো। ওই ঘৃণার যোগ্য কাজ করার জন্য আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।

তোমরা যা খুশি তাই ভাবতে পারো। কিন্তু আমি মনে করি, তোমরা সবাই খুব ভুল করছে।

বেন বললো, ভাবছো–কারণ তুমি আমাদের দলের নয়, একজন মানুষ। আমরা মানা করা সত্ত্বেও তুমি আমাদের অরণ্যে আবার এসেছে।

হ্যাগ্রিড রেগে গিয়ে বললেন–তোমাদের অনেক কথা আমি শুনেছি, এখন তোমরা আমার কথা শোনো। আমি তোমাদের মতো এই অরন্যের একজন, তাই এই অরন্যে কারা আসবে না আসবে তা তোমরা ঠিক করতে পারবে না।

ম্যাগেরিয়ন বললো, তোমারও নয় হ্যাগ্রিড। দুজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়েদের সঙ্গে করে আসার জন্য এবার তোমাকে ছেড়ে দিলাম।

বেন বললো, ওরা এখন আর হ্যাগ্রিডের ছাত্র-ছাত্রী নয়। ওরা ফিরেঞ্জের দেওয়া শিক্ষা বোধকরি অনেকটা শিখে ফেলেছে।

–যাই হোক, ম্যাগেরিয়ন শান্ত স্বরে বললো–খচরদের (অর্ধেক গাধা, অর্ধেক অশ্ব) হত্যা করা ঘোরতর অপরাধ। আমরা নিরীহদের স্পর্শ করি না। হ্যাগ্রিড, তুমি ওদের নিয়ে এখন চলে যাও। ভবিষ্যতে এখানে আর আসবে না। বিশ্বাসঘাতক ফিরেঞ্জকে আমাদের কাছ থেকে পালাতে সাহায্য করেছো, তুমি সমস্ত সেনট্যারদের সহানুভূতি, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব হারিয়েছো হ্যাগ্রিড।

–তোমাদের মতো বুড়ো খচ্চরদের (মিউল) কথায় আমি অরন্যে আসা বন্ধ করবো না, হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে বললেন।

বেন আর পাকাচুলওয়ালা সেনটার মাটিতে থাবা দিয়ে বসলে হারমিওন ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলো, হ্যাগ্রিড! চলুন চলুন, আমরা এখান থেকে চলে যাই।

হ্যাগ্রিড এগিয়ে গেলেন। হাতে তার তীর ধনু। চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি ম্যাগারিয়নের ওপোর।

–আমরা সবাই ভালো করেই জানি অরন্যে এসে তুমি কি করো ত্যাগ্রিড! সেনট্যাররা সেখানে ছিলো না। ম্যাগোরিয়ন তাদের ডাকলো। বললো, জেনে রেখো আমাদের সহ্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে।

হ্যাগ্রিড হটে যাবার লোক নয়। ধীরে ধীরে ম্যাগোরিয়নের দিকে এগোলেন। জেনে রেখো সহ্য তোমাকে করতেই হবে, কারণ এই অরন্য তোমার মতো আমারও।

হ্যারি–হারমিওন হ্যাগ্রিডকে ঠেলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো।

হ্যাগ্রিড মনে হয় হ্যারি আর হারমিওনের ওকে বাধা দেওয়া পছন্দ করলেন। তোমরা উত্তেজিত হবে না।

কথাটা বলে হ্যাগ্রিড পেছন ফিরলেন বললেন, যত্তোসব বুড়ো খচ্চর!

–হ্যাগ্রিড, হারমিওন রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আগের মতোই কাঁটা গাছ সরাতে সরাতে বললো, হ্যাগ্রিড ওরা যদি অরণ্যে মানুষের আসা পছন্দ না করে, তাহলে যেন না ভাবে আমরা ওদের কথা মেনে চলবো। ওরা আমাদের যেনো দুর্বল মনে না করে।

হ্যাগ্রিড বললেন, ওরা কি বলেছে শুনেছো? ওরা নাকি বাচ্চা খচ্চরদের গায়ে আঘাত করে না। মানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের। দেখা যাক, ওরা কেমন করে আমাকে তাড়াতে পারে।

–চেষ্টা করুক, হ্যারি হারমিওনকে বললো।

হারমিওন তখন মনমরা হয়ে কিছু ভাবছিলো।

ওরা ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে আগের মতোই কষ্ট করে সীমানায় এসে দাঁড়ালো। অদূরে দেখতে পেলো কিডিচ খেলার মাঠ। অনেক লোক তখন স্টেডিয়াম থেকে ফিরছে। হাগ্রিড, হ্যারিও হারমিওনকে বললেন–তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি ওদের সঙ্গে মিশে যাও, তাহলে কেউ জানবে না তোমরা আমার জন্য অরণ্যে গিয়েছিলে।

হ্যারি বললো, সুন্দর প্রস্তাব। আবার আমাদের আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

হারমিওন কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, আমি ওকে একটুও বিশ্বাস করি না। কথাটা বললো, হ্যাগ্রিড ওদের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছেন।

হ্যারি বললো, উত্তেজিত হয়ো না।

–কী বললে, উত্তেজিত হবে না? দানব, অরণ্যের একজন দানব! ওকে আমাদের ইংরেজি শেখাতে হবে? ওখানে যেতে গেলে আমাদের বিপদসঙ্কুল রাস্তা শুধু নয় বিপজ্জনক সেনট্যারদের সঙ্গে সব সময় মোকাবিলা করতে হবে। আমি ওকে একটুও বিশ্বাস করি না।

–ভাবছো কেন, আমরা তো এখনও কিছু করিনি, হ্যারি নরম সুরে হারমিওনকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

ওরা দেখলো আনন্দে ফেটে পড়েছে হাফপাফের ছেলে–মেয়েরা, দল বেঁধে ক্যাসেলের দিকে চলেছে।

হ্যাগ্রিড তো আমাদের কিছু করতে বলছেন না যতদিন না উনি হোগওয়ার্টস ছেড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সেটা কোন দিনও ঘটবে না।

ওরা যে পথে চলেছে সেই পথে অন্য কেউ না আসে, তার জন্য ওরা অন্য পথ ধরলো। খুব রেগে বললো, ওহ তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি চলো। আমি বলে দিচ্ছি হ্যাগ্রিডের ছাঁটাই হবে। আমরা আজ যা দেখলাম তার পরে কি আমব্রিজকে দোষ দেওয়া চলে?

হারমিওনের কথা শুনে মনের দুঃখে হ্যারির দুচোখ জলে ভরে গেলো।

–সত্যি, কথাগুলো মন থেকে বলছো হারমিওন?

–না। বুঝতে পারছি না কেন তিনি আমাদের জন্য তার জীবন বিপন্ন করছেন।

–আমি জানি না।

উইসলি আমাদের রাজা
আমাদের রাজা,
কোফাফিলে আমাদের গোলপোস্টের ভেতরে যেতে দেয়নি
উইসলি আমাদের রাজা

হারমিওন বললো, আমার ইচ্ছে করে ওদের গলা টিপে ধরি, বোকার মত অসভ্য গান। ওরা তো অনেক জয়গর্বিত উল্লাস করেছে এখনও শেষ হয়নি।

ঢালু মাঠ দিয়ে একগাদা ছেলে–মেয়ে নেমে পড়লো।

হারমিওন বললো, নাও স্নিদারিনরা আসবার আগে আমরা গান গাই।

ওরা দুজনে গাইলো

উইসলি সব পারে
একটি বলও ঢুকতে দেয়নি
তাইতো আমরা গান গাই
উইসলি আমাদের রাজা তাই

হ্যারি খুব আস্তে আস্তে বললো, হারমিওন।

গানের শব্দ বেড়েই চলেছে; কিন্তু সবুজ রূপালি বেশের স্নিদারিনদের কণ্ঠস্বর নয়। লাল সোনালীর ভিড় ক্যাসেলের দিকে। ওরা একজনকে কাঁধে তুলে গান গাইছে

উইসলি আমাদের রাজা, উইসলি আমাদের রাজা
একবারও কোয়াফ ফিলকে ভেতরে যেতে দেয়নি
 গ্রিফিন্ডরকে কেউ হারাতে পারেনি…

হারমিওন চাপা গলায় বললো, চুপ করো।

–হ্যাঁ, হ্যারি উচ্চস্বরে বললো।

ওরা রনের গলা শুনতে পেলো।

হ্যারি! হারমিওন! রন রূপোর কিডিচ কাপ দেখাতে দেখাতে বললো, আমরা পেরেছি, আমরা জিতেছি।

একটু একটু করে গান আর শোনা গেলো না। গ্রিফিন্ডররা আনন্দ-উল্লাসে ওদের ছেড়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে।

হ্যারি বললো, কাল সকাল পর্যন্ত আমাদের খবর মুলতবি থাক।

–হ্যাঁ, হারমিওন বললো।

ক্যাসেলের দরজার সামনে এসে ওরা নিষিদ্ধ অরণ্যের দিকে তাকালো। হ্যারি বলতে পারে না সত্যি কিছু দেখলো, না ওর কল্পনা। ঝক ঝক অনেক নাম না জানা পাখি অরণ্যের বড় বড় গাছের ওপোর দিয়ে লাইন বেঁধে ভেসে চলেছে। কে জানে কেউ কি ওদের নিড় উপড়ে ভেঙে দিয়েছে, তাই নতুন বাসার সন্ধানে উড়ে চলেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *