২৭. দ্য সেনট্যুর অ্যান্ড দ্য স্নিক

২৭. দ্য সেনট্যুর অ্যান্ড দ্য স্নিক

পার্বতী বোকার মতো হাসতে হাসতে হারমিওনকে জিজ্ঞেস করলো, ডিভিনেসন ক্লাসে যাচ্ছো নাকি?

সময়টা ছিলো ব্রেকফাস্টের। প্রফেসর ট্রিলনীর ছাঁটাইয়ের দুদিন পরের ঘটনা। পার্বতী ওর চোখের পাতা জাদুদণ্ড দিয়ে কার্ল করে চকচকে চামচের পেছন দিয়ে কেমন হয়েছে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলো। সেইদিন সকালে ফিরেঞ্জের ক্লাসে প্রথম যাওয়ার কথা।

হারমিওন মন দিয়ে ডেইলি প্রফেট পড়ছিলো। পার্বতির কথা শুনে সংক্ষিপ্তভাবে বললো, এখনও ঠিক করিনি। কথাটা বলে কাগজের পৃষ্ঠাটা উল্টে চোখ বুলাতে লাগলো।

ল্যাভেন্ডর ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, উনি ঘোড়া কেন হতে যাবেন উনি তো সেনট্যার!

পার্বতী নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো–দারুণ আঁকজমকে সেনট্যার।

হারমিওন খুব সাধারণভাবে বললো, তা সে যাই ব্যাখ্যা করো না কেন তার চারটে পা আছে। আমার মনে হয় ট্রিলনী চলে যাওয়াতে তোমরা খুব কাতর হয়ে পড়েছো তাই না?

–হা হয়েছি, ল্যাভেন্ডর জোর দিয়ে বললো–আমি তার অফিসে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সঙ্গে চারটে ডেফোডিলস (হলুদ রঙের ফুল), প্রাউটের ভেঁপুর মতো নয়, খুব সুন্দর।

হ্যারি জিজ্ঞেস করলো–কেমন আছেন ট্রিলনী?

ল্যাভেন্ডর দুঃখ ভরা কণ্ঠে বললো, খুব একটা ভালো নয়। এখনও কাঁদছেন।

বললেন, এখানে আমি কিছুতেই থাকতে চাই না যদি আমব্রিজ থাকেন। আমি কিন্তু তাকে দোষ দিচ্ছি না। আমব্রিজ অত্যান্ত মারাত্মক, সত্যি না?

হারমিওন জোর দিয়ে বললো, মনে হচ্ছে আমব্রিজ তার বীভৎস্য কাজকর্ম শুরু করেছেন।

–অসম্ভব, রন বললো। ও তখন বড় একটা প্লেটে ডিম আর বেকন খেতে ব্যাস্ত। যা ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আর কি হয়েছে? দেখেনিও নতুন ডিভিএসন টিচার তার সাথে পরামর্শ না করে নিয়োগ করার জন্য, আমব্রিজ ডাম্বলডোরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবেন, প্রতিশোধ নেবেন। আধা মানুষ ফিরেঞ্জকে দেখে তার মুখের চেহারা কেমন হয়ে গিয়েছিলো আশাকরি তোমরা লক্ষ্য করেছিলে।

হারমিওন ব্রেকফাস্ট শেষে অ্যারিথমেন্সি ক্লাসে চলে গেলো। তারপরই হ্যারি, রন, পার্বতী ও ল্যাভেন্ডর চলে গেলো ডিভিএসন ক্লাসে।

পার্বতী পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে রন একটু হতভম্ব হয়ে বললো, আমাদের নর্থ টাওয়ারে যাবার কথা না? পার্বতী ওর দিকে বিরক্তি ভরা চোখে তাকালো…

–আমাদের এগারো নম্বর ক্লাস রুমে যেতে হবে। সেখানে যেতে গেলে ফিরেঞ্জকে মই দিয়ে উঠতে হবে, পাবেন কোথায়? নোটিশ বোর্ড দেখোনি?

এগার নম্বর ক্লাশরুম একতলায়। গ্রেট হলের বিপরীতে করিডোর ধরে যেতে হয় এনট্রেন্স হলকে পাস কাটিয়ে। হ্যারি জানে এগার নম্বর ক্লাসরুমে মাঝে মাঝে পড়ানো হয়, নিয়মিত নয়। ঘরটার কাবার্ড, স্টোর রুম তেমন ফিটফাট নয়। রনের পিছুপিছু ঘরে ঢুকে দেখতে পেলো ও একটা অরন্যের প্রবেশ পথের মুখে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মুহূর্ত ও অবাক হয়ে গেলো।

–কী ব্যাপার?

ক্লাসরুমের ফ্লোর বাঁধানো নয়। ছোট ছোট নরম ঘাস আর গুল্মে ভর্তি। সামনে রয়েছে বড় বড় গাছ। ক্লাসরুমে বাইরের গাছের সবুজ সবুজ পল্লব আর পাতা জানালা দরজা ভেদ করে ছাদে ঠেকেছে। ঘরটা তাই স্যাঁতস্যাঁতে হলেও সবুজ আলোতেঝলমল করছে। যেখানে তাকাও সেখানেই ঠাণ্ডা নরম সবুজের স্পর্শ। ছাত্রছাত্রীরা যারা ওর আগে এসেছে তারা সকলেই নরম ঘাসের মেঝেতে ছোটো বড়ো গাছের শাখা-প্রশাখার, পঁড়িতে বসেছে। ওদের কেউ কেউ হাঁটু মুড়ে দুহাতে ধরে, অথবা বুকে হাত জড়িয়ে বসে রয়েছে। সকলের চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব। ওরা অরণ্যের প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে। ঠিক সেই প্রবেশ পথের মুখে যেখানে কোনো গাছপালা নেই, দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফিরেঞ্জে।

–ক্লাসরুমে হ্যারি পটার ঢুকলে একটা হাত প্রসারিত করে ফিরে বললেন হ্যারি পটার।

হ্যারি পটার অর্ধমানব–অর্ধঅশ্বের সঙ্গে করমর্দন করে বললো, হাই।

হ্যারির হাতটা ধরে ফিরেঞ্জে হ্যারিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তার বড় বড় গভীর দুই নীল চোখ দিয়ে। কিন্তু তার মুখে হাসি নেই। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম হ্যারি বললো।

-আমিও হলাম। ফিরেঞ্জের মাথার সাদা সাদা ঝাঁকড়া চুল নেচে উঠলো, আগেই ভবিষ্যত্বাণী করেছিলাম আবার আমাদের দেখা হবে।

হ্যারি লক্ষ্য করলো ফিরেঞ্জের বুকে একটা ঘোড়ার খুড়ের হাল্কা দাগ।

ফিরেঞ্জের ক্লাসের বাকি সব ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের দৃষ্টি দেখে মনে হয় হ্যারির সঙ্গে এখনও ফিরেঞ্জের কথাবার্তা না বলার কোনো কারণ নেই বা তার মুখে ভয় দেখানোর কোনো ভাব নেই।

শেষ ছাত্রটি ঘরে ঢুকে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের (ময়লা কাগজ ইত্যাদি ফেলার ঝুড়ি–কুড়াদান) পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসলে ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। ফিরেঞ্জ ঘরের চারধার বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকালেন।

–প্রফেসর ডাম্বলডোর অনুগ্রহ করে এই ক্লাশরুমটা আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সকলে স্থির হয়ে বসার পর ফিরেঞ্জ বললেন। সকলের সঙ্গে অন্ত রঙ্গ বন্ধুত্ব আমার অতি স্বাভাবিক স্বভাব। আমি তোমাদের নিষিদ্ধ অরণ্যের মধ্যে ক্লাস নিতে পারলে সুখী হতাম। গত সোমবার পর্যন্ত সেই গভীর অরণ্য ছিলো আমার আস্তানা। কিন্তু সেইখানে তোমাদের নিয়ে গিয়ে শিক্ষাদান আর সম্ভব নয়।

পার্বতী হাত তুলে বললো, স্যার, ওখানে গেলে আমাদের ভালো লাগবে। কেন যাবো না, হ্যাগ্রিড তো আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা মোটেই ভয় পাই না।

–ভয় পাওয়ার বা সাহসের কথা হচ্ছে না, ফিরেঞ্জ বললেন। এখন আমার বর্তমান অবস্থার জন্য ওখানে ফিরে যাওয়া সম্ভবপর নয়, হার্ড আমাকে বিতাড়িত করেছে।

–হার্ড (পশুপাল)? ল্যাভেন্ডর তোতলাতে তোতলাতে বললো। হ্যারির মনে কোনও সন্দেহ নেই ল্যাভেন্ডর হার্ড বলাতে গরুর পাল মনে করেছে! গরু চরানোর দল। ওহ তাই? ও যেন দলের মানে বুঝতে পেরেছে এমন একভাবে মুখ ছেয়ে যায়।

–তাহলে আপনার মতো আরও অনেকে সেখানে আছে?

ডিন কৌতুহলের সঙ্গে প্রশ্ন করলো, হ্যাগ্রিড থ্রেস্টালের মতো আপনাকে লালন-পালন করেছেন?

ফিরেঞ্জ, ডিনের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। ডিন ফিরেঞ্জর মুখ দেখে বুঝতে পারলো না যে ও খুবই অসম্মানজনক প্রশ্ন করেছে।

ফিরেঞ্জ শান্তভাবে বললেন, সেনট্যাররা মানুষের ভূত্য বা খেলার নয়।

–না না আমি তা বলিনি স্যার।

সামান্য নীরব সকলে। তারপর পার্বতী ওর হাত তুললো।

–অন্য সেনট্যারেরা আপনাকে কেন দল থেকে বিতাড়িত করলো স্যার?

–কারণ, কারণ আমি ডাম্বলডোরের কাজ করতে রাজি হয়েছি। ওরা মনে করে এটা দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

হ্যারির চার বছর আগেকার একটা কথা মনে পড়ে গেলো। সেনট্যার কেনের ফিরেঞ্জের দিকে তাকিয়ে তিরস্কার-চিৎকার। ফিরেঞ্জর হ্যারিকে পিঠে চাপিয়ে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া। ও তাকে অতি সাধারণ এক খচ্চর বলেছিলেন। ওর মনে হয় সেনট্যার হয়তো ফিরেঞ্জের বুকে লাথি মেরে ওকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে, বুকে তাই খুড়ের দাগ!

ফিরেঞ্জ বললেন, তাহলে শুরু করা যাক। কথাটা বলে তার লম্বা ল্যাজ ঝাপাট দিয়ে হাত তুললেন ঘরের গুল্মে ভরা ছাদের দিকে, তারপর খুব ধীরে ধীরে নামিয়ে আনলেন। ঠিক সেই সময় ঘরের সবুজ আলো কমে গিয়ে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হল যাতে ছাত্রছাত্রীরা মনে করে সবুজ জঙ্গলের কচি কচি পাতার ওপোর বসে আছে। আশপাশে বড় বড় গাছের সবুজ পল্লব আর ছাদের চাঁদোয়াতে আকাশের তারা টিপ টিপ করছে। চারদিক থেকে ঝড়ো বাতাসের আর শ্বাসের শব্দ। রন সামান্য আতঙ্কিত হয়ে বললো, ব্লিমে! (হে ঈশ্বর আমার দৃষ্টি শক্তি নিয়ে নাও)।

–তোমরা তৃণাচ্ছাদিত জমিতে শুয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকাও, ফিরেঞ্জ অতি শান্ত কণ্ঠে বললেন। আকাশের তারায় তোমাদের ভাগ্যের কথা লেখা আছে। আমাদের পূর্ব পুরুষ বা সগোত্র মানুষের কথা।

হ্যারি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকালো। ও সারা আকাশে তারার ঝিকিমিকি দেখতে পেলো। ওপোরের অগণিত ঝিকিমিকি করা তারা থেকে একটি মাত্র তারা যেন ওকে চোখ টিপলো।

ফিরেঞ্জ বললেন, আমি আশাকরি তোমরা সবাই গ্রহ আর তাদের চাঁদের কথা অ্যাস্ট্রোনমিতে শুনে থাকবে। শুধু তাই নয় আকাশে তাদের গতিবিধিও। শত শত বর্ষ ধরে আমরা সেনট্যাররা তাদের গতিবিধি ও রহস্য উদঘাটন করেছি। আমাদের গণনা বলছে, শিক্ষা দিচ্ছে। ওপোরের অনন্ত সীমাহীন আকাশে আমাদের সেইসব অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটবে, বিলীন হয়ে যাবে।

পার্বতী শুয়ে শুয়ে হাত তুলে বললো, প্রফেসর ট্রিলনী আমাদের জ্যোতির্বিদ্যা শিখিয়েছেন যে, মার্স (মঙ্গলগ্রহ) আমাদের নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটায়। যেমন আকস্মিক অ্যাকসিডেন্ট, পুড়ে যাওয়া, ওই রকম সব বিপদ-আপদ যখন সে শনির কাছে কোনাকুণি থাকে এখন যেমন দেখছি। ও শূন্যে একটা সমকোণ হাতের ভঙ্গিতে আঁকলো। তার মানে এই, মানুষে নরম জিনিস ব্যবহার করার সময় খুব সাবধান হবে।

–ফিরেঞ্জ বললেন, ওই অভ্যাস মানুষের মুখমী ছাড়া আর কিছু নয়।

কথাটা শুনে পার্বতীর হাত ঝুলে পড়লো ওর এক ধারে।

–মানুষের ছোটো ছোটো আঘাত, দুর্ঘটনা, ফিরেঞ্জ বললেন ঘরের খাসপাতার ওপর দিয়ে হাঁটার সময় শব্দ সৃষ্টি করতে করতে। এগুলোর এখন আর গুরুত্ব নেই, অনেকটা বিরাট আকাশের প্রেক্ষাপটে ছোট ছোট পিঁপড়ে চলাফেরা করার মতো। সেগুলো চাঁদ-তারা সূর্য ইত্যাদির মহাকাশে বিচরণের বিঘ্ন সৃষ্টি করে না।

–প্রফেসর ট্রিলনী? পার্বতী বলতে শুরু করলো খুবই দুঃখিত এবং কটুকণ্ঠে।

–হ্যাঁ, তিনি একজন মানুষ, ফিরেঞ্জ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, মানুষ মাত্রই ভুল হয়, ভুল করে, তাদের একটা সীমা আছে।

হ্যারি মুখটা ঘোরালো পার্বতীর মুখটা দেখার জন্য। দেখে মনে হলো ফিরেঞ্জের কথায় খুবই মর্মাহত হয়েছে ও।

-সিবিল ট্রিলনী হয়তো দেখতে পেয়েছেন। সে সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না, আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ফিরেঞ্জ বললেন।

হ্যারি ফিরেঞ্জের ল্যাজের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেলো। সবসময় পায়চারি করছেন। কিন্তু আমার ধারণা তিনি নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে, সময়ের অপব্যবহার করেছেন। মানুষের ভবিষ্যৎবাণী বা ওইরকম একটা বোকা বোকা আত্মপ্রশংসা করে। আমি এসেছি তোমাদের কাছে সেনট্যারসদের জ্ঞানের কথা বলতে, সেগুলো ব্যক্তিগত নয় এবং পক্ষপাতশূন্য। আমরা আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, অশুভের ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া স্রোতের দিকে, অথবা সেখানে প্রাকৃতিক কিছু সংগঠনের দিকে। এমনি করে যা দেখছি বা ভাবছি তার সত্য নিরুপণের জন্য দশ দশটা বছর কাটিয়ে দিই। কথাটা বলে ফিরেঞ্জ হ্যারির ঠিক মাথার ওপোর লাল তারার দিকে আঙ্গুল তুললেন। দুটি গ্রহের কাছাকাছি মায়াবী অবস্থানের জন্য না অশান্তি, যুদ্ধ বিগ্রহ চলে আসছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মঙ্গলগ্রহ। আমাদের ঠিক মাথার ওপোর আকাশে জ্বল জ্বল করছে। জানাচ্ছে শিগগিরই যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হবার সম্ভাবনা। কত শিগগির হতে পারে সেনট্যারসরা আলোকপাত করতে চেষ্টা করে চলেছে, কিছু জড়ি-বুটি-লতা-পাতা পুড়িযে এবং আগুন আর গন্ধতে।

এই ধরনের অদ্ভুত লেসন হ্যারি জীবনে প্রথম শুনলো। ছাত্রছাত্রীরা ফিরেঞ্জের কথামতো সত্যসত্যই কোমল লোমশ পাতাওয়ালা গাছপালা ক্লাশরুমের মধ্যে নিয়ে এস পোড়ালো। ফিরেঞ্জ বললেন, আগুনের আকার ও সঙ্কেত চিহ্ন লক্ষ্য করতে; কিন্তু যা যা বলেছেন, তার একটিও আকার চিহ্ন আগুনে না দেখা গেলেও ফিরেঞ্জ বলা মাত্র বিচলিত হলেন না। না হবার ব্যাখ্যা দিলেন যে মানুষের এ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান নেই সেন্ট্যারদের হাজার হাজার বছর লেগে গেছে তা আয়ত্বে আনতে। আরও বললেন, এই সবের ওপোর আস্থা রাখা মূর্থের পরিচয়। কারণ হাজার হাজার সাধনা করার পরও সেনটাররা এখনও ভুল করে। মুঠোর মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়েছে, ভুল গণনার জন্য। ওই রকম এক শিক্ষক আগে হ্যারি দেখেনি। মনে হয়, তার শিক্ষাদানের ব্যাপারটা ঠিক তিনি যা জানেন তা নয়। বলতে চাইছেন, পৃথিবীতে মানুষ অথবা সেনট্যারদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। কেউ প্রকৃতির ঊর্ধ্বে নয়।

রন খুব চাপা গলায় বললো, মনে হয় কোনও ব্যাপারেই তিনি নিশ্চিত নয়। লোমশ পাতাওয়ালা গাছপালার আগুন সকলেই নেভাতে ব্যস্ত। আমি বলতে চাই আসন্ন যুদ্ধের জন্য আমি বিস্তারিত কিছু করতে পারি, তুমি পারো না? বাইরে থেকে ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা বাজতেই সকলেই ক্লাস রুম থেকে একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে লাফাতে লাফাতে পালিয়ে গেলো। হ্যারি একদম ভুলে গেছে ও ক্যাসেলের ক্লাসরুমে বসে রয়েছে। মনে হয় যেনো নিষিদ্ধ অরণ্যের মাঝে বসে রয়েছে। ক্লাসরুম শূন্য হলে ও সামান্য হকচকিয়ে গেলো।

হ্যারি–রন ক্লাশরুম ছেড়ে যাবে ঠিক সেই সময় ফিরেঞ্জে বললেন, হ্যারি পটার, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

হ্যারি মুখ ফেরালো। সেনট্যার ওর দিকে দুএক পা এগোতে রন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলো।

–তুমিও ইচ্ছে করলে থাকতে পারো; কিন্তু ঘরের দরজাটা অনুগ্রহ করে ভেজিয়ে দাও, ফিরেঞ্জ বললেন।

রন দরজাটা ভেজিয়ে দিলো।

–হ্যারি পটার, তুমিতো হ্যাগ্রিডের বন্ধু, তাই না? সেনট্যার বললেন।

–হ্যাঁ, হ্যারি বললো।

–তাহলে, তুমি আমার হয়ে তাকে সতর্ক করে দিও। ওর লক্ষ্যভেদ ঠিক হয়নি। খুশি হবো যদি ও আবার চেষ্টা না করে।

হ্যারি আপন মনে বললো–লক্ষ্যভেদ হয়নি, চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে!

ফিরেঞ্জ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, বলে দিও আর যেনো চেষ্টা না করেন। আমি অবশ্য নিজে তাকে সতর্ক করে দিতে পারতাম, কিন্তু আমি তো এখন দল থেকে বিতাড়িত। আমার পক্ষে এখন গভীর অরণ্যে যাওয়া অবিবেচকের মতো কাজ হবে, হ্যাগ্রিড সেনট্যারদের সঙ্গে যুদ্ধ না করেই অনেক বিপদ-আপদ ডেকে এনেছে।

হ্যারি সামান্য ভীত হয়ে জানতে চাইলো হ্যাগ্রিড কী প্রচেষ্টা করেছেন।

ফিরেঞ্জ হ্যারিকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন।

–অবশ্য হ্যাগ্রিড আমার একটা বিশেষ বড় কাজ করে দিয়েছে, ফিরেঞ্জে বললেন, সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর ওপোর ভালবাসা ও যত্ন নিয়ে আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। আমি তার গোপনতার বিশ্বাসঘাতকতা অবশ্যই করবো না, কিন্তু নির্বোধের মতো কাজ না করাই উচিত। ওকে বলবে, ওর প্রচেষ্টা কার্যকরী হয়নি। হ্যারি পটার গুড বাই।

***

কুইবলার কাগজের সাক্ষাক্তারের পর হ্যারি পটারের মনে যে আনন্দ, উৎসাহ হয়েছিলো এখন তা আর নেই, উবে গেছে। মার্চের শেষে এপ্রিল শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেলো ধারাবাহিকভাবে নানা চিন্তা আর সমস্যা।

ওদিকে আমব্রিজ এক নতুন চাল ছেড়েছেন। নিয়ম করে কেয়ার অফ ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচারের ক্লাসে আসতে শুরু করেছেন। সেই কারণে হ্যাগ্রিডকে ফিরেঞ্জের সতর্ক বার্তা পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না।

সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে হ্যারি সুযোগ পেয়ে গেলো। ফ্যানটাসটিক বিসট অ্যান্ড হোয়ার টু ফাঁইন্ড দেম বইটা হারিয়ে যাওয়ার অজুহাত নিয়ে একদিন ক্লাশ পালিয়ে হ্যাগ্রিডের কটেজে গিয়ে ফিরেঞ্জের সতর্ক বার্তা হ্যাগ্রিডের কানে তুললো। হ্যারির কথা শুনে হ্যাগ্রিড একটু আশ্চর্য হয়ে হ্যারির মুখের দিকে অনেকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হ্যারি লক্ষ্য করলো হ্যাগ্রিডের মুখের ক্ষত তখনও ভালো করে সারেনি, চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। কিন্তু সময় নষ্ট না করে নিজেকে সামলে নিলেন।

–ফিরেঞ্জ সত্যি ভালো লোক, হ্যাগ্রিড ছোট করে বললেন, আমার মনে হয় ও যা বলছে তা নিজেই জানে না। তবে উদ্দেশ্যটা ভালো সন্দেহ নেই।

–হ্যাডি আপনি কি করতে চান, বলতে চান বুঝতে পারছি না। কিন্তু যাই করুন না কেন আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। আমব্রিজ অজুহাত দেখিয়ে ট্রিলনীকে বরখাস্ত করেছেন। যদি আপনি আমাকে প্রশ্ন করেন তাহলে বলবো, তার লিস্টে আপনার নামও আছে, তাই যা করছেন এরপর তা করবেন না। তাহলে আপনি…।

–আমার চাকরি বজায় রাখার চাইতে আরও অনেক কাজ করার আছে। হ্যাগ্রিড কথাটা বললেও হ্যারি দেখলো ওর হাত কাঁপছে। বেসিন ছাপিয়ে ছোট ছোট কাঠের টুকরো (গ্লানরল) মেঝেতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করার প্রয়োজন নাই হ্যারি। ভালোছেলে হয়ে মন দিয়ে পড়াশুনা করো যাও।

হ্যারির ক্যাসেলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই। হ্যাগ্রিডের ঘরে চতুর্দিকে এলোমেলো সব আজেবাজে ছড়িয়ে থাকা দেখতে দেখতে মনোভঙ্গ হয়ে হ্যারি ফিরে এলো।

সময় ঘনিয়ে আসছে। বিভিন্ন শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের ও হ্যারিকে পঞ্চম বার্ষিক আসন্ন আউল-এর কথাটা বার বার মনে করিয়ে দিতে থাকে। সকলেই তাই চিন্তিত কি হবে, আর কি না হবে সেই কথা ভেবে। হান্না অ্যাবট সর্বপ্রথম ছাত্রী যে ম্যাডাম পমফ্রের কাছ থেকে হার্বোলজির ক্লাশে কামিং ড্রট পেলো। কাঁদতে কাঁদতে ঠিক করলো স্কুল ছেড়ে দেবে।

ডিএ লেসনের ব্যাপারটা না থাকলে হ্যারি খুবই অসুখী থাকতো সন্দেহ নেই। রুম অফ রিকোয়ারমেন্ট ঘরে অনেকটা সময় কাটানো, বেশি পরিশ্রম ইত্যাদিতে ও খুবই আনন্দিত ও খুশি। সদস্য ছেলে মেয়েরাও ওরই সঙ্গে খুশি। খুবই পরিশ্রম করে চললো ওরা।

হ্যারি এক সময় ভেবে ভীষণ মজা পায়, যখন ভাবে–ওর দলের সদস্যরা ডিফেন্স এগেন্সট ডার্ক আর্টে আউট স্ট্যান্ডিং আউল পেলে আমব্রিজের মুখের দৃশ্য ভেবে।

ওরা শেষে পেট্রোনাসের কাজ শুরু করে দিলো। সকলেই সেটা শিখতে উদগ্রিব। হ্যারি ওদের একদিন ডিএ শিক্ষা ক্লাসে মনে করিয়ে দিলো ঘর ভর্তি লোক, দিনের উজ্জ্বল আলোতে বসে পেট্রোনাস করা আর অন্ধকার ডিমেন্টরস বা ওই রকম কিছুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সম্পূর্ণ আলাদা।

ডিএ শিক্ষার শেষদিন চো হাঁসের মত সারা ঘরে পেট্রোনাস উড়তে দেখে হাততালি দিয়ে বললো, হ্যারি তুমি আমাদের আনন্দ-উৎসাহ নষ্ট করে দিও না। দেখো দেখো কি সুন্দর দেখাচ্ছে।

ইস্টারের ছুটির আগে সেদিন ছিলো ডিএ ক্লাসের শেষদিন।

হ্যারি বললো, পেট্রোনাস দেখতে সুন্দর সন্দেহ নেই, কিন্তু ওরা তোমাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করবে এটাই মোদ্দা কথা। আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্র হলো বোগাট বা ওইরকম কিছু, যা আমরা আমাদের ডিএ ক্লাসে শিখেছি। আমায় পেট্রোনাস ব্যবহার করতে হয়েছিলো যখন ডিমেন্টরসরা ছদ্মভাবে বোগার্ট হয়েছিলো।

কিন্তু ল্যাভেন্ডর ওর ম্যাজিক দণ্ডের মুখ থেকে থোকা থোকা রূপালী বাষ্প বার করছিলো। রেগেমেগে বললো, ধ্যাৎ এখনও আমি পারছি না, তুমি করো।

নেভিলের অসুবিধে হচ্ছিলো। ওর জাদুদণ্ড থেকে খুব ধীরে ধীরে রূপালী বাস্প বেরোচ্ছিলো।

হ্যারি বললো, মুখ গোমড়া করে থাকলে চলবে না। সবকিছু ঠিক ঠিক হলে ভাল হবে, সেই চিন্তা করো।

নেভিল বললো, সেই চেষ্টা করছি।

হ্যারি বললো, অসুবিধেতো থাকবেই। সেগুলো পরাজিত করতে হবে কঠিন পরিশ্রম করে।

একমাত্র হারমিওনের পেট্রোনাস ছাড়া সকলেরই একই অবস্থা।

ওদের ক্লাশরুমের দরজাটা খুলে কেউ ঘরে ঢুকলো। হ্যারি কে এসেছে দেখার জন্য দরজার দিকে তাকালো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। কিন্তু মনে হলো কেউ ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে কোথায় আত্মগোপন করে রয়েছে। এই কথা ভাবছে, ঠিক সেই সময় মনে হলো কে যেন ওর হাঁটুর কাছে রোব ধরে টানাটানি করছে! কে টানাটানি করছে দেখার জন্য হ্যারি মাথা নোয়াতেই দেখলো এলফ ডব্বি! ওর মাথায় কম করে আটটা প্রকাণ্ড পশমের হাটে, মুখটা প্রায় ঢেকে গেছে।

–ওহো ডব্বি? হ্যারি ওকে দেখে বললো, কিছু অসুবিধে, কিছু বলবে? ডিএ ক্লাসের সবাই ডব্বির দিকে তাকিয়ে থাকে।

–হ্যারি পটার, স্যার! ডব্বি কাঁপতে কাঁপতে ককিয়ে ককিয়ে বললো–হ্যারি পটার স্যার, ডব্বি আপনাকে আগেভাগে সাবধান করে দিতে এসেছে। হাউজ এলফরা বলেছে, কথাটা আপনাকে না জানাতে, সতর্ক করে দিয়েছে।

হ্যারি জানে ডব্বির স্বভাব। রাগ-দুঃখ হলে সেটা প্রশমিত করার জন্য দেয়ালে ঘুষি মারে, মাথার হ্যাট খুলে ফেলে, মোজা খুলে ফেলে। দেয়ালের দিকে ডব্বি ছুটে যেতেই হ্যারি ওকে চেপে ধরলো। ডব্বি সামলাতে না পেরে মেঝেতে ছিটকে পড়া পশমের হাটগুলোর ওপোর বসে পড়লো। হারমিওন আর দুএকজন ওকে ধরে সহানুভূতি দেখাতে লাগলো।

হ্যারি ওর ছোট্ট হাতটা ধরে বললো, তোমার কী হয়েছে ডব্বি? হাতটা না ধরলে ডব্বি হয়তো সেই হাতে বুকে ভীষণভাবে চাপ মেরে মেরে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিতো।

–হ্যারি পটার… ও… ও। ডব্বি অন্যহাতে নিজের নাকে প্রচণ্ডভাবে ঘুষি মারলো। হ্যারি সেই হাতটাও চেপে ধরলো।

–কার কথা বলছো, ডব্বি?

হ্যারি জানে ডব্বি কার কথা বলতে এসেছে।

–আমব্রিজ? হ্যারি ভয় পেয়ে বললো।

ডব্বি মাথা নেড়ে হ্যারির বুকে মাথা ঠুকতে লাগলো।

–আমব্রিজ তো কী হয়েছে? উনি তো আমাদের এই ডিএ ক্লাসের সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।  

হ্যারি ডব্বির মুখ দেখে জবাবের প্রতিক্ষা করতে থাকে। ডব্বি হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে হ্যারির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ধপাস করে আবার মেঝেতে পড়ে গেলো।

হ্যারি ধীরস্থিরভাবে বললো, এই ঘরের দিকে আসছেন?

ডব্বি একটা পকেট থেকে লোহার হাতা বার করে নিজের পায়ে দমাদম করে পিটাতে থাকে।

–হ্যারি, হ্যারি পটার, হা… হা…।

হ্যারি, ডব্বির কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের সকলের মুখের দিকে তাকালো, দেখলো সকলেই নিশ্চল–নিপ, আসন্ন ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে।

হ্যারি গর্জন করে ওদের বললো, এখানে তোমরা দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? পালাও!

ঘরের সবাই একযোগে দরজা খুলে পালালো। হ্যারি ঘর থেকে শুনতে পেলো করিডোরে ওদের ভীত-সন্ত্রস্থ পদশব্দ! হ্যারি চায় সকলেই যেন তাদের ডরমেটরিতে চলে যায়। সবেমাত্র দশটা বেজে ন মিনিট। ইচ্ছে করলে লাইব্রেরি অথবা প্যাচাঁদের থাকবার জায়গায় (আউলারিতে)ও যেতে পারে।

হারমিওন অবশ্য বললো, হ্যারি দেরি করবে না চলো।

ও ডব্বির হাতটা চেপে ধরে আদেশের সুরে বললো, ডব্বি তুমিও চলো। শোনো, আমি তোমাকে বার বার নিজেকে আঘাত করতে নিষেধ করছি তুমি শুনছো না।

হ্যারি ডব্বির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিলো।

ডব্বি যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাসিক সুরে কাঁদতে কাঁদতে বললো–ধন্যবাদ হ্যারি পটার। তারপর ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে চলে গেলো। হ্যারি করিডোরে তাকিয়ে দেখলো জনমানবহীন, সকলেই চলে গেছে। ও ডানদিক ধরে চলতে শুরু করলো। সামনেই একটা ছেলেদের বাথরুম। ও ওখানে অনায়াসে লুকিয়ে রাখতে পারে! বলতে পারে অনেকটা সময় ও বাথরুমে ছিলো।

হঠাৎ কিছু একটা ওর পায়ের পাতা চেপে ধরলো। হঠাৎ চেপে ধরার জন্য প্রায় ছফিট দূরে ছিটকে পড়লো। হোঁচট খেয়ে পড়া সামলাতে সামলাতে দেখলো ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যালফয়! চোখে মুখে ওর বিদ্রুপের আর শয়তানী হাসি! ম্যালফয় ওকে দেখে একটা ড্রাগন আকৃতি ভেসের আড়ালে দাঁড়ালো।

–নাও ম্যাজিক ফলাও পটার! ম্যালফয় বললো। প্রফেসর একজনকে ধরেছি।

আমব্রিজকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেলো। জোরে জোরে হাঁটার জন্য হাঁফাচ্ছেন। তাহলেও ফিটফাট কেতাদূরন্ত ড্রেস! মুখে একই রকম অমায়িক হাসি।

হ্যারিকে করিডোরের ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে আমব্রিজ খুশিতে উপচে পড়ে বললেন–ও এর কথাই বলছিলে? শাবাস ড্রাকো, শাবাস! খুব ভালো কাজ করেছে। এর জন্য স্লিদারিয়ন পাবে পঞ্চাশ পয়েন্ট! আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। এই যে হ্যারি পটার উঠে দাঁড়াও।

হ্যারি, আমব্রিজের মুখের দিকে তাকালো। আমব্রিজ হাসছেন। এর আগে আমব্রিজকে এতো খুশির হাসি হাসতে দেখেনি। আমব্রিজ হ্যারির হাতে টান মেরে দারুণ খুশিতে উপছে পড়া ম্যালফয়ের দিকে তাকালেন।

–ড্রাকো, আরও যদি দুচারটেকে ধরতে পারো তো তাদের আমার ঘরে নিয়ে এসো। বাথরুম, লাইব্রেরি ঘর চেক করো। মেয়েদের ব্যাপারটা মিস পারকিনসন করতে পারেন। ম্যালফয় আমব্রিজের হুকুম তামিল করতে লাফাতে লাফাতে চলে গেলে আমব্রিজ বললেন, ঘরে তুমি আমার সঙ্গে হেডমাস্টারের চলো পটার।

যেতে যেতে হ্যারির মাথায় অনেক চিন্তা : রনের নাম মিসেস উইসলি জানতে পারলে কি মনে করবেন, হারমিওন হয়তো ওর আউল পাবে না। বাকিদের অবস্থাও খুব ভালো হবে না বলে হ্যারির মনে হয়। ও আমব্রিজের সঙ্গে বাঘের মুখ পেরিয়ে ডাম্বলডোরের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। আমব্রিজ ডাম্বলডোরের ঘরের বন্ধ দরজাতে নক করার কথাও না ভেবে হ্যারির হাত শক্ত করে ধরে ঘরে ঢুকলেন।

অফিস ভর্তি লোক। ডাম্বলডোর যেমন সচরাচর ডেস্কের পেছনে বসে থাকেন তেমনি বসে রয়েছেন। পাশেই ম্যাকগোনাগল জবু থবু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মুখ দারুণ উত্তেজনা। কর্নেলিয়স ফাজ ফায়ার প্লেসের চারধারে ঘুরছেন, মুখ গম্ভীর। দরজার দুধারে দুজন জাদুকর পাহারা দিচ্ছে। একজনকে হ্যারি চিনতে পারলো কিংগশ্নে শ্যালবোল্ট। অন্যগার্ডকে হ্যারি ঠিক চিনতে পারলো না। পার্সি উইসলিও ঘরের চারধারে গম্ভীর মুখে ঘোরাফেরা করছে। ওর হাতে একটা কুইল আর একগাদা পার্চমেন্টস। দেখে মনে হয় পার্চমেন্টে নোট লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

অতীতের হেড মাস্টার আর মিস্ট্রেসরা তাদের ফ্রেমের মধ্যে রয়েছেন। সকলেই গম্ভীর, আর ঘরের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে তার প্রতি সজাগ।

হ্যারি ঘরে ঢুকতেই প্রোট্রেটের অতীতের জাদুকরদের মধ্যে চাপা গলায় ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। খুবই জরুরি কিছু শুনতে চান মনে হয় তাদের মুখ দেখে।

হ্যারি আমব্রিজের হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কর্নেলিয়স ফাজের মুখের পানে তাকালো। দেখলো ফাজ ওর দিকে অসম্ভব এক বিশ্রি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। মুখে কদর্য হাসি!

–বেশ, বেশ, উনি বললেন।

হ্যারিও বিশ্রীভাবে ফাজের দিকে তাকালো। অনেকটা শঠে শঠ্যাং ভাব! ওর বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটলেও মস্তিষ্ক অতিশয় ঠাণ্ডা ও পরিস্কার।

আমব্রিজ বললেন, পটার, গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ঘোরাফেরা করছিলো। গলার সুর অতিশয় কদর্য… অনেকটা ট্রিলনীকে বরখাস্ত করার সময়ের মতো।

–ম্যালয়ের পুত্র ওকে হাতেনাতে ধরেছে।

ফাজ খুব আনন্দের সঙ্গে বললেন, সত্যি, সত্যি? ও ঘোরাফেরা করছিলো? আমি অবশ্যই লুসিয়াসকে খবরটা দিতে ভুলবো না। আচ্ছা পটার আমি আশা করছি তুমি ওখানে কেন ঘুরছিলো, ঠিক বলতে পারবে–তাই না?

হ্যারি সোৎসাহে বলতে গেলো, হ্যাঁ, কিন্তু ডাম্বলডোরের দিকে চোখ পড়তেই বাকি কথাটা বলতে পারলো না, মুখের ভেতর রয়ে গেলো। ওদিকে ডাম্বলডোর কিন্তু হ্যারি পটারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন না। দৃষ্টি তার হ্যারির পেছনের দেয়ালে একটা ছিদ্রের দিকে। কিন্তু হ্যারির দিকে খুব ছোট করে হাসলেন ডাম্বলডোর তার ঠোঁট দুটো না খুলে।

হ্যাঁ কি বলছিলে? অনুগ্রহ করে বলল।

ইয়ে, না। হ্যারি দুর্বলতা কাটিয়ে শক্তভাবে বললো।

–হ্যাঁ কি বললে? তুমি এখানে এসেছা কেন তা তুমি জানো না?

–না, জানি না, হ্যারি বললো।

ফাজ হ্যারির দিক থেকে ডাম্বলডোরের দিকে তাকাতে সেই ফাঁকে ও ডাম্বলডোরকে দেখলো।

–কেন এসেছে সে সম্বন্ধে তোমার কোনও আইডিয়া নেই, ফজ বেশ ব্যাঙ্গের ভাব মুখে এনে বললেন।

জানি না, হ্যারি বললো।

–প্রফেসর আমব্রিজ তাহলে কেন তোমাকে সঙ্গে করে এখানে এনেছেন? তোমার জানা নেই যে তুমি স্কুলের আইন ভেঙেছো?

–স্কুলের আইন? হ্যারি বললো। না তো।

–অথবা মন্ত্রণালয়ের ডিক্রি? ফাজ আইনের বদলে ডিক্রি কথাটার ওপোর জোর দিয়ে বললেন।

হ্যারি অতি ভদ্র ও অমায়িকভাবে বললো–না স্যার, সেরকম কিছু করেছি বলে তো আমার মনে হয় না।

ওর বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা থামেনি। বুঝতে পারছে সেই সময়ে ফাজের রক্তচাপ বাড়ছে। বুঝতে পারছে না কোন শক্তিতে ও তাদের কাছ থেকে মুক্তি পাবে। কেউ যদি ওর ডিএ শিক্ষার ব্যাপারে আমব্রিজকে খবর দিয়ে থাকে তাহলে তার নায়ককেও তার সঙ্গে বাক্স প্যাটরা গোছাতে হবে।

ফাজ বললেন, তাহলে তুমি কিছুই জানে না। তার গলার স্বরে ক্রোধের আগুন। একটা বেআইনী সংগঠন স্কুলের মধ্যে ধরা গেছে?

–হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, হ্যারি বললো। মুখে চোখে তার নিরীহ নিরাপরাধীর ছাপ।

আমব্রিজ বললেন, আমার মনে হয় যে খবরটা দিয়েছে তাকে ডেকে পাঠালে সবকিছু জানা যাবে, মাননীয় মন্ত্রী।

–হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করুন, ফাজ বললেন।

আমব্রিজ ঘর ছেড়ে চলে গেলে ফাজ বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে ডাম্বলডোরের দিকে তাকালেন। সৎ সাক্ষীর মতো আর কিছু নেই, আছে কী, ডাম্বলডোর?

ডাম্বলডোর মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, না একদম না। কর্নেলিয়স।

কয়েক মিনিট কেউ কারও দিকে তাকালেন না। তারপর হ্যারি ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো। আমব্রিজ ঘরে ঢুকলেন চোর কোঁকড়ানো চুলের বিশিষ্ট বন্ধু মেরিয়েটার কাঁধটা চেপে ধরে। মেরিয়েটা দুহাতে মুখ ঢেকে রইলো।

প্রফেসর আমব্রিজ গলার স্বর খুবই নরম করে বললেন–ভয় পেয়ো না, ভয় পাবার কিছু নেই। ওর পিঠ চাপড়ালেন, ঠিক আছে সব ঠিক আছে, তুমি উচিত কাজ করেছে। মন্ত্রী তোমার ওপোর খুব খুশি। তোমার মাকে অবশ্যই জানাবেন তোমার মতো মেয়ে দুটি হয় না। মেরিয়েটার মাকে মন্ত্রী মশাই অবশ্যই চেনেন ম্যাডাম এজকোষবে। ম্যাজিক্যাল ট্রান্সপোর্টেশনে কাজ করেন, ফুঁ নেটওয়ার্ক অফিসে। হোগওয়ার্টসে আগুন লেগেছিলো, তখন তিনি পুলিশকে খুবই সাহায্য করে ছিলেন, অবশ্যই আপনি জানেন!

–বাঃ বাঃ অতি সুন্দর, অতি সুন্দর ফাজ হাসতে হাসতে বললেন। যেমন মা তেমন মেয়ে, তাই না? খুব ভালো, এদিকে এসে দাঁড়াও, আমার দিকে নির্ভয়ে তাকাও। হ্যাঁ বলতো, তুমি কি জানো।

মেরিয়েটা ধীরে ধীরে মাথা তুলতে ফাঁজ এক-দুপা পিছনে হটতেই ফায়ার প্লেসের আগুনে তার রোবের তলাটায় আগুন লেগে ধোয়া বেরোতে লাগলো। তৎক্ষণাৎ ফাজ মন্ত্রবলে আগুন নিভিয়ে দিলেন। মেরিয়েটা ভয় পেয়ে আলখেল্লাটা তুলে মুখে তোলার আগেই অনেকের দৃষ্টি পড়ে গেলো ওর মুখের ওপোর। ওর মুখটা লাল লাল গুটিতে ভর্তি, একবিন্দুও জায়গা বাকি নেই। বেশ পরিষ্কারভাবে নাকে মার গালে লেখা রয়েছে গুপ্তচর (স্নিক)।

–যাক গে, তুমি ওইসব মুখের স্পটে ধ্যান দিও না। মন্ত্রী মশাইকে তুমি যা জানো সবিস্তারে মুখ থেকে আলখেল্লাটা সরিয়ে ফেলে বলো।

কিন্তু মেরিয়েটা রোবটা না সরিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠলো।

আমব্রিজ ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, থাকগে তোমায় বলতে হবে না, আমি সবাইকে বলছি। আমব্রিজ মুখে অমায়িক হাসি টেনে এনে বললেন আজ সন্ধ্যেবেলা ডিনার শেষ করে মিস এজকুম্বে আমার ঘরে এসে বললো, ওর কিছু আমাকে বলার আছে। ও বললো আমি যেন ওর সঙ্গে আটতলায় গোপন ঘরে যাই। যার নাম রুম অফ রিকোয়্যারমেন্ট ওখানে গেলে আমার যাতে কাজে লাগে সেরকম কিছু দেখতে পাবো। আমি ওকে দুএকটা প্রশ্ন করার পর জানতে পারলাম ওই ঘরে কিছু ছাত্র ছাত্রী কিছু একটা মিটিং করছে। দুঃখের বিষয় এইটুকু বলার পর, ওর মুখের ঢাকা সরিয়ে দেখলাম ওর পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।

তারপর মেরিয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্দেহ নেই তুমি খুব সাহসী মেয়ে। তুমি সাহস করে প্রফেসর আমব্রিজের কাছে সব কিছু জানিয়েছে। তা তুমি কী বলবে সেই মিটিং-য়ে কি আলাপ-আলোচনা হচ্ছিলো? কিসের জন্য আর সেখানে কারা কারা উপস্থিত ছিলো?

কিন্তু মেরিয়েটা নীরব। বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ!

ফাজ আমব্রিজের দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েটিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা হয়েছে, ওটা হটাবার কিছু মন্ত্র নেই? তাহলে মনে হয় ও বলতে পারবে।

আমব্রিজ বললেন, আজ পর্যন্ত তো আমি জানি না।

হ্যারি জানে জাদুমন্ত্রটা হারমিওনের।

–যাকগে কিছু না বললেও, বাকিটা আমি বলছি। মিনিস্টার আপনার বোধহয় স্মরণ আছে গত অক্টোবর মাসে আপনাকে হ্যারির হগসমিডের হগসহেডে গোপন মিটিংয়ের কথা লিখে জানিয়েছিলাম?

ম্যাকগোনাগলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। বললেন, সেই মিটিং সম্বন্ধে আপনি কোনও প্রমাণ দাখিল করতে পারেন?

–আমার কাছে উইলী ওয়াইডারসাইনের হলফনামা আছে মিনার্ভা। সৌভাগ্য বলুন চাই দুর্ভাগ্য বলুন সেই সময় হগসহেডের পাবে মজুদ ছিলেন। তার মুখে বেশি রকম ব্যান্ডেজ বাধা থাকলেও কিছু শোনার অসুবিধে ছিলো না। আমব্রিজ যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে বললেন, ও ওদের সব কথা শোনার পর সোজা সেখান থেকে আমার কাছে এসে রিপোর্ট করেছিলো।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন, সেইজন্য টয়লেট ঠিকমতো দেখাশুনো না করার অপরাধে শাস্তি পাননি, তাই না? বাঃ বাঃ খুব সুন্দর আমাদের ন্যায় বিচারের পদ্ধতি।

ডাম্বলডোরের পিছনে দেয়ালে টাঙ্গানো লাল নাক ওয়ালা এক জাদুকর বলে উঠলেন, বেশ উপভোগ করার মতো দুর্নীতি! আমার আমলে মন্ত্রিসভা এমন দুর্নীতি বরদাস্ত করতেন না।

ডাম্বলডোর খুব নরোমভাবে বললেন, ধন্যবাদ ফরটেসকু। এইটুকু যথেষ্ট।

–ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ছাত্রছাত্রীদের এমন একটা দলে গঠন করা, যে দল এমন সব নিয়ম বহির্ভূত কাজকর্ম করবে যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত, বে-আইনী স্পেল আর কার্স শেখা।

ডাম্বলডোর বললেন, ডলোরেস আপনি সম্ভবতঃ ভুল করছেন। বলার সময় তার অর্ধচন্দ্রাকৃতি চশমা নাকের কাছে নেমে এলো।

হ্যারি ডাম্বলডোরের দিকে তাকালো। বুঝতে পারলো না ডাম্বলডোর ওকে কেমন করে মুক্ত করবেন। উইসলি ওয়াইডারসাইনস যদি সত্যিই সব শুনে রিপোর্ট করে থাকে তাহলে তো পালাবার কোনো পথ নেই।

–ওহো তাই নাকি, ফাজ বললেন। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন। বল এখন তার কোর্টে, বেশ আপনারা তাহলে ডাম্বলডোরের মুখ থেকে পটারকে মুক্ত করে নেবার আজগুবি গল্প শুনুন।

–হ্যাঁ, বলে যান ডাম্বলডোর উইসলি ওয়াইডারলাইনস মিথ্যা কথা বলছে–তাই? তা না হলে সেদিন হগসহেডে পটারের মত তার এক যমজ ভাই ছিলো? আরও অনেক কিছু।

পার্সি উইসলি বেশ বড় দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

–মিনিস্টার! মিনিস্টার আপনি যথার্থ বলেছেন, হ্যারির ইচ্ছে হলো পার্সির পেছনে একটা লাথি মারে। তারপরই দেখলো ডাম্বলডোর মৃদ্যু মৃদু হাসছেন।

–কর্নেলিয়স ফাজ, আমি আপনার কথা যেমন অবিশ্বাস করছি না, তেমনি হ্যারি সেখানে ছিলো না তাও না। হ্যাঁ, সে ছিলো, কিন্তু সে ডার্ক আর্টের ডিফেন্সের জন্য সদস্য সংগ্রহ করেছিলো। আমি অতি প্রাঞ্জল ভাষায় ডলোরেসকে বলতে চাই যে একথা ভাবলে ভুল হবে ও কোনো বেআইনী কাজে লিপ্ত ছিলো। আপনি যদি ভুলে গেছেন তো বলি, মিনিস্ট্রির ডিক্রিতে ছাত্রছাত্রীদের কোনও সোসাইটিতে যোগদান নিষেধ করবার দুদিন আগে ওরা হগসহেডে মিলিত হয়েছিলো। তাহলে স্বীকার করতে বাধা নেই যে ডিক্রি চালু হওয়ার পর তারা কিছু করেনি।

পার্সির মুখ দেখে মনে হলো কেউ একটা ভারি জিনিস ওর মুখে আচমকা ছুঁড়ে মেরেছে। ফাজ মিড-বাউন্স বলে অনড় হয়ে গেলেন, মুখ হাঁ করে রইলেন।

আমব্রিজ সবার আগে বললেন। যা বলেছেন, সবই খুব ভালো হেডমাস্টার। আমব্রিজ বললেন না যে–প্রায় চারমাস হয়ে গেলো এডুকেশনল ডিক্রি নম্বর চব্বিশ জারি হয়েছে। তাহলে যদি তাদের প্রথম সমাবেশ বেআইনী না হয়, তাহলে তারপর যা ঘটেছে সেগুলো অবশ্যই বে-আইনী।

–ওয়েল, ভালোকথা, নিজের ইন্টারলকড আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই ডিক্রি চালু হবার পর যদি তারা কিছু করে থাকে। আপনি কী কোনও প্রমাণ দিতে পারেন সেই ডিক্রি চালু হবার পর তারা কিছু সমাবেশ চালিয়েছিলো?

ডাম্বলডোর যখন বলছিলেন হ্যারির কানে এলো পেছনে কিছু ঝটপট শব্দ। মনে হলো কিংগশ্নে কিছু বলছে। আরও মনে হলো ওর পাশে কিছু রয়েছে, সম্ভবত একটা পাখির ডানা। ও এধার ওধার তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না।

–প্রমাণ? তার ব্যাঙ্গের মত মুখে বিশ্রী হাসি টেনে এনে বললেন, আপনি কী কিছুই শুনতে পাননি ডাম্বলডোর? আপনি কেন জানেন না মিস এজকুম্বে কেন এখানে এসেছেন?

–ও, তাহলে তিনি আমাদের ছমাসের মিটিং সংক্রান্ত কিছু বলতে এসেছেন? ভুরু তুলে ডাম্বলডোর বললেন। আমি ভাবছিলাম তিনি হয়তো আমাদের আজ রাতের মিটিংয়ের কথাবার্তা লিপিবদ্ধ (রেকর্ড) করতে এসেছেন।

–আমব্রিজ বললেন, মিস এজকুম্বে তাহলে আমাদের ওদের মিটিংয়ের স্থায়িত্বকাল দয়া করে বলুন। আপনি শুধু মাথা নাড়তে বা মাথা ঝাঁকানি দিতে পারেন। আমি স্থির বিশ্বাস করি তাতে কিছু অশুদ্ধি হবে না। গত ছয় মাস ধরে কি ওরা ধারাবাহিকভাবে মিটিং করে চলেছে?

হ্যারি বুঝতে পারে অকাট্য প্রমাণ আছে, ওর পেটের ভেতরটা মোচড় দিলো। ডাম্বলডোর সেই প্রমাণ খারিজ করতে পারবে না।

আমব্রিজ মেরিয়েটাকে সেই একই কথা বললেন, তাড়াতাড়ি বলো এর মধ্যে তোমার ওপোর প্রদত্ত যাদুমন্ত্র আবার সজাগ হতে পারবে না।

সকলেই মেরিয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর মুখ ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। হ্যারি আশ্চর্য হয়ে দেখলো মেরিয়েটা মাথা নাড়লো।

আমব্রিজ প্রথমে ফাজ, তারপর মেরিয়েটার দিকে তাকালেন।

–আমার মনে হয় তুমি আমার প্রশ্ন সঠিক বুঝতে পেরেছে, পেরেছো কী? আমি জানতে চাই তুমি কী গত ছমাস ধরে ওই মিটিংয়ে যাচ্ছো? হ্যাঁ কিংবা না বলো।

আবার মেরিয়েটা মাথা নাড়লো। –তুমি মাথা নেড়ে কি জানাতে চাইছো? আমব্রিজ তিক্ত কণ্ঠে বললেন।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ঝটপট বললেন, আমার মনে হয় ও যা বলতে চাইছে তা ঠিক। গত ছমাসে ওরা কোনো গোপন মিটিং করেনি। কথাটা কি সত্য মিস একুম্বে?

মেরিয়েটা মাথা ঝাঁকানি দিলো।

আমব্রিজ রেগে তেলে বেগুনে আগুন হয়ে বললেন–কিন্তু আজ রাতে তো মিটিং হয়েছিলো? হ্যাঁ মিটিং হয়েছিলো মেরিয়েটা, তুমি আমাকে স্পষ্ট নালিশ করেছিলে। রুম অফ রিকোয়্যারমেন্টে মিটিং–এ পটার ছিলো তার লিডার তাই না?

পটার সেই মিটিং অর্গানাইজ করেছিলো। কিন্তু মিস মেরিয়েটা তবে কেন তুমি তোমার মাথা নাড়ছে?

ম্যাকগোনাগল বললেন–সাধারণত মানুষে যখন তাদের মাথা নাড়ে তো তারা বলতে চায় না। আমার মনে হয় মিস মেরিয়েটার ওই সাইন ল্যাংগোয়েজের জ্ঞান কম আছে।

 প্রফেসর আমব্রিজ মেরিয়েটাকে কাছে টেনে ওর মুখটা ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকানি দিতে লাগলেন। এক মুহূর্ত পর ডাম্বলডোর দাঁড়ালেন, হাতের জাদুদণ্ড তুললেন। কিংগল্পে এগিয়ে আসতে লাগলো আর আমব্রিজ মেরিয়েটার কাছ থেকে ছিটকে পড়লেন। হাত দুটো ওপোরে তুলে দোলাতে লাগলেন এমনভাবে যেনো হাতদুটো আগুনে পুড়ে গেছে, পুড়ে যাওয়ার জ্বালা মেটাচ্ছেন।

ডাম্বলডোর রেগে বললেন, ডলোরেস, তুমি আমার সামনে আমার ছাত্রীর উপর এইরকম রুঢ় ব্যবহার করতে পারবে না।

হ্যারি এই প্রথম ডাম্বলডোরকে অসম্ভবভাবে রাগতে দেখলো। কিংগল্পে তার ভাবগম্ভীর স্বরে বললেন, ম্যাডাম আপনি দয়া করে শান্ত হয়ে বসুন। এখন আর নিজেকে গোলমালে জড়াবেন না।

কিংগস্লের দূর্দমনীয় চেহারার দিকে তাকিয়ে আমব্রিজ বললেন, আমি বলছি; মানে আপনি ঠিক কথা বলেছেন। শ্যাকেলবোল্ট… আ… আ… বোধহয় ভুল করেছি।

আমব্রিজের সামনে মেরিয়েটা প্রায় স্থবিরের মতো দাঁড়িয়েছিলো। ওর ভাবভঙ্গি বা মুখ দেখে বোঝা শক্ত ও আমব্রিজের রুঢ় আচরণে বা ওকে মুক্ত করাতে খুশি হয়েছে। তখনও ও ওর আলখেল্লায় মুখ পর্যন্ত ঢেকে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

হঠাৎ হ্যারির মনে সন্দেহ হলো। জড়িত রয়েছে কিংগশ্লের ফিস ফিস কথা, আরও অনেক কিছু রয়েছে জড়িয়ে।

–ফাজ বললেন, খোলারেস একটা কিছু মীমাংসা করার চেষ্টায় আজকের ওই মিটিং। আমরা জানি অবশ্যই কিছু ঘটেছিলো।

আমব্রিজ বললেন, হ্যাঁ। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে আবার বলছি, মিস এজকুম্বে আমাকে খবর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আটতলায় উঠি, আমার সঙ্গে আরও কয়েকটি সৎ বিশ্বাসভাজন ছাত্রছাত্রী ছিলো, আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওইসব বেআইনী কাজে লিপ্ত থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের হাতেনাতে ধরা। মনে হয়, আমার আসার খবর ওদের কেউ আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছিলো, তাই আমার আসার খবর পেয়ে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যত্রতত্র ছুটে পালাতে থাকে। তাতে কিছু আসে যায় না, ওদের নাম আমার ফাইলে লেখা আছে। মিস পারকিনসন আমার হয়ে রিকোয়ারমেন্ট ঘরে ঢুকে খোঁজ করে, যদি কিছু তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়। যাকগে, এখন জানা দরকার কে ওদের ঘরটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলো।

হ্যারি আরও ঘাবড়ে গেলো আমব্রিজকে তার রোবের পকেট থেকে সদস্যদের নামের তালিকা বার করছেন দেখে। নামগুলো রিকোয়ারমেন্ট ঘরে পিন দিয়ে সাঁটা ছিলো। আমব্রিজ তালিকাটা ফাজের হাতে দিলেন। বললেন, পটারের নাম ওই তালিকায় দেখেই ধরতে পেরেছি। এখন বুঝতে পারা যাবে কেন আমরা এখানে এসছি।

–বাঃ বাঃ চমৎকার, একগাল হেসে ফাজ তালিকাটা হাতে নিয়ে বললেন। অতি চমৎকার জবাব নেই ডলোরেস, বজ্রপাত ঘটিয়েছেন দেখছি।

ফাজ, ডাম্বলডোরের দিকে তাকালেন। ডাম্বলডোর তখনও মেরিয়েটার পাশে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়িয়ে, জাদুদণ্ডটা শিথিলভাবে ধরে রেখেছেন।

–দেখা যাক ওরা তাদের দলের কি নাম রেখেছে–ডাম্বলডোরের সৈনিক।

ডাম্বলডোর এগিয়ে গিয়ে ফাজের হাত থেকে পার্চমেন্টটা নিলেন। হারমিওনের হাতে লেখা প্রায় একমাসের আগে সদস্যদের নাম আর দলের নাম! ডাম্বলডোর কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যেনো তার। তারপরই জড়তা কাটিয়ে মুখ তুলে হাসলেন।

খুব সাধারণভাবে ডাম্বলডোর বললেন, খেলা এখন সাঙ্গ হয়েছে। আপনি কী আমার কাছ থেকে লিখিত স্বীকৃতি চান কর্নেলিয়স অথবা এই সব সাক্ষীদের সামনে মৌখিক বিবৃতি যথেষ্ট হবে।

হ্যারি দেখলো, ম্যাকগোনাগল আর কিংগশ্নে পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছেন। কি হবে বা হচ্ছে ও যেনো ঠিক বুঝতে পারছে না, বিশেষ করে ফাজের মতলব।

–বিবৃতি? ফাজ খুব আস্তে বললেন–কিসের? আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না!

হাসতে হাসতে ফাজের মুখের সামনে নামের তালিকাকাটা দোলাতে দোলাতে বললেন, ডাম্বলডোরের সৈন্যদল, কর্নেলিয়স। পটারের নয় ডাম্বলডোরের আর্মি।

–কিন্তু… তবে… তবে…।

সমস্ত ব্যাপারটা হঠাৎ যেনো বুঝতে পেরেছেন ফাজ, সেই বোঝার ভাব তার চোখে মুখে প্রজ্জ্বলিত হলো। ভয় পেয়ে দুএকপা পিছু হটলেন, তীক্ষ্ম কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠে আগুনের কাছ থেকে লাফিয়ে সরে গেলেন।

–আপনি? বিড়বিড় করে বললেন, জ্বলে যাওয়া আলখেল্লাতে পদাঘাত করলেন।

ডাম্বলডোর স্নিগ্ধভাবে বললেন, কোনও সন্দেহ নেই। ঠিকই ধরেছেন।

–আপনি, আপনি ওই সৈন্যদল গড়ছেন?

–যথার্থ আমিই করেছি, ডাম্বলডোর বললেন।

–আপনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে সৈন্যদল গঠন করছেন?

–হা করেছি। আজ রাতে সেই সৈন্যদলের প্রথম সমাবেশ হয়েছিলো, ডাম্বলডোর সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। দেখছিলাম ওদের উৎসাহ আর আগ্রহ। এখন দেখছি মিস এজকুম্বেকে ডাকা অতি অবশ্যই ভুল হয়েছিলো।

মেরিয়েটা মাথা ঝকানি দিলো। ফাজ ওর দিকে ক্ষণিক তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরালেন মেরিয়েটার মুখের দিকে। উত্তেজনায় তার বুকটা হাপরের মতো ফুলছিলো।

চিৎকার করে বললেন, তাহলে আপনি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন?

ডাম্বলডোর প্রাণখুলে হেসে বললেন, ঠিকই ধরেছেন।

 –না! হ্যারি সরবে বলে উঠলো।

কিংগস্লে সতর্ক হবার দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। ম্যাকগোনাগল তিরস্কারের ভঙ্গিতে, কিন্তু সহসা হ্যারির মনে উদয় হলো ডাম্বলডোর যা করতে চাইছেন, তা না করাই যেনো ভালো।

–না না প্রফেসর ডাম্বলডোর…!

ডাম্বলডোর হ্যারির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, হ্যারি, সংযত হও, আমার মনে হয় তোমার আমার দপ্তর থেকে বিদায় নেওয়া ভালো হবে।

ফাজ ভীষণ জোরে বললেন, চুপ করো পটার, তখনও তিনি ডাম্বলডোরের দিকে ভয়মিশ্রিত আনন্দে তাকিয়েছিলেন। বেশ, বেশ বেশ, আজ আমি এখানে এসেছিলাম পটারকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার বদলে।

–তার বদলে আমাকে গ্রেফতার করতে হবে, ডাম্বলডোর হাসতে হাসতে বললেন। অনেকটা অচল মুদ্রা হারিয়ে খুঁজতে গিয়ে স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার তাই না?

–উইসলি! ফাজ বাজখাই গলায় বললেন। আনন্দে অধীর হয়ে কাঁপছেন ফাজ, উইসলি আশা করি তুমি সব নোট করেছে, যা যা ডাম্বলডোর বলেছেন। স্বীকারোক্তি… হ্যাঁ সবই…?

পার্সি মাথানত করে বললো, অবশ্যই স্যর! ওর নাকের ডগাটায় কালি লেগে গেছে তাড়াহুড়ো করে লেখার জন্য!

–লিখবে, তলে তলে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে সৈন্য সংগ্রহ করে চলেছেন, ডাম্বলডোর আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত করছেন। ঠিক ঠিক লিখেছো তো?

পার্সি ওর লেখা নোর্ট পড়তে পড়তে বললো, হ্যাঁ স্যার সবই।

–চমৎকার এখন তুমি ওই নোটটার দুকপি করে একটুও দেরি না করে ডেইলি প্রফেটে এক কপি পাঠিয়ে দাও। ফাজ যেনো আনন্দে ফেটে পড়েছেন। তুমি যদি দ্রুত পৌঁছে দেবার জন্য একটা প্যাচা জোগাড় করতে পারতে তাহলে আরও ভাল হতো। তাহলে কাল সকালেই শেষ শহর সংস্করণে খবরটা ছেপে বেরোতে পারে।

কথাটা শুনে পার্সি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিলো। ফাজ আবার ডাম্বলডোরের দিকে তাকালেন, এখন আপনাকে মিনিস্ট্রিতে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে প্রথাগতভাবে আপনাকে চার্জশিট দেয়া হবে, তারপর বিচার শুরু হবার আগে আপনাকে আজকাবান কারাগারে পাঠানো হবে।

–আহ, ডাম্বলডোর অতি দ্রভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ এখন ভাবছি বাধা সৃষ্টি করবার প্রয়োজন আছে, ছোট বাধা।

–বাধা? ফাজ থতোমতো খেয়ে বললেন। তাহলেও তখনও তিনি অতি উফুল্ল, আনন্দে গলার স্বর কাঁপছে। আমি তো সামনে কোনো বাধা দেখছিনে ডাম্বলডোর!

–দেখছেন না, কিন্তু দুঃখিত, আমাকে করতেই হবে, ডাম্বলডোর তার সঙ্গে বললেন।

–ওহ, তাই নাকি?

–ওয়েল, আপনি এখনও দেখছি ভাবজগতে বিচরণ করছেন মি. ফাজ। কথাটা কি যেন? শান্তভাবে আপনাকে অনুসরণ করবো। দুঃখিত আমি মোটেই শান্ত ভাবে চলবো না কর্নেলিয়স। আমার কিন্তু মোটেই আজকাবানে যেতে মন চাইছে না। গেলে অবশ্য ভেঙে বেরিয়ে আসবো, অবশ্যই নিশ্চিন্ত থাকুন; কিন্তু আশ্চর্য লাগছে আপনাদের সময়ের অপব্যবহার দেখে। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো কিছু করবার আগেই কি করতে হবে তার ব্যবস্থা আগেই করে রাখি।

আমব্রিজের মুখ একটু একটু করে লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ওকে এক ট্রাঙ্ক গরম জলে চুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফাজ ডাম্বলডোরের দিকে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে রইলেন মনে হয় হঠাৎ কেউ তার মুখে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরেছে অতর্কিতে।

ফাঁজ গলা দিয়ে ঘড় ঘড় আওয়াজ করে কিংগশ্নে আর কদমছাট ওয়ালা পাকাচুলের একজনের দিকে তাকালেন। ঘরের সকলেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কদমছাট দেওয়া লোকটা দেওয়ালের কাছ থেকে সামান্য এগিয়ে এলো, ফাজকে যেনো সাহস জোগালো। হ্যারি দেখলো লোকটা ওর পকেটে হাত পুরলো। ডাম্বলডোর ওর দিকে তাকিয়ে দয়া পরবাস কণ্ঠে বললেন, মূখের মতো কাজ করো ডলিশ। আমি জানি তুমি অতি চতুর কর্তব্য পরায়ণ অউর। আমি যেন শুনছি তুমি সব নিউটতে আউটস্ট্যান্ডিং পেয়েছে। কিন্তু তুমি যদি আমার ওপোর তোমার শক্তি দেখাতে চাও তাহলে আমি তোমাকে বাধা দিতে বাধ্য হবো।

ডলিশ নামের অউরর বোকার মতো চোখ পিটপিট করতে লাগলো। খুব সম্ভব আদেশের অপেক্ষায় ফাজের দিকে তাকালো, ফাজ ভাবছেন তারপর কি করা যায় ফন্দি আঁটার।

–ফাজ সন্ত্রস্ত হলেন–তো আপনি একা একা আমাদের, আমি, ডলিশ, শ্যাকেল বোল্ট, ডলোরেসের সঙ্গে লড়াই করতে মনস্থির করেছেন ডাম্বলডোর?

ডাম্বলডোর হাসতে হাসতে বললেন, বাজপাখির দাড়ি অবশ্যই, তবে আপনারা মূখের মতো আমার ওপোর শক্তি প্রয়োগের বোকামি করবেন না।

ম্যাকগোনাগল তার আলখেল্লার পকেটে হাত পুরে বেশ জোরে বললেন, কে বলেছে ডাম্বলডোর একা! ডাম্বলডোর চকিতে বললেন, হ্যাঁ তা পারে, মিনার্ভা। হোগওয়ার্টসে আপনার প্রয়োজন আছে।

–অনেক কচকচানি হয়েছে! ফাজ নিজের জাদুদণ্ডটা টেনে নিয়ে বললেন, ডলিশ, শ্যাকেল বোল্ট! ওকে নিয়ে যাও।

সহসা রূপালী এক আলোক রশ্মি ঘরটাকে জ্বল জ্বল করে দিলো। দারুণ মেঘের গর্জনের মতো শব্দ হতেই সমস্ত ঘরটা থর থর করে কেঁপে উঠলো। একটা হাত হ্যারির গলার স্কার্ফ ধরে টান মেরে ওকে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপরই সেই রূপালী আলো অন্তর্হিত হলো। ঘরের পোর্ট্রেটগুলো চিষ্কার করে উঠলো একসঙ্গে। ফকেশ তার স্বরে ডেকে উঠলো। একগাদা মেঘের মতো ধূলো ঘরটা ভরিয়ে দিলো। হ্যারি কাশতে কাশতে দেখলো একটা কালোমূর্তি ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপরই শুনলো আর্তনাদ, ধপধপ শব্দ আর একজন চিৎকার করে উঠলো না। তারপরই কাঁচ ভাঙার শব্দ, দ্রুত চলে যাওয়ার পদশব্দ, গোঙানি, তারপরই সব নীরব।

হ্যারি দেখতে চেষ্টা করলো কে তাকে স্কার্ফ জজিয়ে গলাটিপতে চেষ্টা করেছিলো; পাশ ফিরে দেখলো প্রফেসর ম্যাকগনোগল ওর পাশে হাঁটুগেড়ে বসে রয়েছেন। খুব সম্ভব বিপদ থেকে ওকে আর মেরিয়েটাকে রক্ষা করতে। এখনও বাতাসে ধূলো কমেনি। হাঁফাতে হাঁফাতে হ্যারি দেখলে খুব লম্বামতো একজন ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

–তুমি ঠিক আছে তো? ডাম্বলডোর জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যারি আর মেরিয়েটাকে মাটি থেকে তুলতে তুলতে ম্যাকগোনাগল বললেন, ভালো আছে ওরা।

ধূলো একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। অফিসের ঘর লণ্ডভণ্ড। ডাম্বলডোরের টেবিল উল্টে রয়েছে, অন্যান্য টেবিলগুলো ঘরের মেঝেতে এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে। রূপোর ইস্ট্রমেন্টটাও টুকরো টুকরো। ফাজ, আমব্রিজ, কিংগসলে আর ডনিস মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন। ফকেস ফেনিক্স গোল হয়ে ঘরের মধ্যে উড়ছে, মিষ্টি সুরে গান গেয়ে চলেছে।

ডাম্বলডোর খুব নরম সুরে বললেন, দুর্ভাগ্যবশত আমায় কিংগসলেকেও সম্মোহিত করতে হয়েছে। না করলে সন্দেহজনক দেখাতো। সম্মোহন তুলে নেয়ার ব্যাপারে ও খুবই তৎপর ছিলো সকলে যখন এধার ওধার তাকাচ্ছে তারই ফাঁকে ও মিস এজকম্বের স্মৃতি উদ্ধার করেছে, পরে আমার হয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলবে না মিনার্ডা।

ডাম্বলডোর আরও বললেন, মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা জেগে উঠবে। জেগে উঠে ভাববে কেউ ওদের ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো। অনেকটা সময় কেটে গেছে, তোমার আমার মধ্যে কথা হয়েছে বুঝতে পারবে না।

–আপনি এখন কোথায় যাবেন ডাম্বলডোর? গ্রিমন্ড প্লেসে?

ম্যাকগোনাগল জিজ্ঞেস করলেন।

–আরে না না, ডাম্বলডোর বললেন। মুখে ম্লান হাসি, আমি অবশ্যই লুকিয়ে থাকবো না। কাজ মনে হয় আমাকে আর হোগওয়ার্টস থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে না, এইটুকু তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি।

–প্রফেসর ডাম্বলডোর! হ্যারি বলতে শুরু করলো।

ও কিন্তু জানে কি বলবে কেমন করে বলবে ডিএর দল কবে কতোটা গোলমাল সৃষ্টি করেছে, অথবা ডাম্বলডোর ওকে স্কুল থেকে বহিষ্কার থেকে বাঁচিয়েছেন? কিন্তু ডাম্বলডোর বাধা দিলেন ওর সবকিছু ভাবনা-চিন্তাকে।

–শোনো হ্যারি, এখন থেকে প্রাণপনে অকামেন্সি শিখবে, বুঝতে পেরেছো? প্রফেসর স্নেইপ যা বলবেন তা কোনো রকম প্রশ্ন না করে করবে। রোজ রাতে শুতে যাবার আগে যা যা শিখিয়েছেন সেটা প্র্যাকটিস করবে, তোমার মন ফাঁকা রাখবে। আশাকরি তুমি পরে সব বুঝতে পারবে। আমি যা যা বললাম, প্রতিজ্ঞা করো তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।

ডলিশ নামের লোকটা নড়াচড়া করছিলো। ডাম্বলডোর হ্যারির হাতের কব্জিটা ধরলেন।

–মনে আছে। মন বন্ধ করো।

ডাম্বলডোরের আঙ্গুল তারির চামড়ায় স্পর্শ করতেই আবার ওর সেই কাটাদাগে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো। আবার অতীতের মতো সাপ হয়ে ডাম্বলডোরকে দংশাতে মন চাইলো আক্রমণ করতে আঘাত করতে।

ডাম্বলডোর ওর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, তুমি বুঝতে পারবে।

ডাম্বলডোরের সোনার পাখি সমস্ত অফিস ঘরটায় চক্রাকারে উড়তে উড়তে হ্যারির মাথার কাছে মাঝে মাঝে আসতে লাগলো। ডাম্বলডোর হ্যারিকে ছেড়ে দিয়ে খপ করে ফিনেক্সের সোনার লম্বা পুচ্ছটা ধরে ফেললেন। ধরতেই আগুন জ্বলে উঠলো। তারপরই দুটোই উড়ে চলে গেলো।

ফাজ মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বললেন, সে এখন কোথায় সে কোথায়?

 কিংগশ্লে ওর পায়ের কাছে পড়েছিল বললো, আমি জানি না।

–ও কখনোই ডিসঅ্যাপরেটেড করতে পারে না! আমব্রিজ বললেন, আপনি কিছুতেই স্কুলে বসে বসে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন না।

–সিঁড়ি! ডলিশ চিৎকার করে উঠলো। তারপর দরজার কাছে গিয়ে দরজার নবটা ঘুরিয়ে খুলে পালিয়ে গেলো। ওর পেছনে পেছনে গেলেন আমব্রিজ আর কিংগশ্লে। ফাজ এধার ওধার তাকিয়ে যাবেন কি যাবেন না, ইতস্তত করতে লাগলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গা থেকে ধূলো ঝেড়ে ফেলতে লাগলেন। ঘরের নিস্তব্ধতা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক লাগছিলো।

–মিনার্ভা, জামার ভেঁড়া হাতা ঠিক করতে করতে ফার্জ বিশ্রীভাবে বললেন, আমার মনে হয় আপনার বন্ধু ডাম্বলডোরের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

ম্যাকগোনাগল বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললো, তাই কি আপনি মনে করেন।

ফাজ মুখের এমন ভাব করলেন যেনো ম্যাকগোনাগলের কথা শুনতে পাননি। ভাঙ্গাচোরা অফিস ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। কিছু কিছু পোর্ট্রেট হিস্ হিস্ শব্দ করে ওর দিকে তাকালো, দুএকজন ফাজের দিকে হাত বাড়িয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো।

ফাজ, ম্যাকগোনাগলকে বললেন, এই ছেলে-মেয়ে দুটিকে আপনি শুয়ে পড়তে বলুন।

ফাজ, হ্যারি আর মেরিয়েটার দিকে ঘৃণাভরে তাকালেন।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল কোনো কথা না বলে হ্যারি আর মেরিয়েটাকে নিয়ে দরজার গোড়ায় চলে এলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে হ্যারি ফিনিয়েস নিগেলাসের গলা শুনতে পেলো।

–আপনি জানেন, মন্ত্রী মহাশয়, আমার অনেক ব্যাপারে ডাম্বলডোরের সঙ্গে মতের মিল হয় না কিন্তু তা হলেও আপনি কোনোমতেই তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। জেনে রাখবেন তার একটা নিজস্ব রীতি আছে, সেটা তিনি মেনে চলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *