২০. হ্যাগ্রিডস টেল

২০. হ্যাগ্রিডস টেল

হারমিওনের মুখে খবরটা শুনে হ্যারি লাফিয়ে উঠে এক মিনিটও দেরি না করে রনের সঙ্গে ডরমেটরিতে গিয়ে অদৃশ্য হবার ক্লোক আর ট্রাঙ্ক থেকে মরউডারস মানচিত্র নিয়ে হ্যাগ্রিডের কটেজে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। হারমিওন তখনও মেয়েদের ডবমেটরি থেকে আসেনি। এলো পাঁচ মিনিট পরে। হারমিওন গলায় পরেছে স্কার্ফ, হাতে মোটা দস্তানা, মাথায় নিজের হাতে বোনা মোটা পশমের এলফদের হ্যাট!

রন ওর বেশভূষা দেখে জিবে শব্দ করলে হারমিওন বললো, বুঝলে বাইরে খুব ঠাণ্ডা, হালকা পোশাকে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।

ওরা পোর্ট্রেট হোল দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে অদৃশ্য হবার ক্লোক তাড়াতাড়ি গায়ে জড়িয়ে হ্যাগ্রিডের সঙ্গে দেখা করতে চললো। রন হঠাৎ খুব লম্বা হয়ে গেছে, ক্লোকটা পরেও পা ঢাকে না, তাই সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটতে লাগল। বাইরে বেরুতে গেলে অনেক সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়, তাছাড়া ফিল অথবা মিসেস নরিসের চোখ তো এড়াতে হবেই। হ্যারি তাই মানচিত্রটা নিয়ে দেখতে লাগল ফিলচ এবং নরিস কোথায় আছে। ভাগ্য ভালো ওরা নেই; কিন্তু হেডলেস নিক? ওরা দেখলো নিক আপন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে আর উইসলি আমাদের রাজা গানটা গুনগুন করে গাইছে। ওরা খুব সাবধানে এনট্রেনস হল দিয়ে বাইরের মাঠে এসে দাঁড়ালো। চতুর্দিক নিস্তব্ধ শুধু নয়, সমস্ত মাঠ বরফে ঢেকে গেছে। হ্যারি দূর থেকে দেখতে পেলো হ্যাগ্রিডের কটেজের জানালা দিয়ে বাতি দেখা যাচ্ছে, চিমনি দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। হ্যারি বলতে গেলে দৌড়াতে লাগলো, পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে ওকে ফলো করতে লাগলো হারমিওন আর রন! ঘন তুষারের মধ্যে দিয়ে হট ও টিতে ওবা হ্যাগ্রিডের কটেজের কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল। হ্যারি নিয়মমাফিক দরজায় তিনবার নক করতেই অন্দর থেকে একটা কুকুর ভীষণ শব্দ করে ডাকতে লাগল।

হ্যারি দরজার চাবির ছিদ্রতে মুখ লাগিয়ে বললো, হ্যাগ্রিড আমরা এসেছি।

হ্যাগ্রিডের বিরক্তিসূচক গলা শুনতে পেলো, কে আবার এলো। ওরা হ্যাগ্রিডের রাগ রাগ গলা শুনে থতমত খেয়ে গেলো। বুঝতে পারলো না হ্যাগ্রিডের রাগের কারণ। মাত্র তিন সেকেন্ড হয়নি এসেছি। ফ্যাংগ.. ভাগো বলছি… কুকুরটি বলতে লাগলো।

হ্যাগ্রিডের কর্কশ কণ্ঠস্বরে ওরা একটু আশ্চর্য হলো, দরজার বোল্ট সরানোর শব্দের পরই দরজা ঈষৎ ফাঁক হতে হ্যাগ্রিডের মুখ দেখতে পেল।

–আরে তোমরা? ক্লোক পরে এসেছো? এসো এসো ভেতরে এসো। হারমিওন ক্লোক খুলতে খুলতে বললো–আমরা দুঃখিত হ্যাগ্রিড। এমনিভাবে আসতেই হলো।

হ্যাগ্রিড বললেন, আরে কিছু না, কিছু না। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

হ্যাগ্রিডের চেহারা দেখে ওরা ভয় পেয়ে গেল। মাথার চুলে জমাট রক্ত। বাঁচোখে আঘাত লেগে এতো ফুলে উঠেছে যে, চোখে দেখা যাচ্ছে না। হাতে, মুখে অনেক কাটা দাগ। কোনও কোনও কাটা থেকে রক্ত পড়তে দেখে বুঝতে পারলো ওরা আসবার সামান্য আগে হ্যাগ্রিড বাড়ি ফিরেছেন। চেয়ারের ওপোর রয়েছে ট্রাভেলিং ক্লোক, তার পাশেই একটা হ্যাভার্যাক, যার মধ্যে দুএকটা ছোট ছোট বাচ্চাদের বহন করা যায়। হ্যাগ্রিড খুবই লম্বা চওড়া, সাধারণ মানুষদের চাইতে দুগুণ বেশি।

হ্যাগ্রিড খোড়াতে খোঁড়াতে বড় দেখে একটা তামার কেটলি উনুনে রাখলেন।

–কী হয়েছে, আপনার এমন অবস্থা কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাগ্রিড বললেন, বলছি, এমন কিছু না, চা চলবে?

 –থাক। আপনি একটু সুস্থ হোন, রন বললো।

–কিছু না, কিছু না, হ্যাগ্রিড সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন।

–আপনার মুখের বদলে যদি একপাউন্ড কিমা থাকতো, তাহলেও বলতেন কিছু হয়নি, রন বললো।

–যেতে দাও। তোমাদের দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে।

হারমিওন বললো–আপনার এখন ম্যাডাম পমফ্রের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে হ্যাথিড। দুএকটা জায়গায় বড় বেশি কেটে গেছে।

–আমি দেখছি কি করতে পারি, ঠিক আছে? হ্যাগ্রিড একগুঁয়ের মতো বললেন।

হ্যাগ্রিড ঘরের মধ্যখানে রাখা প্রকাণ্ড টেবিলের ওপোর থেকে একটা চায়ের তোয়ালে নিলেন। তার গলায় ছিল একটা লাল–সবুজ আভাযুক্ত মাংসের টুকরো যা একটা গাড়ির টায়ারের চেয়ে সামান্য বড়।

রন মাংসের টুকরাটা দেখে বললো, আশাকরি ওটা খাবেন না, হ্যাগ্রিড? দেখে মনে হয় বিষাক্ত!

–দেখে তোমাদের তাই মনে হচ্ছে। আসলে এটা ড্রাগনের মাংস, ত্যাগ্রিড বললেন, ভয় নেই এটা আমি খাবো না। কথাটা বলে হ্যাগ্রিড ড্রাগনের মাংসের টুকরোটা বা গালের ক্ষতের ওপর চেপে রাখলেন। হ্যাগ্রিডের আরাম লাগছে তেমন একটা মুখে শব্দ করলেন, এটাতে সেরে যাবে। ম্যাডাম পমফ্রের কাছে যাবার দরকার হবে না। ড্রাগনের মাংস শ্রেষ্ঠ ওষুধ।

–তো আপনি এতোদিন কোথায় ছিলেন, আপনার কি হয়েছিলো বলুন, হ্যারি বললো।

–বলা যাবে না হ্যারি, অতি গোপনীয়, বললে আমার চাকরি যাবে।

–তোমাকে কী দানবরা মারধোর করেছে হ্যাগ্রিড? হারমিন সুমধুর কণ্ঠে জানতে চাইলো।

হ্যাগ্রিড যে হাত দিয়ে ড্রাগনের মাংসটা মুখে চেপে রেখেছিলেন সেটা সামান্য কেঁপে উঠতেই মাংস খণ্ডটা বুকের ওপর পড়ে গেল।

–দানব? মাংস খণ্ডটা ওর প্যান্টের বেল্টের কাছে পড়বার আগেই হ্যাগ্রিড ওটা ধরে ফেলে গালের ক্ষততে চেপে ধরলেন। তোমাকে দানবের কথা কে বলেছে? কারা এসব কথা বলছে?

–আমরা অনুমান করেছি, হারমিওন লজ্জিত হয়ে বললো।

চোখের যে অংশটা ড্রাগনের মাংস দিয়ে ঢাকা নেই, সেই চোখে তীব্রভাবে হারমিওনকে দেখতে দেখতে বললেন, ওহ তোমার ধারণা? অনুমান?

–আমাদের মনে হয়েছিলো, ভুল তো হতে পারে কথাটা হ্যারি বলতে রনও সেই কাথায় সায় দিলো।

 হ্যাগ্রিড ওদের দিকে তাকালেন, তারপর নাকে শব্দ করে মাংস খণ্ডটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উনুনের কাছে গেলেন। উনুনে জল চাপানো কেটলিতে সে সে শব্দ হচ্ছিল ফুটন্ত জলের।

হ্যাগ্রিড ওর বালতির মতো তিনটে মগে গরম জল ঢালতে ঢালতে বললেন, তোমরা ছেলে মানুষ, সব কথা জানার দরকার নেই। একে বলে অনধিকার চর্চা।

কথা বলার সময় হ্যাগ্রিডের দাড়ি কুঁকড়ে গেল।

–আপনি দানবের খোজে গিয়েছিলেন? হ্যারি বললো।

হ্যাগ্রিড বড় বড় মগে তিনটে চা বানিয়ে ওদের দিয়ে আবার মাংস খণ্ডটা গালে চেপে ধরলেন।

–হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। হা যেতে হয়েছিলো।

–ওদের ধরতে পেরেছেন? হারমিওন চাপা গলায় বললো।

–হ্যাঁ, সত্যি কথা বলতে কি ওদের খুঁজে বার করা খুব শক্ত ব্যাপার নয়, হ্যাগ্রিড বললেন, ওরা বেশ লম্বা।

–ওরা কোথায় থাকে, রন বললো।

–পাহাড়ে-পর্বতে, হ্যাগ্রিড সংক্ষেপে বললেন।

 –তো মাগলরা নয় কেন?

–ওরাও থাকে, হ্যাগ্রিড বললেন। মরে গেলে ওদের পাহাড়ে কবর দেয়।

হ্যাগ্রিড ড্রাগনের মাংসের একটা টুকরো এবং ডাব হাতে নিলো যাতে সবচাইতে বড় কাটা জায়গাটা ভালভাবে চাপা পড়ে।

–হ্যাগ্রিড, বলুন পাহাড়ে কেন গিয়েছিলেন? রন বললো, দানবরা আপনাকে কেমন করে আক্রমণ করল। হ্যারি ডিমেনটরদের আক্রমণের কথা আপনাকে বলতে পারে।

হ্যাগ্রিড বললো–তুমি কি বলতে চাইছো ডিমেনটররা তোমাকে আক্রমণ করেছিল?

হারমিওন অবনত চোখে বললো, আপনি জানতেন না?

–আমি এখান থেকে চলে যাবার পর কি ঘটেছিলো তা তো জানি না। আমি অতি গোপনীয় একটা কাজে গিয়েছিলাম। আমি যেখানে গেছি পিছু পিছু তোমাদের প্যাচা, সেখানে গেছে, কিন্তু আমি চাইনি। আমার মনে হয় আপনি একটুও সিরিয়াস নন।

–হ্যাঁ খুবই সিরিয়াস। ওরা লিটল হুইংগিং দিয়ে আমাকে আর আমার কাজিনকে আক্রমণ করেছিলো, তারপর মিনিস্ট্রি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

–কী বললেন?

–আমাকে মিনিস্ট্রির আদালতে যেতে হয়েছিল, সেসব কথা থাক।

–আপনাকে ছাঁটাই করা হয়েছে?

–গরমের ছুটি কেমনভাবে কাটালে বল তোমরা। শোনার পর আমার কথা তোমাদের বলব। হ্যাগ্রিড ওদের দিকে তাকালেন মেঝেতে মাংসের টুকরো পড়ে গিয়েছিলো–ফ্যাংগ ওটা মুখে দিয়েছিল। হ্যাগ্রিড মাংসের টুকরোটা ওর মুখ থেকে টেনে নিলেন।

–হ্যাগ্রিড ওই মাংসটা আর গালে লাগাবেন না, ওটা নোংরা হয়ে গেছে।

হ্যাগ্রিড আরও এক কাপ চা খেতে খেতে বললেন, আমরা অনেক ঘুরে বেড়ালাম। গরমের ছুটি শেষ হতে ফিরে এলাম।

–ম্যাডাম ম্যাক্সিম আপনার সঙ্গে গিয়েছিলেন? হারমিওন বললো।

–ম্যাডাম ম্যাক্সিম সৎ ও সাহসী মহিলা। আমার সঙ্গে ডাম্বলডোরের আদেশে পাহাড়ে–জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তোমরা হয়তো জানো না অলিম্পিয়া অতি দ্র ও সাহসী মহিলা।

–আপনি জানতেন কোথায় দানবেরা থাকে, হ্যারি বললো?

–আমি ঠিক জানতাম না, ডাম্বলডোর সব বলে দিয়েছিলেন।

ওরা সব গোপন ডেরায় লুকিয়ে থাকে? রন বললো।

হ্যাগ্রিড গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমরা হয়ত জানো না, ম্যাজিক মিনিস্ট্রি ডাম্বলডোর আর আমার ওপর নজর রেখে চলেছে।

–কী বলছেন হ্যাগ্রিড?

হ্যারি অনেক গোপন কথা জানে যা রন জানে না। ও হ্যাগ্রিডের এক মাসের ঘটনা শুনতে দারুণ উৎসুক। রনের কৌতুহল হ্যাগ্রিডকে বাধা দিচ্ছে হ্যারির মনে হল।

–তো আপনি ম্যাজিক ব্যহার করলেন না কেন দানবদের আড্ডায় যাবার জন্য? সব সময় মাগলদের মত চলতে হয়েছে? রন বললো।

–না ঠিক তা নয়। আমাদের অনেক সাবধানে চলতে হয়েছে, অনেক ভান করতে হয়েছে। অলিম্পিয়াকে নিয়ে আমি যেন ওর দেশে যাচ্ছি। ফ্রান্সে ভী-জোনে গিয়েছিলাম জাহাজে করে।

হারমিওন কথা শুনে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো, ভী-জোনে আমিও একবার ছুটি কাটাতে বেড়াতে গেছি। রনের মুখ দেখে ও চুপ করে গেল।

তারপর পোলিশ বর্ডার পেরিয়ে দুর্গম পথে যাত্রা। মিনিস্কে একটা পাবে এক ভ্যামপায়ারের (ওরা নিদ্রিত ব্যক্তিদের রক্ত চোষণ করে–রূপকথার গল্প) সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো। মোসাহেবি আর ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে লোকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে।

শেষ পর্যন্ত অভিষ্ট স্থানে গেলাম। আমাদের সব সময় আতঙ্ক পাছে ডেথ ইটারদের পাল্লায় পড়ি। ওদিকে ম্যাজিক ব্যবহারও করতে পারছি না।

কথাটা শেষ করে হ্যাগ্রিড চা খেতে লাগলেন।

হ্যারি বললো, তারপর?

পেয়ে গেলাম ওদের। একদিন রাতে একটা উঁচু জায়গা থেকে দেখলাম অনেক নিচে একটা গাছের তলায় আগুন জ্বেলে ওরা জটলা করছে।

রন থেমে থেমে বললো–ওরা দেখতে কেমন, খুব লম্বা চওড়া?

হ্যাগ্রিড বললেন, তা কুড়ি ফিট হবে। আবার কেউ কেউ পঁচিশ ফিটও হতে পারে।

–কতজন জটলা করছিলো? হ্যারি বললো।

–তা প্রায় আশিজন হবে। তোমরা তো জানো ওরা আমাদের আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আফ্রিকাতে আশ্রয় নিয়েছে। ওরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।

–তাই হবে?

হ্যাগ্রিড দুঃখ দুঃখ কণ্ঠে বললো–হ্যাঁ। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ট্রাইবসেও থাকে। একটু একটু করে ওরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। জাদুকররাও ওদের কিছু মেরে। ফেলেছে, তবে বেশি মরেছে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। ওরা নানা কারণে একসঙ্গে থাকতে পারে না। ডাম্বলডোর বলেন, তারজন্য দায়ী আমরা। জাদুকররা ওদের দেশ থেকে ভাগিয়েছে।

হ্যারি বললো, আপনি তো ওদের দেখতে পেলেন তারপর?

–সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। অন্ধকার রাতে যাওয়া ঠিক হবে না ভাব লাম। প্রায় তিনটের সময় ওরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আমরা শুধু জেগে রইলাম। ভাবলাম, ওদের মধ্যে কেউ যদি এধার ওধার ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দেখে ফেলে! ডাম্বলডোর আমাদের ওদের হাতের মুঠোতে আনার মন্ত্র দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে তাদের দলপতিকে একটা উপহার দেওয়া। ওদের ভাষায় বলা হয় গার্গকে উপহার!

–কে গার্গ তা বুঝবেন কেমন করে?

হ্যাগ্রিড হাসতে হাসতে বললেন, কে আবার, যে সবার চেয়ে মাথায় লম্বা! শুধু তাই নয়, দেখতে বিশ্রী আর কুঁড়ে। গোঁত্তা মেরে বসে থাকে কখন চ্যালা-চামুন্ডারা খাবার নিয়ে আসবে তারই অপেক্ষায়! ওর নাম কারকাস। লম্বায় বাইশ তেইশ ফিট তো হবেই। ডাইনোসরের রাইনোসরাসের মতো গায়ের চামড়া।

হারমিওন শুকনো মুখে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললো, আপনি সোজা তার কাছে চলে গেলেন?

–ও আর ওর স্ত্রী চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা একটা লেকের ধারে শুয়েছিলো।

 –আমি আর অলিম্পিয়া পা টিপে টিপে ওদের কাছে গেলাম।

–ওরা তো আপনাদের দেখে মেরেও ফেলতে পারত।

–হয়তো পারতো হ্যাগ্রিড বললেন। কিন্তু সেই অবস্থা এড়াতে ডাম্বলডোর আমাদের যা বলেছিলেন তাই করলাম। অন্যদের চোখ এড়িয়ে গার্গকে উপহার দেওয়া, ঠিক তাই করলাম। আমাদের কেউ লক্ষ্য করল না, আমরা সোজা ওর পায়ের তলায় উপহারটা রাখলাম।

–কী দিলেন, খাবার? রন বললো।

–খাবারের গার্গের অভাব নেই। ম্যাজিক! দরকার হলে সেটা ওদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারবো। যাকগে, প্রথমদিন ওকে একগুচ্ছ গারব্রেইথান আগুন দিলাম।

হারমিওন ভুরু কোঁচকালো, খুব ধীরে ধীরে বললো, উ! কিন্তু হ্যারি আর রন বুঝতে না পেরে বোকার মত হ্যাগ্রিডের মুখের দিকে তাকালো।

–এক গুচ্ছ?

–সে আগুন কোনও দিন নির্বাপিত হবে না; হারমিওন অধৈর্য হয়ে বললো প্রফেসর ক্লিটউইক ক্লাসে অন্তত দুবার ওই আগুনের কথা বলেছেন।

রন কিছু বলার আগেই হ্যাগ্রিড বললেন, যাকগে, ডাম্বলডোর ওই গুচ্ছটাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে কখনও নির্বাপিত না হয়। কোনও জাদুকরের সেটা ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। তো আমি সেই গাৰ্গ কারকুয়ের পায়ের তলায় বরফের মধ্যে রেখে বললাম, আলবাস ডাম্বলডোর আপনাকে এই উপহারটা পাঠিয়েছেন। সম্মান জানিয়েছেন।

–কারকাস শুনে কি বললো, হ্যারি কৌতূহলী হয়ে বললো।

 –কিছু না, হ্যাগ্রিড বললেন–ওতো ইংরেজি বলতে পারে না।

–আপনি আমাদের বোকা বানাচ্ছেন?

–তাতে কিছু যায় আসে না, হ্যাগ্রিড বললেন, ডাম্বলডোর আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। কারকাসের হাতে কিছু জায়েন্ট আছে যারা ইংরেজি পড়তে পারে, বলতে পারে। ওরা অবশ্য আমাদের দোভাষির কাজ করে।

–প্রেজেন্টটা ওর পছন্দ হয়েছিলো? রন বললো।

–ওটা কী, একবার জানতে পেরে ঝড়ের বেগে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো। কথাটা বলে হ্যাগ্রিড ড্রাগনের মাংসটা অন্য গালে লাগালেন। সেদিকের চোখটাও ফুলে গিয়েছিলো। আমি ওকে বললাম, ডাম্বলডোর আগামীকাল আবার একটা উপহার দেবেন বলেছেন। কেমন লেগেছে জানাবেন।

হারমিওন বললো–পরের দিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখলেন কেন?

হ্যাগ্রিড বললেন, ডাম্বলডোর তাড়াহুড়ো চান না। আগামীকাল আসবো, নতুন একটা উপহার দেবো, তারপর আবার… এতে ভালো ধারণা হয়। প্রথমটার উপকারিতা তো জানবে, এখন কৌতূহল জন্মাবে।

যাইহোক ওইসব দানবদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলা, অন্তরঙ্গতা ঠিক নয়। পরের ব্যাপার পরে তাই আমরা ছোট একটা গুহাতে চলে এলাম। পরেরদিন সকালে গিয়ে দেখলাম কারকাস আমাদের জন্য উৎসুক হয়ে বসে রয়েছে।

–ওর সঙ্গে কথা বললেন?

–খুব বেশি নয়, হ্যাগ্রিড বললেন, ও যা যা বললো আমরা শুনে এলাম। খুব আনন্দের ইঙ্গিত দিলেন। উনি ডাম্বলডোরের কথা শুনেছেন। শুনেছে, ব্রিটেনে দানবদের হত্যার বিরোধী ছিলেন। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ভালই ইংরেজি জানে। কথাবার্তা বেশ জমে উঠেছিলো। যাকগে, আবার আসবে বলে বিদায় নিলাম।

–কিন্তু সেই রাতে কিছু দুর্ঘটনা ঘটলো।

–কি বলছেন আপনি? রন সঙ্গে সঙ্গে বললো।

–হ্যাঁ। ওদের সঙ্গে থাকা বিপজ্জনক। কথায় কথায় ওরা মারামারি, খুন খারাবি করে, মেয়েরাও বাদ যায় না। ঝগড়া হয় খাবার আর আগুন জ্বালানো নিয়ে। এমনি করেই ওরা সংখ্যায় কমতে শুরু করেছে। একদিন সবশেষ হয়ে যাবে।

হ্যারি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।

–কি বলছিলাম দুর্ঘটনা…! ভোরের দিকে দেখলাম ওদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, বেশ কয়েকঘন্টা ওদের দাঙ্গা চলল, চিৎকার, কান্না, ভীষণ শব্দ! সে তোমাদের বলে বোঝাতে পারবো না। সকাল হলো, সূর্য উঠলো, বরফ গলতে শুরু করল দেখলাম লেকের ধারে ওর মুণ্ডুটা পড়ে রয়েছে। হারমিওন আঁতকে উঠে বললো–কার মুণ্ডু?

–কার আবার কারকাসের, হ্যাগ্রিড ভরাট গলায় বললেন, তারপর ওরা নতুন এক নেতা ঠিক করল। গলগোম্যাথ। গলগোম্যাথের কাছে যাওয়ার মোকা পাচ্ছিলাম না। কে জানে কিভাবে আমাদের নেবে।

তাহলেও চেষ্টা করতে হবে তো। তারপর দুদিন অপেক্ষা করে গার্গের যে উপহারটা কাছে ছিলো সেটা নিয়ে গলগোম্যাথের কাছে গেলাম। বীভৎসা লম্বা। কাল চকচকে চুল, সাজানো দাঁত। গলায় মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি নেকলেস, ছোট ছোট নরমুণ্ড। মাথায় কারকাসের হেলমেট। বিশ্বাস কর আমি একটুও ভীতু নই, তাও ওকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠল।

–হ্যাঁ, বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাতে লাগল। আমি সাহস করে ওকে একটা বিরাট ড্রাগনের চামড়া বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে দিলাম। বললাম, গার্গ দানবের জন্য সামান্য উপহার। তারপরই দেখলাম আমি শূন্যে ভাসছি, পা উপরে, মাথা নিচে। ওর দুটি চ্যালা আমাকে তুলে ধরেছে।

হারমিওন হাসি চাপতে মুখে আঙ্গুল দিল।

হ্যারি বললো–সেই অবস্থা থেকে ছাড়া পেলেন কেমন করে?

–বাঁচালো অলিম্পে, ওর চোখ জ্বালা করার কার্স প্রয়োগ করে। ওরা আমাকে ছেড়ে দিতেই কেভের দিকে দৌড়ালাম। জানতে পারলাম, ওদের নতুন নেতা জাদুকরদের বিরুদ্ধে। এদিকে ডাম্বলডোরের কাজ শেষ না করে ফিরতে পারি না। দুটো দিন কেভে মাথা গুঁজে শুয়ে রইলাম। দেখতে লাগলাম নতুন দলপতি আরও মুণ্ডচ্ছেদ করেছে কিনা। করলে ভালো করতে হ্যাগ্রিড বললেন।

–কেন?

–পরে জানলাম ওর রাগ সব জাদুকরের ওপর নয়। রাগ আমাদের ওপর।

হ্যারি চমকে উঠে বললো, ডেথ ইটারস?

–হতেও পারে, ওদের দেখলাম মাঝেমাঝে গার্গের জন্য উপহার নিয়ে আসছে। ওদের গলা টিপে ধরে কেউ শূন্যে দোলাচ্ছে না।

–কী করে জানলেন ওরা ডেথ ইটারস? রন বললো।

–একজনকে আমি চিনতে পেরেছি, হ্যাগ্রিড বললেন–ম্যাকনেয়ারকে মনে আছে? বাকবিককে হত্যা করতে লোক পাঠিয়েছিল? ও খুনে প্রকৃতির গলগোম্যাথের মতো দমাদম খুন করে। তাই ওদের সঙ্গে ভাবসাব করে নিয়েছে।

–তাহলে ধরে নিতে পারি ম্যাকনেয়ার দানবদের ইউ–নো–হুঁর দলে যোগ দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে? হারমিওন বললো।

–ধৈর্য ধরো। আমি এখনও আমার শুরু করা কাহিনী শেষ করিনি। হ্যাগ্রিডের মুখ দেখে ওদের মনে হলো একটু একটু করে বলতে হ্যাগ্রিড ভালবাসেন।

–আমি আর অলিম্পিয়া ভবিষ্যতে কেমন করে এগোব প্ল্যান করতে লাগলাম। ডাম্বলডোরের কাজতো অসমাপ্ত রেখে আসা যায় না। নতুন গার্গ ইউ নো–হুঁর মতো হলেও বুঝতে পারলাম দলের দানবেরা সকলেই ওর ফলোয়ার নয়। এখন খুঁজে বার করতে হবে কারা কারা গলগোম্যাথকে গার্গ হিসেবে মেনে নিতে পারছে না।

রন বললো–তাদের কি করে খুঁজে বার করবেন?

–অনেকেই মরেছে, মার খেয়েছে, তারা এখানে ওখানে লুকিয়ে রয়েছে। ঠিক করলাম যারা ওর বিরোধী তাদের খুঁজে বের করতে হবে।

রন বললো–অন্ধকার গুহা থেকে ওদের খুঁজে বার করবেন?

হ্যাগ্রিড বললো, দানবদের নিয়ে আমার মাথাব্যাথা ছিলো না, ছিলো ডেথইটারসদের নিয়ে। খবর পেলাম ম্যাকনেয়ার আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। অলিম্পিয়াকে অনেক কষ্টে ওকে আক্রমণ করতে বাধা দিলাম।

হ্যাগ্রিড চুপ করে রইলেন। কিছু ভাবছেন, কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

–হ্যাঁ, কারকাস খুন হবার পর, তৃতীয় দিন রাতে, আমরা দুজনে গোপন গুহা থেকে বেরুলাম। ডেথইটারসদের খুঁজতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত ছসাত জায়েন্ট পেলাম যারা গলগোম্যাথের বিরুদ্ধে লড়বে মনে হয়েছিলো। তারা সামান্য ইংরেজিও বলতে পারে।

রন বললো, ছসাত জন? ওরা এখানে এসে ইউ-নো–হুঁর বিরুদ্ধে লড়তে রাজি হয়েছে?

হারমিওন বললো–ওদের বোঝাতে পেরেছেন?

হ্যাগ্রিড হারমিওনের দিকে দুঃখ ভরা চিত্তে তাকিয়ে রইলেন।

 –গলগোম্যাথের লোকেরা একদিন রাতে গুহাতে গিয়ে রেড করেছে। যারা বেঁচে রয়েছে তারা আর যোগ দেবে বলে মনে হয় না।

রন হতাশ হয়ে বললো–তাহলে আপনার চেষ্টা সফল হলো না।

–কোনও আশা নেই। ওদের গলগোম্যাথের লোকেরা আক্রমণ করার আগে সামান্য আশার সঞ্চার হয়েছিলো।

তিনজনেই চুপচাপ। বাইরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ে চলেছে। জানালার কাঁচ বরফে ঢেকে গেছে। হ্যারি ওর রোবের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভিজে রয়েছে। ফ্যাংগ হ্যারির কোলে মাথা ঘষছে।

–হ্যাগ্রিড! হারমিওন নীরবতা ভঙ্গ করে বললো।

–বলো।

–আচ্ছা ওখানে কী আপনার মা সম্বন্ধে কিছু জেনেছেন? হ্যাগ্রিড একটু যেন শঙ্কিত হয়ে হারমিওনের দিকে তাকালেন।

–হ্যাগ্রিড আমি খুব দুঃখিত প্রশ্নটা করে।

–তিনি মারা গেছেন, হ্যাগ্রিড খুব আস্তে আস্তে বললেন, ওরা বলেছে, অনেক বছর আগে মারা গেছেন। আমার এখন তার মুখটাও মনে নেই।

–কিন্তু আপনিতো বলেননি কি করে এখানে এলেন, কে আপনাকে এমনভাবে আক্রমণ করেছে। রন হ্যাগ্রিডের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।

হ্যাগ্রিড চুপ করে রইলেন। রন আবার বললো

–কে আপনাকে আক্রমণ করেছে হ্যাগ্রিড?

–আক্রমণ করেছে? আমি… দরজায় হঠাৎ কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দেয়াতে হ্যাগ্রিড কথাটা শেষ করলেন না। হারমিওনের হাত থেকে চায়ের মগ মেঝেতে পড়ে গেল। ফ্যাংগ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। ওরা চারজনেই দরজার কাছে পর্দার দিকে তাকাল। পাতলা পর্দার পেছনে ছোট এক মানুষের ছায়া ঘোরাফেরা করছে ওরা স্পষ্ট দেখতে পেলো।

রন তোতলাতে তোতলাতে বললো, আ… আ…।

হ্যারি অদৃশ্য হবার আলখেল্লাটা নিয়ে বললো, সবাই এর ভেতরে চলে যাও। ওরা ক্লোকে ঢুকে পড়লো। ফ্যাংগকে থামানো যায় না। পাগলের মতো চীৎকার করতে লাগলো। ওরা তিনজনে একটা কোনায় গিয়ে দাঁড়াল।

হ্যাগ্রিড বোকার মত তাকিয়ে রইলেন।

–হ্যাগ্রিড আমাদের সরিয়ে চায়ের মগগুলো রাখলেন।

হ্যাগ্রিড মগগুলো তুলে নিয়ে ফ্যাংগ-এর ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। ফ্যাংগ দরজার দিকে গিয়ে আগের মতোই লাফালাফি করতে লাগল।

হ্যাগ্রিড পা দিয়ে বন্ধ দরজাটা খুললেন।

ওরা দেখতে পেলো প্রফেসর আমব্রিজ তার সবুজ টুইডের কোট পরে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কোটের সঙ্গে ম্যাচ করে হ্যাট।

আমব্রিজ হ্যাগ্রিডকে দেখতে পাবার জন্য মাথা ঝোকালেন। আমব্রিজ এতো বেঁটে যে তার দৈর্ঘ হ্যাগ্রিডের নাভিকুণ্ডের কাছে!

–আমব্রিজ ধীরে ধীরে অথচ উচ্চস্বরে বললেন–(যেন কোনও কালাকে কথাটা বলছেন) আপনি তো হ্যাগ্রিড?

হ্যাগ্রিডের জবাবের প্রতীক্ষা না করে আমব্রিজ ওর ঘরে ঢুকে ফুলো ফুলো চোখে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগলেন।

–এই যাও, যাও বলছি, আমব্রিজ হাতব্যাগটা ফ্যাংগের মুখের দিকে দোলাতে দোলাতে বললেন। ফ্যাংগ কোনও আদেশ শুনলো না। নতুন কোনও লোক দেখলে তার দিকে দুটো পা তুলে গাল চাটে।

হ্যাগ্রিড সংযত স্বরে আমব্রিজের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি সাধারণত; দ্রতা হারিয়ে কোনও মহিলার সঙ্গে রুঢ় কথা বলি না; কিন্তু জানতে পারি আপনি কে?

–আমার নাম ডলোরেস আমব্রিজ।

আমব্রিজের চোখ দুটো বন বন করে ঘুরছে যেখানে হ্যারি, রন আর হারমিওন দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে আমব্রিজ দুবার তাকালেন।

 হ্যাগ্রিড কোনরকম ভ্রূক্ষেপ না করে বললেন, ডলোরেস আমব্রিজ–আপনি মিনিস্ট্রির একজন অফিসার, আপনি কী ফাজের অধীনে কাজ করেন?

–আমি মাননীয় মন্ত্রীর একজন সিনিয়র আন্ডার সেক্রেটারি, আমব্রিজ বললেন। কথাটা বলার পর হ্যাগ্রিডের ঘরে যা যা রয়েছে সব খুঁটিয়ে দেখে আবার বললেন, আমি বর্তমানে ডার্কআর্টস প্রতিরোধ বিষয়ে স্কুলে শিক্ষাদান করি।

হ্যাগ্রিড বললেন–বাঃ বাঃ সত্যিই সাহসী আপনি, আজকাল শুনেছি অনেকেই এই কাজটা নিতে চায় না।

–তাছাড়া আমি বর্তমানে হোগার্টসের উচ্চপদস্থ একজন তদন্তকারী, এমনভাবে আমব্রিজ কথাটা বললেন যেন হ্যাগ্রিডের কানে তা যাওয়া দরকার।

হ্যাগ্রিড ভুরু কুঁচকে বললেন, সেটা কী?

–এটাই আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, হারমিওনের হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া চায়ের মগের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, আমব্রিজ। –তাই ঘরের যে কোণে ওরা তিনজনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেইদিকে ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–ভাঙা মগ?

ওটা আমার কুকুর ফ্যাংগ-এর কর্ম। হ্যাগ্রিড একহাতে ড্রাগনের মাংস ধরে চোখে লাগিয়ে, অন্য হাতে চায়ের কাপ তুলতে তুলতে কথাটা বললেন–আরও একটা কাপ কিনতে হবে।

আমব্রিজ সোজা হ্যাগ্রিডের দিকে তাকালেন। ঘরের জিনিসে আর মন নেই, মন হ্যাগ্রিডের চেহারার দিকে।

–আপনার ঘরে ঢোকার আগে কিছু ছেলে–মেয়েদের যেন গলা শুনেছিলাম মনে হয়, আমব্রিজ সহজভাবে বললেন।

হ্যাগ্রিড দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন–আমি আমার প্রিয় কুকুরের সঙ্গে আলাপ করছিলাম।

–আর ও জবাব দিচ্ছিলো আপনাকে?

হ্যাগ্রিড সামান্য অস্বস্তির সুরে বললেন–বাইরের অতিথিরা ঠিক বুঝতে পারে না, আমার সঙ্গে ফ্যাংগ-এর সম্পর্ক এইরকম। অনেকটা মানুষের মতো!

আমব্রিজ অনুগভাজন কণ্ঠে বললেন, আমাদের ক্যাসেলের গেট থেকে আপনার কেবিন পর্যন্ত আসার রাস্তায় তিনজোড়া পায়ের ছাপ দেখলাম।

হারমিওন, ব্যারি সামান্য ভয় পেয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। আমব্রিজের কণ্ঠে সেই শব্দ গেল না। ফ্যাংগ তখন আমব্রিজের লম্বা রোবের হেম ধরে টানাটানি করছে।

–ওয়েল, আমি কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছি। খুবই ক্লান্ত, আমাকে দেখেই বুঝতে পারছেন, হ্যাগ্রিড তার একটা প্রকাণ্ড বড় হাত দোলাতে দোলাতে বললেন, এমনও হতে পারে আমি বাড়ি ফেরার আগে কেউ এসেছিলো।

–কিন্তু কেবিনের দরজা থেকে তাদের ফিরে যাবার সময় পায়ের ছাপ তো দেখতে পেলাম না।

–কেন পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন না তাতো আমি বলতে পারবো না; হ্যাগ্রিড বললেন। তাকালেন ওরা তিনজন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই দিকে।

আমব্রিজ একটু নীতিবিরুদ্ধ কাজ করে যেতে লাগলেন। হ্যাগ্রিডের ঘরের সবকিছু কোনওরকম তোয়াক্কা না করে সার্চ করতে লাগলেন, তৈজসপত্র দেখলেন, বারবার দেখেও যেন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ওদিকে হারমিওন, রন আর হ্যারির অবস্থা কাহিল। কতটা সময় একটা ক্লোকের মধ্যে তারা জড়াজড়ি করে থাকবে?

তারপর সার্চ থামিয়ে হ্যাগ্রিডের মুখোমুখি হয়ে আমব্রিজ বললেন, আপনার মুখে কে এমন বীভৎসভাবে আঘাত করেছে? কী হয়েছিলো? সারা মুখে বড় বড় ক্ষত?

হ্যাগ্রিড মুখের ওপোর থেকে ড্রাগনের মাংসের টুকরোটা সরিয়ে নিলেন। হ্যারি দেখেই বলেছিলো, রক্ত মুছে নিন, মাদাম পমফ্রের কাছে যান।

অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, হ্যাগ্রিড বললেন।

–কেমন করে?

–পা পিছলে পড়ে গিয়ে।

আমব্রিজ কোনও রকম তাপ-উত্তাপ না দেখিয়ে বললেন–আপনি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন?

–ও হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমার এক বন্ধুর ঝাড়ুতে পা লেগে…। আমি ঝাড়ু নিয়ে উড়তে পারি না। তাছাড়া, আমার চেহারা লক্ষ্য করুন, বুঝতে পারছেন ঝাড়ুর সাইজ কত বড় হতে হবে! আমার বন্ধুটি অ্যারাবিয়ন ঘোড়ার ব্যবসা করে। আমি ঠিক জানি না ডানাওয়ালা বিরাট ঘোড়া দেখেছেন কি না।

মিনিস্ট্রি স্কুল থেকে অকেজো শিক্ষকদের সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছি। শুভরাত্রি মি.হ্যাগ্রিড।

আমব্রিজ বিদায় নিলে ওরা তিনজন অদৃশ্য হবার আলখেল্লা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো ক্যাসেলে চলে গেছেন।

হ্যাগ্রিড বললেন–বলছিলেন, তদন্ত করতে এসেছিলেন। কিসের তদন্ত?

–ট্রিলনী বিপদে পড়েছেন।

হারমিওন বললো, হ্যাগ্রিড আপনি ক্লাসে আমাদের নতুন কি শেখাতে চাইছেন?

–ও নিয়ে এখন আর তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। আমার মাথায় গাদা গাদা প্ল্যান আছে। তোমাদের আউল ইয়ারের জন্য আমি নতুন নতুন জম্ভ এনেছি।

হারমিওন, তদন্তের নামে আমব্রিজের নানা কৌশল, উৎপাত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল আছে। কোর্সের বাইরে কিছু করলে হ্যাগ্রিডের অযথা বিপদ হবে। তাই বললো, হ্যাগ্রিড বিপদ হতে পারে এমন কিছু করবেন না। আপনাকে আমব্রিজের ইন্সপেকসন পাশ করতে হবে শান্তিতে থাকতে গেলে। ফাজ ওকে অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে সরকারি আইনের বলে। ভাল হবে আপনি ক্লাসে কেমন করে পরলকস নারলস আর হেজহগসদের ভিন্নতা শেখান।

হ্যাগ্রিড বললেন, কিন্তু হারমিওন সত্যিই ওইসব শেখা খুব ইন্টারেস্টিং। আমি যা এনেছি, সেগুলো আরও অনেক ইন্টারেস্টিং, ইমপ্রেসিভ। অনেক কষ্ট করে যত্ন করে তোমাদের শেখাবার জন্য এনেছি।

–হ্যাগ্রিড, অনুগ্রহ করে আমার কথা শুনুন। ডাম্বলডোরের বন্ধু টিচারদের আমব্রিজ সামান্য ছুতোতে স্কুল থেকে সরিয়ে দিতে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। দোহাই হ্যাগ্রিড, ওকে সুযোগ দেবেন না। প্যাঁচা, আমাদের প্যাঁচা সম্বন্ধে যা হোক কিছু শেখান।

হ্যাগ্রিড মৃদু হেসে একধারে রাখা বিরাট বিছানার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘুম পেয়েছে। শোনো, তোমরা অযথা আমার সম্বন্ধে ভেবে পড়ার ক্ষতি করবে না। তোমরা যদি চাও তো আমি তোমাদের নতুন নতুন সব জিনিস শেখাবো। তাহলে এখন বিশ্রাম! এখন তোমরা ক্যাসেলে ফিরে যাও। যাবার সময়ে পায়ের ছাপ সযত্নে মুছে দেবে।

ওরা ক্যাসেলে ফিরে চললো। হারমিওনের অবলিটারেশন চার্মের বদৌলতে বরফের ওপর ওদের পায়ের ছাপ রইল না।

হারমিওন দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, তাহলে আগামীকাল আমি একাই হ্যাগ্রিডের নতুন কিছু শেখার ক্লাসে যোগ দেবো। ট্রিলনিকে হয়তো আমব্রিজ তাড়াতে পারবেন, কিন্তু হ্যাগ্রিডকে অতো সহজ হবে না; কথাটা মনে রাখবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *