০৬. দ্য নোবল অ্যান্ড মোস্ট এনসিয়েন্ট হাউজ অব ব্ল্যাক

০৬. দ্য নোবল অ্যান্ড মোস্ট এনসিয়েন্ট হাউজ অব ব্ল্যাক

মিসেস উইসলি গম্ভীর মুখে ওদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন।

আমি চাই তোমরা কোনও কথা না বলে চুপচাপ ঘরে গিয়ে সোজা শুয়ে পড়। কাল আমাদের অনেক কাজ আছে।

ওরা তখন প্রথম ল্যান্ডিং-এ পৌঁছেছে।

মিসেস উইসলি হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমার মনে হয় জিনি ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুম ভাঙিও না।

হারমিওন ওদের শুভরাত্রি জানিয়ে ঘরে চলে গেলে ওরা ওপরে উঠতে লাগল।

ফ্রেড খুব আস্তে আস্তে বললো–জিনি যদি না ঘুমিয়ে থাকে আর হারমিওনের মুখ থেকে একতলায় যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা শোনার অপেক্ষায় থাকে তাহলে আমি একটি ফ্লবেরওয়ার্ম

মিসেস উইসলি দ্বিতীয় ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে ওদের দেখে ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন–রন, হ্যারি, যাও শুয়ে পড়।

-শুভ রাত্রি! হ্যারি, রন আর ওর দুই যমজ ভাইদের বললো।

ফ্রেড বললো–ভাল করে ঘুমোও।

ওরা দুজনে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মিসেস উইসলি দড়াম করে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন।

ঘরটা হ্যারির কাছে মনে হল ঠাণ্ডা গুহার মত। ঘরের দেয়ালের ছবিগুলো মনে হল খুব আস্তে আস্তে গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। অদৃশ্য মানুষগুলো ঘুমচ্ছে। হ্যারি পাজামা পরে, চশমা খুলে বরফের মত ঠাণ্ডা বিছানায় শুয়ে পড়ল। রন, হেডউইগ আর পিগউইজেনের দিকে ওদের খাবার ছুঁড়ে দিল। ওরা ডানা ঝাঁপটা দিয়ে পরমানন্দে খেতে লাগল।

রন ওর মেরুণ রং-এর পাজামাটা পরতে পরতে বললো–ওদের রোজ রাতে শিকার করতে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। একগাদা পেঁচা স্কোয়ারে শো শো করে উড়ে বেড়ানো ভালবাসেন না ডাম্বলডোর, সন্দেহ করতে পারেন। আরে একেবারে ভুলেই গেছি।

দরজার কাছে গিয়ে ও দরজাটা বন্ধ করে দিল।

–তার জন্য কি করছ?

–ক্রেচার, আলো নিভিয়ে দিয়ে রন বললো। প্রথম রাতে যেদিন আমি এখানে এসেছিলাম সেই ভোর রাত তিনটায় সে পায়চারি করতে করতে ঘরে ঢুকেছিল। গভীর রাতে তোমার বিছানার পাশে কেউ এসে জাগিয়ে দেওয়া তুমি নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না, যাকগে।

কথাগুলো বলে রন গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে অন্ধকারের মধ্যে হ্যারিকে দেখতে চেষ্টা করল।

জানালা দিয়ে ঘরে মিঠে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে হ্যারি, রনের আউট লাইন দেখতে থাকে।

রন কি বলতে চাইল হ্যারি তা জানতে একটুও উৎসুক হল না।

–মিটিং-এর কথাবার্তা ওরা আমাদের সব বলেনি। আমরা তাই কিছু আন্দাজ করতে পারি না। খোলাশা করে কিছু বলেছিল? ও কিচেনে ডিনার খাবার সময় যেসব কতাবার্তা হয়েছিল যেগুলো ভাবতে ভাবতে বললো–আমি সার কথাটা বুঝেছি। অর্ডার সকলকে ভোন্ডে দলে যোগ দেওয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

রন খুব বড় দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

–ভোল্ডেমর্ট, হ্যারি দৃঢ়স্বরে বললো–কবে তুমি ওর পুরো নামটা উচ্চারণ করবে? সিরিয়স, লুপিন তো করেন।

রন যেন হ্যারির শেষ কথাগুলো শুনতে পায় না।

রন বললো–হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। ওদের কথাবার্তা আমরা সবই এক্সটেন্ডেবল ইয়ারস দিয়ে শুনেছি, শুধুমাত্র নতুন।

ক্র্যাক আউচ!

-আস্তে কথা বল রন, তা না করলে তোমার মা এখনই ঘরে ছুটে আসবেন।

 –তোমরা দুজনে আমার হাঁটুর ওপর বসে অ্যাপারেট কর।

–হ্যাঁ, ভাল, অন্ধকারে সেটা করা শক্ত।

হ্যারি দেখল রনের ওপর ফ্রেন্ড আর জর্জের আবছা আবছা ছায়া। হ্যারির বিছানা মচমচ করে উঠল। দেখল জর্জ ওর পায়ের কাছে বসে রয়েছে।

হ্যারি বললো–সিরিয়স অস্ত্রের কথা কি বলছিল?

ফ্রেড বললো–পুরনো যন্ত্র দিয়ে তেমন পরিষ্কারভাবে শুনতে পাইনি। ও রনের বিছানায় বসেছিল।

হ্যারি বললো–অনুমান করে বল।

–ফ্রেড বললো–কিছু একটা হতে পারে, ঠিক বলতে পারছি না।

রন বললো–আভাড়া কেডাভ্ৰা কার্সের চেয়ে মারাত্মক নয় নিশ্চয়ই। মৃত্যুর চেয়ে বড় কি থাকতে পারে?

জজ বললো–এমনও হতে পারে ওই অস্ত্রটা এক মুহূর্তে শত শত মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে।

রন ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো–এমনও হতে পারে মানুষদের অতি যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলে।

হ্যারি বললো–ওর কাছে কুসিয়াস কার্স আছে যন্ত্রণা দেবার জন্য। ওর বেশি কিছু কার্যকারিতা দরকার নাও হতে পারে।

সকলেই চুপচাপ। হ্যারি বুঝতে পারল সকলেই ওই অস্ত্রের বীভৎসতা সম্বন্ধে ভাবছে।

জর্জ বললো–এখন কার কাছে সেই বীভৎস মারাত্মক অস্ত্রটা আছে?

রন বললো–সামান্য নার্ভাস হয়ে, আশা করি আমাদের দিকে….।

তাই যদি হয় তাহলে ডাম্বলডোর সম্ভবত ওটা যত্ন করে রাখছেন; ফ্রেড বললো।

–কোথায়? রন বললো–হোগওয়ার্টসে?

জর্জ বললো–তাই যেন হয়, ওখানেই তো পরশপাথর সংগৃহিত ছিল।

রন বললো–ভাবছি, অস্ত্রটা হয়ত পরশ পাথরের চেয়ে বড় হতে পারে। ফ্রে

ড বললো–নাও হতে পারে।

–আকার শক্তি প্রমাণ করে না, জর্জ বললো, জিনিকে দেখে।

হ্যারি বললো–কি যাতা বলছ!

–তুমি ওর ব্যাট–বোগি–হেসেস দেখনি, দেখেছ?

–শ শ চুপ! ফ্রেড বললো–কিছু শুনতে পাচ্ছ?

ওরা চুপ করে রইল। সিঁড়িতে পদশব্দ, কে যেন ওপরে উঠছে।

–মা, জর্জ বললো।

হৈ চৈ বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ হ্যারি শুনতে পেল একটা কড়কড় শব্দ। ওর মনে হল পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে ওরা শুনতে পেল ওদের ঘরের বাইরে কাঠের মেঝেতে খটখট শব্দ! মিসেস উইসলি দেখতে এসেছেন ওরা ঘুমচ্ছে না আড্ডা দিচ্ছে।

হেডউইগ আর পিগউইগ বিদ্রুপের ভঙ্গিতে ডেকে উঠল।

রন দুঃখভরা কণ্ঠে বললো–মা আমাদের একদম বিশ্বাস করে না।

হ্যারি জানে প্রাইভেট ড্রাইভ থেকে আসার পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যার পর যে সমস্ত কথাবার্তা শুনেছে, বলেছে সেগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে। সেই কথাগুলো ভাবলে, মনে করার চেষ্টা করলে–ঘুম আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। ঘুম আসে তো তখনই ভেঙ্গে যায়।

হ্যারি ভাবল রণের সঙ্গে কথা বলে রাতটা কাটিয়ে দেয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে আবার মিসেস উইসলির পদশব্দ শুনতে পায় যেন।

মিসেস উইসলি হয়ত আবার চলে গেছেন। তারপরই ও পরিষ্কার শুনতে পেল অনেকগুলো পাওয়ালা কিছু একটা প্রাণী ওর ঘরের বাইরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করছে। হঠাৎ ওর হোগার্টস স্কুলের শিক্ষক বন্ধু হ্যাগ্রিডের কথা মনে পড়ল। হ্যাগ্রিড এবং কেয়ার অব ম্যাজিক্যাল ক্রিচারের শিক্ষক বলতেন, ওরা সত্যই সুন্দর, অপূর্ব প্রাণী। হ্যারি তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ওদের দেখতে পেল, সেই প্রাণীদের মাথাগুলো কামানের বলের মত। সেগুলো ওর সামনে বনবন করে ঘুরছে। ও ভয়ে মাথা নিচু করল। তারপরই মনে হল একটা উত্তপ্ত বল ওর বিছানার মধ্যে রয়েছে আর ও তারই পাশে কুঁকড়ে শুয়ে রয়েছে। ওর ঘুম ভেঙে গেল জর্জের ডাকে।

–হ্যারি, মাম বলছে তোমার ব্রেকফাস্ট কিচেনে ঢাকা দেওয়া রয়েছে। ব্রেকফাস্ট শেষ করে বসার ঘরে যাবার হুকুম। বলছেন–চতুর্দিকে গাদাগাদা ডসি দেখতে পেয়েছে, সোফার তলায় একটা মৃত পাফঝেইনের বাসাও দেখেছেন।

আধঘণ্টা পরে ব্যারি এবং রন ব্রেকফাস্ট খতম করে পরিষ্কার জামা প্যান্ট পরে যত শিগগির পারে বসার ঘরে ঢুকল। ঘরটা বাড়ির প্রথম তলায়।

ঘরটা বেশ বড়, উঁচু তার সিলিং। অলিভ সবুজ রঙ-এর দেওয়ালে ময়লা কারুকার্যময় পর্দা ঝোলানো। কার্পেটে এত ধূলো যে কেউ তার ওপর দিয়ে চললে। মেঘের মতো ধুলো উড়ে। সবুজ শেওলা রং-এর ভেলভেটের পর্দা হওয়াতে এমন। বজবজ শব্দ করছে যেন তার পেছনে হাজার হাজার অদৃশ্য মৌমাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঘরের মধ্যে ফ্রেড, জর্জ, জিনি, হারমিওন আর মিসেস উইসলি বসে আছে। তাদের নাকে-মুখে কাপড় বাধা। তাছাড়া প্রত্যেকেরই হাতে বিরাট একটা বোতল। বোতলের মধ্যে কাল তরল পদার্থ, মুখে নজল।

মিসেস উইসলি রন আর হ্যারিকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন–তোমাদের মুখ ঢেকে স্প্রে করে নাও। হ্যারি দেখল সরু পায়াওয়ালা একটা টেবিলের ওপর আরও দুটো কাল জল ভর্তি বোতল রয়েছে।

–ওটা ডক্সিসাইড, এই রকম জীবাণুভর্তি বাড়ি আমি জীবনে দেখিনি। দশ বছর ভরে বাড়ির কিপার কি করেছে একমাত্র ঈশ্বর জানেন। মিসেস উইসলি বিরক্ত মাখা মুখে বললো, তোমাদের মুখ ঢেকে স্প্রে করে নাও।

–ক্রেচার বুড়ো হয়ে গেছে। ওর পক্ষে এত বড় বাড়ি দেখা হয়ত সম্ভবপর নয়। মিসেস উইসলি বললো।

হ্যারি দেখল হারমিওনের মুখটা চায়ের তোয়ালেতে প্রায় অর্ধেক ঢাকা। তারই ফাঁকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মিসেস উইসলিকে দেখছে।

ক্রেচার যে বুড়ো হয়ে গেছে তাতে কারও সন্দেহ নেই।

সিরিয়স বললো–ক্রেচারের কর্মক্ষমতা দেখলে তুমি চমকে উঠবে হারমিওন অবশ্য যখন ও কাজ করতে চায়।

সিরিয়স, রন আর হ্যারি ঘরে ঢোকার পর ঘরে এসেছেন। ওর হাতে একটা রক্ত মাখা ব্যাগ, খুব সম্ভব তাতে রয়েছে মরা সঁদুর।

–আমি এইমাত্র বাকবিক হরিণদের খাইয়ে এলাম। হ্যারির প্রশ্নসূচক মুখ দেখে সিরিয়স বললো–আমি ওপরে আমার মায়ের শোবার ঘরে হরিণটাকে রাখি। যাইহোক এই রাইটিং ডেস্কটা। কথাগুলো বলে সিরিয়স ব্যাগ ভর্তি মৃত ইঁদুরগুলো একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে রাখলেন। তারপর একটা তালা লাগানো ক্যাবিনেটের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন। হ্যারি এই প্রথম লক্ষ্য করল ক্যাবিনেটটা সামান্য কেঁপে উঠল।

–মল্লি আমার নিশ্চিত মনে হয় এটা বোগার্ট, সিরিয়স চাবির গর্তে একটা চোখ রেখে বললেন–আমার মনে হয় বেঁচে দেবার আগে এটা ম্যাড-আইকে একবার চেকআপের জন্য দেখান দরকার, আমার মাকে তো তুমি জান কি রকম মানুষ।

–তুমি ঠিক বলেছ সিরিয়স, মিসেস উইসলি বললেন।

ওরা দুজনেই অতি নরমসুরে, ভালভাবে কথা বলছিলেন। গতকালের কথা কাটাকাটি, অমিল দুজনেরই মনে নেই। ওরা একটু অবাক হল।

একতলা থেকে বেশ জোরে ঢং ঢং শব্দ ভেসে এল বসবার ঘরে। তারপরই অতি বিশ্রীভাবে চিৎকার আর আর্তনাদ। গতকাল রাতে ওইরকম শব্দ টংকস ছাতার স্ট্যান্ডটা ঠেলে ফেলার পর হয়েছিল।

আমি ওদের কতবার বলেছি দরজার ঘণ্টা না বাজাতে। সিরিয়াস। ভীষণ রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ওদের কানে এল সিরিয়সের সিঁড়ি দিয়ে নামার দুমদাম পায়ের শব্দ। মিসেস ব্ল্যাকের আর্তনাদ সারা বাড়িতে অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল গতকালের মত। অসম্মানের কলঙ্ক, নোংরা জারজ সন্তান, রক্ত পিপাসু, বিশ্বাসঘাতক, নরকের কীট

মিসেস উইসলি হ্যারিকে বললেন–দরজাটা বন্ধ করে দাও হ্যারি।

হ্যারি ধীরে ধীরে বসার ঘরের দরজাটা বন্ধ করল। নিচে কে চেঁচাচ্ছে, কেন চেঁচাচ্ছে জানার খুব ইচ্ছে হল। সিরিয়স অবশ্যই ওর মায়ের প্রোটেটের ওপর পরদাটা টেনে দিতে পেরেছেন। কারণ হ্যারি আর কিছু শুনতে পেলো না। সিরিয়সের হলে চলার পদশব্দ শুনতে পেল, তারপরই সদর দরজায় চেন বাধার ঠন ঠন শব্দ। তারপরই এক গম্ভীর স্বর শুনতে পেল, কিংগল্পে শ্যালবোল্ট গলা। এখন ও মুডির আলখেল্লা পেয়েছে, ভেবেছে এই ব্যাপারে ডাম্বলডোরকে একটা রিপোর্ট দেব। মিসেস উইসলি পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে হ্যারি লজ্জিত হয়ে আবার ডক্সি পার্টিতে যোগ দিল।

মিসেস উইসলি লকহার্টসের গাইড টু হাউজহোল্ড পেন্টর্স হেঁট হয়ে চেক করছিলেন। বইটা সোফার ওপর খোলা ছিল।

–ঠিক আছে, তোমাদের খুব সাবধানে কাজ করতে হবে, ডকসিদের কামড় আর তাদের দাঁত অত্যন্ত বিষাক্ত। আমার কাছে এক বোতল প্রতিষেধক আছে, তবে আমার মনে হয় সেটা তোমাদের দরকার হবে না।

মিসেস উইসলি পর্দার সামনে সোজা হয়ে বসে রন, হ্যারি ও বাকি সকলকে ওর সামনে বসতে ইশারা করলেন।

–আমি যখন বলব স্প্রে করতে শুরু কর তখনই শুরু করবে। ডকসিরা আমাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসতে পারে, কিন্তু ভালমত প্রেতে ওদের অসাড় করে দেবে। যখন ওরা মৃতপ্রায় হয়ে যাবে, তখন এক জায়গায় জড়ো করে বালতিতে রেখে দেবে।

 মিসেস উইসলি ওদের এড়িয়ে নিজের প্রেটা হাতে নিলেন।

–ঠিক আছে ছিটোতে শুরু কর। ঠিক ফোয়ারার মত, বললেন মিসেস উইসলি।

হ্যারি সবে স্প্রেইং শুরু করেছে তখন একটা বড় ডসি পর্দার গুটানে অংশের ভেতর থেকে চকচকে সূচের মত ছোট ছোট দাঁত বার করে, কাঁটাওয়ালা ডানা বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে লাগলো। সারা গায়ে তার মোটা কাল লোম ঢাকা। ছোট চারটে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এসে ওর মুখের সামনে বোঁ বোঁ শব্দ করে উড়তে লাগল। বেশিক্ষণ উড়তে পারল না, উড়ন্ত অবস্থাতেই চলনশক্তিহীন হয়ে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল। হ্যারি তখন ডসিটা তুলে নিয়ে বালতিতে ফেলে দিল।

–আরে ফ্রেড তুমি কী করছ? মিসেস উইসলি তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–ওটার গায়ে শুধু স্প্রে করে ফেলে দাও!

হ্যারি দেখল ফ্রেড একটা ছটফট করা ডসি ওর দুআঙ্গুলে ধরে রেখেছে।

–দেখাচ্ছি তোমাকে, ফ্রেড সহাস্যে ডকসিটার মুখে এক ঝলক স্প্রে করতেই ওটা নির্জীব হয়ে গেল। যেই মিসেস উইসলি পিছন ফিরেছেন ও চোখ পিটপট করে মৃত ডকসিটা পকেটে চালান করে দিল।

–আমরা স্কিভিং স্ন্যাকবক্সের সঙ্গে ডকসির লাল মিশিয়ে পরীক্ষা করব। জর্জ হ্যারিকে বললো।

দুটো ডকসি ওর নাকের কাছে আসতেই খুব চতুরতার সঙ্গে ওদের গায়ে স্প্রে করে হ্যারি, জর্জের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললো–স্কিভিং স্ন্যাকবক্সটা কী?

–নানা রকমের মেঠাই। দেখলেই তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে, জর্জও বললো। চোখ কিন্তু ওর মিসেস উইসলির দিকে। খুব অসুস্থতা নয়, তবে মাঝে মাঝে গা ছম ছম করলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

–ফ্রেড আর আমি এই গ্রীষ্মে ওগুলো তৈরি করছি। দুমুখো অনেকটা কমলালেবুর মত রঙ। তুমি যদি কমলালেবু খাও তাহলে তুমি অর্ধেক পার্কিং প্যাস্টিল ফেলে দেবে।

–ওগুলো খেলে তুমি চাঙ্গা হয়ে উঠবে, অবসরের সময় তুমি মনের মতো কাজ করতে পারবে। খুব বেশি নয়, ধর ঘণ্টা খানেক। অবসর সময়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আবার এক ঘেয়েমী থেকে ছাড়া পাবে।

ফ্রেড বললো–আমরা তাই মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছি। উইসলির চোখ আড়ালে ছিল। কথাটা শেষ করে ছড়িয়ে থাকা মৃত ডকসিগুলো একত্রিত করতে লাগল। ওর কিন্তু আরও উইসলির পেছনে খাটতে হবে। আপাতত আমাদের টেস্টাররা একটা গড়বড় করছে।

–টেস্টারস?

–আমরা দুজন। পালা পালা করে করি। জর্জ শুধু ফেন্টিং ফ্যানসিসটা করে ছিল। আমরা দুজনে নোজডি নাগেট।

–মা ভাবে আমরা দুজনে লড়াই করছি। জর্জ বললো।

–তোমাদের জোকশপ এখনও চালু আছে? হ্যারি ভান করে বললো, যেন বোতলের ছিপি ঠিকমত আটকাচ্ছে কিনা দেখছে।

–আমরা অবশ্য এখনও কোনও জায়গা পাইনি, ফ্রেড বললো গলার স্বর আরও কমিয়ে। মিসেস উইসলি এখন ওর মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকছেন ডসিদের পুনরায় আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য।

–আপাতত এখন আমরা খুব তাড়াতাড়ি ওগুলো ডাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। গত সপ্তাহে আমরা ডেইলি ফেটে অ্যাড দিয়েছি।

–অশেষ ধন্যবাদ তোমাকে বন্ধু, জর্জ বললো–কিন্তু কিছু ভেব না, মা আমাদের এক্সপেরিমেন্ট সম্বন্ধে কিছু জানেন না। আজকাল আর ডেইলি প্রফেট পড়েন না। প্রধান কারণ ডাম্বলডোর সম্বন্ধে মিথ্যে লেখা।

হ্যারি হাসল। উইসলির দুই ছেলেকে জোকশপ খোলার জন্য প্রি-ওইজার্ড টুর্নামেন্ট জিতে ও যে হাজার গ্যালিয়নস প্রাইজ পেয়েছিল সেগুলো ওদের দিয়েছে। আরও খুশি হল মিসেস উইসলি ফ্রেড হ্যারির অ্যাম্বিসন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থাকার জন্য। মিসেস উইসলি মনে করেন না জোকশপ বানিয়ে তার দুই ছেলে ঠিকমত ক্যারিয়র গড়ে তুলতে পারবে।

ডকসি নির্মূল কাজে সকাল থেকে দুপুর কেটে গেল। মিসেস উইসলি সন্তুষ্ট হয়ে মুখ ঢাকা বড় রুমালটা খুলে নড়বড়ে আর্ম চেয়ারে বসেই বিরক্তি মাখা মুখে উঠে পড়লেন। ভুলে গিয়ে, না দেখেই সিরিয়সের রাখা থলে ভর্তি মড়া ইঁদুরের ওপর বসে পড়েছেন। পর্দার পেছনে তখন আর ডকসিদের ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অনেক স্প্রে করার জন্য ওগুলো মরে পড়ে রয়েছে। কিছু কিছু নিস্তেজও। বালতির পাশেই একটা গামলায় ডকসিদের কাল কাল ডিম রেখে দিয়েছেন। কুক স্যাংকস মাঝে মাঝে বালতি গামলা ঝুঁকে যাচ্ছে। ফ্রেড আর জর্জ বিজয়ীর দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে রয়েছে।

মিসেস উইসলি নিস্তেজ ডকসিদের আর তাদের কাল কাল ডিমের দিকে তাকিয়ে বললেন–এগুলোর সুরাহা লাঞ্চের পরে করা যাবে। তারপর তাকালেন ম্যান্টেলপিসের দুপাশে দুটো কাঁচ লাগান ক্যাবিনেটের দিকে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গাদাগাদা বাছাই করা জিনিস। ময়লা হয়ে যাওয়া অনেক রূপোর বাক্স, মরচে ধরা ছোরা, জদের শুকনো থাবা আর পাকান পাকান সাপের খোলশ। পোর ছোট ঘোট বাক্সের ডালাতে কিছু লেখা–হ্যারি সেই লেখা পড়তে পারলো না। ওর সবচেয়ে ভাল লাগল একটা অলংকৃত করা ক্রিস্টাল কাঁচের বোতল। তার মধ্যে রয়েছে তরল রক্ত কোন সন্দেহ নেই।

আবার ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। সকলেই একযোগে মিসেস উইসলির মুখের দিকে তাকাল।

–তোমরা এখানে বস; তোমাদের জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে আসছি। মিসেস উইসলি কড়াভাবে বললো।

দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে মিসেস উইসলি চলে গেল। চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা জানালার ধারে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখার জন্য দাঁড়াল। ওরা শুধু দেখতে পেল উসক খুসক ঝাঁকড়া চুলের একটা মাথা তার ওপর রয়েছে একগাদা কড়াই। এমন ভাবে রাখা যাতে পড়ে না যায়।

–আরে মুন্ডানগাস! হারমিওন বললো–মুন্ডানগাস গাদা গাদা কড়াইগুলো কেন এনেছে?

হ্যারি বললো–সম্ভবত একটা নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখতে। যেদিন রাতে আমাকে পাহারা দেবার কথা সেদিন ও ওই বড় বড় কড়াইগুলো সংগ্রহ করেছে।

ফ্রেড বললো–হা হা ঠিক তো ঠিক তো।

সদর দরজাটা কেউ খুলতেই মুন্ডানগাস কড়াই সমেত বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ফ্রেড বললো–ব্লিমে, মা ওইসব একদম পছন্দ করে।

মিসেস ব্লেক তখন ওর হাউমাউ গলা ফাটান চিৎকার বন্ধ করেছে। ফ্রেড আর জর্জ পাশাপাশি দাঁড়াল।

ফ্রেড স্বর নামিয়ে বললো–মুন্ডানগাস, সিরিয়স আর কিংগম্লের সঙ্গে কথা বলছে। তারপর চোখ ছোট ছোট করে বললো–কি যে বলছে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। এক্সটেনডেবল ইয়ার্সটা নিয়ে আসতে পারলে কেমন হয়? তবে ঝুঁকির ব্যাপার।

জর্জ বললো–আনলে কাজে লাগানো যেতে পারে। ওপরে গিয়ে নিয়ে আসতে পারি।

ঠিক সেই সময়ে নিচের তলা থেকে ভীষণ কানফাটানো এক শব্দ শুনতে পেল। ওদের আর এক্সটেনডেবল ইয়ার্স আনার কোনও প্রয়োজন হলো না। ওরা মিসেস উইসলির প্রতিটি শব্দ পরিষ্কারভাবে শুনতে পেল। মিসেস উইসলি গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছেন।

আমাদের এখানে চোরাই মাল রাখার জায়গা নয়।

ফ্রেড বললো–মা যদি অন্য কাউকে এইরকমভাবে বকেন তো শুনতে মন্দ লাগে না। ঘরের দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করল যাতে মিসেস উইসলির গলাস্বর ভালভাবে শোনা যায়। –একটা পরিবর্তন মনে হয়।

–একেবারে অপদার্থ, তুমি কি মনে করছ আমাদের? আমাদের কিছু নেই? তোমার চোরাই মাল এনে বাড়িতে জমা না করলে আমাদের অসুবিধে হবে।

জর্জ বললো–এখন আমাদের মধ্যে কেউ মার কাছে গিয়ে শান্ত করা দরকার। তা না হলে চিৎকার থামার কোনও সম্ভাবনা নেই। মুন্ডানগাস তোমাকে পাহাড়া না দিয়ে পালিয়েছিল। মা ওর ওপর অসম্ভব রেগে আছেন। তারপরই যোগ হচ্ছে। সিরিয়সের মায়ের কানফাটা আর্তনাদ আর ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ।

কথাগুলো জর্জ হ্যারিকে বললো।

নতুন করে সিরিয়সের মায়ের প্রোট্রেট থেকে চিৎকারে মিসেস উইসলির গলার স্বর কম শুনতে পাওয়া গেল।

জর্জ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাবে ঠিক সেই সময় এক বেঁটে খাট লোক ঘরে ঢুকল। ও শুধুমাত্র একটা কাপড়ের টুকরো লজ্জা নিবারণের জন্য পরে আছে। খুব বৃদ্ধ। গায়ের চামড়া ঝুলে গেছে। মাথার চাঁদিতে গোল টাক। শুধুমাত্র পেছনে আর রগের দিকে কাঁচা-পাকা চুল। বাদুড়ের মত ওর দুটো কান। চোখ দুটো জলে ভরা লাল। ওর নাকটা শুয়রের মত শুধু নয় বেশ লম্বা।

বেঁটেখাট লোকটা কারও দিকে না তাকিয়ে (যেন কাউকে দেখেনি) ঘরে কেছে। ও ওর পিঠের বিরাট কুঁজ নিয়ে কোলাব্যাঙ্গের মত লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের এক কোণে গেল। বিড়বিড় করছে, কিছু বলছে, নালির মত দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, আদ্যপ্রান্ত অসৎ–অপরাধী–রক্তলোভী বিশ্বাসঘাতক, যদি জানতে আমার মালকিনের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। হায়রে আমার অভাগা মালকিন, যে সব গাঁজলা ওরা ওর বাড়িতে এনেছে, তাহলে ও বুড়ো ক্রেচারকে কি ছেড়ে দিত? কি লজ্জা! কি লজ্জা! রক্ত চোষা বাদুড় আর নেকড়ে বাঘের মত লোকেরা আর বিশ্বাসঘাতকরা, চোরেরা। বেচারা বুড়ো ক্রেচার… ও কি করতে পারে?

ফ্রেড খুব জোরে জোরে বললো–হ্যালো ক্রেচার। কথাটা বলে ফ্রেড দরজাটা বন্ধ করে দিল।

বেঁটে এলফটা (গৃহ ডাইনী) থেমে গেলো, বড় বড় করা চোখ বন্ধ করে আশ্চর্য হয়েছে এমন দৃষ্টিতে তাকাল।

ক্রেচার তখনও ইয়ং মালিকটিকে দেখেনি। পিছন ফিরে মাথা নত করল ফ্রেডের দিকে ফিরে; কার্পেটের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার কণ্ঠে ও বললো–নোংরা বিশ্বাসঘাতকের ছেলে …ও।

জর্জ বললো–খুব দুঃখিত, তোমার শেষের কথাটার মানে ঠিক ধরতে পারলাম না।

–ক্রেচার কিছু বলেনি; বেঁটে লোকটা বললো। দ্বিতীয়বার আবারও জর্জকে অভিবাদন করল। গলার স্বর নামিয়ে আরও বললো–আরও দুটো যমজ, অস্বাভাবিক ছোট জম্ভ তারা।

হ্যারি বুঝতে পারে না হাসবে কি হাসবে না। বেঁটে লোকটা সোজা হয়ে যতটা পারল দাঁড়াল। ওদের দিকে হিংসুটের দৃষ্টিতে তাকাল। মনে হল ওরা ওর শেষ কথা শুনতে পায়নি। বিড় বিড় করেই চলল ক্রেচার।

আর ওই মাড ব্ল্যাডটা, পেতলের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হায় যদি আমার মালকিন জানতে পারত, ওহ হ তাহলে কতো কাঁদত, আরও একটা নতুন ছেলে। ক্রেচার ওর নাম জানেন না। ও এখানে কেন এসেছে? ক্রেচার জানে না।

-এর নাম হ্যারি, ক্রেচার, হারমিওন বললো–হ্যারি পটার।

ক্রেচারের বিষণ্ণ চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে বিড়বিড় করতে থাকল।

–মাড ব্লাড ক্রেচারের সঙ্গে কথা বলছে যেন ও আমার বন্ধু। ক্রেচারের মালিক যদি ওকে এই অবস্থায় দেখে, ওহহ তাহলে তিনি কি বলতেন।

রন আর জিনি খুব রেগে গিয়ে বললো–এই ওকে মাড-ব্লাড বলবে না বলে দিচ্ছি।

হারমিওন ফিস ফিস করে বললো–তাতে কিছু যায় আসে না। ওর মাথার ঠিক নেই। কি বলছে না বলছে নিজেই জানে না।

–হারমিওন অযথা নিজেকে খেলো করবে না। ও জানে খুব ভাল করেই জানে ও কি বলছে, ফ্রেড বললো ক্রেচারের দিকে অপছন্দের দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

ক্রেচার তখনও হ্যারির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে চলেছে।

–সত্যি? সত্যি ও হ্যারি পটার? ক্রেচার দেখতে চায় ওর কপালের কাটা দাগ! যদি থাকে তাহলে ঠিক। ওই ছেলেটাইতো ডার্ক লর্ডকে থামিয়েছিল। ক্রেচার ভেবে কুল পায় না কেমন করে ওইটুকু ছেলে

ফ্রেড বললো–আমরা কিন্তু নই ক্রেচার।

জর্জ বললো–সত্যি করে বলতো তুমি কি চাও?

–ক্রেচার ঘর দোর সাফ করতে এসেছে; কথা ঘোরায় ক্রেচার।

–একটি সম্ভাব্য ঘটনা হ্যারির পেছন থেকে কে যেন বললো। দেখল সিরিয়স একতলা থেকে ফিরে এসেছে। দরজার গোড়া থেকেই ও তীব্র দৃষ্টিতে ক্রেচারের দিকে তাকালেন। হল থেকে আর গোলমাল চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল না। খুব সম্ভব মুন্ডাগাস আর মিসেস উইসলি কিচেনে গিয়ে কথা বলছে।

মুন্ডানগাসকে দেখেই ক্রেচার এমনভাবে নত মস্তকে অভিবাদন করল যে ওর মোটা শুয়রের মত নাকটা মেঝেতে ঠেকে গেল।

–সোজা হয়ে দাঁড়াও, সিরিয়স হুংকার দিয়ে বললো–বল এখানে তুমি কি করতে এসেছ?

–ক্রেচার ঘর সাফ করতে এসেছে; বেঁটে লোকটা বললেন–ক্রেচার অন্ধকারাচ্ছন্ন নোবল বাড়িতে বেঁচে রয়েছে শুধু সেবা করার জন্য।

–করছ, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাড়িটা আরও নোংরা আর ময়লা হয়ে যাচ্ছে।

ক্রেচার আবার অভিভাবদন করে বললো–মালিক সব সময় ক্রেচারের জোক বুঝতে পারে না। তারপর গলার স্বর কমিয়ে বললো–মালিক একজন অকৃতজ্ঞ, নোংরা লোক। ও তার মায়ের মনে কষ্ট দিয়েছে।

সিরিয়স বললো–ক্রেচার আমার মায়ের হৃদয়–মন বলে কিছু ছিল না। সারা জীবন ঘৃণা সঞ্চয় করে বেঁচে ছিল। ক্রেচার আবার অভিবাদন করল। ও আমার মালকিন, এই মালিক তার মায়ের জুতোর কাদা সাফ করার যোগ্য নয় ও আমার মালকিন। যদি দেখে ক্রেচার একে সেবা করছে, তাহলে তুমি ক্রেচারকে কতটা ঘেন্না করবে, ক্রেচার কতোটা হতাশ হবে …!

সিরিয়স বললো–আমি জানতে চাই তুমি কেন এখানে এসেছ। প্রতিবারই তুমি কাজ করার ভান দেখাও। এক্ষুণি তুমি এ ঘর থেকে তোমার ঘরে চলে যাও, আমাকে যেন তোমায় গলাধাকা না দিতে হয়।

–ক্রেচার ওর জায়গা থেকে একচুলও নড়বে না, এটা আমার মালিকের বাড়ি। মালকিন একটুও বরদাস্ত করবে না যদি পর্দাগুলো ফেলে দেওয়া হয়। কিছুতেই ফেলতে দেবো না।

সিরিয়স বিপরীত দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো–যা ভেবেছি তাই। ক্রেচারের দিকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকালেন–ওকে দেখছি আর একটা স্টিকিং জাদু পরদা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। দুদিকেই… জানি না আমি রেহাই পাব কি না, তবু আমাকে পেতেই হবে। ক্রেচার তুমি এখান থেকে বিদায় হও।

ক্রেচার বিড় বিড় করতে করতে ঘর ছেড়ে চলে গেল। আজকাবান থেকে ফিরে ক্রেচারকে আদেশ করছে। ও আমার অভাগা মালকিন, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না ফেনিয়ে ওঠা অপদার্থরা এখানে অধিষ্ঠান করেছে। আপনার সব বিষয় সম্পত্তি লুটেপুটে খাচ্ছে। আপনি হলফ করে বলেছেন ও আপনার ছেলে নয়। ও আবার ফিরে এসেছে, সকলে বলে ও খুনী, হত্যাকারী।

সিরিয়াস দরজাটা দরাম করে বন্ধ করে বললো–তুমি যদি চুপ না করো তো সত্যিই খুনী হব!

হারমিওন কাকুতি করে বললো–সিরিয়স ওর মাথার ঠিক নেই। আমার মনে হয় ও যা বলছে তার মানে বিন্দুবিসর্গ বোঝে না।

–ও অনেক বছর এখানে নিছক একলাটি ছিল। মায়ের প্রোট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে পাগল পাগল আদেশ নিত, আপন মনে কথা বলত কিন্তু ও খুব সুবিধের লোক নয়।

–আপনি যদি ওকে এখান থেকে ছেড়ে দেন তাহলে আশা করা যায় স্বাভাবিক হবে; হারমিওন বললো।

সিরিয়াস কাঠখোট্টাভাবে বললেন–ওকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। ও অর্ডারের নাড়ি নক্ষত্র জানে। তাছাড়া আকস্মিক আঘাতে মারাও যেতে পারে। তুমি ওকে এখান থেকে চলে যেতে বল, দেখ কি জবাব দেয়, তোমার উপদেশ কিভাবে নেয়।

ক্রেচার যে পরদাগুলো ফেলে না দিয়ে ঠিকমত রাখার কথা বলেছিলেন সেগুলোর দিকে সিরিয়স এগোলে, হ্যারি আর অন্যরা তার পিছু পিছু চলল।

পরদাগুলো শুধু জীর্ণ ময়লা নয় শতছিন্ন। ফুটোফুটো দেখে মনে হয় বিষাক্ত ডকসিরা চিবিয়ে চিবিয়ে শেষ করে দিয়েছে। তাহলেও সোনার সুতোতে এমব্রয়ডারী করা জায়গাগুলো এখনও চকচক করছে। বিরাট এক পরিবারের ছবি (ফ্যামিলি ট্রি) তার তলায় সাল তারিখ লেখা। হ্যারির দেখে মনে হলো ওটা মধ্য যুগের। পরদার ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা

দ্য নোবল অ্যান্ড মোস্ট এনসিয়েন্ট হাউজ অব ব্ল্যাক
টাউজোর্স পার

পর্দার তলায় ব্ল্যাক পরিবারের সদস্যদের খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হ্যারি সিরিয়সকে বললো–ফ্যামিলি ট্রিতে আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।

–ছিলাম। ওই যে, পোড়া দাগটা দেখছ ওখানে ছিলাম। মোল বছর বয়সে আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। মা তখন আমার ওপর রাগ করে ওখানে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিলেন: এক নিশ্বাসে সিরিয়স বললেন।

–বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিলেন?

–বললাম যে বাধ্য হয়ে। আমার বয়স তখন ষোল হবে।

–হ্যারি একদৃষ্টে সিরিয়সের দিকে তাকিয়ে বললো–কোথায়?

–সিরয়স বললেন–তোমাদের বাড়ি। তোমার দাদু-ঠাকুমা আমাকে নিজের দ্বিতীয় পুত্রের মত ভালবাসতেন। তোমার বাবা আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। সতের বছর বয়সে আমার নিজস্ব একটা আস্তানা জুটে গেল। আমার এক কাকা আলফার্ডের দৌলতে। মৃত্যুকালে আমার জন্য অনেক অর্থ দিয়ে গেছিলেন। যাইহোক তারপর থেকে আমার আর কারও সাহায্য-টাহায্য বড় একটা নিতে হয়নি। প্রতি রোববারে তোমার বাবা মা আমাকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করতেন। বাড়ির লোকদের আমি হেট করতাম।কথাটা শেষ করে সিরিয়স ওর একটা হাত ফ্যামিলি ট্রির তলায় চেপে বললো–রেগুলাস ব্ল্যাক। জন্ম-মৃত্যুর সাল লেখা আছে। ও আমার চেয়েও ছোট ছিল। খুব ভাল ছেলে–এই কথাটা বার বার আমাকে শুনতে হত।

–ও মারা গেলো, হ্যারি বললো।

–হ্যাঁ। মূর্খ এক নম্বরের মূর্খ। ও ডেথ-ইটারদের দলে নাম লিখিয়েছিল।

-ঠাট্টা করছেন?

–হ্যারি তোমার কি বুঝতে বাকি আছে আমাদের পরিবারটা কি ধরনের জাদুকর?

–আপনার বাবা–মাও ওদের দলে ছিলেন?

–না না না মোটেই না। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার। তবে তারা মনে করতেন ভোল্ডেমর্ট যা করছে, ঠিকই করছে। ওরা সকলেই জাদুকরদের শুদ্ধি করণের পক্ষে ছিলেন। মাগল জন্ম সূত্র থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন। ওই রকম ইচ্ছা তাদের একার ছিল না। আরও কিছু লোকের ছিল। ভোল্ডেমর্ট তার আসল রূপ দেখাবার আগে ভাবত ও যা করতে চায় বা করছে তাতে কোনও ভুল নেই।  

ওর অনুগামীরা কিছুদিন পর লক্ষ্য করল ভোল্ডেমর্ট ক্ষমতা পাবার জন্য লড়াই করছে। আমার বাবা–মা ভাবতেন রেগুলাস একজন ছোট হিরো।

–ওকে কি একজন অরোর হত্যা করেছিল?

সিরিয়স বললেন–না না। ওকে ভোল্ডেমর্ট হত্যা করেছিল। মানে কাউকে দিয়ে নয়, নিজেই। ভাইয়ের মৃত্যুর পর খবরটা পেয়েছিলাম। ভোল্ডেমর্ট এমন সব কাজ ওকে দিয়েছিল তা করতে ওর মন সায় দেয়নি, ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি শত ভয় দেখালেও ভোমের্টের কাছে নত হবে না। সেটা হবে ক্রীতদাস হওয়া, নয়ত মৃত্যু।

লাঞ্চ–ওরা মিসেস উইসলির কথা শুনতে পেল। মিসেস উইসলি জাদুদণ্ডটা উঁচু করে তার ওপর তুলে ধরে। বিরাট ট্রে ভর্তি স্যান্ডউইচ ও কেক। মুখ দেখলেই বোঝা যায় অসম্ভব রেগে আছেন। ঘরের সকলেই তার দিকে খাবার নেবার জন্য এগিয়ে গেল, কিন্তু হ্যারি না গিয়ে সিরিয়সের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সিরিয়স তখনও পর্দার সামনে দাঁড়িয়েছিল।

–বহুদিন, বহু বছর আমি আমাদের ফ্যামিলি ট্রির সামনে দাঁড়াইনি। ওইটে হচ্ছে আমার গ্রেট–গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ফিনিয়েস নিগেইলাস। দেখতে পাচ্ছ? হোগার্টস স্কুলের একজন প্রখ্যাত হেডমাস্টার ছিলেন। অ্যারামিন মেলিফুয়া আমার মায়ের চাচাতো বোন–জাদু মন্ত্রণালয়ে বিল এনে মাগল হান্টিং আইনত সিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমার প্রিয় আন্ট ইল্লাডোরা, তিনি বাড়ির রক্ষক (গৃহডাহী)দের মাথা কাটা পারিবারিক প্রথা হিসাবে চালু করেছিলেন, যখন তারা অতি বৃদ্ধ, শক্তিহীন হয়ে পড়ত। এত শক্তিহীন, একটা ট্রে যখন তাদের হাতে ধরার ক্ষমতা থাকতো না। তাইতো টংকসকে এখানে দেখতে পাচ্ছি না।

আমাদের পরিবারের লোকেরা যা বলবে তা করতে ক্রেচার বাধ্য। আমাদের পরিবার টংকসকে মান্যতা দেয়নি, তার জন্য ক্রেচারকে আদৌ মানতে চায় না।

–টংকস আপনার আত্মীয়? হ্যারি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাঁ। ওর মা আনড্রোমিডা আমার অতিপ্রিয় কাজিন ছিলেন। পর্দাটার কাছ থেকে দেখতে দেখতে সিরিয়স বললেন–কই অ্যানড্রোমিডাকে দেখতে পাচ্ছি না

এই দেখ।

হ্যারি দেখল সিরিয়স আঙ্গুল দিয়ে রেখেছে যেখানে সেখানেও পোড়া দাগ।

বেল্লাট্রিকস আর নারসিসার মাঝে আরও একটা ছিদ্র দেখালেন। অ্যান্ড্রোমিডাসের বোনেরা আজও এখানে আছে কারণ ওদের সম্মানীয় পিওর ব্লাডের মাগল পরিবারে জন্ম, কিন্তু অ্যান্ড্রোমিডা বিয়ে করে ছিল এক মাগল টেড টংসকে। তাই?

সিরিয়াস কথাগুলো শেষ করেই জাদুদণ্ড দিয়ে পর্দাটা ঘুরিয়ে হাসলেন। হ্যারি কিন্তু হাসল না। ও অ্যান্ড্রোমিডাসের পোড়াদাগের ডানধারের নামগুলো খুব মনোযোগ দিতে দেখতে লাগল। নারসিসা ব্ল্যাকের তলায় দুটি সোনার লাইন। তারই সঙ্গে লুসিয়াস মালফয়। সোনার লাইন টেনে তাদের নামের পর ড্রেকোর নাম।

–আপনি ম্যালফয়ের আত্মীয়?

–পিওর রক্তের পরিবারের সদস্যদের একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। সিরিয়স বললেন। তুমি যদি তোমার ছেলে মেয়েদের (পিওর ব্লাড) শুদ্ধ রক্তের ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাও তো একটু অসুবিধে আছে। সংখ্যায় তারা কম। বিবাহ সূত্রে মন্ত্রী আর আমি কাজিন, আর্থার আমার সেকেন্ড কাজিন। সেইসব কথা ভাবা বা চিন্তা করার কোনও মানে হয় না। যদি কেউ রক্ত সম্বন্ধীয় বিশ্বাসঘাতক হয় তাহলে সে গন্য হতে পারে উইসলি।

হ্যারি অ্যান্ড্রোমিডাসের বাঁ ধারের নামগুলো দেখছিল: বেল্লাট্রিক্স ব্ল্যাক, যার নামের তলায় রডফালস লেস্ট্রেঞ্জের সঙ্গে দুটো লাইন দিয়ে যুক্ত।

–লেস্ট্রেঞ্জ! হ্যারি জোরে জোরে বললো। নামটা যেন ওর খুবই পরিচিত, তাহলেও ঠিক মনে করতে পারল না।

মনে না আসার চাপটা সারা শরীরে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক শিরশিরে ভাব অনুভূতি হয়।

–ওরা এখন আজকাবানে; সিরিয়স বললেন।

হ্যারি ওর দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকায়।

সিরিয়স আগের মত রূঢ়ভাবে বললেন–বেল্লাট্রিক্স আর ওর স্বামী রডলফাস জুনিয়র বার্টি ক্রাউচের সঙ্গে এসেছিল। রডলফাসের ভাই রাবাস্টন ওদের সঙ্গে ছিল। কথাটা শোনার পর হ্যারির মনে পড়ে গেল ও বিল্লাট্রিক্সকে ডাম্বলডোরের পেনসিভে দেখেছে। যেখানে চিন্তা আর মেমরি স্টোর করে রাখা যায়, এক লম্বা ডার্ক মহিলা, বড় বড় পাতাওয়ালা চোখ। ও তার বিচারের সময় তার লর্ড ভোল্টেমর্টের সঙ্গে বহুদিনের আনুগত্য গর্বের সঙ্গে স্বীকার করে ছিল। ভোল্টেমর্টের পতনের ও তার দণ্ড শেষ হবার পর ভোল্ডেমর্টকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিল। আশা করেছিল তার আনুগত্যের জন্য একদিন না একদিন ও পুরস্কৃত হবেই।

-আপনি তো কখনোই বলেননি ও আপনার…।

–ও আমার কাজিন হলে কি আসে যায়? সিরিয়স বললেন। আমার সঙ্গে, আমার পরিবারের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই। মনেও করি না, কখনই না। তোমার মত যখন আমার বয়স তখন থেকেই আর ওদের দেখতে পাইনি। তুমি কি মনে কর ওদের মত আত্মীয় থাকার জন্য আমি গর্বিত।

–সত্যি দুঃখিত, হ্যারি বললো–আমি তা বলিনি, আমি একটু আশ্চর্য হয়েছি।

–তাতে কিছু যায় আসে না। তোমার দুঃখিত হবার কোনও কারণ নেই; সিরিয়স অস্পষ্টভাবে বললেন। তারপর পর্দার কাছ থেকে সরে এসে পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে বসার ঘরটা দেখতে দেখতে বললেন, আমি কখনই ভাবিনি আবার এই বাড়িতে এসে গেঁথে যাব।

হ্যারি সিরিয়সের সব কথা ভালভাবেই বুঝতে পারে। নিজের কথা ভাবল, বড় হয়ে আবার যদি ওকে প্রাইভেট ড্রাইভে ফিরে যেতে হয় তাহলে সিরিয়সের মতই মনের অবস্থা হবে।

সিরিয়স বললেন–এই বাড়িটা সদর দপ্তরের পক্ষে আদর্শ। আমার বাবা যখন এখানে থাকতেন তখন সব রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তো মাগলরা যেন চেয়েছিল কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। এখন ডাম্বলডোর সুরক্ষার পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছেন। এর চাইতে কোনও নিরাপদ জায়গা থাকতে পারে না। ডাম্বলডোর অর্ডারের সবচেয়ে সুদক্ষ পরিচালক। কেউ বা কারও পক্ষে আমাদের সদর দপ্তর খুঁজে বার করা অসম্ভব–যদি না ডাম্বলডোর ব্যক্তিগতভাবে কাউকে বলেন। যে চিরকুটটা মুডি তোমায় গতকাল দেখিয়েছিল সেটা ডাম্বলডোরের নিজের হাতে লেখা। সিরিয়স হাঃ হাঃ করে হাসলেন –যদি আমার বাবা মা এইভাবে ব্যবহার দেখতে পেতেন। আমার মায়ের পোর্ট্রেট তার কিছু আইডিয়া দিতে পারবে।

সিরিয়স সামান্য সময় চুপ থেকে খুব বড় দেখে নিঃশ্বাস ফেলল।

–আমি যদি বাইরে বেরিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কাজ করার দায়িত্ব পাই তাহলে খুশি হব। আমি ডাম্বলডোরকে তোমার শুনানির সময় তোমার সঙ্গে যেতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করেছি। তোমাকে একটু নৈতিক সমর্থন দেওয়া আর কি। তুমি কী মনে কর?

হ্যারির মনে হল ওর পাকস্থলী ময়লা ভর্তি কার্পেট ভেদ করে ডুবে গেলো। গতকাল এখানে আসার পর একবারও শুনানির কথা মনে হয়নি। সেই দূর্ভাবনাটা, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দ্যাখা হওয়া, কথাবার্তা বলতে বলতে মনের মধ্যে থেকে উবে গিয়েছিল। দেখল ওর বন্ধুরা পরমানন্দে স্যান্ডউইচ চিবুচ্ছে।

হ্যারি শান্তভাবে বললো–ওরা যদি আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে, তাহলে কী এখানে এসে আপনার কাছে থাকতে পারি?

সিরিয়স বিষণ্ণ মুখে হাসল। তখন দেখা যাবে।

–আমায় যদি আবার ডার্সলিদের কাছে ফিরে যেতে না হয় তাহলে আমি মনে বল পাই। হ্যারি আবার ওর মনের কথা বলে।

–মনে হয় তুমি এখানে থাকলে ওদের খারাপ লাগতে পারে।

মিসেস উইসলি তাড়া দেয়–তোমরা এতো দেরি করলে কিছুই খাবার পড়ে থাকবে না। সিরিয়স আর হ্যারি ওদের সঙ্গে খাওয়াতে যোগ দিল।

একটা ছোট রূপোর নস্যির কৌটা সরাতে গিয়ে হ্যারির আঙ্গুল কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাটা জায়গাটা ফুলে উঠল।

সিরিয়স ফোলা হাতটা দেখতে দেখতে বললেন–ঠিক আছে। কথাটা বলে ওর হাতের ওয়ান্ড দিয়ে কেটে যাওয়া জায়গাটি ছোঁয়াতে ওর ফোলাটা কমে গেল, মনে হয় এর মধ্যে ওয়ার্টক্যাপ পাউডার ছিল।

সিরিয়স কৌটাটা যেখানে ময়লা জমা করা ছিল সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

হ্যারি দেখল জর্জ ওর হাতটা কাপড়ে মুড়ে কৌটোটা তুলে নিয়ে যে পকেটে মড়া ডকসীগুলো ভর্তি করে রেখেছিল তার মধ্যে সযত্নে রেখে দিল।

ওদের চোখে পড়ল অতি কুৎসিত দেখতে একটা রূপোর টুইজার। অনেকগুলো তার পা। হ্যারি হাত দিতেই মাকড়সার মত সেটা ওর হাতে উঠতে লাগল। ওঠার সময় হ্যারির হাতের চামড়ায় আঁচড় কেটে দিল। সিরিয়স দেখতে পেয়ে হ্যারির হাত থেকে ওটা ছিনিয়ে নিয়ে নেচার নোবিলিটি অব উইজার্ড জেনেলজি নামক মোটা বইটা দিয়ে সেটা ভেঙে দিলেন। একটা মিউজিক্যাল বক্স-এ হাত দিতেই ওটা বেজে উঠল। সুরটা ওদের কানে ঢুকতেই ওদের ঘুম এসে গেল। জিনি দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে বাক্সের ঢাকনাটা বন্ধ করে দিল। একটা খুব ভারি লকেটের বাক্স ওরা খুলতে পারল না। পুরনো দিনের অনেক সিলমোহর দেওয়া ধূলো ভর্তি বাক্স, তার মধ্যে রয়েছে অ্যান অর্ডার অফ মারলিন, ফার্স্ট ক্লাস (সিরিয়সের দাদুকে দিয়েছিল, মন্ত্রণালয়ে ভাল কাজের জন্য) এই সব টুকিটাকি জিনিস।

সিরিয়স মেডেলটা নোংরা ময়লা আবর্জনা ভর্তি থলেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন–তাহলে অনেক সোনা উৎকোচ দিয়েছিলেন।

অনেকবার ক্রেচার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ঢু মেরে গেল। দুএকটা জিনিসও লুকিয়ে লয়েন ক্লথে ঢেকে নিয়ে গেল। নিয়ে যাবার সময় বিড়বিড় করে অভিসম্পাত দিয়ে গেল। সিরিয়স যখন ওর মুঠোর মধ্যে একটা সোনার আংটি নিয়ে মোচড় দিলেন। ক্রেচার সেটা দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘর থেকে চলে গেল। বিশ্রিভাবে সিরিয়সকে কিছু বললো আগে কখনও ওই রকম কথা হ্যারি শোনেনি।

আংটিটা আমার বাবার।

–ক্রেচার আমার বাবার কথাটথা বেশি শুনতো না, মার কথাতেই চলত। গত সপ্তাহে ওকে আমার বাবার এক জোড়া পুরনো ট্রাউজার লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। মিসেস উইসলি মনে হয় কিছুদিন কাজের লোকদের খুব কাজ করিয়ে নেবে। ড্রইং রুমটাতো জীবাণুমুক্ত করতে তিনটে দিন লেগেছে। সবশেষে একমাত্র আজেবাজে অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঘরের পর্দাটা, যাতে ব্ল্যাক পরিবারের ফ্যামিলি ট্রি আছে। ওটা দেয়াল থেকে সরানোর সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি নড়বড়ে লেখার ডেস্কটা। মুডি তখনও সদর দপ্তরে আসেননি, তাই কেউ জানে না ভেতরে কি আছে।

ওরা ড্রইংরুম থেকে একতলার ডাইনিং রুমে গেল। দেখল বড় বড় মাকড়সা থালাবাটির ওপর অবাধে ঘুরছে। (রন এককাপ চা বানিয়ে খাবার জন্য ঘর থেকে তাড়াতাড়ি চলে গিয়ে ফিরল দেড় ঘণ্টা পর)।

কাল এস করা চিনেমাটির বাসন-পত্র সিরিয়স জমা করে রেখেছিল ফেলে দেবার জন্য। রংচটা রূপোর ফ্রেমে বাধান ফটোগ্রাফগুলোর একই অবস্থা। ফ্রেমের কাঁচগুলো ভেঙে গেছে।

স্নেইপ বলেন ওরা ঘর বাড়ির ময়লা–জঞ্জাল সাফ করছে কিন্তু হ্যারির মনে হয় ওরা সাফ করার নামে যুদ্ধ করছে। ক্রেচার পরোক্ষে তাই বলে।

ওরা যখন কাজ করে তখন ফাঁকে ফাঁকে ক্রেচার আসে। ওর নিজের মনে কথা বলা, বিড়বিড় করা যেন বেড়েই চলেছে। থলেতে যা কিছু পায় নিয়ে চলে যায়। সিরিয়স ওকে একটু যেন বেশি বকে। ভয় দেখালে জল ভরা চোখে তাকিয়ে থেকে বলে মালিক যা বলবে সিরিয়স তাই করবে। তারপর চলে যাবার সময় উঁচু গলায় বলে, মালিক ক্রেচারকে তাড়াতে পারবে না–কখনই না, ক্রেচার জানে তারা এখন কি করছে। ডার্ক লর্ডের বিরুদ্ধে মাডব্লাড চক্রান্ত করছে, বিশ্বাসঘাতক আর নোংরা জেলা ওঠা মানুষদের সঙ্গে এক হয়ে।

কথাটা শুনে হারমিওনের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সিরিয়স ওর নেংটির কোমরের বাঁধনটা ধরে ঘর থেকে বার করে দিলেন।

দরজার ঘণ্টি দিনের মধ্যে বার বার বাজে। সিরিয়সের মায়ের চিৎকার আর্তনাদের সূচনা। হ্যারি, রন ওরা সেই চিৎকার শুনলে মিসেস উইসলি ওদের ডেকে ময়লা জঞ্জাল সাফ করার কাজ দিয়ে দেন। স্নেইপও বার বার বাড়ির বাইরে যান আবার ফিরে আসেন। স্নেইপের সঙ্গে হ্যারির মুখোমুখি দেখা হয় না। মাঝে মাঝে ওর প্রফেসর ম্যাগগোনালের সঙ্গে দেখা হয়। খুবই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, মাগল ড্রেস আর কোট পরে থাকেন, মনে হয় আরও বেশিদিন বেঁচে থাকতে চান। মাঝে মাঝে অতিথিরাও আসে সাহায্য করতে। টংকসও আসে। মুনগাস এলে মিসেস উইসলি রেগে যান।

সব ঠিক আছে কিন্তু রাত্রে ভাল ঘুম হয় না, ও দেখে অন্ধকার করিডর। তালাবন্ধ ঘরের দুঃস্বপ্ন দেখলেও হ্যারি ওর বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটায়। ঠাট্টা-ইয়ার্কি নানা গল্প গুজব করে। উইসলি ওদের স্বভাবসিদ্ধ বকাবকি করে, সেটা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে। তবুও যখনই ও ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, সিলিং-এ অস্পষ্ট কালো কালো ছায়া ঘুরে বেড়াতে দেখে। মিনিস্ট্রির হিয়ারিং-এর কথা মনে হলেই ও ম্রিয়মান হয়ে যায়। সুচ ফোঁটানোর ভয় ওর শরীরে বিধতে থাকে। ভাবে স্কুল থেকে বিতাড়িত হলে ও কি করবে। কথাগুলো ও রন হারমিওনের কাছে সব সময়ে বলে না। ও লক্ষ্য করেছে ওরা ওকে দেখে ফিস ফিস করে কথা বলে, ওর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায়। তাছাড়া মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে মুণ্ড হীন মিনিস্ট্রির অফিসিয়ালরা হাতের ডাণ্ডা ঠুকে ঠুকে বলেন, ডার্সলিদের কাছে ফিরে যাও।

বুধবার রাত্রে ডিনারের সময় উইসলি ওকে ডেকে যা বললো তা শুনে হ্যারির পেটের ভেতরটা গুড় গুড় করে উঠল। মিসেস উইসলি গম্ভীর হয়ে বললেন আগামীকালের জন্য তোমার সবচেয়ে ভাল জামা-কাপড় প্রেস করে দিয়েছি হ্যারি, আজ রাতেই চুলে সাবান দেবে, ভাল করে স্নান করবে। প্রথম দর্শন ভাল হলে অনেক কাজ ভাল হয়। তোমাকে তো মিনিস্ট্রিতে যেতে হবে।

রন, হারমিওন, ফ্রেড, জর্জ আর জিনির কথা বন্ধ হয়ে গেল। ওরা সকলেই হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারি মিসেস উইসলির নির্দেশ শুনে মাথা নাড়ল, অর্ধসমাপ্ত চপটা খেতে লাগল। ওর মুখের ভেতরটা শুকনো হয়ে গেল, চপটা ভাল করে চিবুতে পারল না।

–কেমন করে ওখানে যাব? হ্যারি মিসেস উইসলিকেও জিজ্ঞেস করে। মিসেস উইসলি বললেন–আর্থার তোমাকে নিয়ে যাবে।

মি. উইসলি ওদের সঙ্গে ডিনার খাচ্ছিলেন, হ্যারিকে সাহস যোগাবার জন্য বললেন–তুমি আমার অফিসে অপেক্ষা করবে, ডাক পড়লে তুমি যাবে।

হ্যারি সিরিয়সের মুখের দিকে তাকাল; কিন্তু সিরিয়স কিছু বলার আগে মিসেস উইসলি বললেন; প্রফেসর ডাম্বলডোর বলেছেন, সিরিয়সের সঙ্গে তোমার মন্ত্রণালয়ে না যাওয়াই ভাল; আমি অবশ্যই কিছু বলিনি।

–হ্যাঁ তিনি যথার্থ বলেছেন; সিরিয়স মুখ বাদন করে হেসে বললো।

মিসেস উইসলি ঠোঁট দিয়ে জিব ভেজালেন।

হ্যারি বললো–ডাম্বলডোর আপনাকে কখন বললেন? কথাটা বলে সিরিয়সের দিকে তাকাল।

–গতরাতে এখানে এসেছিলেন, তোমরা তখন ঘুমুচ্ছিলে।

সিরিয়স ওর কাঁটা চামচ একটা সেদ্ধ আলুতে বিধিয়ে দিলেন। হ্যারি মুখ নিচু করে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল।

ওর মন বিষাদে ভরে উঠল। আগামীকাল ওকে শুনানির জন্য যেতে হবে, অথচ ডাম্বলডোর এখানে এসেও ওর সঙ্গে কথা বললেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *