২৬. অপরকে মুখ রক্ষা করতে দিন

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
অপরকে মুখ রক্ষা করতে দিন

বেশ কবছর আগে চার্লস্ স্টাইনমেজকে কোন ডিপার্টমেন্টের প্রধানের পদ থেকে সরানোর ব্যাপারে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানী মহা সমস্যায় পড়ে। হিসাবরক্ষা দপ্তরের প্রধান হিসেবে তিনি অচল হলেও বিদ্যুতের ব্যাপারে তাঁর প্রতিভা ছিল অনন্যসাধারণ। তাই কোম্পানি তাকে কোন ভাবেই আঘাত দিতে, চাননি। তিনি ছিলেন অপরিহার্য-আর অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই তাঁরা তাঁকে একটা পদবী দিলেন। তারা তাঁকে করে দিলেন জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানীর কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার–এই নতুন পদবী নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন। এর ফলে অন্য একজন ডিপার্টমেন্টের ভার নিলেন।

স্টাইনমেজ খুশি হলেন।

জেনারেল ইলেকট্রিকের অফিসাররাও খুশি হলেন কারণ তাঁদের সব সেরা তারকাকে নিয়ে কোনরকম ঝড় না তুলেই কাজটা তারা সমাধা করলেন–এটা করা হল তাঁকে মুখ রক্ষা করতে দিয়েই।

তাঁকে মুখ রক্ষা করতে দিয়ে! কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা! অথচ আমরা ব্যাপারটা নিয়ে প্রায় চিন্তাই করি না! আমরা অপরের অনুভূতিকে চিন্তা না করেই আঘাত করি, অন্যের দোষ খুঁজি, ভয় দেখাই, কোন শিশুকে অন্যের সামনে বকাবকি করি। এটা করতে গিয়ে অপরের মনকে আমল দিতে চাই না। অথচ সামান্য একটু চিন্তা, দুটো সহৃদয়তা মাখা কথা, অপরের মনকে বোঝার চেষ্টা করলে কি চমৎকার ভাবে সব সমস্যা মিটে যেতে পারে। তাতে আঘাত দূর হয়ে যায়।

আমাদের মনে রাখা দরকার যখন ভবিষ্যতে কোন চাকর বা কর্মচারিকে বরখাস্ত করার প্রয়োজন হবে তখন আমাদের এটা চিন্তা করে দেখা উচিত।

‘মানুষকে কর্মচ্যুত করা তামাশার ব্যাপার নয়। বরখাস্ত হওয়া তো আরও নয়।’ কথাটা অবশ্য আমার নয় আমার এক বন্ধু এ. গ্রেঞ্জারের। তিনি একজন পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তাঁর একটা চিঠি উল্লেখ করছি :

আমাদের ব্যবসা হলো প্রধানতঃ মরসুমী। তাই অনেককেই মার্চ মাসে ছেড়ে দিতে হয়। আমাদের ব্যবসাতে একটা চলতি কথা আছে কেউই কুল চালিয়ে আনন্দ পায় না। আর তার ফলে একটা রীতি গড়ে উঠেছে যে কাজটা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ করলেই ভালো। সেটা এই ভাবে বলুন, মিঃ স্মিথ; মরসুম কেটে গেছে তাই আপনার জন্য আর কোন কাজ দেখছি না। অবশ্য আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কাজের মরসুম প্রায় শেষ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

যাদের কথাগুলো বলা হতো তাদের অবশ্যই এগুলো শ্রুতিমধুর লাগত না, তারা ভাবতো তাদের ঠকানো হয়েছে। তাদের অনেকেই হিসেবপত্র রক্ষার কাজে কাটিয়েছেন তাই যে প্রতিষ্ঠান তাদের এভাবে পথে বসিয়েছে তার জন্য তাদের কোন ভালবাসা থাকে না।

‘আমি সম্প্রতি ঠিক করি বাড়তি কর্মচারীদের আমি একটু কৌশলে আর অনুভূতির সঙ্গেই বিবেচনা করবো। তাই আমি প্রত্যেকের শীতকালের কাজ ভালো করে বিবেচনা করবো ভাবলাম। আমি এই রকম কিছু বললাম : মিঃ স্মিথ, আপনি চমৎকার কাজ করেছেন (যদি করে থাকেন)। সেবার আপনাকে যখন নেওয়ার্কে পাঠাই কাজটা বেশ কঠিন ছিল। আপনার বেশ কষ্ট হয়েছিল অথচ আপনি চমৎকার ভাবে সামাল দিয়ে আসেন। আমরা আপনার জন্য গর্বিত। আপনি জানেন কাজ কেমন করে করতে হয় তা যেখানেই কাজ করুন না কেন। এই প্রতিষ্ঠান আপনাকে বিশ্বাস করে। যখনই প্রয়োজন হবে আপনাকে নেওয়া হবে। আমরা চাই আপনি এটা ভুলে যাবেন না!’

‘এল ফল কেমন হল? কর্মচারিরা একটু ভালো মন নিয়েই বিদায় নেয়। তারা তাদের পথে বসানো’ হয়েছে ভাবে না। ওরা জানে কোন কাজ থাকলে ওদের আবার ডাকা হবে। আমরা তাদের চাইলে তারা ব্যক্তিগত ভালোবাসা নিয়ে আসে।

ভূতপূর্ব ডোয়াইট মরো দুই ঘোরতর শত্রুর মধ্যে বন্ধুত্ব চালু করার কাজে দারুণ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কি ভাবে? তিনি বেশ কায়দা করে দুজনের মধ্যে কোনগুলো ঠিক সেগুলো প্রশংসা করে প্রকাশ করতেন। আর তাতে মিটমাট যেভাবেই হোকনা কেন উভয়পক্ষ যাতে সমান বিচার পায় তার চেষ্টা করতেন। এবং তিনি কখনও কোন লোককে ভুল প্রমাণ করতেন না।

আর এটাই প্রত্যেক বিচারকরা জানতেন–অপরকে তাদের মুখ রক্ষা করতে দিন।

সত্যিকারের বড় যারা, সারা দুনিয়াতেই, নিজেদের ব্যক্তিগত জয়ের ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার অবসর তাদের থাকে না। যেমন–

দীর্ঘ তিক্ততাময় শত্রুতার শত শত বছরের পর ১৯২২ সালে তুর্কিরা গ্রীকদের তুর্কিস্থান থেকে চিরকালের মত তাড়াতে বদ্ধপরিকর হয়।

মুস্তাফা কামাল নেপোলিয়নের মতই একবার তার সেনাদলের সামনে বক্তৃতা দিয়ে বললেন : ‘আপনাদের লক্ষ্য হলো ভূমধ্যসাগর। সে সময় এই আধুনিককালের সবচেয়ে তিক্ততাময় যুদ্ধই তখন হচ্ছিল। তুর্কিরাই জেতে আর এরপর দুজন গ্রীক সেনাপতি ত্ৰিকুপিস আর ডিয়োনিস যখন কামালের সদর দপ্তরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যান তখন তুর্কিরা পরাজিত শত্রুদের ভীষণভাবে অভিশাপ দিচ্ছিল।‘

কিন্তু কামালের ব্যবহারে বিজয়ীর অহঙ্কার ছিল না।

‘বসুন, ভদ্রমহোদয়গণ,’ তাদের করমর্দন করে তিনি বললেন। ‘আপনারা অবশ্যই ক্লান্ত।‘ তিনি এরপর যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনার পর তাদের পরাজয়ের বেদনা কিছুটা লাঘব করে বললেন এক সেনার অন্য সেনাকে বলার মতই : ‘যুদ্ধ হলো একটা খেলার মত, এতে শ্রেষ্ঠ সেনাদল সবসময় নাও জিততে পারে।‘

জয়ের চরম সন্ধিক্ষণেও কামাল এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি মনে রেখেছিলেন : এখানে আমাদের ৫ নম্বর নিয়ম :

‘অপরকে মুখ রক্ষা করতে দিন।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *