০৮. অন্যদের কীভাবে উৎসাহী করা যায়

অষ্টম পরিচ্ছেদ
অন্যদের কীভাবে উৎসাহী করা যায়

যারা অয়েস্টার বে’তে থিয়োডোর রুজভেল্টের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন তাঁরা তাঁর জ্ঞানের পরিধি আর বিশালতা দেখে আশ্চর্য হয়েছেন। গ্যামালিয়েল ব্রাডফোর্ড লিখেছেন যে দর্শনার্থী কোনো কাউবয় বা রাজনীতিক বা কূটনীতিক যাই হোক রুজভেল্ট জানতেন তার সঙ্গে কি কথা বলা দরকার। এটা তিনি কি করে করতেন? উত্তরটা খুবই সরল। রুজভেল্ট যখন জানতেন কেউ সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে আসবে, তিনি সারারাত ধরে সেই লোকটির পছন্দসই বিষয়ে কতটা জানা যায় জানতে চেষ্টা করতেন।

কারণ রুজভেল্ট জানতেন, যেমন নেতারাও জানেন যে, মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করার একমাত্র উপায় হলো তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় নিয়ে কথা বলা।

সহৃদয় উইলিয়াম লায়ন ফেলপস, ইয়েলের তত্ত্বালীন সাহিত্যের অধ্যাপক অল্প বয়সেই এ অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

‘আমি যখন আট বছরে পড়ি তখন একবার আমার ফুপুর বাড়িতে এক সপ্তাহ কাটাচ্ছিলাম, অধ্যাপক ফেলপস তাঁর ‘হিউম্যান নেচার’ বইতে লিখেছেন, একজন মধ্য বয়স্ক লোক এক সন্ধ্যায় এলেন। তারপর পিসীর সঙ্গে কথাবার্তার পর আমার সঙ্গে আলাপ হলো। তখন আমার নৌকো সম্বন্ধে খুবই আগ্রহ ছিল। ভদ্রলোক তাই নিয়ে আমার সঙ্গে এতো কথা বললেন যে আমার খুব ভালো লাগলো। উনি চলে গেলে আমি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লাম-কী চমৎকার মানুষ! নৌকো সম্বন্ধে ওঁর কত আগ্রহ। পিসী বললেন, ‘উনি নিউইয়র্কের একজন আইনবিদ আর নৌকো নিয়ে তার ছিটে ফোঁটাও মাথা ব্যথা নেই। তাহলে এ নিয়ে এত কথা তিনি বললেন কেন?’

পিসী বললেন, কারণ তিনি একজন ভদ্রলোক। তিনি দেখেছিলেন তুমি নৌকো সম্পর্কে আগ্রহী, তিনি বুঝেছিলেন নৌকো নিয়ে কথা বললে তুমি আনন্দ পাবে। তিনি নিজেকে তোমার কাছে প্রিয় করে তুলেছিলেন।

উইলিয়াম ফেলপস লিখেছিলেন, ‘আমি কখনও পিসীর কথা ভুলিনি।‘

এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় আমার সামনে খোলা রয়েছে বয় স্কাউট আন্দোলনের একজন নামী কর্মী এডওয়ার্ড এল চ্যালিফের একখানা চিঠি।

একদিন আমার বিশেষ এক সাহায্যের দরকার হয়। ইউরোপে এক বিরাট বয় স্কাউট জাম্বোরীর ব্যবস্থা হচ্ছিলো। আমি চাইছিলাম আমেরিকার বিরাট এক কোম্পানির প্রেসিডেন্ট যাতে একটি ছেলেকে সেখানে পাঠানোর খরচ দেন।

সৌভাগ্যবশত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমি জানতে পেরেছিলাম তিনি দশ লক্ষ ডলারের একটা চেক লিখেছিলেন, সেটার ক্যাশ দেয়া হয়ে গেলে ব্যাঙ্ক চেকটা আবার তাঁকেই ফিরিয়ে দেয় আর তিনি সেটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখেন।

অতএব তাঁর অফিসঘরে ঢুকে প্রথমেই আমি সেই চেকটা দেখতে চাইলাম। দশলক্ষ ডলারের চেক, আমি তাকে বললাম আমার জানা নেই এত টাকার চেক কেউ লিখেছেন। আমি আমার সব ছেলেদের বলতে চাই, এমন চেক আমি দেখেছি। তিনি খুশি হয়েই আমায় তা দেখালেন। আমি প্রশংসা জানিয়ে কিভাবে ওটা লেখা হয় জানতে চাইলাম।

‘নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। তাই না, মি. চ্যালিফ বয়স্কাউট, বা অন্য কিছু দিয়ে কথা শুরু করেন নি বা তার চাহিদা কি? তিনি অন্যজন যাতে আগ্রহী তাই দিয়েই আরম্ভ করেন। তার কথাটা হয় এই রকম :

‘যার সঙ্গে কথা বলছিলাম তিনি বললেন, ‘ওহ, আপনি কি জন্য যেন দেখা করতে চান?’ আমি তখন আসার উদ্দেশ্য বললাম।

‘খুবই আশ্চর্য হলাম।‘ মি. চ্যালিয়া লিখেছেন, তিনি যে আমি যা চাইলাম তাই দিলেন তা নয়। বরং আমি একটি ছেলেকে ইউরোপ পাঠাতে চেয়েছিলাম। তিনি আরও পাঁচজন এবং আমাকেও পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তা ছাড়া এক হাজার ডলারের একটা হুন্ডি লিখেও দিলেন আর আমাকে সাত সপ্তাহ ইউরোপে থাকতে বললেন। তিনি ইউরোপে তাঁর শাখায় প্রেসিডেন্টদের পরিচয়পত্রও লিখে দিলেন। আর প্যারীতে আমাদের সঙ্গে দেখা করে শহরটাও ঘুরিয়ে দেখালেন। তার পর তিনি অভাবী কয়েকটি ছেলেকে চাকরিও দেন, আর আমাদের কাজে সক্রিয় অংশ নেন।

তবুও আমি জানি তিনি কিসে উৎসাহী। আগে যদি মেনে না নিতাম তাহলে তাঁর কাছ থেকে এর দশভাগের একভাগও পেতাম কিনা জানি না।

এই মূল্যবান কৌশল কি ব্যবসায় লাগানো হয়? দেখাই যাক! ডুভার্নয় কোম্পানীর হেনরি জি. ডুভার্নয়ের কথাটাই ধরুন। তিনি নিউইয়র্কের বিখ্যাত রুটি কোম্পানীর মালিক।

তিনি নিউইয়র্কের বিখ্যাত কোন হোটেলে তাঁর রুটি বিক্রীর চেষ্টা করছিলেন। চার বছর ধরে তিনি প্রতি সপ্তাহে হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ম্যানেজার যেখানে যান তিনি সেখানেই যেতেন। এমন কি একই হোটেলেও তিনি তাঁর সঙ্গে থেকেছেন, সবই সেই রুটির অর্ডার পাওয়ার জন্য। তবে সবই বৃথা।

‘তারপর’, মি. ডুভার্নয় বলেছিলেন, ‘মানব চরিত্র অনুধাবন করে আমি আমার কৌশল পাল্টানোর ব্যবস্থা করলাম। আমি বের করতে চাইলাম ভদ্রলোকের আগ্রহ কিসে।’

আমি জানতে পারলাম তিনি হোটেল অভ্যর্থনা সমিতির একজন সদস্য। দেখতে পেলাম তিনি শুধু সদস্যই নন, তাঁর দারুণ আগ্রহের জন্য তাঁকেই সভাপতি করা হয়েছে। তাছাড়া তিনিই আন্তর্জাতিক সমিতির প্রেসিডেন্ট। যেখানেই ওই সমিতির সভা হোক, সেটায় হাজির হতে পাহাড়, সমুদ্র বা মরুভূমি পার হতে হলেও তিনি গররাজী নন।

‘অতএব তার সঙ্গে পরদিন যখন দেখা করলাম আমি ওই অভ্যর্থনাকারীদের নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কি আশ্চর্য ব্যাপার যে ঘটল কী বলব! তিনি আমার সঙ্গে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে অভ্যর্থনাকারীদের সম্পর্কে কথা বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বর প্রায় আবেগে আপ্লুত হল। পরিস্কার বুঝতে পারলাম এই সমিতি তার শখ আর জীবনের একমাত্র বাসনা। তাঁর অফিস ছেড়ে আসার আগে তিনি আমাকে তার সমিতির সভ্য করে নিলেন।

‘ইতিমধ্যে আমি রুটি নিয়ে একটা কথাও বলিনি। তবে কদিন পরে হোটেলের স্টুয়ার্ড রুটির নমুনা নিয়ে দেখা করতে ফোন করলেন।

স্টুয়ার্ড আমায় অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘বুড়োকে আপনি কি করেছেন জানিনা তিনি তো আপনার প্রশংসায় ফেটে পড়ছেন।‘

‘একবার কথাটা ভাবুন। চার বছর ধরে আমি যা পারিনি, উনি কিসে আগ্রহী তা যদি বার করতে না পারতাম।‘

তাই যদি চান লোকে আপনাকে পছন্দ করুক তবে ৫নং নিয়ম হোল :

অন্যের উৎসাহের ব্যাপার নিয়ে কথা বলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *