০১. অন্যের সমালোচনা করবেন না

প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ

“কোন মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কথা বলেন তখন তার কথায় যে রঙ ফোটে তা কোন যাদুকরও দেখাতে পারে না।”–আলেকজান্ডার উকট

“মানুষের মনের মধ্যে যে ধারণা আদর্শ বা উপসংহারের অস্তিত্ব থাকে তা সত্য, আর তা বাধাপ্রাপ্ত হয় শুধুমাত্র কোন বিরোধী ধারণা জেগে উঠলে তবেই।”–ওয়াল্টার ডিল স্কট

.

প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ – ডেল কার্নেগি

ভূমিকা

গত পঁয়ত্রিশ বছরে আমেরিকার প্রকাশনা জগৎ দু লাখের উপর নানা ধরনের বই প্রকাশ করেছেন। এর বেশির ভাগই অপাঠ্য আর অর্থকরী ভাবেও ব্যর্থ। অনেক বললাম বটে, আসলে একজন নামজাদা প্রকাশন প্রতিষ্ঠানের প্রধান আমায় বলেছেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠান ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রতি আটখানি বই প্রকাশের পর সাতটিতেই লোকসান দিয়ে চলে।

তাহলে, আমি আবার একখানা বই লেখার মত হঠকারিতা করছি কেন? আর এ বই লেখার পর আপনিই বা তা পড়তে যাবেন কেন?

দুটো প্রশ্নই যথার্থ, তাই আমিও এর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।

প্রায় ১৯২২ সাল থেকেই আমি নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী আর পেশাদার স্ত্রী পুরুষের জন্য নানা ধরণের শিক্ষাদানের কাজ করে আসছি। প্রথম প্রথম আমি শুধু জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা দিতাম–এই শিক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বয়স্কদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আরও সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশের জন্যই, আর সেটা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে বা জনসমাবেশের সামনে যাই হোক।

তবে আস্তে আস্তে সময় কেটে চললে উপলদ্ধি করলাম এই প্রাপ্তবয়স্কদের আসলে যা দরকার তা হলো কথা বলার যোগ্যতা প্রাত্যহিক কাজে কর্মে আর সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপারে জনসংযোগের জন্য তাদের আরও বেশি শিক্ষা দরকার।

আস্তে আস্তে আমি এটাও বুঝলাম আসলে এরকম কিছু শিক্ষা আমার নিজেরই একান্ত দরকার। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে দেখি বারবার কৌশল আর উপলব্ধির কি অভাবই আমার রয়ে গেছে এই ব্যাপারে। আহা! এমন একখানা বই যদি বিশ বছর আগে আমার হাতে পড়তো। তাহলে কি আশাতীত আশীর্বাদের ব্যাপারই না হতো।

জনসংযোগের কাজই বোধ হয় সবচেয়ে বড় সমস্যা, বিশেষ করে আপনি যদি ব্যবসাদার হন। আর এটা আপনি যদি গৃহকর্ত্রী, স্থপতি বা প্রযুক্তিবিদও হন তাহলেও সত্য। কয়েক বছর আগে শিক্ষকদের উন্নতির জন্য কার্নেগী ফাউণ্ডেশনের আনুকুল্যে এক অনুসন্ধানের ফলে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর অর্থপূর্ণ ব্যাপার প্রকাশ পায়-যে ব্যাপারটা পরে কার্নেগী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আরও গবেষণায় সমর্থিত হয়। এই গবেষণায় আরও প্রকাশ পায় যে ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মত কারিগরী বিষয়েও যে কোন মানুষের অর্থকরী সাফল্যের শতকরা ১৫ ভাগ নির্ভরশীল তার কারিগরী জ্ঞানে উপর আর প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ মানবিক জ্ঞানের উপর–এটা হলো তার ব্যক্তিত্ব আর মানুষকে পরিচালিত করার দক্ষতার উপর।

বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে আমি ফিলাডেলফিয়ার ইঞ্জিনীয়ার্স ক্লাব আর নিউইয়র্কের আমেরিকান ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারদের শিক্ষাদান করেছিলাম। প্রায় ১৫০০ ইঞ্জিনীয়ার আমার ওই শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তারা আমার কাছে আসেন যেহেতু তারা বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন যে ইঞ্জিনীয়ারিং দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি আয়ের মানুষেরা প্রায় যারা ইঞ্জিনীয়ারিং-এ অভিজ্ঞ তারা হন না। উদাহরণ হিসেবে, যে কেউ ইঞ্জিনীয়ানিং, হিসাবশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা বা অন্য যে কোন পেশাতেই সপ্তাহে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর ডলার ব্যয় করে কিছু প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। বাজারে এদের শ’য়ে শ’য়ে মেলে। কিন্তু যে লোকের প্রযুক্তিজ্ঞানের সঙ্গে মনোভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা, নেতৃত্ব দেবার শক্তি আর মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগানোর ক্ষমতা আছে–সেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বেশি উপার্জনের ক্ষমতা রাখেন।

জন ডি. রকফেলার তার কর্মকাণ্ডের সেরা সময়ে ম্যাথু সি. ব্রাশ’কে বলেছিলেন যে, জনসংযোগের কাজে দক্ষতা চা বা কফি কেনার মতই কেনা যায়। আর আমি এই ক্ষমতার জন্য অন্য যে কোন বস্তুর চেয়ে বেশি ব্যয় করতে রাজি। আপনাদের কি মনে হয় না দেশের প্রতিটি কলেজেই এই ধরণের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে দামী এই ক্ষমতা বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার? কিন্তু দেশের অন্ততঃ একটা কলেজেও এই ধরণের কোন ব্যবহারিক, সহজবোধ্য প্রাপ্তবয়স্কের উপযোগী শিক্ষণ-ব্যবস্থা আছে কি না তা আমার এই বই লেখার সময় পর্যন্ত নজর এড়িয়ে গেছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আর সমস্ত ওয়াই. এম সি. এ. বিদ্যালয়গুলো প্রাপ্তবয়স্করা সত্যিই কি শিখতে আগ্রহী স্থির করার জন্য যুগ্মভাবে এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষা চালাতে খরচ হয় ২৫০০০ হাজার ডলার আর সময় লাগে দু বছর। সমীক্ষার শেষ অংশ চালানো হয় কানেকটিকাটের মেরিডেনে। শহরটিকে বেছে নেওয়া হয় যেহেতু এটি বৈচিত্র্যময় কোন আমেরিকান শহর বলেই। মেরিডেনের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের ১৫৬টি প্রশ্নের জবাব দিতে অনুরোধ করা হয়–প্রশ্নগুলো ছিল এই ধরণের : আপনার পেশা কি? শিক্ষা কতদূর? আপনি অবসর সময় কিভাবে কাটান? আপনার আয় কত? আপনার শখ কি? আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি? সমস্যা কি রকম? কি ধরনের বিষয় আপনি পড়তে আগ্রহী?’ ইত্যাদি। ওই সমীক্ষায় প্রকাশ পায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রধান আগ্রহ স্বাস্থ্য সম্বন্ধে–আর তাদের দ্বিতীয় আগ্রহ হলো মানুষ, অর্থাৎ কিভাবে মানুষকে বোঝা যায় আর তাদের নিয়ে চলা যায়, কিভাবে তাদের নিজের মত গড়ে তোলা যায় আর কিভাবে অপরকে জয় করে স্বমতে আনা যায়।

যে সমিতি ওই সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তারা ঠিক করলেন এই ধরণের কোন পাঠক্রম মেরিডেনের বয়স্কদের জন্য চালু করবেন। এর পর তারা বেশ পরিশ্রম করেই এই বিষয়ের কোন ব্যবহারিক পাঠ্য বইয়ের খোঁজ করেত চাইলেন–কিন্তু সে রকম কোন বই পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর প্রথিতযশা কোন বয়স্ক শিক্ষণ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন ঐ উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী কোন বইয়ের কথা তার জানা আছে কি না। তিনি জবাবে জানালেন, ‘না। আমি জানি বয়স্করা কি চান। তবে যে বই তাদের দরকার তা আজও লেখা হয় নি।’

আমার অভিজ্ঞতায় আমি জানি কথাটা সত্যি, কারণ আমি নিজেই বেশ কয়েক বছর ধরে মানবিক সম্পর্কে উপর লেখা ব্যবহারিক একখানা বই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।

যেহেতু এরকম কোন বইয়ের অস্তিত্ব ছিল না, আমার নিজের তৈরি পাঠক্রমের জন্য আমি যে বই লেখার চেষ্টা করেছি–এই সেই বই। আশা করি আপনাদের এটা ভালো লাগবে।

এ বই লিখতে গিয়ে, ওই বিষয়ের উপর লেখা যা আমার নজরে এসেছে তাই পড়েছি–এবং তা ডরোথী ডিক্সের লেখা, বিবাহ-বিচ্ছেদের বর্ণনা, ‘পেরেন্টস’ ম্যাগাজিন থেকে প্রফেসর ওভারস্ট্রীট, অ্যালফ্রেড অ্যাকলার আর উইলিয়াম জেমসের রচনা পর্যন্ত। এ ছাড়াও আমি একজন অভিজ্ঞ গবেষকের সাহায্য নিই–নানা গাঠাগারে আমি পড়তে পারিনি এমন সব বই তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে ঘেঁটেছেন। সে সব বইয়ের মধ্যে ছিল মোটা মোটা মনোবিজ্ঞানের বই, শয়ে শয়ে সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ ইত্যাদি। অসংখ্য জীবনী ঘেঁটেও তিনি জানার চেষ্টা করেছেন যুগে যুগে মনীষীরা মানুষের সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করেছেন। আমরা সব যুগের মহাপুরুষদের জীবনী পাঠ করি। জুলিয়াস সীজার থেকে শুরু করে টমাস এডিসন পর্যন্ত সমস্ত বিখ্যাত নেতাদের জীবনীই আমরা পড়ে ফেলি। আমার মনে পড়ছে আমরা শুধু থিয়োডোর রুজভেল্টেরই প্রায় শ’খানের জীবনী পড়ে ছিলাম। আমরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষকে জয় করতে আর প্রভাব বিস্তার করতে যে কার্যকর ধারণা পোষণ করেছে তার প্রতিটি আবিষ্কার করার কাজে আমরা সময় আর অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করবো না।

.

আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিই, তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত। তাদের মধ্যে ছিলেন মার্কনী, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ওয়েন ডি, ইয়ং ক্লার্ক, গেবল, মেরী পিকফোর্ড, মার্টিন জনসন। এই সব খ্যাতনামাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি জানার চেষ্টা করি মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা কি কৌশল কাজে লাগিয়ে ছিলেন।

এই সব মালমশলা দিয়ে আমি ছোট্ট একটা কথিকা তৈরি করলাম। আমি এর নাম দিলাম”প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ”। এটাকে ছোট্ট বলার কারণ আছে। গোড়ায় এটা ছোট্টই ছিল। তবে বর্তমান এটা বেড়ে উঠে প্রায় দেড় ঘন্টার এক বক্তৃতাতেই পৌঁচেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে নিউইয়র্কের কার্নেগী ইনস্টিটিউটে প্রাপ্তবয়স্কদের সামনে সে বক্তৃতা আমি দিয়ে গেছি।

.

এই বক্তৃতা দিয়ে আমি তাদের অনুরোধ করেছি সেটা তাদের ব্যবসা আর সামাজিক যোগাযোগে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা করতে, তারপর আবার ফিরে এসে আমাদের জানাতে তাদের অভিজ্ঞতা আর ফললাভ কেমন হলো। সত্যিই চমৎকার একটা দায়িত্ব! এই সব স্ত্রী-পুরুষ যারা স্বভাবতই আত্মোন্নতির জন্য লালায়িত, তারা নতুন ধরনের কোন গবেষণাগারে কাজ করার প্রেরণায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বয়স্কদের জন্য মানবিক সম্পর্কের এমন গবেষণাগার বলতে এটাই একমেবাদ্বিতীয়। এমন আর ছিল না।

এ বইটি ঠিক বই লেখা বলতে যা বোঝায় তেমনভাবে লেখা হয় নি। শিশু যেমন করে বেড়ে ওঠে সেভাবেই এটা বেড়ে ওঠে। এ বই সেই গবেষণাগারে লালিত হয়ে বেড়ে ওঠে-সে বেড়ে ওঠা হাজার হাজার বয়স্কদের অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়ে।

বেশ ক’বছর আগে প্রায় পোস্ট কার্ডের আকারের একখানা কাগজে আমরা কিছু নিয়ম ছাপিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করি। পরের বছর আরও বড় একখানা কার্ড ছাপালাম, তারপর একখানা পত্রিকা, তারপর এলো পরপর কতকগুলো ছোট বই। এদের প্রত্যেকটাই আকারে আর উদ্দেশ্যে প্রসারিত। আর এখন পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ফলশ্রুতিতে এসেছে এই বইটি। এ বইতে যে সব নিয়ম আমরা লিপিবদ্ধ করেছি তা শুধু তত্ত্ব বা অনুমান নয়। যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক আমি দেখেছি এই নীতি কাজে লাগিয়ে বহু মানুষের জীবনে সত্যিই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি : গত বছর এই পাঠ গ্রহণ করতে আসেন এমন একজন যার প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ৩১৪ জন। বেশ কবছর যাবৎ তিনি তাঁর কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ আর সমালোচনাই করে এসেছেন। সহৃদয় ভঙ্গি, কাজে প্রশংসা বা উৎসাহ দান তার মুখে কখনও কেউ শোনেনি। এ বইতে যে নীতির কথা আছে সেগুলো পড়ার পর ওই নিয়োগকর্তাটির জীবন দর্শন অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। তাঁর প্রতিষ্ঠানে আজ জন্ম নিয়েছে এক নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রেরণা, নতুন নিষ্ঠা আর সহযোগিতার আদর্শ। তিনশ চৌদ্দজন শত্রু তিনশ চৌদ্দজন বন্ধুতেই আজ বদলে গেছে। তিনি স্বয়ং একবার ক্লাসের সামনে বেশ গর্বভরে বলেছিলেন : আমার প্রতিষ্ঠানে যখন হেঁটে ঢুকতাম কেউ অভ্যর্থনা জানাতো না বরং আমাকে আসতে দেখে আমার কর্মচারীরা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতো। কিন্তু আজ তারা সবাই আমার বন্ধু, এমন কি আমার দারোয়ানও আমায় নাম ধরে ডাকে।’

এই নিয়োগ কর্তাটির ব্যবসাতে আজ প্রচুর লাভ, তার অবসরও প্রচুর, আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তিনি তাঁর ব্যবসাতে আর পারিবারিক জীবনে অঢেল সুখ লাভ করেছেন।

অসংখ্য সেলসম্যান এই নিয়ম কাজে লাগিয়ে তাদের বিক্রির মাত্রা দারুণ বাড়াতে পেরেছেন। অনেকেই আবার খুঁজে পেয়েছেন জীবিকার নতুন দিগন্ত, নতুন পথ, যে পথ তারা আগে বৃথাই হাতড়ে ঘুরেছেন। কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাও তাদের ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। বাড়াতে পেরেছেন তাদের আয়। একজন কর্ণধার গতবছর জানিয়েছিলেন তার মাহিনা বছরে পাঁচ হাজারের মত বেড়ে গেছে বিশেষ করে এই বইয়ে লিখিত সত্যগুলো তিনি কাজে লাগান বলেই। আর একজন, ফিলাডেলফিয়া গ্যাস ওয়ার্কস কোম্পানীর এক কর্ণধার, তার কিছুটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মীদের সঠিকভাবে পরিচালনার অযোগ্যতার জন্য প্রায় পদাবনতির মুখোমুখি হন। এই শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁকে যে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে পদাবনতি থেকেই রক্ষা করেছিল তাই নয়, বরং পদোন্নতির সঙ্গে বাড়তি মাইনের সুযোগও এনে দিয়েছিল।

বেশ কয়েকবার পাঠক্রম শেষে কোন কোন সম্বর্ধনায় শিক্ষাগ্রহণকারী স্বামীদের স্ত্রীরা উপস্থিত হয়ে বলেছেন যে তাঁদের স্বামীরা এই শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে তাদের সংসারে সুখ শান্তি বেড়েছে।

বহুলোক এই শিক্ষা নিয়ে যে নতুন ফল লাভ করেন তাতে তারা প্রায়ই খুব আশ্চর্য হয়ে যান। সবটাই যেন যাদুবিদ্যার মত। মাঝে মাঝে উৎসাহের আতিশয্যে তাঁরা আবার রবিবারেও আমাকে বাড়িতে টেলিফোন করেছেন, কারণ আটচল্লিশ ঘন্টা অপেক্ষা করে আবার বক্তৃতা শুরুর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের সাফল্যের কথা জানানোর ধৈর্য রাখতে পারেন নি।

একজন আবার গত বছর এই নিয়মের উপর কোন আলোচনা শুনে এতই বিচলিত হয়ে পড়েন যে ক্লাসে বসেই অন্যান্য সকলের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা করে চলেন। রাত প্রায় তিনটের সময় বাকিরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন, কিন্তু তিনি তার নিজের কৃত ভুল বুঝতে পেরে আর সামনে এক নতুন ঝলমলে ভবিষ্যতের রঙীন হাতছানি দেখে তিনি এতোই উৎসাহিত হয়ে পড়েন যে তিনি ঘুমোতে পারলেন না। ওই রাতে তিনি ঘুমোতে তো পারলেনই না পরের দিন বা রাতেও পারলেন না। তার উপলব্ধি ছিল এমনই।

.

ভদ্রলোক কে হতে পারেন? কোন সাদাসিধে অশিক্ষিত মানুষ হঠাৎ নতুন কিছু তত্ত্ব পেলেই যিনি আঁকড়ে ধরতে পারেন এমন কেউ? না, তা নন–এ রকম কিছু মোটেই নয়? তিনি বেশ মার্জিত রুচির রাশভারি প্রকৃতির এক শিল্পের ব্যবসায়ী, শহরের নামজাদা মানুষ তিনি, দুটো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক আর তিনটে ভাষায় অনর্গল কথা বলতেও পারেন।

এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় এক প্রাচীনপন্থী অভিজাত জার্মান ভদ্রলোকের কাছ থেকে একখানা চিঠি পাই। ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষরা প্রায় সকলেই বংশানুক্রমে হোহেনজোলার্নদের হয়ে সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন। এক আন্ত-আটলান্টিক যাত্রীবাহী স্টীমার থেকে লেখা তাঁর চিঠিতে তিনি এই নিয়ম সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তাতে যেন ধর্মীয় শ্রদ্ধার স্পর্শ লেগে ছিল।

আর একজন, নিউইয়র্কের এক বিশ্বদ্যিালয়ের স্নাতক। সামাজিক স্তরে যার নাম বেশ উঁচুতেই। ভদ্রলোক বেশ ধনী আর মস্ত এক কার্পেট তৈরির কারখানার মালিক। তিনি জানিয়েছিলেন এই ধরণের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চৌদ্দ সপ্তাহে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল তাঁর চার বছরের কলেজ জীবনের শিক্ষার চেয়ে এটা অনেক বেশি শিখতে পেরেছেন। এটা কি অসম্ভব? হাস্যকর? না অকল্পনীয়? আপনি অবশ্যই যে কোন রকম বিশেষণ যোগ করেই এ বক্তব্য উড়িয়ে দিতে পারেন। আমি শুধু কোন রকম মন্তব্য ছাড়াই একজন রক্ষণশীল আর অত্যন্ত সফল হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের বক্তব্যই উল্লেখ করছি মাত্র। ভদ্রলোক তাঁর এই বক্তব্য রেখেছিলেন ১৯৩৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী কোন সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের ইয়েল ক্লাবে প্রায় ছ’শ শ্রোতার সামনে।

আমাদের যা হওয়া উচিত তার সঙ্গে তুলনা করলে হাভার্ডের বিখ্যাত অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস একবার বলেন, আমরা আসলে অর্ধ জাগরিত। আমরা শুধু আমাদের শারীরিক আর মানসিক ক্ষমতার একটা ক্ষুদ্র অংশই কাজে লাগাচ্ছি। আরও ব্যাখ্যা করে বললে বলতে হয় যে কোন একজন মানুষ তার ক্ষমতার তুলনায় ঢের অক্ষমতা নিয়েই জীবন কাটায়। সে তার মধ্যে জমে থাকা বহু বিচিত্র নানা ধরণের শক্তি স্বভাবতই কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়।

যে শক্তি আপনি স্বভাবতই কাজে লাগাতে ব্যর্থ সেই ঘুমন্ত আর অব্যবহৃত মূলধন আবিষ্কার করে তাকে উন্নত করে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই এই বইয়ের প্রস্তাবনা।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডঃ জন জি, হিবেন একবার বলেছিলেন, শিক্ষা হলো জীবনের নানা অবস্থার মোকাবিলা করার যোগ্যতা অর্জন।

এই বইয়ের প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদ পাঠ করার পরেও যদি আপনি জীবনের নানা অবস্থার মোকাবিলা করার কাজে কিছুটা অভিজ্ঞতা না সঞ্চয় করে থাকেন তাহলে অন্ততঃ আপনার ক্ষেত্রে ধরে নেবো এ বই লেখা ব্যর্থ। যেহেতু হাবার্ট স্পেন্সার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার যথার্থ উদ্দেশ্য হলো তাকে কাজে লাগানো, শুধু জ্ঞান আহরণ নয়।’

আর এ বই হল কাজে লাগানোরই বই।

এই ভূমিকা অন্যান্য সবরকম ভূমিকার মতোই একটু বেশি দীর্ঘ হয়ে গেল। অতএব এখানেই থামা যাক। এখন আসুন, সরাসরি কাজের কথায় আসি। আর দেরি না করে প্রথম পরিচ্ছেদ থেকেই পড়তে আরম্ভ করুন।

প্রথম ভাগ
জনসংযোগের প্রাথমিক কৌশল

প্রথম পরিচ্ছেদ
অন্যের সমালোচনা করবেন না

১৯৩১ সালের ৭ মে তারিখে নিউইয়র্ক শহরে দেখা গিয়েছিল সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এক মানুষ শিকারের দৃশ্য। প্রাচীন এ শহরটায় এমন দৃশ্য কেউ আগে দেখেনি। কয়েক সপ্তাহ খোঁজ করার পর ‘দু বন্দুকবাজ’ ক্রোলিকে কজা করেছিল পুলিশ। খুনী ক্রোলির ধূমপানে বা সূরায় আসক্তি ছিল না। সে ধরা পড়লো ওয়েস্ট এণ্ড অ্যাভিনিউতে তার প্রেমিকার আবাসে।

প্রায়শ’ দেড়েক পুলিশ আর গোয়েন্দা তার উঁচু তলার গোপন আবাস ঘিরে ফেলেছিল। ছাদের মধ্যে ফুটো করে তারা ‘পুলিশ খুনকারী’ ক্রোলিকে কাঁদানে গ্যাস ছড়িয়ে বের করার চেষ্টা করা হয়। এরপর পুলিশ আশেপাশের বাড়িতে মেশিনগানও বসালো–ঠিক তার পরেই প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে নিউইয়র্কের বিলাসবহুল আবাসন এলাকা জুড়ে শোনা যেতে লাগলো পিস্তলের শব্দ আর মেশিনগানের আওয়াজ। ক্রোলি মালপত্র বোঝাই একখানা চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে এক নাগাড়ে পুলিশের দিকে গুলি চালাচ্ছিল। দশ হাজার উদগ্রীব মানুষ লড়াই দেখে চললো। নিউইয়র্কের রাস্তায় এমন দৃশ্য আগে কখনও চোখে পড়েনি।

ক্রোলি ধরা পড়ার পর পুলিশ কমিশনার মালরুনি জানান দু-বন্দুকবাজ লোকটা নিউ ইয়র্কের ইতিহাসে ধরা পড়া সবচেয়ে সাংঘাতিক অপরাধী। কমিশনার আরও জানান, সে একটা পালক নড়লেও খুন করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ‘দু-বন্দুকবাজ’ ক্রোলির নিজের সম্পর্কে ধারণা কি রকম? আমরা তা জানতে পেরেছি কারণ পুলিশ যখন তার গোপন আস্তানায় গুলি চালাচ্ছিল সে তখন জনগণকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখছিল। লেখার ফাঁকে তার দেহের নানা আঘাত থেকে ঝরা রক্তের ধারা কাগজের বুকে লালচে আভা ফুটিয়ে তুলেছিল। চিঠিতে ক্রোলি লিখেছিল : আমার কোটের নিচে ঢাকা আছে এক ক্লান্ত অথচ দয়ার্দ্র হৃদয়-সে হৃদয় কারও ক্ষতি করে না।

এর অল্প কিছুক্ষণ আগে ক্রোলি লং আইল্যাণ্ডে এক গ্রাম্য রাস্তায় হৈ হুল্লোড়ে মত্ত ছিল। আচমকা একজন পুলিশ রাস্তায় রাখা ওর গাড়ির কাছে এসে বলে, ‘আপনার লাইসেন্সটা একবার দেখি।’

কোন কথা না বলে ক্রোলি বন্দুক বের করে পুলিশটিকে সীসের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। অফিসারটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই ক্রোলি গাড়ি থেকে নেমে তার রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে আরও একঝাঁক গুলি করলো। আর এই খুনীই কি না বলেছিল : ‘আমার কোটের নিচে ঢাকা আছে এক ক্লান্ত অথচ দয়ার্দ্র হৃদয়–সে কারও ক্ষতি করে না।’

ক্রোলিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। সে যখন সিং সিং কারাগারের মরণ কুঠিতে হাজির হলো তখন হয়তো তার বলা উচিত ছিল : মানুষ খুন করার পুরস্কার হিসেবে এটাই পাচ্ছি। কিন্তু না, সে যা বললো তা হলো : ‘আত্মরক্ষার বদলে এটাই আমি পেলাম।’

এই কাহিনীর বক্তব্য হলো এই : ‘দু-বন্ধুকবাজ’ ক্রোলি নিজেকে মোটেই দোষ দিতে চায়নি।

অপরাধীদের মধ্যে এটা কি কোন অবাস্তব আচরণ মনে করেন আপনারা? তা যদি ভাবেন তাহলে এটা একবার শুনুন।

‘আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো মানুষকে আনন্দ দেবার জন্যই ব্যয় করেছি, তাদের নানাভাবে সাহায্য করেছি, বদলে যা পেয়েছি তা হলো নিন্দা, আর তাড়া খাওয়া পলাতক কোন মানুষের জীবন।

এ হলো অল ক্যাপোনের কথা। জেনে রাখতে পারেন, সে ছিলো এখনও পর্যন্ত আমেরিকার জনগণের এক নম্বর শত্রু-শিকাগোতে সেই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাকাত দলের নেতা। ক্যাপোনও নিজের দোষ দেখতে পায়নি। সে আসলে নিজেকে জনগণের উপকারী বন্ধু বলেই ভাবতো-একজন অপ্রশংসিত জনসেবক আর জনসাধারণই তাকে ভুল বুঝে সম্মান দেয়নি।

ঠিক এই রকমই করেছিল ডাচ সুলজ, নেওয়ার্কে দুবৃত্তদলের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আগে। নিউইয়র্কের অন্যতম একজন জঘন্য ছুঁচো ডাচ সুলতূ খবরের কাগজে এক সাক্ষাৎকারে বলে সে একজন জনদরদী। সে নিজেও তাই বিশ্বাস করতো। সিং সিং কারাগারের ওয়ার্ডেন লয়েজের সঙ্গে আমার এই বিষয়ে বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক পত্রালাপ হয়। তিনি স্বীকার করেন, ‘সিং সিংয়ের খুব কম অপরাধীই নিজেকে দোষী বলে ভাবে। তারা আমার আপনার মতই মানুষ আর সেই কারণেই তারা যুক্তি খাড়া করে বোঝাতে চায়। ওরা বুঝিয়েও দিতে প্রস্তুত তারা কোন সিন্দুক কেন ভাঙে বা গুলিই বা চালায় কেন। ওদের বেশির ভাগই নানা রকম যুক্তি খাড়া করে তাদের সমাজবিরোধী কাজকর্মের সাফাই দিতে চায়, সে যুক্তি ভুল বা যুক্তিগ্রাহ্য যাই হোক। তাদের বেশ জোরালো শেষ কথা হলো তাদের কখনই আটক করা উচিত হয়নি।

যদি অল ক্যাপোন, ‘দু-বন্দুক বাজ’ ক্রোলি, ডাচ সুলজ বা জেলখানার ওই সাংঘাতিক লোকগুলো নিজেদের কোনভাবেই দোষী বলে না ভাবে–তাহলে আমরা যেসব মানুষের সংস্পর্শে আসি তাদের ব্যাপারটা কি রকম?

পরলোকগত জন ওয়ানামেকার একবার স্বীকার করেন : ‘ত্রিশ বছর আগে উপলব্ধি করেছিলাম কাউকে তিরস্কার করা বোকামি। আমার নিজের দুর্বলতাগুলো দূর করতে আমায় কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়নি কারণ এটা না বুঝে উপায় ছিল না যে ইশ্বর সকলকে সমান বুদ্ধি দেননি।‘

ওয়ানামেকার এ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বেশ আগে ভাগেই, কিন্তু আমার বেলায় তা হয়নি। প্রায় শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ হাতড়ে বেড়াবার আগে আমার উপলব্ধি হয়নি যে শতকরা নব্বই জন মানুষই নিজের দোষ দেখেও কখনও আত্ম-সমালোচনা করতে চায় না।

সমলোচনা করা বৃথা, কারণ এতে মানুষ সাবধানী হয়ে পড়ে আর স্বভাবতই সে নিজের কাজ সমর্থন করার পথ খোঁজে। সমালোচনা মারাত্মক জিনিস যেহেতু এটা মানুষের অহমিকাকে আঘাত করে, তার আত্মগর্বে চিড় ধরে আর তার ফলে সে সেটা ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করে।

জার্মান সেনাবাহিনীতে কোন সৈনিককে কোন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই কোন রকম অভিযোগ পেশ করতে বা সমালোচনা করতে দেওয়া হয় না। প্রথমে তার ক্রোধ প্রশমিত করে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলা হয়। সে যদি সঙ্গে সঙ্গে কোন অভিযোগ আনে তাহলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। ঈশ্বর জানেন, সাধারণ মানুষের জীবনেও এরকম কিছু লাইন থাকলে ভালো হতো–যেমন হাতশাগ্রস্ত বাবা মা, ঘ্যানর ঘ্যানর করা বউ বা পরের ছিদ্র খুঁজে ফেরা জঘন্য সব মানুষের জন্য।

ইতিহাসের হাজার হাজার পাতায় এরকম সমালোচনার অসারতার উদাহরণ খুঁজে পাবেন আপনারা। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় থিয়োডোর রুজভেল্ট আর প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের বিখ্যাত সেই ঝগড়া-যে ঝগড়ার ফলে রিপাবলিকান দল প্রায় ভেঙে যায় আর উড্রো উইলসন হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পেয়ে যান। এর ফলে বিশ্বযুদ্ধে তিনি আলোকোজ্জ্বল লেখার সৃষ্টি করে ইতিহাসের ধারাটাই বদলে দেন।

সব ব্যাপার একটু খতিয়ে দেখা যাক। ১৯০৮ সালে থিয়োডোর রুজভেল্ট যখন হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন তিনি ট্যাফটকে প্রেসিডেন্ট বানালেন। এরপর তিনি আফ্রিকায় সিংহ শিকার করতে চলে যান। ফিরে এসেই তিনি ফেটে পড়লেন। তিনি ট্যাফটকে তার রক্ষনশীলতার জন্য ভর্ৎসনা করে নিজেই তৃতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নতুন দল গঠন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ঝগড়াটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠলো। এর পরেই নির্বাচন এলো, তাতে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট আর তার রিপাবলিকান দলের দারুণ পরাজয় ঘটল-তারা মাত্র দুটো রাজ্য দখল করতে পারলেন–ভারমন্ট আর উটা। প্রাচীন দলটার এমন হার কখনও হয়নি।

.

থিয়োডোর রুজভেল্ট ট্যাফটকেই দোষ দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্যাফট কি নিজেকে দোষী মনে করেন? অবশ্যই না। অশ্রুসজল চোখে ট্যাফট বলেন : ‘আমি বুঝতে পারছি না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।’

এখন দোষটা কার রুজভেল্টের না ট্যাফটের? সত্যি কথা বলতে গেলে আমি সেটা জানি না,গ্রাহ্যও করি না। যে কথাটা বোঝাতে চাই তা হলো থিয়োডোর রুজভেল্টের ওই সমালোচনাতেও ট্যাফট নিজেকে দোষী বলে ভাবেন নি। বরং এটা সজল চোখে ট্যাফটকে আত্মসমর্পণ করতে আর ভাবতে বাধ্য করেছিল যে তিনি আর কিছু করতে পারতেন কি না।

এছাড়া ধরুন, টিপট ডোম তেল কেলেঙ্কারীর কথাটাই। ব্যাপারটা মনে আছে? ব্যাপারটা বছরের পর বছর খবরের কাগজে আলোড়ন তুলেছিল। সারা দেশেই এতে প্রায় কাঁপন ধরেছিল। আজকের দিনে যারা জীবিত আছেন তাঁরা জানেন আমেরিকার জনজীবনে এর চেয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড আর কখনও ঘটেনি সেই কেলেঙ্কারীর ব্যাপারটা ছিলো এইরকম : হার্ডিংয়ের মন্ত্রীসভার ইন্টিরিয়র সেক্রেটারি অ্যালবার্ট ফলের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় এক হিল আর টিপট ডোমের সংরক্ষিত সরকারি তেল ভাণ্ডার লিজ দিতে–এই তেল ভাণ্ডার নৌ বাহিনীর ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্যই রাখা ছিল। সেক্রেটারি কি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দর ডেকেছিলেন মনে হয়? না, তিনি ওই দারুণ লাভজনক চুক্তির ব্যাপারটা তার বন্ধু এডওয়ার্ড এল ডোহেনিকে দিয়ে দেন। ডোহেনি কি করলেন? তিনি তার বন্ধু সেক্রেটারি ফলকে ‘ধার’ হিসেবে দিয়েছিলেন প্রায় লাখ খানেক ডলার। তারপর সেক্রেটারির ফল প্রায় স্বৈরতান্ত্রিক পথে যুক্তরাষ্ট্রীয় নৌবহরকে ওই এলাকায় গিয়ে প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের ‘এক হিল’ রিজার্ভে তাদের তৈল রূপ স্তূপ ব্যবহার করা নিবৃত্ত করে হটিয়ে দেবার আদেশ দেন। প্রতিযোগিরা বন্দুক আর বেয়োনেটের মুখে হটে গিয়ে বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হলেন–আর তার ফলেই টিপট ডোমের দশ কোটি ডলারের কেলেঙ্কারী ফাস হয়ে গেল। এর ফলে যে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এলো সেটা এতই পচন ধরা যে হার্ডিং শাসন ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে গেলো। তাছাড়াও এরই সঙ্গে সারা দেশটা ঘৃণায় শিউরে উঠলো, রিপাবলিকান দলও এসে দাঁড়ালো ভাঙনের মুখে আর অ্যালবার্ট বি. ফলের জায়গা হলো কারাগারে। . ফলকে সকলেই প্রচণ্ডভাবে দোষারোপ করলোজনজীবনে এধরনের অভিযুক্ত কেউ হয়নি। কিন্তু তাতে তিনি কি অনুশোচনা করেছিলেন? কখনও না! বেশ কয়েক বছর পরে হার্বার্ট হুভার এক জনসমাবেশে বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হার্ডিংয়ের মৃত্যুর কারণ ছিল মানসিক বিপর্যয় আর দুর্ভাবনা। কারণ এক বন্ধু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মিসেস ফল যখন কথাটা শুনেছিলেন তিনি চেয়ার চেড়ে লাফিয়ে উঠে সজল চোখে নিজের ভাগ্যকেই ধিক্কার জানিয়ে চিৎকার করে ওঠেন : কি! হার্ডিংকে ফল বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? কখনও না। আমার স্বামী কোনদিন কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। এই বাড়িটা সম্পূর্ণ সোনায় মুড়ে দিলেও আমার স্বামী লোভে পড়বেন না। তারই সঙ্গে আসলে বিশ্বাসঘাতকাত করা হয়েছে আর যুপকাষ্ঠে তাকেই যীশুখ্রীষ্টের মত ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে।

এই হলো ব্যাপার, মানব চরিত্রের কাজই এই, দোষীরা সবসময়ই নিজেকে ছাড়া সকলকেই দোষারোপ করে চলে। আমরা সকলেই এই রকম। অতএব আপনি বা আমি যখন আজ বা কাল অন্য কাউকে সমালোচনা করার জন্য উৎসাহিত হবো তখন আমাদের মনে রাখা দরকার অল ক্যাপোন, ‘দু বন্দুকবাজ’ ক্রোলি আর অ্যালবার্ট ফলকে। আমাদের অনুভব করতে হবে সমালোচনা অনেকটা পোষা পায়রার মতই। এটা সবসময়েই নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। আমাদের আরও উপলব্ধি করতে হবে যে লোককে আমরা ঠিক পথে আনতে চাইছি বা দোষ দিতে চাইছি সে সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থণ করতে আর উল্টে আমাদেরই দোষারোপ করবে। তাছাড়াও হয়তো বা সেই শান্ত ট্যাফটের মতই বলবে, আমি বুঝতে পারিছ না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।

.

১৮৬৫ সালের ১৫ই এপ্রিলের এক শনিবারের সকালে আব্রাহাম লিঙ্কন সস্তাদরের এক সরাইখানার হলঘরের শয়নগৃহে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। সে ঘর ছিল ফোর্ডের নাট্যশালার ঠিক সামনের রাস্তায়, যে নাট্যশালায় রুথ তাকে গুলি করে। লিঙ্কনের দীর্ঘ দেহ অতি ছোট একখানা শয্যায় আড়াআড়ি অবস্থায় শায়িত ছিল। বিছানার ঠিক মাথার দিকে টাঙানো ছিল অত্যন্ত সস্তা রোসা বনহিউর বিখ্যাত ছবি ‘দি হর্স ফেয়ারের’ প্রতিলিপি আর ঘরের মধ্যে হলদে আলো ছড়িয়ে চলে ছিল একটা বিষণ্ণ গ্যাসের আলো।

মৃত্যু পথযাত্রী লিঙ্কনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘ওই যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।‘

.

জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে লিঙ্কনের সাফল্যের রহস্য কি? আমি দশ বছর ধরে আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী পাঠ করেছি আর তারই সঙ্গে তিন বছর ব্যয় করেছি অজানা লিঙ্কন’ নামে একখানা বই সংশোধন করে লিখতে। আমার বিশ্বাস কোনো মানুষের পক্ষে যা সম্ভব সেই ভাবেই আমি লিঙ্কনের ব্যক্তিত্ব এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছি; বিশেষ করে আমি জানার চেষ্টা করেছি লিঙ্কনের জনসংযোগের পদ্ধতিকে। তিনি কি সমালোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন? হ্যাঁ, তাই। ইণ্ডিয়ানার পিজিয়ন ক্রীক উপত্যকায় তরুণ বয়সে তিনি যে শুধু সমালোচনাই করতেন তা নয় বরং মানুষকে ব্যঙ্গ করার মধ্য দিয়ে তিনি চিঠি আর কবিতা লিখতেন। চিঠিপত্রগুলো তিনি আবার গ্রাম্য পথের বুকে ছড়িয়ে দিতেন যাতে সেগুলো অবধারিত ভাবেই পথিকের নজরে পড়ে। এই সব চিঠির মধ্যে একটার জন্য প্রচণ্ড আপত্তি ওঠে আর সেটা সারা জীবনই উত্তপ্ত জ্বালার সৃষ্টি করেছিল।

এছাড়াও লিঙ্কন ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ডে একজন ব্যবহারজীবী হিসেবে কাজ শুরু করার পরেও তিনি তার বিরোধীদের খোলাখুলি ভাবেই আক্রমণ করে খবরের কাগজে চিঠি প্রকাশ করতেন। একাজে একবার তিনি অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেন।

১৮৪২ সালের শরঙ্কালে তিনি জেমস শিল্ডস নামে এক গর্বিত অথচ কলহপ্রিয় আইরিশ রাজনীতিককে ব্যঙ্গ করেন। লিঙ্কন স্প্রিংফিল্ড জার্নালে এক বেনামা চিঠিতে ওই লোকটিকে ঠাট্টা করে কিছু লেখেন। সারা শহরই তাতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। স্পর্শকাতর আর গর্বিত শীল্ডস এতে প্রায় ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি খুঁজে বের করেন চিঠির লেখককে, তারপর তাঁর ঘোড়ায় চড়ে লিঙ্কনের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। লিঙ্কনকে পেয়েই তিনি তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। লিঙ্কন অবশ্য লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন–কিন্তু এ ব্যাপার থেকে তার বেরিয়ে আসার কোন সম্ভাবনাই ছিল না কারণ তাঁকে সম্মান বাঁচাতে হতো। তাঁকে অস্ত্র বেছে নিতে সুযোগ দেওয়া হলো। যেহেতু তার বেশ বড় বড় লম্বা হাত ছিল তিনি অশ্বারোহীর উপযুক্ত চওড়া তরোয়ালই বেছে নিলেন। তারপর ওয়েস্ট পয়েন্টের একজন স্নাতকের কাছে তরোয়ার খেলা শিখতে আরম্ভ করলেন। লড়াইয়ের দিনে লিঙ্কন আর শীল্ডস মিসিসিপি নদীর তীরে বালুকাবেলায় আমৃত্যু লড়াইয়ের জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রায় দুজনেরই বন্ধুরা এসে লড়াই বন্ধ করার ব্যবস্থা করলো।

লিঙ্কনের জীবনে এটাই বলতে গেলে সবচেয়ে জঘন্য এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এটাই তার কাছে মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক অমূল্য শিক্ষা। তিনি আর কখনই অপমানজনক চিঠি লেখেন নি বা আর কখনও কাউকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপও করেন নি। তারপর থেকেই প্রায় কোনদিন কাউকে তিনি সমালোচনাও করেন নি কোন কারণে।

গৃহযুদ্ধ চলার দিনগুলোর লিঙ্কন অটোম্যাকের যুদ্ধে একের পর এক সেনাবাহিনীতে নতুন নতুন সেনাপতি নিয়োগ করেন। সেই সব সেনাপতিদের মধ্যে একের পর এক আসেন ম্যাকক্লেলান, পোপ, বার্ণসাইড, হুঁকার। মীড–আর তাদের প্রত্যেকেই লজ্জাজকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় লিঙ্কন হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়েন। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ঐ সব অপদার্থ সেনাধ্যক্ষদের ক্রমাগত দোষারোপ করে চললেও লিঙ্কনের কিন্তু কারও প্রতি কোন বিমোগার ছিল না, বরং ছিল প্রত্যেকের প্রতি সহৃদয়তা। তিনি শান্তভাবেই সব মেনে নিয়েছিলেন। তার অতি প্রিয় উক্তি ছিল কারও সমালোচনা করো না, তাহলে নিজেও সমালোচিত হবে না।

মিসেস লিঙ্কন আর অন্যান্যরা যখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের কড়া সমালোচনা করতে চাইতেন, লিঙ্কন জবাব দেন : ‘ওদের সমালোচনা কোরো না, ওই অবস্থায় পড়লে আমরাও ওই রকমই করতাম।‘

.

তা সত্ত্বেও, কোন কারণে যদি কাউকে সমালোচনা করতে হতো তিনি ছিলেন নিশ্চয় লিঙ্কনই। একটা উদাহরণ দেখা যেতে পারে :

গেটিসবার্গের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিনে। ৪ঠা জুলাই রাতে শত্রু সেনাপতি লী দক্ষিণে পশ্চাদপসরণ করতে আরম্ভ করলে সারা দেশ মেঘে ঢাকা পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়, ফলে। লী যখন পটোম্যাক নদীর কাছে তার পরাজিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাজির হন তিনি সভয়ে দেখতে পান তার সামনে ফুলে ফেঁপে ওঠা ভয়ঙ্কর এক নদী, যেটা পার হওয়া অসম্ভব, আর তার পিছনে তাড়া করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় বিজয় বাহিনী। ফাঁদে পড়েছিলেন লী, তার পালানোর আর পথ ছিল না। ব্যাপারটা লিঙ্কন বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর হাতে এসেছিল ঈশ্বর-প্রেরিত এক সুবর্ণ সুযোগ-লী’র সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করার সুযোগ। অতএব দারুণ আশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিঙ্কন কোন সামরিক পরামর্শ সভা না ডেকে সঙ্গে সঙ্গে লীকে আক্রমণ করতে সেনাপতি মীডকে আদেশ করলেন। লিঙ্কন টেলিগ্রাফ করে লীকে আদেশ জানানোর পর বিশেষ এক দূত পাঠিয়েও মীডকে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে বললেন।

কিন্তু জেনারেল মীড কি করলেন? তাকে যা করার আদেশ দেওয়া হয় তিনি ঠিক তার উল্টোটাই করলেন। লিঙ্কনের হুকুম তিনি সরাসরি অগ্রাহ্য করে সামরিক পরামর্শ সভা ডাকলেন। তিনি ইতস্ততঃ আর দীর্ঘ সূত্রতা অবলম্বন করে লিঙ্কনকে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে নানরকম ওজর আপত্তি তুললেন। তিনি সরাসরি লীকে আক্রমণ করতে অস্বীকৃত বলে জানালেন। শেষ পর্যন্ত নদীর জল কমে গেলে লী তার সেনাবাহিনীসহ পটোম্যাক নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলেন।

ক্ষেপে আগুন হয়ে গেলেন লিঙ্কন। এসবের উদ্দেশ্য কি? লিঙ্কন চিৎকার করে তাঁর ছেলে রবার্টকে বলে উঠলেন। হা ঈশ্বর! এসবের মানে কি? শত্রুকে আমরা আমাদের হাতের মুঠোতে পেয়েছিলাম, শুধু হাত বাড়ালেই ওরা আমাদের হতো। তা সত্ত্বেও আমার কথায় বা আদেশে আমার সেনাবাহিনী একটুও নড়লো না। এমন অবস্থায় যে কোন সেনাপতিই লীকে পরাজিত করতে পারতো। ওখানে আমি থাকলে আমি লী-কে নিজেই চাবকাতে পারতাম।

তিক্ত হতাশায় লিঙ্কন ভেঙে পড়ে তৎক্ষণাৎ নিচের চিঠিটি লিখেছিলেন : একটা কথা মনে রাখবেন তাঁর জীবনের এসময়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল আর তাঁর বাগবিন্যাসেও যথেষ্ট সতর্কতা ছিল। অতএব ১৮৬৩ সালে লিঙ্কনের কাছ থেকে আসা চিঠিটার মধ্যে আসলে ছিল তীব্র তিরস্কার।

প্রিয় জেনারেল,

আমার বিশ্বাস হয় না আপনি লী-র পলায়নের মধ্যে যে বিরাট ব্যাপার এবং দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে আদৌ সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। সে সহজেই আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে গিয়েছিল, তাই তাঁর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, আমাদের ইদানীং কালের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের সমাপ্তিই ঘটতে পারতো। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল ধরেই চলবে। আপনি যদি গত সোমবার নিরাপদে লীকে আক্রমণ না করে থাকতে পারেন তাহলে কিভাবে আপনি তাঁকে নদীর দক্ষিণ দিকে মোকাবিলা করবেন–বিশেষ করে সঙ্গে যখন বেশি সৈন্য নিতে পারবেন না? সেই সেনার সংখ্যা তখনকার তুলনায় দুই তৃতীয়াংশও যখন হতে পারে না! আপনার কাছে এ সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু আশা করাই অন্যায় হবে আর আমি আশাও করি না আপনি বিশেষ কিছু করতে পারবেন। আপনার সুবর্ণ সুযোগ আপনি হারিয়েছেন আর এজন্য আমি আশাতীত রকম দুঃখ লাভ করেছি।

মীড যখন এ চিঠি পেলেন তখন সেটা পড়ে তিনি কি করেছিলেন বলে আপনাদের মনে হয়?

মীড চিঠিটা আদৌ দেখেন নি। কারণ লিঙ্কন আদৌ তা তাকে দেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর লিঙ্কনের কাগজপত্রের মধ্যে চিঠিটা পাওয়া যায়।

আমার ধারণা হলো–যদিও নিছক একটা ধারণা–যে চিঠিটা লেখার পর লিঙ্কন জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরে স্বগতোক্তি করেছিলেন, এক মিনিট অপেক্ষা করা যাক। মনে হয় আমার এতোটা তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। আমার পক্ষে হোয়াইট হাউসের শান্ত পরিবেশে বসে মীডকে আক্রমণ করতে হুকুম। দেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু আমি যদি গেটিসবার্গে থাকতাম আর মীড গত সপ্তাহে যে রক্তপাত দেখেছে তা দেখতাম, আহত আর মৃতকল্পদের কাতর আর্তনাদ যদি আমার কানে প্রবেশ করতো তাহলে হয়তো আক্রমণ করতে আমিও তেমন উৎসাহবোধ করতাম না। আমার যদি মীডের মত ভীরুতা মাখা মনোবৃত্তি হতো তাহলে সে যা করেছে হয়তো আমিও তাই করতাম। যাইহোক অনুশোচনা করে লাভ নেই। আমি যদি এ চিঠি ওকে পাঠাই তাতে আমি মানসিক শান্তি পাবো বটে কিন্তু পরিবর্তে মীড যেভাবে হোক আত্মসমর্পণ করে নিজেকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চাইবে। এটা হলে সে আমাকে দোষারোপ করতে চাইবে। এর ফলে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে তার সেনাপতি হিসেবে তার সব যোগ্যতা আর প্রয়োজনও নষ্ট হয়ে যাবে আর খুব সম্ভব এটার জন্য তাকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগে বাধ্য হতে হবে।

অতএব আমি যা আগেই বলেছি, লিঙ্কন চিঠিটা সরিয়ে রেখে দেন কারণ তিনি বুঝছিলেন তীব্র সমালোচনা আর নিন্দা নিঃসন্দেহে ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়। থিয়োডোর রুজভেল্ট বলেছিলেন যে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন কোন গভীর সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনি আরাম কেদারায় শরীর ছড়িয়ে হোয়াইট হাউসে তার ডেস্কের পিছনে টাঙানো লিঙ্কনের বিশাল ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন ‘আমার মত অবস্থায় পড়লে লিঙ্কন কি করতেন?’ তিনি নিজের সমস্যার সমাধান কি ভাবেই বা করতেন?

কখনও কাউকে কোন তিরস্কার করার আগে আমাদের উচিত পকেট থেকে একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে লিঙ্কনের ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা এমন সমস্যার সম্মুখীন হলে লিঙ্কন কি করতেন?

আপনার কি এমন কাউকে জানা আছে যাকে পরিবর্তিত করে তার উন্নতি ঘটিয়ে পরিচালিত করতে চান? চমৎকার! খুব ভালো কথা। আমিও মনে প্রাণে সেটা সমর্থন করি। তবে একাজ আপনার নিজেকে দিয়েই শুরু করছেন না কেন? এটাকে বেশ স্বার্থপরতার দৃষ্টিতেই দেখতে পারেন, এটা বরং অন্য কাউকে বদলে যাওয়ার চেষ্টার চাইতে অনেক বেশি লাভজনক–কথাটা নিছক সত্যি, আর ঢের কম বিপজ্জনকও বটে।

ব্রাউনিং একবার বলেছিলেন, কোন মানুষ যখন নিজের মধ্যেই সংগ্রাম শুরু করতে চায় তখন বুঝতে হবে তার কিছুটা মূল্য আছে। কাজটা ঠিক এখনই শুরু করলে আগামী বড়দিনের মধ্যেই হয়তো নিজেকে শুধরে নিতে পারবেন। হয়তো এর পরেই দীর্ঘ অবসরের পর নববর্ষের দিনগুলোয় অন্যান্য সব মানুষকে আপনি সমালোচনা করতে পারবেন।

তবে আগেই নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করে ঠিক করে নিন।

কনফুশিয়াস বলেছিলেন, ‘আপনার পড়শীর ছাদের অবস্থা দেখে অনুযোগ জানাবেন না যখন আপনার নিজের সদরই অপরিচ্ছন্ন।’

আমার বয়স যখন খুবই অল্প তখন মানুষকে প্রভাবিত করার বেশ চেষ্টা করতে চাইতাম। সেই সময় আমেরিকার সাহিত্যকাশে স্বমহিমায় বিরচণ করতেন যিনি, সেই রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসকে আমি একটা মূখের মত চিঠি লিখেছিলাম। আমি লেখকদের সম্বন্ধে এক সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ রচনা করছিলাম আর এই জন্যই ডেভিসকে অনুরোধ জানাই তাঁর কাজের পদ্ধতি আমায় জানাতে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে আমি একজনের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই, তার তলায় লেখা ছিল ‘এটা তিলিখিত, কিন্তু পঠিত হয়নি। আমার দারুণ ভালো লেগেছিল সেটা। আমার মনে হয়েছিল লেখক নিশ্চয়ই মস্ত একজন কেউ,হয়তো খুবই ব্যস্ত আর নামী। কিন্তু ব্যস্ততা আমার কণামাত্রও ছিল না, তা সত্বেও রিচার্ড ডেভিসের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মানোর জন্যই আমার চিঠির শেষে লিখে দিই তিলিখিত, কিন্তু পঠিত নয়।’

তিনি সে চিঠির কোন উত্তর দেননি। তিনি শুধু আমার চিঠিটার তলায় এ কথা কটি লিখে ফেরৎ দেন : ‘ভদ্রতার কণামাত্রও আপনার জানা নেই।’ কথাটা সত্যি, আমি খুব বোকামি করেছিলাম। তাঁর ওই গালাগাল আমার পাওনা ছিল। তবে আমি রক্ত মাংসের মানুষ বলেই সেটা সহ্য করতে পারিনি। আমার বিতৃষ্ণাটা এমন স্তরেই পৌঁছেছিলো যে দশ বছর পরে যখন রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করি তখনও কথাটা আমার মনে ছিলো–অবশ্য স্বীকার করতে আমার লজ্জাই হচ্ছে–কথাটা হলো, তিনি আমাকে আঘাত দিয়েছিলেন।

ধরুন আগামীকাল আমার আপনার মধ্যে একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলো–সেটা কিন্তু কয়েক দশক ধরেই জিইয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্তও থাকতে পারে। সামান্য সমালোচনা করে দেখা যাক, আর সেটা যতখানি যুক্তিসঙ্গতই আমরা ভাবি না কেন।

মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার সময় আমাদের মনে রাখা দরকার যে আমরা যুক্তিসহ কোন প্রাণীর সঙ্গে ব্যবহার করছি না। আমরা এমন কোন প্রাণীর সঙ্গে কারবার করছি যাদের রয়েছে ভাবাবেগ–এই প্রাণীরা টগবগ করছে সংস্কার নিয়ে আর তারা চালিত হয় অহঙ্কার এবং গর্ব নিয়ে। তাছাড়া সমালোচনা ভয়ঙ্কর একটা স্ফুলিঙ্গ-যে স্ফুলিঙ্গ অহমিকার কেন্দ্রবিন্দুতে বারুদের মধ্য বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে–যে বিস্ফোরণে কখনও কখনও মৃত্যুও ত্বরান্বিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেনারেল লেনার্ড উডকে সমালোচনা করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ফ্রান্সে যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে তার অহমিকায় যে আঘাত লাগে তাতেই বোধ হয় তার জীবন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল।

অত্যন্ত তিক্ত সমালোচনায় ইংরাজী সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ রত্ন টমাস হার্ডিকে চিরকালের জন্যই উপন্যাস লেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। এই সমালোচনাই আবার ইংরাজ কবি টমাস চ্যাটারটনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।

.

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যৌবনে খুবই ভোলামনের ছিলেন, অথচ তিনিই আবার পরবর্তী কালে এমন কুশলী আর জনগণের সঙ্গে ব্যবহারে এমনই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে তাঁকে ফ্রান্সে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। তাঁর সাফল্যের রহস্যটা কি? ফ্রাঙ্কলিন নিজেই বলেছিলেন :..আমি কাউকেই নিন্দা করবো না … সকলের মধ্যে যেটুকু ভালো সেটাই শুধু বলবো।

যে কোন মূখের পক্ষেই সমালোচনা, নিন্দা বা অভিযোগ জানানো সহজ কাজ–বেশিরভাগ মূর্খই তাই করে।

কিন্তু অপরকে বুঝতে পারা আর ক্ষমাশীলতা পেতে গেলে দরকার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর আত্ম সংযম।

কার্লাইল বলেছিলেন, ‘কোন মহান মানুষের মহত্বের প্রকাশ ঘটে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেন তার মধ্য দিয়ে। তাই মানুষকে নিন্দা না করে বরং তাদের বুঝতে চেষ্টা করি আসুন। চেষ্টা করে দেখা যাক তারা যা করে সেটা তারা কেন করে। এটাই সমালোচনার চেয়ে ঢের বেশি লাভজনক এবং কিছুটা বিহ্বলতাময়ও আর এর মধ্য দিয়ে আসে সহানুভূতি, ধৈর্য এবং দয়া ভাব। সবাইকে জানার অর্থই হলো সবাইকে ক্ষমা করা।’

ড. জনসন যেমন বলেছিলেন : ‘স্বয়ং ইশ্বরও মানুষের মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্ত তাকে বিচার করেন না।’

তাহলে আপনি বা আমি জীবিত লোকদের বিচার করব কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *