৩৪. প্রিওরি ইনক্যানটাটেম

৩৪. প্রিওরি ইনক্যানটাটেম

ওয়ার্মটেল হ্যারির কাছে এসে ওর বাঁধন খুলে দিলে হ্যারি কবরের পাথরের ওপর কোন রকমে কষ্ট করে পা রেখে দাঁড়াতে পারলো। পায়ে ব্যথা তীব্র।

হ্যারি ভাবল পালায়; কিন্তু পালাবে কেমন করে ডেথইটারস, ওয়ার্মটেল, ভোল্ডেমর্ট ওরে ঘিরে রেখেছে। তাছাড়া তখনও পায়ের ব্যথা সারেনি, দৌড়াবে কেমন করে? কোথায় একটুও ফাঁক নেই। ফাঁকা জায়গাটুকু ডেথইটাররা ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়ার্মটেল যেখানে সেডরিকের মৃতদেহ পড়ে আছে সেখান গিয়ে হ্যারির ম্যাজিক দণ্ডটা নিয়ে এল। দণ্ডটা ও হ্যারির দিকে ছুঁড়ে দিল। ওয়ার্মটেলের নতুন হাতটা ঝলসে উঠল।

ভোল্ডেমর্ট খনখনে গলায় অন্ধকার থেকে বললেন, কেমন করে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে হয় তা তুমি নিশ্চয়ই জান হ্যারি পটার?

হ্যারি সামনে তাকাল, দেখল ভোল্টেমর্টের চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। হ্যারির মনে পড়ে গেল বছর দুই আগেরকার কথা ও হোগার্টের ডুয়েলিং ক্লাবে যোগ দিয়েছিল। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ে। ও জানে ডিসআর্মিং স্পেল জাদুমন্ত্রের দ্বারা হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দেওয়া। এক্সপেলি আর্মস কিন্তু সেটা প্রয়োগ করেই বা কি হবে, শত্রুরা ওকে ঘিরে রেখেছে পালাবার পথ নেই। ওরা ওকে ধরে ফেলবে। একজনের কম করে তিরিশ জনের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। এইরকম কোনও লড়াই-এর কথাও সে কখনো শোনেনি। ও বুঝতে পারলো কেন ওকে সর্বদা মুডি মানা করে গেছে এই রকম খারাপ পরিস্থিতি থেকে সাবধানে চলার জন্য। আভাদা কেডাভ্রা কার্স থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন… ভোল্ডেমর্ট যা বলেছেন সঠিক বলেছেন। মা নেই যে নিজে মৃত্যুবরণ করে ওকে বাঁচাবেন আগের মতো। ও কবরস্থানে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

ভোল্ডেমর্ট ওর সাপের মতো মুখ করে সামান্য মাথানত করে বললেন–যুদ্ধের আইন–কানুন নিশ্চয়ই তুমি জান। এস তুমিও মাথানত করে সবরকম শিষ্ঠাচার শালীনতা বজায় রেখে এস শুরু করা যাক। ডাম্বলডোর নিশ্চয়ই তোমার আচরণে খুশি হবেন… এসো এবার, মৃত্যুকে আলিঙ্গন কর… হ্যারি পটার।

ভোল্ডেমর্ট শুধু তার ঠোঁটবিহীন মুখে আর ডেথইটাররা… বিশ্রি গলায় খলখল করে হেসে উঠল। হ্যারি মাথানত করলো না। ও কিছুতেই ভোল্ডেমর্টের হাতের খেলার পুতুল হবে না তাকে হত্যা করার আগে। ওকে কিছুতেই সেই সুখানুভূতি দেবে না।

ভোল্ডেমর্ট ওর হাতের জাদুদণ্ডটা তুলে ধরে বললেন–মাথানত করবে না করবে না? হ্যারির মনে হল কোনও অদৃশ্য শক্তিশালী হাত ওকে ধরে মেরুদণ্ডটা বেঁকিয়ে দেবার প্রবল চেষ্টা করছে। ডেথইটারদের হাসি থামে না, ওরা বিশ্রিভাবে হেসে চলেছে।

–বেশ, খুব ভাল, ভোল্ডেমর্ট বললেন। দণ্ড নিয়ে হাত উঠালেন। মেরুদণ্ডে অসম্ভব চাপ থাকা সত্ত্বেও হ্যারি ওর জাদুদটা তুলল।

হ্যাঁ, এবার তুমি মানুষের মতো আমার মুখোমুখি হও।… তোমার বাবার মতো… লড়াই করে মৃত্যুবরণ কর।

-এস, এবার আমরা দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু করি।

হ্যারি হাত তোলার আগেই, ভোল্ডেমর্ট হাত তুলে কুসিয়াটাস কার্স প্রয়োগ করলেন। হ্যারি যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। সর্বাঙ্গে আগুন ধরে গেছে মুগুড় দিয়ে যেন পিটাচ্ছে কেউ। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, এত যন্ত্রণা যে হ্যারি বুঝতে পারছে না কোথায় ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভোল্ডেমর্ট আবার কুসিয়াটাস কার্স প্রয়োগ করলেন… ওর মনে হল শত শত সাদা ছুরি ওর দেহের চামড়ার প্রতিটি ইঞ্চির ব্যবধানে বিদ্ধ হচ্ছে। ও তীব্র চিৎকার করে উঠল।

তারপরই সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। হ্যারি ভোল্ডেমর্টের পায়ের তলায় কাতরাতে কাতরাতে গড়িয়ে পড়ল। ঠিক ওইরকমভাবে ওয়ার্মটেল পড়েছিল–যখন ওর একটা হাত ভোল্ডেমর্ট কেটে দিয়েছিলেন। ও গড়িয়ে গড়িয়ে যেখানে ডেথইটাররা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেইদিকে গেলে ওরা ওকে পা দিয়ে ঠেলে দিল ভোমেটের দিকে।

-একটু বিশ্রাম, ভোল্ডেমর্ট মিষ্টি স্বরে বললেন। ওর নাকের ছোট্ট ফুটো দুটো উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। খুব কী লেগেছে হ্যারি, তুমি কী চাও আবার আমি তোমাকে এমন শাস্তি দিই?

–সেডরিকের মৃতদেহের দিকে হ্যারি তাকাল। ওর মতো কী মরে পড়ে থাকবে? ওর জীবনের সবকিছু শেষ। ভোল্টেমর্টের আদেশ পালন করা, ওর কাছে হাত জোড় করে মাথানত করার চাইতে মৃত্যু অনেক ভাল।

ভোল্ডেমর্ট বললেন–ওহ তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না? আবার আমাকে কার্স প্রয়োগ করতে বাধ্য করবে? জবাব দাও। ইমপেরিও!

জীবনে এই প্রথম হ্যারি অনুভব করল ওর শরীর থেকে সবকিছু উবে গেছে…. চিন্তা, ভাবনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা–সবকিছু। ও যেন হাওয়াতে ভেসে বেড়াচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে। জবাব দাও, না… বল না… জবাব দাও না

ভোল্ডেমর্টের চাইতে আরও শক্ত কণ্ঠে কে যেন বলল–না, আমি বলবো না, আমি তোমার কথার জবাব দেবো না।

ভোল্ডেমর্ট গর্জে উঠলেন, এখনও চুপ করে থাকবে?

বল না

আমি বলবো না!

হ্যারির কথাটা কবরস্থানের কবরে, গাছপালায়… অন্ধকারের পর্দায় ঘা লেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।… হ্যারি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। ঠাণ্ডাজল এসে ওকে ধুইয়ে দিল। কুসিয়াস কার্সের বেদনা–জ্বালা অনেকটা প্রশমিত হল যেন।

ভোল্ডেমর্ট খুব আস্তে উঠল,–তুমি তাহলে আমার আদেশ পালন করবে না? ডেথইটারদের হাসি তখন বন্ধ হয়ে গেছে।

–আচ্ছা তুমি আমার কথার জবাব দেবে না? শোন হ্যারি আমার কথা শুনলে তোমায় আর যন্ত্রণাকাতর হয়ে মরতে হবে না। মনে হয় আরও একটি ডোজ তোমার দরকার।

এইবার হ্যারি ওর কিডিচ খেলার খেল দেখাল। ও লাফিয়ে পড়ল এক ধারে, ভোল্টেমর্টের বাবার শ্বেত পাথরের কবরের ধারে। তারপরই কানে এল কড়কড় শব্দ, ভন্ডেমর্টের নিক্ষিপ্ত কার্স মিস হয়ে গেছে। ওর গায়ে লাগেনি। ভোল্ডেমর্ট কর্কশ কন্ঠে বলল,–হ্যারি, আমার সঙ্গে লকোচুরি খেলবে না। আমার সামনে এসে দাঁড়াও। দেরি করবে না… তোমার মৃত্যুটা যন্ত্রণাদায়ক হবে না… জেনে রাখবে আমার মৃত্যু হবে না, আমি অমর।

হ্যারি যে রকম ছিল তেমনই ভাবে শুয়ে রইল ভোল্ডেমর্টের কথাতে ও নড়বে … ওর বাবার মতই মৃত্যুবরণ করবে। হ্যারি জাদুদণ্ডটা নিয়ে দাঁড়াল…শক্ত করে ধরল। এক লাফে ভোল্টেমর্টের সামনে দাঁড়াল।

হ্যারি উচ্চস্বরে এক্সপেলিআরমাস বলতেই ভোল্ডেমর্ট চিৎকার করে বলল, আভাদা কেদাভরা।

ভোল্টেমর্টের জাদুদণ্ড থেকে সবুজ আলোক রশ্মি বেরিয়ে এল… হ্যারির দণ্ড থেকে লাল আলো ঠিকরে পড়ে… মাঝপথে ঠোক্কর খেল–সহসা হ্যারির হাতের জাদুদণ্ডটা কাঁপতে লাগল… ইলেকট্রিক চার্জ দেওয়ার মতো। হ্যারি দেখল লাল সবুজ আলোকরশ্মি এক হয়ে সোনালী হয়ে গেল। আরও আশ্চর্য হল, দেখল ভোল্টেমর্টের সাদা আঙ্গুল দিয়ে ধরা হাতের দণ্ডটাও কাঁপছে। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রয়েছে সেই সোনালী আলোর দিকে। ও, দেখল, ভোল্ডেমর্টের হাতটাও।

তারপরই ওরা দুজনেই মুখোমুখি হয়ে শূন্যে ভাসতে ভাসতে একটা মাঠের ওপর ধপাস্ করে পড়ল। ধূ–ধূ করছে সবুজ মাঠ একটিও কবর নেই। কানে এল ডেথইটারদের চিৎকার, ওরা ভোল্ডেমর্টের কাছ থেকে আদেশ চাইছে। ওরা নতুন করে দুজনকে ঘিরে ফেলল–বৃত্ত আরও ছোট হয়ে গেল।

নাগিন হিস হিস শব্দ করে ওদের পায়ের কাছে ঘুরপাক খেতে লাগল।

যে সোনার সুতোটা হ্যারি আর ভোল্ডেমর্টের জাদুদণ্ড জুরে রেখেছিল আরও সরু হয়ে গেল, ওদের জাদুদণ্ডগুলো কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে লেগে রইল। হ্যারি আর ভোল্ডেমর্টের মাথার ওপর, আশেপাশে হাজার হাজার নানা রঙের আলোর গুটি আতসবাজির মতো ঘুরতে লাগল। অথচ একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে না.. তারপর সেগুলো ধীরে ধীরে গোলাকার সোনালী গম্বুজের মতো হয়ে গেল… সেটাকে ঘিরে রইল মাকড়সার জালের মতো একটা চাদোয়া। অনেকটা আলোর খাঁচার মতো। এর বাইরে ডেথইটাররা খাঁচাটাকে ঘিরে শেয়ালের মতো মুখ তুলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল।

ভোল্ডেমর্ট ডেথইটারদের বলল–চেঁচামেচি করবে না। হ্যারি দেখল ওর কাল চোখ দুটো বিস্ফোরিত, কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ভোন্ডেমট সেই আলোর সুলতা ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করলেন। হ্যারির জাদুদণ্ডের সঙ্গে ভোল্টেমর্টের জাদুদণ্ড তখনও যুক্ত হয়ে আছে। হ্যারি ওর দণ্ডটা দুহাতে শক্ত করে ধরে রইল। সোনালী সুতো অটুট রইল। ভোর্টে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ডেথইটারদের বললেন, আমি না বললে কিছু করবে না।

তারপর এক স্বর্গীয় সুর বাতাসে ভেসে এল।… সুরটা ভেসে আসছে, আলোতে বোনা প্রতিটি সুতো থেকে… সেই সুরের মূর্ঘনায় হ্যারি, ভোল্ডেমর্ট কেঁপে কেঁপে উঠল।… সুরটা হ্যারির কাছে নতুন নয়… অনেক বছর আগে শুধু একবারই শুনেছিল।

একটা আশার আলো বয়ে নিয়ে এল সেই মধুর সুর… মনে হল সুরটা বাইরে থেকে নয় ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে।… শব্দটা ডাম্বলডোরের সঙ্গে যুক্ত… মনে হয় ওর এক পরম বন্ধু কানে কানে শোনাচ্ছে।

জাদুদণ্ডের সংযোগ ছিন্ন করবে না।

–আমি জানি, হ্যারি সেই মধুর সঙ্গীতকে ফিস ফিস করে বলল। আমি জানি… ছিন্ন করবো না! সঙ্গীতকে সেই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর জাদুদণ্ড আরও বেশি কাঁপতে লাগল… এত জোরে যে ও ধরে রাখতে পারছে না। দণ্ডটা প্রচণ্ড গরম হয়ে গেছে… মনে হল যেকোন সময় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে!… আলোর বিন্দুগুলো তখনও ওদের চারপাশে ঘুরছে। বিন্দুগুলো যত কাছে আসে… ততই হ্যারির দণ্ড জোরে জোরে কাঁপে।… ও সুনিশ্চিত দণ্ডটা অক্ষত থাকবে না–ভোল্ডেমর্টের দরে সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। এত উত্তপ্ত হয়ে গেছে আঙ্গুল দিয়ে আর হ্যারি ধরে রাখতে পারছে না ওর জাদুদণ্ডকে।

ভোল্ডেমর্টের জাদুদক্সে ইঞ্চিখানেক দূরে একটা আলোর গুটি কাঁপতে লাগল। হ্যারি তার জাদুদণ্ড দিয়ে আলোর গুটিগুলো যেখানে ইচ্ছে ঘোরাতে লাগল, কেন তা ও জানে না। ও সেই গুটি ভোমেটের দণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করাবার চেষ্টা করতে লাগল ধীরে–খুব ধীরে। গুটিটি সোনার সুতোর সঙ্গে ঘুরতে লাগল… সামান্য সময় কাঁপলো… তারপরই দণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল।

যুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভোল্ডেমর্টের জাদুদণ্ড থেকে যন্ত্রণাকাতর শব্দ বেরিয়ে আসল… তারপর প্রচণ্ড এক ধাক্কাতে ভোষ্টেমর্টের লাল চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। একটা কালো হাত ওর জাদুদণ্ডের মুখ থেকে বেরিয়ে এসে অদৃশ্য হয়ে গেল… যে ভৌতিক হাতটা ও ওয়ার্মটেলকে দিয়েছে সম্ভবত সেই হাতটা… তারপরই আরও বেশি যন্ত্রণাকতর চিৎকার… একটা বিরাট কিছু ভোল্ডেমর্টের দণ্ডের মুখ থেকে ফুটে উঠতে লাগল… একটা ধূসর বর্ণের কিছু… মনে হয় বোয়া থেকে কঠিন পদার্থে তৈরি হয়েছে… কিন্তু সেটা একটা মানুষের মুণ্ডুতে রূপান্তরিত হল… তারপর তার বুক…হাত… হ্যারি দেখল সেই মূর্তি সেডরিক ডিগরির!

হ্যারি ওর হাতের দণ্ডটা শক্ত করে আঁকড়ে রইল যাতে সোনার সুতোর আলো ছিন্ন না হয়। সেডরিক ডিগরির (সত্য না কী ভূত) ভূত ভোল্ডেমর্টের দণ্ডের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেডরিকের ছায়ারূপ দাঁড়াল, এধার–ওধার তাকাল, সোনার সুতোর আলোর দিকেও তাকাল… তারপর বলল,

–হ্যারি দণ্ডটা ধরে থাক। ছেড়ো না…। অদ্ভুত ওর কণ্ঠস্বর। ওর কথা যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে… প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হ্যারি ভোল্ডেমর্টের দিকে তাকাল, তার লাল চোখ দুটো তখনও বিহ্বল এমন একটা কিছু হয়ত আশা করেনি। হ্যারি ঠিক সেই সময়ে শুনতে পেল ডেথইটারদের ভয়ার্ত চিৎকার, সোনার গম্বুজের আশপাশে যেন ওরা কিছু দেখেছে। হ্যারি দেখল ভোল্ডেমর্টের দণ্ডের সরু ছিদ্র থেকে সেডরিকের মতো আরও একজন বেরিয়ে এল… এক বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধকে হ্যারি স্বপ্নে দেখেছে। সেই বৃদ্ধ অথবা ওর ছায়া, যাই হোক না কেন, সেডরিকের পাশে দাঁড়িয়ে হ্যারি ও ভোল্ডেমর্টকে দেখল।… সেই সোনার জাল, আর দণ্ড দুটি সংযোগ আলোকরশ্মি ওর ওয়াকিং স্টিকের গায়ে ঢলে পড়ল।

ছায়াভূত বৃদ্ধ বলল, ও একসময় আসল জাদুকর ছিল, চোখের দৃষ্টি ওর ভোল্ডেমর্টের ওপর। আমাকে ও হত্যা করেছিল… তুমি ওর সঙ্গে লড়াই কর বালক।

আবার ভোল্টেমর্টের দণ্ডের যন্ত্রণাকাতর স্বর। দণ্ডের ছিদ্র দিয়ে সেডরিক আর বৃদ্ধের মতো আরেকজন ছায়ামূর্তি আত্মপ্রকাশ করল। এক মহিলা। দণ্ডটা ধরে রাখতে হ্যারির হাত কাঁপছিল। মহিলা মাটিতে পড়েই সোজা হয়ে দাঁড়াল অন্যদের মত, তাকিয়ে রইল।

বার্থা জোরকিনসের ছায়ামূর্তি বড় বড় চোখ করে ওদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখতে লাগল।

–হ্যারি ওকে ছেড়ে দিও না। সেডরিকের মতই বার্থার কণ্ঠস্বর যেন বহু দূর থেকে ভেসে এল।–হ্যারি তুমি ওকে কিছুতেই ছেড়ে দিও না। ও তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।

সোনার জালের মধ্যে সেডরিক, বৃদ্ধ আর বার্থা জোরকিনস পায়চারি করতে লাগল… ডেথইটাররা বাইরে থেকে অস্থির চিত্তে তাকিয়ে রইল। ভোল্ডেমর্ট যাদের হত্যা করেছে তারা হ্যারির কানে ফিস ফিস করে ভোল্ডেমর্টের ওপর প্রতিশোধ নেবার কথা বলতে লাগল, এত আস্তে যাতে ভোমেন্টের কানে না যায়।

আবার একজনের মাথা ভোল্টেমর্টের জাদুদণ্ডের সরু প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল, হ্যারি তাকে দেখে চিনতে পারলো, তিনি কে হতে পারেন, সেডরিকের আবির্ভাবের পর থেকেই হ্যারি তাকেই যেন আশা করছিল। যিনি এলেন তার কথাই সারা রাত ধরে হ্যারি ভেবেছিল। বার্থার মতই সেই একটি মেয়ের ধোঁয়াটে ছায়া মাটিতে পড়ল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেই ছায়া হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারির হাত তখন অসম্ভবভাবে কাঁপছে… সামনে তাকিয়ে দেখল তার মায়ের ভৌতিক মুখ।

মা বললেন, তোমার বাবাও আসবেন হ্যারি। তোমার বাবা তোমাকে দেখতে চান। ভাল করে ধরে থাক… কিছু ভেব না… সব ঠিক হয়ে যাবে… ধরে থাক।

তারপর তিনি এলেন… প্রথমে তার মাথা, তারপর দেহ… লম্বা চেহারা, হ্যারির মতই অবিন্যস্ত মাথার চুল… ধোঁয়াটে ছায়া জেমস পটার ভোল্টেমর্টের জাদুদণ্ডের সংকীর্ণ ছিদ্র থেকে বেরিয়ে এল। স্ত্রীর মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হ্যারির দিকে একদৃষ্টে তাকাতে তাকাতে ওর কাছে গেলেন। অন্যদের মতো সমান দূরত্ব রেখে প্রতিধ্বনিত কণ্ঠে বললেন, সংযোগ ছিন্ন হলে আমরা তো বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আমরা তোমার সময় করে দেবো। যত শীঘ পারবে পোর্ট কীতে চলে যাবে… পোর্ট–কী তোমাকে হোগার্টে পৌঁছে দেবে। বুঝতে পেরেছ হ্যারি?

ভোল্ডেমর্ট তখন ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে… যাদের ও হত্যা করেছিল তারা সকলেই ওকে ঘিরে রয়েছে।

হ্যারির আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে জাদুদণ্ড সরে যাচ্ছে… যেকোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। ও আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ধরে রইল।

হ্যারি, সেডরিকের ছায়া দেহ বলল, আমার মৃতদেহটা ফেলে যেয়ো না ভাই… আমার মা-বাবার কাছে নিয়ে যেও।

দেরি করবে না হ্যারি, দৌড়াবার জন্য প্রস্তুত হও… ওর মৃত দেহ নিয়ে এখান থেকে পালাও, হ্যারির বাবা বললেন।

এখনই… হ্যারির আর যেন শক্তি নেই ওর জাদুদণ্ডটা ধরে রাখার। ও দণ্ডটা উপরের দিকে তুলল… দেহে যত শক্তি আছে তা দিয়ে। সোনার সুতো ছিন্ন হল, খাঁচাটা অন্ধকার হয়ে গেল… ফনিক্সের সঙ্গীত আর শোনা গেলো না… কিন্তু ভোল্ডেমর্ট যাদের হত্যা করেছে তাদের ছায়াদেহ দাঁড়িয়ে রইল। ওরা ভোল্ডেমর্টের পৈশাচিক দৃষ্টি থেকে হ্যারিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল।

হ্যারি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়াল। এত জোরে… জীবনে দৌড়ায়নি। যাবার সময় ওর দুচারজন ডেথইটারের গায়ে ধাক্কা লাগল।… পথটা সোজা নয় আঁকাবাঁকা ছোটবড় আধভাঙ্গা, ভাঙ্গা কবরের পাশ দিয়ে ও ছুটতে লাগল। বাবা বলেছেন, দেরি করলে চলবে না। যেমন করেই হোক সেডরিকের মৃতদেহ ওর বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।… দৌড়াবার সময় মাথায় অন্য কোনও চিন্তা নেই, পায়ে ব্যথা নেই… ওকে যা বলা হয়েছে তা করতেই হবে।

ও শুনতে পেল ভোল্ডেমর্টের গলা–ওকে যেতে দিও না ওকে আটকাও, পাথর করে দাও।!

আর মাত্র দশ ফিট দূরে সেডরিকের মৃতদেহে পড়ে রয়েছে। ফোয়ারার মতো লাল আলো এড়িয়ে যাবার জন্য একটা ত্রিকোণ শ্বেতপাথর দেখে ও লাফ দিল। যে জাদুমন্ত্রটা ওকে নিক্ষেপ করা হয়েছে তার আক্রমণে পাথরটার একটা কোণ থরথর করে কেঁপে উঠল। হাতের দণ্ডটা শক্ত করে ধরে সেটাকে পেছনে ফেলে এগোলো হ্যারি। পেছন ফিরে দেখল একদল ডেথইটার ওকে ধরবার জন্য ছুটে আসছে। ও কাঁধের ওপর দণ্ডটা রেখে গর্জন করে বলল, ইমপেডিয়ামেন্টা!

নিশ্চয়ই সেই মন্ত্রবলে দুএকজন কাবু হয়েছে। কারা হয়েছে, কজন হয়েছে পেছনে ফিরে দেখার সময় নেই। হ্যারি সেডরিকের মৃতদেহের পাশে ট্রাইউইজার্ড কাপটার ওপর দিয়ে লাফিয়ে হাত বাড়িয়ে সেডরিককে ধরতে গেল। অদূরে শুনতে পেল আরও অনেক আলো ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে… তারই সঙ্গে প্রবল গর্জন।

ভোল্ডেমর্ট তখন ওর অনেক কাছে এসে গেছে। চিৎকার করে বললেন, সরে যাও বলছি! আমি ওকে হত্যা করেছি… ও আমার।

হ্যারি তখন প্রায় সেডরিকের হাতের কব্জি ধরে ফেলেছে… ফারাক একটা কবরের ফলক আর অপর পাশে ডাম্বলডোর। কিন্তু সেডরিককে নিয়ে যাবে কেমন করে? ওর দেহটা বইবার ওর শক্তি নেই।… কাপটা তার নাগালের বাইরে।

অ্যাসিও! হ্যারি আবার গর্জন করে বলল, দণ্ডটার মুখ কাপের দিকে। কাপটা উড়তে উড়তে ওর কাছে এসে গেল… হ্যারি কাপের একটা হাতল ধরে ফেলল। তারপরই ওর নাভির চারপাশে ঝাঁকুনিতে বুঝতে পারলো পোর্ট–কী কাজ করেছে… ওকে দূরন্ত বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে চলল… সেডরিকের মৃতদেহকে ও জড়িয়ে রইল… ওরা ফিরে যাচ্ছে…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *