২৬. দ্য সেকেন্ড টাস্ক

২৬. দ্য সেকেন্ড টাস্ক

হারমিওন কিছুটা শুষ্ক কণ্ঠেই বলল, হ্যারি তুমি বলেছিলে ডিমের ক্লু পরীক্ষার কাজ তোমার হয়ে গেছে!

–আস্তে বল কেউ শুনতে পাবে, হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে বলল।–কেমন কাজ করছে আমার দেখার প্রয়োজন, ঠিক আছে না?

চার্ম ক্লাসে হ্যারি, রন ও হারমিওন পেছনের একটা বেঞ্চে বসে আলোচনা করছিল। সেদিন ওদের সামনিং চার্মের অনুশীলন করার ক্লাস ছিল। প্রফেসর ফ্লিটউইক সব বাধাবিঘ্নের বিরুদ্ধে কেমন করে ব্যানিশিং চার্ম (বিতাড়ন জাদু) দিয়ে প্রতিরোধ করবে ছাত্র–ছাত্রীদের সে সম্বন্ধে তত্ত্ব বোঝালেন। তত্ত্বটি ভাল হলেও কাজ ভাল করেনি।

–ডিমের প্রসঙ্গ এখন ভুলে যাও, বুঝলে? হ্যারি ফিসফিস করে বলল, তখন প্রফেসর ফ্লিটউইক ছাত্র–ছাত্রীরা কি করছে দেখার জন্য ঘুরছিলেন। আমি তোমাদের স্নেইপ আর মুডি সম্বন্ধে কিছু বলব, একটা ঘটনা ঘটেছে।

ফ্লিটউইকের ক্লাসটা ছাত্র–ছাত্রীদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা, আলোচনার জন্য স্বর্গরাজ্য বলা যায়। হ্যারি গতরাতের অভিজ্ঞতার কথা বলল। তা প্রায় আধা ঘণ্টা তো হবেই।

–তোমার কি মনে হয়–মুডি শুধু স্নেইপ নয় কারকারফের ওপরও নজর রাখছেন?

আমি ঠিক বলতে পারব না ডাম্বলডোর কি করতে বলেছেন; কিন্তু তিনি তাই . করছেন, হ্যারি বলল ঘরের মধ্যে উল্টা–পাল্টা কিছু হচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে। মুডি বলছেন, স্নেইপকে তিনি এখানে রেখে দিয়েছেন, তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ বা ওই রকম কিছু।

রন চোখ বড় বড় করে বলল,–কী বললে? হ্যারি আমার মনে হয় মুডির সন্দেহ স্নেইপ তোমার নামটা গবলেট অব ফায়ারে দিয়েছেন! হারমিওন বলল,–ওহ রন এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। আমরা এর আগে একবার ভেবেছিলাম স্নেইপ হ্যারিকে মেরে ফেলতে চান, কিন্তু শেষে জানা গেল তিনিই হ্যারির প্রাণ রক্ষা করেছেন, ব্যাপারটা মনে আছে? কথার মধ্যে ওরা ওদের পরীক্ষার কাজও চালাতে লাগল।

হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকাল, ভাবল, সত্যি বলতে কি, স্নেইপ একবার ওর জীবন রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু হ্যারির বাবাকে পছন্দ করতেন না। যখন তারা স্কুলে একসঙ্গে পড়াশুনা করতেন তখন থেকেই। সে কারণে হয়ত হ্যারিকে পছন্দ করেন না, হতে পারে। স্নেইপ সুযোগ পেলেই হ্যারির পয়েন্ট কেটে নেন, শাস্তি দিতে ভোলেন না, ওকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হোক, এমন কথা বলেন।

–হারমিওন বলল, আমি মুডির কথার গুরুত্ব দেই না। বুঝলে ডাম্বলডোর এত মূর্খ নন। তুমি জান প্রফেসর লুপিন আর হ্যাগ্রিডকে যখন কেউ কাজ দেয়নি, একমাত্র ডাম্বলডোর ওদের ডেকে চাকরি দিয়েছেন। স্নেইপকেও সে সময়ই চাকরি দিয়েছিলেন। যদিও স্নেইপ সকল সময় কিছু না কিছু দোষত্রুটি করেই থাকেন।

–স্নেইপ একটা শয়তান! তা না হলে ডার্ক উইজার্ড ক্যাচারস (যারা কাল জাদু করে তাদের ধরা)… ওরা অফিসে কেন ঢুকে তল্লাশি করবেন? তাহলে…? রন বলল।

হারমিওন রনের কথার কান না দিয়ে বলল–মি. ক্রাউচ যেন ভান করছেন তিনি অসুস্থ? কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয় বিষয়টা, তাই না? ইয়ুল বল নাচে আসতে পারলেন না অথচ যখন তার নিজের প্রয়োজন গভীর রাতে বের হয়েছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার!

রন বলল–তুমি ক্রাউচকে কেন পছন্দ করো না আমি জানি… কারণ সে–ই এলফ উইঙ্কীর কারণে…।

ওরা দু জনে প্রতিরোধের পরীক্ষার জন্য কুশন ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগল।

***

সিরিয়স হ্যারিকে জানিয়েছিলেন তাকে যেন হোগার্টে কি ঘটছে না ঘটছে তা জানায়। সেই রাতেই হ্যারি ব্রাউন আউল মারফত সিরিয়সকে ক্রাউচের দরজা ভেঙে স্নেইপের অফিসে ঢুকে কাগজপত্র সরানো, মুডি আর স্নেইপের কথাবার্তা সবই পরিষ্কার করে লিখে জানাল।

তারপরই সে জলের তলায় একঘণ্টা ডুবে থেকে প্রাণে বেঁচে থাকা যায় কেমন করে, সেই সমস্যা নিয়ে ভীষণভাবে ভাবতে লাগল। বেশি আর দেরি নেই চব্বিশে ফেব্রুয়ারি আসতে। সেই দিনটির জন্য ওর এই সমস্যাটি প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তো হ্যারি বলতে গেলে দিন–রাত লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়া শুরু করল। যদি কোথায় এমন এক জাদুমন্ত্র পাওয়া যায় যার সাহায্যে মানুষ জলের মধ্যে অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। হ্যারি–হারমিওন–রন সন্ধ্যা বেলা এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বইতে মুখ গুঁজে রইল। হ্যারি প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের কাছ থেকে লাইব্রেরীর রেস্ট্রিকেটেড সেকশনে যাবার অনুমতি পেয়েছে। লাইব্রেরিয়ান মাদাম পিনস-এর কাছ থেকে অনেক রকম সাহায্য পেয়েও হ্যারি বই ঘেঁটে ঘেঁটে কিছু পেল না, যাতে ও একঘণ্টা জলের তলায় থাকতে পারে।

নানা রকম গুজব হ্যারিকে প্রচুর দুর্বল করে দিতে লাগল। ক্লাসের পড়াশুনাতে মন বসে না, আবার আগের মতো হোমওয়ার্ক জমা হতে থাকে। ক্লাসরুম থেকে লেকের দিকে তাকালে বুক দুরু দুরু করতে থাকে। লৌহ–ধূসর ঠাণ্ডা বরফের মতো জল দেখে মনে হয় বহুদূরের চাঁদের মতো যেন দূরে রয়েছে।

ঘড়ির কাঁটা যেন জাদুমন্ত্রে অতি দ্রুত গতিতে ঘুরছে, এক ঘণ্টা যেন এক মিনিট! কে জানে সেই চব্বিশ তারিখ এত তাড়াতাড়ি আসছে কেন? আর মাত্র পাঁচটা দিন সময় হাতে। এর মধ্যে ওকে বেঁচে থাকার মন্ত্র জানতেই হবে।

আর মাত্র এক সপ্তাহ!

আর মাত্র তিনদিন!

দুদিন হাতে থাকতে হ্যারি টেনশনে অস্থির, তার খাওয়া–দাওয়া বন্ধ। সোমবার ব্রেকফাস্টে, ওর সুখকর সময় এলো, ফিরে এল ব্রাউন পাচা সিরিয়সের চিঠি নিয়ে। ও উদগ্রীব হয়ে পাচার পা থেকে গোল করে পাকান পার্চমেন্ট খুলে নিল। দেখল এক লাইন মাত্র লিখেছেন। সবচেয়ে ছোট চিঠি।

পাঁচা মারফত ও যেন অবশ্যই জানায়, কবে হগসমেডে সাপ্তাহিক ছুটি।

এত ছোট চিঠি! নিশ্চয়ই পার্চমেন্টের পেছনে আরও কিছু লিখেছেন! কিন্তু না… পেছনের দিকটাও শূন্য!

–পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটি! হারমিওন বলল। ও সিরিয়সের লেখা এক লাইন চিঠিটি হ্যারির পেছন থেকে পড়ে ফেলেছে। ও বলল–শোন আমার পালকটা নাও আর উত্তর দিয়ে প্যাঁচাটাকে সোজা ফেরৎ পাঠাও।

হ্যারি সিরিয়সের চিঠির পৃষ্ঠার পেছনেই দিনটি লিখে বাদামি পাচার পায়ে বেঁধে ওকে উড়িয়ে দিল। কিন্তু ও ভুলে গেল, সেদিনের রাতের ঘটনা–মুডি ও স্নেইপের কথা লিখতে। ডিমের কু ওর মাথায় এমন জট পাকিয়েছে যে এ মুহূর্তে অন্য কিছু আর ভাবতে পারছে না।

রন বলল–হগসমেডে সম্বন্ধে কেন জানতে চান বুঝতে পারলাম না।

হ্যারি বলল–কেমন করে বলবো।… পাচাকে দেখে মনের মধ্যে যে খুশির জোয়ার এসেছিল তা মিটে গেল।–চল, কেয়ার অব ম্যাজিক্যাল ক্রিচারসে যাওয়া যাক।

আজও ইউনিকর্নের লেশন মন দিয়ে ওরা করতে লাগল। ফিরে আসার পর হ্যাগ্রিড ভালই পড়াচ্ছে। প্রফেসর গ্রাবলি প্ল্যাংক থেকে সে মন্দ নয়, হয়তো তা প্রমাণ করার জন্য।

আজ ও ইউনিকনের শাবক ধরতে পেরেছে। তারা বড় ইউনিকনের মতো নয়, সোনার মতো রং। পার্বতী আর ল্যাভেন্ডর, বাচ্চা দুটোকে দেখে বেজায় খুশি… তারা শুধু নয় প্যানসি পারকিনসন অনেক কষ্টে ওর খুশির ভাব চেপে রাখে।

হ্যাগ্রিড ক্লাস নেবার সময় বললেন–ওদের বড় অবস্থায় ধরা সহজ। বছর দুই বয়স হলে ওদের রং রূপালি হয়ে যায়। চার বছর বয়স হলে বাচ্চা দেয়, সাত বছর বয়সে সাদা ধবধবে হয়ে যায়। ওদের গায়ে গলায় হাত দিতে ভয় পেও না। তোমরা ওদের চিনি দলা করে খেতেও দিতে পার।

ছাত্র–ছাত্রীরা যখন বাচ্চা ইউনিকর্ন দেখতে ব্যস্ত, হ্যারিকে তখন ঝিমিয়ে বসে থাকতে দেখে হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি তোমার শরীর ভাল আছে তো?

হ্যারি বলল–হ্যাঁ।

–ভয় পেয়েছ?

–খুব সামান্য, হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিড তার বিরাট মোটা হাতটা যারির কাঁধে রাখতেই হাতের ভারে ও একটু যেন দেবে গেল। বললেন–তুমি যখন হর্নটেলদের সঙ্গে লড়াই করছিলে… মিথ্যে বলছি না, সত্যি একটু ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানি তুমি সব ঠিকঠাক করতে পারবে। তাই একটুও চিন্তিত নই। তুমি পরীক্ষায় ঠিক উতরে আসবে। ও হ্যাঁ ডিম সম্বন্ধে কাজকর্ম শেষ হয়েছে?

হ্যারি মাথা নাড়ল। তাহলেও বলতে পারলো না পুরো একটি ঘণ্টা জলের তলায় থাকলে অবস্থাটা কি হবে। বাঁচবে, না মরবে? ও হ্যাগ্রিডের মুখের দিকে তাকাল…।

–ভয় পেও না। হ্যারি। তুমি ঠিক পারবে, হ্যাগ্রিড ওকে সাহস দিয়ে বললেন। আবার হ্যারির কাঁধে আদরের চাপড় দিলেন।

–সাহস হারাবে না হ্যারি, তুমি কখনও বিফল হবে না হ্যারি।

হ্যাগ্রিডের থাবায় ও যেন আরও ইঞ্চি দুই কর্দমাক্ত মাটিতে যেন দেবে গেল। আবার বললেন–আমি জানি… আমি অনুভব করছি তুমি জিতবে, হেরে যাবে না।… তুমি জিতবেই হ্যারি।

হ্যারি চাইল না, হ্যাগ্রিডের মন দমে যায়, মুখের হাসি মিলিয়ে যায় ওর আসল কথা শুনে। যে সে এখনো জানে না জলের তলায় কিভাবে বাঁচতে হয়। বাচ্চা ইউনিকর্নদের দেখে দারুণ মজা পেয়েছে, সেটা দেখাবার জন্য মুখে হাসি টেনে এনে ও অন্য ছেলেমেয়েদের দলে মিশে গেল।

***

দ্বিতীয় টাস্কের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা, হ্যারির মনে হতে লাগল ও যেন রাত্রের দুঃস্বপ্নের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। ও ভাবল কোন অলৌকিকভাবে যদি একটা নির্ভরযোগ্য জাদুমন্ত্র (স্পেল) পেয়ে যায় তাহলে সেটা ভালভাবে রপ্ত করতে সারারাত লেগে যাবে। কেন এমন অবস্থার সৃষ্টি হল? কেন ও সোনার ডিম পেয়েও আগে থেকে কাজ করেনি? কেন ও ক্লাসে কাজের কথা না ভেবে অন্য কথা ভাব কোনো শিক্ষক একবারও যদি বলতেন, জলের তলায় কেমন করে নিশ্বাস নেওয়া যায় তাহলে কি এমন হত? কিন্তু কেউ এক কণা আভাস দেননি।

সূর্যাস্তের পর ওরা তিন বন্ধু লাইব্রেরিতে গেল। ম্যাজিক মন্ত্রের যত বই আছে তার পাতার পর পাতা ওল্টাতে লাগল… যদি কিছু পেয়ে যায় কোনও বইয়ের পাতায় ওয়াটার শব্দটা চোখে পড়লে ওর বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ভাবে নিশ্চয়ই কিছু পেয়ে যাবে।… লেখা আছে দু পাঁইট জল, আধ পাউন্ড টুকরো টুকরো ম্যানড্রেট (আলুর মতো) পাতা আর একটি গোলাপ…।

রন একটা বই দেখতে দেখতে বলল,–বৃথা পরিশ্রম! মনে হয় কিছু মিলবে।… পুকুর বা দিঘি শুকিয়ে ফেলার কিছুই নেই… ড্ৰটটচার্ম (শুকনো করার জাদুমন্ত্র) সম্বন্ধে কিছুই লেখেনি।… সম্পূর্ণ একটা হ্রদ (লেক) শুকিয়ে দেওয়া দূরের ব্যাপার।

হারমিওন বলল–আছে আছে… নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। কথাটা বলে মোমবাতিটা দূর থেকে কাছে টেনে আনল।… ছোট ছোট অক্ষরে ছাপা পুরনো এবং ভুলে যাওয়া ডাকিনীবিদ্যা এবং জাদুমন্ত্র বইটাতে ও প্রায় মুখ গুঁজে বলল মনে হয় এমন কোনো টাস্ক নেই যা করা যাবে না।

–না–ও পারা যেতে পারে, রন বলল।

 হারমিওন বলল,–রন তোমার উল্টোপাল্টা কথা বলা থামাবে? সব জিনিসই সুষ্ঠুভাবে করার একটা পদ্ধতি আছে। একটা না একটা কিছু থাকতে বাধ্য!

হ্যারির মুখ দেখে মনে হয় লাইব্রেরিতে কোনও কিছু না পেয়ে খুবই ক্ষুব্ধ! সবটাই মনে করে ব্যক্তিগত অপমান ছাড়া কিছুই নয়। আজ পর্যন্ত কোনও কাজে ও অকৃতকার্জ হয়নি।

হ্যারি বলল–আমি জানি আমার কি করা উচিত ছিল। ও কৌলিদের জন্য কৌশল বইটা দেখতে থাকে। তারপর মুখ তুলে বলল–সিরিয়সের মতো অ্যানিমেগাস শেখা উচিত ছিল।

রন বলল–যখন ইচ্ছে তখন নিজে গোল্ড ফিশ হয়ে যেতে পার না।

হ্যারি বলল–তাহলে ব্যাঙ!… হ্যারি খুবই ক্লান্ত!

–বুঝলে অ্যানিমেগাস, শিখতে অনেক সময় লাগে। তারপর শেখার পর তোমার রেজিস্টার করা, আরও অনেক কিছু আছে। হারমিওন বলল। যাকগে শুরু করা যাক জাদুকরী ধাঁধা এবং সমাধান হারমিওন পড়তে লাগল, তালিকা বানান… যাকগে মনে রেখ… তোমাকে অবশ্যই তোমার নাম লিখিয়ে নিতে হবে জাদুর অনুচিত প্রয়োগ অফিসে… জানাতে হবে কি জg হবে, আর তোমার লক্ষ্য, তাহলে তুমি আইন ভঙ্গ করতে পারবে।

হ্যারি পরিশ্রান্ত গলায় বলল–হারমিওন আমি ঠাট্টা করছিলাম। আমি খুব ভাল করেই জানি আগামীকাল সকালে ব্যাঙের রূপ নিতে পারবো না।

হারমিওন উইজার্ডিং ডায়লেমা শব্দ করে বন্ধ করল, বলল–বাজে কোনও কাজের বই নয়… কারা তাদের নাকের চুল বাড়িয়ে রিং করতে চায়?

ফ্রেড উইসলি দূর থেকে বলল,–আমার কোনও অসুবিধে নেই।

হ্যারি, রন, হারমিওন দেখল ফ্রেড আর জর্জ!

 রন বলল–তোমরা লাইব্রেরিতে কেন এসেছ হে!

–কেন আবার তোমাদের খুঁজতে। শোন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল হারমিওনকে ডেকেছেন।

–কেন? হারমিওন একটু আশ্চর্য হয়ে বলল। ফ্রেড বলল–বলতে পারি না। ওনাকে দেখে দারুণ ক্রুদ্ধ মনে হয়েছে।

জর্জ বলল, তোমাদের দুজনকে নিয়ে যাবার হুকুম দিয়েছেন। এর বেশি কিছু জানিনে।

রন হারমিওন, হ্যারির দিকে তাকাল। ওর মুখ শুকিয়ে গেছে। তবে কী ম্যাকগোনাগল জানতে পেরেছেন যে কাজটা হ্যারির একা করার কথা, তা দুই বন্ধুর সাহায্যে দিন রাত করে চলেছে।

হারমিওন রনের সাথে ম্যাকগোনাগলের ঘরে যেতে যেতে হ্যারিকে বলল ফিরে এসে কমনরুমে আবার দেখা হবে। ওদেরও মুখ দেখে মনে হয় খুবই চিন্তি ত।… শোন যতগুলো পার বই নিয়ে যেও।

হ্যারি চিন্তিত মুখে বলল–আচ্ছা।

রাত আটটার সময় মাদাম পিনসে লাইব্রেরিতে এসে সব বাতি নিভিয়ে দিলেন। তারপর হ্যারিকে একরকম ঘর থেকে চলে যাবার জন্য তাড়া করলেন। হ্যারি যতগুলো বই নিতে পারে, কোন রকমে বগলদাবা করে গ্রিফিন্ডর কমনরুমে এল। বইগুলো টেবিলে রেখে ঘরের একটা কোন বেছে নিয়ে একটার পর একটা মোটামোটা বইয়ের পাতা উল্টোতে লাগল। ম্যাডক্যাপ ম্যাজিক ফর ওয়েকি ওয়ার লকস এ কিছু নাই, এ গাইড টু মিডিয়েভ্যাল সরসরিতেও না।… সাত–আটটি বই ভাল করে পড়ে একটাতেও কোনও নির্দেশ পেলো না।

কোথা থেকে কুক শ্যাংকস এসে ওর কোলে আরাম করে বসে পড়ল।… প্রায় সব বই শেষ হয়ে গেলেও বন ও হারমিওনের পাত্তা নেই।

হ্যারি নিজের মনে বলল, থাক পাওয়া গেল না। চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে, ওর বিরোধী পক্ষের সকলের হাসাহাসি, বিদ্রূপ কানে আসতে লাগল। দু কানে আঙ্গুল দিয়েও কানে আসতে লাগল ঠাট্টা, তামাশা, হাসাহাসি। তারপর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই পটার স্টিংকস। ফ্লেউর ডেলকৌর বলছে… ও তো বাচ্চা ছেলে।

হ্যারি তারপর ভীষণ রেগে লাফ দিয়ে উঠল। বেড়ালটা ওর কোল থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভীষণ রেগে হ্যারির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

হ্যারি ততক্ষণে প্যাঁচান সিঁড়িতে পা দিয়েছে। ডরমেটরিতে গিয়ে অদৃশ্য হবার আলখেল্লাটা পরে আবার ওকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে।… সারারাত ওখানে বসে বই ঘাটতে হবে।

লুমস। প্রায় পনের মিনিট পরে লাইব্রেরি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খুব আস্তে বলল : লুমস, দরজাটা খুলে গেল। ঘরে আলো নেই। হ্যারি ওর জাদুদণ্ডটা টর্চের মতো জ্বালিয়ে যেসব বই ওর দরকার র‍্যাক থেকে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখল।… সম্মোহন আর জাদুমন্ত্র, মের পিপল আর জল দৈতে, বিখ্যাত জাদুকর জাদুকরীদের প্রসঙ্গ, জাদু আবিষ্কার ইত্যাদি বিভিন্ন বহু পুরনো বই… তাছাড়া জলের তলায় বেঁচে থাকার উপায়… বই ও গোগ্রাসে পড়তে লাগল। মাঝে মাঝে সময় দেখার জন্য ঘড়ি দেখতে লাগল।

পড়তে পড়তে নিদারুণ আশঙ্কা আর ক্লান্তিতে ওর দু চোখ বন্ধ হয়ে এল। বহু চেষ্টাতেও ও দু চোখ খুলতে পারলো না। মনে হল ও প্রিফেক্টের বাথরুমও আবার গেছে, সেখানে বাথটবের কিনারায় বসে জলাশয়ের ধারে বিরাট একটা পাথরের চাই-এর ওপর বসে রয়েছে জলকন্যা। ও জলে পড়ে গিয়ে (জলটা বুঁদ বুদ করছে) একটা ছিপির মতো হাবুডুবু খেতে লাগল। জলকন্যা ওর ফায়ার বোল্টটা (ঝাড়ু) হাতে নিয়ে উঁচু করে বলল-এস এস এটা নেবে না! কথাটা বলে ও খনখনিয়ে হেসে উঠল-এস লাফ দিয়ে তোমার ফায়ার বোল্টটা নিয়ে যাও পটার।

–আমি পারবো না, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল। দিয়ে যাও দিয়ে যাও বলছি…। জলের তলায় তলিয়ে না যায় তার জন্য হাত তুলল।

কিন্তু মৎস্যকুমারী হ্যারিকে ওর ফায়ারবোল্ট ঝাড়ুর মুখ দিয়ে তো দিল, আবার সেই রকমভাবে হাসতে লাগল।

–ওটা সরিয়ে নাও, আমার পেটে ব্যথা লাগছে… উঃ! লাগছে।

–হ্যারিপটার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুন, স্যার!

–আঃ লাগছে, হাত সরাও… খোঁচা দিও না। হ্যারি বলল।

–ডব্বিকে হ্যারি পটারকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য খোঁচা দিয়েছিল। ডব্বি বলল।

হ্যারি চোখ খুলল। কোথায়–বাথরুম? ও তো তখনও লাইব্রেরিতে বসে আছে। ওর গা থেকে অদৃশ্য হবার ক্লোক খুলে গেছে ঘুমিয়ে পড়ার সময়। একটা গাল হোয়ার দেয়ার ইজ অ্যান্ড ওয়ান্ড, দেয়ার ইজ অ্যাওয়ে বইটার পাতায় চেপে আছে। ও চটপট সোজা হয়ে বসল। চশমাটা ঠিক করে পরে নিল…. চশমার কাঁচ দুটো ভোরের সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছিল।

–হ্যারি পটারের তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন। ডব্বি অনুরোধের সুরে বলল।

–হ্যারি পটারের তাড়াতাড়ি যেতে হবে; ডব্বি বলল–সেকেন্ড টাস্ক দশ মিনিটের মধ্যে শুরু হবে। আর হ্যারি পটার…।

–দশ মিনিট? হ্যারি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। দশ মিনিট… মাত্র দশ মিনিট?

হ্যারি হাত ঘড়িতে সময় দেখল। ডব্বি ঠিক বলেছে। এখন বেজেছে, নটা বেজে কুড়ি মিনিট। মনে হল বিরাট একটা ভারি কিছু ওর বুকে এসে পড়েছে… সেখান থেকে পেটে।

–তাড়াতাড়ি হ্যারি পটার; হ্যারির জামার হাত ধরে টেনে বলল।–আপনাকে যেতে হবে… বাকি সব চ্যাম্পিয়নরা লেকে এসে গেছে।

হ্যারি হতাশ হয়ে বলল,–অনেক দেরি হয়ে গেছে ডব্বি, আমি টাস্কে অংশ নেব না… আমি জানি না কেন…।

–হ্যারি পটারকে টাস্কে যেতেই হবে! এলফ আবার বলল–ডব্বি জানে হ্যারি পটার ঠিক বইটা পায়নি… তাই ডব্বি সেটা বের করে রেখেছে।

–কী বললে? হ্যারি বলল,–কিন্তু তুমি তো জান না সেকেন্ড টাস্ক কী?

–ডব্বি সব জানে স্যার… হ্যারি পটারকে লেকের জলের ভেতরে গিয়ে ওর হুইজি (Wheezy) খুঁজতে হবে।

–কী খুঁজতে হবে

–সেরপিপলদের কাছ থেকে তার হুইজি ফেরত নিয়ে আসতে হবে।

–হুইজি সেটা আবার কী?

ডব্বি ওর মেরন রংয়ের রনের দেওয়া সোয়েটারে টান দিল।

–কি বললে?… ওরা রনকে আটকে রেখেছে জলের তলায়?

–না গেলে হ্যারি পটার কেমন করে… এক ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করবে…।

হ্যারি মুখস্তের মতো বলল–আশা নেই। ভয়ে ভয়ে এলফের মুখের দিকে তাকাল।… অনেক অনেক দেরি হয়ে গেছে… ও ফিরে আসবে না। ডব্বি তুমি বল। এখন আমায় কি করতে হবে?

এলফ সবুজ রংয়ের হড়হড়ে গোলাকার জিনিস পকেট থেকে বের করে অনেকটা ধূসর–সবুজ ইঁদুরের ল্যাজের মতো লতপতে।-এখনই আপনাকে লেকে যেতেই হবে। স্যার–জিল্লি উইড খেতে হবে।

হ্যারি, ডব্বির জিল্লি–উইডের দিকে তাকিয়ে বলল,–ওটা নিয়ে কী করতে হবে?

-এটা ডুব দেবার আগে খেতে হবে। হ্যারি পটারকে জলের তলায় নিশ্বাস নিতে সাহায্য করবে স্যার!

–ডব্বি, হ্যারি একটু ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,–শোনো… তুমি সব জেনে বলছ তো?

হ্যারির মনে পড়ে গেল… ভুলতে পারে না ওর ডান হাতের হাড় জখম হবার পর ডব্বির সাহায্য।

ডব্বি নিশ্চিত হয়ে বলছে, স্যার! এলফ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল–ডব্বির সকলের সব কথা কানে আসে, স্যার। ও একজন হোগার্টের ভৃত্য… ওকে ক্যাসেলের সব কাজ করতে হয়… বাতি জ্বালান, ঘর পরিষ্কার করা, আগুন জ্বালান… ডব্বি স্টাফরুমে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ও প্রফেসর মুডির আলাপ শুনেছে… ওরা পরের টাস্কের কথা বলছিলেন… ডব্বি কখনও তার হ্যারি পটারকে তার হুইজিকে হারাতে দিতে পারে না!

হ্যারি, ডব্বির কথা শুনে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হবার আলখেল্লা খুলে ফেলে, ব্যাগের মধ্যে রেখে, জিল্লিউইডটা–ডব্বির হাত থেকে একদম ছিনিয়ে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে ছুটল লেকের দিকে।

ডব্বি বলল–ডব্বিকে এখন কিচেনে যেতে হবে, স্যার!… ডব্বি হ্যারি পটারের খেলা দেখতে পারবে না, স্যার।… গুডলাক!

–তোমার সঙ্গে পরে দেখা হবে ডব্বি! হ্যারি করিডলর দিয়ে যেতে যেতে বলল… ও এখনও সময় আছে।

ছাত্র–ছাত্রীরা ব্রেকফাস্ট সেরে গ্রেটহল থেকে তাড়াহুড়ো করে লেকের দিকে চলেছে। হ্যারি তাদের একরকম ধাক্কা দিয়ে লেকের দিকে ছুটল। হ্যারিকে দেখে দর্শকরা হৈচৈ করে উঠল। হ্যারি দেখল বিচারকরা লেকের অপর পারে গ্যালারিতে বসেছেন। তাদের প্রতিবিম্ব লেকের জলে পড়েছে। লেকের জল স্থির নয়, বুঁদ বুদ করছে। ও দেখল সেডরিক, ফ্লেউর আর ক্রাম বিচারকদের পাশে বসে রয়েছে। ওরা দেখতে পেল হ্যারি হন্তদন্ত হয়ে ওদের দিকে আসছে।

–আমি এসে গেছি, হ্যারি ভীষণভাবে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল। জল–কাদা এমনভাবে ছিটতে লাগল যে ফ্রেউরের রোবস-এ লেগে গেল।

একজন বেশ গম্ভীর গলায় বললেন–তুমি কোথায় ছিলে?… টাস্ক শুরু হবার তো সময় হয়ে গেছে!

হ্যারি বিচারকদের দিকে তাকাল। ক্রাউচ নেই… তার জায়গায় বসে রয়েছে পার্সি। ক্রাউচ তা হলে আসতে পারেননি।

লাডো বেগম্যান বললেন,–আর দেরি নয় পার্সি।

হ্যারি দেখল পার্সি উইসলি ওকে দেখে স্বস্তি পেয়েছে।.. ও বলল,–ওকে একটু নিশ্বাস নিতে দিন।

ডাম্বলডোর, হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কিন্তু কারকারফ আর মাদাম ম্যাক্সিমের মুখ দেখে মনে হয়, তারা একটুও খুশি নয় হ্যারিকে দেখে। ওরা হয়ত ভেবেছিলেন হ্যারি ভয় পেয়ে আসবে না।

হ্যারি দুহাঁটুতে হাত রেখে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। কিন্তু সময় নেই বিশ্রামের। লাডো বেগম্যান চারজনকে লেকের ধারে নিয়ে গিয়ে দশ ফিট অন্তর অন্তর দাঁড় করালেন। হ্যারি দাঁড়াল লাইনে সবার শেষে। ওর পাশে ক্রাম। ও পরেছে সাঁতারের পোশাক ও হাতে জাদুদণ্ড।

বেগম্যান ফিস ফিস করে বললেন,–তোমাদের সব ঠিক আছে তো?… আশাকরি কি করতে হবে। তোমরা ভাল করে বুঝতে পেরেছ?

হ্যারি ওর পাজরগুলো মালিশ করতে করতে বলল–হ্যাঁ।

বেগম্যান ঘুরে বিচারকদের চেয়ারে এসে বসলেন। তারপর দণ্ডটা কণ্ঠনালীতে চেপে (ওয়ার্ল্ডকাপে যেমন করেছিলেন) বললেন মনোরম! তার কণ্ঠস্বর লেকের গভীর কালো জলের ওপর দিয়ে ঢেউ ঢেউ খেলে ওধারের দর্শকদের স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছল।

–বন্ধুরা আমাদের চ্যাম্পিয়নরা দ্বিতীয় টাস্ক শুরু করার জন্য প্রস্তুত। আমার বাঁশির নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের কাছ থেকে যা নিয়ে নেওয়া হয়েছে তা ওদের আবার ফিরে পেতে একঘন্টা লাগবে। এক… দুই–তিন!

ঠাণ্ডা বাতাস…! সবকিছু যেন বরফ করে দিচ্ছে সেই বাতাস। সকলেই হি হি হি করে কেঁপে কেঁপে উঠছে… বেগম্যান হুইসেল ঠোঁটে লাগিয়ে তীব্রভাবে বাজালেন। হুইসেলের তীক্ষ্ণশব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ল।

চ্যাম্পিয়ন কারা, তারা কি করছে বা ভাবছে সেদিকে স নেই। হ্যারি ওর জুতো–মোজা খুলে ডাব্বির দেওয়া জিল্লিউইড পকেট থেকে বের করে তার থেকে খানিকটা নিয়ে মুখের ভেতর চালান করল। তারপর লেকের জলে নেমে একটু করে ডুব দেবার জন্য এগোতে লাগল।

 জল এত ঠাণ্ডা মনে হল ওর পায়ের চামড়া আগুনে ঝলসানোর মতো ঝলসে গেল। জলের তলায় ছোট ছোট পাথরের নুড়িগুলো পায়ের চাপে সরে যেতে লাগল। যত জোরে পারে জিল্লি উইড চিবিয়ে গিলে যেতে লাগল। তলতলে, রবারের মতো… অনেকটা অক্টোপাসের নরম শরীরের মতো। কোমর পর্যন্ত জলে নেমে হ্যারি থামল। বাকি অংশটা গিলে ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল কোনও রকম প্রতিক্রিয়ার জন্য।

ওর কানে আসতে লাগল ওর বিরোধী পক্ষের ছাত্র–ছাত্রী আর দর্শকদের বিচিত্র হাসি–বিদ্রূপ! কোনও রকম জাদুশক্তি না দেখিয়ে কোমর পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে থাকাতে তো সকলেই বোকা ভাববে, হাসবে, ঠাট্টা–বিদ্রূপ করবে। শরীরের যে অংশটা জলের বাইরে হিম–শীতল বাতাস যেন বরফ করে দিতে লাগল। মাথার চুলগুলো ঠাণ্ডা বাতাসে খাড়া খাড়া হয়ে গেল। কানে আসতে লাগল স্নিদারিয়নদের টিটকারি আর হাসি।

তারপর হঠাৎ মনে হল একটা অদৃশ্য বালিশ ওর মুখ আর নাক চেপে ধরল। নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করল; কিন্তু পারলো না। মাথার ভেতরে কিছু যেন লাফালাফি করতে লাগল। বুকের ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা, গলার দুপাশে তীব্র ব্যথা। ও দুহাতে কণ্ঠলালী চেপে ধরতে মনে হল দুকানের তলায় দুটো বড় বড় মাংসের টুকরো বরফশীতল হাওয়াতে দুলছে। হ্যারির মাথার ভেতর কিলবিল বন্ধ হয়েছে। আর কোনও কিছু না ভেবে কারও দিকে না তাকিয়ে ও জলে ডুব দিল। লেকের ঠাণ্ডা জলের প্রথম সেঁকটা পেটে যেতেই ওর মনে হল প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তারপর আরও দু–তিন টোক জল খাবার পর মনে হল কানের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে অক্সিজেন কুলু কুলু করে যেতে শুরু করেছে। ও দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখতে লাগল। হাত দুটো জলের ভেতর সবুজ আর আবছা কেমন যেন ভূতুড়ে ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মাকড়সার জালের মতো হয়ে গেছে।… ও এঁকে–বেঁকে ওর নিজের পা দুটোর দিকে তাকাল… দেখল পাতা দুটোও মাকড়সার জালের মতো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। দেখে মনে হল মাছের ডানার মতো…।

জল এমন আর বরফের মতো ঠান্ডা মনে হচ্ছে না… বরং কুসুম কুসুম গড়ম অনায়াসে সাঁতরে যাবার মতো হালকা। ওর পায়ের পাতা দুটো লতপত করছে। সমস্ত দেহটা হালকা হয়ে গেছে অবাধগতিতে জলের ভেতর ঘোরা ফেরার জন্য। সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, পিটপিট করে আর তাকাতে হচ্ছে না। তাহলেও সাঁতরাতে সাঁতরাতে লেকের তলদেশ তখনও যায়নি। ও আরও তলায় ডুবুরির মতো ডুব দিল। প্রায় জলের তলায় পৌঁছে গেল, অদ্ভুত এক শান্ত, সুন্দর পরিবেশ। প্রায় অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন পটভূমি। এত ঘন কুয়াশা যে দশ ফিটের দূরের কিছু দেখা যায় না। সেই অঞ্চলে হ্যারি বিস্ময়–বিহ্বল হয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। জীবনে এত আনন্দ ও পায়নি। কত রকমের ছোট ছোট সবুজ রংয়ের লতা–পাতা, চিরহরীৎ গাছ–গাছালি… চারপাশে ছড়িয়ে আছে মণি মাণিক্যের মতো পাথরের নুড়ি। ও প্রকৃতির অপূর্বতার মধ্যে নিজেকে সঁপে আনন্দে বিভোর হয়ে মাছের মতো সাঁতরাতে লাগল।

ওর পাশ দিয়ে ছোট ছোট রূপালী মাছগুলো শাণিত ফলার মতো ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল বিরাট আকারের কাল রংয়ের কিছু ভেসে যাচ্ছে। কাছে আসতে দেখল সেগুলো বিরাট বিরাট গাছের খন্ড। তাদের গায়ে লেপ্টে রয়েছে সবুজ শ্যাওলা আর গুল।… কিন্তু চ্যাম্পিয়নদের তো ও দেখতে পাচ্ছে না… মের পিপলস, রন কোথায় গেল? চারদিকে চোখে পড়ছে সবুজ তাজা ঘাস বেশ বড় বড়… বিস্মৃত সবুজ মাঠ। হ্যারি প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ পেছনে থেকে কে যেন ওর গোড়ালিতে টান দিল। পেছন ফিরে দেখল একটা গ্রিন্ডিলো (ক্ষুদ্র শিং–ওয়ালা জল দৈত্য)। ও গোড়ালিটা চেপে ধরে রইল। ওর সুঁচলো দাঁতগুলো শাণিত ছুরির মতো বেরিয়ে রয়েছে। হ্যারি গ্রিন্ডিলোকে সম্মোহিত করার জন্য মাকড়সার মতো সরু সরু আঙ্গুলগুলো পকেটে ঢোকাল জাদুদন্ত্রে জন্যে। তারই মধ্যে আরও তিন–চারটে গ্রিন্ডিলো ঝোপেড় আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওকে ধরে টানাটানি করতে লাগল। রিনাশিও হ্যারি দণ্ডটা হাতে নিয়ে ওদের দিয়ে তাকিয়ে গর্জে উঠল। কিন্তু গর্জনই সার… শব্দের বদলে মুখ থেকে বুদবুদ বেরিয়ে এল। জাদুদণ্ডের মুখ থেকে ফুটন্ত জল ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। ওদের সর্বাঙ্গ গরম জল লেগে লাল লাল ছোপে ভর্তি হয়ে গেল।… হ্যারি ওর পা টেনে নিয়ে আবার সাঁতরাতে লাগল। কোথা থেকে আরও ডজনখানেক গ্রিন্ডিলো এসে ওকে তাড়া করল। আঁকড়ে ধরতে গেলে হ্যারি ওদের লাথি মেরে হটাতে লাগল।… শেষ পর্যন্ত ওরা পরাস্ত হয়ে ওদের গাছ–পালার আস্ত পানায় পালিয়ে গেল। হ্যারি সাঁতারের গতি কমিয়ে দণ্ডটা পকেটে রেখে দিল। তারপর আবার চারদিকে তাকাল। নানা রকম বিচিত্র শব্দ কানে আসতে লাগল। কোনটাই অশ্রুতিমধুর নয়।

মাঝে মাঝে সেই শব্দ বিলুপ্ত হতে লাগল।… হঠাৎ সাঁতরাতে সাঁতরাতে ওর মনে হল ও জলের আরও যেন অনেক গভীরে এসে পড়েছে।

কেমন লাগছে হ্যারি পটার?

হ্যারির ঝাপসা ঝাপসাভাবে চোখে পড়ল কাঁদুনে মারটল (Myrtle) সামনে ভেসে যাচ্ছে। কাছে আসার সময় ওর মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে দুটো চোখ ড্যাব ড্যাব করে হ্যারিকে দেখছে।

–মারটল! হ্যারি জোরে জোরে ওর নামটা বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু মুখদিয়ে একটি শব্দও বের হল না। শুধু বড় দেখে দু একটা বুদবুদের সৃষ্টি করল। কাঁদুনে মারটল হাসল।

–তুমি ওধারটায় যেতে চাও? কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গে যাবো না, আমি ওদের একটুও পছন্দ করি না; কাছে গেলেই ওরা আমাকে তাড়া করে।

হ্যারি ওর হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা তুলে কাঁদুনে মারটলকে ধন্যবাদ জানাল। আবার এধার–ওধার সাঁতরাতে লাগল। খুব সাবধানে, বিশেষ করে ঝোপঝাড় এড়িয়ে… কে জানে কোথায় গ্রিন্ডিলোরা লুকিয়ে আছে!

কম করে হ্যারি কুড়ি মিনিট একনাগাড়ে সাঁতরে বেড়াল। যেখানে ও পৌঁছেছে, সেখানটায় কর্দমাক্ত জল। চাই চাই কাল কাদা। তার ওপর এদিকে যাবার সময় জল আরও ঘন আর ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে হ্যারির কানে আসতে লাগল টুকরো টুকরোভাবে ভূতুড়ে সুরের গান :

ঘণ্টা খানেক ওগো তোমায় দেখতে হবে,
তোমার আমরা যা নিয়েছি সবই তুমি পেয়ে যাবে…

আরও আরও জোরে হ্যারি সাঁতরায়, তারপর দেখতে পেল গভীর থকথকে কাদার মধ্যে বিরাট এক পাহাড় সদৃশ কাল পাথর। পাথরের গায়ে খুব সম্ভব মারপিপলদের অঙ্কিত ছবি; তাদের হাতে বর্শা,–তাড়া করছে বিরাট একটা সামুদ্রিক মাছকে। সেই গান শুনতে শুনতে পাহাড়ের মতো বিরাট পাথর ছাড়িয়ে ও অন্যধারে চলে গেল

আধা সময় গেছে তোমার, আর করো না দেরি
মরে পঁচতে না চাও যদি তো খোঁজ কর তাড়াতাড়ি…

হঠাৎ সেই পাহাড়ের আনন্দ থেকে কারা যেন ওর দিক লক্ষ্য করে অবিশ্রান্ত ভাবে নানা আকারের পাথর ছুঁড়তে থাকে। এলোপাতাড়ি। হ্যারি সামান্য দূর থেকে যারা ছুঁড়ছে তাদের মুখ দেখতে পেল। প্রিফেটদের বাথরুমে সে মৎস্যকন্যা দেখেছিল তার মতো কারও মুখ নয়।

ওদের গায়ের রং ধুসর, ঝকড়া–ঝাঁকড়া বন্য মানুষের মতো লম্বা লম্বা চুল। চুলের রং গাঢ় সবুজ, চোখ হলুদ বর্ণের দাঁতগুলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা। গলায় রংয়ের ছোট ছোট গোল পাথরের নুড়ির মালা। হ্যারির দিকে ওরা তেরছা চোখে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ পাহাড়ের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ওকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে। ওদের মাছের মতো শক্তিশালী বিরাট ল্যাজ মাঝে মাঝে জলে ঝাঁপট দিলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হতে লাগল।… ওদের প্রত্যেকেরই হাতে ফলক দেওয়া বল্লম।

হ্যারি প্রাণপণ শক্তিতে ওদের কাছ থেকে সরে আসার জন্য সাঁতার কাটতে লাগল। আরও অনেক ছোট ছোট পাথরের তৈরি বসতবাড়ি এপার–ওধারে দেখতে পেল। কোনও কোনও বসতবাড়ির সামনে পেছনে ফুলের বাগান। একটা বাড়ির সামনে পোম্বা একটা গ্রিন্ডিলো দেখতে পেল। মারপিপলরা তাদের বাড়ির চারদিক থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সকলেই হ্যারির দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। মাকড়সার মতো হাতের আঙ্গুল দিয়ে কেউ কেউ ওকে দেখায়। হ্যারি একটা কোনে আত্মগোপন করে রইল। তখন অদ্ভুত একদৃশ্য ওর চোখে পড়ল।

হ্যারি দেখল কাঁচারাস্তার ধারে শ্রেণীবদ্ধ গ্রামের বাড়ির মতো বাড়ি থেকে পিল পিল করে মারপিপলরা বেরিয়ে এসে ভাসতে ভাসতে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। ঠিক তাদের মাঝখানে বিরাট আকারের একটা মূর্তি। মূর্তিটার কোনও ছিরিছাঁদ নেই পাথর কেটে বানান। মূর্তিটা মারপিপলের। ওরা সকলে মূর্তিটাকে কেন্দ্র করে গান গাইছে। সেই মূর্তির পায়ের কাছে চারজনকে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। মারেরা তাদের গানের সাথে সাথে চ্যাম্পিয়নদের ডাকছে।

চারজনের মধ্যে মাঝখানে রন আর ওর দুপাশে হারমিওন আর চো চ্যাংগ। আরও একটি অল্প বয়সী মেয়ে, বছর আটেক বয়স হবে তার। মাথা ভর্তি রূপালী চুল। হ্যারির বুঝতে অসুবিধে হলো না। মেয়েটি ফ্লেউর ডেলাকৌরের বোন। ওদের দেখে মনে হল ওরা জেগে নেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওদের মাথাগুলো দুলছে। মুখের ভেতর থেকে স্রোতের মতো জলের–বুদবুদ বেরিয়ে আসছে।

হ্যারি ভয়ে ভয়ে, মনে দারুণ আশঙ্কা নিয়ে হোস্টেজদের (মারপিপলদের কাছে বন্দীরূপে আটকে রাখা) ওদের কবল থেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য এগোতেই, বিস্মিত হলো দেখে যে কেউ ওকে বল্লম তুলে আক্রমণ করলো না। যেমন ভাবে ভাসছিল তেমন ভাবে ভাসতে লাগল। শেকড়–বাকড় দিয়ে বানান দড়িটা বেশ মোটা… পাকাঁপোক্ত। ওর মনে পড়ে গেল ক্রিস্টমাসে সিরিয়সের উপহার দেওয়া একটা ছুরি। সেটা তো ও ট্রাঙ্কের মধ্যে রেখে এসেছে। এখন আর ফিরে গিয়ে চকচকে ছুরিটা আনার কোনও উপায় নেই। তাহলে উপায়?

ও চারদিকে তাকাল। অনেক মারেরা হতে বর্শা–বল্লম নিয়ে ওদের চারজনকে ঘিরে রেখেছে। প্রায় সাত ফুট লম্বা–লম্বা সবুজ দাড়ি শার্কের মতো বড় দাঁতওয়ালা একজন মারপিপলদের কাছে সাঁতরে গিয়ে আকারে–ইঙ্গিতে তার হাতের বল্লমটা ওকে দেবার জন্য অনুরোধ করল।

মারপিপল শুধু হেসে বলল–আমরা কাউকে সাহায্য করি না। ওর গলার স্বর রুক্ষ আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা।

হ্যারি মারমুখী হয়ে বলল-এগিয়ে এস! কথার বদলে ওর মুখ থেকে শুধু বুঁদ বুদ বেরিয়ে এল। তারপর হাত থেকে বল্লমটা ছিনিয়ে নিতে গেলে ও ঝাঁকি মেরে পেছনে হটে গেল।

লেকের তলদেশে ঘোট ঘোট পাথরের নুড়ি ইতস্তত পড়ে রয়েছে। হ্যারি ড্রাইভ দিয়ে সেখানে গিয়ে নুড়ির ভেতর থেকে খাজকাটা একটা নুড়ি বেছে নিয়ে মূর্তির সামনে দাঁড়াল। যে দড়িটা দিয়ে রনকে ওরা বেঁধে রেখেছে সেটা কাটার জন্য নুড়ির দিয়ে কোপাতে লাগল। বেশকিছুটা সময় লাগলেও খোদাতে খোদাতে মোটা দড়িটা কেটে গেল। রন মুক্ত হয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। তবে জলের তলায় তলিয়ে না গিয়ে কয়েক ইঞ্চি ওপরে। তখনও ও অচেতন।

হ্যারি আবার চারদিকে তাকাল। একজনও চ্যাম্পিয়নের কোনও হদিশ নেই। ওরা তাহলে এখন কী করছে? এত দেরী করছে কেন? ও হারমিওনের দিকে তাকিয়ে সেই খাঁজকাটা পাথরের টুকরোটা দিয়ে রনের মতই হারমিওনের বন্ধনটা কাটতে লাগল।

তৎক্ষণাৎ কয়েকটা শক্ত সমর্থ হাত ওর হাত চেপে ধরল। প্রায় আধডজন মারপিপল ওকে হারমিওনের কাছ থেকে টেনে নিয়ে গেল। ঠিক আগের মতই ওরা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগল।

একজন বলল, তুমি শুধু তোমার হোস্টেজকে (রন) নিয়ে যেতে পার। বাকিদের ছেড়ে দাও।

–না, যাবো না, হ্যারি মুখ থেকে কথার বদলে বুদবুদ বেরিয়ে এল।

–তোমার টাস্ক শুধু তোমার বন্ধুকে উদ্ধার করা, অন্যদের কথা ভাবতে হবে।

হ্যারি হারমিওনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তীব্রস্বরে বলল–সেও আমার বন্ধু। কথার বদলে দু ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একরাশ রূপালী বুঁদ বুদ বেরিয়ে এল। আমি চাই না ওদের মৃত্যু!

চোর মাথাটা হারমিওনের কাঁধে রাখাছিল। ছোট ছোট রূপলী চুলওয়ালা মেয়েটার মুখটা ভূতুড়ে সবুজ আর বিবর্ণ। হ্যারি মার পিপলদের সঙ্গে লড়াই করে অগ্রসর হতে চাইলো, কিন্তু ওরা ওকে ধরে রেখে আরও অট্টহাসিতে হাসতে লাগল। আর সব চ্যাম্পিয়নরা কোথায় লুকিয়ে আছে? ওর কি রনকে জলের ওপরে তুলে নিয়ে গিয়ে ফিরে এসে হারমিওনকে নিয়ে যাবার বা আর বাকিদের নিয়ে যাবার কি সময় হবে? সময় দেখার জন্য ও হাতঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।

তারপর হ্যারি দেখল মার পিপলরা ওর মাথার ওপরে আঙ্গুল তুলে উত্তেজিতভাবে কিছু দেখাচ্ছে। হ্যারি ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল সেডরিক ওদের দিকে সাঁতরে সাঁতরে আসছে। ওর মাথার ওপরে, চারধারে গাদা গাদা বুঁদ বুদ… ওর শরীরটা অদ্ভুত চওড়া আর মাত্রাছাড়া লম্বা দেখাচ্ছে।

–হারিয়ে গেছলাম! অসম্ভব আতঙ্কপীড়িত ওর মুখের ভাব। ফ্লেউর আর ক্রাম আসছে। সেডরিক বলল।

হ্যারির মন থেকে সব দুঃশ্চিন্তা দূর হলো। ও দেখল সেডরিক পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে চোকে মুক্ত করল। তারপর ওকে তুলে নিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

হ্যারি, ক্রাম আর ফ্লেউরের অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু ওরা এখনও আসছে না কেন? এদিকে তো সময় চলে যাচ্ছে। গানে তো বলেই দিয়েছে একঘণ্টার বেশি হলে হোস্টেজেদের হারাতে হবে!

হঠাৎ মারপিপলরা দারুণ চঞ্চল হয়ে উঠল। যারা হ্যারিকে ধরে রেখেছিল তাদের হাতের মুঠো শিথিল হয়ে গেল। ভয়ভীতি মুখে পেছনে তাকিয়ে রইল। হ্যারি পেছনে তাকিয়ে দেখল একটা বিরাট দৈত্যের মতো একটা কিছু জল কেটে কেটে তাদের দিকে আসছে। ওর দেহটা মানুষের মতো হলেও ওর নাক নেই, লম্বা গুঁড়… মাথাটা হাঙরের মতো…। সন্দেহ নেই ও ক্রাম। নিজের রূপ বদলেছে (ট্রান্স–ফিগারেসন করে)… তবে খুবই ভয়াবহ।

হাঙর–মানুষ সোজা হারমিওনের কাছে গিয়ে, ওকে বেঁধে রাখা দড়িটা কটমট শব্দ করে কাটতে শুরু করল। অসুবিধে ওর দাঁতের পাটি নিয়ে। ঠিকমত লাগেনি, তাই তাড়াতাড়ি কাটতে পারছে না। ক্রামের দড়িকাটা দেখে হ্যারি শঙ্কিত হলো। সামান্য অসাবধান হলে হয়ত হারমিওন দুটুকরো হয়ে যাবে। হ্যারি তাই হারমিওনকে বাঁচাতে ওর ক্রামের পিঠে খুব জোরে মেরে ওর হাতের ধারাল পাথরটা ক্রামের দিকে এগিয়ে দিল। ক্রাম পাথরটা নিয়ে দড়ি কেটে কেটে হারমিওনকে মুক্ত করল। দড়ি কাটতে ওর এক সেকেন্ডও সময় লাগলো না।

হারমিওনকে ধরে একবারও পেছনে না–তাকিয়ে জলের উপরিভাগে উঠতে লাগল।

কিন্তু… হ্যারি চিন্তায় পড়ল। ফ্লেউরকে ফেলে যায় কেমন করে? হাতে সময় নেই। দারুণ উত্তেজনায় ও ছটফট করতে লাগল ফ্লেউরের দেখা নেই কেন?

ক্রাম হারমিওনের দড়ি কাটার পর পাথরটা ফেলে দিয়েছিল। হ্যারি ডুব দিয়ে পাথরটা তুলে আনল। কিন্ত হ্যারিকে ওরা রন আর ছোট মেয়েটির কাছে যেতে না দিয়ে মাথা নাড়তে লাগল। হ্যারি ওর জাদুদণ্ডটা বার করে বলল–পথ ছাড় বলছি।

মুখ থেকে শুধু বুঁদ বুঁদ বেরোল… কথা নয়। তাহলেও ও মারপিপলদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সম্ভবত ওরা হ্যারিকে বলল বুঝতে পেরেছে… কারণ ওরা হাসি বন্ধ করেছিল। ওদের হলুদ বর্নের চোখ হ্যারির জাদুদণ্ডের দিকে পড়তেই… ভয় পেয়ে গেল।

–আমি তিন গুনব। কিন্তু মুখ দিয়ে কথার বদলে বুঁদ বুদ বেরোল। তাই হ্যারি হাতের তিনটে আঙ্গুল তুলে দেখাল যাতে ওরা বুঝতে পারে কি বলল।… এক (একটা আঙ্গুল ও নামাল)… দুই (দ্বিতীয়টা নামাল)

ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। হ্যারি এক মুহূর্তে সময় নষ্ট না করে মূর্তির পেছন থেকে এক হাতে ছোট মেয়েটার কোমর জড়িয়ে অন্য হাতে অচৈতন্য রনের রোবটা চেপে ধরল।

অনেক কসরৎ করে হ্যারি রন আর ছোট মেয়েটাকে নিয়ে জলের ওপর ভাগে নিজেকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উঠতে লাগল। ওপরে দ্রুত ওঠার জন্য হাত ও পার ফ্লীলার ব্যবহার করতেপারছে না, কারণ দুজনকে দুহাতে তুলতে হচ্ছে। পাও আটকে যাচ্ছে ওদের শরীরে। ওর মনে হল দুটো আলুর বস্তা দু হাতে নিয়ে ওপরে উঠছে। লেকের জল গাঢ় অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না… ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। মার পিপলরা ওকে ঘিরে রয়েছে বুঝতে পারলো। ওরাও ওর সঙ্গে ওপরে উঠছে দল বেঁধে। মনে হল… ওরা কী সময় শেষ হলে আবার টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাবে? গানের কলির মতো পচে মরে পড়ে থাকবে? ওরা কী সম্ভবত মানুষ খায়?

রন আর মেয়েটিকে নিয়ে জলের উপর ভাগে উঠতে হ্যারির খুব কষ্ট হতে লাগল। আবার ওর গলা ব্যথা করতে লাগল। ঘন ঘন মুখের ভেতর জল ঢুকতে লাগল তাহলেও ভাবনা হল অন্ধকার ভাবটা যেন কেটে যাচ্ছে। ওপরে মুখ তুলে সামান্য দিনের আলো দেখতে পেল। জল ভেদ করে আলো আসছে।

হ্যারির শরীর, একটু একটু করে যেন অসাড় হয়ে আসছে… পায়ে ফ্লিপার নেই। মস্তিষ্কে জল ঢুকেছে, অক্সিজেন কম, নিশ্বাস নিতে পারছে না। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। আরও একটু উঠতেই… মাথা তুলে দেখল জলের ওপরে ভেসে উঠেছে। চতুর্দিক থেকে ওর ভেজা মুখে ঠাণ্ডা হাওয়া কাটার মতো বিধছে, তাহলেও আর কষ্ট নেই–প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পাচ্ছে। ও হাঁফাতে হাঁফাতে রন আর ছোট মেয়েটাকে তুলে ধরল।

দর্শকরা ওদের দেখে আনন্দে, উত্তেজনায় চিক্কার, করতালি, হর্ষধ্বনিতে যেন ফেটে পড়ল। ওরা হয়ত ভেবেছিল তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাদের সেই ভয় আতঙ্ক ভুল প্রমাণ করল। রন আর মেয়েটি তাদের বন্ধ চোখ খুলল। মেয়েটির চোখে–মুখে তখনও ভয় আর সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে নিজেই যেন বুঝতে পারছে না। কিন্তু রন মুখ থেকে একরাশ জল বের করে উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাল। তারপর হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল আমি এত ভিজে গেছি কেন?… প্রশ্নের পর চোখ পড়ল ফ্লেউরের ছোট বোনের দিকে–তুমি একে এখানে এনেছ কেন?

হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–ফ্লেউর আসতে পারেনি, তাই আমি ওকে ফেলে আসতে পারিনি?

রন বলল,–ধ্যাৎ কি বকবক করছ। তুমি সেই গানটা মন দিয়ে শোননি, শুনেছ? ডাম্বলডোর থাকতে আমরা সবাই জলে ডুবে মরব, পচে যাব? না, না, না, আমাদের একজনকেও জলে ডুবে তিনি মরতে দেবেন না।–কিন্তু সেই গান?

–তোমরা সময় সীমার মধ্যে ফিরে আসতে পারছ কি না সেটাই আসল বিষয়, রন বলল–আশা করি জলের তলায় তুমি নায়ক হতে গিয়ে সময় নষ্ট কর নি।

হ্যারির একই সঙ্গে নিজেকে শুধু মূর্খ নয়, বিরক্তির কারণ মনে হল। ভাবল রন ঘুমিয়েছিল, ভালই ছিল। ওকে তো সেই সব ভয়ঙ্কর জিনিস জলের তলায় দেখতে হয়নি।

হ্যারি বলল–চল, আমরা জল থেকে উঠে পড়ি। আমাদের দুজনকেই তুমি সাহায্য কর। ছোট মেয়েটা মনে হয় ভাল সাঁতার জানে না।

সকলে মিলে ফ্লেউরের বোনকে লেকের তীরে তুলল। সেখানে বিচারকরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রায় কুড়িটি মারপিপল বিচারকদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমনভাবে যেন গার্ড অব অনার দিচ্ছে।… গানও গাইছে সেই বিরক্তিকর সুরে।

হ্যারি দূর থেকে দেখল মাদাম পমফ্রে হারমিওন, কাম, সেডরিক আর চোর সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলছেন। ওরা কখন উঠেছে ও জানে না। ওদের গায়ে মোটা কম্বল চাপানো। ডাম্বলডোর আর বেগম্যান তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওদের জন্যে। পার্সি আনন্দ–উজ্জ্বল মুখে দৌড়ে আসছে। আরও দেখল মাদাম ম্যাক্সিম ফ্লেউরকে যেন ধরে রাখতে পারছেন না। ফ্লেউর আবার লেকের জলে নামার জন্য পাগলের মতো হাত–পা ছুঁড়ছে।

–গ্যাবরিয়েলে! গ্যাবরিয়েলে! ও কী বেঁচে আছে…? কোনও আঘাত লাগেনি তো?

হ্যারি শুধু বলতে পারলো ও ঠিক আছে–বেশি কিছু বলতে পারলো না। দারুণ ক্লান্তি… দম ফুরিয়ে গেছে… কথা বলার শক্তি নেই। চ্যাঁচাক ফ্লেউর, প্রাণ ভরে চ্যাঁচাক।

পার্সি রনকে ধরে ধরে নিয়ে চলল বেগম্যান আর ডাম্বলডোর, হ্যারিকে সোজা দাঁড় করালেন। ফ্লেউর ওর ছোট বোনকে আদর করতে লাগল। মাদাম ম্যাক্সিম সেখান থেকে চলে গেলেন।

মাদাম পমফ্রে হ্যারিকে গ্রিন্ডিলো… বা অন্যসব বিষয় বলতে মানা করলো, কারণ কারকরফ সামনে দাঁড়িয়ে হ্যারির কথা শুনছিলো। পমফ্রে হারমিওনদের মতো হ্যারিকে মোটা কম্বলে মুড়ে রাখলেন। এত আঁট করে জড়িয়ে রাখলেন যেন স্ট্রেট জ্যাকেট পরে আছে (পাগলদের আয়ত্তে আনার জন্য শক্ত আঁট–সঁট জামা পরান হয়)… আর জোর করে গরম পোসান গিলিয়ে দিয়েছে। হারমিওন চিৎকার করে বলল–হ্যারি… হ্যারি তুমি দারুণ করেছ… তুমি একা সব কিছু করেছ।

–হ্যাঁ। হ্যারি ডব্বি সম্বন্ধে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কারকারফকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চুপ করে গেল। দেখল কারকারফ শুধু ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কারকারফ শুধু একমাত্র বিচারক, যিনি সিট ছেড়ে উঠেননি শুধু নয়, ওদের ফিরে আসাতে তার মুখে খুশির আভাস দেখা যায়নি। বা হ্যারি, রন আর ফ্লেউরের বোন নিরাপদে ফেরাতেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেননি।

তারপর ওরা শুনতে পেল লাডো বেগম্যানের গুরুগম্ভীর জাদুভরা কণ্ঠ। ছাত্র ছাত্রীরা, দর্শকরা সকলেই শান্ত হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন।

–উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমরা সবদিক বিচার করে সঠিক নির্ণয়ে পৌঁছেছি। লেকের জলের তলায় যা যা সত্যই ঘটেছে তা আমাদের মারচিফ টেইনেস মারকাস বলেছেন, এবং তার ভিত্তিতে আমরা প্রতিটি চ্যাম্পিয়নকে পঞ্চাশ নম্বরের ভিত্তিতে নম্বর প্রদানে উপনীত হয়েছি…

–মিস ফ্লেউর ডেলাকৌর যদিও সে সূচারুরূপে বাবলে–হেড–চার্ম প্রদর্শন করেছে, কিন্তু তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময় গ্রিন্ডিলোরা আক্রমণ করেছিল, এবং সে হোস্টেজেদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে তাকে পঞ্চাশের মধ্যে পঁচিশ পয়েন্ট আমরা প্রদান করছি।

দর্শকরা হর্ষধ্বনি দিল।

–আমার তাহলে শূন্য পাওয়া প্রাপ্য, ডেলাকৌর শুষ্ক কণ্ঠে বলল।

–মি. সেডরিক ডিগরি, সেও বাবলে–হেড–চার্ম ব্যবহার করেছিল। প্ৰদও সময়সীমা এক ঘণ্টা পার হয়ে এক মিনিট দেরিতে ফিরলেও ও প্রথম ওর হোস্টেজকে নিয়ে ফিরেছে। হাফপাফের দর্শকরা সেডরিককে প্রচণ্ডভাবে বাহবা দিতে থাকে। হ্যারি লক্ষ্য করল চো সেডরিকের দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে আমরা ওকে সাতচল্লিশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

হ্যারি দমে গেল। সেডরিক সময়সীমার বাইরে গেছে এক মিনিট মাত্র তাহলে ও?

–মি. ভিক্টর ক্রাম… অসম্পূর্ণ ট্রান্সফিগারেসন করেছে… মোটামুটি সেটা কার্যকরী হয়নি। ও হোস্টেজকে নিয়ে মি. ডিগরির পর পৌঁছেছে। আমরা ওকে চল্লিশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

হাততালি দিতে দিতে গর্বিত হয়ে তাকালেন কারকারফ ক্রামের দিকে।

মি. হ্যারি পটার খুব দক্ষতার সঙ্গে জিল্লিউইড ব্যবহার করেছে, বেগম্যান বলে চললেন। অবশ্য ও সবার শেষে ফিরে এসেছে… এক ঘণ্টা অতিবাহিত হবার পর। যাইহোক মার–চিফটেনেস জানিয়েছেন মি. পটার সর্বপ্রথম হোস্টেজদের কাছে পৌঁছেছিল, দেরি করার প্রধান কারণ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা–তার নিজস্ব হোস্টেজ ছাড়াও যারা রয়ে গেছে তাদের সঙ্গে নিয়ে ফেরা। এটা ওর সাহসি মানসিকতা… তার মূল্য আছে।

রন ও হারমিওন হ্যারির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল।

–বেশিরভাগ বিচারক এবং আমি, (কারকারফের দিকে শুষ্কভাবে তাকালো) মনে করি তার ওই কর্তব্যপরায়ণতা… খুবই দৃষ্টান্তস্বরূপ… ফুলমার্ক পাওয়ার যোগ্য… যাইহোক মি. পটারকে দেওয়া হচ্ছে পঁয়তাল্লিশ পয়েন্ট। হ্যারি অবশ্যই হতাশ হল। প্রথম স্থান অধিকার করতে পারলো না। রন–হারমিওন সামান্য আশ্চর্য হল… হ্যারির দিকে তাকিয়ে অন্যদের সঙ্গে হাততালি দিতে লাগল।

রন চিৎকার করে বলল,–দুঃখ করবে না হ্যারি… তুমি অসামান্য সাহস দেখিয়েছ।

ফ্লেউর খুব শব্দ করে হাততালি দিলেও, ক্রামকে দেখে মনে হয় খুব খুশি হয়নি। ক্রাম হারমিওনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দেখল ও হ্যারিকে চিয়ার্স জানাতে ব্যস্ত।

–আগামী চব্বিশ জুন সূর্যাস্তের পর তৃতীয় ও ফাইনাল টাস্ক হবে।, বেগম্যান বললেন।–চ্যাম্পিয়নদের বিষয়বস্তু জানিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের সকলকে চ্যাম্পিয়নদের সমর্থন করার জন্য ধন্যবাদ।

দ্বিতীয় টাস্ক সুস্থভাবে শেষ হতেই মাদাম পমফ্রে চ্যাম্পিয়ন ও হোস্টেজদের আপন আপন ক্যাসেলে গিয়ে ভিজে পোশাক পরিবর্তন করার আদেশ দিলেন। হ্যারি খুশি। এখন আর কোনও আশঙ্কা ও দুঃশ্চিন্তা নেই… অন্তত চবিশ জুন পর্যন্ত।

ও ক্যাসেলে যেতে যেতে ঠিক করল আবার যখন হগসমেডসে যাবে তখন ডবির জন্য এক জোড়া মোজা কিনবে, যাতে ও সারা বছর সেটা পরতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *