১৫. বক্সবেটন এবং ডার্মস্ট্র্যাংগ

১৫. বক্সবেটন এবং ডার্মস্ট্র্যাংগ

খুব ভোরে হ্যারি বিছানা ছেড়ে উঠল। সারারাত ভাল করে ঘুমোতে পারেনি। সিরিয়সকে কি লিখবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে। ভোরের আলো ঘরে এসে পড়েছে। হ্যারি রাতের পোশাক ছেড়ে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। রন তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ডরমেটরি থেকে বেরিয়ে ও কমনরুমে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে লেখার কাগজ ও কালি–কলম নিয়ে বসল। গতকালের কাগজপত্র ইত্যাদি তখনও টেবিলের উপর। ও লিখল

প্রিয় সিরিয়স,
আমার হঠাৎ মনে হচ্ছে কাটা দাগটায় জ্বালা করছে। আগে যে চিঠিটা আপনাকে লিখেছিলাম তখন আমি আধঘুমে ছিলাম। আপনার এখানে আসার কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না। এখানে সবকিছুই ভালভাবে চলছে। আমার সম্বন্ধে কোনও চিন্তা করবেন না। আমার কপালের ব্যথা এখন আর নেই, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।
হ্যারি

তারপর হ্যারি ছবির গর্ত দিয়ে উপরে উঠে নিস্তব্ধ ক্যাসেলের (সাময়িকভাবে পীভস রয়েছে, ও হ্যারিকে দেখে একটা বড় টব ওর দিকে ফেলে দিয়ে ফোর্থ ফ্লোর করিডোরে চলে গেল) আউলারিতে পৌঁছল। আউলারি পশ্চিম টাওয়ারের ওপরে।

আউলারি ঘর একটা গোলাকৃতি পাথরের খুব ঠাণ্ডা আর শুকনো। জানালার পাল্লায় একটাও কাঁচ নেই। মেঝেটা ঘাস–খড় দিয়ে ঢাকা। সেখানে প্যাঁচাদের বিষ্ঠা, মরা ইঁদুরের হাড় আর ধেড়ে ইঁদুরের কঙ্কাল। শত শত প্যাঁচা ওখানে থাকে। ও দেখল সব প্যাঁচা ঘুমুচ্ছে। কেউ কেউ আবার ওর দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে হেডউইগকে দেখতে পেল। বেশ জোরে জোরে হেঁটে ওর সামনে দাঁড়াল হ্যারি। হেডউইগ তখন ঘুমাচ্ছে।

ওকে ঘুম থেকে তুলতে একটু সময় লাগল।

হেডউইগ ঘুমন্ত চোখে হ্যারির দিকে তাকাল। তখনও গতকালের খারাপ ব্যবহারের জন্য ও বেশ রেগে আছে। তাহলেও হ্যারির মনে হল হেডউইগ ক্লান্ত, ও যেন পিগউইজেনকে কাজটা দেয়।… হ্যারি চলে যাচ্ছিল কিন্তু থামতে হল হেডউইগের বাড়িয়ে দেয়া একটা পা–দেখে। হ্যারি ঘোট চিঠিটা ওর বড় বড় নখওয়ালা পায়ে বেঁধে দিতেই হেডউইগ আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল।

.

ব্রেকফাস্ট খাবার সময় হারমিওন বলল, তুমি ঠিক বলছো যে তোমার কপালের কাটা দাগে এখন ব্যথা করছে না, কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না।

–হয়েছেটা কী তাতে, হ্যারি বলল–আমার জন্য নিশ্চয়ই ওকে আজকাবানে ফিরে যেতে হচ্ছে না। রন হারমিওনকে বলল–ওসব কথা এখন রাখ।

হারমিওন আর কথা বাড়ালো না, কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেল।

হ্যারি এর বেশ কয়েকটা সপ্তাহ সিরিয়সকে ভুলে থাকার চেষ্টা করল। আবারও এটা সত্যি প্রতিদিন সকালে উৎসুক হয়ে তার চিঠি পাবার জন্য বসে থাকে। রোজ রাতে সিরিয়সকে নিয়ে ভয়াল স্বপ্ন দেখে ও। স্বপ্ন দেখে লন্ডনের অন্ধকার এক রাস্ত য় ও ঘুরে বেড়াচ্ছে .. ডেমনটরসরা তাড়া করেছে। শংকা থেকে মন ভাল রাখার জন্য সে কিডিচ খেলে। কিন্তু উদ্বিগ্ন মনে খেলাও ঠিকমতো হয় না।

মুডির ক্লাস কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল প্রতিটি নতুন লেসনে। বিশেষ করে ডার্ক আর্ট প্রতিরোধের ব্যাপারে।

একদিন মুডি ক্লাস নিতে নিতে বললেন–আমি এক এক করে সকলের ওপর পরীক্ষা চালাব। কথাটা শুনে সকলের ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। প্রফেসর মুডি সকলের ওপর ইমপেরিয়স কার্স প্রয়োগ করবেন! সেটা কাল জাদুর প্রতিরোধের ক্লাস।

মুডি জাদুদণ্ড দিয়ে শুধু টেবিলটপ পরিষ্কার করলেন না; ঘরের মাঝখানটাও পরিষ্কার করলেন। হারমিওন বলল–কিন্তু আপনি বলেছেন, ওই জাদু প্রয়োগ বেআইনি! একজন মানুষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা…?

ডাম্বলডোর বলেছেন, তোমাদের জন্য যা শেখানোর প্রয়োজন তাই শেখাব। হারমিওনের দিকে তার ম্যাজিক্যাল চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন… তারপর ভূতুড়ে দৃষ্টিতে হারমিওনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–ঠিক আছে, তুমি না শিখতে চাইলে শিখবে না। যাক… তুমি তাহলে ক্লাসের বাইরে যেতে পার।

মুডি একটা আঙ্গুল দিয়ে হারমিওনকে দরজাটা দেখিয়ে দিলেন। হারমিওনের মুখের রঙ বদলে গেল, বিড়বিড় করে কিছু বলতে চাইল… বলতে চাইল তার মানে এই নয় যে, ও ক্লাস ছাড়তে চেয়েছে।হ্যারি আর রন হাসল। ওরা জানে হারমিওন কোনমতেই এই জরুরি ক্লাস মিস করতে চায় না, যদিও ওকে আবর্জনাও খেতে হয়, তা হলেও না।

মুডি ছাত্রছাত্রীদের লাইন করে দাঁড়াতে বলে এক এক করে তাদের ওপর ইমপেরিয়স কার্স প্রয়োগ করতে লাগলেন। হ্যারি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। ডিন টমাস কম করে তিনবার ব্যাঙের মত লাফাতে লাফাতে জাতীয় সঙ্গীত গাইল। ল্যাভেন্ডর ব্রাউন চড়ুই পাখির মত কিচির–মিচির করতে লাগল। নেভিল পরপর কয়েকটা অদ্ভুত অদ্ভুত জিমনাস্টিক দেখাল। স্বাভাবিক অবস্থায় ও তা কখনোই করতে পারতো না। কেউ প্রতিরোধ করতে পারলো না। মুডি অবশ্যই সকলকে তাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন।

পটার এবার তোমার পালা। মুডি গম্ভীর স্বরে বললেন।

হ্যারি ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। মুডি তারপর জাদুর্দণ্ড তুলে পটারকে স্পর্শ করে বললেন–ইমপেরিও!

স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে ও ইমপেরিও কানে যেতেই হ্যারি যেন অন্য এক মানুষ হয়ে গেল। দারুণ এক চাঞ্চল্যকর অনুভূতি! মনে হল ও যেন নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। শরীর মন পালকের মত হালকা হয়ে গেছে। মাথাটা হালকা… দেহমনে কোনও চাপ নেই। সুখের সাগরে ভাসছে সেই অবস্থাতে ম্যাড আই মুডির জলদগম্ভীর স্বর শুনতে পেল। সেই স্বর শূন্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করে অদ্ভুত এক সুরেলা প্রতিধ্বনি হতে লাগল–ডেস্কের ওপর দাঁড়াও… লাফিয়ে ওঠো ডেস্কে।

আদেশ পালন করার জন্য হ্যারি হাঁটু–বেঁকাল লাফ দেবার জন্য।

–ডেস্কের ওপর লাফিয়ে ওঠ।

–দেরি করছ কেন?

হ্যারির মস্তিষ্ক থেকে কে যেন বলে উঠল, যতসব বোকার মত কাজ। সত্যি ভেবে দেখ।

–ডেস্কের ওপর লাফিয়ে ওঠো।

না, আমি পারবো না। ধন্যবাদ। মস্তিষ্ক থেকে অন্য কেউ বলল। (এবার যেন কঠিনভাবে)। না, আমি লাফাতে চাই না।

লাফাও! এখনই!

তারপরই হ্যারি অসম্ভব যন্ত্রণায় কাতর হল। ওর একই সঙ্গে লাফাবার ইচ্ছা আবার তারই সাথে সাথে অনিচ্ছা–পরিণতি হল সরাসরি ডেস্কে ওর মাথায় আঘাত। তারপরই ওর মনে হল ওর শরীরের হাড়গোড় সব ভেঙে চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে গেছে… পায়ে কোনও শক্তি নেই, হাঁটু দুটো ভেঙে গেছে। ও শুনতে পেল মুডির গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর; এই রকমই হবে।

কথাটা শোনার সাথে সাথে আবার ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। তারপরই মাথার মধ্যে শূন্যতাবোধ আর থাকলো না, ব্যাথা উধাও হয়ে গেল। মাথার মধ্যে আর কিছু প্রতিধ্বনিও হচ্ছে না। হাঁটুর ব্যথা দ্বিগুণ হয়ে গেল। কি কি ঘটেছে সবই মনে হতে লাগল।

–তোমরা সবাই দেখ, দেখ সবাই পটার কেমন করে কাল ম্যাজিক প্রতিরোধ করেছে–সকলে মনোযোগ দাও ওর দুচোখ এখান থেকে ওকে ভাল দেখতে পাবে। পটার তুমি অসাধ্য সাধন করেছ। তোমাকে রোধ করা ওদের পক্ষে খুবই কঠিন।

ডার্ক আক্রমণের প্রতিরোধ সাঙ্গ হবার ঘণ্টাখানেক পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে রনকে হ্যারি বলল-এমনভাবে প্রফেসর বলেন, (মুডি হ্যারিকে বলেছিলেন… একবার নয়, চারবার প্রতিরোধ ক্রিয়াকলাপ করতে। তা না করলে কার্স থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি হবে না… যেন যেকোন মুহূর্তে আমরা আক্রান্ত হতে পারি।

রন বলল–আমারও তাই মনে হয়। ও যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে বা নামে কখনও পর পর স্টেপে পা দেয় না। তড়াক তড়াক করে দুটো স্টেপ নামে বা ওঠে।

বেচারি রন! ম্যাড–আই মুডি ওকে বলেছেন, তোমার কোনও ভয় নেই। লাঞ্চের আগেই নর্মাল হয়ে যাবে। তবু নেভিলের চেহারা দেখে ওর ভয় আরও বেড়ে যায়। পটারের কথা আলাদা! মস্তিষ্ক বিকৃতিদের কথা বল… রন লাঞ্চ খেতে খেতে কথাটা বলে পেছনে তাকাল। কথাটা ম্যাড আই মুডি কি শুনেছেন। দেখল মুডি বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন–শোনার সম্ভাবনা নেই।… মন্ত্রণালয়ের লোকেরা মুডিকে পছন্দ করে না এমনি এমনি নয়।….. তুমি সিমাসেরটা শুনেছো? ওকে স্পেল করার সময় সিমাসের বু–উ–উ চিৎকার?… ঘটনাটা আবার এপ্রিল ফুল দিনে। কি আর করা যায়, ডাম্বলডোর যখন বলেছেন, মানতেই হবে।

চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের যে পরিমাণ পড়ার বোঝা সেই টার্মে বইতে হবে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অনেক বেশি কাজ করতে হবে। ট্রান্সফিগারেশনের হোম ওয়ার্ক দেখে ছাত্র–ছাত্রীরা আঁতকে উঠলে ম্যাকগোনাগল তার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিলেন।

–তোমরা এখন জাদুবিদ্যা শিক্ষার একটি দরকারি স্তরে পৌঁছেছে, মিসেস ম্যাকগোনাগল চশমার আড়ালে চোখ বড় বড় করে বললেন–তোমাদের সাধারণ জাদুবিদ্যা শিক্ষার স্তর প্রায় সমাপ্ত হতে চলেছে।

ডিন টমাস বলল–তাহলে ফিফথ ইয়ারের আগে আমরা 0.WL পাবো না। ওর কথায় হতাশা।

–নাও হতে পারে টমাস, তবে আমার ওপর বিশ্বাস রাখলে বা আস্থা থাকলে তোমরা সব রকমভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে! শুনলে খুশি হবেন মিস গ্রেঞ্জার তোমাদের মধ্যে একজনই শজারুকে একটা সন্তোষজনক পিন কুশনে পরিণত করেছে। টমাস একটা কথা মনে রাখবে, মনে করিয়ে দিতে চাই যে, তোমার পিন কুশন এখনও এমন অবস্থায় আছে যে কেউ তাতে পিন খুঁজতে গেলে বেগ পেতে হবে।

হারমিওনের কথাটা শুনে গাল লাল হয়ে গেল… মনে হল সে তার খুশি চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

হ্যারি ও রনকে প্রফেসর ট্রেলা বললেন, তোমরা দুজনে হোমওয়ার্কে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছ, শুনে ওরা খুশিতে ডগমগ। হোমওয়ার্ক ছিল ভবিষ্যৎ কথনের। উনি সমস্ত ক্লাসের ছাত্র–ছাত্রীদের ওদের হোমওয়ার্ক পড়ে শোনালেন। খুব তারিফ করলেন। ভয় নেই, ভাবনা নেই… বুদ্ধিমানের সাথে হিসাব, আন্দাজ…! আগামী মাসের পরের মাসে এভাবে ভবিষ্যৎ গণনা করতে হবে তোমাদের কথাটা শুনে ওরা বেশ বিপদে পড়ল… ভবিষ্যৎ বিপত্তির কথা নতুন করে আর কি বলা যায়!

ইতোমধ্যে প্রফেসর বিন্স, (একজন ঘোস্ট যিনি জাদুবিদ্যার ইতিবৃত্ত পড়ান) ওদের আঠার শতাব্দীতে গবলিন (কদাকার ভূত) বিদ্রোহীদের সম্বন্ধে প্রতি সপ্তাহে রচনা লিখতে বললেন। আবার প্রফেসর স্নেইপ ওদের প্রতিষেধক ওষুধ সম্বন্ধে গবেষণা করতে বাধ্য করলেন। নিরুপায় ছাত্রছাত্রীরা খুব মন দিয়ে গবেষণা করতে লাগল। স্নেইপ ওদের ভয় পাইয়ে দিয়েছেন বড়দিনের আগে তোমাদের মধ্যে কারও দেহে বিষ ঢুকতে পারে, তার জন্য প্রতিষেধক সম্বন্ধে প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন আছে। সে তো গেল, প্রফেসর ফ্লিটউইক ওদের সিলেবাসের বাইরে তিনটে বই মন দিয়ে পড়তে বললেন… বিষয় বিভিন্ন জাদুবিদ্যা বা জাদুমন্ত্রের সক্রিয় আদেশের শিক্ষা!

হ্যাগ্রিডও কেন বাদ যাবেন! হ্যাগ্রিডও অনেক কাজের চাপ বাড়িয়ে দিলেন। ওর প্রজেক্টের জন্য ছাত্রছাত্রীদের একদিন অন্তর ওর বাড়িতে যেয়ে ক্রিউটদের অস্বাভাবিক গতিবিধি নোট করতে হয়। স্ক্রিউটদের শারীরিক বৃদ্ধি অভাবনীয়। ড্র্যাকো ম্যালফয় সরাসরি যোগদানে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি ওসব অদ্ভুত ক্লাস করবো না।

হ্যাগ্রিড ম্যালফয়ের কথাবার্তা শুনে খুবই মর্মাহত হলেন।

–আমি যা বলছি তা তোমাকে করতেই হবে ম্যালফয়, হ্যাগ্রিড বললেন। যদি অবাধ্য হও তাহলে তোমার কাছে মুডির যে বই আছে তার থেকে দুটো পাতা ছিঁড়ে নেব। শুনলাম তোমাকে না–কি সাদা পোকা বানানো হয়েছিল, ম্যালফয়।

কথাটা শুনে গ্রিফিন্ডরের ছেলে মেয়েরা সশব্দে হেসে উঠল। ম্যালফয় রেগে তেলে–বেগুনে আগুন। তখনও মুডির শাস্তি ওকে ভয়ানকভাবে ঘিরে রেখেছে। লেসন শেষ হবার পর হ্যারি–রন–হারমিওন খুশি মনে ক্যাসেলে ফিরে গেল। হ্যাগ্রিড ম্যালফয়ের বিষ দাঁত ভেঙে দিয়েছেন। গত বছর ম্যালফয় ওর বাবার সাহায্যে হ্যামিডকে স্কুল থেকে তাড়াবার অনেক চেষ্টা করেছিল।

হলের প্রবেশ পথে ওরা গিয়ে দেখল প্রচন্ড ভিড়। ভেতরে ঢোকা দায়। চোখে পড়ল পাথরের সিঁড়িতে বিরাট সাইনবোর্ড রাখা আছে। অনেকেই পড়ার চেষ্টা করছে… কিন্তু পারছে না। রনের উচ্চতা অন্যান্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি, সে পায়ের সামনের আঙুলের ওপর ভর করে উঁচু হয়ে পড়ল।

ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট
আগামী ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যা ছটার সময় বোক্সবেটনস এবং ডার্মাংগর প্রতিনিধি দল হোগার্টে আসবেন। তাই স্কুলের ক্লাস নির্দিষ্ট সময়ের আধঘন্টা আগে শেষ হবে।

হ্যারি বলে উঠল–দারুণ। পোসানের ক্লাস শুক্রবার শেষ! হা, হা. স্নেইপ আর আমাদের বিষাক্ত করতে পারবে না।

ছাত্রছাত্রীদের বই–খাতা স্কুলব্যাগ তাদের নির্দিষ্ট ডরমেটরিতে রেখে ক্যাসেলের সামনে দাঁড়িয়ে অতিথিদের স্বাগত জানাবে। তারপরই ওয়েলকাম ফিস্ট শুরু হবে।

–জনতার ভিড় থেকে হাফেলপাফের এরনি ম্যাকমিলন দীপ্তিময় দুই চোখে বলল–আর মাত্র এক সপ্তাহ। ফেডরিক জানে তো? খবরটা ফেডরিককে দিয়ে আসতে হবে।

রন ভাসা ভাসা ভাবে বলল–ফেডরিক? এরনি রনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ফেডরিককে খবর দিতে ছুটলো।

হ্যারি বলল, ডিগরি, ও নিশ্চয়ই টুর্নামেন্টে অংশ নেবে।

–ওই বোকাটা… হোগার্ট চ্যাম্পিয়ন? রন কথাটা বলে হল্লা করে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সিঁড়ির দিকে এগোল।

হারমিওন বলল–ও বোকা মোটেই নয়, তুমি ওকে পছন্দ করো না কেন আমি জানি… কারণ কিডিচ খেলায় ওরা গ্রিফিন্ডরকে হারিয়েছে। শুনেছি খুব ভাল ছাত্র এবং ভালো প্রিফেক্ট।

হারমিওন এমনভাবে বলল যাতে ফেডরিককে নিয়ে আর কোনও কথা হয় না।

রন ব্যঙ্গ করে বলল–ও সুন্দর তো দেখতে তাই…!

হারমিওন বিরক্তি মাখা সুরে বলল-এমন কথা বলবে না। সুন্দর হলেই তাকে পছন্দ করতে হবে এমন কোনও ব্যাপার নয়।

রন মজা করে খিক খিক করে হাসল।

ক্যাসলের ছেলে–মেয়েরা টুর্নামেন্টের নোটিশ দেখে চঞ্চল হয়ে উঠল। সকলের মুখে একই কথা একই আলোচনা। অধীর আগ্রহ আগামী সপ্তাহে অতিথি আগমনের। হ্যারির কথা ভাবা কারও সময় নেই, উৎসাহ নেই। ট্রাই উইজার্ড টুর্নামেন্ট যেন দারুণ এক সংক্রামক জীবাণু। গুজবের পর গুজব। যার যা ইচ্ছে তাই বলে চলেছে। কে হোগার্ট চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য প্রতিযোগিতা করবে? অন্য দুই স্কুলে খেলোয়াড়দের স্ট্যান্ডার্ড কেমন? হোগার্টের সঙ্গে তফাৎ কোথায়।

ক্যাসেল নতুন সাজে সজ্জিত হল। পুরনো সব ফেলে নতুন আসবাবপত্র, ছবি, কার্পেট…. নানা রকম নব নব সাজ। কেয়ারটেকার ফ্লিচ… আরও বেশি কঠোর হয়ে গেল। সকলকেই টিপটপ থাকতে হবে। জামা, প্যান্ট, জুতো, কোথায় যেন কোনও ত্রুটি থাকে না। ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে হবে। প্রথম বর্ষের দুএকটি মেয়ে ফ্লিচের তাড়নায় ক্ষেপে যাবার উপক্রম। রাগে তারা হাত–পা ছুঁড়তে লাগল। অনাবশ্যক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। ফ্লিচকে কেন বলে দিতে হবে–সকলের পেছনে ও লেগে থাকবে কেন?

ছাত্রছাত্রী কেন? কর্মচারীরাও রেহাই পায় না ফ্লিচের তাড়নায়।

প্রফেসর ম্যাকগোনাল ঢিলেঢালা লংবটমকে বললেন–দেখ কেউ যেন ধরতে পারে তুমি অতি সাধারণ জাদুমন্ত্র বদলাতে পার না। তোমার অক্ষমতা যেন ডারমস্ট্রাংগ ধরতে না পারে।… বেচারি নেভিল ভুল করে ওর নিজের দুটি কান ক্যাকটাসে লাগিয়ে দিয়েছিল একবার।

তেরই অক্টোবর ছাত্রছাত্রীরা সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে ঘর দেখে অবাক! রাতারাতি সবকিছু বদলে গেছে–যেন রাজপুরীতে এসেছে। ঘরভর্তি সিল্কের ব্যানার প্রতিটি দেয়ালে ঝুলছে। প্রত্যেকটি ছাত্রাবাসের জন্য আলাদা আলাদা। লাল আর সোনালী গ্রিফিন্ডরের, র‍্যাভেন ক্লর ব্রোঞ্জে ঈগল ছাপ, হাফেলপাফের–হলুদ ও কাল; স্লিদারিনের সবুজের সঙ্গে রূপালী সাপ। শিক্ষকদের টেবিলের পেছনে ঝুলছে সবচাইতে বড় আকারের ব্যানার : হোগার্টের অস্ত্রশস্ত্র, সিংহ, ঈগল, ভেদর, ইংরেজি এইচকে পেঁচিয়ে রয়েছে একটা সাপ।

গ্রিফিন্ডের টেবিলে ফ্রেড আর জর্জকে পেয়ে গেল, রন, হ্যারি–আর হারমিওন। দেখল ওরা আলাদা দুজনে খুব ফিস ফিস করে কথা বলছে। অস্বাভাবিক ভাব চোখে–মুখে। রন ওদের কাছে বসল। জর্জ খুব আস্তে ফ্রেডকে বলল–ঠিক আছে, তো কি হয়েছে। কিন্তু ও যদি আমাদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলে… তাহলে চিঠি পাঠান ছাড়া গত্যন্তর নেই। অথবা ওর হাতে ধরিয়ে দিতে হবে… ওতো চিরকাল আমাদের এড়িয়ে চলবে না।

রন বলল–কে তোমায় এড়িয়ে চলছে?–কে আবার তুমি, ফ্রেড মেজাজ দেখিয়ে বলল।

–তুমি ভবঘুরে বা অলস বলতে কি বোঝাতে চাইছ? রন জর্জকে জিজ্ঞেস করল।

–তোমার মত একটি অপদার্থ ভাই-এর জন্য।

হ্যারি ওদের কাছে এসে বলল–ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট সম্বন্ধে কিছু খবর–টবর পেলে? অংশগ্রহণের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?

–কেমন করে চ্যাম্পিয়ন বাছাই হয় ম্যাকগোনাগলকে জিজ্ঞেস করতে ম্যাডাম সেফ বললেন–জানি না; জর্জ তিক্ত কণ্ঠে বলল। মুখটা ঝামটা দিয়ে বললেন, ওসব না ভেবে আমেরিকার ভালুকের চেহারা বদল সম্বন্ধে যা যা ক্লাসে বলেছি সেটা ভাল করে কর।

রন ভেবেচিন্তে বলল–আশ্চর্য ভালুকের চেহারা বদল করে লাভটা হবে কী? আমরা প্রতিযোগিতায় ভালো কিছু করতে পারি।… এর আগেও আমরা অনেক শক্তশক্ত কিছু করেছি।

–করেছি, কিন্তু বিচারকদের সামনে নয়, তুমিও না, ফ্রেড বলল ম্যাকগোনাগল বলেছে, চ্যাম্পিয়নরা কেমন করে কাজ সুষ্ঠুভাবে করল তার ওপর নম্বর পায়।

হ্যারি বলল–বিচারক কারা হচ্ছেন?

–যে সমস্ত স্কুল অংশগ্রহণ করছে সেই স্কুলের প্রধানরা, হারমিওন বলল।… ও বলার সময় সকলেই ওর দিকে তাকাল। একটু অবাক হয়ে… কারণ ওই তিনটে স্কুলের প্রধানরা ১৭৯২ সালে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন।

অবাক হবার প্রধান কারণ: যারা শুনছে তারা খেলা সম্বন্ধে কোনও বই পড়েনি। অল ইন হোগার্টস খুব একটা বিশ্বস্ত নয়, অ্যারিডাইজড হিষ্ট্রি অব হোগার্টস… ঠিক মত বইয়ের টাইটেল হলে ভাল হত। অথবা অ্যা হাইলি বায়াসড অ্যান্ড সিলেকটেড হিস্টরি অফ হোগার্টস, সেই বইটাতে শুধু স্কুলের খারাপ দিকটার বর্ণনা আছে।

রন বলল–বই সম্বন্ধে তোমার অভিমত?

হারমিওন বলল-এলফস ঘর! খুব জোর দিয়েই বলল–হাজার পাতার মধ্যে এক জায়গায় পাবে না হোপার্টের; অ্যা হিস্ট্রি… তে কোথাও এক অক্ষর শত শত ক্রীতদাস সম্বন্ধে কিছু লিখেছে!

হ্যারি আর রন SPEW ব্যাজের জন্য দুসিকল খরচ করেছে।

হারমিওন বলল-একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছে কারা তোমাদের বিছানার চাদর ঘোয়, নিয়মিত বদলায়, ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালে, তোমাদের ক্লাসরুম সাফ–সুতরো করে, বাবার বানায়? তারা কাজের বদলে একটি সিকেল পারিশ্রমিক পায় না কারণ তারা ক্রীতদাস?

রন হারমিওনের কথা শোনার পর ছাদের সিলিং-এ তাকাল। সিলিং-এর রঙ বদলে গেছে… রোদে ঝা চকচক। ফ্রেড–জর্জ কেউ কারও কথা শোনায় মন নেই। ওরা বেকন নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রেড–জর্জ কেউ SPEW ব্যাজ কেনেনি। ফ্রেড হারমিওনের দিকে না তাকালেও জর্জ তাকাল।

ও বলল–আচ্ছা হারমিওন তুমি কখনও কিচেনে গেছ?

–অবশ্যই না, হারমিওন সোজাসুজি বলল–আমি মনে করি না কাজটা ছাত্র ছাত্রীদের।

আমাদের আছে, জর্জ বলল–অনেক ভাল রান্না সময়মত করে। আমার মনে হয় এলফদের কোনও অভিযোগ নেই। ওরা কাজটাকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে।

–কারণ তারা অশিক্ষিত, তাদের জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত শুনে আসছে বিনা পারিশ্রমিকে তাদের কাজ করতে হবে। হারমিওন রেগে গিয়ে বলল।

হঠাৎ হুস হুস শব্দ হ্যারির কানে এল। হারমিওন কথা বন্ধ করল–রন তাকাল হেডউইগের দিকে। ও হ্যারির পিঠের কাছে ঘুরছে। হ্যারির কাছে বসে ওর ডানা বন্ধ করল। তারপর পাটা বাড়িয়ে দিল।

হ্যারি সিরিয়সের পাঠান চিঠিটা হেড উইগের মধ্য থেকে খুলে নিল।

সুন্দর চেষ্টা হ্যারি,
আমি দেশেই আছি, তবে লুকিয়ে। আমি চাই হোগার্টে কি হচ্ছে, না হচ্ছে তোমার কাছ থেকে জানতে। হেডউইগকে দিয়ে চিঠি পাঠাবে না। পাচা পরিবর্তন করবে। আমার জন্য কিছু চিন্তা করবে না। নিজেকে সতর্ক রাখবে। তোমার কাটা দাগ সম্বন্ধে যা বলেছি ভুলবে না।
সিরিয়স।

কেউ যাতে শুনতে না পায় এমনিভাবে রন বলল–প্যাঁচা কেন বদলাতে বলছেন? হেড উইগকে সকলে দেখলেই তাকিয়ে থাকে, হারমিওন বলল–কারও পোষ মানে না। ও সাদা তুষারের প্যাঁচা। যতক্ষণ না খুঁজে পাবে ঘুরে বেড়াবে… মানে যেখানেই সিরিয়স থাকুন না কেন… দেশী পাখিতো নয়।

হ্যারি চিঠিটা পাকিয়ে রোবের পকেটে রেখেছিল। ভাবতে থাকে ও কি আগের চেয়ে বেশি চিন্তিত না কম। ও মনে করল, ধরে নিল সিরিয়স সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আসতে চায়। এমনভাবে যাতে ধরা না পড়ে (অথবা এমনও হতে পারে ও খুব নিকটেই আছে। যাতে চিঠির জবাব পেতে ওকে বেশিদিন আশা করে থাকতে হবে না।

ও হেডউইগের পিঠে হাত দিয়ে বলল–ধন্যবাদ হেডউইগ! হেড উইগ ওর মুখ গায়ের পালকে খুঁজে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ ওর চোখ পড়ে গেল অরেঞ্জ জুসের পানপাত্রে (গবলেট)। ও ঠোঁট দুটো জুসে চোবাল… তারপর ঘুমুতে চলে গেল ওর গৃহে,আউলারিতে।

সেদিন সকলেই খুশি মনে নানা রকম জল্পনা–কল্পনা করছে। পড়াশুনায় কারও মনোযোগ নেই। সন্ধ্যাবেলা দুই স্কুলের অতিথিদের আসার অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে। ওদের কাছে তখন ট্রেলার পোসান যেন কিছুই নয়। আধঘণ্টা আগেই ছুটি হয়ে যাবে তবেই প্রতীক্ষা। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই ওরা তিনজন ছুটল গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে। যেমন ডাকে নির্দেশ ছিল তেমনভাবে–ব্যাগ জমা দিয়ে, আলখেল্লা টেনে খুলে একতলায় প্রবেশ হলে ছুটল।

প্রতিটি হাউজের হেডেরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের লাইনে দাঁড়াতে বললেন। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল খুঁত ধরবেনই। বললেন–উইসলি তোমার হ্যাট সোজা কর, রনকে বললেন, মিস পাতিল তোমার চুল থেকে অদ্ভুত জিনিসটা খুলে রাখ।

–তোমরা আমার পিছু পিছু চল, ম্যাকগোনাগল প্রথমবর্ষের ছেলেমেয়েদের বললেন, সাবধানে চল, কোনও ধাক্কা–ধাক্কাধাক্কি নয়।

রন ঘড়ি দেখে বলল–আরে ছটা বাজে এখনও ওদের দেখা নেই; ও রাস্তার শেষে গেটের দিকে তাকাল–ওরা কখন আসছে, কেমন ভাবে আসছে জানবো কেমন করে? ট্রেনে?

হারমিওন বলল–ঠিক জানি না।

–তাহলে ঝাড়ুতে চেপে? ও তারাভরা আকাশের দিকে তাকাল।

রন বলল–পোর্টকিতে? ওরা অ্যাপারেট করতে পারে–ওরা যেখান থেকে আসছে হয়ত তাদের আইনে সতের বছরের কম বয়সের ছেলে–মেয়েদের অ্যাপারেট করার স্বাধীনতা আছে।

হারমিওন অধৈর্য হয়ে বলল–তোমরা হোগওয়ার্টের মাঠে অ্যাপারেট করতে পার… কতবার বলেছি তোমাদের বলত?

ওরা অন্ধকার মাঠের দিকে কোনও কিছুই নড়াচড়া দেখতে পেল না। হ্যারির খোলা জায়গায় বসে শীত শীত করতে লাগল… উ. আর কত দেরি করবে?…  এমনও হতে পারে (হ্যারি ভাবে)…. বিদেশী ছাত্ররা নাটকীয়ভাবে আসার পরিকল্পনা করছে।

ওরা শুনতে পেল ডাম্বলডোরের গম্ভীর ভরাট গলা,–আহ! আমার যদি ভুল না হয় তাহলে খুব সম্ভব বকসটেনস প্রতিনিধিরা আসছে?

সমবেতভাবে হোগার্টের ছাত্ররা বলল–কই? কই? কোথায়?

ওরা দেখতে পেল নীল আকাশে ছোট একটা কিছু… ওদের ক্যাসেলের দিকে ঝড়ের বেগে নেমে আসছে। যত কাছে আসে ওটা বিরাট হতে থাকে।

প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী হর্ষধ্বনি করে উঠল–ড্রাগন!

ডেনিস ক্রিভে বলল–বোকার মত কথা বলবে না। এটা একটা উড়ন্ত বাড়ি!

ডেনিসের অনুমান সত্যের আকার ধারণ করল। সকলেই বিস্ময়–বিহ্বল হয়ে দেখল বিরাট কালো আকারের একটা কিছু নিষিদ্ধ বাগানের গাছের ওপর দিয়ে দূরন্ত বেগে আসছে। ক্যাসেলের আলোতে ওরা দেখল একটা প্রকাণ্ড হালকা নীল রঙ-এর ঘোড়ায় টানা ক্যারেজ ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। ঘোড়াগুলো টেনে আনছে একটা বিরাট বড় ক্যারেজ দেখতে বাড়ির মত। ঘোড়ার সংখ্যা কম করে এক ডজন হবেই। তাদের রঙ সোনালী, ল্যাজ সাদা। আকার হাতির মত।

সামনের সারিতে বসা ছেলে–মেয়েরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। সেই ঘোড়ায় টানা বাড়িটা তাদের দিকে ঝড়ের বেড়ে নেমে আসছে। সবচেয়ে বেশি ভয় পেল নেভিল। হাতির মত গ্যালমাইনস ঘোড়ারা ধপাস করে মাটিতে নামল। এক সেকেন্ড পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত ক্যারেজ (বাড়ি)। সেই সোনালী রঙ-এর ঘোড়াগুলো তাদের মাথা প্রচণ্ডভাবে নাড়তে লাগল। নাক মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে… চোখ রক্তবর্ণ।

হ্যারির চোখ পড়ল বাড়ি সদৃশ ক্যারেজের দরজায়। দরজায় আঁকা রয়েছে কোট অব আর্মস (দুটি সোনালী দণ্ড ক্রস করা, দরে মুখ থেকে তারা নির্গত হচ্ছে )।

গাড়ি থেকে প্রথমে লাফিয়ে নামল একটি ছেলে। পরনে হালকা হালকা নীল রোব। সামান্য হোঁচট খেল নামার সময়। সে নেমে ভাঁজ ভাঙ্গলে সোনালী রঙ এর সিঁড়ি ভাঁজ করা। ও নত হয়ে সকলকে অভিনন্দন জানাল। গাড়ির দিকে তাকাতেই হ্যারির চোখে পড়ল কালো চকচকে চামড়ার খুড়ওয়ালা এক জোড়া জুতার ওপর। অনেকটা বাচ্চা ছেলেদের বরফের উপর হাঁটার জুতার মত। তারপর গাড়ি থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন এক দীর্ঘকায়া মহিলা। এত দীর্ঘকায়া মহিলা এর আগে হ্যারি দেখেনি। ওকে দেখে কেউ কেউ ভয়ে হাঁপাতে লাগল।

মহিলাকে দেখতে দেখতে হ্যারির মনে হল হ্যাগ্রিড ওর কাছে শিশু। …তাহলেও কে কত দৈর্ঘ্য মাপার প্রশ্ন আছে। মহিলা হোগার্ট স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী ও কর্মীদের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে তিনি প্রবেশ বা এনট্রেন্স হলের সিঁড়ির মুখে পৌঁছলেন। উজ্জ্বল আলোতে হ্যারি দেখল মহিলা অতি সুন্দরী, মুখের রঙ অলিভফলের মত। বড় বড় দুই গভীর কালো চোখ। চোখ দুটো ভেজাভেজা। লম্বা নাক। নাতিদীর্ঘ চুল কাঁধের কাছে ক্লিপ দেওয়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো মার্টিনের রোব। গলায় গাদা গাদা দামি পাথরের হার আর আঙ্গুলে সেইরকম পাথরের আংটি। ডাম্বলডোর হাততালি দিতেই স্কুলের সকলেই একইভাবে হাততালি দিল। মেয়েরা দাঁড়িয়ে ভালভাবে মহিলাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

তিনি হেসে ডাম্বলডোরের দিকে এগিয়ে গেলেন। চকচকে মসৃণ হাত ডাম্বলডোরের দিকে প্রসারিত করলেন। লম্বায় ডাম্বলডোরের চেয়ে বেশি তাই সামান্য ঝুঁকে পড়ে হাতে চুম্বন করলেন।

–আমাদের সকলের প্রিয় মাদাম ম্যাকসিম, আপনার হোগার্টে আসার জন্য অভিনন্দন গ্রহণ করবেন।

মাদাম ম্যাকসিম আন্তরিক স্বরে বললেন–ডাম্বলডোর… আমি আশা করি ভালো আছেন।

ডাম্বলডোর বললেন–ধন্যবাদ, খুবই ভাল আছি।

মাদাম ম্যাকসিম হাত তুলে বললেন–আমার প্রিয় ছাত্র–ছাত্রীরা তোমরা আমার আন্তরিক স্নেহ ভালবাসা গ্রহণ কর।

হ্যারি পেছন ফিরে দেখল প্রায় এক ডজন কিশোর–কিশোরী মাদাম ম্যাকসিমের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। শুধুমাত্র পাতলা সিল্কের রোবস পরার জন্য। কেউ ওভারকোট পরেনি। কেউ কেউ তাদের মাথায় বড় স্কার্ফ বা শাল দিয়ে ঢেকেছে। হ্যারির তাদের মুখ দেখে মনে হল হোগার্ট স্কুল দেখে ওরা শুধু মুগ্ধ নয়–অবাক হয়ে গেছে।

মাদাম ম্যাকসিম জিজ্ঞেস করলেন–কারকারফ এসেছেন? ডাম্বলডোর বললেন–যেকোনও মুহূর্তে আসতে পারেন। আপনি কি তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন? না চাইলে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। এখানে তো বেশ ঠাণ্ডা।

–খুব ঠাণ্ডা? মাদাম বললেন–জিরো তো নয়।

ডাম্বলডোর বললেন–আমাদের ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচারস কারও শরীর খারাপ হলে যথেষ্ট যত্ন নেবে।

হ্যারি রন কথাটা শুনে হেসে ফেলল। বলল–স্কুরেটস।

মাদামের মুখ দেখে মনে হল তার সন্দেহ আছে।

ডাম্বলডোর বললেন–সবকিছু হ্যাগ্রিডের ওপর ভার দেওয়া আছে ও দেখাশুনা করবে।

–দয়া করে মি. হ্যাগ্রিডকে বলবেন, আমাদের ঘোড়ারা হুইস্কি ছাড়া কিছু পান করে না।

ডাম্বলডোর নত হয়ে বললেন–চিন্তা করবেন না।

ডারমস্ট্রংগের আসার অপেক্ষায় সকলেই বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে মাদাম ম্যাকসিমের ঘোড়াদের হ্রেষাধ্বনি শোনা যাচ্ছে।… কিন্তু তারপরই।

হঠাৎ রন বলল–কিছু শুনতে পাচ্ছ?

হ্যারির কানে এল… ভীষণ এক শব্দ… অন্ধকার থেকে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে আসছে। জলের ঢেউ আর স্রোতের শব্দ… ঘূর্ণির শব্দও। মনে হয় বিরাট একটা হোস পাইপ দিয়ে লেকের সব জল টেনে নিচ্ছে। ঘূর্ণিটা হৃদের চতুর্দিকে ঘুরছে।

ওরা লেকের দিকে তাকাল। লেকের জল ঠিকই আছে শুধু জলের উপরিভাগ স্থির নয় চঞ্চল। খুব সম্ভব লেকের জলের তলদেশে কিছু অস্থিরতা হয়েছে। জলের উপরিভাগ ফুটন্ত জলের মত বুগ যুগ যুগ শব্দ করে বুঁদ বুদের সৃষ্টি করছে। তারপর হঠাৎ জলের ওপর ঘূর্ণিস্রোত দেখা দিল। তারপর ঘূর্ণিস্রোতের মাঝ থেকে কালো এক স্তম্ভ উঠে এল।

হ্যারি রন আর হারমিওনকে বলল–ওটা জাহাজের মাস্তুল মনে হয়।

ধীরে ধীরে লেকের জলের ভেতর থেকে একটা মাঝারি আকারের জাহাজ ভেসে উঠল। চাঁদের আলো পড়ে সেটা অভূতপূর্ব চক চকে দেখাচ্ছে। দেখে মনে হয় অতি মূল্যবান এক জাহাজকে লেকের জলের ভেতর থেকে ভোলা হয়েছে। তারপরই সেই ডুবন্ত জাহাজ সম্পূর্ণ ভেসে উঠে তির তির করে তীরের দিকে এগোতে লাগল।

তারপর সেই জাহাজ থেকে মানুষজন নামতে লাগল। তাদের কেমন যেন কালো কালো দেখাচ্ছে দূর থেকে। ওদের পেটগুলো ক্র্যাব আর গোয়েলের মত মোটাসোটা। না, তা নয়। এনট্রেন্স হলের কাছে ওরা দাঁড়ালে হ্যারি দেখল ওরা এমন এক ধরনের আলখেল্লা পড়েছে তার পেটের কাছটা বিভিন্ন ধরনের ফার দিয়ে তৈরি। ওর চুলের মত রূপালী চকচকে।

–ডাম্বলডোর! একজন উদাত্ত স্বরে বললেন–কেমন আছেন ডাম্বলডোর বলুন বলুন কেমন আছেন ডাম্বলডোর?–নবীন ও যৌবনোচ্ছল… তাজা, ধন্যবাদ। প্রফেসর কারকারফ, ডাম্বলডোর বললেন।

কারকারফের গলাটা সুরেলা ও অতিরিক্ত বিনয়ী। গায়ে আলো পড়তে ওরা দেখল কারকারফ প্রফেসর ডাম্বলডোরের মতই লম্বা ও রোগা। কিন্তু মাথার পাকা চুল ঘোট ঘোট, চিবুকের চুলের (ছাগলে দাড়ি) শেষ প্রান্ত সামান্য কোঁকড়ানো। সেই দাড়ি তার দুর্বল চিবুক ঢাকা দিতে পারেনি।…. ডাম্বলডোরের কাছে গিয়ে করমর্দন করেও অনেকটা সময় হাত ধরে রইলেন।

কারকারফ হোগার্টের ছাত্র–ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন–আমার প্রিয় হোগার্ট ক্যাসেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হ্যারি লক্ষ্য করল তার দাঁতগুলো হলুদ বর্ণের। হাসলে চোখ বড় বড় হয় না; স্থির ও অবিচলিত থাকে।

এখানে এসে এত ভাল লাগছে যে কথায় বোঝানো যাবে না ভিক্টর তুমি এদিকে এস… এখানে এসে তোমার ভাল লাগবে… কিছু মনে করবে না। ডাম্বলডোর? ভিক্টরের সামান্য ঠাণ্ডা লেগেছে… ওর শরীরটা তেমন ভাল নেই।

কারকাফ ওর একজন ছাত্রকে ডাকলেন। হ্যারিকে পাশ দিয়ে যাবার সময় হ্যারি ওকে লক্ষ্য করল। বেশ ছেলেটি… লম্বা নাক, মোটা দুই ভুরু। ওকে চিনিয়ে দেবার অপেক্ষা রাখে না। হ্যারিকে দেখে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে বলল–হ্যারি–আমি ক্রাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *