০৪. ব্যাক টু দ্য বারও

০৪. ব্যাক টু দ্য বারও

হ্যারি পরদিন বেলা বারটার মধ্যে ট্রাঙ্কে ওর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল।

স্কুলের বইপত্র, জামা–কাপড়, বাবার অদৃশ্য হয়ে যাবার আলখেলা, সিরিয়সের দেওয়া ঝাড়ু। হোগার্টের জাদুমুগ্ধ করা ম্যাপ (গত বছর ফ্রেড আর জঞ্জ ওকে দিয়েছে), লুকিয়ে রাখা খাবার–দাবার, জাদুমন্ত্রের বই, কালি–কলম। দেওয়ালে একটা চার্ট টাঙিয়ে দিয়েছিল। সেটা প্রতিদিন কেটে গেলে ক্রস করে দিত। বোঝা যেত আর কদিন এখানে কাটাতে হবে।

প্রিভেট ড্রাইভের চার নম্বর বাড়ির সকলেই উত্তেজিত। জাদুকর–জাদুকরী ওর বাড়িতে আসবেন তার জন্য ভার্নন খুবই উদবিগ্ন! ডার্সলে পরিবারের সে সময় সকলেই ছিল অশান্ত ও অস্থির। হ্যারি বলেছে, উইসলিরা ঠিক পাঁচটার সময় আসবেন।

–আমি আশাকরি তুমি ওদের ভদ্ৰ সভ্য ড্রেস পরে আসতে বলেছ।… আমি দেখেছি ওরা কি কুৎসিত জামা–কাপড় পরে চলাফেরা করে। সুন্দর–ভাল ড্রেস পরে চলাফেরা করতে পারে না? ভদ্র সমাজে ওইরকম ঢিলেঢালা আলখেল্লা পরে আসাটা অদ্ৰজনক এটা তুমি বোঝ। মি. ও মিসেস উইসলি পরিচ্ছদ সম্বন্ধে উদাসীন। জাদুকররা যা পরে তাই পরেন। মি, ডার্সলে খুব চিন্তিত। বাড়িতে কেউ ভাল ড্রেস পরে না আসলে তিনি মোটেই তাদের পছন্দ করেন না। পাড়ার লোকেরা দেখলেই বা কি বলবে?

হ্যারি অবশ্য ড্রেস–ফ্রেসের তোয়াক্কা করে না। ভার্নন বেছে বেছে তার দামি প্যান্ট–শার্ট পরলেন। লোকেরা ভাবতে পারে অতিথিদের আসার জন্য ভাল ড্রেস পরেছেন। ভার্নন ও পেটুনিয়া হেডউইগকে প্রাইভেট হাসপাতালে চালান করতে বলেছেন, ডাডলিকে।

নিঃশব্দে ওরা লাঞ্চ শেষ করলেন। ডাডলিও পিটুনিয়া যা খেতে দিয়েছে নিঃশব্দে খেয়ে ফেলল। আন্টি কিছুই মুখে তুললেন না। দুহাতে মুখ রেখে বসে রইলেন। মাঝে মাঝে শুকনো জিব চাটতে লাগলেন।

–ওরা নিশ্চয়ই নিজেদের গাড়িতে আসবে? আঙ্কেল ভার্নন খেতে খেতে বললেন।

–হ্যাঁ, তাইত মনে হয়, হ্যারি বলল।

এখন আর উইসলিদের গাড়ি নেই। পুরনো ফোর্ড গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন। উইসলি ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের গাড়িতে আসছেন। এখন ওদের গাড়ি হোগার্টের নিষিদ্ধ জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছে। গতবারও ডার্সলেদের কাছে দেখা করার সময়ে অফিসের গাড়িতে এসেছিলেন।

ভার্নন সকলকে বিচার করে তাদের মত অর্থ–বাড়িঘর–গাড়ি চাকর–বাকর আছে তার ওপর। তাই উইসলিদের গাড়ি নেই অফিসের গাড়িতে চেপে হ্যারিকে নিতে আসছে শুনে খুশি হলেন। যদিও আঙ্কেল ভার্নন, মি. উইসলি নিজস্ব ফেরারি গাড়ি চেপে এলেও খুশি হতেন না।

হ্যারি সমস্ত বিকেলটা ওর ঘরে শুয়ে কাটাল। বিরক্তি লাগে আন্টি পেটুনিয়াকে বারবার জানালা দিয়ে উঁকি মারতে দেখে। সবাই এমন মুখ করে ঘুরছে যেন একটা গভার পালানোর সতর্ক বার্তা পেয়েছে যে কোনও সময় কোনও বাড়িতে ঢুকতে পারে। ঠিক পাঁচটা বাজার পনের মিনিট আগে হ্যারি নিচে নেমে বসবার ঘরে ঢুকল।

আন্টি পেটুনিয়া তখন কুশনের কভার টানটান করছেন, পর্দা ঠিক করছেন। আঙ্কেল ভার্নন হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে এমন ভান করছেন যেন মনোযোগ দিয়ে কাগজটা পড়ছেন। হ্যারি জানে সবই উৎকণ্ঠা কাটাবার পন্থা ও জাহির করা। হ্যারির মনযোগ কোনও গাড়ি এসে থামল কিনা তার দিকে। ডাডলি একটা আর্ম চেয়ারে আঁটসাঁট হয়ে বসে। মোটাসোটা হাত দুটো পেছনে ঘুরিয়ে রেখেছে। হ্যারির দারুণ টেনসন। ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে হলের সিঁড়িতে বসে রইল। বারে বারে ঘড়ি দেখে। হৃদযন্ত্র খুব দ্রুত চলছে।

পাঁচটা বেজে গেল তাও উইসলিদের দেখা নেই। আঙ্কেল ভার্নন গরম স্যুট পরে দরদর করে ঘামছেন। বার বার বাইরে বেরিয়ে রাস্তা দেখছেন।

হ্যারির উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–আশ্চর্য এখনও ওদের কোনও পাত্তা নেই!

–হ্যাঁ, হয়তো ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গেছেন।

পাঁচটা বেজে দশ, তারপর পাঁচটা পনের তাও উইসলিদের আসার কোনও নাম গন্ধ নেই। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল তাও দেখা নেই।

–আশ্চর্য! ওদের কোনও বুদ্ধি–সুদ্ধি নেই নাকি?

–আমাদেরও তো কোনও কাজ থাকতে পারে।

–হয়ত ভাবছে ডিনার খেয়ে যাবে।

হ্যারি বাইরে থেকে দেখল আঙ্কেল ভার্নন অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছেন আর ঘড়ি দেখছেন।

–ওরা আসবে, ছেলেটাকে নেবে আর চলে যাবে। আর তো কিছু নয়।… মনে হয় দিন ভুল করেছে।

–আমার মনে হয় ওদের সময়জ্ঞান খুব কম। ভাবছে যখন খুশি গেলেই হল।

–মনে হয় ভাঙা ঝর ঝরে গাড়ি পেয়েছে। ওরা সময়–টময়ের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। গাড়িটা হয়ত রাস্তায় ভেঙে পড়েছে।

হ্যারি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আঙ্কেল–আন্টির মন্তব্য শোনে।

হঠাৎ ওরা অদ্ভুত শ শ শ… ঘরর ঘরর শব্দ… কিছু ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল। হ্যারি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। ওই ওরা এসে গেছে। কিন্তু শব্দটাতো গাড়ির নয়। শব্দটা আসছে পাশের ঘরের দরজা থেকে। ভার্নন–পিটুনিয়া অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলেন। ডাডলি ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকল। ওর মুখে ভয়ঙ্কর এক ভয়ের ছাপ!

–হ্যারি বলল, কী হয়েছে?

ডাডলি মনে হয় দাঁত কপাটি লেগেছে। কিছু বলতে গেল, কিন্তু পারলো না। ও এক দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। তবু শব্দ থামছে না।

হ্যারি বসবার ঘরে ঢুকল।

ধাক্কা মারার আর কোনও জিনিস ভেঙে ফেলার শব্দ।

শব্দটা আসছে ঢাকা দেওয়া ফায়ার প্লেস থেকে। ফায়ার প্লেসের সামনের দিকটা কয়েকটা কয়লার মতো জিনিস দিয়ে ঢাকা। পেটুনিয়া তখন ঘরের এক ধারে দেওয়ালের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে কী ব্যাপার বলত?… তুমি একটু দেখ ফায়ার প্লেস থেকে কিসের শব্দ আসছে।

কয়েক সেকেন্ড পরই ওই ফায়ার প্লেসের ভেতর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেল।

–ওরে বাবা, ফ্রেড… না না ফিরে চল। কোনও একটা ভুল হয়ে গেছে। জর্জ তুমি ওইরকম শব্দ করবে না।… চল চল আমরা ফিরে যাই… রনকে বল।

–ড্যাড হ্যারি নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে।

–ফায়ার প্লেসের ঢাকা দেওয়া বোর্ডে কারা যেন দমাদম করে ঘুষি মারছে।

–হ্যারি, হ্যারি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছ? ডার্সলেরা ভীষণ রেগে হ্যারিকে ঘিরে রইল।

-এসব কী ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারছি না। ভার্নন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন।

হ্যারি বলল–ওরা ফ্লু-পাউডার আগুনে ছড়িয়ে এখানে আসতে চেষ্টা করছে। মুখটা বন্ধ করে রেখেছেন তো আসবে কেমন করে? ওরা মন্ত্র বলে জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে। কথাটা বলে হ্যারি বন্ধ ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে বলল–মি. উইসলি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

দমাদম শব্দ থেমে গেল। চিমনি থেকে কে যেন বলল, শ–শ–চুপ!

–মি. উইসলি আমি হ্যারি কথা বলছি। ফায়ার প্লেসের ঢাকনা বন্ধ আছে। ওখান দিয়ে আসতে পারবেন না।

–চুলোয় যাক। ফায়ার প্লেসের দরজা বন্ধ করে রেখেছে কেন?

–তাদের আরেকটি ইলেকট্রিক ফায়ার আছে তাই। হ্যারি ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করল।

–সত্যি! মি. উইসলি উত্তেজিত হয়ে বললেন–ইলেকট্রিক! তুমি তাই বললে হ্যারি–আমাদের দেখতে হবে সেটা কেমন। ভাবতে দাও।…… রন!

হ্যারি রনের কথা শুনতে পেল।-এখানে তোমরা কি করছ–কী হয়েছে, ব্যাপার কি? ফ্রেডের গলা শুনতে পেল–আমরা এমনিভাবে বাড়িতে ঢুকতে চেয়েছিলাম, এমন অবস্থা হবে কে জানেন?

জর্জ বলল–আমাদের দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে নাকি?

–মি. উইসলি বললেন, আমার পেছনে সকলে লাইন করে দাঁড়াও। আমি ইশারা করলে তোমরা সব একসঙ্গে ধাক্কা দেবে।

হ্যারি সোফাতে এসে বসল। আঙ্কেল ভার্নন অবস্থা বুঝে এগিয়ে গেলেন।

আপনারা ভেতরে ঢুকলেন কেমন করে এখন কী করতে চান?

–ব্যাংগ।

ফায়ার প্লেসের দরজাটা মড়মড় করে ভেঙে পড়তেই মি. উইসলি, রন, ফ্রেড আর জর্জ ফায়ার প্লেস দিয়ে ঘরে ঢুকল। তাদের এমন অবস্থা তাকানো যায় না। সারা দেহে ভাঙ্গা ইট চুনকালি ইত্যাদিতে ভরে গেছে। আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে সকলেই হাঁফাচ্ছে।

আন্টি পেটুনিয়া ওদের অবস্থা দেখে ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে সোফার ওপর পড়ে গেলেন।

–হাঃ বাঁচলাম! মি. উইসলি ভার্ননের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন আপনি নিশ্চয়ই মি. ডার্সলে? কথাটা বলে সবুজ আলখেল্লার ধূলা ঝাড়ুলেন, চশমাটা মুছলেন।

লম্বা একহারা চেহারা, প্রায় মাথায় টাক… ভার্ননের দিকে এগিয়ে এলেন। কিন্তু আঙ্কেল হাত না মিলিয়ে দুএক পা পিছিয়ে এলেন। সঙ্গে পেটুনিয়াকেও ধরে নিলেন।

আঙ্কেল ভার্ননের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। ওর সব চেয়ে সুন্দর মূল্যবান স্যুট ধুলোতে ভরে গেছে। গোঁফ ও ধুলোতে ভরে গেছে। দেখে মনে হয় হঠাৎ তিরিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।

মি. উইসলি বলল, অত্যন্ত দুঃখিত মি. ডার্সলে… ভাঙা ফায়ার প্লেস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন। আমি ভাবলাম আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে একটু অসুবিধে হতে পারে… আপনার ফায়ার প্লেসের সঙ্গে ফুঁ নেটওয়ার্কের সঙ্গে কানেক্ট করেছি… বেশি সময়ের জন্য নয় শুধুমাত্র এই বিকেলের জন্য। মাগলদের ফায়ার প্লেসের সঙ্গে সাধারণত কানেক্ট করা যায় না। আমার সঙ্গে ফ্লু–রেগুলেশন প্যানেলের যোগাযোগ আছে, ওরা আমার জন্য লাগিয়ে দিয়েছে। ভাববেন না আমি জাদুদণ্ড দিয়ে আগুন সৃষ্টি করব তখন ছেলেরা বিনা বাধায় চলে যেতে পারবে। এর পরে আমি আপনার ফায়ার প্লেস মেরামত করে দেব। আমি উবে যাবার আগে।

হ্যারি খুব ভাল করেই জানে সমস্ত ব্যাপারটা ভার্নন, পেটুনিয়া ও ডাডলির বুদ্ধির অগম্য। ওরা তখনও উইলসির থান্ডারস্ট্রাকে ভয়ে বিহ্বল হয়ে আছে। নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে কিছুই বোঝে না, জানে না।

–হ্যালো হ্যারি তোমার সব জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেছে তো? মি. উইসলি বললেন।

ও আর জর্জ ঘর ছেড়ে চলে গেল। ওরা জানে হ্যারির বেডরুম কোথায়। একবার গভীর রাতে ওখান থেকে ওকে উদ্ধার করেছিল। হ্যারির সন্দেহ হয় ফ্রেড আর জর্জ, ডাডলিকে দেখতে চায়। হ্যারির মুখে ওর সম্বন্ধে অনেক মজার মজার কথা শুনেছে। তাই একটু ওর সঙ্গে জোক করতে চায়।

সকলেই চুপচাপ। উইসলি ঘরের নীরবতা ভঙ্গ করে কি বলবেন ভেবে পেলেন। বললেন–সুন্দর জায়গায়, অতি সুন্দর বাড়ি…।

ঝকঝকে তকতকে ঘরটা আর আগের মতো নেই। ধূলো–বালি–ইটের টুকরোতে ছত্রকার। উইসলির ওই রকম গুণগান একটুও মনে ধরলো না ভার্ননের, বরং মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। পেটুনিয়া তখন ধাতস্থ হয়েছেন শুরু করলেন জিব চোষা। আসলে ওদের গালগল্প করার মতো মনের অবস্থা নেই।

মি. উইসলি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। মাগলদের পেছনে লাগতে খুব ভালবাসেন। হ্যারি লক্ষ্য করল ঘরের টেলিভিশন, ভিডিও রেকর্ডারগুলো দেখার জন্য ছটফট করছেন। উইসলি বিজ্ঞের মতো বললেন–আহা–হা! আপনারা দেখছি সবকিছুতেই ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করেন। ঘরে অনেক প্লাগ দেখছি। আমার আবার প্লাগ জমানোর স্বভাব। আর পুরনো ব্যাটারিও। আমার বাড়িতে ব্যাটারি আর প্লাগে ভর্তি। আমার স্ত্রী বলেন, আমি নাকি পাগল। কিন্তু আপনিও তাই দেখছি।

আঙ্কেলের মনে কোনও সন্দেহ থাকে না মি, উইসলির মাথা খারাপ। ভার্নন একটু অস্বস্তিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ভাবলেন, পাগল লোকটা পেটুনিয়াকে আক্রমণ না করে বসে। ঠিক সেই সময় ডাডলি ঘরে ঢুকল।হ্যারি সিঁড়িতে ট্রাক টানাটানির শব্দ শুনতে পেল। কোনও সন্দেহ নেই ডাডলি সেই শব্দ শুনে ভয় পেয়েছে। ডাডলি ঘরের দেওয়ালের এক পাশে দাঁড়িয়ে উইসলিকে ভয়ার্ত চোখে দেখতে লাগল। তারপর ভয়ে ভয়ে মা-বাবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধু তাই নয় মি. উইসলিকে আতঙ্কিত হয়ে দেখতে লাগল। আঙ্কেল বুঝতে পারছেন না, পাগলের হাত থেকে কাকে বাঁচাবেন… ছেলে না স্ত্রীকে।

–আহ্… আপনার ছেলে? হ্যারির কাজিন… তাই না হ্যারি?

–হা ডাডলি… আমার কাজিন; হ্যারি বলল ডাডলি রন আর হ্যারির দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। প্যান্টটা যাতে আরও নেমে না যায় সেই আশঙ্কায় চেপে ধরে রইল। উইসলির ভার্ননের মতই ডাডলিকে একটু অদ্ভুত মনে হল। সামান্য করুণাও হল।

–ছুটি কেমন কাটালে ডাডলি? উইসলি স্নেহভরে জিজ্ঞেস করলেন।

ডাডলি চুপ করে রইল। হ্যারি দেখল ডাডলি তখনও তার বিশাল প্যান্টটা খুলে না পড়ে তারও চেষ্টা করছে পেছনে হাত দিয়ে। ফ্রেড আর জর্জ ঘরে ঢুকল। ওরা ধরাধরি করে এনেছে হ্যারির স্কুল ট্রাঙ্ক।

ঘরের সব কিছু দেখতে দেখতে ওদের চোখ পড়ে গেল ডাডলির দিকে। ওদের মুখে দুষ্টুমি হাসি ফুটে উঠল।

–ট্রাঙ্কটা নামানোর সময় ভেঙ্গেটেঙ্গে ফেলনি তো? উইসলি ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন। কথাটা বলে রোবের আস্তিন গুটিয়ে পকেট থেকে ম্যাজিক ওয়াল্ড জাদুদণ্ড বার করলেন। ডাডলি সেটা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এতক্ষণে ফায়ার প্লেসে স্বাভাবিকভাবে আগুন জ্বলে উঠল। এমনভাবে জ্বলতে লাগল যেন অনেকটা সময় ধরে জ্বলছে।

–হ্যারি এবার তাহলে আমাদের যেতে হয়, উইসলি বললেন।

–আসছি, ফ্রেড বলল, না না একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ফ্রেডের পকেট থেকে ছোট বড় টফি চকোলেটের গাদাগাদা ব্যাপার ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রেড পকেট থেকে একটা চেরি টফি বার করে ডাডলিকে দিল তারপর ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে বলল, দ্যা বাররো। সঙ্গে সঙ্গে একটা হুস হুস শব্দ শোনা যেতেই আন্টি পেটুনিয়া আঁতকে উঠলেন। দ্বিতীয় বার হুস শব্দের পর ফ্রেড অদৃশ্য হয়ে গেল।

মি. উইসলি বললেন, হ্যারির ট্রাঙ্কটা নিয়ে তুমিও যাও। তারপর রন।

রন হাত তুলে ডার্সলেদের বলল–আবার দেখা হবে। তারপর ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত আগুনের কাছে গিয়ে বলল–বাররো তারপরই ফ্রেড–জর্জের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।

বাকি রয়ে গেল উইসলি আর হ্যারি। হ্যারি ডার্সলেদের হাত তুলে বলল বাই…।

হ্যারি আগুনের কাছে যেতেই উইসলি বাধা দিলেন। ডার্সলের দিকে মৃদু হেসে বললেন–হ্যারি আপনাদের কাছে গুডবাই বলল, শুনতে পেয়েছেন?

হ্যারি হেসে উইসলিকে বলল, কিছু যায় আসে না। আমি কোনও কিছু মনে করি না।

উইসলির হাত তখনও হ্যারির কাঁধে ন্যস্ত।

–আপনারা কিন্তু হ্যারিকে আগামী বছর গরমের ছুটিতে ছাড়া দেখতে পাবেন। অবশ্যই আপনারা ওকে বিদায় অভিনন্দন জানাবেন। তাই না?

কথাটা শুনে আঙ্কেল ভার্নন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। যে লোকটা আধঘণ্টা আগে দরজা দিয়ে না এসে ফায়ার প্লেস ভেঙেচুড়ে একশা করে, ঘর তছনছ করেছে তার সঙ্গে কথা বলতে মন চাইল না। ওরা চলে গেলে কে সব ঠিকঠাক করবে–পরিষ্কার করবে আগের মতো?

কিন্তু মি. উইসলির হাতে তখনও জাদুদণ্ড! ঝগড়া করে, কথা কাটাকাটি করলে লোকটা আরও ক্ষতি করবে। তাই অতি অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন–গুড বাই। আবার দেখা হবে।

হ্যারি ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত আগুনের দিকে একটা পা বাড়িয়ে বলল–আবার দেখা হবে–বাই।

হঠাৎ শোনা গেল গলাটিপে ধরার শব্দ। শব্দটা হ্যারির পেছনের দিক থেকে ভেসে এল। হ্যারি পেছন ফিরে দেখল ডাডলি ওর মা-বাবার আড়ালে দাঁড়িয়ে নেই। কফি টেবিলে বসে গোগ্রাসে একটা রুটি বা কেক গিলে খেতে গিয়ে গলায় আটকেছে। শব্দটা তারই… গলা থেকে বার করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ওকে বাঁচানোর জন্য পেটুনিয়া ওর মুখ থেকে খাবারের বাকি অংশ টেনে টেনে বার করতে লাগল। ডাডলি তখন আর্তস্বরে চেঁচাচ্ছে। গলা থেকে পেটুনিয়া যাতে খাবারের বাকি অংশ বের করতে পারে… ডাডলি হাত–পা ছুঁড়ে বাধা দেয়। তাই ওর হাত দুটো জোর করে চেপে ধরলেন ভার্নন। খাবার মুখ থেকে টেনে আনার জন্য রেগে গিয়ে ডাডলি চিৎকার করে চলল। অনেক কসরৎ করেও ওর মুখ থেকে পেটুনিয়া অর্ধভূক্ত খাবারটা টেনে বার করতে পারলেন না।

মি. উইসলি বললেন, ঘাবড়াবেন না, আমি বার করি দিচ্ছি। না করলে দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

ডাডলির দিকে এগিয়ে গিয়ে জাদুদটা ওর দিকে তাক করলেন, কিন্তু আন্টি পেটুনিয়া ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে ডাডলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উইসলিকে জাদু প্রয়োগ করতে বাধা দিলেন।

মি. উইসলি হেসে বললেন, আপনার ছেলের দুষ্টুমী… ওর গলায় একগাদা টফি আটকেছে… এনগরজমেন্ট চার্ম ব্যবহার করছি। পেট থেকে খাবার টেনে বার করতে হবে, অনুগ্রহ করে ঘাবড়াবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।… আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

কিন্তু আঙ্কেল–আন্টি ওদের কোন কথাই শুনতে চায় না। মি. উইসলিকে বাধা দিয়ে ডাডলির জিভ ধরে টানতে লাগলেন। ডাডলি আরও ভয় পেয়ে গেল। আশ্চর্য! আমাকে বাধা দিচ্ছেন কেন? আমি তো আপনাদের সাহায্য করছি মাত্র। এটা আমার কর্তব্য।

ভার্নন, পেটুনিয়ার একটা হাতের বালা ছুঁড়ে মারলেন মি. উইসলির দিকে। ক্ষ্যাপা–আঘাতপ্রাপ্ত গন্ডারের মতো আঙ্কেল মি. উইসলির হাত থেকে জাদুদণ্ড কেরে নেবার চেষ্টা করতেই মি, উইসলি অতি গম্ভীর স্বরে বললেন–হ্যারি তুমি যাও। এখনই যাও… আমি সব ঠিক করছি।

হ্যারি মজার ব্যাপারটা না দেখে যেতে চায় না।

ভার্নন আর একটা বালা ছুঁড়ে দিলেন মি. উইসলির দিকে। ভাগ্য ভাল সেটা হ্যারির কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। হ্যারি ব্যাপারটা মি. উইসলির হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক মনে করল। আর দেরি না করে ফায়ার প্লেসে একটা পা রেখে বলল–বারো।

শেষ দৃশ্য দেখল আঙ্কেল ভার্নন পাগলের মতো হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই ছুঁড়ছেন মি. উইসলিকে। ওদিকে আন্টি পেটুনিয়া ডাডলিকে চেপে ধরে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। ডাডলির জিভটা অজগর সাপের মতো বেরিয়ে লকলক করছে।

পর মুহূর্তে আঙ্কেল ভার্ননের বসার ঘর হালকা সবুজ রঙয়ের অগ্নিশিখাতে পূর্ণ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *