০১. দ্য রিডল হাউজ

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার জে. কে. রাওলিং

০১. দ্য রিডল হাউজ

গ্রামটার নাম লিটিল হ্যাংগলেন। দীর্ঘদিন থেকে, গোপনে, গ্রামের লোকদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অস্বস্তি আর চাপা ভয়। ওই অশান্তি ও অস্বস্তির কারণ একটা পোড়া বাড়ি। গ্রামের মানুষ ওই বাড়িটাকে এখনও ডাকে রিডল হাউজ বলে। গ্রাম থেকে দূরে পাহাড়ের চূড়োয় একলা দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার নাম চিরদিন ধরেই রিডল হাউজ। অনেক অনেক দিন আগে, প্রায় বছর পঞ্চাশ তো হবেই, ওই বাড়িতে বাস করতো রিডল পরিবারের লোকেরা। বাড়িটায় তখন কতো যে জৌলুস ছিলো! আলো ছিলো–জানালায় ছিলো সুন্দর ঝকঝকে কাঁচ; আর বাড়ির ভেতরে ছিলো আনন্দ হুল্লোড় ফুর্তিতে ডগমগ বাসিন্দারা। এইসব কিছু নিয়ে, কতোদিন আগে রিডল হাউজ, পাহাড় চূড়ায় একা বসে বসে চেয়ে থাকতো পুরো গ্রামটার দিকে। রিডল হাউজ থেকে পুরোটা গ্রাম-এ মাথা থেকে ও মাথা–পরিষ্কার দেখা যেতো। এখন রিডল হাউজ শুধু নামেই বাড়ি; ভেঙেচুরে একাকার, পোড়ো আর ভূতুড়ে। অনেক ঘরের দরজা জানালা উধাও, অনেক অনেক জায়গায় ছাদের টালি ভেঙেচুরে ছিন্ন ভিন্ন, মেঝে ফেটে ফেটে গজিয়েছে নানারকম গাছ, বুনো আইভিলতা ঢেকে দিয়েছে বারান্দার কারুকাজ। হায়রে-এক সময়ের সেই ঝকঝকে তকতকে সুন্দর, আর আনন্দ হাসিতে ভরা রিডল হাউজের এখন কী ভয়ানক দশা; স্যাঁতস্যাঁতে, নিঃস্তব্ধ, পোভড়া আর ভয় জাগানো।

এখন রিডল হাউজের দিকে চোখ পড়লেই গা ছমছম করে ওঠে। সেটা রাতের বেলায়ই হোক, কি দিনে–ওটার দিকে চোখ পড়লেই ভয়ে বুক ধক করে ওঠে। গ্রামের বুড়োদের হাতে এমনিতেই কাজকর্ম থাকে কম; সারাবেলা ভরে খালি গল্পগুজব করে তারা। এই কথা সেই কথার মধ্যে মধ্যে ঠিকই রিডল হাউজের কথা এসে পড়ে। অনেকদিন আগে কী ঘটেছিলো ওই বাড়িতে, সেই কথা ঘুরে ফিরে এসে পড়বেই তাদের গল্পে। এই যে গ্রামের লোকেরা রিডল হাউজকে মাঝে মাঝেই ডাকে ভূতের বাড়ি বলে, সে তো বিনা কারণে নয়। বাড়িটাতে ভয়ঙ্কর একটা অশুভ ব্যাপার ঘটেছিলো তো, পঞ্চাশ বছর আগে। সেটা ছিলো পঞ্চাশ বছর আগের এক গ্রীষ্মের সকাল। সেই সকালে খুব ভয়ঙ্কর খারাপ ঘটনা ঘটেছিলো। যদিও গ্রামের কেউই জানে না আদতে কী ঘটেছিলো এবং কীভাবে ভয়ঙ্কর খারাপটা ঘটেছিলো; কিন্তু ওই বিষয়ে কথা বলার সময়, আচ্ছা এক গল্প বানিয়ে ফেলে প্রত্যেকে–যে যার মতো, যেমন ইচ্ছে তেমন গল্প। তবে নিজেরা যা জানে তা হলো, গ্রীষ্মের এক ভোরে, বাসার কাজের মেয়েটা ঘরদোর সাফ করার জন্য দরোজা ঠেলে ড্রইংরুমে ঢুকে দেখে, সর্বনাশ হয়েছে। রিডল হাউজের সকলে (সকলের বলতে তো ছিলো মোটে তিনজন) মরে পড়ে আছে মেঝের ওপরে।

সকলকে এইভাবে মরে পড়ে থাকতে দেখে মেয়েটা ভয়ে হিম চিৎকার দিতে দিতে দিশেহারা হয়ে ছোটা ধরে। ওর চিৎকারে আকাশ–বাতাস পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে ওঠে, গ্রামবাসীরা তো বটেই। কী যে ভয়ঙ্কর কথা মেয়েটা শোনায় সকলকে, শোনো শোনো–দেখি কি–মুনিবদের তিনজনেরই চোখ হা করে খোলা। যেন ভয় পেয়েছিলো কিছু দেখে খুব খারাপ কিছু হবে। নয়তো চোখ এমন হা করা থাকে মরা মানুষের! হায় হায়রে-এমন লোকেরা, পড়ে আছে ঠাণ্ডা মেঝের ওপর! ডিনারের জামা–কাপড়ও পাল্টায়নি একজন! ও ঈশ্বর! কোন জীনভূত এসেছিলো কে জানে! ওরে মা রে-এই মরার দৃশ্য জীবনেও ভুলতে পারবো না–ও ঈশ্বর!

যথারীতি পুলিশকে খবর দেওয়া হল। সেই অদ্ভুত ঘটনায় লিটিল হ্যাংগেলটনের সবাই শুধু মানসিক আঘাতে নয়–ভয়–ভাবনা ও কৌতূহলে… অকথিত উত্তেজনায় থমথম করতে লাগল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি গ্রামের সকলেই লোক দেখান দুঃখ প্রকাশ করল। অন্তরে অন্তরে গ্রামের লোকেরা কেউ রিডল হাউজের লোকদের পছন্দ করত না। এক কথায় তারা ছিল অতিমাত্রায় অপ্রিয়। পরিবারের মি, ও মিসেস রিডল খুব ধনী ছিলেন শুধু নয়, ছিলেন অত্যন্ত অহঙ্কারী ও অসংস্কৃত–অসভ্য। তাদের একমাত্র ছেলেও তাই। অনেকের মতে টিম ছিল বাপ–মায়ের চেয়েও বেশি অহঙ্কারী–অসভ্য! গ্রামের লোকেরা, সুস্থ সকল তিনজন মানুষের ওই রকম মৃত্যু, ভাবা যায় যে সাধারণ মৃত্যু নয়–তা তারা একেবারে নিশ্চিত। একই রাতে তিনজনের এই অস্বাভাবিক মৃত্যু!

গ্রামের মদশালা হাংগম্যানে সে রাতে মদো–মাতালদের ভিড়ে জমজমাট, হৈ হুল্লোড় কিন্তু সকলের মুখে একই প্রশ্ন, কে খুনি, কেনই বা ওদের খুন করা হল। আজ্ঞা আরো জমে উঠল যখন রিডলদের কুক হঠাৎ পানশালায় নাটকীয়ভাবে ঢুকল। ওরা তখন বসে বসে আগুন পোহাচ্ছিল। ও এসে সকলের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিয়ে বলল, ফ্র্যাংক ব্রাইস নামে একজন খুনের জন্যে ধরা পড়েছে।

কেউ কেউ বলে উঠে–ফ্র্যাংক? না আমাদের বিশ্বাস হয় না–হতেই পারে না।

ফ্র্যাংক ব্রাইস রিডলদের বাগানের মালি। ও রিডল হাউজের মাঠের এক কোণে একটা কুড়েঘরে থাকত। যুদ্ধে শত্রুদের গুলি লেগে একটা পা শক্ত হয়ে গেছে, একেবারেই নিরীহ গোবেচারা মানুষ, ও লোকজন ভিড় ভাট্টা গোলমাল এড়িয়ে চলতো। যখন থেকে রিডলরা ওই বাড়িতে এসেছে তখন থেকেই ও বাগানে মালির কাজ করে। স্বভাবতই যারা পাবে মদ খাচ্ছিল, হৈ–হুঁল্লোড় করছিল তারা আরও কিছু খবরের আশায় আঁকিয়ে বসল। পানশালা আরও সরগরম হয়ে উঠল।

মি. রিডল কিম্ভুতকিমাকার ছিল। এক মহিলা চারবার শেরী খাবার পর কৌতূহলী গ্রামবাসীদের বলল। অমিশুক… আমি ওকে এক বোতলের জায়গায় একশ বোতল মদ অফার করতাম যদি ও ভদ্র ভাল মানুষ হত। কারও সঙ্গে কখনো মিশতোই না।

–আহ এখন, পানশালায় এক মহিলা বলল, যুদ্ধের সময় ফ্র্যাংক দারুণ কষ্টে দিন কাটিয়েছে, ফিরে এসে একটা ছোটখাট কাজে নিরিবিলি থাকতে চাইছিল। তার মানে এই নয় যে…।

কুক জোর গলায় বলল, দরজার চাবিতো ওর কাছেই থাকত, তাহলে? আমি ভাল করেই জানি পেছনের দরজার ডুপ্লিকেট চাবি ওর কাছে থাকত। কেউ তো দরজা ভেঙে ঢোকেনি রাত্তির বেলায়, জানালাও ভাঙা ছিল না। আমরা যখন সবাই ঘুমচ্ছি তখন ফ্র্যাংক চুপিসারে দরজা খুলে কাজটা সেরেছে।

গ্রামের লোকেরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

একজন ঘোঁত ঘোঁত করে বলল–ওই লোকটা দারুণ বিশ্রীভাবে তাকায়… দেখলে হাড়পিত্তি জ্বলে যায়।

দোকানের মালিক বলল, আমায় যদি তার কারণ জিজ্ঞেস কর তো আমি বলব, যুদ্ধ ওকে অদ্ভুত এক মানুষে পরিণত করেছে।

এক মহিলা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বলল–আমি কিন্তু সব সময় ফ্র্যাংকের খারাপ দিকটা দেখি না। দেখি, তুমি বল ডট?

ডট মাথা নেড়ে বলল, দারুণ বদরাগী… আমার মনে আছে ও যখন ঘোট ছিল…।

পরেরদিন সকালে লিটিল হ্যাংগেলটনের কেউ বিশ্বাস বা সন্দেহ করতে চাইল না যে রিডল পরিবারকে ফ্র্যাংক খুন করেছে।

লিটিল হ্যাংগলেটনের সংলগ্ন শহর গ্রেট হ্যাংগলেটনের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার নোংরা… পুলিশ স্টেশনে ফ্র্যাংক ক্রমাগত বলতে লাগল, ও খুন করেনি, নির্দোষ নিরপরাধ… যেদিন রাতে রিডলরা খুন হয় ও একজন অচেনা অল্পবয়সী ছেলেকে… ও মাঠে–দেখেছিল। রোগাপটকা চেহারা, মাথার চুল কাল। ও দেখলে কি হবে গ্রামের লোকদের কারও নজরে পড়েনি সেই চেহারার ছেলে। পুলিশ বলল, নানারকম সব গল্প ফাঁদছে ফ্র্যাংক।

যখন ওই রকম অবস্থায় ফ্র্যাংক সম্বন্ধে ওইসব কথাবার্তা চলছে, তখন থানাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল। তারপরই সব গুজবের অবসান, সবকিছু বদলে গেল।

পুলিশ এর আগে ওই রকম অদ্ভুত অস্বাভাবিক রিপোর্ট কখনো পায়নি। একদল চিকিৎসক তিনটি মৃতদেহ পরীক্ষা করার পর এক মত হয়েছে যে, ওদেরকে কেউ বিষ খাওয়ায়নি, অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেনি, গলাটিপে বা শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেনি। তাছাড়া আরও জানিয়েছে রিডলদের স্বাস্থ্য খুবই ভাল ছিল। তবে একটা সিদ্ধান্তে এসেছে; মৃত দেহের চেহারা দেখে মনে হয়, মি. ও মিসেস রিডল আর এদের পুত্র ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছিলেন এবং সেই ভয়েই খুব সম্ভব তাদের মৃত্যু হয়েছে। কেউ তাদের হত্যা করেনি। রিপোর্টের শেষাংশ পড়ে পুলিশরা হতভম্ভ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কেউ ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে এমন কথা ওরা কখনও শোনেনি।

রিপোর্টে যখন ফ্র্যাংক রিডলদের হত্যা করেনি জানা গেল তখন বাধ্য হয়ে পুলিশ ওকে ছেড়ে দিল। রিডলদের লিটল হ্যাংগেলটনের চার্চের উঠানে কবর দেওয়া হল; কিন্তু ওদের কবর কিছুদিন সকলের কাছে একটা কৌতূহলের খোরাক হয়ে রইল। আরও সকলে আশ্চর্য হলো যখন ফ্র্যাংক বাগানের এককোণে ওর ঘোট কুটিরেই ফিরে এসে থাকতে শুরু করল। হ্যাংগম্যান পানশালায় ডট বলল,–আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ওই বাগানের মালিটা রিডলদের খুন করেছে। পুলিশ বা ডাক্তাররা কি বলছে তা আমি মানি না। লোকটার যদি সত্যি সত্যি সভ্যতা, দ্রতা জ্ঞান থাকে তাহলে ওর ওখান থেকে চলে যাওয়া উচিত, কারণ ও জানে আমরাও জানি ও খুনি, খুন ও করেছে।

তারপর রিডল হাউজে যারা বাড়িটা কিনে থাকতে লাগল ফ্র্যাংক তাদের মালি হয়ে কাজ করতে লাগল। কিন্তু বেশিদিন কোনও পরিবার ওখানে টিকতে পারল না। ফ্র্যাংক যে এর কারণ তা নয়, যারাই ওই বাড়িতে থাকতে এল, তারা সেই বাড়িটায় কেমন যেন বিশ্রি একটা গা ছম ছমে ভাব, কিছু একটা বিপদ হতে পারে এই আশঙ্কায় আর সেখানেই থাকতে চাইল না। যারাই মনের আনন্দে থাকতে আসে ভয়ে, ভীত হয়ে চলে যায়।

***

এখন সেই ভুতুড়ে বাড়িটা একজন ধনী লোক কিনলেও সেখানে তিনি থাকেন না। না থাকলেও, অন্য কাজেও ব্যবহার করেন না। গ্রাম অঞ্চলের বাড়ি, নানা লোকে নানা কথা বলতে লাগল। যার যা মনে আসে তাই বলতে লাগল। ভদ্রলোক সেখানে বাস না করলেও ফ্র্যাংককে তার চাকরি থেকে ছাড়ালেন না। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার; বাগান পরিচর্যার জন্য ওকে রেখেছিলেন। তবে ফ্র্যাংক আর আগের মত চটপটে নেই। বৃদ্ধ হয়েছে, বয়স আশি ছুঁই ছুঁই; কানে শুনতে পায় না শুধু নয়, শুকিয়ে যাওয়া পাটা আরও শুকিয়ে গেছে, ঠিকমত চলাফেরা করতে পারে না। তাহলেও সকলে দেখতে পায় ও নিয়মিত গাছপালায় ফুলের বাগানে জল দিচ্ছে, আগাছা পরিষ্কার করছে।

গাছপালায় জল দেওয়া, বাগানের আগাছা উপড়ে ফেলা এসব কাজ ছাড়াও ছেলে মেয়েরা ওকে দেখে পাথর, ঢিল ইত্যাদি ছুঁড়ে বাগান অপরিষ্কার করে সেগুলো ওকে সাফ করতে হয়। শুধু বাগানে নয় রিডল হাউজের জানালা খোলা থাকলে সেখান দিয়ে ঘরের মধ্যে চিল–পাটকেল ছোড়ে। তাছাড়া বাগানের অতি পরিশ্রম করে তৈরি করা মসৃণ ঘাসের জমিতে মনের সুখে সাইকেল চালায়। মাঝেমধ্যে সাহস করে ছেলেমেয়েগুলো রিডল হাউজের জানালা টপকে বা দরজা ভেঙে বাড়ির মধ্যে ঢোকে। ছেলে–মেয়েগুলো ফ্র্যাঙ্কের এই অতি পরিশ্রম করে বাগান ও ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রাখার কোনও মূল্যই দেয় না। সুযোগ পেলে নানা রকমভাবে নোংরা করে আর বৃদ্ধ ফ্র্যাংককে ভেঙ্গায়। ও যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে ওদের তাড়াবার জন্য লাঠি নিয়ে তাড়া করে, তখন ওরা আরও ভেজায়। বেচারা ফ্র্যাঙ্ক ভাল করে হাঁটতে পারে না, ওদের ধরবে কেমন করে। ফ্র্যাঙ্ক জানে ওইসব ছেলে–মেয়েরা ওদের মা-বাবার মতোই মনে করে সে রিডলদের হত্যা করেছে। সে কথা মনে করে–ওকে অত্যাচার করে। তো একদিন আগস্ট মাসের গভীর রাতে কিছু অদ্ভুত রকমের শব্দ শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ওর কুটির থেকে রিডল হাউজের ভেতরে এমন এক অদ্ভুত জিনিস দেখল। সেটা দেখার পর ও মনে মনে হাসল… ভাবল ছেলে–মেয়েগুলো তাহলে ওকে আরও জ্বালাতন করার জন্য ওইসব ভয় দেখানোর কাণ্ডকারখানা করছে। লিটিল হ্যাংগলেটনের আপামর জনসাধারণ নিশ্চিত যে বিড়লদের ফ্র্যাঙ্ক হত্যা করেছে। হত্যা করার শাস্তিও পাচ্ছে।

শুধু অদ্ভুত এক জিনিস ফ্র্যাঙ্ক দেখল তা নয়, দেখার পর ওর পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হল। মাঝে মাঝে ব্যথাতে ওর ঘুম ভেঙে যায়। তাহলেও সেদিনের ব্যথাটা ছিল অতি তীব্র, ও বিছানা থেকে ওঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গরম জল করে সেঁক দেবার জন্য উনুনে জল বসাল। হট ওয়াটার ব্যাগে সেঁক দিয়ে যদি হাঁটুতে শক্ত হয়ে যাওয়া স্থানে ব্যথা কমে সেই আশায়। গরম জল হয়ে গেলে ফ্র্যাঙ্ক সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে হটওয়াটার ব্যাগে জল ঢালতে ঢালতে জানালা দিয়ে রিডল হাউজের দিকে তাকাল। দেখল দোতলার ঘরের জানালা দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। ফ্র্যাঙ্ক বুঝতে পারল দুষ্ট ছেলেগুলো বাড়ির মধ্যে ঢুকে কম পাওয়ারের বাতিতে অন্ধকার অন্ধকার ভাব দেখে, ঘরের ভেতরে যেয়ে ঢুকে ফায়ার প্লেসে কাঠ জ্বালিয়েছে। কাঠের আগুনের আলো দপদপ করে জ্বলছে, তারই আলো।

ওর কোনও টেলিফোন নেই। থাকলেও ও পুলিশকে খবর দিতো না। রিডলদের খুন হবার পর অহেতুক ধরে নিয়ে যাওয়ার অপমানের ঘা এখনও দগদগ করে জ্বলছে। পুলিশকে ও একটুও বিশ্বাস করে না। ও কেটলিটা রেখে যত তাড়াতাড়ি পারে ব্যথা পা নিয়েই দোতলায় উঠে ব্যাপারটা কি জানার জন্য মরচে ধরা চাবির গুচ্ছ নিয়ে কিচেনে এসে রাতের পোশাক ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরে ওয়াকিং স্টিকটা হাতে নিয়ে রিডল হাউসের দিকে চলল।

সদর দরজা দেখে ওর মনে হল না কেউ বা কারা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে। জানালাগুলোও তাই। ফ্র্যাঙ্ক খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির পেছনের দিকে গেল। আইভি লতায় ঢাকা একটা দরজা অনেক হাতড়াবার পর খুঁজে পেল। ও মরচেধরা চাবির গুচ্ছ থেকে একটা চাবি বার করে বন্ধ দরজাটা কোনও রকম শব্দ না করে খুলল। তারপর গুহার মতো নিকষ কালো অন্ধকারে কিচেনে ঢুকল। রিডলদের মৃত্যুর পর এই প্রথম গুহার মত অন্ধকার আর দূর্গন্ধে ভরা রান্না ঘরে ও ঢুকল। রান্নাঘর থেকে দরজা খুলে হলঘরে যেতে একটুও অসুবিধে হল না। সমস্ত হলঘরটা যেমনি ঠাণ্ডা–তেমনি অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝেতে পুরো করে ধূলো আর ঝুল জমেছে। কার্পেটের মতো পুরু ধুলোর ওপর দিয়ে চললে পায়ের শব্দ শোনা যায় না। হলঘরের বড় বড় জানালাগুলো খোলা থাকলে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব থাকতো না। হলঘর থেকে ফ্র্যাঙ্ক সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকাল। কারা যেন সেই ঘরের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা বলছে, চলাফেরা করছে। ও ঘরের ভেতরে না ঢুকে করিডলরে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘরের মধ্যে সে কাঠের আগুনটা জ্বলছে সেটা কড়কড় শব্দ করে জ্বলছে। ফ্র্যাঙ্ক ঠিক বুঝতে পারল না, এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা কেমন করে হচ্ছে, কারাই বা করছে। আশ্চর্য হবারই কথা। হঠাৎ ও সচকিত হয়ে গেল, দুএকজনের চাপা কণ্ঠস্বর শুনে। গলার স্বরটা শুধু চাপা নয় কেমন যেন ভীতিকর।

মাই লর্ড আপনি যদি এখনও তৃষ্ণার্ত থাকেন বোতলে আরও কিছু বেঁচে আছে।

প্রশ্নের জবাবে অন্য কেউ শিরশির গলায় বলল–পরে। গলার স্বরটা অতি তীক্ষ্ম… এত ঠাণ্ডা যে মনে হল বরফের পাহাড় থেকে ঠাণ্ডা বাতাস দূরন্তগতিতে বয়ে আসছে। অব্যক্ত এক ভয়ে ফ্র্যাঙ্কের সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল, মাথার চুল গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।–ওয়ার্মটেল আগুনের কাছে এসে বস।

ফ্র্যাঙ্ক দরজার দিকে কান খাড়া করে রইল, আরও কি বলে শোনার প্রতীক্ষায়। তারপর শুনতে পেল বোতল খোলার শব্দ, শব্দ করে সেটা কোনও একটা সমতল জায়গায় রাখার খট শব্দও।… তারপরেই একটা ভারি চেয়ার টেনে আনার শব্দ। বাইরে থেকে ফ্র্যাকের চোখে পড়ল একজন বেঁটে মতো লোক সেই চেয়ারটা কাঠের আগুনের কাছে রাখল। পিছন ফিরে ছিল বলে ফ্র্যাঙ্ক লোকটার মুখ দেখতে পেলো না। লোকটার পরনে বিরাট একটা ঢলঢলে কাল রং-এর আলখেল্লার মতো পোশাক। মাথার মাঝখানে গোলমতো টাক। ও সামান্য সরে যাওয়াতে ওকে আর দেখতে পেল না।

–নাগিনী কোথায়? আবার সেই হিমশীতল কণ্ঠস্বর।

–লর্ড আমি… আমি বলতে পারছি না। গলার স্বর ওর কাঁপছে…। মনে হয় ও বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।

–আমি শুতে যাবার আগে ওর সব দুধ দুয়ে নেবে ওয়ার্মটেল। রাত্রে আমার দুধ খাবার প্রয়োজন হতে পারে। অনেকটা পথ সফর করে আমি অতিশয় ক্লান্ত।

আরও কিছু শোনার আশায় দরজার গোড়ায় কান খাড়া করে ও দাঁড়িয়ে রইল। সামান্য সময় নীরব থেকে বেঁটে ওয়ার্মটেল বলল,

–লর্ড… আমরা এই বাড়িতে আরও কতদিন থাকব দয়া করে বলবেন?

সেই হিমশীতল স্বর–সপ্তাহ খানেক, বা আর কিছুদিন বেশিও হতে পারে। জায়গাটা মোটামুটি মন্দ নয়, আরামদায়ক। তাছাড়া আমাদের পরিকল্পনা এখনও তেমন এগোয়নি। কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা শেষ হবার আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া বোকামি হবে।

ফ্র্যাঙ্ক কানের মধ্যে একটা আঙুল ঢুকিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য ঘোরাতে লাগল। ওরা আর কী বলে শোনার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। তবে কিডিচ কাপ খেলা হবে শুনেছে। কিডিচতো কোনও শব্দ নয়। অদ্ভুত নাম, এর আগে কখনো সে শোনননি।

–লর্ড… কিডিচ ওয়ার্ল্ড কাপ? বেঁটে ওয়ার্মটেল বলল।

ফ্র্যাঙ্ক আরও ঘন ঘন কান খোঁচাতে লাগল–আমায় ক্ষমা করবেন… ঠিক বুঝতে পারলাম না–ওয়ার্ল্ড কাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন আমাদের থাকতে হবে?

–মূর্খ! তুমি জান না ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে জাদুকররা আসছে। জাদু মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কর্মীদের অসম্ভব ব্যস্ত থাকতে হবে। সে সময় তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সকল ধরনের অস্বাভাবিক কাজের ওপর, চেকিং, ডবল চেকিং মাগলদের প্রকৃত পরিচয়পত্রের ওপর। মাগলরা যেন বুঝতে না পারে কি হচ্ছে, সে জন্য তাদের অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হবে। আর সে সময়টার জন্য আমরা অপেক্ষা করব।

ফ্র্যাঙ্ক কান পরিষ্কার করা বন্ধ করল। ও খুব পরিষ্কারভাবে শুনেছে : জাদুকর, মাগল, জাদু মন্ত্রণালয়। ওর মনে হল ওদের কথাবার্তা খুবই গোপনীয়। তবে গুপ্তচর আর অপরাধী কথা দুটো খুবই পরিচিত। ফ্র্যাঙ্ক দরজার গোড়া থেকে চলে না গিয়ে আরও কিছু শোনার প্রতীক্ষা করতে লাগল। ভাল করে দাঁড়াবার জন্য হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে রইল।

ওয়ার্মটেল অসহায়ের মত বলল, তাহলে লর্ড আপনার সিদ্ধান্ত নড়চড় করছেন না?

সেই হিমশীতল কণ্ঠস্বর কেমন যেন অস্বাভাবিক আর ঘৃণাভরা। ওয়ার্মটেল তুমি তো জান আমার সিদ্ধান্তের কোনও নড়চড় হয় না।

ওয়ার্মটেল যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। হতাশার সুর, লর্ড হ্যারি পটার ছাড়াও তো কাজ সম্ভবপর হতে পারে।

আর কোনও সাড়া শব্দ নেই। ওরা যেন ঘর থেকে চলে গেছে। কিন্তু নীরবতা ছিল ক্ষণিকের। তারপরই ও শুনতে পেল আরও কঠিন, আরও নির্মম স্বরে, কী বললে হ্যারি পটার ছাড়া? তারপরই নরম সুর-ও তাই?

–লর্ড ছেলেটির ভাল মন্দের কথা ভেবে কিন্তু আমি বলছিনে! ওয়ার্মটেল বলল। তারপরই একটু উঁচু গলায়, ছেলেটা তো আমার কেউ হয় না, একেবারে কেউ নয়। তবে আমি বলছিলাম, ওর বদলে যদি আমরা অন্য কোনও জাদুকরী অথবা জাদুকর… যে কোনও জাদুকর দিয়ে যদি কাজ করাই, তাহলে কাজটা তাড়াতাড়ি হবে! আমাকে যদি দুএকদিনের ছুটি দেন, আপনি তো জানেন আমি খুব ভালভাবেই ছদ্মবেশী থাকতে পারি, দুএকদিনের মধ্যে একজন উপযুক্ত লোককে আমি নিয়ে আসব।

–অন্য এক জাদুকরকে আমি বহাল করতে পারি, সে কথা সত্য।

ওয়ার্মটেল বলল, উপযুক্ত কথা বলেছেন। আমি খুবই নিশ্চিত হলাম। হ্যারি পটারকে আনা খুবই কষ্টকর, তাছাড়া ও দারুণ নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে।

–ও বুঝেছি, তাই তুমি ওর বদলে অন্য কাউকে নিয়ে আসতে চাইছ? আমার মনে হয়, আমার কাজ করতে আর তোমার ভাল লাগছে না, তাই না ওয়ার্মটেল? এটা কী তোমার আমাকে ছেড়ে যাবার একটা পরিকল্পনা?

–লর্ড, আপনাকে কি কখনও আমি ছেড়ে যেতে পারি?

–মিথ্যে কথা বলবে না! লর্ড সাপের মত হিসহিস করে বলল।

শোন ওয়ার্মটেল, তুমি আমার কাছে ফিরে এসে যেন খুবই ভুল করেছ। এইরকম আমার মনে হচ্ছে। আমি তোমাকে একদম সহ্য করতে পারছিনে…. আমার দিকে তাকালে তুমি ভয় পাও, স্পর্শ করলে কাঁপতে থাক, তা আমি ভাল করেই জানি।

–না লর্ড! আমি সব সময় আপনার অতি অনুগত ভৃত্য।

–তোমার আনুগত্য ভীরুতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি খুব ভাল করেই এটা জানি অন্য কোথায় যাবার জায়গা থাকলে তুমি আমাকে অনেক আগেই ছেড়ে যেতে। তুমি ছাড়া আমি বাঁচব কেমন করে। দুএক ঘন্টা অন্তর তুমি আমাকে দুধ খাওয়াও। তুমি না থাকলে নাগিনের দুধ কে দুইবে ওয়ার্মটেল?

–কি লর্ড আপনাকে দেখে তো মোটেই দুর্বল মনে হয় না।

–মিথ্যুক! বিরাট নিঃশ্বাস নিয়ে লর্ড বলল–দেখে কি আমাকে এই রকম মনে হয়। দুএকদিন কেউ আমাকে দেখাশুনা না করলে হয়ত মরে যাব। তোমার সেবায় আমার হারান স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছি। সেই সেবা আন্তরিক না হলেও। যাকগে তোমাকে অনেকবার বলেছি, আবার বলছি, হ্যারি পটারকে আমার কাজে লাগাবার বিশেষ কারণ আছে। আমি ওকে ছাড়া অন্য কাউকে কাজে লাগাব না।… তের… তেরটা বছর আমি অপেক্ষা করেছি। তাই আর দুএক মাস দেরি হলে কিছু আসে যায় না। তোমার ওই ছেলেটার নিরাপত্তার জবাবে আমি বলছি, আমারও অতি উন্নতমানের পরিকল্পনা আছে তা তুমি জান। সেটা কার্যকরী হবেই। তবে তোমার একটু সাহসের প্রয়োজন আছে। শোন ওয়ার্মটেল, যদি বদ্ধপরিকর হও ভোলডেমর্টের ক্রোধ থেকে বাঁচতে সাহস তোমার স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসবে।

–লর্ড… এখানে আসার সময় আমি সব সময় ভেবেছি… প্ল্যানও আমার মাথায় আছে… তাছাড়া বার্থা জোরকিলের উধাও হয়ে যাওয়া বেশিদিন গোপন থাকবে না। আমরা যদি ঠিক মত এগিয়ে যাই, আমি যদি ঠিকমত কাজ করি…।

যদি তুমি প্ল্যান মোতাবেক কাজ কর, ওয়ার্মটেল, মন্ত্রণালয় ওই উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা জানতেও পারবে না যদি তুমি স্থির মাথায় হট্টগোল না করে কাজ করে যাও। অবশ্য আমি নিজে যদি করতে পারতাম তাহলে সবচেয়ে ভাল হত; কিন্তু আমার শরীরের যা অবস্থা সেতো তুমি দেখতেই পাচ্ছো। ওয়ার্মটেল আমাদের আরেকটি বাধা দূর করলে হ্যারি পটারের দিকে পথটা সুগম হয়ে যাবে।

ওয়ার্মটেল বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি আপনার অতি বিশ্বস্ত ভৃত্য লর্ড।

–ওয়ার্মটেল আমার প্রয়োজন শুধু বিশ্বস্ততা নয় মাথার ঘিলুও। দুঃখিত তোমার দুটোর মধ্যে একটাও নেই। ওয়ার্মটেল অভিমান জড়িত কণ্ঠে বলল, আপনাকে আমি খুঁজে এনেছি, বার্থা জোরকিনসকে আপনার জন্য তো আমিই এনেছিলাম।

–অস্বীকার করি না। শীতল কণ্ঠে ব্যঙ্গ করে তোন্ডেমট বলল! তুমি বার্থ জোরকিনসে এনেছিলে; কিন্তু তখনকার বার্থা আর বর্তমানের বার্থা কি আগের মত আছে? তুমি কি জানতে আমি ওকে কেমন করে গড়েপিঠে নিয়েছি?

ওয়ার্মটেল বলল, আমি এই ভেবে ওকে এনেছিলাম।

ও আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

–আবার মিথ্যে বলছ! ভোল্ডেমর্টের গলায় দারুণ নিষ্ঠুরতা–আমি অস্বীকার করছি না ওর দেওয়া খবরাখবর খুবই মূল্যবান। ওকে ছাড়া আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থা কখনও কৃতকার্য হতে পারতো না। তাই তোমার কাজের জন্য আমি সুখী ও তোমার যথোচিৎ পুরস্কার পাওয়া উচিত। ওয়ার্মটেল তোমায় আমার একটা অতি দরকারি কাজ করতে হবে। আমার অনেক অনুগতদের মধ্যে তুমি একজন, যাকে চাইলেই পাওয়া যায়।

–সত্যি, সত্যি বলছেন লর্ড? কি কাজ বলুন। ওয়ার্মটেলের গলায় আবারো নিদারুণ ভয়ের আভাস।

–আহ্ চমৎকার। ওয়ার্মটেল… এখন না বলাই ভাল।… আমার প্ল্যান মোতাবেক কাজের শেষে তোমায় দরকার হবে। কিন্তু তোমাকে বলছি… আমি শপথ করে বলছি, তুমি একদিন বার্থা জোরকিনসের মতোই প্রয়োজনীয় হবার সম্মান পাবে।

–আপনি… আপনি! সহসা ওয়ার্মটেলের ওয়ার্ত কণ্ঠস্বর

–আপনি তো আমাকে হত্যা করবেন–তাইতো চান?

সেই শীতল কণ্ঠ বলল–হায় ওয়ার্মটেল! ওয়ার্মটেল এই কথা তোমাকে কে বলল? বার্থাকে আমি প্রয়োজন হয়েছিল বলেই হত্যা করেছি। বারবার জাদু প্রয়োগে ও কোনও কাজের যোগ্য ছিল না। এই সহজ সরল সত্য কথাটা তোমাকে বললাম। যদি ও মন্ত্রণালয়ে ফিরে যায় এবং বলে দেয় ছুটির সময় ও তোমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। জাদুকররা মরে গেলে কখনই মন্ত্রণালয়ে কোনও কাজ করতে পারে না। ওরা রাস্তার ধারে সরাইখানাতে জাদুকরীদের সঙ্গে কাজ করতে পারে। ওয়ার্মটেল বিরতির কিছু একটা বলল, ফ্র্যাঙ্ক শুনতে পেল না।

–আমরা আবার ওর স্মৃতিশক্তি ঠিকমত চালু করতে পারি? কি সেটা অকেজো করে দিতে পারে কোনও শক্তিশালী জাদুকর। ওর কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি সেটা যদি কাজে লাগাতে না–পারি তাহলে পারতপক্ষে ওকে অপমান করা হবে। বাধ্য হয়েই ওকে হত্যা করেছি।

করিডোরে লাঠি হাতে চেপে দাঁড়িয়ে ফ্র্যাঙ্ক ওয়ার্মটেল ও অদেখা মানুষটি যাকে ওয়ার্মটেল অসম্ভব ভয় পায় তার কথা শুনছিল। হঠাৎ ওর মনে হল লাঠিটা ও ঠিকমতো ধরতে পারছে না… ঘামে ভিজে হাত থেকে ছিটকে পড়তে চাইছে। ওই শীতল কণ্ঠের লোকটি অকপটে বলছে যে একটি মেয়েকে ও খুন করেছে… খুব আনন্দ সহকারে বলছে। লোকটা অসম্ভব ধূর্ত… পাগল… খুনি।… আরও খুন করার পরিকল্পনা করছে।… হ্যারি পটার কে, তার সম্বন্ধে বৃদ্ধ অর্ধ পঙ্গু বৃদ্ধটি কিছুই জানে না ফ্র্যাঙ্ক। যেখানেই ছেলেটি থাকুক… সে বিপদের মধ্যে রয়েছে।

তবে ও কী করবে? টেলিফোন বুথে গিয়ে ও যা যা শুনেছে সব পুলিশকে জানাবে? গ্রামবাসীদের বলবে?… আবার সেই মারাত্মক বরফের মতো ঠাণ্ডা গলার স্বর শুনতে পেল। ফ্র্যাঙ্ক যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে স্থানুর মত রইল।

–আর একটি অভিশাপ দাও হোগার্টসের আমার অতি প্রিয় পাত্র ওয়ার্মটেল। ব্যাপারটা পাকা হয়ে গেছে। আর কোনও তর্ক নয়।… চুপ… আমি নাগিনের ডাক যেন শুনতে পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ ওয়ার্মটেল?

তারপরই ওর কণ্ঠস্বর বদলে যায়। ও অদ্ভুত স্বরে শুধু নানা কথা বলতে থাকে, কখনও শব্দ করে থুথু ফেলে, কখনও বা বিষাক্ত সাপের মতো হিস হিস শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। ফ্র্যাঙ্ক ভাবল নিশ্চয়ই ওর মৃগিরোগ আছে। হঠাৎ মনে হল অন্ধকার করিডোরে কে যেন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফ্র্যাঙ্ক দেখার জন্য মাথা ঘোরাতে চেষ্টা করল… কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মাথা ঘোরাতে পারল না। ওর সমস্ত শরীর যেন পঙ্গু হয়ে গেছে। অজানা এক ভয়ে মন বিকল হয়ে গেছে। মনে হল কেউ বা কিছু একটা জীবন্ত প্রাণী অন্ধকার করিডোর দিয়ে ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ঠিক সেই সময়ে ঘরের কাঠের আগুনের এক ঝলক রূপালী শিখা করিডোরে এসে পড়তেই ও কম্পিত চোখে দেখল একটা প্রায় বার ফিট লম্বা সাপ! করিডোরে মোটা পুরু ধূলোর ওপর সাপটা শুয়ে। এগিয়ে আসা সাপের দিকে ও দারুণ ভয় পেয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাপটা নীল চোখে ওকে যেন গ্রাস করতে আসছে… কিন্তু কি করতে পারে ফ্র্যাঙ্ক? একটি মাত্র পথ–সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে গেলে ঘরের ভেতরে যেতে হবে। সেখানে দুটো লোক আগুন জ্বেলে নানা ভয়ঙ্কর সব কথা বলছে, খুনের পরিকল্পনা করছে। আর যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে না নড়লে সাপটা ওকে নির্ঘাত মেরে ফেলবে।

কিন্তু আশ্চর্য! ও কিছু করার আগেই… এক সেকেন্ডের মধ্যে হিরকখচিত ল্যাজওয়ালা ভয়ার্ত সাপটা হিস হিস শব্দ করতে করতে সামান্য খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

ফ্র্যাঙ্ক দরদর করে শুধু ঘামতে লাগল তা নয় লাঠি ধরে থাকা হাতটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু ওর মনে হলসাপটা যেন শীতল কণ্ঠের খুনিদের সঙ্গে কিছু কথা বলছে হি হিস্ শব্দ করে।… আশ্চর্য সাপ আর মানুষ দুজনেই কথা বলছে? তা কখনও হতে পারে? আশ্চর্য! আশ্চর্য!… সাপের সঙ্গে মানুষের কথা! অসম্ভব!!

ফ্রাঙ্ক বুঝতে পারে না ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে। আর করিডোরে দাঁড়াতে ওর মন চাইল না। ভাবল, ঘরে ফিরে হাঁটুতে সেঁক দিলে অনেক আরাম পাবে।

হাঁটুর ওপর ব্যাগটা রেখে শুয়ে পড়বে। কিন্তু সমস্যা হল ওর একটা পাও করিডোর থেকে চলতে চাইল না। বেশ খানিকটা সময় স্থানুর মত কাঁপা কাঁপা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ কানে এল সেই মার্ডারের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর… বলল: ওয়ার্মটেল, নাগিনি এক দারুণ সুসংবাদ নিয়ে এসেছে… ওয়ার্মটেল।

–সত্যি লর্ড! ওয়ার্মটেল যেন লাফিয়ে উঠে বলল।

–সত্য। শীতল কণ্ঠে বলল।–হ্যাঁ, ও বলল, এক বৃদ্ধ মাগল দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। [সাধারণ মানুষকে জাদুকররা মাগল বলে]

ফ্র্যাঙ্কের তখন পালাবার বা লুকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়াল।

বেঁটে খাট পাতলা পাকা চুলওয়ালা একজন। টাক পড়তে আর দেরি নেই। লম্বা পুঁচলো নাক, কুত কুতে একজোড়া চোখ। চোখ দুটো ভেজাভেজা। ওর চোখে মুখে ভয়মিশ্রিত উদবেগের ছাপ!

–ওয়ার্মটেল ওকে ভেতরে নিয়ে এস। তুমি কী দ্রতা জানো না? ঘরের ভেতরে শীতল কণ্ঠের লোকটি কাঠের আগুনের সামনে অতি পুরনো হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে কথাটা বলল। ফ্র্যাঙ্ক কিন্তু যে কথাগুলো বলছে তার মুখ দেখতে পেলো না। তবে সাপটা দেখল ধূলোতে ভর্তি পুরনো কার্পেটের ওপর পোষা কুকুরের মতো ওর পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে।

ঘরের মধ্যে একমাত্র আলো হলো কাঠের আগুন! ফ্র্যাঙ্ক ওর মুখ দেখতে পেল, চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয়েছে আগুনের দিকে মুখ করে। লোকটা এত বেঁটে যে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসার পরও মনে হল চেয়ারটা যেন শূন্য।

এত বেঁটে আর ছোটখাট যে ফ্রাঙ্ক লোকটার মাথাও দেখতে পেল না।…ফ্র্যাঙ্ক ঘরের মধ্যে দেওয়ালে যেসব ছায়াগুলো পড়েছে তার দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে মনে হল সেগুলো যেন ছায়া নয়, পর পর অনেকগুলো মাকড়সার জাল ছাদের কড়ি কাঠে, দেওয়ালে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই ছায়া।

–মাগল, তুমি কী আমাদের সব কথা শুনেছ? শীতল কণ্ঠ প্রশ্ন করল।

ফ্র্যাঙ্ক বুঝতে পারল লোকটাকে ও যদি ভয় পায় তাহলে ও পেয়ে বসবে। এখন ও নিজেদের ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। লোকটা খুনি হোক, যাই হোক ওকে ভয় পেলে চলবে না। প্রতিরোধ করতে হবে।

–কী সব যা–তা বলছেন।

–আমি তোমাকে মাগল বলছি। তার মানে তুমি আমাদের মত জাদুকর নও।

–জাদুকর বলতে কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছিনে। ফ্রাঙ্ক ক্রমশ নিজের শক্তিতে ফিরে আসছে। আমি তোমাদের যেসব কথাবার্তা শুনেছি–সেগুলো থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে পারি। তোমরা দুজনে খুনি, আরও খুন করার ছক কষছ! আমি যদি এখান থেকে ফিরে না যেতে পারি তাহলে আমার স্ত্রী থানায় যাবে।

হাসালে বোকা মাগল। আমরা জানি তোমার স্ত্রী নেই। তাছাড়া কাক–পক্ষিও জানে না তুমি এখানে এসেছ। শোন মাগল, লর্ড ভোল্ডেমর্টের কাছে মিথ্যে কথা বলবে না। মাগলদের আমি চিনি।

–লর্ড, একটু আগে তুমি সভ্যতার কথা বলছিলে–সভ্য হলে আমার দিকে ফিরে কথা বল। কেন সাহস নেই? ফ্র্যাঙ্ক বলল।

–কিন্তু মাগল, আমি তো তোমাদের মতো মানুষ নই। কাঠ পুড়ছে খট খট শব্দ করে। সেই শব্দে কথা যেন শোনা যায় না। কিন্তু আমি মানুষদের চেয়েও বেশি। বেশ, তুমি যখন চাইছে–আমি তোমার দিকে মুখ করে বসছি মাগল।… ওয়ার্মটেল আমার চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে দেবে মাগলের দিকে?

ওয়ার্মটেল কথাটা শুনে শুধু হুম শব্দ করল। চেয়ারটা ঘুরিয়ে দিলো না লর্ডের আদেশ মতো। সামান্য সময়… তারপর ও সাপটাকে ডিঙিয়ে শীতল কণ্ঠ লর্ড ভোল্ডেমর্টের চেয়ারের কাছে গিয়ে চেয়ারটা এমনভাবে যোরাল যাতে দুজনে মুখোমুখি হয়। সাপটা হিস হিস শব্দ করে ওর চৌকো মাথা তুলল। চেয়ারে বসে থাকা লর্ডকে ফ্র্যাঙ্ক দেখল। দেখা মাত্র ওর হাতের লাঠিটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। ও শুধু মাত্র তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল। চেয়ারে বসা লর্ড ওকে কিছু বলল–ফ্র্যাঙ্কের সেই কথা কানে গেলো না। লোকটা ওর হাতের দণ্ডটা তুলল। দণ্ড থেকে সবুজ রঙের বিদ্যুৎ ভীষণ এক শব্দ করে ফ্র্যাঙ্ককে স্পর্শ করল। ফ্র্যাঙ্ক জড় পদার্থের মতো ধব করে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল। পড়বার আগেই ও মৃত।

.

দুশ মাইল দূরে হ্যারি পটার নামে ন দশ বছরের ছেলেটি ঘুমের ঘোরে আর্তনাদ করে বিছানায় উঠে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *