০৭. জানাবার জন্য বক্তৃতা

০৭. জানাবার জন্য বক্তৃতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের সভায় একবার জনৈক বক্তা এমন বক্তৃতা করেন যে শেষপর্যন্ত সভার সকলে বেশ বিরক্তই বোধ করতে আরম্ভ করেন। এ কাহিনী হয়তো কেউ কেউ শুনেও থাকবেন। ভদ্রলোক ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী, অথচ কথা বলার কৌশল তাঁর একেবারেই জানা না থাকায় অনেকক্ষণ ধরে শুধু উদ্দেশ্যহীনভাবেই বকে যান তিনি। কোন রকমেই তাঁর বক্তব্যের বিষয় পরিষ্কার হলনা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়, কমিটির সদস্যদের মধ্যে অসহিষ্ণুভাব জাগতে আরম্ভ করে। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে ম্যানুয়েল জেমস আরভিন জুনিয়র, নামে একজন সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে বেশ চোখা একটা মন্তব্য শোনালেন।

তিনি বলেছিলেন মাননীয় বক্তার কথা শুনে তাঁর পরিচিত এক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ছে। ভদ্রলোক তাঁর উকিলকে জানান তিনি তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ অর্থাৎ ডাইভোর্স করতে চান, যদিও স্ত্রী সুন্দরী, চমৎকার রাঁধতে পারেন আর মা হিসেবেও ভালো, একেবারে আদর্শ।

তাহলে বিচ্ছেদ চাইছেন কেন?’ উকিল জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কারণ সে সারাক্ষণ বকবক করে’, স্বামী উত্তর দিলেন।

‘কোন্ বিষয়ে বকবক করেন?’

‘সেটাই তো ঝামেলা’, স্বামী জবাব দিলেন।

বহু বক্তার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা, তা তিনি স্ত্রী বা পুরুষ যাই হোন। তাদের শ্রোতারা জানে না তাঁরা কি বলতে চান। তাঁরা তা বলেন না। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য স্পষ্ট করেন না।

সপ্তম পরিচ্ছেদে আপনারা শ্রোতাদের কাছ থেকে কাজ আদায় সম্পর্কে ফর্মুলার কথা পড়েছন। এবার আপনাদের শোনাবো কিভাবে শ্রোতাদের আপনার বক্তব্য জানাতে পারেন, এবং কিভাবে তাদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।

মনে রাখবেন প্রায় প্রতিদিনই আমরা এই তথ্য জানিয়ে কথাবার্তা বলি–যাতে আমরা অনেক আদেশ দিই, ব্যাখ্যা করি, ইত্যাদি। সারা বছর ধরে আমাদের পাঠক্রমের ক্লাসে যে সব পরামর্শ দেওয়া হয় তার মধ্যে এই তথ্য জানান দেওয়া হল কাজে উদ্বুদ্ধ করার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পরিষ্কার, স্পষ্টভাবে বক্তব্য রাখতে পারলে অপরকে চট করে কাজে উদ্বুদ্ধ করা যায়। এ সম্বন্ধে আমেরিকার বিখ্যাত শিল্পতি ওয়েন ডি, ইয়ং বলেছেন আজকের দুনিয়ায়, এই স্পষ্ট বক্তব্য রাখার প্রয়োজনীয়তা অসামান্য। তিনি যা বলেছেন সেটা এই রকম :

‘কোন মানুষ যখন অপরকে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে পারেন, তিনি ততটাই নিজের প্রয়োজনীয়তা বাড়াতে পারেন। আমাদের সমাজে নিশ্চিত ভাবেই মানুষকে ছোটখাটো ব্যাপারেও পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হয়। এ জন্য প্রথমেই তাদের ভাষাই হবে প্রধান অবলম্বন, অতএব আমাদের এটার ব্যবহার করা শিখতে হবে, নিছক ব্যবহারের জন্য নয়, অত্যন্ত কৌশলে।‘

এই পরিচ্ছেদে আপনার কাছে উপস্থিত করা হচ্ছে কিভাবে স্পষ্ট, পরিষ্কার ভাবে শ্রোতাদের সামনে নিজেকে হাজির করতে পারবেন যাতে আপনাকে বুঝে নিতে তাদের কোনই অসুবিধা না হয়। লর্ড উইগ উইটগেনস্ক্রিন বলেন, সবকিছু যদি ভালভাবে চিন্তা করা যায় এবং তাই পরিষ্কার ভাবে বলাও যায়।

১. আপনার হাতের সময় অনুযায়ী বক্তব্য রাখুন

শিক্ষকদের কাছে কথা বলার এক ফাঁকে প্রফেসর উইলিয়াম জেমস মন্তব্য করেছিলেন যে কোন বক্তা বক্তব্য রাখতে গিয়ে একটা সময় একটা বিষয় নিয়েই বক্তব্য রাখতে পারেন। যে বক্তৃতার কথা তিনি বলেছিলেন তাতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। তবুও ইদানীং একজন বক্তাকে আমি বলতে শুনি মাত্র তিন মিনিট সময় দেওয়া সত্ত্বেও তিনি এগারোটি বিষয় নিয়ে বলবেন। ভাবুন, প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে সময় মাত্র সাড়ে ষোল সেকেণ্ড। শুনে অসম্ভব আর অবাস্তবই মনে হবে যে, কোন বুদ্ধিমান বক্তা এমন অবাস্তব কাজ করবেন।

যেমন ধরুন, আপনি যদি কোন শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে কিছু বলতে চান তাহলে তিনি কি ছ’ মিনিটে কখনই বলার চেষ্টা করবেন না এই শ্রমিক ইউনিয়নের জন্ম হয় কেমন করে, তাদের কাজের ধারা কেমন। কি কি ভাল কাজ তারা করেছে আর কলকারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ কিভাবেই বা সমাধান করা যায়। না, এসব ব্যাপারে কখনই কিছু ওই অল্প সময়ে বলার চেষ্টা করবেন না। করণ তাতে শ্রোতারা। বিষয়টা আদৌ ভালভাবে বুঝবে না। আসলে এতে আপনার বক্তব্য হয়ে দাঁড়াবে গোলমেলে অস্পষ্ট।

মনে রাখবেন বহু অভিজ্ঞ বক্তারাও এরকম মারাত্মক রকম ভুল করে থাকেন। আসলে অন্য ব্যাপারে তাদের দক্ষতা থাকায় তারই অহঙ্কারে এটা চাপা পড়ে যায়। আপনি এ পথ তাই পরিহার করবেন।

২. আপনার ধারণা সাজিয়ে নিন

প্রায় সব বিষয়েই যুক্তি পূর্ণ ধারাবাহিকতা দিয়ে গড়ে তোলা যায়। এটা করার জন্য কাজে লাগাতে হবে সময়, অবকাশ, আর বিশেষ বিষয়কে। সময়ের ব্যাপার যেমন ধরা যাক, আপনি আপনার বক্তব্যকে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত এই তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারেন। ধরুন, আপনি কোন একটা তারিখ দিয়ে শুরু করার পর অতীতে চলে গেলেন তারপর আবার এগিয়ে এলেন। যে সব বক্তব্যের বিষয় কোন গঠনমূলক কিছুতে নিবদ্ধ থাকে সেটা শুরু করতে হয় প্রথমেই কাঁচা মাল দিয়ে। তারপর ধাপে ধাপে তাকে বিভিন্ন পথে এগিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ উৎপাদিত পণ্যে পরিণত করতে হয়। বক্তব্যে কতখানি বর্ণনা রাখবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার হাতে সময় কতটা আছে।

অবকাশের ব্যাপারে আপনি এগিয়ে চলবেন আপনার ধারণার বিষয় বস্তুকে সাজিয়ে। এখান থেকেই আপনি অগ্রসর হবেন। যেমন ধরুন আপনি যদি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটেল প্রাসাদের বর্ণনা দিতে চান তাহলে আপনি শুরু করবেন একদম এর চূড়ো থেকে। তারপর একটু একটু করে চারপাশের বর্ণনা দেবেন। কোন জেটের ইঞ্জিন বা মোটর গাড়ির ইঞ্জিনের বর্ণনা দিতে গেলে সবচেয়ে ভাল হয় ইঞ্জিনকে টুকরো করে তার ব্যাখ্যা দিয়ে।

৩. এগিয়ে চলার পথে বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন

কোন বক্তব্যকে শ্রোতাদের মনে আগ্রহের আর সজীব রাখতে গেলে বক্তৃতা চলার ফাঁকে পরিষ্কারভাবে শ্রোতাদের বলতে চাইবেন, বিষয়গুলো পর পর সাজিয়ে বলবেন। ‘আমার প্রথম কথা হল এই…’, আপনি এই রকম সাদামাটা ভাবেও শুরু করতে পারেন। এইভাবেই পরপর শেষ পর্যন্ত যেতে পারেন।

ড. রালফবাঞ্চ, রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎকালীন অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারী, নিউইয়র্কে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা এইভাবে আরম্ভ করেছিলেন :

‘আজ সন্ধ্যায় আমি এই বিষয়ে যা বলব ঠিক করেছি তাহল ‘মানবিক সম্পর্কের সংঘাত’। এটা করতে চাই দুটি কারণে, তিনি বলেন, প্রথমত এই…’, তারপরই তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত এই…’। তাঁর বক্তৃতায় সারাক্ষণই তিনি এইভাবে পরপর তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। একেবারে উপসংহারে তিনি বলেন :

‘আমাদের কখনই মানুষের ভালো করার সুপ্ত ক্ষমতার কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।‘

ঠিক এই রকম পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল এইচ, ডগলাস ব্যবসা ও উৎপাদনে দেশে ভাঁটা দেখা দেওয়ায় উৎসাহ দিতে। তিনি ছিলেন কর সম্বন্ধে অভিজ্ঞ এবং ইলিনয়ের সেনেটর হিসেবে তার সারগর্ভ বক্তৃতা রেখেছিলেন।

তিনি শুরু করেন এইভাবে : আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু হল এই : নিম্ন আর মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য কর রেহাইয়ের উপযুক্ত পদ্ধতি-অর্থাৎ যে আয়ের মানুষেরা তাদের আয়ের শেষ কপর্দকও খরচ করতে বাধ্য হন।

তিনি এরপর বলেন, এর তিনটি প্রধান কারণ বর্তমান…প্রথম… দ্বিতীয়…তৃতীয়।

৪. অচেনাকে চেনার সঙ্গে তুলনা করুন

মাঝে মাঝে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজেকে বেশ একটু বেকায়দায় পড়েছেন বলে মনে হতে পারে–অর্থাৎ আপনার বক্তব্য বিষয় ব্যাখ্যা করতে। বিষয়টা হয়তো বা আপনার কাছে বেশ পরিষ্কার–কিন্তু নিজের কাছে পরিষ্কার হলেই হবে না, শ্রোতাদের কাছেও তা স্পষ্ট হওয়া চাই। এক্ষেত্রে করণীয় কি?

ধরুন আপনি শ্রোতাদের কাছে রসায়ন শাস্ত্রের অবদান সম্পর্কে বলতে চান–বিশেষ করে অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট সম্পর্কে। এই পদার্থটি নিজে পরিবর্তিত না হয়ে দুটি পদার্থকে পরিবর্তিত হতে সাহায্য করে। ব্যাপারটা খুবই সহজ। এটা বোঝানোর জন্য বলতে পারেন অনুঘটক হল এক স্কুলের বড়সড় দুষ্টু ছেলের মত–সে সারাক্ষণ ছোট ছোট ছেলেদের মারধর করে অথচ তার কিছু কেউই করতে পারে না।

একবার একদল মিশনারী আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলে ধর্ম প্রচার করার সময় বাইবেলের কাহিনীকে বাধ্য হয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের কথ্য ভাষায় অনুবাদ করতে বাধ্য হন। তারা নিজেরা কি বাইবেলকে সরাসরি অনুবাদ করলে কাজ হত। একেবারেই না–কারণ অশিক্ষিত ওই অধিবাসীরা তার কিছুই বুঝত না। যেমন ধরুন বাইবেলের এই লাইনটি : ‘তোমার পাপের রঙ রক্তবর্ণ হলেও তা তুষারের মত শুভ্র হবে। এখন তুষার আর শ্যাওলার তফাত ওই অধিবাসীরা বুঝত না। অতএব মিশনারীরা প্রয়োজনে লাইনটা বদলে নিয়েছিলেন এইরকম করে : ‘তোমার পাপ রক্ত লাল হলেও তা নারকেলের শাঁসের মতই সাদা হবে।’

অবস্থা বিবেচনায় এর চেয়ে আর কি করণীয় থাকতে পারে?

কোন ঘটনাকে ছবির মত করে তুলুন।

পৃথিবী থেকে চাঁদ কত দূরে? সূর্য? অথবা সবচেয়ে কাছের কোন গ্রহ। বিজ্ঞানী মহাকাশ অভিযানের বর্ণনা অঙ্কের মাধ্যমেই দেবেন। কিন্তু বিজ্ঞান সম্বন্ধে বক্তা আর লেখকরা জানেন সাধারণ শ্রোতাদের বোঝানোর পথ এটা নয়। তারা অঙ্ককে ছবিতে পরিণত করেন।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জেমস জিন্স বিশেষ ভাবেই চেষ্টা করতেন সাধারণ মানুষ যাতে পৃথিবীর আর মহাবিশ্বের রহস্য জারতে পারে। একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আর দক্ষ মানুষ হিসেবে স্যার জেমস জিনস্ জানতেন বিজ্ঞানে অঙ্কের স্থান কোথায়। তাই যখন সহজবোধ্যভাবে তিনি বিজ্ঞানের কথা বলতেন বা লিখতেন তার পক্ষে কোথায় অঙ্ক এড়িয়ে যেতে হবে তা তিনি জানতেন।

আমাদের সূর্য (সূর্যও একটি তারা) আর আমাদের গ্রহের চারপাশের গ্রহগুলো এতই কাছে যে আমরা বুঝতে পারি না মহাজগতের অন্যান্য বস্তুরা কতদূরে অবস্থিত। ব্যাপারটা স্যার জিনস্ তাঁর আমাদের চার পাশের মহাবিশ্ব বইটিতে বুঝিয়ে বলেছেন। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘আমাদের সবচেয়ে কাছের তারাটি (প্রক্সিমা সেন্টাউরি) রয়েছে ২৫,০০০,০০০,০০০,০০০ মাইল দূরে। তারপর দূরত্বটা ভাল করে বোঝাতেই তিনি লিখেছেন কেউ যদি আলোর গতিতে, অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল বেগে পৃথিবী থেকে প্রক্সিমা সেন্টাউরির দিকে যাত্রা করে তাহলে সেখানে পৌঁছতে তার চার বছর তিন মাস সময় লেগে যাবে।

এই ভাবেই স্যার জিন্স অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের দূরত্বকে বেশ সহজভাবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। আমি একবার এক বক্তাকে আলাস্কার আয়তন বোঝাতে শুনি। তিনি স্রেফ বলেন আলাস্কার আয়তন হল ৫৯০,৮০৪ বর্গমাইল। এর বেশি আর কিছুই তিনি বলেন নি।

এথেকে কারও পক্ষে কি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম রাজ্যটির আসল আয়তন আন্দাজ করা সম্ভব? রাজ্যটি কতটা বড় জানতে আমায় বেশ অপেক্ষাই করতে হয়, যখন আর একজন বক্তা জানালেন–আলাস্কার আয়তন হল ভারমন্ট, নিউ হ্যাঁম্পশায়ার, মেইন, ম্যাসাচুসেট্‌স, রোড আইল্যাণ্ড, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলাওয়ার, মেরীল্যাণ্ড, পশ্চিম ভার্জিনিয়া, উত্তর ক্যারোলিনা, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, টেনেশী আর মিসিশিপির মিলিত আয়তনের সমান। এবার ৫৯০,৮৪০ বর্গমাইল কতটা হতে পারে তার একটা ধারণা পেলাম। নড়াচড়া করার মত ভাল জায়গাই তো তবে আলাস্কায় রয়েছে।

কয়েক বছর আগে আমাদের ক্লাসের এক সদস্য আমাদের দেশের রাজপথে যে ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা ঘটে তার এক ভয়াল বিবরণ দেন : ধরুন আপনি নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলস চলেছেন। এবার রাস্তার পাশ চিহ্নের বদলে কফিন সাজানোর রয়েছে ভাবতে পারেন-আর প্রতিটি কফিনে ভরা আছে গতবছরে দুর্ঘটনায় মৃত এক একজন মানুষ। যতই গাড়িতে এগোবেন ততই পাঁচ সেকেণ্ড অন্তর ওই কফিন আপনার চোখে পড়বে। অর্থাৎ সারা দেশ জুড়ে প্রতি মাইলে এ রকম বারোটা কফিন দেখবেন।

পথ দুর্ঘটনা শিকারের এমন নিখুঁত বর্ণনা আর হতে পারে না। যখনই আমি গাড়িতে যাই বিবরণটা আমার চোখে ভেসে ওঠে।

এর কারণ কি? কারণ হল কানে শোনা বর্ণনা বেশি কাল মনে থাকেনা। এটা মিলিয়ে যায়। কিন্তু চোখে দেখা কিছু তা যায় না। কয়েক বছর আগে আমি দানিয়ুব নদীর তীরে একটা বাড়িতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর ছোঁড়া কামানের গোলা বিদ্ধ থাকতে দেখেছি। উলমের যুদ্ধে সেটা ছেঁড়া হয়। চোখে দেখা উপলব্ধি এই কামানের গোলার মতই। এগুলো প্রচণ্ড চাপ দিয়ে তারা মনে গেঁথে যায়। চিরকাল থেকেও যায়। বোনাপার্ট যেমন সব অষ্ট্রিয়ানদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এগুলো সেইভাবেই বাকি সব বিরুদ্ধতা দূর করে দেয়।

টেকনিকাল কথা বাদ দেবেন

আপনি যদি কোন প্রযুক্তিবিদ্যা বা টেকনিকাল কাজ করে থাকেন-বা আপনি যদি আইনবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা আরও কোন কিছুর বিশেষজ্ঞ হন–তাহলে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে আপনাকে বক্তা হিসেবে। শ্রোতাদের কাছে কথা বলার সময় এসব খুঁটিনাটি আপনাকে বাদ দিতেই হবে।

আমার শিক্ষা সংক্রান্ত জীবনে আমি বহুবার দেখেছি শতশত বক্তৃতা উপযুক্ত মুহূর্তে কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তারা বক্তৃতা দানের সময় শ্রোতাদের তার বিশেষজ্ঞতার ধারণা যে থাকতে পারে না সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এর ফল কি হয়? শ্রোতারা কোন আগ্রহই বোধ করেনি। এরকম ক্ষেত্রে বক্তার কি করা দরকার? তাকে ইণ্ডিয়ানরা সেনেটর রেভেবিজের এই লেখাটি পাঠ করে মনে রাখতে হবে :

‘সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হল শ্রোতাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে কম বুদ্ধিমান মনে হওয়া শ্রোতাটিকে বেচে নিয়ে তাকে আপনার বক্তৃতায় আগ্রহী করতে চাওয়া। এটা একমাত্র সম্ভব আপনার বক্তব্যকে সহজবোধ্য, স্পষ্ট করে তোলার মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটা ছোট ছেলেমেয়েদের বোঝানোর মত করেই বলা উচিত।’

একবার আমাদের ক্লাসে একজন ডাক্তার বলেন স্বাস্থ্য ভাল রাখার কাজে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলা কতখানি দরকার। বিষয়টা তিনি জটিল করে তোলেন ডাক্তারী শাস্ত্রের আর শারীর বিদ্যার নানা টেকনিকাল কথা জানিয়ে। তিনি যখন তাঁর বক্তব্যের পরবর্তী অধ্যায়ে যাচ্ছিলেন আমাদের একজন শিক্ষক তখন তাকে বাধা দিলেন। তিনি এবার শ্রোতাদের কাছে হাত তোলার আবেদন জানিয়ে বললেন কজন ডাক্তারের কথা বুঝেছেন। দেখা গেল প্রায় অধিকাংশ শ্রোতাই তাঁর বক্তব্য বোঝেনি।

এরপর ডাক্তার সহজ সরল ভাষায় শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের কাজটি বুঝিয়ে দিলেন।

এ ধরনের বক্তব্য রাখার সময় সবচেয়ে ভাল হলো সরল থেকে কঠিন পর্যায়ে ধাপে ধাপে পৌঁছান। যেমন ধরুন আপনি হয়তো রেফ্রিজারেটারের জমাট বাঁধা বরফের বিষয়ে বলতে চাইছেন। সেক্ষেত্র যদি টেকনিকাল খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আপনার কথা বলতে চান তাতে শ্রোতাদের আগ্রহ আদৌ জাগবে না।

অ্যারিস্টটল এই বিষয় সম্পর্কে একবার চমৎকার একটি উপদেশ দান করেন : জ্ঞানী মানুষের মত চিন্তা করুন, কথা বলুন সাধারণ মানুষের মত। কখনও বক্তব্যের মাঝখানে যদি টেকনিকাল বিষয় বলার প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সেটা আগে সহজবোধ করে বুঝিয়ে দিন।

আমি একবার কিছু গৃহকর্ত্রীর সামনে জনৈক ব্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞকে কথা বলতে দেখি। ভদ্রলোক অনায়াস ভঙ্গীতে সুন্দরভাবে ব্যাঙ্ক আমানতের বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

৫. দৃশ্যমান সূত্রের সাহায্য নিন

মানুষের চোখ থেকে যে সব স্নায়ু মস্তিষ্ক পর্যন্ত চলে গেছে সেগুলো কানের স্নায়ুর চেয়ে আকারে ঢের বড়। বিজ্ঞান বলে আমরা চোখের বক্তব্য কানের বক্তব্যের চেয়ে পঁচিশ গুণ বেশি আমল দিতে চাই।

জাপানী এক প্রবাদে আছে, ‘একবার দেখা একশবার শোনার চেয়ে ভালো।’

তাই যদি পরিষ্কারভাবে বলতে চান তাহলে আপনার বক্তব্যকে স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং দৃশ্যমান করে তুলুন। ন্যাশনাল ক্যাশ রেজিস্টার কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা জন এইচ. প্যাটারসনের নীতিও তাই ছিল। তিনি তাঁর কর্মচারিদের আর বিক্রেতাদের সামনে কথা বলার সময় বলেন :

‘আমি দেখেছি মানুষ শুধু কথা বলার উপর নির্ভর করতে পারে না যাতে তার প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগে। একটা নাটকীয় বাড়তি জিনিসও এজন্য চাই। তাই আমার মনে হয় ভাল ফল লাভ করার জন্য দরকার ছবি–যার সাহায্যে কোন বস্তুর কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা যায়। ছবি আবার সাধারণ অঙ্কনের চেয়ে ভাল।

কখনও কোন সময় যদি এঁকে দেখানো প্রয়োজন হয় তাহলে যথাসম্ভব বড় করে তা আঁকবেন। তবে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। একনাগাড়ে ছবি দেখানোও আবার বিরক্তিকর হয়। মনে রাখবেন শ্রোতারা পাকা আঁকিয়ের ছবি দেখতে আগ্রহ বোধ করে না। যদি কোন সময় ছবি এঁকে বা এনে দেখানো দরকার হয় তাহলে শ্রোতাদের আগ্রহ জানানোর জন্য নিচের পরামর্শ মেনে চলবেন :

১। দেখাবার প্রয়োজনীয় মুহূর্তের আগে পর্যন্ত ছবিগুলি আড়ালে রাখবেন।

২। বেশ বড় ছবি দেখাবেন, যাতে শেষ সারি থেকেও তা দেখতে পাওয়া যায়। মনে রাখবেন শ্রোতারা ছবিটা না দেখতে পেলে বক্তব্য অনুধাবন করতে পারবে না।

৩। কথা বলার সময় কোন ছবি শ্রোতাদের হাতে দেবেন না।

৪। কোন ছবি দেখাতে হলে হাতে নিয়ে উঁচু করেই তা দেখাবেন যাতে শ্রোতারা দেখতে পায়।

৫। মনে রাখবেন যে জিনিস নড়তে পারে না এবং যা পারে তার চেয়ে দশগুণ বেশি কার্যকর। সম্ভব হলে তার ব্যবস্থা করবেন।

৬। কথা বলার সময় দ্রষ্টব্য নির্ণয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না–কারণ আমি শ্রোতাদের বোঝাতে চাইছেন।

৭। দেখানো হয়ে গেলে দ্রষ্টব্যটি সরিয়ে নিন।

৮। দ্রষ্টব্যটি টেবিলের উপরে রেখে আস্তে আস্তে তার ব্যাখ্যা করবেন–তাহলেই শ্রোতাদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারবেন

দৃশ্যমান বস্তু আজকাল সহজবোধ্যভাবে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ব্যবহার হতে শুরু করেছে। আপনি যা বলতে চান তা বোঝাবার ক্ষেত্রে এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।

কথা বার্তায় অভিজ্ঞ দুজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে পরিষ্কারভাবে কথা বা বক্তব্য বুঝিয়ে বলার দক্ষতা জন্মায় কেবল ভাল রকম শিক্ষা আর নিয়মানুবর্তিতার উপর। লিঙ্কন যেমন বলেছিলেন স্পস্ট বলার জন্য আমাদের ঐকান্তিক আগ্রহ থাকা দরকার। নক্স কলেজের প্রেসিডেন্ট ডঃ গ্যালিভারকে তিনি একবার বলেছিলেন অল্প বয়সে তিনি কিভাবে এই আগ্রহ গড়ে তোলেন :

‘ছোট বেলার যে স্মৃতি আমার মনে পড়ে তার মধ্যে রয়েছে কেউ আমায় কোন কথা বললে তা যদি বুঝতে না পারতাম তাহলে ভয়ানক রাগ হত। আমার মনে হয় না আর কোন ব্যাপারেই আমার রাগ হত। এটা তখন থেকেই আমার মেজাজ খারাপ করে দিত, তা আজও সেইভাবেই আছে। আমার মনে পড়ছে আমার ছোট্ট ঘরে গিয়ে অনবরত রাত্রিতে পায়চারি করতে করতে পড়শীদের বলা কিছু কথাবার্তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করতাম। যতক্ষণ না কথাগুলো স্পষ্ট কোন অর্থ উপলব্ধি করতাম ততক্ষণ আমার স্বস্তি ছিল না।এ ব্যাপারটা তখন থেকেই আমার বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে, আজও তার পরিবর্তন ঘটেনি।

একজন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনও এসম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছেন। সেটা এই রকম :

‘আমার বাবা ছিলেন একজন অতিমাত্রায় বুদ্ধিজীবি মানুষ। আমার সেরা শিক্ষালাভ হয় তাঁরই কাছে। বাবা কোন সময়েই অস্পষ্ট অগোছালো কথা সহ্য করতে পারতেন না। গোড়া থেকে শুরু করে তাঁর একাশি বছর বয়সে মৃত্যুকাল পর্যন্ত (১৯৪৩ পর্যন্ত) আমি যাই শিখতাম তার কাছে নিয়ে যেতাম।

আমি যা লিখতাম তিনি সবই চেঁচিয়ে পড়তে বলতেন, ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কষ্টকর হত। পড়ার ফাঁকে তিনি মাঝে মাঝেই থামিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘যে কথা লিখেছ তার মানে কি?’ আমি তাঁকে সেটা বুঝিয়ে বলতাম আর দেখতাম লেখার চেয়ে বলাই ভালো হয়েছে। লেখায় এভাবে বলোনি কেন? বাবা শুনে বলতেন, ‘কোন পাখি মারার জন্য সারা এলাকা জুড়ে গুলি চালাবে না, বরং রাইফেল দিয়ে নির্দিষ্ট পাখিকেই মারতে চেষ্টা করবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *