০৪. কথা বলার অধিকার অর্জন

০৪. কথা বলার অধিকার অর্জন

বহু বছর আগে একজন দর্শনের অধ্যাপক আর বহু বছর আগের একজন নাবিক, বর্তমানের সাধারণ মানুষ নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাসে যোগ দেন। অধ্যাপক ভদ্রলোক কলেজে নিযুক্ত ছিলেন আর নাবিকটি ছোট একটি ট্রাক ব্যবসায়ী। অথচ আশ্চর্যের কথা ওই ব্যবসায়ীর কথাই শ্রোতারা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনতে চাইছিল, অধ্যাপকের বক্তব্য তাদের আকর্ষণ করেনি। এরকম হওয়ার কারণ কী? কলেজীয় ভদ্রলোক চমৎকার ইংরাজীতে বলছিলেন। তিনি শহুরে ভদ্রলোক, কৃষ্টিবান নিখুঁত চলাফেরা এবং তাঁর বক্তব্য আগাগোড়াই যুক্তিগ্রাহ্য আর পরিষ্কার। তবে তাঁর মধ্যে একটা জিনিসের অভাব ছিল–সঠিক বক্তব্য। তাঁর কথা আগাগোড়াই কেমন যেন অগোছালো আর অস্পষ্ট। তিনি তাঁর সমস্ত বক্তব্যের মাঝখানে একেবারের জন্যও কোন উদাহরণ রাখেন নি। ব্যক্তিগত কোন অভিজ্ঞতার উদাহরণও রাখেন নি। তাঁর বক্তব্যের আগাগোড়া সরু সুতোয় গাঁধা কতগুলো এলোমেলো ধারণাই বোঝাতে চাইছিল।

অন্যদিকে ট্রাক ব্যবসার মালিক লোকটির ভাষা বেশ সোজা, নিটোল আর চমৎকার ছিল। তিনি প্রাত্যহিক জীবনের উপরেই নির্ভর করে কথা বলতে চাইছিলেন। তিনি আমাদের কোন বিষয় বলতে গিয়েই তার ব্যবসায় কি ঘটেছিল সে কথার উল্লেখ করলেন। তাঁর বক্তব্য আর বাচনভঙ্গীর সজীবতা দারুণ আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল শ্রোতাদের মনে।

আমি এ কাহিনীর উল্লেখ এজন্য করছি না যে কলেজীয় অধ্যাপক বা ট্রাক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এটা কোন বিশেষ ব্যাপার। আমার এ কাহিনী উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল শ্রোতাদের আকর্ষণ করার কাজে উদাহরণ সম্পন্ন বক্তব্য কেমন কাজ দেয় তাই বোঝাতে।

শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে বক্তব্যের বিষয়বস্তু তৈরি করতে যদি এই চারটি ধাপ তৈরি করতে পারেন তাহলে নিঃসন্দেহে বলতে পারি শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবেনই।

১. আপনার বক্তব্য বিষয় সীমায়িত রাখুন

আপনার বক্তব্যের বিষয় যখন ঠিক মনস্থ করা হয়ে যাবে, তখন আপনাকে যা করতে হবে তা হল কতখানি কি বলবেন তা ঠিক করা আর সেই সীমানায় থেকে যাওয়া। একটা কথা, কখনই ভুল করে এর বাইরের এলাকায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। একবার একজন তরুণ বক্তা দু মিনিটে ‘খ্রষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের প্রথম থেকে কোরিয়ার যুদ্ধ’ পর্যন্ত বলার চেষ্টা করেছিল। এ এক হাস্যকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা! তরুণ বক্তাটিকে এথেন্স নগরীর পত্তন অবধি বলেই বসে পড়তে হয়। এ হল একটা বক্তৃতার মধ্যে অনেক কথা বলার শিকারের উদাহরণ। অবশ্য এটা বড় বেশি বাড়াবাড়ি রকমের স্বীকার করছি। আমি জীবনে এমন হাজার হাজার বক্তৃতা ব্যর্থ হতে শুনেছি-কারণ তারা অস্পষ্ট বিষয় এক বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছে। কেন এরকম ঘটে? এর উত্তর হল মানুষের পক্ষে এক ঘেয়ে ঘটনার কথা শুনে যাওয়া বিরক্তিকর। আপনার বক্তব্য যদি পুরনো দিনপঞ্জি কোন গ্রন্থের মত শোনায় তাহলে কিছুতেই শ্রোতাদের আকর্ষণ করাতে পারবেন না বেশিক্ষণ। শ্রোতাদের মন টেনে রাখতে হলে সহজ বিষয়ের অবতারণা করুন। যেমন, ইয়েলোস্টোন পার্ক ভ্রমণ বিষয়ই ধরা যাক। এর নানা বৈচিত্র্যের বর্ণনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট : বক্তা যদি রঙীন বর্ণনায় পার্কটির বন্য জীবজন্তু, উষ্ণ প্রস্রবণ, গাছপালা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি তুলে ধরতে পারেন তা হয়ে উঠবে স্মরণীয়।

এ ব্যাপারটা যে কোন বিষয়ের সম্পর্কেই প্রযোজ্য। তা সে বিক্রীর সম্পর্কেই হোক, কেক তৈরিই হোক বা ব্যালিষ্টিক মিশাইল তৈরি সম্পর্কেই হোক। আপনার বক্তব্য শুরু করার আগেই সীমানা বেঁধে নিতে হবে। আপনার বক্তব্যের বিষয়কে ছোট জায়গায় বেঁধে ফেলে সময়কে কাজে লাগাতে চেষ্টা করুন।

ছোট মাপের বক্তৃতায়, ধরুন সময় যেখানে পাঁচ মিনিটেরও কম, সেক্ষেত্রে প্রধান বিষয় নিয়ে শুধু উল্লেখ করাই সম্ভব। ত্রিশ মিনিটের মত দীর্ঘ বক্তৃতাতেও কোন ভাল বক্তা চার কি পাঁচটির বেশি প্রধান উল্লেখ্য বিষয়ের বেশি বলে সাফল্য পান না।

২. সঞ্চয় ক্ষমতা গড়ে তুলুন

ওপর ওপর ভাসা ভাসা কথা বলে বক্তব্য রাখার কাজটা বেশ সহজেই বলা চলে-বরং কঠিন হল গভীরে প্রবেশ করা। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার–যখন ভাসা ভাসা বক্তব্য রাখতে চাইবেন তখনই শ্ৰোতৃকূলের উপর আপনার প্রভাব পড়বে সামান্য বা একেবারেই না। আপনি যখন আপনার বক্তব্যের বিষয়বস্তুকে বেশ ছোট কোন সীমানায় বেঁধে রাখতে পারবেন, তখন আপনার পরের পদক্ষেপ হবে আপনার নিজের কিছু প্রশ্ন করা। এই প্রশ্ন আপনি যে বিষয় ঠিক করে রেখেছেন সেটা ভালভাবে বুঝতে আর তৈরি করতে দারুণ সাহায্য করবে। প্রশ্নটা হল, ‘এটা আমি কেন বিশ্বাস করি? বাস্তব জীবনে এর প্রমাণ কখন পেয়েছি? আমি সঠিক কি প্রমাণ করতে চাইছি? এটা ঠিক কিভাবে ঘটেছিল?’

এই ধরনের সব প্রশ্নের যে উত্তর দরকার তা পেলে আপনার মধ্যে সঞ্চয়িত শক্তির প্রকাশ ঘটেবে, যে শক্তি থাকলে লোকে উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে চায়। লুথার বারব্যাঙ্ক, যিনি ছিলেন উদ্ভিদবিদ্যার যাদুকর, তাঁর সম্বন্ধে কথিত আছে মাত্র দুটো সেরা জাতের চারাগাছ হাজির করার জন্য তিনি দশলক্ষ চারাগাছ বাতিল করেছিলেন। কোন বক্তৃতার ব্যাপারেও তাই। বক্তব্য সাজাতে একশ রকম চিন্তা করুন, কিন্তু তার নব্বইটাই বাতিল করা চাই। এর অনেকগুলো বক্তব্য তথ্য হয়তো কাজে লাগবে না, তবুও সেগুলো সংগ্রহ করলে আরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নিশ্চিত হতে পারবেন। এ হলো নিজেকে তৈরি করার কাজে প্রাথমিক পথ, অথচ বক্তারা একে অবহেলা করেন তা সে জনসংযোগের ক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই হোক।

আর্থার কান বলেছেন, আমি শয়ে শয়ে সেলসম্যান, ক্যানভাসার আর অন্যান্যদের নাড়াচাড়া করেছি, আর তা করে তাদের বেশির ভাগের মধ্যে যে দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি তা হল তাদের সব বিক্রয় যোগ্য জিনিস পত্রের সম্বন্ধে সমস্ত রকম জ্ঞান নেই। বিক্রি শুরু করার আগে যেটা দরকার ছিল। তাদের অনেকেই আমার অফিসে এসে তাদের পণ্যদ্রব্যের এক লাইন বর্ণনা করে সঙ্গে সঙ্গে মাল বিক্রি করতে চেয়েছে। এই বিক্রয় প্রতিনিধিদের কেউ কেউ এক সপ্তাহও টেকেনি আর বেশির ভাগ আটচল্লিশ ঘন্টাও না। আমি ওই সব বিক্রয় প্রতিনিধিদের নানা শিক্ষা দিতে চেয়েছি। আমি তাদের প্রথমেই তাদের পণ্য দ্রব্য সম্বন্ধে সব জানতে বাধ্য করেছি, খাদ্যের প্রোটিন সম্পর্কে জানতে বাধ্য করেছি। নানা ক্লাসে শিক্ষাও তারা নিয়েছে। সেরা বিক্রয় সম্পর্কীয় বক্তৃতার জন্য পুরস্কারও দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এটাই হল বিক্রয় প্রতিনিধি হওয়ার প্রাথমিক কর্তব্য।

‘আমি সব সময় প্রয়োজন ও ব্যবহারের চেয়ে দশ গুণ বেশি খবরাখবর জোগাড় করি; অল্প কিছুকাল আগে কথাটা বলেছিলেন জন গান্থার। জন গান্থার হলেন বিখ্যাত লেখক ভিতর থেকে দেখা’ সিরিজের বই লিখে তিনি বিখ্যাত হন। এই বইগুলো বেষ্ট সেলারের মর্যাদা পায় এই বই লেখার কাজের সবরকম খবর তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়।

একবার কোন সময়ে কথাটার সত্যতা প্রমাণ হয়ে যায়। ১৯৫৬ সালে তিনি এক মানসিক হাসপাতাল নিয়ে ধারাবাহিক কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি এজন্য মানসিক হাসপাতালে গিয়ে অধ্যক্ষের সহকারী আর রোগীদের সঙ্গেও কথা বলেন। আমার এক বন্ধু তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিনি বলেছেন ওই কাজে তাদের অসংখ্যবার বারান্দা পার হয়ে ওপর নিচে ওঠানামা করতে হয়। অফিসে এসে মিঃ গান্থার গাদা গাদা রিপোর্ট, নোট, পরিসংখ্যান ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি করেন।

‘শেষ পর্যন্ত বন্ধুটি লিখেছিলেন : মিঃ গান্থার চারটি ছোট নিবন্ধ লেখেন, চমৎকার বক্তৃতার পক্ষে এগুলো অপূর্ব। যে কাগজে ওগুলো লেখা হয় তার ওজন ছিল বোধ হয় মাত্র কয়েক আউন্স। অথচ সেটা লিখতে মিঃ গান্থার যেসব কাগজপত্র ঘেঁটেছেন তার ওজন অন্ততঃ বিশ পাউণ্ড।’

মিঃ গান্থার জানতেন তিনি কি কাজ করছেন। তিনি এও জানতেন কোন কিছুই অবহেলা করলে চলবে না। এসব কাজে তিনি প্রাচীন অভিজ্ঞতা সারা মন প্রাণ ওই উদ্দেশ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন।

আমার এক সার্জন বন্ধু আমায় বলেছেন : ‘তোমাকে দশ মিনিটেই শিখিয়ে দিতে পারি কি করে উপাঙ্গ বের করে ফেলা যায়। তবে কোন রকম গোলমাল হলে কি করণীয় সেটা শেখাতে আমার চার বছর লেগে যাবে।’ বক্তৃতার ব্যাপারেও ওই একই কথা : সব সময় এমনভাবে তৈরি থাকুন যাতে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারেন আপনার জ্ঞান। এমনটা ঘটতে পারে পূর্ববর্তী কোন বক্তার মন্তব্যের ফলে বা আপনার বক্তৃতা শোনার পর কোন শ্রোতার প্রশ্ন।

আপনিও এই সঞ্চিত শক্তি আহরণ করতে পারবেন খুব তাড়াতাড়িই। যেদিন জনগণের সামনে বক্তৃতা করবেন তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শেখার কাজ ছাড়াবেন না। যে কোন সময় আপনার খবর সংগ্রহের কাজ চালাতে পারেন। মনেমনে আবার তা পর্যালোচনাও করে যাওয়া চাই। এর সবচেয়ে ভালো সময় বা অবকাশ হল আপনার অবসর মুহূর্ত–যেমন বাড়ি ফেরার সময় গাড়ি চালাতে চালাতে, বাসের জন্য অপেক্ষার সময়, পাতাল রেলে চলার ফাঁকে ইত্যাদি। এই রকম মুহূর্তেই আপনার মনে আপনার জানা তথ্য ঝিলিক মেরে যায়। আপনার অবচেতন মন আগে থেকেই আপনাকে তৈরি হতে সাহায্য করে যাবে।

বিখ্যাত বক্তা নর্মান টমাস যিনি তাঁর বিরোধী রাজনৈতিক শ্রোতাদের সশ্রদ্ধ নজর কেড়ে নিতেন, তিনি বলেছেন : কোন বক্তৃতা যদি গুরুত্বপূর্ণ করতে হয় তা হলে বক্তাকে তার বক্তব্য বিষয় বারবার মনে মনে আলোচনা করে যেতে হবে। তিনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন কিভাবে অবসর সময়ে, কাগজ পড়ার ফাঁকে, রাস্তা চলার সময়, শুতে যাওয়ার সময় তাঁর মন নতুন নতুন নিদর্শনে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সাধারণ স্তরের কোন বক্তৃতার পরিণতি যা তাইই হয়, এটা হলো অসাধারণ চিন্তাভাবনারই প্রতিফলন আর বক্তব্য বিষয় সম্বন্ধে অসম্পূর্ণ ধ্যান ধারণার পরিণতি।

এ ধরনের প্রক্রিয়ায় আপনি যখন নিবিষ্ট থাকেন তখন আপনার মধ্যে জোরালো একটা আকর্ষণ জাগবে প্রতিটি শব্দ এবং বক্তব্যকে একটা কাগজে লিখে ফেলার। কখনও এমন কাজ করবেন না। কারণ এ রকম কিছু করে ফেললেই আপনার সন্তুষ্টি আসবে আর সেটাই আঁকড়ে ধরতে চাইবেন আপনি। এর অবধারিত পরিণতি হবে গঠনমূলক চিন্তাধারা আর কাজ করবে না। এর পরেও একটা আশঙ্কা থেকে যাবে–আর তা হল আপনার বক্তব্য কণ্ঠস্থ করতে চাইবেন আপনি। মার্ক টোয়েন এ ধরনের মুখস্থ করার সম্পর্কে বলেছেন : লিখিত বিষয় বক্তৃতার জন্য নয়, তাদের চরিত্র আর গঠন হল সাহিত্যমূলক। এ হল কঠিন, অনমনীয় আর জিভের আড়ষ্টতা এড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণও সম্ভব হয় না। এর উদ্দেশ্য যদি হয় মনোরঞ্জন শেখানো তাহলে একে ভেঙে সহজ কথ্য ভাষায় এনে কথাবার্তার ভঙ্গীতে বলে যেতে হবে, না হলে তা শুধু শ্রোতাদের বিরক্তিই উদ্রেক করবে–তাদের মনোরঞ্জন করতে পারবে না।

চার্লস্ এফ. কেটারিং যার আবিষ্কারের প্রতিভায় নির্ভর করেই গড়ে ওঠে বিখ্যাত জেনারেল মোটরস প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন আমেরিকার একজন আদরের বক্তা। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয় তিনি তার বক্তব্য লিখে রাখতেন কি না? তিনি জবাব দেন : আমার মনে হয় আমি যা বলতে চাই তা লেখার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার শ্রোতাদের মনে সাড়া জাগাতে চাই, চাই তাদের আবেগে দাগ রাখতে। একখণ্ড কাগজ আমার আর আমার ইচ্ছার মাঝখানে পথ আটকে থাকতে পারে না।

লিঙ্কন কীভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন

লিঙ্কন কিভাবে তাঁর বক্তৃতা তৈরি করতেন? সৌভাগ্যবশত এটা আমাদের জানা, আর বিগত এক শতাব্দীর চার ভাগের তিন ভাগ ধরে তিনি যেভাবে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তা ডীন ব্রাউনের বক্তৃতাতে জানা গেছে। লিঙ্কনের অন্যতম বিখ্যাত বক্তৃতা হল যেটা তিনি ঋষিকল্প হয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন : যে গৃহের অধিবাসীরা নিজেরাই বিভক্ত তা কখনও টিকে থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি অর্ধেক ক্রীতদাস আর অর্ধেক মুক্ত অবস্থায় এ জাতিও টিতে থাকতে পারবে না। আব্রাহাম লিঙ্কন এই বক্তৃতাটি সারাক্ষণ মনে মনে পর্যালোচনা করে চলতেন। খাওয়ার সময়, পথ চলতে চলতে, বাগান পরিচর্যার সময়ও।

কাজ করার ফাঁকে সুযোগ পেলেই লিঙ্কন ছেঁড়া কাগজের টুকরোয়, খামের উপর যেখানেই পেরেছেন নানা ধরনের মন্তব্য লিখে রাখতেন। এর সবগুলো তিনি তাঁর মাথার টুপির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতেন আর অবসর সময়ে সেগুলো ঠিক মত দেখে সাজিয়ে ফেলতেন পরে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে। কোন খুঁটিনাটি তথ্যও তিনি অবহেলা করতেন না।

আপনার আমারও এটা করতে আপত্তি থাকা উচিত না।

৩. আপনার বক্তব্য উদাহরণ দিয়ে সজীব করে তুলুন

রুডলফ ফ্লেমা তাঁর ‘আর্ট অফ রিডেবল রাইটিং’ গ্রন্থে একটা পরিচ্ছেদ এইভাবে শুরু করেছেন : ‘একমাত্র গল্পই পাঠ করার যোগ্য। তিনি এরপর দেখিয়েছেন ‘টাইম’ আর ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ সাময়িক পত্র দুটি কিভাবে এই নীতিকে কাজে লাগায়। পত্রিকা দুইটির প্রায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধই হয় নিছক বর্ণনা হিসেবে লেখা বা ছোটখাটো ঘটনায় পূর্ণ। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কোন শ্রোতৃবৃন্দের সামনে কথা বলার সময় গল্পের কোন জুড়ি নেই। ঠিক তেমনই নেই কোন পত্রিকায় শেখার ব্যাপারে।

রেডিও আর দূরদর্শনের পর্দায় যাঁর বক্তব্য লক্ষ লক্ষ লোক শুনেছেন সেই নর্মান ভিনসেন্ট পীল বলেন যে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে থাকতেই হবে কিছু উদাহরণ। এই উদাহরণ নিঃসন্দেহে শ্রোতাদের কাছে একান্ত আকর্ষণীয়। এটা তাদের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে।

আমার বইয়ের পাঠকরাও বুঝতে পেরেছেন আমার বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি কিভাবে ছোট ছোট কাহিনীর অবতারণা করি। প্রতিপত্তি ও বন্ধু লাভ’ গ্রন্থটিতে এরকম যে সব উদাহরণ রেখেছি তাতে বইটির তিন-চতুর্থাংশই ভরে গেছে। বাকি এক চতুর্থাংশই মাত্র নিয়মের কথা।

তাহলে আমরা এইরকম বর্ণনামূলক উদাহরণ দেওয়ার কৌশল কিভাবে আয়ত্ত করবো? এটা করার পাঁচটি উপায় আছে। তা হল এই রকম: মানবিকভাব আনা, ব্যক্তিগত কারণ নির্দিষ্টকরণ, নাটকীয়তা আনা, আর দৃষ্টিগোচর করা।

আপনার বক্তব্য মানবিক করুন

আমি প্যারীতে একবার একদল আমেরিকার ব্যবসায়ীকে বলেছিলাম কী করে সফল হওয়া যায় নিয়ে বক্তব্য রাখতে। তাদের বেশিরভাগই কতকগুলো সাধারণ গুণের উল্লেখ করেন আর কঠিন পরিশ্রম, ধৈর্য এবং উচ্চাকাঙক্ষার কথা বলেন।

আমি তখন ক্লাসে কাজ বন্ধ করে এই রকম কিছু বলেছিলাম : আমাদের কোন বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। কেউ সেটা পছন্দ করে না। মনে রাখবেন, আপনাদের মনোরঞ্জন করতে হলে যাই বলুন লোকে কান দেবে না। এ ছাড়াও মনে রাখবেন পৃথিবীর সবচেয়ে আগ্রহ সৃষ্টিকারী বিষয় হল বেশ মনোহারী কাহিনী। অতএব আপনারা আপনাদের পরিচিত দুজন মানুষের গল্প শোনান। আমাদের বলুন তাদের একজন কেন সফল হল আর অন্যজন কেন ব্যর্থ। আমরা এটা মন দিয়ে শুনে আনন্দ পাব আর এমনকি হয়তো তা থেকে লাভবানও হব।

ওই পাঠক্রমে একজন সদস্য ছিলেন যিনি কোন ভাবেই ক্লাসের কাউকে বা নিজেকেও খুশি করতে পারতেন না। আজকের রাতে অবশ্য তিনি মানবিক আগ্রহের ব্যাপারটা শুনে আমাদের তার দুজন কলেজ বন্ধুর গল্প শোনালেন। এক বন্ধু ছিল একটু রক্ষণশীল-সে শহরের নানা দোকান থেকে সার্ট কিনত আর একটা তালিকা তৈরি করে কোন দোকানের সার্ট ভাল তার হিসাব রাখত। নিজের সম্বন্ধে তার এতই উঁচু ধারণা ছিল যে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও সে জীবনে ব্যর্থ হল। তার আশা ছিল বিরাট কোন সুযোগ তার জীবনে আসবে–অথচ সে সুযোগ আর আসেনি। সাধারণভাবেই তাকে জীবন কাটাতে হল।

বক্তা এরপর শোনালেন অন্য বন্ধুর কথা। সে ক্লাসের সকলেরই প্রিয় ছিল। সকলের সঙ্গেই সে মেলামেশা করত। সব সময় তার একটা উচ্চাকাঙক্ষা ছিল। সে সযোগ খুজত। একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবে সে জীবন আরম্ভ করে। সেই সময় নিউইয়র্কে বিশ্ব মেলার আয়োজন করা হচ্ছিল। সে জানত ওখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারে কাজ থাকবে। তাই সে ফিলাডেলফিয়ার চাকরি ছেড়ে নিউইয়র্ক রওনা হল। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে সে কন্ট্রাকটরের কাজ নিল। টেলিফোন কোম্পানির অনেক কাজ করায় সেই কোম্পানীই মোটা মাইনেয় তাকে কাজে লাগায়।

বক্তার কাহিনী মোটামুটি ভাবেই আমি শোনালাম। সে কাহিনী শোনানোর সময় বেশ সরস কিছু উদাহরণও দেয়। তার কথা বলার সময় ছিল মাত্র দু মিনিট, অথচ কথা শেষ হলে দেখা গেল দশ মিনিট কেটে গেছে। বক্তৃতাটি এতই সুন্দর হয় যে শ্রোতারা তা খুবই উপভোগ করে।

এই ঘটনা থেকে প্রায় সকলেই উপকৃত হতে পারেন। সাধারণ যে কোন বক্তৃতাই লোকের মনে ছাপ ফেলতে পারে তার মধ্যে যদি মানবিক স্পর্শ থাকে। বক্তার দরকার কেবল কথার মধ্যে ছোট খাটো ঘটনার উল্লেখ। এ ধরনের বক্তৃতা কখনও ব্যর্থ হয় না।

অবশ্যই এটা ঠিক যে মানবিক আগ্রহ জাগতে পারে এমন সব কাহিনীর উৎস হল আপনার জীবনেরই অতীত। নিজের সম্বন্ধে বলতে আপত্তি আছে ভেবে কখনই এসব শোনাতে পিছিয়ে যাবেন না। শ্রোতারা কারও নিজের কথা তখনই শুনতে আপত্তি করে যখন তার মধ্যে থাকে অহং ভাব। এ ছাড়া শ্রোতারা সবসময়েই বক্তার জীবনের নানা ঘটনার কথা শুনতে আগ্রহী হয়। এ হল শ্রোতাকে আকর্ষণ করার নিশ্চিত পথ, এটাকে অবহেলা করবেন না।

নাম উল্লেখ করে বক্তৃতাকে ব্যক্তিগত স্পর্শ দিন

যখন কোন কাহিনী শোনাবেন সব সময় সে কাহিনীর চরিত্রগুলো পরিচয় দেবেন নাম জানিয়ে। ‘সে’ বা তারা না বলে ‘মিঃ ব্রাউন’ বা ‘মিঃ স্মিথ’ বললেও চলবে আসল নাম যদি জানাতে না চান। রুডলফ ফ্লেশ বলেছেন, কোন কাহিনীর বাস্তবতা তখনই সম্পূর্ণ হয় যদি নাম পরিচয় রাখা যায়। এমন কোন কাহিনীর কথা ভাবুন যার নায়কের কোন নাম নেই।

আপনার বক্তব্য যদি নাম আর ব্যক্তিগত পরিচিতিতে পূর্ণ থাকে তাহলে শ্রোতাদের সাগ্রহে শোনার আকাঙক্ষায় সন্দেহ থাকবে না। এটা হয়ে উঠবে আপনার এক অমূল্য বক্তব্য।

আপনার বক্তব্য নির্দিষ্ট আর বর্ণনায় পূর্ণ রাখুন

আপনি এবার হয়তো বলবেন, কথাগুলো ভালই, তবে কিভাবে নিশ্চিত হব আমার বক্তব্য বর্ণনায় পূর্ণ করতে পারব? এ বিষয়ে একটা পরীক্ষা করা যায়। প্রত্যেক রিপোর্টার যেভাবে পাঁচটা প্রশ্ন করে থাকে সেই ভাবেই আপনি এগোতে পারেন। সেই পাঁচটা প্রশ্ন হল এই :

১। কখন? ২। কোথায়? ৩। কি? ৪। কে? ৫। কেন?

এই প্রক্রিয়া যদি অনুসরণ করেন তাহলে আপনার উদাহরণগুলো সজীব হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে আমার নিজের একটা কাহিনী শোনাচ্ছি। এটা রিডার্স ডাইজেস্টে ছাপা হয় :

কলেজ ছাড়বার পর আমি দুবছর আরমাউর অ্যাণ্ড কোম্পানির হয়ে দক্ষিণ ডাকোটায় বিক্রয় প্রতিনিধি হয়ে ভ্রমণ করি। আমি আমার এলাকায় ঘোরার সময় মাল গাড়িতে ভ্রমণ করেছিলাম। একদিন রেডফিল্ডে দক্ষিণের ট্রেন ধরার জন্য পড়ে থাকতে হয়। রেডফিল্ড আমার বিক্রয় এলাকা ছিল না তাই এজন্য কোন সময় রাখিনি। এক বছরের মধ্যে আমি আমেরিকান নাটক অ্যাকাডেমীতে পড়তে যাব। তাই ঠিক করলাম ট্রেন না আসা পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে ম্যাকবেথের নাটক থেকে মহড়া দিতে শুরু করবো। হাত বাড়িয়ে নাটকীয় ভাবে আমি শুরু করলাম : ‘আমার সামনে যা দেখতে পাচ্ছি তা কি একটা ছোরা? এস, তোমাকে ধরতে দাও : তোমাকে স্পর্শ করিনি, তবুও তোমাকে নিরীক্ষণ করছি।’

আমি আপন মনে তখনও মহড়া দিয়ে চলেছিলাম, আর তখনই চারজন পুলিশ আমাকে ঘিরে ধরল। তারা জানতে চাইল আমি মেয়েদের ভয় দেখাচ্ছি কেন? কথাটা শুনে আমি একেবারে স্তম্ভিত, ওরা যদি বলত আমি ট্রেনে ডাকাতি করছি তাহলেও অতটা আশ্চর্য হতাম না। তারা আমায় জানাল একশ গজ দূর থেকে একজন গৃহকর্ত্রী আমাকে লক্ষ্য করে পুলিশে খবর দেন। এরকম কাণ্ড তিনি আগে কখনও দেখেন নি। আমি ছোরার কথা বলছিলাম বলে এই ব্যাপার হল।

‘আমি পুলিশদের জানালাম আমি শেক্সপীয়ারের কবিতা আবৃত্তি করছি। আমাকে আমার কোম্পানীর কার্ড দেখাতে হল। তবেই ছাড়া পেলাম।’

এবার দেখুন, ওই পাঁচটি প্রশ্ন কেমন কাজ করছে। অবশ্য অতিরিক্ত বর্ণনা আবার খারাপ : আমরা সকলেই বেশি বাড়াবাড়ি রং ঢং পছন্দ করি না।

কথপোকথন সহ আপনার বক্তব্য নাটকীয় করুন

ধরুন, আপনি কিভাবে একজন ক্রুদ্ধ ক্রেতাকে ঠাণ্ডা করার জন্য মানবিক সম্পর্কের কোন দিক কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা বর্ণনা করতে চান। তাহলে এইভাবে শুরু করতে পারেন।

‘একদিন আমার অফিসে একজন এসেছিলেন। তিনি প্রায় ক্ষিপ্ত, কারণ গত সপ্তাহে আমরা তাকে যে যন্ত্রটা পাঠাই সেটা কাজ করছিল না। আমি তাঁকে জানালাম এ সম্পর্কে যা করণীয় সবাই আমরা করব। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক খানিকটা ঠাণ্ডা হলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন আমরা সত্যিই সাহায্য করতে ইচ্ছুক।’ এই সত্য কাহিনীর একটা গুণ আছে। এটা বেশ নির্দিষ্ট, তবে এতে কোন নাম, বর্ণনা আর সবার উপর কোন নির্দিষ্ট কথপোকথন নেই যেটা থাকলে এটি সজীব হতে পারত। সে রকম হলে কি দাঁড়াত এবার দেখা যাক :

‘গত সপ্তাহে আমার অফিস ঘরের দরজাটা হাঁ করে খুলে গেল, মুখ তুলতেই আমাদের পরিচিত ক্রেতা চার্লস্ ব্লেক্সামের ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখতে পেলাম। তাকে বসতে বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, এড, এই শেষবার। এখনই একটা ট্রাক পাঠিয়ে আমার বাড়ি থেকে কাপড় কাঁচার মেশিনটা আনবার ব্যবস্থা কর।‘

‘আমি তাকে প্রশ্ন করলাম ব্যাপারটা কী? তিনি বললেন, যন্ত্রটা কাজ করছে না। সব কাপড় জামা জড়িয়ে যাচ্ছে, আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে গেছে।’

‘আমি তাঁকে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে বললাম। তিনি চিৎকার করে বললেন; আমার সময় নেই অফিসের দেরী হয়ে যাবে। জিনিসটা এখান থেকে কেনাই উচিত হয়নি। তিনি টেবিলে এমন ঘুসি মারলেন যে আমার স্ত্রীর ছবিটা উল্টে পড়ল।

‘দেখ, চার্লি’ আমি বললাম, ‘সব কথা যদি বুঝিয়ে বল তাহলে যা বলবে তাই করব।’ এ কথায় চার্লি শান্তভাবে সব জানাতে ব্যাপারটা সমাধান হয়ে গেল।

আপনার পক্ষে হয়তো সব সময় কথার মধ্যে কথপোকথন ঢোকানো সম্ভব নাও হতে পারে। তবে উপরের লেখা থেকে এটা নিশ্চয়ই বুঝেছেন বক্তব্য কতখানি নাটকীয় হতে পারে। বক্তার যদি নকল করার ক্ষমতা থাকে তাহলে তো কথাই নেই, আরও সজীব হতে পারে বক্তব্য। এই ধরনের বক্তব্য বেশ বিশ্বাসযোগ্যও হয়ে ওঠে।

যা বলেছেন তাকে ছবিতে জীবন্ত ফুটিয়ে তুলুন

মনস্তত্ববিদরা বলেন আমাদের জ্ঞানের শতকরা পঁচাশি ভাগই আসে দর্শন থেকে। এই কারণেই মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে দূরদর্শনের এত সাফল্য, বিজ্ঞাপন হিসেবেও তাই। জনসংযোগের ব্যাপারেও দর্শন আর শ্রবণের মূল্য অনেকখানি! আশ্চর্যের কথা প্রচুর বক্তাই এটাকে ঠিক অনুসরণ করেন না। গড় পড়তা বক্তাই দর্শনের মূল্য নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। এটা নেহাতই ভুল। আমি এখানে বলতে চাই বক্তব্যের মাঝখানে ছবি সৃষ্টি করার কথা। সেই বক্তার কথাই শ্রোতারা মন দিয়ে শুনে থাকেন যিনি ছবি তৈরী করে হাজির করতে পারেন।

ছবি। ছবি। ছবি। যে বাতাসে শ্বাস টানছেন এগুলো তার মতই মুক্ত। আপনার কথার মাঝখানে তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। ছবির মাধ্যমে আপনার বক্তব্য জীবন্ত করে তুলুন।

বাইবেল আর শেকসপীয়ারের রচনাই পাতায় পাতায় ছবির মত এই কথা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : যে কোন সাধারণ লেখক বলবেন বিশেষ কোন জিনিস ‘অপ্রয়োজনীয়’–এ যেন শ্রেষ্ঠকে আরও ভাল করার চেষ্টা। শেকস্‌পিয়ার কীভাবে লিখেছেন? একটা আলেখ্য তিনি তৈরী করে অমরত্ব লাভ করেছেন : মসৃণ স্বর্ণকে মসৃণতা দেয়া, পদ্মফুলকে সুন্দর করা আর রজনী গন্ধার সুগন্ধি ঢালা …।’

কোনদিন কি ভেবে দেখেছেন যুগ যুগান্ত পার হয়ে যে সব প্রবাদ চালু রয়েছে তার সবই জীবন্ত ছবির মত? ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’, ‘অনিচ্ছুক ঘোড়াকে জল পান করালে খায় না ইত্যাদি।

আব্রাহাম লিঙ্কন অধিকাংশ সময়েই এই ধরনের সচিত্র কথপোকথনের অবতারণা করতেন। যখনই তিনি কোন দীর্ঘ, জটিল রিপোর্ট হোয়াইট হাউসে তাঁর ডেস্কের উপর পেতেন তখন সেগুলো সম্পর্কে তীব্র প্রতিবাদ করতেন। এগুলো কোন সময়েই আবার নীরস বাক্যবিন্যাসে নিবদ্ধ থাকত না। বরং এমন চমকার ছবির মত শব্দ ব্যবহার করতেন যা প্রায় ভোলা অসম্ভব। তিনি যেমন বলেছেন : কোন ঘোড়ার সম্পর্কে জানার সময় ঘোড়ার ল্যাজে কটা চুল আছে আমি জানতে চাই না, বরং জানতে চাই ওর গুণ কি রকম।’

আপনার দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট আবেদন ফুটিয়ে তুলুন। মনে মনে ছবি এঁকে নিয়ে তাকে প্রকাশ করুন। এ ব্যাপারে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে–যেমন ধরুন কখনও কোন কুকুরের উল্লেখ করলে তাকে বোঝানোর জন্য আরও ব্যাখ্যার দরকার। যেমন যদি বলা যায় পানিয়েল’ ‘স্কটিশ টেরিয়ার’ বা ‘ফেট কর্নার্ড’ তাহলে নির্দিষ্ট জাতের কুকুরের একটা ছবিই শ্রোতারা চোখে ফুটে ওঠে। আরও পরিষ্কার আর

পরিস্ফুট করা যায় যদি কোন ‘ঘোড়ার’ উল্লেখ করার বদলে বলা যায় কালো টাটু ঘোড়া।

উইলিয়াম ট্রাঙ্ক, ছোট, তার ‘এলিমেন্টস অব স্টাইল’ প্রবন্ধে বলেছেন : যারা লেখার কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তারা অন্ততঃ একটা বিষয়ে একমত হন। সেটা এই : পাঠকের নজর কেড়ে নেওয়ার নিশ্চিত পথ হল নির্দিষ্ট সঠিক আর উপযুক্ত হতে হবে। হোমার, দান্তে, শেকস্পীয়ারের মত মহান লেখকরা অমরত্ব লাভ করেন বিশেষ করে তাঁদের রচনায় নির্দিষ্ট এবং সঠিক বর্ণনা করেছেন বলেই। তাঁদের প্রতিটি বাক্যই ছবির মত দৃশ্যমান। লেখার বেলায় এটা নিছক সত্যি।

বেশ ক’বছর আগে কার্যকর বক্তৃতা সম্পর্কে একটা পাঠক্রমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করি, আমরা ঠিক করে দিই প্রত্যেক বক্তাকে হয় কোন ঘটনা বা ব্যক্তি বা তারিখ সম্বন্ধে উল্লেখ করতে হবে। এর ফল হয়েছিল একেবারে বৈপ্লবিক। ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছিল।

ফরাসী দার্শনিক আঁলে বলেছেন, কোন বিমূর্ত ভাব সব সময়েই খারাপ। আপনার বাক্যকে সর্বদাই মানুষ, আসবাবপত্র, প্রাণীতে পূর্ণ রাখা চাই।

প্রাত্যহিক কথাবার্তাতেও এটা সত্য? আসলে এ বইয়ে যা এখন পর্যন্ত বলেছি তার প্রত্যেকটি অংশই প্রাত্যহিক কথপোকথনের ক্ষেত্রে দরকার। বর্ণনা থাকলেই বক্তব্য প্রস্ফুটিত হয়। যে কোন লোকই হোক, সে যদি কার্যকর বক্তা হতে চায় তাকে এ বইয়ের পরামর্শ মেনে চলতে হবে; তারপর সুযোগ মত তা কাজেও লাগাতে হবে। যারা দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন, গৃহকর্ত্রীর আর শিক্ষকরা দেখতে পাবেন শিক্ষাদান করার সময় এই পদ্ধতি কাজে লাগালে কতটা ফলপ্রসূ হওয়া যায়।

অতএব সঞ্চয়ী জ্ঞান লাভ করতে আপনাকে যত বেশি সম্ভব জ্ঞানও অর্জন করতে হবে আর তাকে কাজেও লাগাতে হবে।

.

০৫. বক্তব্য প্রাণবন্ত করে তোলা

প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পরে আমি লন্ডনে থেকে লাওয়েল টমাসের সঙ্গে কাজ করছিলাম। লাওয়েল টমাস, ‘অ্যালেনবী’ আর ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ সম্বন্ধে চমৎকার কিছু বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সভায় সে সময় তিল ধারণের জায়গা থাকত না। এক রবিবার আমি হাইড পার্কে মার্বেল আর্চের কাছে হাজির হলাম। সেখানে নানা মতবাদের মানুষ নানা বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বর্ণ, রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে নানা জাতের বক্তার সেখানে আইনরক্ষকদের বাধা ছাড়াই বক্তৃতা দানের ব্যবস্থা ছিল। এক মুহূর্তে আমি শুনলাম একজন ক্যাথলিক বোঝাচ্ছেন পোপই সর্বশ্রেষ্ঠ। তার কখনও ভুল হয় না। সেখান থেকে সরে গেলাম আর এক মঞ্চে-সেখানে একজন সমাজতন্ত্র আর কার্ল মার্কসের তত্ত্ব ব্যাখ্যায় ব্যস্ত। এবার তৃতীয় এক বক্তার সামনে শ্রোতাদের মধ্যে দাঁড়ালাম। সেখানে বক্তা বোঝাচ্ছেন চারটি স্ত্রী রাখার যৌক্তিকতা কি। এরপর সরে এসে তিনটি দলের দিকেই তাকালাম।

ব্যাপারটা কি বিশ্বাস করবেন? যে লোকটি চারটি স্ত্রী রাখার সুবিধার কথা বলছিল তার শ্রোতার সংখ্যা সবচেয়ে কম মাত্র কয়েক জনই। অথচ বাকি দুজন বক্তার শ্রোতার সংখ্যা প্রচুর, আর ক্রমশঃ বাড়ছিল। নিজেকে প্রশ্ন করতে চাইলাম এর কারণ কি? বিষয় বস্তু আলাদা হওয়ার জন্য? তা কিন্তু মনে হোলনা.। এরপর বক্তাদের ভাল করে লক্ষ্য করেই এর ব্যাখ্যা মিলে গেল। তাদের মধ্যেই এর উত্তর ছিল। যে লোকটি চারটি স্ত্রী রাখার কথা বলছিল সে নিজেই বোধহয় চার স্ত্রী রাখতে আগ্রহী নয় বলেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু বাকি দুজন বক্তা সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়ে একান্তভাবেই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা সজীব আর জীবন্ত ভঙ্গীতে কথা বলছিলেন। মাঝে মাঝেই তাঁদের হাত নড়ছিল। তাঁদের কণ্ঠস্বর দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল। তাঁদের মধ্যে থেকে যেন আগ্রহ আর সজীবতা বিচ্ছুরিত হতে চাইছিল।

সজীবতা, প্রাণশক্তি, আগ্রহ-এই তিনটিকেই চিরকাল আমি একজন বক্তার একান্ত প্রয়োজনীয় গুণ বলেই ভেবেছি। প্রাণশক্তিতে ভরপুর বক্তার কাছেই ভিড় করে শ্রোতারা।

কিন্তু প্রাণশক্তিময় বক্তৃতা করার ক্ষমতা কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব? এই পরিচ্ছেদে আপনাদের বক্তৃতাকে কীভাবে এই রকম আগ্রহী আর উত্তেজনাময় সজীবতায় জুড়ে দিতে পারবেন সে কথাই বলব।

১. যাতে ঐকান্তিক আগ্রহ আছে তেমন বিষয়ই ঠিক করে নিন

তৃতীয় পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে আপনার বক্তব্য বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া কতখানি দরকারী। আপনি যদি আপনার বক্তব্য সম্বন্ধে আবেগে জড়িত না হন তাহলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবেন না শ্রোতারা তাতে আদৌ আগ্রহী হবে। এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার যে, যে বিষয়ে আপনার খুবই ঐকান্তিকতা আছে তেমন কোন বিষয় বেছে নিলে। যেমন আপনার অবসর বিনোদনের উপায় বা শখ ইত্যাদি যাতে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাহলে দেখবেন শ্রোতাদের আগ্রহ জাগাতে আপনার কণামাত্র অসুবিধা হচ্ছে না।

ঐকান্তিকতা যে একজন বক্তার কতখানি শক্তি, সেটার প্রমাণ পেয়েছিলাম নিউ ইয়র্কে আমার এক ক্লাসে। আমি ব্যাপারটা নাম দিয়েছি ‘সবুজ ঘাস বনাম কাঠের ছাই’ এর মামলা।

শহরের এক নামজাদা প্রতিষ্ঠানের একজন বিখ্যাত সেলসম্যান বা বিক্রয় প্রতিনিধি যাচ্ছেতাই একটা বক্তব্য পেশ করেন যে, শিকড় বীজ ছাড়াই তিনি সবুজ ঘাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জানালেন শুকনো ছাই গাদার মধ্যে তিনি ঘাস ফুটিয়েছেন। তার বক্তব্য হল ছাই থেকেই ওই ঘাস জন্মেছিল।

ভদ্রলোকের কথা শোনার পর আমি বেশ নম্রভাবেই তাকে বললাম, তিনি যে আবিষ্কার করেছেন তাতে তিনি লক্ষপতি হয়ে যাবেন। তাকে আরও বললাম তার আবিষ্কার তাঁকে বিশ্বের একজন নামী বিজ্ঞানীর সম্মানও এনে দেবে। তাঁকে এও বললাম আজ অবধি কোন মানুষ ছাইগাদা থেকে ঘাস জন্মাতে পারে ভাবেনি কারণ সবাই জানে জড় পদার্থ থেকে জীবন সৃষ্টি হতে পারে না।

আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোকের ভুলটা এতই অসম্ভব যে তিনি অবশ্যই তা বিশ্বাস করবেন। আমার কথা শেষ হতেই শ্রোতাদেরও দেখলাম ভদ্রলোকের কথার অসারতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। কিন্তু লোকটি নিজের ভুল আদৌ উপলব্ধি করতে পারলেন না তিনি আমার কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন আর তীব্র প্রতিবাদ করলেন। তিনি বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, তিনি যা বলছেন তা ভেবেচিন্তেই বলছেন। তিনি আবার তার আগের কথার জের টেনে জানালেন, ছাইগাদা থেকে ঘাস জন্মাতে দেখেছেন। কথাটা এবার বেশ ঐকান্তিকতা আর জোর মিশিয়েই বললেন তিনি।

আমি আবার তার কথায় আপত্তি জানালাম। এও তাকে বললাম, আসল সত্যের হাজার মাইলের মধ্যেও তিনি আসেন নি। তিনি এবার লাফিয়ে উঠে বললেন, তিনি পাঁচ ডলার বাজি রাখতে রাজি আছেন। ব্যাপারটা আমেরিকার কৃষি দপ্তরে লেখা যেতে পারে মতামতের জন্য।

এবার কি ঘটল জানেন? শ্রোতাদের মধ্যে বেশ অনেকেই তাঁর লক্ষ সমর্থন করতে লাগল। আবার অনেকেই তার বিরুদ্ধে গেল। যদি তখন ভোট নিতাম তাহলে দেখতাম অর্ধেকেরও বেশিই তাঁর দিকে চলে গেছে। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম তাদের মত বদলাবার কারণ কি? একের পর এক শ্ৰোতা জানাল বক্তার ঐকান্তিকতা আর বিশ্বাসই তাঁদের মতো পরিবর্তনে বাধ্য করেছে আর সেইজন্য তাদের সাধারণ বুদ্ধি কাজ করেনি।

যাই হোক ওই রকম একটা অবস্থায় পড়ে বিষয়টা নিয়ে আমি কৃষি দপ্তরে চিঠি লিখলাম। তাদের লিখলাম ব্যাপারটা এতই বোকার মত যে আমি লজ্জিত। তার জবাবে তারা জানাল ব্যাপারটা অবাস্তব ও অসম্ভবছাইগাদা থেকে ঘাস কখনই জন্মায় না। তারা আরও জানাল আর একটা চিঠিও তারা এ বিষয়ে পেয়েছেন। সেই বিক্রয়-প্রতিনিধি নিজের মতে এতই অবিচল ছিলেন যে তিনিই চিঠি লেখেন।

ওই ঘটনাটা আমাকে যে শিক্ষা দেয় জীবনে সেটা ভুলতে পারিনি। কোন বক্তা যদি ঐকান্তিক হয়ে কিছু বিশ্বাস করে আর সেই আগ্রহ নিয়ে তা বলে তাহলে তার কথায় আস্থা স্থাপন করার লোকের অভাব হয় না।

আর তা ছাই থেকে ঘাস জন্মানো হলেও।

অধিকাংশ বক্তাই মাঝে মাঝে ভাবনায় পড়ে যান যে তাদের বক্তব্য বিষয় শ্রোতাদের গ্রহণযোগ্য হবে কি না। শ্রোতাদের আগ্রহী করার একটা পথই আছে : আপনার বক্তব্য সম্পর্কে ঐকান্তিক হয়ে ওঠে আর আবেগ প্রকাশ করা।

ইতালিতে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড পয়াসবার্ন চাইল্ডকে একবার প্রশ্ন করা হয় লেখক হিসাবে তার সফলতার কারণ কি? তিনি জবাব দেন : ‘জীবন সম্পর্কে আমার এমনই উত্তেজনা জাগে যে স্থির থাকতে পারি না। মানুষকে সে কথা আমায় জানাতেই হয়।‘ কোন বক্তা বা লেখকের ব্যাপারও তাই-শ্রোতা বা পাঠক উদ্বেল না যে পারে না।

একজনের কথা এবার বলছি। ওয়াশিংটনে আমাদের পাঠক্রমে ক্লাসে মিঃ ফ্লিন নামে একজন আসেন। এক সন্ধ্যায় তিনি ক্লাসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহর সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি আসলে যা শোনাচ্ছিলেন তা স্থানীয় কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বর্ণনা থেকে ধার করা মাত্র। তাই তাঁর বক্তৃতা নেহাতই নীরস লাগছিল শ্রোতাদের। যদিও তিনি চিরকাল ওয়াশিংটনে থেকে এসেছেন তা সত্বেও একবারও বললেন না শহরটি তাঁর ভালো লাগার কারণ কী? তিনি নিছক, নীরস কতকগুলো বর্ণনা দিয়ে গেলেন।

এক পক্ষকাল পর এমন একটা ব্যাপার ঘটলো যে মি. ফ্লিন একদম হৃদয়ে নাড়া খেলেন। তাঁর নতুন গাড়িখানা রাস্তায় দাঁড় করানো ছিল। অন্য একখানা গাড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা মেরে ভাঙচুর করে পালিয়ে যায়। এর ফলে মি. ফ্লিনের পক্ষে কোনভাবেই বীমার টাকা আদায় করার উপায় ছিল না। এ বিষয়ে বলতে মি. ফ্লিন প্রায় ভিসুভিয়াসের মত টগবগ করছিলেন। যে ক্লাসের শ্রোতারা তার আগের কথায় কান দেয়নি তারাই আজ তাঁর কথায় দারুণ আগ্রহ দেখাল। তারা হাততালি দিয়ে সম্বর্ধনা জানাতে লাগলেন।

এই কারণেই আমি বারবার বলতে চেয়েছি সঠিক বিষয় বেছে নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারলে আপনি কখনই ব্যর্থ হবেন না। বক্তব্যের একটা অংশ আপনাকে জয় এনে দেবেই। তাহল যে বিষয়ে আপনার ঐকান্তিকতা আছে সেটাই বলা। এই বিষয় খুঁজে পেতে আপনাকে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে না–এটা ভাসমান অবস্থায় আপনার চেতনার উপরে নির্ভর করে। এর কারণও পরিষ্কার–আপনি প্রায়ই এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেন।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, প্রাণদণ্ড সম্পর্কে একটা পরিষদীয় বিল নিয়ে টেলিভিশনে মতামত বিনিময় করা হয়। বহু সাক্ষীকে তাদের মতামত জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়-পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত দিতে। এদের একজন ছিলেন লস এঞ্জেলেসের পুলিশ দপ্তরের কর্মী। যিনি বিষয়টা নিয়ে প্রচুর চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। প্রাণদণ্ডের প্রতি তার প্রচণ্ড দাবী ছিল কারণ তাঁর এগারো জন সহকর্মী অপরাধীদের সঙ্গে বন্দুকের লড়াইতে মারা যায়। তিনি এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যাতে বোঝা গেল এ ব্যাপারে তাঁর ঐকান্তিকতা কতটা। ইতিহাসে যে কোন আবেদনই এই ঐকান্তিকতায় নির্ভর করে এগিয়েছে। যে কোন সৎ প্রচেষ্টা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল আর বিশ্বাসের অধিষ্ঠান মানুষের হৃদয়ে। হৃদয়ের যুক্তি আছে যে যুক্তি তা জানে না।’ কথাটা পাসকালের, আর এটা আমার ক্লাসে যাচাই করে দেখেছি। আমার বোস্টনের জনৈক আইনজ্ঞের কথা মনে পড়ছে যিনি বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতা করতেন। তাঁর চেহারাও ছিল চমৎকার অথচ তিনি বক্তৃতা শেষ করবার পর শ্রোতারা বলে উঠলেন : বেশ চালাক মানুষ। এর কারণ হল তিনি যে ছাপ রাখতেন তা ওপর ওপর ভেসে থাকত। তার বক্তৃতায় কোন হৃদয়ের অনুভুতি মেশানো থাকত না–শুধু চটকদার কিছু কথার ফুলঝুরি। ওই একই ক্লাসে আবার ছিলেন একজন বীমার বিক্রয় প্রতিনিধি। ছোট খাটো চেহারা, খুব দাগ কাটে না মনে। অথচ তিনি যখন কথা বলেন শ্রোতারা তাঁর প্রতিটি কথাই মন দিয়ে শুনতে চায়।

ওয়াশিংটনের এক নাট্যশালায় আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে অথচ তার জীবনে নীতিবোধ আর তাঁর কথা আজও আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আইন সম্পর্কে তাঁর চেয়েও অভিজ্ঞ মানুষ হয়তো ছিলেন তা সত্ত্বেও যে একনিষ্ঠতা আর সততা নিয়ে তিনি গেটিসবার্গে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তা কেউ অতিক্রম করতে পারেন নি।

একবার, আপনারা যেমন বলেন সেইভাবে একজন বলেছিলেন, তাঁর কোন বিষয়েই তেমন আগ্রহ জাগে না। আমি তাকে বলেছিলাম যে-কোনো একটা বিষয়ে আগ্রহী হতে! যেমন, একটা উদাহরণ দিন তো? ভদ্রলোক একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করেছিলেন। আমি উত্তর দিই, ধরুন পায়রা?’ ভদ্রলোক আরও অবাক। হ্যাঁ, পায়রা’, আমি উত্তর দিয়েছিলাম। বাইরে গিয়ে পায়রার ঝাঁক কোথাও পেলে তাদের খাওয়ান। লাইব্রেরীতে তাদের সম্বন্ধে বই পড়ে নিন তারপর এখানে এসে সে কথা শোনান। লোকটি তাই করেছিল। সে এসে যখন পায়রা নিয়ে কথা আরম্ভ করল তাকে বাধা দেওয়াই কঠিন হয়ে উঠল। অদ্ভুত দক্ষতায় আর আবেগে সে যে বক্তব্য রাখল এমন চমৎকার বক্তৃতা আর শুনিনি।

আর একটা পরামর্শ রাখছি : যতটা পারেন আপনার জানা আর প্রিয় বিষয়ে শিখুন এবং এটা করলেই দেখতে পাবেন আপনি কতখানি আবেগ আর সজীবতা লাভ করেছেন। বিক্রয়ের পাঁচটি বিখ্যাত নিয়ম বইয়ের লেখক পার্সি এইচ হুইটিঙ বিক্রয় প্রতিনিধিদের তার ওই বইয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তাদের পণ্য সম্পর্কে জানার কাজে কখনই অবহেলা না করতে। মিঃ হুইটিঙ বলেছেন, কোন ভাল পণ্য সম্পর্কে যত জানবেন, ততই আপনি আগ্রহী হবেন। অন্যান্য সব বিষয় সম্পর্কেও একই কথা-সেগুলো সম্বন্ধে আপনি যতই জানবেন ততই আপনার উৎসাহ বাড়বে।

২. নিজের বক্তব্যের অনুভূতিকে জীবন্ত করে তুলুন

ধরুন আপনি শ্রোতাদের সামনে শোনাচ্ছেন, নির্ধারিত গতিবেগের এক মাইল বেশি গতিতে চালানোর ফলে একজন পুলিশ আপনাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঘটনাটা আপনি বেশ শীতলভাবেই তৃতীয় ব্যক্তিকে শোনাতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা আপনার জীবনেই ঘটেছে আর সে সময় আপনার কিছু অনুভূতিও জন্মায়। তৃতীয় ব্যক্তিকে বর্ণনা শ্রোতাদের তেমন মনোরঞ্জন করতে পারে না। অতএব ঘটনাটা যে ভাবে আপনার জীবনে ঘটেছে ঠিক সেই ভাবে বর্ণনা করলে, তাকে জীবন্ত করে তুললে তা ঢের বেশি হৃদয়গ্রাহী হবে।

আমরা যে নাটক বা সিনেমা দেখতে যাই তার কারণ হল আমরা আবেগের প্রকাশ দেখতে আগ্রহ বোধ করি। আমরা নিজেদের আবেগ সকলের সামনে প্রকাশ করে এতই ভয় পাই যে নাটক বা ছবি দেখে আমাদের সেই আকাঙক্ষা দমন করি।

আপনি যখন জনসংযোগ করেন তখন আপনাকে আপনার বক্তব্যের মধ্যে আনুপাতিক হারে উত্তেজনা আর আবেগের মিশেল দিতে হবে। আপনার সৎ আবেগকে গলা টিপে ধরবেন না। বরং আপনার শ্রোতাদের সামনে প্রমাণ রাখুন কতখানি আগ্রহ আপনার বক্তব্য সম্পর্কে রয়েছে।

৩. আন্তরিকতা প্রকাশ করুন

আপনি যখন পায়ে পায়ে শ্রোতাদের সামনে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান তখন কোন কিছু ঘটবে এ আশা করে এগোতে চাইবেন না। কখনই এমন ভাব দেখাবেন না যেন ফাঁসি কাঠের দিকে এগোচ্ছেন। আপনার চলার ছন্দে হয়তো কৃত্রিমতা থাকতে পারে। তবুও তা চমক সৃষ্টি করতে পারে। এতে শ্রোতাদের ধারণা জন্মাবে কোন বিষয় শোনাবার নিদারুণ আগ্রহ আপনারও রয়েছে। এরপর শুরু করার ঠিক আগে বেশ গভীর একটা শ্বাস টানুন। কোন রকম আসবাব বা চেয়ার এড়িয়ে চলুন। মাথা উঁচু আর চিবুক তুলে এগোন। আপনি একটু পরেই আপনার শ্রোতাদের প্রয়োজনীয় কিছু শোনাতে চলেছেন–তাই তাদের আপনার বক্তব্য প্রাঞ্জলভাবে শোনাবেন। এখন আপনিই রাজা। এই রকমই বলেছিলেন একদিন উইলিয়াম জেমস।

এই ভঙ্গীকে বলা যেতে পারে শরীর গরম করা। এটা যে কোন অবস্থাতেই করা চলে। ডোনাল্ড এবং এলিনর লেয়ার্ড তাদের টেকনিকস ফর এফিসিয়েন্ট রিমেমবারিং’-এ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেন্ট এ ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন আগ্রহ আর ঐকান্তিকতার মূর্ত প্রতীক। উইলিয়াম জেমসের দর্শন অনুযায়ী টেডি রুজভেল্টকেই শ্রেষ্ঠ বলা যায়। আর তা হল : ‘আন্তরিক হোন আর তাহলেই আপনি যা করবেন তাতেই আন্তরিকতা অর্জন করতে পারবেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *