১৭. বিড়াল, ইঁদুর এবং কুকুর

১৭. বিড়াল, ইঁদুর এবং কুকুর

বাকবিকের শোকে হ্যারির মনটা যেন পাথর হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার জামাটার নিচে ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে জড় ভূতের মতো। অস্ত যাওয়া সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো মাটির উপরে দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। শুনতে পেল ওরা, উন্মাদের মতো কে যেন কাঁদছে।

হ্যাগ্রিড, বিড়বিড় করে বলল হ্যারি এবং কি করছে সেটা না ভেবেই পেছন ফিরল ওদিকে যাওয়ার জন্য কিন্তু রন এবং হারমিওন ওর হাত ধরে রাখল।

আমরা পারি না, বলল রন ওর মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। আমরা ওর সঙ্গে দেখা করছি এটা জানতে পারলে ও খুবই বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে।

ঘনঘন শ্বাস ফেলছে হারমিওন।

ওরা–কীভাবে–পারল? কান্নায় গলা খুঁজে এল ওর। কীভাবে পারল? 

চল যাই, বলল রন, মনে হচ্ছে ওর দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে।

প্রাসাদের দিকে রওনা হল ওরা, ধীরে ধীরে হাঁটছে। আলো দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠে পৌঁছতে পৌঁছতে ওদের ওপর জাদুর মতো ছেয়ে গেল অন্ধকার।

স্ক্যাবার্স, শান্ত হও, ফিসফিস করে বলল রন। ইঁদুরটা এখন যাচ্ছেতাই ভাবে ছটফট করছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে পকেটের আরো ভেতরে ওটাকে ঢোকানোর চেষ্টা করছে রন। কি হলো তোমার, গাধা কোথাকার। চুপ করে থাক–উফ! কামড়ে দিয়েছে।

রন, চুপ কর! দ্রুত ফিসফিস করল হারমিওন। যেকোন মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারেন ফাজ

সে আসবে না–নড়বে না বলছি

স্ক্যাবার্স সাংঘাতিক রকমের ভয় পেয়ে গেছে। সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করছে। রনের মুঠো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।

ওটার হয়েছে কী?

কিন্তু হ্যারি এই মাত্র দেখতে পেয়েছে–অন্ধকারে চোরের মতো ওদের দিকে চকচক করছে বড় বড় হলুদ একজোড়া চোখ–কুকশ্যাংকস। ওটা কি ওদের দেখতে পেয়েছে না স্ক্যাবার্সের চি চি শুনতে পেয়েছে, হ্যারি সেটা বুঝতে পারছে না।

ক্রুকশ্যাংকস! হারমিওন বলল। না, কুকশ্যাংকস না, যাও এখন থেকে!

কিন্তু বিড়ালটা ক্রমেই কাছে আসছে।

না–স্ক্যাবার্স, না!

অনেক দেরি হয়ে গেছে–রনের আঙুলের ফাঁক গলে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে ইঁদুরটা মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। লাফ দিয়ে ওটার পেছনে ছুটল ক্রুকশ্যাংকস, গায়ের উপর থেকে জামাটা ফেলে দিয়ে রনও ছুটল পেছন পেছন অন্ধকারের মধ্যে।

রন! চাপা আর্তনাদ করে উঠল হারমিওন।

একবার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে সে আর হ্যারিও দৌড়ে ওদেরকে অনুসরণ করল; কিন্তু জামাটা থাকায় পুরো শক্তিতে দৌড়ানো যাচ্ছে না; গা থেকে ওটা খসিয়ে নিল, এখন ওরা দৌড়াচ্ছে, আর ওদের পেছন পেছনে উড়ছে ওটা ব্যানারের মতো; রনের পায়ের শব্দ আর চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ওরা।

ওর কাছ থেকে সরে যাও–সরে যাও–স্ক্যাবার্স, এখানে এস—

জোরে একটা ভোতা শব্দ হলো।

গচচচা! শয়তান বিড়াল গেলি–

হ্যারি এবং হারমিওন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রনের উপর; মাটির উপর পড়ে আছে ও। স্ক্যাবার্স এখন তার পকেটে; দুই হাত দিয়ে চেপে রেখেছে ওটাকে।

রন–জামাটার নিচে এসো জলদি– হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হারমিওন। ডাম্বলডোর–মন্ত্রী–যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারেন।

কিন্তু আবার নিজেদেরকে ঢেকে নেয়ার আগে, এমনকি স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই ওরা শুনতে পেল কে যেন মাটিতে বিশাল বড় বড় থাবা ফেলে এগিয়ে আসছে। অন্ধকার থেকে কিছু একটা ওদের দিকে ছুটে আসছে-একটা দৈত্যাকার, ঘোলা–চোখের, ঘনকালো বর্ণের কুকুর।

জাদুর কাঠির দিকে হাত বাড়াল হ্যারি, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বিশাল একটা লাফ দিল কুকুরটা এবং ওটার সামনের দুই পা সজোরে আঘাত করল হ্যারির বুকে। পেছনের দিকে কাত হয়ে গেল হ্যারি, জটার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর গায়ে লাগল, ও দেখতে পেল ওটার এক ইঞ্চি লম্বা দাঁতগুলো

কিন্তু লাফ দেয়ার গতি ওটাকে অনেক দূরে নিয়ে গেল; হ্যারির ওপর থেকে সরে গেল ওটা। চোখে অন্ধকার দেখছে হ্যারি, মনে হচ্ছে ওর বুকের পাজরগুলো যেন ভেঙে গেছে, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল ও; ওটার গর্জন আবার শুনতে পাচ্ছে সে, নতুন আরেকটি আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসছে জটা।

রন দাঁড়িয়েছিল, কুকুরটা আবার ওদের দিকে লাফ দিতেই ও হ্যারিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল; ওটার তীক্ষ্ণ দাঁত বসে গেল রনের প্রসারিত হাতে। লাফ দিয়ে দৈত্যাকার কুকুরটার উপর পড়ল হ্যারি, ওটার লোম ধরল মুঠো করে, টানবার চেষ্টা করল, কিন্তু একটা ছেঁড়া পুতুলের মতো রনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কুকুরটা

তারপর, হঠাৎ, হ্যারির মুখের উপর কিছু একটা এমন জোরে মারল যে সে আবার মাটিতে পড়ে গেল। ও শুনতে পাচ্ছে হারমিওনও চিৎকার করছে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায়, মাটিতে পড়ে গেছে সেও। জাদুর কাঠিটার দিকে হাত বাড়াল সে, চোখ বেয়ে পড়ছে রক্ত

লুমোস! ফিসফিস করে বলল সে।

জাদুর কাঠির আলোয় ও এখন দেখতে পেল একটা মোটা গাছের গুঁড়ি; স্ক্যাবার্স-এর পেছনে ধেয়ে ওরা হোমপিং উইলো গাছটার কাছে চলে এসেছে, গাছটার ডালপালা চাবুকের মতো সামনে পেছনে দুলছে যেন ওরা কাছে না যেতে পারে।

এবং ওইখানেই গাছটার গোড়ায়, কুকুরটা রয়েছে, রনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুটো শেকড়ের ফাঁকে–পাগলের মতো হাত–পা ছুড়ছে রন কিন্তু ওর মাথায় এবং শরীর আস্তে আস্তে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে

রন! হ্যারি চিৎকার করে উঠল, অনুসরণ করার চেষ্টা করল, কিন্তু মোটা একটা ডাল এত জোরে বাতাসের মধ্যে দিয়ে এসে পড়ল যে হ্যারিকে পিছিয়ে আসতে হলো।

এখন ওরা শুধু রনের পা দেখতে পাচ্ছে, ওটা একটা শেকড়ের সঙ্গে বাধিয়ে রেখেছে ও যেন কুকুরটা ওকে টেনে আরও ভেতরে না নিয়ে যেতে পারে। কড়াৎ করে ভেঙে গেল রনের পাটা, পরমুহূর্তেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল ওটা।

হ্যারি–আমাদের এখন সাহায্য দরকার– হারমিওন চিৎকার করে উঠল; ওরও রক্ত ঝরছে; গাছটা ওর কাঁধের অনেকখানি কেটে ফেলেছে।

না! ওই জটা ওকে খেয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট বড়, আমাদের হাতে সময় নেই–

সাহায্য ছাড়া আমরা ওখানে যেতেই পারব না।

আরেকটা ডাল চাবুকের মতো ওদের দিকে ধেয়ে এল, ওটার শাখাগুলো আঙুলের গাঁটের মতো বাকানো।

যদি ওই কুকুরটা ভেতরে যেতে পারে, তাহলে আমরাও পারব, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হ্যারি। এদিকে ওদিকে দৌড়াচ্ছে সে চেষ্টা করছে ভয়াবহ ডালগুলোর ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য, কিন্তু গাছের ডালের চাবুক এড়িয়ে মোটেও এগোতে পারছে না সে।

ওহ, সাহায্য দরকার, সাহায্য! পাগলের মতো বলছে হারমিওন, প্লিজ

দৌড়ে সামনে গেল কুকশ্যাংকস। চাবুক মারা ডালগুলোর মধ্য দিয়ে পিছলে ভেতরে গিয়ে গাছের গুঁড়ির একটা জায়গায় ওর সামনের থাবা দুটো চেপে ধরল।

হঠাৎ, গাছটা যেন পাথর হয়ে গেল, ওটা আর নড়ছে না। একটা পাতাও কাঁপছে না।

ক্রুকশ্যাংকস! অনির্দিষ্টভাবে ফিসফিস করে বলল হারমিওন। হ্যারির একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে। ও কীভাবে জানে?

ওই কুকুরটার বন্ধু সে, গম্ভীর মুখে বলল হ্যারি। ওদেরকে আমি এক সঙ্গে দেখেছি। এসো–জাদুর কাঠিটা বের করে রাখ।

এক মুহূর্তের মধ্যে গাছের গুঁড়িতে পৌঁছে গেল ওরা কিন্তু শেকড়ের ফাঁকটার কাছে যাওয়ার আগে ওটার ভেতর দিয়ে গলে ভেতরে চলে গেল কুকশ্যাংকস। এরপর গেল হ্যারি; বুক হেঁটে সামনে গেল, তারপর ঢাল বেয়ে খুবই নিচু একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে। একটু সামনে কশ্যাংকস, হ্যারির হাতের জাদুর কাঠির আলোয় ওর চোখ জ্বলছে। মুহূর্ত পরে ওদের পেছনে চলে এল হারমিওন।

রন কোথায়? ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে ফিসফিস করল হারমিওন।

এইদিকে, বলল হ্যারি, বাঁকা হয়ে কুকশ্যাংকসের পেছনে পেছনে ছুটছে সে।

এই সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল হারমিওন।

আমি জানি না ওই মরেডার্স-এর ম্যাপে এটা দেয়া আছে কিন্তু ফ্রেড এবং জর্জ বলেছে এর ভেতরে কেউ কখনও যায়নি। এটা ম্যাপটার একটা কিনারা থেকে বেরিয়ে মনে হচ্ছিল হগসমিড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে …।

যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াচ্ছে ওরা ওদের সামনে কুকশ্যাংকসের লেজটা কখনও দেখা যাচ্ছে কখনও দেখা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হ্যারির মাথায় একটাই চিন্তা, রন এবং ওই বিশাল কুকুরটা ওকে নিয়ে কি করছে … ঘনঘন শ্বাস ফেলছে সে, ব্যথাও করছে, দৌড়াচ্ছে নিচু হয়ে।

সুড়ঙ্গটা উঠতে শুরু করেছে। মুহূর্ত পরে বাঁক খেল এবং কুকশ্যাংকসকে আর দেখা যাচ্ছে না। বিবর্ণ আলোর একটা শিখা দেখতে পেল সে। ছোট্ট একটা খোলা জায়গার মধ্যে দিয়ে আসছে।

থামল সে আর হারমিওন, দম নেয়ার জন্যে, আস্তে আস্তে সামনে যাচ্ছে। দুজনেই ওদের জাদুর কাঠি দুটো উপরে ধরে রেখেছে, অপেক্ষায় রয়েছে সামনে কি রয়েছে দেখার জন্যে।

একটা কক্ষ। একেবারেই অগোছালো। ধুলো ভর্তি। দেয়াল থেকে কাগজ বেরিয়ে আসছে; মেঝেতে দাগ, প্রত্যেকটি আসবাব ভাঙাচোরা যেন কেউ আঁছড়ে ভেঙেছে। জানালাগুলো সব তক্তা দিয়ে বন্ধ করা।

হারমিওনের দিকে তাকাল হ্যারি, ওকে খুবই ভীত দেখাচ্ছে, মাথা নাড়ল সে।

গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হ্যারি, দেখছে চারদিকে। কক্ষে কেউ নেই, কিন্তু ওদের ডানদিকে একটা দরজা খোলা রয়েছে, ওটা দিয়ে একটা ছায়া অন্ধকার হল রুমে যাওয়া যায়। হারমিওন আবার হ্যারির হাত আঁকড়ে ধরল। তক্তা দিয়ে ঢাকা জানালাগুলোর উপর ওর চোখ।

হ্যারি, ফিসফিস করল হারমিওন। আমার মনে হয় আমরা শিকিং শ্যাক-এ এসে পড়েছি।

চারদিকে তাকাল হ্যারি। কাছেই রয়েছে একটা কাঠের চেয়ার। মনে হয় কে যেন ওটার গা থেকে খাবলা মেরে বড় বড় টুকরা খুলে নিয়েছে; একটা পা পুরোটাই খুবলে নিয়েছে।

কোন ভূত এটা করেনি, ধীরে ধীরে বলল হ্যারি।

ঠিক সেই মুহূর্তে, মাথার উপর একটা মচমচ শব্দ শোনা গেল। উপরে যেন কেউ নড়ছে। দুজনেই উপরে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। আরও জোরে হ্যারির হাতটা আঁকড়ে ধরল হারমিওন, হ্যারির মনে হলো ওর আঙুলে সাড়া নেই।

যত ধীরে সম্ভব, ওরা হল রুমে উঠে এলো। ধীরে ধীরে প্রায় ভাঙা সিঁড়ির লিফট বেয়ে উপরে উঠল। মেঝেটা ছাড়া সবকিছুই পুরু ধুলোর আস্তরে ঢাকা, ওখানে একটা দীর্ঘ দাগ রয়েছে, চকচকে দাগ, যেন কাউকে টেনে হেঁচড়ে উপরে তোলা হয়েছে।

অন্ধকার জায়গায়টা পা রাখল ওরা।

নক্স, দুজনে এক সাথে ফিসফিস করে বলল, ওদের জাদুর কাঠির মাথার আলো নিভে গেল। একটি মাত্র দরজা খোলা। ওই দিকে পা টিপে টিপে যেতে যেতে ওরা ওটার পেছন থেকে খুবই নিচু স্বরে যন্ত্রণাকাতর শব্দ শুনতে পেল, এবং তারপর একটা বিকট ঘরঘর শব্দ। যেন শেষ বারের মতো পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল ওরা, এবং শেষ বারের মতো মাথা নাড়ল।

সামনে শক্ত করে জাদুর কাঠিটা ধরা, লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেলল হ্যারি।

চমৎকার একটা বিছানায় শুয়ে আছে কুকশ্যাংকস, ওদের দেখে জোরে জোরে ঘরঘর শব্দ করল। ওর পাশে মেঝেতে পড়ে আছে রন, দুহাতে ধরে আছে ওর পা, অদ্ভুত একটা কোণের সৃষ্টি করেছে।

ছুটে ওর কাছে গেল হ্যারি আর হারমিওন।

রন–তুমি ঠিক আছ তো?

কুকুরটা কোথায়?

ওটা কুকুর না, যন্ত্রণায় কাতরে বলল রন। ব্যথায় দাঁত কামড়ে ধরে আছে ও। এটা একটা ফাঁদ

কি

ওই হচ্ছে কুকুর …একজন অ্যানিম্যাগাস

হ্যারির কাঁধের উপর দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রন। চট করে ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি। ছায়ায় দাঁড়ানো লোকটা চট করে ওদের পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

লোকটার কনুই থেকে নোংরা জট পাকানো চুল ঝুলে আছে। ওর ঘন কালো অক্ষি কোটর থেকে যদি চোখ দুটো চকচক না করতো তাহলে ওটাকে একটা মৃতদেহ বলে মনে হতো। মোমের মতো চামড়ার মুখের হাড়ের উপর এতো টান টান করে ছড়ানো যেন ওটাকে কঙ্কালের মুণ্ড বলে মনে হচ্ছে। হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসছে। সাইরিয়াস ব্ল্যাক।

এক্সপেলিয়ার্মাস! গলা দিয়ে ব্যাঙের মতো শব্দ করল ব্ল্যাক, ওদের দিকে রনের জাদুর কাঠিটা তাক করে।

হ্যারি আর হারমিওনের হাত থেকে ওদের দণ্ড দুটো ছুটে বেরিয়ে গেল, ধরে ফেলল ব্ল্যাক। এক পা সামনে এগোলো সে। ওর চোখ স্থির হয়ে আছে হ্যারির উপর।

আমি ভেবেছিলাম যে তুমি তোমার বন্ধুকে বাঁচাতে আসবেই, ভাঙা গলায় বলল সে। ওর গলার স্বর শুনে মনে হলো অনেক দিন ধরে ওটা ব্যবহারের অভ্যাস সে ত্যাগ করেছে। তোমার বাবাও আমার জন্যে একই কাজ করতেন। তোমার সাহসের তারিফ করতে হয়, কোন শিক্ষকের সাহায্যের জন্য দৌড়ে যাওনি। আমি কৃতজ্ঞ ব্যাপারটা আরও সহজ হবে।

ওর বাবা সম্পর্কে ব্ল্যাক-এর টিটকিরিটা হ্যারির কানে জোরে জোরে বাজছে। বুকের ভেতর থেকে জ্বলে উঠছে ঘৃণা, ওখানে ভয়ের কোন জায়গা যেন নেই। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ও, জাদুর কাঠিটা হাতে পেতে চাইল, আত্মরক্ষার জন্য নয়, আক্রমণ করার জন্য হত্যা করার জন্য। কি করছে, বুঝে ওঠার আগে হ্যারি সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল, ওর দুদিক থেকে হঠাৎ কি যেন নড়ে উঠল, দুটো হাত ওকে ধরে ফেলেছে। না, হ্যারি না! ভীতসন্ত্রস্ত হারমিওন ফিসফিস করে বলল; এদিকে রন, কথা বলল ব্ল্যাক-এর সাথে।

তুমি যদি হ্যারিকে হত্যা করতে চাও, তবে আমাদের দুজনকেও তোমার হত্যা করতে হবে! ভয়ঙ্করভাবে বলল সে, যদিও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক দুলছে সে।

কি যেন একটা নড়ে উঠল ব্ল্যাক-এর ছায়াঘন চোখে।

শুয়ে থাকো, শান্ত স্বরে বলল সে রনকে। তোমার ভাঙা পায়ের আরও ক্ষতি হবে।

তুমি কী আমার কথা শুনেছ? দুর্বল স্বরে বলল রন, যদিও হ্যারিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাদের তিন জনকেই হত্যা করতে হবে তোমাকে!

এখানে আজ রাতে একটি মাত্র হত্যা হবে, দাঁত বের করে বলল ব্ল্যাক।

সেটা কেন? থুথু ফেলল হ্যারি, হারমিওন আর রনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছে। গতবার তো তোমার কিছুই মনে হয়নি, হয়েছিল? অতজন মাগলকে হত্যা করতে তোমার একটু বাধেনি কী ব্যাপার, আজকাবানে গিয়ে তোমার মনটা নরম হয়ে গেছে নাকি?

হ্যারি! ফুঁপিয়ে উঠল হারমিওন। চুপ কর।

ও আমার মা এবং বাবাকে হত্যা করেছে! গর্জন করে উঠল হ্যারি, বল চেষ্টায় হারমিওন এবং রনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তারপর সামনের দিকে দিল এক লাফ

ও ভুলে গেছে ম্যাজিকের কথা ভুলে গেছে ওর বয়স তের, ও বেটেখাটো এবং হাড্ডিসার, অন্যদিকে ব্ল্যাক লম্বা এবং পূর্ণবয়স্ক একজন পুরুষ। ওর শুধু ইচ্ছা যত গুরুতরভাবে পারে ব্ল্যাককে আঘাত করতে হবে কিন্তু পরিণতিতে সে কত আঘাত পাবে এ ব্যাপারে তার পরোয়া নেই।

হয়তো হ্যারির এই বোকামির জন্যই ব্ল্যাক হতভম্ব হয়ে জাদুর কাঠিটা সময়মতো তুলতে পারল না। এক হাতে হ্যারি ব্ল্যাক-এর অকেজো কব্জিতে আঘাত করে জাদুর কাঠিটা সরিয়ে দিল; অন্য হাতের মুঠো গিয়ে লাগল ব্ল্যাক-এর মাথার পাশে মারল দুজনেই পড়ে গেল ওরা, পেছন দিকে, দেয়ালের উপরে

আর্তনাদ করছে হারমিওন; চিৎকার করছে রন; চোখ ধাঁধানো আলো বেরিয়ে এলো ব্ল্যাক-এর হাতে ধরা জাদুর কাঠিটা থেকে, ইঞ্চির জন্যে হ্যারির মুখটা বেঁচে গেল। ওর মুঠোর ভেতর ব্ল্যাক-এর অকেজো হাতটা চেষ্টা করছে বেরিয়ে আসার জন্য, ও ধরে রেখেছে শক্ত করে এবং অন্য হাত দিয়ে ওর শরীরের সর্বত্র সমানে ঘুষি মেরে চলেছে হ্যারি।

কিন্তু ব্ল্যাক-এর মুক্ত হাতটা হ্যারির গলা খামচে ধরল

না, হিসফিস করে বলল সে। অনেক দিন ধরে আমি অপেক্ষায় রয়েছি

ওর আঙুলগুলো হ্যারির গলায় চেপে বসছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, ওর চশমাটা বাঁকা হয়ে গেছে।

তারপরে সে দেখল কোথা থেকে যেন হারমিওনের পা ছুটে এলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে হ্যারিকে ছেড়ে দিল ব্ল্যাক। জাদুর কাঠিটা ধরা ব্ল্যাক-এর হাতটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রন। একটা কিছু পড়ে যাওয়ার ক্ষীণ শব্দ শুনল হ্যারি

নিজেকে মুক্ত করে দেখল ওর জাদুর কাঠিটা মেঝেতে গড়াচ্ছে; ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটার উপরে সে, কিন্তু

আর্ঘ;

লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে কুকশ্যাংকস; সামনের দুই থাবার সবগুলো নখ সেঁধিয়ে দিয়েছে হ্যারির হাতে; ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল হ্যারি, কিন্তু বিড়ালটা দৌড়ে যাচ্ছে হ্যারির জাদুর কাঠিটার দিকে

না, তুমি ওটা পাবে না! চিৎকার করে উঠল হ্যারি, বিড়ালটার উদ্দেশ্যে একটা লাথি ছুড়ল, লাফিয়ে একপাশে সরে গেল ওটা; জাদুর কাঠিটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে

সামনে থেকে সরে যাও!রন এবং হারমিওনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করল সে।

দুবার বলতে হলো না ওদের। হারমিওনের ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে, নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে হা করছে, এক পাশে সরে গেল সে, ওর এবং রনের জাদুর কাঠি দুটো ছো মেরে তুলে নিল। হামাগুড়ি দিয়ে বিছানাটার কাছে গেল রন, হাঁপাচ্ছে, ধপাস করে ওটার উপর পড়ল ওর ফর্সা মুখটা সবুজ হয়ে গেছে, দুই হাতে চেপে ধরে আছে ভাঙা পাটা।

দেয়ালের কোণায় হাত–পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ব্ল্যাক। ওর বুকটা ঘনঘন ওঠানামা করছে, তাকিয়ে দেখছে ধীরে ধীরে হ্যারি এগিয়ে আসছে, জাদুর কাঠি সরাসরি তাক করা ব্ল্যাক-এর হৃৎপিণ্ডের দিকে।

আমাকে হত্যা করবে হ্যারি? ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল ব্ল্যাক।

ঠিক মাথার উপর এসে থামল হ্যারি, জাদুর কাঠি তখনও ব্ল্যাক-এর বুক বরাবর, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ব্ল্যাক-এর বাম চোখ ফুলে উঠছে এবং নাক দিয়ে পড়ছে রক্ত।

তুমি আমার বাবা এবং মাকে হত্যা করেছে, বলল হ্যারি, ওর স্বর কাঁপছে কিন্তু হাতে ধরা জাদুর কাঠি স্থির।

ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে ব্ল্যাক।

আমি অস্বীকার করছি না, সে বলল, শান্ত স্বরে। কিন্তু তুমি যদি পুরো ঘটনাটা জানতে

পুরো ঘটনাটা? পুনরাবৃত্তি করল হ্যারি, মাথার ভেতরে যেন জোরে জোরে হাতুড়ির শব্দ শুনছে সে। তুমি ওদেরকে ভন্ডেমোর্ট-এর হাতে তুলে দিয়েছিলে, আমার শুধু এটুকু জানলেই চলবে।

আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে, বলল ব্ল্যাক, এখন তার গলায় জরুরি ভাব ফুটে উঠল। তুমি যদি না শুনতে চাও তাহলে পরে পস্তাবে তুমি বুঝতে পারছ না।

তুমি যতটা ভাবছ আমি তার চেয়ে অনেক বেশি বুঝি, বলল হ্যারি, ওর গলার স্বর আরও কেঁপে উঠল। মা যে চিৎকার করছিলেন তুমি শোননি তাই না? আমার মা প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন যেন ভন্ডেমোর্ট আমাকে হত্যা করতে না পারে আর তুমি সেটাই করলে তুমি হত্যা করলে তাদের 

কেউ কিছু বলার আগেই হঠাৎ ছায়ার মতো কি যেন একটা হ্যারির পাশ দিয়ে উড়ে গেল; কশ্যাংকস গিয়ে বসেছে ব্ল্যাক-এর বুকের উপরে, ঠিক যেখানটায় ওর হৃৎপিণ্ডটা রয়েছে। চোখ মটকে বিড়ালটার দিকে তাকাল ব্ল্যাক।

সরে যা, বিড়বিড় করে বলল ব্ল্যাক, কুকশ্যাংকসকে ওখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।

কিন্তু বিড়ালটা ব্ল্যাক-এর কাপড়ে ওর থাবা আটকে বসে আছে, নড়ানো গেল ওটাকে। ওটা কুৎসিত মুখ ঘুরিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল, বড় বড় কালো এক জোড়া চোখ। ডানদিকে হারমিওন জোরে কেঁদে উঠল।

স্থির দৃষ্টিতে ব্ল্যাক এবং কুকশ্যাংকস-এর দিকে তাকাল হ্যারি, জাদুর কাঠির ওপর মুঠোটা শক্ত হলো। বিড়ালটাকেও যদি মারতে হয় তাহলে কী আসে যায়? ওটা তো ব্ল্যাক-এর দোসর ওটা যদি মরতে চায় ব্ল্যাককে বাঁচাতে গিয়ে, তাহলে হ্যারির কি করার আছে … যদি ব্ল্যাক বিড়ালটাকে বাঁচাতে চায় তাহলে প্রমাণিত হবে যে হ্যারির মা-বাবার চেয়ে বিড়ালটার প্রতি ওর দরদ বেশি

জাদুর কাঠি তুলল হ্যারি। এখনই সময়। এখনই সময়, তার মা-বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার। ব্ল্যাককে হত্যা করতে যাচ্ছে সে। ওকে মারতেই হবে। এটাই হ্যারির সুযোগ

সময় যাচ্ছে, তারপরও হ্যারি পাথরের মতো জমে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়, জাদুর কাঠি তাক করা, ব্ল্যাক তাকিয়ে আছে ওর দিকে নিস্পলক এবং ওর বুকের উপরে কুকশ্যাংকস। রন-এর অনিয়মিত নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে বিছানার কাছ থেকে; হারমিওন একেবারে চুপ।

এবং তারপর শোনা গেল নতুন একটা শব্দ

নিচের মেঝে থেকে কাঁদের যেন চলাফেরার চাপা পদশব্দ শোনা গেল।

আমরা এখানে উপরে! চিৎকার করে উঠল হারমিওন হঠাৎ। আমরা উপরে এখানে–সাইরিয়াস ব্ল্যাক–জলদি!

চমকে উঠে নড়ে উঠল ব্ল্যাক, ওর বুকের উপর থেকে প্রায় পড়ে গিয়েছিল কুকশ্যাংকস; জাদুর কাঠি শক্ত করে ধরে আছে হ্যারি–ওর মাথার ভেতরে কে যেন বলে উঠল-এক্ষুণি, এক্ষুণি! কিন্তু পায়ের শব্দগুলো সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে এবং হ্যারি তখনও মারতে পারেনি ব্ল্যাককে।

ঘরের দরজাটা সশব্দে খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে ঝরনার মতো লাল ফুলিঙ্গ ঢুকল ভেতরে, ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি, প্রফেসর লুপিন ঢুকলেন ঘরের ভেতরে। ওর মুখে রক্ত সরে গেছে, জাদুর কাঠি তোলা এবং প্রস্তুত। রনের উপর দিয়ে ঘুরে গেল ওর চোখ, হারমিওন দরজার পাশে পড়ে আছে ভীত, হ্যারিকে দেখছেন প্রফেসর ব্ল্যাক-এর দিকে জাদুর কাঠি তাক করে দাঁড়িয়ে আছে এবং সবশেষে দেখলেন ব্ল্যাককে, জবুথবু হয়ে পড়ে আছে হ্যারির পায়ের কাছে রক্ত ঝরছে নাক থেকে।

এক্সপেলিয়ার্মাস! লুপিন চিৎকার করে উঠলেন।

আরো একবার হ্যারির হাত থেকে উড়ে চলে গেল ওর জাদুর কাঠি। একই সঙ্গে হারমিওনের হাতে ধরা দুটো। সবগুলো লুপিন দক্ষতার সাথে ধরে ফেললেন। কক্ষের আরও ভেতরে চলে এলেন, তাকিয়ে রয়েছেন ব্ল্যাক-এর দিকে, তখনও কুকশ্যাংকস বসে রয়েছে ওর বুকের ওপরে।

হ্যারি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, হঠাৎ ওর ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। ও ব্ল্যাককে মারতে পারল না। ওর নার্ভে কুলালো না। এখন ব্ল্যাককে ডিমেন্টারদের হাতে তুলে দেয়া হবে।

কথা বললেন লুপিন। গলার স্বর স্বাভাবিক। এমন একটা স্বর যেটা অবদমিত আবেগের কারণে কাঁপছে। ও কোথায়, সাইরিয়াস?

চট করে লুপিনের দিকে তাকাল হ্যারি। উনি কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারল না হ্যারি। কার সম্পর্কে বলছেন? ও আবার ব্ল্যাক-এর দিকে ঘুরল।

ব্ল্যাক-এর চেহারা ভাবলেশহীন। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে একেবারেই নড়ল। তারপর, খুব ধীরে ধীরে, ওর শূন্য হাতটা তুলল সে এবং সোজা রনকে দেখিয়ে দিল। বিভ্রান্ত হ্যারি ঘুরে তাকাল রনের দিকে, ওকেও হতভম্ব দেখাচ্ছে।

কিন্তু তাহলে বিড়বিড় করলেন লুপিন, গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন ব্ল্যাক-এর দিকে যেন ওর মনটা পড়ার চেষ্টা করছেন, তাহলে এর আগে কেন সে আত্মপ্রকাশ করেনি? যদি না– হঠাৎ লুপিনের চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেল, যেন ব্ল্যাক-এর পেছনে আরও কিছু দেখতে পাচ্ছেন তিনি, আরও কিছু যেটা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না, যদি না সেই হবে যদি না তুমি বদলে ফেল আমাকে না জানিয়ে?

খুব ধীরে ধীরে, লুপিনের মুখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে, মাথা নাড়ল ব্ল্যাক।

প্রফেসর লুপিন, জোরে বাধা দিল হ্যারি, কি হচ্ছে এসব?

প্রশ্নটা শেষ করতে পারল না হ্যারি, কারণ এরপর যা সে দেখল তাতে মুখের কথা মুখেই আঁটকে গেল। জাদুর কাঠি ধীরে ধীরে নামাচ্ছেন লুপিন। পরমুহূর্তে, ব্ল্যাক-এর পাশে হেঁটে গেলেন তিনি, ওর একটা হাত সজোরে ধরলেন, টেনে নিলেন নিজের কাছে ক্রুকশ্যাংকস পড়ে গেল মেঝের ওপর এবং ঠিক ভাইয়ের মতো ব্ল্যাককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

 হ্যারির মনে হলো ওর শরীরের নিচে আর কিছু নেই।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! চিৎকার করল হারমিওন।

ব্ল্যাককে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে ফিরলেন লুপিন। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে হারমিওন, লুপিনকে দেখিয়ে উদ্ৰান্ত চোখে বলছে, তুমি–তুমি

হারমিওন–

–তুমি এবং ও!

হারমিওন, শান্ত হও।

আমি কাউকে বলিনি! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করল হারমিওন। তোমাকে সবসময় আড়াল করে আসছিলাম

হারমিওন, প্লিজ, আমার কথা শোন! লুপিন চিৎকার করলেন। আমি বুঝিয়ে বলতে পারি।

কাঁপছে হ্যারি, ভয়ে নয়, কিন্তু আরেক দফা রাগে।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, লুপিনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল সে, গলার স্বরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই তার, এবং পুরো সময়টাই তুমি ওর বন্ধু হয়ে আছো!

তুমি ভুল করছে, বললেন লুপিন। বার বছর ধরে আমি নিশ্চয়ই সাইরিয়াস এর বন্ধু ছিলাম না, কিন্তু এখন আমি তার বন্ধু আমাকে বুঝিয়ে বলতে দাও

না! হারমিওনের চিৎকার, ওকে বিশ্বাস করো না হ্যারি, ও ব্ল্যাককে প্রাসাদের ভেতরে যেতে সাহায্য করছে, ও তোমার মৃত্যুও চায়–ও একটা ওয়েরউলফ!

হঠাৎ ঘরটা নীরব হয়ে গেল। সবার চোখ এখন লুপিনের ওপরে, কিন্তু ওকে শান্ত দেখাচ্ছে, যদিও ফ্যাকাশে।

তোমার মনমতো হলো না হারমিওন, বললেন লুপিন। তিনজনের মধ্যে শুধু এক একজনকেই আমি ভয় পাই। সাইরিয়াসকে প্রাসাদে ঢুকতে আমি কখনও সাহায্য করিনি এবং হ্যারির মৃত্যুও আমি চাই না … ওর মুখের উপর দিয়ে অস্বাভাবিক একটা কম্পন বয়ে গেল। কিন্তু আমি অস্বীকার করছি না যে আমি ওয়েরউলফ।

উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করল রন, কিন্তু যন্ত্রণাকাতর আরেকটি শব্দ করে পড়ে গেল। ওর দিকে এগিয়ে গেলেন লুপিন, ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছে, ঘনঘন শ্বাস ফেলছে রন, দূরে সরে যাও, ওয়েরউলফ!

স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন লুপিন। তারপর ঘুরলেন হারমিওনের দিকে, কতদিন ধরে তুমি জান?

অনেক দিন ধরে, ফিসফিস করে বলল হারমিওন। যখন থেকে আমি প্রফেসর স্নেইপ-এর লেখাটা

সে খুবই আনন্দিত হবে, শীতল স্বরে বললেন লুপিন। ওই লেখাটা সে দিয়েছিল এই আশায় যেন কেউ একজন আমার লক্ষণগুলো ধরতে পারে। তুমি কী চান্দ্রমাসের হিসাব ধরে বুঝতে পেরেছিলে যে পূর্ণিমার সময় আমি অসুস্থ হয়ে যাই? অথবা আমাকে দেখলেই বোগার্টটা চাদে রূপান্তরিত হয়?

দুটোই, শান্ত স্বরে বলল হারমিওন।

যেন জোর করে হাসলেন লুপিন।

তোমার বয়সী যত ডাইনি দেখেছি তার মধ্যে তুমিই সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, হারমিওন।

আমি নই, আস্তে আস্তে বলল হারমিওন। যদি আমি আরেকটু বুদ্ধিমতী হতাম, তাহলে আমি সবাইকে বলতাম তোমার আসল পরিচয়!

কিন্তু তারা এরই মধ্যে জেনে ফেলেছে, বললেন লুপিন। বিশেষ করে কর্মচারীরা তো বটেই।

তোমাকে ওয়েরউলফ জেনেও ডাম্বলডোর চাকরিতে নিয়েছেন? হাঁপতে হাঁপাতে বলল রন। তুমি কী পাগল?

কোন কোন কর্মচারীও তাই ভাবত, বললেন লুপিন। আমি যে বিশ্বাসী এটা বিশ্বাস করাতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে

এবং তিনি ভুল করেছেন! হ্যারি চিৎকার করল। তুমি ওকে সবসময় সাহায্য করে যাচ্ছ! ব্ল্যাক-এর দিকে আঙুল তুলে বলল হ্যারি, ও ততক্ষণে সরে গেছে বিছানাটার উপর, কাঁপা হাতে লুকিয়ে রেখেছে মুখ। কশ্যাংকস লাফিয়ে ওর পাশে উঠল। ওদের দুজনের কাছ থেকেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সরে গেল রন।

আমি সাইরিয়াসকে সাহায্য করছিলাম না, বলল লুপিন। তোমরা যদি আমাকে ব্যাখ্যা করার একটু সুযোগ দাও, আমি বুঝিয়ে বলব। দেখ হ্যারি, রন এবং হারমিওনের জাদুর কাঠি তিনটি ওদের কাছে ছুঁড়ে দিলেন তিনি; নিজেরটা ধরে ফেলল হ্যারি, হতবাক হয়ে গেছে সে।

এই যে, বলল লুপিন, নিজের জাদুর কাঠিটা বেল্টে গুঁজে রাখলেন। এখন তোমরা সশস্ত্র, আমরা নই, এখন তো আমাদের কথা শুনবে?

কি করবে বুঝতে পারছে না হ্যারি। এটাও কী একটি ফাঁদ?

যদি ওকে তুমি সাহায্যই না করবে, বলল হ্যারি, ব্ল্যাক-এর দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তাহলে তুমি কীভাবে জান যে ও এখানে রয়েছে?

মানচিত্র, বললেন লুপিন। ওই মানচিত্রটা, আমার অফিসে বসে আমি ওটা পরীক্ষা করছিলাম

তুমি জান ওটা কীভাবে কাজ করে? সন্দেহের স্বরে বলল হ্যারি।

নিশ্চয়ই, আমি জানি, বললেন লুপিন, অধৈর্যের সঙ্গে হাত নেড়ে। ওটা লিখতে আমিই তো সাহায্য করেছি। আমিই মুনি–স্কুলে আমার বন্ধুরা আমাকে ডাকত ওই নামে।

তুমি–আপনি লিখেছিলেন–?

জরুরি ব্যাপারটা হচ্ছে, আজ সন্ধ্যা বেলায় আমি ওটা দেখছিলাম, কারণ আমার একটা ধারণা ছিল তুমি, রন এবং হারমিওন হিপোথিফটাকে মারার আগে চুপিচুপি একবার হ্যাগ্রিডকে দেখতে যাবে। এবং আমার ধারণা সঠিক ছিল, তাই না?

পায়চারি করতে শুরু করলেন লুপিন, তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। ওর পা থেকে ধুলো উড়ছে।

তুমি হয়তো তোমার বাবার পুরনো জামাটা পড়েছিলে হ্যারি

জামাটা সম্পর্কে আপনি জানেন কীভাবে?

ওটার নিচে যে কতবার জেমসকে হারিয়ে যেতে দেখেছি … বললেন লুপিন, আবার অস্থিরভাবে হাত নাড়লেন। বিষয়টা হচ্ছে তুমি যদি অদৃশ্য হওয়ার জামাটা পরে থাকো তবুও তোমাকে ওই মরেডার্স ম্যাপে দেখা যাবে। আমি দেখেছি তোমরা মাঠ পেরিয়ে হ্যাগ্রিডের কুঠিরে গেছ। বিশ মিনিট পর ওখান থেকে বেরিয়ে এলে, প্রাসাদের দিকে আসছ। কিন্তু এই সময় তোমাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল।

কী? বলল হ্যারি। না ছিল না?

নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বললেন লুপিন, তখনও পায়চারি করছেন, হ্যারির বাধাকে উপেক্ষা করলেন। আমি ভেবেছিলাম ম্যাপটা বোধহয় ভুল করছে। ও কীভাবে তোমাদের সঙ্গে থাকবে?

আমাদের সঙ্গে তো কেউ ছিল না! বলল হ্যারি।

এবং তারপর আমি আরেকটা বিন্দু দেখলাম, তোমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, নাম লেখা সাইরিয়াস ব্ল্যাক আমি দেখলাম তোমাদের সঙ্গে ওর সংঘর্ষ হলো, দেখলাম তোমাদের দুজনকে হোমপিং উইলোর ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে

একজনকে! ক্ষিপ্ত স্বরে বলল রন।

না, রন, বললেন লুপিন। দুজনকে।

পায়চারি থামালেন, রন-এর উপর দিয়ে ঘুরে এল ওর দৃষ্টি।

তোমার কী মনে হয় আমি ইঁদুরটাকে দেখিনি? সোজাসাপটা প্রশ্ন করলেন লুপিন।

কী? বলল রন। এর সঙ্গে স্ক্যাবার্স-এর আবার কী সম্পর্ক?

পুরোপুরি, বললেন লুপিন। আমি কী ওটাকে দেখতে পারি?

ইতস্তত করছে রন, তারপর পোশাকের ভেতরে হাত ঢুকালো। বের করে নিয়ে। এল স্ক্যাবার্সকে, সাংঘাতিকভাবে ছটফট করছে ও; ওটার লম্বা লেজটা ধরে থাকল রন যেন পালিয়ে না যেতে পারে। ব্ল্যাক-এর কোলে উঠে দাঁড়াল কুকশ্যাংকস, নরম একটা হিসস শব্দ করল।

রনের আরও কাছে গেলেন লুপিন। স্ক্যাবার্স-এর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, যেন দম বন্ধ করে রয়েছেন।

কী? আবার বলল রন, স্ক্যাবার্সকে আঁকড়ে ধরে আছে, ভয় পেয়েছে ও। আমার এই ইঁদুরটার সঙ্গে এই সবের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

ওটা ইঁদুর নয়, ভাঙা গলায় হঠাৎ বলে উঠল সাইরিয়াস ব্ল্যাক।

কী বলতে চাইছো–অবশ্যই ওটা একটা ইঁদুর

না, ওটা ইঁদুর না, শান্তস্বরে বললেন লুপিন। ওটা জাদুকর। একজন অ্যানিম্যাগাস, বলল ব্ল্যাক, নাম পিটার পেট্টিগ্রু।

1 Comment
Collapse Comments

ডাউনলোড অপশন থাকলে ভালো হতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *