০৭. ওয়ার্ডরোবে বোগার্ট

০৭. ওয়ার্ডরোবে বোগার্ট

বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ক্লাশেই এলো না ম্যালফয়। আর যখন এলো তখন দেরী করে এলো। ও যখন এলো তখন স্লিথারিন আর গ্রিফিন্ডররা তাদের ডাবল পোশন ক্লাশের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে। ক্লাশরুমে ঢুকল দাম্ভিক ম্যালফয় ডান হাত ব্যান্ডেজে জড়ানো, স্লিং-এ ঝোলানো; হ্যারির মতে অভিনয় করছে সে, যেন কোন ভয়াবহ যুদ্ধ ফেরত বীর যোদ্ধা।

কেমন আছে হাতটা ড্র্যাকো? বোকার মতো কাষ্ঠ হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করল প্যানসি পারকিনসন। খুব কি ব্যথা করছে?

হ্যাঁ, বলল ম্যালফয় যেন একটা ভেংচি কাটল। কিন্তু হ্যারি লক্ষ্য করল, প্যানসির দৃষ্টি অন্য দিকে সরে যেতেই সে ক্র্যাব আর গয়লের উদ্দেশ্যে চোখ টিপল।

বসে পড়ো, বসে পড়ো, অলস ভাবে বললেন প্রফেসর স্নেইপ।

হ্যারি আর রন নিজেদের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ কুটি বিনিময় করল; ওরা যদি দেরী করে আসত তাহলে স্নেইপ কখনই বলতেন না বসে পড়ো বসে পড়ো, ওদেরকে শাস্তি দিতেন। কিন্তু স্নেইপের ক্লাশে যে কোন কিছু করেই পার পেয়ে যেতে পারে ম্যালফয়; স্নেইপ স্লিথারিন হাউজের প্রধান, এবং সাধারণত নিজের ছাত্রদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন।

আজ ওরা একটা নতুন পোশন বানাচ্ছে, আকৃতি ছোট করতে পারে সে রকম একটা পোশন। হ্যারি আর রনের লোহার বড় কড়াইটার পাশেই ম্যালফয় নিজেরটা বসালো। এবং ওরা তিনজন একই টেবিলে ওদের গাছ গাছড়াগুলি কাটতে শুরু করল।

স্যার, ম্যালফয় ডাকল স্নেইপকে, স্যার, এই শেকড়গুলো কাটার জন্যে আমার সাহায্য দরকার, আমার হাতটা–

উইজলি, ম্যালফয়ের জন্য ওর শেকড়গুলো কেটে দাও, বললেন স্নেইপ, মাথা না তুলে।

[রাগে] রনের মুখ লাল হয়ে গেলো।

তোমার হাতে তো আসলে কিছু হয়নি, চাপা স্বরে বলল ও ম্যালফয়ের উদ্দেশ্যে।

টেবিলের ওপার থেকে হাসির ভান কলল ম্যালফয়।

উইজলি, তুমি শুনেছ প্রফসর স্নেইপ কি বলেছেন, শেকড়গুলো কেটে ফেলো।

ছুড়িটা নিয়ে ম্যালফয়ের শেকড়গুলো নিজের দিকে টেনে নিয়ে ও যেনতেন ভাবে ওগুলো কাটতে শুরু করল, যেন এক একটা টুকরা এক এক সাইজের হয়।

প্রফেসর, টেনে টেনে বলল ম্যালফয়, উইজলি আমার শেকড়গুলোকে নষ্ট করছে, স্যার।

স্নেইপ এগিয়ে এলেন ওদের টেবিলের দিকে, ওর বাঁকা নাকটাকে নিচু করে তাকালেন শেকড়গুলোর দিকে, তারপর রনের উদ্দেশে একটা পিলে চমকানো হাসি দিলেন।

ম্যালফয়ের সঙ্গে শেকড়গুলো বদলে নাও, উইজলি।

কিন্তু, স্যার

পনরো মিনিট ধরে রন ওর শেকড়গুলোকে একেবারে সমান সাইজে কেটে রেখেছে।

এখনই, বললেন স্নেইপ ভয়ংকর সুরে।

খুব সুন্দর করে কাটা ওর নিজের শেকড়গুলো ম্যালফয়ের দিকে ঠেলে দিল, আবার ছুরিটা তুলে নিল হাতে।

আর স্যার, এই ডুমুর ডাটাগুলোর ছাল ছাড়াতে হবে, বলল ম্যালফয়, ওর স্বরে বিষ ভরা হাসি।

পটার তুমি ম্যালফয়ের ডুমুর ডাটাগুলোর ছাল ছাড়াবে, একমাত্র হ্যারির জন্য তুলে রাখা বিতৃষ্ণার হাসিটা হাসলেন স্নেইপ।

হ্যারি ম্যালফয়ের ডুমুর ডাটাগুলোকে নিজের দিকে টেনে নিল, রন আগের কাটা শেকড়গুলোকে ঠিকঠাক করায় মনোযোগ দিল। খুব দ্রুত ডাটা গুলোর ছাল ছাড়িয়ে ওগুলো ম্যালফয়ের দিকে ছুঁড়ে দিল হ্যারি কোন কথা না বলে। ম্যালফয়ের কৃত্রিম হাসিটা বেড়ে গেলো আরো।

তোমাদের বন্ধু হ্যাগ্রিডকে ইদানিং দেখেছ? আস্তে করে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করল ম্যালফয়।

সেটা তোমার নাক গলাবার কোন বিষয় নয়, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল রন ওর দিকে না তাকিয়ে।

আমার ভয় হচ্ছে ও আর শিক্ষক থাকতে পারছে না, কত্রিম দরদ দেখিয়ে বলল ম্যালফয়। আমার আহত হওয়ার ঘটনায় বাবা খুব বেশি খুশি হননি—

বেশি কথা বললে আমি কিন্তু তোমাকে এবার আসলেই আহত করবো, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল রন।

স্কুল গভর্নরদের কাছে ইতোমধ্যেই নালিশ করেছেন তিনি। এবং মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকেও। তোমরা তো জানো বাবার অনেক প্রভাব রয়েছে সব যায়গায়। আর এ রকম একটা দীর্ঘস্থায়ী আঘাত সে একটা লম্বা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, কে জানে, আমার হাতটা আর কোনদিন আগের মতো হবে কি না?

ও সে জন্যেই তুমি হাতটা এভাবে ঝুলিয়ে রাখছ, বলল হ্যারি, ভুল করে একটা মরা শুয়োপোকার মাথা কেটে ফেলল, রাগে কাঁপছিল ওর হাত। যেন হ্যাগ্রিডকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করানো যায়।

বেশ, বলল ম্যালফয়, স্বর নিচু করে ফিস ফিস করে বলল, আংশিক সত্য, পটার। তাছাড়া অন্যান্য সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। উইজলি, আমার শুয়োপোকাটাকে কেটে দাও।

কয়েক কড়াই দূরে ম্যালা ঝামেলায় পড়েছে নেভিল। পোশন ক্লাশে নিয়মিতভাবেই মুশকিলে পড়ে ও; ওর জন্যে এই ক্লাশটা সবচেয়ে অলুক্ষুণে, এবং প্রফেসর স্নেইপের প্রতি ভীষণ ভীতি ওর অবস্থাটাকে আরো জটিল করে তুলেছে। ওর পোশন যেটা, উজ্জ্বল অ্যাসিড গ্রীন, সেটা হয়ে গেছে

কমলা রঙ, লংবটম, বললেন স্নেইপ হাতা দিয়ে কড়াই থেকে কিছুটা পোশন তুলে আবার ছেড়ে দিলেন কড়াইয়ে, যেন সবাই দেখতে পায়। কমলা রং। আমাকে বলো তোমার ওই মোটা মাথায় কি কখনই কিছু ঢোকে না? তুমি কি শোনোনি আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি ইঁদুরের মাত্র একটা প্লীহা হলেই চলবে? বলিনি জোকের একটুখানি রসই যথেষ্ট? তোমাকে বোঝাতে হলে আমার আর কি করতে হবে, লংবটম?

লাল-গোলাপী হয়ে গেলো নেভিলের মুখের রং, কাঁপছে সে ভয়ে। মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে সে।

প্লিজ, স্যার, অনুনয় করল হারমিওন, প্লিজ, আমি নেভিলকে সাহায্য করতে পারি

আমার তো মনে পড়ছে না তোমাকে বাহাদুরি দেখাবার জন্য আমি ডেকেছিলাম মিস ঘের, ঠাণ্ডা স্বরে বললেন স্নেইপ, এবং হারমিওনও নেভিলের মতোই লাল হয়ে গেল। লংবটম এই ক্লাশের পর তোমার পোশনের কয়েক ফোঁটা তোমার ব্যাঙটাকে খাইয়ে দেখবে কি হয়। বোধহয় এরপর তুমি সঠিকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত হবে।

সরে গেলেন স্নেইপ, ভয়ে নেভিলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে।

আমাকে সাহায্য করো! কাতর কণ্ঠে হারমিওনকে বলল সে।

হ্যারি, ডাকল সিমাস ফিনিগান সামনে ঝুঁকে ওর ওজন মাপার পিতলের যন্ত্রটা নেয়ার সময়, শুনেছ? ডেইলী প্রফেট পত্রিকায় আজ সকালে লেখা হয়েছে ওরা মনে করে সাইরিয়াস ব্ল্যাককে দেখা গেছে।

কোথায়? হ্যারি আর রন একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল। টেবিলের আরেক মাথায় ম্যালফয় মাথা তুলল, কান পাতল শোনার জন্যে।

এখান থেকে খুব দূরে নয়, বলল সিমাস, ওকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। একজন মাগল ওকে দেখতে পেয়েছে। অবশ্য সে ঘটনাটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। মাগলরা মনে করে ও একটা সাধারণ অপরাধী, তাই না? সে অবশ্য হটলাইনে টেলিফোন করেছিল। তবে, মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ওখান থেকে সরে পড়েছিল সে।

এখান থেকে খুব দূরে নয়  পুনরাবৃত্তি করল রন, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকাল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যালফয়কে দেখল মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছে। কি হয়েছে ম্যালফয়? আরো কোন কিছুর ছাল ছাড়াতে হবে?

বিদ্বেষে চকচক করছে ম্যালফয়ের চোখ জোড়া, এবং হ্যারির দিকে নিবদ্ধ ওর দৃষ্টি। ও টেবিলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল।

ব্ল্যাককে একাকী ধরবার ফন্দি আঁটছ পটার?

হু, সেটা ঠিক, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল হ্যারি।

ম্যালফয়ের সরু মুখটায় ছড়িয়ে পড়ল একটা ক্রুর হাসি।

নিশ্চয়ই, আমিই চেষ্টা করবো, শান্ত স্বরে বলল সে। এর আগেই আমার কিছু করা উচিত ছিল। ভালো ছেলের মতো আমার স্কুলের চার দেয়ালের ভেতরে থেকে যাওয়া ঠিক হয়নি, বাইরে গিয়ে ওকে খুঁজে বার করবার দরকার ছিল।

কি বলছ তুমি ম্যালফয়? রুক্ষ স্বরে বলল রন।

তুমি কি সেটা জানো না, পটার? ওর নিপ্রভ চোখ দুটো সরু হয়ে এলো।

কী জানি না?

ম্যালফয় একটা দীর্ঘ অবজ্ঞাপূর্ণ হাসি হাসল।

হয়তো তুমি কোন ঝুঁকি নিতে চাও না, বলল সে (ম্যালফয়)। ওটা তুমি ডিসেন্টরদের হাতেই ছেড়ে রাখতে চাও, তাই না? কিন্তু তোমার যায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে প্রতিশোধ নিতে চাইতাম। আমি নিজে ওকে খুঁজে বার করতাম।

তুমি কী বলছো? ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করল হ্যারি, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন স্নেইপ, এতক্ষণে তোমাদের উপাদান মেশানো হয়ে গেছে। এই পোশন পান করবার আগে জ্বাল দিয়ে নিতে হয়; যখন ফুটতে শুরু করবে তখন পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং তারপর আমরা পরীক্ষা করবো লংবটমের

ক্র্যাব এবং গয়ল জোরে হেসে উঠল নেভিলকে ঘামতে দেখে ও নিজের পোশনটা নাড়ছে পাগলের মতো। হারমিওন বিড় বিড় করে ওকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল, যেন স্নেইপ শুনতে না পায়। হ্যারি আর রন ওদের অব্যবহৃত উপাদানগুলো গুছিয়ে কোণার পাথরের বেসিনে হাতা আর হাত ধুতে গেলো।

ম্যালফয় কি বোঝাতে চেয়েছিল? ছাদের নর্দমা সংলগ্ন সিংহাকৃতির মুখ থেকে বেরনো বরফ শীতল পানির নিচে হাত দিয়ে হ্যারি জানতে চাইল রনের কাছে। আমি কেন ব্ল্যাক-এর ওপর প্রতিশোধ নিতে যাবো, ও তো আমার কোন ক্ষতি করেনি-এখনো।

এটা ওর ষড়যন্ত্র, ও এটা তৈরি করছে যেন তুমি বোকার মতো কিছু একটা করে বসো

ক্লাশ শেষ হওয়ার পথে, স্নেইপ হেঁটে গেলেন নেভিলের কাছে, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে ওর কড়াইয়ের কাছে।

সবাই এসে চারপাশে দাঁড়াও। বললেন স্নেইপ, চকচক করছে ওর কালো চোখ জোড়া, এসে দেখো লংবটমের ব্যাঙের দশা কি হয়। যদি সে সংকোচন পোশন বানাতে সফল হয়ে থাকে তবে ওর ব্যাঙটা ছোট হয়ে ব্যাঙাচি হয়ে যাবে। এবং যদি সে বানাতে না পারে, এবং কোন সন্দেহ নেই সে ব্যর্থই হয়েছে, তাহলে সম্ভাবনা হচ্ছে যে ওর ব্যাঙটা বিষে আক্রান্ত হয়ে যাবে।

গ্রিফিন্ডাররা ভয়ে ভয়ে দেখছে। স্লিথারিনরা মহা উত্তেজিত। নেভিলের ব্যাঙ ট্রেভরকে বাঁ হাতে তুলে নিলেন স্নেইপ, নেভিলের পোশনের মধ্যে ছোট্ট একটা চা চামচ ডোবালেন, ওটা এখন সবুজ রং ধারণ করেছে। ট্রেভরের গলা দিয়ে কয়েক ফোঁটা পোশন নামিয়ে দিলেন তিনি।

এক মুহূর্তের জন্য সবাই নীরব হয়ে গেল একেবারে, ঢোক গিলল ট্রেভর; পপ করে ছোট্ট একটা শব্দ হলো, ক্ষুদে ব্যাঙাচি ট্রেভরকে নড়তে দেখা গেল স্নেইপের হাতের তালুতে।

হাততালিতে ফেটে পড়ল গ্রিফিন্ডররা। বেজার হয়ে গেলেন স্নেইপ, পকেট থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করে ট্রেভরের ওপর কয়েক ফোঁটা তরল ঢাললেন এবং সে হঠাৎ করেই আবার পূর্ব আকৃতি ফিরে পেল।

গ্রিফিন্ডর থেকে পাঁচ পয়েন্ট কেটে নেয়া হলো, বললেন স্নেইপ। সবগুলো মুখ থেকে হাসি মুছে গেলো। মিস গ্রেঞ্জার আমি বলেছি ওকে সাহায্য না করবার জন্যে। ক্লাশ ডিসমিস।

হ্যারি, রন আর হারমিওন সিঁড়ি বেয়ে সামনের হল রুমে ঢুকল। হ্যারি তখনও ভাবছে ম্যালফয়ের কথাগুলো। রন উত্তেজিত স্নেইপের ব্যাপারে।

পোশন ঠিক হয়েছে বলে গ্রিফিন্ডর থেকে পাঁচ পয়েন্ট কেটে নেয়া হলো। হারমিওন তুমি মিথ্যা কথা বললে না কেন? তোমার বলা উচিৎ ছিল ওটা নেভিল নিজে নিজেই করেছে!

হারমিওন জবাব দিল না। রন চারপাশে তাকালো।

কোথায় হারমিওন?

হ্যারিও ফিরে দাঁড়াল। ওরা সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপে। দেখছে ক্লাশের বাকি সবাই গ্রেট হলে ঢুকছে লাঞ্চের জন্য।

ও তো আমাদের ঠিক পেছনেই ছিল, ভ্রুকুটি করে বলল রন।

ক্র্যাব আর গয়লকে দুপাশে নিয়ে ম্যালফয় ওদের পাশ দিয়ে চলে গেলো হ্যারিকে কৃত্রিম একটা হাসি উপহার দিয়ে।

ওই যে হারমিওন, বলল হ্যারি।

দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে হারমিওন; একহাতে নিজের ব্যাগটা খামচে ধরে আছে অন্য হাতে কাপড়ের নিচে কি যেন একটা খুঁজে রেখেছে।

তুমি কীভাবে ওটা করলে? জিজ্ঞাসা করল রন।

কী? ওদের সঙ্গে যোগ দিতে দিতে বলল হারমিওন।

এক মুহূর্তে তুমি ছিলে আমাদের সাথে আর আবার পরের মুহূর্তেই সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে।

কী? হারমিওনকে একটু বিভ্রান্ত লাগল। ওহ-একটা জিনিষের জন্যে আমাকে ফিরে যেতে হয়েছিল। ও না

হারমিওনের ব্যাগের একদিকটায় সেলাই খুলে গিয়েছে। হ্যারি অবাক হলো; ওটা অন্তত ডজনখানেক বড় আর ভারি বইয়ে ঠাসা।

ওগুলো বয়ে বেড়াচ্ছ কেন? রন জিজ্ঞাসা করল।

তুমি জান কতগুলো বিষয় পড়ছি আমি, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হারমিওন। এগুলো একটু ধরতে পারবে?

কিন্তু– ওর দেয়া বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে রন, প্রচ্ছদগুলো দেখে বলল, আজ তো এর একটিরও ক্লাশ নেই, শুধু ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস রয়েছে দুপুরের পরে।

ও হ্যাঁ, অনিদিষ্টভাবে বলল হারমিওন, কিন্তু তারপরও সবগুলো বইই আবার নিজের ব্যাগে রাখল। আশা করি লাঞ্চে ভালো কিছু পাওয়া যাবে ক্ষুধায় পেট জ্বলছে, বলতে বলতে গ্রেট হলের দিকে হেঁটে চলে গেল হারমিওন।

তোমার কী মনে হচ্ছে হারমিওন আমাদের কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে? রন জিজ্ঞাসা করল হ্যারিকে।

***

ওরা যখন ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্ট ক্লাশে পৌঁছল তখনও প্রফেসর লুপিন সেখানে পৌঁছাননি। ওরা সবাই বসল, যার যার বই, পালকের কলম এবং পার্চমেন্ট বার করল। প্রফেসর লুপিন যখন ক্লাশে ঢুকলেন তখন ওরা একে অন্যের সাথে কথা বলছে। প্রফেসর লুপিন অস্পষ্টভাবে হেসে নিজের পুরনো রংচটা ব্রিফকেসটা টিচার্স ডেস্কের উপর রাখলেন। আগের মতোই জীর্ণ লাগছে তাকে, কিন্তু ট্রেনে যেমন দেখাচ্ছিল তার চেয়ে তাজা দেখাচ্ছে, যেন এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ভরপেট খেতে পেয়েছেন।

গুড আফটারনুন, বললেন তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে, তোমরা কি তোমাদের বইগুলো ব্যাগে ভরে রাখবে, প্লিজ। আজকের ক্লাশটা প্র্যাকটিকাল, তোমাদের শুধু জাদুর কাঠির প্রয়োজন হবে।

বই রাখতে রাখতে ক্লাশের মধ্যে কয়েকটা কৌতূহলী দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো। এর আগে স্মরণকালের মধ্যে এই ক্লাশের কোন প্র্যাকটিকাল হয়নি, শুধুমাত্র গত বছর তাদের আগের শিক্ষক খাঁচাভর্তি পিক্সি এনে ক্লাসে ছেড়ে দিয়েছিল।

ঠিক আছে, সবাই তৈরি হলে বললেন প্রফেসর লুপিন, আমাকে অনুসরণ করো।

বিভ্রান্ত কিন্তু কৌতূহলী ক্লাসটা ওকে অনুসরণ করে বাইরে গেল। জনশূন্য করিডোর ধরে, বাঁক ঘুরে ওরা অনুসরণ করল প্রফেসরকে। পথে দেখা গেল পিভস দ্য পোল্টারজিস্ট (উপদ্রপকারী ভূত) শূন্যে উল্টো হয়ে ঝুলতে ঝুলতে সবচেয়ে কাছের দরজার চাবির ফটোটাকে চুইং গাম দিয়ে ঠাসছে।

প্রফেসর লুপিন দুফিটের মধ্যে না আসা পর্যন্ত পিভস তাকে দেখেনি। সে তার বাঁকা–আঙলের পা এক পাশ থেকে আরেক পাশে আন্দোলিত করে গান গেয়ে উঠল।

লুনি, লুপি লুপিন, পিভস গাইল। লুনি, লুপি লুপিন, লুনি, লুপি লুপিন

দুর্বিনীত পিভসকে সামলানো সব সময়ই কঠিন, কিন্তু সে শিক্ষকদের বরাবর সম্মান করতো। সবাই প্রফেসর লুপিনের দিকে তাকাল তার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্যে; ওদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রফেসর তখনও হাসছেন।

আমি যদি তোমার যায়গায় হতাম পিভস, তাহলে ওই চুইংগামটা চাবির ফুটো থেকে বের করে নিতাম, ভালোভাবেই বললেন প্রফেসর। মিস্টার ফিলচ তার ঝাড়ুগুলো পাবেন না।

ফিলচ হচ্ছে হোগার্টস-এর কেয়ারটেকার, বদমেজাজি এবং ব্যর্থ এক জাদুকর যে সব সময়ই ছাত্রদের এবং বিশেষ করে পিভস-এর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। প্রফেসর লুপিনের কথা পাত্তাই দিল না পিভস, বরং ওঁর কথা শুনে বিচিত্র আওয়াজ আর অঙ্গভঙ্গি করে তার বিরাগ প্রকাশ করল।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রফেসর লুপিন তার জাদুর কাঠিটা বের করলেন।

 চমৎকার একটা উপকারী কিন্তু ছোট্ট জাদু, মাথা ঘুরিয়ে ক্লাশকে বললেন তিনি, খুব ভালোভাবে খেয়াল কর।

কাঁধ বরাবর জাদুর কাঠিটা তুললেন তিনি, বললেন, ওয়ার্দিওয়াসি! এবং ওটাকে পিভস-এর দিকে তাক করলেন।

বুলেটের গতিতে চুইংগামের দলাটা চাবির ফুটো থেকে বেরিয়ে পিভস-এর বা নাকের ফুটোর ভেতরে ঢুকে গেল; উপরের দিকে ঘুরে গেল পিভস এবং অভিশাপ দিতে দিতে পালিয়ে বাঁচল।

দারুণ, স্যার! বিস্ময়ে বলল ডিন থমাস।

ধন্যবাদ ডিন, জাদুর লাঠিটা রাখতে রাখতে বললেন প্রফেসর, আমরা কী তাহলে যাবো?

আবার চলতে শুরু করল ক্লাসটা। প্রফেসর লুপিনের দিকে তাকাচ্ছে ওরা সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে। দ্বিতীয় একটা করিডোরে এসে থামলেন তিনি, একেবারে স্টাফ রুমের দরজার সামনে।

রুমটা খুলে দিয়ে একপাশে সরে গিয়ে বললেন, ভেতরে প্লিজ।

স্টাফ রুম, অগোছালো চেয়ারে ভর্তি লম্বা একটা রুম, একজন শিক্ষকের উপস্থিতি ছাড়া পুরোটা খালি। প্রফেসর স্নেইপ বসেছিলেন একটা নিচু চেয়ারে, ওরা সবাই রুমে ঢুকতেই ঘুরে দেখলেন। তার চোখ জোড়া চকচক করছে মুখে কদর্য একটা অবজ্ঞার ভাব। রুমে ঢুকে প্রফেসর লুপিন দরজাটা বন্ধ করবার উপক্রম করতেই স্নেইপ বললেন, এটা খোলাই রাখ লুপিন, আমি বরং এটা দেখবো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে ক্লাশের পাশ দিয়ে চলে গেলেন তিনি কালো পোশাকটায় বিরাট ঢেউ তুলে। দরজার কাছে এসে পেছন ফিরলেন, সম্ভবত কেউ তোমাকে সাবধান করে দেয়নি লুপিন, যে এই ক্লাশে নেভিল লংবটম রয়েছে। তাকে কোন কঠিন কিছু করবার দায়িত্ব না দেয়ার জন্যেই উপদেশ দিচ্ছি। যদি না মিস গ্রেঞ্জার তার কানের কাছে ফিস ফিস করে সব বলে দিতে থাকে।

লাল হয়ে গেল নেভিল। হ্যারি তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল স্নেইপের দিকে নিজের ক্লাশে তিনি নেভিলকে পীড়ন করেন সেটাই যথেষ্ট খারাপ, আবার অন্য শিক্ষকদের সামনে ওর একই রকম আচরণ করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রফেসর লুপিন চোখ বড় করলেন।

আমি তো আশা করছি প্রথম দিকের অপারেশনে নেভিলই আমাকে সাহায্য করবে, বললেন প্রফেসর লুপিন, এবং আমি নিশ্চিত সে প্রশংসনীয়ভাবেই সেটা করবে।

নেভিলের চেহারাটা সম্ভব আরো লাল হলো। বাঁকা হয়ে গেলো সেইপের ঠোঁট, চলে গেলেন তিনি দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে।

তাহলে, বললেন প্রফেসর লুপিন, ক্লাশকে রুমের শেষ প্রান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে, ওখানে একটিমাত্র ওয়ার্ডরোব ছাড়া আর কিছুই নেই, শিক্ষকরা ওখানে তাদের অতিরিক্ত পোশক রাখেন। প্রফেসর লুপিন ওয়ার্ডরোবের কাছে যেতেই ওটা এদিক ওদিক কেঁপে দেয়ালের সঙ্গে জোরে বাড়ি খেল।

কয়েকজন ভয়ে লাফিয়ে পেছনে চলে গিয়েছিল। ঘাবড়াবার কিছু নেই, তাদের লক্ষ্য করে বললেন প্রফেসর লুপিন শান্ত স্বরে। ওটার ভেতরে একটা বোগার্ট রয়েছে।

বেশিরভাগই মনে করল ওটা ভয় পাবার মতো কোন কিছু। নেভিল তাকাল প্রফেসর লুপিনের দিকে চোখে নির্ভেজাল আতংক, আর সিমাস ফিনিগান ভয়ে তাকিয়ে রয়েছে কাঁপতে থাকা দরজার নবটার দিকে।

বোগার্টরা পছন্দ করে অন্ধকার, বদ্ধ যায়গা, বললেন প্রফেসর লুপিন। ওয়ার্ডরোব, বিছানার মাঝখানের ফাঁক, সিঙ্কের নিচের কাবার্ডে-একবার আমি একজনের দেখা পেয়েছিলাম যে কি না বড় দেয়ালঘড়ির মধ্যে তার আবাস বানিয়েছিল। এটা এখানে এসেছে গতকাল দুপুরের পরে, আমি হেডমাস্টারকে বলেছিলাম স্কুলের স্টাফরা যদি ওকে ওখানেই থাকতে দেয় তবে থার্ড ইয়ারের একটা প্র্যাকটিকাল ক্লাশ নিতে সক্ষম হবো।

তাহলে প্রথম যে প্রশ্নটি আমাদের করতে হবে সেটা হলো বোগার্ট কী? হাত তুলল হারমিওন।

আকৃতি–পরিবর্তনকারী, বলল সে। আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাতে সক্ষম যে আকৃতি সেটাই ধারণ করে সে।

আমি নিজেও এত ভালো করে বলতে পারতাম না, বললেন প্রফেসর লুপিন, গর্বিত দেখাল হারমিওনকে। তাহলে ভেতরের অন্ধকারে যে বোগার্টটা বসে রয়েছে সে এখনও কোন আকতি ধারণ করেনি। সে এখনও জানে না দরজার বাইরে যারা রয়েছে কোন আকৃতি তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভীত করবে। কেউ জানে না বোগার্ট আসলে দেখতে কেমন। কিন্তু, যে মুহূর্তে আমি ওটাকে বের করে আনব, ঠিক সেই মুহূর্তে ওটা সেই আকৃতি ধরবে যেটা দেখলে আমরা প্রত্যেকে ভয় পাবো।

তার মানে হচ্ছে, বললেন প্রফেসর লুপিন, নেভিলের মুখ নিসৃত ভয়ার্ত শব্দগুলোকে পাত্তা দিচ্ছেন না তিনি, শুরুতেই বোগার্টের তুলনায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছি। ধরতে পেরেছ হ্যারি?

সদা তৎপর, হাত তুলে সব প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত হারমিওন পাশে থাকলে কোন প্রশ্নের জবাব দেয়া সত্যিই কঠিন, কিন্তু হ্যারি সফল হলো।

ইয়ে–মানে আমরা এতজন রয়েছি যে ওটা বুঝবেই না কোন আকৃতি ধারণ করতে হবে?

একেবারে সঠিক, বললেন প্রফেসর, এবং ওর হাত নিচে নামাল, একটু হতাশ দেখাচ্ছে ওকে। যখন কোন বোগার্টের সঙ্গে তোমাদের মোলাকাৎ হবে তখন সঙ্গে লোকজন থাকাই ভালো। বিভ্রান্ত হয়ে যায় ও। সেটাই হওয়া উচিৎ, মস্তকবিহীন মৃতদেহ অথবা মাংসখেকো একটা? একবার আমি দেখেছিলাম একটা বোগার্ট একসঙ্গে দুজনকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেকে অর্ধ–শ্লাগে রূপান্তরিত করেছিল। একেবারেই ভয়ের কিছু নয়।

বোগার্টকে ঠেকানোর জাদুটা খুব সহজ, কিন্তু তারপরও প্রয়োগ করতে মনের জোর লাগে। দেখো, একটা বোগার্টকে যেটা একেবারে শেষ করে দেয় সেটা হচ্ছে হাসি। তোমাকে যা করতে হবে সেটা হচ্ছে মনের প্রভাব খাঁটিয়ে ওটাকে এমন একটা আকৃতি ধারণ করতে বাধ্য করা যেটা দেখলে তোমার খুব মজা লাগবে এবং তুমি হাসবে।

প্রথমে জাদুর কাঠি ছাড়াই আমরা জাদুটা প্র্যাকটিস করব। আমার সঙ্গে বলো রিড্ডিকুলাস!

রিড্ডিকুলাস! ক্লাশের সবাই এক জোটে বলে উঠল।

বেশ, বললেন প্রফেসর লুপিন। খুব ভালো। কিন্তু ওটা ছিল সবচেয়ে সহজ অংশটা। আসলে শুধু শব্দটাই যথেষ্ট নয়। এবং এখানেই নেভিল, তোমার প্রয়োজন।

ওয়ার্ডরোবটা আবার কেঁপে উঠল, তবে নেভিলের মতো নয়, কাঁপতে কাঁপতে যে সামনে এগোচ্ছে, যেন ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছে।

ঠিক আছে নেভিল, বললেন প্রফেসর লুপিন। আগের কাজ আগে: তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভীত করে কোন জিনিষটা?

নেভিলের ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কোন শব্দ বের হলো না।

শুনতে পাইনি, নেভিল, দুঃখিত, বললেন প্রফেসর উফুল্ল কণ্ঠে।

চারদিকে উদ্রান্তের মতো তাকাল নেভিল, যেন কারো সাহায্য ভিক্ষা করছে, তারপর বলল, প্রায় ফিস ফিস করে, প্রফেসর স্নেইপ।

প্রায় সকলেই হেসে উঠল। এমনকি নেভিলও হেসে উঠল যেন অপরাধীর মতো। প্রফেসর লুপিনকে অবশ্য চিন্তিত হতে দেখা গেল।

প্রফেসর স্নেইপ হুমমম নেভিল, আমার বিশ্বাস তুমি তোমার দাদীর সঙ্গে থাকো?

ইয়ে–মানে হ্যাঁ, বলল নার্ভাস নেভিল। কিন্তু আমি–আমি চাইনা বোগার্ট দাদীতে রূপান্তরিত হোক।

না, না, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, হেসে বললেন প্রফেসর লুপিন। আমি ভাবছি তুমি আমাদের বলতে পারবে কি না, কী ধরনের পোশাক তোমার দাদী পরেন?

নেভিলকে চমকে উঠতে দেখা গেল, তবে সে বলল, মানে সব সময়ই একই হ্যাট। একটা লম্বা হ্যাট ওটার মাথায় একটা শকুন ঠাসা। এবং একটা লম্বা পোশাক সাধারণত সবুজ, এবং কখনও কখনও শেয়ালের–চামড়ার স্কার্ফ।

এবং একটা হ্যান্ডব্যাগ? যোগ করলেন প্রফেসর লুপিন।

বড় একটা লাল, বলল নেভিল।

ঠিক আছে তাহলে, বললেন প্রফেসর লুপিন। ওই পোশাক কী তুমি পরিষ্কার ভাবে তোমার মনের চোখে দেখতে পারো?

হ্যাঁ, বলল নেভিল অনিশ্চিতভাবে, ভাবছে এর পরে কি হতে যাচ্ছে।

বোগার্ট যখন এই ওয়ার্ডরোব থেকে সজোরে বেরিয়ে আসবে, নেভিল, এবং তোমাকে দেখতে পাবে, ওটা প্রফেসর স্নেইপের আকৃতি ধারণ করবে, বললেন লুপিন। এবং তুমি এইভাবে তোমার জাদুর কাঠি তুলে চিৎকার করে বলবে রিডিকুলাস এবং গভীরভাবে তোমার দাদীর পোশাকের কথা ভাববে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে প্রফেসর স্নেইপ বাধ্য হবেন শকুন–মাথা হ্যাট, সবুজ পোশাক এবং লাল হ্যান্ডব্যাগধারীতে পরিণত হতে।

হাসির একটা গমক শোনা গেল। ওয়ার্ডরোবটা আরো জোরে নড়ে উঠল।

যদি নেভিল সফল হয়, তবে, বোগার্টটা একে একে আমাদের সকলের দিকেই ফিরবে। বললেন প্রফেসর লুপিন। আমি চাচ্ছি এখন তোমরা এক মুহূর্তের জন্যে ভাববে কোনটা তোমাদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর এবং সঙ্গে সঙ্গে এও ভাববে কিভাবে ওটাকে হাস্যকর কিছুতে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করা যায়।

নীরবতা নেমে এলো রুমে। হ্যারি ভাবছে কোনটা ওর কাছে সবচেয়ে বেশি ভীতিকর?

তার প্রথম চিন্তা ছিল লর্ড ভল্ডেমর্ট–পর্ণ শক্তিতে ফিরে আসা একজন লর্ড ভন্ডেমর্ট। কিন্তু বোগার্ট–ভল্টেমর্টের ওপর প্রতি আক্রমণের প্ল্যান ঠিক করবার আগেই, ওর মনের পর্দায় ভয়ংকর একটা ছবি ভেসে উঠল

একটা পঁচা গলিত চকচকে হাত, কালো পোশাকের নিচে টলটলায়মান ভাবে গড়িয়ে চলছে … একটা লম্বা, অদৃশ্য মুখ নিঃসৃত নিঃশ্বাস গা শির শির করা ঠাণ্ডা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে … ডোবার কথা

কেঁপে উঠল হ্যারি, তাকাল চারদিক, কেউ দেখে ফেলেনি তো। অনেকেরই চোখ চেপে বন্ধ হয়ে আছে। রন বিড় বিড় করছে, ওটার পা ছিঁড়ে ফেল। হ্যারি নিশ্চিত যে ও জানে রন কি নিয়ে ভাবছে। রনের সবচেয়ে ভয়ের হচ্ছে মাকড়সা।

সবাই তৈরি? জিজ্ঞাসা করলেন প্রফেসর লুপিন।

হ্যারির ভেতর ভয়ের একটা স্রোত বয়ে গেল। সে তৈরি নয়। একজন ডিমেন্টরকে কী করে কম ভীতিকর করা যায়? কিন্তু সে আরো সময় নিতে চাচ্ছে না, সকলেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ছে, সার্টের হাত গোটাচ্ছে।

নেভিল, আমরা সকলে পেছনে সরে যাবো, বললেন প্রফেসর লুপিন। যেন তোমার সামনের যায়গাটা পরিষ্কার থাকে, ঠিক আছে? পরের জনকে আমি সামনে ডাকব সবাই পেছনে যাও, নেভিল যেন পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়।

সবাই পেছনে সরে গেলো, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, নেভিলকে ওয়ার্ডরোবের সামনে একা ছেড়ে দিল। ওকে ম্লান আর ভীত দেখাচ্ছে, কিন্তু ও সার্টের হাত গুটিয়ে নিয়ে জাদুর কাঠিটা হাতে ধরে প্রস্তুত।

তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে, নেভিল, বললেন প্রফেসর লুপিন, ওয়ার্ডরোবের হাতলের দিকে নিজের জাদুর কাঠিটা তাক করে। এক–দুই–তিন-এখন!

স্ফুলিঙ্গের একটা ঝলক প্রফেসর লুপিনের জাদু কাঠি থেকে বেরিয়ে সোজা ওয়ার্ডরোবের নবে আঘাত করল। সজোরে খুলে গেল ওয়ার্ডরোবটা। বড়শীর মতো নাক এবং ভীতিকর, প্রফেসর স্নেইপ বেরিয়ে এলেন ওয়ার্ডরোব থেকে, তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন নেভিলের দিকে।

পিছিয়ে গেল নেভিল, ওর জাদুর কাঠিটা সোজা করে ধরা, মুখ নড়ছে কিন্তু নিঃশব্দে। ওর ওপর প্রায় এসে পড়ল স্নেইপ, পোশাকের ভেতরে হাত ঢোকাল।

রি–র–রিড্ডিকুলাস! কঁকিয়ে উঠল নেভিল।

বাতাসে চাবুকের সপাং আওয়াজের মতো আওয়াজ হলো। হোঁচট খেল স্নেইপ; এখন ওর পরনে লেস লাগানো লম্বা পোশাক, সোজা একটা হ্যাট মাথায় পোকা খাওয়া শকুনি, এবং হাতে দোলাচ্ছেন টকটকে লাল রঙের একটা হ্যান্ডব্যাগ।

হাসিতে ফেটে পড়ল গোটা ক্লাস; বোগার্ট থমকে দাঁড়াল, বিভ্রান্ত, প্রফেসর লুপিন চিৎকার করে উঠলে, পার্বতী! সামনে এসো!

পার্বতী সামনে এগিয়ে গেলো, মুখ স্থির। স্নেইপ ঘুরে ওর দিকে তাকাল। আরেকটি বজ্রপাতের শব্দ হলো, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল স্নেইপ ওখানে এখন সারা গা ব্যান্ডেজে মোড়া রক্তাক্ত এক মমি দাঁড়িয়ে রয়েছে; ওটার দৃষ্টিহীন মুখটা পাবর্তীর দিকে এবং ওর দিকে হাটছে মমিটা, খুব ধীরে, পা টেনে টেনে, আড়ষ্ট হাতটা ধীরে ধীরে উঠছে ওপরে

মমির পায়ের ব্যান্ডেজের পাক খুলে গেল; পা জড়িয়ে উপুড় হয়ে আছড়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়িয়ে গেলো।

সিমাস! প্রফেসর লুপিনের গর্জন শোনা গেল।

পার্বতীকে পাশ কাটিয়ে সিমাস এগিয়ে গেল।

ক্র্যাক! আরেকটা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেল। মমিটা যেখানে ছিল সেখানে এখন এক নারী, কালো চুল তার মেঝের সমান দীর্ঘ এবং সবুজের ছোঁয়া লাগানো মুখটা কংকালের মতো–বাপরী একটা। মুখ ব্যাদন করে বিরাট একটা হা করল সে, অপার্থিব একটা শব্দে ভরে গেল রুমটা, দীর্ঘ একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, হ্যারির মাথার চুল সব দাঁড়িয়ে গেল।

রিড্ডিকুলাস! চিৎকার করে উঠল সিমাস।

বাস্তুপরীর গলা দিয়ে কর্কশ একটা শব্দ বের হলো, নিজের গলাটা খামচে ধরল সে; নীরব হয়ে গেলো সে।

ক্র্যাক! বাস্তূপরীটা ইঁদুরে রূপান্তরিত হয়ে গেল, বৃত্তাকারে ঘুরে নিজের লেজটাকে ধরবার চেষ্টা করছে সে, আবার ক্র্যাক!–সাপে পরিণত হয়ে গেলো ওটা, গড়িয়ে এগোলোলা সাপটা, পাক খেলো তারপর আবার ক্র্যাক!-একটিমাত্র অক্ষিগোলকে পরিণত হলো ওটা।

ওটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে! চিৎকার করে উঠলেন লুপিন। আমরা লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। ডিন!

দ্রুত এগিয়ে গেলো ডিন।

ক্র্যাক! অক্ষিগোলকটা কাটা হাতে পরিণত হলো, মৃদু নড়ল, মেঝে ঘষটাতে ঘষটাতে এগোতে লাগল কাঁকড়ার মতো।

রিড্ডিকুলাস! চিৎকার করে উঠল ডিন।

সাৎ করে একটা শব্দ হলো, ইঁদুর ধরার কলে আটকে গেলো হাতটা।

চমৎকার! রন, এরপর তুমি!

লাফিয়ে সামনে এলো রন।

ক্র্যাক!

চিৎকার করে উঠল কয়েকজন। বিরাট একটা মাকড়সা, ছয় ফিট লম্বা এবং সারা গা লোমে ঢাকা, এগিয়ে যাচ্ছে বনের দিকে, দাঁড়াগুলো শানাচ্ছে। ভীতিকরভাবে। এক মুহূর্তের জন্য হ্যারি ভাবল রন জমে পাথর হয়ে গেছে। তারপর

রিড্ডিকুলাস! গলা ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠল রন, মাকড়সার পা গুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো। গড়াতে শুরু করল ওটা; চিৎকার দিয়ে ওটার পথ থেকে সরে গেলো ল্যাভেন্ডার ব্রাউন। হ্যারির পায়ের কাছে গিয়ে থামল ওটা। জাদুর লাঠিটা তুলল ও, প্রস্তুত, কিন্তু

এখানে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর লুপিন, দ্রুত চলে গেলেন সামনে।

ক্র্যাক!

পা বিহীন মাকড়সাটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য সবাই উদ্রান্তের মতো চারদিকে তাকালো, কোথায় ওটা। এরপর ওরা দেখতে পেলো লুপিনের সামনে শূন্যে ঝুলছে রূপালী একটা গোলক, অনেকটা আলস্যভরেই তিনি বললেন রিড্ডিকুলাস!

ক্র্যাক!

নেভিল সামনে এসো, আর এটাকে শেষ করো! বললেন লুপিন, মেঝেতে পড়লো বোগার্টটা আরশোলা হিসেবে। ক্র্যাক! আবার ফিরে এলো স্নেইপ। এবার নেভিল একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েই বেগে এগিয়ে গেলো।

রিড্ডিকুলাস! চিৎকার করল নেভিল এবং মুহূর্তের কম সময়ের জন্য ওরা স্নেইপকে দেখতে পেলো ওর লেস লাগানো পোশাকে, হাঃ করে বড় একটা হাসি দিল নেভিল সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো বোগার্ট এবং ধূয়ার হাজার হাজার ছোট ছোট কুণ্ডলীতে ছড়িয়ে পড়ে শেষ হয়ে গেলো।

চমৎকার! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর লুপিন, সমস্ত ক্লাশ হাততালিতে ফেটে পড়ল। চমৎকার, নেভিল, খুবই ভালো করেছ, তোমরা সবাই। এখন দেখা যাক… গ্রিফিন্ডরের যারা বোগার্টের মোকাবেলা করেছে তাদের প্রত্যেককে পাঁচ পয়েন্ট নেভিলের জন্য দশ পয়েন্ট, কারণ ও দুবার মোকাবেলা করেছে এবং হ্যারি ও হারমিওন প্রত্যেকের জন্যে পাঁচ পয়েন্ট করে।

কিন্তু আমি তো কিছু করিনি, বলল হ্যারি।

তুমি এবং হারমিওন ক্লাশের শুরুতে আমার প্রশ্নগুলো সঠিকভাবে জবাব দিয়েছিলে, হ্যারির কথার জবাবে বললেন প্রফেসর লুপিন। ঠিক আছে, চমৎকার একটি ক্লাশ। বাড়ীর কাজ, বোগার্ট সম্পর্কিত অধ্যায়টা পড়বে আর সংক্ষেপে লিখবে সোমবার আমাকে দিতে হবে। আজ এ পর্যন্তই।

উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ক্লাশটা। হ্যারির অবশ্য খুব ভাল লাগছিল না। প্রফেসর ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বোগার্টের মোকাবেলা করা থেকে বিরত করেছেন। কেন? কারণ হ্যারিকে ট্রেনে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছেন উনি এবং ভেবেছেন ওর মোকাবেলা করার ক্ষমতা নেই? আশংকা করেছেন আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে হ্যারি?

কিন্তু কেউই মনে হয় কোন কিছু খেয়াল করেনি।

ওই যে বাস্তুপরীটাকে মোকাবেলা করলাম, দেখেছ? চিৎকার করে উঠল সিমাস।

এবং হাতটা! নিজের হাতটাই এক প্রস্ত ঘুরিয়ে বলল ডিন।

আর হ্যাট পরা স্নেইপ!

এবং মমিটা!

আমি ভাবছি প্রফেসর লুপিন ক্রিস্টাল বলকে এত ভয় পান কেন? চিন্তিত স্বরে বলল ল্যাভেন্ডার।

এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে ভালো ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস-এর ক্লাস, তাই না? ক্লাশরুমে ফিরে গিয়ে ব্যাগ নেয়ার সময় উত্তেজিত হয়ে বলল রন।

ওঁকে ভালো শিক্ষক বলেই মনে হচ্ছে, সহমত হয়ে বলল হারমিওন। কিন্তু আমি যদি একবার বোগার্টকে মোকাবেলা করতে পারতাম।

তোমার জন্যে ওটা আর কি? চাপা বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে বলল রন। আরেকটা হোম ওয়ার্ক যেটা শুধুমাত্র দশে নয় আনতে পারে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *