০৫. দ্য ডিমেন্টার

০৫. দ্য ডিমেন্টার

অরদিন সকালে হ্যারির ঘুম ভাঙ্গালো টম, এক কাপ চা আর ওর স্বভাবসুলভ দন্তহীন হাসি দিয়ে। হ্যারি উঠে তৈরি হয়ে নিল। নাছোড়বান্দা হেডউইগকে ও যখন খাঁচার ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে ঠিক সেই সময় একটা সার্টের ভেতর মাথাটা গলাতে গলাতে সবেগে ঘরে ঢুকল রন। খুবই বিরক্ত দেখাচ্ছে ওকে।

যত তাড়াতাড়ি ট্রেনে ওঠা যায় ততই মঙ্গল, বলল সে। আর যাই হোক হোগার্টস-এ পার্সির হাত থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে। এখন কি করেছে ও জানো?

হ্যারির বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, বলবে কি করে। মাথা নাড়ল ও।

আমি নাকি পেনেলোপে ক্লিয়ারওয়াটারের ছবির ওপর চা ফেলেছি, তুমি জানো আমাকে ও অভিযুক্ত করছে, মুখ ভেংচে বলল রন। ওটা ওর গার্লফ্রেড, ফ্রেমের নিচে মুখ লুকিয়ে রেখেছে কারণ ওর নাকে বিচ্ছিরি একটা দাগ হয়ে গেছে যে…

তোমাকে বলার আমার কিছু কথা আছে, হ্যারি শুরু করতে গিয়েছিল, ফ্রেড আর জর্জ এসে পড়ায় থেমে গেলো। ওরা রনকে খুঁজছিল অভিনন্দন জানাবে আবার পার্সিকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পেরেছে বলে।

নাস্তার টেবিলে যাওয়ার পথে রন জিজ্ঞাসা করল, কি যেন বলতে চেয়েছিলে?

ঝড়ের বেগে পার্সিকে আসতে দেখে রন মৃদুস্বরে শুধু বলল, পরে।

রওনা হওয়ার তাড়াহুড়োর মধ্যে হ্যারি না বলতে পারলো রনকে, না হারমিওনকে। মালপত্র, বাক্স প্যাটরা নিয়ে সবাই নিচে নামল।

মিস্টার উইজলি একা বাইরে অপেক্ষা করছেন গাড়ির জন্যে। একটু পরেই দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে বললেন, গাড়ী চলে এসেছে। হ্যারি এদিকে চলে এসো।

পুরনো মডেলের ঘন সবুজ রঙের দুটো গাড়ী। মিস্টার উইজলি হ্যারিকে একেবারে আগলে ধরে প্রথম গাড়িটার কাছে নিয়ে গেলেন।

হ্যারি উঠে পড়ো চট করে, বললেন তিনি মানুষে ঠাসা রাস্তাটার সামনে পেছনে দেখে নিয়ে।

হ্যারি পেছনের সীটে বসল। একটু পরেই এলো হারমিওন, রন এবং রনের গা জ্বালানো পার্সি।

বিশ মিনিট আগেই ওরা কিংস ক্রস রেল স্টেশনে পৌঁছে গেলো। মিনিস্ট্রির ড্রাইভাররা ওদের জন্যে ট্রলি যোগাড় করে এনে ওদের বাক্স প্যাটরা ট্রলিতে তুলে দিয়ে মিস্টার উইজলিকে হ্যাটের কোণা অভিবাদন জানিয়ে গাড়ী নিয়ে চলে গেলো।

একেবারে প্লাটফর্ম পর্যন্ত মিস্টার উইজলি হ্যারিরকে রীতিমত বগলদাবা করে রাখলেন। হ্যারির ট্রলিটা মিস্টার উইজলিই ঠেলে পাটফর্ম সাড়ে ন-এ নিয়ে গেলেন। অন্যদের দুজন দুজন করে আসতে বললেন। স্টিলের হ্যারিয়ারটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে ওরা দুজনেই পড়ে গেলো। এবং পড়েই দেখতে পেলো হোগার্টস এক্সপ্রেসের টকটকে লাল স্টিম ইঞ্জিনটা ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে উইজার্ড আর উইচ ভর্তি প্লাটফরমটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা সব এসেছে ওদের ছেলেমেয়েদের হোগার্টস-এর ট্রেনে তুলে দিতে।

হাপাতে হাপাতে পার্সি আর জিনি ওদের পেছনে এসে উপস্থিত হলো।

আহ! ওই যে পেনেলোপে। বলল পার্সি ওর চুল বিন্যস্ত করতে করতে। এরই মধ্যে লাল হতে শুরু করেছে ও। জিনি আর হ্যারির মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো, হাসি লুকোবার চেষ্টা করল ওরা দুজনেই।

পার্সি হেঁটে গেলো লম্বা কোকড়া চুলের মেয়েটির দিকে। বুক ফুলিয়ে হাঁটছে পার্সি যেন ওর চকচকে ব্যাজটা কিছুতেই পেনেলোপের দষ্টি এড়িয়ে না যায়।

মিস্টার উইজলি আর হ্যারির নেতৃত্বে ট্রেনের প্রায় পেছনের একটা খালি কামরায় উঠে পড়লো ওরা সদলবলে। কামরায় মালপত্র রেখে, লাগেজ র‍্যাকে হেডউইগ আর কুকশ্যাংককে তুলে দিয়ে ওরা আবার ট্রেন থেকে নামলো মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইজলির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্যে।

মিসেস উইজলি সবাইকে আদর করলেন। বিশেষ করে সবার শেষে হ্যারিকে আদরটা যেন একটু বেশিই করলেন। সাবধানে থেকো হ্যারি, থাকবে তো! বললেন মিসেস হ্যারি। এই যে তোমাদের সবার জন্যে স্যান্ডউইচ রইল। হারমিওনের হাতে তুলে দিলেন ওগুলো।

হ্যারি, শান্ত স্বরে ডাকলেন মিস্টার উইজলি। একটু শুনে যাবে। মাথা কঁকিয়ে একটা পিলারের দিকে ইশারা করলেন। অন্যদেরকে মিসেস উইজলির চারদিকে রেখে সে মিস্টার উইজলির পেছন পেছন হেঁটে গেলো পিলারটা পর্যন্ত।

যাওয়ার আগে তোমাকে একটা কথা বলতেই চাই–মিস্টার উইজলির গলায় উত্তেজনা।

কোন সমস্যা নেই মিস্টার উইজলি, বলল হ্যারি নিরুত্তাপ স্বরে, আমি সবই জানি।

তুমি জানো? তুমি কীভাবে জানো?

মানে, আমি মানে–আমি গত রাতে আপনাদের সব কথাই শুনে ফেলেছি। শুনে কোন উপায় ছিল না। বলেই দ্রুত বলল, দুঃখিত।

আমি তো চাইনি তুমি ওভাবে সব কথা জানো, বললেন মিস্টার উইজলি। ওর চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ।

না–সত্যিই বলছি এভাবেই ঠিক হয়েছে। এইভাবে আপনাকে ফাজ-এর কাছে আপনার দেয়া কথার খেলাপ হতে হলো না। আবার আমিও জেনে গেলাম কোথায় কিভাবে কি ঘটছে।

হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছ।

না, আমি মোটেও ভয় পাইনি, বলল হ্যারি বিশ্বাসযোগ্য স্বরে। সত্যিই, কারণ ওর কথায় মিস্টার উইজলির চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস দেখতে পাচ্ছে হ্যারি। আমি কোন হিরো হওয়ার চেষ্টা করছি না, কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞাসা করছি সাইরাস ব্ল্যাক কি ভোল্ডেমোর্টের চেয়ে ভয়ংকর?

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার উইজলি কুকড়ে গেলেন, কিন্তু ওদিকে গেলেন না।

হ্যারি আমি বিশ্বাস করি ফাজ যা ভাবেন তার চেয়েও কঠিন পদার্থে তুমি তৈরি এবং আমি অবশ্যই খুব খুশি যে তুমি ভয় পাওনি কিন্তু।

আর্থার চিৎকার করে উঠলেন মিসেস উইজলি, ট্রেনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ওকে আটকে রেখেছ কেন?

ও আসছে মলি, হ্যারির দিকে ফিরে নিচু স্বরে জরুরি গলায় বললেন, শোন আমাকে তোমার কথা দিতে হবে।

যে আমি ভালো ছেলে হয়ে থাকবে এবং সবসময়ই স্কুলের ভেতরে থাকবো? বলল হ্যারি ভারি স্বরে।

ঠিক এটুকুই না, বললেন মিস্টার উইজলি, হ্যারি কখনই তাকে এত সিরিয়াস দেখেনি। হ্যারি আমাকে কথা দাও, তুমি সাইরাস ব্ল্যাককে খুঁজবে না।

হ্যারি অপলকে তাকিয়ে থেকে বলল, কি!

ট্রেনের শেষ বাঁশি শোনা গেলো। ট্রেনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গার্ডরা কামরার দরজাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে।

প্রতিজ্ঞা কর হ্যারি, আরো দ্রুত বললেন মিস্টার উইজলি, যাই কিছু ঘটুক কেন!

যে লোকটা আমাকে মারতে চাচ্ছে বলে জানি, সেই লোকটাকে আমি কেন খুঁজতে যাবো? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি সোজাসুজি।

আমাকে কথা দাও, যাই শোনো না কেন।

আর্থার জলদি, চিৎকার করে উঠলেন মিসেস উইজলি।

ট্রেনের ইঞ্জিন হুশ করে স্টিম ছেড়ে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। হ্যারি দৌড়ে গিয়ে কামরার হাতলটা ধরে ফেলল, দরজাটা মেলে দিয়ে রন সরে দাঁড়াল। এক লাফে উঠে পড়ল হ্যারি। জানালা দিয়ে ঝুঁকে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইজলির উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। ট্রেনটা বাঁক নেয়ায় ওরা দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টিসীমা থেকে।

ট্রেন ছুটতে শুরু করল তুমুল বেগে।

তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কথা আছে, হ্যারি বলল রন এবং হারমিওনকে।

জিনি অন্যদিকে যাও তো, বলল রন।

চমৎকার! ক্ষেপে উঠে চলে গেল জিনি।

ট্রেনের করিডোর ধরে এগিয়ে চলল ওরা তিনজন খালি কোন কামরার খোঁজে। কিন্তু সব কটি কামরাই প্যাসেঞ্জারে ঠাসা একেবারে শেষেরটি ছাড়া।

কামরার একমাত্র প্যাসেঞ্জার জানালার ধারে ঘুমিয়ে আছে। ওরা কামরাটা ভালো করে দেখে নিল। হোগার্টস এক্সপ্রেস সাধারণত ছাত্রদের জন্যেই রিজার্ভ থাকে। এপর্যন্ত খাবারের ট্রলি ঠেলা উইচটা ছাড়া আর কোন বয়স্ক যাদুকর বা ডাইনীকে ওরা হোগার্টস এক্সপ্রেসে দেখেনি।

আগন্তুক অত্যন্ত ময়লা একটা উইজার্ড চাদর গায়ে দিয়ে আছে। ওটা আবার জায়গায় জায়গায় তালি দেয়া। ওকে অসুস্থ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তবে ওকে বেশ কম বয়সী মনে হলেও ওর হাল্কা বাদামি রঙের চুলে এখনই পাক ধরে গেছে।

তোমার কি মনে হয়, ও কে? চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল রন। বসে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার পর। ওরা বসেছে জানালার কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে।

প্রফেসর আর.জে লুপিন, ফিস ফিস করে বলল হারমিওন সঙ্গে সঙ্গে।

কীভাবে জানো?

ওর ব্রিফকেসের ওপর লেখা রয়েছে, ওর মাথার ওপরের লাগেজ র‍্যাকে রাখা এখানে সেখানে চোট খাওয়া কেসটা দেখিয়ে বলল হারমিওন।

অবাক হয়ে ভাবতে হয় উনি কি পড়াতে পারেন? ভ্রূ কুঁচকে বলল রন।

সহজেই বোঝা যায়, বলল হারমিওন। একটাই মাত্র পদ খালি আছে তাই? ব্ল্যাক আর্টের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা।

টিকতে পারবে কি না সন্দেহ, বলল রন দ্বিধার সঙ্গে। একটা ভালো ঝাঁকি খেলেই সাধ মিটে যাবে। চাকরিটার সঙ্গে বোধহয় দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে, কোন শিক্ষকই বছরখানেকের বেশি টিকতে পারেন না–সে যাই হোক, হ্যারির দিকে ঘুরে বলল কি যেন বলতে চেয়েছিলে? 

হ্যারি ওদেরকে সব কথাই খুলে বলল। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইজলির তর্ক বিতর্ক থেকে শুরু করে স্টেশনে উনি যে তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন সব, কিছুই লুকালো না। ওর কথা শেষ হওয়ার পর রন বসে রইল বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো, হারমিওনের হাত উঠে এসেছে ওর মুখের ওপর। ওই প্রথম কথা বলল মুখ থেকে হাত নামিয়ে, সাইরাস ব্ল্যাক জেল থেকে পালিয়েছে তোমাকে মারবার জন্যে? ওহ! হ্যারি… তোমাকে আসলেই খুউব খুউব সাবধানে থাকতে হবে। বিপদ খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে না হ্যারি..

আমি তো বিপদ খুঁজে বেড়াই না, বিরক্ত হয়ে বলল হ্যারি বিপদই সাধারণত আমাকে খুঁজে পেয়ে যায়।

হ্যারিকে কতটা স্টুপিড হতে হবে সেই উম্মাদটাকে খোঁজার জন্যে, যে কি না ওকেই মারতে চাচ্ছে? বলল রন। কিন্তু ওর ভেতরটা যেন নাড়া খেয়েছে প্রবলভাবে।

হ্যারি যতটা ভেবেছিল খবরটা ওরা তার চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে শুনল। সে নিজে ব্ল্যাককে যতটা ভয় না পায়, রন এবং হারমিওন দুজনেই ওর চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেয়েছে।

কেউ জানে না ও ব্যাটা কিভাবে আজকাবান থেকে বেরিয়েছে, বলল রন অস্বস্তির সঙ্গে। এর আগে কেউ কখনও ঐ কঠিন কাজটি কাজ করতে পারেনি। এছাড়াও ব্যাটা ছিল টপ সিকিউরিটি বন্দী।

আমার বিশ্বাস ওরা ওকে ধরবেই, বেশ জোরের সঙ্গে বলল হারমিওন।

ওটা কিসের শব্দ? হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল রন।

একটা ক্ষীণ শব্দ অনেকটা হুইসল-এর মতো কোথাও থেকে আসছে। ঘরের চারদিকটা ওরা ভালো করে দেখল।

ওটা তোমার ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে আসছে হ্যারি, বলল রন।

এক মুহূর্ত পর রন লাগেজ র‍্যাক থেকে হ্যারির ট্রাংক টেনে নামিয়ে ওটা খুলে ফেলল। হ্যারির কাপড়ের ভাজের ভেতর থেকে ওর পকেট স্নিকোস্কোপটা বের করল। রনের হাতে ওটা তীব্র বেগে ঘুরছে আর ওটা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

ওটা ট্রাঙ্কের ভেতরেই রেখে দাও, বলল হ্যারি। যে আওয়াজ করছে আবার ওকে জাগিয়ে দেয়। প্রফেসর লুপিনের দিকে মাথা ঝাঁকাল ও।

ট্রেনের গতি কমে শুরু করল।

আমরা বোধহয় পৌঁছে গেছি, বাইরের ঘন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল রন।

ঘড়ি দেখল হারমিওন, না পৌঁছাতে পারি না, এখনও অনেক সময় বাকি।

তাহলে আমরা থামছি কেন?

হঠাৎ করেই যেন একটা ধাক্কা খেয়ে ট্রেনটা থেমে গেল। ওরা শুনতে পেলো দুদ্দাড় করে লাগেজগুলো পড়ছে ওপর থেকে। তারপর একসঙ্গে সবগুলো বাতি নিভে গেল পুরো ট্রেনটা ঝপ করে আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন।

আহ আমার পাটা মাড়িয়ে দিলে কে, নিশ্চয়ই তুমি রন, গুঙ্গিয়ে উঠল হারমিওন।

হাতড়ে হাতড়ে হ্যারি ফিরে গেলো ওর সিটে। দেখতে পেলো জানালার কাঁচটা মুছে নিয়ে রন বাইরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে, বাইরের দিগন্তের পটভূমিতে রনের কাঠামোটা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।

বাইরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে, বলল রন, আমার মনে হচ্ছে কেউ ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছে…

হঠাৎ করেই কামরার দরজাটা সশব্দে খুলে গেলো। কেউ একজন বিপদজনকভাবে হ্যারির পায়ের ওপর পড়ে গেলো।

দুঃখিত! অন্ধকারে নেভিলের গলা শুনতে পাওয়া গেলো। তোমরা বলতে পারো কি হচ্ছে?

অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে নেভিলের জমাটা ধরে হ্যারি ওকে তুলল, হ্যালো নেভিল!

কে? হ্যারি! কী হচ্ছে কী ওখানে? কোন ধারণাই নেই! বসো।

আমি যাচ্ছি, ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে আসি ব্যাপারটা কী? বলে হারমিওন হ্যারিকে পেরিয়ে দরজার দিকে এগোল। আবার দরজাটা খুলে গেলো এবং প্রায় একইসঙ্গে একটা ভোতা শব্দ আর দুটো যন্ত্রণাকাতর শব্দ শোনা গেলো।

কে?

কে?

জিনি?

হারমিওন?

অন্ধকারে বেরিয়েছ কেন?

আমি রনকে খুঁজছি

ভেতরে এসে বসো।

অন্ধকারে বসতে গিয়ে হ্যারির ওপরেই প্রায় বসতে গিয়েছিল জিনি, এখানে এখানে আমি হ্যারির গলা পেয়ে সরে বসতে গেলে, উফ নেভিলের কাতরোক্তি শোনা গেল।

আস্তে হঠাৎ একটা ভাঙ্গা গলার স্বর শোনা গেল।

মনে হচ্ছে প্রফেসর লুপিনের ঘুম ভেঙ্গেছে। ওর দিক থেকে হ্যারি নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না।

একটা মৃদু ঘর্ষণের শব্দ পাওয়া গেলো। প্রফেসর লুপিনের হাতে অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠল। ওর ক্লান্ত বুড়ো চেহারাটা আলোকিত হয়ে উঠল কিন্তু ওর চোখ দুটো খুবই সজাগ এবং সতর্ক।

যে যেখানে আছে ওখানেই থাকো, আবারো ভাঙ্গা গলায় বললেন প্রফেসর। হাতের আলো নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দরজাটা দিকে এগোচ্ছেন।

কিন্তু! প্রফেসর লুপিন দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই কামরার দরজাটা আবার খুলে গেলো।

প্রফেসর লুপিনের হাতের কম্পিত শিখায় ওরা সবাই দেখতে পেলো চাদর গায়ে বিরাট এক মূর্তি।

মাথা গিয়ে ঠেকেছে একবারে ছাদে।

মুখটা সম্পূর্ণ ঢাকা।

হ্যারির দৃষ্টি ওপর থেকে নিচে নামছে।

কাঁপা কাঁপা শিখার আলোয় হ্যারি যা দেখল তাতেই ওর গা শির শির করে উঠল।

চাদরের তলা থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে, হাতটা

হাতটা চকচক করছে, ছাই রঙের, চিকন এবং হাতে ক্ষত রয়েছে মামড়ির, যেন মরা একটা হাত পানিতে বহুদিন থাকার পর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে…

এক মুহূর্তের জন্যে! শুধুমাত্র এক মুহূর্তের জন্যে হাতটা দেখতে পেলো হ্যারি। যেন চাদর পড়া জীবটা হ্যারির দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরেই হাতটা চাদরের তলায় টেনে নিল।

এবং তারপর!

তারপর মুখ ঢাকা জীবটা ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস নিজের ভেতরে টেনে নিল যেন নিঃশ্বাসের চেয়েও বেশিকিছু সে টেনে নিতে চাচ্ছে চারপাশ থেকে।

ওদের সবার ওপর দিয়েই তীব্র একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হ্যারি টের পেলো ওর নিজের শ্বাস আটকে গেছে বুকে! ঠাণ্ডাটা ওর চামড়া ভেদ করে একবারে ভেতরে চলে গেছে। একেবারে গভীরে ওর হার্টের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে..

ওর চোখ কপালে উঠে গেলো। ও আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

ঠাণ্ডায় একেবারে ঠাণ্ডায় যেন সে ডুবে যাচ্ছে।

ওর কানে ভেতর রাশি রাশি পানির গর্জন!

ওকে কেউ নিচের দিকে টানছে!

পানির গর্জনটা বাড়ছে…!

অনেক অনেক দূর থেকে চিৎকার শুনতে পেলো হ্যারি। ভয়াবহ, ভীত চিৎকার, ওকে কেউ যেন সাহায্যে করার জন্যে ডাকছে!

যেই হোক হ্যারি সাহায্য করতে চাইল। হাতটা নাড়াতে চাইল হ্যারি। পারছে। হ্যারি ওর হাত নাড়াতে পারছে না…!

একটা ঘন সাদা কুয়াশা ওর চারদিকে ঘুরছে! কেবলই ঘুরছে…

ওর ভেতরে ঘুরছে।

হ্যারি! হ্যারি! তুমি ঠিক আছে তো?

কেউ তার মুখে চাপর মারছে।

কী হয়েছে? হ্যারি চোখ খুলেছে।

ওর ওপরে বাতি জ্বলছে। মেঝেটা কাঁপছে হোগার্টস এক্সপ্রেস আবার চলতে শুরু করেছে, বাতিও ফিরে এসেছে। কামরার মেঝেতে কেন ছিটকে পড়ল? রন আর হারমিওন ওর পাশে হাঁটু গেড়ে আছে। ওদের ওপর দিয়ে নেভিল এবং প্রফেসর লুপিন ওকে দেখছে। অসুস্থ লাগছে নিজেকে। চোখের চশমাটা ঠিক করতে গিয়ে দেখলো সারা মুখ ঠাণ্ডা ঘামে জবজবে হয়ে গেছে!

রন এবং হারমিওন মিলে ওকে ওর আসনে টেনে তুলল।

তুমি ঠিক আছো? ওকে জিজ্ঞাসা করল নার্ভাস রন।

হু ঠিক, বলতে বলতে দরজাটার দিকে তাকালো হ্যারি। মুখ ঢাকা মূর্তিটা নেই। গায়েব হয়ে গেছে। কি হয়েছে? ওই ওইটা কোথায়? ওই যে–কে চিৎকার করছিল?

কই কেউ তো চিৎকার করেনি, রন আরো নার্ভাস।

আলোকোজ্জল কামরাটার চারদিকে ভালো করে দেখল হ্যারি। ওইতো জিনি আর নেভিল বসে আছে, দুইজনই ওর দিকে আছে, দুজনকেই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

কিন্তু আমি তো স্পষ্ট শুনলাম চিৎকার

খটাস করে একটা শব্দ হলো। ওরা সবাই একেবারে লাফিয়ে উঠল। প্রফেসর লুপিন বড়সড় একটা চকলেট ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করছেন।

নাও, হ্যারির দিকে সবচেয়ে বড় টুকরোটা বাড়িয়ে ধরে বললেন। খেয়ে নাও ভালো লাগবে।

ওটা কী ছিল? লুপিনকে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

ডিমেন্টার, অন্যদের চকলেট দিতে দিতে বললেন প্রফেসর।আজকাবানের একটা ডিমেন্টার।

সকলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিস্ফোরিত নেত্রে সবাই তাকিয়ে রইল প্রফেসরের দিকে। চকলেট র‍্যাপারটা দলা পাকিয়ে পকেটে ভরলেন প্রফেসর।

খাও, আবার বললেন। কাজে দেবে। ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করতে হবে আমি আসছি… কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।

তুমি কী সত্যিই ঠিক আছে হ্যারি? ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল উত্তষ্ঠিত হারমিওন।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না… কী যে ঘটেছিল? মুখ থেকে আরো ঘাম মুছে বলল হ্যারি।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না কী যে ঘটেছিল? মুখ থেকে আরো ঘাম মুছে বলল হ্যারি।

ওই যে ডিমেন্টার না কি যেন, ওইটা ওখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল (মানে আমার মনে হচ্ছে যে ওটা চারদিকেই তাকাচ্ছিল কিন্তু আমি তো ওটার মুখ দেখতে পাইনি) এবং তুমি মানে তুমি।

আমার মনে হচ্ছিল তুমি যেন জ্ঞান হারাচ্ছ। বলল রন। ওকে এখনও ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। হঠাৎ তুমি যেন কাঠের মতো শক্ত হয়ে সিট থেকে মেঝেতে পড়ে গেলে। তোমার সারা শরীরের তখন খিচুনি দেখে কে!

প্রফেসর লুপিন তোমাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। ওর যাদুর কাঠিটা বের করে নিয়ে দরজা লক্ষ্য করে ডিমেন্টার না কি যেন ওটার দিকে এগিয়ে গেলেন, বলল হারমিওন। আর বললেন যাও, আমরা কেউই কাপড়ের নিচে সাইরাস ব্ল্যাককে লুকিয়ে রাখিনি, যাও। তবুও ওটা যাচ্ছে না দেখে বিড় বিড় করে কিছু বললেন প্রফেসর, তখন ওর যাদুকাঠি থেকে রূপালি কি একটা বেরিয়ে উম্মাদটার দিকে ছুটে গেলো। তখন ওটা ঘুরে যেন হাওয়ায় উড়ে চলে গেল…

ভয়াবহ একটা ব্যাপার। তোমাদের মনে আছে ওটা যখন দরজায় এলো কামরাটা কীরকম ভয়ংকর রকমের ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল? স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু গলায় বলল নেভিল।

আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা এত অস্বাভাবিক লাগছে যে মনে হচ্ছে আর কোনদিনই আমি নিজে স্বাভাবিক হতে পারবো না… বলল রন।

জিনি জড়সড় হয়ে বসে আছে এক কোণায়। ধাক্কাটা ওর হ্যারির চেয়ে কম লাগেনি। ফঁপিয়ে কেঁদে উঠল। হারমিওন এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল।

কিন্তু তোমরা কেউ কি তোমাদের সিট থেকে পড়ে গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল হ্যারি।

না, রনের জবাব, হ্যারির দিকে উদ্বেগের সঙ্গে তাকাল সে। অবশ্য জিনি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কাঁপছিল…

হ্যারি কিছুই বুঝতে পারছে না। ওর কাছে সবকিছুই ঘোলাটে মনে হচ্ছে। দুর্বল লাগছে, শীত শীত করছে যেন ফুর আক্রমণ থেকে উঠে এসেছে এই মাত্র। মনে মনে লজ্জাও পেল হ্যারি। সে কেন এমন ভেঙ্গে পড়ছে যখন আর কেউ এত বিপর্যস্ত হয়নি?

ফিরে এসেছেন প্রফেসর লুপিন। কামরায় ঢোকার আগে যেন একটু দম নিলেন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। চারদিক তাকিয়ে বললেন, ও চকলেটটায় কিন্তু বিষ মেশানো নেই। 

প্রফেসর ঘরে ঢোকা পর্যন্ত সবার হাতের চকলেট হাতেই ধরা ছিল। প্রথমে হ্যারি কামড় দিয়ে এক টুকরা মুখে পুরলো। আশ্চর্যের ব্যাপার আঙুলের ডগায় উষ্ণতা ফিরে পেলো ও।

দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা হোগার্টস-এ পৌঁছে যাবো, বললেন প্রফেসর লুপিন। হ্যারি, ভালো বোধ করছ তো?

হ্যারি জিজ্ঞাসা করল না, প্রফেসর তার নাম জানলেন কিভাবে।

ভালো, বিড় বিড় করে বলল সে, ব্ৰিতও বোধ করছে একটু।

যাত্রার বাকি সময়টা আর খুব বেশি কথা হলো না। অবশেষে ট্রেন থামল হগসমিড স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামার জন্য বিরাট একটা হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল; পেঁচার ডাক, বিড়ালের মিয়াও এবং টুপির নিচে থেকে নেভিলের পোষা ব্যাঙের ডাক, সব মিলিয়ে বিরাট একটা হৈ চৈ। প্লাটফর্মে ভীষণ ঠাণ্ডা; বৃষ্টি পড়ছে যেন বরফের ছুরি।

প্রথম বর্ষ এই দিকে! পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে হ্যাগ্রিডের দৈত্যাকার কাঠামোটাকে দেখতে পেলো ওরা প্লাটফরমের অন্য প্রান্ত থেকে, ডাকছে ভীত–সন্ত্রস্ত নতুন ছাত্রদের লেক-এর ওপর দিয়ে ওদের ঐতিহ্যবাহী যাত্রার জন্যে।

এই যে তোমরা তিনজন? সকলের মাথার ওপর দিয়ে চিৎকার করে উঠল হ্যাগ্রিড। হাত নাড়ল ওরা, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেল না। চারদিকের মানুষের চাপ ওদের ঠেলে নিয়ে গেল প্লাটফরমের আরেক দিকে। অন্য ছাত্রদের অনুসরণ করে উঁচু নিচু মাটির রাস্তায় উঠে এলো হ্যারি, রন আর হারমিওন। কমপক্ষে একশো ঘোড়ার গাড়ী অপেক্ষা করছে ওখানে। হ্যারির ধারণা ওগুলো টেনে নিয়ে যায় অদৃশ্য সব ঘোড়া, কারণ ওরা যখন ভেতরে চেপে বসে দরজা বন্ধ করল, নিজে নিজেই চলতে শুরু করল ঘোড়ার গাড়ীটা, লাফিয়ে উঠল এবড়ো খেবড়ো রাস্তায়।

গাড়ির মধ্যে খড় এবং ছাতা পড়ার স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ পাচ্ছে সে সামান্য। চকলেটটা খাওয়ার পর থেকে ওর ভালোই বোধ হচ্ছে, কিন্তু এখনও দূর্বল লাগছে। রন আর হারমিওন আড়চোখে দেখছে ওকে, যেন ভয় পাচ্ছে আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে সে।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল চমৎকার এক লোহার গেটের দিকে গাড়িটা এগোচ্ছে। হ্যারি দেখল গেটের দুপাশে পাখাওয়ালা শূকর মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের দুটো পিলার। আরো দেখল দুদিকে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে ওগুলোর চেয়ে দীর্ঘ দুজন ডিমেন্টর। আবার একটা অসুস্থ শীতল অনুভূতি যেন ওকে গ্রাস করতে উদ্যত হলো। সীটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেলল হ্যারি, চোখ বন্ধ করেই গেটটা অতিক্রম করল। দীর্ঘ ঢালু সড়কটায় গাড়ির গতি বেড়ে গেল; ছোট্ট জানালাটা দিয়ে মুখ বের করে হারমিওন দেখল প্রাসাদশৃঙ্গ আর টাওয়ার গুলো ক্রমশ কাছে চলে আসছে। অবশেষে একটা দোল খেয়ে থামল ঘোড়ার গাড়িটা, হারমিওন আর রন নামল।

হ্যারি যখন নামছে তখন শুনল কে যেন টেনে টেনে বলছে, তুমি কি জ্ঞান হারিয়েছিলে পটার? লংবটম কি সত্য কথাই বলছে? সত্যিই তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে?

হারমিওনকে কনুই দিয়ে সরিয়ে পাথরের ধাপের ওপর হ্যারির পথ আঁটকে দাঁড়াল ম্যালফয়, খুশিতে ঠিকরে পড়া ওর নিস্প্রভ চোখ দুটো বিতৃষ্ণায় চক চক করছে।

দাঁতে দাঁত চেপে রন বলল, সরে দাঁড়াও ম্যালফয়।

তুমিও কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে উইজলি? জোরে জোরে কথা বলছে ম্যালফয়। ডিমেন্টরটা কি তোমাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল?

কোন সমস্যা? শান্ত একটি স্বর শোনা গেল। পরের গাড়িটা থেকে এইমাত্র নামলেন প্রফেসর লুপিন।

প্রফেসরের দিকে একটা বেয়াড়া দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল ম্যালফয়, ওর দৃষ্টি ঘুরে গেল প্রফেসরের পোশাকের তালি দেয়ায় দুমড়ানো পুরনো স্যুটটার দিকে। স্বরে সামান্য বিদ্রূপ মেখে বলল সে,ওহ, না, না–মানে–কিছু না প্রফেসর। ক্র্যাব আর গোয়েলের দিকে তাকিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে ওদের নিয়ে প্রাসাদের দিকে উঠে গেল সে।

পেছন থেকে রনকে গুতো দিল হারমিওন দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য, ওরা তিনজন অন্য সকলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাথরের ধাপগুলো বেয়ে উঠতে শুরু করল। সামনের বিশাল ওক–কাঠের দরজার ভেতর দিয়ে প্রথম বড় হলটায় এলো ওরা, জ্বলন্ত মশালের আলোয় পুরো হলটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। অনেকগুলো গুহা রয়েছে হলে, আরো রয়েছে ওপর তলায় যাওয়ার মার্বেল সিঁড়িটা।

ডান দিকের দরজাটা গ্রেট হলে যাওয়ার; সকলের পিছু পিছু হ্যারি ওই দরজাটার দিকে এগোলো, জাদু করা আর সিলিংটায় মাত্র চোখ পড়েছে, কালো মেঘাচ্ছন্ন; এমন সময় শুনতে পেলো পটার! গ্রেঞ্জার! আমার সঙ্গে দেখা করো দুজনই!

হ্যারি আর হারমিওন ঘুরে দাঁড়াল, অবাক। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, ট্রান্সফিগিউরেশন টিচার এবং গ্রিফিন্ডর হাউজের প্রধান, ডাকছেন ওদের। কঠোর মুখো ডাইনী একজন, টান করে চুল বাধা; চশমার চৌকো ফ্রেমের মধ্যে বসানো তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখ। ভিড় ঠেলে হ্যারি এগিয়ে গেল ওঁর দিকে, বুক কাঁপছে আশংকায়। প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে দেখলেই কোথায় আমি যেন একটা ভুল করেছি এমন একটা অনুভূতি হয় হ্যারির।

অত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, আমার অফিসে শুধু তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই, ওদেরকে আশ্বস্ত করলেন প্রফেসর। তুমি এগিয়ে যাও উইজলি।

প্রফেসর ম্যাকগোনাল হ্যারি আর হারমিওনকে ভীড় থেকে বের করে নিয়ে গেলেন, তাকিয়ে রইল রন। ওরা ওঁর সঙ্গে বাইরের হলটা পেরিয়ে, মার্বেল পাথরের সিঁড়িটা বেয়ে উপরে উঠে করিডোর ধরে এগিয়ে গেল।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের অফিস ঘরটা ছোট্ট, ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। ওদেরকে বসবার জন্যে ইশারা করলেন প্রফেসর। ডেস্কের পেছনে বসে হঠাৎ করেই যেন বললেন, তোমরা আসার আগেই প্রফেসর লুপিন পেঁচা পাঠিয়ে সব খবর দিয়েছেন, ট্রেনে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে, পটার।

হ্যারি জবাব দেয়ার আগেই, আস্তে টোকা পড়ল দরজায়, এবং হাসপাতালের ট্রেন ম্যাডাম পমফ্রে সজোরে প্রবেশ করল ভেতরে।

হ্যারির মনে হলো ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে। ও যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সেটাই যথেষ্ট খারাপ হয়েছে, এখন আবার সবাই ঘটনাটা নিয়ে যেভাবে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে সেটা আরো খারাপ।

আমি ভালো আছি, বলল সে। আমার কোন কিছুর দরকার নেই

ওহ, তাহলে তুমিই, তাই কী? ওর কথাটা গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে বললেন ম্যাডাম পমফ্রে। (ওকে আরো ভালো করে দেখবার জন্যে সামনের দিকে ঝুঁকলেন। মনে হয় আবারো কোন ভয়ংকর কিছু করেছ?

একটা ডিমেন্টার এর কারণ পপি, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

ওদের মধ্যে ক্ষুব্দ দৃষ্টি বিনিময় হলো। ম্যাডাম পমফ্রে ব্যাপারটা পছন্দ করল না।

স্কুলের চারদিকে ডিমেন্টার বসানো, বিড় বিড় করে বললেন ম্যাডাম পমফ্রে, হ্যারির চুল সরিয়ে কপালটা পরীক্ষা করছেন তিনি। ওই প্রথম অজ্ঞান হয়নি ওই পিশাচগুলোকে (ডিমেন্টার) দেখে। ইস শরীর একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ভয়াবহ। ওই ওরা ওই ডিমেন্টরগুলো! যারা এমনিতেই নাজুক, দুর্বল, ওদের ওপর এই হতভাগাগুলোর যে আছর হয়

আমি নাজুক নই! ক্ষুব্ধ কণ্ঠে হ্যারি বলল।

অবশ্যই তুমি নও, বললেন মাদাম পমফ্রে অন্যমনস্কভাবে, ওর পালস দেখছেন তিনি।

ওর কী দরকার? শুষ্ক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। বিশ্রাম? অথবা আজ রাতে হাসপাতালেও থাকতে পারে?

আমি ভালোই আছি! লাফিয়ে উঠে বলল হ্যারি। ও হাসপাতালে যাচ্ছে শুনে ড্র্যাকো ম্যালফয় কি বলতে পারে এই ভাবনাটাই ওর জন্যে একটা নির্যাতন।

বেশ, নিদেনপক্ষে ওর কয়েকটা চকলেট খাওয়াই উচিৎ, বললেন মাদাম পমফ্রে, হ্যারির চোখ দুটো ভালো করে দেখার চেষ্টা করছেন এখন তিনি।

এরই মধ্যে আমি কয়েকটি খেয়েছি, বলল হ্যারি। প্রফেসর লুপিন দিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে।

দিয়েছিলেন? অনুমোদনের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন মাদাম পমফ্রে। তাহলে অবশেষে আমরা ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস-এর এমন একজন শিক্ষক পেলাম যিনি তার বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিকারগুলোও জানেন।

তুমি ঠিক বলছ তো পটার, ঠিক আছো? তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা করলে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

হ্যাঁ, বলল হ্যারি।

ঠিক আছে। একটু বাইরে অপেক্ষা করো, ততক্ষণে মিস গ্রেঞ্জারের সঙ্গে ওর রুটিন সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে নিই, তারপর একসঙ্গে যাওয়া যাবে রাতের খাওয়া খাবার জন্যে।

মাদাম পমফ্রের সঙ্গে করিডোরে বেরিয়ে এলো হ্যারি। বিড় বিড় করতে করতে হাসপাতালের উদ্দেশে চলে গেলেন তিনি। কয়েক মিনিট পরই বেরিয়ে এলো হারমিওন, কোন একটা ব্যাপারে তাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে, ওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, তিনজন ওরা মার্বেল সিঁড়ি ধরে নিচতলায় নেমে এলো, গ্রেট হলে।

যেন সরু লম্বা কালো টুপির সমুদ্র; প্রত্যেকটি হাউজ–টেবিলের দুই দিকে বসেছে ছাত্ররা, হাজার মোমবাতির আলোয় চকচক করছে সকলের চেহারা। মোমবাতি গুলো ভাসছে বাতাসে ঠিক টেবিলগুলোর ওপরে। প্রফেসর ফ্লিটউইক, বেটেখাট জাদুকর, এক মাথা সাদা ধবধবে চুল, একটি প্রাচীন হ্যাট আর তেপায়া বের করে নিয়ে যাচ্ছেন হল থেকে।

ওহ, বলল হারমিওন আস্তে করে, আমরা বাছাইটা মিস করলাম।

বাছাই-হ্যাট! হোগার্টস-এর নতুন ছাত্রদেরকে যার যার হলের জন্য বাছাই করে দেয়। যে হলের জন্য সংশ্লিষ্ট ছাত্রটি উপযুক্ত (গ্রিফিন্ডর, র‍্যাভেনক্ল, হাফলপাফ অথবা স্লিথারিন) সেই হলের নাম সজোরে উচ্চারণ করে বাছাই–হ্যাট। তার জন্য সংরক্ষিত আসনটার দিকে হেঁটে গেলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, হ্যারি আর হারমিওন গেল অন্য দিকে গ্রিফিন্ডর টেবিলের উদ্দেশে। ওরা হলের পেছন দিকে হেঁটে যাচ্ছে নিঃশব্দে, সকলের চোখ ওদের দিকে, দু একজন আঙুল তুলে হ্যারিকে দেখাল। ডিমেন্টর দেখে ওর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা কী এত দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে?

সে আর হারমিওন রনের দুই পাশে বসল, ওদের জন্য যায়গা রেখেছিল সে।

কী জন্যে ডেকেছিল তোমাকে? চুপি চুপি ও জিজ্ঞাসা করল হ্যারিকে।

ওকে ব্যাপারটা খুলেই বলতে শুরু করেছিল হ্যারি, ঠিক সেই সময় স্বয়ং হেডমাস্টার উঠে দাঁড়ালেন, ওদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবার জন্যে। থেমে গেল সে।

প্রফেসর ডাম্বলডোর, যদিও অনেক বয়স্ক, তবুও তাকে দেখলে মনে হয়, যেন প্রচুর প্রাণশক্তি রয়েছে তার মধ্যে। কয়েক ফুট লম্বা সাদা চুল আর দাড়ি, অর্ধ চন্দ্রাকৃতি চশমা এবং খুবই বাকা নাক। প্রায়ই বলা হয় তিনি হচ্ছেন যুগের সবচেয়ে বড় জাদুকর। অবশ্য শুধু সেই জন্যেই হ্যারি যে তাকে শ্রদ্ধা করে, তা নয়। আসলে অ্যালবাম ডাম্বলডোরের ওপর আস্থা না রেখে পারা যায় না। ছাত্রদের দিকে তাকে উদ্ভাসিত হাসি নিয়ে তাকাতে দেখে, ট্রেনের কামরায় ডিমেন্টারটাকে দেখবার পর এই প্রথমবারের মতো সত্যিই নিরাপদ বোধ করল হ্যারি।

স্বাগতম! বললেন ডাম্বলডোর, মোমের আলোটা কাঁপছে ওঁর দাড়িতে পড়ে। হোগার্টস-এ আরেক বছরের জন্য স্বাগতম! তোমাদেরকে আমাদের কিছু কথা বলবার আছে, এবং এর মধ্যে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমার মনে হয় আমাদের অতি চমৎকার ভূরিভোজের আগেই সেটা বলে নেয়া ভালো।

গলা পরিষ্কার করে বলে যেতে লাগলেন ডাম্বলডোর, হোগার্টস এক্সপ্রেস-এ ওদের খোঁজাখুঁজির পর তোমরা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছ আমাদের স্কুলেও এখন কয়েকজন ডিমেন্টর রয়েছে, ওরা এখানে ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

থামলেন তিনি, হ্যারির মনে পড়ল মিস্টার উইজলি বলেছিলেন, ডিমেন্টররা স্কুল পাহারা দিচ্ছে, ব্যাপারটা তার পছন্দ নয়।

মাঠে যাওয়ার সব কয়টি প্রবেশ পথে ওরা রয়েছে, বলে চলেছেন ডাম্বলডোর, এবং যতদিন ওরা এখানে থাকছে, তোমাদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার করে বলছি, অনুমতি ছাড়া কেউই স্কুল ছেড়ে যাবে না। ছদ্মবেশ ধরে কৌশল করে ডিমেন্টরদের বোকা বানানো যায় না–অথবা অদৃশ্য হওয়ার জামা পড়েও নয়। সোজা সাপ্টা বললেন তিনি, দৃষ্টি বিনিময় করল হ্যারি আর রন। কোন অজুহাত বা অনুরোধ উপরোধ বোঝা ডিমেন্টরদের স্বভাবে নেই। সুতরাং আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি, তোমাদের ক্ষতি করবার মতো কোন কারণ ওদের জন্য তৈরি করবে না। আমি প্রিফেক্ট, নতুন হেড–বয় এবং হেড–গার্লদের উপর নির্ভর করছি যেন ওরা নিশ্চিত করে, কোন ছাত্র ভুল করেও যেন কোনভাবে ডিমেন্টরদের সঙ্গে জড়িয়ে না যায়।

পার্সি বসেছিল হ্যারি থেকে কয়েক আসন দূরে, এবার বুক ফুলিয়ে বসল সে, চারদিক তাকাল একটা ভাব নিয়ে। থামলেন ডাম্বলডোর; চারদিকে তাকালেন গম্ভীরভাবে, কেউ কোন শব্দ করছে না, নড়ছেও না কেউ।

আর খুশির খবর হলো, বলছেন ডাম্বলডোর, এ বছর আমাদের মধ্যে আরো দুজন নতুন শিক্ষককে স্বাগত জানাতে পেরে আমি আনন্দিত।

প্রথমে, প্রফেসর লুপিন, যিনি, ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস-এর শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণে সদয় হয়েছেন।

এলোমেলো কয়েকটা করতালি শোনা গেল, কিন্তু কোন উৎসাহ দেখা গেল না। শুধু, যারা ট্রেনে প্রফেসর লুপিনের সঙ্গে এক কামরায় ছিলেন তারাই জোরে জোরে তালি দিল, তার মধ্যে হ্যারিও রয়েছে। শিক্ষকরা সব তাদের সবচেয়ে ভাল পোশাক পড়ে রয়েছে, প্রফেসর লুপিনকে এদের মধ্যে সত্যিই মলিন এবং বেমানান দেখাচ্ছিল।

স্নেইপের দিকে দেখো, হ্যারির কানে কানে বলল রন।

প্রফেসর স্নেইপ, পোশন টিচার, স্টাফ টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে অপলক তাকিয়ে রয়েছেন প্রফেসর লুপিনের দিকে। সবাই জানে, প্রফেসর স্নেইপই এই বিষয়টা পড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হ্যারি স্নেইপকে রীতিমত ঘৃণা করে, সেও স্নেইপের সরু ফ্যাকাশে মুখের অভিব্যক্তির তাকিয়ে দিকে বিস্ময়ে ভয়ে হতবাক হয়ে গেল। রাগের চেয়ে বেশি ঘৃণা যেন ফুটে উঠেছে ওর চেহারায়। এই অভিব্যক্তি হ্যারির খুব চেনা, কারণ যতবার প্রফেসর স্নেইপ ওর দিকে তাকিয়েছেন ততবারই ওর চেহারায় এই ভাব দেখেছে সে।

আর আমাদের দ্বিতীয় নিয়োগের ব্যাপারে, কথা শেষ হয়নি প্রফেসর ডাম্বলডোরের, প্রফেসর লুপিনের জন্য করতালি থেমে গেছে, দুঃখের সঙ্গে তোমাদের জানাতে হচ্ছে প্রফেসর কেটলবার্ণ, আমাদের কেয়ার অফ ম্যাজিকাল ক্রিয়েচার্স বিষয়ের যিনি শিক্ষক ছিলেন, তিনি গত বছরের শেষে অবসরে চলে গেছেন, তার অবশিষ্ট হাত এবং পায়ের জন্যে আরো বেশি সময় দিতে চান তিনি। আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, তার যায়গাটি নিচ্ছেন, আর কেউ নয়, রুবিয়াস হ্যাগ্রিড, ওর পশু দেখাশোনার পাশাপাশি এই কাজটিও করতে সম্মত হয়েছে সে।

হ্যারি, রন আর হারমিওন তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে ওরা। তারপর যোগ দিল অন্যান্যদের সঙ্গে করতালিতে, এবং গ্রিফিন্ডর টেবিল থেকে সেটা সবচেয়ে জোরে শোনা গেল। সামনের দিকে ঝুঁকে হ্যাগ্রিডকে দেখার চেষ্টা করল হ্যারি, মুখ একেবারে চুণির মতো লাল হয়ে গেছে ওর, নিজের বিশাল দুই হাতের দিকে চেয়ে রয়েছে সে, কালো দাড়ির জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওর বিখ্যাত হাসিটা।

আমাদের বোঝা উচিৎ ছিল! চিৎকার করে উঠল রন, বইটা টেবিলের উপর সজোরে রেখে, ও ছাড়া আর কে আমাদেরকে কামড়াতে পারে এমন বই পাঠাবে?

হ্যারি, রন আর হারমিওনের করতালি সবার শেষে থামল, প্রফেসর ডাম্বলডোর আবার বলতে শুরু করলেন, ওরা দেখল টেবিল ক্লথের কোণা দিয়ে হ্যাগ্রিড ওর চোখের পানি মুছছে।

ঠিক আছে, আমার মনে হয় এটুকুই ছিল তোমাদের জানাবার মতো জরুরী কথা, বললেন ডাম্বলডোর। এবার ফিস্ট শুরু করা যাক।

ওদের সামনে রাখা সোনালী প্লেট আর পানপাত্রগুলো হঠাৎ করেই পূর্ণ হয়ে গেল। হ্যারিরও যেন বেশ ক্ষুধা পেয়ে গেল, হাতের কাছে যা যা পেল তাই মুখে পুরতে শুরু করল সে।

অপূর্ব সুস্বাদু খাবার সব; হাসি, গল্প, কথা এবং কাঁটা চামচ ও ছুরির শব্দে পুরো হল ঘরটা মুহূর্তের মধ্যেই মুখর হয়ে উঠল। হ্যারি, রন আর হ্যাগ্রিড তাড়াতাড়ি খাওয়া সারতে চাইছে যেন হ্যাগ্রিডের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়। ওরা জানে, ওকে যে শিক্ষক বানানো হয়েছে সেটা ওর কাছে কতখানি। হ্যাগ্রিড পূর্ণ জাদুকর নয়; থার্ড ইয়ারে পড়বার সময় ওকে হোগার্টস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, বের করে দেয়া হয়েছিল যে অপরাধের জন্যে সেটা ও করেইনি। গত বছর হ্যারি, রন আর হারমিওন মিলে সেই অভিযোগ থেকে হ্যাগ্রিডকে মুক্ত করেছিল। 

সোনালী পাত্র থেকে অবশেষে কদর কেক-এর শেষ দানাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডাম্বলডোর যখন বললেন এবার শুতে যাওয়ার সময় হয়েছে, তখন ওরা ওদের সুযোগ পেল।

অভিনন্দন, হ্যাগ্রিড! শিক্ষকদের টেবিলে পৌঁছতে পৌঁছতে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল হারমিওন।

এ সবই তোমাদের তিনজনের জন্য সম্ভব হয়েছে, চকচকে মুখটা ন্যাপকিনে মুছে নিয়ে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল ও। বিশ্বাস হয় না বিশাল হৃদয়ের মানুষ ডাম্বলডোর প্রফেসর কৌলবার্ণ অবসর নেয়ার কথা বলবার পর সোজা আমার কুড়েঘরে চলে এলেন… আমি আজীবন এটাই হতে চেয়েছিলাম

আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে, ন্যাপকিনে মুখ আড়াল করল।

প্রফেসর ম্যাকগোনাল ওদেরকে এরপর প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন যার যার হোস্টেলে।

স্রোতের মতো ওপরে উঠছে গ্রিফিন্ডররা মার্বেল পাথরের সিঁড়ি বেয়ে, করিডোর ধরে, ওপরে এবং আরো ওপরে, সিঁড়ে বেয়ে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ঢোকার গোপন প্রবেশ পথের দিকে ক্লান্ত হ্যারি, রন আর হারমিওন ওদের অনুসরণ করল। থামল এসে গোলাপী পোশাক পরা সুলকায় এক মহিলার বিশাল এক ছবির সামনে, ছবির ভেতর থেকে মহিলা ওদের জিজ্ঞাসা করল, পাসওয়ার্ড?

আসছি, আসছি! ভীড়ের পেছন থেকে চিৎকার করছে পার্সি। নতুন পাসওয়ার্ড হচ্ছে ফরচুনা মেজর!

ওহ! না, আবারও একটি নতুন পাসওয়ার্ড বলল নেভিল লংবটম বিষণ্ণভাবে। পাসওয়ার্ড মনে রাখতে ওর খুব অসুবিধা হয়।

ছবির ফুটোটার মধ্য দিয়ে কমন রুমের ভেতর গিয়ে, মেয়েরা এবং ছেলেরা আলাদা হয়ে গেল যার যার সিঁড়ির দিকে। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠছে হ্যারি, হোগার্টস-এ ফিরে আসার আনন্দ ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না সে এখন। পরিচিত বৃত্তাকার রুমটায় পৌঁছল ওরা, ঘরটার পাঁচটি ফোর–পোস্টার বিছানা যথাস্থানেই রয়েছে, চারদিকে তাকিয়ে হ্যারি ভাবল অবশেষে সে যেন বাড়ি ফিরে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *