০৪. দ্য লিকি কলড্রন

০৪. দ্য লিকি কলড্রন

অদ্ভুত এই স্বাধীনতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হ্যারির কয়েকদিন লেগে গেলো। এর আগে কখনই, কখনই সে নিজের ইচ্ছেমতো বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। অথবা যখন যা চেয়েছে তা খেতে পারেনি। এমনকি সে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারছে, অবশ্য যাওয়াটা যতক্ষণ ডায়াগন অ্যালির মধ্যে থাকছে এবং যেহেতু এই লম্বা সান বাঁধানো গলিটার মধ্যেই দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় যাদুর দোকানগুলো রয়েছে, হ্যারির কোন শখ নেই ফাজকে দেয়া কথার খেলাপ করে আবার মাগল জগতে ঘুরে বেড়াবার।

সকালের নাস্তাটা হ্যারি লিকি কলড্রনেই সারতে পছন্দ করত। নাস্তার টেবিলে অন্যান্যদের সাক্ষাৎ মিলতো। ও বেশ মজা করেই দেখতো অন্যদেরকে। ছোট ছোট সব ডাইনী গ্রাম থেকে এসেছে এক দুদিনের জন্য শপিং করতে। বুড়ো দুর্বল সব ডাইনী, ট্রান্সফিগুরেশন টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে তর্ক করছে। বন্য দেখতে সব যাদুকর। নাস্তা খাওয়ার পর পেছনের উঠোনে গিয়ে তার যাদু কাঠি দিয়ে ডাস্টবিনের বাঁ দিকের ওপরের ইটটায় আস্তে করে টোকা দিতেই দেয়ালের মধ্যে ডায়াগন অ্যালি যাওয়ার পথটা খুলে যেত। গ্রীষ্মের লম্বা রৌদ্রালোকিত দিনগুলি হ্যারি কাটিয়ে দিত দোকানগুলি ঘুরে ঘুরে। দোকানের বাইরে বসানো রংবেরং-এর বড় বড় ছাতার নিচে বসে। ওখানে নানাধরনের সব যাদুকর আর ডাইনীদের দেখা তো পাওয়া যেতই, এমনকি ওদের বিচিত্র সব কথাও শুনতে ওর ভালো লাগতো। এখন আর কম্বলের নিচে লুকিয়ে হ্যারিকে হোমওয়ার্ক করতে হচ্ছে না। ফ্লোরেন ফোরটেঙ্কুর আইসক্রীম পারলারের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বসে সে তার হোমওয়ার্ক করছে। এমনকি ফ্লোরেন ফোরটেস্কু, যে কিনা মধ্যযুগের ডাইনী পোড়ানো সম্পর্কে অনেককিছুই জানে, সে পর্যন্ত তাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করছে।

ইতোমধ্যে গ্রিংগটের লকারে রাখা অর্থ থেকে হ্যারি ওর সোনার গ্যালিয়ন, রূপার সিকলস এবং ব্রোঞ্জ নাটগুলো বের করে ফেলেছে। কিন্তু তাতে হয়েছে আর এক মুসিবত। নিজেকে ওর প্রচণ্ডভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে খরচের ব্যাপারে। বারবার ওর নিজেকে শাসাতে হচ্ছে আমাকে হোগার্টস-এ আরো পাঁচ বছর পড়ার খরচ যোগাতে হবে। বইয়ের জন্যে ডার্সলিদের কাছে হাত পাতাটা নিশ্চয়ই সুখকর কিছু হবে না। তবে লিকি কলড্রনে আসার এক সপ্তাহ পর তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরীক্ষা হয়ে গেলো, প্রিয় দোকান কোয়ালিটি কুইডিচ সাপ্লাইজ-এ। ভিড় দেখে একদিন হ্যারি ওই দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলো। সবাই কি যেন দেখছে। ভিড় ঠেলে গেল সামনে। চারদিকে সব উত্তেজিত যাদুকর আর ডাইনী। অস্ফুট মুগ্ধ উচ্চারণে সব প্রশংসা করছে। একেবারে সামনে গিয়ে হ্যারি দেখতে পেলো যে জিনিসটা শক্তিশালী চুম্বকের মতো প্রবলভাবে আকর্ষণ করে রেখেছে সকলকে। নতুন একটি স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করানো তার সারাজীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর বিস্ময়করভাবে সুন্দর, যাদুর ব্রুম।

চৌকো মুখো এক যাদুকর তার সাথীকে বললো, সবেমাত্র বেরিয়েছে… কিন্তু প্রোটোটাইপ…।

এটা দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী ব্রুম তাই না ড্যাড, বলল হ্যারির চেয়েও ছোট একটি ছেলে ওর বাবার হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে।

আইরিশ ইন্টারন্যাশনাল টিম এরকম সাতটি ব্রুমের অর্ডার দিয়েছে এবং এগুলো বিশ্বকাপের জন্যে হট ফেভারিট; ভিড়ের উদ্দেশ্যে বললো দোকানের মালিক। হ্যারির সামনে থেকে বিশালদেহী এক ডাইনী সরে গেলো। এতক্ষণে ও ব্রুমের পাশের নোটিশটা পড়তে পারছে:

দ্য ফায়ারবোল্ট
সর্বাধুনিক রেসিং ক্রম। ছাইয়ের তৈরি সুপার–ফাইন হাতল। আলাদা করে বাছাই করা প্রত্যেকটি বার্চ কাঠিকে এরোডায়নামিক্স উৎকর্ষতায় তৈরি করা হয়েছে যা ফায়ারবোল্টকে দিয়েছে অনতিক্রম্য ভারসাম্য এবং করেছে পিন পয়েন্ট নির্ভুল। ফায়ারবোল্ট মাত্র দশ সেকেন্ডের মধ্যে ঘণ্টায় ০–১৫০ মাইল গতি তুলতে পারে। এবং এর রয়েছে এমন ব্রেক সিসটেম যা মুগ্ধ না করে পারেই না। মূল্য অনুরোধে।

মূল্য অনুরোধে কতটা সোনার মুদ্রা লাগবে ফায়ারবোল্টর জন্যে হ্যারি ভাবতেও চায় না। সারাজীবনে হ্যারি বোধহয় এমন করে আর কিছু চায়নি। আবার তার নিম্বাস দুই হাজার ক্রম দিয়ে একটিও কুইডিচ ম্যাচ হারেনি সে, তার অমন একটি ব্রুম থাকতে গ্রিংগট থেকে তোলা টাকাপয়সা শেষ করার কোন মানে হয় না। হ্যারি আর দাম জিজ্ঞাসা করল না, কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই ঘুরে ফিরে যেত ফায়ারবোল্টকে দেখতে। তবে কিছু কিছু জিনিস যে তাকে কিনতে হয়নি তা নয়। স্কুলের পোশাক বানাতে হয়েছে আগেরটা ছিঁড়ে যাওয়ায়। ইস্কুলের বইও কিনতে হয়েছে। এর মধ্যে নতুন দুটি বিষয়ের বইও রয়েছে–ম্যাজিক্যাল জীবের যত্ন এবং ডিভাইনেশন-এর ওপর।

বইয়ের দোকানের কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে হ্যারি অবাকই হলো। বড় বড় সাইজের স্পেল বুক (যাদু টোনার বই)-এর বদলে কাঁচের ওপারে লোহার একটি বড়সড় খাঁচা দেখতে পেলো। খাঁচার মধ্যে দি মনস্টার বুক অফ মনস্টারস-এর একশ কপি রয়েছে। খাঁচার ভেতরে বইয়ের ঘেঁড়া পাতা এদিক ওদিক উড়ছে, বইগুলো একটা আরেকটার সাথে ঝাপটাঝাঁপটি করছে যেন মল্লযুদ্ধ করছে এবং একটা আরেকটাকে ছিঁড়ছে।

হ্যারি ওর বুক লিস্ট বের করে মিলিয়ে নিল। লিস্টে দি মনস্টার বুক অফ মনস্টারস রয়েছে ম্যাচিক্যাল জীবের যত্ন বিষয়ক সেট বই হিসেবে।

হ্যারি ফ্লারিশ অ্যান্ড ব্লটস-এ ঢুকলো, হন্তদন্ত হয়ে ম্যানেজার ছুটে এলো। বলল, হোগার্টস-এর নতুন বই লাগবে?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি, আমার দরকার…

সরে দাঁড়াও, বলল ম্যানেজার অস্থিরভাবে, হ্যারিকে একপাশে সরিয়ে দিল। একজোড়া খুবই পুরু গ্লাভস বের করে হাতে পরলো, একটা বড় গোল মাথা লাঠি হাতে নিয়ে মনস্টার বুক খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল।

দাঁড়াও, বলল হ্যারি, আমার আছে ওর একটা।

তোমার আছে? ম্যানেজার যেন বেঁচে গেলো, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এ নিয়ে সকাল থেকে পাঁচবার আক্রান্ত হয়েছি।

কোন কিছু ভেঁড়ার জোর একটা শব্দ শোনা গেলো। দুইটা মনস্টার বুক মিলে একটাকে চেপে ধরে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করছে। ওরই আওয়াজ।

আরে থাম! থাম! চেঁচিয়ে উঠল ম্যানেজার। হাতের লাঠিটা খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বইগুলোকে বিচ্ছিন্ন করল। আমি আর এ বই রাখছি না। কখনও না। আমার মনে হয়েছিল যখন আমরা ইনভিজিবল বুক অফ ইনভিজিবিলিটি কিনে রেখেছিলাম সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে খারাপ সময়। লাখ লাখ টাকা দাম অথচ লাভ তো দূরের কথা দামই উঠে আসেনি। মানে আর কোন বইয়ের দরকার আছে তোমার?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি ওর বুক লিস্টের দিকে চোখ রেখে। ক্যাসান্দ্রা ভাব্লাতস্কির ভবিষ্যতকে কুয়াশা মুক্তকরণ বইটা দরকার।

হু ডিভাইনেশন শুরু করছ, বলল ম্যানেজার। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে হ্যারিকে দোকানের পেছন দিকে নিয়ে গেলো। বইয়ের একটা কর্ণার রয়েছে সেখানে ভাগ্য গণনার ওপর। ছোট একটা টেবিলের ওপর অনিশ্চয়তা সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী, ভাগ্য যখন বিরুদ্ধে যায়: অভিঘাত এবং ভাঙ্গা বল থেকে নিজেকে রক্ষাকরণ জাতীয় বই স্তূপ করা আছে।

মোটা একটা কালো বাইন্ডিং করা বই নামিয়ে ম্যানেজার বলল, এই যে বইটা। ভবিষ্যতবাণী করার সব ধরনের উপায়–হাত দেখা, ক্রিস্টাল বল, পাখি দিয়ে ভবিষ্যৎ পড়ানো সম্পর্কে মৌলিক গাইড…।

কিন্তু হ্যারি শুনছিল না। ওর চোখ তখন আরেকটি বইয়ের ওপর পড়েছে: মৃত্যুর লক্ষণ–যখন জানো সবচেয়ে খারাপটাই আসছে তখন কি করতে হবে।

তোমার জায়গায় আমি হলে কিছুতেই ও বই পড়তাম না। হ্যারির চোখ অনুসরণ করে ম্যানেজার বলল। চারিদিকেই তুমি মৃত্যুর লক্ষণ দেখতে পাবে। তোমাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যে ওই একটা বইই যথেষ্ট।

কিন্তু তখনও হ্যারি তাকিয়ে রয়েছে বইটার কভারের দিকে। কভারে রয়েছে ভালুকের সমান একটা বিশাল আকৃতির কুকুর, চোখ দুটো চকচক করছে। অবিশ্বাস্য হলেও ছবিটা পরিচিত মনে হচ্ছে…

ম্যানেজার ওর হাতের বইটা হ্যারির হাতে গুঁজে দেয়ার চেষ্টা করল।

আর কিছু চাই? একটু জোর দিয়েই জিজ্ঞাসা করল ম্যানেজার।

হা, জোর করে নিজের চোখ দুটোকে প্রচ্ছদের কুকুরটার ওপর থেকে সরিয়ে হাতে ধরা বুকলিস্টের দিকে তাকিয়ে বলল হ্যারি, আরো দরকার ইন্টারমিডিয়েট ট্রান্সফিগিউরেশন এবং স্ট্যান্ডার্ড বুক অফ স্পেস গ্রেড থ্রি।

মিনিট দশেক পর ফ্লারিশ এন্ড ব্লটস থেকে বের হলো হ্যারি বগলের নিচে বই নিয়ে। বিমনা অন্যমনস্ক হ্যারি হাটছে লিকি কলড্রনের দিকে কিন্তু যেন উদ্দেশ্যহীন, এর ওর সাথে ধাক্কা খাচ্ছে।

দোতলায় নিজের রুমে ঢুকে বিছানার ওপর বইগুলো ছুঁড়ে ফেলল সে। ঘর গোছানোর জন্যে কেউ একজন এসেছিল। ঘরটা বেশ গোছানো। জানালাটা খোলা এবং সূর্য যেন আলো একেবারে ঢেলে দিচ্ছে জানালা দিয়ে।

বেসিনের উপর আয়নাটায় নিজেকে দেখল হ্যারি।

এটা নিশ্চয়ই মৃত্যুর কোন লক্ষণ হতে পারে না, আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বলল হ্যারি, কিন্তু ম্যাগনোলিয়া ক্রিসেন্টে ওটা দেখে আমি আতংকিত হয়ে পড়েছি কেন? ওটা নেড়ে কুকুর ছাড়া আর কিছুই না।

হাত তুলে মাথার চুলগুলো সমান করতে চাইল হ্যারি।

হিস হিস করে আয়নাটা বলল, হেরে যাওয়া লড়াই লড়ছ তুমি।

***

একটি দুটি করে দিন যেতে লাগল। হ্যারি খুঁজছে রন বা হারমিওনকে। স্কুল খোলার সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই হোগার্টস-এর এর ছাত্ররা ডায়াগন অ্যালিতে আসছে। এরই মধ্যে ওর সঙ্গে সিমাস ফিনিগান এবং পিন থমাস-এর দেখা হয়েছে। ফ্লারিশ অ্যান্ড ব্লটস-এর বাইরে দেখা হয়েছে মন ভোলা গোল মুখো আসল নেভিল লংবটম-এর সঙ্গে। ও ওর বুক লিস্ট হারিয়ে ফেলেছে। জাঁদরেল দাদীর কাছে এর জন্যে বকুনিও খেয়েছে নেভিল। হ্যারি ভাবছে নেভিলের দাদী যেন জানতে না পারে যে ম্যাজিক মিনিস্ট্রির কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ও নেভিল সেজেছিল।

ছুটির শেষ দিনে ঘুম ভাঙ্গার পর হ্যারির প্রথম ভাবনা ছিল কাল হোগার্টস এক্সপ্রেস-এ রন এবং হারমিওনের সঙ্গে দেখা হবে। ঘুম থেকে উঠে কাপড়চোপড় পড়ে বেরিয়ে এলো ফায়ারবোল্টটাকে একবার শেষ দেখা দেখবার জন্যে। ঘুরে ফিরে দেখল। ভাবছে কোথায় লাঞ্চ করা যায়। এমন সময় শুনতে পেলো কারা যেন তার নাম ধরে চিৎকার করছে:

হ্যারি! হ্যারি

ঘুরে ওদের দেখতে পেলো সে। রন আর হারমিওন, দুইজন বসে আছে ফ্লোরিন ফোর্টেঙ্কুর আইসক্রীম পারলারের বাইরে।

অবশেষে তোমাকে পাওয়া গেলো। কোথায় কোথায় না তোমাকে খুঁজেছি বলল রন। লিকি কলড্রনে গেলাম, বলল বেরিয়ে গেছে। গেলাম ফ্লারিশ অ্যান্ড ব্লটস-এ, তারপর মাডাম মালকিন্স-এ আর…

স্কুলের সব জিনিস গত সপ্তাহেই কিনে ফেলেছি, বলল হ্যারি। কিন্তু তোমরা কি করে জানো আমি লিকি কলড্রনে রয়েছি?

বাবা বলেছেন, বলল রন।

মিস্টার উইজলি ম্যাজিক মিনস্ট্রিতে চাকরি করেন। তিনি জানবেন পুরো ঘটনা এবং এও জানবেন ওর হাতে পড়ে মার্জ আন্টির যে দশা হয়েছে তার কথা।

সত্যিই তুমি কি তোমার আন্টিকে ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে দিয়েছিলে? সিরিয়াস স্বরে জিজ্ঞাসা করল হারমিওন।

বিশ্বাস কর আমার কোন ইচ্ছে ছিল না, বলল হ্যারি। আমি–আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। রন তখন অট্টহাসি হাসছে।

এটা কোন মজা করার মতো ব্যাপার নয় রন, বলল হারমিওন। আমি অবাক হচ্ছি যে হ্যারিকে এখনও কেন বহিষ্কার করা হয়নি।

আমিও কম অবাক হইনি, বলল হ্যারি, বহিষ্কারের কথা থাক, আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে গ্রেফতারই করা হবে। তোমার বাবা কি জানেন কেন ফাজ আমাকে ছেড়ে দিলেন?

সম্ভবত তুমি বলেই, তাই না, দি ফেমাস হ্যারি পটার, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল রন, আমি যদি আমার কোন আন্টিকে এমন ব্লো করতাম তাহলে মন্ত্রণালয় যে আমাকে কি করত সেটা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। তবে একটা কথা তোমাকে মানতেই হবে, ওদেরকে আগে আমাকে কবর থেকে তুলতে হতো, কারণ ঐরকম একটা ঘটনা ঘটানোর পর মা–ই আমাকে মেরে ফেলতো। বাবাকে আজ রাতে অবশ্য জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পারো তোমার প্রশ্নের উত্তর। আমরাও আজ রাতটা লিকি কলড্রনেই থাকছি। এবং হারমিওনও।

মাথা নেড়ে হারমিওন বলল, বাবা মা আমাকে সকালেই এখানে রেখে গেছে, সঙ্গে দিয়ে গেছে হোগার্টস-এর সব জিনিসপত্র।

চমৎকার, বলল হ্যারি।

এবং সেপ্টেম্বরেই আমার জন্মদিন, বলল হারমিওন, সেই সুবাদে বাবা কিছু টাকা আগাম দিয়ে গেছে আমার পছন্দমতো বার্থ ডে প্রেজেন্ট কেনার জন্যে।

একটা ভালো বই কিনলে কেমন হয়, রনের নিরীহ প্রস্তাব।

আমার মনে হয় না আমি কোন বই কিনব, বলল হারমিওন স্থির স্বরে, আমার একটা পেঁচা চাই। হ্যারির হেডউইগ আছে তোমারও আছে এরল…

না, আমার নেই, বলল রন, এরল পারিবারিক পেঁচা, আমার নয়। আমার আছে শুধু স্ক্যাবার্স। রন পকেট থেকে তার পোষা ইঁদুরটা বের করল। ওকে চেক আপ করাতে হবে। মিশরে ও সুস্থ বোধ করেনি।

স্ক্যাবর্সকে একটু রোগাই লাগছিল। ওর গোঁফটাও যেন ঝুলে পড়েছে।

ইতিমধ্যেই ডায়গন অ্যালির এক্সপার্ট হ্যারি বলল, ওইদিকে ম্যাজিকাল জীবজন্তুর একটা দোকান রয়েছে। তুমি দেখতে পারো স্ক্যাবার্স-এর জন্যে কিছু পাওয়া যায় কিনা। হারমিওন ওর পেঁচাও পেয়ে যেতে পারে।

আইসক্রিমের বিল মিটিয়ে ওরা দোকানটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।

ভেতরে খুব বেশি জায়গা নেই। দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে খাঁচা ঝোলানো। জায়গাটা দুর্গন্ধে ভরা। বিচিত্র সব শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো উইচটা কাকে যেন কি বোঝাচ্ছে। হ্যারি, রন এবং হারমিওন হাতে কিছু সময় পেলো খাঁচাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবার।

বেগুনি রঙের এক জোড়া ব্যাঙ বসে বসে মরা কতগুলো মাছি খাচ্ছে। জানালার কাছে খাঁচাটায় বিশাল এক কচ্ছপ বসে আছে কুতকুতে চোখ বের করে। ওর খোলসটা চকচক করছে যেন মূল্যবান পাথর খচিত। কমলা রঙের সব বিষাক্ত সাপ কাঁচের জারের গা বেয়ে বেয়ে কিছু দুর উঠছে আবার পড়ে যাচ্ছে। দুনিয়ার সব রং-এর বিড়াল যেমন আছে তেমনি রয়েছে দাঁড়কাকের একটা খাঁচা। দাঁড়কাকের সম্মিলিত কর্কশ শব্দে তিষ্টানো দায়। কাউন্টারের ওপর বড়সড় একটা খাঁচায় চকচকে কতগুলো কালো ইঁদুর ওদের লম্বা লেজগুলিকে ব্যবহার করে স্কিপিং গেম খেলছে।

কাউন্টারের উইজার্ডটা চলে যেতেই রন এগিয়ে গেলো।

আমার ইঁদুরটা, মানে মিশর থেকে ফিরে এসে ওর রং কেমন ফিকে হয়ে গেছে, বলল রন।

পকেট থেকে কালো এক জোড়া ভারি চশমা বের করে উইচটা বলল, ওটাকে কাউন্টারের ওপর রাখো।

রন ভেতরের পকেট থেকে স্ক্যাবার্সকে বের করে ইঁদুরের খাঁচার পাশে রাখল। ইঁদুরগুলো ওদের লাফালাফি বন্ধ করে স্ক্যাবার্সকে ভালো করে একনজর দেখবার জন্যে একদিকে জড়ো হলো।

হুম! স্ক্যাবাসকে তুলে ধরে বলল উইচ, এই ইঁদুরটার বয়স কত?

জানি না, বলল রন। একটু বয়স হবেই। ওটা আমার বড় ভাইয়ের ছিল।

স্ক্যাবার্সকে ভালো করে দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল কাউন্টারের উইচ, ওর কি কি গুণ বা ক্ষমতা আছে?

মানে–বলল রন। আসলে সত্যটা হচ্ছে এখন পর্যন্ত স্ক্যাবার্স উল্লেখ করবার মতো কোন ক্ষমতা দেখায়নি। কিন্তু স্ক্যাবাকে খুব গভীরভাবে নিরীক্ষা করছে উইচটা। ওটার ফাটা ছেঁড়া কান থেকে সামনের পা পর্যন্ত সবই দেখলো। সামনের পায়ের একটি আঙুল নেই।

এটার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, বলল কাউন্টার থেকে।

আত্মরক্ষার্থে রন বলল, পারসি যখন ওটা আমাকে দিয়েছ তখনও ও এরকমই ছিল।

একটা সাধারণ অথবা বাগান–ইঁদুর তিন বছরের বেশি বাঁচবে এটা আশা না করাই ভালো। বলল কাউন্টারের উইচটা। তবে তুমি যদি আরো একটু কষ্টসহিষ্ণু কিছু খুঁজছ তবে এরকম একটা তোমার ভালো লাগতে পারে। পাশের কালো ইঁদুরের খাঁচার দিকে ইঙ্গিত করল। ইঁদুরগুলো আবার স্কিপিং শুরু করেছে।

তবে তুমি যদি বদল করতে না চাও তাহলে এই র‍্যাট টনিকটা ওকে খাইয়ে দেখতে পারো, নিচে থেকে একটা ছোট লাল শিশি বের করে বলল কাউন্টারের উইচ।

বেশ, বলল রন, কত… আউচ!

রন ঝুঁকে পড়ল, কমলা রঙের বড়সড় একটা কিছু সবচেয়ে উঁচু খাঁচার ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে একেবারে রনের মাথার ওপর নামল। ঝড়ের বেগে থুথু ছিটাচ্ছে ওটা স্ক্যাবারের গায়ে।

না! ক্রুকশ্যাংক না! চিৎকার করে উঠল কাউন্টারের ডাইনীটা। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ততক্ষণে ডাইনীটার হাত পিছলে বেরিয়ে স্ক্যাবার্স দরজা লক্ষ্য করে লাগিয়েছে ছুট।

স্ক্যাবার্স! চিৎকার করে উঠল রন ওটার পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে। হ্যারি ওকে অনুসরণ করল।

দশ মিনিট লেগে গেল ওদের স্ক্যাবাসকে খুঁজে বের করতে। একটা ওয়েস্ট পেপার বিন-এর নিচে ও লুকিয়ে ছিল। ভীত কম্পিত ইঁদুরটাকে আলতো করে তুলে রন ওর পকেটে ভরল। মাথায় হাত বুলিয়ে ওটাকে আশ্বস্ত করল।

কী ছিল ওটা? প্রশ্ন করল রন।

হয় বড়সড় একটা বেড়াল না হয় তো ছোটখাট বাঘ, হ্যারির সোজাসাপটা জবাব।

হারমিওন কোথায়?

সম্ভবত ওর পেঁচা কিনছে।

ভিড় ঠেলে আবার ওরা ওই দোকানে ফিরে গেল। ওরা পৌঁছতে পৌঁছতে হারমিওন বেরিয়ে এলো। কিন্তু ওর হাতে কোন পেঁচা নেই। বরং একটা বিশালাকৃতির বেড়ালকে কোলে করে বেরিয়ে এসেছে হারমিওন।

তুমি ওই দৈত্যটাকে কিনেছ? বলল রন। বিস্ময়ে ওর মুখটা ঝুলে আছে।

ওটা গর্জাস, তাই না, উদ্দীপ্ত হারমিওনের জবাব।

সেটা অবশ্য দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, ভাবল হ্যারি।

হারমিওন, ওই জটা আমার মাথার চামড়া প্রায় তুলে ফেলেছিল, বললো রন।

আসলে ও সেরকম কিছু করতে চায়নি, তাই না কশ্যাংক? বললো হারমিওন।

আর স্ক্যাবার্স-এর কী হবে? ওর বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা ইঁদুরটাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলো রন। ওর বিশ্রাম এবং নিরুদ্বেগ আরাম দরকার। ওরকম একটা জন্তু আশপাশে থাকলে স্ক্যাবার্স কী সেটা পাবে?

তোমার এ কথায় মনে পড়ে গেলো র‍্যাট টনিকটা ভুলে ফেলে এসেছিলে। রনের হাতে ছোট লাল শিশিটা ধরিয়ে দিল হারমিওন। বাজে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো। কশ্যাংক থাকবে আমার ঘরে, স্ক্যাবার্স তোমার ঘরে, সমস্যাটা কোথায় দেখছো তুমি? বেচারা কশ্যাংক ওখানে যুগ যুগ ধরে পড়ে ছিল, কিন্তু ওর কোন খদ্দের ছিল না। ওকে কেউই কিনতে চায়নি।

আমিও ভাবছি কিনবে কেন? বলল রন। ততক্ষণে ওরা লিকি কলড্রনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

ওখানে পৌঁছে ওরা মিস্টার উইজলিকে দেখতে পেল, বার-এ বসে খবরের কাগজ পড়ছেন।

হ্যারি, মুখ তুলে বললেন তিনি। কেমন আছো?

বেশ ভালো, ধন্যবাদ, মিস্টার উইজলির টেবিলে বসতে বসতে বলল হ্যারি।

পত্রিকাটা রাখলেন মিস্টার উইজলি টেবিলের ওপর। সাইরাস ব্ল্যাক-এর পরিচিত মুখটা দেখতে পেলো ও কাগজে, যেন সোজাসুজি ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

তাহলে, এখনো ওরা ওকে ধরতে পারেনি? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

না। বললেন মিস্টার উইজলি। তাকে খুবই গম্ভীর দেখাছে। মন্ত্রণালয় আমাদেরকে আমাদের রুটিন কাজ থেকে বের করে নিয়েছে সাইরাস ব্ল্যাককে খুঁজে বের করবার জন্যে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সুখবর নেই।

আমরা যদি ওকে ধরতে পারি তবে পুরস্কারের টাকাটা পাবো তো? জিজ্ঞাসা করল রন। বাড়তি কিছু টাকা পেলে মন্দ হতো না।

বোকার মতো কথা বলো না রন, বললেন মিস্টার উইজলি। ভালো করে লক্ষ্য করলে ওর মানসিক চাপটা পরিষ্কার বোঝা যায়। তেরো বছরের কোন বালক নিশ্চয়ই সাইরাস ব্ল্যাককে ধরতে পারবে না, ব্ল্যাক ধরা পড়বে আজকাবানের গার্ডদের হাতেই।

ঠিক ঐ মুহূর্তে মিসেস উইজলি বার-এ ঢুকলেন। হাতে দুনিয়ার শপিং, পেছনে দুই জমজ পুত্র ফ্রেড এবং জর্জ, হোগার্টস-এ ওদের ফিফথ ইয়ার শুরু হতে যাচ্ছে এবার, হোগার্টস-এর নতুন ক্যাপ্টেন পার্সি এবং উইজলিদের একমাত্র মেয়ে জিনি।

হ্যারির প্রতি জিনির সবসময় একটা বিশেষ মনোযোগ থাকে, দেখা গেলো অন্যান্য সময়ের চেয়ে আজকে যেন একটু বেশি লজ্জামধুর মাধুর্যে ব্ৰিত হলো সে। এটা কি এজন্যে যে হোগার্টস-এ গত টার্মে হ্যারি জিনির জীবন বাঁচিয়েছিল? লাল হয়ে গেলো জিনি, ওর দিকে না তাকিয়েই হ্যালো বলল। পার্সি অবশ্য এমন গম্ভীরভাবে হাত বাড়িয়ে দিল যেন সে আর হ্যারি জীবনে কখনো মুখোমুখি হয়নি। বলল, হ্যারি, তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগল।

হ্যালো পার্সি, বলল হ্যারি কাষ্ঠ হাসি হেসে।

আশাকরি তুমি ভালোই আছো, প্রবলভাবে হাত কঁকিয়ে বলল পার্সি। যেন হ্যারিকে মেয়রের সাথে পরিচিত হতে হলো।

বেশ ভালো, ধন্যবাদ

হ্যারি, হাক দিল ফ্রেড। এই মধ্যে সে সামনে থেকে কনুই মেরে পার্সিকে সরিয়ে দিয়ে ঝুঁকে বলল, তোমাকে দেখে কি যে আনন্দ হচ্ছে ওল্ড বয়…।

মারভেলাস, ফ্রেডকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হ্যারির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল জর্জ, একেবারেই…

পার্সি মুখ গোমড়া করে ফেলল।

এখনকার মতো অনেক হয়েছে। বললেন মিসেস উইজলি।

মাম, বলল ফ্রেড এমনভাবে যেন এইমাত্র মাকে দেখেছে, মার হাতটা টেনে নিয়ে বলল সে, সত্যিই তোমাকে দেখে না!

আমি বলেছি না যথেষ্ট হয়েছে, খালি চেয়ারের ওপর শপিং ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললেন মিসেস উইসলি। হ্যালো হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা শুনেছ? পার্সির বুকে লাগানো নতুন সিলভার ব্যাজটার দিকে ইশারা করলেন তিনি। পরিবারের দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন, কণ্ঠস্বরে গর্ব স্পষ্ট।

অবশেষে, বিড় বিড় করল ফ্রেড।

কোন সন্দেহ নেই, হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেলেন তিনি, ওরা তোমাদের দুজনকে তো ক্যাপ্টেন বানায়নি।

আমরা ক্যাপ্টেন হতে চাইব কেন, যেন এই চিন্তাটাই ওর স্বভাববিরুদ্ধ, ওটা আমাদের জীবনের সব আনন্দই ছিনিয়ে নিত।

জিনি খিল খিল করে হেসে উঠল।

মনে হয় তোমরা তোমাদের বোনের সামনে খুব ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করছ! তীব্র স্বরে বললেন মিসেস উইজলি।

জিনির আরো ভাই আছে ওর জন্যে ভালো ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারবে মাম, বলল পার্সি রাতের খাবার খেতে হবে, আমি ওপর থেকে কাপড়টা বদলে আসছি।

ও চলে গেলো ওপরে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল জর্জ। আমরা ওকে একটা পিরামিডে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মা আমাদের ধরে ফেললেন। বলল জর্জ হ্যারিকে উদ্দেশ্য করে।

***

সে রাতের খাবারের ব্যাপারটি ছিল সত্যিই উপভোগ্য। রেস্টুরেন্ট মালিক টম তিনটা টেবিল জোড়া লাগিয়ে ওদের পার্লারে জায়গা করে দিল। সাতজন উইজলির সঙ্গে হ্যারি আর হারমিওন অত্যন্ত সুস্বাদু পাঁচটা কোর্স শেষ করল।

কাল কিভাবে কিংস ক্রসে যাবো বাবা? মুফতে দেয়া চকলেটে কামড় দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল ফ্রেড।

মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকটা গাড়ী দেয়া হবে।

সবাই মুখ তুলে মিস্টার উইজলির দিকে তাকালো।

কেন? পার্সি জিজ্ঞাসা করল।

তোমার জন্যেই পার্স, বলল জর্জ সিরিয়াসলি। এবং গাড়ীর বনেটে ছোট ছোট ফ্ল্যাগ থাকবে ওর ওপর এইচবি লেখা থাকবে ফ্ল্যাগগুলোর মধ্যে..

এইচবি মানে হামাংগাস বিগহেড আর কি, বলল ফ্রেড।

পার্সি এবং মিসেস উইজলি ছাড়া বাকি সকলেই পুডিং খেতে খেতে বিষম খেল।

মিনিস্ট্রি আমাদের গাড়ী দিচ্ছে কেন বাবা? পার্সি নিজের মর্যাদা বুঝে গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞাসা করল।

যেহেতু আমাদের গাড়ী নেই এবং যেহেতু আমি মিনিস্ট্রিতে কাজ করি আমাকে ওরা কিছু বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।

তোমরা ভাবতে পারো তোমাদের কী পরিমাণ লাগেজ আছে সাথে? বললেন মিসেস উইজলি।

রন এখনও তার জিনিসপত্র ট্রাঙ্কে ভরেনি আমার বিছানার ওপর ফেলে রেখেছে, লম্বা একটা যন্ত্রণা কাতর স্বরে বলল পার্সি।

সকালে সময় পাওয়া যাবে না, রন তোমাকে এখনই প্যাকিং সেরে ফেলতে হবে। খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন মিসেস উইজলি। পার্সির দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল রন।

ভরপেট খাওয়ার পর সবাই একে একে নিজ নিজ কামরার দিকে এগিয়ে গেলো। পরের দিনের জন্যে জিনিসপত্র শেষবারের মতো আরেকবার চেক করে নেয়া দরকার। হ্যারির পরের কামরাটাই রন এবং পার্সির। সবেমাত্র নিজের ট্রাঙ্কটা বন্ধ করেছে হ্যারি দেয়ালের ওপাশ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো। ভালো করে শোনার জন্যে এগিয়ে গেলো ও।

বারো নম্বর কামরার দরজাটা আবছাভাবে ভেজানো।

ওটা এখানেই ছিল বেডসাইড টেবিলের ওপর, পলিশ করার জন্যে ওটা খুলেছিলাম আমি, চেঁচাচ্ছে পার্সি।

আমি ওটা ধরেও দেখেনি, পাল্টা গর্জন করে বলল রন।

কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

আমার হেডবয় ব্যাজটা খোয়া গেছে, হ্যারির দিকে ঘুরে বলল পার্সি।

এবং আমার ইঁদুর স্ক্যাবার্স-এর র‍্যাট টনিকটাও পাওয়া যাচ্ছে না, বলল রন। নিজের ট্রাংক থেকে জিনিসপত্র বের করতে করতে। আমার মনে হচ্ছে ওটা আমি বার-এ ফেলে এসেছি…

 আমার ব্যাজ খুঁজে না দিয়ে তুমি কোথাও যাচ্ছ না, চিৎকার করে উঠল পার্সি।

আমি স্ক্যাবার্স-এ টনিকটা নিয়ে আসছি নিচে থেকে, আমার প্যাকিং হয়ে গেছে, বলে হ্যারি নিচে চলে গেলো।

অর্ধেকটা সিঁড়ি নামতেই হ্যারি অন্ধকার পার্লার থেকে ভেসে আসা কারো রাগত স্বর শুনতে পেলো। এক সেকেন্ড পর লোকগুলোকে চিনতে পারলো হ্যারি, মিস্টার এবং মিসেস উইজলি। দ্বিধায় পড়ে গেলো সে, ওদের ঝগড়া শুনে ফেলেছে এটা ওদের জানতে দেয়া ঠিক নয়। ওর নিজের নামটা শুনতে পেলো এবার, থামল এবং নিঃশব্দে পার্লারের দরজাটার আরো কাছে চলে এলো।

..ওকে না বলার কোন অর্থ নেই, রাগ হয়েই বললেন মিস্টার উইজলি। হ্যারির জানার অধিকার আছে। আমি ফাজকে বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ও হ্যারিকে এখনও শিশু হিসেবেই বিবেচনা করছে। ওর বয়স এখন তেরো বছর এবং…

আর্থার সত্যটা জানলে ও ঘাবড়ে যাবে, মিসেস উইজলি তীক্ষ্ম স্বরে বললেন। তুমি কি হ্যারিকে ওর মাথার ওপর ওরকম একটা ব্যাপার ঝুলে আছে অবস্থায় স্কুলে পাঠাতে চাও। ঈশ্বরের দোহাই, ও না জেনে অনেক ভালো আছে!

 আমি নিশ্চয়ই ওকে কষ্ট দিতে চাই না, তবে আমি ওকে সতর্ক করতে চাচ্ছি, বললেন মিস্টার উইজলি, তুমি তো জানো হ্যারি আর রনের প্রকৃতি, নিজে নিজে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়… মনে নেই দুই দুইবার ওরা নিষিদ্ধ বনে গিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এবার হ্যারিকে ওরকম কিছু করলে চলবে না। যখন আমি চিন্তা করি ওর বাড়ি থেকে পালানোর কথা, কি না ওর হতে পারতো যদি না নাইট বাসটা ওকে তুলে নিত। আমি বাজি ধরে বলতে পারি মিনিস্ট্রি ওকে খুঁজে পাওয়ার আগেই ও মরে ভূত হয়ে যেতো।

ওতো মারা যায়নি, ওতো ভালোই আছে, তাহলে কি দরকার…।

মলি, ওরা বলে সাইরাস ব্ল্যাক পাগল, এবং হয়তো সত্যিই তাই, কিন্তু সে আজকাবান থেকে পালাবার মতো বুদ্ধিমানও বটে এবং সেটা কিন্তু অসম্ভবই ছিল। তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে এখন পর্যন্ত কেউ তার টিকিটি যেমন দেখেনি তেমনি সে যে কোথায় লুকিয়ে আছে তারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ডেইলি প্রফেট পত্রিকায় ফাজ প্রত্যেক দিন কি বলছে তার আমি দুই পয়সারও মূল্য দিই না, আমরা ব্ল্যাককে ধরতে পারবো এমন কোন সম্ভাবনাই আমি এ মুহূর্তে দেখছি না। শুধু একটা কথা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি আর সেটা হচ্ছে ব্ল্যাক-এর একমাত্র টার্গেট হচ্ছে…

কিন্তু হ্যারি তো হোগার্টস-এ একেবারে নিরাপদ থাকবে।

আমরা তো আজকাবানকেও একশ ভাগ নিরাপদ ভাবতাম। ব্ল্যাক যদি আজকাবান ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে ও হোগার্টস ভেঙ্গেও ঢুকতে পারবে।

কিন্তু কেউ তো নিশ্চিতভাবে জানে না যে ব্ল্যাক হ্যারিকেই খুঁজছে…

কাঠের ওপর একটা ভোঁতা আওয়াজ হলো। হ্যারি শিওর যে মিস্টার উইজলি টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মারলেন।

মলি, তোমাকে কতবার বলব যে ওরা এই কথাটা মিডিয়াকে জানতে দিতে চায় না, কারণ ফাজ এটাকে গোপন রাখতে চায়। যে রাতে ব্ল্যাক পালিয়েছিল সেই রাতেই ফাজ আজকাবান গিয়েছিল। গার্ডরা ফাজকে জানিয়েছে যে ইদানিং ব্ল্যাক ঘুমের মধ্যে কথা বলতো। এবং একটা কথাই বলতো; ও এখন হোগার্টস-এ আছে… হোগার্টস-এ আছে। ব্ল্যাক এখন উন্মত্ত এবং সে হ্যারির মৃত্যু চায়। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর তবে বলব, ও ভাবছে যে হ্যারিকে মারতে পারলে তুমি তো–জানো কাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা যাবে। এবং একাকী বারোটা বছর হাতে পেয়েছিল ও ভাবার জন্যে যে…

থামলেন মিস্টার উইজলি। পার্লারে নীরবতা। দরজার আরো কাছে ভর দিয়ে দাঁড়ালো হ্যারি। ও আরো শুনতে চায়।

বেশ, আর্থার যেটা তুমি ভালো বোঝে সেটাই তোমার করা উচিত, কিন্তু তুমি অ্যালবাস ডাম্বলডোর-এর কথা ভুলে যাচ্ছ। আমি মনে করি যতদিন তিনি হোগার্টস-এর হেডমাস্টার আছেন ওখানে কেউই হ্যারির কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ধারণা করি তিনি নিশ্চয়ই সব কিছু জানেন।

নিশ্চয়ই জানেন। আজকাবানের গার্ডদেরকে ওর স্কুলে ঢোকার মুখে ডিউটি দেয়ার ব্যাপারে ওর আপত্তি আছে কি না সেটা জানতে হয়েছিল। রাজি হয়েছেন তবে খুব খুশি হয়ে নয়।

কেন? খুশি হয়ে না কেন? খুশি হবে না কেন, ওরা তো ওখানে ব্ল্যাকের মতো ক্রিমিনালকে ধরতে যাচ্ছে?

ডাম্বলডোর আজকাবানের গার্ডদের খুব একটা পছন্দ করেন না, বললেন মিস্টার উইজলি গম্ভীরভাবে, এমনকি আমিও পছন্দ করি না… কিন্তু যখন ব্ল্যাক এর মতো উইজার্ড নিয়ে কায়কারবার, তখন এমনসব শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হয় স্বাভাবিক অবস্থায় যাদেরকে এড়িয়ে চলাই উচিৎ।

যদি ওরা হ্যারিকে বাঁচাতে সক্ষম হয় তাহলে আমি ওদের বিরুদ্ধে কখনও একটি কথাও বলব না, ক্লান্ত স্বরে বললেন মিস্টার উইজলি, অনেক দেরি হয়ে গেছে, মলি, আমাদের এবার ওঠা উচিৎ…

চেয়ার সরানো হচ্ছে শুনতে পেলো হ্যারি। নিঃশব্দে ও সিঁড়ি বেয়ে বার-এ চলে এলো। পার্লারে দরজাটা খুলল, পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইজলি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন।

ওরা যে টেবিলটায় বসেছিলেন ওরই নিচে র‍্যাট টনিকটা পড়েছিল। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইজলির শোবার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনার পর ব্যাট টনিকের বোতলটা নিয়ে হ্যারি ওপরের দিকে রওয়ানা হলো।

সিঁড়ির ওপরে ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে ফ্রেড আর জর্জ পার্সির কাণ্ডকারখানা দেখে হাসি চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ব্যাজের খোঁজে মাস্টার পার্সি উইজলি ওর আর রনের রুম ওলটপালট করে ফেলছে।

ওটা আমাদের কাছেই রয়েছে, হ্যারিকে ফিস ফিস করে বলল ফ্রেড, আমরা ওটার উন্নয়ন ঘটিয়েছি।

হেড বয়-এর বদলে ব্যাজটায় এখন লেখা রয়েছে বিগহেড বয়।

হ্যারি যেন জোর করে হাসল, রনের হাতে ওর র‍্যাট টনিকটা তুলে দিল। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়লো।

তাহলে সাইরাস ব্ল্যাক তারই পেছনে লেগেছে। এখন সব কিছুই বোঝা যাচ্ছে। ওকে জীবন্ত ফিরে পেয়ে মন্ত্রী ফাজ কেন স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলেন। ওর প্রতি উদার আচরণের সেটাই ছিল কারণ। হ্যারির কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন, যে, সে ড্রাগন অ্যালিতেই থাকবে। ওখানে অনেক উইজার্ড রয়েছে ওকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। রেল স্টেশনে পৌঁছানোনার জন্যে মন্ত্রণালয় থেকে কাল দুটো গাড়ীও পাঠাচ্ছেন ওই কারণেই। ও যেন নিরাপদে ট্রেনে উঠতে পারে, আবার ট্রেন পর্যন্ত যেন উইজলিরা ওর ওপর চোখও রাখতে পারে।

পাশের ঘর থেকে তখনও পার্সি বা রনের ভোঁতা চিৎকার ভেসে আসছে। হ্যারি ভাবছে ওর কেন ভয় লাগছে না? এক হামলায় সাইরাস ব্ল্যাক তেরজনকে মেরেছে, স্বাভাবিকভাবেই উইজলি দম্পতি ভেবেছেন যে আসল ঘটনা জানলে সে ভয়েই মরে যাবে। কিন্তু মিসেস উইজলির সঙ্গে হ্যারি সম্পূর্ণ একমত, অ্যালবাস ডাম্বলডোর যেখানে রয়েছেন সেটাই বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। লোকে সবসময়ই বলে ডাম্বলডোরই একমাত্র ব্যক্তি যাকে লর্ড ভোল্টেমোর্ট ভয় পায়। ভোল্ডেমোর্টের ডান হাত হিসেবে ব্ল্যাকও নিশ্চয়ই ওকে তারই মতো ভয় পাবে?

এছাড়া ওখানে ওই আজকাবান গার্ডরা থাকবে, যাদের দর্শনেই লোকে ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। ওরা স্কুলের চারপাশে থাকলে, ব্ল্যাকের সাধ্য নেই ভেতরে ঢোকে।

কিন্তু এসব নয়, যে বিষয়টা হ্যারিকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করছে সেটা হলো তার হগসমিডে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন একেবারেই শূন্য। ব্ল্যাক ধরা না পড়া পর্যন্ত কেউই চাইবে না হ্যারি স্কুলের বাইরে যাক। বস্তুত হ্যারি সন্দেহ করছে বিপদ না কাটা পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তাকে নজরে রাখা হবে।

অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে হ্যারি একটা ভেংচি কাটল। ওরা কি মনে করে? সে নিজে নিজের খেয়াল রাখতে পারবে না? তিন তিনবার সে লর্ড ভোল্ডেমোর্টের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে; সে কোন অপদার্থ নয়…

হঠাৎ করেই ম্যাগনোলিয়া ক্রিসেন্টে ছায়ার মধ্যে দেখা জটা ওর মনের আয়নায় ভেসে উঠল। যখন জানোই সবচেয়ে খারাপ সময়টাই আসছে তখন কি করবে…

আমি ঘাতকের হাতে মরবো না, বেশ জোরেই বলল হ্যারি।

সাবাশ এই তো চাই, বলল ঘরের ঘুম ঘুম আয়নাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *