০৮. মৃত্যুদিনের পার্টি

০৮. মৃত্যুদিনের পার্টি

আক্টোবর এসে গেলো। মাটির ওপর দিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা ছড়াতে ছড়াতে ক্যাসল পর্যন্ত ছড়ালো। ছাত্র এবং কর্মচারীদের মধ্যে হঠাৎ করেই ঠাণ্ডা লাগার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মেট্রন ম্যাডাম পমফ্রের কাজ বেড়ে গেলো। ওঁর পেপারআপ পোশন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি, যদিও এই মহৌষধ যিনিই পান করছেন কয়েক ঘণ্টা ধরে তার কান দিয়ে সমানে ধোয়া বেরোতে দেখা গেল। জিনি উইসলির শরীররটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, ভয় দেখিয়ে পার্সি ওকেও খানিকটা খেতে বাধ্য করল। তার সজীব চুলের নিচ থেকে ধোঁয়া বেরোলে মনে হলো যেন তার পুরো মাথাটায়ই আগুন লেগে গেছে।

বুলেটের সাইজের বৃষ্টির ফোঁটা ক্যাসল-এর জানালায় পড়ছে দিনের পর দিন; লেকের পানি বাড়ছে, ফুলের কেয়ারিগুলো কাদার স্রোতধারায় পরিণত হলো এবং হ্যাগ্রিডের কুমড়োগুলো এক একটা বাগানের শেড-এর সমান বড় হলো। নিয়মিত ট্রেনিং নেয়ার ব্যাপারে অলিভার উডের উৎসাহ নিভে যায়নি। এবং এ কারণেই হ্যালোঈন উৎসবের কয়েকদিন আগে এক ঝড়ো শনিবারের বিকেলে, হ্যারিকে দেখা গেল গ্রিফিন্ডর হাউজে ফিরছে ভিজে চুবচুবে এবং কাদায় মাখামাখি।

বৃষ্টি আর বাতাসের কথা বাদ দিলেও এই সময়টা প্র্যাকটিসের জন্যে খুব ভাল না। ফ্রেড আর জর্জ স্লিথারিন টিমের ওপর নজরদারি করছে, নিজের চোখে দেখেছে ওই নিম্বাস দুই হাজার এক ঝাড়ুগুলোর যে কী দুর্দান্ত গতি। ওরা জানালো স্লিথারিন টিমটা সাতটি অস্পষ্ট বিন্দু ছাড়া যেন আর কিছুই নয়, বাতাস কেটে জাম্প–জেটের মতো সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

হ্যারি করিডোর দিয়ে পেচ পেচ শব্দ করে হেঁটে যেতে যেতে যার সামনে পড়ল সেও তারই মতো কোন একটা বিষয়ে চিন্তামগ্ন হয়েই ছিল। প্রায় মস্তক বিহীন নিক, গ্রিফিল্ডর টাওয়ারের ভূত, জানালা দিয়ে গোমড়া মুখে বাইরে তাকিয়ে ছিল, ফিস ফিস করে বলছে, …ওদের প্রয়োজন পূরণ করো না…অর্ধেক ইঞ্চি, যদি সেটা…।

হ্যালো, নিক, বলল হ্যারি।

হ্যালো, হ্যালো, বলল প্রায়-মস্তকবিহীন নিক, চারদিক তাকিয়ে। লম্বা কোকড়ানো চুলের ওপর ও একটা চোখ ধাঁধানো পালক লাগানো হ্যাট পরেছে, জ্যাকেট পরেছে একটা যার মধ্যে রয়েছে পালকের মোড়ক, ওর গলাটা যে প্রায় বিচ্ছিন্ন তা ঢেকে রেখেছে এই মোড়কটা। ধোয়ার মতোই ফ্যাকাশে ও, একেবারে ওর দেহের ভেতর দিয়েই হ্যারি বাইরের অন্ধকার আকাশ এবং মুষলধারার বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে।

তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে, পটার, বলতে বলতে নিক, একটি স্বচ্ছ চিঠি ভাঁজ করে ভেতরের বুক পকেটে রাখল।

তোমাকেও তো, বলল হ্যারি।

আহ, প্রায়-মস্তকবিহীন নিক ওর অভিজাত হাতটা নাড়ল, কোন জরুরি ব্যাপার নয়, এমন নয় যে সত্যি সত্যি আমি যোগ দিতে চেয়েছিলাম… ভেবেছিলাম দরখাস্ত করব, কিন্তু আসলে আমি যোগ্যতার শর্তগুলো পূরণ করি না।

তার কথায় হাল্কা ভাব থাকলেও, তার চেহারায় ফুটে উঠেছে তিক্ততা।

কিন্তু তুমি চিন্তা করবে, করবে না, ক্ষেপেই উঠল সে হঠাৎ, পকেট থেকে আবার চিঠিটা বের করল, যে ঘাড়ে ভোতা কুড়ালের পয়তাল্লিশটি আঘাত তোমাকে মুণ্ডহীন শিকারে যোগ দেয়ার উপযুক্ততা দেবে?

হ্যাঁ–নিশ্চয়ই, বলল হ্যারি যে একমত হওয়ার জন্য তৈরি হয়েই ছিল।

আমি বোঝাতে আমার চেয়ে বেশি তো আর কেউ চায় না যে ব্যাপার দ্রুত এবং একেবারে পরিস্কারভাবে শেষ হওয়াই উচিৎ ছিল, এবং আমার মাথাটা সঠিকভাবেই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, মানে এরকম হলে আমি অনেক ব্যথা আর উপহাস থেকে বেঁচে যেতাম। সে যেই হোক…

প্রায়-মস্তকবিহীন নিক হাত ঝেড়ে চিঠিটা খুলে প্রচন্ড ক্রোধে পড়তে শুরু করল:

আমরা শুধু সেই ধরনের শিকারীই গ্রহণ করতে পারি যাদের মাথা দেহ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই অনুধাবন করবে যে এর অন্যথা হলে সদস্যদের পক্ষে অশ্বারোহে মাথা দিয়ে খেলা দেখানো এবং মাথা-পোলোর মতো খেলায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। সুতারাং, অতীব দুঃখের সঙ্গে তোমাকে আমার জানাতে হবে যে তুমি অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারোনি। সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে, স্যার প্যাট্রিক ডিলানে–পডমোর।

গজরাতে গজরাতে, প্রায়-মস্তকবিহীন নিক চিঠিটা আবার ভেতরে রেখে দিল।

মাত্র আধ ইঞ্চি চামড়া এবং পেশি আমার ঘাড়টাকে ধরে রেখেছে, হ্যারি! বেশিরভাগ লোকই ভাববেন বেশ পুরোপুরিইতো মাথাটা কাটা হয়ে গেছে, কিন্তু না, ওহ, স্যার প্রপারলি বিচ্ছিন্ন মাথা পডমোরের জন্যে এটা যথেষ্ট নয়।

গভীর কয়েকটা শ্বাস টানল প্রায়-মস্তকবিহীন নিক, তারপর একটু শান্ত কন্ঠে বলল,কিন্তু–তোমার কি অসুবিধা? আমি কিছু করতে পারি?

না, বলল হ্যারি যদি না তুমি জান যে স্লিথারিনদের বিরুদ্ধে আমাদের ম্যাচে খেলবার জন্যে আমরা কোথায় বিনামূল্যে সাতটি নিম্বাস দুহাজার এক পেতে পা–

হ্যারির পরবর্তী শব্দগুলো ডুবে গেলো খুবই উচ্চ তীক্ষ্ণ একটা বেড়ালের ডাকে, তার পায়ের গোড়ালীর কাছে কোথাও থেকে শব্দটা এলা। নিচে তাকাল হ্যারি, দেখল প্রদীপের মতো হলুদ একজোড়া চোখ। মিসেস নরিস, কেয়াটেকার অরগাস ফিলচের ব্যবহার করা কঙ্কালসার ধূসর বেড়ালটা। ছাত্রদের সঙ্গে কেয়ারটেকারের শেষ না হওয়া লড়াইয়ে সহকারি বিশেষ।

তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল, হ্যারি, তাড়াতাড়ি বলল নিক। ফিলচের মুড় খুব ভাল না। ওর ফ্লু হয়েছে এবং থার্ড ইয়ারের কোন ছাত্র ভুল করে মাটির নিচের পাঁচ নম্বর ভূ–গর্ভস্থ কক্ষের সিলিং-এ ব্যাঙের মগজ লেপে দিয়েছে। সারা সকাল ধরে ওগুলো পরিস্কার করেছে ও, এরপর যদি দেখে তুমি কাদা মাখাচ্ছে…

ঠিক, বলল হ্যারি, মিসেস নরিসের অভিযোগ করা চোখের দৃষ্টি থেকে সরে গেলো, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সরতে পারল না। কোন রহস্যজনক শক্তি যেন আকর্ষণ করে ওকে এই জঘন্য বেড়ালটার সঙ্গে যুক্ত করছে, হঠাৎ করেই সজোরে হাজির হলো অর্গাস ফিলচ একটা পর্দা ভেতর থেকে, হাঁচি দিচ্ছে আর খুঁজছে আইন ভাঙছে কে। মোটা একটা স্কটল্যান্ডিয়ান পশমী কাপড়ের স্কার্ফ মাথায় বাধা এবং নাক অস্বাভাবিক রকমের রক্তবর্ণ।

নোংরা! চিৎকার করে উঠল সে, চোয়াল কাঁপছে, চোখজোড়া বিপজ্জনকভাবে বেরিয়ে আসতে চাইছে আঙুল দিয়ে হ্যারির কিডিচ পোশাক থেকে ঝরে পরা কাদাপানির ছোটখাট পুকুরটাকে ধোবার সময়। সব জায়গায়ই নোংরা, গোবর, ময়লা! তোমাকে বলছি! যথেষ্ট হয়েছে, আমার সঙ্গে এসো পটার!

প্রায়-মস্তকহীন নিককে বিষণ্ণভাবে বিদায় জানাল হ্যারি, তারপর চলল ফিলচের পেছন পেছন নিচের তলায়, যেতে যেতে মেঝেতে তার কাদামাখা পায়ের ছাপের সংখ্যা দ্বিগুণ করে গেলো।

হ্যারি আগে কখনো ফিলচের অফিসে আসেনি, এই একটি জায়গা যেটা ছাত্ররা সব সময়ই এড়িয়ে চলে। রুমটা নোংরা মলিন এবং জানালাও নেই রুমে। একটামাত্র তেলের বাতি নিচু সিলিং থেকে ঝুলছে। ভাজা মাছের একটা ক্ষীণ গন্ধ জায়গাটায় ছড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালের কাছে কাঠের ফাঁইলিং ক্যাবিনেট, লাগানো লেবেল থেকে বোঝা যায় ওগুলোতে ফিল্যাচের শাস্তি দেয়া সব ছাত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ফ্রেড এবং জর্জ উইসলির নামে একটা পুরো ড্রয়ার রয়েছে। ফিলচের চেয়ারের পেছনে ঝুলছে চকচকে পলিশ করা চেইন এবং হাতকড়া। সকলেরই জানা যে সে সবসময়ই ডাম্বলডোরের কাছে ছাত্রদের গোড়ালীতে বেধে সিলিং থেকে ঝোলানোর অনুমতি চাইছে। 

ডেস্কের ওপরের একটা পট থেকে একটা লেখার পালক তুলে নিয়ে ফিলচ এদিক ওদিক ঘাটছে পার্চমেন্টের খোঁজে।

গোবর, ক্ষিপ্ত হয়ে বিড়বিড় করল সে, গ্রেট সিজলিং ড্রাগন ভূত–ব্যাঙের মগজ…ইঁদুরের পাকস্থলী…যথেষ্ট হয়েছে…একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে…ফরমটা কোথায় গেল…হা, এই যে…

ডেস্কের ড্রয়ার থেকে পার্চমেন্টের একটা বড় রোল সে বের করল, সামনে ছড়ালো, লম্বা কালো পালকের কলমটা কালির দোয়াতে ডুবালো।

লাম.. হ্যারি পটার। অপরাধ…

একটু খানি তো মাত্র কাদা! বলল হ্যারি।

তোমার কাছে ওটা একটুখানি কাদা হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত ধোয়া মোছা করা! ধমকে উঠল ফিলচ, নাকের ডগায় অস্বস্তি কর একটা ফোঁটা কাঁপছে। অপরাধ…ক্যাসল নোংরা করা…প্রস্তাবিত শাস্তি…

 কিন্তু যেই না ফিলচ তার পাখার কলম ডেস্কে রেখেছে, বিকট একটা ব্যাং! অফিসের সিলিং-এ, তেলের প্রদীপটা একেবারে কেঁপে উঠল।

পিভস! গর্জন করে উঠল ফিলচ, পাখার কলমটা রাগে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার আমি তোমাকে দেখে নেব, দেখে নেব তোমাকে!

এবং পেছনে হ্যারির দিকে একবারও না তাকিয়ে ফিঞ্চ পুরোদস্তুর দৌড়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে, মিসেস নরিস [বেড়ালটা] দৌড়ে গেল পায়ে পায়ে।

পিভস হচ্ছে স্কুল পোল্টারজিস্ট, দাঁত বের করা, আকাশে ওড়া বিপদবিশেষ যে বেঁচেই রয়েছে ধ্বংস আর বিপদ সৃষ্টির জন্য। হ্যারি পিভসকে খুব পছন্দ করে না কিন্তু মোক্ষম সময় অ্যাকশনে যাওয়ার জন্যে কৃতজ্ঞ না হয়ে পারছে না। আশা করা যায় পিভস যা করেছে (মনে হচ্ছে এবার বেশ বড় কিছুই ভেঙ্গেছে) সেটা হ্যারির দিক থেকে ফিলচের মনোযোগ সরিয়ে নেবে।

ফিলচের জন্যে অপেক্ষাই করবে মনে করে আরি ডেস্কের কাছে একটা পোকা খাওয়া চেয়ারে বসে পড়ল। ডেস্কের ওপর ওর অর্ধ–সমাপ্ত ফরমটা ছাড়া আরেকটি বড়, রক্তবর্ণ গ্লসি খাম শুধু রয়েছে। খামের ওপর রূপালি অক্ষরে লেখা। দরজার দিকে চট করে একবার দেখে নিল হ্যারি যে ফিলচ আসচে কি না, খামটা তুলে নিয়ে পড়ল।

কুইকস্পেল
———————–
চিঠির মাধ্যমে নবিশদের জন্য ম্যাজিক কোর্স

কৌতূহলী হ্যারি খামটা খুলে ভেতর থেকে পার্চমেন্টের পাতাগুলো বের করল। প্রথম পাতার আরো বাঁকা রূপালি বর্ণের লেখাগুলো হচ্ছে :

আধুনিক ম্যাজিক দুনিয়ায় নিজেকে যোগ্য মনে করছ না? একেবারে সাধারণ জাদুগুলো প্রয়োগ না করার জন্য অজুহাত খুঁজে বেড়াচ্ছ? তোমার সাদামাটা যাদুর জন্যে উপহাসের পাত্র হয়েছ?
এসবেরই জবাব রয়েছে!
কুইকস্পেল হচ্ছে সব-নতুন, অব্যর্থ, দ্রুত-ফল, সহজে শিক্ষা কোর্স। শত শত পুরুষ ও মহিলা জাদুকর কুইকস্পেল পদ্ধতিতে উপকৃত হয়েছে।
টপসহ্যাম-এর মাজাম,জেড, নেইলস লিখছেন :
মন্ত্রোচ্চারণ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আর আমার পোশন ছিল পরিবারের উপহাসের ব্যাপার! এখন, এক কোর্স কুইকস্পেলের পর, আমি এখন পার্টির শদ্যমণি, বন্ধুরা আমার সিন্টিলেশন সলুশনের রেসিপির জন্য পায়ে ধরছে!
ডিডসবারি–র ওয়ারলক ডি. জে, প্রড লিখছেন :
আমার দুর্বল জাদুতে আমার স্ত্রী নাক সিটকাতেন কিন্তু আপনাদের চমৎকার কুইকস্পেল কোর্সের এক মাস পর আমি ওকে গৃহপালিত ষাড়ে পরিণত করতে সফল হয়েছি! ধন্যবাদ, কুইকস্পেল!

চমৎকার, হ্যারি খামের ভেতরের বাকি পাতাগুলো ওল্টালো। ফিল্চ এই কুইকস্পেল কোর্স চাচ্ছে কেন? তার মানে কি ও পুরোপুরি জাদুকর নয়? হ্যারি সবে মাত্র পড়তে শুরু করেছে, পাঠ এক : জাদুদণ্ড সঠিকভাবে ধরা (কয়েকটি প্রয়োজনীয় টিপস), শুনতে পেলো পায়ের আওয়াজ, ফিলচ ফিরে আসছে। তাড়াতাড়ি পার্চমেন্টো শিটগুলো খামের ভেতর গুঁজে দিল, দরজা খোলার মুহূর্তে ডেস্কের ওপর ছুঁড়ে মারল।

বিজয়ীর মতো লাগছে ফিলচকে।

ওই অদৃশ্যমান কেবিনেটটা খুবই দামী! আনন্দের সঙ্গে মিসেস নরিসকে বলছিল সে। এবার পিভসকে আমরা বের করেই দেবো, কি বলে সুইটি।

হ্যারির ওপর ওর চোখ পড়ল তারপর কুকইকস্পেল খামটার ওপর, যেটা, হ্যারি এখন দেরিতে বুঝতে পারছে আগের জায়গার চেয়ে দুই ফিট দূরে পড়ে আছে।

ফিলচের সাদা মুখটা সুড়কির মতো লাল হয়ে গেলো। আরেক ঢেউ ক্রোধের টার্গেট হওয়ার জন্য হ্যারি নিজেকে প্রস্তুত করল। খুড়িয়ে ডেস্কের কাছে গেলো হ্যারি, খামটা ছিনিয়ে নিয়ে একটা ড্রয়ারের মধ্যে ছুঁড়ে মারল।

তুমি কি তুমি কি পড়েছ ওটা? দ্রুত অসংলগ্নভাবে বলল সে।

না, তাড়াতাড়ি মিথ্যা বলল হ্যারি।

গাঁটওয়ালা হাত দুটো মলচে ফিলচ।

যদি আমি জানতাম তুমি আমার ব্যক্তিগত চিঠি পড়বে না এটা আমার নয়…আমার এক বন্ধুর জন্য…যার জন্যেই হোক…সে যাই হোক…।

হ্যারি ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে লুকিয়ে আছে, সতর্ক বটে; এতটা ক্ষিপ্ত ফিলচকে কখনই দেখা যায়নি। তার চোখ জোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, এক গালের গর্তের পেশিতে খিচুনি হচ্ছে এবং মাথার স্কার্ফটাও কোন কাজে আসছে না।

বেশ..যাও…এবং কারো কাছে একটি শব্দও নয়..ওটা নয়..যদি তুমি পড়ে না থাকো…এখন যাও, আমাকে পিভস সম্পর্কে রিপোর্ট লিখতে হবে, যাও…

নিজের সৌভাগ্যে বিস্মিত হ্যারি, দৌড়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল, করিডোর ধরে উপরের তলায়। ফিলচের অফিস থেকে শাস্তি না পেয়ে বের হয়ে আসা সম্ভবত একটা স্কুল রেকর্ড।

হ্যারি! হ্যারি! কাজ হয়েছে তো?

প্রায়-মস্তকহীন নিক উড়ে এলো একটা ক্লাসরুমের ভেতর থেকে। ওর। পেছনেই হ্যারি দেখতে পেল একটা বিরাট কালো–সোনালি ক্যাবিনেট-এর ধ্বংস স্তূপ, সম্ভবত ওটা অনেক উঁচু থেকে ফেলা হয়েছিল।

আমি পিভসকে এটা ঠিক ফিলচের অফিসের ওপর ফেলার জন্যে প্ররোচিত করেছি, আগ্রহের সঙ্গে বলল নিক। ভেবেছিলাম ফিলচের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো যাবে।

তাহলে তুমিই? কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল হ্যারি। হ্যাঁ, কাজ হয়েছে বৈকি, আমার কোন শাস্তিই হয়নি, ধন্যবাদ, নিক!

ওরা একসঙ্গে করিডোর ধরে এগোল। হ্যারি খেয়াল করল প্রায়-মস্তকহীন নিক তখনও স্যার প্যাট্রিকের প্রত্যাখ্যানপত্রটা হাতে ধরে রয়েছে।

আমি যদি ওই মুন্ডবিহীন–শিকারে তোমার জন্য কিছু করতে পারতাম। বলল হ্যারি।

জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল প্রায়-মস্তকহীন নিক এবং হ্যারি ওর ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। না গেলেই মনে ভাল হতো; ব্যাপারটা বরফ–পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো।

কিন্তু একটা ব্যাপার রয়েছে যা তুমি আমার জন্যে করতে পার, উত্তেজিত হয়ে বলল নিক। হ্যারি–আমার কি বেশি চাওয়া হবে। কিন্তু না, তুমিই হয়তো চাইবে না

কি ব্যাপার? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

বেশ, মানে, এই হ্যালোঈনে আমার পাঁচশতম মৃত্যুদিবস, বলল প্রায়-মস্তকহীন নিক, নিজেকে সোজা করে মর্যাদার সঙ্গে দাগাল।

ওহ, বলল হ্যারি, তবে নিশ্চিত নয় যে তার দুঃখিত না খুশি হওয়া উচিৎ। আচ্ছা।

আমি একটা পার্টি করছি, নিচে বড় সড় একটা ভূ–গর্ভস্থ কক্ষে। সারাদেশ থেকে বন্ধুরা আসছে। তুমি যদি পার্টিতে আস তবে সেটা আমার জন্যে খুব সম্মানের ব্যাপার হবে। মিস্টার উইসলি এবং মিস গ্রেঞ্জারও স্বাগত, অবশ্য কিন্তু তার চেয়ে আমি বলি কি তুমি স্কুলের ফিস্টেই যাও? হ্যারি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছে লক্ষ্য করল নিক।

না, তাড়াতাড়ি বলল হ্যারি, আমি আসব… ডিয়ার হ্যারি পটার! আমার ডেথডে পার্টিতে! এবং, ইতস্তত করছে নিক, উত্তেজিত হয়ে গেছে সে, তোমার কি মনে হয় যে স্যার প্যাট্রিককে বলতে পারবে আমাকে কত বেশি ভীতিকর এবং চিত্তাকর্ষক লাগে তোমার কাছে?

নি–নিশ্চয়ই, বলল হ্যারি।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল প্রায়-মস্তকহীন নিক।

ডেথডে পার্টি? হারমিওন আগ্রহ নিয়ে বলল, কাপড় বদলে হ্যারি ওর আর রনের সঙ্গে কমন রুমে মিলিত হওয়ার পর। খুব কম জীবিত মানুষ আছেন যারা বাজি ধরে বলতে পারবেন, অমন একটা পার্টিতে গিয়েছেন–দারুণ আকর্ষণীয় ব্যাপার হবে!

মানুষ কেন সেই দিনটা পালন করবে, যেদিন সে মারা গেছে? বলল রন, যে তার পোশন হোমওয়ার্ক-এর মাঝ পর্যন্ত এসেছে। মেজাজটা ওর খারাপ। আমার কাছে মৃত্যুর মতই বিষাদ মনে হচ্ছে ধারণাটা…

খনও কালির মতো কালো বৃষ্টির ছাট আসছে, কিনতু সবই উজ্জ্বল এবং আনন্দময়। আগুনের আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে অসংখ্য আরাম কেদারার ওপর, যেগুলিতে বসে লোকে পড়াশোনা করে, আলোচনা করে, বাড়ির কাজ করে অথবা ফ্রেড ও জর্জ উইসলির মতো যারা এই মুহূর্তে আলোচনা করে বের করবার চেষ্টা করছে স্যালামান্ডারকে ফিলিস্টার আতশবাজি খাওয়ালে কি হতে পারে। ম্যাজিক্যাল জীবের যত্ন নেয়ার ক্লাস থেকে ফ্রেড এই উজ্জ্বল কমলা রঙের আগুনে বাসকারী টিকটিকিকে উদ্ধার করেছে। এখন ওটা এক দল কৌতূহলী মানুষের মাঝে টেবিলের ওপর আস্তে ধিকি ধিকি জ্বলছে।

রন আর হারমিওনকে কেবলমাত্র ফিলচ এবং কুইকস্পেল-এর কথাটা বলতে যাচ্ছিল হ্যারি এমন সময় হঠাৎ সালামান্ডারটা হুসস করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল, রুমের চারদিকে পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে উচ্চশব্দে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুড়ছে আর প্রচন্ড ব্যাং ব্যাং আওয়াজ বের করছে। ফ্রেড আর জর্জের উদ্দেশে পার্সি চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, স্যালামান্ডারের মুখ থেকে নিঃসৃত ক্ষুদে ক্ষুদে তারার দর্শনীয় প্রদর্শনী এবং বিস্ফোরণের সঙ্গে ওটার আগুনের মধ্যে

পালিয়ে যাওয়া সব কিছু মিলে হ্যারির মাথা থেকে ফিলচ আর কুইকম্পেলের খামের কথাটা একেবারেই উবে গেল।

***

যে সময়ের মধ্যে হ্যালোঈন এলো, হঠাৎ করে দেয়া ডেথডে পার্টিতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে হ্যারির আফসোস হতে লাগল। স্কুলের বাকি সবাই তাদের গ্যালোঈন ফিস্ট নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে; জীবন্ত বাদুড় দিয়ে গ্রেট হলটাকে সাজানো হয়েছে, হ্যাগ্রিডের বিরাটকায় কুমড়োগুলোকে ল্যান্টার্নের মতো করে কাটা হয়েছে, এত বড় যে তিনজন অনায়াসে বসতে পারে এর ভেতরে এবং গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ডাম্বলডোর কংকালের একটা নাচের ট্রুপকে বুক করেছেন।

প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই, বসের মতো হ্যারিকে মনে করিয়ে দিল হারমিওন। তুমি বলেছ ডেথডে পার্টিতে যাবে।

সাতটার সময় হ্যারি, রন আর হারমিওন একেবারে পরিপূর্ণ গ্রেট হলটার দরজা পেরিয়ে ভূগর্ভস্থ কারাগারগুলোর দিকে পা চালালো। অবশ্য এর জন্যে হালের চকচকে সোনালি প্লেট আর মোমবাতির নরম আলোর আমন্ত্রণ তাদেরকে এড়াতে হয়েছে।

প্রায়-মস্তকহীন নিকের পার্টির দিকে যেতে করিডোরটাও মোমবাতি দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে। কিন্তু অন্যরকম দেখাচ্ছে। আনন্দের লেশ মাত্র নেই : এগুলো লম্বা, পাতলা, ঘন–কালো মোম,সবগুলো নীল আলো দিয়ে জ্বলছে, ওদের চোখে মুখেও একটা ভৌতিক স্বল্প আলো–আঁধারি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক একটা ধাপ ওরী নামছে সিঁড়ি দিয়ে আর তাপমাত্রা নামছে। ঠাণ্ডায় কাঁপছে হ্যারি, নিজের চারদিকে পোশাকটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিল। এমন সময় শুনতে পেলো যেন বিশাল এক ব্ল্যাকবোর্ডে হাজারটা নখ আঁচড়াচ্ছে।

ওটা কি মিউজিক? রন ফিস ফিস করে বলল। একটা কোনা ঘুরে দেখতে পেলো প্রায়-মস্তকহীন নিক দাঁড়িয়ে আছে কালো ভেলভেটের পর্দা ঝোলানো একটা দরজার সামনে।

আমার প্রিয় বন্ধুরা, বলল সে শোকে, স্বাগতম, স্বাগতম…তোমরা যে আসতে পেরেছ সে জন্যে আমি যারপরনাই আনন্দিত…।

পালক লাগানো হ্যাটটা সরিয়ে বো করে ওদেরকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানাল সে।

অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য। মাটির নিচের অন্ধকার কারাকক্ষটি ভর্তি মুক্তার মতো সাদা, আলো প্রবাহী কিন্তু অস্বচ্ছ লোকে, প্রায় সকলেই ডান্স ফ্লোরের ভিড়ের দিকে সরছে, নাচছে ওয়ালজ তিরিশটি মিউজিক্যাল করাতের কাঁপা এবং ভয়াবহ শব্দের তালে তালে, কালো চাদরে ঢাকা প্লটফরম থেকে বাজাচ্ছে একটি অর্কেস্ট্রা। মাথার ওপর থেকে একটি ঝাড়ুবাতি হাজার কালো মোমবাতি থেকে মধ্যরাতের–নীল আলোকচ্ছটা ছড়াচ্ছে। ওদের নিঃশ্বাস মুখের সামনেই কুয়াশা তৈরি করছে। যেন ফ্রিজারে ঢুকেছে ওরা।

আমরা কি চারদিকটা একটু ঘুরে দেখব, প্রস্তাব দিল হ্যারি, আসলে পা গরম করতে চাচ্ছে ও।

সাবধান থেকে কারো ভেতর দিয়ে যেন হেঁটে যেও না, বলল রন, একটু নার্ভাস বোধ করছে সে, রো নাচের ফ্লোরের ধার ধরে হাঁটতে শুরু করল। এক গ্রুপ মন ভার নানের পাশ দিয়ে গেল, এক হতচ্ছাড়া চেন পরা, মোটাসোটা ফ্রায়ার, উৎফুল্ল হাফপাফ ভূত, কথা বলছে একজন নাইটের সঙ্গে যার কপালে লেগে আছে একটা তীর। ব্লাডি বেরন, রোগী স্লিথারিন ভূত সারা শরীরে রূপালি রক্তের দাগ, অন্যান্য ভর্তি সকলেই তাকে এড়িয়ে চলছে দেখল হ্যারি, কিন্তু অবাক হলো না।

ওহ না! বলল হারমিওন হঠাৎ করে থেমে,। পেছন ফেরো, পেছন ফেরো, আমি মোনিং মার্টল-এর সঙ্গে কথা বলতে চাই না।

কে? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি, পেছন দিকে যেতে যেতে।

সে প্রথম তলায় মেয়েদের টয়লেটে ঘুরে বেড়ায়, বল্ল হারমিওন।

সে টয়লেটে ঘুরে বেড়ায়?

হ্যাঁ। সারা বছর ধরেই টয়লেটটা নষ্ট কারণ প্রায়ই ওর রাগ হয় আর সে টয়লেটটাতে পানির বন্যা বইয়ে দেয়। এড়াতে পারলে আমি কখনো ওখানে যাইনি। তুমি টয়লেটে গেছ আর ও বিলাপ করছে সেখানে কি একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার না

দেখো, খাবার! বলল রন।

অন্ধকার কারাকক্ষটির আরেক প্রান্তে একটা লম্বা টেবিল, ওটাও কালো ভেলভেট ঢাকা। ওরা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু পর মুহূর্তে জায়গায়ই দাঁড়িয়ে পড়ল, ভয়ে। গন্ধটা একেবারেই জঘন্যরকমের বিরক্তিকর। বড় বড় পঁচা মাছ সুন্দর রূপালি প্লেটে করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কেক, পোড়া কাঠকয়লার মতো কালো, ধাতুর ট্রের ওপর স্তূপ করা রয়েছে, পনিরের একটা ঠাঁই পশমী সবুজ ছত্রাক দিয়ে ঢাকা এবং সম্মানের জায়গাটিতে, সমাধিফলকের আকৃতির বিশাল এক ধূসর কেক তার ওপর আলকাতরার মতো আইসিং দিয়ে লেখা :

স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি–পরপিংটন
মৃত্যু ৩১ অক্টোবর, ১৯৪২

হ্যারি অবাক হয়ে দেখছে। একজন হৃষ্টপুষ্ট ভূত টেবিলের কাছে এসে একটু ঝুঁকে টেবিলটার মধ্যে দিয়ে চলে গেলো। মুখ হা করা ছিল ভূতটার যেন সে দুর্গন্ধযুক্ত স্যামন মাছের ভেতর দিয়ে যেতে পারে।

ওটার মধ্য দিয়ে গেলে কি স্বাদ পাওয়া যায়? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল ভূতটাকে।

প্রায়, বলল ভূতটা মলিন মুখে তারপর চলে গেল অন্যদিকে।

আমার মনে হয় গন্ধটাকে তীব্রতা দেয়ার জন্যে ওরা ওটাকে আরো পঁচিয়েছে, নাক ধরে দুর্গন্ধযুক্ত ভেড়ার মাংসের স্কটিশ ডিশটার আরো কাছে গিয়ে অভিজ্ঞের মত বলল হারমিওন।

চলো এখান এখন থেকে সরা যাক, আমি অসুস্থ বোধ করছি, বলল রন।

ওরা ঘুরতে পেরেছে কি পারেনি, হঠাৎ করেই টেবিলের নিচে থেকে বেরিয়ে এসে একটি বেটেখাটো মানুষ ওদের সামনে শুনে থমকে দাঁড়ালো।

হ্যালো, পিভস, বলল হ্যারি সতর্কতার সঙ্গে।

চারদিকের ভূতগুলোর তুলনায় পল্টারজিস্ট পিভস একেবারে উল্টো, ফ্যাকাশেও নয় স্বচ্ছও নয়। ওর পরনে একটা উজ্জ্বল কমলা পার্টি হ্যাট, একটা ঘূর্ণায়মান বো টাই এবং ওর বড় শয়তানী মুখটায় চওড়া হাসি।

খাবে? সুন্দরভাবে ফাংগাসে ভরা এক গামলা ছোলা ওদের দিকে বাড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা কল পিভস।

না, ধন্যবাদ, বলল হারমিওন।

তোমাকে মার্টল সম্পর্কে কথা বলতে শুনেছি, বেচারা, বলল পিভস, ওর চোখ জোড়া নাচছে। মার্টল-এর উপর অবিচারই করেছো, বেচারা। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে হাঁফ ছাড়ল,ওয়! মার্টল।

ওহ,না, পিভস, ওকে বলো না আমি কি বলেছি, ও মন খারাপ করবে, দ্রুত পাগলের মতো ফিস ফিস করে বলল হারমিওন। আমি ঠিক ওটা বিশ্বাস করে বলিনি, আমি কিছু মনে করি না ওর মানে-এই যে, হ্যালো মার্টল।

বসে থাকা একটা মেয়ে ভূত উড়ে এলো। দীর্ঘ, কৃশ এবং চাদিতে লেপ্টে থাকা চুল এবং চওড়া চশমার আড়ালে অর্ধ লুকনো হ্যারির দেখা সবচেয়ে বিষণ্ণ চেহারা মার্টলের।

কি? জিজ্ঞাসা করল গাল ফুলিয়ে।

কেমন আছোঁ, মার্টল? জিজ্ঞাসা করল হারমিওন, মেকি আন্তরিকতায়। টয়লেটের বাইরে তোমাকে দেখে ভালই লাগছে।

হাঁচি দিল মার্টল।

মিস গ্রেঞ্জার এই মাত্র তোমার সম্পর্কেই আলাপ করছিল– বলল পিভস ধূর্ততার সঙ্গে মার্টলের কানে কানে।

এই বলছিলাম–বলছিলাম কি তোমাকে আজ রাতে কত সুন্দর দেখাচ্ছে, পিভস এর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলল হারমিওন।

চোখে সন্দেহ নিয়ে হারমিওনের দিকে তাকাল মার্টল।

তোমরা আমাকে নিয়ে তামাশা করছ, বলল সে, ওর স্বচ্ছ সি–থ্র চোখে রূপালি অশ্রু টল টল করছে।

না–সত্যি–অনেস্টলি-এইমাত্র না আমি বললাম মার্টলকে আজ কত সুন্দর লাগছে? হ্যারি আর রনের পাঁজরে জোরে খোঁচা দিয়ে বলল হারমিওন।

ওহ,হ্যা…।

সে বলেছে…

আমার কাছে মিথ্যা কথা বলবে না, ঘন ঘন শ্বাস টানল মার্টল, ওর চোখের পানিতে বাধ ভাঙা বান, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে খুশিতে চাকুম করে উঠল পিভস। তোমরা কি মনে করো লোকে আড়ালে আমার সম্পর্কে কি বলে সেটা আমি জানি না? মোটা মর্টল! কুৎসিৎ মার্টল! যাচ্ছে–ভাই, কোঁকানো, মনমরা মার্টল!

তুমি দাগওয়ালী বলতে ভুলে গেছ, ওর কানে ফিস ফিস করে বলল পিভস।

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল কোকানো মার্টল, ছুটে বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। পিসও দৌড়াল ওর পেছন পেছন, ছোট ছোট মটর ওর দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে জোরে জোরে বলছে, দাগওয়ালী! দাগওয়ালী!

আহা বেচারা! বলল রমিওন দুঃখের সঙ্গে।

প্রায়-মস্তকহীন নিক ভিড়ের ঠেলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো!

এনজয় করছ তো?

ওহ! নিশ্চয়ই, মিথ্যা বলল ওরা।

এসেছে অনেকেই, বেশ গর্বের সঙ্গে বলল নিক। বিলাপী বিধবারা সেই কেন্ট থেকে এসেছে…এখন আমার বক্তৃতা দেয়ার সময় প্রায় হয়ে গেছে, আমি যাই বাজনাদারদের একটু বলি…

ঠিক সেই সময়ই বাজনাদাররা বাজনা থামিয়ে দিল। ওরা এবং ওই কারা প্রকোষ্ঠে যারাই ছিল সবাই একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে, চারদিকে তাকাচ্ছে উত্তেজনায়, শিকারির হর্ণের আওয়াজ শোনা গেল।

ওহ! এই যে এসে গেছে, তিক্ততার সঙ্গে বলল নিক।

ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে দেয়ালের মধ্যে দিয়ে সজোরে বেরিয়ে এলো এক ডজন অশরীরী ঘোড়া, প্রত্যেকটির উপর সওয়ার হয়ে আছে একজন করে মাথাহীন অশ্বারোহী। ওরা জোরে জোরে তালি বাজাল: হ্যারিও তালি বাজাতে শুরু করল, কিন্তু নিকের চেহারার দিকে তাকিয়ে তালি বাজানো বন্ধ করে দিল।

ঘোড়াগুলো নাচের ফ্লোরের ঠিক মাঝখানে দৌড়ে গেলো, থামল, পেছনে এলো, সামনে এগোলো; সামনে বিশাল এক ভূত যার কাটা মাথা ওর নিজের বগলে, হর্ণ বজালে ও, লাফ দিয়ে নিচে নামল, মাথাটাকে লোকজনের মাথার উপরে তুলল যেন সবার মাথার উপর দিয়ে ও দেখতে পায় (সবাই হাসল। হেঁটে নিকের কাছে গেলো, মাথাটা ঘাড়ের উপর বসালো।

নিক, গর্জন শোনা গেল একটা। কেমন আছো? মাথাটা এখনও ওখানেই ঝুলছে?

প্রাণখুলে একটা অট্টহাসি দিল সে, প্রায়–মাথাহীন নিকের কাঁধের চাপড় দিল।

স্বাগতম, প্যাট্রক, বলল নিক আড়ষ্টভাবে।

জীবিতরা! বললেন স্যার প্যাট্রিক হ্যারি, রন আর হারমিনের দিকে চোখ পড়তেই এবং যেন আশ্চর্য হয়েছেন এমন একটা ভাব করে দিলেন এক ভূয়া লাফ, ওর মাথাটা আবার পড়ে গেলো। উপস্থিত সকলেই হাসিতে ফেটে পড়ল।

বেশ মজার, মুখ গোমড়া করে বলল নিক।।

কিছু মনে করো না নিক, মেঝে থেকে চিৎকার করে উঠলেন সারি পাাট্রিকের মাথাটা। তাকে যে শিকারে যোগ দিতে দেয়া হয়নি সে ব্যাপারে এখনো মন খারাপ করে আছে! কিন্তু আমি বোঝাতে চাইছি–ওর দিকে তাকাও

আমার মনে হয়, তাড়াতাড়ি বলল হ্যারি, নিকের অর্থবোধ চাহনির জবাবে, নিক খুবই–ভয় পেয়েছে এবং মানে

হা! চিৎকার করে উঠল স্যার প্যাট্রিকের লুষ্ঠিত মাখী।বাজি ধরে বলতে পারি ও তোমাকে ওটা বলতে বলেছে।

আমি কি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, আমার মনে হয় এখন আমার বক্তৃতা দেয়ার সময় হয়েছে। বলল প্রায়–মাথাহীন নিক জোরে, হেঁটে মঞ্চের দিকে গেল এবং একটা বরফ–শীতল স্পটলাইটের ভেতরে প্রবেশ করল।

আমার মৃত লর্ড, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোকেরা, এটা আমার অতি বড় দুঃখ,,,

এরপর কেউই আর কিছু শোনেনি। স্যার প্যাট্রিক আর হেডলেস হান্টের অনারা মিলে হেড–হকি খেলা শুরু করে দিল, উপস্থিত সকলে খেলা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বৃথাই চেষ্টা করল নিক দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করার। কিন্তু হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, ওর পাশ দিয়ে স্যার প্যাট্রিকের মাথাটা উড়ে যাওয়ার সময় দর্শকদের সোচ্চার উল্লাস দেখে।

ঠাণ্ডায় হ্যারির একেবারে জমে যাওয়ার দশা, ক্ষিধেও পেয়েছে।

আমি আর সহ্য করতে পারছি না, বিড় বিড় করে বলল রন, ঠাণ্ডায় দাতে দাঁত লাগছে, বাজনাদাররা আবার বাজাতে শুরু করল, ভূতগুলো সব আবার ডান্স–ফ্লোরে।

চলো যাই, হ্যারিও বলল।

ওরা আস্তে আস্তে দরজার দিকে সরে যেতে লাগল, কারো দিকে মাথা নেড়ে, কাউকে চাপা হাসি দিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই কালো মোমবাতি জ্বালানো প্যাসেজে চলে এলো ওরা।

এখনও হয়তো পুডিং শেষ হয়ে যায়নি, রনের আশান্বিত কণ্ঠস্বর, সবার আগে হলঘরের ধাপগুলোর দিকে এগিয় যাচ্ছে ও।

এর ঠিক পরেই হ্যারি শুনতে পেলো।

…ছেড়ো…ফাড়ো, মারো…

সেই একই কণ্ঠস্বর, একই রকম শীতল, খুনে কণ্ঠস্বর যেটা সে শুনতে পেয়েছিল লকহার্টের অফিসে।

হোঁচট খেয়ে পাথরের দেয়ালটা আঁকড়ে ধরে থেমে গেলো সে। সর্বশক্তি দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে, চারদিকে দেখবার চেষ্টা করছে, চোখ কুঁচকে প্রায়ান্ধকার প্যাসেজটা দেখার চেষ্টা করছে।

হ্যারি, তোমার কি?

ওই কণ্ঠস্বরটা আর–চুপ কর এক মিনিট

..এতো ক্ষুধার্ত..এত দিন ধরে…

শোন! বলল হ্যারি, কণ্ঠে জরুরিভাব, এবং রন আর হারমিওন ওকে দেখে একেবারে জমে গেলো।

..হত্যা করো…হত্যা করার সময়…

স্বরটা ক্ষীণ হয়ে আসছে। হ্যারি নিশ্চিত যে ওটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে উপরের দিকে। অন্ধকার সিলিংটার দিকে চেয়ে রইল সে, ভয় আর উত্তেজনা গ্রাস করেছে ওকে; ওটা উপরে যাচ্ছে কি ভাবে? তবে কি ওটা ফ্যান্টম, যার কাছে পাথরের সিলিং কোন ব্যাপারই নয়?

এই পথে, চিৎকার করে ও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল এবং প্রথম হলঘরে প্রবেশ করল। ওখানে কিছু শোনার আশা করা বৃথা, গ্রেট হলের ভেতর থেকে হ্যালোইন ফিস্টের কলরব ভেসে আসছে। হ্যারি সিঁড়ির মাৰ্বল ধাপ বেয়ে দৌড়ে দ্বিতীয় তলায় উঠল, রন আর হারমিওন ওর পেছন পেছন।

হ্যারি, আমরা কি

সশশ!

কান পাতল হ্যারি। খুব ক্ষীণভাবে উপরের তলা থেকে, এবং ক্রমেই ক্ষীণতর শুনতে পেলো সে কণ্ঠস্বর…আমি রক্তের গন্ধ পাচ্ছি…আমি রক্তের গন্ধ পাচ্ছি?

ওর পাকস্থলী যেন ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। কাউকে ও মেরে ফেলবে! ও চিৎকার করে উঠল। রন আর হারমিওনের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা উপেক্ষা করে ও এর পরের তলায় উঠতে শুরু কলল দৌড়ে এক একবারে তিন তিনটি করে সিঁড়ির ধাপ ভেঙ্গে। ওর নিজের পায়ের শব্দের বাইরে শুনতে চেষ্টা করছে ও।

প্রচণ্ড বেগে পুরো তৃতীয় তলাটা চষে বেড়াল হ্যারি, রন আর হারমিওন ওর হাঁপাচ্ছে ওর পেছন পেছন। শেষ একটা কোনায় এসে মোড় ঘুরেই পেল খালি প্যাসেজ।

হ্যারি, পুরো ব্যাপারটা কি হচ্ছে? বলল রন মুখ থেকে ঘাম মুছতে মুছতে। আমি কিছু শুনতে পাইনি…

কিন্তু হঠাৎ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল হারমিওন, সামনের করিডোরটা দেখিয়ে।

দেখো!

সামনের দেয়ালে কি যেন একটা চকচক করছে। সামনে গেলো ওরা, ধীরে, অন্ধকারের মধ্যে চোখ কুঁচকে। দুই জানালার মাঝখানের দেয়ালে এক ফুট উঁচু উঁচু অক্ষর, জ্বলন্ত মশালের আলো ঝিলমিল করছে।

গোপনীয়তার প্রকোষ্ঠটি খোলা হয়েছে।
উত্তরাধিকারের শত্রুরা, সাবধান।

ওটা কি নিচে ঝুলছে? বলল রন, ওর স্বরে সামান্য কাপন।

কাছাকাছি পৌঁছে হ্যারি প্রায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। মেঝেতে পানির রীতিমত একটা ডোবা তৈরি হয়ে আছে। রন আর হারমিওন ওকে ধরে ফেলল, এবং ইঞ্চি ইঞ্চি করে লেখাটার দিকে এগোচ্ছে, নিচের একটা ঘন ছায়ার ওপর চোখ স্থির। একই সঙ্গে ওরা তিনজঁন বুঝতে পারল ওটা কি, সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পেছনে সরে এলো।

মিসেস মরিস, কেয়ারটেকারের বিড়ালটা টর্চ লাগানোর ব্র্যাকেট ধরে লেজে ঝুলে রয়েছে। শক্ত কাঠের মতো মিসেস মরিসের চোখ দুটো পুরো খোলা এবং এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ওরা নড়ল না। তারপর রন বলল, চলো এখান থেকে চলে যাই।

আমাদের কি একবার সাহায্য করার চেষ্টা করা উচিৎ নয়–বেখাপ্পাভাবেই বলল হ্যারি।

বিশ্বাস করো, বলল রন। আমাদেরকে এখানে কেউ দেখুক এটা চাচ্ছি না।

কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। গুড় গুড় আওয়াজ পাওয়া গেলো, যেন কোন দূরের বজ্রধ্বনি, ওদের জানিয়ে দিল যে, এইমাত্র ফিস্ট শেষ হলো। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই দিক থেকেই শত শত পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠছে। সঙ্গে শোনা যাচ্ছে ভূরিভোজনের পর মানুষের সুখ–গল্পের আওয়াজ; পর মুহূর্তেই, দুদিক থেকেই ছাত্ররা যেন জোয়ারের মতো প্যাসেজে এসে পড়ল।

বকবক, উত্তেজিত কথাবার্তা এবং সব শব্দ এক পলকে থেমে গেল যখনই সামনের ছাত্রদের চোখ ঝুলন্ত বিড়ালটার ওপর পড়ল। হ্যারি, রন আর হারমিওন দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন, করিডোরের মাঝখানে, নিরবতা নেমে এসেছে, ছাত্ররা সবাই ঠেলে সামনে আসতে চাইছে বিভৎস দৃশ্যটা দেখার জন্যে।

নিরবতার মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠল।

উত্তরাধিকারের শত্রুরা, সাবধান! এরপর তোমাদের পালা, মাডব্লাডস!

কথাটা বলেছে ড্র্যাকো ম্যালফয়। ঠেলে সামনে চলে এসেছে ও, ওর সাপের মতো চোখ জোড়া হঠাৎ করেই যেন জীবন্ত হয়ে গেছে, ওর রক্তশূন্য মুখটা এখন রক্তিম, যখন সে দেখল ঝুলন্ত অনড় বিড়ালটাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *