০৭. মাডব্লাড এবং মর্মর

০৭. মাডব্লাড এবং মর্মর

পরের কয়েকটা দিন হ্যারি কাটালো গিল্ডরয় লকহার্টকে এড়িয়ে। যখনই সে দেখেছে গিল্ডরয় লকহার্টকে করিডোর দিয়ে আসছে তখনই সে তার দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার জন্যে সচেষ্ট থেকেছে। তবে কঠিন ছিল কলিন ক্রিভিকে এড়ানো। ও যেন হ্যারির সময়গুলো মুখস্থ করে রেখেছে। ওকে দিনে কয়েকবার, ঠিক আছে, হ্যারি? বলা আর জবাবে, হ্যালো, কলিন, শোনা কলিনের কাছে যেন বিরাট একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। হ্যারির গলার স্বরে যতই ধৈর্যচ্যুতি বোঝাক না কেন।

হেডউইগ তখনও রেগে আছে হ্যারির ওপর। কারণ সেই গাড়িতে করে বিপর্যয়কর যাত্রাটা। রনের জাদুদণ্ডটা এখনও ঠিকমত কাজ করছে না। শুক্রবার সকালে রনের হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে সোজা গিয়ে বেঁটেখাটো প্রফেসর ফ্লিটউইকের দুই চোখের মাঝখানে আঘাত করল। ফুলে গেল জায়গাটা সবুজ হয়ে যাওয়া। এই ভাবে একটা না আরেকটা ঘটনার মধ্য দিয়ে যখন উইকএন্ড এলো তখন হ্যারি খুশিই হলো। সে, রন আর হারমিওন প্ল্যান করল শনিবার সকালে হ্যাগ্রিডের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। হ্যারিকে অবশ্য তার ওঠার কয়েক ঘন্টা আগেই গ্রিফিল্ডর কিডিচ টিমের ক্যাপ্টেন অলিভার উড ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে জাগল।

কি হয়েছেএএএ? আলসে গলায় বলল হ্যারি।

কিডিচ প্র্যাকটিস! বলল উড। এসো!

চোখ কুচকে হ্যারি জানালার দিকে তাকাল। গোলাপী এবং সোনালি আকাশ থেকে ক্ষীণ একটা কুয়াশা ঝুলে রয়েছে। এখন সে সম্পূর্ণ জেগে আছে, সে বুঝতে পারছে না কি করে সে পাখীর কলকাকলির মধ্যে সে ঘুমাতে পেরেছে।

অলিভার, মাত্র তো ভোর হয়েছে, হ্যারির গলা থেকে কোলা ব্যাঙের স্বর বের হলো।

একেবারে ঠিক, বলল উড। লম্বা এবং স্থূলকায় ও, উন্মাদ উৎসাহে চোখ জোড়া জ্বলছে। এটা আমাদের নতুন ট্রেনিং কর্মসূচির অংশ। জলদি ওঠো, ঝাড়ু নাও, চলে যাওয়া যাক, বলল উড উত্সাহের সঙ্গে। অন্য কোন টিমই প্র্যাকটিস শুরু করেনি, আমরাই এ বছর সবার আগে শুরু করবো…

হাই তুলতে তুলতে আর একটু কেঁপে উঠতে উঠতে হ্যারি বিছানা ছেড়ে উঠল এবং ওর কিভিচ পোশাক খোঁজার চেষ্টা করল।

এই তো লক্ষ্মী ছেলে, বলল উড। পনরো মিনিটের মধ্যে পিচে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

টকটকে লাল টিম পোশাকটা পেয়ে আলখাল্লাটাও গায়ে চাপিয়ে নিল হ্যারি। সে কোথায় কোথায় যাচ্ছে সে ব্যাপারে রনের উদ্দেশে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখল। নিম্বাস দুহাজারটা কাঁধে ফেলে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে একেবারে কমন রুমে। ছবির গর্তটার কাছে যেই পৌঁছেছে পেছনে ঠনঠন শব্দ শুনতে পেলো হ্যারি। দৌড়ে আসছে কলিন ক্রিভি পাগলের মতো। ওর ক্যামেরাটা ঝুলছে গলায়। হাতে যেন কি ধরা।

সিঁড়িতে কে যেন তোমার সম্পর্কে কথা বলছে হ্যারি! এটা দেখো ডেভেলপ করিয়েছি, তোমাকে দেওয়ার জন্যে এনেছি

ওর নাকের নিচে ছবিটা দোলাচ্ছে কলিন, হ্যারিকে হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে।

সাদা কালো ছবিতে নড়ছেন লকহার্ট, একটা হাতকে সবলে টানছেন তিনি, চিনতে পারল হ্যারি, হাতটা ওর নিজের। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ও আসতে চাচ্ছে না, ক্যামেরার সামনে টানার বিরুদ্ধে বেশ বাধাই দিচ্ছে, খুশি হলো হ্যারি। হ্যারি দেখছে, লকহার্ট শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হলেন এবং ছবির সাদা কোণাটায় গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ধপ করে বসে পড়লেন।

তুমি কি এটা সই করবে? আগ্রহের সঙ্গে বলল কলিন।

না। সোজাসাপটা বলল হ্যারি। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিল, সত্যিই কেউ নেইতো। সরি কলিন, আমাকে যেতে হবে–কিডিচ প্র্যাকটিস আছে।

ছবির গর্তের ভেতর উঠে গেল হ্যারি।

ওহ ওঔ! আমার জন্যে অপেক্ষা করো! আমি কখনো আগে কিডিচ খেলা দেখিনি।

কলিনও ওর পেছন পেছন গর্তে উঠল।

সত্যি ওটা একেবারেই বিরক্তিকর হবে, বলল হ্যারি, কিন্তু কলিন ওর কথায় কান দিল না, ওর চোখমুখ উত্তেজনায় জ্বল জ্বল করছে।

একশ বছরের মধ্যে তুমিই তো সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার, তাই না হ্যারি? তাই? বলল কলিন তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে। তুমি নিশ্চয়ই অসাধারণ। আমি কখনও উড়িনি। ব্যাপারটা কি সহজ? ওটা কি তোমার নিজের ঝাড়ু? এখানে যতগুলো আছে ওর মধ্যে ওটাই কি সবচেয়ে ভাল?

ওর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হ্যারির জানা ছিল না। যেন একটা সাংঘাতিক রকমের বাচাল ছায়া।

আমি সত্যিই কিডিচ খেলাটা বুঝি না, বলল কলিন এক নিঃশ্বাসে। এটা কি সত্যি যে এই খেলায় চারটি বল ব্যবহার হয় এবং এর মধ্যে দুটো আকাশে উড়তে থাকে প্লেয়ারদেরকে তাদের ঝাড়ু থেকে ফেলে দেয়ার জন্য?

হা, ভারি গলায় বলল হ্যারি, হাল ছেড়ে দিয়ে কিডিচ খেলার জটিল নিয়মগুলো ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হলো। ওগুলোকে ব্লাজার্স বলে। প্রত্যেক টিমে দুজন করে বিটার থাকে, এদের কাজই হলো ওদের দিক থেকে ব্লাজার্স দুটোকে পিটিয়ে দূরে রাখা। গ্রিফিল্ডরের দুজন বিটার হচ্ছে ফ্রেড এবং জর্জ উইসলি।

অন্য বল দুটো কি জন্যে? কলিন জিজ্ঞাসা করল। হোঁচট খেল সে, হা করে হ্যারির দিকে চেয়ে হাঁটছিল বলে।

বেশ, কোয়াফল মানে–ওই বড় লাল বলটা ওটাই গোল করে। এক এক টিমের তিনজন করে চেসার, নিজেদের মধ্যে কোয়াফলটা ছুঁড়ে পিচের শেষ প্রান্তের পোস্টে গোল করার চেষ্টা করে গোল পোস্টে তিনটি লম্বা খুঁটি মাথায় ধাতব বলয় আটকানো থাকে।

আর চতুর্থ বলটা

-এটা হচ্ছে গোল্ডেন স্নিচ, বলল হ্যারি, এটা খুবই ছোট, খুবই দ্রুত এবং ধরা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু ওই কাজটিই সিকারদের করতে হয়, কারণ কিডিচ খেলা কখনই শেষ হয় না যতক্ষণ না স্নিচটা ধরা হচ্ছে। যখনই একজন সিকার স্নিচটাকে ধরবে, তখনই সে তার দলের জন্যে অতিরিক্ত দেড়শত পয়েন্ট অর্জন করবে।

এবং তুমিই হচ্ছে গ্রিফিন্ডরের সিকার, তাই না? বলল কলিন বিস্ময়ে।

হ্যাঁ, বলল হ্যারি, প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওরা শিশির ভেজা মাঠ পেরোতে শুরু করল। একজন কীপারও রয়েছে, সে গোলপোস্ট রক্ষা করে। ব্যস এটাই কিডিচ খেলা।

কিন্তু লন পেরিয়ে একেবারে কিডিচ পিচ পর্যন্ত যেতে যেতে কলিনের প্রশ্ন থামল না কিছুতেই, শুধু মাত্র ড্রেসিং রুমে যাওয়ার সময় হ্যারি ওকে পিছু ছাড় করতে পারল। তবুও ওকে পেছন থেকে চিকন গলায় ডেকে বলল কলিন, যাই আমি একটা ভাল বসার জায়গায় যাই, হ্যারি! দ্রুত চলে গেলে ও স্ট্যান্ডের দিকে।

গ্রিফিল্ডর টিমের অন্যরা আগেই ড্রেসিং রুমে চলে এসেছে। এর মধ্যে উডই একমাত্র ব্যক্তি যাকে দেখা যাচ্ছিল সম্পূর্ণ জাগ্রত। ফ্ৰেড় আর জর্জ উইসলি বসে আছে, চোখ ফোলা আর উস্কোখুস্কো চুল, পাশেই ফোর্থ ইয়ারের অ্যালিসিয়া স্পিনেট, মনে হচ্ছে ও ঘুমেও ঢলেই পড়ে যাবে। ওর সাথের চেসার ক্যাটি বেল আর অ্যাঞ্জেলিনা জনসন পাশাপাশি বসে হাই তুলছে।

এই যে হ্যারি, এত দেরি হলো যে? উড বলল দ্রুত। পিচে যাওয়ার আগে তোমাদের সকলে সঙ্গে আমি জরুরি কিছু কথা বলে নিতে চাই, কারণ এই গ্রীষ্মে আমি ট্রেনিং-এর একটা সম্পূর্ণ নতুন কর্মসূচি বের করেছি, আমার মনে হয় এটাই একেবারে অন্য স্তরে নিয়ে যাবে…

কিডিচ পিচের একটা বড়সড় ডায়গ্রাম বোর্ড উডের হাতে, বিভিন্ন রঙের কালিতে লাইন টেনে, তীর আর ক্রস আঁকা হয়েছে। জাদুদণ্ডটা বের করে বোর্ডের ওপর টোকা দিতেই তীরগুলো ডায়গ্রামের ওপর শুয়োপোকার মতো চলতে শুরু করল। এবার উড তার নতুন কৌশল সম্পর্কে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিতে শুরু করতেই আলিসিয়ার কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ল প্যেড উইসলির মাথা এবং নাক ডাকতে শুরু করল তার।

প্রথম বোর্ডটা বোঝাতে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে গেল, এর নিচে আরো একটি বোর্ড ছিল এবং তারও নিচে তৃতীয় আরো একটা বোর্ডও ছিল। উড একঘেয়ে স্বরে বলে যেতেই লাগল এদিকে হ্যারিকে মনে হচ্ছে, প্রায় অচেতন।

তাহলে, বলল উড অবশেষে, হ্যারিকে একটা স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে, বেচারা হ্যারি এইমাত্র স্বপ্ন দেখছিল ক্যাসল-এ বসে সে কি নাস্তা খাবে, সব পরিস্কার তো, কোন প্রশ্ন আছে?

আমার একটি প্রশ্ন আছে, অলিভার, বলল জর্জ, চমকে উঠে। কাল যখন আমরা জেগে ছিলাম তখন এসব আমাদের কেন বললে না?

খুব খুশি হলো না উড।

এখন, আমার কথা শোন সবাই,ক্রুদ্ধভাবে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল সে, গত বছরই আমাদের কিডিচ কাপ জেতা উচিৎ ছিল। আমরাই ছিলাম সবার সেরা টিম। কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের সব অবস্থার জন্যে…

হ্যারি অপরাধীর মতো নিজের সিটে নড়ে বসল। সে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ছিল, তার মানে গ্রিফিল্ডর হাউজকে একজন প্লেয়ার কম নিয়ে খেলতে হয়েছে। এবং গত তিনশ বছরের ইতিহাসে তাদেরকে সবচেয়ে বিপর্যকরভাবে হারতে হয়েছিল।

এক মুহূর্ত ব্যয় করল উড নিজেকে সামলে নিতে। সর্বশেষ পরাজয়টা ওকে এখনও পীড়া দিচ্ছে।

তাহলে, এ বছর আমরা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি প্র্যাকটিস করবো…ও,কে, এখন চলো আমাদের নতুন থিওরিগুলো প্র্যাকটিস করে দেখি! উড চিৎকার করে উঠল, নিজের ঝাড়ুদণ্ডটা সবেগে তুলে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে সকলকে ড্রেসিং রুমের বাইরে নিয়ে গেল। পা তখনও জমে আছে হাই তুলতে তুলতে তার টিম অনুসরণ করল।

এত দীর্ঘ সময়ের জন্য ওরা ড্রেসিং রুমে ছিল যে ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। যদিও স্টেডিয়ামের মাঠের ঘাসে এখনও কুয়াশার পাতলা আবরণ লেগে আছে। পিচে গিয়ে হ্যারি দেখল রন আর হারমিওন ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

তোমাদের এখনও শেষ হয়নি? জানতে চাইল রন অবিশ্বাসের সঙ্গে।

শুরুই হয়নি এখনও, বলল হ্যারি, গ্রেট হল থেকে আনা রন আর হারমিওনের টোস্ট আর মোরব্বার দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে। উড আমাদের নতুন কিছু কৌশল শেখাচ্ছিল।

ঝাড়ুদণ্ডে চড়ে মাটিতে লাথি মারল হ্যারি, সা করে অনেক উঁচুতে উঠে গেলো। সকালের ঠান্ডা বাতাস ওকে একেবারে পুরোপুরি জাগিয়ে দিল, উডের দীর্ঘ আলোচনার চেয়ে অন্তত বেশি কার্যকরভাবে। কিডিচ পিচে ফিরে এসে চমৎকার লাগছে। ফ্রেড আর জর্জের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে ডান দিকে ঘুরে পূর্ন গতিতে স্টেডিয়াম চক্কর দিল।

ওই অদ্ভুত শব্দটা কি ক্লিক করছে? জিজ্ঞাসা করল ফ্রেড কোনাটা সবেগে ঘুরে আসতে আসতে।

হ্যারি স্ট্যান্ডের দিকে তাকাল। সবচেয়ে উঁচু সিটগুলোর একটাতে কলিন বসে আছে। ছবির পর ছবি তুলছে। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দটা প্রায় জনশূন্য স্টেডিয়ামে অদ্ভুতভাবে বহুগুণে বর্ধিত হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে তাকাও, হ্যারি! এদিকে? চিকন গলায় চিৎকার করছে ও।

কে ওটা? বলল ফ্রেড।

কোন ধারণা নেই, মিথ্যা বলল হ্যারি, গতি বাড়িয়ে দিল যে কলিনের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে যাওয়া যায়।

কি হচ্ছে এখানে? ঊড জিজ্ঞাসা করল, ভ্রূ কুঁচকে, বাতাস কেটে ওদের দিকে যেতে যেতে। ওই ফাস্ট–ইয়ারটা ছবি তুলছে কেন? আমার এটা পছন্দ হচ্ছে না। ও সিথারিনদের চরও হতে পারে, আমাদের নতুন ট্রেনিং প্রোগ্রাম সম্পর্কে জেনে নিচ্ছে।

গ্রিফিল্ডরেই আছে ও, তাড়াতাড়ি বলল হ্যারি। এবং গ্রিফিন্ডরদের কোন চরেরও দরকার হবে না, অলিভার, বলল জর্জ।

কি দেখে ওরকম বলছ, বলল উড।

কারণ, ইতোমধ্যে ওরা সশরীরেই এখানে চলে এসেছে, বলল জর্জ ওদেরকে দেখিয়ে।

সবুজ পোশাক পরা কয়েকজন পিচে চলে আসছে হেঁটে, কাঁধে ঝাড়ুদণ্ড।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! রাগে হিসহিস করে উঠল ঊড। আমি সারা দিনের জন্য পিচটা বুক করেছি! ঠিক আছে দেখা যাবে।

উড মাটির দিকে সবেগে নামল, রাগের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে। একটু টলমল করে ঝাড়ু থেকে নামল ও। হ্যারি, ফ্রেড এবং জর্জ ওকে অনুসরণ করল।

ফ্লিন্ট! স্লিথারিনের ক্যাপ্টেনের উদ্দেশে গর্জন করে উঠল উড। এটা আমাদের প্র্যাকটিসের সময় এর জন্যে আমরা মাঠে এসেছি! তোমরা এখন যেতে পারো!

মার্কাস ফ্লিন্ট উডের চেয়েও বিশাল। জবাব দেয়ার সময় দুবৃত্তসুলভ ধূর্ততা ওর মুখে, আমাদের সকলের জন্যেইতো অনেক জায়গা রয়েছে,উড়।

অ্যাঞ্জেলিনা আলিসিয়া এবং কেটিও এগিয়ে এসেছে। মিথারিন টিমে এনি কোন মেয়ে নেই–যারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, গ্রিফিল্ডরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপাঙ্গে তাকাতে পারে।

কিন্তু আমিই তো পিচটা বুক করেছি! বলল উড, রাগের সঙ্গে থুতু ফেলে। আমি বুক করেছি।

আহ, বলল ফ্লিন্ট, কিন্তু আমার কাছে তো রয়েছে প্রফেসর স্নেইপ-এর বিশেষভাবে স্বাক্ষর করা একটি চিরকুট। আমি প্রফেসর এস.স্নেইপ, স্লিথারিন টিমকে, ওদের নতুন সিকারকে ট্রেনিং দেয়ার প্রয়োজনে কিডিচ পিচে আজ প্র্যাকটিস করবার জন্যে অনুমতি দিচ্ছি।

তোমরা একজন নতুন সিকার নিয়েছ? বলল উড মূল বিষয় থেকে সরে গিয়ে। কোথায়?

এবং দশাসই মানুষের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো সপ্তম জন, ছোট্ট একজন বালক, পান্ডুর সূচালো মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি। বালকটি ড্র্যাকো ম্যালফয়।

তুমি কি লুসিয়াস ম্যালফয়-এর পুত্র নও? বলল ফ্রেড, ম্যালফয়ের দিকে তাকিয়ে, দৃষ্টিতে পরিষ্কার অপছন্দের ছাপ।

মজার ব্যাপার তুমি ড্র্যাকোর বাবার নামটাই বললে, বলল ফ্লিন্ট, পুরো স্লিথারিন টিমটারই মুখের হাসি আরো চওড়া হলো। তিনি সিথারিন টিমকে যে সহৃদয় উপহারটা দিয়াছেন দাঁড়াও সেটা তোমাকে দেখাই।

সাতজনই তাদের ঝাড়ুলাঠি বাড়িয়ে ধরল। সাতটি অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে চকচক করা, একেবারে নতুন হ্যান্ডল এবং সাত সেট চমৎকার সোনালি অক্ষরে লেখা নিম্বাস দুই হাজার এক সকালের রোদ্দুরে ঝলসে উঠল গ্রিফিল্ডরদের নাকের সামনে।

একেবারে লেটেস্ট মডেলের। মাত্র বেরিয়েছে গত মাসে, বলল ফ্লিন্ট নিস্পৃহভাবে, ওর নিজের ঝাড়ুলাঠির প্রান্ত থেকে এক কণা ধুলো ঝাড়ুতে ঝাড়ুতে। আমার বিশ্বাস এটা বেশ উল্লেখযোগ্যভাবেই পুরনো নিম্বাস দুই হাজারকে ছাড়িয়ে যাবে। আর পুরনো ক্রিমসুইপগুলো, সে নোংরাভাবে ফ্রেড আর জর্জের দিকে তাকিয়ে হসল, ওরা দুজনেই ওদের ক্লিনসুইপ পাঁচ আঁকড়ে ধরুল, নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের বোর্ডও মুছে।

এক মুহূর্তের জন্যে গ্রিফিল্ডরের কেউই বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। ম্যালফয়ের আত্মতৃপ্তির হাসিটা বড় হতে হতে, ওর চোখ জোড়া একেবারে সরু হয়ে গেছে।

ওহ! দেখো, বলল ফ্লিন্ট। পিচ দখলের হামলা।

রন আর হারমিওন ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে, কি ঘটছে তা পরখ করার জন্যে।

কি হচ্ছে? রন জিজ্ঞাসা করল হ্যারিকে। তোমরা খেলছ না কেন? আর ও এখানে কি করছে?

ম্যালফয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও, চোখটা স্লিথারিন কিডিচ জার্সির দিকে।

আমি নতুন স্লিথারিন সিকার, উইসলি, বলল ম্যালফয় তৃপ্ত স্বরে। আমার বাবা আমাদের টিমের জন্য যে ঝাড়ুগুলো কিনে দিয়েছেন সকলেই সেগুলোর প্রশংসা করছে।

রন ঢোক গিলল, হা করে তাকিয়ে থাকল তার সামনের সাতটি অপূর্ব ঝাডুলাঠির দিকে।

ভাল, তাই না? আস্তে করে বলল ম্যালফয়। হয়তো গ্রিফিল্ডর টিমও হয়তো কিছু স্বর্ণমুদ্রা জোগাড় করে নতুন কিনে নিতে পারবে। ওই ক্লিনসুইপ পাঁচ গুলোকে এবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে। আমার মনে হয় হয়তো কোন জাদুঘর ওগুলোর নেয়ার জন্যে আগ্রহী হবে।

স্লিথারিন টিম এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

গ্রিফিল্ডর টিমে অন্তত কাউকে পয়সা দিয়ে নিজের জায়গা কিনতে হয় না। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল হারমিওন। তারা জায়গা পায় শুধু প্রতিভার জোরে।

ম্যালফয়ের চেহারা থেকে আত্মতৃপ্তির হাসিটা নিভে গেল। তোমার মতামত কেউ চায়নি, নোংরা মাডব্লাড, থু থু ফেলল ম্যালফয়।

সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি বুঝতে পারল, ম্যালফয় সাংঘাতিক খারাপ কিছু বলেছে। কারণ ওর কথা শেষ না হতেই তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। ফ্লিন্টকে ম্যালফয়ের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে ফ্রেড আর জর্জের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলো। অ্যালিসিয়া চিৎকার করে উঠল, তোমার এত বড় সাহস রন পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল, বের করে আনল ওর জাদুদণ্ডটা, চিৎকার করে ঊঠল, তোমাকে এর জন্যে মূল্য দিতে হবে, ম্যালফয়! ফ্লিন্টো হাতের নিচ দিয়েই ওটা সে ম্যালফয়ের মুখের দিকে তাক করল ক্ষিপ্ত রন।

আকস্মিক প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা স্টেডিয়াম জাদুদরে উল্টো দিক থেকে সবুজ আলোর একটা তীব্র ঝলক বেরিয়ে রনেরই পেটে আঘাত করে ওকে একেবারে ঘাসের ওপর আছড়ে ফেলল।

রন। রন! তুমি ঠিক আছে তো? আর্ত চিৎকার করে উঠল হারমিওন।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলল রন, কি কোন কথা বের হলো না। পরিবর্তে সর্বশক্তি দিয়ে ঢেকুর দিল রন আর তার মুখ দিয়ে কয়েকটা অসম আকৃতির বুলেট বেরিয়ে কোলের উপর পড়ল।

হাসিতে যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলো স্লিথারিন টিম। হাসির দমকে বেঁকে একেবারে দ্বিগুণ হয়ে গেলো ফ্লিন্ট, ভর করে আছে নতুন তার ওপর। চার হাতপায়ে ভর করে মাটিতে সজোরে ঘুষি মারছে ম্যালফয়। গ্রিফিনরা রনকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, আরো বড় বড় চকচকে বুলেট মুখ দিয়ে উদগিরণ করছে সে। তবুও কেউ যেন ওকে ধরতে চাইছে না।

ওকে হ্যাগ্রিডের কাছেই নিয়ে যাওয়া ভাল, কারণ ওর বাসাটাই কাছে, বলল হ্যারি হারমিওনকে, সাহসের সঙ্গে মাথা নাড়ল সে, ওরা দুজন মিলে রনকে হাত ধরে টেনে তুলল।

কি হয়েছে, হ্যারি? কি হয়েছে? ও কি অসুস্থ কিন্তু তুমি তো ওকে সুস্থ করে তুলতে পারবে, পারবে না? আসন ছেড়ে দৌড়ে এসে ওরা যখন পিচ ত্যাগ করছে তখন ওদের পাশে যেতে যেতে বলছে কলিন। রন একটা শ্বাস ছাড়ল আরো কয়েটা বুলেট ওর মুখ গলে সামনে পড়ল।

উহহহ, বলল চমৎকৃত কলিন ক্যামেরা তুলে, ওকে একটু স্থির করে ধরতে পারো?

সামনে থেকে সরো কলিন! ক্ষেপে গেছে হ্যারি। সে আর হারমিওন রনকে ধরে স্টেডিয়াম থেকে বের করে বনের কিনারার দিকে নিয়ে এলা।

ওই তো ওর কাছেই, রন, বলল হারমিওন, যখন খেলার শিক্ষকের কেবিনটা নজরে পড়ল। এক মিনিটের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে…প্রায় পৌঁছে গেছি…

ওরা যখন হ্যাগ্রিডের বাসার কুড়ি গজের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন সামনের দরজাটা খুলে গেলো, কিন্তু যিনি বেরিয়ে এলে তিনি হ্যাগ্রিড নন। গিল্ডরয় লকহার্ট উজ্জ্বল বেগুনি রঙের সবচেয়ে ফ্যাকাসে পোশাকটা পড়ে বেরিয়ে এলেন।

জলদি করো, এই যে এখানে, চাপা স্বরে বলল, হ্যারি, রনকে টেনে কাছের একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে যেতে যেতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হারমিওন ওকে অনুসরণ করল।

তুমি যদি জানো ঠিক কি করছ, তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ! লকহার্ট উচ্চস্বরে হ্যাগ্রিডের উদ্দেশে বলছেন। যদি সাহায্যের দরকার হয়, তুমি জানো আমি কোথায় থাকব! আমার বইয়ের একটা কপি তোমাকে দেবো–আশ্চর্য তুমি এখনও পাওনি। আজ রাতে স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দেবো। আচ্ছা, বিদায়! হেঁটে প্রাসাদের দিকে চলে গেলেন লকহার্ট।

লকহার্ট দৃষ্টির বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, রনকে ঝোপ থেকে তুলে বের করে হ্যাগ্রিডের দরজা পর্যন্ত নিয়ে এলো। দ্রুত নক করল।

হ্যাগ্রিড এলো সঙ্গে সঙ্গে। মেজাজ খারাপ। কিন্ত্র দরজা খুলে আগন্তুককে দেখে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেল।

ভাবছিলাম তোমরা কখন আমাকে দেখতে আসবে–ভেতরে এসো, ভেতরে এসো, ভেতরে এসো ভেবেছিলাম প্রফেসর লকহার্টই আবার এসেছেন।

হ্যারি আর হারমিওন দরজা দিয়ে রনকে নিয়ে গেল এক রুমের কেবিনের ভেতরে। এক কোণায় একটি মাত্র বিশাল একটা খাট আরেক কোণায় চুলীতে আগুন জ্বলছে শব্দ করে। বনের সমস্যায় হ্যাগ্রিডকে খুব একটা বিচলিত দেখালো না। এর আগে হ্যারি ব্রনকে একটা চেয়ারে বসিয়ে সমস্যাটা সংক্ষেপে হ্যাগ্রিডের কাছে ব্যাখ্যা করেছে।

ভেতরে থাকার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়াই ভাল, খোশ মেজাজে বললেন হ্যাগ্রিড, রনের সামনে বড় একটা তামার গামলা বসাতে বসাতে। সবগুলো বের করে দাও।

আমার মনে হয় না ওগুলো নিজে থেকে সব বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, উদ্বেগের সাথে বলল হারমিওন। জন আবার উবু হলো গামলার ওপর। ভাল সময়ই অমন একটা শাপ কার্যকর করা খুবই কঠিন আর একটা ভাঙ্গা জাদুদণ্ড দিয়ে…

এদিক ওদিক ব্যস্ত হ্যাগ্রিড। ওর কুকুর ফ্যাং হ্যারির দিকে তাকিয়ে লালা ঝরাচ্ছে।

ফ্যাঙের কান চুলকে দিয়ে হ্যারি জিজ্ঞাসা করল, প্রফেসর লকহার্ট আপনার কাছে কি চেয়েছিল, হ্যাগ্রিড?

আমাকে উপদেশ দিচ্ছিলেন, কি করে কুয়া থেকে সামুদ্রিক গুল্ম তুলতে হয়, ক্ষিপ্ত হ্যাগ্রিড বললেন। টেবিলের ওপর থেকে অর্ধেক পাখা তোলা মুরগীটা সরিয়ে টি–পটটা রাখলেন। যেন আমি জানি না আরকি। যেন কোন অশরিরী আত্মা যাকে সে নির্বাসিত করেছে তার ওপর আমি ঝাঁপিয়ে পড়ছি। এর এক বর্ণও যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আমার কেটলি খাব।

হোগার্টস্-এর কোন শিক্ষকের সমালোচনা করা, হ্যাগ্রিডের জন্য অস্বাভাবিক বটে, অবাক হয়ে তারি তাকিয়ে রইল। হারমিওনও কথা বলল, তবে তার চেয়ে যা স্বাভাবিক তার চেয়ে উচ্চস্বরে, আমার মনে হচ্ছে আপনিও ঠিক করছেন না। প্রফেসর ডাম্বলডোর স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছেন তিনিই কাজটির জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত

সেই কাজটার জন্যে একমাত্র ব্যক্তি, বললেন হ্যাগ্রিড ওদের দিকে এক প্লেট গুড়ের সন্দেশ এগিয়ে দিতে দিতে, রন তখনও গামলার ভেতর উগড়ে চলেছে। এবং আমি বোঝাতে চাইছি একমাত্রই। কালো জাদু প্রতিরোধ বিষয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়াও কঠিন। দেখো এই বিষয়টা পড়ার ব্যাপারে কেউ খুব বেশি আগ্রহীও নয়। সবাই ভাবতে শুরু করেছে বিষয়টা দুর্লক্ষণযুক্ত, দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। এখন আর কেউ এ বিষয়ে বেশিদিন টেকে না। এখন আমাকে বলো তো, বলল হ্যাগ্রিড, রনের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে, ও কাকে শাপগ্রস্ত করতে যাচ্ছিল?

ম্যালফয় হারমিওনকে গালি দিয়েছে, গালিটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ হবে, কারণ ওটা শোনার পর সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।

সত্যিই খারাপ ছিল বলল, টেবিলের ওপর মাথা তুলে ভাঙ্গা গলায় বলল রন, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চেহারা ঘাম ঝরছে। ম্যালফয় ওকে মাডব্লাড বলে গালি দিয়েছে, হ্যাগ্রিড–

রন আবার উবু হয়ে ভেতর থেকে উঠে আসা ধাতব গুলি ওগলাতে শুরু করল। হ্যাগ্রিডকে ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে।

দিয়েছে! হারমিওনের দিকে চেয়ে গর্জে উঠল হ্যাগ্রিড।

হ্যা দিয়েছে, বলল সে, কিন্তু আমি এর মানে জানি না। আমি শুধু বলতে পারি সত্যি অভদ্র ছিল ওর আচরণ, অবশ্য–

ওটা ছিল সবচেয়ে অপমানকর ব্যাপার, দম নিয়ে বলল রন, আবার সোজা হয়ে বসেছে সে। মাডব্লাড হচ্ছে মাগল পরিবারে মানে যার বাবা-মা জাদুকর নয়, তেমন এক বাবা-মায়ের সন্তানের জন্য সবচেয়ে জঘন্য খারাপ গালি। কোন কোন জাদুকর রয়েছে–যেমন ম্যালফয়ের ফ্যামিলি–যারা ভাবে যে তারা হচ্ছে ওই যে কি বলে না বিশুদ্ধ রক্ত–সে জন্যেই অন্যদের চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ। একটা ঢেকুর দিল রন, ওর বাড়ানো হাতে একটা গুলি পড়ল। ওটা গামলায় ফেলে ও বলতে লাগল, অবশ্য অবশিষ্ট আমরা জানি এর কোন মানে নেই এবং এর ফলে কোন পার্থক্যও হয় না। নেভিল লংবটমকে দেখো ও তো বিশুদ্ধ রক্ত তবুও তো একটা বড় কড়াই পর্যন্ত সঠিকভাবে খাড়া করে রাখতে পারে না।

এবং এখনও এমন কোন মায়া আবিস্কৃত হয়নি যা কি না হারমিওন করতে পারে না, হ্যাগ্রিড বলল গর্বভরে, সঙ্গে সঙ্গে হারমিওনের চেহারাটা একেবারে টকটকে লাল।

খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার কাউকে,কাঁপা হাতে ঘামে ভেজা ভ্রূ দুটো মুছে বলল রন। বদ রক্ত, মানে সাধারণ রক্ত। এটা পাগলামি। আজকাল বেশিরভাগ জাদুকর যেভাবেই হোক মিশ্রিত রক্তের। আমরা যদি মাগলদের বিয়ে না করতাম, তাহলে কবে মরে ভূত হয়ে যেতাম।

আবার উবু হয়ে মাথা নোয়ালো সে।

বেশ, ওকে শাপ দেয়ার চেষ্টা করবার জন্যে আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি রন, বলল হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে, গামলায় ধাতব গুলি পড়ার শব্দকে ছাপিয়ে। ভালই বোধহয় হয়েছে যে তোমার জাদুদণ্ডটা উল্টো তোমাকেই শাপগ্রস্ত করেছে। না হলে, লুসিয়াস ম্যালফয় দৌড়ে স্কুলে চলে আসত, তুমি ওর ছেলেকে শাপগ্রস্ত করলে। আর যাই হোক তুমি মুশকিলে তো পড়নি।

হ্যারি বলতে চেয়েছিল সমস্যা যা হয়েছে তা শুধু মুখ দিয়ে ধাতব গুলি ওগলানো এর বেশি কিছু নয়, কিন্তু বলতে পারল না, হ্যাগ্রিডের মিষ্টি টফি ওর চোয়ালগুলো যেন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে।

হ্যারি, বলল হ্যাগ্রিড হঠাৎ, যেন কোন আকস্মিক চিন্তা ওর মনে খেলে গিয়েছে, তোমার কাছে কি খোঁচা দেয়ার মতো কাটা রয়েছে। শুনেছি তুমি আজকাল ছবিতে সই দিতে শুরু করেছে। আমি একটাও পেলাম না এটা কেমন কথা?

এতই রাগ হলো হ্যারির যে, যেন চোয়াল টেনে দাঁত আলাদা করল সে।

আমি কোন ছবিতে সই দিইনি, উত্তপ্ত স্বরে বলল সে। যদি এখনও লকহার্ট ওসব বলে বেড়াতে থাকে

এতক্ষণে খেয়াল করল সে, হ্যাগ্রিভ হাসছে।

আমি জোক করছিলাম, বলল সে, আদর করে হ্যারির পিঠে চাপড় দিয়ে। ওকে টেবিলের দিক মুখ করে ঠেলে দিয়ে যোগ করল, আমি জানি তুমি সে রকম কিছু করনি। আমি লকহার্টকে বলেছি তোমার ওরকম করারই দরকার নেই। চেষ্টা না করেই তুমি ওর চেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে গেছ।

বাজি ধরে বলতে পারি তিনি সেটা পছন্দ করেননি, উঠে বসে বলল হ্যারি, এক হাতে থুতনিটা ঘষতে ঘষতে।

মনে হয় না পছন্দ করেছে, বলল হ্যাগ্রিড ওর চোখ পিট পিট করছে। এরপর আমি বললাম ওর একটাও বই পড়িনি এবং সে চটে গেল। গুড়ের টফি? শেষের কথাটা রনের উদ্দেশে বলা, উবু হয়ে থাকা রন আবার সোজা হয়ে মাথা তুলেছিল।

না ধন্যবাদ, বলল রন, ঝুঁকি না নেয়াই ভাল।

হ্যারি আর হারমিওন ওদের চা শেষ করল, হ্যাগ্রিড ডাকল ওদের, এসে দেখে যাও আমি যে সবজির চাষ করছি।

বাড়ির পেছনের শব্জির ছোট্ট বাগানটায় প্রায় এক ডজন মিষ্টি কুমড়ো, এক একটার সাইজ বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইয়ের সমান। হ্যারি এত বড় কুমড়ো আগে কোনদিন দেখেনি।

বেশ বড়সড় হয়েছে তাই না? বলল হ্যাগ্রিড খুশি হয়ে। ওগুলো হ্যালোঈন উৎসবের জন্যে… ততদিনে যথেষ্ট বড় হয়ে যাবে সন্দেহ নেই।

গাছ গুলোকে কি খাওয়াচ্ছো? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল হ্যাগ্রিড ওরা একা কি না।

খাওয়া, মানে আমি ওদেরকে দিচ্ছিলাম–তুমি জানোতো মানে এই একটু বাড়তি সাহায্য আর কি।

হ্যারি লক্ষ্য করেছে হ্যাগ্রিডের ফুল ছাপানো গোলাপী ছাতাটা কেবিনের পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। হ্যারির বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে হ্যারির ছাতাটা যা দেখায় শুধু তাই নয় অর্থাৎ শুধু ছাতা নয়; বস্তুত, ওর দৃঢ় বিশ্বাস যে হ্যাগ্রিডের পুরনো স্কুল–জাদুদণ্ডটা ওটার ভেতরেই লুকনো রয়েছে। হ্যাগ্রিডের ম্যাজিক ব্যবহার করার কথা নয়। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ই হোগার্টস থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। হ্যারি অবশ্য কোন সময়ই কারণটা জানতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে কখনও কথা উঠলেই হ্যাগ্রিড জোরে গলা খাকারি দিত এবং প্রসঙ্গ পাল্টানো না পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে চুপ হয়ে যেত।

আমার মনে হয় ভেতর থেকে বড় করার জাদুর প্রয়োগ করা হয়েছে? বলল হারমিওন, অর্ধেক অননুমোদন অর্ধেক মজা পাওয়ার স্বরে। বেশ, কাজটা ভালই করেছ।

তোমার ছোট বোনটিও ঠিক তাই বলেছিল,রনের দিকে মাথা নেড়ে বলল হ্যাগ্রিড। গতকালইমাত্র ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। হ্যাগ্রিড বাঁকা চোখে হ্যারির দিকে একটু তাকাল, ওর দাঁড়ি মোচড়াচ্ছে। আমাকে অবশ্য ও বলেছিল ও শুধু জায়গাটা দেখে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয় ও আশা করেছিল আমার বাড়িতে অন্য কারো দেখা পাবে। ও হ্যারির দিকে চেয়ে চোখ টিপল। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর তাহলে, ও স্বাক্ষর করা একটা

ওহ, চুপ করো তো, বলল রন। রন হেসে উঠল, মাটিতে অনেকগুলো বুলেট ছড়িয়ে পড়ল।

সাবধান! দেখে, হ্যাগ্রিড চিৎকার করে উঠল, রনকে ওর মহামূল্যবান কুমড়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনল।

দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, সকালে হ্যারি একটা মাত্র গুড়ের পিঠা খেয়েছে, খিদেয় ওর পেট চো চো করছে, খাওয়ার জন্যে স্কুলে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেই এখন ওর আগ্রহ বেশি। হ্যাগ্রিডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা ক্যাসলের ফিরে এলো। মাঝে মাঝে কাশছে রন। মাত্র দুটো খুবই ছোট বুলেট বের হলো ওর পেট থেকে।

সবেমাত্র ওরা হলে পা রেখেছে, অমনি শোনা গেলো কন্ঠস্বর। এই যে পটার এবং উইসলি, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ওদের দিকে হেঁটে আসছেন, চেহারায় কাঠিন্য ফুটে রয়েছে। আজ সন্ধ্যাতেই তোমাদের শাস্তি শুরু হচ্ছে।

আমাদের কি করতে হবে প্রফেসর? বন জিজ্ঞাসা করল, নার্ভাস সে, পেট থেকে উঠে আসা আরেকটা ধাক্কা সামলে নিল কোনরকমে।

মিস্টার ফিলচের সঙ্গে ট্রফি রুমের রূপার ট্রফিগুলো পলিশ করবে, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। কিন্তু কোন ম্যাজিক নয়, উইসলি–

রন ঢোক গিলল। অরগাস ফিলচ, কেয়ারটেকার, স্কুলের সব ছাত্রই যাকে ঘৃণা করে।

আর তুমি পটার, প্রফেসর লকহার্টকে তার চিঠির জবাব দিতে সাহায্য করবে।

ওহ না– আমিও কি ট্রফি রুমে যেতে পারি না? হ্যারি মরিয়া হয়ে বলল।

নিশ্চয়ই না, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ভ্রূ কুঁচকে। প্রফেসর লকহার্ট ঠিক তোমার জন্যেই অনুরোধ জানিয়েছেন। ঠিক কাটায় কাটায় আটটায়, তোমরা দুজনেই।

গম্ভীর হতাশায় শ্রান্ত দু,জন দাঁড়িয়ে রইল, ওদের পেছনে হারমিওন, তোমরা–সকালের–নিয়ম–গোছের ভাব চেহারায়। হ্যারির কাছে খাবার আর ভাল লাগল না, খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন উবে গেছে। সে আর রন দুজনেই ভাবল সবচেয়ে খারাপ শাস্তিটাই ওরা পেয়েছে।

ফিলচ তো আমাকে সারারাতই খাটাবে, রন বলল ভারি গলায়। কোনো ম্যাজিক নয়! ওই রুমে নিশ্চয়ই একশ কাপ রয়েছে। মাগল বস্তু পরিস্কার করার ব্যাপারে আমি কোন দক্ষ নই।

আমি যে কোন সময়ই আমাদের কাজ বদল করব, বলল হ্যারি ফাঁকা স্বরে। ডার্সলিদের ওখানে আমার এ ব্যাপারে প্রচুর প্র্যাকটিস হয়েছে। কিন্তু লকহার্টের হয়ে ভক্তদের চিঠির জবাব দেওয়া… ওটা একটা দুঃস্বপ্ন হবে…

শনিবারের বিকেলটা যেন দ্রুত চলে গেল চুপিসারে এবং মনে হলো যেন কোন সময় না দিয়েই রাত আটটা বাজতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল। দ্বিতীয় তলার করিডোর দিয়ে হ্যারি পা টেনে রওয়ানা হলো লকহার্টের অফিসের উদ্দেশে। দাঁত কামড়ে সে লকহার্টের অফিসের দরজায় নক করল।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। লকহার্ট ওর দিকে তাকালো সহাস্যে।

আহ, এই যে এসেছে অপদার্থটা! বললেন তিনি। ভেতরে এসো, হ্যারি, ভেতরে এসো।

অনেক মোমবাতির আলো। ফ্রেমে বাঁধানো লকহার্টের অসংখ্য ছবি। কয়েকটি আবার স্বাক্ষরও করেছেন তিনি। ডেস্কের ওপর আরেকটি স্তূপ পড়ে রয়েছে।

তুমি এনভেলাপগুলিতে ঠিকানা লিখতে পারো! লকহার্ট এমনভাবে বললেন হ্যারিকে যেন বিরাট একটা মজার ব্যাপার। প্রথমটা যারে গ্লাডিস গাজিওনের কাছে, ইশ্বর তার মঙ্গল করন–আমার বিরাট ভক্ত।

শম্বুকের গতিতে সময় পার হচ্ছে। লকহার্ট বক বক করে যাচ্ছে, হ্যারি শুধু মাঝে মাঝে হুমম এবং ঠিক এবং ইয়েহ করছে। কখনও সখনও হ্যারি কানে একটা দুটো বাক্যাংশ আসছে, যেমন, খ্যাতি হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী, হ্যারি অথবা মনে রাখবে খ্যাতিমান হচ্ছে যেমন করবে তেমন।

মোমবাতি পুড়তে পুড়তে ছোট হয়ে এসেছে। আলো নাচছে লকহার্টের ছবিগুলোর ওপর, ওরা তাকিয়ে তাকিয়ে লকহার্টকেই দেখছে। ব্যাথায় জর্জর আঙুল, হ্যারি সম্ভবত হাজারতম এনভেলাপে ভেরোনিকা স্মেথলির ঠিকানা লিখেছে। এখন নিশ্চয়ই প্রায় যাবার সময় হয়ে এসেছে। হ্যারি, বিমর্ষভাবে ভাবল, এখনই যাওয়ার সময় হোক…।

এবং তারপর সে যেন কি শুনতে পেলো–নিভু নিভু মোমবাতির আওয়াজ এবং ভক্তদের সম্পর্কে লকহার্টের বকবকের চেয়ে আলাদা কিছু।

একটা গলার স্বর, এত শীতল যে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, একটা স্বর বরফ–শীতল বিষের চেয়েও ভয়ংকর, শ্বাসরুদ্ধকর।

এসো… আমার কাছে এসো… তোমাকে একটানে ছিঁড়ে ফেলি…তোমাকে ছিঁড়ে..তোমাকে হত্যা করি…

লাফিয়ে উঠল হ্যারি এবং ভেরোনিকা স্মেথলির স্ট্রীটে বিশাল একটা লাইলাকের ছাপ ভেসে উঠল।

কি হলো? জোরে বলল সে।

আমি জানি! বললেন লকহার্ট। ছয় মাস ধরে বেস্ট–সেলার তালিকার শীর্ষে! সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে গেছে।

না, বলল হ্যারি উন্মত্তের মতো, ওই কণ্ঠস্বরটা!

সরি? বলল লকহার্ট, ওঁকে বিমূঢ় দেখাচ্ছে। কোন কণ্ঠস্বর?

ওই–ওই যে কণ্ঠস্বর যে বলল–আপনি শোনেন নি?

অপার বিস্ময়ে লকহার্ট তাকিয়ে রইল হ্যারির দিকে।

তুমি কি বলছ, হ্যারি? মানে তোমার ঝিমুনি আসছে? হা ঈশ্বর–সময় দেখো কত হয়ে গেছে! আমরা এখানে প্রায় চার ঘণ্টা! আমার কখনই বিশ্বাস হয় না–সময় সত্যিই যেন উড়ে চলে গেছে, তাই না?

হ্যারি কোন জবাব দিল না। ওই ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে হ্যারি কান পেতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন কিছুই সে শুনতে পেল না। শুধু শুনল লকহার্ট বলছেন, পরবর্তীকালে শাস্তির এ রকম ভাল ব্যবহার সে আশা করতে পারে না। ঘুম পাচ্ছে, হ্যারি চলে এলো লকহার্টের অফিস থেকে।

এত রাত হয়েছে যে গ্রিফিল্ডর কমন রুম প্রায় খালি হয়ে গেছে। হ্যারি সোজা হোস্টেলে চলে গেলো। রন তখনও ফেরেনি। পাজামা পরে হ্যারি বিছানায় চলে গেলো। অপেক্ষা করছে হ্যারি। আধঘণ্টা পর রন এলো, ডান হাত মালিশ করতে করতে, অন্ধকার ঘরটায় পলিশের তীব্র গন্ধ নিয়ে।

আমার সবগুলো মাসল জাম হয়ে গেছে, কঁকিয়ে উঠল বিছানায় শুয়ে। চোদ্দবার সে আমাকে দিয়ে ওই কিডিচ কাপটা মুছিয়ে তারপর সন্তুষ্ট হয়েছে। তারপর আবার বুলেট–বমি হতে শুরু করল সবগুলো গিয়ে পড়ল, স্কুলে সার্ভিস দেয়ার জন্যে বিশেষ পদকটির উপর। এক যুগ লেগে গেল সব পরিস্কার করতে..লকহার্টের ওখানে কেমন ছিল?

গলা খাটো করে, যেন নেভিল, ডিন এবং সিমাস জেগে না উঠে, রনকে বলল হ্যারি সে যা শুনেছে।

আর লকহার্ট বললেন যে ওই কথাগুলো শুনতেই পাননি? রনের জিজ্ঞাসা। চাঁদের আলোয় হ্যারি দেখতে পেলো যে সে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তোমার কি মনে হয় উনি মিথ্যা বলছেন কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না-এমনকি যিনি অদৃশ্য তাকেও ঘরে ঢুকতে হলে দরজাটা খুলতে হয়।

আমি জানি, বলল হ্যারি, ওর মশারী টানানোর চার খুটিওয়ালী খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে তার মাথার ওপরের চাদোয়াটার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে। আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *