০৩. দ্য বারো

০৩. দ্য বারো

রন! নিঃশ্বাস ছাড়ল হ্যারি, হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে গেল সে, জানালাটাকে একটু তুলে ধরল যেন শিকের ফাঁক দিয়ে কথা বলা যায়। রন তুমি কি ভাবে… কি ..?

চোখে যা দেখছে তার পুরো অভিঘাতটা উপলব্ধি করে বিস্ময়ে হ্যারির মুখ হা হয়ে গেলো। পুরনো একটা ফিরোজা রঙের গাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে রন বেরিয়ে আছে, গাড়িটা মধ্য-বাতাসে শূন্যের ওপর পার্ক করা। সামনের সিট থেকে হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসছে ফ্রেড এবং জর্জ। রনের বড় জমজ দুই ভাই।

বেশ, হ্যারি? কি হচ্ছে? বলল রন। তুমি আমার চিঠির জবাব দাওনি কেন? আমি তোমাকে প্রায় বারোবার লিখেছি আমাদের বাড়িতে থাকার জন্যে। তারপর একদিন বাবা বাড়ি এসে বললেন মাগলদের সামনে জাদু বিদ্যা প্রয়োগ করার জন্যে তোমাকে সরকারিভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে…

আমি ওটা করিনি–আর উনি জানলেন কিভাবে?

উনি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন, বলল রন। তুমি তো জান স্কুলের বাইরে আমাদের জাদু বিদ্যা প্রয়োগ করার কথা নয়..।

তোমাদের কাছ থেকে একটু ধনী ধনী ভাব আসছে, ভাসমান গাড়িটার দিকে অপলকে তাকিয়ে বলল হ্যারি।

ওহ!, এটা কোনো ব্যাপার নয়, বলল রন। আমরা এটা শুধু ধার করে নিয়ে এসেছি, এটা বাবার, আমরা এটা জাদু করিনি। কিন্তু যে মাগলদের সঙ্গে তুমি থাক তাদের সামনে জাদু বা মোহিনী বিদ্যার প্রয়োগ করা…

আমি তো বলেছি তোমাদের, আমি ওটা করিনি। কিন্তু এখন তোমাদের বোঝাতে অনেক সময় নেবে। দেখো, তোমরা কি হোগার্টস-এ ওদের বোঝাতে পারবে যে ডার্সলিরা আমাকে আটকে রেখেছে এবং আমাকে ওখানে ফিরে যেতে দেবে না এবং সঙ্গত কারনেই আমি জাদু করে নিজেকে বের করতেও পারছি না, কারণ এতে মন্ত্রনালয় ভাববে যে তিনদিনের মধ্যে আমি দুবার জাদু বিদ্যা ব্যবহার করলাম, সুতরাং

বকবকানি বন্ধ কর, বলল রন, আমরা এসেছি তোমাকে আমাদের সঙ্গে বাড়ি নিয়ে যেতে।

কিন্তু তোমরাও তো আমাকে জাদু করে বের করতে পারবে না

আমাদের করতেও হবে না, গাড়ির সামনের সিটের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁত বের করে বলল রন। তুমি ভুলে গেছ আমার সঙ্গে কে রয়েছে।

হ্যারির দিকে একটা রশির এক মাথা ছুঁড়ে দিয়ে ফ্রেড বলল, শিকের সঙ্গে ওটা কষে বাধো।

যদি ডার্সলিরা জেগে ওঠে তাহলে আমি শেষ, বলতে বলতে হ্যারি রশিটা কষে বাধল শিকের সঙ্গে। ফ্রেড গাড়িটা পেছনে চালাবার উদ্যোগ নিল।

ভয় পেয়ো না, বলল ফ্রেড। পেছনে সরে দাঁড়াও।

পেছনে ছায়ার মধ্যে হেডউইগের কাছে সরে গেলো হ্যারি। হেডউইগও বোধহয় বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটার গুরুত্ব নিঃশব্দে স্থির হয়ে বসে আছে। গাড়ি এবার জোরে রশিটা টানল, জোর বাড়তে বাড়তে এক সময় মচ মচ শব্দে শিকগুলো জানালা থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্রেড সোজা আকাশের দিকে উড়ে গেলো। দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে হ্যারি দেখল শিকগুলো মাটির কয়েক ফিট উপরে ঝুলছে। হাঁপাতে হাঁপাতে রন ওগুলোকে গাড়িতে তুলল। উদ্বিগ্ন হ্যারি কান পেতে শুনল, না, ডার্সলিদের বেডরুম থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

শিকগুলো গাড়ির পেছনের সিটে তোলা হয়ে গেলে হ্যারির জানালার যতখানি কাছে সম্ভব তত কাছে গাড়ির পেছন দিকটা নিয়ে এলো ফ্রেড।

উঠে পড়ো, বলল রন। কিন্তু আমার হোগার্টস-এর সব জিনিস.. আমার যাদুর কাঠি…আমার ঝাড়ুলাঠি…

কোথায় ওটা?

সিঁড়ির নিচের কাবার্ডে তালা মারা, কিন্তু আমি তো এই রুম থেকে বের হতে পারছি না।

কুছ পরোয়া নেই, বলল জর্জ গাড়ির সামনের সিট থেকে। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও হ্যারি।

ফ্রেড আর জর্জ জানালা বেয়ে হ্যারির রূমে চলে এলো। ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল ভাবল হ্যারি। পকেট থেকে একটা সাধারণ হেয়ার পিন বের করে জর্জ তালা খোলায় মন দিল।

অনেক জাদুকর ভাবে এ ধরনের ছোটখাট মাগল কায়দাগুলো শেখাটা সময়ের অপচয়, বলল হ্যারি। কিন্তু আমরা মনে করি একটু স্লো হলেও কায়দাগুলো শেখা থাকলে অনেক সময় কাজে লাগে!

ছোট্ট একটা ক্লিক শব্দ করে, দরজাটা খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

তাহলে আমরা তোমার ট্রাংকটা নিচ্ছি আর তোমার যদি এখান থেকে কিছু নেয়ার থাকে তবে রনের হাতে তুলে দাও, ফিস ফিস করে বলল জর্জ।

নিচের ধাপগুলো খেয়াল রেখো ওগুলো শব্দ করে, সাবধান করে দিল। হ্যারি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দুই জমজ ভাইয়ের উদ্দেশে।

হ্যারি দ্রুত ওর রুমের চারদিক থেকে জিনিসপত্র নিয়ে রনকে যোগান দিতে লাগল। তারপর গেল জর্জ আর ফ্ৰেডকে সিঁড়ি দিয়ে ওর ট্রাংক তোলার কাজে সাহায্য করতে। হ্যারি শুনতে পেল আঙ্কল ভার্ননের কাশির শব্দ।

অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা সিঁড়ির ওপরে পৌঁছল, হ্যারির রুমের মধ্য দিয়ে ট্রাংকটা বহন করে খোলা জানালাটার কছে নিয়ে গেল। ফ্রেড এবার চলে গেল গাড়িতে যেন রনের সাথে মিলে ট্রাংকটা নিজেদের দিকে টানতে পারে আর জর্জের সাথে মিলে হ্যারি রয়ে গেল বেডরুমের দিক থেকে ওটাকে ঠেলা মারার জন্যে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে ট্রাংকটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল।

আঙ্কল ভার্ননের কাশির শব্দ পেল ওরা।

আরেকটু, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ফ্রেড গাড়ির ভেতর থেকে ট্রাংকটা টানতে টানতে, বড়সড় একটা ধাক্কা….

হ্যারি আর জর্জ কাধ লাগিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে এক ধাক্কা দিতেই ট্রাংকটা গিয়ে পড়ল গাড়ির পেছনের সীটে।

ওকে, এবার যাওয়া যাক, ফিস ফিস করে বলল জর্জ।

কিন্তু যেই না হ্যারি জানালায় পা দিয়েছে অমনি পেছন থেকে শোনা গেল তীক্ষ্ণ এক চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল আঙ্কল ভার্ননের বজ্রকণ্ঠ।

ওই লালমুখো পেঁচাটা!

আমি হেডউইগের কথা একদম ভুলে গেছি।

হ্যারি তীর বেগে আবার রুমে গিয়ে ঢুকল সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি গোড়ার বাতিটাও জ্বলে উঠল। সে ছোঁ মেরে হেডউইগের খাঁচাটা তুলে নিল, তীরের মতো জানালার দিকে ছুটে গিয়ে ওটা তুলে দিল রনের হাতে। ফিরে গিয়ে হ্যারি সবে চেষ্ট অফ ড্রয়ার্সটা বেয়ে উঠছিল সেই সময় আঙ্কল ভার্নন তালা খোলা দরজাটায় সবেগে ধাক্কা মারলেন–সজোরে খুলে গেল দরজাটা।

এক মুহূর্তের জন্যে আঙ্কল ভার্নন হতভম্ব হয়ে দরজার ফ্রেমে যেন আঁটকে রইলেন; একটু থমকে, রাগী ষাড়ের মতো হুংকার ছেড়ে হ্যারির দিকে দিলেন ডাইভ, হ্যারির গোড়ালি ধরে ফেললেন।

রন, ফ্রেড আর জর্জ হ্যারির হাত ধরে ফেলল, গায়ের জোরে টানল নিজেদের দিকে।

পেতুনিয়া! গর্জন করে উঠলেন তিনি। পালিয়ে যাচ্ছে। ও পালিয়ে যাচ্ছে!

উইসলি ভাইয়েরা এমন এক হেঁচকা টান মারল যে হ্যারির পা আংকল ভার্ননের মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল। যে মুহূর্তে হ্যারি গিয়ে গাড়িতে পড়ল আর সজোরে দরজাটা বন্ধ করল, সেই মুহূর্তে রন চিৎকার করে উঠল, পা নিচের দিকে নামাও ফ্রেড! হঠাৎ গাড়িটা সোজা চাঁদের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল।

হ্যারি বিশ্বাস করতে পারল না ও মুক্ত হয়ে গেছে। জানালার কাঁচটা নামালো হ্যারি, রাতের বাতাস ওর চুল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে, পেছন ফিরে ছোট হয়ে আসা প্রিভেট ড্রাইভের ছাদগুলোর দিকে তাকাল। আঙ্কল ভার্নন, আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলি সকলেই হতবাক হয়ে ঝুলে রয়েছে হ্যারির জানালা থেকে।

আগামী গ্রীষ্মে দেখা হবে! চিৎকার করে উঠল হ্যারি।

উইসলি ভাইয়েরা হাসিতে ফেটে পড়ল। হ্যারি নিজের সিটে জুৎসই হয়ে বসল, এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল হাসি।

রনকে বলল, হেডউইগকে ছেড়ে দাও। ও আমাদের পেছন পেছন উড়ে আসতে পারবে। অনেক দিন ধরেই পাখা মেলার সুযোগ পায়নি বেচারা।

জর্জ হেয়ারপিনটা রনের দিকে এগিয়ে দিল, মুহূর্ত পরে হেডউইগ পাখা মেলে উড়ে গেলো আকাশে ওদের পাশাপাশি ছায়ার মতো।

তাহলে–হ্যারি তোমার গল্পটা কি? বলল রন অধৈর্য হয়ে। কি হচ্ছিল ওখানে?

হ্যারি ওদের সব খুলে বলল। ডব্বি সম্পর্কে, ওর সাবধান করা সম্পর্কে আর ভায়োলেট পুডিংটা নিয়ে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে সেটা সম্পর্কেও। ও শেষ করবার পরও দীর্ঘ একটা নীরবতা ওদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখল।

বেশ রহস্যময়, বলল ফ্রেড অবশেষে।

নিশ্চয়ই কৌশলী, একমত প্রকাশ করল জর্জ। তাহলে সে তোমাকে বলেনি কে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে?

আমার মনে হয় না সে বলতে পারত, বলল হ্যারি। আমি বলেছি না তোমাদের, যতবার সে বলার চেষ্টা করেছে ততবারই সে দেয়ালে মাথা ঠুকেছে আর বলা হয়নি।

হ্যারি লক্ষ্য করল ফ্রেড আর জর্জ দৃষ্টি বিনিময় করছে।

কি, তোমরা মনে করো ও আমাকে মিথ্যা বলেছে? বলল হ্যারি।

মানে, বলল ফ্রেড, এরকম ভাবা যেতে পারে গৃহ-ডাইনীদের নিজস্ব শক্তিশালী মায়াশক্তি রয়েছে, কিন্তু সাধারণত তারা ওটা তাদের মালিকের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করতে পারে না। আমার বিশ্বাস জুব্বিকে পাঠানো হয়েছিল তোমার হোগার্টস-এ ফিরে আসা ঠেকাতে অন্য কারো বুদ্ধি এটা। তোমার বিরুদ্ধে আক্রোশ এমন কেউ স্কুলে রয়েছে বলে কি তোমার মনে পড়ে?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি আর রন একসাথে।

ড্র্যাকো ম্যালফয়, হ্যারি বলল, ও আমাকে ঘৃণা করে।

ড্র্যাকো ম্যালফয়? পিছন ফিরে বলল জর্জ। লুসিয়াস ম্যালফয়ের ছেলে না?

হতেই হবে, এরকম নাম খুব একটা শোনা যায় না, যায় কি? বলল হ্যারি। কিন্তু কেন?

বাবাকে ওর সম্পর্কে কথা বলতে শুনেছি, বলল জর্জ, ও তুমি জান ইউ নো হুর একজন বড় সমর্থক।

আর যখন ইউ নো হু গায়েব হয়ে গেলো, গলা বাড়িয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল ফ্রেড। লুসিয়াস ম্যালফয় বলা শুরু করল ওসবের সঙ্গে ওর কোনো যোগাযোগ নেই। একেবারে গোবরে মিথ্যে–বাবা বিশ্বাস করেন সে একেবারে ইউ নো হুর ভেতরের সার্কেলের লোক।

ম্যালফয় পরিবার সম্পর্কে এ সব গুজব হ্যারি আগেও শুনেছে, সেজন্যে মোটেই আশ্চর্য হলো না। কারণ সে হাড়ে হাড়ে জানে ড্র্যাকো ম্যালফয় কেমন ছেলে। সন্দেহ নেই ড্র্যাকো ম্যালফয়-এর তুলনায় ডাডলি একটি দয়ালু, চিন্তাশীল আর সংবেদনশীল বালক।

আমি অবশ্য জানি না ম্যালফয়দের গৃহ-ডাইনী রয়েছে কি না…বলল হ্যারি।

ফ্রেড বলল, আচ্ছা যে-ই ওর মালিক হোক না কেন, পরিবারটি হবে প্রাচীন একটি উইজার্ডিং পরিবার এবং অবশ্যই ধনী।

আমার মায়েরও সব সময়ের ইচ্ছা কাপড় ইস্ত্রী করার জন্যে একটা গৃহ ডাইনী রাখা, বলল জর্জ। কিন্তু আমাদের চিলেকোঠায় একটা বিরক্তিকর মরা খেকো ভূত আর বাগান ভর্তি বাসন ভূত আছে। গৃহ-ডাইনীদের দেখতে পাওয়া যায় বড় বড় তালুকে, প্রাসাদে এবং ওরকম জায়গায়, আমাদের মতো বাড়িতে ওর দেখা পাবে না তুমি…

হ্যারি চুপচাপ ভাবছিল। ড্র্যাকো ম্যালফয় সাধারণত সবকিছুর সর্বোত্তমটাই পেয়ে থাকে, ওর পরিবার উইজার্ড সোনার ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে; সে দিব্য দেখতে পাচ্ছে ম্যালফয় সদর্পে পদচারণা করছে এমন একটা প্রাসাদোপম বাড়িতে। হ্যারিকে হোগার্টস-এ যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য বাড়ির চাকরকে পাঠানোর মতো কাজ ম্যালফয়ই করবে। ডব্বিকে গুরুত্ব দিয়ে হ্যারি কি ভুল করল?

অবশ্য আমি খুশি যে তোমাকে নিতে এসেছিলাম, বলল রন। তুমি আমার একটি চিঠির জবাব দাওনি দেখে সত্যি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা এরলের দোষ…

এরল কে?

আমাদের পেঁচা। খুবই পুরনো। আমি ভেবেছিলাম চিঠি নিয়ে যাওয়ার সময় পথে সে অবসাদে ভেঙ্গে পড়ে থাকতে পারে, তবে এটাই প্রথম ছিল না সে আগেও এ রকম করেছে কি-না তাই ভেবেছিলাম। তারপর আমি হারমেসকে ধার করবার চেষ্টা করলাম

কে?

পার্সি প্রিফেক্ট হওয়ার পর মা-বাবা ওকে যে পেঁচাটা কিনে দিয়েছিল, সামনের সিট থেকে বলল ফ্রেড।

কিন্তু ওর পেঁচা আমাকে ধার দেবে না, বলল রন। ওর নাকি কি কাজ আছে বলেছে।

এই গ্রীষ্মে পার্সি কেমন যেন খাপছাড়া আচরণ করছে, বলল জর্জ ভ্রূ কুঁচকে। এবং সে অনেক অনেক চিঠি পাঠাচ্ছে এবং নিজের বন্ধ রুমে অনেক সময় ব্যয় করছে… মানে আমি বলতে চাচ্ছি কতবার আর নিজের প্রিফেক্ট ব্যাজটা পলিশ করা যায়… ফ্রেড তুমি অনেকখানি পশ্চিমে চলে এসেছ, ড্যাশবোর্ডের কম্পাসটা দেখিয়ে যোগ করল সে। ফ্রেড স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে গাড়ির গতিপথ ঠিক করল।

তো, তোমার বাবা জানেন যে তোমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছ? প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি জবাবটাও আন্দাজ করতে পারছিল।

ইয়ে মানে, না, বলল রন। আজ রাতে তিনি কাজে বাইরে ছিলেন। আশা করছি মা জানার আগেই আমরা গাড়িটা গ্যারেজে রেখে দিতে পারব।

ভাল কথা তোমার বাবা মিনিস্ট্রি অফ মাজিকে কি করেন?

উনি সবচেয়ে বিরক্তিকর বিভাগে কাজ করেন। মাগলদের তৈরি কৃত্রিম জিনিসের অপব্যবহার রোধ সংক্রান্ত দপ্তরে।

কোন্ দপ্তরে?

মাগলদের তৈরি ম্যাজিক বস্তুগুলো সম্পর্কিত দপ্তর আর কি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিকার যাদুর জিনিস আবার গিয়ে পড়ে মাগলদের দোকানেই, বিক্রির জন্যে। গত বছর, এক বুড়ি উইচ মারা গেলেন আর তার টি-সেটটা অ্যান্টিকস-এর দোকানে বিক্রি হয়ে গেলো। এক মাগল মহিলা ওটা কিনে নিয়ে যান তার বাসায়। ওটা দিয়ে বন্ধুদের চা দিতে গেলেন। একটা দুঃস্বপ্ন আর কি– বাবাকে কয়েক সপ্তাহ ওভারটাইম করতে হয়েছিল।

কি হয়েছিল?

টিপটটা হঠাৎ যেন ক্ষিপ্ত হয়ে পাগলামি শুরু করে দিল, চারদিকে গরম পানি ছিটাতে শুরু করে দিল এবং এক লোককে তো হাসপাতালেই যেতে হয়েছিল চিনি তোলার টংটা নাকে নিয়ে। বাবার তো পাগল হয়ে যাওয়ার যোগাড়, অফিসে তখন শুধুমাত্র বাবা আর এক পুরনো যুদ্ধাভিজ্ঞ নাম পারকিন্স এবং তাদেরকে মেমরি চার্মসসহ আরো কত কি করতে হয়েছিল পুরো ঘটনাটা সামাল দেয়ার জন্যে…।

কিন্তু তোমার বাবা….. এই গাড়ি….

ফ্রেড হাসল…. ইয়ে, মাগলদের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল বিষয় সম্পর্কেই বাবা অতি উৎসাহী, আমাদের চালাঘরটা ভর্তি হয়ে আছে মাগলদের জিনিসপত্রে। বাবা এসব খুলে নিয়ে যায় ওগুলোর ওপর জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে আবার রেখে দেয়। আমাদের নিজেদের বাড়ি তল্লাশি করলে বাবার নিজেই নিজেকে সোজা গ্রেফতার করতে হবে। মা এতে ভীষণ রাগ করেন।

ওটাই বড় রাস্তা, বলল জর্জ, উইন্ড স্ক্রীনের ভেতর দিয়ে নিচে তাকিয়ে। দশ মিনিটের মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাব…ভালোই হলো, দিনের আলোও ফুটে উঠছে….।

পূর্ব দিগন্তে হাল্কা একটা গোলাপী আভা দেখা যাচ্ছে।

ফ্রেড গাড়িটাকে নিচে নামালো। হ্যারি দেখতে পেলো ঘনকালো মাঠ আর গাছের ঝাড়।

আমরা গ্রামের একটু বাইরে রয়েছি এখনও, বলল জর্জ। অটেরি স্ট্রিটক্যাচপোল…

নিচে এবং আরো নিচে নামল ফ্লাইং-কার। গাছের ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল সূর্যের কিনারাটা তখন ফুটে উঠেছে।

মাটি স্পর্শ করছি, বলল ফ্রেড, ছোট্ট একটা ঝাঁকি খেয়ে গাড়িটা মাটি স্পর্শ করল। ছোট্ট উঠোনে ওরা নামল নুয়ে পড়া একটা গ্যারেজের পাশে। রনের বাড়ির দিকে হ্যারি প্রথমবারের মতো তাকালো।

বাড়িটা দেখতে এমন মনে হয় এক সময় এটা পাথরের তৈরি বড়সড় একটা শুয়োরের খোয়াড় ছিল। পরে এর সঙ্গে এখানে আরো ঘর তৈরি করা হয়, এইভাবে কয়েক তলা উঁচু হয়েছে বাড়িটা। এবং এত বাঁকা হয়েছে বাড়িটা যে মনে হয় ওটাকে কোনো ম্যাজিক দাঁড় করিয়ে রেখেছে ( হ্যারি নিজেকে মনে করিয়ে দিল ব্যাপারটা বোধহয় ঘটেছেও তাই)। লাল ছাদটার ওপর দিয়ে পাঁচ অথবা ছয়টা চিমনি সোজা উঠে গেছে। গেটের কাছে একটা সাইনবোর্ড ঝুলে আছে, লেখা দ্য বারো। সামনের দরজার পাশে ওয়েলিংটন বুটের একটা পাহাড় জমে আছে, রয়েছে একটা ভীষণ রকমের জং ধরা কড়াই। উঠোনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মোটা তাজা ব্রাউন চিকেন।

তেমন কিছু নয়, তাদের বাড়ি সম্পর্কে বলল রন।

সঙ্গে সঙ্গে প্রিভেট ড্রাইভের কথা মনে পড়ে গেলো হ্যারির, বলল, কি এটা তো অপূর্ব।

গাড়ি থেকে নামল ওরা।

এখন আমরা একেবারে চুপি চুপি উপরে চলে যাব, বলল ফ্রেড। এবং নাস্তার জন্য মায়ের ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকব। তারপর রন তুমি লাফাতে লাফাতে নিচে নেমে বলবে, মা দেখো কে এসেছে রাতের বেলায়, হ্যারিকে দেখে মা যারপরনাই খুশি হবেন, কারো জানারও দরকার হবে না যে আমরা গাড়ি উড়িয়েছিলাম।

ঠিক, বলল রন। এসো হ্যারি, আমি ঘুমাই…

বলতে বলতেই রন জঘন্য রকমের সবুজ হয়ে গেল, ওর চোখ বাড়ির দিকে স্থির। অন্য তিনজনও ঘুরে দাঁড়াল।

উঠোনের ওপর দিয়ে তেড়ে আসছেন মিসেস উইসলি, মুরগীর বাচ্চাগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে, তার মতো একজন বেটে, মোটা-সোটা, নরম চেহারার মানুষের চেহারা যখন রাগী বাঘিনীর মতো হয় তখন সেটা দেখার মতো বৈকি।

আহ! বলল ফ্ৰেড।

ওহ ডিয়ার? বলল জর্জ।

তেড়ে আসা মিসেস উইসলি ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, দুই হাত কোমরে, একটি অপরাধী মুখ থেকে আরেকটির দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাচ্ছেন। পরনে ফুল আঁকা এপ্রনের পকেটে তার জাদুর কাঠি।

তাহলে? বললেন তিনি।

মর্নিং মাম, বলল জর্জ। বলার ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস রয়েছে, মনে হচ্ছে জিতে গেছে।

আমি কি রকম পেরেশান হয়েছিলাম তোমাদের কি কোনো ধারণা আছে? মিসেস উইসলি বললেন ফিস ফিস করে। গলার স্বর দারুণ শীতল।

সরি মাম, কিন্তু আমাদেরকে

মিসেস উইসলির তিন ছেলেই তার চেয়ে লম্বা, কিন্তু মায়ের রাগের সামনে তিনজনই যেন কেমন ভয়ে সিটিয়ে গেল।

বিছানা খালি। কিন্তু কোনো চিরকুট নেই! গাড়িও নেই….অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত….দুশ্চিন্তায় পাগল হওয়ার দশা….তোমাদের তো এসবের পরোয়া নেই? আমি যতদিন বেঁচে আছি কখনো না….আজ আসুক তোমাদের বাবা, বিল বা চার্লি বা পার্সি কখনো আমাদের এমন সমস্যায় ফেলেনি…

একেবারে পারফেক্ট পার্সি, বিড় বিড় করল ফ্রেড।

পার্সির বুকে আঙুলের খোঁচা মেরে মিসেস উইসলি চিৎকার করে বললেন, পার্সির খাতা থেকে একটা পাতা বের করে নিয়ে তোমরা লিখতে পারতে। তোমরা মারা যেতে পারতে, তোমরা ধরাও পড়তে পারতে এবং তোমাদের জন্যেই হয়তো তোমাদের বাবাকে তার চাকরিও হারাতে হতো

মনে হচ্ছিল এভাবেই হয়তো চলবে ঘন্টার পর ঘন্টা। চিৎকার করতে করতে মিসেস উইসলির গলাটাই ভেঙ্গে গেল। হ্যারির দিকে এবার ফিরলেন তিনি। ও ততক্ষণে পিছু হটে গেছে।

তোমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি হ্যারি ডিয়ার, বললেন তিনি। ভেতরে এসো আর নাস্তাটা সারো।

ঘুরে তিনি বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন, আর নার্ভাস হ্যারিও রমের কাছ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক ইশারা পেয়ে তাকে অনুসরণ করল।

রান্নাঘরটা ছোট এবং অপ্রশস্ত। মাঝখানে ঘষে পরিষ্কার করা চেয়ার আর টেবিল। হ্যারি একটা চেয়ারের কিনারায় বসে চারদিকে তাকাল। এর আগে কখনো সে কোনো উইজার্ডের বাড়িতে যায়নি।

ওর উল্টোদিকের দেয়াল ঘড়িটা একটি মাত্র কাটা আর কোনো সংখ্যা সেখানে লেখা নেই। ধারগুলিতে কিছু লেখা রয়েছে, যেমন, চা বানাবার সময়, মুরগীর বাচ্চাগুলিকে খাওয়ানোর সময়, এবং তুমি লেট। চুল্লির ওপরের তাক-এ তিন সারি বই রাখা রয়েছে। বইগুলোর নামও বিচিত্র, যেমন–তোমার নিজের পনিরকে জাদুগ্রস্ত করো, রুটি বেক করায় জাদু এবং এক মিনিটে ভোজ-এটা ম্যাজিক! এবং হ্যারির যদি শুনতে ভুল না হয়ে থাকে তবে সিঙ্কের পাশের রেডিওতে এই মাত্র একটা ঘোষণা শোনা গেল, পরের অনুষ্ঠান হচ্ছে জাদুর সময়, সঙ্গে রয়েছে সেলেস্টিনা ওয়ারবেক।

মিসেস উইসলি কাজ করছেন সশব্দে, এলোমেলোভাবে নাস্তা তৈরি করছেন, ফ্রাইং প্যানে সসেজ ছুঁড়ে দেয়ার সময় তার ছেলেদের দিকে তাকাচ্ছেন ভ্রূকুটি করে। বিড় বিড় করছেন, জানি না বাপু তোমরা কি ভাবছ এবং এমন হতে পারে কখনও বিশ্বাস করতাম না।

আমি তোমাকে দুষছি না, ডিয়ার, হ্যারির প্লেটে আট-নয়টা সসেজ ফেলে দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলেন তিনি। আর্থার আর আমি তোমার সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করছিলাম ঠিকই। এই গতরাতেই আমরা বলাবলি করছিলাম শুক্রবারের মধ্যে রনের চিঠির জবাব না দিলে আমরা নিজেরাই তোমাকে নেয়ার জন্যে আসতাম। (ওর প্লেটে তিনটা ডিম ভাজা দিতে দিতে) কিন্তু সত্যি, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একটা অবৈধ গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া যে কেউ তোমাদের দেখতে পারতো—

সিঙ্কের দিকে এবার জাদুর কাঠিটা একটু তাক করলেন, অমনি ওখানে রাখা প্লেটগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করলো, মৃদু টুন টুন শব্দ শোনা যেতে লাগল।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, মাম! বলল ফ্রেড।

খাবার সময় মুখ বন্ধ রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে বললেন মিসেস উইসলি।

ওরা ওকে না খাইয়ে রাখছিল, মাম! বলল জর্জ।

আর তুমি! বললেন মিসেস উইসলি, এবার অবশ্য তার গলার স্বর একটু নরম হয়ে এসেছে। হ্যারির জন্যে রুটি কেটে তাতে মাখন লাগাচ্ছেন তখন তিনি।

এমন সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল লম্বা নাইট ড্রেসের লাল-মাথা ছোট্ট একটি মানুষ, রান্নাঘরে ঢুকে ছোট্ট একখানা চিৎকার দিয়েই দিল ভো দৌড়।

জনি, মৃদুস্বরে হ্যারিকে বলল রন। আমার বোন, সারা গ্রীষ্ম শুধু তোমার কথাই বলেছে।

ও কিন্তু তোমাকে অটোগ্রাফের জন্য পাগল করে ফেলবে, দাঁত বের করে হেসে বলল ফ্রেড, কিন্তু মায়ের চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় আর কোনো কথা না বলে প্লেটের ওপর মাথা নোয়াল। ওদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো কথা শোনা গেল না এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ওটা হতে বেশিক্ষণ লাগল না।

বিশ্বাস করো, আমি খুবই ক্লান্ত, হাই তুলে বলল ফ্রেড, প্লেটের ওপর ছুরি কাটা রাখল। আমি শুতে চললাম–

না, তুমি যাবে না, চাবুকের মতো কণ্ঠ মিসেস উইসলির। সারা রাত জেগেছ, এটা তোমার দোষ। বাগান থেকে বাসন-ভূতগুলোকে এখন তাড়াবে, একেবারে বাগান ছেয়ে ফেলেছে ওগুলো আবার।

ওহ, মাম—

আর তোমরা, দুজনও, রন আর ফ্রেডের দিকে চোখ লাল করে তাঁকালেন।

তুমি ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়তে পারো, ডিয়ার, হ্যারির দিকে ফিরে বললেন তিনি। তুমি তো আর ওদেরকে গাড়ি উড়িয়ে যেতে বলোনি।

কিন্তু হ্যারির তো তখন ঘুম পাচ্ছিল না, বলল, আমি রনকে সাহায্য করতে পারি। কখনও বাসন-ভূত তাড়ানো দেখিনি কি না—

খুব ভালো কথা ডিয়ার, কিন্তু এটা খুবই বিরক্তিকর কাজ, বললেন মিসেস উইসলি। দেখা যাক এ বিষয়ে লকহার্ট-এ কি লেখা রয়েছে।

চুল্লির উপরের তাক থেকে একটা ভারি বই তিনি টেনে নামালেন। কঁকিয়ে উঠল জর্জ।

মাম, বাগান থেকে বাসন-ভূত তাড়াতে আমরা জানি।

মিসেস উইসলির হাতে ধরা বইটা দেখছে হ্যারি। মলাট জুড়ে সুন্দর সোনালী অক্ষরে লেখা : গিল্ডরয় লককার্ট এর হাউজহোল্ড পেটস। প্রথমেই রয়েছে চমৎকার দেখতে একজন উজ্জ্বল নীল চোখ আর ঘন রুপালী চুলের জাদুকরের বড়সড় ছবি। জাদুর দুনিয়ার যেমন সবখানে, এখানেও ছবিটা নড়ছে, হ্যারি ধারণা করল এই-ই গিল্ডরয় লকহার্ট। ওদের সকলের দিকেই চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছেন তিনি। মিসেস উইসলি ছবিটার দিকে ডগোমগো হয়ে তাকালেন।

ওহ, সে বিস্ময়কর, বললেন তিনি, সে জানে এইসব বাড়িঘরের পোকামাকড়ের বিষয়ে, এটা একটা চমৎকার বই..

ওকে মা খুব পছন্দ করেন, নিচুস্বরে বলল ফ্রেড।

এমন উদ্ভট কথা বলো না, ফ্রেড, বললেন মিসেস উইসলি, অবশ্য বলার সময় তার গাল দুটো একটু গোলাপীও হয়েছে। বেশ, তোমরা যদি লকহার্টের চেয়ে বেশি জান, যাও গিয়ে নিজেরাই করোগে, কিন্তু আমি এসে দেখার সময় যদি একটাও বাসন-ভূত পাওয়া যায় তবে তোমাদের কপালে দুর্ভোগ আছে।

হাই তুলে গাল ফুলিয়ে, উইসলিরা বাইরে বেরিয়ে এল, পেছনে হ্যারি। বাগানটা বড় এবং যেমনটা হওয়া উচিত হ্যারির চোখে ঠিক তেমনই লাগল। ডার্সলিরা নিশ্চয়ই এ রকম একটি বাগান পছন্দ করত না। আগাছা ভর্তি, ঘাসগুলি কাটা দরকার–চারদিকের দেয়াল ঘেসে আঁকাবাকা সরু পুরনো গাছ, ফুলের প্রত্যেকটি কেয়ারি থেকে চারা উপচে পড়ছে এমনটি হ্যারি কখনও দেখেনি আর বড় একটা সবুজ ডোবা তাতে ব্যাঙ ভর্তি।

জানো মাগলদেরও বাগানে বাসন-ভূত থাকে, রনকে বলল হ্যারি।

হ্যাঁ, আমিও ওগুলো দেখেছি যেগুলোকে ওরা বাসন-ভূত বলে, বড় গোল লাল–গোলাপী–সাদা ফুল গাছের ঝাড়ুটার উপর উবু হয়ে বসে বলল রন। যেন ছিপসহ মোটাসোটা ছোটখাট ফাদার ক্রিসমাস এক একটা….

প্রচণ্ড হুটোপুটির আওয়াজ হলো একটা, ঝাড়টা কেঁপে উঠলে রন সোজা হয়ে দাঁড়াল। এটাই হচ্ছে বাসন-ভূত, নির্মমভাবে বলল সে।

আমাকে ছাড়! আমাকে ছাড়! তীক্ষ্ণ আর্তধ্বনি করে উঠল বাসন-ভূত।

এটা দেখতে মোটেও ফাদার ক্রিসমাসের মতো নয়। ছোট্ট, চামড়ার মতো দেখতে, বিশাল আলুর মতো চকচকে টেকো মাথা। হাত মেলে রন ওটাকে ধরে রাখল দূরে, ছোট ছোট শক্ত পা দিয়ে রনের দিকে লাথি ছুঁড়ে দিচ্ছে ওটা। রন ওটার গোড়ালি ধরে উল্টো ঝুলিয়ে রাখল।

এখন এটাকে নিয়ে এরকম করতে হবে, বলে সে বাসন-ভূতটাকে মাথার ওপর তুলে শূন্যে (ওটা তখনও চিঁ চিঁ করছে আমাকে ছাড়ো) ঘোরাতে শুরু করল। হ্যারির চোখে মুখে দুঃখ পাওয়ার অভিব্যক্তি দেখে আবার বলল, এতে ওরা ব্যথা পায় না–ওদের শুধু মাথা ঘুরিয়ে হতবুদ্ধি করে দিতে হয়, তাহলেই ওরা আর ফিরে যাওয়ার জন্যে ওদের গর্ত খুঁজে পাবে না।

ঘোরাতে ঘোরাতে হাত থেকে বাসন-ভূতের গোড়ালিটা ছেড়ে দিল রন। আকাশের দিকে সোজা বিশ ফিট উঠে গেল ওটা, তারপর ঝোপের আরেক পাশে পড়ল থপ করে।

আহা, বলল ফ্রেড। বাজি ধরে বলতে পারি আমারটা আরো দূরে ওই স্টাম্পের ওপারে যাবে।

খুব দ্রুতই শিখে গেলো হ্যারি, বাসন-ভূতগুলোর জন্যে দুঃখ পাওয়ার দরকার নেই। সে ঠিক করল, প্রথম যেটাকে ধরবে শুধু ঝোপের ওপারে ফেলে দেবে। কিন্তু বাসন-ভূতটা হ্যারির দুর্বলতা বুঝতে পেরে ওর তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত বসিয়ে দিল হ্যারির আঙুলে, ওটাকে ঝেড়ে ফেলতে হ্যারির দারুণ কষ্ট হয়েছিল।

ও হ্যারি–ওটা নিশ্চয়ই পঞ্চাশ ফিট…

অল্পক্ষণের মধ্যেই উড়ন্ত বাসন-ভূতে বাতাস ভারী হয়ে এলো।

দেখেছ ওগুলো খুব চালাক নয়, একসঙ্গে পাঁচ ছয়টা বাসন-ভূত ধরে বলল জর্জ। যে মুহূর্তে ওরা জানতে পারে ওদের তাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে অমনি সবাই ঝড়ের গতিতে উপরে উঠে আসে কি ঘটছে দেখার জন্যে। তুমি হয়তো ভাবছ এর মধ্যে ওদের শিখে নেয়া উচিত যে ওদেরকে গর্তের ভেতরেই থাকতে হবে।

এক সময় মাঠের বাসন-ভূতগুলো বিশৃংখল লাইনে হেঁটে যেতে শুরু করল, ওদের ছোট্ট কাঁধগুলো সব ঝুলে পড়েছে।

ওরা আবার ফিরে আসবে, মাঠের অপর দিকে ওগুলোকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখতে দেখতে বলল রন। এখানে থাকতে ওরা ভালবাসে…..বাবা ওদের প্রতি একটু সদয়, তিনি ভাবেন ওরা বেশ মজার…

ঠিক সেই সময়, বাড়ির সামনের দরজা দড়াম করে খুলে গেলো।

উনি এসে পড়েছেন! বলল জর্জ। বাবা বাড়িতে!

বাগানের ভেতর দিয়ে দ্রুত ওরা বাড়ি ফিরে এলো। মিস্টার উইসলি কিচেনে একটা চেয়ারের উপর গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন, বন্ধ চোখে চশমা নেই। তিনি একহারা, মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু যে টুকু চুল রয়েছে, সব ছেলেমেয়ের মতোই লাল। সবুজ রঙের গাউন পরনে, ভ্রমণে ধুলি ধূসরিত এটা।

কি যে একটা রাত গেল, অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি। ওরা সবাই ওর চারদিকে এসে বসেছে ততক্ষণে। নয়টা তল্লাশী। নয়টা! এবং যেই আমি পিছন ফিরেছি তখনই বুড়ো মানডাংগার ফ্লেচার আমার উপর একটা….

কিছু পেলে, ড্যাড? ফ্রেড আগ্রহভরে জানতে চাইল।

পেয়েছি, কয়েকটা সংকুচিত হয়ে আসা দরজার চাবি আর কামড় দেয় এমন একটি কেটলি, হাই তুললেন মিস্টার উইসলি। আরো কয়েকটা জঘন্য নোংরা জিনিস ছিল, ওগুলো অবশ্য আমার ডিপার্টমেন্টের নয়। কিছু অস্বাভাবিক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে মর্টলেককে ধরে নিয়ে গেছে, ভাগ্যকে ধন্যবাদ ওটা ছিল পরীক্ষামূলক মায়াবিদ্যা প্রয়োগ বিষয়ক কমিটি…

জর্জ জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু দরজার চাবি সংকোচন করার ঝামেলা কেন একজন পোহাবে?

শুধু মাগলদেরকে টোপে ফেলবার জন্যে আর কিছু নয়, মিস্টার উইসলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ওদের কাছে এমন একটা চাবি বিক্রি করা যেটা নাকি ছোট হতে হতে একেবারে নেই হয়ে যাবে, যেন প্রয়োজনের সময় ওরা ওটা কিছুতেই খুঁজে না পায়…..অবশ্য এ ব্যাপারে কাউকে শাস্তি দেয়া খুবই কঠিন, কারণ কোনো মাগলই স্বীকার করবে না যে, তার চাবিটি ছোট হয়ে যাচ্ছে ওরা জোর দিয়ে বলবে খালি ওটা হারিয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বর তাঁদের মঙ্গল করন, ম্যাজিক উপেক্ষা করার জন্যে তারা কী না করতে পারে, এমনকি ওটা যদি তাদের নাকের ডগায় ঘটে তবুও…কিন্তু জাদু প্রয়োগ করার জন্য কত রকমের জিনিস যে ব্যবহার করা হচ্ছে তোমরা ভাবতেও পারবে না।

যেমন গাড়ি?

মিসেস উইসলি উদয় হলেন হাতে তলোয়ারের মতো করে একটা লম্বা লোহার শলাকা ধরা। যেন একটা ধাক্কা খেয়ে মিস্টার উইসলির চোখ এক ঝটকায় খুলে গেল। অপরাধীর মতো স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।

গা–গাড়ি, মলি ডিয়ার?

হ্যাঁ, আর্থার গাড়ি, বললেন মিসেস উইসলি। ওর চোখ জ্বলছে। ভাব তো এক জাদুকর একটা পুরনো জং ধরা গাড়ি কিনল, স্ত্রীকে বুঝ দিল ওর ইচ্ছা গাড়িটা খুলে দেখে ওটা কি ভাবে কাজ করে, আসলে সে সারাক্ষণ গাড়িটাকে জাদু দিয়ে ওড়াবার চেষ্টা করে আসছিল।

মিস্টার উইসলির চোখ পিট পিট করে উঠল।

কিন্তু ডিয়ার আমার মনে হয় ওরকম কিছু করলেও সেটা আইনের মধ্যেই পড়ে, অবশ্য, মানে, ভালো হতো যদি সে তার স্ত্রীকে সত্যি কথাটা বলত….আইনের মধ্যেই একটা ফাঁক রয়েছে, তুমি দেখবে…যতক্ষণ না সে গাড়িটা ওড়াতে ইচ্ছা করছে, তেমন অবস্থায় গাড়িটা উড়তে পারে এটা প্রমাণিত…

আর্থার ঊইসলি, আইনটা করবার সময়ই তুমি নিশ্চিত করেছিল যেন ওতে ফাঁক থাকে! চিৎকার করে উঠেছিলেন মিসেস উইসলি। যেন তুমি ওই সব মাগল–রাবিশ তোমার শেডে রাখতে পারো! আর তোমার জানার জন্যে জানাচ্ছি, যে গাড়িটা তোমার মোটেই চালাবার ইচ্ছা নেই সেই গাড়িটা চড়েই আজ সকালে হ্যারি এখানে এসেছে।

হ্যারি? কেমন যেন ফাঁকা স্বরে বলল মিস্টার উইসলি। হ্যারি কে?

চারদিকে তাকাল। হ্যারিকে দেখে লাফিয়ে উঠল।

হায় খোদা, এ কি হ্যারি পটার? তোমাকে দেখে খুবই খুশি হয়েছি। রন তোমার সম্পর্কে এতো কথা বলেছে–

তোমার ছেলেরা গত রাতে ওই গাড়ি চালিয়ে হ্যারির বাসায় গিয়েছে আবার ফিরেও এসেছে! চিৎকার করে বললেন মিসেস উইসলি। এ ব্যাপারে তোমার কি বলবার আছে, বলো?

সত্যিই তোমরা? অগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলেন মিস্টার উইসলি। ওটা কি ঠিকমতো চলেছিল? আমি মানে আমি, তোতলাতে শুরু করলেন তিনি, মিসেস উইসলির চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে, বলতে চাইছি তোমরা অন্যায় করেছ, সাংঘাতিক অন্যায় …সত্যিই সাংঘাতিক…

এই ব্যাপারের ফায়সালাটা ওদের হাতেই ছেড়ে দেয়া যাক, রন বিড় বিড় করে হ্যারিকে বলল, মিসেস উইসলি মর্দা ব্যাঙের মতো তখনও ফুলছে। চলে এসো, তোমাকে আমার বেডরুমটা দেখাচ্ছি।

রান্নাঘর থেকে চুপিসারে বেরিয়ে ওরা সরু প্যাসেজ ধরে নেমে এলো অসমান সিঁড়িতে। উপরে উঠে গেছে সিঁড়িটা এঁকেবেঁকে বাড়ির ভেতর দিয়ে। তৃতীয় ল্যান্ডিং-এ একটা দরজা একটু ফাঁক করা। দরজাটা চট করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে হ্যারি এক জোড়া উজ্জ্বল বাদামী চোখ দেখতে পেলো।

জিনি, বলল রন। তুমি জান না এভাবে নিজেকে বন্ধ করে রাখা ওর জন্য যে কতটা অস্বাভাবিক, সাধারণত ও এরকম করে না

আরো দুই ধাপ উপরে উঠে ওরা আরো একটা দরজার সামনে এলো, ওটার রং পড়ছে খসে। দরজায় একটা ছোট্ট নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে, রোনাল্ড এর ঘর।

হ্যারি ভেতরে পা রাখল, ঢালু হয়ে আসা ছাদে ওর মাথা ছুঁই ছুঁই, চোখ পিট পিট করল ও। মনে হচ্ছে যেন একটা অগ্নিকুণ্ডে ঢুকল ওরা: রনের রুমের প্রায় সবকিছুই উগ্র কমলা রঙে রাঙানো; বিছানার চাদর, দেয়াল, এমনকি সিলিংটাও। হ্যারি দেখল ছেঁড়াখোঁড়া মলিন ওয়াল পেপারের প্রতিটা ইঞ্চি ভরেছে সাত ডাইনী আর জাদুকরের পোস্টার দিয়ে, সবাই পড়ে রয়েছে উজ্জ্বল কমলা রঙের পোষাক, হাতে ঝাড়ুলাঠি নাড়ছে জোরে জোরে।

তোমার কিডিচ টিম? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

দি শাডলি ক্যাননস, বলল রন, কমলা রঙের বিছানার চাদরের দিকে দেখিয়ে বলল। ওটার ওপর দুটো বিশাল আকৃতির সি বর্ণ এবং কামানের একটি ধাবমান গোলা বসানো রয়েছে। লীগে নবম।

রনের স্কুল যাদুবিদ্যার বই এক কোণে পড়ে আছে অযত্নে, পাশেই পড়ে রয়েছে এক গাদা অ্যাডভেঞ্চারস অফ মার্টিন মিগস, দি ম্যাড মাগল জাতীয় কমিক। রনের জাদুর কাঠিটা পড়ে রয়েছে কাঁচের মধ্যে ব্যাঙাচি ভর্তি একটা মাছের অ্যাকুরিয়ামের ওপরে। পাশেই ওর নাদুস নুদুস ধূসর ইঁদুর স্ক্যাবার্স এক টুকরো রোদে শুয়ে ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে নিচ্ছিল।

মেঝেতে রাখা এক প্যাকেট স্ব-সাফলিং তাস পেরিয়ে হ্যারি ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অনেক নিচে মাঠে দেখতে পেলো এক দল বাসন-ভূত নিঃশব্দে চোরের মতো একটা একটা করে উইসলিদের ঝোপের ভেতর দিয়ে ফিরে আসছে। তারপর ও ফিরে তাকাল বনের দিকে, রন অপেক্ষা করছিল, ওর মতামতের জন্যে। একদম নার্ভাস।

একটু ছোট, বলল রন দ্রুত। মাগলদের ওখানে তোমার যে রুম মোটেই এটা ওর মতো নয়। আর আমি ঠিক ওই চিলেকোঠার মড়াখেকো ভূতটা নিচে, ওটা সব সময় পাইপের ওপর দড়াম করে পিটছে আর গোঙাচ্ছে…

কিন্তু হ্যারি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি যত বাড়িতে গেছি এটাই তার মধ্যে সবচাইতে ভাল।

কিছু স্বস্তি ও কিছু লজ্জায় রনের কান গোলাপী হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *