০১. নিকৃষ্টতম জন্মদিন

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস

০১. নিকৃষ্টতম জন্মদিন

চার নম্বর প্রিভেট ড্রাইভের নাস্তার টেবিলে তর্কটা এই প্রথমবারের মতো বাধলো না। খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল মিস্টার ডার্সলির, মানে ঘুমটা ভেঙ্গে দিয়েছিল তার ভাগ্নের ঘরের ওই অশুভ পেঁচাটার ডাক।

এটা নিয়ে এই সপ্তাহের মধ্যেই এই ঘটনা তিনবার হলো! খাওয়ার টেবিলের ওপার থেকে তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন হ্যারিকে। তুমি যদি ওই পেঁচাটাকে থামাতে না পারো তবে ওটাকে যেতেই হবে!

আরো একবার হ্যারি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করল।

ঘরে থেকে থেকে ওটা বিরক্ত হয়ে গেছে, বলল হ্যারি। বাইরে সে উড়ে বেড়াতো চারদিকে। শুধু যদি আমি ওকে রাতে বের হতে দিতে পারতাম…

আমাকে কি বোকা মনে হচ্ছে? দাঁত খিচালেন আঙ্কল ভার্নন, ওর গোঁফের ঝোপের মধ্যে ভাজা ডিমের খানিকটা তখনও ঝুলছে। ওই পেঁচাটাকে বাইরে যেতে দিলে যে কি হবে সেটা আমার খুব ভাল করেই জানা আছে।

কথাটা বলে তিনি স্ত্রী পেতুনিয়ার দিকে তাকালেন।

যুক্তি দিয়ে হ্যারি ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চেয়েছিল, কিন্তু ডার্সলির পুত্র ডাডলির ইয়া বড় এক ঢেকুরের বিকট শব্দে ওর কথাগুলো চাপা পড়ে গেলো।

আমাকে আরো বেকন দাও।

ফ্রাইং প্যানে আরো আছে মিষ্টি সোনা, বললেন আন্ট পেতুনিয়া, পুত্রের দিকে আদরে মন আচ্ছন্ন করা ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তোমাকে ভালো করে খাওয়ানো দরকার–. ওই স্কুলে খাওয়ানোর ব্যাপারটা আমার একেবারেই অপছন্দ…..

ননসেন্স, পেতুনিয়া কি বাজে কথা বলছ, স্মেলটিংস এ আমি কখনও খালি পেটে থাকিনি, বললেন আস্কল ভার্নন। ডাডলি ও যথেষ্ট পাচ্ছে তাই না বেটা?

ডাডলি, এত বিশাল যে তার পাছার দুই দিক কিচেন চেয়ারের দুই পাশে ঝুলে পড়েছে, দাঁত কেলিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল।

ফ্রাইং প্যানটা এদিকে দাও।

তুমি কি সেই ম্যাজিক শব্দটা ভুলে গেছ,বলল হ্যারি বিরক্ত হয়ে।

পরিবারের অন্যদের ওপরও এই ছোট্ট কথাটার অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিক্রিয়া হলো: দম বন্ধ হয়ে এলো ডাডলির, এমন প্রচণ্ড শব্দে চেয়ার থেকে নিচে পড়ল যে পুরো কিচেনটাই কেঁপে উঠল। মিসেস ডার্সলির মুখ থেকে ছোট্ট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, পরক্ষনেই হাত দিয়ে মুখচাপা দিলেন তিনি। মিস্টার ডার্সলি লাফিয়ে উঠলেন, কপালের রগগুলো লাফাচ্ছে তার। 

প্রতিক্রিয়া দেখে বেচারা হ্যারি গেছে ঘাবড়ে, তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করল, আমি, মানে ম্যাজিক শব্দ বলতে প্লিজ শব্দটা বোঝাতে চেয়েছিলাম, আমি কোনো মানে আমি …….. 

আমি তোমাকে কি বলেছি, গর্জন করে উঠলেন, তার আঙ্কল ভার্নন সারা টেবিলে থুথু ছিটিয়ে, আমার বাড়িতে এমন শব্দ বলার ব্যাপারে?

কিন্তু আমি মানে

কোন সাহসে তুমি ডাডলিকে ভয় দেখাও? আবার গর্জে উঠে আঙ্কল হাত দিয়ে টেবিলে এক ঘা বসিয়ে দিলেন।

আমি শুধু …।

আমি তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছি। এই ছাদের নিচে তোমার অস্বাভাবিক চরিত্রের কোনকিছু আমি সহ্য করব না!

হ্যারি তার তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা আঙ্কলের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফ্যাকাসে আন্টির দিকে তাকাল, তিনি ডাডলিকে টেনে ওর পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন।

বেশ, বলল হ্যারি, বেশ …

গণ্ডারের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে আঙ্কল ভার্নন গিয়ে চেয়ারে বসে তার ছোট্ট কুতকুতে তীক্ষ্ণ চোখের কোণা দিয়ে হ্যারিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।

যখন থেকেই গরমের ছুটিতে হ্যারি বাড়ি এসেছে, আঙ্কল ভার্নন হ্যারির সঙ্গে যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে বোমার মতো আচরণ করছেন। সব সময় হ্যারির প্রতি কারণে-অকারণে রেগে ফুঁসে থাকবেন। তিনি মনে করেন হ্যাঁরি কোনো স্বাভাবিক ছেলে নয়। বস্তুত যতটা সম্ভব স্বাভাবিক না হওয়া যায় হ্যারি ঠিক তাই।

হ্যারি পটার একজন যাদুকর হোগার্টস স্কুল অব উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রির প্রথম বর্ষ থেকে সদ্য এসেছে। ছুটিতে ওর আসাতে ডার্সলিরা যদি খুশি না হয়, তবে হ্যারির ওতে কিছু যায় আসে না।

সে দারুণভাবে হোগার্টর্সকে মিস করছে, যেন সারাক্ষণ পেট চিন চিন করছে। সে মিস করছে দূর্গ আর এর গোপন পথ, ভূতগুলো, পড়াশোনা যদিও সম্ভবত পোশন (জাদু পানীয়) শিক্ষক স্নেইপকে নয়, চিঠি নিয়ে আসা পেঁচাটা, গ্রেট হলে ডিনার খাওয়া, টাওয়ার-ছাত্রাবাসে চার-কোণা বিছানায় ঘুমানো, গেমকিপার হ্যাগ্রিড-এর সঙ্গে নিষিদ্ধ বনের পাশে তার কেবিনে দেখা করা এবং সর্বোপরি কিডিচ, উইজার্ডিং দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা (ছয়টি দীর্ঘ গোলপোস্ট, চারটি উড়ন্ত বল ঝাড়ু–লাঠিসহ চৌদ্দজন প্লেয়ার)।

হ্যারি বাড়ি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আঙ্কল ভার্নন তার জাদুর বই, জাদুর কাঠি, পোষাক, কলড্রন এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী নিম্বাস ২ হাজার ঝাড়ু-লাঠি সব সিঁড়ির নিচের কাবার্ডে তালা মেরে রেখেছেন। সারা গ্রীষ্ম প্র্যাকটিস না করার কারণে হ্যারি যদি হাউজ কিডিচ টিমে তার স্থানটি হারায় তবে ডার্সলিদের কি আসে যায়? কোনো হোমওয়ার্ক না করেই হ্যারি যদি স্কুলে ফিরে যায় তাতে ডার্সালদের কি? ডার্সলিরা হচ্ছে, উইজার্ডরা যাদের মাগল বলে ঠিক তাই (তাদের ধমনীতে এক ফোঁটাও জাদুর রক্ত নেই) এবং মাগলদের বিবেচনায় পরিবারে একজন যাদুকর থাকা চরম লজ্জার ব্যাপার। আঙ্কল ভার্নন হ্যারির পেঁচাটাকেও তালা মেরে রেখেছেন, যেন জাদুর দুনিয়ায় ওটা কোনো খবরা-খবর না নিয়ে যেতে পারে।

হ্যারি মোটেই পরিবারের অন্যদের মতো দেখতে নয়। আঙ্কল ভার্নন বিশালদেহী এবং যেন ঘাড় নেই তার কিন্তু বিশাল কালো গোঁফ রয়েছে নাকের নিচে। আন্ট পেতুনিয়া ঘোড়ামুখো এবং শুকনো হাড্ডিসার। ডাডলি ব্লন্ড, গোলাপী এবং শুয়োরের মতো। অন্যদিকে হ্যারি হচ্ছে ছোটখাট এবং পাতলা দুবলা, উজ্জ্বল সবুজ চোখ এবং এক মাথা ঘন কালো চুল, যা সব সময়ই অগোছালো থাকে। ওর চশমার কাঁচ গোল এবং কপালে রয়েছে চিকন বিদ্যুতের মতো দাগ।

এই দাগটাই হ্যারিকে এত ব্যতিক্রম করেছে যেমন অন্যদের কাছ থেকে তেমনি একজন যাদুকরের থেকেও। হ্যারির রহস্যজনক অতীতের এই দাগটাই ইঙ্গিত। যে কারণে এগারো বছর আগে তাকে ডার্সলিদের দরজায় রেখে দেওয়া হয়েছিল।

যখন তার বয়স এক, তখনও হ্যারি কোনরকমে রক্ষা পেয়েছিল, ভয়ে যার নাম কোনো যাদুকর নেয় না, সেই সর্বকালের সেরা কালোবিদ্যার যাদুকর লর্ড ভোলডেমর্ট-এর অভিশাপ থেকে। হ্যারির বাবা-মা এই ভোলডেমর্ট-এর হামলায়ই মারা গেছে, হ্যারি অবশ্য বেঁচে গিয়েছিল, কপালের ওই বিদ্যুতের মতো দাগটা রয়ে গেছে হামলার নিদর্শন হিসেবে এবং যেভাবেই হোক কারণটা কারো জানা নেই। ভোলডেমর্ট-এর সমস্ত ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে হ্যারিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার মুহূর্ত থেকে।

এরপর থেকে হ্যারিকে বড় করেছে তার মৃত মায়ের বোন এবং তার স্বামী। ডার্সলিদের সঙ্গে সে দশ বছর কাটিয়েছে; কিন্তু কখনই সে বুঝতে পারেনি করতে না চাইলেও কেন সে অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা করে বসত। কেন সে বিশ্বাস করত ডার্সলিদের কথা, যে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে তার বাবা মা মারা গেছে, সেই অ্যাকসিডেন্ট থেকেই তার কপালের দাগটা এসেছে।

এবং ঠিক এক বছর আগে হোগার্টস থেকে যখন হ্যারির কাছে চিঠি আসছে, তারপরই তো পুরো কাহিনী প্রকাশিত হয়। জাদুবিদ্যার স্কুলে হ্যারি ভর্তি হলো, যেখানে সে আর তার দাগ দুটোই বিখ্যাত… এখন স্কুলের দিনগুলো শেষ হয়েছে, গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে আবার সে ডার্সলিদের ওখানেই ফিরে এসেছে, দুর্গন্ধযুক্ত কোনকিছু বা আবর্জনার ওপর গড়াগড়ি খাওয়া কুকুরের মতো ব্যবহার পাওয়ার জন্যে।

আজ যে হ্যারির ১২তম জন্মদিন সেটাও ডার্সলিদের মনে নেই। অবশ্য এ ব্যাপারে তার খুব বড় কোনো আশা নেই; কেক তো দূরের কথা, ওরা কখনই তাকে ভাল কোনো প্রেজেন্টেশন দেয়নি… কিন্তু একেবারে উপেক্ষা করা…।

ঠিক সেই মুহূর্তে আঙ্কল ভার্নন বেশ গুরুত্বের সাথে কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, মানে, আমরা সবাই জানি, আজকের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।

হ্যারি অবাক মুখ তুলে, তার বিশ্বাস করতে ভয় হচ্ছে। তার জন্মদিনের কথা আঙ্কল বলছেন। কিভাবে হয়।

যদি আজকের দিনটা এমন হয় যে আজকেই আমি আমার ব্যবসা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ডিলটা করতে পারি। বললেন আঙ্কল ভার্নন। হ্যারির আশ্চর্য হওয়া মুখমণ্ডলটি ম্লান হলো।

হ্যারি আবার টোস্টের দিকে মনোযোগ দিল। অবশ্যই, তিক্ততার সাথে। হ্যারি ভাবলো আঙ্কল ভার্নন ওই স্টুপিড ডিনার পার্টির কথা ভাবছেন। আগামী দুসপ্তাহ তিনি যে একই কথা বার বার বলবেন এবং অন্য কোনকিছু নিয়ে কথা বলবেন না, এটাও নিশ্চিত। কোনো এক ধনী কন্ট্রাক্টর আর তার স্ত্রী আজকে ডিনারে আসছেন এবং তিনি আশা করছেন ওর কাছ থেকে বড় রকমের একটা অর্ডারও পাওয়া যাবে (আঙ্কল ভার্ননের কোম্পানি ড্রিল তৈরি করে।

আমার মনে হয় আমাদের আর একবার প্রোগ্রামটার ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়া দরকার, বললেন তিনি। রাত আটটার মধ্যে আমাদেরকে যার যার পজিশনে থাকতে হবে। পেতুনিয়া ভুমথাকবে?

লাউঞ্জে, সঙ্গে সঙ্গে বললেন আন্ট পেতুনিয়া। তাদেরকে আমাদের বাড়িতে সৌজন্যের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে অপেক্ষমান।

ভাল, ভাল। আর ডাডলি?

আমি দরজা খোলার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকব, ডাডলি জঘন্য রকমের একটি বোকা-হাসি উপহার দিল। আমি বলব, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মেসন আমি কি আপনাদের কোটগুলো নিতে পারি? ডার্সলি বলল।

ওরা ওকে নিশ্চয়ই ভালবাসবে, ডার্সলির কথা শুনে অতি উৎসাহে চিৎকার করে উঠলেন আন্ট পেতুনিয়া।

এক্সেলেন্ট, ডাডলি, বললেন আঙ্কল ভার্নন। তারপর তিনি ফিরলেন হ্যারির দিকে, আর তুমি?

আমি বেড-রুমেই থাকব, কোনরকম শব্দ করব না এবং এমন ভান করব যেন আমি ওখানে নেই, হ্যারি বলল কোনো ভাবাবেগ ছাড়াই। সে জানে কোনো অতিথি এলে তাকে কি করতে হয়।

ঠিক তাই, বললেন আঙ্কল ভার্নন মুখ বিকৃতি করে কুৎসিতভাবে। আমি তাদেরকে লাউঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে আসব এবং পেতুনিয়া তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো এবং তাদেরকে ড্রিংকস দেবো। ঠিক সোয়া আটটায়

আমি ডিনারে ডাকবো, বললেন আন্ট পেতুনিয়া।

এবং ডাডলি, তুমি বলবে–আমি কি আপনাকে ডিনার টেবিলে নিয়ে যেতে পারি মিসেস মেসন? অদৃশ্য এক মোটা মহিলার উদ্দেশ্যে বাহু বাড়িয়ে অভিনয় করে বলল ডাডলি।

আমার ছোট্ট ভদ্রলোকটি, আদুরে গলায় বললেন আন্টি পেতুনিয়া।

আর তুমি? বললেন আঙ্কল ভার্নন হ্যারির দিকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হ্যারির উত্তরের অপেক্ষা না করে স্ত্রীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ঠিক তাই। ডিনার টেবিলে অতিথিদের উদ্দেশে প্রশংসামূলক কিছু বলা দরকার, পেতুনিয়া তোমার কোনো আইডিয়া আছে?

ভার্নন বলেছে, মিস্টার মেসন আপনি একজন চমৎকার গলফ প্লেয়ার… ড্রেসটা কোথা থেকে কিনলেন মিসেস মেসন…

একেবারে সঠিক… আর ডাডলি তুমি?

এটা কেমন হয় যদি বলি স্কুলে যার যার হিরোকে নিয়ে আমাদেরকে রচনা লিখতে হয়েছিল। মিস্টার মেসন, আমি তোমার সম্পর্কে লিখেছি …

আন্ট পেতুনিয়া এবং হ্যারি দুজনের জন্যই এটা বড় বেশি হয়ে গেলো। অবশ্য দুজনের অনুভূতি ছিল ভিন্ন। আন্ট পেতুনিয়া কেঁদে ফেললেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন আর ডাডলির ভাড়ামোর মত কথা শুনে হ্যারি গিয়ে লুকালো টেবিলের নিচে যেন ওর হাসি ওরা দেখতে না পায়।

আর এই যে, তুমি?

টেবিলের নিচে থেকে বের হবার সময় হ্যারি কষ্ট করে মুখ স্বাভাবিক রাখল।

আমি আমার রুমে থাকব, কোনো শব্দ করব না এবং ভান করব যে আমি ওখানে নেই। এক নাগাড়ে গড় গড় করে বলল হ্যারি।

ঠিক বলেছ ওটাই তুমি করবে। জোর দিয়ে বললেন আঙ্কল ভার্নন। মেসনরা তোমার সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং এটা এভাবেই থাকবে। ডিনার শেষ হলে পেতুনিয়া তুমি মিসেস মেসনকে নিয়ে যাবে আবার লাউঞ্জে বসে কফি পান করার জন্যে, আমি ড্রিল-এর বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করব। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তবে দশটার খবরের আগেই চুক্তি এবং সিল মারা শেষ হয়ে যাবে। আর কাল এ সময় আমরা মেজরকায় ছুটির দিনের শপিং করে বেড়াবো।

এ ব্যাপারে হ্যারি খুব উৎফুল্ল হতে পারল না। তার মনে হয় না ডার্সলিরা প্রিভেট ড্রাইভে তাকে যেমন পছন্দ করে মেজরকায় তার চেয়ে বেশি পছন্দ করবে।

ঠিক আছে–আমি শহরে যাচ্ছি ডাডলি আর আমার জন্যে ডিনার জ্যাকেট আনতে। আর তুমি! হ্যারির দিকে ফিরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, যতক্ষণ তোমার আন্টি ধোয়া মোছা করবে ততক্ষণ তুমি তার কাছ থেকে দূরে থাকবে।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসল হ্যারি। চমৎকার একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। সে লনটা পার হলো, একটা গার্ডেন বেঞ্চে ধপ করে বসল, চাপা গলায় গান গাইতে শুরু করল, হ্যাপি বার্থ ডে টু মি…….হ্যাপি বার্থ ডে টু মি…….

কোনো গ্রীটিংস কার্ড নেই, কোনো উপহারও নেই এবং সন্ধ্যাটা তাকে ভান করতে হবে যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সামনের এক গাছের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রইল। কখনই তার এমন একাকী মনে হয়নি। হোগার্টস-এর দিনগুলোর কথা ভাবলো। হোগার্টস-এ অন্য কিছুর চেয়ে বেশি, কিডিচ খেলার চেয়েও বেশি হ্যারি মিস করছে তার সবচেয়ে কাছের দুই বন্ধু রন উইসলি এবং হারমিওন গ্রেঞ্জারকে। তার মনে হয় ওরা তাকে মোটেই মিস করছে না। সারা গ্রীষ্মে দুজনের একজনও তাকে কোনো চিঠি লেখেনি, যদিও রন বলেছিল সে বাড়িতে গিয়ে হ্যারিকে তাদের সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ জানাবে।

অসংখ্যবার হ্যারি ভেবেছে জাদু দিয়ে হেডউইগের খাঁচা খুলে চিঠিসহ ওকে রন আর হারমিওনের কাছে পাঠায়, কিন্তু এটা একটু বেশিই হয়ে যাবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক জাদুকরদের স্কুলের বাইরে জাদু ব্যবহার করা নিষেধ। হ্যারি অবশ্য কখনই ডার্সলিদের কাছে তার এই ইচ্ছার কথা বলেনি, সে জানে ওদের এই একটাই ভয়, সে যদি ওদেরকে জাদু করে গোবরে পোকা বানিয়ে ফেলে। এই ভয়েই জাদুর কাঠি এবং ঝাড়ু-লাঠিসহ সিঁড়ির নিচের কাবার্ডে তালা মেরে রেখেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে নিচু স্বরে অর্থহীন কথা আওড়ানো এবং রুম থেকে ডাডলির ওর মোটা পদযুগল যত জোরে ওকে বহন করতে পারে অর্থাৎ তীর বেগে বেরিয়ে যাওয়া দেখতে ওর মজাই লাগত। কিন্তু রন এবং হারমিওনের দীর্ঘ নীরবতা তাকে ম্যাজিকের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে যে ডাডলিকে ক্ষেপানোও তার কাছে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। আর এখন রন এবং হারমিওন তার জন্মদিনটাও ভুলে গেছে।

হোগার্টস-এর একটা খবরের জন্য সে কিইনা করতে পারে? যে কোনো উইচ বা উইজার্ডের কাছ থেকে খবর পেলেও সে খুশি। এমন কি তার সবচেয়ে বড় শত্রু ড্র্যাকো ম্যালফয়-এর দেখা পেলেও সে খুশি হতো, শুধু নিশ্চিত হওয়ার জন্যে যে, সেসব স্বপ্ন ছিল না।

অবশ্য এমন নয় যে, তার হোগার্টস-এর পুরো বছরটা শুধু আনন্দেই কেটেছে। গত টার্মের একেবারে শেষে, হ্যারি, আর কারো সঙ্গে নয় একেবারে স্বয়ং লর্ড ভোলডেমর্টের একেবারে মুখোমুখি হয়েছিল। ভোলডেমর্টের এখন আর আগের শক্তি নেই। এখন হয়তো সে আগের ভোলডেমর্টের ধ্বংসাবশেষ কিন্তু এখনও ভীতিকর, এখনও ধূর্ত, এখনও ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ভোলডেমর্টের কবল থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বেঁচে গেছে হ্যারি, একেবারে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া বলতে হবে। এবং এখনও, কয়েক সপ্তাহ পরও, হ্যারি ঘাম ভেজা শরীরে রাতের বেলায় জেগে ওঠে, ভাবে এখন ভোলডেমর্ট কোথায়, মনে পড়ে ওর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ চেহারা, বড় বড় উন্মুক্ত চোখ……

হ্যারি হঠাৎ গার্ডেন বেঞ্চে সোজা হয়ে বসল। সে অন্যমনস্কভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ঝোপের দিকে হঠাৎ মনে হলো ঝোপটাও ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। পাতার মধ্যে দুটো বড় সবুজ চোখ ভেসে উঠল।

হ্যারি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, এমনি সময় লনের ওপর দিয়ে ভেসে এলো বিদ্রূপভরা একটা কণ্ঠস্বর, আমি জানি আজ কি দিন, হেলে দুলে গেয়ে উঠল ডাডলি।

বড় সবুজ চোখ দুটো কেঁপে উঠেই মিলিয়ে গেলো।

কী? বলল হ্যারি, ও দুটো চোখ যেখানে ছিল সেখানে চোখ রেখে।

আমি জানি আজ কি দিন, বলতে বলতে একেবারে সোজা হ্যারির কাছে চলে এলো।

চমৎকার, বলল হ্যারি। তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমি সপ্তাহের দিনগুলি সম্পর্কে শিখে ফেলেছ।

আজ তোমার জন্মদিন, অবজ্ঞাভরে বলল ডাডলি। তুমি কোনো কার্ড পাওনি এটা কেমন কথা? ওই উদ্ভট যায়গাটায় তোমার একজনও বন্ধু নেই?

তুমি আমার স্কুল সম্পর্কে আলোচনা করছ এটা তোমার মা না শুনলেই ভাল, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল হ্যারি।

হ্যারির স্থূল পশ্চাদ্দেশ থেকে প্যান্টটা স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছিল, হ্যাচকা টানে ওপরে তুলল ও।

তুমি ঝোপটার দিকে তাকিয়ে আছো কেন, সন্ধিগ্ধভাবে প্রশ্ন করল সে হ্যারিকে।

আমি স্থির করার চেষ্টা করছিলাম ওটাতে আগুন লাগাতে হলে কোনো জাদুটা সবচেয়ে ভাল হবে, বলল হ্যারি।

ডাডলি পেছন দিকে হোঁচট খেল, ওর ছোট্ট মুখে একটা ভীতির ছায়া।

তু তুমি পারো না–ড্যাড তোমাকে বারণ করেছে তুমি ম্যা… ম্যাজিক করতে পারবে না– বলেছে তোমাকে বাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে–আর তোমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তোমার কোনো বন্ধুও নেই যে তোমাকে নিয়ে যাবে।

জিগারি! পকারি! হ্যারি তীব্র কণ্ঠে বলল। হোকাস পোকাস… স্কুইগলি উইগলি…

মাআআআআআআম? আর্তনাদ করে উঠল আর দ্রুত পদক্ষেপে ঝাড়া দৌড় দিল ডাডলি। মাআআআআম! ও করছে, ইউ নো হোয়াট!

এই এক মুহূর্ত মজা করার জন্যে হ্যারিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। ডাডলিও ব্যথা পায়নি ঝোপটারও কোনো ক্ষতি হয়নি। আন্ট পেতুনিয়া যদিও বুঝতে পেরেছিলেন হ্যারি কোনো যাদুর ধার দিয়েও যায়নি। তবুও আন্ট পেতুনিয়া এক ভারি প্যান নিয়ে হ্যারিকে মারতে তেড়ে আসলেন। আঘাত হানতে উদ্যত আন্ট পেতুনিয়ার ভারি ফ্রাইং প্যানটাকে এড়াবার জন্য হ্যারিকে মাথা নিচু করে পালাতে হয়েছিল। শাস্তি হিসেবে তার ওপর অনেকগুলো কাজ চাপিয়ে দেয়া হলো, এবং তাকে প্রতিজ্ঞা করতে হলো যে, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে খাবে না।

চারিদিকে ডাডলি পায়চারি করছে, হ্যারির কাজ করা দেখছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে। হ্যারি জানালা পরিষ্কার করেছে, গাড়ি ধুয়েছে, লন-এর ঘাস আর গোলাপের চারাগুলোকে ছেটেছে, পানি দিয়েছে এবং বাগানের বেঞ্চগুলোকে আবার রং করেছে। মাথার ওপর সূর্য গনগন করছে, ঘাড়ের পেছনটায় যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। হ্যারি জানত তার ডাডলির ফাঁদে পা দেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু ডাডলি ঠিক ওই কথাটাই বলেছে যেটা সে নিজেও ভাবছিল….. হয়তো হোগার্টর্স-এ আসলেই তার কোনো বন্ধু নেই…

এখন যদি তারা বিখ্যাত হ্যারি পটারকে এ অবস্থায় দেখতো, ভাবল সে তিক্ততার সঙ্গে ফুলের বেডগুলোর উপর সার ছড়াতে ছড়াতে। পিঠ ব্যথা করছে, মুখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঘাম ঝরছে।

একেবারে ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সে আন্ট পেতুনিয়ার ডাক শুনতে পেলো।

হয়েছে এবার এসো! কাগজের ওপর দিয়ে হাটো।

খুশিতে হ্যারি চকচকে কিচেনের ছায়ায় চলে এলো। কিচেন ফ্রিজের ওপরে রয়েছে রাতের বরাদ্দ পুডিংটা : তোলা মাখনের বড় একটা তাল এবং চিনি মাখানো ভায়োলেট। অভেনে গরম হচ্ছে রোস্টেড পর্ক।

জলদি খেয়ে নাও! এক্ষুণি মেসনরা চলে আসবেন, চড়া গলায় বললেন আন্ট পেতুনিয়া। দেখিয়ে দিলেন কিচেন টেবিলের উপর রাখা দুস্লাইস রুটি আর এক দলা পনির। ইতোমধ্যেই তিনি নিজে পড়ে ফেলেছেন সামন গোলাপী ককটেল ড্রেস।

হাতমুখ ধুয়ে হ্যারি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সকরুণ রাতের খাবারের উপর। শেষ হওয়া মাত্র আন্ট পেতুনিয়া দ্রুত তার প্লেটটা সরিয়ে ফেললেন। জলদি! ওপরে!

লিভিং রুমের দরজা পেরোবার সময় এক ঝলক দেখতে পেলো আঙ্কল ভার্নন এবং ডাডলির পরনে ডিনার জ্যাকেট এবং বো টাই। উপরের তলায় মাত্র পা দিয়েছে অমনি নিচের কলিং বেল বেজে উঠল, সিঁড়ির গোড়ায় আঙ্কল ভার্ননের রাগে-লাল চেহারাটা দেখা গেলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,

মনে রেখ-একটা শব্দ …

পা টিপে টিপে হ্যারি তার বেডরুমে পৌঁছে গেলো, চুপিসারে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই অবসাদে গড়িয়ে পড়ল বিছানার ওপর।

কিন্তু মনে হলো কে যেন আগে থেকেই তার বিছানায় বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *