১০. হ্যালোইন

হ্যালোইন

পরদিন সকালে যখন হ্যারি এবং রনকে হোগার্টসেই দেখতে পেল, ম্যালফয় নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ধারণা ছিল হ্যারি আর রন মরে ভূত হয়ে গেছে। ক্লান্ত দেখালেও তারা বেশ উফুল্ল ছিল।

হ্যারি আর রন সেই তিনমুখো কুকুরের সাথে দেখা হওয়াটাকে একটা দারুণ অভিযান হিসেবে ভাবতে শুরু করলো এবং আবার সেখানে যাওয়ার কথা মাথায় রাখলো।

এর মধ্যে হ্যারি রনকে সেই প্যাকেটের মনে করিয়ে দিল যেটা সম্ভবত গ্রিংগটস থেকে হোগার্টসে পাঠানো হয়েছে। তারা দুজন ভাবছিল এত কড়া প্রহরার প্রয়োজন কী।

এটা হয়ত খুব মূল্যবান অথবা খুব বিপজ্জনক কিছু। রন মন্তব্য করল।

বা দুটাই, হ্যারি বলল।

শুধু তারা নিশ্চিত যেটা জানতে পারল, সেটা হলো যে, রহস্যজনক বস্তুগুলোর দৈর্ঘ্য দুই ইঞ্চি। অন্য কোন সূত্র ছাড়া প্যাকেটের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করাও সম্ভব হলো না। নেভিল বা হারমিওন কুকুর অথবা গোপন দরজার ভেতরে কী আছে–সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করেনি।

হারমিওন কয়েকদিন ধরে ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। এতে রন বা হ্যারির বরং লাভ, কারণ হারমিওন সব সময় তার কর্তৃত্ব ফলাতে চায় যা তাদের পছন্দ নয়। ওদের এখন একমাত্র লক্ষ্য ম্যালফয়কে এক হাত দেখিয়ে দেয়া, এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই ডাকযোগে সে সুযোগ এসে গেল।

যখন পেঁচারা এসে গ্রেট হলে প্রবেশ করল তখন সবাই তাকিয়েছিল একটা প্যাকেটের দিকে যেটি ছুটি পেঁচা বয়ে নিয়ে এসেছে। যখন পেঁচারা প্যাকেটটা হ্যারির ঠিক সামনে ফেলল তখন সত্যি সে অবাক হলো। পেঁচাগুলো বাইরে চলে গেলে হ্যারি দেখল প্যাকেটের ওপর একটা চিঠি। হ্যারি চিঠিটা খুলল। চিঠিটা এসেছে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কাছ থেকে আনন্দের সংবাদ নিয়ে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল লিখেছেন

পার্সেলটা টেবিলের ওপর খুল না।
এর ভেতর আছে নতুন নিম্বাস–২০০০।
আমি চাই না অন্য কেউ জানুক তুমি একটা নতুন ঝাড়ু পেয়েছ।
আজ রাতে অলিভার উড তোমার সাথে দেখা করবে–কিভিচ খেলার মাঠে।
ঠিক সাতটায়–তোমার প্রশিক্ষণের জন্য।
–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল

নিজের আনন্দ গোপন করতে হ্যারির কষ্ট হচ্ছিল। তাই সে চিঠিটা রনকে পড়তে দিল।

রন বলল–নিম্বাস ২০০০! আমি তো এ ধরনের ঝাড়ু এখন পর্যন্ত স্পর্শই করিনি।

তারা হলের বাইরে এসে দেখে ওপরে সিঁড়ি আটকে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেব আর গয়েল। ম্যালফয় হ্যারির হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। আরে এটা তো একটা ঝাড়ু। এই বলে দ্বেষ ও হিংসাভরা দৃষ্টিতে ম্যালফয় ঝাড়ুটা হ্যারির দিকে ছুঁড়ে মারল আর বলল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য তো ঝাড়ু নিষিদ্ধ।

রন আর চুপ থাকতে পারল না। বলল-এটা তো পুরনো ঝাড়ু নয়, নিম্বাস–২০০০। ম্যালফয় তুমি বলেছিলে যে, তোমার কাছে একটি কমেন্ট ২৬০ আছে?

রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল–কমেট দেখতে বড়। কিন্তু নিশ্বাসের সাথে কমেন্টের কোন তুলনাই হয় না।

এটা পেয়ে তোমাদের কোন লাভ নেই। এর হাতলের অর্ধেক তোমরা ব্যবহারই করতে পারবে না। ম্যালফয় মন্তব্য করল।

রন জবাব দেয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক ফ্লিটউইক। তিনি বললেন–কী ব্যাপার। তোমরা কী নিয়ে ঝগড়া করছ।

হ্যারিকে একটি ঝাড়ু পাঠানো হয়েছে। ম্যালফয় বলল।

আমি তা জানি। ফ্লিটউইক বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির ব্যাপারে আমাকে সবকিছু জানিয়েছেন। এটা কোন মডেল?

নিম্বাস ২০০০, স্যার। ম্যালফয়ের আতঙ্ক দেখে অনেক কষ্টে হাসি চেপে হ্যারি জবাব দিল। আর এটা পাবার জন্য আমি ম্যালফয়কে ধন্যবাদ দিতে চাই।

ম্যালফয়ের হতাশা দেখে হ্যারি আর রন খুব খুশি। হাসতে হাসতে ওরা ওপরে উঠতে লাগল।

মর্মর পাথরের সিঁড়ির ওপরে উঠে হ্যারি বলল–সে যদি নেভিলের স্মারকটি চুরি না করতো, আমি আজকে এখানে থাকতে পারতাম না।

তুমি কি মনে কর-এটা তোমার আইন ভাঙার পুরস্কার? পেছন থেকে হারমিওনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

আমি ভেবেছি তুমি আমাদের সাথে কথা বলবে না? হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল।

আমাদের সাথে কথা না বলার অভ্যাসটা তুমি চালিয়ে যাও। রন মন্তব্য করল।

বিরক্ত হয়ে হারমিওন উঠে চলে গেল।

ওইদিন নানাবিধ ঝামেলা হ্যারির পড়াশোনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটালো। তার বড় চিন্তা ডর্মিটরির কোন জায়গাটিতে সে তার নতুন ঝাড়ুটা রাখবে। সে রাতে হ্যারি কিছুই খেল না। ঝাড়ুর প্যাকেট খোলার জন্য সে আর রন ওপরে গেল। খোলার পর দেখা গেল–চিকন চকচকে ঝাড়ু। মেহগনি কাঠের হাতল। ঝাড়ুর গায়ে সোনালী হরফে লেখা–নিম্বাস ২০০০।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল। সন্ধ্যা সাতটা বাজার কিছু আগেই হ্যারি দুর্গ ছেড়ে কিডিচ মাঠের দিকে রওনা হলো। এর আগে সে কখনও স্টেডিয়ামে আসেনি। একশর মত আসন। খেলা বা অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট।

উড তখনও আসেনি। হ্যারির ওড়ার ইচ্ছে হলো। সে মাটিতে লাথি দিয়ে ঝাড়ু নিয়ে উড়ে চলল। বারবার গোলপোস্টের ভেতর দিয়ে ঢোকা আবার বেরিয়ে আসা। হ্যারির দারুন মজা লাগছে। তার সামান্য স্পর্শে নিম্বাস ২০০০ অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করছে।

হায় পটার, এদিকে এসো। অলিভার উড এসে গেছে।

তার হাতে কাঠের একটা বড় বাক্স। হ্যারি উডের পাশে দাঁড়াল।

চমৎকার। ঊড মন্তব্য করল। হ্যারি, আমি দেখতে পাচ্ছি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল যা বলেছিলেন… একেবারে খাঁটি। আজ আমি তোমাকে কিডিচ খেলার নিয়মকানুন সম্পর্কে কিছু বলব। তারপর তুমি সপ্তাহে তিনদিন খেলা অনুশীলন করবে। উড বাক্সটা খুলল। বাক্সের ভেতর বিভিন্ন আকারের চারটা বল। অলিভার ঊড় এবার তাকে খেলাটা বোঝালেন। বললেন–খেলাটা একটু কঠিন। প্রত্যেক দলে সাতজন খেলোয়াড় থাকবে। তাদের মধ্যে তিনজন হবে চেজার বা ধাওয়াকারী।

তিনজন চেজার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

উড এবার ফুটবল আকৃতির একটা উজ্জ্বল লাল বল বের করল।

উড এবার ব্যাখ্যা করল-এই বলটার নাম কুয়াফল।

চেজারগণ কুয়াফল পরস্পরের মাঝে হস্তান্তর করে এবং গর্তে ফেলে গোল করার চেষ্টা করে।

উড আরো ব্যাখ্যা করল–প্রতিটা দলে একজন খেলোয়াড় থাকে যার নাম কীপার। কীপারের দায়িত্ব হলো গোল ঠেকালো। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের কিপার।

এ খেলায় তাহলে তিনজন চেজার ও একজন কীপার থাকে। তারা কুয়াল নিয়ে খেলা করে। হ্যারি খেলার বিস্তারিত নিয়মকানুন আগ্রহের সাথে জানার চেষ্টা করলো।

এবার আমি তোমাকে দেখাবো কীভাবে খেলতে হয়। উড বলল এটা হাতে নাও।

উড হ্যারিকে তিনটা ছোট ব্যাট ও একই রকম দুটো বল দিলেন। বল দুটো কালো রঙের এবং কুয়াফলে থেকে একটু ছোট। বল দুটোর নাম ব্লুজার। এবার দাঁড়িয়ে থাকো। উড হ্যারিকে নির্দেশ দিল।

হঠাৎ করে কালো ব্লুজারটা ওপরে উঠে হ্যারির মুখের কাছে চলে এলো। হ্যারি ব্যাট দিয়ে সরিয়ে দিল যাতে বলটি তার মাকে আঘাত না করে। এটা ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে উডের কাছে চলে গেল। উড ব্লুজারটা ঠেকিয়ে গর্তে পাঠিয়ে দিল।

খেলা নিয়ে হ্যারিকে উড কয়েকটা প্রশ্ন করল। হ্যারি প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল।

চমৎকার। উড মন্তব্য করল।

হ্যারি উডকে প্রশ্ন করল–আচ্ছা ব্লুজারদের হাতে কখনও কি কেউ মারা গেছে?

হোগার্টসে কখনও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সর্বোচ্চ যেটা হয়েছে সেটা হলো কারো কারো দাঁত ভেঙেছে। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটেনি। এবার শোন, এই দলের সর্বশেষ ব্যক্তি হলো সিকার–সেটা হচ্ছো তুমি। অবশ্য কুয়াফল বা ব্লুজার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

যতক্ষণ না তারা আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়।

তোমার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। উড বলল–ব্লুজারদের ঠেকাতে দুই উইসলি যমজ ভাই–ই যথেষ্ট। তারা নিজেরাই একটা ব্লুজার জুটি। এরপর উড বাক্স থেকে চতুর্থ এবং শেষ বলটা বের করল। কুয়াফল এবং ব্লুজারের তুলনায় এটা ছিল আরো ছোট এবং বড় একটা কাঠবাদামের সমান। এটা ছিল উজ্জ্বল সোনালী রঙের, ছোট একটু গোলাপী পাখা।

বলগুলো হাতে নিয়ে উড বলল-এটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এ বলটার গতি এত বেশি যে এটা ধরাই মুশকিল। আর সিকারের দায়িত্ব হল বলগুলো ধা। সিকার যদি এ বলটা ধরতে পারে তাহলে তার দল অতিরিক্ত ১৫০ পয়েন্ট পাবে।

আর কোন প্রশ্ন আছে? উড হ্যারির কাছে জানতে চায়।

হ্যারি মাথা নাড়ল। তার কী করণীয় এটা সে বুঝতে পেরেছে।

আমরা এখনও স্নিচ বল নিয়ে খেলিনি। বলগুলো বাক্সে রাখতে রাখতে উড বলল-এত অন্ধকারে বল হারিয়ে যেতে পারে।

উড তার পকেট থেকে গলফ বলের একটা সাধারণ ব্যাগ বের করল। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল উড চারদিকে জোরে জোরে বলগুলো ছুঁড়ে মারছে আর হ্যারি তা লুফে নিচ্ছে।

হ্যারি প্রতিটা বল লুফে নিল। উড খুব খুশি। আধঘণ্টা পর যখন সত্যি সত্যিই অন্ধকার নেমে এল, তখন তারা অনুশীলন বন্ধ করল।

এবার কিডিচ কাপ আমরা পাব। খুশি মনে উড মন্তব্য করল। দুর্গে ফেরার পথে উড বলল–তুমি যদি চার্লস উইসলির চেয়ে ভালো খেল, আমি অবাক হব না। সে হয়ত ইংল্যান্ডের পক্ষ হয়েই খেলতে পারত যদি সে ড্রাগনের পেছনে না ছুটত।

হ্যারি এখন খুবই ব্যস্ত। একদিকে কিন্ডিচ খেলার জন্য সপ্তাহে তিনবার অনুশীলন। অন্যদিকে হোমওয়ার্ক তো আছেই। হ্যারি ভাবতে লাগল সে হোগার্টসে এসেছে মাত্র দুমাস হলো। এর ভেতরই সে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রিভেটড্রাইভের তুলনায় দুর্গটি তার কাছে অনেক আপন মনে হচ্ছে। লেখাপড়া গোড়াতে কঠিন মনে হলেও এখন খুব উৎসাই বোধ করছে।

ঘুম ভাঙলো সুস্বাদু খাবারের গন্ধে। হ্যারির মনে হলো, হ্যালোইন ব্যাপারটা বোঝা দরকার। অধ্যাপক ফ্লিটউইক ঘোষণা দিলেন, এখন ছাত্ররা জিনিসপত্র আকাশে ওড়াতে পারবে। এজন্য তিনি ছাত্রদের জোড়ায় জোড়ায় বসিয়ে দিলেন। হ্যারির জুটি হলো সিমাস ফিনিগান। নেভিলের ব্যাঙ একটি ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল। রানের জুটি হলো হারমিওল গ্রেপ্পার। রন অথবা হারমিওন কেউ এতে অখুশি কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। যেদিন থেকে হ্যারি ডাকে ঝাড়ু পেল সেদিন থেকেই হারমিওন হ্যারি ও ব্রনের সাথে কথা বলে না।

অধ্যাপক ফিটউইক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন-একটা কথা মনে রেখো। কথাটি হলো–সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক, মনে রেখো সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক। এ মন্ত্র উচ্চারণ করো। কখনো ভুল করে উচ্চারণ করবে না। মনে রেখো–ভুল করে জাদুকর বারুফিয়ে একবার স এর বদলে ফ উচ্চারণ করেছিল, তারপর সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে। তার বুকের ওপর একটা মহিষ।

এটা ছিল বেশ কঠিন! হ্যারি ও সিমাস বার কয়েক সুইশ এন্ড ফ্লিক করলো একটা পালক আকাশের দিকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু এটা টেবিলের ওপর থেকে আর আকাশের দিকে উঠলো না। সিমাস ধৈর্য হারিয়ে জাদু কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে পালকটাতে আগুন ধরিয়ে দিল আর হ্যারিকে তার টুপি দিয়ে সেই আগুন নিভাতে হলো।

পাশের টেবিলে রন তেমন সুবিধে করতে পারছিল না। রন তার লম্বা হাত ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–উইংগার্ডিয়াম লেভিওসা।

হারমিওন বলল–ভুল হলো। তুমি ভুল উচ্চারণ করেছ।

এতই যদি জানো তাহলে তুমি নিজেই উচ্চারণ কর। হারমিওনের উদ্দেশ্যে রন বলল।

হারমিওন তার গাউনের আস্তিন গুটালো, এবং জাদুর দণ্ডটা ঘোরাল। তারপর উচ্চারণ করল–উইং–গার–ডিয়াম লেভি–ও–সা। এরপর পালকটা টেবিল থেকে ওপরদিকে উঠতে লাগলো এবং তাদের মাথারও চার ফুট ওপরে উঠলো। অধ্যাপক ফ্লিটউইক করতালি দিয়ে উঠলেন এবং হারমিওনের প্রশংসা করলেন।

ক্লাসশেষে রনের মেজাজ খুব খারাপ।

জনাকীর্ণ করিডোর অতিক্রম করতে করতে রন হ্যারিকে বলল-এটা কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে কেউই হারমিওনকে সহ্য করতে পারে না। সত্যি বলতে কী সে সবার জন্য একটা দুঃস্বপ্ন।

মনে হলো কেউ যেন হ্যারির পিঠ ছুঁয়েছে। হ্যারি তাকিয়ে দেখে হারমিওন। হারমিওনের চোখে অশ্রু দেখে হ্যারি সত্যিই অবাক হলো।

মনে হয় সে তোমার কথা শুনতে পেয়েছে। হ্যারি রনকে বলল।

তাতে কী হয়েছে? রন একথা বললেও খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। একটু থেমে বলল–সে এখন বুঝতে পেরেছে তার কোন বন্ধু নেই।

পরবর্তী ক্লাসে হারমিওন এল না। বিকেলেও কোথাও তাকে দেখা গেল না। হ্যালোইন ভোজে যোগদানের জন্যে গ্রেট হলে যাবার পথে হ্যারি আর রন শুনতে পেল যে পার্বতী পাতিল তার বন্ধু ল্যাভেঞ্জারকে বলছে, হারমিওন মেয়েদের টয়লেটে গিয়ে কাঁদছে এবং সে চাইছে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। একথা শুনে রনের খুব খারাপ লাগতে লাগল। পরে যখন তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করলো, সেখানকার চোখ ধাঁধানে সাজসজ্জায় ও হইচইয়ে তারা হারমিওনের কথা একেবারেই ভুলে গেল।

হাজার খানেক জীবন্ত বাদুর সিলিং ও দেয়াল ধরে এদিক–ওদিক ঊড়ছিল। আরো হাজার খানেক বার টেবিলের সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে মোমবাতিগুলো কুমড়োর খোলে বসিয়ে দিল। ছাত্রদের টার্মের প্রথম দিকের ভোজসভা বলে সোনালী থালায় খাদ্য পরিবেশিত হলো।

হ্যারি যখন তার প্লেটে আলু তুলে নিচ্ছিল ঠিক তখন প্রায় দৌড়ে অধ্যাপক কুইরেল গ্রেট হলে প্রবেশ করলেন। তার পাগড়ি বিপর্যস্ত। সবাই অবাক হয়ে দেখল তিনি ডাম্বলডোরের চেয়ারের দিকে যাচ্ছেন। টেবিলের কাছে গিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন–ট্রল, সেই বিরাট জল্পটা… বন্দিশালা… আমার ধারণা ছিল আপনি সব জানেন। তারপর তিনি মুৰ্ছা খেয়ে মরার মত মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।

চারদিকে শোরগোল পরে গেল, কোণ থেকে অধ্যাপক ডাম্বলডোর তার জাদুদণ্ড ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেন।

প্রিফেক্টগণ। ডাম্বলডোর নির্দেশ দিলেন, এখনই তোমরা হাউজের সকলকে নিয়ে ডর্মিটরিতে ফিরে যাও।

পার্সি কাছেই ছিল।

পার্সি বলল–তোমরা সবাই আমাকে অনুসরণ কর। প্রথম বর্ষের সব ছাত্র আমার পেছনে এসো। আমার পেছন পেছন এলে তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। ট্রল তোমাদের কিছু করতে পারবে না। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা একাট্টা হয়ে আমার পেছনে পেছনে এসো। সরে দাঁড়ান, প্রথম বর্ষের ছাত্ররা আসছে। আমি একজন প্রিফেক্ট।

হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলো, ট্রল এলো কি করে?

আমাকে এ প্রশ্ন করো না। মনে হয় তারা সবাই বুন্ধু। রন বলল। হয়ত হ্যালোইন ভোজসভায় মজা করার জন্য পিভস এটা করেছে।

তারা বিভিন্ন গ্রুপের ছাত্রদের পার হয়ে গেল যারা ঊর্ধ্বশ্বাসে বিভিন্ন দিকে ছুটছে। তারা যখন হাফলপাফ হাউজের উদভ্রান্ত ছাত্রদের ভিড় অতিম করছিল তখন হ্যারি হঠাৎ করেই রনের হাত চেপে ধরলো।

আমি কিন্তু ভাবছি হারমিওনের কথা। হ্যারি বলল।

তার সম্পর্কে কী ভাবছো? রন জানতে চাইল।

ট্রলের বিষয়ে সে জানে না।

রন ঠোঁটে কামড় দিল।

ঠিক আছে। রন বলল–পার্সি আমাদেরকে না দেখে ফেললেই হলো।

তারা হাফল পাফ হাউজের ছাত্রদের দলের ভেতরে মিশে গেল। সেখান থেকে সটকে পড়ে একটি নির্জন করিডোরের দিকে অগ্রসর হলো। আরেকটু এগিয়েই তারা মহিলা টয়লেটের কাছাকাছি এলো। পেছন দিকে তারা দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পেল।

পার্সি। নিচু কণ্ঠে রন উচ্চারণ করল।

তারা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল–পার্সি নয়, স্নেইপ।

স্নেইপ করিডোরে তৃতীয় তলার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

হ্যারির নাকে এক ধরনের বাজে গন্ধ এলো। অনেকটা ভেজা, স্যাঁতসেতে অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের গন্ধ। একটু পরেই মনে হলো কে যেন আসছে। পদশব্দ, দৈত্যের পদশব্দের মত। অতিকায় জীবটি ঘরে ঢুকল। বারো ফুট লম্বা। গায়ের চামড়া অন্যরকম। গ্রানাইট পাথরের মতো গায়ের রঙ। মাথায় টাক। অনেকটা নারকেলের মত। হাতে একটা বিশাল কাঠের ডাণ্ডা। দরোজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলো ট্রল।

হ্যারি বলল চাবিটা তালার মধ্যেই আছে। আমরা তো ট্রলকে আটকে রাখতে পারি।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল–চলো তাই করি। তারা দুজন আগে বাড়ল। তারা মনে মনে প্রার্থনা করছিল যেন ট্রল তাদের দিকে অগ্রসর না হয়। তাদের প্রার্থনায় কাজ হলো। হ্যারি লাফ দিয়ে কোনমতে তালা ও চাবি হাতের নাগালে পেল। তারপর তালা লাগিয়ে ট্রলকে বন্দি করে ফেলল।

সাফল্যের আনন্দে তারা যখন ফিরে আসছিল ঠিক তখনই তারা শুনলো একটা বিকট আর্তনাদ। যে ঘরে তারা ট্রলকে বন্দি করেছে, সেখান থেকেই শব্দটা আসছে।

ওটা তো মেয়েদের টয়লেট। হ্যারি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

আরে এ তো হারমিওন। বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে তারা একসাথে চিৎকার করে উঠল।

তারা যে কাজটি করতে চাইল সেটা করা ছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় ছিল না। তারা আবার দরোজার কাছে গেল। ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে দরোজার তালাটি খুলেই দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

হারমিওন গ্রেঞ্জার বিপরীত দিকের দেয়ালে ভয়ে কুঁচকে গেছে। মুৰ্ছা যাবার উপক্রম। দৈত্যটি তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তাকে বিভ্রান্ত কর। রনের উদ্দেশ্যে হ্যারি কলল। তারপর হ্যারি একটি ট্যাপ থেকে ট্রলের চোখে অনবন্ত পানি ছুঁড়তে লাগল।

হারমিওনের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্রল। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল আওয়াজটি কোত্থেকে আসছে। তার ছোট চোখ দুটি হ্যারির ওপর পড়ল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মুগুরটা হাতে নিয়ে ট্রল হ্যারির দিকে অগ্রসর হলো।

ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রন একটা ধাতব পাইপ ছুঁড়ে মারল। ট্রলের ঘাড়ে পাইপটা লাগলেও তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলো না।

তবে তার বিকট চিৎকার শোনা গেল। সে হ্যারিকে পালাবার সুযোগ দিয়ে তার বিশ্রী মুখটা রনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

চলে এসো। দৌড়, দৌড় দাও। হারমিওনের উদ্দেশ্যে হ্যারি চিৎকার করল। কিন্তু হারমিওন নড়তে পারছে না। সে দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভয়ে তার মুখ হা হয়ে আছে।

এরপর হ্যারি যে কাজটা করল তা একদিকে যেমন সাহসের অপরদিকে বোকামির। সে এক লাফ দিয়ে ট্রলের পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরল। এবার ট্রল আর নড়তে পারছে না। হ্যারি তার জাদুদণ্ড তার একটা নাকের ফুটোয় সোজা ঢুকিয়ে দিল।

যন্ত্রণায় ট্রল আর্তনাদ করে উঠল। সে তার মুগুরটা ঘোরানো শুরু করলো, এবং হ্যারি আশঙ্কা করছে যেকোন সময় এটা তার মাথা দু ভাগ করে দেবে।

হারমিওন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রন তার নিজের জাদুদণ্ডটা নিয়ে কি করবে প্রথমে ভেবে পাচ্ছিল না, পরে উচ্চারণ করলো, উইনগারডিয়াম লেভিওসা?

মুগুরটা হঠাৎ ট্রলের হাত থেকে ছুটে ওপরে ওঠা শুরু করলো এবং ফিরে এসে ট্রলের মাথায় পড়লো। তীব্র আঘাতে ট্রল মাটিতে পড়ে গেল।

হ্যারি উঠে দাঁড়ালো। সে কাঁপছে, কোন শ্বাসও নিতে পারছে না।

হঠাৎ দরোজা বন্ধ হবার আওয়াজ শোনা গেল। পদশব্দও শোনা গেল। তারা তিনজন মাথা উঁচু করে তাকাল। তারা বুঝতে পারল না তারা কোন্ চক্রের ভেতর জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য নিচতলায় কেউ না কেউ তাদের হৈচৈ এবং জন্তুটার গর্জন শুনেছে।

একটু পরই ঘরে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। তার পেছন পেছন এসেছেন স্নেইপ ও অধ্যাপক কুইরেল। কুইরেল এক নজর ট্রলের দিকে তাকালেন। মৃদু আর্তনাদ করে দুহাতে কান চেপে টয়লেটে বসে পড়লেন। স্নেইপ মাথা ঝুঁকিয়ে ট্রলকে দেখতে লাগলেন। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারি আর রনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। হ্যারি কখনও তাঁকে এত ক্ষুদ্ধ দেখেনি। তার ঠোঁট বিবর্ণ, সাদী। হ্যারি ভাবল গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য যে পঞ্চাশ পয়েন্ট পাওয়ার কথা ছিল তা আর পাওয়া যাবে না।

তোমরা নিজেদের কি ভাব? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খুব রেগেমেগে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন। হ্যারি রনের দিকে তাকাল। রনের হাতে তখন ওর জাদুদণ্ড। ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের ভাগ্য ভালো, তোমরা মারা যাওনি। তোমরা ডর্মিটরির বাইরে কেন এসেছিলে?

স্নেইপ তীব্র দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারির মনে হচ্ছিল রনের জাদুদণ্ডটা নামিয়ে রাখা উচিত। শিক্ষকদের সামনে ওভাবে হাতে রাখা ঠিক নয়।

একটু পরে পেছনের অন্ধকারের মধ্য থেকে মৃদু শব্দ শোনা গেল। ম্যাকগোনাগল দয়া করে একটু শুনুন। ওরা আমাকে খুঁজছিল।

মিস গ্রেঞ্জার?

হারমিওন অবশেষে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে।

আমি ট্রলের সন্ধান করছিলাম। কারণ, আমার ধারণা ছিল আমি একাই তার সাথে লড়তে পারব। আমি তাদের ওপর অনেক পড়াশোনা করেছি।

রন তার জাদুদণ্ড নামিয়ে রাখল। হারমিওন কীভাবে শিক্ষকের সামনে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে?

আমি ভেবেছিলাম আমি ট্রলকে আটকাতে পারবো। কারণ, এই জন্তুটা সম্পর্কে অনেক বই পড়েছি। তারা যদি আমাকে খুঁজে না পেত, তাহলে এতক্ষণে আমি মারাই যেতাম। হ্যারি তার জাদুদণ্ডটা ট্রলের নাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর রন ট্রলের মুগুর দিয়েই ওর মাথায় আঘাত করেছে। তারা কোন সময় পায়নি অন্য কাউকে ডাকার।

ও–তা হলে তুমি–ই… প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তাঁদের তিনজনের মুখ পরখ করে বললেন। মিস গ্রেঞ্জার তুমি তো এক ভীষণ বোকার মত কাজ করেছো। তুমি কী করে ভাবলে যে তুমি এই পাহাড়ি জন্তুটিকে আটকাতে পারবে।

হারমিওন তার শিক্ষকের কাছে একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *