০৯. মধ্যরাতের মল্লযুদ্ধ

মধ্যরাতের মল্লযুদ্ধ

হ্যারি কখনো ভাবতে পারেনি যে, ডাডলির চেয়েও কোন খারাপ ছেলের সাথে তার দেখা হবে। কিন্তু তাই হলো। ছেলেটির নাম ম্যালফয়। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের প্রথম বর্ষের ছাত্ররা শুধুমাত্র ওষুধ তৈরির ক্লাস করতেই এক সাথে মিলিত হতো।

ওই ক্লাস ছাড়া অন্য কোন ক্লাসে ম্যালফয়ের সাথে দেখা হতো না। বৃহস্পতিবার থেকে ফ্লাইং শেখানো হবে। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের ছাত্রদেরকে একসাথে ওড়া শেখানো হবে জেনে হ্যারি আক্ষেপ করে বলল ম্যালফয়ের সামনে আমাকে ঝাড়ু লাঠির ওপর বোকা বানাবার জন্যই এটা করা হয়েছে।

উড়তে শেখার অনুশীলন নিয়ে হ্যারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রন বলল–তুমি এখনই সব কিছু বলতে পার না, ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা দেখে নিজেই হয়তো অবাক হবে। ম্যালফয় দেখাতে চায় যে, কিডিচ খেলায় সে কতখানি দক্ষ। আসলে সে যতটা বলে ততটা সে নয়।

ম্যালফয় ওড়ার বিষয়ে তার দক্ষতা নিয়ে অনেক কথা বলত। সে এটাও জোর দিয়ে বলত যে, প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে হাউজ টিমে কিডিট খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় না। সে নিজের সম্পর্কে গল্প করতো, কীভাবে খাগলরা তার কাছ থেকে অল্পের জন্য হেলিকপ্টারে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। তার গল্পের শেষটা সব সময় এই রকমই হয়–অল্পের জন্য…।

শুধু ম্যালফয়ই নয়। সিমাস ফিনিগানও এ ধরনের বাড়িয়ে কথা বলত। সে দাবি করত যে ছোটবেলায় ঝাড়ুর সওয়ার হয়ে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। এমন কী রনও দাবি করত যে, সে উড়তে গিয়ে তার ভাই চার্লির ঝাড়ুর সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল। জাদুকর পরিবার থেকে যারা এসেছে তারা প্রায় সবাই কিভিচ খেলার ব্যাপারে আলোচনা করত।

এ নিয়ে ডীন টমাসের সাথে রনের তর্ক হয়ে গেছে। বিতর্কের বিষয় ছিল ফুটবল। রন বুঝে উঠতে পারে না কেবল একটি বল নিয়ে খেলায় কীভাবে এত আনন্দের হতে পারে, যেখানে ওড়ার কোন সুযোগ নেই।

নেভিল কখনও ঝাড়ুর ওপর সওয়ার হয়নি কারণ ওর নানী কখনো ওকে ওটার ধারে কাছে যেতে দেয়নি। কারণ, সে ইতোমধ্যে মাটিতেই খেলতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নেভিলের মত ওড়ার ব্যাপারে হারমিওন-এরও সাহস কম, এটা এমন একটা জিনিস যা বই পড়ে শেখা যায় না।

বৃহস্পতিবার সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় হারমিওন লাইব্রেরি থেকে সগ্রহ করা কিডিচ থ্রু এইজেস বই থেকে জানা ওড়ার বিষয়ে নানা জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। নেভিল তার পেছন থেকে হারমিওনের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহে তার কথা শোনে। অন্যদের শোনার কোন আগ্রহ ছিল না। বরং ডার্ক চলে আসার পর তার বক্তৃতা থেকে সবাই যেন রেহাই পায়।

হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের পর হ্যারির নামে কোন চিঠি আসেনি-এটা ম্যালফয় লক্ষ্য করেছে। এসব বিষয় সে খেয়াল করে বেশি। ম্যালফয়ের ঈগলপেঁচা তার জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে। ম্যালফয় ঝাঁপিয়ে পড়ে তা স্লিদারিন হাউজের টেবিলের ওপর খোলে। একটি পেঁচা নেভিলের নানীর বাড়ি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো।

সে উত্তেজনায় দ্রুত প্যাকেটটি খুলল। এটা ছিল মার্বেল আকারের একটা কাঁচ। মনে হলো কাঁচের ভেতর ধুয়া।

এটা একটা স্মারক। সে ব্যাখ্যা করল। আমার নানী জানেন যে আমি অনেক কিছুই ভুলে যাই। তুমি যদি কিছু ভুলে যাও এই কাঁচটা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে। শক্ত করে ধরে এটার দিকে তাকিয়ে থাক। এটা যদি লাল হয়ে যায় তাহলে তুমি বুঝবে তুমি হয়ত কিছু ভুলে গেছ। স্মারকটা হঠাৎ লাল হয়ে উঠল, এর অর্থ আমি নিশ্চয়ই কিছু ভুলে গেছি।

নেভিল ভাবতে লাগলো এমন কিছু কি আছে যা সে ভুলে গেছে। সে সময় ম্যালফয় তার গ্রিফিল্ডর হাউজের টেবিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে নেভিলের হাত থেকে স্মারকটা ছিনিয়ে নিল। হ্যারি আর রন লাফ দিয়ে ম্যালফয়ের ওপর চড়াও হলো। তারা ভাবছিল ম্যালফয়কে একহাত দেখিয়ে দেবে। ঠিক এই সময় অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন–কী ব্যাপার, এখানে গণ্ডগোল কিসের?

প্রফেসর, ম্যালফয় আমার স্মারক নিয়ে নিয়েছে। ম্যালফয় তাড়াতাড়ি স্মারকটা টেবিলের ওপর রেখে দিল।

ঠাট্টা করছিলাম। এই বলে সে ক্রেব আর গয়েলকে নিয়ে সরে গেল।

***

তখন বিকেল সাড়ে তিনটা। প্রথম উড়ান শিক্ষা শুরু হবে। হ্যারি, রন ও অন্যরা মাঠে গেছে। সবুজ দুর্বাঘাস বাতাসে হেলে পড়েছে।

স্লিদারিন হাউজের ছাত্ররা ইতোমধ্যে এসে গেছে। কুড়িটা ঝাড়ু মাঠে সারি করে সাজানো। হ্যারি শুনেছে ফ্রেন্ড আর জর্জ এই ঝাড়ি নিয়ে অনেক অভিযোগ করেছে। এগুলো নাকি বেশি উপরে উঠলে কাঁপতে থাকে। আর বাঁদিকে ঘুরে যায়।

তাদের শিক্ষক মাদাম হুচ ক্লাসে প্রবেশ করলেন। তার চুল ছোট ও ধূসর রঙের। চোখ বাজপাখির চোখের মত হলুদ।

তিনি এসেই চিৎকার করে বললেন তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই ঝাড়ুর পাশে দাঁড়াও তাড়াতাড়ি চলে এসো।

হ্যারি তার ঝাড়ুর দিকে তাকাল। ঝাড়ুটি পুরনো এবং কিছু কাঠি বাঁকা হয়ে নড়ে গেছে।

মাদাম হুচ এবার নির্দেশ দিলেন–ডান হাত সামনের দিকে ঝাড়ুর ওপর রাখ। এবার বল–আপ।

হ্যারির ঝাড়ুটা তার হাতে লাফিয়ে উঠল। হারমিওনেরটা মাঠের ওপর গড়িয়ে পড়ল। নেভিল এক চুল পরিমাণ নড়তে পারল না। ওর হাত কাঁপছে। ওর মাথায় ভয়ের ছাপ। ও মাটি থেকে উপরে উঠতে ভয় পাচ্ছে। মাদাম হুচ দেখালেন কিভাবে ঝাড়ুর ওপর চড়তে হয়। তিনি ম্যালফয়কে ধমক দিলেন–তুমি কি সারাজীবন ভুল করবে?

এই কথাটা শুনে হ্যারি ও রন দারুণ খুশি হলো যে, ম্যালফয় সব সময়ই ভুল করছে।

মাদাম হুচ বললেন–আমি বাঁশি বাজাবার সাথে সাথে তোমরা লাফ দেবে। ঝাড়ু সোজা রাখবে। কয়েক ফুট ওঠার পর সামনের দিকে ঝুঁকবে। তারপর নিচে নেমে আসবে। তোমরা প্রস্তুত হও। আমি এখন বাঁশি বাজাচ্ছি। তিন……..দুই……..

এক বলা বাকি। নেভিল আগেই লাফ দিল। মাটি থেকে উপরে উঠার পর সে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ল। সে একটু বেশিই উপরে উঠেছে কারণ সে মাটিতে জোরে ধাক্কা দিয়েছিল।

মাদাম হুচ চিৎকার করলেন–কামব্যাক মাই বয়। কিন্তু নেভিল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হ্যারি লক্ষ্য করল যে, নেভিলের চেহারা একেবারে ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। ঝড়ির পাশে থেকে সে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। নেভিল যখন মাটিতে পড়লো তখন ধুম করে শব্দ হলো।

নেভিলের কবজি ভেঙে গেছে। সে উপুড় হয়ে একটা ঘাসের পে শুয়ে পড়ল। তার ঝাড়ু এখনও ঊর্ধ্বমুখী। ঝাড়ুটা নিষিদ্ধ বনের দিকে যেতে যেতে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। মাদাম হুচ নেভিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। দুজনেরই মুখ ফ্যাকাসে, সাদা।

হ্যারি শুনতে পেল, মাদাম হুচ বলছেন–কজি ভেঙে গেছে। কাম অন বয়। দাঁড়াও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাদাম হুচ এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এর ভেতর তোমরা এক পাও নড়বে না। যার যার ঝাড়ু যেখানে ছিল সেখানে ঠিকমত রাখবে আর তা না করলে তোমাদের কিডিচ খেলার আগেই হোগার্টস ছেড়ে যেতে হবে।

নেভিলকে বললেন–আমার সাথে এসো।

নেভিলের দুচোখেই অশ্রু। কবজি চেপে ধরে টলতে টলতে সে আগে বাড়ল। ওরা চলে যাবার সাথে সাথেই ম্যালফয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তোমরা কি এই থল থলে মাংস পিণ্ডটির চেহারা দেখেছো?

স্লিদারিন হাউজের অন্যান্যরা নেভিলকে তামাশা করা শুরু করল। চুপ করো ম্যালফয়। পার্বতি পাতিল ধমক দিল।

লংবটমের জন্য তোমার এত দরদ? স্লিদারিন হাউজের এক কর্কশ চেহারার ছাত্রী প্যানসি পার্কিনসন বলল। পার্বতি, আমি কখনো ভাবতে পারিনি তুমি হিঁচকানে শিশুদের এত পছন্দ কর।

দেখো। মাটি থেকে একটা জিনিস উঠিয়ে ম্যালফয় বলল—

এক ফালতু জিনিস, লংবটমের নানী তাকে এটাই পাঠিয়েছে।

স্মারকটা সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল।

ম্যালফয়, ওটা এদিকে দাও। হ্যারি গম্ভীর কণ্ঠে ম্যালফয়কে বলল।

কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সবাই একেবারে চুপ।

ম্যালফয় দুষ্ট হাসি হেসে বলল-এটা আমি কোথাও রাখবো, সেখান থেকে লংকটমকে নিতে হবে–গাছের ওপর হলে কেমন হয়?

ওটা এদিকে দাও। হ্যারি চিৎকার করে উঠল। ম্যালফয় তার ঝড় নিয়ে উড়তে শুরু করল। মিথ্যে বলেনি, সে ভালো উড়তে পারে। ম্যালফয় একটা ওক গাছের চূড়ায় উঠে হ্যারির উদ্দেশ্যে বলল-এসো। এখান থেকে নিয়ে যাও।

হ্যারি তার ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিলো।

না, না। হারমিওন গ্রেঞ্জার চিৎকার করে উঠল–মাদাম হুচ বলে গিয়েছেন আমরা যেন একটুও না নড়ি। তুমি আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলবে।

কিন্তু হ্যারি তার কথা শুনল না। মাথায় তার রক্ত চড়েছে। সে তার ঝাড়ুতে চড়ে মাটিতে ধাক্কা দিল। আর সাথে সাথে সে উড়তে লাগল। বাতাসে তার চুল উড়ছে! পোশাক উলটে যাচ্ছে। তার কাছে খুব অবাকই লাগলো। না শিখেই সে কোনো বিদ্যা রপ্ত করতে পারে। তার কাছে ওড়াটা অত্যন্ত সহজ মনে হলো। নিচে মেয়েদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। রনের উল্লাস হ্যারির দৃষ্টি এড়াল না।

হ্যারি তার ঝাড়ু ঘুরিয়ে মধ্য আকাশে ম্যালফয়ের দিকে অগ্রসর হলো। ম্যালফয় স্তম্ভিত হয়ে গেল।

এবার দাও, নইলে আমি তোমাকে ওই ঝাড়ু থেকে ফেলে দেবো। হ্যারি বলল।

এতো সহজ। ম্যালফয় বলল, কিন্তু তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। হ্যারি জানে এখন কী করতে হবে। দুহাতে নিজের ঝড় শক্ত করে ধরে হ্যারি বর্শার মত তীব্র বেগে ম্যালফয়ের দিকে ছুটল। বিপদ বুঝে ম্যালফয় সরে গেল। নিচে করতালির শব্দ শোনা গেল।

হ্যারি বলল-এখানে তো তোমার বন্ধু ক্রেব আর গয়েল নেই।

ম্যালফয়ের মনেও একই চিন্তা।

চেষ্টা করে দেখো, নিতে পারো কিনা। এই বলে ম্যালফয় কাঁচের গোলকটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল।

হ্যারি প্রথমে ওপরে উঠল। পরে নিচে নামতে লাগল। সে ঝুঁকে ঝাড়ুর মুখ ঘুরিয়ে দিল। তার ঝাড়ু দ্রুতবেগে নিচে নামতে লাগল। হ্যারি মাটি থেকে ঠিক এক ফুট উঁচু থেকে গোলকটা ধরে ফেলল। তার মুঠোর ভেতর কাঁচের গোলকটা নিয়ে হ্যারি মাটিতে নামল।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ছুটে এসে চিৎকার করে বললেন—

হ্যারি পটার।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তুমি কোন সাহসে এত ওপরে উঠলে। আর একটু হলেই তো ঘাড় ভেঙে যেত। তিনি রাগে কাঁপছিলেন।

এটা তার দোষ নয়…

চুপ কর, মিস পাতিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন।

কিন্তু ম্যালফয়।

আর বলতে হবে না। মি. উইসলি ও পটার এখন আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল আদেশ দিলেন।

হ্যারি দেখল–ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল বিজয়ের হাসি হাসছে।

হ্যারি বুঝতে পারল এখন সে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি। তার মনে ভয় যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য হ্যারি কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ম্যাকগোনাগল তার কথায় কান দিলেন না। তিনি হন হন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে তাল রাখার জন্য হ্যারিকে রীতিমত দৌড়াতে হলো। হ্যারি ভাবতে লাগল, তাকে বের করে দেয়া হলে সে কোন মুখে আবার ডার্সলি পরিবারে ফিরে যাবে।

ম্যাকগোনাগল দরোজা খুলে করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলেন। হ্যারিও উদ্বিগ্ন মনে তাকে অনুসরণ করছে। কোথায় যাচ্ছে তারা! হ্যারি ভাবল, তিনি হয়ত অধ্যাপক ডাম্বলডোরের কাছে যাবেন। হ্যারি হগ্রিডের কথা ভাবল। হ্যাগ্রিন্ডকেও তো হোগার্টস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তবে তার গেমকিপারের চাকরিটা ছিল। হ্যাগ্রিডের সহকারী হিসেবে তাকে রেখে দেয়া যেতে পারে।

ম্যাকগোনাগল একটা ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়ালেন। তিনি দরোজা খুলে মুখটা ক্লাস রুমের ভেতরে গলিয়ে বললেন–অধ্যাপক ফ্লিটউইক আমাকে মাফ করবেন। আপনি কি এক মুহূর্তের জন্য উডকে দিতে পারেন।

উড কেন? হ্যারি অবাক হয়ে ভাবল–উড কি কোন বেত নাকি যা তার ওপর প্রয়োগ করা হবে।

দেখা গেল উড একজন মানুষ। সে ফিফথ ইয়ারের ছাত্র। সে কিছু না জেনেই ক্লাস থেকে বাইরে এলো। ম্যাকগোনাগল দুজনকেই বললেন তোমরা দুজনেই আমার পেছন পেছন এসো।

তারা করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। উড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল।

এখানেই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে একটা ক্লাসরুমে নিয়ে গেলেন। ক্লাসে কেউ ছিল না। কেবল পিভিস ব্ল্যাকবোর্ডে বাজে কিছু লিখছিল। পিভিস, এখান থেকে যাও। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কড়া নির্দেশ দিলেন। পিভিস তার চকটি ফেলে দিল। বেশ জোরে শব্দ হলো। তারপর অভিশাপ দিতে দিতে পিভিস ক্লাসরুম ত্যাগ করল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ঠাস করে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে দুই বালকের দিকে তাকালেন।

ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন-এই হচ্ছে অলিভার উড। উড–তোমার জন্য আমি একজন পেয়েছি।

উডের মুখে ধাঁধা থেকে খুশির রেখা।

উড এবার জিজ্ঞেস করল–প্রফেসর আপনি কি সত্যিই বলছেন?

অবশই। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জোর দিয়ে বললেন, ছেলেটা খুবই ভাল। আমি এর মত আর কাউকে দেখিনি।

এবার তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন–তুমি কি এই প্রথম ঝাড়ুর ওপর উড়লে? হ্যারি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালো।

হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না তাকে নিয়ে কী করা হবে। তবে এতটুকু সে বুঝতে পারল যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। সে তার পায়ে শক্তি পেতে শুরু করল।

হ্যারি পঞ্চান্ন ফুট ওপর থেকে নিচে ড্রাইভ দিয়ে একটা জিনিস ধরেছে। ম্যাকগোনাগল উডকে বললেন। তার গায়ে একটুও আচড় লাগেনি। এটা চার্লি উইসলিও করতে পারত না। উডের কাছে মনে হল তার স্বপ্ন যেন এখনই সফল হতে যাচ্ছে।

তার চোখমুখে আনন্দের ঝিলিক। একই সঙ্গে উত্তেজনা। জিজ্ঞেস করল, হ্যারি তুমি কি কখনও কিডিচ খেলা দেখেছো?

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ব্যাখ্যা করে বললেন–উড, গ্রিফিল্ডর হাউজের অধিনায়ক।

তার শারীরিক গঠনও একজন সিকারের মতই। হ্যারির চারদিকে হেঁটে ও হ্যারির দিকে তাকিয়ে উড এই মন্তব্য করল। হালকা… গতিসম্পন্ন। প্রফেসর, তাকে একটি সুন্দর ঝাড়ু দিতে হবে–নিম্বাস ২০০০ অথবা ক্লীনসুইপ সাত।

আমি অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলব। আমরা দেখি প্রথম বর্ষের জন্য নিয়মকানুন কিছু শিথিল করা যায় কিনা। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। গতবারের চেয়ে আমরা ভাল দল চাই।

স্লিদারিনদের কাছে গত ম্যাচে হেরে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ লজ্জায় সিভিরাস স্নেইপের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি!

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যারি, আমি শুনতে চাই তুমি এখানে ভালো প্রশিক্ষণ নিচ্ছ। আমি শুনতে চাই তুমি প্রশিক্ষণকালে পরিশ্রম করছো, আর ভিন্ন কিছু শুনলে তোমার শাস্তির বিষয়ে আমার মত পরিবর্তন করতে পারি বলে মুচকি হাসলেন।

তারপর তিনি বললেন–তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই গর্ব করতেন। তিনি একজন উঁচুমানের কিডিচ খেলোয়াড় ছিলেন।

***

রন তার স্টিক অ্যান্ড কিডনি পাই অর্ধেক মুখে পুরেছে, কিন্তু সে খেতে ভুলে গেল। সিকার? সে বলল, কিন্তু প্রথম বর্ষের কেউ তো হতে পারে না, কখনোই না, তুমি সবচেয়ে ছোট, এর আগে…তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো।

মধ্যাহ্নভোজের সময় ম্যাকগোনাগলের সাথে মাঠ থেকে যাওয়ার পর কি কি ঘটেছে এই মাত্র হ্যারি বলে শেষ করেছে।

হ্যারি বলল–শতাব্দীর মধ্যে এটাই প্রথম। উড আমাকে তাই বলল।

এ খবর শুনে রন এত অবাক ও অভিভূত হল যে, সে হ্যারির দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

হ্যারি রনকে বলল–আগামী সপ্তাহ থেকে আমার প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তুমি কাউকে বলো না কিন্তু, কারণ উড চায় না কেউ এটা জানুক।

ঠিক এই সময় ফ্রেড আর জর্জ উইসলি হলঘরে প্রবেশ করল। হ্যারিকে দেখে জর্জ নিচু কণ্ঠে বলল–শাবাশ! উড আমাদেরকে সব বলেছে। আমরাও এই টিমে আছি।

ফ্রেড বলল-এবার আমরা নিশ্চিতভাবে কিডিচ কাপ জিতব। চার্লি চলে যাবার পর আমরা কখনো এ খেলায় জিততে পারিনি। তবে এ বছর আমাদের দল অনেক শক্তিশালী। হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই ভালো খেলবে। তোমার কথা বলতে গিয়ে উড যেন লাফাচ্ছিল।

যাহোক, আমাদের যেতে হবে। স্কুল থেকে বেরুবার জন্য লী জর্ডান একটি নতুন গোপন পথ বের করেছে।

ফ্রেড ও জর্জ যাবার পরপরই ম্যালফয়, ক্রেব আর গয়েল এসে উপস্থিত হলো।

তারা হ্যারিকে বলল-এখানকার খাবার কি শেষ, মি. পটার? তুমি কোন ট্রেনে আবার মাগলদের কাছে ফিরে যাচ্ছ?

হ্যারি খুব শীতল কণ্ঠে বলল–বেশ সাহস দেখছি তো এখন, মাটিতে ফিরে এসেছ বলে। সাথে ক্ষুদে বন্ধুদেরও দেখছি।

উঁচু টেবিলে শিক্ষকরা বসে থাকায় আঙ্গুল বাঁকানো বা ভয় দেখানো, ক্রেব এবং গয়েলের একটু–আধটু বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।

ম্যালফয় হ্যারিকে বলল–সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমি বদলা নেব। তুমি যদি চাও আজ রাতেই জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ হতে পারে, শুধু জাদুদণ্ড। শারীরিক নয়। কী, এ ব্যাপারে কথা বলছ না যে, তুমি কি জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানো না?

অবশ্যই সে জানে। রন জবাব দিল–আমি ওর দ্বিতীয় হবো। তোমার সাথে কে থাকবে?

ম্যালফয় ক্রেব ও গয়েলের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ক্রেব সে বলল, মাঝরাতে ঠিক আছে? ট্রফি রুমেই দেখা হবে। ওটা তালা লাগানো থাকে না।

ওরা চলে গেলে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল–জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ জিনিসটা কী? আর দ্বিতীয় বলতেই বা কী বোঝায়? রন বলল–তুমি যদি মল্লযুদ্ধে মারা যাও তাহলে আমি তোমার দায়িত্ব নেব। যিনি এই দায়িত্বটা নেন তাকেই দ্বিতীয় বলা হয়।

রন আরো বলল–আসল জাদুকর যখন মল্লযুদ্ধে অংশ নেয় তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যায়। তোমার আর ম্যালফয়ের মধ্যে কেউই এতটা দক্ষ হওনি যে কেউ কারো ক্ষতি করতে পারবে। আমি নিশ্চিত যে ম্যালফয় ভেবেছিল তুমি তার মল্লযুদ্ধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।

আমি যদি জাদুদণ্ড ব্যবহার করি আর দেখা গেল কিছুই ঘটেনি তাহলে কী হবে? হ্যারি জানতে চাইল।

তাহলে তুমি তার নাকে জোরে একটা ঘুষি মারবে। রন বলল।

এক্সকিউজ মি। হ্যারি আর রন তাকিয়ে দেখল যে হারমিওন গ্রেঞ্জার এসেছে। রন মন্তব্য করল-এখানে কেউ শান্তিতে খেতেও পারবে না নাকি?

রনের কথার পাত্তা না দিয়ে হারমিওন হ্যারিকে বলল–আমি তোমার আর ম্যালফয়ের কথা আড়ি পেতে না শুনে পারলাম না।

না শুনলেও পারতে? রন বলল।

হামিওন রনের কথার উত্তর না দিয়ে হ্যারিকে বলল–মধ্যরাতে তোমার স্কুলে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবে না। ভেবে দেখো, তুমি যদি ধরা পড়ো, ধরা পড়বেই, তাহলে গ্রিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কাটা যাবে। হ্যারি, মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হয়।

এটা তোমার দেখার বিষয় নয়। হ্যারি মন্তব্য করল।

বিদায়। বলে রন বিদায় নিল।

***

নেভিল এখনও হাসপাতালে।

সব দিনই এক রকম। হ্যারি ভাবলো, দিনটি ভালভাবে শেষ হয়েছে বলা যাবে না। ডীন ও সিমাস ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। নেভিল হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেনি। হ্যারি বিছানায় জেগে সময় কাটালো।

রন আস্তে আস্তে হ্যারির কাছে এসে কানে কানে বলল–রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। চলো যাওয়া যাক।

ড্রেসিং গাউন পরে জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে কমনরুমে এসে পৌঁছল। হঠাৎ সামনের চেয়ার থেকে কে যেন বলে উঠল হ্যারি, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–তুমি এসব কাজে যাচ্ছ।

হালকা আলোতে হারমিওন গ্রেঞ্জারকে দেখা গেল। গায়ে গোলাপী রঙের গাউন।

রন চিৎকার করে বলল–তুমি এখানে? যাও শুতে যাও।

হারমিওন বলল–আমি তোমার ভাই পার্সিকে আভাস দিয়েছি। সে তো এখানকার প্রিফেক্ট। সে তোমাদের এসব কাজ বন্ধ করবে।

কেউ যে কারো কাজে এতটা হস্তক্ষেপ করতে পারে-এটা হ্যারি ভাবতেই পারে না।

চলে এসো। হ্যারি রনকে বলল। সেই মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে গর্ত দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

হারমিওনও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে সে–ও রনকে অনুসরণ করল।

হারমিওন ওদের পেছনে পেছনে এসে রুক্ষ কণ্ঠে বলল–গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য কি তোমাদের একটুও দরদ নেই? তোমরা কি কেবল নিজের স্বার্থই দেখবে? আমি চাই না স্লিদারিন হাউজ হাউজকাপ জয় করুক। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কানে গেলে তোমরা সব পয়েন্ট খোয়াবে।

এখান থেকে ভাগো। রন হারমিওনকে ধমক দিল।

ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। হারমিওন বলল–আমি যে তোমাদেরকে সতর্ক করেছি-এ কথাটি মনে রেখে বিশেষ করে যখন তুমি কাল বিকেলে বাড়িতে ফেরত যাবার জন্য ট্রেনে উঠবে।

ওদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার জন্য হারমিওন মোটা মহিলার প্রতিকৃতির দিকে তাকাল। না, সেখানে কোন প্রতিকৃতি নেই। মোটা মহিলা রাতে ভ্রমণের জন্য বাইরে গেছে। হারমিওন বের হওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।

আমি এখন কী করব? হারমিওন উৎকণ্ঠার সাথে বলল।

রন বলল–সেটা তোমার ব্যাপার। আমাদের এক্ষুণি যেতে হবে। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তোমাদের সাথে আমিও যাব। হারমিওন বলল।

না, তুমি আসবে না। রনের দৃঢ় নিষেধাজ্ঞা।

হারমিওন বলল–তোমরা কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আর ফিল আমাকে পাকড়াও করুক। যদি তিনি আমাদের তিনজনকে এক সঙ্গে পান আমি সত্যি কথাটাই বলব। আমি বলব, আমি তোমাদের থামাবার চেষ্টা করছিলাম আর তুমিও আমাকে সমর্থন করতে পার।

চুপ! তোমরা দুজনেই চুপ কর। হ্যারি বলল–আমি যেন কিসের আওয়াজ পাচ্ছি।

শ্বাস–প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ।

মিসেস নরিস? বিস্ময়ের সাথে রন উচ্চারণ করল।

আসলে এটা মিসেস নরিস নন। নেভিল। সে মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিল। তার কাছে গেলেই সে ঘুম থেকে উঠে পড়ল।

হায় ঈশ্বর। তোমরা এখানে। আমি কয়েক ঘণ্টা ধরে এখানে আটকে আছি। বিছানায় যাবার নতুন পাসওয়ার্ডটি এখন মনে করতে পারছি না।

তোমার স্বর নিচুতে রাখো, নেভিল। নতুন পাসওয়ার্ড হল–পিগ আউট। তবে এতে এখন কোন কাজ হবে না, কারণ মোটা মহিলাটা কোথায় যেন গেছে।

তোমার হাতের অবস্থা এখন কেমন। হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

ভাল। হাত দেখিয়ে নেভিল বলল–মাদাম পমফ্রে এক মিনিটের ভেতরই সব সারিয়ে দিয়েছেন।

ভালো কথা। হ্যারি বলল–নেভিল, আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে। তোমার সাথে পরে দেখা হবে। নেভিল বলল–আমাকে তোমরা একা ফেলে যেও না। আমার এখানে একা থাকতে ভাল লাগছে না।

রন ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর ক্রুদ্ধভাবে নেভিল ও হারমিওন দুজনের দিকেই তাকাল।

রন বলল–তোমাদের দুজনের যে কেউ একজন যদি আমাদের ধরিয়ে দাও তাহলে তোমাদের খবর আছে। বোগিস কুইরেল আমাদের যে অভিশাপ শিখিয়েছেন আমি তোমাদের ওপর সেই অভিশাপ দেব।

হারমিওন তার মুখ খুলল। কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়-এটাই বোধ হয় সে রনকে বলতে চাচ্ছিল। হ্যারি তাকে ফিস ফিস করে চুপ করতে বলল। তারপর সবাইকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।

তারা করিডোর ধরে এগোতে লাগলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। প্রতি মুহূর্তেই হ্যারি আশঙ্কা করছে ফিলচ অথবা মিসেস নরিসের সাথে দেখা হয়ে যাবে। তার ভাগ্য ভালো–তার আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। তারা চার তলায় যাবার সিঁড়িতে এল। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে কোন শব্দ না করে তারা আগে বাড়তে লাগল। তাদের লক্ষ্য ট্রফি হাউজ।

ম্যালফয় আর ক্রেব তখনও এসে পৌঁছায়নি। ট্রফি হাউজের শোকেসের স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের ওপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ট্রফি হাউজের রূপা বা সোনার কাপ, শিলড, প্লেট ও মূর্তি অন্ধকারেও চক চক করছে। ওরা দেয়াল ঘেঁষে এগুতে লাগল। তাদের চোখ দুটি দরোজারই ওপরে। পাছে ম্যালফয় এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে সেই আশঙ্কায় হ্যারি তার জাদুদণ্ড বের করলো। সময় বয়ে চলল। কিন্তু ম্যালফয়ের দেখা নেই। হয়ত এমনও হতে পারে সে ভয় পেয়ে গেছে।

একটু পরে পাশের কক্ষে একটা শব্দ শোনা গেল। তারা সতর্ক হলো। হ্যারি যখন তার জাদুদণ্ড ঘোরাল তখন কয়েকটা শব্দ তার কানে ভেসে এল। না এটা মালফয়ের কণ্ঠস্বর নয়।

আরে এ যে ফিলচ। তিনি নরিসের সাথে কথা বলছেন। ওরা একটু এগিয়ে দেখল পোশাকের গ্যালারি। দৌড় দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নেভিল রনের কোমর জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো। নেভিল দেখল–ফিলচ ট্রফি রুমে প্রবেশ করেছেন।

হ্যারি আর রন শুনতে পেল ফিলচ বলছে–তারা কাছাকাছি কোথাও আছে। হয়ত তারা লুকিয়ে।

এই দিকে। হ্যারি উল্টোদিকে ছুটলো এবং ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে তারা একটি লম্বা গ্যালারি নিঃশব্দে পার হতে লাগল। গ্যালারিতে ছিল অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র। তারা বুঝতে পারল, ফিলচ নেভিলের কাছাকাছি চলে গেছেন।

বিভিন্ন ধরনের আওয়াজে দুর্গের সবাই জেগে গেছে।

পালাও বলে হ্যারি দৌড় দিল। তারা চারজন নিচের দিকে দৌড়াতে লাগল। মি. ফিলচ ওদের পেছনে আসছেন কিনা–পেছন ফিরে সেটা দেখার অবকাশ তাদের নেই। একটা দরোজা দিয়ে বেরিয়ে তারা একের পর এক করিডোর পার হল। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে হ্যারি। তারা কোথায় যাচ্ছে–কেউই জানে না। এরপর ওরা পেল দেয়াল ঢাকা একটি বড় পর্দা এবং ওটা সরিয়ে ওরা পেল একটি গুপ্তপথ। এই পথ দিয়ে তারা বশীকরণ ক্লাসরুমের কাছে এলো। তাদের পরিচিত বশীকরণ ক্লাসরুম থেকে ট্রফি রুমের ব্যবধান কয়েক মাইল।

মনে হচ্ছে তার নাগালের বাইরে চলে এসেছি–ক্লান্ত–শ্রান্ত হ্যারি ঠাপ্তা দেয়ালে হেলান দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। নেভিল কুঁজো হয়ে দুহাঁটুতে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল ও তার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছিলো।

হারমিওন বলল–আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম।

আমাদেরকে খুব দ্রুতই গ্রিফিল্ডর টাওয়ারে পৌঁছতে হবে। রন শান্ত কণ্ঠে বলল।

হারমিওন–তুমি কি এখন বুঝতে পেরেছে যে, এটা ম্যালফয়ের চালাকি। সে কখনোই মল্লযুদ্ধ করার জন্য তোমার কাছে আসবে না। যেভাবেই হোক ফিল খবর পেয়েছেন ট্রফি রুমে কেউ আসবে। হয়ত ম্যালফয়ই তাকে সব বলে দিয়েছে।

হ্যারি ভাবল, হারমিওনই বোধহয় ঠিক। তবে তার কাছে হ্যারি নিজের ভুলের কথা স্বীকার করবে না।

চলো, যাওয়া যাক। হ্যারি বলল।

তখন তারা দশ–বারো পাও অতিক্রম করেনি, একটা দরোজা খোলার আওয়াজ পেল। দৃশ্য দেখে তারা অবাক। পিভিস বেরিয়ে আসছেন ক্লাস রুম থেকে।

তোমাদের তো ডরমিটরিতে থাকার কথা। এই মধ্যরাতে তোমরা বাইরে কেন। পিভস প্রশ্ন করল।

পিভস দয়া করে চুপ কর। তুমি দেখছি আমাদের বিপদে ফেলবে।

পিভস হো হো করে হেসে উঠলো। মধ্যরাতে ঘুরে বেড়ানো? তু, তু, তু। নটি, নটি, ইউ উইল গেট কটি

না ধরা পড়বো না দয়া করে পথ ছাড় পিভস।

আমি ফিলচকে বলব। আমার বলা উচিত। পিস বলল। তার চোখে দুষ্টুমির হাসি। তোমাদের মঙ্গলের জন্যই এটা বলা উচিত।

পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও। রন ধমকের সুরে বলল। মানছি এটা আমাদের ভুল হয়েছে।

যেসব ছাত্র বিছানায় নেই। পিভস চিৎকার করে বলল–যেসব ছাত্র বিছানায় নেই তারা নিচে বশীকরণ ক্লাসের সামনে করিডোরে।

পিভসের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে জীবন বাঁচাতে তারা বশীকরণ ক্লাসের করিডোরের শেষ প্রান্তে উধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। সেখানে তারা একটি দরোজা খোলার চেষ্টা করলো। না, বন্ধু, খোলা যাচ্ছে না। এই হলো আমাদের পরিণতি। রন কাদো কাঁদো কন্ঠে বলল।

দরোজা ধাক্কা দিয়েও খুলতে না পেরে রন বলল, আমাদের আর কোন উপায় নেই। আমরা শেষ হয়ে গেছি।

তারা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পিভসের চিৎকার শুনে ফিলচ ছুটে আসছেন।

এখান থেকে যেতে হবে। হারমিওন বলল। সে হ্যারির হাত থেকে জাদুদণ্ডটি নিয়ে তালাটিতে ছোঁয়ালো, তারপর ফিসফিস করে বলল আলোহেমোরা।

তালায় ক্লিক করে আওয়াজ হলো এবং দরোজাটা খুলে গেল। তারা ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে কান পেতে রইল। তাদের কানে ভেসে এলো–ওরা কোনদিকে গেছে, পিভস। আমাকে তাড়াতাড়ি বল। ফিলচ পিভসকে জিজ্ঞেস করছে।

আগে বল প্লিজ। ঝামেলা করো না পিভস, বল ওরা কোন দিকে গেছে?

আমি কিছুই বলব না! হা হা হা! আমি বলেছি যতক্ষণ তুমি ভালভাবে প্লিজ না বলবে আমি কিছুই বলব না। হা হা হা!

বল, প্লিজ।

ঠিক আছে–প্লিজ

তারা শুনতে পেল পিভস হুস করে উধাও হয়ে যাচ্ছে আর ফিলচ তাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

হ্যারি ফিসফিস করে বলল–তিনি হয়তো মনে করছেন দরোজাটা বন্ধ। তাই এখানে কেউ আসেনি। মনে হচ্ছে আমরা এখন নিরাপদ। নেভিল বেরিয়ে এসো।

নেভিল হ্যারির গাউনের আস্তিন ধরে টানছে।

কী?

হ্যারি চারদিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হল সে এখন একটা দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি! খুবই বাজে কাজ করেছে সে আজ। তার আজকের কাজ আগের সব কিছু অতিক্রম করেছে।

হ্যারি যা ভেবেছিল আসলে ঘটনা তা ছিল না। তারা কোন ঘরের ভেতরে নয়। ছিল একটা করিডোরে। এটা তৃতীয় তলার নিষিদ্ধ করিডোর। এখন ওরা বুঝতে পারে, এটা কেন নিষিদ্ধ। তাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল একটা দানবীয় কুকুরের চোখের ওপর। কুকুরটা এতো বড় যে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত পুরো জায়গা সে দখল করে রেখেছে। কুকুরটার তিনটি মাথা, তিনটা নাক, তিনটা মুখ। তার মুখের লালা গড়িয়ে পড়ছে পিচ্ছিল রশির ওপর। কুকুরটা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তার দুটো চোখই তাদের ওপর নিবদ্ধ। হ্যারি উপলব্ধি করল কেন তারা এখনো মারা যায়নি, হঠাৎ এসে পড়ায় কুকুরটা তাদের দেখে অবাক হয়েছে। অবাকের পালা শেষ করে কুকুরটি আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে উঠল। কুকুরের বজ্র নিনাদের অর্থ কী তা বুঝতে হ্যারি বা তার সঙ্গীদের স্বাকি রইল না। হ্যারি দরোজা খোলার জন্য হাতল মোচড়াতে লাগলো।

এখন হ্যারিকে দুটো বিকল্পের একটাকে বেছে নিতে হবে, হয় মৃত্যু নয় ফিলচ। সে বেছে নিল ফিলচকে!

তারা পেছন দিকে হটে এসে করিডোরে ফিরে এল। হ্যারি দরোজাটা সজোরে বন্ধ করে দ্রুতবেগে নিচে করিডোরে নামল। ফিলচ নিশ্চয়ই তাদের কোথাও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তারা ফিরে আসার পথে কোথাও ফিলচকে দেখেনি। এটা এখন তাদের জন্য বড় বিষয় নয়, তাদের এখন একমাত্র চেষ্টা দানব থেকে বাঁচা–তাই দানব থেকে দূরত্ব বাড়াতে তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। আট তলায় সেই মোটা মহিলার প্রতিকৃতির সামনে না আসা পর্যন্ত তারা তাদের দৌড় থামায়নি।

তাদের কাধ থেকে পড়ে যাওয়া ঝুলন্ত ড্রেসিং গাউন এবং ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে মহিলাটা প্রশ্ন করলেন-এত রাতে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?

তেমন কিছু না–পিগ স্নাউট, পিগ আউট। হ্যারি উচ্চারণ করল। হ্যারির জবাবের সাথে সাথেই ছবিটি তাদের দিকে এগিয়ে এল এবং যাওয়ার পথ ছেড়ে দিল। তারা কমনরুমে প্রবেশ করে ধপাস করে আরাম কেদারায় বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ নিরব ছিল, কোন কথা বলেনি, দেখে মনে হলো নেভিলের এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে বোধ হয় আর কথা বলতে পারবে না

এ রকম একটা জিনিসকে তারা স্কুলে আটকিয়ে রেখেছে কেন? রন বলল কুকুরের ব্যায়ামের প্রয়োজন হয়, এরও প্রয়োজন হতে পারে। এতক্ষণে হারমিওনের শ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল এবং মেজাজও। হারমিওন ওদের থামিয়ে বলল–তোমরা কি কেউ ভাল করে দেখেছো? তোমরা কি লক্ষ্য করেছিলে কুকুরটা কিসের ওপর দাঁড়িয়েছিল?

মেঝের ওপর? হ্যারি বলল–আমি তার পায়ের দিকে তাকাইনি। আমার চোখ ছিল তার মাথার ওপর।

না, মেঝের ওপর নয়। কুকুরটা দাঁড়িয়েছিল একটা গোপন দরোজার ওপর। এটা স্পষ্ট যে কুকুরটা কোন কিছু পাহারা দিচ্ছিল। হারমিওন দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে এ কথা বলল।

বলল–আজ আমরা সবাই মারা পড়তে পারতাম। অথবা ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হতে পারতাম। আশা করি তোমরা নিশ্চয়ই এখন নিজেদের ভাগ্যের জন্য খুশি, এখন তোমরা যদি কিছু না মনে কর আমি ঘুমুতে যাই।

হা করে রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে রইল।

না, আমরা কিছু মনে করবো না। বন বলল–তুমি কি মনে কর আমরা তোমাকে জোর করে আমাদের সাথে নিয়ে গেছি।

কিন্তু হারমিওন হ্যারিকে চিন্তার জন্য একটা কিছু দিয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে হ্যারি ভাবতে লাগল–কুকুরটা নিশ্চয়ই কিছু পাহারা দিচ্ছে… হগ্রিড় একবার বলেছিলো পৃথিবীতে গ্রিংগটস হলো কোন কিছু নিরাপদে রাখার জন্য সব থেকে নিরাপদ জায়গা এবং তার চেয়েও নিরাপদ হোগার্টস।

এইখানে কি ৭১৩ নম্বর ভল্টের ছোট্ট প্যাকেটটা পাওয়া যাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *