০৭. সেই হ্যাট

সেই হ্যাট

মুহূর্তেই দরোজা খুলে গেল। লম্বা, কালো চুলের এক মহিলা পান্নার মত সবুজ রঙের পোশাক পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চাহনি খুব কড়া। হ্যারি ভাবল, এ মহিলাকে পেরিয়ে সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

হ্যাগ্রিড বললেন, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, এরা প্রথম বর্ষের ছাত্র।

ধন্যবাদ হ্যাগ্রিড। আমি ওদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি।

ম্যাকগোনাগল সবাইকে হল ঘরে নিয়ে গেলেন। হল ঘরটি বিশাল। পাথরের দেয়ালে মশালের আলো। ছাঁদ অনেক উঁচুতে।

তারা সবাই অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলকে অনুসরণ করলো। পাথরের মেঝেতে নানা রকম চিত্র আঁকা। হ্যারি ডানদিকের দরোজার ওপাশ থেকে শত শত লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল–স্কুলের বাকি অংশটুকু নিশ্চয়ই এখানে কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে হল ঘরের মধ্যে একটা খালি ছোট কামরায় নিয়ে গেলেন। তারা সবাই পরস্পরের গা ঘেঁষে কোনমতে সেখানে দাঁড়ালো, সাধারণত এতক্ষণ তাদের দাঁড়ানোর কথা নয়। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের সবাইকে হোগার্টসে স্বাগত জানাচ্ছি। টার্ম শুরুর ভোজসভা শিগগিরই শুরু হবে। গ্রেট হলে আসন গ্রহণ করার আগেই তোমাদের কে কোন হাউজে যাবে তা বণ্টন করা হবে। এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হাউজটাই হবে তোমাদের পরিবার। তোমরা হাউজের ডর্মিটরিতে থাকবে। অবসর সময় কমনরুমে কাটাবে।

এখানে চারটা হাউজ আছে–গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র‍্যাভেন ক্ল ও স্লিদারিন। প্রত্যেকটা হাউজের ম্যাজিকের ইতিহাস আছে। হাউজে থাকার ব্যাপারে কিছু নিয়ম–কানুন আছে। অনিয়ম করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। বছরের শেষে হাউজ-কাপ দেয়া হয়। যে হাউজ সবচে বেশি পয়েন্ট পাবে সে হাউজই কাপ পাবে। হাউজ কাপ পাওয়া একটা সম্মানের ব্যাপার।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্কুলের সামনে বাছাই অনুষ্ঠান হবে, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নেভিলের জামা ও রনের নাকের দিকে লক্ষ্য করলেন। হ্যারিকে খুব নার্ভাস দেখাছিল। সে যথাসম্ভব তার চুল ঠিক করে নিলো।

তোমরা শান্তভাবে অপেক্ষা কর। আমি সময়মতো ফিরে আসবো। এই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বিদায় নিলেন।

তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদের হাউজ ভাগ করে দেবেন? রন জানতে চাইল।

আমার মনে হয় তারা কোন একটা পরীক্ষা নেবেন। ফ্রেড বলছিল এই পরীক্ষা বেশ কষ্টকর। ফ্রেড বোধহয় ঠাট্টা করেছে। হ্যারির বুক কাঁপছে। আবার পরীক্ষা দিতে হবে। কিসের পরীক্ষা!

হ্যারির বুক ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। পরীক্ষা? স্কুলের সবার সামনে। সে তো এখন পর্যন্ত কোন জাদু জানে না। তাকে কি করতে হবে? এই সময় যে এই ধরনের কিছু হবে, আসার আগে সে ভাবেনি।

কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না। শুধু হারমিওন ফিস ফিস করে নিজের জাদুর ক্ষমতার কথা বলল।

হ্যারি চারিদিকে দেখল যে প্রত্যেকের চেহারায় একটা আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠেছে।

তারপর হঠাৎ কিছু একটা ঘটলো, হ্যারি লাফ দিয়ে এক ফুট ওপরে উঠলো–তার পেছনের কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো। প্রায় বিশটা ভূত পেছনের দেয়াল থেকে স্রোতের মত আসছে। দেখতে মুক্তোর মত সাদা ও কিছুটা স্বচ্ছ। তারা একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে ভেসে বেড়ালো। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দিকে তারা খুব একটা তাকালো না। একজন মোটা সন্ন্যাসীর মতো ভূত বলছে–ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ। আমার মনে হয় ওকে আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিত। আরেকজন বলছে—না না। তাকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর দেয়া যায় না।

একটা ভূত হঠাৎ করে ছাত্রদের দেখে বলল, এখানে তোমরা কী করছ?

কেউ জবাব দিল না।

মোটা সন্ন্যাসী বলল-এরা নতুন ছাত্র। একটু পরে এদের বাছাই পর্ব শুরু হবে।

কয়েকজন নীরবে সম্মতি জানাল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ফিরে এসে বললেন-এখন অন্যসব কাজ বন্ধ। এখন বাছাই পর্ব শুরু হবে।

এরপর ভূতগুলো পেছনের দেয়াল দিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

যাবার আগে একটা ভূত বলল–আশা করি, তোমাদের সাথে হাফলপাফে দেখা হবে। আমি ওই হাউজের সদস্য ছিলাম।

সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াও এবং আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নির্দেশ দিলেন।

পায়ে ব্যথার কারণে হ্যারি খুব দ্রুত হাঁটতে পারছিল না। তার সামনে ছিল বালু রঙের চুলের একটি ছেলে, আর তার পেছনে ছিল রন। তারা কামরা থেকে বের হয়ে হল ঘর পার হয়ে গ্রেট হলে প্রবেশ করল।

জায়গাটা খুবই মনোরম। হ্যারি এ ধরনের অপূর্ব সুন্দর জায়গা কল্পনা করতেও পারে না। চারটা লম্বা টেবিলের ওপর হাজার হাজার মোমবাতি মৃদু বাতাসে জ্বলছে। মঞ্চে একটা লম্বা টেবিল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলসহ শিক্ষকগণ এই টেবিলটাতে বসলেন। তাদের দিকে যে শত শত মুখ তাকিয়ে ছিল, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল মোমবাতির সামনে ক্ষণপ্রভা লণ্ঠন। ছাত্রদের মাঝে দুএক ভূতকেও দেখা যাচ্ছিল। সামনের চেহারাগুলো দেখার জন্য হ্যারি ওপরে তাকাল। ওপরে সে কালো ভেলভেটের সিলিং ও তারা দেখতে পেল। হারমিওন হ্যারির কানে কানে বলল, হোগার্টস, এ হিস্টরি–বইতে আমি পড়েছি, বাইরের আকাশের মতই এটা আকর্ষণীয়। এখানে কোন ছাদ আছে এবং এই গ্রেট হলটা স্বর্গের কোন স্থান নয়। এটা একেবারেই মনে হয় না।

হ্যারি নিচে তাকিয়ে দেখলো অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা চার–পায়া টুল তাদের সামনে রাখলেন। টুলের ওপর ছিল জাদুকরের একটা চোখা হ্যাট। হ্যাটটা খুবই পুরনো ও জরাজীর্ণ। আন্ট পেতুনিয়া হলে এটাকে কোনদিন বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। একটু পরে এই হ্যাটটা গান গাইতে শুরু করল। ছাত্রদের মাঝখানে এখানে সেখানে ভূত ঘোরাফেরা করছিল।

হে তুমি হয়তো ভাবনি আমিও সুন্দর
শুধু চোখের দেখা দিয়ে করো না বিচার
যদি আমার চেয়ে চৌকস কোনো হ্যাট
দেখাতে পারো তুমি; আমি নিজেই,
নিজেকে গিলে খাবো।
তুমি তোমার টুপিকে কালো রাখতে পারো
তোমার উঁচু হ্যাট মসৃণ ও লম্বা
কিন্তু আমার জন্যে আছে হোগার্টসের সর্টিং হ্যাট
এবং আমি সবাইকে তা পরাতে পারি
তোমার মাথায় কিছুই নেই গোপন
সর্টিং হ্যাট দেখতে পায় না কিছু
অতএব আমাকে পরীক্ষা করো, বলে দেবো
কোথায় তুমি যেতে চাও?
হতে পারো তুমি গ্রিফিল্ডরের বাসিন্দা
যেখানে হৃদয়ে বাস করে সাহস
তাদের সাহস, স্নায়ু ও মর্যাদা
গ্রিফিল্ডরদের করে তোলে মহীয়ান
হতে পারো তুমি হাফলপাফের বাসিন্দা
যেখানে তারা ন্যায়বান ও অনুগত
আর ধৈর্যশীল হাফলপাফেরা হচ্ছে সৎ
এবং পরিশ্রমে অকাতর।
অথবা বিজ্ঞ পুরনো র‍্যাভেন ক্লর বাসিন্দা
যদি থেকে থাকে তোমার তৈরি মন
যেখানে ধীমান ও শিক্ষিতেরা সহযাত্রী খুঁজে পাবে
কিংবা হতে পারো বাসিন্দা স্লিদারিনের
যেখানে খুঁজে পাবে তুমি প্রকৃত বন্ধুকে
ধূর্ত লোকেরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে
বেছে নেয় যেকোন উপায়।
অতএব আমাকে ভয় পেও না, করো না হৈচৈ
(আমার কেউ না থাকলেও) তুমি রয়েছ
ঠিক নিরাপদ হাতে, যে কারণে আমি থিংকিং ক্যাপ।

হ্যাটের গান শুনে হলভর্তি সবাই আনন্দে করতালি ও শীস দিয়ে উঠল। হ্যাট সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে চুপ হয়ে গেল।

এই হ্যাট নিয়ে কি আমাদেরকেও পরীক্ষা দিতে হবে। রন হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল।

হ্যারি খুব নিস্পৃহভাবে মুচকি হেসে বলল–জাদু শেখার চেয়ে হ্যাট নিয়ে নাড়াচাড়া করাও অনেক ভালো।

হ্যাটটাকে দেখে হ্যারি বুঝতে পারল যে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই হ্যারি হ্যাটটার কাছে যেতে সাহস পেল না।

এবার অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল পার্চমেন্টের একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

ম্যাকগোনাগল বললেন–আমি যখন তোমাদের রোল কল করব তখন তোমরা এই হ্যাটটা পরে টুলের ওপর বসবে।

গোলাপী বর্ণের ও বাদামী চুলের একটা মেয়ে হ্যাট পরল। পরার সাথে সাথেই হ্যাটটা চিৎকার করে উঠল–হাফল পাফ।

ডানদিকের টেবিলের সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। হান্না হালপাফের টেবিলে গিয়ে বসল। হ্যারি দেখল আগে দেখা সেই ভূতটাও আনন্দ প্রকাশ করছে।

এরপর ডাকা হল–বোনস, সুজান। 

হালপাফ আবার হ্যাটটা চিৎকার করল। সুজান হাননার পাশে বসল।

বুট, টেরি।

এবার হ্যাটটা চিৎকার করল–র‍্যাভেন ক্ল।

বাঁ দিকের দ্বিতীয় টেবিলের সবাই করতালি দিল। টেরি র‍্যাভেন ক্লর জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে বসল।

ম্যান্ডি ও ব্রকলহার্স্ট র‍্যাভেন ক্ল হাউজে গেল। তবে ল্যাভেন্ডার ব্রাউন গেল গ্রিফিল্ডর হাউজে। বাঁ দিকে দূরের টেবিলটা যেন আনন্দে বিস্ফোরিত হল। হ্যারি দেখতে পাচ্ছিল রনের যমজ দু ভাই বিদ্রূপ করে শব্দ করছে।

মিলিসেন্ট বালসট্রোড স্লিদারিন হাউজের সদস্য হয়ে গেল। হ্যারি ভাবছিল তার ভাগ্যে স্লিদারিন হাউজ পড়বে। হ্যারির মনে হলো ওদের বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তার কল্পনাও হতে পারে।

হ্যারির এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হতে লাগলো। মনে পড়ল তার স্কুলে খেলার জন্য যখন কোন দলে তাকে বেছে নেয়া হত, সব সময় তাকে সবার শেষে বেছে নেয়া হত। সে যে খারাপ খেলতো সে কারণে নয়, তারা বরং ডাডলিকে বোঝাতে চাইতো না যে, তারা হ্যারিকে পছন্দ করে।

ফিনচ, ফ্লেচলি, জাস্টিন

তার ভাগ্যে হাফলপাফ হাউজ পড়ল।

হ্যারি লক্ষ্য করল কারো কারো নাম ডাকতে হ্যাটটার তেমন কোন সময়ই লাগছে না। অথচ কারো কারো জন্য অনেক সময় নিচ্ছে।

হ্যারির পাশে দাঁড়ানো বেলেচুলের ছেলেটি সিমাস ফিনিংগাম টুলের ওপর বসল। এবার হ্যাটটি ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

গ্রেঞ্জার, হারমিও।

হারমিওন দৌড়ে গিয়ে টুলে বসল। মাথায় হ্যাট লাগাল। এবার আওয়াজ এল–গ্রিফিল্ডর।

হ্যারির মনে একটি দুর্ভাবনার উদয় হলো। আসলে যখন কেউ খুব নার্ভাস থাকে তখন তার মনে নানা দুর্ভাবনা হয়। যদি তার নাম একেবারেই না ডাকা হয়!

যদি এমন হয় যে সে হ্যাট মাথায় দিয়ে টুলের ওপর বসে আছে দীর্ঘক্ষণ কিন্তু হ্যাট কোন কিছু বলছে না। যদি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যাটটা খুলে নিয়ে হ্যারিকে বলেন–নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে, তোমার আর ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। তুমি ট্রেনে ফেরত চলে যাও।

ব্যাঙ হারানো ছেলেটা নেভিল লংবটমকে যখন ডাকা হলো, টুলে যাবার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। দীর্ঘ বিরতির পর হ্যাট ঘোষণা করল গ্রিফিল্ডর। অনেক হাসি–ঠাট্টার ভেতর দিয়ে নেভিলকে ফিরে যেতে হলো।

নাম ডাকা হলে ম্যালফয় আগে বাড়ল। মাথায় হ্যাট লাগাবার সাথে সাথেই ঘোষণা এল–স্লিদারিন।

খুশি মনে ম্যালফয় তার বন্ধু ক্রেব ও গয়েলের কাছে গেল।

আর বেশি নাম ডাকতে বাকি নেই।

তারপর ডাকা হলো মুন…নট….. পার্কিনসন যমজ বোন, পাতিল ও পাতিল-এরপর পার্ক, স্যালি, অ্যানাকে। প্রায় শেষের দিকে দু একজনের আগে ডাকা হলো হ্যারি পটারকে। পটার, হ্যারি? যেই হ্যারি এগিয়ে গেল অমনি গুঞ্জন শুরু হল

পটার, তিনি কি ঠিক তা-ই বলেছেন?

হ্যারি পটার?

হ্যাট পরার আগে হ্যারি দেখলো সবাই তাকে ভাল করে দেখার জন্য উঁচু হয়ে তাকাচ্ছে। পরের মুহূর্তে সে হ্যাটের ভেতরের কালো রং দেখছে। হাম, তার কানে এল। কঠিন। খুব কঠিন। অনেক সাহস। মনটাও খারাপ নয়। প্রতিভাও আছে–কিছু করার আগ্রহও আছে।

হ্যারি টুলের কোণা শক্ত করে ধরে উচ্চারণ করল–না, স্লিদারিন নয়….. স্লিদারিন নয়।

স্বরটি তাকে বলল–তুমি তাহলে স্লিদারিন হাউজে যেতে চাও না। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ। স্লিদারিন হাউজ তোমাকে সাহায্য করবে। স্লিদারিন হাউজ তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি স্লিদারিন হাউজে তুমি একেবারেই যেতে না চাও তাহলে তোমাকে গ্রিফিল্ডর হাউজে দেয়া হবে।

হ্যাটের কাছ থেকে ঘোষণা শুনে হ্যারি মাথা থেকে হ্যাটটা নামাল। তারপর ধীরে ধীরে গ্রিফিল্ডরের টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। স্লিদারিন হাউজের বদলে গ্রিফিল্ডর হাউজ পাওয়ায় হ্যারি বেশ স্বস্তি বোধ করছে।

প্রিফেক্ট পার্সি উঠে দাঁড়াল ও শক্ত হাতে হ্যারির সাথে করমর্দন করল। ওয়েসলি পরিবারের যমজ দুভাই অন্যদের সাথে চিৎকার করে উঠল। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। আগে দেখা ভূতটার উল্টো দিকে হ্যারি বসল। ভূতটি মৃদুভাবে হ্যারির কাঁধে চাপড় দিল।

হ্যারি এখন উঁচু টেবিলটা ভালভাবে দেখতে পারছে। হ্যারি হ্যাগ্রিডের কাছাকাছি বসল। হ্যাগ্রিড বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। একটি সোনার চেয়ারে বসে আছেন আলবাস ডাম্বলডোর। হ্যারি তাকে চিনতে পারল। আরো কয়েকটা মুখ হ্যারির পরিচিত যেমন অধ্যাপক কুইরেল।

হাউজ বাছাইয়ের জন্য আর মাত্র তিনজন বাকি। তারপিন, লিসা গেল র‍্যাভেন ক্ল হাউজে! তারপর রনের পালা। রনের মুখ শুকিয়ে সবুজ হয়ে গেল। ওর জন্য হ্যারি টেবিলের তলায় ফিঙ্গার ক্রস করল। হ্যাট ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

আনন্দে হ্যারি অন্যদের সাথে মিলে হাততালি দিল। রন হ্যারির পাশের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লো।

শাবাশ রন। চমৎকার। হ্যারির পাশে পার্সি উইসলি হর্ষধ্বনি করল। জেবনী ব্লেইজ গেল স্লিদারিন হাউজে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল রোল কলের কাগজ গুটিয়ে হ্যাট তুলে নিয়ে ঘোষণা দিলেন–বাছাই পর্ব শেষ।

হ্যারি তার স্বর্ণের থালার প্রতি দৃষ্টি দিল। সে এই প্রথম অনুভব করল যে সে খুব ক্ষুধার্ত। সে কদুর প্যাস্ট্রি তুলে নিল। আঃ কী মজা।

আলবাস ডাম্বলডোর উঠে দাঁড়ালেন। দুই হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন নবীন ছাত্রগণ। তোমাদেরকে স্বাগত জানাই। এই হোগার্টসে তোমরা স্বাগত। আমাদের খাওয়ার পর্ব শুরু হওয়ার আগে আমি চারটি শব্দ উচ্চারণ করব। সেগুলি হলো–নিটউইট! ব্লুবার! অডমেন্ট! টুইক। ধন্যবাদ।

তিনি বসে পড়লেন। সবাই করতালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করলো। হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না-এখন কী করবে।

উনি কি পাগল। হ্যারি পার্সিকে জিজ্ঞেস করল।

পার্সি বলল–কী বলছ তুমি। তিনি তো এক অসামান্য প্রতিভা। তিনি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর। একজন অসাধারণ ব্যক্তি। অবশ্য অসাধারণ ব্যক্তিরাই এক আধটু পাগল হয়। তোমাকে আলু দেব, হ্যারি।

হ্যারির খিদে পেয়েছে। সামনে খাবারের পাহাড়। খাবারে কী নেই রোস্ট, চিকেন, ল্যাম্ব চপ, সসেজ, শূকরের মাংস, আলু সেদ্ধ, পুডিং, আরো নানা রকমের সস।

ডার্সলি পরিবারে হ্যারিকে অনাহারে থাকতে হয়নি। তবে সে কখনোই পেট পুরে বা ইচ্ছেমত খেতে পায়নি। তার পছন্দের খাবার তার কাছ থেকে সব সময় ডাডলি কেড়ে নিত। এই মুহূর্তে হ্যারির খুব খিদে পেয়েছে। সে একটা প্লেটে সব খাবারই অল্প অল্প করে নিয়ে খেতে শুরু করলো। পাশ থেকে ভূত তাকে লক্ষ্য করছিল।

ভূতটা বলল-এগুলো খুব সুস্বাদু খাবার।

তুমি খাবে না। হ্যারি ভূতকে বলল।

আমি প্রায় চারশ বছর কিছুই খাইনি। ভূতটি জবাব দিল। আমার এখন খাবার প্রয়োজন নেই। তবে সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? আমি তো এখনও আমার পরিচয় দিইনি। আমার নাম স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি পর্পিংটন। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের আবাসিক ভূত।

আমি তোমাকে চিনি। হঠাৎ করে রন বলে উঠল–আমার ভাই তোমার কথা বলেছে, তুমি তো মুণ্ডহীন গলা।

আমাকে স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি বলে ডাকলে আমি খুশি হব। ভূত বলল।

মুণ্ডহীন? কীভাবে তুমি মুণ্ডহীন হলে? বেলেচুলের সিম্মাস ফিননিগান জিজ্ঞেস করলো।

ভূতটাকে খুব বিব্রত মনে হলো। কারণ প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি।

এভাবেই–সে রেগে বলল। সে তার বাম কান টান দিয়ে পুরো মাখাঁটি নিচে নামিয়ে ঘাড়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। মনে হলো কেউ যেন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিকোলাস কিছুক্ষণ পর তার মাথাকে ঘাড়ের সাথে সংযুক্ত করল। একটু কেশে বলল–গ্রিফিন্ডারের নবীন ছাত্ররা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে তোমরা আমাদের সাহায্য করবে

হ্যারি এবার স্লিদারিন টেবিলের দিকে তাকাল সেখানেও একটা ভূত বসে আছে। ভয়ঙ্কর চেহারা। সারা পোশাকে রূপালী রক্ত।

ওর জামায় রক্ত কেন?–সিমাস জিজ্ঞেস করলো।

প্রায় মুণ্ডহীন ভূতটা বলল–আমি তো তাকে জিজ্ঞেস করিনি।

সবাই পেট পুরে খেল তারপর অবশিষ্ট খাদ্য প্লেট থেকে উধাও হয়ে গেল। প্লেটগুলো আবার ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরেই টেবিলে পুডিং দেখা গেল। সব ধরনের ও সব স্বাদের আইসক্রিম ও উপস্থিত। তারপর এল আপেল, পাই, চকোলেট, জেলি, বাদাম, স্ট্রবেরি, চালের পুডিং…. যখন একটা খাবার নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল তখন তাদের পরিবারের বিষয়ে কথা উঠল।

এরপর চললো নানা বিষয়ে কথাবার্তা। মাগল পরিবারের সব দুষ্কর্মের কথা। নেভিল এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দিল। হ্যারির ঘুম পাচ্ছে। সে উঁচু টেবিলের দিকে তাকাল। অধ্যাপক মাকগোনাগল ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলছেন। অধ্যাপক কুইরেলের মাথায় একটা অদ্ভুত পাগড়ি। অধ্যাপক কুইরেল কথা বলছেন চকচকে কালো চুলের এক শিক্ষকের সাথে। শিক্ষকটার লম্বা বাঁকানো নাক ও গায়ের রঙটা হলুদাভ। হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটলো। বাঁকানো নাক শিক্ষকটা কুইরেলের পাগড়ির পেছন থেকে হ্যারির চোখাচুখি হলেন–তিনি হ্যারির কপালের দিকে তাকালেন। সাথে সাথেই হ্যারি তার কপালের দাগে তীব্র ব্যথা ও গরম অনুভব করতে লাগল।

আ…. উ….

পার্সি প্রশ্ন করল–কি ব্যাপার, তোমার কী হয়েছে?

না–কিছুনা হ্যারি জবাব দিল।

ব্যথাটা যত তাড়াতাড়ি এসেছিল, ঠিক তত তাড়াতাড়ি চলে গেল।

অধ্যাপক কুইরেল যে শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন তিনি কে? হ্যারি পার্সিকে প্রশ্ন করে।

ওহ, তুমি তাহলে অধ্যাপক কুইরেলকে আগে থেকেই চেনো? পার্সি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

পার্সি বলে চলল–তিনি প্রফেসর স্নেইপ, তিনি তরল পানীয় ও ওষুধ বিষয়ে পড়ান।

অবশেষে পুডিংও অদৃশ্য হয়ে গেল। অধ্যাপক ডাম্বলডোর আবার দাঁড়ালেন। হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা। তিনি বললেন–তোমাদের কাছে আমার কিছু বলার আছে। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জানানো যাচ্ছে যে মাঠের জঙ্গলে যাওয়া তোমাদের নিষেধ। সিনিয়র ছাত্ররাও একথাটি মনে রাখলে ভালো করবে।

ডাম্বলডোরের দৃষ্টি হঠাৎ করে উইসলি যমজ ভাইদের ওপর পড়ল।

তিনি বললেন–আমাদের কেয়ারটেকার মি. ফিলচ একটা সংবাদ তোমাকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। দু ক্লাসের মাঝখানের বিরতিতে করিডোরে জাদুবিদ্যার কোন অনুশীলন চলবে না। টার্মের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিভিচ খেলার অনুশীলন হবে। যারা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতে চায় তারা তাদের হাউজের মাধ্যমে মাদাম হুচের সাথে যোগাযোগ করবে।

তোমাদেরকে আরেকটি কথাও আমাকে জানাতে হচ্ছে, চতুর্থতলার ডানদিকের করিডোরটি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের পরিণাম হবে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।

হ্যারি হাসল, কিন্তু তার সাথে আর কেউ হাসল না।

তিনি আসলে সত্যি কথা বলছেন না, ভয় দেখাচ্ছেন। হ্যারি পার্সিকে বলল।

তিনি সত্যি কথাই বলে থাকেন। পার্সি জবাব দিল–তিনি যখনই কোন কিছু আমাদের নিষেধ করেন তার কারণও জানিয়ে দেন। সবাই জানে বনে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। আমি মনে করি তিনি এ তথ্যটি প্রিফেক্টদের জানাতে পারতেন।

ডাম্বলডোর এবার তার জাদুদণ্ডে মোচড় দিলেন। একটি সোনালী রিন উড়ে গেল। টেবিলের ওপর সাপের মত উড়তে উড়তে সে কতগুলো শব্দ লিখে ফেলল–

হোগার্টস হোগার্টস হোগি ওয়ার্টি হোগার্টস
দয়া করে আমাদের কিছু শেখাও
আমরা বুড়ো বা টেকো মাথা হই
কিংবা ইস্পাত দৃঢ় হাঁটুর তরুণ
আমাদের মাথায় আছে কিছু কৌতূহলী জিনিস
এখন সেগুলো খালি, বাতাসভরা
কিছু মরা মাছি, কিছু পেজা তুলা
মূল্যবান কিছু আমাদের শেখাও
মনে করিয়ে দাও, যা আমরা ভুলে গেছি
যা উত্তম তাই তুমি করো
বাকিটা আমাদের জন্যে রেখে দাও
এবং মাথার ঘিলু পচে না যাওয়া তক
আমরা শিখতে থাকবো।

সবাই বার বার এ গান গাইতে লাগল। শেষ দিকটা যেন শব যাত্রার সঙ্গীতের মত। ডাম্বলডোর জাদুদণ্ড ঘোরালেন। আবার হর্ষধ্বনি।

তিনি বললেন-এখন শোবার সময়। তোমরা ঘুমোতে যাও।

সবাই গ্রেট হলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। হ্যারি খুব ক্লান্ত। সে খুব বেশি খেয়েছে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। তাই চারপাশের কথা তার কানে আসছে না। সিঁড়ির দুপাশে বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ছে না। এর পর কিছু বেলুন উড়ল। কিছু হাঁটার ছড়ি আকাশে উড়ল। ব্যারনের কথা শোনা গেল। করিডোরের শেষে একটা মোটা মহিলার ছবি দেখা গেল। গোলাপী রঙের পোশাক। ছবিটা বলল–তোমার পাসওয়ার্ড জানাও।

পার্সি বলল–ক্যাপুট ড্রাকোনিস।

সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা এগিয়ে গেলে দেখা গেল দেয়ালে একটা গোল ছিদ্র।

ওরা ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ল। আর এটাই নাকি কমনরুম। বাঃ বেশ আরামের। বেশ কয়েকটা আরাম চেয়ার রয়েছে।

পার্সি মেয়েদের ডর্মিটরি যাবার দরোজাটা দেখিয়ে দিল। ছেলেদের দরোজা পৃথক। একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে তারা ওপরে উঠল। সুন্দর শোবার ঘর। লাল ভেলভেটের পর্দা। কয়েকটা পোস্টার ঝুলছে। শোবার পাজামা পরে তারা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

হ্যারি একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। তাই সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্নে দেখল, সে অধ্যাপক কুইরেলের পাগড়ি পরেছে এবং পাগড়ি তার সাথে কথা বলছে, তাকে বলছে সে যেন এক্ষুণি স্লিারিনে বদলি হয়, কারণ এটাই তার নিয়তি। হ্যারি পাগড়িকে বলল, সে শ্লিদারিনে বদলি হতে চায় না। পাগড়িটা ক্রমশই ভারি হয়ে উঠছে, সে ওটা খুলে ফেলতে চাইলো, কিন্তু সেটা খুব শক্ত হয়ে আঁকড়ে আছে। ব্যথাও দিচ্ছে তাকে। তার সাথে কথা বলছে। ম্যালফয় হাসছে। হঠাৎ এক লম্বা নাকওয়ালা শিক্ষক–ক্ষেইপ হয়ে গেল। স্নেইপ হাসছে কখনও উঁচু কখনও নিচু স্বরে তীব্র সবুজ আলোর ঝলক! হ্যারি জেগে উঠলো, সে ঘামছে ও কাঁপছে।

একটু পর হ্যারি অন্যদিকে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে ওঠার পর হ্যারি আগের স্বপ্নের সবকিছুই ভুলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *