২৪. আপনার ক্লান্তির কারণ ও তার প্রতিকার

আপনার ক্লান্তির কারণ ও তার প্রতিকার

একটা আশ্চর্যজনক আর উল্লেখজনক ব্যাপার জানাচ্ছি–শুধুমাত্র মানসিক পরিশ্রম আপনাকে ক্লান্ত করতে পারে না। শুনলে অসম্ভব বলেই মনে হবে। তবে কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা বের করতে চেষ্টা করছিলেন মানুষের মস্তিষ্ক পরিশ্রান্ত না হয়ে কতখানি কাজ করে যেতে পারে–যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো অবসাদ বা ক্লান্তি। এই সব বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছেন যে সতেজ মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচলের সময় কোন অবসাদের চিহ্ন দেখা যায় না। আপনি যদি কোন রোজ খেটে খাওয়া শ্রমিকের শিরা থেকে এক ফোঁটা রক্ত তার কর্মরত অবস্থায় বের করে আনেন, তাহলে দেখতে পাবেন সে রক্ত প্রচুর ক্লান্তিময় টক্সিনে ভর্তি। কিন্তু আপনি যদি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এক ফোঁটা রক্ত নিতেন তাহলে দেখতে পেতেন তাতে কিন্তু ক্লান্তির সেই টক্সিনের ছিটে ফোঁটাও নেই। এ মস্তিষ্কের কথা বলতে গেলে দেখা যাবে মস্তিষ্ক কাজ শুরু করার গোড়াতেও যে রকম চলে আট বা বারো ঘন্টা পরেও সেই রকমই কর্মক্ষম থাকে। মস্তিষ্ক হলো সম্পূর্ণভাবে ক্লান্তিবিহীন কিছু…তাহলে আপনার ক্লান্তির কারণ কী?

মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে আমাদের অবসাদ বা ক্লান্তির প্রধান উৎস হলো আমাদের মানসিক আর ভাবাবেগময় হাবভাব । ইংল্যাণ্ডের জনৈক খ্যাতনামা মনোসমীক্ষক জে. এ. ব্যাকফিল্ড তাঁর সাইকোলজি অব পাওয়ার নামক গ্রন্থে বলেছেন…যে ক্লান্তিতে আমরা বেশির ভাগ সময় ভুগে থাকি, তার বেশির ভাগই জন্ম নেয় মন থেকে। আসলে শুধুমাত্র দৈহিক কারণে অবসাদ প্রায় দেখাই যায় না।

আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মনোবিজ্ঞানী ডঃ এ. এ. ব্রিল আরও একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মত হলো : যারা বসে কাজ করে থাকেন তাদের মত সুস্থ মানুষের শতকরা একশ ভাগ অবসাদের কারণ হল মনস্তাত্ত্বিক কারণ, এর মানে হলো আবেগ জনিত কারণ।

কি ধরনের আবেগ জনিত কারণে (বা বসে থাকা) কর্মী ক্লান্ত হয়ে থাকেন? আনন্দের আতিশয্যে? মনের খুশিতে? না! কক্ষনোও তা নয়! একঘেঁয়েমি, বিরক্তি, যোগ্য সমাদরের অভাব, তুচ্ছতাবোধ, তাড়াহুড়ো, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা–এই গুলোই সেই আবেগজনিত কারণ, যাতে বসে কাজ করা মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয় এবং এর ফলেই সে মাথার যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। হ্যাঁ, জেনে রাখুন আমরা ক্লান্ত হই কারণ আমাদের আবেগই আমাদের শরীরে স্নায়বিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানী অবসাদের উপর একটা পুস্তিকায় বলেছিলেন এই কটি কথা : কঠিন পরিশ্রম কখনই কদাচিৎ ক্লান্তি বা অবসাদ আনতে পারে, যে অবসাদ ভালো দ্রিা বা বিশ্রামে দূর হয়। না…দুশ্চিন্তা : উদ্বেগ আর আবেগজনিত গণ্ডগোলই ক্লান্তি বা অবসাদের প্রধান তিনটি কারণ। যখন শারীরিক বা মানসিক কাজের ফলেই এটা হয় তখন এদেরই দোষের কারণ বলা হয়…মনে রাখবেন টান টান কোন মাংসপেশীই হলো কার্যকর মাংসপেশী। অতএব সহজ হয়ে উঠুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য শক্তি জমিয়ে রাখুন।

এবারে যেমন অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় থেকে, আপনি নিজেকে একবার পরীক্ষা করে নিন! এই লাইনগুলো পড়তে বইটার দিকে ভ্রুকুটি করছেন না তো? দুচোখের মাঝখানে কোন মানসিক চাপ বোধ করছেন না তো? আপনার চেয়ারে বেশ আরাম করে বসে আছেন তো? নাকি কাধ কুঁচকে রয়েছেন? আপনার মুখের পেশীগুলি কি টান টান হয়ে আছে? এই মুহূর্তে যদি আপনার সারা শরীরটা তুলোর পুতুলের মত সরল আর ঢিলেঢালা না থাকে, তাহলে কোন সন্দেহ নেই এই মুহূর্তে আপনি স্নায়বিক উত্তেজনা আর পেশীর উত্তেজনায় আক্রান্ত। আপনি স্নায়বিক অবসাদ তৈরি করে চলেছেন।

মানসিক কাজ করতে গিয়ে আমরা কেন এই অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা তৈরী করি? জোসেলিন বলেন : আমি লক্ষ্য করেছি যে প্রধান বাধা হলো সার্বজনীন এই বিশ্বাস যে কঠিন কাজ করার জন্য চাই চেষ্টার এক চিন্তা, না হলে কাজটি ঠিকমতো হতে চায় না। আর এই কারণেই আমরা মনোযোগ দেওয়ার সময় ভ্র কুঁচকে তাকাই। আমরা কাঁধ সঙ্কুচিত করি। আমরা আমাদের পেশীকে আমাদের চেষ্টার মধ্যে গতি আনতে বলি, কিন্তু এসব আমাদের মস্তিষ্ককে কোনভাবেই তার কাজে সাহায্য করে না।

এখানে আশ্চর্যজনক আর বিয়োগান্ত একটা সত্য উদ্ধৃত করছি : কোটি কোটি মানুষ যারা তাদের টাকা নষ্ট করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না তারাই আবার উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে সেই টাকা আর তাদের শক্তি নাবিকদের মত উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে উড়িয়ে চলে।

এই স্নায়বিক অবসাদের উত্তর কি রকম? বিশ্রাম! বিশ্রাম! বিশ্রাম! কাজ করে চলার অবসরে বিশ্রাম গ্রহণ করার কৌশল আয়ত্ত করুন।

ব্যাপারটা সহজ! মোটেই না। এটা করতে গেলে আপনাকে হয়তো আপনার সারা জীবনের অভ্যাসকে উল্টোপথে চালনা করতে হতে পারে। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে, কারণ এর ফলে আপনার জীবনে হয়তো বা বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। উইলিয়াম জেম্‌স তার ‘দি গসপেল অব রিল্যাক্সেশান’ প্রবন্ধে বলেছেন : আমেরিকান জীবনে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ, ঝাঁকুনি আর সন্ত্রস্ততা এবং তারই সঙ্গে প্রকাশের ব্যথা আর তীব্রতা…এর মূল হলো আর কিছুই না–খারাপ অভ্যাস।

উদ্বেগ একটা অভ্যাস। বিশ্রামও একটা অভ্যাস। খারাপ অভ্যাস যেমন দূর করা যায়, ভাল অভ্যাস তেমন গড়ে তোলাও সম্ভব।

আপনি বিশ্রাম নেন কেমন করে? আপনার মন থেকেই শুরু করেন না স্নায়ু দিয়ে শুরু করেন? আসলে এ দুটোর কোনটা দিয়ে তা করেন না। সবসময়েই আপনি আপনার পেশীকে বিশ্রাম দিতে শুরু করুন।

আসুন একটু চেষ্টা করে দেখি। কি করে এটা হয় দেখাতে গেলে আসুন আপনার চোখ দিয়েই শুরু করা যাক। এই অংশটা ভাল করে পড়ুন, তারপর শেষপ্রান্তে পৌঁছনোর পর একটু হেলান দিয়ে বসে চোখ দুটো বন্ধ করে আপনার চোখকে আস্তে আস্তে বলতে থাকুন, যেতে দাও, যেতে দাও। জোর করে কিছু দেখবার দরকার নাই, ভ্রুকুটি করো না। যেতে দাও, যেতে দাও। আরও এক মিনিট আস্তে আস্তে এই রকম করুন…।

আপনি লক্ষ্য করে দেখেছেন কি কয়েক সেকেণ্ড পরেই চোখের পেশীগুলো হুকুম তামিল করতে আরম্ভ করেছে? আপনার কি মনে হয় নি যেন কোন হাতের স্পর্শে আপনার অবসাদ দূর হতে আরম্ভ করেছে? যাই হোক, আসল রহস্য হলো ওই একটা মিনিটের মধ্যেই আপনি বিশ্রাম বা বিনোদনের গোপন রহস্যটা জেনে ফেলেছেন। এটাই মূল কথা। এই সকল একই জিনিস আপনি করতে পারেন আপনার চোয়াল দিয়ে, বা মুখের পেশী, ঘাড় বা কাঁধ দিয়ে, মোট কথা সারা শরীর দিয়ে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটি হলো ওই চোখ। চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এডমন্ড জ্যাকসন তো এমনকি বলেই ফেলেছেন যে, আপনি যদি চোখের পেশীগুলোকে সম্পূর্ণ নমনীয় করে ফেলতে পারেন তাহলে সমস্ত রকম জ্বালা যন্ত্রণার কথা একেবারেই ভুলে যেতে পারবেন! চোখ যে কোন স্নায়বিক উদ্বেগ দূর করার কাজে এত গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ হলো তারা শরীরের গ্রহণীয় সমস্ত ক্ষমতার এক চতুর্থাংশ খরচ করে ফেলে। আর এই কারণেই বহু মানুষ যাদের দৃষ্টিশক্তি চমৎকার, তাঁরা চোখের টাটানিতে ভোগেন।

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভিকি ব্রাউন বলেন যে তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন কোন এক বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁর দেখা হলে তিনি তাঁকে এমন একটা জিনিস শিখিয়ে দেন, যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তিনি আর শোনেন নি। পড়ে গিয়ে তার হাটু ছড়ে গিয়েছিলো আর কব্জিতেও আঘাত লেগেছিল। বৃদ্ধ লোকটি তাকে তুলে ধরেছিলেন, তিনি এককালে সার্কাসের ক্লাউন ছিলেন। তার পোশাকের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বৃদ্ধ বলেছিলেন : পড়ে গিয়ে তোমার আঘাত লাগার কারণ হলো তুমি জানো না কেমন করে নমনীয় হতে হয়। তোমার ভাব দেখাতে হবে যেন তুমি পুরানো দলা পাকানো মোজার মতোই নড়বড়ে আর নরম। এসো, তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি কেমন করে সেটা করতে হয়। না সেই বৃদ্ধ এরপর শিশু ভিকিকে আর অন্যান্য বাচ্চাদের শিখিয়ে দেন কি করে পড়ে যেতে হয় আর কেমন করে গড়িয়ে গিয়ে ডিগবাজি খেতে হয়। বৃদ্ধ বারবার বলেছিলেন, একটা কথা সবসময় মনে রাখবে তুমি হচ্ছো পুরনো দলা পাকানো মোজা। তারপরই তোমায় নমনীয় হতে হবে।

আপনিও যখন তখন যে কোন মুহূর্তেই এই বিশ্রাম নিতে পারেন। শুধু বিশ্রাম নেওয়ার কোন চেষ্টা করবেন না। বিশ্রাম হলো সমস্ত রকম উদ্বেগ আর প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি। সহজভাবে ভাবতে চেয়ে বিশ্রাম নিন। এটা শুরু করবেন আপনার চোখের আর মুখের পেশী নমনীয় করতে চেয়ে, সঙ্গে বারবার বলতে থাকবেন সব চলে যাক…চলে যাক,…বিশ্রাম চাই। আপনার মুখের পেশী বেয়ে অনুরণকে শরীরের অভ্যন্তরে থামতে অনুভব করতে থাকুন। শিশুর মতো সবরকম উদ্বেগ মুক্ত বলে নিজেকে ভাবতে থাকুন।

ঠিক এই রকমই করতেন বিখ্যাত গায়িকা গ্যাল্লি কুর্চি। হেলেন জেপসন নামে একজন মহিলা আমায় একবার বলেছিলেন যে তিনি কোন অনুষ্ঠানের ঠিক আগে গ্যাল্লি কুর্চিকে একটা চেয়ারে সমস্ত পেশী এলিয়ে দিয়ে বসে থাকতে দেখেছেন। তাঁর চোয়াল প্রায় মুখে পড়তো তখন। ভারি চমৎকার অভ্যাস এটা–এটা তাঁকে মঞ্চে প্রবেশের আগে সব উদ্বেগ আর স্নায়বিক দুর্বলতা মুক্ত করে দিত, এটা তার অবসাদও দূর করত।

শরীরে শিথিলতা এনে বিশ্রাম করার জন্য নিচের পাঁচটি উপদেশ মেনে চলতে পারেন :

এক। এ বিষয়ে কিছু ভালো বই পড়তে পারেন, যেমন ড. ডেভিড হ্যাঁরল্ড ফিঙ্কের স্নায়বিক উদ্বেগ থেকে মুক্তি। এছাড়াও আছে ড্যানিয়েল ডব্লিউ জোসেলিনের লেখা’ কেন ক্লান্ত হন বইখানা।

দুই। যখন তখন বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করুন। পুরনো মোজার মত নিজেকে শিথিল করে ফেলুন। আমি আমার কাজের টেবিলে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা পুরনো মোজা রেখে দিই। এ ছাড়া বিড়ালের কথাটাও মনে রাখবেন। ঘুমন্ত বিড়াল–ছানা কখনও হাতে নিয়ে দেখেছেন? তুলে নিয়ে দেখবেন কেমন তুলোর বস্তার মত লাগে। ভারতীয় যোগীরাও বলেন বিশ্রামের কৌশল আয়ত্ত করতে হলে বিড়ালের চালচলন লক্ষ্য করবেন। আমি কোনদিন অবসাদে ভেঙে পড়া বিড়াল দেখিনি।

তিন। বেশ আরাম করে বসে যতটা পারেন কাজ করবেন। মনে রাখবেন শরীরে উদ্বেগ থাকলে কাঁধ ব্যাথা হয় আর অবসাদ আসে।

চার। দিনের মধ্যে চার কি পাঁচ বার নিজেকে পরীক্ষা করুন আর নিজেকে প্রশ্ন করুন : আমি কি বেশি পরিশ্রম করছি? যে কাজে পেশীর প্রয়োজনে নেই তাতে কি তাই কাজে লাগাচ্ছি? এটা আপনাকে বিশ্রামের কৌশল আয়ত্ত করতে শেখাবে।

পাঁচ। এরপর দিনের শেষে নিজেকে আবার প্রশ্ন করুন : আমি কতখানি ক্লান্ত? আমি যদি ক্লান্ত হই সেটা আমার মানসিক কাজের বা পরিশ্রমের জন্য নয়, বরং আমি যেভাবে করেছি সেই জন্যেই। ড্যানিয়েল ডব্লিউ জোসেলিন বলেন : আমি দিনের শেষে নিজেকে প্রশ্ন করিনা আমি কতখানি ক্লান্ত বরং জানতে চাই আমি কতটা ক্লান্ত নই। আমি যখন দিনের শেষে কোনভাবে অবসাদগ্রস্ত বলে নিজেকে ভাবি বা কোনরকম বিরক্তি আসে আর বুঝি আমার স্নায়ু ক্লান্ত, তখন বুঝতে পারি ভালোভাবেই কাজটা বেশি করেই করেছি, যোগ্যতাও অভাব ছিলো। আমেরিকার ব্যবসাদারদের প্রত্যেকে যদি এটা খেয়াল রাখতেন তাহলে হয়তো উচ্চ রক্তচাপের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা ঢের কমে আসতো। এছাড়াও স্যানাটোরিয়াম আর উন্মাদাশ্রমে মানুষের সংখ্যাও কম হতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *