২৩. অবসাদ দূর করার উপায়

অবসাদ দূর করার উপায়

দুশ্চিন্তা দূর করার সম্বন্ধে বইয়ে অবসাদ দূর করার কথা লিখতে চাইছি কেন? ব্যাপারটা খুবই সরল : কারণ অবসাদ অনেক ক্ষেত্রেই দুশ্চিন্তা আনে–অন্ততঃ দুশ্চিন্তা প্রবণ করে তুলতে পারে। যে কোন ডাক্তারি ছাত্রই বলবে অবসাদ যে কোন রকম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়–আবার যে কোনো মনস্তাত্ত্বিকও বলবেন অবসাদ ভয় আর দুশ্চিন্তার আবেগ দূর করার ক্ষমতাও কমিয়ে আনে। তাই অবসাদ দূর করতে পারলে দুশ্চিন্তা দূর করা সম্ভব হতে পারে।

দূর করা সম্ভব হতে পারে’ বললাম? কথাটা নরম করেই বললাম। ডঃ জ্যাকবসন আর একটু এগিয়েছেন এবং তিনি দুখানা বইও লিখেছেন বিশ্রাম সম্পর্কে। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফিজিওলজির ডিরেক্টর। ডাক্তারি ক্ষেত্রে বিশ্রাম নিয়ে তিনি ঢের পরীক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন পরিপূর্ণ বিশ্রামের সময় স্নায়বিক বা আবেগজনিত অবস্থা মোটেই থাকতে পারে না। অন্যভাবে বললে বলা যায় : আপনি বিশ্রাম করতে থাকলে কিছুতেই দুশ্চিন্তা করতে পারবেন না।

তাই অবসাদ আর দুশ্চিন্তা কাটানোর ক্ষেত্রে নিয়ম হল : ঘন ঘন বিশ্রাম নিন। ক্লান্ত হওয়ার আগেই বিশ্রাম করুন।

এটা এত জরুরি কেন? কারণ অবসাদ অত্যন্ত দ্রুত ছড়ায়। আমেরিকার সেনাবিভাগ তরুণ সেনাদের ঘন ঘন পরীক্ষা করে আবিষ্কার করেছেন যে, কাজ করার ফাঁকে ঘন্টায় তারা যদি দশ মিনিট জিরিয়ে নেয় তাহলে তারা আরও ভালো ভাবে কাজ করতে পারে। তাই সামরিক দপ্তর তাদের বিশ্রাম করতে বাধ্য করে। আপনার হৃৎপিণ্ডও ওই রকম। আপনার হৃৎপিণ্ড প্রতিদিন যে পরিমাণ রক্ত পাম্প করে তাই দিয়ে একটা রেলের গাড়ি বোঝাই করা যায়। এর ফলে যে শক্তির উৎপাদন হয় তা দিয়ে পাঁচশ চল্লিশ মন কয়লা তিন ফুট উঁচু করে জমা করা চলে। এরকম কাজ সে পঞ্চাশ, সত্তর বা নব্বই বছর ধরে করে চলতে পারে। হৃৎপিণ্ড কিভাবে তা সহ্য করে? হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ডঃ ওয়াল্টার বি. ক্যানন বলেন : বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা হৃৎপিণ্ড সারাক্ষণই কাজ করে চলে। আসলে প্রতিবার সঙ্কোচনের সময় বিশ্রাম ঘটে। মিনিটে মাত্র সত্তর বার বুক ধুক পুক করে আর হৃৎপিণ্ড চব্বিশ ঘন্টায় পনেরো ঘন্টা বিশ্রাম নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইনস্টন চার্চিল সত্তর বছর বয়সে রোজ প্রায় ষোল ঘন্টা কাজ করতে পারতেন, বছরের পর বছর ধরে সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। এ এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার। এর গোপন রহস্য কি? তিনি রোজ সকালে এগারোটা পর্যন্ত বিছানায় বসে কাজ করতেন, রিপোর্ট পড়তেন, আদেশ দিতেন, টেলিফোন করতেন আর জরুরি সভাও করতেন। মধ্যাহ্ন ভোজের পর তিনি একঘন্টা ঘুমোতেন। সন্ধ্যাবেলাতেও তিনি দু ঘন্টা ঘুমোতেন আটটায় ডিনার খেয়ে। তাঁকে অবসাদ দূর করতে হত না। তিনি অবসাদ আসতেই দিতেন না। যেহেতু তিনি অনবরত বিশ্রাম নিতেন, তাই ক্লান্ত না হয়ে কাজ করতেও পারতেন।

প্রথম জন ডি রকফেলার দুটো বিচিত্র রেকর্ড করেন। ওই সময়ে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা রোজগার করেন এবং আটানব্বই বছর বয়স অবধি বেঁচে ছিলেন। এসব কিভাবে করেন তিনি? প্রধান কারণ অবশ্য তিনি দীর্ঘকাল বাঁচবেন মনস্থ করেন উত্তরাধিকার সূত্রে। আর একটা কারণ প্রতিদিন দুপুরে অফিসে আধঘন্টা ঘুমিয়ে নিতেন। তিনি আরাম কেদারায় যখন শুয়ে থাকতেন তখন স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডাকলেও ফোন ধরতেন না।

‘কেন ক্লান্ত হন’ নামের এক চমৎকার গ্রন্থে ড্যানিয়েল ডব্লিউ জোসেলিন বলেছেন : বিশ্রাম কোন অর্থহীন কাজ নয়, বিশ্রাম মানে মেরামত করা। বিশ্রামের মেরামত করার শক্তি এতই বেশি যে এমন কি পাঁচ মিনিট ঘুমও অবসাদ দূর করতে পারে। বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় কনি ম্যাক বলেছেন বিকেলে এটুকু ঘুমিয়ে না নিলে তিনি খেলতেই পারতেন না।

এলিনর রুজভেল্টকে যখন প্রশ্ন করেছি তিনি হোয়াইট হাউসে থাকার সময় বারো বছর কিভাবে ক্লান্ত হয়ে কাজ করতেন, তিনি বলেছিলেন কোন সভা বা বক্তৃতা দেবার আগে চেয়ারে বসে বিশ মিনিট চোখ বুজে বিশ্রাম নিতেন।

আমি একবার হলিউডের চিত্রাভিনেতা জীন অট্রির সাজঘরে গিয়েছিলাম। তাঁর ঘরে একখানা স্প্রিংয়ের খাট দেখেছিলাম। জীন অট্রি আমায় বলেন, প্রতিদিন বিকেলে ওটায় শুয়ে কাজের ফাঁকে আমি একঘন্টা ঘুমিয়ে নিই। হলিউডে যখন ছবি করি আরাম কেদারায় শুয়ে দশ মিনিট করে বার তিনেক ঘুমোই। এতে প্রচুর উৎসাহ পাই।

এডিসনও বলেছিলেন তাঁর অদ্ভুত শক্তি আর সহ্যশক্তির মূলে রয়েছে যখন তখন ঘুমিয়ে নেবার ক্ষমতা।

আমি হেনরী ফোর্ডকে তাঁর আশি বছরের জন্মদিনের সময় একবার দেখেছিলাম। আমি অবাক হয়ে যাই তাঁর সুন্দর সজীব চেহারা আর প্রফুল্লতা দেখে। আমি তাকে তার রহস্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি বসার সুযোগ পেলে দাঁড়াই না, শোবার সুযোগ পেলে বসি না।

আধুনিক শিক্ষার গুরু হোরেসমান বৃদ্ধ বয়সে তাই করতেন। অ্যান্টিয়ক কলেজের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি একটা কোচে শুয়েই ছাত্রদের সাক্ষাৎকার নিতেন।

আমি হলিউডের একজন চিত্রপরিচালককে এই রকম বিশ্রাম করতে বলেছিলাম। তিনি স্বীকার করেছেন ব্যাপারটা অলৌকিক কাজ দিয়েছে। আমি জ্যাক চাৰ্টকের কথা বলছি। তিনি আমায় বলেছিলেন এর আগে তিনি প্রচুর টনিক, পিল, ইত্যাদি খেয়েছেন কিন্তু কিছুই উপকার পাননি। আমি তাকে বলেছিলাম প্রতিদিন ছুটি নিতে। তিনি জানতে চান কিভাবে? প্রতিদিন অফিসে কিছুক্ষণ টানটান হয়ে বিশ্রাম নিতে।

দু বছর পরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন আমার একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেছে। ডাক্তাররা অন্তত তাই বলেছিলেন। তিনি তাঁর ঘরে যখন তখন টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন, তাতে তিনি খুবই ভালো বোধ করেন। এখন তিনি দুঘন্টা বেশি পরিশ্রম করেও শ্রান্ত হন না।

আপনার ক্ষেত্রে এটা কি রকম হতে পারে? আপনার পক্ষে যদি দুপুরে ঘুমোন সম্ভব না হয় তাহলে সন্ধ্যায় খাওয়ার আগে তা করতে পারেন। দুপুরে খাওয়ার পর কিছু সময় ঘুমালে ক্লান্তি কেটে যায়। শহুরে মানুষদের এটাই করা উচিত। জেনারেল জর্জ মার্শাল তাই করতেন। সেনাবাহিনী পরিচালনার ফাঁকে তিনি দুপুরে ঘুমিয়ে নিতেন। রাত্রে আট ঘন্টা ঘুমিয়ে যে বিশ্রাম মেলে তার চেয়ে বিশ্রাম পাওয়া যায় খাওয়ার আগে একঘন্টা আর রাত্রে ছ’ঘণ্টা ঘুমোলে।

একজন শারীরিক পরিশ্রমকারী অনেক বেশি কাজ করতে পারে সে যদি কাজের ফাঁকে কিছু বিশ্রাম নেয়।

বেথলেহেম ইস্পাত কোম্পানির ফ্রেডরিক টেলার ব্যাপারটা প্রমাণ করে দেখান। তিনি দেখেন মজুররা রোজ ১২ টন লোহা বোঝাই করতে পারে। অথচ তারাই আবার পারে ৪৭ টন বোঝাই করতে যদি উপযুক্ত বিশ্রাম পায়।

টেলর বিশেষ একজন মজুরকে বেছে নিয়ে স্টপ ওয়াচ দিয়ে পরীক্ষা চালান। ওই লোকটিকে লোহা তোলার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম করতে দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায় যে ১২ টনের জায়গায় ৪৭ টন তুলতে পেরেছে।

তাই আবার বলি :

সেনাবাহিনী যা করে আপনিও তাই করুন। প্রায়ই বিশ্রাম নিন। আপনার হৃৎপিণ্ডের মত পরিশ্রান্ত হওয়ার আগেই বিশ্রাম করুন। আপনার জীবনে তাহলে প্রতিদিন বেশি সময় পাবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *