১৫. আপনার সম্পদ হাতবদল করবেন?

আপনার সম্পদ হাতবদল করবেন?

অনেকদিন ধরেই হ্যাঁরল্ড অ্যাবটকে আমি চিনি। তিনি ৮২০ সাউথ ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ, মিসৌরীর ওয়েবসিটিতে থাকেন। তিনি আমার বক্তৃতার ম্যানেজার ছিলেন। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় কানসাস সিটিতে। তিনি আমায় তাঁরই গাড়িতে আমার বেলটনের খামারে পৌঁছে দেন। পথ চলতে চলতে আমি তাকে প্রশ্ন করি উদ্বেগকে তিনি কেমন করে সরিয়ে রাখেন? উত্তরে তিনি এমন একটা উদ্বুদ্ধ করা গল্প শোনান যা কোনদিনই ভুলতে পারব না।

তিনি বলেন আমি আগে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা করতাম, তবু ১৯৩৪ সালের বসন্তকালে একদিন ওয়েব সিটির ওয়েষ্ট ডুহাটি বরাবর বেড়ানোর সময় এমন একটা দৃশ্য আমার চোখে পড়লো যাতে আমার সব। দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেলো। মাত্র দশ সেকেন্ডে ব্যাপারটা ঘটে যায়। কিন্তু ওই দশ সেকেন্ডে আমি যা শিখেছিলাম দশ বছরেও তা পারিনি।

বিগত দু’বছর ধরে ওয়েব সিটিতে আমি একটা মুদীখানার দোকান চালিয়ে আসছিলাম। কাজটা করতে গিয়ে আমার সর্বস্ব যে হারাই তাই নয়, এমন ঋণগ্রস্ত হই যে সেটা শোধ করতে ৭ বছর লেগে যায়। আমার মুদী দোকান গত শনিবার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, আর এখন আমি চলেছি ব্যাঙ্কে কিছু টাকা ধার করতে যাতে কানসাস সিটিতে গিয়ে একটা চাকরির খোঁজ করতে পারি। পরাজিত এক মানুষের মতই আমি চলেছিলাম। তখনই আচমকা আমার নজরে পড়লো একজন লোক আসছে যার দুটো পা নেই। সে একটা ছোট স্কেটিং করার চাকা লাগানো কাঠের তক্তায় বসে হাতে একখণ্ড কাঠ দিয়ে সেটা ঠেলে নিয়ে আসছিলো। সে লোকটি রাস্তা পার হওয়ার ঠিক পরেই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। সে চমৎকার হাসি দিয়ে আমায় অভ্যর্থনা জানালো। সুপ্রভাত স্যার অতি চমৎকার সকাল তাই না? তার দিকে তাকাতেই আমার মনে খেলে গেলো আমি কতখানি ভাগ্যবান আমার দুটো পা আছে, আমি হাঁটতে পারি। আমার নিজের উপর ধিক্কার দেওয়ার জন্য লজ্জিত বোধ করলাম। আমি আমার নিজেকেই বললাম ও যদি ওর দুটো পা না থাকা সত্ত্বেও সুখী আনন্দিত আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকতে পারে তাহলে পা নিয়ে আমি নিশ্চয়ই পারবো। ইতিমধ্যেই আমি বুকে জোর পেতে শুরু করেছিলাম। আমি ব্যাঙ্কের কাছে একশ ডলার ধার নেবো ভেবেছিলাম, এখন ঠিক করলাম দুশো ডলার নেব। আগে ভেবেছিলাম টাকা নিয়ে কানসাস সিটিতে গিতে একটা চাকরির চেষ্টা করবো। এখন ঠিক করে দৃঢ় নিশ্চিত হলাম সেখানে গিয়ে একটা চাকরি পাবোই। আমি ধারও পেলাম আর চাকরিও পেলাম।

এখন আমার স্নানঘরের আয়নার উপর নিচের কথাগুলো সেঁটে রাখা আছে। এগুলো প্রতিদিন সকালে দাড়ি কামানোর সময় আমি পাঠ করি :

একদিন আমার জুতো ছিলো না বলে মন খারাপ ছিলো, সে দুঃখ দূর হয়ে গেল রাস্তায় যখন দেখলাম একজন মানুষের দুটো পা নেই।

আমি একবার এডি রিকেন ব্যারাককে প্রশ্ন করেছিলাম, প্রশান্ত মহাসাগরে অসহায় ভাবে সঙ্গীদের নিয়ে একটা ভেলায় চড়ে একুশদিন ভেসে বেড়িয়ে কি পেয়েছেন তিনি। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ওই অভিজ্ঞতা থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা আমি পাই; তাহলো যদি আপনার ইচ্ছে মত যথেষ্ট খাওয়ার জল থাকে, ইচ্ছেমত খাওয়ার জন্য খাদ্যও থাকে তাহলে কোন ব্যাপারেই কখনও অনুযোগ জানানো উচিত। নয়।

টাইম পত্রিকায় একবার গয়াদাল কানালে আহত এক সার্জেন্টের গল্প বেরিয়ে ছিলো । গোলার উকবো গলায় লেগে সে আহত হওয়ার পর তাকে রক্ত দিয়ে হয়। সে ডাক্তারকে একটা চিরকূট পাঠিয়ে প্রশ্ন করে : আমি কি বাচবো? ডাক্তার জবাব দেন হ্যাঁ। সে এবার লেখে : আমি কি কথা বলতে পারবো? এবারও উত্তর এলো হ্যাঁ। সে তখন আর একটা চিরকূট পাঠালো : তাহলে এতো ভাবনায় পড়ছি কেন?

আপনিও ঠিক এই ভাবে নিজেকেই প্রশ্ন করতে পারেন : আমিই বা এতো দুশ্চিন্তা করছি কেন? হয়তো একটু ভাবলেই দেখতে পাবেন চিন্তার কারণটা সত্যিই অকিঞ্চিৎকর।

আমাদের জীবনে শতকরা নব্বই ভাগ ব্যাপারই ঠিক আর মাত্র দশ ভাগই ভুল। আমরা যদি সুখী হতে চাই তাহলে আমাদের যে শতকরা নব্বই ভাগ ঠিক তার উপরেই নজর রাখতে হবে বাকি দশভাগ ভুলকে অগ্রাহ্য করতে হবে।

অন্যদিকে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে যদি পাকস্থলীর আলসারে আক্রান্ত হতে চাই তাহলে ওই শতকরা দশভাগের উপরেই নজর দিয়ে নব্বই ভাগকে অগ্রাহ্য করতে হবে।

ক্রমওয়েলের আমলে ইংল্যান্ডের বহু গীর্জায় চিন্তা করুন ও ধন্যবাদ জানান কথাগুলো খোদাই করা আছে। এই কথাগুলো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে রাখা উচিত। আমরা যে যে জিনিসের জন্য কৃতজ্ঞ হতে পারি সেকথাই চিন্তা করা দরকার আর আমাদের সমস্ত রকম সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।

গ্যালিভারের ভ্রমণবৃত্তান্তের লেখক জোনাথন সুইফটই ছিলেন ইংরাজী সাহিত্যের সবচেয়ে সাংঘাতিক নিরাশাবাদী। তিনি এতই দুঃখিত থাকতেন যে তিনি সবসময় কালো পোশাক পরতেন আর নিজের জন্মদিনে উপবাস পর্যন্ত করতেন। অথচ তা সত্ত্বেও হতাশায় ভেঙ্গে পড়েও ইংরেজী সাহিত্যের অত বড় নিরাশবাদীও আনন্দিত আর সুখী থাকার স্বাস্থ্যদায়িণী ক্ষমতার প্রশংসা করেছেন।

তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাক্তার বলেন, ডাক্তার কম খাওয়া, ডাক্তার শান্ত থাকা আর ডাক্তার আনন্দ।

আপনি বা আমি ওই ডাক্তার আনন্দকে প্রতিটি ঘন্টাই আমাদের কাছে রাখতে পারি শুধু আমরা যদি মনে করি আমাদের অফুরান ঐশ্বর্য–যে সম্পদের পরিমাণ আলিবাবার ধন গুহাকেও হার মানাতে পারে । কোটি টাকা পেলে আপনি কি আপনার চোখ দুটো বিক্রি করতে পারবেন? পারবেন আপনার পা বিক্রি করে দিতে? আপনার হাত? আপনার শ্রবণ শক্তি? আপনার সন্তানদের? আপনার পরিবার? সব সম্পদ যোগ করে দেখুন, তাহলেই দেখতে পাবেন রকফেলার, ফোর্ড অথবা মর্গ্যানদের সংগৃহীত সমস্ত সোনার বদলেও আপনি এগুলো বিক্রি করতে পারবেন না।

কিন্তু আমরা কি এটার কথা ভাবি কখনও? ওহঁ, না। সোপেনহাওয়ার যেমন বলেছিলেন : আমাদের যা আছে তার কথা আমরা কদাচিতই ভেবে থাকি বরং অধিকাংশ সময় চিন্তা করি যা আমাদের নেই। এটাই হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিয়োগান্ত ব্যাপার। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ আর রোগের যুত দুঃখের সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে বেশি দুঃখ এনেছে এই ধরণের চিন্তা।

ঠিক এই চিন্তাই জন পামারকে সুস্থ মানুষ থেকে খুঁতখুঁতে স্বভাবের এক বৃদ্ধে বদলে দেয়। আর তার সংসার প্রায় ভাঙার মুখে এনে দাঁড় করায়। এটা আমার জানা, কারণ তিনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন।

মিঃ পামার নিউ জার্সির প্যার্টারজের ১৯ অ্যাভিনিউতে থাকতেন। তাঁর নিজের কথায় বলি। সৈন্যবাহিনী ছেড়ে আসার ঠিক পরেই আমি একটা ব্যবসা আরম্ভ করি। সারাদিন রাতই পরিশ্রম করতাম। সবই বেশ চমৎকার চলছিলো। তারপরেই গন্ডগোল আরম্ভ হলো। আমি ব্যবসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজারে পাচ্ছিলাম না। ভয় হলো ব্যবসা হয়তো বন্ধ করেই দিতে হবে। আমার দুশ্চিন্তা এমনই বেড়ে গেলো যে সুস্থ মানুষ থেকে খিটখিটে বুড়ো হয়ে গেলাম । তাছাড়া আমি এমনই খিটখিটে আর রাগী হয়ে পড়লাম যে তখনও বুঝতে পারিনি আমার সুখের সংসারটাই ভাঙতে বসেছে। তখন একদিন আমার এক পুরনো প্রতিবন্ধী কর্মচারি আমায় বললো, বন্ধু, তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত। তুমি এমনভাব দেখাচ্ছো যেন পৃথিবীতে একমাত্র তোমারই যত সমস্যা আছে। হয়তো কিছুদিন ব্যবসার দরজা বন্ধ রাখতে হবে–তাতে হলোটা কি? আবার সব ভালো হলে নতুন করে সুরু করতে পারবে। তোমার যা আছে তাতে তোমার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তা সত্ত্বেও তুমি খালি অনুযোগ জানাচ্ছো, চাঁচামেচি করছে। বন্ধু, আমার ইচ্ছে করে তোমার অবস্থায় আমি যধিন থাকতাম! আমার দিকে একট তাকিয়ে দেখ । আমার একটা মাত্র হাত আছে, মুখের একটা অংশ উড়ে গেছে, তবুও আমি কোন অনুযোগ জানাচ্ছি না। এই রকম চাচামেচি আর অনুযোগ যদি বন্ধ না করো তাহলে জেনে রেখ শুধ তোমার ব্যবসাটাই হারাবে না, হারাতে হবে তোমার স্বাস্থ্য, সংসার আর বন্ধুবান্ধবকেও!

ওই মন্তব্যগুলো আমায় স্তব্ধ, হতবাক করে দিলো। আমি বুঝতে পারলাম আমি কত সুখে আছি । আমি তখন সেই মুহূর্তেই প্রতিজ্ঞা করলাম আমি আবার আগের মতই হব–আর হলামও তাই।

আমার এক বান্ধবী লুসিল ব্লেক, এক শোচনীয় অবস্থায় পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছিলো। তার দুশ্চিন্তাই কেবল ছিলো তার কি নেই, কিন্তু তার কি আছে একবার ও চিন্তা করে সে দেখেনি।

লুসিলের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে বেশ কয়েক বছর আগে আমরা যখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদালত ছোট গল্প লেখার পাঠ নিচ্ছিলাম। নবছর আগে সে জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ধাক্কা খায়। সে on। আরিজোনার টাকশনে। তার কাহিনী তার জবানীতেই শুনুন :

আমি একদম ঘূর্ণীর মতো জীবন কাটাচ্ছিলাম। আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অর্গ্যান বাজানো শিখছিলাম, তাছাড়াও শিখছিলাম অনেক কিছু, সঙ্গীতবোধ সম্পর্কে ক্লাসে বক্ততাও দিতাম। না; নাচে, ঘোড়ায় চড়ায় অংশও নিতাম। একদিন সকালে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমার বুকের অসুখ দেখা দিলো। ডাক্তার জানালেন, আপনাকে এক বছর বিছানায় শুয়ে কাটাতে হবে, সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। তিনি একবারও উৎসাহ জানিয়ে বললেন না আবার আগের মত আমি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো।

বিছানায় শুয়ে এক বছর কাটাতে হবে? শয্যাশায়ী হবে–শেষ পর্যন্ত হয়তো মাই দেন, ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। আমার জীবনে এরকম হলো কেন? আমি কি অপরাধ করলাম যে আমার আমায় পেতে হবে? আমি বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এছাড়াও আমি যেন তিক্ত আর বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। তাসত্বেও ডাক্তারের পরামর্শ শুনে শয্যাতেই আশ্রয় নিলাম। আমার প্রতিবেশী শিল্পী মিঃ রুডলফ আমায় বললেন, তুমি ভাবছো বিছানায় একবছর শুয়ে থাকা ভারি কষ্টকর। কিন্তু দেখে নিও, তাহলে তুমি ভাববার অনেক সময় পাবে আর নিজেকে জানতে পারবে। তোমার সমস্ত আগেকার জীবনটায় যা পারোনি আগামী কয়েক মাসে তোমার আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটবে দারুণভাবে। এসব শুনে আমি কিছুটা শান্ত হলাম আর নতুন কিছু মূল্যবোধ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে চাইলাম। অনুপ্রাণিত করার মত বই পড়তে লাগলাম আমি। একদিন একজন বেতার ঘোষককে বলতে শুনলাম : আপনার জ্ঞানে যা আছে সেটাই আপনি প্রকাশ করতে পারেন। এধরণের কথা আগে বহুবার শুনেছি, কিন্তু এখন কথাগুলো আমার শরীরে এবং মনের গভীরে শিরার শিরায় যেন ছড়িয়ে গেল। আমি মনে মনে ঠিক করলাম যে, যে চিন্তা নিয়ে আমি বাঁচতে চেয়েছি তাই শুধু ভেবে চলব–সে চিন্তা হলো আনন্দ, সুখ, আর স্বাস্থ্য। রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেই যে সব জিনিসের জন্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাই শুধু ভাবতে আরম্ভ করলাম। কোন যন্ত্রণা নেই। সুন্দর কিশোরী একটি মেয়ে। আমার দৃষ্টি শক্তি। আমার শ্রবণ শক্তি । রেডিওতে চমৎকার গান। পড়ার সময়। ভালো খাদ্য ভালো বন্ধু । আমি এমনই হাসিখুশি উচ্ছল হয়ে উঠলাম যে প্রচুর বন্ধুবান্ধবী দেখা করার জন্য আসতে সুরু করলে ডাক্তারকে বাধ্য হয়ে একটা নোটিশ টাঙিয়ে দিতে হলো, আমার কেবিনে একবারে মাত্র একজন দর্শনার্থীই আসতে পারবেন–তাও আবার নির্দিষ্ট সময়।

এ ঘটনার পর ন’বছর কেটে গেছে আর আমি এখন পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় চমৎকার জীবন কাটিয়ে চলেছি। একটা বছর যে আমায় বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে তার জন্য আমি আজ কৃতজ্ঞ। আরিজোনায় কাটানো ওই একটা বছর আমার কাছে দারুণ মূল্যবান আর সুখের বছর। ওই সময় যে। আশীর্বাদ আমি পেয়েছি তা প্রতি সকালে স্মরণ করার অভ্যাসটি আজও আমার রয়ে গেছে। এ আমার কাছে অত্যন্ত দামী কোন সম্পদ। এটা বুঝতে আমি লজ্জাবোধ করি যে যতক্ষণ না আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি জানতেও পেরেছি, ততদিন সত্যি বাঁচার কথা আমি অনুভব করতে পারিনি।

প্রিয় লুসিল ব্লেক তুমি হয় তো উপলব্ধি করতে পারোনি, তবে তুমি যা শিখেছিলে সেই শিক্ষাই লাভ করেছিলেন দুশ বছর আগে ডঃ স্যামুয়েল জনসন। ডঃ জনসন বলেছিলেন : প্রতি ঘটনার ভালো দিকটা দেখা বছরে হাজার পাউন্ডের চেয়েও বেশি মূল্যবান।

এই কথাগুলো মনে রাখবেন, কোন পেশাদার আশাবাদীর মুখ থেকে বের হয়নি, বরং বেরিয়েছিলো এমন একজন মানুষের মুখ থেকে যিনি বিশ বছর যাবৎ উদ্বেগ, দারিদ্র আর অনাহার মুখোমুখি হন–আর শেষ পর্যন্ত তিনি সেই আমলের এক বিখ্যাত লেখক এবং সর্বকালের নামী বক্তা হয়ে ওঠেন। লোগান পিয়ারসন স্মিথ অল্পকথার মধ্যে একমুঠো দামী কথা প্রকাশ করেছিলেন এই ভাবে : জীবন দুটো বস্তুর জন্য নজর রাখা উচিত, আপনি যা চান তাই পাওয়া, আর তারপর সেটা উপভোগ করা। একমাত্র শুধু সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষই দ্বিতীয়টি লাভ করে থাকে।

আপনার কি জানতে ইচ্ছে আছে রান্নাঘরে শুধু ডিস ধোওয়াও কত উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়? তা যদি থাকে তাহলে বর্গহিল্ড ডালের লেখা একখানা বই পড়ে দেখতে পারেন। বইখানার নাম ‘আমি দেখতে চেয়েছিলাম’।

এ বইখানা লিখেছিলেন যে মহিলাটি তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অন্ধ ছিলেন। ভদ্রমহিলা লিখেছেন : আমার মাত্র একটা চোখ ছিলো আর সে চোখও এমন ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো যে সামান্য একটা ফুটো দিয়ে আমায় দেখতে হতো। একেবারে চোখের কাছে এনে প্রায় চোখে লাগিয়েই কোন বই দেখতে পেতাম তারপর লেখা চোখে পড়তো চোখ টান টান করে একেবারে বাঁ পাশে তাকালে।

.

এমন হওয়া সত্ত্বেও তিনি কারও অনুকম্পা নিতে চাননি, চাননি অন্যরকম কোন ব্যবহার। ছোটবেলায় অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে তিনি এক্কাদোক্কা খেলতে চাইতেন, কিন্তু মাটিতে দেয়া দাগ তিনি দেখতে পেতেন না। তাই সব বাচ্চারা খেলার পর বাড়ি চলে গেলে তিনি মাটিতে চোখ লাগিয়ে দাগগুলো দেখার জন্য হামাগুড়ি দিতেন। এমনি করে মাটির প্রতিটি দাগই তিনি একেবারে মনে গেঁথে রেখেছিলেন। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে তিনি সকলকে প্রায় হারিয়ে দিতেন। বাড়িতেই তিনি লেখা। করতেন, বড় বড় অক্ষরে লেখা বই প্রায় চোখের কাছে ঠেকিয়ে পড়ে ফেলতেন তিনি। এমন অs তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ডিগ্রী লাভও করেছিলেন। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী আর কলম্বিয়া থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।

তিনি মিনেসোটারা টুইন ভ্যালীতে ছোট্ট এক গ্রামে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন আর শেষ পর্যন্ত তিনি সাউথ ডাকোটার অগাস্টান কলেজের সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের অধ্যাপিকা হন। সেখানে তিনি তেরো বছর শিক্ষাদান করেন আর মেয়েদের ক্লাবে বক্তৃতা দেন। তিনি রেডিওতে বই আর লেখকদের উপর কথিকাও প্রচার করেন। তিনি লিখেছেন : আমার মনের কোণে বরাবরই চিরদিনের মতো অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তির তির করে কাপতো। এটা থেকে বাঁচার জন্যই জীবন সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ আনন্দ উচ্ছল, হাস্যময় একটা ধারণা পোষণ করতাম।

এরপর ১৯৪৩ সালে তাঁর বয়স যখর বাহান্ন বছর, একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটে যায়। বিখ্যাত মেয়ো ক্লিনিকে তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। এর ফলে তিনি চল্লিশ গুণ বেশিই আগের চেয়ে দেখতে লাগলেন।

এর ফলে তার চোখের সামনে সৌন্দর্যময় উত্তেজনায় ভরপুর একটা দুনিয়ার দরজা খুলে যায়। তিনি রান্নাঘরের বেসিনে ডিস ধোয়ার মধ্যেও অদ্ভুত একটা উত্তেজনার স্পর্শ খুঁজে পেলেন। তার নিজের কথায় ব্যাপারটা এই রকম : আমি বেসিনের মধ্যে ডিসে লাগানো সাবানের ফেনা নিয়ে খেলতে আরম্ভ করেছিলাম। ওই সাবানের ফেনায় হাত ঢুকিয়ে ছোট ছোট বুদ্বুদের গোল বল তুলে এনে আলোর সামনে ধরে তার মধ্যে দেখে চলতাম ছোট্ট ছোট্ট রামধনু রঙের খেলা।

রান্নাঘরের বেসিনের উপরের জানালা দিয়ে তাকাতেই তার চোখে পড়তো সাদাকালো ডানা ঝাঁপটে তুষার স্তূপের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে চড়ুই পাখির ঝাঁক।

চড়ুই পাখি আর সাবান ফেনার ওই অপরূপ দৃশ্য দেখে তাঁর মন ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তিনি তার বইটি শেষ করেন এই কটি কথা দিয়ে : প্রিয় ঈশ্বর, আমাদের স্বর্গের পিতা, আমি ফিসফিস করে বলি, আমি আপনাকে আমার অন্তরের ধন্যবাদ দিই, জানাই আমার প্রণাম।

একবার ভাবুন আপনি, যেহেতু ডিস ধুতে পারছেন আর সাবানের বুদবুদে রামধনু দেখতে পাচ্ছেন এবং তুষারের বুকে চড়ুইকে উড়তে দেখছেন বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ।

আপনার বা আমার নিজেদের সম্বন্ধে লজ্জিত হওয়া উচিত। সমস্ত সময়েই আমরা সৌন্দর্যময় রূপকথার জগতে বিচরণ করে চলেছি। কিন্তু আমরা এমনই অন্ধ যে এসব আমরা দেখেও দেখতে পারি না, আমরা এতই পরিপূর্ণ যে আমরা এই আনন্দ উপভোগ করতে পারি না।

আমরা যদি দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে জীবনকে উপভোগ করতে চাই, তাহলে এই নিয়মটাই মেনে চলা উচিত :

জীবনে যা পেয়েছেন তারই হিসেব করুন, যা পাননি তার নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *