১১. কাঠের গুড়ো করাত দিয়ে কাটতে চাইবেন না

কাঠের গুড়ো করাত দিয়ে কাটতে চাইবেন না

এই বাক্যটা যখন লিখছি তখন জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাই বাগানের পথের উপর পড়ে থাকা পাথরের বুকে ডাইনোসরের পদচিহ্ন। ওই ডাইনোসরের পদচিহ্ন আমি ইয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের পীবডি যাদুঘর থেকে কিনি। এ সম্বন্ধে সেখানকার কিউরেটরের একখানা চিঠিও পেয়েছি তাতে তিনি বলেছেন ওই পদচিহ্ন আঠারো কোটি বছর আগে। কোন মোঙ্গালয়ান আকাট মূর্খও ভাববে না আঠারো কোটি বছর আগে ফিরে গিয়ে ওই পদচিহ্নের পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু একশ আশি সেকেন্ড আগে যা ঘটে গেছে। তাকেও তা বদলানো অসম্ভব–অথচ আমাদের মধ্যে অনেকেই সেই চেষ্টা করেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমরা একশ আশি সেকেণ্ড আগের কাজের ফলাফল হয়তো কিছুটা পরিবর্তন করতে পারি–কিন্তু কিছুতেই সেই ঘটনাকে বদল করতে পারি না।

ঈশ্বরের রাজত্বে একটা মাত্র পথেই গঠনমূলকভাবে অতীতকে গ্রহন করা যেতে পারে। আর তা হল অতীতের ভুলকে শান্তভাবে বিশ্লেষণ করে তা থেকে উপকার লাভকরা–এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অতীতকে বিস্মৃত হওয়া।

আমি জানি এটা সত্য, কিন্তু আমার কি তা মেনে নেওয়ার মতো সাহস বা জ্ঞান থাকে? এর উত্তর দিতে হলে বেশ কবছর আগে যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করি তার কথা শোনাতে দিন। আমি এক পেনিও লাভ না করে লক্ষ লক্ষ ডলার নিজের হাতের মধ্য দিয়েই নষ্ট করি। ব্যাপারটা এইভাবে ঘটে : আমি বয়স্ক শিক্ষার এক বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলাম, নানা শহরে শাখাও খুলেছিলাম, নানাভাবে বিজ্ঞাপন আর অফিসের পিছনে খরচও করেছিলাম। শিক্ষাদানে আমি এমনই ব্যস্ত ছিলাম যে টাকা পয়সার দিকে নজরই দিতে পারিনি। আমি এতই অপরিণত ছিলাম যে খরচের দিকটা দেখার জন্য যে একজন ব্যবসায় পাকা ম্যানেজার রাখা দরকার সেটা বুঝতে পারিনি ।

শেষ পর্যন্ত প্রায় একবছর পরে মারাত্মক একটা অবস্থা টের পেলাম। দেখলাম প্রচুর আয় হওয়া সত্ত্বেও লাভ কিছুমাত্র হয়নি। এটা আবিষ্কারের পর দুটো জিনিস আমার করা উচিত ছিল। প্রথমতঃ জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার যিনি বিখ্যাত একজন নিগ্রো বিজ্ঞানী–যা করেছিলেন তাই করা উচিত। অর্থাৎ একটা ব্যাঙ্ক ফেল মারলে তার সারা জীবনের সঞ্চয় চল্লিশ হাজার ডলার জলে গেলে তিনি যা করেছিলেন। কেউ যখন তাকে প্রশ্ন করত যে তিনি দেউলিয়া সেকথা জানেন কিনা–তিনি জবাব দিতেন : হ্যাঁ সে রকম শুনেছি বটে। তিনি তারপর তাঁর শিক্ষকাত চলিয়ে গেলেন। তিনি তার ক্ষতির ব্যাপারটা মন থেকে একদম সরিয়ে দিয়েছিলেন। একবারের জন্যও আর ভাবতে চাননি।

দ্বিতীয় আর একটা কাজ আমার করণীয় ছিল : আমার উচিত ছিল আমার ভুলগুলো বিশ্লেষণ করা আর একটা স্থায়ী শিক্ষা পাওয়া।

সত্যি বলতে কি এদুটোর কোনটাই আমি করিনি। তার বদলে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ি। কয়েক মাস যাবৎ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি ঘুমোতে পারিনি, আমার ওজনও কমে গেল। একটা শিক্ষালাভ করার বদলে একই কাজ করে আবার অল্প টাকা খোয়ালাম?

এতসব বোকামির কথা স্বীকার করাটা সুখের হয়। তবে একটা ব্যাপার বেশ আগেই শিখেছি যে বিশজনকে শেখানো সহজ কিন্তু বিশজনের হয়ে একজন পালন করা সহজ নয়।

নিউ ইয়র্কের জর্জ ওয়াশিংটন হাই স্কুলের ডঃ পল ব্রান্ডওয়াইনের কাছেই আমার শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল । তিনি অ্যালেন সণ্ডার্স নামে একজনকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। মি. সন্ডার্স আমাকে বলেছিলেন যে ডঃ ব্র্যান্ডওয়াইনের স্বাস্থ্যের ক্লাসে এক মহামূল্যবান শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি বলেন : আমার বয়স তখন অল্পই। তবুও বড় দুশ্চিন্তা করতাম। যেসব ভুল করতাম তা ভেবে আমার অস্বস্তি আর রাগ হত । পরীক্ষা দেওয়ার পর জেগে থেকে আঙুল কামড়ে চলতাম পাছে পাশ না করি। সব সময় যা করতাম তা নিয়ে ভাবতাম আর অন্যরকম করলে ভালো হত মনে করতাম। বারবার যা করেছি তা রোমন্থন করতাম।

এরপর একদিন বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে সবাই ক্লাস করতে গেলাম। সেখানে ডঃ ব্রান্ডওয়াইন ছিলেন। তার ডেস্কের উপর রাখা ছিল এক বোতল দুধ। আমরা অবাক হয়ে ভাবলাম দুধ দিয়ে কি হবে । আচমকা তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বোতলটা বেসিনের মধ্যে ফেলে দিলেন আর চেঁচিয়ে বলে উঠলেন : পড়ে যাওয়া দুধ নিয়ে অনুশোচনা করো না!

এরপর তিনি আমাদের সকলকে ডেকে দেখালেন সব দুধ নর্দমায় চলে গেছে। তিনি এবার বললেন : ভালো করে দেখ সবাই। কারণ আমি চাই এই কথাটা সারাজীবন মনে রাখবে। দুধটা পড়ে গেছে–আর তাকে নর্দমা থেকে তুলে আনতে পারবে না। এক ফোঁটাও না। একটু সাবধান থাকলে দুধটা বোধ হয় বাচানো যেত, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে–এখন যা করণীয় তা হল এর কথা ভুলে যাওয়া।

অ্যালেন সন্ডার্স আমায় আরও বলেছিলেন, এই ছোট্ট ঘটনাটা আমি লাতিন আর জ্যামিতি ভুলে যাওয়ার পরেও মনে রেখেছি। আসলে হাই স্কুলে চার বছর পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে ঢের বেশি ওই ঘটনা থেকে শিখেছিলাম। এতে শিখি দুধ যাতে না পড়ে যায়, তবে তা পড়ে গেলে আর যেন মাথা না ঘামাই।

কোন কোন পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন দুধ পড়ে গেলে অনুশোচনা করো না প্রবাদটা নিয়ে বড় বেশি রকম আলোচনা করছি। আমি জানি এটা অতি সাধারণ প্রবাদ, একদম বস্তাপচা । তবু আমি জানি এই বস্তাপচা প্রবাদের মধ্যে যুগ যুগের সঞ্চিত জ্ঞান রয়ে গেছে। এগুলো মানুষের অতীতের লভ্যজ্ঞান থেকে হাজার হাজার বছরের মধ্য দিয়ে এসেছে। বহু পুরনো আনন্দ থেকে যেসব প্রবাদ চলে আসছে তার সবগুলো পড়তে গেলে এইদুটো প্রবাদের প্রকৃতই কোন তুলনা মেলে না : কোন সেতু না আসা পর্যন্ত সেটা অতিক্রম করার চেষ্টা কোরো না বা গড়িয়ে যাওয়া দুধ নিয়ে অনুশোচনা কোরো না। আমরা যদি ওই প্রবাদ দুটো কাজে লাগাতাম তাহলে এই বই পড়ার কোন দরকারই হতো না। আসলে প্রাচীন প্রবাদগুলো যদি আমরা মেনে চলতাম তাহলে মহাসুখেই জীবন কাটাতে পারতাম। তা যাই হোক জ্ঞানকে যতক্ষণ না কাজে লাগানো যায় ততক্ষণ তার দাম নেই। আর এ বইয়ের মধ্য দিয়ে আপনাদের নতুন কিছু বলতে চাইছি না। এ বইয়ের উদ্দেশ্য হল আপনাদের জানা কথাই আবার মনে করিয়ে দেওয়া। যাতে আপনারা তাকে কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ হন।

প্রয়াত ফ্রেড ফুলার শেডের মত মানুষকে আমার বেশ লাগতো, তিনি পুরনো কথাকে বেশ নতুন করে বলতে পারতেন। তিনি ফিলাডেলফিয়া বুলেটিনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ক্লাসে একবার বলেছিলেন : তোমরা কতজন করাত দিয়ে গাছ কেটেছে? দেখি তোমাদের হাত। দেখা গেল অনেকেই তা করেছে। এরপর তিনি বললেন : তোমরা কতজন করাত নিয়ে কাঠের গুঁড়ো কেটেছো? কোন হাতই কেউ তুললো না ।

মিঃ শেড তখন বললেন : অবশ্যই কাঠের গুঁড়ো করাতে কাটতে পারবে না। এটাতো আগেই কাটা হয়ে যায় । অতীতেরও তাই ব্যাপার। অতীতে যা ঘটে গেছে তা নিয়ে যখন দুশ্চিন্তায় মগ্ন হও তখন করাতে কাঠের গুড়ো কাটাই হয়।

কিছদিন আগে জ্যাক ডেম্পসির সঙ্গে আমি ডিনার খেয়েছিলাম। টুনির কাছে তিনি যেভাবে হেরে যান সে ঘটনার কথা আমাকে শোনান তিনি। হেভিওয়েট প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে তার সম্মানে দারুণ লেগেছিল। তিনি আমাকে বলেন : সেই লড়াইর মাঝখানে আমার হঠাৎ মনে হল বুড়ো হয়ে পড়েছি… দশ রাউণ্ডের শেষে যদিও সোজা দাঁড়িয়ে ছিলাম তবে তার বেশি কিছু করার শক্তি আমার ছিল না! আমার সারা মুখ ক্ষত বিক্ষত, চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। দেখতে পেলাম রেফারি বিজয়ী হিসেবে জিন টনির হাত তুলে ধরেছেন, আমি আর বিশ্বজয়ী নই! আমি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে আমার সাজঘরে ফিরে এলাম। তখনই দেখলাম দর্শকের কেউ আমার হাত ধরার চেষ্টা করছে, কারও বা চোখে জল।

একবছর পর আবার টুনির সঙ্গে লড়লাম। তবে করার কিছুই আর ছিল না। চিরকালের জন্যেই আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম । দুশ্চিন্তা না করে উপায় ছিল না তবুও নিজেকে বললাম : পড়ে যাওয়া দুধ নিয়ে মাথা ঘামাবো না। ঘুসির জন্য গাল পেতে দিলেও মাটিতে পড়ব না।

জ্যাক ডেম্পসি ঠিক তাই করেছিলেন। কীভাবে জানেন? বারবার নিজেকে এই কথা বলে, যা ঘটে গেছে তার জন্য শোক করব না। না, তাহলে তার অতীত নিয়ে চিন্তা আরও বেড়ে যেত। তিনি নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন। তিনি ব্রডওয়েতে জ্যাক ডেম্পসি রেস্তোরাঁ আর গ্রেট নর্দান হোটেল খুললেন। তিনি এসব করলেন মুষ্টিযুদ্ধ পরিচালনা আর প্রদর্শনী করে । এই সব করার কাজে তিনি এমনই ব্যস্ত হয়ে রইলেন যে দুশ্চিন্তা করার সময় তার আর রইল না। জ্যাক ডেম্পসি বলেছিলেন : গত দশ বছর আমি এত আনন্দে ছিলাম যে চ্যাম্পিয়ান হয়েও তা পাইনি।

মিঃ ডেম্পসি আমায় বলেছিলেন যে তিনি আমার বই পড়েন নি তবে তিনি শেকসপীয়ারের এই উপদেশ মেনে চলতেন : বুদ্ধিমান মানুষরা কখনও তাদের ক্ষতি নিয়ে ভাবতে চাননা বরং খুশি মনে এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করেন।

ইতিহাস আর জীবনীমূলক বই যখন পড়ি তখন ওই সব মানুষের কষ্টকর অবস্থার কথা পর্যালোচনা করি। আমি অবাক হয়েছি বিপদে এবং দুশ্চিন্তায় তারা কিভাবে দুঃখ দুর্দশাকে ভুলে নতুন উদ্যমে পরম সুখে দিন কাটিয়েছেন।

আমি একবার সিং সিং কারাগারে কয়েদীদের দেখতে যাই। সেখানে গিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম সেখানকার কয়েদীরা বাইরের সাধারণ মানুষের মত সুখী । আমি কথাটা ওখানকার ওয়ার্ডেন লুইস ই লসকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কয়েদীরা যখন প্রথম সিং সিং এ আসে তারা স্বভাবতই ভেঙে পড়ে আর দুঃখিত বোধ করে। কিন্তু কয়েক মাস পরে ওদের মধ্যে বুদ্ধিমান যারা তারা নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা ভুলে গিয়ে শান্তভাবে জেলখানার জীবন যাপন মেনে নেয়। ওয়ার্ডেন লুইস লস আমাকে বলেছিলেন একজন কয়েদী জেলখানার মধ্যেই গান গাইতে গাইতে চাষ বাস করত।

যে কয়েদীটি ফুলের বাগান তৈরি করত আর গান গাইত আমাদের অনেকের চাইতেই তার বুদ্ধি বেশি ছিল। সে জানতো–

চলমান অঙ্গুলি যে লিখে চলে দ্রুত
        লেখা হলে থামেনা সে, ভাবেনা সতত,
        যা কিছু হলো লেখা মোছেনা তখনও
        শত অশ্রুজল তাতে পারেনা কখনও।

তাই অশ্রুজল ফেলে লাভ কি? আমরা নিশ্চয়ই ভুল করেছি–অবিশ্বাস্য কাজও করেছি। কিন্তু তাতে হলো কি? এরকম কে না করে? নেপোলিয়ানও একদিন তার করা সমস্ত বড় যুদ্ধের এক তৃতীয়াংশ হেরে যান। সম্ভবতঃ আমাদের গড়পড়তা কাজ নেপোলিয়ানের চেয়ে খারাপ নয়, কে বলতে পারে?

আর যাই হোক রাজার সমস্ত ঘোড়া আর সৈন্য অতীতকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। অতএব আসুন ৭ নম্বর নিয়মটা মনে রাখি :

করাত দিয়ে কাঠের গুঁড়ো কাটতে চাইবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *