আজকের জন্য বেঁচে থাকুন
১৮৭১ সালের বসন্তকালে এক তরুণ একখানা বইয়ের একুশটি কথা পড়ে গেলেন, কথাগুলো তার ভবিষ্যৎ জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। মন্ট্রিল জেনারেল হাসপাতালের এক ডাক্তারী ছাত্র ছিলেন তিনি। শেষ পরীক্ষায় পাশকরা, ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, কি করবেন, ডাক্তারি পসার কেমন হবে কিভাবে জীবিকা অর্জন করবেন এইসব নিয়ে তিনি খুবই চিন্তায় পড়েছিলেন।
১৮৭১ সালে যে কথাগুলো ঐ তরুণ ডাক্তার ছাত্রটি পড়েছিলেন তারই সাহায্যে তিনি হয়েছিলেন তার কালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসক। তিনি বিশ্ববিখ্যাত ‘জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিন’ পরিচালনা করেন। তিনি অক্সফোর্ডের রেজিয়াস অধ্যাপক নিযুক্ত হন–এটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোন চিকিৎসককে দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান। ইংলণ্ডের রাজা তাকে নাইট উপাধি দেন। মৃত্যুর পর তার জীবনী প্রকাশের জন্য দুটো বিরাট বইয়ে ১৪৬৬খানা পাতা লেগেছিল।
ওই চিকিৎসক হলেন স্যার উইলিয়ম অসলার। ১৮৭১ সালের বসন্তকালে যে কথাগুলো তিনি পড়েছিলেন তা এই টমাস কার্লাইলের লেখা একুশটা কথা : অস্পষ্টতায় ভরা দূরের কিছুর চেয়ে কাছের স্পষ্ট কিছু দেখাই আমাদের দরকার।
বিয়াল্লিশ বছর পরে এক নরম বসন্তের রাতে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউলিপ ফুলে ভরা আঙিনায় স্যার উইলিয়াম অসলার ছাত্রদের সামনে একটা ভাষণ দেন। তিনি বলেন তার মত একজন মানুষ, যিনি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর জনপ্রিয় কোনো বই লিখেছেন, তার অবশ্যই বিশেষ ধরনের গুণ মস্তিষ্কে থাকবে। তিনি বলেন কথাটা একদম অসত্য, কারণ তার বন্ধুরা জানেন তার মস্তিষ্ক অতি সাধারণ।
তাহলে তার এই সাফল্যের গোপন রহস্য কি? তিনি বলেছিলেন, সেটা হল তার কথা অনুযায়ী দৈনিক জীবন যাপনের ফল। কথাটার অর্থ কি? এই বক্তৃতা দেওয়ার কয়েক মাস আগে স্যার অসলার বিরাট এক যাত্রীবাহী জাহাজে আটলান্টিক পার হন। জাহাজের ক্যাপ্টেন সেখানে একটা বোতাম টিপতেই আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটে–কিছু যন্ত্রপাতির শব্দ জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের প্রতিটি অংশ একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যায়। ডঃ অসলার ছাত্রদের এবার বললেন, তোমরা ওই চমৎকার জাহাজের চেয়েও অনেক বেশী আশ্চর্যজনক ভাবে তৈরি এবং ভবিষ্যতে অনেক দূর তোমাদের যেতে হবে। আমি যা বলতে চাই তা হলো তোমাদের সব যন্ত্রপাতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করো যাতে দৈনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হও–এতেই নিরাপদে যাত্রা পথে চলতে পারবে। পাটাতনে দাঁড়িয়ে দেখে নাও বেশিরভাগ যন্ত্র সচল আছে কিনা। আর একটা বোতাম টেপা আর শুনে নাও তোমাদের জীবনের লোহার দরজাগুলো অতীতকে তোমাদের জীবনে রুদ্ধ করতে পারছে কিনা। আর একটা বোতাম টিপে বন্ধ করে দাও নবাগত ভবিষ্যৎকে। তাহলেই তোমরা নিরাপদ–আজকের মত নিরাপদ! অতীতকে রুদ্ধ করো! অতীতকে সমাধিতে দাও …অতীতের কথা ভেবে অনেক মূর্খই মরেছে…. ভবিষ্যতের ভারের সঙ্গে অতীতের বোঝা যুক্ত হয়ে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎকে অতীতের মতই বন্ধ করে দাও …. ভবিষ্যৎ হলো আজ… আগামীকাল বলে কিছুই নেই। মানুষের মুক্তির দিন হলো আজ। মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভেবে শক্তিহীনতা, মানসিক দুশ্চিন্তা আর স্নায়ুর দুর্বলতায় ভোগে। অতএব অতীত আর ভবিষ্যৎকে অর্গলরুদ্ধ করে রোজকার জীবন নিয়েই বাঁচতে চেষ্টা করো। ডঃ অসলার কি তবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি থাকতে বারণ করেছেন? না, কখনই না। তবে ঐ ভাষণে তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়ার সব সেরা পথ হলো সমস্ত বুদ্ধি, ক্ষমতা আর আগ্রহ দিয়ে আজকের কাজ করে যাওয়া।
স্যার উইলিয়াম অসলার ইয়েলের ছাত্রদের খৃষ্টের এই প্রার্থনা দিয়ে দিন শুরু করতে বলেছিলেন: প্রভু, আজ আমাদের আজকের রুটি দাও। মনে রাখবেন প্রার্থনায় কেবল আজকের রুটির কথাই প্রার্থনাকারী বলছে। গতকালের বাসি রুটি খাওয়ার জন্য কোন অভিযোগ জানায় নি সে। প্রার্থনায় সে বলেনি, হে প্রভু, গম চাষের জমি খরা কবলিত–আর আবার খরা হতে পারে–আগামী শীতে তাহলে কিভাবে খাওয়া জুটবে–বা আমার যদি চাকরি না থাকে–ও ঈশ্বর তাহলে কীভাবে রুটি জুটবে?
না, ওই প্রার্থনায় খালি আজকের রুটির কথাই আছে। সম্ভবত আজকের রুটিই শুধু আপনারা খেতে পারেন।
বহু বছর আগে এক কপর্দকহীন দার্শনিক এক কঙ্করময় দেশে ভ্রমণ করছিলেন, যে দেশের লোকেরা সকলেই দরিদ্র। একদিন এক পাহাড়ে, তার পাশে কিছু লোক জমায়েত হলে তিনি যা বললেন সেটাই আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উদ্ধত বাণী। ছাব্বিশ শব্দের ওই বাণী শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে অনুরণিত: আগামীর চিন্তা ত্যাগ কর, কারণ আগামীকালই তার ভার নেবে। আজকের দিনেই ত্যাগ কর, কারণ আগামীকালই তার ভার নেবে। আজকের দিনেই করণীয় অনেক আছে।
অনেকেই যীশুর সেই বাণী, ‘কালকের কথা চিন্তা কর না’ মেনে নেয় নি। তাদের বক্তব্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পক্ষে ওকালতি, যেটা প্রাচ্যের কিছু রহস্যময়তা। তাদের কথা হল, আমায় কালকের কথা ভাবতেই হবে। আমার পরিবারের জন্য বীমা করতেই হবে, বৃদ্ধবয়সের জন্যও টাকা চাই। উন্নতির জন্য আমায় চেষ্টা করতেই হবে।
ঠিক। এসব তো করা চাইই। আসল কথাটা হলো খ্রিস্টের ওই বাণী প্রায় তিনশ বছর আগে অনুদিত রাজা জেমসের রাজত্বের সময় তার যা মানে ছিল আজ আর তা নেই। তিনশ বছর আগে ‘চিন্তা’ কথাটার অর্থ ছিল দুশ্চিন্তা। বাইবেলের আধুনিক সংস্করণে যীশুর বাণী আরও প্রাঞ্জল করে বলা হয়েছে : আগামীকালের জন্য দুশ্চিন্তা কোর না।
অবশ্যই কালকের চিন্তা করবেন, কালকের জন্য সাবধানে পরিকল্পনাও করবেন। তবে কোনো দুশ্চিন্তা নয়।
যুদ্ধের সময় আমাদের সামরিক নেতারা ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতেন। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল আর্নেষ্ট জে. কিং বলেছিলেন, আমি আমাদের সেরা সৈন্যদের সব সেরা জিনিসপত্র দিয়েছি, সঙ্গে দিয়েছি সবচেয়ে ভালো কাজের দায়িত্ব। এর বেশি আর কিছু করতে পারি না।
অ্যাডমিরাল কিং আরও বলেন, একটা জাহাজ ডুবে গেলে তাকে তুলে আনতে পারি না। সেটা ডুবতে আরম্ভ করলে আমার শক্তি নেই তাকে ভাসিয়ে রাখি। তার চেয়ে গতকালের কথা না ভেবে আগামীকালের সমস্যা নিয়ে ভাবাই ভালো। তাছাড়া এই দুশ্চিন্তা আমায় পেয়ে বসলে আমি শেষ হয়ে যাব।
যুদ্ধ বা শান্তির সময়, যাই হোক ভালো আর মন্দ চিন্তার তফাৎ হল : ভালো চিন্তার ফলে সঠিক যুক্তিসহ পরিকল্পনা নেয়া যায়। মন্দ চিন্তায় বেশিরভাগই শুধু উদ্বেগ আর স্নায়বিক দুর্বলতা জাগায়।
সম্প্রতি আমি বিশ্বের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দি নিউইয়র্ক টাইমসের’ প্রকাশক আর্থার হেস সালজবার্গারের সাক্ষাৎকার নিই। তিনি আমায় বলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন সারা ইউরোপকে গ্রাস করে তিনি ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় প্রায় ঘুমোতে পারেন নি। প্রায় মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে একটা রঙের টিউব ক্যানভাস নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের ছবি এঁকেছেন। অথচ ছবি আঁকার কিছুই তিনি জানতেন না, আসলে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি আঁকতেন। মিঃ সালজবার্গার বলেছিলেন দুশ্চিন্তা থেকে কিছুতেই তিনি রেহাই পাননি যতদিন না একটা চার্চের প্রার্থনা গীতের পাঁচটা শব্দ থেকে তার নীতি গ্রহণ করেন : একপা এগোলেই আমার পক্ষে যথেষ্ট।
পথ দেখাও হে স্নেহময় আলোক….
আমাকে স্থির রাখো : দূরের দৃশ্য আমার চাই না;
এক পা চলাই আমার যথেষ্ট।
ঠিক ওই সময়েই একজন সৈন্য ইউরোপের কোথাও একই জিনিস শিখছিলেন। তার নাম টেড বেনজারমিনো। বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ডের মানুষ সে। দুশ্চিন্তার ফলে তিনি হয়ে যান পয়লা নম্বর এক যুদ্ধ শান্ত মানুষ।
টেড বেনজারমিনো লিখেছেন ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে এতোই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই যে ডাক্তার আমাকে বলেন ‘স্প্যাসমোডিক ট্রান্সভার্স কোলন’ নামে জটিল রোগ হয়েছে। এতে অসহ্য যন্ত্রণা। যুদ্ধ যদি শেষ না হ’ত তাহলে নিশ্চয়ই আমার শরীর একদম ভেঙে পড়ত।
আমার দম প্রায় ফুরিয়ে আসে। আমি ৯৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিসনের নন্ কমিশন্ড অফিসার ছিলাম। আমার কাজ ছিল যুদ্ধে যত লোক নিহত বা নিরুদ্দেশ হয়, তারা মিত্র বা শত্রুপক্ষের যার লোকই তোক তাদের তালিকা তৈরি করা। আমার কাজ ছিল যে–সব মৃতদেহ তাড়াহুড়োয় অগভীর মাটিতে কবর দেওয়া দুশ্চিন্তামুক্ত নতুন জীবন হয়েছিল সেগুলো উঠিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পাঠিয়ে দিতে হত। আমার সব সময় চিন্তা আর ভয় হত বোধহয় মারাত্মক ভুল করছি। আমার দুশ্চিন্তা ছিল সব কাজ সম্পন্ন করতে পারব কি না। আমার ভাবনা হত আমার ষোল মাসের ছেলে–যাকে আমি এখনও দেখিনি তাকে কোলে নিতে পারব কি না। আমার এতই দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তি আসে যে প্রায় চৌত্রিশ পাউন্ড ওজন কমে যায়। আমি পাগলের মতো হয়ে যই, হাত–পা লক্ষ্য করে দেখলাম সেগুলো হাড় আর চামড়া সর্বস্ব। ভাঙা শরীরে বাড়ি ফেরার কথা ভাবলে আতঙ্ক হত ভেঙে পড়ে শিশুর মতই কাঁদতাম। বালজের যুদ্ধের পড় এমন কাঁদলাম যে মনে হল আর স্বাভাবিক হতে পারব না।
শেষপর্যন্ত আশ্রয় পেলাম এক সামরিক ডিসপেনসারিতে। একজন সামরিক ডাক্তার আমায় যে উপদেশ দিলেন তাতেই আমার জীবনে দারুণ পরিবর্তন হল। আমাকে যত্ন করে পরীক্ষার পর তিনি বললেন আমারসব রোগই মানসিক। তিনি এবার বললেন, টেড, আমি চাই জীবনটাকে বালিঘড়ি বলে মনে কর। তুমি জানো বালিঘড়িতে হাজার হাজার বালুকণা থাকে, তারা ধীরে ধীরে যন্ত্রটার ভিতরের ছোট্ট ফুটো দিয়ে পড়তে থাকে। যন্ত্রটা না ভেঙে আমরা একসঙ্গে বেশি বালি ঢোকাতে পারি না। তুমি বা আমি সকলেই ওই বালি ঘড়ির মত। সকালে আমরা কাজ শুরু করার সময় শত শত কাজ থাকে, সে সব একে একে না করে একসঙ্গে করতে গেলে বালি ঘড়ির মতই অবস্থা হবে, তাতে আমাদের শরীর মন ভেঙে পড়বে।
আমি তখন থেকেই সেই স্মরণীয় দিন থেকে, যেদিন একজন সামরিক ডাক্তার আমায় উপদেশ দেন আমি ওই কথা মেনে চলেছি এক সময় এককণা বালি…। যুদ্ধের সময় ওই পরামর্শ আমার শরীর আর মনকে রক্ষা করেছে, আর আজ আমি যে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ডাইরেক্টর সেখানেও সেই উপদেশ আমায় সাহায্য করে চলেছে। এখানেও সেই এক সমস্যা যা যুদ্ধে দেখেছি–অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হবে–আর তা করার সময় কত কম। কত সমস্যা ছিল–স্টক কম, ঠিকানা বদল, অফিস খোলা আর বন্ধ করা, ইত্যাদি। ‘এক সময় এককণা বালি’ ডাক্তার আমায় যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাই আমার কাজে লাগল। বারবার কথাটা স্মরণ করে আমি মানসিক জটিলতা থেকে মুক্ত হয়েছিলাম।
আমাদের বর্তমান জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, আমাদের হাসপাতালের প্রায় অর্ধেক বেড়ই মানসিক আর স্নায়বিক রোগীতে পূর্ণ, যারা অতীত আর আগামীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে ভেঙে পড়ে। অথচ তাদের অনেকেই আজ আনন্দে জীবন কাটাতে পারতেন যদি শুধু তারা যীশুর সেই কথা : আগামীকালের জন্য দুশ্চিন্তা কর না অথবা স্যার উইলিয়াম অসলারের সেই কথা, ‘রোজকার জীবন যাপন কর’ এই কথাগুলো যদি মনে রাখতেন।
আপনি বা আমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি দুই অসীমের সন্ধিক্ষণে–যে বিশাল অতীত চিরকাল রয়ে গেছে আর যে আগামী ভবিষ্যৎ চিরকাল থাকবে। আমরা এ দুই কালের কোনটাতেই সম্ভবত থাকতে পারি না–না, এক মুহূর্তও না। এরকমভাবে থাকতে গেলে আমাদের শরীর আর মন শেষ হয়ে যাবে। তাই যা থাকা সম্ভব তাই থাকি আসুন–এখন থেকে ঘুমোনোর সময় পর্যন্ত। রবার্ট লুই স্টিভেনসন বলেছেন, যত কঠিন ভারই হোক মানুষ রাত অবধি তার বোঝা বইতে পারে। যে–কোনো লোকই যত কঠিন হোক তার কাজ করতে পারে একদিনের জন্য। যে কোন মানুষ আনন্দে, ধৈর্য নিয়ে, সুন্দরভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর জীবনের অর্থই তাই।
হ্যাঁ, জীবনে এর বেশি আর কিই বা প্রয়োজন। তবে মিচিগানের মিসেস ই.কে. শিল্ডস হতাশায় প্রায় আত্মহত্যাই করে বসেছিলেন যতদিন না তিনিও ঘুমনো পর্যন্ত বেঁচে থাকার কৌশল আয়ত্ব করেন। মিসেস শিল্ডস আমায় বলেন, ১৯৩৭ সালে আমার স্বামী মারা যান। আমি হতাশায় ভেঙে পড়ি–একেবারে কপর্দক শূন্য ছিলাম আমি। আমার পূর্বতন নিযোগকর্তা মি. লিও রোচকে লিখে পুরনো কাজটা ফিরে পাই। আগে শহরে আর গ্রামের স্কুলে ওয়ার্লড বুকস এর বই বিক্রি করতাম। স্বামীর সুখের সময় দুবছর আগে আমার গাড়িটা বেচে দিই, সামান্য টাকা জমিয়ে একটা পুরনো গাড়ি কিনে বই বিক্রি শুরু করলাম।
ভেবেছিলাম রাস্তায় বের হলে আমার হতাশা কাটবে। কিন্তু একাকী গাড়ি চালিয়ে আর একা একা খেতে গিয়ে আমার অসহ্যবোধ হল। কোথাও কিছুই বিক্রি হত না, গাড়ির কিস্তির টাকা কম হলেও তা শোধ দিতে পারিনি।
১৯৩৮ সালের বসন্তকালে মিসৌরির ভার্সাইতে আমি কাজ করছিলাম। স্কুলগুলো বড় গরিব ছিল, আমিও একাকীবোধ করতাম, রাস্তাও বড় খারাপ। হতাশায় প্রায় আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিলাম। সাফল্য অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সবেতেই আমার ভয় ছিল, ভাবছিলাম গাড়ির টাকা দিতে পারব না, ঘরের ভাড়া হবে, খাওয়া জুটবে না, ডাক্তারের পয়সাও ছিল না। আত্মহত্যায় প্রয়াসী হই নি আমার বোন কষ্ট পাবে বলে আর অন্ত্যেষ্টির জন্য এক কপর্দকও ছিল না বলে।
তারপর একটা প্রবন্ধ পড়ার পরই আমি হতাশা ভুলে বাঁচার সাহস পেলাম। প্রবন্ধের একটা কথার জন্য আমি চিরঋণী হয়ে রইলাম। কথাটি এই : বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই নতুন জীবন। কথাটি টাইপ করে আমার গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে রাখলাম, গাড়ি চালানোর প্রতি মুহূর্তেই তা নজরে পড়ত। আমি রাখলাম, গাড়ি চালানোর প্রতি মুহূর্তেই তা নজরে পড়ত। আমি দেখলাম প্রতিদিন বেঁচে থাকা কঠিন নয়। আমি গতকাল আর আগামীকালের কথা ভুলে গিয়ে তার কৌশল আয়ত্ব করলাম। প্রতিদিন সকালে নিজেকে বলতাম, আজ এক নতুন জীবন।
আমি একাকীত্বের আর অভাবের ভয় কাটিয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। আজ আমি সুখী আর বেশ সফল, জীবন সম্পর্কে আমার নতুন আগ্রহ জেগেছে। আমি জানি আর কখনই আমি ভয় পাবো না, জীবনে যে সমস্যাই আসুক না কেন। আমি জানি ভবিষ্যৎকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই–আমি জানি আমি এখন প্রতিদিনের জন্য বাঁচতে পারি–আর প্রতিটি দিনই জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে এক নতুন জীবন।
নিচের কবিতাটি কার লেখা বলতে পারেন?
সেই
মানুষই সবার চেয়ে সুখী,
যিনি আজকের দিনকে নিজের বলতে পারেন,
তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি
বলেন :
আগামীর বিপদকে ভয় করি না কারণ আমি আজ বেঁচেছি।
কবিতাটি আধুনিক মনে হচ্ছে? তবুও বলি এই কবিতা যীশুর জন্মেরও ত্রিশ বছর আগে লিখেছিলেন রোমান কবি হোরেস।
মানবচরিত্র সম্পর্কে আমার সবচেয়ে দুঃখজনক যে কথা জানা আছে তাহল আমরা সকলেই জীবনযুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাই। আমরা সবাই দিগন্তপারের কোন মায়া গোলাপের স্বপ্নে আচ্ছন্ন। কিন্তু জানালার পাশে যে অসংখ্য গোলাপ ফুটে রয়েছে তা আমরা দেখি না।
আমরা এরকম বোকামির কাজ করি কেন?
স্টিফেন লিকক লিখেছিলেন, আমাদের জীবনের ছোট্ট শোভাযাত্রা কী অদ্ভুত! শিশু ভাবে আমি যখন বড় হব। কিন্তু বড় হবার পর সে বলে আমি যখন আরও বড় হব। বড় হয়ে সে বলে, যখন আমি বিয়ে করব। কিন্তু বিয়ে করার পর কী হল? চিন্তাটা দাঁড়াল আমি যখন অবসর নেব। কিন্তু অবসর নেবার পর সে পিছনে তাকালে দেখে অতীতের দৃশ্য–একটা শীতল পরশ যেন বয়ে যায়–সবই সে উপভোগে বঞ্চিত হয়েছে। আমরা ভুলে যাই এ জীবন উপভোগের জন্যই প্রতিদিন, প্রত্যেক মুহূর্ত তাকে উপভোগ করতে হয়।
ডেট্রয়টের প্রয়াত এডওয়ার্ড ই. ইভান্স দুশ্চিন্তায় প্রায় আত্মহত্যা করতে যান, কিন্তু যেদিন তিনি বুঝতে পারলেন বেঁচে থাকাতেই জীবনের আনন্দ প্রতিটি মুহূর্তে তখনই তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। দারিদ্রের মধ্যে তিনি মানুষ হন, অর্থ রোজগার করেন প্রথম সংবাদপত্র বিক্রি করে, এমনকি মুদির দোকানেও কাজ করেন। সাতজনের পরিবারে রুটি জোগানোর দায়িত্ব নিয়ে সহকারী গ্রন্থাগারিকের কাজ নেন। সামান্য মাইনে ছিল তার তবু কাজটা ভয়ে ছাড়তে পারতেন না। আট বছর কাটার পর তিনি সাহস সঞ্চয় করে নিজে কিছু করবার চেষ্টা করেন। তারপর ধার করে মাত্র পঞ্চান্ন ডলার ব্যবসায় লাগিয়ে তাকে করে তোলেন বিশাল–বছরে তার আয় হয় বিশ হাজার ডলার। কিন্তু তারপরেই কুয়াশায় সব আচ্ছন্ন হয়ে গেলধ্বংসের কুয়াশা। একবন্ধুকে অনেক টাকা ঋণ দিলেন সে দেউলিয়া হয়ে গেল। একটার পর একটা বিপদ নেমে এল এবার, তার সর্বস্ব নষ্ট হয়ে গেল। মোল হাজার ডলার দেনায় পড়ে গেলেন তিনি। তার স্নায় ভেঙে পড়ল। তিনি আমাকে বলেছিলেন; আমি ঘুমোতে পারতাম না, খেতে পারতাম না। অদ্ভুতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। দুশ্চিন্তা, শুধু দুশ্চিন্তাই আমায় অসুস্থ করে তোলে। একদিন পথে জ্ঞান হারালাম। হাঁটার ক্ষমতাও আমার ছিল না। শয্যাশায়ী হয়ে সারা দেহ ফোড়ায় ভরে গেল। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়লাম। আমার ডাক্তার জানালেন আর মাত্র দুসপ্তাহ বাঁচব। দারুণ আঘাত পেলাম। নিজের উইল তৈরি করলাম, তারপর চুপচাপ শুয়ে শুয়ে শেষের অপেক্ষায় পড়ে রইলাম। আর লড়াই–বা দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। মন হালকা করে ঘুমোলাম। আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টানা দুঘন্টাও ঘুমোই নি, আর এখন শিশুর মতো ঘুমোলাম। আমার সব ক্লান্তি কোথায় চলে গেল। খিদে হল, ওজনও বাড়তে লাগল।
কয়েক সপ্তাহ পরে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারলাম। ছয় সপ্তাহ পরে কাজে যোগ দিতে পারলাম। বছরে বিশ হাজার ডলার আয় করেছিলাম, আর এখন যে সপ্তাহে ত্রিশ ডলার পেলাম তাতেই আমি খুশি। কাঠের টুকরো বিক্রি করাই আমার কাজ ছিলো। তবু আমি একটা শিক্ষা পেয়েছি–আর দুশ্চিন্তা নয়, অতীত নিয়ে ভাবনা নয়–যা গেছে তার জন্য দুঃখ একেবারে নয়। ভবিষ্যত নিয়েও কোন আতঙ্ক নয়। আমার সমস্ত শক্তি আর আগ্রহ দিয়ে কাঠের টুকরো বিক্রির কাজ করে চলোম।
এবার এডওয়ার্ড ইভান্স দ্রুত উন্নতি করলেন। কয়েক বছরেই তিনি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন ইভান্স প্রোডাক্টস কোম্পানি। কোনোদিন গ্রিনল্যান্ডে গেলে আপনি হয়তো ইভান্স ফিল্ডেই নামবেন–ঐ বিমান ক্ষেত্রটি তারই সম্মানে নামাঙ্কিত। এডওয়ার্ড ইভান্স এই সম্মান হয়তো পেতেন না যদি তিনি রোজকার জীবন যাপন করতেন।
হোয়াইট কুইন কি বলেছিলেন হয়তো জানেন আপনারা : গতকাল আর আগামীকালের রুটিতে মিষ্টি মাখান, কখনই আজকের রুটিতে নয়। আমরাও বেশিরভাগ এই রকম গতকাল আর আগামীকালের রুটিতে মিষ্টি মাখানোর কথা চিন্তা করি অথচ আজকের রুটিতে পুরু করে তা মাখাতে ভুলে যাই।
বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মন্তেইনও এই ভুল করেন। তিনি বলেছিলেন; আমার জীবনে সাংঘাতিক সব দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে পূর্ণ, যার বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটেনি। ঠিক সেইরকম আপনার আর আমারও তাই।
দান্তে বলেছিলেন, ভেবে দেখ, আজকের দিন আর আসবে না। জীবন দ্রুত এগিয়ে চলেছে অসম্ভব গতিতে, প্রতি সেকেন্ডে প্রায় উনিশ মাইল । আজ তাই আমাদের অশেষ মূল্যবান সম্পত্তি, এটাই আমাদের একমাত্র নিশ্চিত সম্পদ।
লাওয়েল টমাসের দর্শনও তাই। সম্প্রতি তার খামারে এক সপ্তাহ কাটিয়েছি। তার বেতার স্টুডিওতে বাইবেলের এই উদ্ধৃতিটি লেখা ছিলো, যেটা তার সব সময় নজরে পড়ত :
আজকের এই দিনটি ঈশ্বরই তৈরি করেছেন, আনন্দোৎসবের মধ্যে দিয়ে আমরা এতেই সন্তুষ্ট থাকবো।
জন রাস্কিনের টেবিলে একখণ্ড পাথরে লেখা থাকত : আজকের দিনটি। যদিও আমার টেবিলে কোন পাথরের টুকরো নেই, তবে আয়নায় একটা কবিতা আঁটা আছে যেটা দাড়ি কামাতে গিয়ে রোজই পড়ি–যে কবিতাটি স্যার উইলিয়াম অসলারও তার ডেস্কে রেখে দেন–বিখ্যাত ভারতী কবি ও নাট্যকার কালিদাসের লেখা কবিতা। কবিতাটির মর্মার্থ এই রকম :
‘আজকের জীবনই সব কিছু, এতেই রয়েছে জীবনের পরিপূর্ণতা। কারণ গতকাল তো শুধু স্বপ্ন আর আগামীকাল সে তো কল্পনা, শুধু আজকের মধ্যেই রয়েছে বেঁচে থাকার আনন্দ। আজ ভালো করে বেঁচে থাকলেই গতকালই সুখস্বপ্ন হয়ে ওঠে আর আগামীকাল হয় আশায় ভরপুর। তাই আজকের দিনকেই সানন্দে গ্রহণ কর। এই হল প্রভাত বন্দনা’।
অতএব দুশ্চিন্তা সম্পর্কে যা জানবেন আর তাকে জীবন থেকে সরিয়ে রাখতে যা করবেন তা হলো এই: অতীত আর ভবিষ্যৎকে লোহার কপাটে আবদ্ধ করে রাখুন। শুধু রোজকার জীবন যাপন করুন।
নিচের প্রশ্নগুলো নিজেকে করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন কি?
১.
বর্তমানকে ছেড়ে কি ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই?
২. অতীতে যা হয়নি তা ভেবে কি অনুতাপ করি?
৩. সকালে উঠে কি চব্বিশটা ঘণ্টা কাটানোর কথাই ভাবি?
৪. আজকের জীবন কাটিয়ে কি
আনন্দ আহরণ করি?
৫. কাজটা কবে শুরু করব? আগামী সপ্তাহে
…কাল? …আজ?