৫১-৬০. কারের দে প্রভেনকা

অধ্যায় ৫১

কারের দে প্রভেনকা আর পাসিজ দে গ্রাসিয়ার এককোণে খাঁজকাটা পাথরের পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছে ১৯০৬ সালে নির্মিত কিছুটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন আর কিছুটা শিল্পকর্মতুল্য গওদির এই মাস্টারপিসটি, যা কাসা মিলা নামেই বেশি পরিচিত।

নয়তলার এই স্থাপনাটি খুব দ্রুতই চোখে পড়ে তার চুনাপাথরের সম্মুখভাগটির কারণে। এর ঢেউ খেলানো বেলকনিগুলো আর অসমান জ্যামিতিক গঠন ভবনটিকে অর্গানিক রূপ দান করেছে। যেন হাজার হাজার বছর ধরে ঝড়ো বাতাস এর খাঁজ আর ফাঁপা অংশগুলো যেমন সৃষ্টি করেছে তেমনি মরুভূমির গিরিখাদের মতো বেঁকিয়ে দিয়েছে।

যদিও গওদির এই শকিং মডার্নিস্ট ডিজাইন আশেপাশের মানুষজন প্রথম দেখায় এড়িয়ে যায়, তারপরও কাসা মিলাকে সারাবিশ্বের আর্ট ক্রিটিকরা প্রশংসা করে থাকে, খুব দ্রুতই এটু, বার্সেলোনার স্থাপত্যের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল মণি হয়ে ওঠে। পেরে মিলা নামের যে ব্যবসায়ি এটা বানিয়েছিল সে তিন দশক ধরে এখানকার সুবিশাল মেইন অ্যাপার্টমেন্টে তার স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করার পাশাপাশি ভবনের বাকি বিশটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিল। পাসিজ দে গ্রাসিয়ার ৯২ নম্বর এই বাড়িটিকে আজকের দিনে স্পেনের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং কাঙ্খিত ঠিকানা হিসেবে দেখা হয়।

বৃক্ষশোভিত স্বল্প যানবাহনের অভিজাত অ্যাভিনু দিয়ে টেসলা গাড়িটি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রবার্ট ল্যাংডন। প্যারিসের যেমন শ্যাম্প এলিসি প্রাসাদ, তেমনি বার্সেলোনা শহরের হলো পাসিজ দে গ্রাসিয়া-প্রশস্ত আর বিশাল বিশাল সব অ্যাভিনু, নিখুঁত ল্যান্ডস্কেপ আর সারি সারি ডিজাইনার বুটিক শপ।

শানেল…গুচ্চি…কার্তিয়ে…লংশ্যাম্প…

অবশেষে দুশো মিটার দূরে ল্যাংডন দেখতে পেলো সেটা।

নিচ থেকে নরম আলোয় আলোকিত কাসা মিলার ফ্যাকাশে চুনাপাথরের বহিরাবণটি, সামনের দিকে সামান্য বেরিয়ে আসা এর বেলকনিগুলো পাশের বেলকনি থেকে বিচ্ছিন্ন।

এই ভয়টাই পেয়েছিলাম আমি, সামনের অ্যাভিনুটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল অ্যাম্ৰা। দেখুন।

কাসা মিলার সামনে চওড়া ফুটপাতের দিকে তাকালো ল্যাংডন। আধ ডজনের মতো মিডিয়া ট্রাক ওখানে পার্ক করা আছে। একদল রিপোর্টার কিয়ার্শের আবাসস্থলটাকে ব্যাকড্রপ হিসেবে ব্যবহার করে লাইভ রিপোর্ট করে যাচ্ছে। বেশ কিছু সিকিউরিটি এজেন্ট লোকজনকে প্রবেশপথের সামনে থেকে সরিয়ে দেবার কাজে ব্যস্ত। মনে হচ্ছে এডমন্ডের মৃত্যু এখন নিছক আর মৃত্যু হিসেবে আর নেই, নতুন কিছুতে মোড় নিয়েছে।

পাসিজ দে গ্রসিয়ার দিকে ভালো করে তাকালো ল্যাংডন গাড়িটা পার্ক করার জায়গা খোঁজার জন্য। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখতে পেলো না।

নিচু হয়ে যান, তাড়া দিয়ে সে বলল অ্যাম্রাকে। বুঝতে পারছে এখন গাড়িটা চালিয়ে সরাসরি মিডিয়া ট্রাকগুলো অতিক্রম করে চলে যেতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

অ্যাম্ৰা নিচু হয়ে গাড়ির মেঝেতে বসে রইলো, পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার বাইরে। জনাকীর্ণ মোড়টা পেরিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন তার মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে রাখলো।

মনে হচ্ছে তারা ঢোকার পথটা ঘিরে রেখেছে, বলল সে। আমরা ভেতরে কোনভাবেই যেতে পারবো না।

ডানদিকে যান একটু, উইনস্টন উদয় হলো আবার। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস প্রকট। আমিও ভেবেছিলাম এমনটা ঘটবে।

*

ব্লগার হেক্টর মারকানো শোকাতুর দৃষ্টিতে কাসা মিলার টপ ফ্লোরটার দিকে মুখ তুলে তাকালো, এডমন্ড কিমার্শ যে সত্যি মারা গেছে সেটা এখনও মেনে নিতে পারছে না সে।

তিনবছর ধরে হেক্টর বার্সেলোনার এন্টারপ্রেনার আর উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করে তদের প্লাটফর্ম হিসেবে পরিচিত Barcinno.com-এর হয়ে টেকনোলজির উপরে রিপোর্টিং করে যাচ্ছে। মহান এডমন্ড কিয়ার্শের বার্সেলোনায় বসবাস করাটা যেন তার কাছে মনে হতো জিউসের পদতলে বসে কাজ করার মতোনই একটি ঘটনা।

তিনবছর আগে ফাঁকআপ নাইট নামে পরিচিত বারসিন্নোর মাসিক আয়োজনে বক্তব্য দেবার জন্য এই কিংবদন্তিতুল্য ফিউচারিস্ট যখন রাজি হয় তখনই তার সাথে হেক্টরের পরিচয় হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে সফল। উদ্যোক্তাদের নিয়ে আসা হয় তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার কথা খোলামেলাভাবে স্বীকার করার জন্য। কিয়াশ কিছুটা লজ্জার সাথেই স্বীকার করে নেয় যে, বিগত ছয় মাসে সে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে E-Wave নামের এমন একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর জন্য যার প্রসেসিং স্পিড এতটাই দ্রতগতিসম্পন্ন হবে যে, এরফলে বিজ্ঞান আর কম্পেক্স সিস্টেম মডেলিং-এর ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হবে।

বলতে বাধ্য হচ্ছি, এডমন্ড স্বীকার করেছিল, এ পর্যন্ত আমার কোয়ান্টাম কম্পিউটারের স্বপ্নটা পোতানো আতশবাজির মতোই ফুটুস করে নিভে গেছে।

আজ রাতে হেক্টর যখন শুনতে পেলো কিয়ার্শ একটি যুগান্তকারি, দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের ঘোষণা দেবে তখন সে দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করেছিল, ধরেই নিয়েছিল এটা অবশ্যই E-Wave কম্পিউটারের ঘোষণাই হবে। সে কি এমন কোন কিছু আবিষ্কার করেছে যার ফলে ওটা বানানো সম্ভব হবে? কিন্তু। কিয়ার্শের প্রারম্ভিক দার্শনিক বক্তব্য শোনার পর হেক্টর বুঝতে পেরেছিল তার আবিষ্কারটি আসলে অন্য কিছু নিয়ে।

আর কখনও সেটা জানা যাবে বলে মনে হয় না, হেক্টর ভাবলো। তার এতটাই কষ্ট হচ্ছিলো যে, কিয়ার্শের এই বাড়ির সামনে না এসে পারেনি। আজকে সে ব্লগ লেখার জন্য আসেনি, এসেছে অসাধারণ মানুষটিকে শ্রদ্ধা। জানাতে।

ই-ওয়েভ! কাছেই কেউ একজন চিৎকার করে বলল। ই-ওয়েভ!

হেক্টরের চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষজন তাদের ক্যামেরা তাক করলো কালো রঙের একটি টেসলা গাড়ির দিকে। ওটা এখন আস্তে আস্তে মানুষজনের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে প্লাজার দিকে আসছে তার হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বালিয়ে।

বিস্ময়ের সাথে সুপরিচিত গাড়িটার দিকে চেয়ে রইলো হেক্টর।

কিয়ার্শের টেসলা মডেল এক্সের লাইসেন্স প্লেটে ই-ওয়েভ লেখাটা বার্সেলোনা শহরে তোটাই সুপরিচিত যতোটা সুপরিচিত রোম শহরে পোপ মোবাইল। কিয়ার্শ প্রায়শই কারের দে প্রভেনকার দানিয়েল ভয়ার জুয়েলারি শপের বাইরে তার গাড়িটা পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে অটোগ্রাফ শিকারিদের সন্তুষ্ট করতো আর লোকজনকে রোমাঞ্চিত করার জন্য গাড়িটাকে নিজে নিজে পার্কিং করতে দিতো।

সেল্ফ-পার্ক করার ব্যবস্থা সব টেসলা ইলেক্ট্রিক গাড়িরই একটি স্ট্যান্ডার্ড ফিচার-কিন্তু এডমন্ড টেসলার সিস্টেমটা হ্যাক করে আরো জটিল আর বাড়তি কিছু সংযোজন করে নিয়েছিল। ফলে অনেক জটিল পথ দিয়েও তার গাড়িটা নিজে নিজে চলতে পারতো। তার বাড়িতে যখন গাড়িটা নিয়ে আসতো, তখন ওটা নিজে নিজেই গ্যারাজে চলে যেতো সব সময়।

এর সবটাই ছিল লোকজনকে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য।

আজ রাতের ঘটনাটি একটু অদ্ভুত। কিয়াৰ্শ মারা গেছে, তারপরও গাড়িটার আবির্ভাব ঘটেছে এখানে। কারের দে প্রভেনকা দিয়ে ফুটপাত ঘেষে ওটা এগিয়ে গিয়ে গ্যারাজের চমৎকার দরজার সামনে এসে থেমে গেল।

রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যানের দল ছুটে গেল গাড়িটার কাছে, গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো তারা।

গাড়িটা খালি! কেউ চালাচ্ছে না! এটা কোত্থেকে এলো?!

কাসা মিলার সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে দৃশ্যটা পরিচিত, তাই তারা লোকজনকে টেসলা গাড়ি থেকে সরিয়ে দিলো যাতে করে সেটা নিজে নিজে গ্যারাজে ঢুকে যেতে পারে।

এডমন্ডের খালি গাড়িটাকে আস্তে আস্তে গ্যারাজে ঢুকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো হেক্টরের ভেতর থেকে। যেন কোন প্রভুভক্ত কুকুর তার মালিকের মৃত্যুর পর শোকে মুহ্যমান হয়ে বাড়িতে ফিরে আসছে।

টেসলা গাড়িটা গ্যারাজের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় হুট করেই লোকজনের মধ্যে এক ধরণের আবেগের বহিপ্রকাশ ঘটে গেল যেন, এডমন্ডের প্রিয় গাড়িটার উদ্দেশে করতালি দিতে শুরু করলো তারা।

*

আমি জানতাম না আপনার এতটা ক্লসট্রোফোবিয়া আছে, ল্যাংডনের পাশে টেসলার ফ্লোরে শুয়ে থেকে বলল অ্যাম্ব্রা। তারা দুজনে গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে দ্বিতীয় আর তৃতীয় সিটের মাঝখানে স্বল্প পরিসরের জায়গাটাতে কালো রঙের ভিনাইল কাভারে নিচে। অ্যাম্ৰা এটা কার্গো এরিয়া থেকে নিয়ে নিয়েছিল। সেজন্যে হালকা কালচে রঙের জানালার কাঁচ দিয়ে তাদের উপস্থিতি একদমই টের পায়নি কেউ।

আমি মরবো না, নাভাস ভঙ্গিতেই মজা করে বলল ল্যাংডন। এমনিতেই তার ক্লসট্রোফোবিয়া আছে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে সেল্ফ-ড্রাইভিং গাড়ির ভীতিটা। সে টের পাচ্ছে গাড়িটা নিজে নিজে স্পাইরাল র‍্যাম্প দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। গাড়িটা ক্রাশ করে বসে কিনা সে ভয়ই পাচ্ছে প্রফেসর।

দুই মিনিট আগে, তারা যখন কারের দে প্রভেনকার দানিয়েল ভয়ার-এর জুয়েলারি শপের সামনে এসে পৌঁছালো, উইনস্টন তখন তাদেরকে একটা পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়।

গাড়ি থেকে অ্যাম্ব্রা আর ল্যাংডন বের না হয়ে পেছনের সিটে গিয়ে বসে, তারপর ফোনের একটামাত্র বোতাম চেপেই গাড়িটার সেল্ফ-পার্ক ফিচারটি অ্যাক্টিভেট করে দেয়।

অন্ধকারে ল্যাংডন টের পেয়েছিল গাড়িটা ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির ফ্লোরে স্বল্প পরিসরের জায়গায় অ্যাম্ব্রা আর সে গা ঘেষাঘেষি করে থাকার সময় টিন্যুনেজ বয়সে গাড়ির পেছনে এক সুন্দরি মেয়ের সাথে ডেটিং। করার কথাটা মনে না করে পারেনি সে। তখন আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম, ভেবেছিল ল্যাংডন, আর এখন স্পেনের হবু রাণীর সাথে ড্রাইভারবিহীন গাড়িতে এভাবে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকাটাকে নির্মম পরিহাসের বলেই মনে হয়েছে। তার কাছে।

ল্যাংডন টের পেলো র‍্যাম্পের শেষ মাথায় এসে কয়েকটা ছোটখাটো মোড় নিয়ে গাড়িটা থেমে গেল।

আপনারা এসে গেছেন, উইনস্টন বলল।

সঙ্গে সঙ্গে শরীরের উপর থেকে কাভারটা সরিয়ে সতর্কতার সাথে উঠে বসলো অ্যাম্ব্রা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো এবার। ক্লিয়ার, কথাটা বলেই নেমে গেল গাড়ি থেকে।

এরপর গাড়ি থেকে নেমে এলো ল্যাংডন। গ্যারাজের মুক্ত জায়গায় নিঃশ্বাস নিতে পেরে স্বস্তি বোধ করলো সে।

মেইন ফয়ারে এলিভেটরগুলো আছে, আঁকাবাঁকা ড্রাইভওয়ে র‍্যাম্পের দিকে ইঙ্গিত করলো বলল অ্যাম্ব্রা।

একেবারে অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে ল্যাংডনের চোখ আটকে গেল যেন। এখানে, এই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং গ্যারাজে এডমন্ডের গাড়িটা যেখানে পার্ক করা আছে সেখানকার সিমেন্টের দেয়ালে চমৎকার একটি সমুদ্রতটের ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং টাঙানো।

অ্যাম্ব্রা? বলল ল্যাংডন। এডমন্ড তার পার্কিং স্পটটা পেইন্টিং দিয়ে সাজিয়েছে?

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। আমিও তাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম। সে আমাকে বলেছে, এটা তাকে প্রতি রাতে বাড়িতে ফিরে আসার পর স্বাগত জানানোর নিজস্ব পদ্ধতি।

ল্যাংডন বাঁকাহাসি দিলো। ব্যাচেলর।

এই আর্টিস্ট এমন একজন যাকে এডমন্ড খুবই সম্মান করতো, বলল উইনস্টন। তার কণ্ঠটা এবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অ্যাম্ৰার হাতে থাকা কিয়ার্শের ফোন থেকে কথা বলছে। আপনি কি তাকে চিনতে পেরেছেন?

ল্যাংডন চিনতে পারলো না। পেইন্টিংটা দেখে মনে হচ্ছে ওয়াটার কালারে আঁকা চমৎকার একটি ছবি-এডমন্ডের আভা-গার্দে জাতীয় কিছু না।

এটা চার্চিলের, অ্যাম্ব্রা বলল। এডমন্ড সব সময়ই তার উক্তি ব্যবহার করতো।

চার্চিল। ল্যাংডনের কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল এটা বুঝতে যে, অ্যাম্ব্রা আসলে খ্যাতিমান সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, এক এবং অদ্বিতীয় উইনস্টন চার্চিলের কথা বলছে। একজন সৈনিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইতিহাসবিদ, সুবক্তা, নোবেল প্রাইজ বিজয়ি লেখক এবং সেইসাথে অসাধারণ একজন শিল্পী। ল্যাংডনের এবার মনে পড়ে গেল, যখন তাকে কেউ মন্তব্য করতে বলেছিল, ধর্মিয় লোকজন তাকে ঘৃণা করে তখন এডমন্ড বৃটিশ প্রধানমন্ত্রির একটি উক্তি ব্যবহার করে জবাব দিয়েছিল : তোমার শত্রু আছে? ভালো। তার মানে তুমি ভালো কোন কিছুর পক্ষে দাঁড়িয়েছে!

চার্চিলের বৈচিত্র্যপূর্ণ মেধাই এডমন্ডকে বেশি মুগ্ধ করেছিল, বলল উইনস্টন। মানুষের মধ্যে এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ মেধা আর বিশাল কর্মতৎপরতা খুব কমই দেখা যায়।

এজন্যেই এডমন্ড তোমার নাম রেখেছে উইনস্টন?

সেটাই, কম্পিউটার জবাব দিলো। এডমন্ডের তরফ থেকে এক ধরণের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

জিজ্ঞেস করেছি বলে আমি খুশি, ল্যাংডন ভাবলো। এর আগে ভেবেছিল উইনস্টন নামটা সম্ভবত ওয়াটসন নামটাকে ইঙ্গিত করেই রাখা-যে আইবিএম কম্পিউটারটি জিওপার্ডি নামের টেলিভিশনের একটি গেম শোয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল! সন্দেহ নেই, সেই ওয়াটসনকে এখন বিবেচনা করা হবে আদিম কিছু হিসেবে-এককোষি ব্যাক্টেরিয়া যেটা কিনা সিনথেটিক ইন্টেলিজেন্সে বিবর্তিত হয়ে গেছে।

ঠিক আছে, ল্যাংডন বলল এলিভেটরগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে। এবার তাহলে উপরে যাওয়া যাক, চেষ্টা করে দেখি যেটা খুঁজতে এসেছি সেটা পাই কিনা।

*

ঠিক এ সময় মাদ্রিদের আলমুদেনা ক্যাথেড্রালের অভ্যন্তরে কমান্ডার ডিয়েগো গারজা তার ফোনটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। প্রাসাদের পিআর কো-অর্ডিনেটর মনিকা মার্টিনের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য খবরটা শুনে যাচ্ছে সে।

ভালদেসপিনো আর যুবরাজ হুলিয়ান নিরাপদ কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে গেছেন?

তারা কী ভাবছে সেটা কল্পনা করতেও পারলো না গারজা।

তারা একজন যাজক-সহকারির গাড়িতে করে মাদ্রিদ শহরের কোথাও যাচ্ছে? এটা তো পাগলামি!

আমরা ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির সাথে যোগাযোগ করতে পারি, মনিকা বলল। সুরেশ বলেছে তারা ট্রাফিক ক্যামেরাগুলো ব্যবহার করে তাদেরকে ট্র্যাক করতে

না! সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলো গারজা। যুবরাজ যে সিকিউরিটি ছাড়া প্রাসাদের বাইরে গেছেন এটা কাউকে জানানোটা মারাত্মক বিপজ্জনক কাজ। হয়ে যাবে! মনে রাখতে হবে, তার নিরাপত্তাই আমাদের প্রথম চিন্তা।

বুঝতে পেরেছি, স্যার, মার্টিন বলল। মনে হলো হঠাৎ করেই সে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। আরেকটা বিষয় আছে আপনার জানা দরকার। এটা মিসিং ফোন রেকর্ড সংক্রান্ত।

দাঁড়াও, চারজন গার্ডিয়া এজেন্ট চলে এসেছে দেখে বলল গারজা। তারা তাকে রহস্যময় ভঙ্গিতে চারপাশ থেকে ঘিরে দাঁড়ালো। গারজা কোন কিছু। করার আগেই তার এজেন্টরা দক্ষতার সাথে তার কাছ থেকে অস্ত্র আর ফোনটা নিয়ে নিলো।

কমান্ডার গারজা, এজেন্টদের নেতা চোখমুখ শক্ত করে বলল, আমাকে সরাসরি অর্ডার দেয়া হয়েছে আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য।

.

ধ্যায় ৫২

কাসা মিলা নির্মাণ করা হয়েছে অনেকটা ইনফিনিটি সাইন-এর আদলে। একটা অবিরাম বাঁক ঘুরে এসে পুণরায় মিলে গেছে, যেন মিশে গেছে দুটো খাড়া মুখ। প্রতিটি খোলা-মুখের বাতির কুয়োগুলো প্রায় একশ ফিট গভীর। উপর থেকে দেখলে এ দুটোকে ভবনের ছাদে বিশাল বড় দুটো সিঙ্কহোলের মতোই লাগে।

ল্যাংডন এখন দাঁড়িয়ে আছে সঙ্কীর্ণ বাতির কূপটার নিচে, উপরের দিকে তাকালে কেমন উদ্বগজনক অনুভূতি হয় বিশাল কোন প্রাণীর মুখগহ্বরের ভেতরে ঢুকে পড়ার মতো।

পায়ের নিচে যে মেঝেটা আছে সেটা পাথরে তৈরি, কিছুটা ঢালু আর অসমান। একটা পেঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের শ্যাফটের দিকে, ওটার রেলিংয়ে যে রট আয়রনের নক্সাটা আছে তা যেন মনে করিয়ে দেয় সামুদ্রিক স্পঞ্জের কথা। একগুচ্ছ লতা-গুল্ম রেলিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে রাখা আছে।

জীবন্ত স্থাপত্য, ল্যাংডন ভাবলো। জৈব গুণাগুণ সমৃদ্ধ কাজের সক্ষমতা ছিল গদির।

ল্যাংডনের চোখ আবারো উপরের দিকে চলে গেল, খোদাই করা বাদামি রঙের দেয়াল আর সবুজ রঙের টাইলগুলো একে অন্যের সাথে মিশে এক ধরণের ফ্রেসকোর সৃষ্টি করেছে। যেখানে ফুটে উঠেছে লতা-গুল্ম আর ফুলের ছবি।

এলিভেটরগুলো এখানে, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্ৰা। তাকে নিয়ে গেল সেখানে। এডমন্ডের অ্যাপার্টমেন্টটা একেবারে উপরে।

ছোটখাটো এলিভেটরের ভেতরে ঢুকতেই ভবনটির টপ-ফ্লোরের খোলা মুখটার ছবি ভেসে উঠলো ল্যাংডনের মনের পর্দায়। একবার সে ওখানে গিয়েছিল গদির এক্সিবিট হাউজটা দেখতে। তার যতোটুকু মনে পড়ে কাসা মিলার চিলেকোঠাটি বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, সর্পিলাকৃতির একসারি জানালাবিহীন ঘর।

এডমন্ড এই ভবনের যেকোন জায়গাতেই বাস করতে পারতো, এলিভেটরটা উপরে উঠতে শুরু করলে বলল ল্যাংডন। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, সে চিলেকোঠাটা লিজ নিয়েছে।

ওটা অদ্ভুত একটা অ্যাপার্টমেন্ট, একমত পোষণ করে বলল অ্যাম্ব্রা ভিদাল। আপনি তো জানেনই, এডমন্ড ছিল একটু অদ্ভুত স্বভাবের।

এলিভেটরটা টপ-ফ্লোরে পৌঁছাতেই তারা বের হয়ে এলো, পা রাখলো অভিজাত একটি হলওয়েতে, সেখান থেকে আরেকটা পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ভবনের একেবারে উপরে, একটি প্রাইভেট ল্যান্ডিংয়ের দিকে।

এটাই, কালো চকচকে লোহার একটি দরজা দেখিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা। দরজাটার কোন নব কিংবা কিহোল, কিছুই নেই। এই ফিউচারিস্টিক প্রবেশদ্বারটি এরকম একটি ভবনে একেবারে বেমানান লাগছে। বোঝাই যাচ্ছে, এটা এডমন্ড নিজে যোগ করেছে।

আপনি বলেছিলেন সে কোথায় তার চাবিটা লুকিয়ে রাখে সেটা আপনি জানেন? জানতে চাইলো ল্যাংডন।

এডমন্ডের ফোনটা তুলে ধরলো অ্যাম্ব্রা। একটু আগেই বলেছিলাম…ভুলে গেছেন হয়তো।

প্রফেসর কাঁধ তুলল শুধু। কথা সত্যি।

মনে হয় এখানেই সে সব কিছু লুকিয়ে রাখে।

ফোনটা সে মেটাল দরজার সাথে চেপে ধরলে পর পর তিনবার বিপ্ হবার শব্দ হলো। এরপরই ডেডবোল্টগুলো একে একে খুলে যেতে শুরু করলে সেই আওয়াজটা শুনতে পেলো ল্যাংডন। ফোনটা পকেটে রেখে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল অ্যাম্ব্রা।

আগে আপনি ঢুকুন, বলল সে।

ভেতরের মৃদু আলোর একটি ফয়ারে পা রাখলো ল্যাংডন, এখানকার দেয়াল আর ছাদ সাদা ইট দিয়ে তৈরি। মেঝেটা পাথরের, ভেতরের বাতাস বেশ হাল্কা।

সামনের অংশ থেকে আরেকটু ভেতরে যেতেই বিশাল একটি ঘর দেখতে পেলো সে। সেই ঘরের শেষমাথায় যে দেয়ালটা আছে সেখানে টাঙানো রয়েছে বিশাল একটি পেইন্টিং, নিখুঁতভাবেই কতোগুলো পিন লাইট দিয়ে সেটা

আলোকিত করা, অনেকটা জাদুঘরে যেরকমটি দেখা যায়।

ছবিটা দেখামাত্রই ল্যাংডন বরফের মতো জমে গেল এক জায়গায়। হায়। ঈশ্বর, এটা…অরিজিনালটাই?

হাসলো অ্যাম্ব্রা। হ্যাঁ, এটার কথা প্লেনেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভেবে দেখলাম এটা সারপ্রাইজ হিসেবেই থাকুক।

বাকরুদ্ধ হয়ে ল্যাংডন মাস্টারপিসটার দিকে এগিয়ে গেল। দৈর্ঘ্যে বারো ফিট আর উচ্চতায় চার ফিটের মতো হবে পেইন্টিংটা-অনেক আগে বোস্টন মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস-এ এটা যেরকম দেখেছিল এখন তার চাইতে বেশি বড় লাগছে তার কাছে। আমি শুনেছিলাম এটা নাকি নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা যে এডমন্ড হতে পারে আমার কোন ধারণাই ছিল না!

এটা যখন আমি এই অ্যাপার্টমেন্টে প্রথম দেখি, অ্যাম্ব্রা বলল, আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না এরকম আর্টের প্রতি এডমন্ডের আগ্রহ আছে। কিন্তু এখন আমি জানি এই বছর সে কী নিয়ে কাজ করছিল, পেইন্টিংটা মনে হচ্ছে অদ্ভুতভাবেই তার কাজের সাথে খাপ খেয়ে যায়।

অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে সায় দিলো ল্যাংডন।

এই বিখ্যাত মাস্টারপিসটি ফরাসি পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী পল গগ্যার সিগনেচার ওয়ার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম-যুগান্তকারি একজন পেইন্টার, যিনি আঠারো শতকের সিম্বলিস্ট আন্দোলনের অন্যতম একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। পরবর্তিকালে তিনি আধুনিক আর্টের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

পেইন্টিংটার কাছে যেতেই ল্যাংডনের মনে হলো, গগ্যার তুলির আঁচড়ের সাথে কাসা মিলার প্রবেশপথের কতোটাই না মিল রয়েছে-অরগানিক সবুজ, বাদামি আর নীলের মিশ্রণ-এই ছবিটাও প্রকৃতিকেই ফুটিয়ে তুলেছে।

ছবিতে কতোগুলো মানুষ আর পশুপাখি থাকা সত্ত্বেও ল্যাংডনের চোখ গেল উপরের বামদিকের এককোণে-এক পোচ উজ্জ্বল হলুদ রঙের মধ্যে ছবিটার। নাম লেখা আছে।

অবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো পড়লো সে : Dot Venons Nous /Que Sommes Nous / Où Allons Nous i

কোথা হতে এসেছি আমরা? আমরা কী? কোথায় আমরা যাচ্ছি?

ল্যাংডন ভাবলো, প্রতিদিন নিজের ঘরে ফিরে এসে এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখিন হতো এডমন্ড, সুতরাং এর জবাব খুঁজে পেতে ছবিটা যে তাকে উৎসাহি করে তুলেছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

অ্যাম্ৰাও ল্যাংডনের পাশে এসে দাঁড়ালো। এডমন্ড আমাকে বলেছিল, যখনই সে এই ঘরে ঢুকতো সে চাইতো এই প্রশ্নগুলো তাকে উদ্দীপ্ত করুক।

এই ঘরে ঢুকলে এই জিনিস চোখে না পড়ে উপায় নেই, ভাবলো ল্যাংডন।

এডমন্ড এই মাস্টারপিসটাকে এমন দৃষ্টিগ্রাহ্য করে রেখেছে দেখে ল্যাংডন ভাবলো, হয়তো এই পেইন্টিংটার মধ্যেই এমন কোন কু আছে যেটা দিয়ে এডমন্ডের আবিষ্কারটির সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রথম দর্শনে পেইন্টিংটার বিষয়বস্তু মনে হতে পারে এতটাই আদিম যে, অগ্রসর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কোন ইঙ্গিত এতে পাওয়া যাবে না। ছবিটাতে দেখানো হয়েছে তাহিতি দ্বীপের আদিবাসি আর পশুপাখিদের।

ল্যাংডন এই পেইন্টিংটা সম্পর্কে ভালো ধারণাই রাখে, যতোটুকু সে মনে করতে পারে, গ্যার উদ্দেশ্য ছিল এই কাজটা যেন পড়া হয় ডান থেকে বামদিকে-ফরাসি লেখা শুরু হয় ঠিক এর বিপরীত দিক থেকে। সেজন্যে ল্যাংডনের চোখও ডানদিকের পরিচিত ফিগারগুলোর দিকে চলে গেল।

একেবারে ডানদিকে সদ্যোজাত এক শিশু শুয়ে আছে পাথরের চাতালের উপরে। জীবনের সূচনাকে বোঝায় এটা। কোথা হতে এসেছি আমরা?

মাঝখানে, বিভিন্ন বয়সের মানুষজন তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত আছে। আমরা কী?

আর বামদিকে, জরাগ্রস্ত এক বৃদ্ধ মহিলা একা বসে আছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। মনে হচ্ছে নিজের নশ্বর জীবনটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি। আমরা?

ল্যাংডন একটু অবাকই হলো, সে যখন প্রথমবার এডমন্ডের মুখে এ কথাটা শুনেছিল তখন কেন এই পেইন্টিংটার কথা তার মনে পড়েনি। আমাদের উৎপত্তি কি? আমাদের নিয়তি কি?

ছবিটার অন্যসব জিনিসের দিকে এবার নজর দিলো ল্যাংডন-বেশ কিছু কুকুর, বিড়াল আর পাখি, দেখে মনে হতে পারে তারা নির্দিষ্ট কিছুই করছে না; ব্যাকগ্রাউন্ডে আদিম মানুষের এক দেবির মূর্তি; একটা পাহাড়, শেকড়-বাকড় আর গাছ। আর অবশ্যই গর্গার বিখ্যাত অদ্ভুত সাদা পাখি, ওটা বসে আছে। বৃদ্ধ মহিলার পাশেই, শিল্পীর মতে এটা প্রতিনিধিত্ব করে শব্দের নিরর্থকতাকে।

নিরর্থক হোক আর যাই হোক, ভাবলো ল্যাংডন, আমরা এখানে শব্দ খুঁজতেই এসেছি। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সাতচল্লিশটি মূল্যবান অক্ষর।

কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, পেইন্টিংটার অপ্রচলিত নামই কি সরাসরি সাতচল্লিশটি অক্ষরের সেই পাসওয়ার্ডকে নির্দেশ করে কিনা। কিন্তু ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় দ্রুত হিসেব করে সে দেখলো এতে কোন কাজ হবে না।

ঠিক আছে, আমরা কবিতার লাইন খুঁজছি, আশাবাদি হয়ে বলল ল্যাংডন।

এডমন্ডের লাইব্রেরিটা এদিকে, অ্যাম্ব্রা তাকে বলল, তার বামদিকে চওড়া একটি করিডোর দেখালো সে। ল্যাংডন দেখতে পেলো সেখানে বেশ রুচিসম্মত আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গওদির আর্টিফেক্ট আর ডিসপ্লের কাছাকাছি।

এডমন্ড একটা জাদুঘরে থাকতো? এখনও ল্যাংডন এখানকার সবকিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে কখনও দেখেনি কাসা মিলার চিলেকোঠার মতো কোন জায়গায় মানুষজন বাস করে। জায়গাটা নির্মাণ করা হয়েছে পাথর আর ইট দিয়ে, এটা বিরামহীন একটি টানেল বিভিন্ন উচ্চতার ২৭০টি ডিম্বাকৃতির আর্চ, একটার সাথে আরেকটার দূরত্ব এক গজের মতো হবে। খুবই অল্প কিছু জানালা রয়েছে, আর এখানকার বাতাস যেমন শুকনো তেমনি বিশুদ্ধ। বোঝাই যাচ্ছে সেগুলো বেশ ভালোমতোই প্রসেস করা হয়েছে গওদির আর্টিফেক্টগুলো। সুরক্ষিত রাখার জন্য।

আমি একটু আসছি, ল্যাংডন বলল। প্রথমে আমাকে এডমন্ডের রেস্ট রুমটা খুঁজে বের করতে হবে।

অ্যাম্ৰা অদ্ভুতভাবেই মেইন দরজার দিকে তাকালো। এডমন্ড আমাকে সব সময়ই নিচের লবিটা ব্যবহার করতে বলতো…তার অ্যাপার্টমেন্টের প্রাইভেট বাথরুমের ব্যাপারে সে রহস্যজনকভাবেই খুব। প্রটেক্টিভ ছিল।

এটা একজন ব্যাচেলরের ডেরা-তার বাথরুমটা সম্ভবত অপরিষ্কার, সে হয়তো এটা নিয়ে বিব্রত ছিল।

হেসে ফেলল অ্যাম্ৰা। আমার মনে হয় ওটা এদিকে, এবার সে লাইব্রেরির বিপরীত দিকটা দেখালো। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি টানেল দিয়ে যেতে হবে সেখানে।

ধন্যবাদ। আমি একটু পরই আসছি।

এডমন্ডের অফিসের দিকে পা বাড়ালো অ্যাম্ব্রা, আর ল্যাংডন গেল ঠিক বিপরীত দিকে, ইটের তৈরি খিলানযুক্ত পথের একটি সঙ্কীর্ণ করিডোর দিয়ে। এটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো মধ্যযুগের ভূগভৰ্ছ ক্যাটাকম্বগুলোর কথা। যে টানেলটা দিয়ে সে এখন যাচ্ছে তার নিচে, প্রতিটা খিলানের গোড়ায় মোশন সেন্সর নরম আলোর বাতি জায়গাটাকে আলোকিত করে রাখছে।

অভিজাত আর মার্জিত রিডিং এরিয়া, ব্যায়াম করার জায়গা, এমনকি খাবার-দাবার রাখার জন্য ছোটখাটো একটি প্যান্ট্রিও অতিক্রম করে গেল ল্যাংডন। এগুলোর পাশাপাশি রয়েছে কিছু টেবিল, সেখানে গওদির বিভিন্ন ধরণের ড্রইং, স্থাপত্যিক স্কেচ আর তার প্রজেক্টের থ্রি-ডি মডেলগুলো রাখা।

বায়োলজ্যিকাল আর্টিফেক্টের একটি আলোকিত টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু থমকে দাঁড়ালো ল্যাংডন, ওখানকার জিনিসগুলো দেখে অবাকই হলো সে-প্রাগৈতিহাসিক যুগের মাছের একটি ফসিল, চমৎকার সুন্দর একটি শামুকের খোলস, আর সাপের একটি আঁকাবাঁকা কঙ্কাল। যেতে যেতেই ল্যাংডনের মনে হলো, নিশ্চয় এডমন্ড এসব জিনিস ডিহপ্লে করার জন্য এখানে এনে রেখেছে-সম্ভবত তার জীবনের উৎপত্তি নিয়ে স্টাডির সাথে সম্পর্কিত বলে। এরপরই একটা কেসের উপরে যে পাদটীকা দেয়া আছে সেটা তার চোখে পড়লো। বুঝতে পারলো এইসব আর্টিফেক্টগুলো গওদির নিজেরই আর সেগুলো এই বাড়িটার বিভিন্ন ফিচারগুলোকেই প্রতিনিধিত্ব করছে : মাছের স্কেলটা দেয়ালের টাইলগুলোর প্যাটার্ন, শামুকটা গ্যারাজের বাঁকানো সিঁড়ি, আর সাপের কঙ্কালটা এখানকার আঁকাবাঁকা হলওয়েগুলোকেই নির্দেশ করছে।

ডিসপ্লেতে স্বয়ং স্থপতির একটি বিনয়ি কথা লেখা আছে :

কোন কিছুই উদ্ভাবন করা যায় না, সেগুলো আসলে প্রকৃতিতে আগে থেকেই থাকে। মৌলিকত্ব মানে উৎসের কাছে ফিরে যাওয়া।– আন্তোনিও গওদি

ল্যাংডন আবারো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া করিডোরটির দিকে তাকালো, আরেকবার মনে হলো সে বুঝি কোন জীবন্ত প্রাণীর ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে।

এডমন্ডের জন্য একদম পারফেক্ট একটি বাসা, ভাবলো সে। বিজ্ঞান থেকে অনুপ্রাণিত শিল্প।

সাপের মতো টানেলটার প্রথম বাঁক নিলো প্রফেসর ল্যাংডন, প্রশস্ত জায়গাটাকে মোশন-অ্যাক্টিভেটেড বাতিগুলো আলোকিত করে রেখেছে। হলের মাঝখানে বিশাল বড় একটি কাঁচের ডিসপ্লের দিকে তার চোখ গেল।

একটি ক্যাটানারি মডেল, ভাবলো সে। গদির এইসব মেধাবি প্রটোটাইপগুলো দেখলে সব সময়ই ল্যাংডন বিস্মিত হয়। ক্যাটানারি একটি আর্কিটেকচেরাল টার্ম, এটা দিয়ে বোঝানো হয় দুপ্রান্ত আটকে কোন তার ঝুলিয়ে দিলে যে আকৃতি তৈরি সেটাকে অনেকটা হ্যামোকের মতো।

ল্যাংডনের সামনে যে ক্যাটারি মডেলটি রাখা আছে, সেই কেসের ঠিক উপর থেকে ঝুলে আছে কিছু শেকলের মতো জিনিসওগুলো দৈর্ঘ আর আটকে থাকা দুই প্রান্তের দূরত্ব শেকলগুলোকে ইংরেজি ইউ অক্ষরের আকৃতি দান করেছে মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে।

গওদি নিশ্চয় এটা দেখেছিলেন, শেকলগুলো যখন এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয় তখন সেগুলো নিজের ওজনের কারণেই এমন আকৃতির সৃষ্টি করে। তিনি সেটাকে তার স্থাপত্যে অবশ্য উল্টো করে ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে এখানে। তাহলে এটারও একটা প্রতিচ্ছবি থাকার কথা।

কিন্তু সেটা করতে হলে একটা ম্যাজিক আয়না লাগবে, ভাবলো ল্যাংডন। কেস থেকে একটু সরে আসতেই যেমনটা সে ভেবেছিল তা-ই দেখতে পেলো। মেঝেটাই আয়না। প্রতিফলনটার দিকে তাকিয়ে ম্যাজিক্যাল ইফেক্টটা দেখতে পেলো সে। পুরো মডেলটি উল্টো হয়ে আছে-ঝুলন্ত লুপগুলো হয়ে উঠেছে। খাড়া স্পায়ার।

এবার ল্যাংডন বুঝতে পারলো সে আসলে দেখতে পাচ্ছে আকাশ থেকে দেখলে গওদির অমর সৃষ্টি ব্যাসিলিকা দে লা সাগ্রাদা ফামিলিয়াকে যেমনটা দেখা যায়, তার ঠিক উল্টো দৃশ্যটি। হয়তো এটা থেকেই ওরকম স্থাপত্য নক্সা করেছেন তিনি।

হল দিয়ে আরেকটু এগোতেই রাজকীয় একটি ঘুমানোর জায়গা দেখতে পেলো প্রফসর। পুরনো আমলের, প্রায় অ্যান্টিকতুল্য চার-পোস্টের একটি পালঙ্ক, চেরি কাঠের একটি ওয়ার্ডরোব আর নক্সা করা ড্রয়ার। দেয়ালগুলো গওদির নক্সা আর স্কেচে সজ্জিত। এসব দেখে ল্যাংডনের মনে হলো জাদুঘরের কোন প্রদশনীর মতোই কোন কিছু।

এই ঘরে একমাত্র যে শিল্পকর্মটি আছে সেটা এডমন্ডের পালঙ্কের ঠিক উপরে একটি উক্তির বিশাল এক ক্যালিওগ্রাফি। প্রথম দুটি শব্দ পড়ার পরই ল্যাংডন চিনতে পারলো উক্তিটা কার।

ঈশ্বর মৃত। ঈশর মৃতই থাকবে। আর আমরা তাকে হত্যা করেছি। আমরা কিভাবে প্রশান্তি পাবো যখন কিনা আমরাই সকল খুনির খুনি?–নিৎশে

উনিশ শতকের প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক এবং নাস্তিক ফ্রেডরিখ নিৎশের দুটো বিখ্যাত শব্দ হলো ঈশ্বর মৃত। ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করার জন্য যেমন নিৎশে আলোচিত ছিলেন, তেমনি আলোচিত ছিলেন বিজ্ঞানের ব্যাপারে তার অভিমতের জন্যেও বিশেষ করে ডারউইনের বিবর্তনবাদ-তিনি বিশ্বাস করতেন এটা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। এটা। জীবনের নিরর্থকতাকে অনুমোদন করে, যেন জীবনের কোন সুমহান উদ্দেশ্য নেই, আর বলতে চায়, ঈশ্বরের কোন অস্ত্বি নেই।

বিছানার উপরে এই উক্তিটা দেখে ল্যাংডন ভাবলো, হয়তো ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করা সত্ত্বেও ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীর ব্যাপারে তার নিজের যে ভূমিকা সেটা নিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিল এডমন্ড।

ল্যাংডন স্মরণ করতে পারলো, নিৎশের উক্তিটা শেষ হয়েছে এ কথা দিয়ে : এই চুক্তিটার মহিমা কি আমাদের জন্য অনেক বেশি মঙ্গলজনক নয়? আমাদেরকে ঈশ্বর হয়ে উঠতে হবে শুধুমাত্র উপযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

মানুষকে ঈশ্বর হতে হলে ঈশ্বরকে হত্যা করতে হবে-এই সাহসি ধারণাটি ছিল নিৎশের চিন্তাভাবনার মূল প্রতিপাদ্য। ল্যাংডন আরো বুঝতে পারলো, সম্ভবত ঈশ্বরের আংশিক ব্যাখ্যার জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছে এডমন্ডের মতো টেকনোলজির অসংখ্য জিনিয়াস আর পুরোধা ব্যক্তিত্বগণ। যারা ঈশ্বরকে মুছে ফেলে…তাদেরকে ঈশ্বর হতে হয়।

এ কথা ভাবতে গিয়ে আরেকটি বোধোদয় ঘটলো ল্যাংডনের।

নিৎশে কেবলমাত্র একজন দার্শনিক ছিলেন না-তিনি একজন কবিও ছিলেন!

ল্যাংডনের কাছে নিশের দ্য পিকক অ্যান্ড দি বাফেলো নামের ২৭৫টি কবিতার একটি সঙ্কলন আছে। ঈশ্বর-চিন্তা, মৃত্যু আর মানুষের মন সংক্রান্ত ভাবনাগুলো এতে বিধৃত হয়েছে।

বিছানার উপরে যে উক্তিটা আছে তাতে কতোগুলো অক্ষর রয়েছে সেটা দ্রুত গুনে নিলো ল্যাংডন। না। এবারও হলো না। তারপরও মনের কোণে একটা আশা উঁকি দিচ্ছে। আমরা যে কবিতার লাইনটা খুঁজছি সেটা কি নিৎশেরই কোন কবিতা? যাই হোক, উইনস্টনকে সে বলবে অনলাইন থেকে নিৎশের সবগুলো কবিতা সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে যেন সার্চ করে দেখে সাতচল্লিশটি অক্ষরের কোন লাইন আছে কিনা।

এই ভাবনাটা শেয়ার করার জন্য এক্ষুণি অ্যাম্ব্রার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করলেও ল্যাংডন তড়িঘরি ছুটলো বেডরুমেরর ভেতরে যে রেস্ট রুমটা আছে সেদিকে।

রেস্ট রুমের ভেতরে ঢুকতেই বাতি জ্বলে উঠলো, তার সামনে উদ্ভাসিত হলো অভিজাতভাবে সুসজ্জিত একটি বাথরুম যেখানে রয়েছে একটা সিঙ্ক, শাওয়ার নেবার জন্য একটি খোলা জায়গা, আর একটি টয়লেট।

সঙ্গে সঙ্গে ল্যাংডনের চোখ গেল একটা নিচু অ্যান্টিক টেবিলের দিকে, ওটার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন ধরণের টয়লেট্রিজ আর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কিছুইজনিস। টেবিলের আইটেমগুলো দেখে সশব্দেই নিঃশ্বাস নিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সে।

ওহ্ ঈশ্বর। এডমন্ড…না।

তার সামনে যে টেবিলটা রয়েছে সেটা যেন নিষিদ্ধ মাদকের ছোটখাটো একটি ল্যাবরেটরি-ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, পিলের বোতল, কিছু ক্যাপসুল, এমনকি শুকনো রক্তের দাগলাগা এক টুকরো কাপড় পর্যন্ত।

ল্যাংডন ভীষণ কষ্ট পেলো।

এডমন্ড ড্রাগ নিতো?

প্রফেসর জানে, আজকাল এইসব রাসায়নিক মাদকাসক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সবখানেই এটা দেখতে পাওয়া যায়, এমন কি বিখ্যাত আর ধনীদের মধ্যেও। বিয়ারের চেয়ে হেরোইন এখন সস্তা। লোকজন এমনভাবে পেইনকিলার ব্যবহার করে যেন তারা অ্যালার্জির ওষুধ খাচ্ছে।

মাদকাসক্তির কারণেই যে আজকাল তার ওজন কমে গেছিল সেটা নিশ্চিত, ল্যাংডন ভাবলো। এডমন্ড হয়তো নিরামিষি হয়ে যাবার ভান করেছিল তার শুকিয়ে যাওয়া, ওজন হারানো আর চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়াটা আড়াল করার জন্যই।

টেবিল থেকে একটা বোতল তুলে নিলো ল্যাংডন। প্রেসক্রিপশনের লেবেলটা পড়লো সে। ধরেই নিয়েছে, অক্সিকন্টিন আর পারকোসেটের মতো পেইন কিলার দেখতে পাবে।

কিন্তু তার বদলে সে দেখতে পাচ্ছে : ডসিটাক্সেল।

বিভ্রান্ত হয়ে সে আরেকটা বোতল চেক করে দেখলো : জেমসিটাবাইন।

এসব কী? অবাক হয়ে তৃতীয় বোতলটাও দেখলো এবার : ফ্লুরোরাসিল। মূর্তির মতো জমে গেল ল্যাংডন। হারভার্ডের এক কলিগের কাছ থেকে ফ্লুরোরাসিল সম্পর্কে জেনেছিল। হঠাৎ করেই নিজের ভেতরে ভয়ের একটি স্রোত টের পেলো সে। কিছুক্ষণ পর বোতলগুলোর পাশে পড়ে থাকা একটি প্যালেটের দিকে নজর দিলো। শিরোনামটি বলছে নিরামিষ ভোজন কি অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারকে ধীরগতি করে তোলে?

সত্যটা জানতে পেরে ল্যাংডনের চোয়াল ঝুলে পড়লো।

এডমন্ড মাদকাসক্ত ছিল না।

সঙ্গোপনে সে প্রাণঘাতি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিল।

.

অধ্যায় ৫৩

এত জায়গা থাকতে কেন এরকম একটা চিলেকোঠাকে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিল এডমন্ড সেটা ভেবে আগেও বেশ কয়েকবার অবাক হয়েছে অ্যাম্ব্রা ভিদাল। তবে এডমন্ড যেরকম স্বভাবের ছিল, তাতে করে বেশি অবাক হবার সুযোগও নেই।

ছিল, কত তাড়াতাড়ি একজন মানুষ বর্তমান থেকে অতীতে পাড়ি জমিয়েছে, সেটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অ্যাম্ব্রার বুক চিড়ে। এ মুহূর্তে এডমন্ডের অ্যাপার্টমেন্টে তার সারি সারি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও।

যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি সমৃদ্ধ ওর বইয়ের সংগ্রহ, পরিমাণটাও বিশাল।

বাঁকানো হলওয়ের একটা বিশাল অংশ লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত করেছিল এডমন্ড। গওদির নকশা করা পিলারগুলোর মাঝে মাঝে তাক বসানো হয়েছে। বই রাখার জন্যে। তবে এত বিশাল সংখ্যক বই দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যাবে, বিশেষ করে এডমন্ডের যেহেতু এখানে মাত্র দুই বছর থাকার কথা ছিল।

দেখে তো মনে হচ্ছে বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল ওর।

বইভর্তি তাকগুলোর দিকে তাকিয়ে আরেকটা ব্যাপার উপলব্ধি হলো অ্যাম্ব্রার। এখান থেকে এডমন্ডের প্রিয় একটা কবিতার লাইন খুঁজে বের করা চাট্টিখানি ব্যাপার হবে না। যা ভেবেছিল তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগবে। বইয়ের নামগুলো পড়া শুরু করলো ও, সবই বিজ্ঞানভিত্তিক বই : জোতির্বিদ্যা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রাণরসায়ন :

The Big Picture
Forces of Nature
Origins of Consciousness
The biology of belief
Intelligent Algorithms
Our Final Invention

দেখতে দেখতে একটা তাকের শেষ প্রান্তে চলে আসলো ও, অন্যপাশটা দেখা শুরু করলো আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু এখানেও কেবল বিজ্ঞানের বই। বিভিন্ন বিষয় অনুযায়ি আলাদা আলাদা করে রাখা। তাপগতিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, প্রিমর্ডিয়াল কেমিস্ট্রি, অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবীর রাসায়নিক অবস্থা সংক্রান্ত বিজ্ঞান।

কিন্তু কোন কবিতার বই নেই।

অনেকক্ষণ ধরে উইনস্টনের কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় পকেট থেকে কিয়ার্শের ফোনটা বের করলো অ্যাম্ব্রা। উইনস্টন? আছো?

হ্যাঁ, ব্রিটিশ উচ্চারণে জবাব আসলো।

এডমন্ড কি আসলেই ওর লাইব্রেরির সবগুলো বই পড়ে শেষ করেছে?

হ্যাঁ, জবাব দিলো উইনস্টন। অবসর সময়ের পুরোটাই বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে এডমন্ড। এই লাইব্রেরিটাকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নামে ডাকতো ও।

এখানে কি আদৌ কোন কবিতার বই আছে?

আসলে এই লাইব্রেরিতে কি কি বই আছে তার পূর্ণ তালিকাটা নেই আমার কাছে। মাঝে মাঝে কিছু নন ফিকশন বই আমাকে পড়ে শোনাতে বলতো ও, সেগুলো সম্পর্কেই ধারণা আছে কেবল। আপনাকে নিজেই খুঁজে দেখতে হবে কোন কবিতার বই আছে কিনা।

ঠিক আছে।

আপনি খুঁজতে থাকুন, সেই ফাঁকে একটা খবর জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি-প্রিন্স হুলিয়ানের ব্যাপারে।

কি হয়েছে? কাজ থামিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো অ্যাম্ব্রা। এখনও কিয়ার্শের মৃত্যুর সাথে হুলিয়ানের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততার ব্যাপারটা নিয়ে দোটানায় ভুগছে ও। কোন প্রমাণ নেই আমার কাছে, নিজেকে মনে করিয়ে দিলো অ্যাম্ব্রা। হুলিয়ানই যে অ্যাডমিরাল আভিলাকে মিউজিয়ামে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এ ব্যাপারটা এখনও নিশ্চিত নয়।

কিছুক্ষণ আগে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে বলছি, মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদের সামনে ভিড় জমাচ্ছে এডমন্ডের অনুসারিরা। গুজব ছড়িয়েছে, বিশপ ভালদেসপিনো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এডমন্ডের হত্যাকান্ডের সাথে, আর সেক্ষেত্রে প্রাসাদের ভেতর থেকে কেউ সহায়তা করেছে তাকে। প্রিন্স। হুলিয়ানের নামও বলছে অনেকে। প্রাসাদ লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ছে কেউ কেউ। দেখুন।

এডমন্ডের স্মার্টফোনে একটা লাইভ স্ট্রিম শুরু করলো উইনস্টন। সেখানে প্ল্যাকার্ড হাতে একদল উত্তেজিত মানুষকে স্লোগান দিতে দেখা যাচ্ছে। অনেকের প্ল্যাকার্ডে স্প্যানিশে কেবল একটা কথা লেখা-APOSTASIA! সেই সাথে পাশে একটা লোগো, ইদানিং মাদ্রিদের রাস্তায় এই লোগোটা হরদম চোখে পড়ছে।

স্বধর্মত্যাগ

Apostasy অর্থাৎ স্বধর্মত্যাগ স্পেনের অসাম্প্রদায়িক তরুণদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চার্চ ত্যাগ করুন!–তাদের বেদবাক্য।

হুলিয়ান কি এখন পর্যন্ত কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে?

সেটাই তো সমস্যা, জবাবে বলল উইনস্টন। এখন পর্যন্ত হুলিয়ান অথবা বিশপের পক্ষ থেকে কোন বিবৃতি আসেনি। প্রাসাদের কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। সেই সুযোগে হালে পানি পাচ্ছে ষড়যন্ত্রতত্ত্বীরা। জাতীয় গণমাধ্যম এখন প্রশ্ন তুলছে আপনার অবস্থান নিয়ে। কেন আপনি এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি, সেটা নিয়েও গবেষণা চলছে।

আমাকে নিয়ে কেন টানা হেচড়া করছে?! মোচড় দিয়ে উঠলো অ্যাম্ব্রার ভেতরটা।

আপনি এডমন্ড হত্যাকান্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাছাড়া আপনি প্রিন্স হুলিয়ানের বাগদত্তা, এ দেশের হবু রাণী। জনগণ আপনার মুখ থেকে স্পষ্টভাবে শুনতে চায়, এই ঘটনার সাথে কোনভাবেই জড়িত নয় হুলিয়ান।

অ্যাম্ব্রার শক্ত ধারণা এডমন্ডের খুনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই হুলিয়ানের; তাকে যতটা চেনে ও, সেটাতে এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। হুলিয়ানের চরিত্রে কখনো কৃত্রিমতা বা কপটতার আভাস পায়নি অ্যাম্ব্রা-যা বলার সেটা অকপটে, নির্ভয়ে বলেছে সে। কাউকে খুন করা বা খুনের জন্যে আদেশ দেয়া হলিয়ানের পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রফেসর ল্যাংডনকে নিয়েও একইরকম প্রশ্ন উঠছে, উইনস্টন বলল। গণমাধ্যম এটা নিয়ে মাতামাতি করছে যে, কেন এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনে একটা বড় ভূমিকা পালন করার পরে এভাবে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন তিনি। অনেক কন্সপিরেসি ব্লগে তো এটাও লেখা হচ্ছে, কিয়ার্শের মৃত্যুর ঘটনার সাথে জড়িত প্রফেসর ল্যাংডন।

এ তো পাগলামি!

কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করে বসে আছে কথাটা। প্রফেসর ল্যাংডনের অতীতে হলি গ্রেইলের জন্যে অনুসন্ধান, খ্রিস্টের বংশধরদের খোঁজ-এসব ব্যাপার ঘি ঢালছে কল্পনার আগুনে। খ্রিস্টের স্যালিক বংশধরদের সাথে। কার্লিস্টদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে, তাছাড়া গুপ্তঘাতকের ট্যাটু-

থামো, উইনস্টনের কথার মাঝেই বলে উঠলো অ্যাম্ব্রা। যত সব অর্থহীন কথাবার্তা!

আরেকদল লোক কিন্তু এমনটা ধারণা করছে যে, প্রফেসর ল্যাংডন গা ঢাকা দিয়েছেন কারণ তার পেছনেও লোক লেগেছে। সবাই গোয়েন্দা হয়ে গেছে আজ রাতে। এডমন্ড কী আবিষ্কার করেছিল তা জানতে উদগ্রীব প্রত্যেকে…সেই সাথে, যে এডমন্ডকে খুন করিয়েছে তার পরিচয় জানতেও উদগ্রিব সবাই।

এসময় করিডোর থেকে ল্যাংডনের পদশব্দ ভেসে আসায় সেদিকে তাকালো অ্যাম্ব্রা।

অ্যাম্ব্রা? উদ্বিগ্ন স্বরে বলল ল্যাংডন, আপনি কি জানতেন, এডমন্ড মৃত্যুর সাথে লড়ছিল?

কী বলছেন?! অবাক স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো অ্যাম্ব্রা। কিছু জানতাম তো!। এডমন্ডের ব্যক্তিগত বাথরুমে কী দেখেছে সেটা খুলে বলল ল্যাংডন। হা হয়ে গেল অ্যাম্ৰার মুখ।

অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার? এই জন্যে ওরকম ফ্যাকাসে আর দূর্বল লাগতো এডমন্ডকে।

অসুস্থ হবার ব্যাপারে টু শব্দটিও উচ্চারণ করেনি এডমন্ড। এই জন্যেই গত কয়েক মাস কাজে ওরকম একাত্ম ছিল সে। ও জানতো, সময় শেষ হয়ে আসছে।

উইনস্টন, ডাকলো ও, তুমি কি এডমন্ডের অসুস্থতার ব্যাপারটা জানতে?

হ্যাঁ, কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিলো উইনস্টন। ব্যাপারটা কাউকে জানতে দেয়নি সে। বাইশ মাস আগে ক্যান্সারের কথা জানতে পারে। তখন থেকেই পাল্টে ফেলে খাদ্যাভ্যাস। কাজের গতিও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। ইচ্ছে করেই এই চিলেকোঠায় উঠে আসে, যেখানকার বাতাস মিউজিয়ামের মত নিয়ন্ত্রন করা হয় আর অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও নিরাপদ জায়গাটা। যতটা সম্ভব অন্ধকারে সময় কাটাতে হতো এডমন্ডকে, কারণ ওর ওষুধগুলো ওকে আলোর প্রতি সংবেদনশীল করে তুলছিল। চিকিৎসকরা যা ধারণা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশিদিন বেঁচেছে এডমন্ড। অবশ্য কিছুদিন আগ থেকে ওর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ব্যাপারে যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম আমি সেগুলো পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আর বড়জোর নয়দিন বাঁচবে এডমন্ড।

ও জানতো, নয় দিনের মধ্যে মৃত্যু হতে যাচ্ছে ওর, ভাবলো অ্যাম্ব্রা। এডমন্ডকে শুধুমাত্র সবজি খেতে দেখে বেশ কয়েকবার খোঁচা দিয়েছিল ও, এখন অপরাধবোধ হচ্ছে সেটার জন্যে। ভাবনাটা নতুনভাবে ওকে উদ্দীপ্ত করলো এডমন্ডের প্রিয় কবিতা খুঁজে বের করার জন্যে। এডমন্ড যা শুরু করে গিয়েছিল তার যবনিকা ওদেরকেই টানতে হবে।

এখন পর্যন্ত কোন কবিতার বই খুঁজে পাইনি আমি, ল্যাংডনের উদ্দেশ্যে বলল সে। শুধুমাত্র বিজ্ঞানের বই।

আমার ধারণা ফ্রেডরিক নিৎশের কোন কাজ খুঁজছি আমরা, ল্যাংডন বলল অ্যাম্ব্রাকে। এডমন্ডের বিছানার ওপরে তার একটা পঙক্তি বাধাই করে রাখা। ওটায় অবশ্য সাতচল্লিশটা অক্ষর নেই, তবে এডমন্ড নিশ্চয়ই নিৎশের ভক্ত, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

উইনস্টন, তুমি কি নিৎশের কবিতাগুলোর মধ্যে খুঁজে দেখতে পারবে, কোনটায় সাতচল্লিশ অক্ষরের কোন পঙক্তি আছে কিনা?

অবশ্যই, জবাব দিলো উইনস্টন। জার্মান ভাষায় খুঁজবো, নাকি ইংরেজি অনুবাদে?

অনিশ্চয়তা ভর করলো অ্যাম্ব্রার চেহারায়।

ইংরেজিতেই খোঁজ করো, ল্যাংডন বলল। এডমন্ড প্রেজেন্টেশনের সময় পাসওয়ার্ডটা তার স্মার্টফোন থেকে লিখতে চেয়েছিল, অর্থাৎ কোন ইংলিশ কিবোর্ডই ব্যবহার করেছে।

সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো অ্যাম্ব্রা।

হয়ে গেছে কাজ, প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলো উইনস্টন। তিনশটা অনুবাদ কবিতায় মোট একশো বিরানব্বইটা পঙক্তি পেয়েছি যেগুলো সাতচল্লিশ অক্ষরের।

এতগুলো? লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল ল্যাংডন।

উইনস্টন, অ্যাম্ব্রা বলল এই সময়, এডমন্ড বলেছিল, ওর পছন্দের পঙক্তিটি একটা ভবিষ্যত্বণী…যেটা ইতিমধ্যে সত্যি হতে শুরু করেছে। এরকম কোন পঙক্তি পেয়েছো কি?

না, দুঃখিত, উইনস্টন জবাব দিলো, কোন পঙক্তিই ভবিষ্যবাণী বলে মনে হচ্ছে না। দেখতে চান আপনারা?

অনেক বেশি সংখ্যক পঙক্তি, এত সময় নেই হাতে, ল্যাংডন বলল। আমাদের উপযুক্ত বইটা খুঁজে বের করতে হবে, আর এটাও আশা করতে হবে যে, এডমন্ড ওর পছন্দের উক্তিটা দাগিয়ে রেখেছে।

তাহলে দ্রুত কাজে লেগে পড়ুন, উইনস্টন বলল। এখানে আপনাদের উপস্থিতির কথা আর বেশিক্ষণ গোপন থাকবে বলে মনে হয় না।

কেন? জানতে চাইলে ল্যাংডন।

স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ি বার্সেলোনার এল প্রাত এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণ আগে দু-জন গার্ডিয়া রিয়েল এজেন্টসমেত একটা সামরিক প্লেন অবতরণ করেছে।

*

এই মুহূর্তে মাদ্রিদের উপকণ্ঠ ধরে ছুটে চলা একটা গাড়িতে বসে আছেন বিশপ ভালদেসপিনো। সব দিকের চাপ সামলে প্রাসাদ থেকে গোপনে বের হয়ে আসায় স্বস্তিবোধ করছেন কিছুটা। ওপেল সেডান গাড়িটা তার সহকারি যাজকের। সেটার ব্যাকসিটে তার সাথে এই মুহূর্তে প্রিন্স হুলিয়ানও আছেন। পর্দার আড়াল থেকে যেভাবে কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে তাতে আর অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে-এমনটাই আশাবাদ তার।

লা ক্যাসিতা দেল প্রিন্সিপে, চালকের আসনে থাকা তরুণ যাজককে নির্দেশ দিলেন ভালদেসপিনো।

প্রিন্সের এই বাড়িটা মাদ্রিদের ঠিক সীমানায় একটা মফস্বল অঞ্চলে অবস্থিত। অবশ্য বাড়ি না বলে ম্যানশন বলাটাই মানানসই হবে। ১৭০০ সাল থেকে এই ক্যাসিতা স্প্যানিশ রাজপরিবারের ব্যক্তিগত আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খুব কম মানুষই জানে এটার অবস্থান। ভালদেসপিনো প্রিন্সকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, সেখানেই বাকি রাতটা কাটানো নিরাপদ হবে তাদের জন্যে।

কিন্তু আমাদের মূল গন্তব্য অন্য কোথাও, ভেতরে ভেতরে ঠিকই জানেন বিশপ ভালদেসপিনো। এই মুহূর্তে আনমনা ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন প্রিন্স, কিছু একটা ভাবছেন।

প্রিন্সকে দেখে যতটা সহজ সরল মনে হয়, আসলেও কি সে ওরকম? ভাবলেন ভালদেসপিনো। নাকি বাবার মতনই নিজের প্রকৃত ব্যক্তিত্বটা সবার সামনে আড়াল করতে দক্ষ?

.

অধ্যায় ৫৪

গতানুগতিকের চেয়ে অনেক বেশি আঁটসাঁট করে হাতকড়া পরানো হয়েছে। কমান্ডার গারজাকে। ওগুলো চেপে বসেছে তার কব্জিতে।

যা করার জেনে বুঝেই করছে এরা, ভাবলো সে। নিজের লোকদের হাতে এভাবে আটক হওয়ার ঘটনাটা মানতে এখনও বেশ কষ্ট হচ্ছে তার।

হচ্ছে কী এসব?! রাগতস্বরে গার্ডদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো সে, ক্যাথেড্রাল থেকে বাইরে প্লাজায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।

কেউ জবাব দিলো না।

গারজাকে নিয়ে দলটা প্রাসাদের দিকে এগোতে লাগলে হঠাৎ তার মনে পড়লো, গেটের বাইরে ভিড় করে আছে টেলিভিশনের লোকজন এবং বিক্ষোভকারীরা।

অন্তত আমাকে পেছন দিয়ে নিয়ে যাও, পাশের লোকটার উদ্দেশ্যে বলল সে, বাইরের লোকজনকে কিছু দেখানোর দরকার নেই।

কিন্তু তার অনুরোধে কেউ ভুক্ষেপও করলো না। সরাসরি প্লাজার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে থেকে ছুটে আসলো প্রশ্নবাণ। মেজাজের দফারফা হওয়া সত্ত্বেও খুব কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলো গারজা। মাথা উঁচু করে গার্ডদের সাথে গেটের একদম পাশ দিয়ে। এগোতে থাকলো।

একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করা হচ্ছে তার উদ্দেশ্যে :

আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কেন?

কী করেছেন আপনি, কমান্ডার?

এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকান্ডের সাথে আপনি কি কোনভাবে জড়িত?

গারজা ভেবেছিল, তার অধীনস্থ কর্মিরা লোকজনের ভিড় আর প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলে যাবে সেখান থেকে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্টরা। তার একদম সামনেই অনেকগুলো টিভি ক্যামেরা। প্রাসাদের দিক থেকে একজনকে দ্রুতপায়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল এই সময়।

মনিকা মার্টিন।

কোন সন্দেহ নেই তার এই দুর্দশা দেখে একদম অবাক হয়ে যাবে মেয়েটা।

কিন্তু কাছে আসার পর মনিকার চেহারায় অবাক হবার কোন লক্ষণ দেখলো না কমান্ডার। বরং বিরক্ত মনে হচ্ছে তাকে। জোর করে তাকে রিপোর্টারদের মুখোমুখি দাঁড় করালো গার্ডরা।

হাত উঁচিয়ে সবাইকে চুপ করার অনুরোধ জানালো মনিকা মার্টিন। এরপর পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে চোখের মোটা কাঁচের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে পড়তে শুরু করলো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।

এডমন্ড কিয়ারে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে, ঘোষণার স্বরে বলল সে, রাজপ্রাসাদের আদেশ অনুযায়ি কমান্ডার ডিয়েগো গারজাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিশপ ভালদেসপিনোকে অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন তিনি।

এই বানোয়াট অভিযোগের প্রতিবাদ করার আগেই আবার তাকে হাঁটতে বাধ্য করা হলো প্রাসাদের উদ্দেশ্যে। মনিকা মার্টিন কাগজ দেখে পড়েই যাচ্ছে তখনও।

আমাদের ভবিষ্যৎ রাণী, অ্যাম্ব্রা ভিদাল, বলছে সে, এবং মার্কিন প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন সম্পর্কেও কিছু বিস্ময়কর তথ্য আছে আমাদের হাতে।

*

প্রাসাদের নিচতলায় একটা টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে মনিকা মার্টিনের প্রেস কনফারেন্সের সরাসরি সম্প্রচার দেখছে ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির পরিচালক সুরেশ ভাল্লা।

প্রচণ্ড বিরক্ত মনে হচ্ছে মনিকাকে।

পাঁচ মিনিট আগেই নিজের ব্যক্তিগত নম্বরে একটা ফোন আসে মনিকা মার্টিনের। অফিসে গিয়ে সেটা রিসিভ করে নিচুস্বরে কিছুক্ষণ কথা বলে সে। এর তিরিশ সেকেন্ড পর হাতে একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে আসে, যেটাতে ফোনালাপ চলাকালীন কিছু জিনিস টুকে নিয়েছিল মেয়েটা। একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। সুরেশের উদ্দেশ্যে কিছু না বলেই প্লাজায় গণমাধ্যমকর্মিদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে চলে যায় সে।

মনিকার দেয়া বিবৃতিতে যা দাবি করা হয়েছে সেটা সঠিক হোক বা না হোক, একটা ব্যাপার একদম নিশ্চিত-যে ব্যক্তি বিবৃতিটা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে, রবার্ট ল্যাংডনকে বড় রকমের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে সে।

কে দিলো মনিকাকে এই নির্দেশ? অবাক না হয়ে পারলো না সুরেশ।

এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে এমন সময় একটা শব্দ ভেসে আসলো তার কম্পিউটার থেকে। নতুন কোন ইমেইল এসেছে। কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে গিয়ে ইমেইল প্রেরকের নাম দেখেই চমকে উঠলো ও।

[email protected]

সেই গোপন তথ্য সরবারহকারী, ভাবলো সুরেশ।

কন্সপিরেসি নেটকে এই ঠিকানা থেকেই বেনামে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এখন কোন এক কারণে তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়েছে ঠিকানাটা থেকে।

বসে দ্রুত ইমেইলটা খুললো সুরেশ। সেখানে লেখা :

ভালদেসপিনোর মোবাইল হ্যাক করেছি আমি।
তার পাঠানো মেসেজটা পড়েছি।
কিছু বিপজ্জনক কাজ করছেন তিনি।
রাজ প্রাসাদ থেকে তার এসএমএস রেকর্ড খতিয়ে দেখা হোক যত দ্রুত সম্ভব।

আবারও পুরো মেসেজটা পড়ে মুছে দিলো সুরেশ। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ভাবলো, কী করবে।

এরপর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রয়্যাল অ্যাপার্টমেন্টের একটা মাস্টার-কি তৈরি করে নিলো দ্রুত। সবার চোখ এড়িয়ে উঠে এলো ওপরতলায়।

.

অধ্যায় ৫৫

নতুন উদ্যোমে এডমন্ডের লাইব্রেরির সংগ্রহের দিকে চোখ বোলাচ্ছে ল্যাংডন।

কবিতার বই…একটা না একটা কবিতার বই তো থাকবেই।

গার্ডিয়া রিয়েল এজেন্টদের বার্সেলোনায় হঠাৎ আগমন বদলে দিয়েছে পরিস্থিতি, আর খুব বেশি সময় পাবে না ওরা। তবে ল্যাংডন এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসি যে তাদের এখানে এসে পড়ার আগেই কাজ হয়ে যাবে। এডমন্ডের পছন্দের কবিতার পঙক্তিটা বের করে ওটা ফোনের মাধ্যমে। পাসওয়ার্ড বক্সে লিখতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এরপরেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে এডওয়ার্ডেরে প্রেজেন্টেশন, যেমনটা চাইছিল সে।

অ্যাম্ব্রার দিকে তাকালো ল্যাংডন। দেয়ালের অন্যপাশের তাকে উপযুক্ত বইটা খুঁজতে ব্যস্ত সে। কিছু পেলেন? জিজ্ঞেস করলো ও।

জবাবে মাথা ঝাঁকালো অ্যাম্ৰা। এখন পর্যন্ত কেবল বিজ্ঞান আর দর্শনের বই চোখে পড়েছে। নিৎশের কিংবা অন্য কোন কবির কবিতার বই নেই।

দেখতে থাকুন, বলে নিজেও খুঁজতে লাগলো ল্যাংডন। এখন যে অংশে চোখ বোলাচ্ছে সে, সেখানে কেবল মোটা মোটা ইতিহাসের বই।

বইয়ের নামগুলো দেখে কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের। সেদিন নিজের জীবনের কষ্টের এক কাহিনী শুনিয়েছিল তাকে। এডমন্ড। একজন নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও স্পেন এবং ক্যাথোলিসিজম নিয়ে। আগ্রহের কমতি ছিল না তার। সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে এডমন্ড মুখ কালো করে বলে যে, আমার মার জন্মস্থান স্পেন। আর তিনি একজন ক্যাথলিক ছিলেন।

এডমন্ডের কাছ থেকে পুরো কাহিনীটা শুনে অবাকই হয়েছিল ল্যাংডন। এডমন্ডের মা, পালোমা ক্যালভের জন্ম স্পেনের কাদিজের একদম সাদামাটা একটা শ্রমিক পরিবারে। উনিশ বছর বয়সে মাইকেল কিয়ার্শ নামের এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচারের সাথে পরিচয় হয় তার, ছুটি কাটাতে স্পেনে এসেছিল সে। শিকাগোর মাইকেলের প্রেমে পড়ে যায় পালোমা। কিছুদিনের মধ্যেই প্রণয় গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। পালোমা বুঝতে পারে, মা হতে যাচ্ছে সে। কিন্তু একদম কট্টর ক্যাথলিক সম্প্রদায়ে এ ঘটনা কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত, অন্য অবিবাহিত মাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয় তা ভালোমতোই জানা ছিল পালোমার। তাই মাইকেল কিয়ার্শের বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিয়ে শিকাগোয় পাড়ি জমায় সে। কিন্তু এডমন্ডের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তার বাবা।

পাপের শাস্তি নিজের বাবার কাছ থেকে শুনতে হয় এডমন্ডের মাকে। তার পরিবার তাকে কাদিজে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বলে যে, পালোমার দুর্দশার কারণ, ঈশ্বর ক্রোধান্বিত হয়েছে তার ওপর, আর সেই ক্রোধ প্রশমনের একমাত্র উপায় হচ্ছে ধর্মের পথে বাকি জীবনটা উৎসর্গ করা।

এডমন্ড কিছুটা বড় হবার পর একটা হোটেলে পরিচারিকার কাজ শুরু করে পালোমা। যতটা ভালোভাবে সম্ভব বড় করে তোলার চেষ্টা করে এডমন্ডকে। প্রতি রাতে ধর্মিয় বই পাঠ করে নিজের কৃতকর্মের জন্যে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতো সে। কিন্তু অবস্থার বেশি পরিবর্তন হয় না, বরং তার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে, ঈশ্বর ক্ষমা করেননি তাকে।

এভাবে পাঁচ বছর কাটানোর পরে হঠাৎ করেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় পালোমা। তার কাছে মনে হয়, এডমন্ডকে তার নিজের পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার দূরে চলে যাওয়া। তাই পাঁচ বছর বয়সি এডমন্ডকে একটা অনাথাশ্রমে ভর্তি করিয়ে দিয়ে স্পেনে ফিরে যায় সে, সেখানে একটা কনভেন্টে যোগ দেয়। আর কখনো তার দেখা পায়নি এডমন্ড।

দশ বছর বয়সে এডমন্ড জানতে পারে, কনভেন্টেই মৃত্যু হয়েছে তার মার। সেখানে ইচ্ছে করে ধর্মিয় কারণে একটানা অনেকদিন ধরে উপোস থাকছিল সে। অবশেষে আর শারীরিক যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে ফাঁস নেয়। পালোমা।

জানি কাহিনীটা দুঃখের, এডমন্ড বলে ল্যাংডনকে। হাই স্কুলে থাকাকালীন আরো বিস্তারিত জেনেছিলাম এ ব্যাপারে। আমার ধর্ম বিমুখতার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। ব্যাপারটা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত করে বললে-প্রত্যেক পাগলামিরই সমান ও বিপরীত পাগলামি আছে।

গল্পটা শোনার পরে ল্যাংডন বুঝতে পারে, কেন হারভার্ডে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন সবসময় খারাপ মেজাজে থাকতো এডমন্ড। তবে একটা ব্যাপারে অবাক না হয়ে পারে না সে। কোনদিন শৈশবকালীন দুর্দশা নিয়ে এডমন্ডকে আক্ষেপ করতে দেখেনি। বরং নিজেকে সৌভাগ্যবান দাবি করতো ছেলেটা। বলতো, যদি ছোটবেলায় কষ্ট না করতে হতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি নিজের প্রধান দুই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারতো না সে-এক হচ্ছে। দারিদ্রতা থেকে মুক্তি, অন্যটা হচ্ছে-যে ধর্মের কারণে মৃত্যু হয়েছে তার মার, সে ধর্মকে একহাত দেখে নেয়া।

দুই লক্ষ্যেই সমান সফলতা অর্জন করেছিল ছেলেটা, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো ল্যাংডন। মনোযোগ দিলো লাইব্রেরিতে সঠিক বইটা খুঁজে বের করার কাজে।

এবার যে বইয়ে তাকে চোখ পড়লো তার সেখানে এডমন্ডের জন্যে একদম উপযুক্ত বইগুলোর নাম চোখে পড়লো :

Letter to a Christian Nation
The God Delusion
The Portable Atheist

গত কয়েক দশকে নন ফিকশন ধাঁচের সবচেয়ে বেশি বিলিত বইগুলো খ্রিস্টধর্মের অন্ধবিশ্বাসের বিপক্ষে লেখা। ল্যাংডন খেয়াল করেছে, ধর্মের প্রতি মানুষের মন উঠে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে-এমনকি হারভার্ড ক্যাম্পাসেও। কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন পোস্টে একটা প্রতিবেদ। ছাপা হয়েছে এই ব্যাপারে। সেখানে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, হরভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতন প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রিদের মধ্যে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টান্টদের মোট সংখ্যার তুলনায় ধর্মে অবিশ্বাসিদের সংখ্যা বেশি।

সেই সাথে পশ্চিমা বিশ্বে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ধর্মবিরোধি বিভিন্ন সংগঠন। যেমন-আমেরিকান অ্যাথিস্টস, অ্যাটি অ্যালাইয়েন্স-এসব।

এসব সংগঠন নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায়নি ল্যাংডন। তবে একবার এডমন্ডের কাছে একটা সংগঠনের নাম শুনে কিছুটা অবাক হয়ে যায় সে। ব্রাইটস নামের সেই সংগঠনের সদস্য স্বয়ং রিচার্ড ডকিন্স, ড্যানিয়েল ডেনেট, মারগারেট ডাউনি প্রমুখ। অর্থাৎ হোমড়া চোমড়া লোকদের নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে সংগঠনগুলো।

কিছুক্ষণ আগেই ডকিন্স এবং ডেকেটের বই চোখে পড়েছে ল্যাংডনের। এবার লাইব্রেরির বিবর্তন অংশে চলে আসলো সে। আর সেখানে অবধারিতভাবেই ডারউইনের সবগুলো বইয়ের দেখা মিললো।

জীবনের সৃষ্টির জন্যে ঈশ্বরের দরকার নেই, এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনের শুরুতে বলা কথাটা মনে পড়লো ল্যাংডনের। কোথা থেকে এসেছি আমরা? প্রশ্নটা নিয়ে অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলো সে। এডমন্ডের আবিষ্কারের সাথে এটার কোন সম্পর্ক আছে?

তবে এই ধারণাটা যে জীবের আবির্ভাবের প্রচলিত সকল ধারণার বিরুদ্ধে যাবে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই ল্যাংডনের। সেজন্যেই এডমন্ডের আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে এতটা আগ্রহি সে। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হবে না কোনভাবেই।

রবার্ট? অ্যাম্ব্রা ডাক দিলো তাকে পেছন থেকে।

ঘুরে দেখলো, নিজের ভাগের লাইব্রেরির অংশটুকু দেখা শেষে অ্যাম্ব্রার। এখানে সব ননফিকশন। অন্য কিছু চোখে পড়লো না, বিমর্ষচিত্তে মাথা নেড়ে বলল সে। আপনি কিছু পেলেন?

একই অবস্থা, জানালো ল্যাংডন।

ল্যাংডনের পাশে এসে বইগুলোর নামে চোখ বোলাতে শুরু করলো অ্যাম্ব্রা। ঠিক সেই সময় উইনস্টনের গলার স্বর ভেসে এলো স্পিকার ফোনে।

মিস ভিদাল?

এডমন্ডের ফোনটা বের করলো অ্যাম্ব্রা। হ্যাঁ?

আপনার এবং প্রফেসর ল্যাংডন, দু-জনেরই একটা জিনিস দেখা উচিত, উইনস্টন বলল। রাজ প্রাসাদ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।

দ্রুত অ্যাম্ব্রার কাছাকাছি এসে ছোট স্মার্টফোনটার স্ক্রিনে চোখ দিলো ল্যাংডন। সেখানে একটা ভিডিও চলছে এ মুহূর্তে।

মাদ্রিদের রাজ প্রাসাদের সামনের রাজা চিনতে অসুবিধে হলো না তার। হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় একজন ইউনিফর্ম পরিহিত লোককে ক্যামেরার সামনে হাজির করা হয়েছে। ইচ্ছে করেই তার চেহারা ক্যামেরার দিকে ঘোরানো হলো যাতে পুরো পৃথিবীর লোক দেখতে পারে।

গারজা?! অবাক স্বরে বলল অ্যাম্ব্রা। গার্ডিয়া রিয়েলের প্রধান কমান্ডার তিনি। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে?!

এবার ক্যামেরা ঘুরে গেল চশমা পরিহিত এক কমবয়সি দ্রমহিলার দিকে। একটা কাগজ বের করে সেখান থেকে পড়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো সে।

ইনি মনিকা মার্টিন, অ্যাম্ব্রা বলল। প্রাসাদের গণসংযোগ বিভাগের কোঅর্ডিনেটর। হচ্ছেটা কি?

হাতের কাগজটা থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে পড়া শুরু করলো মার্টিন, এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে, ঘোষণার স্বরে বলল সে, রাজপ্রাসাদের আদেশ অনুযায়ি কমান্ডার ডিয়েগো গারজাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিশপ ভালদেসপিনোকে অত্যন্ত ঘৃণিতভাবে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন তিনি।

অ্যাম্ব্রার চেহারায় অস্বস্তির ছাপ প্রকট হতে দেখলো ল্যাংডন।

আমাদের ভবিষ্যৎ রাণী, অ্যাম্ব্রা ভিদাল, বলল মার্টিন, এবং মার্কিন প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন সম্পর্কেও কিছু বিস্ময়কর তথ্য আছে আমাদের হাতে।

অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকালো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা।

আমরা একদম নিশ্চিত খবর পেয়েছি, গুগেনহাইম জাদুঘর থেকে মিস ভিদালকে অপহরণ করেছেন প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। আমাদের গার্ডিয়া। রিয়ালের সদস্যরা একদম সতর্ক অবস্থায় আছে এখন, বার্সেলোনার কর্তৃপক্ষের সাথে একযোগে কাজ করছেন তারা। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেই মিস ভিদালকে জিম্মি করে রেখেছেন রবার্ট ল্যাংডন।

কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলো ল্যাংডন।

যেহেতু ঘটনাটা অপহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সেহেতু জনসাধারণের কাছে আমাদের অনুরোধ, যাতে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ সাহায্য করা হয়। আপনাদের কাছে যদি কোন তথ্য থেকে থাকে তবে অতি দ্রুত আমাদের সাথে যোগাযোগ করার আহ্বান জানাচ্ছি।

মনিকা মার্টিনের বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্র প্রশ্ন করা শুরু করলো সাংবাদিকেরা। কিন্তু তাদের কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো ঘুরে হাঁটা শুরু করলো সে।

এটা স্রেফ…পাগলামি, কথাটা বলার সময় কিছুটা তোতলালে অ্যাম্ব্রা। এজেন্টরা দেখেছে, আমি নিজের ইচ্ছায় জাদুঘর থেকে বের হয়ে এসেছি।

ফোনের স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে আছে ল্যাংডন, হজম করার চেষ্টা করছে। কথাগুলো। তার মাথায় অনেকগুলো ব্যাপার একসাথে ঘুরপাক খেলেও একটা ব্যাপারে একদম নিশ্চিত সে।

খুব বড় ধরণের বিপদে পড়তে যাচ্ছে শিঘ্রই।

.

অধ্যায় ৫৬

আমি খুবই দুঃখিত, রবার্ট, অপরাধি কণ্ঠে বলল অ্যাম্ব্রা। ভয় খেলা করছে তার বড় বড় চোখদুটোতে। এই বানোয়াট কাহিনীর পেছনে কার হাত সেটা জানি না আমি, কিন্তু আপনাকে অনেক বড় বিপদে ফেলে দিয়েছে ব্যাপারটা, স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী পকেট থেকে এডমন্ডের ফোনটা বের করলো। মনিকা মার্টিনকে এখনই ফোন দিচ্ছি আমি।

না, ফোন দেবেন না, উইনস্টন বলে উঠলো। ওরা চাইছে আপনি যাতে ঠিক এই কাজটাই করেন, আর সাথে সাথে আপনার অবস্থান জেনে যাবে ওরা। মাথা পরিষ্কার করে ভাবুন। আপনার সাথে গার্ডিয়ার যে দুজন এজেন্ট ছিল তারা ভালোমতোই জানে, প্রফেসর ল্যাংডন আপনাকে অপহরণ করেননি। তবুও মিথ্যেটাকে সমর্থন করে আপনাদের খোঁজে বার্সেলোনায় চলে এসেছে তারা। প্রাসাদের সবাই এটার সাথে জড়িত। আর রয়্যাল গার্ডের কমান্ডারকে যেহেতু আটক করা হয়েছে সেহেতু এই নির্দেশগুলো আসছে আরো ওপর মহল থেকে।

মানে…হুলিয়ান? ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করলো অ্যাম্ব্রা।

এটাই যুক্তিযুক্ত উত্তর, উইনস্টন বলল। একমাত্র প্রিন্সেরই ক্ষমতা আছে কমান্ডার গারজাকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়ার।

বেশ খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলে অ্যাম্ব্রা। ল্যাংডন বুঝতে পারলো, এতক্ষণ মনে মনে প্রিন্স হুলিয়ানের এসবের সাথে অসম্পৃক্ততার যে ক্ষীন আশা ধারণা করছিল অ্যাম্ব্রা, সেটুকুও মুছে গেল।

এডমভের আবিষ্কারের সাথে জড়িত এসব, বলল ল্যাংডন। প্রাসাদের কেউ একজন জানে আমরা এডমন্ডের আবিষ্কার সবার কাছে উন্মুক্ত করে। দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি, তাই আমাদের যেকোন মূল্যে থামাতে চাইছে তারা।

বোধহয় তারা ভেবেছিল, এডমন্ডকে চুপ করিয়ে দিলেই আশঙ্কা কেটে যাবে, উইনস্টন তাল মিলালো ল্যাংডনের সাথে। অন্য কেউ যে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব নিতে পারে সেটা ধারণায় আসেনি তাদের।

একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসলো লাইব্রেরিটায়। অ্যাম্ব্রা, অবশেষে বলল ল্যাংডল প্রিন্স হুলিয়ানকে চিনি না আমি, কিন্তু আমার সন্দেহ, বিশপ ভালদেসপিনো তাকে নিয়ন্ত্রন করছে। একটা ব্যাপার ভুললে চলবে না, গুগেনহাইমে এডমন্ডের অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেও এডমন্ড আর ভালদেসপিনোর মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো সে, অনিশ্চিয়তা ভর করেছে তার চেহারায়, যাই হোক না কেন, আপনি বিপদে পড়তে যাচ্ছেন।

এসময় বাইরে থেকে ভেসে আসা সাইরেনের শব্দে চমকে উঠলো দুজনেই।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল ল্যাংডনের। কবিতাটা এখনই খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, এই বলে দেখতে লাগলো তাকগুলোতে। এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দিলেই কেবলমাত্র বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারবো আমরা। কারণ ততক্ষণে আমাদের প্রতিপক্ষ বুঝতে পারবে যে দেরি হয়ে গেছে তাদের।

ঠিক, বলল উইনস্টন। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আপনার জন্যে খোঁজ অব্যাহত রাখবে। তাদের চোখে আপনি একজন অপহরণকারী। রাজ প্রাসাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের মত করেই লড়তে হবে আপনাদের।

কিভাবে সেটা? জানতে চাইলে অ্যাম্ব্রা।

গণমাধ্যমকে আপনাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাচ্ছে তারা, কালক্ষেপণ না করে জবাব দিলো উইনস্টন। কিন্তু এতে তাদেরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে।

উইনস্টনের প্রস্তাবটা শান্তভাবে শুনলো ল্যাংডন এবং অ্যাম্ব্রা। স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে তার কথা মত কাজ করলে বিভ্রান্তি এবং বিশঙ্খলা শুরু হবে প্রতিপক্ষ শিবিরে।

কাজটা করবো আমি, সাথে সাথে সম্মতি জানালো অ্যাম্ব্রা।

আপনি নিশ্চিত? জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন। পরে কিন্তু আপনার ঝামেলা হতে পারে।

রবার্ট, বলল সে, আমি আপনাকে এই বিপদের মধ্যে টেনে এনেছি। প্রাসাদ থেকে গণমাধ্যমকে আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এখন আমি সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করবো তাদের ওপর।

ঠিক, বলল উইনস্টন, তরবারি যদি কারো জীবনের মূলমন্ত্র হয়, তবে তার নিজের মৃত্যুও হবে তরবারির আঘাতেই।

বিষম খাবার উপক্রম হলো ল্যাংডনের। এডমন্ডের কম্পিউটার কি আসলেও অ্যাস্কিলাসের উক্তি উদ্ধৃত করলো? নিৎশের একটা উক্তিও এই ঘটনার সাথে মানানসই : দুষ্টের দমনকারি নিজেই যাতে দুষ্টে পরিণত না হয় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা জরুরি।

ল্যাংডন বাঁধা দেবার আগেই এডমন্ডের ফোন হাতে নিয়ে নিচের হলের দিকে রওনা দিলো অ্যাম্ব্রা, পাসওয়ার্ডটা খোঁজার চেষ্টা করুন, রবার্ট, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল সে। এখনই ফিরছি আমি।

তাকে কাসা মিলার পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যেতে দেখলো ল্যাংডন। সাবধানে, পেছন থেকে সতর্ক করে দিলো সে।

এডমন্ডের অ্যাপার্টমেন্টে এখন একা ল্যাংডন। চিলেকোঠার সর্পিলাকার হলওয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এখানে আসার পরে দেখা বিস্ময়কর শিল্পগুলো নিয়ে-নিৎশের বিখ্যাত একটি উক্তি বাধাই করা এডমন্ডের বিছানার ওপর, পল গগ্যাঁর আঁকা একটা ছবি যেটা কিনা এডমন্ডের মতনই প্রশ্ন করে এলেম আমরা কোথা থেকে? যাচ্ছিই বা কোথায়?

এখন পর্যন্ত এমন কিছু চোখে পড়েনি ওর, যেটা এডমন্ডের আবিষ্কারকে উন্মুক্ত করতে সহায়তা করবে ওদের। লাইব্রেরির কেবলমাত্র একটা বইই কিছুটা আগ্রহের খোরাক যুগিয়েছিল-Unexplained Art-এমন বই যেখানে মানবসৃষ্ট অদ্ভুত সব স্থাপত্যের ছবি স্থান পেয়েছে, যেমন স্টোনহেঞ্জ, ইস্টার আইল্যান্ডের মানব চেহারার আদলে গড়া মূর্তি, পেরুর নাহকা মরুভূমির অদ্ভুত রেখাচিত্র-যেগুলো এত বিস্তৃত পরিসরে আঁকা যে কেবল মাত্র আকাশ থেকেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়।

লাভ হচ্ছে না, অন্য তাকগুলোতে দেখতে শুরু করলো ল্যাংডন। বাইরে সাইরেনের আওয়াজ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে।

.

অধ্যায় ৫৭

আমি কোন সন্ত্রাসি নই! আভিলা বলল তার উবার ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে একটা হাইওয়ে রেস্ট স্টপে থেমেছে তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে।

তার পাশে কাঁপছে লোকটা। কিন্তু…আপনি আমার পরিবারকে হুমকি দিয়েছেন, তোতলাতে তোতলাতে বলল সে।

তুমি যদি আমার কথামতো চলো, জবাবে বলল আভিলা। তোমাকে কথা দিচ্ছি, কোন ক্ষতি হবে না তাদের। আমাকে বার্সেলোনায় নামিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে তোমার। বন্ধুর মত একে অপরের কাছ থেকে তখন বিদায় নিতে পারবো আমরা। তোমার ওয়ালেট ফিরিয়ে দেবো, এমনকি তোমার বাসার ঠিকানাও ভুলে যাবো। আমাকে নিয়ে আর কখনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না তোমাকে।

নিস্পলক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো গাড়ি চালক।

তুমি একজন বিশ্বাসি, আভিলা বলল, তোমার উইন্ডশিল্ডে পাপাল ক্রুশ দেখেছি আমি। আমাকে নিয়ে যে ধারণাই হোক না কেন তোমার, একটা কথা শুনে রাখো, আমাকে সাহায্য করলে পক্ষান্তরে ঈশ্বরকেই সাহায্য করা হবে, ইউরিনালে কাজ শেষ করে পেছনে সরে দাঁড়ালো আভিলা, বলল, ঈশ্বরের রহস্য বোঝা দায়।

সিঙ্কের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলো সে। বেল্টে গোঁজা সিরামিকের বন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখলো একবার, একটা মাত্র গুলি আছে আর। ভাবলো, আজ রাতে সেটা ব্যবহার করতে হবে কিনা। হাতের তালুর ট্যাটুতে চোখ গেল এসময়। বাড়তি সতর্কতা-এখন অবধি কোন কাজে আসেনি এটা। নিজেকে আঁধারের বুক চিড়ে এগিয়ে যাওয়া এক ছায়াশ্বাপদ মনে হচ্ছে ওর কাছে।

নোংরা আয়নাটার দিকে তাকালো ও, অবাক হয়ে গেল নিজের চেহারা দেখে। শেষবার যখন আয়নায় নিজেকে দেখেছিল আভিলা, ধবধবে সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরণে ছিল তার, একদম পরিপাটি। এখন ইউনিফর্মটা খুলে ফেলায় একজন সাধারণ ট্রাক ড্রাইভারের মত দেখাচ্ছে ওকে। একটা ভি গলার টিশার্ট আর মাথায় ড্রাইভারের কাছ থেকে নেয়া ক্যাপ।

আয়নার লোকটাকে দেখে সেই ঘটনার পরপর নিজের অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল আভিলার। সারাদিন মদ খেতো আর বসে বসে ঝিমাতো সে। ভেতরে ভেতরে আত্মঘৃণা কুরে কুরে খেতো তাকে।

এক তিমিরাচ্ছন্ন অতল গহ্বরে আটকা পড়েছিল সে।

কিন্তু তার ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট মার্কো যেদিন তাকে পোপের কাছে নিয়ে যায় সেদিন থেকেই বদলাতে শুরু করে আভিলার ভাগ্য।

পালমেরিয়ান চার্চের সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা কখনো ভুলবে না সে। হাঁটু গেঁড়ে প্রার্থনারত লোকদের মাঝ দিয়ে ক্যাথেড্রালের ভেতরে প্রবেশ করেছিলো আভিলা।

বিশাল উপাসনালয়ের আলোর একমাত্র উৎস জানালা দিয়ে প্রবেশ করা প্রাকৃতিক আলো। ধূপের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল অনেক দূর থেকে। সোনালি। বেদি আর পিউ নামে পরিচিত বার্নিশ করা কাঠের গির্জার আসন দেখে বুঝতে পারে, এতদিন শুনে আসা পালমেরিয়ানদের অগাধ সম্পত্তির গুজব আসলে মিথ্যে নয়। এটার আগে যতগুলো ক্যাথেড্রাল দেখেছিল সে, সেগুলোর মতনই দেখতে চাৰ্চটা। তবুও এই ক্যাথলিক চার্চ যে অন্য চার্চগুলো থেকে ভিন্ন সেটা জানত।

ভ্যাটিকানদের শত্রু পালমেরিয়ানরা।

ক্যাথেড্রালের পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে আভিলা ভাবছিল, সরাসরি রোমের বিরোধিতা করার পরেও কিভাবে এতদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই চার্চ। ভ্যাটিকানের ক্রমবর্ধমান উদারনীতির প্রকাশ্য নিন্দা করে তারা। এতে করে রক্ষণশীল ক্যাথলিকদের বেশ বড় একটা অংশের সমর্থন পেয়েছিল পালমেরিয়ানরা।

ক্রাচে ভর দিয়ে বেঞ্চের সারির মাঝ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আভিলার মনে হচ্ছিল যেন অলৌকিক আরোগ্যের আশায় লুৰ্ড চার্চের উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছে সে। একজন সহকারি যাজক এসে স্বাগত জানায় মার্কো এবং আভিলাকে, একদম সামনের সারিতে নিয়ে বসানো হয় তাদেরকে। আশেপাশের লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল যে, কাকে এভাবে বিশেষ সম্মান দেখানো হচ্ছে। সেদিন আভিলার মনে হয়েছিল, মার্কোর কথা শুনে তার নাভাল ইউনিফর্মটা না পরলেই বোধহয় ভালো হতো।

আমি ভেবেছিলাম পোপের সাথে দেখা হতে যাচ্ছে আমার।

বসার পর প্রধান বেদির দিকে চোখ যায় আভিলার। একজন যাজক বাইবেল থেকে পড়ে শোনাচ্ছে সেখানে। আখ্যানটা চিনতে পেরেছিল আভিলা-মার্কের গসপেল।

যদি কারো বিরুদ্ধে কোন আক্ষেপ চেপে রাখো তুমি, যাজক পড়তে লাগলো, ক্ষমা করে দাও তাদের, যেমনটা স্বর্গ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। তোমার সব পাপ।

আবার ক্ষমা? বিরক্তি ভর করলো আভিলার মনে। কাউন্সিলর আর নানদের কাছ থেকে এই ক্ষমার বাণী শুনতে শুনতে ঘেন্না ধরে গেছে ওর। সন্ত্রাসিদের সেই হামলার পর থেকে এই একই কথা শুনতে হয়েছে ওকে।

বাইবেল পাঠ শেষ হলে পাইপ অর্গানের আওয়াজ ভেসে আসে চারপাশ থেকে। উঠে দাঁড়ায় সবাই। পায়ের প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও তাদের সাথে উঠে দাঁড়ায় আভিলা। বেদির পেছনের একটা গুপ্ত দরজা খুলে গেলে সেখান দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন একজন। তাকে দেখামাত্র গুঞ্জন ওঠে উপস্থিত সবার মধ্যে।

সৌম্যদর্শন লোকটার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে হবে। একটা সাদা। রঙের কাসোক তার পরনে, কাঁধ থেকে ঝুলছে সোনালি টিপেট আর মাথায় সোনালি মুকুটের ন্যায় পাপাল মাইটার। হাত সামনে বাড়িয়ে সবাইকে

অভিবাদনের ভঙ্গিতে সামনে এগোলেন তিনি।

এসে গেছেন তিনি, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে মার্কো, পোপ চতুর্দশ ইনোসেন্ট।

নিজেকে চতুর্দশ পোপ ইনোসেন্ট দাবি করেন তিনি? মনে মনে ভাবে আভিলা। এটা ওর জানা আছে যে ১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করা পোপ পল দ্য সিক্সথকেই শেষ বৈধ পোপ হিসেবে মান্য করে পালমেরিয়ানরা।

বেদি থেকে সাধারণ মানুষদের কাতারে নেমে আসেন পোপ। মাইক্রোফোন ঠিক করে আন্তরিক একটা হাসি দেন তিনি।

শুভ সকাল, সবার উদ্দেশ্যে বলেন।

শুভ সকাল, ধর্মসভার সবাই একসাথে জবাব দেয়।

কিছুক্ষণ আগে মার্কের গসপেল থেকে উদ্ধৃতি শুনছিলাম আমরা। আমি নিজেই ঠিক করে দিয়েছিলাম কোনটুকু পড়তে হবে, কারণ আজ ক্ষমাশীলতা নিয়ে কথা বলবো আমরা।

একদম আভিলার সামনে এসে দাঁড়ান পোপ, একটু ওপরে। চোখ উপস্থিত সবার দিকে। অস্বস্তি নিয়ে মার্কোর দিকে তাকায় সে। মাথা নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করে মার্কো।

ক্ষমা করতে মাঝে মাঝে বেগ পেতে হয় আমাদের, ধর্মসভার সবার উদ্দেশ্যে বলেন পোপ। কারণ কিছু কিছু ব্যাপার ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে হয়। কেউ যদি কেবল ব্যক্তিগত ঘৃণাবশত হত্যা করে নিষ্পাপ মানুষদের, তখন কি তার দিকে আসলেও অন্য গালটা এগিয়ে দেয়া উচিত? এমনটাই কিন্তু শেখানো হয় অনেক চার্চে, অখণ্ড নীরবতা নেমে আসে গোটা উপাসনালয়ে। সেভিয়ার ক্যাথেড্রালে ক্যাথলিক বিরোধিদের বোমা আক্রমনে অসংখ্য নিরীহ নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়, তবুও তাদের ক্ষমা করে দিতে হবে? বোমা বর্ষণ তো যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। শুধু ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় এটা, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও নয়…স্বয়ং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে!

চোখ বন্ধ করে সেদিনকার সকালবেলার স্মৃতি মনের পর্দা থেকে দূর করার চেষ্টা করলো আভিলা। ভেতরে দলা পাকানো ক্রোধ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। এসময় কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো সে। চোখ খুলে দেখলো পোপ হাত রেখেছেন ওর কাঁধে, কিন্তু তার দৃষ্টি এখনও সামনের দিকে। কিছুটা শান্ত হয়ে আসলো ওর মন।

আমাদের নিজেদের টেরর রোহো সম্পর্কেও ভুলে গেলে চলবে না, আভিলার কাঁধে হাত রেখেই বলতে থাকেন পোপ। স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ, রেড টেরর নামেও পরিচিত। গৃহযুদ্ধের সময় ঈশ্বরের শত্রুরা স্পেনের বেশিরভাগ চার্চে আগুন দেয়, ছয় হাজারেরও বেশি যাজককে হত্যা করে, অত্যাচার চালানো হয় নানদের ওপর, সিস্টারদের বাধ্য করা হয় তাদের জপমালা গিলে খেতে। এরপর তাদের ছুঁড়ে ফেলা হয় খনির অন্ধকার গহ্বরে, এটুকু বলে কিছুক্ষণ থামলেন তিনি। এরকম পাশবিকতা কিন্তু চিরদিনের জন্যে থেমে থাকবে না, আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিছুদিন পর। বন্ধুরা, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, অশুভ। শক্তি আমাদের গ্রাস করে নেবে যদি না উপযুক্ত জবাব দেই আমরা। শুধুমাত্র ক্ষমাশীলতা নিয়ে বসে থাকলে হবে না।

ঠিক বলছেন তিনি, ভাবলো আভিলা। সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে, যদি অসদাচরণের কোন শাস্তি না দেয়া হয়, তবে সেটা অসদাচরণের ক্রমশ বৃদ্ধির জন্যে সহায়ক হবে।

আমার বিশ্বাস, পোপ বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমা বিপজ্জনক। আমরা যদি অশুভ শক্তিকে ক্ষমা করে দেই, এর অর্থ দাঁড়াবে আমরা অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করছি। তাদের শক্তির ব্যাপ্তিতে সহায়তা করছি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যদি ক্ষমাশীলতা নিয়ে এগোতে চাই আমরা, তাহলে শত্রুরা সেফ কচুকাটা করবে আমাদের। জিশুর মতই একসময় রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে!

একমত! চিৎকার করে বলার ইচ্ছে হলো আভিলার। আশেপাশে সবাই সম্মতি জানালো পোপের সাথে।

কিন্তু আসলে কি কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়? জিজ্ঞেস করলেন পোপ, রোমের ক্যাথলিক চার্চ কি জিশুর মত রুখে দাঁড়ায়? না, দাঁড়ায় না। আজও অশুভের মোকাবেলা করার আমাদের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ভালোবাসা, কিন্তু। এতে করে তাদের আরো সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আমরা নিজেদের বোঝাই যে। একজন খারাপ মানুষ খারাপ হয়েছে সমাজের কারণে, অসুস্থ শৈশবের কারণে-তাই পৃথিবীর সবার প্রতি তার ঘৃণা জন্মানোটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলবো, যথেষ্ট হয়েছে! আর এরকমটা ভাবা চলবে না। খারাপকে খারাপই। বলতে হবে। আমাদের সবাইকেই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ভুগতে হয়।

প্রশংসার ধ্বনিতে সরব হয়ে উঠলো গোটা চার্চ। কোন ক্যাথলিক চার্চে এর আগে কখনও এমনটা হতে দেখেনি আভিলা

আজকে ক্ষমাশীলতা নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটা কারণে, বললেন পোপ, এখনও আভিলার কাঁধে হাত তার, আমাদের মাঝে বিশেষ একজন অতিথি আছেন আজ। অ্যাডমিরাল লুই আভিলাকে আমাদের মাঝে উপস্থিত হবার জন্যে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। স্পেনের সামরিক বাহিনীর একজন সদস্য তিনি। অকল্পনীয় বেদনার সাথে যুঝতে হয়েছে তাকে।

আভিলা কিছু বলার আগেই সবাইকে তার জীবন ইতিহাস শোনানো শুরু করলেন পোপ। কিভাবে বোমা বিস্ফোরণে পরিবারের সবাইকে হারাতে হয় তাকে, এরপর ঘোর অমানিশার মত তার জীবনে নেমে আসে মদ্যপানের। অভ্যাস, অবশেষে ব্যর্থ আত্মহত্যার চেষ্টা। তার কথা নিশ্চয়ই মার্কো খুলে বলেছে পোপকে, এটা ভেবে তার ওপর আভিলার রাগ হলেও পোপের মুখে নিজের জীবন কাহিনী শোনার পর নিজেকে অন্য আলোয় আবিষ্কার করলো

সে। উপস্থিত সবাই কায়মনোবাক্যে মেনে নিয়েছে যে এত দুর্ঘটনার পরেও তার বেঁচে থাকাটা অলৌকিক।

আমার ধারণা, পোপ বললেন, ঈশ্বর আভিলার জীবনে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন কোন মহৎ উদ্দেশ্যে।

এটুকু বলে প্রথমবারের মত পোপ ইনোসেন্ট দ্য ফোরটিন্থ সরাসরি তাকালেন আভিলার চোখের দিকে। এক সম্মোহনী শক্তি যেন খেলা করছে তার দৃষ্টিতে।

অ্যাডমিরাল আভিলা, নরম স্বরে বললেন পোপ, আপনার সাথে যা ঘটেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। যে অসীম ক্রোধ দানা বেধেছে আপনার অন্তরে সেটাকে প্রশমিত করা যাবে না খুব সহজে-আর সেটা প্রশমিত করার কোন দরকারও নেই। আপনার বেদনা হবে আমাদের পরিত্রাণের চালিকাশক্তি। এখানে আমরা সবাই আপনার সহায়তায় কাজ করবো। আপনার ক্রোধকে পৃথিবীর ভালোর জন্যে কাজে লাগাতে সাহায্য করবো। ঈশ্বর আমাদের মঙ্গল করুন!

ঈশ্বর আমাদের মঙ্গল করুন, সমস্বরে বলে উঠলো সবাই।

অ্যাডমিরাল আভিলা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল পোপ, বলুন তো স্প্যানিশ আরমাডা নৌবহরের মূল মন্ত্র কি ছিল?

ঈশ্বর এবং মাতৃভূমির জন্যে, সাথে সাথে জবাব দিলো আভিলা।

হ্যাঁ, ঈশ্বর এবং মাতৃভূমির জন্যে। আজ আমাদের মধ্যে এমন একজন নাভাল অফিসার উপস্থিত আছেন যিনি একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের জন্যে, এটুকু বলে নিচে ঝুঁকে আসলেন পোপ, কিন্তু ঈশ্বরের জন্যে দায়িত্ব পালন করবেন না?

পোপের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হঠাই অস্বস্তিবোধ হলো আভিলার।

আপনার জীবনের এখনও অনেকটা বাকি, অ্যাডমিরাল, ফিসফিসিয়ে বললেন পোপ, আপনার দায়িত্ব এখনও শেষ হয়নি। সেজন্যেই আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ঈশ্বর। যে শপথ নিয়েছিলেন তার কেবল অর্ধেকটা পালন করেছেন আপনি, দেশের জন্যে খেটেছেন…কিন্তু এবার ঈশ্বরের জন্যে খাটবার পালা।

আভিলার মনে হয়েছিল কেউ যেন এক ইঞ্চি দূরত্ব থেকে বুলেট বিদ্ধ করেছে ওকে।

শান্তি বর্ষিত হোক আপনাদের ওপর! এই বলে শেষ করেন পোপ।

এরপর সবাই এগিয়ে এসে সহমর্মিতা প্রকাশ করে আভিলার জন্যে। অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয় সে। তাদের চোখে ধর্মান্ধতা খোঁজার চেষ্টা করে আভিলা, কিন্তু সেখানে কেবল ঈশ্বরের জন্যে অগাধ ভালোবাসা চোখে পড়ে তার। ঠিক এই জিনিসটার খোঁজেই এতদিন ছিল সে।

সেদিনের পর থেকে মার্কো এবং অন্য শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায় সেই তিমিরাচ্ছন্ন গহ্বর থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে বের করে আনতে সক্ষম হয় সে। আগের মত নিয়ম মাফিক জীবন যাপনে ফিরে যায় আভিলা, সেই সাথে ফিরে পায় বিশ্বাস।

তার ফিজিক্যাল থেরাপি শেষ হবার কয়েক মাস পর মার্কো একটা চামড়ায় বাঁধানো বাইবেল উপহার দেয় আভিলাকে। সেখানে কয়েকটা

পরিচ্ছেদ বিশেষভাবে চিহ্নিত।

সেগুলো থেকে একটা পরিচ্ছেদ তখনই পড়ে ফেলে সে।

রোমান ১৩:৪।

ঈশ্বরের হয়ে যে শাস্তি দেবে পাপীদের-একজন আদর্শ বিশ্বাসি সে।

মনে রাখবেন, তার উদ্দেশ্যে হেসে বলে মার্কো, পৃথিবীতে যখন অশুভ শক্তি রাজত্ব কায়েম করে, তখন আমাদের প্রত্যেককে দিয়ে একেকভাবে নিজের ইচ্ছে পূরণ করান ঈশ্বর। ক্ষমা করে দেয়াই কিন্তু পরিত্রাণের একমাত্র উপায় নয়।

.

অধ্যায় ৫৮

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

যত দ্রুত সম্ভব আমাদের আরো জানান, আপনি যে-ই হয়ে থাকুন না কেন!

আপনারা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন, আজ রাতে আমরা যত তথ্য পেয়েছি সেগুলোর বেশিরভাগই আমাদেরকে সরবরাহ করেছে [email protected] নামের একজন অজ্ঞাত জনপ্রতিনিধি।

আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচিছ আমরা। Monte আমাদের যে তথ্যগুলো দিয়েছেন সেগুলোর সবগুলোই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই তার কাছে একটা অনুরোধ থাকবে আমাদের :

Monte, আপনার কাছে যদি এডমন্ড কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন নিয়ে কোন তথ্য থেকে তাহলে নির্দ্বিধায় যত দ্রুত সম্ভব সেগুলো আমাদের জানার সুযোগ করে দিন।

#এলেমআমরাকোথাথেকে

.

অধ্যায় ৫৯

এডমন্ডের লাইব্রেরির বাকি তাকগুলোতে দেখতে দেখতে একটু হতাশ না হয়ে পারলো না ল্যাংডন। তাহলে কি পাসওয়ার্ডটা পাবে না ওরা? বাইরে থেকে যে সাইরেনের আওয়াজ ভেসে আসছিল এতক্ষণ সেটা কাসা মিলার একদম সামনে এসে থেমে গেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ছোট ছোট জানালা গলে পুলিশের গাড়ির লাল নীল আলো দেখা যাচ্ছে।

এখানে ফাঁদে পড়ে গেছি আমরা, ভাবলো ও। সাতচল্লিশ অক্ষরের পাসওয়ার্ডটা দরকার যে কোন মূল্যে, নাহলে শেষ রক্ষা হবে না।

কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্য, এই পর্যন্ত একটা কবিতার বইও চোখে পড়েনি ওদের।

লাইব্রেরির শেষ অংশের তাকগুলো অন্য তাকগুলোর তুলনায় বেশ প্রশস্ত। বড় বড় আর্টের বই রাখা আছে এখানে। বইয়ের নামগুলো দেখে বুঝতে পারলো এডমন্ডের পছন্দের সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির নিদর্শন ধারণ করছে ওগুলো।

সেইরা…কুনস…হাস্ট..ব্লগেরা…বাঁক…ব্যাঙ্কসি…আব্রামোভিচ…

কোন কবিতার বই পাবার আশা ছেড়েই দিলো ল্যাংডন। এখানকার বইগুলোতে আছে শিল্পকলা সম্পর্কে গম্ভীর সব আলোচনা আর গবেষণামূলক কাজ। কয়েকটা বই চোখে পড়লো যেগুলো ওর জন্যেও পাঠিয়েছিল এডমন্ড।

What Are You Looking At?

Why Your Five-Year-Old Could Not Have Done That

How To Survive Modern Art

এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি এই ধরণের আর্ট, ল্যাংডন ভাবলো। এরপরের তাকে যে বইগুলো রাখা সেগুলোও মডার্ন আর্টের আওতায় পড়লেও শিল্পীদের নামগুলো পরিচিত ঠেকলো ওর কাছে। এদের কাজ কিছুটা হলেও বুঝি আমি। ধীরে ধীরে পুরনো আমলের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের বইয়ের দেখা মিলতে লাগলো। ১৮৭০ সাল থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যবর্তি এই শিল্পীরা প্রচলিত আর্টের সংজ্ঞাই বদলে দেন।

ভ্যানগগ…পিকাসো…মুঞ্চ…মাতিস…ম্যাগ্রাত… ক্লিত…ক্যান্ডিন্সকি…জনস… হকনি…গগ্যাঁ..দুক্যাম্প…ডেগা…শাগাল…সেজান…ক্যাসাত…ব্রাক…আর্প…অ্যালবারস…

বিখ্যাত শব শিল্পীদের মেলা।

লাইব্রেরির একদম শেষ অংশে চলে আসলো ল্যাংডন, এখানে যে আর্ট ভলিউমগুলো আছে সেগুলোর শিল্পীদের সম্পর্কে এডমন্ড বলতো মৃত শ্বেতাঙ্গ শিল্পীদের সমারোহ। মূলত উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগেকার শিল্পী তারা।

কিন্তু এই নামগুলোই বেশি পরিচিত ঠেকে ল্যাংডনের কাছে।

ভার্মিয়া…ভেলাকুয়েজ…তিতিয়ান…তিনতোরেত্তো…রুবেন্স…রাফায়েল…পুসিন…মাইকেলাঞ্জেলো…গয়া…জিওতো…এলগ্রেসো…ভিঞ্চি…কারাজ্জিও…বতিচেল্লি…বস্ক…লিপ্পি…

শেষ তাকটার বাম পাশের অংশে একটা বিশাল কাঁচের কেবিনেট। ওটার ভেতরে উঁকি দিয়ে পুরনো একটা চামড়ার বাক্স দেখতে পেলো ল্যাংডন। অনেক পুরনো কোন বই নিশ্চয়ই রাখা আছে ওটার ভেতরে। আবছা আলোয় বাক্সটার বাইরের অংশে লেখা নামটা কোনমতে পড়তে পারলো।

ঈশ্বর! বুঝতে পারলো, কেন এটাকে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়েছে নিশ্চয়ই এটার পেছনে।

খুবই দুষ্প্রাপ্য একটা কাজ। আসলে একটা কাজ বললে ভুল হবে, একজন শিল্পীর সবগুলো কাজের একটা ভলিউম। যে সে শিল্পী নয়, ব্রিটিশ আর্টের বহুল আলোচিত একটা নাম। তার অঙ্কিত ছবিগুলো এতটাই অদ্ভুত ছিল যে অনেকে বলতো, ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন তিনি।

এডমন্ডের সাথে অনেক মিল এই শিল্পীর।

নিচু হয়ে আবারো বাক্সের গায়ে লেখা নামটা পড়লো ল্যাংডন :

The Complete works of William Blake

উইলিয়াম ব্লেক, ভাবলো ল্যাংডন, অষ্টাদশ শতাব্দির এডমন্ড কিয়ার্শ।

তার ছবিগুলোতে প্রাধান্য পেতো ধর্মিয় বিভিন্ন ধরণের সংকেত, বাইবেলের বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার কাল্পনিক চিত্র আর নিজ কল্পনার অদ্ভুত সব সত্তা।

আর ঠিক কিয়ার্শের মতন, ব্লেকও খ্রিস্টধর্মের প্রতি বেকায়দা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পছন্দ করতো।

ভাবনাটা তড়াক করে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করলো ল্যাংডনকে।

উইলিয়াম ব্লেক!

এতজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর কাজের মাঝে ব্লেকের নাম দেখে একটা ব্যাপার ভুলেই গিয়েছিল ল্যাংডন।

ব্লেক যে শুধু একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন তা নয়…

একজন গুণী কবিও ছিলেন তিনি।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল ল্যাংডনের। ব্লেকের বেশিরভাগ কবিতার বিষয়বস্তু আর এডমন্ডের চিন্তাধারার বিষয়বস্তু প্রায় একই ধাঁচের। এমনকি কেউ যদি বলে, ব্লেকের সবচেয়ে সমালোচিত কাজThe Marriage of Heaven and Hell-এডমন্ড নিজে লিখেছে, তবে সেটা বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হবে না ওর।

সেখানে ব্লেক বলেছেন :

সব ধর্মই এক।

অ্যাম্রাকে এডমন্ড তার নিজের পছন্দের কবিতার পঙক্তির ব্যাপারে যা বলেছিলো সেটা মনে করার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। একটা ভবিষ্যৎবাণী। আর ব্লেককে ভবিষ্যত থেকে আগত কবি বলার পেছনে প্রধান দুটি কারণ তার লেখা। দুটি ভয়ংকর কবিতা।

America A Prophecy
Europe A Prophecy

ল্যাংডনের সংগ্রহে দুটো কাজই আছে। ব্লেক যে ডায়রিতে লিখেছিলেন কবিতাগুলো, সেগুলোর সুন্দর অনুলিপি করে বিশেষ সচিত্র সংস্করণ বের করা হয়েছিল।

ক্যাবিনেটের ভেতরের বাক্সটার দিকে আবার তাকালো ল্যাংডন।

ওটার ভেতরে নিশ্চয়ই কবিতাগুলোর মূল সংস্করণ আছে। অনেক বড় পরিসরে ছাপানো হয়েছিল ওগুলো। এতক্ষণ ওরা যা খুঁজছে সেটা এই চামড়ার বাক্সের ভেতরে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। সাতচল্লিশ অক্ষরের একটা পঙক্তি। এডমন্ড হয়ত চিহ্নিত করে রেখেছে ওটাকে। ক্যাবিনেটের হাতল ধরে টান দিলো ল্যাংডন।

তালা দেয়া।

ল্যাংডন একবার ভাবলো, ওপর তলায় উঠে গিয়ে অ্যাম্ব্রার কাছে থেকে। স্মার্টফোনটা নিয়ে উইনস্টনকে উইলিয়াম ব্লেকের কবিতাগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু এই সময় একটা হেলিকপ্টারের আওয়াজ কানে আসলো ওর।

এসে গেছে ওরা।

ক্যাবিনেটের সবুজাভ কাঁচের দিকে দৃষ্টি ফেরালো আবার। সাধারণ জাদুঘরে যেরকম কাঁচ দেখা যায়, অতিবেগুনির রশ্মি রোধক।

পরণের জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে কাঁচের ওপর ধরলো ওটাকে। এরপর বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ না করে কনুই দিয়ে জোরে এক ধাক্কায় ভেঙে ফেললো ক্যাবিনেটের কাঁচের দরজাটা। ভেতর থেকে চামড়ার বাক্সটা বের করে নিয়ে এলো।

বাক্সটা হাতে নেয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলো, কিছু একটা সমস্যা আছে। যেমনটা ভারি হবার কথা ছিল তেমন ভারি না ওটা। আসলে কোন ওজনই নেই যেন।

সাবধানে বাক্সের ঢাকনাটা খুললো।

যেমনটা ভয় পেয়েছিল…খালি।

কোথায় গেল বইটা?!

বাক্সটা বন্ধ করে রাখবে এমন সময় ঢাকনার সাথে একটা জিনিস লাগানো অবস্থায় দেখতে পেলো ও। এম্বস করা দামি লিনেন কাগজের একটা নোট কার্ড।

কার্ডটার লেখাগুলো পড়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ল্যাংডনের। আবারো পড়লো লেখাটা।

সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটলো।

*

ঠিক সেই মুহূর্তে মাদ্রিদের রাজ প্রাসাদের দোতলায় ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির পরিচালক সুরেশ ভাল্লা সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে প্রিন্স হুলিয়ানের ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। ভেতরে ঢুকে ডিজিটাল সেফটার সামনে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ওটা খুলে ফেললো সে। জরুরি অবস্থার জন্যে যে পাসওয়ার্ডটা ঠিক করা ছিল, সেটা আগে থেকেই ও জানতো।

ভেতরে দুটো ফোন। একটা রাজ প্রাসাদ থেকে দেয়া স্মার্টফোন, যেটা প্রিন্স হুলিয়ান ব্যবহার করেন। আরেকটা আইফোন, এটা অবশ্যই বিশপ ভালদেসপিনোর সম্পত্তি।

আইফোনটা তুলে নিলো ও।

কাজটা কি আসলেও ঠিক হচ্ছে?

[email protected] থেকে আগত মেসেজটার কথা ভাবলো আরেকবার।

ভালদেসপিনোর মোবাইল হ্যাক করেছি আমি।

তার পাঠানো মেসেজটা পড়েছি।

কিছু বিপজ্জনক কাজ করছেন তিনি।

রাজ প্রাসাদ থেকে তার এসএমএস রেকর্ড খতিয়ে দেখা হোক যত দ্রুত সম্ভব।

.

বিশপের ফোনের ইনবক্সে কী এমন মেসেজ থাকতে পারে বুঝতে পারলো সুরেশ। আর কেনই বা ওদের সাহায্য করতে চাইছে অজ্ঞাত তথ্যদাতা? হয়তো প্রাসাদের লোকদের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যেই এমনটা করেছে। সে। আর যদি কোন তথ্য প্রাসাদের কারো কোন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সেটা খতিয়ে দেখা সুরেশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

একবার ভাবলো, অফিস থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে আইফোনটা খুলবে, কিন্তু আজকের যেরকম পরিস্থিতি, যা করার দ্রুত করতে হবে। ওসব দাপ্তরিক কাজে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

আইফোনের হোম বাটনে চাপ দিলো সে। লক করা ফোনটা।

সমস্যা নেই। আমি জানি কী করতে হবে।

ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে হোম বাটন চেপে বলল, হ্যালো সিরি, এখন কয়টা বাজছে?

লক করা থাকলেও সময় ভেসে উঠলো ফোনটার স্ক্রিনে। সেই স্ক্রিনে কিছু সাধারণ কমান্ড দিলো সুরেশ-একটা নতুন টাইম জোন ঠিক করে সেটা। এসএমএস এর মাধ্যমে শেয়ার করতে বলল, একটা ছবিও যোগ করে দিলো। এরপর এসএমএসটা না পাঠিয়ে আবার হোম বাটনে চাপ দিলো একবার।

ক্লিক।

খুলে গেল ফোনটা।

ইউটিউব দেখে খুব সহজেই এই হ্যাকিংয়ের উপায়টা জানতে পারবে যে কেউ, ভাবলো সুরেশ। আইফোন ব্যাবহারকারীরা যদি ভেবে থাকে যে পাসওয়ার্ড দিলেই তাদের ফোনে কেউ ঢুকতে পারবে না, সেটা ভুল।

দ্রুত ফোনের আইমেসেজ অ্যাপটা চালু করলো সুরেশ। দরকার পড়লে ভালদেসপিনোর মুছে দেয়া এসএমএসগুলোও ফিরিয়ে আনতে হবে ওকে আইক্লাউডের সহায়তায়।

যেমনটা ভেবেছিল, বিশপের মেসেজ হিস্ট্রিরি পুরো খালি।

কেবল একটা মেসেজ বাদে, দুই ঘন্টা আগে একটা সংরক্ষিত নম্বর থেকে এসেছে এই মেসেজটা।

মেসেজটা খুলে তিন লাইনের লেখাগুলো পড়লো ও। মনে হলো যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে।

এটা সত্যি হতে পারে না!

আবারও মেসেজটা পড়লো সুরেশ। ভালদেসপিনোর অকল্পনীয় বিশ্বাসঘাতকতার বড় প্রমাণ ওর হাতে।

আর কতটা উদ্ধত হলে এরকম মেসেজ সরাসরি কোন গোপনীয়তা ছাড়াই আদান প্রদান করে লোকটা।

একবার যদি ফাঁস হয়ে যায়…

ব্যাপারটা ভাবতেই কেঁপে উঠলো সুরেশ। মনিকা মার্টিনকে এখনই দেখাতে হবে মেসেজটা।

.

অধ্যায় ৬০

অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারটা থেকে নিচের শহরের আলোকছটার দিকে তাকিয়ে আছে এজেন্ট ডিয়াজ। রাত অনেক হলেও বেশিরভাগ বিল্ডিংয়েই টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটার চালু আছে। সেগুলোর সম্মিলিত আলো একটা নীলচে আবরণে ঢেকে রেখেছে গোটা শহরকে। একবিংশ শতাব্দির একটি সাধারণ দৃশ্য। প্রযুক্তির গ্রাসের এক অপার নিদর্শন।

আর আজকের রাতটায় পুরো পৃথিবীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্পেন। সবাই নজর রাখছে ওদের ওপর।

ব্যাপারটা ভেবে একটু অস্বস্তিবোধ হলো তার। কোনকিছুই পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছে না। কেবল জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে যে কোন সময়।

তার সামনে বসে থাকা এজেন্ট ফনসেকা মুখের কাছে হাত নিয়ে জোরে কিছু একটা বলল, এরপর সামনের দিকে দেখালো।

না দেখালেও কোন সমস্যা ছিল না, ওদের গন্তব্যস্থল অনেক দূর থেকে যে কারও চোখে পড়তে বাধ্য। পুলিশের গাড়ির লাল-নীল আলো ঘিরে রেখেছে গোটা দালানটাকে।

ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন!

যেমনটা ভেবেছিল ডিয়াজ, ওদের আগেই এখানে চলে এসেছে স্থানীয় পুলিশের গাড়ি। বার্সেলোনার কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই মনিকা মার্টিনের প্রেস কনফারেন্সে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছে।

রবার্ট ল্যাংডন স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণীকে অপহরণ করেছেন। তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে সবার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।

ডাহা মিথ্যে কথা, ডিয়াজ ভালো করেই জানে এটা, আমার নিজের চোখে তাদের একসাথে গুগেনহাইম জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখছি আমি।

মার্টিন এই ভূয়া তথ্যটা দিয়েছে যাতে অ্যাম্ব্রা ভিদালের অবস্থান জানাটা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটায় বিপদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সবাই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে মিস ভিদালকে উদ্ধারের। কিন্তু তিনি যদি ভুলক্রমে স্থানীয় পুলিশদের ক্রসফায়ারে পড়ে যান, তাহলে যেটা হবে সেটা ভাবতেও ভয় লাগছে তার। পুলিশের লোকদের ওপর ভরসা বরাবরই কম ডিয়াজের। মিথ্যেটা বলা একদমই উচিত হয়নি প্রাসাদ থেকে। কমান্ডার গারজা কখনও এমন কিছুর অনুমতি দিতেন না।

গারজাকে কিসের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হলো সেটা এখনও রহস্য ডিয়াজের কাছে। প্রফেসর ল্যাংডনকে যেভাবে ফাঁসানো হয়েছে, ঠিক সেভাবে তাকেও ফাঁসানো হয়েছে।

যাইহোক, এজেন্ট ফনসেকার কাছে কিছুক্ষণ আগে ফোন এসেছিল। ওদের কিছু নির্দেশ দেয়া হয়েছে তখন।

কমান্ডার গারজার ওপরমহল থেকে নির্দেশ।

কাসা মিলার যত কাছে যেতে লাগলো হেলিকপ্টারটা, ডিয়াজ বুঝতে পারলো যে, নিচে হেলিকপ্টার নামার মত নিরাপদ কোন জায়গা নেই। দালানটার সামনের চওড়া রাস্তাটা এবং কোণার পাজা গণমাধ্যমকর্মিদের ট্রাকে ভর্তি। এছাড়াও পুলিশ এবং আগ্রহি জনতার ঢল তো আছেই।

বার্সেলোনার কাসা মিলা দালানটা স্থাপত্যের সবচেয়ে দারুণ নিদর্শনগুলোর একটি। বিশেষ করে এটার ছাদের দিকে তাকালে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। ডিয়াজও অবাক চোখে তাকালো সেদিকে। ছাদ থেকে বার্সেলোনার শহরতলি তো দেখা যাবেই, সেই সাথে দালানটার ভেতরের অংশে নয়তলা নিচের কারুকাজ করা প্রাঙ্গনও চোখে পড়বে।

ওখানে নামা যাবে না। গোটা ছাদটা পাহাড়ের চুড়ার মত উঁচু নিচু, সেই সাথে আন্তোনি গদির যুগান্তকারি স্থাপত্য প্রতিভার নিদর্শন স্বরূপ চিমনীগুলো তৈরি করা হয়েছে দাবার ঘুটির প্রহরীদের আদলে। সেই হেলমেট পরিহিত প্রহরীদের দেখে প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা জর্জ লুকাস এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তার স্টার ওয়ার্স সিনেমার স্টর্ম টুপারদের সেই আদলে উপস্থাপন করেছেন।

হেলিকপ্টার নামানোর মত খালি জায়গা খুঁজতে লাগলো ডিয়াজ আশেপাশের জায়গাগুলোতে। কিন্তু হঠাৎ কাসা মিলার ছাদের ওপর চোখ পড়তে জমে গেল যেন। সেখানে বড় বড় মূর্তিগুলোর মাঝে একজনকে দেখা যাচ্ছে নিচের দিকে নুয়ে কিছু করার চেষ্টা করছে। পরনে সাদা পোশাক তার। রেলিঙে ভর দিয়ে নিচের প্লাজার গণমাধ্যম কর্মিদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে সে, সেইন্ট পিটার স্কয়ারের ব্যালকনি থেকে পোপ তার অনুসারিদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন যেভাবে।

কিন্তু এটা পোপ না।

সাদা পোশাক পরিহিত একজন সুন্দরি, সম্রান্ত ভদ্রমহিলা। স্পেনের হবু রাণী।

*

নিচের মিডিয়া ট্রাকগুলোর চোখ ধাঁধানো আলোর কারণে কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল না অ্যাম্ব্রা ভিদাল। কিন্তু খুব কাছে একটা হেলিকপ্টারের আওয়াজ ঠিকই কানে আসলো তার। সময় শেষ হয়ে আসছে। আবারো রেলিঙে ভর দিয়ে নিচে ঝুঁকে গণমাধ্যম কর্মিদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু হেলিকপ্টারের রোটরের প্রচণ্ড আওয়াজে তার কথাগুলো হারিয়ে গেল।

উইনস্টন ধারণা করেছিল, অ্যাম্রাকে ছাদের দেখা যাওয়ামাত্র সবগুলো ক্যামেরা ঘুরে যাবে সেদিকে। ঠিক তেমনটাই হয়েছে, তবুও অ্যাম্ব্রা জানে না ওদের পরিকল্পনা সফল হবে না।

আমি কি বলছি সেটা শুনতেই পারছে না তারা।

ছাদটা বেশি ওপরে আর নিচেও হৈ হট্টগোলের পরিমাণ কম নয়। আর এখন হেলিকপ্টারের আওয়াজের কারণে ওর নিজের গলার স্বর নিজেরই শোনা দায়।

আমাকে অপহরণ করা হয়নি, যতটা জোরে সম্ভব চিৎকার করে বলল অ্যাম্ব্রা, পঞ্চমবারের মত। রাজ প্রাসাদ থেকে রবার্ট ল্যাংডন সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে সব মিথ্যে। আমাকে মোটেও জিম্মি করে রাখেননি তিনি।

আপনি স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী, উইনস্টন কিছুক্ষণ আগে বলেছে তার উদ্দেশ্যে, যদি আপনি এখন অপহরণের ব্যাপারটা অস্বীকার করেন তবে কর্তৃপক্ষ একদম হতবাক হয়ে যাবে। একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে সবার মাঝে। কার কথা বিশ্বাস করবে সেটা বুঝে উঠতে পারবে না কেউই।

উইনস্টন যে ঠিক কথাই বলেছিল সেটা জানে অ্যাম্ব্রা। কিন্তু সেজন্যে ওর কথা পৌঁছুতে হবে নিচে জড়ো হওয়া গণমাধ্যম কর্মিদের পর্যন্ত।

হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেল হেলিকপ্টারের গর্জন। রেলিং থেকে পেছনে সরে দাঁড়ালো অ্যাম্ব্রা। কপ্টারটা এখন ওর ঠিক সামনে। সেটার খোলা দরজা দিয়ে দুজন পরিচিত মুখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। এজেন্ট ডিয়াজ এবং ফনসেকা।

অ্যাম্ব্রাকে হতবাক করে দিয়ে তার দিকে কিছু একটা তাক করলো এজেন্ট ফনসেকা, একদম কপাল বরাবর। একটা ভীতিকর সন্দেহ উঁকি দিলো ওর মনের এক কোণে। হুলিয়ান আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে, কারণ তাকে কোন উত্তরাধিকার দিতে পারবো না আমি।

আত্মরক্ষার চেষ্টায় হোক আর অন্য কারণেই হোক চমকে উঠে পেছনে সরতে গিয়ে অ্যাম্ব্রা খেয়াল করলো, পায়ের নিচ থেকে সরে গেছে শক্ত কংক্রিট। ডান হাত দিয়ে রেলিং আঁকড়ে ধরে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেও কিছু হলো না। পিছলে কয়েক ধাপ নিচের সিঁড়িতে পড়ে গেল।

বাম কনুই সজোরে বাড়ি খেলো সিমেন্টে। তবুও কোন ব্যথা অনুভূত হলো না অ্যাম্ব্রার। কারণ ওর পূর্ণ মনোযোগ এখন ডান হাত থেকে ছুটে যাওয়া জিনিসটার দিকে-এডমন্ডের স্মার্টফোনটা।

ঈশ্বর! না! ওটাকে নয়তলা নিচের প্রাঙ্গণে হারিয়ে যেতে দেখলো ও।

উইনস্টনের সাথে যোগাযোগের আর কোন উপায় রইলো না।

নিচের পাথুরে মেঝেতে আছড়ে পড়ে গুঁড়ো হয়ে যেতে দেখলো জিনিসটাকে।

*

ঠিক সেই মুহূর্তে অন্যপাশের সিঁড়িটা দিয়ে কাসা মিলার ছাদে প্রবেশ করলো রবার্ট ল্যাংডন। প্রচন্ড শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হলো তার। একটা হেলিকটার ভাসছে দালানের পাশে, অ্যাম্ব্রাকে দেখতে পেলো না কোথাও।

পুরো ছাদে নজর বোলালো ল্যাংডন। কোথায় গেল অ্যাম্ব্রা? ছাদটার কিম্ভুত নকশার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে। উঁচুনিচু প্রাচীর…খাড়া সিঁড়ি…প্রহরী মূর্তি…আর মাঝে নয়তলা গভীর এক গহ্বর।

অ্যাম্ব্রা!

অবশেষে যখন খুঁজে পেলো অ্যাম্ব্রাকে, শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। সিঁড়ির কাছে পড়ে আছে সে।

তার দিকে ছুটে গেল ল্যাংডন। ছাদের একটা উঁচু অংশ পার হচ্ছে ঠিক এই সময় একটা গুলি এসে বিঁধলো তার পাশের দেয়ালে সিমেন্টে।

ঈশ্বর!

হাঁটু গেড়ে বসে মাথা আড়াল করার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। আরো দুটো গুলি ছুটে এসে বিধতে দেখলো দেয়ালে। প্রথমে মনে হলো, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হচ্ছে, কিন্তু অ্যাম্ব্রার দিকে এগোতে এগোতে দেখলো, ছাদের অন্য প্রান্ত থেকে কয়েকজন পুলিশ বন্দুক তাক করে আছে ওদের দিকে।

আমার দিকে নির্দ্বিধায় গুলি ছুড়ছে তারা, মনে মনে ভাবলো ও, কারণ তাদের ধারণা স্পেনের হবু রাণীকে অপহরণ করেছি আমি। উইনস্টনের পরিকল্পনা সফল হয়নি।

পাঁচ হাত দূরে পড়ে থাকা অ্যাম্ব্রার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কের সাথে খেয়াল করলো, রক্ত বের হচ্ছে তার বাম হাত দিয়ে। গুলি লেগেছে অ্যাম্ব্রার হাতে! মাথার পাশ দিয়ে বাতাসে শিষ কেটে আরেকটা গুলি চলে গেল সেই মুহূর্তে।

পেঁচানো সিঁড়িটার রেলিং ধরে কষ্ট করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অ্যাম্রা।

মাথা নিচু করুন! চিৎকার করে বলল ল্যাংডন। তিন লাফে তার কাছে পৌঁছে গেল সে। নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখলো।

এই সময় হেলিকপ্টারটা চলে আসলো তাদের একদম পাশে। ওটার রোটরের বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় হলো। পুলিশ আর ওদের মাঝে এখন কপ্টারটা।

দিয়েন দে দিসপারার! হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে মাইকের সহায়তায় ঘোষণা করলো কেউ। ইনফুন্দেন লাস আরমাস! গুলি করা বন্ধ করুন! অস্ত্র নামিয়ে রাখুন!

ঠিক ওদের সামনে হেলিকপ্টারের খোলা দরজা থেকে একহাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছে এজেন্ট ডিয়াজ।

উঠে পড়ুন!

কথাটা শুনে অ্যাম্ব্রাকে মিইয়ে যেতে দেখলো ল্যাংডন।

এখনই! রোটরের আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার করলো ডিয়াজ।

হেলিকপ্টারে চড়তে হলে রেলিং টপকে ছোট্ট কার্নিশ থেকে লাফ দিতে হবে। হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে গার্ডিয়া রিয়েলের এজেন্ট। তেমনটাই ইঙ্গিত করছে ডিয়াজ।

দোটানায় ভুগছে ল্যাংডন।

এসময় ডিয়াজ এজেন্ট ফনসেকার হাত থেকে মাইকটা কেড়ে নিয়ে ল্যাংডনের মুখের দিকে তাক করলো, প্রফেসর! হেলিকপ্টারে উঠে পড়ুন এখনই! গমগমে কণ্ঠস্বরে অনুরোধ করলো সে। স্থানীয় পুলিশের উপর দেখামাত্র আপনাকে গুলি করার নির্দেশ আছে। আমরা জানি, মিস ভিদালকে অপহরণ করেননি আপনি। কিছু হয়ে যাবার আগে উঠে আসুন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *