১১-২০. দুবাইর সমুদ্র উপকূল

অধ্যায় ১১

দুবাইর সমুদ্র উপকূল থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চোখ ঝলসানো উঁচু ভবন, মানুষের তৈরি দ্বীপ আর সেলিব্রেটিদের পার্টি-ভিলায় সমৃদ্ধ শারজাহ শহরটি-সংযুক্ত আরব আমিরাত নামের অতিরক্ষণশীল ইসলামিক সংস্কৃতির রাজধানী এটি।

ছয়হাজার মসজিদ আর এই অঞ্চলের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আধ্যাত্মিকতা এবং শিক্ষার জন্য শারজাহ শহরের যে প্রসিদ্ধি তার পেছনে ভূমিকা পালন করেছে প্রচুর তেলের রিজার্ভ আর এর শাসক। তিনি তার জনগণের জন্য সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন শিক্ষাকে।

আজ রাতে শারজাহর সম্মানিত আল্লামা, সাঈদ আল-ফজলের পরিবার। একত্রিত হয়েছে সারা রাত জেগে থাকার জন্য। গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার বদলে, গতকাল থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়া তাদের পিতা-চাচা-স্বামীর ফিরে আসার উপলক্ষ্যে শুকরিয়া আদায় করার জন্য নামাজ পড়ছে।

স্থানীয় পত্রপত্রিকার মারফত কেবল জানা গেছে, সাঈদের একজন কলিগ নাকি দাবি করেছে, দু-দিন আগে পার্লামেন্ট অব দি ওয়ার্ল্ডস রিলিজিয়ন্স-এর সম্মেলন থেকে ফিরে আসার পর সচরাচর চুপচাপ স্বভাবের আল্লামাকে অদ্ভুত রকমের উত্তজিত দেখাচ্ছিল। ঐ কলিগ আরো বলেছে, ফিরে আসার পর পরই তিনি নাকি সাঈদকে ফোনে গলা চড়িয়ে তর্ক করতেও শুনেছেন। যা কিনা গম্ভীর স্বভাবের লোকটির জন্য বিরল একটি ব্যাপার। ঐ ফোনালাপটি ইংরেজিতে হবার কারনে তারপক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভবপর হয়নি, তবে সেই কলিগ জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি সাঈদকে বার বার একটা নাম উচ্চারণ করতে শুনেছেন।

এডমন্ড কিয়ার্শ।

.

অধ্যায়

স্পাইরাল স্থাপত্য থেকে বের হয়ে আসার সময় ল্যাংডনের মাথার ভেতরে চিন্তাভাবনার ঘুর্ণিপাক শুরু হয়ে গেল যেন। কিয়ার্শের সাথে তার কথাবার্তা যেমন আগ্রহোদ্দীপক ছিল তেমনি সেটা দুশ্চিন্তারও বিষয়। সত্য-মিথ্যা যাইহোক না কেন, কিয়ার্শের দাবি অতিরঞ্জিত কিনা কে জানে, তবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই কম্পিউটার বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, সে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যা পৃথিবীকে আমূল পাল্টে দেবে।

কোপার্নিকাসের মতবাদের মতোই নাকি এই আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ?

সর্পিল কাঠামোর ভাস্কর্য থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসার পর ল্যাংডনের মনে হলো তার মাথা হাল্কা ঝিমঝিম করছে। মেঝেতে রেখে যাওয়া হেডসেটটা আবার পরে নিলো সে।

উইনস্টন, আছো তুমি?

হাল্কা একটা ক্লিকের মতো শব্দ হতেই কম্পিউটারাইজড বৃটিশ ডোসেন্ট ফিরে এলো আবার। হ্যালো প্রফেসর, আমি আছি। মি.  কিয়ার্শ বলেছেন আমি যেন আপনাকে সার্ভিস এলিভেটরের কাছে নিয়ে যাই কারণ আর্টিয়ামে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি আরো মনে করেছেন, আপনার জন্য বড় সাইজের এলিভেটরই বেশি ভালো হবে।

তাকে ধন্যবাদ। সে জানে আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে।

এখন আমিও সেটা জানি। আর আমি এটা কখনও ভুলে যাবো না।

উইনস্টনের সহায়তায় একটা সাইড দরজা দিয়ে কংক্রিটের একটি হলওয়ে পেরিয়ে এলিভেটর বের কাছে চলে এলো ল্যাংডন। যেমনটা তাকে বলা হয়েছিল, এই এলিভেটরটা আকারে অনেক বড়। বোঝাই যাচ্ছে, বড়সর শিল্পকর্ম বহন করার জন্যই এটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

উপরের বোতামটা চাপুন, এলিভেটরের ভেতরে পা রাখতেই ল্যাংডনকে। বলল উইনস্টন। চারতলা।

এলিভেটরটা থেমে গেলে বেরিয়ে এলো সিম্বলজির প্রফেসর।

ডানে, ল্যাংডনের মাথার ভেতরে উইনস্টনের উৎফুল্ল কণ্ঠটা বলে উঠলো এবার। আমরা গ্যালারিতে যাবো আপনার দিক থেকে বামদিক দিয়ে। এটাই অডিটোরিয়ামে যাবার সবচাইেসহজ পথ।

উইনস্টনের কথামতো বহুদামি একটি গ্যালারির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল রবার্ট ল্যাংডন। এখানে প্রদর্শন করা আছে অদ্ভুত দেখতে সব আর্ট ইন্সটলেশন : স্টিলের একটা কামান সামনের সাদা দেয়ালে লাল টকটকে মোমের গোলা নিক্ষেপ করেছে; তারের দঙ্গলে তৈরি একটা কানু নৌকা, স্পষ্টতই সেটা পানিতে ভাসছে না; ধাতুর ব্লক দিয়ে বানানো আস্ত একটি শহরের মিনিয়েচার।

এই গ্যালারির বের হবার দরজার দিকে যেতে যেতে ল্যাংডন নিজেকে আবিষ্কার করলো সে অবাক হয়ে বিশাল বড় একটি জিনিসের দিকে তাকিয়ে আছে।

এটা এখানে অফিশিয়ালি রাখা হয়েছে, তার কাছে মনে হলো, এই জাদুঘরের সবচাইতে অদ্ভুত জিনিসটা আমি দেখতে পাচ্ছি।

পুরো ঘরটার এ মাথা থেকে ও মাথা জুড়ে টিম্বার-উলফ নামে পরিচিত একটি নেকড়ে পাল বেশ নাটকিয় ভঙ্গিতে ছুটে যাচ্ছে, শূন্যে লাফিয়ে আছে, তেড়ে যাচ্ছে একটি কাঁচের দেয়ালের দিকে, তারপর সেই দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মৃত নেকড়ের দলের একটি স্তূপ।

এটাকে বলে হেড অন, উইনস্টন নিজে থেকেই বলল। সব মিলিয়ে নিরানব্বইটি ধাবমান নেকড়ে আছে, অন্ধের মতো তারা দেয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে, এটা নেকড়ে পালের মানসিকতাকে সিম্বলাইড করেছে-প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে যাবার সাহস করেনি ওরা।

সিম্বলিজমের এই নির্মম পরিহাসটি ল্যাংডনের মনে বেশ দাগ কাটলো। ৬মন্ডের বেলায় অন্তত এ কথা খাটবে না। আজ রাতে সে তার অবস্থান থেকে নাটকিয়ভাবে সরে আসবে বলে মনে হয় না।

এখন সোজা সামনের দিকে চলে যান, উইনস্টন বলল, রঙচঙে আকৃতির একটি পেইন্টিংয়ের বামদিকে বের হবার পথটি আপনি দেখতে পাবেন। এর স্রষ্টা এডমন্ডের অন্যতম পছন্দের শিল্পী।

সামনের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল রঙের পেইন্টিংটা দেখতে পেলো ল্যাংডন। ছবিটার মাঝখানে একটা চোখ ভাসছে যেন।

জোয়ান মিরো, ল্যাংডন ভাবলো। এই প্রখ্যাত বার্সেলোনিয়ান শিল্পীর ক্ষ্যাপাটে কাজ সব সময়ই সে পছন্দ করে। তার কাজ দেখে মনে হতে পারে বাচ্চাদের কাঁচাহাতে আঁকা ড্রইংবুক আর কাঁচের উপরে আঁকা প্রাচীন শিল্পরীতির মিশ্রণজাতীয় কিছু।

কাঁচের উপরে আঁকা

ছবিটার কাছ দিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন থমকে দাঁড়ালো কিছুক্ষণের জন্য। ছবির সারফেসটা একেবারে মসৃণ দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো সে। তুলির আঁচড়ের কোন চিহ্নই নেই। এটা রিপ্রোডাকশন?

না, এটাই আসলটা, জবাব দিলো উইনস্টন। ল্যাংডন আরো কাছে গিয়ে দেখলো। দেখে মনে হচ্ছে ছবিটা বিশাল আকৃতির কোন প্রিন্টার দিয়ে প্রিন্ট করা হয়েছে। উইনস্টন, এটা তো প্রিন্ট করা। এমনকি ক্যানভাসের উপরেও প্রিন্টটা করা হয়নি।

আমি ক্যাভাসের উপর আঁকাআঁকির কাজ করি না, বলল উইনস্টন। আমি ভার্চুয়ালি ছবি আঁকি। তারপর এডমন্ড সেগুলো প্রিন্ট করেন।

কী বললে? অবিশ্বাসে বলে উঠলো প্রফেসর। এটা তোমার আঁকা? হ্যাঁ, আমি জোয়ান মিরোর স্টাইল অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিলাম।

সেটা আমি দেখতেই পাচ্ছি, বলল ল্যাংডন। তুমি এমনকি এটাতে সাইনও করেছো-Mir6 নামে।

না, বলল উইনস্টন। ভালো করে দেখুন আবার। আমি এটা Miro নামে সাইন করেছি-O-এর উপরে কোন অ্যাকসেন্ট চিহ্ন নেই। স্প্যানিশে miro শব্দের অর্থ আমি দেখি।

দারুণ চালাকি, মিরো-স্টাইলে আঁকা ছবির মাঝখানে চোখটা দেখে এটা তাকে স্বীকার করতেই হলো।

এডমন্ড আমাকে আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার জন্য বলেছিলেন, তাই আমি এটা এঁকেছি।

এটা তোমার আত্মপ্রতিকৃতি? ছবিটার দিকে আরেকবার তাকালো প্রফেসর। তুমি অবশ্যই দেখতে অদ্ভুত একটি কম্পিউটার।

কিছুদিন আগে একটা লেখা পড়েছিল ল্যাংডন। তাতে বলা ছিল, এডমন্ড নাকি কম্পিউটারকে অ্যালগোরিদমিক আর্ট শেখানোর ব্যাপারে ক্রমশ উৎসাহি হয়ে উঠছে-খুবই জটিল কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে আঁকা হয় এসব ছবি। এরকম প্রচেষ্টা অস্বস্তিকর একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে : কম্পিউটার যদি ছবি আঁকে তাহলে সেটার শিল্পী কে হবে-কম্পিউটার নাকি প্রোগ্রামার? সাম্প্রতিক সময়ে এমআইটিতে অ্যালগোরিদমিক আর্টের একটি সফল এবং প্রশংসিত প্রদর্শনী হারভার্ডের মানবিক কোর্সে অদ্ভুত একটি আলোচনার সূচনা করেছে : আর্টই কি সেই জিনিস যা আমাদেরকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে? মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে?

আমি সঙ্গিতও কম্পোজ করেছি, আনন্দের সাথে বলল উইনস্টন। যদি আগ্রহি হোন তো এডমন্ডকে বলবেন, আপনাকে যেন শোনানোর ব্যবস্থা করে দেন।

গ্যালারি থেকে বের হতেই ল্যাংডন চলে এলো মেইন আর্টিয়ামের উপরে একটা ক্যাটওয়াকে। নিচের সুবিশাল জায়গাটিতে দেখা যাচ্ছে অডিও গাইডদের তাড়া খেয়ে অনেক অতিথি এলিভেটরের সামনে জড়ো হয়েছে উপরে আসার জন্য।

আজকের অনুষ্ঠানটি আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই শুরু হবার কথা, উইনস্টন বলল। আপনি কি প্রেজেন্টেশন হলের প্রবেশপথটি দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। আমার ঠিক সামনেই ওটা।

দারুণ। শেষ একটা কথা বলি। ভেতরে ঢোকার পর আপনি কতোগুলো কালেকশান-বিন দেখতে পাবেন হেডসেটগুলো রাখার জন্য। এডমন্ড আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনি আপনার হেডসেটটা ওখানে না রেখে নিজের কাছেই রেখে দেবেন, এরফলে আমি অনুষ্ঠান শেষ হবার পর লোকজনের ভিড় এড়িয়ে আপনাকে জাদুঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবো। ওখান থেকে খুব সহজেই একটা ট্যাক্সি খুঁজে নিতে পারবেন।

বিজনেস কার্ডের উপরে অদ্ভুত সেই লেখাটা ল্যাংডনের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। উইনস্টন, এডমন্ড শুধু লিখেছে BIO-EC346। সে বলেছে এটা নাকি খুবই সহজ একটি কোড।

উনি সত্যি কথাই বলেছেন, চট করে জবাব দিলো উইনস্টন। প্রফেসর, এখনই অনুষ্ঠানটি শুরু হবে। আশা করি আপনি মি.  কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা উপভোগ করবেন। অনুষ্ঠান শেষে আমি আবারো আপনার সহযোগিতার জন্য সক্রিয় থাকবো।

আচমকা ক্লিক করে শব্দ হতেই উইনস্টন উধাও হয়ে গেল।

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় হেডসেটটা খুলে জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল ল্যাংডন। তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকে পড়লো এবার। তার পেছনে আরো কিছু অতিথি প্রবেশ করলো হন্তদন্ত হয়ে।

আরো একবার অপ্রত্যাশিত একটি জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলো সে।

আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রেজেন্টেশনটা দেখবো?

ল্যাংডন ভেবেছিল, অডিটোরিয়ামের আরামদায়ক আসনে বসে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা উপভোগ করবে সবাই, অথচ এখন দেখতে পাচ্ছে কয়েক শ অতিথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখবে। এই সাদা রঙের বিশাল ঘরটিতে বসার কোন আসন কিংবা শিল্পকর্ম দেখতে পেলো না সে-শেষ মাথায়, দেয়ালের কাছে শুধু একটা পোডিয়াম, আর তার পেছনে বিশাল বড় একটি এলসিডি মনিটর রাখা। মনিটরে একটা লেখা দেখা যাচ্ছে :

লাইভ অনুষ্ঠানটি শুরু হবে ২ মিনিট ০৭ সেকেন্ড পর

প্রবল উত্তেজনা নিয়ে মনিটরে ভেসে ওঠা লেখাগুলোর দ্বিতীয় লাইনের দিকে মনোযোগ দিলো। অক্ষরগুলো বেশি ছোট বলে তাকে চোখ কুঁচকে

তাকাতে হলো এবার :

বর্তমান দর্শক সংখ্যা : ১৯৫৩৬৯৪

দুই মিলিয়ন মানুষ?

কিয়ার্শ তাকে বলেছিল, সে তার প্রোগ্রামটা লাইভ-স্ট্রিমিং করবে, কিন্তু দর্শকের এই বিপুল সংখ্যা ল্যাংডনের বোধগম্য হচ্ছে না। তারচেয়েও বড় কথা প্রতি মুহূর্তে সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে।

রবার্ট ল্যাংডনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার সাবেক এই ছাত্রটি বেশ ভালোমতোই আয়োজনটির ব্যবস্থা করেছে। এখন প্রশ্ন হলো : এডমন্ড আসলে কী বলবে?

.

অধ্যায় ১৩

দুবাইয়ের পুবদিকের চন্দ্রালোকিত মরুভূমিতে, একটা স্যান্ড ভাইপার ১১০০ বাগি-গাড়ি বামদিকে মোড় নিতেই থমকে দাঁড়ালো। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল বালি উড়ছে।

স্টিয়ারিং ধরে অল্প বয়েসি যে ছেলেটা বসে আছে সে তার গগল্স খুলে সামনের দিকে যেটা পড়ে আছে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক চোখে। আরেকটু হলেই গাড়িচাপা দিয়ে দিতো। আর বসে না থেকে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল সেদিকে।

যা ভেবেছিল তা-ই।

তার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একজন মানুষ।

মারহাবা? ছেলেটা ডাকলো। হ্যালো?

নিথর দেহটা থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না।

ঐতিহ্যবাহি পোশাকটা দেখে ছেলেটি বুঝতে পারলো এটা একজন পুরুষ মানুষ। বালির উপরে লোকটার পদচিহ্ন মিশে গেছে অনেক আগেই, কোন গাড়ির চাকার দাগও দেখা যাচ্ছে না যে, বুঝতে পারবে কিভাবে লোকটা মরুভূমির এত ভেতরে চলে এলো।

মারহাবা? আবারো বলল ছেলেটি।

আগের মতোই সাড়াশব্দহীন।

কী করবে বুঝতে না পেরে ছেলেটা তার পা দিয়ে লোকটার বুকের পাশে আলতো করে ঠেলা দিলো। যদিও লোকটা বেশ মোটাসোটা, শক্তসামর্থ্য তার পেশি, কিন্তু এরইমধ্যে তপ্তবাতাস আর রোদের কারণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।

নির্ঘাত মারা গেছে।

হাটু গেড়ে বসে লোকটার কাঁধ ধরে তাকে চিত করে দিলো সে। মানুষটার নিষ্প্রান চোখদুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ আর দাড়ি বালির আস্তরণে ঢাকা। এমন নোংরা অবস্থায়ও তার মুখটা দেখে কেনজানি বন্ধুভাবাপন্ন বলে মনে হলো ছেলেটার কাছে। কিছুটা পরিচিতও ঠেকলো। প্রিয় চাচা কিংবা দাদা-নানার মতো একটি মুখ।

সঙ্গে সঙ্গে আধডজন কোয়াড বাইক আর বাগি গাড়ি গর্জন তুলে ছুটে এলো ছেলেটার আশেপাশে। তার সঙ্গিরা তাকে দূর থেকে গাড়ি থামাতে দেখেছে, তাদের বন্ধু ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে চলে এসেছে এখানে।

সবাই গাড়ি থামিয়ে চোখের উপর থেকে গগলস আর হেলমেট খুলে মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃতলোকটিকে দেখেই চিনতে পারলো একটা ছেলে-বিখ্যাত আল্লামা সাঈদ আল-ফজল-বিশিষ্ট ধর্মবেত্তা এবং আধ্যাত্মিক নেতা। প্রায়শই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যেতেন তিনি।

মাথা আলাইনা আন নাফ আল? চিৎকার করে বলল সে। আমাদের কী করা উচিত?

ছেলেগুলো হতবাক হয়ে লাশের চারপাশ ঘিরে পঁড়িয়ে আছে। তারপর পৃথিবীর তাবৎ টিনেজারদের মতোই একটা কাজ করলো তারা-ার যার পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে ছবি তুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে পাঠাতে শুরু করে দিলো সবাই।

.

ধ্যায়

কাঁধে কাঁধ ঘেষে পোডিয়াম ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিদের ভিড়ের মধ্যে থেকে ল্যাংডন দেখতে পেলো এলসিডি মনিটরে ভেসে ওঠা সংখ্যাটা বাড়ছে তো বাড়ছেই।

এ মুহূর্তে দর্শক সংখ্যা : ২৫২৭৬৬৪

ঘরভর্তি মানুষের ফিসফাস বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে চাপা গর্জনের রূপ নিলো। কয়েক শ অতিথি উত্তেজনায় কী দেখবে কী শুনবে সেই প্রতীক্ষায়। অস্থির হয়ে আছে। অনেকে শেষ মুহূর্তে ফোন কল আর টুইট করে কিংবা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিচ্ছে পরিচিতজনদের কাছে।

একজন টেকনিশিয়ান পোডিয়ামের মাইক্রোফোনটা পরীক্ষা করে দেখলো। লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আপনাদেরকে আগেই বলা হয়েছে, যার যার মোবাইলফোন বন্ধ করে রাখার জন্য। এই মুহূর্তে আমরা ওয়াইফাই আর সেলুলার নেটওয়ার্ক ব্লক করে দিচ্ছি। অনুষ্ঠান শেষে আবারো সেগুলো অ্যাক্টিভ করা হবে।

অনেক অতিথি এখনও ফোন নিয়ে ব্যস্ত আছে। তবে হঠাৎ করেই তাদের সবার কানেকশান বন্ধ হয়ে গেল। বেশিরভাগই এমন বোকার মতো বিস্ময় নিয়ে তাকালো যেন নতুন কোন ম্যাজিক্যাল টেকনোলজির কেরামতিতে সারা দুনিয়ার ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেছে।

যেকান ইলেক্ট্রনিকসের দোকানে এই টেকনোলজি পাঁচশ ডলার খরচ করলেই কেনা যায়, ল্যাংডন এটা জানে কারণ বর্তমান সময়ে হারভার্ডের অনেক প্রফেসরই এরকম পোর্টেবল ডিভাইস লেকচার হলে নিয়ে আসেন সঙ্গে করে ছাত্রছাত্রিরা যাতে তাদের ফোন ব্যবহার করতে না পারে সেজন্যে।

কাঁধে বিশাল একটি ক্যামো নিয়ে একজন ক্যামেরাম্যান অবস্থান নিলো পোডিয়ামের কাছে। ঘরের বাতির উজ্জ্বলতা কমে এলো।

লাল হয়ে উঠলো এলসিডি মনিটরের পদটিা আর তাতে ভেসে উঠলো একটা লেখা :

সরাসরি সম্প্রচার শুরু হবে ৩৮ সেকেন্ডের মধ্যে
বর্তমান দর্শক সং
খ্যা : ২৮৫৭৯১৪

সংখ্যাটা যে হারে বাড়ছে সেটা দেখে আরেকবার বিস্মিত হলো ল্যাংডন। মনে হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের যে ন্যাশনাল ডিবেট সম্প্রচারিত হয় সেই অনুষ্ঠানের দর্শক সংখ্যাকে আজকের এই অনুষ্ঠানটি ছাড়িয়ে যাবে। প্রায় ত্রিশ লক্ষের মতো মানুষ নিজের বাড়িতে বসে এই অনুষ্ঠানটি দেখবে।

ত্রিশ সেকেন্ড, মাইক্রোফোনে বলে উঠলো টেকনিশিয়ান।

পোডিয়ামের পেছনের দেয়ালে ছোট্ট একটি দরজা খুলে যেতেই ঘরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সবাই উন্মুখ হয়ে আছে এডমন্ড কিয়ার্শের জন্য।

কিন্তু এডমন্ডকে সেখান দিয়ে ঢুকতে দেখা গেল না।

দরজাটা দশ সেকেন্ড ওভাবেই খোলা থাকলো।

এরপরই দেখতে অভিজাত এক মহিলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো, সোজা হেঁটে গেল পোডিয়ামের দিকে। মহিলা দেখতে অসম্ভব সুন্দরি-লম্বা, হালকাঁপাতলা গড়ন, দীর্ঘ কালো চুল-আঁটোসাটো সাদা একটি পোশাক পরে আছে, তাতে কালো বরফির স্ট্রাইপ দেয়া। তাকে দেখে বেশ সাবলীল মনে হচ্ছে। মঞ্চের মাঝখানে এসে মাইক্রোফোনটা পরীক্ষা করে দেখলো। গভীর করে দম নিয়ে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলো সে। তার। হাসির অর্থটা যেন, আরো দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে।

সরাসরি সম্প্রচার শুরু হবে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে

কয়েক মুহূর্তের জন্য মহিলা চোখ বন্ধ করে ফেলল, যেন নিজের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছে। এরপরই সে চোখ মেলে তাকালো।

ক্যামেরাম্যান হাতের পাঁচটি আঙুল তুলে ধরলো এবার।

চার, তিন, দুই…

ক্যামেরার দিকে মহিলা তাকাতেই ঘরে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। এলসিডি ডিসপ্লেতে ভেসে উঠলো তার মুখচ্ছবি। গভীর কালো চোখে শ্রোতাদের দিকে তাকালো সে। গালের পাশে একগোছা চুল ব্রাশ করে ছেড়ে দিয়েছে।

গুড ইভনিং, সবাইকে, শুরু করলো মহিলা। তর কণ্ঠ পরিশীলিত আর আন্তরিকতাপূর্ণ। হালকা স্প্যানিশ টান আছে তাতে। আমার নাম অ্যাম্ব্রা ভিদাল।

অপ্রত্যাশিতভাবেই পুরো ঘরটা হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। বোঝাই গেল, এখানে উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষই জানে সে কে।

ফেলিসিদাদেস! কেউ চিৎকার করে বলল কথাটা। কংগ্র্যাচুলেশন্স!

মহিলা আরক্তিম হয়ে গেল। ল্যাংডন বুঝতে পারছে এখানে কিছু একটা ব্যাপার আছে যা সে জানে না।

লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, দ্রুত বলে উঠলো মহিলা, বিগত পাঁচবছর ধরে আমি বিলবাওর এই গুগেনহাইম মিউজিয়ামের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে গেছি। আপনাদেরকে অসাধারণ একজন মানুষের অবিশ্বাস্য একটি প্রেজেন্টেশন দেখার জন্য স্বাগত জানাচ্ছি আজকে।

উৎফুল্ল হয়ে সবাই হাততালি দিলে ল্যাংডনও তাতে যোগ দিলো।

এডমন্ড কিয়াশ শুধুমাত্র একজন জিনিয়াসই নন, এই জাদুঘরের একজন পৃষ্ঠপোষকও বটে। তারচেয়েও বড় কথা, তিনি আমাদের বিশ্বস্ত একজন বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আজকের এই অনুষ্ঠানের জন্য বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার সঙ্গে কাজ করার দুর্লভ সম্মান লাভ করেছি আমি। আমি একটু আগে চেক করে। দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে আজকের অনুষ্ঠানটি নিয়ে! কোন সন্দেহ নেই আপনারা সবাই জেনে গেছেন, এডমন্ড কিয়ার্শ একটি অবিস্মরণীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণা দেবেন আজ-এটা এমন একটা আবিষ্কার, তিনি মনে করেন, চিরকাল সেটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ বিশ্বে অপরিসীম অবদান রাখার কারণে।

পুরো হলজুড়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল আবার। আগের চেয়েও বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে অতিথিদের মধ্যে।

কালো চুলের মহিলা রহস্যভরা হাসি দিলো। অবশ্যই আমি এডমন্ডকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, সে যেন আমাকে বলে কী আবিষ্কার করেছে, কিন্তু সে আমাকে এ ব্যাপারে সামান্যতম ইঙ্গিতও দেয়নি। হাততালির সাথে এবার যোগ হলো হাসির রোল।

আজ রাতের এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি, সে বলতে লাগলো, ইংরেজিতে উপস্থাপন করা হবে-এটা মি.  কিয়ার্শের মাতৃভাষা-তবে যারা ভার্চুয়ালি আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন তাদের জন্য বিশটির মতো ভাষায় রিয়েল টাইম ট্রান্সলেশনের সুবিধা থাকবে।

এলসিডির পদাটা বদলে গেলে অ্যাম্ব্রা আরো যোগ করলো, কেউ যদি এডমন্ডের আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারে কোনরকম সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে তাদের জন্য বলছি, একটা অটোমেটেড প্রেস রিলিজ পনেরো মিনিট আগে সারাবিশ্বের সোশ্যাল মিডয়াতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এলসিডি পর্দার দিকে তাকালো ল্যাংডন।

আজকের রাত : সরাসরি সম্প্রচার। ২০:০০০ সিইএসটি

ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়ার্শ এমন একটি আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করবেন যা বিজ্ঞানের চেহারা পাল্টে দেবে চিরকালের জন্য।

তাহলে এভাবেই তুমি ত্রিশ লক্ষ দর্শক জোগাড় করতে পেরেছে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে, ল্যাংডন মনে মনে বলে উঠলো। পোডিয়ামের দিকে মনোযোগ দিতেই দু-জন লোককে সে দেখতে পেলো, যাদেরকে আগে খেয়ালই করেনি-দু দু-জন পাথুরে মুখের সিকিউরিটি গার্ড পোডিয়ামের পেছনে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ উপস্থিত লোকজনের উপর নিবদ্ধ। দু-জনের পরনে নীল রঙের ব্লেজারের বুকে মনোগ্রামটা দেখে অবাক হলো ল্যাংডন।

দ্য গার্ড রিয়েল?! রাজার রয়্যাল গার্ডরা এখানে কী করতে এসেছে? রাজপরিবারের কেউ আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা নয়; কট্টর ক্যাথলিক হিসেবে এডমন্ড কিয়ার্শের মতো নাস্তিকের সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ করবে না তারা।

স্পেনের রাজা সংসদীয় রাজতন্ত্রের কারণে খুব কম ক্ষমতাই রাখেন, তারপরও নিজ দেশের জনগণের উপরে তার অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। লক্ষ লক্ষ স্পেনিয়ার্ডের কাছে রাজতন্ত্র হলো সমৃদ্ধ ক্যাথলিক ঐতিহ্য লস রেইস ক্যাতেলিকোস আর স্পেনের স্বর্ণালি যুগের প্রতীক।

ল্যাংডন শুনেছে, স্পেনে নাকি একটা কথা প্রচলিত আছে : পার্লামেন্ট দেশ শাসন করে কিন্তু রাজত্ব করে রাজা। শত শত বছর ধরে স্পেনের রাজারা

অতিমাত্রায় রক্ষণশীল আর ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হিসেবেই পরিচিত হয়ে এসেছে। বর্তমান রাজাও তার ব্যতিক্রম নন, ল্যাংডন ভাবলো। লোকটার গভীর ধর্মানুরাগ আর রক্ষণশীল মূল্যবোধের উপরে কিছু লেখা পড়েছে সে।

সাম্প্রতিক সময়ে বয়োবৃদ্ধ রাজা মৃত্যুপথযাত্রি একজন মানুষ, তাই স্পেন এখন রাজার একমাত্র ছেলে হুলিয়ানকে নতুন রাজা হিসেবে বরণ করে নেবার ওন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। পত্রপত্রিকার ভাষ্যমতে, যুবরাজ হুলিয়ান একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে তার বাবার ছায়াতলেই থাকেন। দেশের মানুষ জানে না, তাদের নতুন রাজা কী রকম মানুষ।

যুবরাজ হুলিয়ান কি এডমন্ডের এই অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য গার্ডিয়া এজেন্টদেরকে পাঠিয়েছেন? বিশপ ভালদেসপিনো যে এডমন্ডকে হুমকি দিয়ে ভয়েস মেইল পাঠিয়েছিলেন সে কথাটা মনে পড়ে গেলে ল্যাংডনের। কিন্তু ল্যাংডনের দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও ঘরের আবহ খুবই প্রণোচ্ছল আর নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। তার আরো মনে পড়ে গেল, এডমন্ড বলেছিল, আজকের অনুষ্ঠানে টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে-তাহলে স্পেনের গার্ডিয়া রিয়েল আজকের অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে শেষ হবার জন্যই এখানে নিয়োজিত আছে।

এডমন্ড কতোটা নাটকিয়তা পছন্দ সে সম্পর্কে আপনারা যারা ওয়াকিবহাল আছেন, অ্যাম্ব্রা ভিদাল বলতে লাগলো, তারা ভালো করেই জানেন, এডমন্ড এখানে এই মঞ্চে এসে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিছু বলার মতো লোক নন।

ঘরের অন্যপ্রান্তে বিশাল একটি দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

ঐ দরজাটার ওপাশে এডমন্ড কিয়ার্শ একটি এক্সপেরিয়েন্সিয়াল স্পেস নির্মাণ করেছেন, ওখানেই তিনি তার ডায়নামিক মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনটা আপনাদেরকে দেখাবেন। এটা পুরোপুরি কম্পিউটারের সাহায্যে অটোমেটেড করা, সারাবিশ্বে এখান থেকেই লাইভ স্ট্রিম করা হবে। একটু থেমে হাতের স্বর্ণের ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। আজকের অনুষ্ঠানটির সময় খুব হিসেব করে নির্ধারণ করা হয়েছে। এডমন্ড আমাকে বলেছেন, আমি যেন আপনাদেরকে ঠিক আটটা পনেরো মিনিটে ওখানে নিয়ে যাই। তার মানে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি আছে। দরজাটার দিকে আবারো ইঙ্গিত করলো সে। লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, দয়া করে আপনারা সবাই ওখানে চলে যান, দেখুন বিস্ময়কর এডমন্ড কিয়ার্শ আপনাদের জন্য কী বিস্ময় জমিয়ে রেখেছেন।

দরজাটার দুটো পাল্লা খুলে গেল এ সময়।

ভেতরের দিকে তাকালো ল্যাংডন, আরেকটা গ্যালারি দেখার আশা করলো সে। কিন্তু যা দেখলো সেটা তাকে চমকে দিলো। দরজাটার ওপাশে সুগভীর অন্ধকার একটি টানেল রয়েছে।

*

অতিথিরা সবাই মৃদু আলোর প্যাসেজওয়ের দিকে যেতে শুরু করলে অ্যাডমিরাল আভিলা একটু পিছিয়ে গেল। টানেলের ভেতরটা দেখে খুশি হলো

সে, একেবারে ঘন অন্ধকার।

অন্ধকার তার কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দেবে।

পকেটে থাকা রোসারি জপমালাটা স্পর্শ করে চিন্তাভাবনাগুলো শেষবারের মতো গুছিয়ে নিলো। আজকের মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে তাকে।

টাইমিংটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

.

অধ্যায় ১৫

টানেলটা বিশ ফিটের মতো চওড়া আর সামান্য ঢালু হয়ে বামদিক দিয়ে উপরে উঠে গেছে। টানেলের মেঝেটা কুচকুচে কালো কার্পেটে ঢাকা। এর দুই দেয়ালের গোড়ায় দুই সারির স্ট্রিপ লাইট চলে গেছে। ওটাই টানেলের ভেতরে এ মাত্র আলোর উৎস।

তো, প্লিজ, এক ডোসেন্ট নতুন আগতদেরকে বিনয়ের সাথে বলল। সবাই দয়া করে নিজেদের জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিন।

ল্যাংডন তার চাড়মার জুতোটা খুলে ফেলল। তার মোজা পরা পাদুটো ডুবে গেল অসম্ভব নরম কার্পেটে। টের পেলো তার শরীর মুহূর্তে রিল্যাক্স হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে যে গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে সেটা কেবলই মুগ্ধতা প্রকাশের জন্য।

টানেলের ভেতর দিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই অবশেষে শেষমাথাটা দেখতে পেলো সে-কালো পর্দার একটি ব্যারিয়ার, ওখানে অতিথিদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে ডোসেন্টরা। কালো পর্দার ওপাশে যাবার আগে তারা প্রত্যেক অতিথির হাতে ভারি আর মোটা বিচ-টাওয়েল ধরিয়ে দিচ্ছে।

একটু আগে যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল সেটা এখন অনিশ্চিত নীরবতায় মিইয়ে গেল। কালো পর্দার সামনে আসতেই ভাজ করা একটি কাপড় ধরিয়ে দেয়া হলো ল্যাংডনের হাতে। অন্যদেরকে যেরকম বিচ-টাওয়েল দেয়া হচ্ছে। তারটা সেরকম কিছু না। বরং ছোটখাট একটি কম্বল আর একমুখ সেলাই করা একটি বালিশ। ডোসেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে পর্দার ওপাশে চলে এলো ল্যাংডন।

আজ রাতে দ্বিতীয়বারের মতো ল্যাংডন বাধ্য হলো অনুমাণ করা থামিয়ে দিতে। যদিও ল্যাংডন পদার ওপাশে কী থাকবে বলে কল্পনা করেনি, তারপরও এ মুহূর্তে সামনে যা দেখতে পাচ্ছে তার কাছাকাছি কোন কিছু তার ভাবনাতেও আসতো না।

আমরা কি…বাইরে চলে এসেছি?

একটা বিশাল মাঠের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে রবার্ট ল্যাংডন। মাথার উপরে চমৎকার তারাভরা আকাশ,ছুরে একটি ম্যাপল গাছের আড়াল থেকে চিকন চাঁদটা এইমাত্র যেন উদয় হয়েছে। ঝিঁঝিপিপাকা ডাকছে, উষ্ণ বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো ল্যাংডনের মুখে। বাতাসে মিশে আছে তার পায়ের নিচে থাকা সুন্দর করে কাটা ঘাসের গন্ধ।

স্যার? আস্তে করে বলল এক ডোসেন্ট, তার হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল মাঠের মধ্যে। প্লিজ, এখানে ঘাসের উপরে নিজের জন্য একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে কম্বলটা বিছিয়ে দিন। উপভোগ করুন।

বাকি অতিথিরাও নিজের জায়গা খুঁজে নিতে শুরু করে দিয়েছে। সুন্দর করে ছাটা ঘাসের মাঠটি হকিফিল্ডের আকারের হবে। চারপাশে গাছপালা আর ঝোঁপঝাঁড়ে পরিপূর্ণ। বাতাসে সেগুলোর পাতা দোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

ল্যাংডনের বুঝতে বেশ কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল যে, এর সবটাই দৃষ্টি বিভ্রম। ইল্যুশন-অসাধারণ আর্টের কাজ। আমি আসলে বড়সর একটি প্রানেটারিয়ামের ভেতরে আছি, ভাবলো সে। এত ডিটেইল আর সুক্ষ্ম কাজ দেখে বিমুগ্ধ সে।

উপরে যে তারাভরা আকাশ, চাঁদ, মেঘের দল আর বহুদূরের পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে তার সবটাই আসলে প্রজেকশন। বাতাসে নড়ে ওঠা পাছপালা আর ঘাসগুলো সম্ভবত সত্যিকারের-হয় নিখুঁত ফেইক গাছপালা নয়তো জ্যান্ত গাছপালার ছোটখাটো একটি বন। সবকিছু এতটা চাতুর্যের সাথে সাজানো হয়েছে যে, পুরোপুরি প্রাকৃতিক পরিবেশের আবহ ফুটিয়ে তুলেছে।

উপুড় হয়ে ঘাসগুলো ধরে দেখলো ল্যাংডন। নরম আর আসল বলেই মনে হলো তার কাছে, তবে পুরোপুরি শুকনো। নতুন সিনথেটিক টাফের ব্যাপারে সে পড়েছে, প্রফেশনাল অ্যাথলেটরাও নাকি বোকা বনে যায় এসব দেখে। কিন্তু কিয়ার্শ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে, সামান্য উঁচু-নিচু গ্রাউন্ড তৈরি করেছে সে। ফলে সত্যিকারের ঘাসের মাঠের মতোই মনে হয়।

প্রথমবার এরকম বোকা বনে যাওয়ার ঘটনাটির কথা মনে পড়ে গেল ল্যাংডনের। তখন সে বেশ ছোট, একটা নৌকায় করে পৃর্ণিমা রাতে হারবারে ঘুরছিল, জলদস্যুদের একটি জাহাজ কানফাঁটা শব্দে কামানের গোলা দাগিয়ে যুদ্ধ করছিল সেখানে। ল্যাংডনের শিশুমন এটা বুঝতেই পারেনি, সে আসলে হারবারে নৌকোতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে না, বরং এমন একটি ভূগর্ভস্থ অন্ধকার সিনেমা হলে বসে আছে, যে জায়গাটা পানি দিয়ে পুরোপুরি প্লাবিত করা হয়েছে ডিজনির ওয়ার্ল্ড রাইড পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান-এর আবহ সৃষ্টি করার জন্য।

আজ রাতের ইফেক্টটা অসম্ভব রকমের বাস্তবিক, আর তার চারপাশে বসে থাকা বাকি অতিথিদের চোখমুখ দেখে সে বুঝতে পারছে, তাদের অবস্থাও তার মতোই। এডমন্ডকে এজন্যে কৃতিত্ব দিতেই হয়-এই মনোমুগ্ধকর ইল্যুশন সৃষ্টি করার জন্য নয়, বরং শত শত প্রাপ্তবয়স্ক অতিথিকে পায়ের জুতো খুলে এরকম একটি লনে বসে বসে এসব দেখতে রীতিমতো বাধ্য করেছে বলে।

শিশুকালে আমরা এরকমটা করতাম, কিন্তু এক পর্যায়ে এসে বাদ দিয়ে দিতাম।

ল্যাংডন বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে নরম ঘাসে শুয়ে পড়লো।

মাথার উপরে আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি চলছে, কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে আবারো টিনেজার ভাবতে শুরু করলো সে। মাঝরাতে বন্ড পিক-এর গলফ কোর্সে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে শুয়ে শুয়ে জীবনের রহস্য নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে, মনে মনে বলল ল্যাংডন, এডমন্ড কিয়াশ আজ রাতে সেইসব রহস্যের মধ্যে কিছু রহস্যের সমাধান হয়তো দিতে পারবে।

*

থিয়েটারের পেছনে, অ্যাডমিরাল লুই আভিলা শেষবারের মতো ঘরটা ভালো করে দেখে নিঃশব্দে পিছু হটতে লাগলো। একটু আগে যে পর্দা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল সেটা দিয়েই সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেল সে। টানেলের প্রবেশমুখে সে এখন একা, কাপড়ের দেয়াল হাতরে বেড়ালো যতোক্ষণ না একটা সেলাইয়ের ভাঁজ খুঁজে পেলো। যতোটা সম্ভব নিঃশব্দে নাইলনের কাপড়টার জোড়া দেয়া জায়গাটাতে একটা ফাঁক করতে পারলো সে। দেয়াল থেকে সরে এসে কাপড়ের জোড়াটা আবার আগের মতো ঠিক করে রেখে দিলো।

সব ইস্যুশন কেটে গেছে।

আভিলা মোটেও কোন মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের একটি আয়তক্ষেত্রের মধ্যে, যার মধ্যে রয়েছে বিরাট বড় একটি ডিম্বাকৃতির বুদবুদ। ঘরের ভেতরে বানানো আরেকটি ঘর। তার সামনে। যে স্থাপনাটি আছে সেটা অনেকটা ডোমড থিয়েটারের মতোই। এর চারপাশে ঘিরে আছে টাওয়ারে মতো উঁচু উঁচু পিলার আর মাচাঙ। মাচাঙের উপরে রাখা আছে তারের দঙ্গল, অসংখ্য বাতি আর অডিও স্পিকার। ভেতরের দিকে তাক করে রাখা আছে অনেকগুলো ভিডিও প্রজেক্টর, তারা একইসাথে নিচের স্বচ্ছ পর্দার উপরে আলোকরশ্মি প্রক্ষেপণ করে যাচ্ছে। এরফলে সৃষ্টি হয়েছে তারাময় আকাশ আর পাহাড়ঘেরা একটি দৃশ্যের আবহ।

কিয়ার্শের নাটকিয়তার প্রতি এমন ঝোঁককে মনে মনে প্রশংসাই করলো আভিলা, যদিও ফিউচারিস্ট কখনও কল্পনাও করেনি খুব জলদি আজকের রাতটা তার জন্য কতোটা নাটকিয় হয়ে উঠবে।

মনে রেখো, বিপদের কথাটা মনে রেখো। একটি মহাযুদ্ধের তুমি একজন সৈনিক। অনেক বড় আর বিশাল কিছুর অংশ।

অসংখ্যবার এই মিশনটা নিয়ে মনে মনে রিহার্সেল করেছে আভিলা। পকেট থেকে বড় আকারের রোসারি জপমালাটি বের করে আনলো সে। এই মুহূর্তে, ডোমের ভেতরে, উপরে থাকা স্পিকারগুলো থেকে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর এমনভাবে গর্জে উঠলো যেন সেটা ঈশ্বরের কণ্ঠ।

গুড ইভনিং, বন্ধুরা। আমার নাম এডমন্ড কিয়ার্শ।

.

অধ্যায় ১৬

বুদাপেস্টে রাবাই কোভেস নার্ভাস হয়ে নিজের হাৎজিকো স্টাডির মৃদু আলোতে পায়চারি করছেন। তার হাতে টিভির রিমোটটা ধরা, বিশপ ভালদেসপিনোর কাছ থেকে আরো কিছু সংবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করার সময় উদ্বিগ্ন হয়ে একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছেন তিনি।

বিগত দশ মিনিট ধরে চ্যানেলগুলো তাদের নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রেখে গুগেনহাইম থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে দিয়েছে। কমেন্টেটররা আলোচনা করছে এ পর্যন্ত কিয়াশ কি কি করেছে, আর একটু পর সে কী ঘোষণা দিতে যাবে সেটা নিয়েও নানান রকমের অনুমাণ করা চলছে। আগ্রহের পারদ এরকম তুঙ্গে উঠে গেছে বলে কোভেসের চোখমুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো।

এই ঘোষণাটা আমি এরইমধ্যে দেখে ফেলেছি।

তিনদিন আগে মন্তসেরাতে কোভেস, আল-ফজল আর ভালদেসপিনোর জন্য এটার একটা রাফকাট ভার্সন নিয়ে হাজির হয়েছিল কিয়ার্শ। এখন, কোভেসের সন্দেহ হচ্ছে, সারা দুনিয়া ঠিক ঐ প্রোগ্রামটা দেখবে একটু পর।

আজ রাতে সবকিছু বদলে যাবে, বিষণ্ণ হয়ে ভাবলেন তিনি।

ফোনটা বেজে উঠলে চমকে উঠলেন কোভেস। হ্যান্ডসেটটা হাতে তুলে নিলেন তিনি।

কোনরকম দেরি না করেই ভালদেসপিনো শুরু করলেন, ইয়েহুদা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আরো খারাপ খবর আছে আমার কাছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে যে অস্বস্তিকর খবরটা জানতে পেরেছেন সেটা জানালেন।

আতঙ্কে মুখচাপা দিলেন কোভেস। আল্লামা আল-ফজল…সুইসাইড করেছেন?

পুলিশ সেরকমটাই ধারণা করছে। মরুভূমি থেকে একটু আগে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে…সব দেখে মনে হয়েছে, তিনি যেন মরে যাবার জন্যই ওখানে চলে গেছিলেন। একটু থামলেন ভালদেসপিনো। আমার কেবলই মনে হচ্ছে শেষ কয়েকদিন তিনি যে মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছিলেন সেটা আর নিতে পারেননি।

সম্ভাবনাটার কথা বিবেচনা করলেন কোভেস, শোকের পাশাপাশি তার মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহও দেখা দিলো। তিনিও কিয়ার্শের আবিষ্কারটা নিয়ে যারপরনাই মানসিক পীড়নের মধ্যে আছেন, তারপরও এ কারণে আল্লামা আল ফজল নিজের জীবন নিজে নিয়েছেন বলে তার কাছে মোটেও মনে হচ্ছে না।

কিছু একটা ঘাপলা আছে, কোভেস বললেন। আমার বিশ্বাস হয় না তিনি এরকম কাজ করতে পারেন।

দীর্ঘ সময়ের জন্য চুপ মেরে গেলেন ভালদেসপিনো। আপনি এটা বলেছেন দেখে খুশিই হয়েছি আমি, অবশেষে বললেন। স্বীকার করছি, আমি নিজেও তার আত্মহত্যার ব্যাপারটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না।

তাহলে…কে এমন কাজ করতে পারলো?

এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কারটি যেন প্রকাশ না পায়-এরকমটা যারা চায় তাদের যে কেউই হতে পারে, দ্রুত জবাব দিলেন বিশপ। এমন কেউ, যে কিনা আমাদের মতোই বিশ্বাস করতো তার ঘোষণাটি আরো কয়েক সপ্তাহ পরে দেয়া হবে।

কিন্তু কিয়ার্শ তো বলেছিল তার এই আবিষ্কারের কথা কেউই জানে না! বললেন কোভেস। কেবলমাত্র আপনি আমি আর আল-ফজল ছাড়া।

হতে পারে এ ব্যাপারে কিয়ার্শ মিথ্যে বলেছে আমাদের কাছে। কিন্তু আমাদের তিনজনও যদি এ কথা জেনে থাকি, তাহলে ভুলে যাবেন না, আমাদের বন্ধু সাঈদ আল-ফজল এটা প্রকাশ করার ব্যাপারে কতোটা মরিয়া। ছিলেন। হতে পারে, আল্লামা এই তথ্যটা আরব আমিরাতে তার কোন কলিগের সাথে শেয়ার করেছিলেন। আর সেই কলিগ হয়তো আপনার আমার মতোই। বিশ্বাস করে, কিয়ার্শের এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ পেলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে।

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই রাবাই জানতে চাইলেন। আল-ফজলের ঐ কলিগই তাকে চুপ করানোর জন্য খুনটা করেছে? এটা তো হাস্যকর!

রাবাই, শান্ত কণ্ঠে বললেন বিশপ। আমি আসলে নিশ্চিত করে জানি না কী হয়েছে। আপনার মতো আমি অনুমাণ করছি কেবল।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কোভেস। আমি দুঃখিত। সাঈদের মৃত্যুর খবরটা এখনও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার।

আমারও হচ্ছে। সাঈদ যা জানতেন তার জন্যে যদি খুন হয়ে থাকেন তাহলে আমাদেরকেও সাবধানে থাকতে হবে। আমি এবং আপনিও টার্গেট হতে পারি।

কথাটা বিবেচনা করে দেখলেন কোভেস। খবরটা সারা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যাবার পর এটা নিয়ে আর আমাদের চিন্তা না করলেও হবে।

সত্যি, কিন্তু এটা এখনও সবাই জানে না।

মহানুভব, ঘোষণাটি আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই দেয়া হবে। সব কটা চ্যানেল এটা প্রচার করছে।

হ্যা…ক্লান্তিকর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভালদেসপিনো। মনে হচ্ছে, আমার প্রার্থনায় যে কোন কাজ হবে না সেটা আমাকে মেনে নিতেই হচ্ছে।

কোভেস ভাবলেন, সত্যিই বিশপ এরকম কোন প্রার্থনা করেছেন কিনা যাতে করে কিয়ার্শের মন বদলাতে পারে।

এমন কি এটা জানাজানি হবার পরও, ভালদেসপিনো বললেন, আমরা কিন্তু নিরাপদ থাকবো না। আমার মনে হচ্ছে কিয়ার্শ সারা দুনিয়াকে আনন্দের। সাথেই জানিয়ে দেবে, তিনদিন আগে সে ধর্মিয় নেতাদের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছে। আর সে যদি আমাদের নামও বলে দেয় তাহলে আমাদের নিজেদের সম্প্রদায় আর গোষ্ঠির লোকজনদের রোষানলে পড়ে যাবো আমরা। তারা হয়তো মনে করবে, এর বিরুদ্ধে আমাদের পদেক্ষপ নেয়া উচিত ছিল। আমি দুঃখিত, আমি কেবল…বিশপ একটু ইতস্তত করলেন, যেন তিনি আরো কিছু বলতে চাইছেন।

কী সেটা? কোভেস চাপ দিলেন।

আমরা এটা নিয়ে পরে কথা বলবো। কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা শেষ হলে আমি আপনাকে ফোন দিচ্ছি। তার আগপর্যন্ত দয়া করে বাড়িতেই থাকুন। দরজায় তালা মেরে রাখুন। কারো সঙ্গে কথা বলবেন না। নিরাপদে থাকেন।

আপনি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছেন, আন্তোনিও।

আমি ঘাবড়ে দেয়ার জন্য এটা বলিনি, জবাবে বললেন ভালদেসপিনো। আমরা একটু অপেক্ষা করে দেখি সারা দুনিয়া কী প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটা এখন ঈশ্বরের হাতে।

.

অধ্যায় ১৭

উপর থেকে এডমন্ড কিয়ার্শের কণ্ঠটা গমগম করে উঠতেই গুগেনহাইম মিউজিয়ামের ভেতরে সবুজ ঘাসের মাঠে নীরবতা নেমে এলো। শত শত অতিথি কম্বলে শুয়ে মনোমুগ্ধকর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রবার্ট ল্যাংডন শুয়ে আছে মাঠের মাঝখানে, কী হতে যাচ্ছে সেই ভাবনায় সে-ও। আক্রান্ত।

আজ রাতে চলুন আমরা সবাই আবার শিশু হয়ে যাই, কিয়ার্শের কণ্ঠটা বলতে শুরু করলো। আমাদের মনটা যতোটুকু সম্ভব প্রসারিত করে দিয়ে আসুন তারাদের নিচে শুয়ে পড়ি।

অতিথিদের মধ্যে যে উত্তেজনার স্রোত বয়ে গেল সেটা টের পেলো। ল্যাংডন।

আজ রাতে, আসুন আমরা সবাই প্রাচীনকালের অভিযাত্রিদের মতো হয়ে যাই, যারা সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল…তাদের মতো যারা কখনও না দেখা দেশ প্রথম দেখতে পেয়েছিল…যারা বুঝতে পেরেছিল, দর্শন যতোটা কল্পনা করতে পারে তার চেয়ে এই পৃথিবী আরো অনেক বিশাল। নিজেদের পৃথিবী সম্পর্কে তাদের সুদীর্ঘকালের বিশ্বাস নতুন আবিষ্কারের ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছিল। আজকের রাতে এটাই হবে আমাদের মাইন্ডসেট।

দুর্দান্ত, মনে মনে বলে উঠলো ল্যাংডন। এডমন্ড এসব কথা প্রিরেকর্ড করে রেখেছে নাকি মঞ্চের পেছনে বসে স্ক্রিপ্ট দেখে বলছে তা নিয়ে কৌতূহলি হয়ে উঠলো সে।

বন্ধুরা তাদের মাথার উপর এডমন্ডের কণ্ঠটা প্রতিধ্বণি তুলল-আজ রাতে আমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছি গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কারের খবর শোনার জন্য। আজ রাতে সমস্ত মানবিক দর্শনের পরিবর্তন হতে দেখবো

আমরা, সুতরাং এই মুহূর্তটার জন্ম কিভাবে হলো সেটা পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদেরকে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

ডানদিক থেকে একটা বজ্রপাতের শব্দ হলো। এর গম্ভীর আওয়াজ একেবারে মর্মে মর্মে উপলবিব্ধ করতে পারলো ল্যাংডন।

আজ রাতে আমাদেরকে এ ব্যাপারে একটু অভ্যস্ত হতে সাহায্য করবার জন্য, এডমুন্ড বলতে লাগলো, এখানে উপস্থিত আছেন, সেলেব্রেটেড স্কলার-কোড, ইতিহাস, ধর্ম, আর্ট আর সিম্বলের দুনিয়ায় একজন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তি। তিনি আর কেউ নন, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু। লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আসুন আমরা সবাই হারভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনকে স্বাগত জানাই।

চারপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত করতালির মধ্যে কনুইর উপরে ভর দিয়ে একটু উঠে বসলো ল্যাংডন। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেল তারাগুলো, তার বদলে সেখানে লোকে লোকারণ্য বিশাল একটি অডিটোরিয়ামের ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল শট ভেসে উঠলো। মঞ্চে হ্যারিস টুইড জ্যাকেট পরা ল্যাংডন পায়চারি করছে।

তাহলে আমার এই ভূমিকার কথাই এডমন্ড বলেছিল, ভাবলো সে। একটু অস্বস্তি বোধ করলেও আবারো ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো সে।

প্রাচীনকালের মানুষেরা, পদায় ল্যাংডনকে লেকচার দিতে দেখা যাচ্ছে, তাদের এই জগত্তা নিয়ে অপার বিস্ময়ের সাথেই ভাবতো, বিশেষ করে যেসব ঘটনা তারা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারতো না। এইসব রহস্য সমাধানকল্পে-যেসব জিনিস তাদের বোধগম্যতার বাইরে ছিল-বজ্রপাত, জোয়ার, ভূমিকম্প, আগ্নেগিরির অগ্নপাত, বন্ধ্যাত্ব, প্লেগ এমনকি ভালোবাসা-সেগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য সৃষ্টি করলো অসংখ্য দেব-দেবি।

এটা বাস্তব নয়, পরাবাস্তব, ভাবলো ল্যাংডন। শুয়ে শুয়ে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে সে মাথার উপরে।

প্রাচীন গ্রিকের মানুষজন সমুদ্রের জোয়ার-ভাটাকে পসাইডনের মেজাজ মর্জি বলে ধরে নিতো। মাথার উপরে ল্যাংডনের ছবিটা উধাও হয়ে গেল, যদিও কণ্ঠটা ঠিকই বলে চলেছে এখনও।

সামুদ্রিক ঢেউয়ের শব্দে পুরো ঘরটা কেঁপে উঠলো। অবাক হয়ে দেখলো ল্যাংডন, দৃশ্যের সাথে সাথে ঘাসের মাঠেও এক ধরণের ঠান্ডা সামুদ্রিক বাতাস বয়ে যাচ্ছে।

ঋতু বদলে গিয়ে যে শীত আসে, ল্যাংডনের কণ্ঠ বলে গেল আগের মতোই, তার কারণ, প্রতি বছর পার্সিফোনকে অপহরণ করে ভূগর্ভস্থ জগতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে এই গ্রহ শোক প্রকাশ করে থাকে।

বাতাস আবারো উষ্ণ হয়ে উঠলো। বরফে জমে থাকা বিশাল ভূখণ্ডের দৃশ্যটা বদলে গিয়ে একটা পাহাড় ভেসে উঠলো এবার। ওটার চূড়া থেকে স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে, উদগীরিত হচ্ছে আগুন, বোয়া আর লাভা।

রোমানরা বিশ্বাস করতো, প্রফেসর বলল, আগ্নেয়গিরিগুলো আসলে ভালকানের বাসা-দেবতাদের কামার তিনি-পাহাড়ের নিচে বসে বিশাল এক কামারশালায় কাজ করেন, পাহাড়ের এই অগ্নপাত আসলে তার কামারশালার চিমনি দিয়ে বের হওয়া আগুনের ফুলকি আর ধোয়া।

সালফারে মৃদু গন্ধ পেলো ল্যাংডন। অবাক হয়ে ভাবলো, মাল্টি-সেন্সরিস ব্যবহার করে কতোটা নিখুঁতভাবেই না তার লেকচারটাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে এডমন্ড।

আগ্নেয়গিরির গর্জন হঠাৎ করেই থেমে গেল। নীরবতা নেমে আসতেই শোনা গেল ঝিঁঝিপোকার শব্দ। ঘাসের মাঠে বয়ে গেল মৃদুমন্দ বাতাস।

এভাবে প্রচীনকালের মানুষেরা…সিম্বলজিস্ট ব্যাখ্যা করলো…কেবলমাত্র তাদের গ্রহের রহস্যের সমাধানের আশায়ই নয়, বরং নিজেদের শরীরের রহস্যের কূলকিণারা করতে অসংখ্য দেব-দেবি সৃষ্টি করেছিল।

মাথার উপরে ঝিকিমিকি করতে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জটা আবার উদয় হলো। এখন অবশ্য তার উপরে অনেকগুলো দেব-দেবির লাইন ড্রইং দেখা যাচ্ছে। এরা সবাই বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে।

বন্ধ্যাত্বের কারণ হলো দেবি জুনোর আশির্বাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া। এরোসের তীর যাকে বিদ্ধ করবে সে-ই প্রেমে পড়ে। মাহামারিকে ব্যাখ্যা করা হতো অ্যাপোলোর শাস্তি হিসেবে।

নতুন আরেকটি নক্ষত্রপুঞ্জের আবির্ভাব ঘটলো, সেই সঙ্গে নতুন কিছু দেব দেবির ছবিও।

আপনারা যদি আমার বই পড়ে থাকেন, ল্যাংডন বলল, তাহলে নিশ্চয় জানেন আমি প্রায়শই গড অব দি গ্যাপস্ বলে একটা টার্ম ব্যবহার করি। এটা দিয়ে আমি আসলে বোঝাতে চাই, প্রাচীনকালের মানুষেরা যখন তাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে গিয়ে কিছু গ্যাপ খুঁজে পেতো তখন তারা সেটা পূরণ করতো গড দিয়ে।

আকাশটা এবার ভরে উঠলো প্রাচীন সব দেবতার বড় বড় ছবি আর মূর্তি দিয়ে।

অসংখ্য গ্যাপ পূরণ করলো অসংখ্য গড, ল্যাংডন বলল। আর এদিকে শত শত বছর ধরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। আকাশ ভরে উঠলো গাণিতিক আর টেকনিক্যাল সিম্বলগুলো দিয়ে। আমাদের প্রাকৃতিক জগতকে বোঝার ক্ষেত্রে যে গ্যাপগুলো ছিল সেগুলো আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যেতে শুরু করলে দেব-দেবিরাও গুরুত্ব হারাতে শুরু করলো। তারা আর আগের মতো সর্বেসর্বা হিসেবে রইলো না।

এবার পসাইডনের ছবি ভেসে উঠলো।

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, যখন আমরা জানতে পারলাম জোয়ার-ভাটার কারণ আসলে চাঁদের পরিক্রমণ তখন আর পসাইডনের কোন দরকার পড়লো না। আমরা তাকে অন্ধকার যুগের ফালতু মিথ বলে খারিজ করে দিলাম।

পসাইডনের ছবিটা দেয়া হয়ে উড়ে গেল।

আপনারা জানেন, একই ভাগ্য বরণ করে নিয়েছে বাকি দেব দেবিরাও-আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে একে একে মরতে শুরু করলো তারা।

মাথার উপরে থাকা দেবতাদের ছবিগুলো একে একে নিভে যেতে লাগলো-বজ্রপাত, ভূমিকম্প, প্লেগ, এরকম দেবতারা।

ছবিগুলো অপসৃত হতেই ল্যাংডনের কণ্ঠ আরো যোগ করলো, তবে ভুলে যাবেন না, এইসব দেবতারা আমাদেরকে টাটা-গুডনাইট বলে এমনি এমনি বিদায় নিয়েছে। কোন একটি সংস্কৃতির জন্য তার দেব-দেবিদেরকে পরিত্যাগ করার প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ কিছু না। আধ্যাত্মিক বিশ্বাস আমাদের মনোজগতে গভীরভাবে প্রোথিত করে দেয়া হয় আমাদের শৈশবকালেই। আর। এ কাজটা করেন আমাদের সবচাইতে কাছের এবং ভালোবাসার মানুষেরা-বাবা-মা, শিক্ষক, ধর্মগুরু। সেজন্যে যখনই কোন ধর্মমতের বদল ঘটেছে তখন সেটা চরম উৎকণ্ঠা, নৈরাজ্য আর রক্তপাত ছাড়া হয়নি বললেই চলে।

তলোয়ারের ঝনঝনানি আর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দের সাথে সাথে দেবতারা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। অবশেষে একটিমাত্র ঈশ্বরের ছবি রয়ে গেল সেখানে-বহুল পরিচিত সাদা গোঁফ-দাড়ির একটি মুখ।

জিউস…ল্যাংডন ঘোষণা দিলো জোড়ালো কণ্ঠে। সব দেবতার দেবতা। প্যাগানদের সমস্ত দেব-দেবির মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর এবং শ্রদ্ধাভাজন যিনি। অন্য যেকোন দেবতার চেয়ে জিউস অনেক বেশি লড়াই করেছে টিকে থাকার জন্য।

মাথার উপরে স্টোনহেঞ্জ, সুমেরিয়ানদের কিউনিফর্ম লিপি আর মিশরের পিরামিডের ছবি ভেসে উঠলো। তারপরই আবার ফিরে এলো জিউসের ছবিটা।

জিউসের অনুসারিরা তাদের দেবতাকে কোনভাবেই ছাড়তে রাজি হয়নি, যার কারণে বিজয়ি খৃস্ট্রিয় ধর্মের পক্ষেও তাদের নতুন ঈশ্বরের মুখ হিসেবে জিউসের প্রতিচ্ছবি বেছে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

সিলিংয়ে এখন দাড়িমুখের জিউসের ছবিটা রুপান্তরিত হয়ে পরিচিত একটি মুখ হয়ে উঠলো-সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেলাঞ্জোর আঁকা ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম ফ্রেসকোতে ঈশ্বরের মুখটা।

আজ আমরা জিউসের কোন গল্পই আর বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না ছাগলের কাছে প্রতিপালিত হওয়া একটি বাচ্চা ছেলে সাইক্লোপ নামের একচোখা এক দৈত্যের কাছ থেকে তার সমস্ত ক্ষমতা লাভ করেছিল। আমাদের কাছে এসব গালগল্প মিথলজি হিসেবেই বেঁচেবর্তে আছে-আমাদের কুসংস্কারগ্রস্ত অতীতের মজার গল্প এগুলো।

মাথার উপরে এবার ভেসে উঠলো পুরনো, ধুলিমাখা একটি লাইব্রেরির ছবি। শেফে দেখা যাচ্ছে মিথলজির উপরে বিভিন্ন ধরণের বইপুস্তক, চামড়ায় বাধানো বাল, ইনানা, ওসিরিস আর অসংখ্য প্রাচীন ধর্মপুস্তক।

এখন আর সেই দিন নেই! ল্যাংডনের গম্ভীর কণ্ঠ ঘোষনা দিলো। আমরা এখন আধুনিক।

আকাশে নতুন ছবি ভেসে উঠলো-মহাশূণ্যের অভিযান…কম্পিউটার চিপস…একটা মেডিকেল ল্যাব…একটা পার্টিকেল এক্সেলেটর…জেট বিমান।

আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দিন দিন উন্নতি করছি, টেকনোলজিক্যালি বেশ দক্ষ হয়ে উঠছি। বিশালাকারের একজন কামার আগ্নেয়গিরির নিচে বসে কাজ করছে কিংবা দেবতারা জোয়ার-ভাটা, ঋতু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে বলেও বিশ্বাস করি না।

নাকি করি? আপন মনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো ল্যাংডন, ভেসে আসা স্পিকারের কণ্ঠের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে।

নাকি করি? প্রফেসরের কণ্ঠ এখন বেশ জোরে শোনালো। নিজেদেরকে আমরা এখন যুক্তিবাদি হিসেবে বিবেচনা করি, তারপরও আমাদের মনুষ্য প্রজাতিটির প্রায় সবগুলো প্রধান ধর্ম অলৌকিক সব ঘটনার দাবি করে থাকে-মৃত অবস্থা থেকে আবার পুণরুত্থিত হওয়া, কুমারি মায়ের পেটে বাচ্চা আসা, বিক্ষুব্ধ ঈশ্বর শাস্তি দেবার জন্য প্লেগ, বন্যার সৃষ্টি করেন, পরকালে চমৎকার স্বর্গ লাভ অথবা আগুনের নরকে ঠাই পাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ল্যাংডনের এসব কথা ভেসে আসার সময় পর্দায় দেখা গেল অনেকগুলো ছবি-জিশুর পুণরুত্থান, কুমারি মেরি, নুহের নৌকা, লোহিত সাগরের ভাগ হয়ে যাওয়া, স্বর্গ আর নরক।

সুতরাং কয়েক মুহূর্তের জন্য আসুন একটা দৃশ্যের কথা কল্পনা করি আমরা, বলল ল্যাংডন, মানব-সভ্যতার ভবিষ্যতের ইতিহাসবেত্তা আর নৃবিজ্ঞানীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে তারা কি আমাদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মবিশ্বাসগুলোকে মিথলজির মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের গালগল্প হিসেবে চিহ্নিত করবে? আমরা জিউসকে এখন যেভাবে দেখি তারাও কি আমাদের ঈশ্বরদেরকে একইভাবে দেখবে? আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো সংগ্রহ করে তারা কি সেগুলোকে ধুলোয় মলিন ইতিহাসের বুকশেলফে রেখে দেবে?

প্রশ্নটা কয়েক মুহূর্ত ভেসে বেড়ালো অন্ধকারের মাঝে। তারপর আচমকাই এডমন্ড কিয়ার্শের কণ্ঠ ভেঙে দিলো সেই নীরবতা।

হ্যাঁ, প্রফেসর, ফিউচারিস্টের গমগমে কণ্ঠ উপর থেকে বলে উঠলো। আমি বিশ্বাস করি এরকমটাই হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদেরকে প্রশ্ন করবে, কী করে আমাদের মতো টেকনোলজিক্যালি অগ্রসর একটি প্রজাতি তাদের ধর্মগুলোর আজগুবি সব কথাবার্তায় বিশ্বাস রাখতো।

সিলিংয়ে নতুন কিছু ইমেজ ভেসে উঠতেই কিয়ার্শের কণ্ঠ যেন আরো শক্তিশালি হয়ে উঠলো-আদম আর হাওয়া, বোরখা পরা একজন মহিলা, হিন্দুদের আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া।

আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের বর্তমান ধর্মগুলোর কথা শুনে এই ধারণাই করবে, কিয়া ঘোষণা দিলো, আমরা আসলে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক যুগে বাস করতাম। এর সপক্ষে তারা আমাদের ধর্মগুলোর অনেক মতবাদ আর দাবি তুলে ধরবে, যা নিয়ে বর্তমান সময়ে আমরা নিজেরাও কমবেশি প্রশ্ন তুলে থাকি।

আরো ইমেজ ভেসে উঠলো বিভিন্ন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের খণ্ড খণ্ড চিত্র-এক্সরসিজম থেকে শুরু করে ব্যাপ্টিজম, শারীরে সুঁচ ফোঁটানো, পশু বলি দেয়া। এই স্লাইড শোটি শেষ হলো খুবই আৎকে ওঠার মতো একটি ভিডিও দিয়ে : এক ভারতীয় পুরোহিত পঞ্চাশ ফুট উঁচু টাওয়ারের উপর থেকে এক নবজাতক শিশুকে দোলাচ্ছে। আচমকা সেই পুরোহিত বাচ্চাটা হাত থেকে ছেড়ে দিলো, সেই নবজাতক উপর থেকে পড়ে ডিগবাজি খেয়ে। পঞ্চাশ ফিট নিচে একটি বিশাল চাঁদর ধরে রেখেছে একদল গ্রামবাসি, বাচ্চাটা সেই চাঁদরে পতিত হলো।

শ্ৰী সান্তেশ্বর মন্দিরের নিক্ষেপ, ল্যাংডন মনে মনে বলে উঠলো। যারা এটা করে তারা বিশ্বাস করে এর মাধ্যমে শিশুটি ঈশ্বরের আশির্বাদ লাভ করবে।

স্বস্তির কথা হলো, এই ভয়ঙ্কর ভিডিওটা দ্রুতই শেষ হলো।

এবার পুরোপুরি অন্ধকারে কিয়ার্শের কণ্ঠটা বলে উঠলো। কিভাবে আধুনিক মানবসভ্যতায় বসবাসকারি মানুষ, যারা কিনা সূক্ষ্ম লজিক্যাল অ্যানালিসিস করতে সক্ষম, একইসাথে আবার এরকম ধর্মবিশ্বাসে আস্থা রাখে, যা কিনা সামান্যতম যৌক্তিক চিন্তাভাবনা করলেই হুরমুরিয়ে খুঁড়িয়ে পড়বে?

মাথার উপরে আবারো তারাগুলো ফিরে এলো। বলতে গেলে এই প্রশ্নের জবাবটা খুবই সহজ-সরল, এডমন্ড বলল।

আকাশের তারাগুলো এ সময় হঠাৎ করেই আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এক গোছা সংযোগসৃষ্টিকারি ফাঁইবারের ছবিও দেখা গেল সেই সাথে, তারাগুলোর ভেতর দিয় চলে গেছে সেগুলো তৈরি করেছে অসংখ্য আন্তঃসংযোগের একটি জাল।

নিউরন, এডমন্ড কথা বলা শুরু করতেই বুঝতে পারলো ল্যাংডন।

মানুষের মস্তিষ্ক, ঘোষণা করলো কিয়ার্শ। নিছক বিশ্বাসের জন্য বিশ্বাস করবে কে?

নিউরনের জটগুলো চমকিত হলো এবার। যেন এর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে।

অনেকটা জৈব-কম্পিউটারের মতো, এডমন্ড বলতে লাগলো, আপনাদের মস্তিষ্কেরও একটি অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে-অসংখ্য নিয়ম আছে যার মাধ্যমে সারাদিনভর ইনপুট নেয়া জিনিসগুলোকে সংগঠিত করে, সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে-ভাষা, চমঙ্কার সুরেলা গান, সাইরেনের শব্দ, চকোলেটের স্বাদ। ইনকামিং তথ্যগুলোর স্রোত বিক্ষিপ্ত, উত্তাল আর বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে বইতে থাকে, আর আপনার মস্তিষ্ককে এসব বুঝে নিতে হয়। সত্যি বলতে কি, এই কাজটা করে আপনার মস্তিষ্কের অপারেটিং সিস্টেমের সুনির্দিষ্ট একটি প্রোগ্রাম, এটাই আপনাকে বাস্তবতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে শেখায়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের সাথে যেন তামাশা করার জন্যই, আমাদের মস্তিষ্কের জন্য এই প্রোগ্রামটি যিনিই তৈরি করে থাকুন না কেন তার রসবোধ একটু অপ্রতিকার। অন্য কথায় বললে, আমরা যে ফালতু সব জিনিসে বিশ্বাস। করি তার জন্যে আমাদের কোন দোষ দেয়া যায় না।

মস্তিষ্কের ভেতর থেকে পরিচিত অনেক ইমেজ বুদবুদের মতো বের হয়ে আসতে দেখা গেল পদায় : জ্যোর্তিবিদ্যার চার্ট, জিশুর পানির উপর দিয়ে হাটা; সায়েন্টোলজি ধর্মের প্রবর্তক এল. রন হুবার্ড; মিশরিয় দেবতা ওসিরিস; হিন্দুদের হাতিমুখো দেবতা গণেশ, এবং কুমারিমাতা মেরি কাঁদছে এরকম

একটি মার্বেলের মূর্তি।

একজন প্রোগ্রামার হিসেবে, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি : কি ধরণের ফালতু অপারেটিং সিস্টেম এরকম অযৌক্তিক আউটপুট তৈরি করতে পারে? আমরা যদি মানব-মস্তিষ্কে অপারেটিং সিস্টেমটাকে ঠিকমতো পড়তে পারি তাহলে এরকম কিছুই দেখতে পাবো।

মাথার উপরে ছয়টি বিশাল শব্দ উদ্ভাসিত হলো।

বিশৃঙ্খলা ঘৃণা করো।
শৃঙ্খলা
তৈরি করো

এটা আমাদের মস্তিষ্কের রুট প্রোগ্রাম, বলল এডমন্ড। আর সেজন্যেই মানুষের ঝোঁকও সেরকম হয়ে থাকে। বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। শৃঙ্খলার পক্ষে।

এবার প্রচণ্ড শব্দে ভুলভাল নোটে পিয়ানো বেজে উঠলো, যেন কোন বাচ্চা ছেলে পিয়ানোর কিবোর্ডে আন্দাজে টোকা মেরে যাচ্ছে। ল্যাংডন এবং তার আশেপাশে থাকা মানুষজন না চাইলেও অস্থির হয়ে উঠলো।

এই বেসুরো আওয়াজের মধ্যেই চিৎকার করে বলল এডমন্ড। পিয়ানো যদি কেউ উল্টাপাল্টা বাজায় তাহলে তার শব্দ আমরা সহ্য করতে পারি না! কিন্তু ঐ একই নোটগুলো যদি আমরা সুন্দর করে সাজিয়ে বাজাই…বেসুরো পিয়ানোর সুর হঠাৎ করেই থেমে গেল, তার বদলে বেজে উঠলো ডিব্যাশির ক্লেয়ার দে লুন-এর সুরেলা সঙ্গিত।

ল্যাংডন টের পেলো তার মাংসপেশি রিল্যাক্স হয়ে এসেছে। সেই সাথে এই ঘরে যে টেনশন তৈরি হয়েছিল সেটাও দূরীভূত হয়ে গেল নিমেষে।

আমাদের মস্তিষ্ক এখন প্রশান্তি পাচ্ছে, এডমন্ড বলল। একই নোটগুলো। বাজছে, বাদ্যযন্ত্রটাও একই আছে। কিন্তু ডিব্যাশি সেগুলোকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে সাজিয়েছেন। মানুষ এই একই প্রশান্তি লাভ করে জিগশ পাজল মিলিয়ে, কিংবা দেয়ালে বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকা পেইন্টিংয়ের ফ্রেমটা ঠিকঠাক করে দিয়ে। সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার আমাদের এই প্রবণতা আমাদের ডিএন-এর মধ্যেই প্রোথিত করা আছে। সেজন্যে এতে মোটেও অবাক হবার কিছু নেই, মানুষের মস্তিষ্ক তার সেরা যে আবিষ্কারটি করেছে সেটা কম্পিউটার-এটা এমন এক মেশিন যা আমাদেরকে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা তৈরি করতে সাহায্য করে। সত্যি বলতে কি, স্প্যানিশে কম্পিউটার শব্দটিকে বলে অরদেনাদোর-আক্ষরিক অর্থেই, যা কিনা অর্ডার ক্রিয়েট করে।

সুপার কম্পিউটারের বিশাল একটি ইমেজ দেখা গেল এবার, ওটার টার্মিনালে এক তরুণ বসে আছে।

কল্পনা করুন, আপনার কাছে এমন একটি কম্পিউটার আছে যার রয়েছে এ বিশ্বের সব তথ্যে অ্যাকসিস করার ক্ষমতা। আপনি এই কম্পিউটারকে যেকোন প্রশ্নই করতে পারেন। সম্ভাব্যতার সূত্রমতে, আপনি সেই দুটো প্রশ্নের একটি করবেন যে দুটো মৌলিক প্রশ্ন মানুষের আত্মসচেতনতা তৈরি হবার পর থেকেই উদ্ভব হয়েছে।

কম্পিউটার টার্মিনালে বসে থাকা তরুণ টাইপ করতে শুরু করলো। তার টাইপ করা লেখা ভেসে উঠলো আকাশে।

কোথা হতে এলাম আমরা?
কোথা
য় আমরা যাচিছ?

সোজা ভাষা বলতে গেলে, এডমন্ড বলল, আপনি আসলে আমাদের অরিজিন অর্থাৎ উৎস এবং নিয়তি সম্পর্কে জানতে চাইবেন। এই প্রশ্নদুটো যখন করবেন তখন কম্পিউটার আপনাকে এই জবাবটি দেবে।

টার্মিনালটা ফ্ল্যাশ করে উঠলো :

অপর্যাপ্ত ডাটার কারণে যথাযথ জবাব দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

নাহ্, কাজ হলো না, কিয়াশ বলল, কিন্তু নিদেনপক্ষে যন্ত্রটা সতা দেখিয়েছে।

এবার মানুষের মস্তিষ্কের একটি ছবি ভেসে উঠলো।

কিন্তু আপনি যদি এই ছোট্ট বায়োলজিক্যাল কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করেন-কোত্থেকে এসেছি আমরা?-তাহলে অন্য কিছু ঘটবে।

মস্তিষ্ক থেকে ধর্মিয় সব ছবি বিচ্ছুরিত হতে লাগলো এবার-ঈশ্বর তার সৃষ্ট আদমের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করছেন, প্রমিথিউস কাদা থেকে আদিম মানুষ নির্মাণ করছে, ব্রহ্মা তার নিজের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন ধরণের মানুষ তৈরি করছে, এক আফ্রিকান দেবতা মেঘপুঞ্জ ভাগ করে দু দুটো মানবসন্তানকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনছে, এক নর্স দেবতা ভেসে আসা কাঠের খণ্ড থেকে নারী ও পুরুষ বানাচ্ছে।

এখন আপনি জিজ্ঞেস করুন, এডমন্ড বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

মস্তিষ্ক থেকে আরো কিছু ছবি বিচ্ছুরিত হতে লাগলো-পূতপবিত্র স্বর্গ, অগ্নিকুণ্ডের নরক, মিশরিয়দের বুক অব ডেথ-এর হায়ারোগ্লিফ, পাথরে খোদাই করা নাক্ষত্রিক বস্তু, গ্রিকদের ইলিশিয়ান ফিল্ডে কর্মতৎপরতা, গিলগুল নেশামত-এর কাব্বালিস্টিক বর্ণনা। বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্মের পুণর্জন্মের ডায়াগ্রাম দুটো, সামারল্যান্ডের ধর্মচক্র।

মানুষের মস্তিষ্কের কাছে, এডমন্ড ব্যাখ্যা করলো, কোন জবাব না দেয়ার চাইতে যেকোন জবাব দেয়াটাই শ্রেয়। অপর্যাপ্ত ডাটার মুখোমুখি হলেই আমরা যারপরনাই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাই, সেজন্যে আমাদের মস্তিষ্ক ডাটা তৈরি করে নেয়-আমাদেরকে নিবেদন করে শৃঙ্খলার ইল্যুশন-অসংখ্য দর্শন, মিথলজি আর ধর্ম তৈরি করে আমাদেরকে আশ্বস্ত করতে চায় যে, অদেখা জগতে অবশ্যই একটি শৃঙ্খলা এবং কাঠামো রয়েছে।

ধর্মিয় ইমেজগুলো আবর্তিত হতে থাকলে এডমন্ডের কণ্ঠ আরো বেশি প্রবল হয়ে উঠলো।

আমরা কোত্থেকে এসেছি? কোথায় যাচ্ছি? মানুষের এই মৌলিক দুটো প্রশ্ন আমাকে সব সময়ই মোহাচ্ছন্ন করে রাখতো। কয়েক বছর ধরে আমি স্বপ্ন। দেখা শুরু করেছিলাম এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার জন্য। একটু থামলো। এডমন্ড, তার কণ্ঠ আবারো মিয়ান হয়ে গেল। ট্র্যাজিক ব্যাপার হলো, ধর্মিয় মতবাদগুলোর কারণে লক্ষ-কোটি মানুষ বিশ্বাস করে তারা এ দুটো প্রশ্নের জবাব এরইমধ্যে জানে। আর যেহেতু সব ধর্ম এই প্রশ্নগুলোর একই রকম। জবাব দেয়নি, ফলে কার জবাবটা সত্যি, কার ঈশ্বরের গল্পটা একমাত্র সত্যি। গল্প সেটা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে।

পর্দায় এবার দেখা গেল গানফাইট, মর্টার শেলের বিস্ফোরণ-ধর্মযুদ্ধের সহিংস সব চিত্র। এরপরই ভেসে উঠলো শরণার্থিদের কান্না, বাস্তুচ্যুত মানুষ আর বেসামরিক লোকজনের মৃতদেহের ছবি।

ধর্মের শুরু থেকে নাস্তিক, খৃস্টান, মুসলিম, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, সব ধর্মের বিশ্বাসি মানুষ অনন্তকালের এক ক্ৰশফায়ারের মধ্যে পড়ে গেছে। একমাত্র যে জিনিসটি আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখে সেটা হলো শান্তির প্রতি আমাদের সুগভীর আকাঙ্খা।

যুদ্ধের ছবি পাল্টে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠলো রাতের নিরব তারাভরা আকাশ।

কল্পনা করুন, আমরা যদি অলৌকিকভাবে জীবনের সবচাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নদুটোর জবাব পেয়ে যাই তাহলে কী ঘটতে পারে…আমরা সবাই যদি হঠাৎ করে অভ্রান্ত সেই প্রমাণের দেখা পেয়ে যাই, বুঝতে পারি দু-হাত বাড়িয়ে একে গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।

একজন যাজকের ছবি দেখা গেল এবার, তিনি চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছেন।

আধ্যাত্মিক অন্বেষণই সব সময় ধর্মের চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়ে আসছে, এজন্যে আমরা অন্ধভাবে এর শিক্ষাকে অনুসরণ করতে সাহস পাই, যদিও সেগুলো খুব কমই যৌক্তিক বলে মনে হয়।

ধর্মবিশ্বাসিদের কিছু ইমেজ দেখা গেল এবার, সবার চোখ বন্ধ, গান গাইছে, মাথা নত করছে, মন্ত্র পড়ছে, প্রার্থনা করছে। অদৃশ্য, অবর্ণনীয় কিছুকে মেনে নিতে বলছে।

কিন্তু ধর্মবিশ্বাস, ঘোষণার সুরে বলল এডমন্ড, এর নিজস্ব সংজ্ঞার কারণেই, আপনার কাছ থেকে অন্ধ আনুগত্য দাবি করে; অদৃশ্য, অবর্ণনীয় কিছু দাবি করে। তাই বোধগম্য কারণেই, আমরা ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের বিশ্বাস স্থাপন করি কারণ চিরন্তন সত্য বলে কিছু নেই। একটু থেমে আবার বলল সে, যদিও…এবার একটা মাত্র ছবি ভেসে উঠলো। এক ছাত্রি চোখ প্রসারিত করে সাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে।

বিজ্ঞান হলো ধর্মবিশ্বাসের পুরোপুরি বিপরীত জিনিস, কিয়ার্শ আবার বলতে লাগলো, চরিত্রগত দিক থেকে বিজ্ঞান অজানা, অচেনা, কিংবা এখনও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি এরকম কিছুর ভৌত প্রমাণ খুঁজে বেড়ায়। সেইসাথে প্রমাণের অভাবে বাতিল করে দেয় সব ধরণের কুসংস্কার আর মিসপারসেপশানকে। বিজ্ঞান যখন কোন প্রশ্নের জবাব দেয় সেটা হয় সার্বজনীন। মানুষ সেটা নিয়ে লড়াই করতে শুরু করে না। তারা এটাকে মেনে। নেয়।

পর্দায় এবার দেখা গেল নাসার ঐতিহাসিক ল্যাব, সিইআরএন (সার্ন), এবং অন্যসব জায়গার ছবি-যেখানে সব জাতের বিজ্ঞানীরা একত্রে কাজ করছে। নতুন কোন তথ্য আবিষ্কার করার জন্য।

বন্ধুরা, এডমন্ডের কণ্ঠ এখন ফিসফিসানিতে পরিণত হলো, আমি আমার জীবনে অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছি। আজ রাতে আমি সেরকম আরো একটা ভবিষ্যদ্বাণী করবো। আস্তে করে গভীর দম নিয়ে নিলা সে। ধর্মের যুগ শেষ হতে যাচ্ছে, বলল সে, বিজ্ঞানের যুগ সমাগত।

পুরো ঘরে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল।

আজ রাতে মানবসভ্যতা সেই পথে বড়সর একটি উল্লম্ফন দিতে যাচ্ছে।

কথাগুলো ল্যাংডনের ভেতরে অপ্রত্যাশিত এক ভয় ধরিয়ে দিলো। যে রহস্যময় আবিষ্কারের কথাই সে বলুক না কেন, স্পষ্টতই পৃথিবীর সব ধর্মের বিরুদ্ধে একটা বিরাট শো-ডাউন হয়ে উঠেছে এডমন্ডের এই মঞ্চটি।

.

অধ্যায় ১৮

কন্সপিরেসিনেট.কম

এডমন্ড কিয়ার্শ আপডেট

ধর্ম ছাড়া ভবিষ্যৎ?

বর্তমানে লাইভ স্ট্রিমে ত্রিশ লক্ষ দর্শকের অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়ার্শের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘোষনা দেবার এই অনুষ্ঠানটি। ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তার এই আবিষ্কারটি মানব সভ্যতার ইতিহাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব নিহিত রয়েছে। হারভার্ডের সিম্বলজিস্ট রবার্ট ল্যাংডনের রেকর্ড করা একটি চমকপ্রদ লেকচার প্রদর্শন করার পর এডমন্ড কিয়ার্শ ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনামূলক একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ধর্মের যুগ শেষ হয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত আজ রাতে এই সুপরিচিত নাস্তিককে আগের তুলনায় একটু বেশি সংযত আর শ্রদ্ধাশীল হিসেবে দেখা গেছে। অতীতে কিয়ার্শের ধর্মবিরুদ্ধ বক্তব্যের সংগ্রহটি দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

.

অধ্যায় ১৯

ডোম-থিয়েটারের কাপড়ের দেয়ালের বাইরে অ্যাডমিরাল আভিলা অসংখ্য মাচাঙের মধ্যে সবার দৃষ্টির আড়ালে পজিশন নিয়ে নিলো। একটু নিচু হয়ে থাকার কারণে, সে তার ছায়াটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে, এখন অডিটোরিয়ামের সামনের দিকে স্কিনওয়ালের সাথে গা ঘেঁষে স্থির হয়ে আছে।

নীরবে-নিঃশব্দে সে তার পকেট থেকে রোসারির জপমালাটা বের করে আনলো।

টাইমিংটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

জপমালার স্ট্রিংটা হাতিয়ে ভারি ধাতব শিফিক্সটা পেয়ে গেল সে। নিচে মেটাল ডিটেক্টরের সামনে থাকা গার্ডরা জিনিসটা দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখেনি। খুব সহজেই সেই বাধা পেরোনো সম্ভব হয়েছে।

ক্রুশিফিক্সের বেইজে লুকিয়ে রাখা আছে একটি রেজর ব্লেড, অ্যাডমিরাল আভিলা কাপড়ের দেয়ালটি ছয় ইঞ্চির মতো কেটে ফেলল ওটা দিয়ে। আস্তে করে সেই কাটা অংশটি ফাঁক করে উঁকি দিয়ে আরেকটি জগত দেখতে পেলো সে-ঘাসে ঢাকা একটি মাঠে কম্বল বিছিয়ে বসে আছে শত শত অতিথি, তাদের সবার দৃষ্টি উপরের দিকে।

তারা জানে না কী হতে যাচ্ছে।

গার্ডিয়া রিয়েলের দু-জন এজেন্টকে মাঠের বিপরীতে, অডিটোরিয়ামের ডানদিকের এক কোণে অবস্থান নিতে দেখে খুশি হলো সে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা, কিছু গাছপালার আড়ালে থাকায় খুব একটা চোখেও পড়ছে না। স্বল্প আলোয় আভিলাকে দেখা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। যখন দেখতে পাবে তোক্ষণে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে।

এই দু-জন গার্ডের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে জাদুঘরের ডিরেক্টর অ্যাম্ব্রা ভিদাল, কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন দেখে, মনে হচ্ছে সে একটু অস্বস্তি বোধ করছে।

নিজের অবস্থান নিয়ে খুশি আভিলা, কাপড়ের ফাঁকটা বন্ধ করে দিয়ে ক্রুশিফিক্সের দিকে মনোযোগ দিলো এবার। বেশিরভাগ ক্রশের মতোই এটাতেও ছোট দুটো হাত আছে, কিন্তু এই ক্ৰশটার হাতদুটো লম্বা দণ্ডটির সাথে চুম্বকের সাহায্যে লাগানো। ফলে হাতদুটো খুলে ফেলা যায়।

একটা হাত ধরে শক্ত করে বাঁকিয়ে দিলো আভিলা, ছোট্ট টুকরোটা খুলে তার হাতে চলে এলো। অন্য হাতটিও একইভাবে খুলে ফেললে ক্রুশিফিক্সটা হাতবিহীন হয়ে পড়লো এবার-এখন কেবলই ভারি চেইনের সাথে আটকে থাকা একটি চৌকোনো ধাতব দণ্ড এটি।

জপমালার চেইনটা সে আবারো পকেটে রেখে দিলো। একটু পরই এটা আমার দরকার পড়বে। এবার সে ক্রশের হাতদুটোর ভেতরে লুকিয়ে রাখা ক্ষুদ্র। দুটো জিনিসের দিকে মনোযোগ দিলো।

দুটো শর্ট-রেঞ্জের বুলেট।

আভিলা পেছনে হাত দিয়ে তার বেল্টের নিচে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট জিনিসটা বের করে আনলো। সুট জ্যাকেটের নিচে করে এটা এখানে নিয়ে এসেছে সে।

কয়েক বছর আগে এক আমেরিকান টিনেজার কোডি উইলসন দ্য লিবারেটর নামের একটি জিনিস ডিজাইন করেছিল পৃথিবীর প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টেড পলিমার পিস্তল-এরপর এই টেকনোলজিটা দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে। নতুন সিরামিক এবং পলিমার অস্ত্র এখনও তেমন একটা শক্তিশালি হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু রেঞ্জের দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও এ কথা সত্যি, এগুলোকে আসলে মেটাল ডিটেক্টর ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে বয়ে নেবার জন্যই বানানো হয়ে থাকে।

আমাকে কেবল একটু কাছাকাছি যেতে হবে।

সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিক এগোয়, তাহলে তার বর্তমান অবস্থানটি একেবারে পারফেক্ট।

দ্য রিজেন্ট কিভাবে যেন আজকের এই অনুষ্ঠানের বিস্তারিত সবকিছু জেনে নিয়েছে। প্রেজেন্টেশনের লে-আউট এবং কোনটার পর কী হবে সবই রয়েছে তার মধ্যে…তাকে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে, এই মিশনটা বাস্তবায়ন করতেই হবে। ফলাফল খুবই নৃশংস হবে, কিন্তু কিয়ার্শের আজকের এই ঈশ্বরবিরোধি বক্তব্য শোনার পর আভিলা এখন পুরোপুরি নিশ্চিত, তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

আমাদের শত্রুরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, দ্য রিজেন্ট তাকে বলেছিল। আমাদেরকে হয় মরতে হবে নয়তো মারতে হবে।

অডিটোরিয়ামের ডানদিকের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্ব্রা ভিদাল আশা করছে, তাকে যেন দেখে মনে না হয় সে খুব অস্বস্তিতে রয়েছে।

এডমন্ড আমাকে বলেছিল এটা একটা বৈজ্ঞানিক প্রোগ্রাম।

এই আমেরিকান ফিউচারিস্ট ধর্মের ব্যাপারে নিজের বিদ্বেষের কথা কখনও লুকোছাপা করেনি। কিন্তু অ্যাম্ব্রা কখনও ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি আজকের প্রেজেন্টেশনটা এরকম সরাসরিভাবে ধর্মকে আঘাত করবে।

এডমন্ড আমাকে অনুষ্ঠানটি প্রিভিউও করতে দেয়নি।

জাদুঘরের বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে, তবে এ মুহূর্তে অ্যাম্ৰার দুশ্চিন্তা তার নিজেকে নিয়ে নয় মোটেও।

কয়েক সপ্তাহ আগে খুবই প্রভাবশালি একজন মানুষের কাছে আজকের এই অনুষ্ঠানে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল অ্যাম্রা। ঐ ব্যক্তি তাকে বেশ তাগিদ দিয়ে বলেছিল এসবে যেন সে অংশগ্রহণ না করে। কোন অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে একদম কিছু না জেনে অন্ধের মতো উপস্থাপনা। করার যে বিপদ থাকতে পারে সে-ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। সে-বিশেষ করে অনুষ্ঠানটি যখন সর্বসাধারণের কাছে নাস্তিক হিসেবে পরিচিত এডমন্ড কিয়ারে।

তিনি আমাকে রীতিমতো হুকুম দিয়ে বলেছিলেন আমি যেন এটা ক্যান্সেল করে দেই, স্মরণ করলো সে। কিন্তু তার অতিরিক্ত নীতিবাগিশ কথাবার্তা শুনে আমি আর আমলে নেইনি তার কথাটা।

এখন তারাভরা এই আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অ্যাম্ৰা ভাবছে, ঐ লোকটা কি এখন দূরে কোথাও বসে কপালে হাত রেখে এই লাইভ অনুষ্ঠানটি দেখছে কিনা।

অবশ্যই দেখছে, মনে মনে বলল সে। আসল প্রশ্নটা হলো : সে কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

*

আলমুদেনা ক্যাথেড্রালের ভেতরে নিজের অফিস ডেস্কে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন বিশপ ভালদেসপিনো। তার চোখ আঠার মতো লেগে আছে ল্যাপটপের পদায়। তার মনে কোন সন্দেহ নেই, কাছেই অবস্থিত রাজপ্রাসাদের সবাই এই অনুষ্ঠানটি দেখছে, বিশেষ করে যুবরাজ হুলিয়ান-যে কিনা স্পেনের পরবর্তি রাজা হবার পথে আছেন।

যুবরাজ নির্ঘাত ক্ষুব্ধ হবেন।

আজ রাতে স্পেনের সবচাইতে নামকরা জাদুঘর বিখ্যাত এক আমেরিকান নাস্তিকের এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করছে যেটাকে ধর্মিয় পণ্ডিতেরা এরইমধ্যে ব্লাসফেমাস, খৃস্টবিরোধি পাবলিসিটি স্টান্টবাজি বলে অভিহিত করেছে। এই বিতর্কে আরো ঘি ঢেলেছে জাদুঘরের ডিরেক্টর, স্পেনের সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে দৃশ্যমান সেলিব্রেটি, সুন্দরি অ্যাম্ব্রা ভিদাল-মহিলা এরকম একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করে তার ক্যারিয়ারকে শুধু হুমকির মুখেই ফেলেনি, ঈশ্বর নিন্দার মতো কঠিন পাপেরও ভাগিদার হয়েছে।

স্পেনের সার্বভৌম ক্যাথলিক ফিগার হিসেবে তার আসন্ন ভূমিকা আজকের এই অনুষ্ঠানের পর খুব সামান্যই চ্যালেঞ্জের শিকার হবে। কিন্তু বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, গত মাসেই যুবরাজ হুলিয়ান আত্নাদিত হয়ে এমন একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তার ফলে এই অ্যাম্ব্রা ভিদাল স্পটলাইটে চলে আসে।

তিনি তাদের বিয়ের এনগেজমেন্টের ঘোষণা দিয়েছেন।

.

অধ্যায় ২০

আজকের অনুষ্ঠানটি যেদিকে যাচ্ছে তাতে করে অস্বস্তি বোধ করছে রবার্ট ল্যাংডন।

সাধারণভাবে বলতে গেলে, এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটি বিপজ্জনকভাবেই প্রকাশ্যে ধর্মবিরোধিতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো, এডমন্ড কি কোনভাবে ভুলে গেছে কিনা, সে কেবলমাত্র এই ঘরে থাকা একদল এগনোস্টিক বিজ্ঞানীর সামনেই এসব বলছে না, বরং তার কথা শুনছে এ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।

তার এই প্রেজেন্টেশন নির্ঘাত বিতর্কের আগুন ছড়িয়ে দেবে।

এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিয়েও চিন্তায় পড়ে গেছে ল্যাংডন, যদিও তার লেকচারের ভিডিওটা প্রর্দশন করে এডমন্ড তাকে এক ধরণের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে, কিন্তু এটাও সত্যি, অজান্তেই সে অতীতের ধর্মিয় বিতর্কগুলোর দিকে আঙুল তুলে দিয়েছে…এমন কাজ আর কখনও করবে না বলে মনে মনে প্রতীজ্ঞা করলো প্রফেসর।

কিয়ার্শ আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মের উপরে আঘাত হেনেছে। ল্যাংডন এখন নতুন করে ভাবতে শুরু করলো বিশপ ভালদেসপিনোর ভয়েসমেইলে দেয়া হুমকির কথাটা আমলে না। নেয়ার ব্যাপারটি। এডমন্ডকে সে আশ্বস্ত করে বলেছিল, এ নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই।

এডমন্ডের কণ্ঠটা আবারো শোনা গেল ঘরে। মাথার উপরে থাকা দৃশ্যটি এবার বদলে গিয়ে এ বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মের সিম্বলে ভরে উঠলো। আমি স্বীকার করছি, আজকের এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমার মনেও কিছুটা দ্বিধা ছিল। বিশেষ করে ধার্মিকেরা এটা কিভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। একটু থামলো সে। এ কারণে তিনদিন আগে আমি আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে গিয়ে একটা কাজ করেছি। ধর্মিয় দৃষ্টিকোণকে সম্মান দেখানো এবং বিভন্ন ধর্মের লোকজনদের উপরে এই আবিষ্কারটি কী রকম প্রভাব ফেলবে সেটা জানার জন্য আমি গোপনে ইসলাম, খৃস্টান আর ইহুদি ধর্মের তিনজন ধর্মবেত্তার সাথে এ নিয়ে গোপনে আলোচনা করি। তাদেরকে আমার আবিষ্কারটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত করেছি।

পুরো ঘরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।

আমি যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলাম, তিনজনের সবাই যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন, তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন তারা। এমনকি রেগেও গেছিলেন আমার আবিষ্কারের সবটা দেখেশুনে। তাদের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হলেও আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে সময় দেবার জন্য। আরো বলি, তাদের সম্মানে আমি তাদের নাম প্রকাশ করবো না। তবে আজ আমি তাদেরকে সরাসরি বলবো এবং ধন্যবাদ দেবো আমার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তারা কোন রকম ইন্টারফেয়ার করেননি বলে।

একটু থামলো সে। ঈশ্বর জানেন, তারা এটা ইচ্ছে করলেই করতে পারতেন।

এডমন্ডের কথা শুনতে শুনতে ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো, সে কতোটা কুশলতার সাথে সূক্ষ্মভাবে নিজের বেইজটাকে কাভার করছে। এডমন্ড কিয়াশ যে ধর্মিয়নেতাদের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা প্রমাণ করবে সবার কাছে, সে কতোটা খোলামনের অধিকারি, বিরুদ্ধমতের প্রতি কতোটা। শ্রদ্ধাশীল-সাধারণত এসব গুণাবলির জন্য এই ফিউচারিস্ট পরিচিত নয়। ল্যাংডন এখন সন্দেহ করছে, মন্তসেরাতের ঐ মিটিংটা সম্ভবত অংশত তার রিসার্চ মিশন ছিল, কিংবা পাবলিক রিলেশন্সের কোন কৌশল।

খুব সহজে পার পেয়ে যাবার একটি কৌশল, ভাবলো সে।

ঐতিহাসিকভাবে, এডমন্ড বলতে লাগলো, অতি উৎসাহি ধার্মিকেরা সব সময়ই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা করে গেছে। তাই আজ আমি সমগ্র বিশ্বের ধর্মিয় নেতাদের আহ্বান করবো, তারা যেন প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে বোঝার চেষ্টা করে আমি কী বলতে চাচ্ছি। দয়া করে রক্তাক্ত আর হিংস্র ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি করবেন না আপনারা। অতীতের মতো আর কোন ভুলও করবেন না।

এবার ভেসে উঠলো পুরনো একটি দেয়ালঘেরা শহরের ড্রইং-মরুর পাশে এক নদীর তীরে নিখুঁত বৃত্তাকারের একটি মেট্রোপলিস।

ল্যাংডন দেখেই চিনতে পারলো, এটা এক সময়কার প্রাচীন বাগদাদের ছবি।

অষ্টাদশ শতকে, এডমন্ড বলল, বাগদাদ শহরটি শিক্ষা-দীক্ষায় এ বিশ্বের সবচাইতে সমৃদ্ধ শহর ছিল। এদের লাইব্রেরি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরণের দর্শন আর বৈজ্ঞানিক মতবাদকে স্বাগত জানানো হতো। প্রায় পাঁচশত বছর ধরে এই শহরটি যে পরিমাণে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উপহার দিয়েছে নিউমেরা ব্যবহার করি রোমান সংখ্যা পৃথিবীকে সেটার কোন তুলনা নেই। আমাদের আধুনিক সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনও রয়ে গেছে।

মাথার উপরে ভেসে উঠলো কিছু তারকার নাম : ভেগা, বেতেলগিউস, রিগেল, আলজেব্রা, দেনেব, আকরাব, কিতালফা।

এই নামগুলোর সবই এসেছে আরবি থেকে, বলল এডমন্ড। আজকের দিনে আকাশের দুই তৃতীয়াংশ তারকার নাম এসেছে এই ভাষা থেকে, এর কারণ এসব তারকা আরববিশ্বের জ্যেতির্বিদরাই আবিষ্কার করেছিলেন।

আকাশে একের পর এক তারা আর আরবি নাম ভেসে উঠতে শুরু করলো। নামগুলো আবার মিইয়েও গেল কিছুক্ষণ পর। ফাঁকা হয়ে গেল পুরো আকাশ।

আমরা যদি তারাগুলো গুণতে চাই…। জ্বলজ্বলে তারার পাশাপাশি রোমান সংখ্যাগুলো ভেসে উঠলো এবার। I, II, III, IV, V…এই সংখ্যাগুলোও হুট করে উধাও হয়ে গেল আকাশ থেকে।

কিন্তু আমরা তো রোমান সংখ্যা ব্যবহার করি না, এডমন্ড বলল। আমরা ব্যবহার করি আরবি সংখ্যা-যাকে আমরা সবাই অ্যারাবিক নিউমেরালস বলে চিনি।

আবারো কিছু সংখ্যা ভেসে উঠলো, এবার সেগুলো আরবি সংখ্যা পদ্ধতির। 1, 2, 3, 4, 5…

আপনারা হয়তো এইসব ইসলামিক আবিষ্কারগুলো চিনতে পারবেন, বলল এডমন্ড। সেগুলোর বেলায় আমরা এখনও আরবি নাম ব্যবহার করি।

অ্যালজেব্রা শব্দটি আকাশে দেখা গেল। তর চারপাশে মাল্টিভেরিয়েবল ইকুয়েশনগুলো। এরপর ভেসে উঠলো অসংখ্য ফর্মুলার সারির সাথে অ্যালগোরিদম শব্দটি। এরপর আজিমুথ শব্দটি, তার সাথে পৃথিবীর দিগন্তে একটি অ্যাঞ্জেল দাঁড়িয়ে আছে এরকম একটি ডায়াগ্রাম। এরপর দ্রুত ভেসে উঠলো কিছু শব্দ : নাদির, জেনিথ, অ্যালকেমি, কেমিস্ট্রি, সাইফার, এলিক্সির, অ্যালকোহল, অ্যালকেলাইন, জিরো…

আরবি শব্দগুলো একে একে ভেসে ওঠার সময় ল্যাংডন ভাবলো, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, বেশিরভাগ আমেরিকানই বাগদাদের কথা উঠলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি শহরের কথাই ভাবে। সংবাদে তারা সেরকমটিই দেখে আসছে সাম্প্রতিক সময়ে। কিন্তু তারা কখনও জানতে পারেনি এক সময় এই শহরটি ছিল এ বিশ্বের বিজ্ঞান প্রসারের কেন্দ্রবিন্দু।

এগারো শতকের মধ্যেই, এডমন্ড বলল, পৃথিবীর সব মহান আবিষ্কার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠলো বাগদাদ। তারপর বলতে গেলে রাতারাতি বদলে গেল পুরো দৃশ্যপট। হামিদ আল-গাজ্জালি নামের এক মেধাবি পণ্ডিত্যাকে এখন মুসলিম বিশ্বে সবচাইতে প্রভাবশালি মানুষদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়-ধারাবহিকভাবে কিছু লেখা লিখতে শুরু করলেন মানুষকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে। তিনি প্রশ্ন তুললেন প্লেটো এবং এরিস্টটলের ব্যাপারে, গণিতকে অভিহিত করলেন শয়তানের দর্শন হিসেবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা, যা কিনা বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে হেয় প্রতিপন্ন করলো। বাধ্যতামূলক করা হলো ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়নকে, প্রকারান্তরে সমগ্র ইসলামিক দুনিয়ায় বৈজ্ঞানিক আন্দোলনে নামলো বিরাট ধ্বস।

ইসলাম ধর্মের লেখাগুলো সরে গেল, সে-জায়গায় ভেসে উঠলো কিছু বৈজ্ঞানিক শব্দ।

ধর্মবিশ্বাস ঝেটিয়ে বিদায় করলো অনুসন্ধানকে। আজকের দিন পর্যন্ত ইসলামিক বিশ্ব তাদের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটু থামলো এডমন্ড। অবশ্য খৃস্ট্রিয় বিজ্ঞানের দুনিয়াটাও এরচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল না।

কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও আর ব্রুনো জিয়োদানোর প্রতিকৃতি ভেসে উঠলো পর্দায়।

চার্চ সিস্টেমেটিক্যালি ইতিহাসের সবচাইতে মেধাবি কিছু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, জেলে পুরেছে, প্রকাশ্যে নিন্দা করেছে। ফলে পৃথিবীর উন্নতি পিছিয়ে পড়েছে কমপক্ষে একশ বছর। আমাদের সৌভাগ্য, বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের সুবিধাগুলো ভালোমতো অনুধাবন করতে পেরে চার্চ তার আক্রমণ

একটু বদলে ফেলেছে…দীর্ঘশ্বাস ফেলল এডমন্ড। ফেলেছে কি?

ক্রুশিফিক্স আর সাপ সংম্বলিত একটি গ্লোবের লোগো ভেসে উঠলো, সেই সাথে কিছু লেখা :

বিজ্ঞান এবং প্রাণ সংক্রান্ত মাদ্রিদ ঘোষণা

এই স্পেনে, সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব দি ক্যাথলিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছে, বিজ্ঞান আত্মার খরায় ভুগছে, সেজন্যে এটার লাগাম টেনে ধরা উচিত চার্চের।

গ্লোবের লোগোটা বদলে গেল অন্য একটা বৃত্তে-বিশাল একটি পার্টিকেল এক্সেলেরেটর-এর নক্সা।

এটা হলো টেক্সাসের সুপারকন্ডাটিং সুপার কলাইডর-বর্তমানে এটাই পৃথিবীর সবচাইতে বড় পার্টিকেল কলাইডর-সৃষ্টির শুরুর মুহূর্তটা আবিষ্কার করার সম্ভাবনা নিয়ে এটা কাজ করার কথা। পরিহাসের বিষয় হলো, এই মেশিনটা স্থাপন করা হয়েছে আমেরিকার বাইবেল বেল্ট হিসেবে পরিচিত অঞ্চলের একেবারে কেন্দ্রে।

টেক্সাসের মরুভূমিতে বিশাল এলাকা নিয়ে বৃত্তাকারের একটি স্থাপনার ছবি দেখা গেল এবার। স্থাপনাটি পুরোপুরো নির্মিত হয়নি। দেখেই মনে হয়, নির্মাণের মাঝপথে ওটা পরিত্যাক্ত করা হয়েছে।

আমেরিকান এই সুপার কলাইডর থেকে আমরা পেতে পারতাম মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় কোন আবিষ্কার। এমনকিছু, যা আমাদের চিন্তাভাবনাকে আমূল পাল্টে দিতো। কিন্তু এই প্রজেক্টটা ব্যয়সাপেক্ষ এবং রাজনৈতিক চাপের দোহাই দিয়ে বাতিল করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক চাপ এসেছে চমকে যাবার মতো কিছু জায়গা থেকে।

এক তরুণ টেলিভেঞ্জেলিস্টের ভিডিও ক্লিপ দেখা গেল, হাতে একটা বেস্টসেলিং বই দ্য গড পার্টিকেল ধরে আছে, বিক্ষুব্ধ হয়ে সেটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিৎকার করে সে বলছে, আমাদের উচিত ঈশ্বরকে আমাদের হৃদয়ে মাঝে খোঁজা! কোন পরমাণুর ভেতরে নয়! বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এরকম উদ্ভট আর অর্থহীন এক্সপেরিমেন্ট টেক্সাস রাজ্যকে বিব্রত করছে, একই সাথে এটা ঈশ্বরকেও অপমান করার শামিল।

এডমন্ডের কণ্ঠটা আবার ফিরে এলো। আমি যেসব কনফ্লিক্টের কথা বললাম-সেগুলো মূলতঃ চলমান যুদ্ধের কিছু খণ্ডচিত্র।

এবার দেখা গেল আধুনিক সমাজের কিছু হিংসাত্মক ছবিজেনিটিক্স রিসার্চ ল্যাবের সামনে পিকেটাররা জড়ো হয়েছে, ট্রান্সহিউম্যানিজম কনফারেন্সের বাইরে এক যাজক নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, ইভাঞ্জেলিক্যালরা একহাতে বুক অব জেনেসিস ধরে আছে, তাদের অন্যহাত মুষ্টিবদ্ধ, জিশুর মাছ ডারইউনের মাছকে খেয়ে ফেলছে, কিছু ধর্মিয় বিলবোর্ড, যেখানে স্টেমসেল রিসার্চের নিন্দা করা হয়েছে, সমকামি অধিকার, গর্ভপাত, এরকম আরো কিছু বিষয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রচারণার ছবি।

অন্ধকারে শুয়ে আছে ল্যাংডন, তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। রীতিমতো হাতুড়ি পেটা চলছে এখন। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো নিচের

ঘাসগুলো যেন কাঁপছে, মাটির নিচ দিয়ে কোন ট্রেন চলে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনি। এরপর ভাইব্রেশনটা আরো বেড়ে গেল, বুঝতে পারলো মাটিটা আসলেই কাঁপছে। সশব্দে কেঁপে উঠছে পুরো ডোমটা।

গর্জনটা যে উত্তাল নদীর শব্দ সেটা বুঝতে পারলো ল্যাংডন। বিশাল শক্তিশালি স্পিকার এই টার্ফের নিচে বসানো আছে, সেখান থেকেই আসছে আওয়াজটা। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে, মনে হচ্ছে উত্তাল কোন নদীর মাঝখানে বসে আসে সে, ভেজা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তার চোখেমুখে।

আপনারা কি শব্দটা শুনতে পাচ্ছেন? গর্জনের মধ্যেও শোনা গেল এডমন্ডের কণ্ঠ। এটা হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উত্তাল নদীর শব্দ!

পানির গর্জন আরো বেড়ে গেল এবার, ল্যাংডন নিজের গালে কুয়াশার আদ্রতা টের পেলো।

আগুন আবিষ্কারের পর থেকে, এডমন্ড চিৎকার করে বলল, এই নদী ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। প্রতিটি আবিষ্কার পরবর্তি নতুন আবিষ্কারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আর প্রতিবারই এই নদীতে যোগ হয় একফোঁটা পানি। আজ আমরা সুনামির মাথার উপরে চড়ে বসবো। এটা এমন এক মহাপ্লাবন যা কিনা সামনের দিকে ধেয়ে যাবে প্রবল শক্তিতে। একে থামানোর কোন উপায় নেই!

পুরো ঘরটা আরো বেশি করে কাঁপতে শুরু করলো এখন।

আমরা কোত্থেকে এসেছি! চিৎকার করে বলল এডমন্ড। কোথায় যাচ্ছি আমরা! প্রশ্নদুটোর জবাব খুঁজে বের করাই আমাদের নিয়তি! এই মিলেনিয়াতে এসে আমাদের অন্বেষণের পদ্ধতি অনেক অনেক উন্নতি লাভ করেছে!

পুরো ঘরে আদ্র বাতাস বয়ে যেতে লাগলো এবার, নদীর গর্জনটা। কানফাটা শব্দে বিদীর্ণ করলো চারপাশ।

এটা বিবেচনা করে দেখুন! ঘোষণা দেবার সুরে বলল এডমন্ড। আগুন আবিষ্কারের পর প্রায় এক মিলিয়ন বছর লেগে গেছিল চাকা আবিষ্কার করতে। এরপর মাত্র কয়েক হাজার বছর পরই আবিষ্কৃত হয় প্রিন্টিং প্রেস। তারপর মাত্র। একশ বছর লাগে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করতে। পরবর্তি একশ বছরে অতি অল্প সময়ে আমরা পেয়েছি বাম্পিয় ইঞ্জিন, গ্যাসে চলা অটোমোবাইল, মহাশূণ্যযান! তারপর, মাত্র দুই দশকে আমরা আমাদের নিজেদের ডিএনএ মোডিফাই করার মতো অবস্থায় চলে এসেছি!

আমরা এখন বিজ্ঞানের উন্নতি বছরে নয়, হিসেব করি মাসে মাসে, কিয়ার্শ জোরে বলল, অগ্রগতি হচ্ছে অভাবনীয় দ্রুততার সাথে। খুব বেশি দিন লাগবে না, যখন আজকের সুপার কম্পিউটারকে মনে হবে অ্যাবাকাসের মতো কিছু। বর্তমান কালের সবচাইতে অগ্রসর সার্জিক্যাল পদ্ধতিকেও তখন বর্বর বলে মনে হবে; আজকের দিনে আমাদের সমৃদ্ধ এনার্জি সোর্সকে তখন মনে হবে মোমবাতির মতো জিনিস!

উত্তাল নদীর গর্জন আর এডমন্ডের কণ্ঠ একই সাথে চলছে অন্ধকার ঘরে।

প্রাচীন গ্রিক পুরনো সভ্যতা স্টাডি করার জন্য শত বছর পেছনে ফিরে তাকাতো, কিন্তু আমরা মাত্র এক জেনারেশন পেছনে তাকালেই দেখতে পাবো বর্তমান কালে আমাদের যে টেকনোলজি সেটা তারা ব্যবহার করেনি। মানবসভ্যতার উন্নতি হচ্ছে অসামান্য গতিতে। প্রাচীন এবং আধুনিক-এর মধ্যে যে ফারাকটা আছ সেটা ক্রমশ কমতে কমতে প্রায় বিলীন হবার পথে। এ কারণেই, আমি আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি, পরবর্তি কয়েক বছরে আৎকে ওঠার মতো উন্নতি করবে মানবসভ্যতা। নিয়ন্ত্রনহীন গতিতে এবং পুরোপুরি অচিন্তনীয়ভাবে!

হুট করেই নদীর গর্জন থেমে গেল।

আকাশে আবারো দেখা গেল অসংখ্য তারা। ফিরে এলো মৃদুমন্দ বাতাস, ঝিঁঝিপোকার ডাক।

পুরো ঘরের সব অতিথি, মনে হলো একইসাথে হাফ ছাড়লো।

এই নীরবতার মধ্যে এডমন্ডের কণ্ঠটা ফিরে এলেও সেটা ফিসফিসানির মতোই শোনালো।

বন্ধুরা, নরম করে বলল সে। আমি জানি আপনারা এখানে এসেছেন আমার একটি আবিষ্কারের কথা শোনার জন্য। বিশাল বড় ভূমিকা শোনার জন্য আপনাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আসুন, এবার আমরা অতীতের চিন্তাভাবনার শেকল থেকে বের হয়ে আসি। সময় এসেছে আবিষ্কারটির থুল শেয়ার করার।

এ কথার সাথে সাথে হালকা কুয়াশা চারপাশ থেকে গড়িয়ে আসতে লাগলো, আকাশে দেখা গেল ভোরের আবহ।

হঠাৎ করে একটা শক্তিশালি স্পটলাইট জ্বলে উঠলো, আর সেটা দুলতে দুলতে চলে গেল হলের পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব অতিথিই উঠে বসলো। তারা আশা করছে কুয়াশা ভেদ করে তাদের আমন্ত্রণদাতা হাজির হবে এখন। কয়েক সেকেন্ড পর স্পটলাইটটা গিয়ে পড়লো ঘরের সামনের দিকে।

সঙ্গে সঙ্গে দর্শক-শ্রোতাও সেদিকে তাকালো।

ওখানে, স্পটলাইটের নিচে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে এডমন্ড কিয়ার্শ। তার হাতদুটো পোডিয়ামের উপরে রাখা। কয়েক সেকেন্ড আগেও সেখানে কেউ ছিল না। গুড ইভনিং বন্ধুরা, কুয়াশা সরে যেতেই আন্তরিক কণ্ঠে বলল সে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত লোকজন দাঁড়িয়ে পড়লো তাদের আমন্ত্রণদাতাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেবার জন্য। ল্যাংডনও তাদের সাথে যোগ দিলো, নিজের হাসিটা আটকে রাখতে সক্ষম হলো না সে।

ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলা হলেও, এ পর্যন্ত আজ রাতে এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা অসাধারণ ছিল-সাহসি এবং অপ্রতিরোধ্য-ঠিক তার মতোই। এবার ল্যাংডন বুঝতে পারলো, কেন এ বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মুক্তচিন্তার মানুষজন। এডমন্ডকে এতটা শ্রদ্ধা করে।

অন্য কিছু বাদ দিলেও, সে এমন কথা বলে যেটা খুব কম মানুষই বলার সাহস রাখে। এডমন্ডের ছবিটা যখন মাথার উপরে থাকা পর্দায় দেখতে পেলো ল্যাংডন তখন আগের চেয়েও অনেক কম ফ্যাকাশে দেখতে পেলো তাকে। তারপরও, সাবেক ছাত্রের মুখে ক্লান্তির ছাপটা ধরতে পারলো সিম্বলজির প্রফেসর।

হাততালির কারণে ল্যাংডন টের পেলো না তার বুকপকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করছে। টের পেতেই ফোনটা হাতে নিতে গেল সে, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো ওটা অফ করে রাখা আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ভাইব্রেশনটা তার পকেটে থাকা অন্য একটা জিনিস থেকে হচ্ছে-বোন কনডাক্টর হেডসেট-ওটা। দিয়ে এখন উইনস্টন তার সাথে কথা বলতে চাইছে নিশ্চয়।

আর সময় পেলো না!

জ্যাকেটের পকেট থেকে ওটা বের করে মাথায় পরে নিতেই উইনস্টনের কণ্ঠটা শুনতে পেলো।

–সর ল্যাংডন? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ফোনগুলো সব ডিজেবল করা। আপনিই এখন আমার একমাত্র কন্ট্যাক্ট। প্রফেসর ল্যাংডন?!

হ্যাঁ-উইনস্টন, আমি শুনতে পাচ্ছি, করতালির শব্দের মধ্যেই জবাব দিলো ল্যাংডন।

আহ, বাঁচা গেল। বলল উইনস্টন। খুব মন দিয়ে শুনুন। আমাদের সিরিয়াস একটা সমস্যা হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *