০৩. এন্টিম্যাটারের কথা

২১.

মনে হয় আপনি এন্টিম্যাটারের কথা আগে থেকেই জানেন, তাই না মিস্টার

ল্যাঙডন? জিজ্ঞাসা করল ভিট্টোরিয়া।

জানতাম… একটু।

আপনি স্টার ট্রেক দেখেন, তাই না?

আমার ছাত্র ছাত্রীরা দেখে। ইউ এস এস এন্টারপ্রাইজকে চালায় না এন্টিম্যাটার?

ভাল সায়েন্স ফিকশন ভাল সায়েন্সের উপর ভর করে তৈরি।

তাহলে এন্টিম্যাটারের কাহিনী সত্যি?

প্রকৃতির গৃঢ় ব্যাপার। সব কিছুর বিপরীত ব্যাপার আছে। প্রোটনের বিপরীত ইলেক্ট্রন, আপ কোয়ার্কের ক্ষেত্রে ডাউন কোয়ার্ক। প্রতিবস্তু সব হিসাবের মধ্যে একটা পূর্ণতা এনে দেয়।

এখনো বিশ্বাস হতে চায় না ব্যাপারটা।

উনিশো আঠারো থেকেই বিজ্ঞানীরা জানে যে সব ব্যাপারের বিপরীত আছে। বিগ ব্যাঙে এন্টিম্যাটার তৈরি হয়েছিল।

এক ধরনের বস্তু আমরা। আমাদের পৃথিবী, শরীর, বৃক্ষ, সব। আর এর বিপরীতের সব একই রকম, শুধু এর চার্জের ক্ষেত্রটা উল্টো।

কোহলারের ঝালিয়ে নেয়ার সময় এসেছে, কিন্তু এ কাজের পথে বিরাট বাঁধা আছে। স্টোর করবে কী করে? আলাদা করে রাখবে কীভাবে?

প্রতিবস্তুর পজিট্রনগুলো আসার সাথে সাথে সেগুলোকে আকৃষ্ট করে আলাদা করার ব্যবস্থা করেছিলেন বাবা।

ভ্যাকুয়াম?

হ্যাঁ।

কিন্তু একটা ভ্যাকুয়াম ম্যাটার এন্টিম্যাটার দুটাকেই শুষে নিবে।

বাবা একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করলেন। ফলে, চুম্বকের প্রভাবে, ম্যাটার চলে গেল বামে আর এন্টিম্যাটার চলে গেল ডানে। বেঁকে গেল তারা বিপরীত দিকে।

এত যুক্তির ভিতরে একটু একটু করে প্রবেশ করছে কোহলার। অ… বিশ্বাস্য! বলল সে, এখনো হার মেনে নেয়নি, তাহলে সেটাকে স্টোর করবে কী করে? এই ক্যানিস্টারে ভ্যাকুয়াম থাক, কিন্তু এগুলো তো ম্যাটারের তৈরি। বস্তুর সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে প্রতিবস্তু-

স্পেসিমেন কখনোই ক্যানিস্টারের গায়ে লেগে যাবে না, বলছে ভিট্টোরিয়া, এ ক্যানিস্টারগুলোর নাম দিয়েছি এন্টিম্যাটার ট্র্যাপ। স্পেসিমেটুকু আর যাই করুক, ক্যানিস্টারের গায়ে লাগবে না কস্মিনকালেও।

কীভাবে?

দুটা ভিন্ন চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে। এদিকে, তাকান।

তাকাল কোহলার একটা কালো, বন্দুকের মত নলের ভিতর দিয়ে।

তোমরা দেখার মত এ্যামাউন্ট তৈরি করেছ?

দেখা যাচ্ছে টলটলে একটা তরল বিন্দুকে। ভাসছে।

পাঁচ হাজার ন্যানোগ্রাম। মিলিয়ন পজিট্রনের একটা লিকুইড প্লাজমা।

লক্ষ লক্ষ ! কিন্তু কেউ কখনো একত্রে মাত্র কয়েকটার বেশি এন্টিম্যাটার তৈরি করতে পারেনি।

তিনি জেননকে কাজে লাগিয়েছিলেন। জেননের জেটে পার্টিকেল বিম প্রবাহিত করেন। এগুলো ইলেক্ট্রন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। কাচা ইলেক্ট্রনও কাজে লাগে এক্সিলারেটরে।

ল্যাঙডন ভেবে পায় না এখনো তারা ইংরেজিতে কথা বলছে কিনা।

টেকনিক্যালি, তা থেকে—

ঠিক তাই! অনেক অনেক পাওয়া যাবে।

আবার তাকাল কোহলার আইপিস দিয়ে। তাকিয়েই থাকল। তারপর চোখ তুলে, কপালের রেখাকে গভীরতর করে বলল, মাই গড… তোমরা সত্যি সত্যি কাজটা করেছ!

আমার বাবা করেছেন।

কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

ল্যাওডনের দিকে তাকাল ভিট্টোরিয়া, আপনি একবার চোখ রাখবেন?

চোখ রাখল সে।

এবং দেখতে পেল।

তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জিনিসটাকে ক্যানিস্টারের তলায় পাওয়া গেল না। পারদের মত চকচকে একটা তরল ভেসে আছে উপরে। এর উপরিতলে সর্বক্ষণ কাঁপন উঠে আসছে। একবার শূণ্যতায় পানির ফোটার কাজ দেখেছিল সে। এ ব্যাপারটাও তেম্নি।

এটা… ভাসছে এটা!

এমন থাকাই তার সাজে, বলল ভিট্টোরিয়া, এন্টিম্যাটার চরম অস্থিতিশীল। এন্টিম্যাটার আর ম্যাটার যদি একত্র হয় তাহলে তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে। বাতাসের সংস্পর্শ এলেও ফুসে উঠবে তারা।

আবার হতবাক হয়ে যায় ল্যাঙডন।

ভ্যাকুয়ামে কাজ করার কথা বলছে!

এন্টিম্যাটার ট্র্যাপগুলোও কি, বলছে কোহলার, তোমার বাবার কাজ?

আসলে,.. সেটার ভার আমার।

চোখ তুলে তাকাল কোহলার।

আমিই তাকে পথ বাৎলে দিই। বলি এমন একটা পথ বের করার কথা।

তাকিয়ে থাকল ল্যাঙডন। কোহলারের কথাই সত্যি। এ অসাধারণ।

চুম্বকের পাওয়ার সোর্স কোনটা?

ট্র্যাপের নিচের একটা পিলার। অবাক হলেও সত্যি, ফাদের ব্যাপারটা অসম্ভব ভাল। .

সে ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু যদি কারেন্ট চলে গেল?

হতেই পারে। বোতলের এ অংশটায় তরল চলে আসে, আমরা একটা বিস্ফোরণ ঘটাব। দেখব এ্যানিহিলেশস।

এ্যানিহিলেশন? ভেবে পায় না এ কথার মানে।

যদি একবার এখানে, আমাদের কাছাকাছি, পৃথিবীর বুকে একটা প্রতিবস্তুর কণা পড়ে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। এন্টিম্যাটার আর ম্যাটার মিললে এ পরিণতি হবেই।

ওহ!

এটা একেবারে সহজ। একটা বস্তু আর প্রতিবস্তু পরস্পরের সাথে মিলিত হলে নতুন একটা কণা বেরোয়। ফোটন। আলোর কণা।

ল্যাঙডন ফোটনের কথা পড়েছে। বলা চলে আলোর একক। শক্তির প্যাকেট। ক্লিঙ্গনদের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেন কার্ক কীভাবে ফোনট ব্যবহার করে তা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। তার মানে, এন্টিম্যাটার পড়লে আমরা আলোর একটা ছোট্ট রেখা দেখতে পাব?

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া, নির্ভর করছে কোনটাকে আপনি ছোট্ট বলেন। এখানে, আমাকে দেখাতে দিন।

একটা ক্যানিস্টারকে প্রস্তুত করল সে।

সাথে সাথে যেন পাগল হয়ে গেল কোহলার।

ভিট্টোরিয়া! পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?

 

২১.

কোহলার, অবিশ্বাস্যভাবে, তার দু পায়ের উপর, কাঠির মত দু পায়ের উপর ভর দেয়। তার চেহারা কাগজের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আতঙ্কে। ডিরেক্টরের হঠাৎ আসা আতঙ্কের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না ল্যাঙডন।

পাঁচশ ন্যানোগ্রাম! তুমি যদি চৌম্বক্ষেত্রটা ভাঙ…।

ডিরেক্টর! এটা একেবারে নিরাপদ। প্রত্যেকটা ট্র্যাপের ফেইল সেফ আছে। রিচার্জার থেকে সরিয়ে আনলে একটা ব্যাটারি তাকে ব্যাক আপ দিবে। ভয় নেই।

ব্যাটারিগুলো অটোম্যাটিক এ্যাকটিভেটেড হয়। চব্বিশ ঘণ্টা। লাগাতার।

প্রতিবস্তুর একটা বিচিত্র ব্যবহার আছে, মিস্টার ল্যাঙডন। একটা দশ মিলিগ্রামের প্রতিবস্তু, বালির কণার সমান যার আয়তন, দুশ মেট্রিকটন প্রচলিত রকেট ফুয়েলের চেয়েও বেশি কাজ করে।

আবার চক্কর দিতে শুরু করল ল্যাঙড়নের মাথা।

এই আগামী দিনের শক্তির উৎস। নিউক্লিয়ার এ্যানার্জির চেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষমতাবান। একশোভাগ কর্মক্ষম। কোন বাই প্রোডাক্ট নেই। নেই তেজস্ক্রিয়তা। নেই দূষণ। মাত্র কয়েক গ্রাম বেশ কয়েকদিনের জন্য একটা বড় মহানগরীর চাহিদা মিটাতে পারবে।

গ্রাম?

দুঃখ পাবেন না। আমাদের পরীক্ষার পরিমাণ লাখ লাখ ভাগের এক ভাগ, সেই ভরের। অনেক কম ক্ষতিকর।

তুলে ফেলল ভিট্টোরিয়া একটা ক্যানিস্টার। সেখানে লেডের আলো কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছে।

২৪:০০:০০…

২৩:৫৯:৫৯…

২৩:৫৯:৫৮…

এতো টাইম বোমা!

ব্যাটারিটা, ব্যাখ্যা করছে ভিট্টোরিয়া, মরে যাবার আগে পুরোদস্তুর চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে কাজ করবে। আবার পোডিয়ামে ফিরিয়ে দিলে চার্জ হতে থাকবে। যেন বহন করা যায়, সেজন্যেই এ ব্যবস্থা।

পরিবহন? আৎকে উঠল কোহলার, তুমি এ জিনিসকে বাইরে নেয়ার মতলব আঁটছ?

অবশ্যই না। কিন্তু এতে করে আমরা কাজ আরো ভাল করে করতে পারি।

একটা দরজা খুলল ভিট্টোরিয়া। তার পিছনে আগাগোড়া ধাতুতে মোড়া একটা ঘর। মনে পড়ে গেল ল্যাঙডনের, হেনতাই কীর্তি দেখার জন্য পাপুয়া নিউ গিনিতে গিয়ে এমন ব্যাপারটা দেখেছিল সে।

এটা এ্যানিহিলেশন ট্যাঙ্ক। ঘোষণা করল ভিট্টোরিয়া।

চোখ তুলে তাকাল কোহলার, তোমরা সত্যি সত্যি এ্যানিহিলেশন কর?

বাবা। বলল ছোট্ট করে ভিট্টোরিয়া, একটা ধাতব ড্রয়ার টেনে বের করতে করতে। সাথে সাথে ট্রাপটা চলে গেল ঘরের মাঝামাঝি। …

একটা শক্ত হাসি দিল ভিট্টোরিয়া, আপনারা এখন প্রথম দেখতে পাবেন ম্যাটার আর এন্টিম্যাটারের সংঘর্ষ। অতি কম। এক গ্রামের লাখ লাখ ভাগের এক ভাগ।

বাকি দুজন বোকাটে দৃষ্টি নিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা ক্যানিস্টারটার দিকে তাকাল।

সাধারণত চব্বিশ ঘণ্টা প্রতীক্ষা করার কথা। কিন্তু এই চেম্বারটার ভিতরে, নিচে আরো শক্তিশালী ক্ষেত্র আছে। সেটা পরাস্ত করবে ক্যানিস্টারের শক্তিকে। আপনারা দেখতে পাবেন…।

এ্যানিহিলেশন? বলল কোহলার।

আরো একটা ব্যাপার। এন্টিম্যাটার একেবারে খাঁটি শক্তি নির্গত করে। ভরকে শতভাগ ফোটনে রূপান্তরিত করে। তাই সরাসরি স্যাম্পলের দিকে তাকাবেন না। শিল্ড ইউর আইস।

বেশি বেশি করছে কি ভিট্টোরিয়া? ত্রিশগজ দূরে তারা। বিশেষ কাঁচের জানালা দিয়ে আলো আসবে। ভিতরের এন্টিম্যাটারটা দেখা যাবে না।

বাটন চাপল ভিট্টোরিয়া।

একটা আলোর বিন্দু বেরিয়ে এল।

ছড়িয়ে গেল সারা এলাকায়। আলোর শকওয়েভ ঠিক ঠিক টের পেল. তারা। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল চোখ কোটর ছেড়ে।

একটা মুহূর্ত, মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ।

তারপর আলোটা ফিরে গেল আগের উৎসতে। তারপর থেমে গেল। একটা বিন্দুতে একটু জুলে থেকে গেল নিভে।

চোখ পিটপিট করল ল্যাঙডন…

গ… গড!

ঠিক এ কথাটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন আমার বাবা।

 

২৩.

কোহলার আরো বেশি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে চেম্বারের দিকে।

আমি আমার বাবাকে এবার দেখতে চাই। ল্যাব দেখিয়েছি, এবার দেখতে চাই বাবাকে।

এত দেরি কেন করলে, ভিট্টোরিয়া? তোমার আর তোমার বাবার উচিৎ ছিল এ প্রজেক্ট সম্পর্কে আগেভাগে আমাকে জানানো।

কত কারণ চাও তুমি?

ডিরেক্টর, এ নিয়ে বচসা করার অনেক সময় হাতে পাব আমরা। ঠিক এখন, আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই।

তুমি কি জান এ টেকনোলজির কত মূল্য?

শিওর, সার্নের জন্য টাকা। অসীম টাকা। এবার আমি বাবাকে দেখতে চাই।

কেন তোমরা লুকিয়ে রাখলে? আমি রেজিস্টার করে ফেলব এ ভয়ে? শুধু টাকা নয় ভিট্টোরিয়া, বিজ্ঞান একেবারে আনকোরা নূতন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল। মানবজাতি পৌঁছে যেতে চলেছিল সৃষ্টি জগতের প্রান্তে প্রান্তে। সব সায়েন্স ফিকশনের কল্পনাও চলে যাচ্ছিল পুরনো হয়ে।

এটাকে লাইসেন্সড করাও প্রয়োজন। বলল ভিট্টোরিয়া, এর গুরুত্ব আমরা ভাল করেই জানতাম। জানতাম, এ নিয়ে বিপদের সম্ভাবনাও কম নয়। আমরা সময় নিচ্ছিলাম একে আরো আরো নিরাপদ করার কাজের জন্য।

অন্য কথায়, তোমরা বোর্ড অব ডিরেক্টরসকে তোয়াক্কা করনি।

আরো কারণ আছে। বাবা এন্টিম্যাটারকে আরো আলোকিত অবস্থায় সবার সামনে উপস্থাপন করার কাজ করছিলেন।

মানে?

জেনেসিস। ঈশ্বরের উপস্থিতি।

তার মানে তিনি চাচ্ছিলেন না কেউ নাক গলাক?

অনেকটা তাই।

এবং তিনি বাণিজ্যিকতায় যেতে চাচ্ছিলেন না শুরুতেই?

অনেকটা তাই।

আর তুমি?

নিশ্চুপ ভিট্টোরিয়া। এ প্রযুক্তির জন্য রাতদিন ঘুম হারাম করেছিল তারা। গাস্টিকের আধার বানিয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যাটারি বানিয়েছে। নিরাপদ করেছে আরো আরো।

আমার আগ্রহ, বলল ভিট্টোরিয়া, বিজ্ঞান আর ধর্মকে এক করে দেয়ার চেয়ে বেশি ছিল অন্য ব্যাপারের উপর।

পরিবেশ?

এ প্রযুক্তি পুরো দুনিয়াকে বাঁচিয়ে তুলতে পারত। এক ধাক্কায় গোটা পৃথিবীকে তুলে আনতে পারত প্রথম বিশ্বের সারিতে।

অথবা এটাকে ধ্বসিয়ে দেয়া। কে ব্যবহার করছে তার উপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।

অন্য কেউ না। বলেছি আমি সেকথা।

তাহলে কী কারণে তোমার বাবা খুন হলেন?

কোন ধারণাই নেই। সার্নে তার শত্রুর কোন অভাব ছিল না। কিন্তু এর সাথে এন্টিম্যাটারের কোন গোল নেই। আর কাউকে বলবেন না, এ ওয়াদা করা ছিল আমাদের মধ্যে।

তোমাদের প্রস্তুতি শেষ হওয়া পর্যন্ত?

হ্যাঁ।

আর তুমি নিশ্চিত বাবা সে ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন?

এরচে অনেক বড় বড় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছেন তিনি!

আর তুমিও বলনি কাউকে?

অবশ্যই বলিনি!

ধরে নেয়া যাক, স্রেফ ধরে নেয়া যাক, কেউ জানতে পারল, কেউ আসতে পারল, কী মনে হয়, কীসের খোঁজ করবে সে? এখানে তোমার বাবার কোন নোট কি আছে? ডকুমেন্ট?

ডিরেক্টর, অনেক ধৈর্য ধরেছি। এবার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আমাকেও। আপনি বারবার এখানে প্রবেশের কথা বলছেন–

কথার জবাব দাও। কী খোয়া যেতে পারে?

আমার কোন ধারণা নেই। আসেনি কেউ। সবই ঠিকঠাক গোছানো উপরে।

উপরে?

হ্যাঁ, এখানে, আপার ল্যাবে।

তোমরা লোয়ার ল্যাবটাও কাজে লাগাচ্ছ?

স্টোর হিসাবে।

তোমরা হাজ-মাত চেম্বার ব্যবহার করছ? কীসের স্টোর হিসাবে?

আর কীসের!

উত্তেজনায় বিষম খেল কোহলার। আরো স্পেসিমেন আছে? আগে বলনি কেন?

আমি কোন সুযোগ পাইনি বলার।

আমাদের সেসব চেক করতে হবে। এখনি!

সেটা। সিকুলার। আর কেউ সেটার টিকিটারও খোঁজ পাবে না।

মাত্র একটা? উপরে নেই কেন?

বাবা জিনিসটাকে নিরাপত্তার খাতিরে নিচে রেখেছেন। এটা আর সবগুলোর চেয়ে বড়।

তোমরা পাঁচশ ন্যানোগ্রামের চেয়ে বড় স্পেসিমেন তৈরি করেছ?

প্রয়োজনে। আমাদের প্রমাণ করতে হত যে ইনপুট করার সময় বেশি পরিমাণ নিলেও ভয় নেই।

তেলের ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান জ্বালানিটাকে তারা উপরে না রেখে নিচে রেখেছে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল নাকি ভয়ে কুকড়ে গেল তারা বোঝা যাচ্ছে না।

বাবা চাননি বড় স্পেসিমেন তৈরি করতে। ভিট্টোরিয়াই চাপ দিত সব সময়। দুটা ব্যাপার প্রমাণ করতে হত তাদের। আরো দুটা ব্যাপার। প্রথমত, বিশাল পরিমাণে সেগুলো জমানো যায়। দ্বিতীয়ত, সেগুলো স্টোর করা যায় নিরাপদে।

হাজ-মাতে, গ্রানাইটের একটা ছোট্ট খুপরিতে, আরো পঁচাত্তর ফুট নিচে, বসানো ছিল সেটা।

সেখানেও, শুধু তারা দুজনে যেতে পারবে।

ভিট্টোরিয়া! এবার মিনতি ঝরে পড়ল কোহলারের কন্ঠে, কত বড় স্পেসিমেন তুমি আর তোমার বাবা মিলে তৈরি করেছ?

অবিশ্বাস্য বিস্ময় দেখা দিবে এখন গ্রেট ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলারে চোখে। ভেবে তৃপ্ত হয় ভিট্টোরিয়া।

এক গ্রামের পুরো চার ভাগের একভাগ।

কোহলারের চোখমুখ থেকে সরে গেল সমস্ত রক্ত, কী! একগ্রামের চার ভাগের এক ভাগ? এর শক্তি… প্রায় পাঁচ কিলোটনের সমান!

কিলোটন! শব্দটাকে ঘৃণা করে ভিট্টোরিয়া। এক কিলোটন হল এক হাজার মেট্রিকটন টি এন টির সমতুল্য।

এটা বিস্ফোরকের হিসাব। অকল্যাণের হিসাব।

সে আর বাবা মিলে সব সময় ইলেক্ট্রন-ভোল্টে মাপত শক্তিটাকে। নয়ত জোল্টে।

এই পরিমাণ বিস্ফোরক আধমাইল ব্যাসের জায়গাকে ধূলার সাথে মিশিয়ে দিবে এক পলকে!

যদি পুরোটাকে একেবারে জ্বালানো হয়। কেউ তা করতে পারবে না।

যদি কেউ ভুল করে বসে… যদি তোমার পাওয়ার সোর্স নষ্ট হয়ে যায়… –

সেজন্যেই বাবা সেটাকে হাজ-মাতে, নিরাপদ দূরত্বে, ফেইল সেফ সহ- সিয়ে রেখেছেন।

হাজ-মাতেও তোমাদের বাড়তি নিরাপত্তা আছে?

দ্বিতীয় রেটিনা স্ক্যান।

নিচের দিকে! এখনি!

 

ফ্লাইট এলিভেটর একটা পাথরের মত পড়ে গেল।

আরো পঁচাত্তর ফুট নিচে।

দুজনের চোখে কেন ভয় দেখতে পাচ্ছে ভেবে পায় না ভিট্টোরিয়া।

একেবারে তলায় পৌঁছে গেল তারা।

একটা করিডোর। তার শেষ প্রান্তে লোহার গেটে লেখা, হাজ-মাত। স্ক্যান করাল সে নিজের চোখ।

চোখ তুলে ফেলল সে সাথে সাথে। সেখানে কিছু একটা আছে… রক্ত?

ফিরল সে দুজনের দিকে। তাদের মুখও ফ্যাকাশে। তাকিয়ে আছে ভিট্টোরিয়ার পায়ের দিকে।

ভিট্টোরিয়া তাদের চোখকে অনুসরণ করে তাকাল নিচে।

না! দৌড়ে গেল ল্যাঙড়ন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

মেঝেয় পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে আটকে গেল তার চোখ৷ এটা একই সাথে একেবারে অপরিচিত এবং সুপরিচিত।

একটা মাত্র পল লাগল।

বুঝল সে ঠিক ঠিক। চিনতে ভুল হল না চোখের গালটাকে

 

২৪.

সিকিউরিটি টেকনিশিয়ান তার কাঁধে কমান্ডারের শ্বাস টের পায়। তাকিয়ে আছে সে শক্ত ঘাড়ে, স্ক্রিনের দিকে।

কমান্ডারের নিরবতার কারণ আছে। বোঝায় সে নিজেকে। তিনি একজন প্রটোকল মানা লোক। তিনি কখনোই আগে বলে এবং পরে চিন্তা করে কিছু করেন না। পৃথিবীর সবচে এলিট বাহিনীগুলো সেসব নিয়ম মানে।

কিন্তু সে কী ভাবছে?

একটা স্বচ্ছ ক্যানিস্টারের দিকে তাদের চোখ।

কীভাবে যেন সেটার ভিতরে একটা ফোঁটা ভেসে আছে।

সেইসাখে আছে রোববাটিক ব্লিঙ্ক। লেডের লাল আলোয় কাউন্ট ডাউন।

ক্যানিস্টারকে আরো একটু আলো দেয়া কি সম্ভব? জিজ্ঞেস করল কমান্ডার।

চেষ্টা চরিত্র করল টেকনিশিয়ান লোকটা। একটু আলো এল।

সামনের দিকে ঝুঁকে এল কমান্ডার। কন্টেইনারের একেবারে ভিত্তিতে একটা কিছু দেখা যাচ্ছে।

টেকনিশিয়ানের দৃষ্টি তার কমান্ডারকে অনুসরণ করুল। চারটা বড় হাতের অক্ষর আছে সেখানে।

এখানেই থাক, বলল কমান্ডার, কিছু বলোনা। আমি পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি।

 

২৫.

হাজ-মাত।

ভিট্টোরিয়া ভেট্রা পড়ে যাচ্ছে জ্ঞান হারাতে হারাতে। রবার্ট ল্যাঙডন এগিয়ে এল। তারা চোখ উপড়ে নিয়েছে!

দুমড়ে মুচড়ে গেল তার পৃথিবী। যেন এ এক স্বপ্ন। চোখ খুললেই সব মিথ্যা সরে যাবে।

খুলে গেল দরজা।

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই সে প্রস্তুতি নিল যে কোন কিছু দেখার জন্য এবং তার আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হল।

ক্যানিস্টারটা নেই।

কেউ একজন এটাকে তুলে নিয়েছে। আর কল্যাণের অগ্রদূত পরিণকুহয়েছে সবচে বীভৎস অস্ত্রে। নিয়ে নেয়ার সাথে সাথে।

মারা গেছে বাবা। তার মেধার জন্যই।

আরো একটা আবেগ এগিয়ে এল। নিজেকে দোষী ভাবার আবেগ। এ কাজটা সেই করতে বলেছিল। বলেছিল বড় একটা স্পেসিমেন গডতে। তৈরি করেছিল ব্যাক আপ সিস্টেম এবং ব্যাটারি।

এক গ্রামের এক চতুর্থাংশ…

আর সব টেকনোলজির মতই- আগুন, গান পাউডার, কমবাশন ইঞ্জিন এবং ভুল হাতে পড়লে এন্টিম্যাটারও, হতে পারে প্রাণঘাতী।

আর সময়টা বয়ে গেলে…

একটা অন্ধ করে দেয়া আলো। বজ্রপাতের শব্দ। একটা বিস্ফোরণ, শুধু আলোর একটা ঝলক। বিশাল, খালি একটা জ্বালামুখ তৈরি হয়ে যাবে। এক বিশাল, খালি জ্বালামুখ।

এর কোন ধাতব আবরণ নেই যে মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়বে। নেই কোন কেমিক্যাল যে কুকুর ধরে ফেলবে। এটাকে বসানোর মত কোন চার্জারও নেই যে চার্জ করবে তারা।

 

ভিট্টোরিয়া তাকিয়ে আছে বোবার মত। স্থাণুর মত। তার চোখ থেকে আড়াল করার জন্য ল্যাঙডন তাকায় নিচে। রুমাল দিয়ে ঢেকে দেয় অক্ষিগোলকটাকে।

মিস্টার ল্যাঙডন! আপনি স্পেশালিস্ট, বলল কোহলার, আমি জানতে চাই এই ইলুমিনেটি বাস্টার্ডরা কী করবে ক্যানিস্টারটা দিয়ে।

ইলুমিনেটির কথা আমার এখনো অপ্রযোজ্য মনে হচ্ছে, মিস্টার কোহলার। হয়ত সার্নের ভিতর থেকেই কেউ স্যাবোটাজ করছে। কে, জানি না। কিন্তু ইলুমিনেটি বলতে এখনো কোন সংস্থার অস্তিত্ব আছে তা মনে হয় না।

এখনো আপনার কাছে অস্পষ্ট লাগছে মিস্টার ল্যাঙডন? যারাই খুনটা করে থাক না কেন- করেছে এই ক্যানিস্টার চুরি করার উদ্দেশ্যে। আর এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা আছে। নিশ্চিত।

সন্ত্রাসবাদ?

সোজা।

কিন্তু ইলুমিনেটি সন্ত্রাসী নয়।

কথাটা লিওনার্দো ভেট্রাকে বলুন।

ধাক্কা খেল ল্যাঙডন এবার। ইলুমিনেটির অপ্রকাশিত সিম্বল আকা আছে তার বুকে। কোন না কোন ব্যাখ্যা থাকবেই।

আবার ভাবে সে।

ইলুমিনেটি যদি এখনো টিকে থাকে, কী করবে তারা এন্টিম্যাটারটা নিয়ে তাদের টার্গেট কী হতে পারে?

না। মিলছে না। ইলুমিনেটির এক শত্রু আছে ঠিকই। সেটা এখনো টিকে আছে। তাই বলে এত বছর পর, সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে, মাস ডেস্ট্রাকশনের মাধ্যমে সে লক্ষ্য হাসিল করবে তারা এমন কোন সম্ভাবনা নেই।

এখনো, সন্ত্রাসবাদের চেয়ে বড় কোন ব্যাখ্যা আছে…

কোহলার তাকাল। অপেক্ষা করছে।

বলা হয় ইলুমিনেটি ক্ষমতা চায়। কিন্তু সেটা অন্য কোন ক্ষেত্র থেকে। আর্থিক ক্ষেত্র, শিক্ষা ক্ষেত্র। তাদের হাতে আছে পৃথিবীর সবচে দামি জিনিস, দ্য ইলুমিনেটি ডায়মন্ড, আছে সোনার খনি।

টাকা। বলল সে অবশেষে, টাকার জন্য কেউ এটাকে নিয়ে থাকতে পারে।

আর্থিক সুবিধা? কোথায় তারা এক ফোঁটা এন্টিম্যাটার বেচবে?

স্পেসিমেন নয়, বলল সে, টেকনোলজিটা। হয়ত কেউ চুরি করেছে প্রযুক্তিটা বোঝার জন্য।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ? কিন্তু এর ঘড়ি টিক টিক করছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এর রফা দফা হয়ে যাবে।

তারা রিচার্জ করতে পারে। এমন একটা চার্জার তৈরি করতে পারে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে? তারা যদি এটাকে নিয়ে গিয়ে সার্চে বসে যায় তবু চার্জার বানাতে ইঞ্জিনিয়ারদের গলদঘর্ম হতে হবে মাসের পর মাস ধরে। কয়েক ঘণ্টায়? অসম্ভব।

মৃদু কণ্ঠ শোনা গেল ভিট্টোরিয়ার দিক থেকে, তার কথা ঠিক।

দুজনেই তাকাল তার দিকে।

তার কথা ঠিক। ফ্লাক্স ফিল্টার, সার্ভো কয়েল, পাওয়ার কন্ডিশনিং এ্যালয়, এসব। ঠিক করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে যাবে।

বুঝল ল্যাওড়নও, একটা সকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে চার্জ করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।

একটা অস্বস্তি ঝুলে রইল বাতাসে।

 

আমাদের ইন্টারপোলকে ডাকতে হবে, বিড়বিড় করল আঘাত পাওয়া ভিট্টোরিয়া,

সময়মত ডাকতে হবে সঠিক অথরিটিকে।

কোহলার তাকাল তার দিকে, এ্যাবসোলিউটলি নট!

না? কী বলতে চান আপনি?

তুমি আর তোমার বাবা মিলে আমাকে একটা গ্যাড়াকলে ফেলে দিয়েছ।

ডিরেক্টর, আমাদের সহায়তা প্রয়োজন! আমাদের সময় মত ক্যানিস্টারটাকে ফিরে পেয়ে রিচার্জ করতে হবে। নাহলে

নাহলে আমাদের চিন্তা করতে হবে। এই পরিস্থিতি সার্নের জন্য কতটা নাজুক ইতে পারে একবার ভেবেছ?।

আপনি সার্নের সুনাম নিয়ে চিন্তিত? একটা শহুরে এলাকায় সেই ক্যানিস্টার কী করতে পারে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আপনার? এর ব্লাস্ট রেডিল্লাস আধ মাইলের। নয়টা সিটি ব্লকের সমান!

হয়ত বানানোর সময় কথাটা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল তোমাদের।

কিন্তু আমরা সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করেছি।

দেখাই যাচ্ছে, কাজ হয়নি তাতে!

কিন্তু কেউ জানেনি এ সম্পর্কে।

আর হাওয়া থেকে, না জেনে, কেউ এসে এটাকে নিয়ে গেছে।

ভিট্টোরিয়া কাউকে বলেনি। ঘুণাক্ষরেও না। তার বাবা কি বলেছে? তাও কি সম্ভব? আর যদি বলেও থাকে, তা আর জানার কোন উপায় নেই। তিনি এখন মৃত।

শর্টস পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করল সে।

কোহলার ফেটে পড়ল রাগে, কাকে ফোন করছ?

সার্নের সুইচবোর্ডে। তারা আমাদেরকে ইন্টারপোলের সাথে যুক্ত করবে।

ভাব! তুমি কি এতই বোকা? ক্যানিস্টারটা এতক্ষণে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে থাকতে পারে। কোন ইন্টেলিজেন্স তা পাবে না সময়মত।

আর তাই আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি?

আমরা তাই করব, যা স্মার্ট। না ভেবে সার্নের সুনাম ভূলুণ্ঠিত করতে পারি না।

কোহলারের কন্ঠে যুক্তি আছে। আবার মানুষের জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা করাটাও সবচে বড় যুক্তির কাজ।

তুমি কাজটা করতে পার না। সাবধান করে দিল ভিট্টোরিয়াকে কোহলার।

শুধু চেষ্টা করুন আমাকে থামানোর।

নড়ল না কোহলার।

এক মুহূর্ত পরেই টের পেল ভিট্টোরিয়া, কেন। সেলফোনে ডায়াল নেই মাটির এত নিচে।

সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিল ভিট্টোরিয়া।

শুরু করল ছোটা।

 

২৬.

পাথুরে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে হ্যাসাসিন। টানেলের বদ্ধ বাতাসে তার নিভু নিভু লণ্ঠন থেকে কালো ধোঁয়া মিশে গিয়ে আরো সমস্যা সৃষ্টি করছে। সামনের লোহার দরজা দেখতে এই টানেলের মতই পুরনো। এবং শক্ত।

চলে এসেছে সময়।

ভিতর থেকে কেউ একজন সহায়তা করবে। কেউ একজন ভিতর থেকে বিশ্বাস ভাঙরে। সারা রাত সে দাড়িয়ে থাকতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করার সুবাদে।

কয়েক মিনিট পরে, একেবারে সময়মত একে একে ভারি চাবি দিয়ে দরজার তালাগুলো খোলার শব্দ উঠল। বোঝাই আয়, এটাকে অনেক শতাব্দি ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

তারপর নিরবতা।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে হাসানি। পাঁচ মিনিট। ঠিক যা বলাছিল তাকে। তারপর, শক্ত হাতে সে ধাক্কা দেয়। খুলে যায় বিখ্যাত দরজায় পাল্লা।

 

২৭.

ভিট্টোরিয়া! আমি এ কাজ অনুমোদন করব না!

এখন কেন যেন এ জায়গাটাকে অচেনা মনে হয়। কেন যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কান্না।

একটা ফোনের কাছে চলে যাও…

রবার্ট ল্যাঙডন এখনো চুপ করে আছে।

কীসের স্পেশালিস্ট সে? কীভাবে সহায়তা করবে? তারা দুজনেই কিছু না কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে। কী সেটা?

সার্নের ডিরেক্টর হিসাবে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ, সার্নের ভবিতব্যের কথা আমাকে ভাবতে হয়–

বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ? আপনি কি সোজা নির্জলা মিথ্যা বলবেন? কাউকে জানাবেন না যে সেটা সার্ন থেকে পাওয়া গেছে? আপনি কি বিনা দ্বিধায় এত মানুষের জীবন। সংশয় নিয়ে ছেলেখেলা খেলবেন?

আমি না। তোমরা। তুমি আর তোমার বাবা।

দূরে তাকাল ভিট্টোরিয়া।

আর যতই জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলব আমরা, বলল কোহলার, এবার একটু নিচু লয়ে, জীবন হল এমন এক ব্যাপার যা নিয়ে এখন কথা বলা যায়। কিন্তু মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সার্নের মত প্রতিষ্ঠানের উপর। তুমি আর তোমার বাবার মত বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সমস্যা মিটানোর জন্য এখানে অহর্নিশি কাজ করছে।

থামল সে। তারপর আবার বলতে শুরু করল, বিজ্ঞান এই পৃথিবীর অর্ধেক সমস্যা এনেছে। আর স্পেস প্রোগ্রাম, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন–সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের জয় জয়কারের সাথে সাথে তার ভুলগুলোকেও শুধরে নেয়ার সময় এসেছে।

ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে বলল, আপনি মনে করেন সার্ন পৃথিবীর ভবিষ্যতের সাথে এমন জটিলভাবে সম্পর্কিত যে আমাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেও দূরে থাকতে হবে?

আমার সাথে নৈতিকতা নিয়ে যুক্তি দেখাবে না। স্পেসিমেনটা তৈরির সময়ই নৈতিকতার দ্বার পেরিয়ে গেছ তোমরা। আমি শুধু এখানটার তিন হাজার বিজ্ঞানীর চাকরি রক্ষার চেষ্টা করছি না। চেষ্টা করছি তোমার বাবার সুনামও অক্ষুন্ন রাখতে। ব্যাপক বিদ্ধংসী অস্ত্রের আবিষ্কতা হিসাবে তার নাম যাওয়া কোন দিক দিয়েই ভাল নয়।

আমিই বাবাকে স্পেসিমেন তৈরি করতে বলেছি। যা ভুল সব আমার।

 

যখন দরজা খুলে গেল, তখনো কথা বলছিল কোহলার। থামল ভিট্টোরিয়া, তারপর আবার খুলল ফোন।

এখনো নেটওয়ার্ক নেই। ড্যাম! সে দরজার দিকে যেতে শুরু করল।

ভিট্টোরিয়া! থাম! কথা বলতে হবে আমাদের।

বাস্তা ডি পার্লারে!

বাবার কথা ভাব! কী করতেন তিনি?

যাচ্ছে মেয়েটা।

ভিট্টোরিয়া! তোমাকে সব বলা হয়নি?

এবার টের পেল ভিট্টোরিয়া, তার পা স্থবির হয়ে আসছে।

জানি না কী ভাবছিলাম আমি। শুধু তোমাকে রক্ষার কথাই ভাবছিলাম। শুধু বল আমাকে, কী চাও তুমি। একত্রে কাজ করতে হবে আমাদের।

আমি শুধু এন্টিম্যাটারটা পেতে চাই। আর জানতে চাই কে আমার বাবাকে খুন করল।

ভিট্টোরিয়া, এরমধ্যেই আমরা জানি কে তোমার বাবাকে খুন করেছে। আই এ্যাম স্যরি।

কী?

ব্যাপারটা জটিল—

আপনি আগে থেকেই জানেন কে আমার বাবাকে খুন করেছে?

একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। খুনি চিহ্ন রেখে গেছে। এজনন্যই আমি মিস্টার ল্যাঙডনকে ডাকি। গ্রুপটা

গ্রুপ? টেররিস্ট গ্রুপ?

ভিট্টোরিয়া, তারা এক কোয়ার্টার গ্রাম এন্টিম্যাটার চুরি করেছে।

নতুন করে ভাবতে শুরু করল ভিট্টোরিয়া। তাকাল আমেরিকান লোকটার দিকে।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি জানতে চাই কে বাবাকে খুন করেছে। আর আপনার এজেন্সির সহায়তাও চাই।

আমার এজেন্সি?

আপনি ইউ এস ইন্টেলিজেন্সের সাথে যুক্ত, তাই না?

আসলে… না!

কোহলার নাক গলাল, মিস্টার ল্যাঙডন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর। আর্ট হিস্টোরির প্রফেসর।

একজন আর্ট টিচার?

তিনি কাল্ট সিম্বলজির বিশেষজ্ঞ। ভিট্টোরিয়া, আমরা মকেছি তোমার বাবা কোন শয়তানি সংঘের কারণে নিহত হয়েছেন।

শয়তানি সংঘ?

দায়িত্ব স্বীকার করা গ্রুপের নাম ইলুমিনেটি।

ইলুমিনেটি? দ্য ব্যাভারিয়ান ইলুমিনেটি?

তাদের কথা জানতে?

স্টিভ জ্যাকসনের কম্পিউটার গেম আছে এর উপর। ব্যাভারিয়ান ইলুমিনেটিঃ দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার। ইন্টারনেটে বেশিরভাগ লোক খেলে। কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না…

ল্যাঙডনের দিকে একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কোহলার।

নড করল ল্যাঙডন, জনপ্রিয় গেম। প্রাচীণ ব্রাদারহুড পৃথিবীর দখল নিয়ে নেয়। আধা-ঐতিহাসিক। আমি জানতাম না এটা ইউরোপেও আছে।

কী বলছেন আপনি? দ্য ইলুমিনেটি? এ এক কম্পিউটার গেম।

ভিট্টোরিয়া, বলল কোহলার, তারাই তোমার বাবার হত্যার কথা স্বীকার করছে।

পুরো পরিস্থিতিটার উপর একবার নজর বুলিয়ে তীক্ষ্ণ্ণধীর ভিট্টোরিয়া বুঝে ফেলল, সে একেবারে একা। এগিয়ে যেতে নিল ভিট্টোরিয়া, থামাল তাকে কোহলার। তারপর একটা ফ্যাক্স বের করল পকেট থেকে।

তারা তাকে ব্র্যান্ডেড করেছে, বলল সে, ব্র্যান্ডেড করেছে বুকে।

 

২৮.

এখন একটা আতঙ্কে পড়ে গেছে সিলভিয়া বডেলক। তাকাল সে ডিরেক্টরের খালি অফিসে।

কোন নরকে গেল সে? কী করব এখন আমি?

আজকের দিনটাই গোলমেলে। অবশ্যই, কোহলারের সাথে যে কোন দিন গুজরান করা কষ্টকর। কিন্তু আজ তার মাথার টিকিটারও দেখা পাওয়া ভার।

আমাকে লিওনার্দো ট্রোর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দাও। বলেছিল সে আজ সকালে।

পেজ করল সিলভিয়া। ফোন করল, তারপর পাঠাল ই-মেইল।

লা জওয়াব।

তার পরই বেরিয়ে গেল সে। কয়েক ঘণ্টা পরে যখন ফিরে এল, একেবারে অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে… তার পরই মডেমে ঢোকা। ফোন। ফ্যাক্স। কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি।

এরপর যখন বেরিয়ে গেল সে, এখনো ফিরেনি।

এটাকেও কোহলারের নাটকীয়তা বলে ধরে নিয়েছিল সে। কিন্তু যখন ফিরে এল না ইঞ্জেকশন নিতে, চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়ল প্রাইভেট সেক্রেটারি। মাঝে মাঝে সিলভিয়ার মনে হয় ডিরেক্টরের মনে সুপ্ত আছে মরার চেষ্টা।

গত সপ্তাহে যখন ভিজিটিং বিজ্ঞানীর দল তার পায়ের কথা তুলে আফসোস করছিল তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে একটা পেপার ক্লিপবোর্ড ছুড়ে মেরেছিল তাদের একজনের মাথা লক্ষ্য করে।

এখন ডিরেক্টরের স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক আগে সার্নে একটা বিদেশি ফোন আসে।

তারপর অপারেটর বলল, কে কল করেছে।

আপনি ঠাট্টা করছেন, তাইতো? আর আপনার কলার আইডি বলছে যে–আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনি কি জিজ্ঞেস করতে পারবেন কেন না ঠিক আছে। হোল্ড করতে বলুন। এখনি ডিরেক্টরের সাথে যোগাযোগ করছি। হু। বুঝলাম। আমি দ্রুত করব।

কিন্তু পেল না সিলভিয়া তাকে।

যে মোবাইল কাস্টমারকে চাচ্ছেন আপনি তিনি রেঞ্জের বাইরে।

রেঞ্জের বাইরে? কতদূর যেতে পারে সে?

এবার সে চেষ্টা করল বিপারে, দুবার। কোন জবাব নেই। নেই সাড়া ইমেইল করল মোবাইল কম্পিউটারে।

যেন লোকটা হাওয়া হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে!

কী করব আমি?

একটা লম্বা শ্বাস নিল সে। শেষ চেষ্টা। কী ভাববে,ডিরের তী, আর ভয় অবকাশ নেই।

মাইক্রোফোনটা তুলে নিল সিলভিয়া।

 

২৯.

এক সময় বুঝতে পারল ভিট্টোরিয়া, তার বাবার কথা মনে পড়ছে। উঠে এসেছে তারা উপরের এলিভেটরে। কখন বলতে পারবে না।

পাপা!

মনে পড়ছে তার বাবার কথা। চট করে চলে গেল ভিট্টোরিয়া ন বছর বয়সে।

পাপা! পাপা!

কী, এ্যাঞ্জেল?

পাপা জিজ্ঞেস কর হোয়াট দ্য ম্যাটার?

কিন্তু তোমাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে, মিষ্টি মেয়ে! কেন তোমাকে জিঞ্জেস করব হোয়াট দ্য ম্যাটার?

জিজ্ঞেস কর না!

শ্রাগ করল ট্রো, হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার?

এভরিথিং ইজ দ্য ম্যাটার। পাথর! গাছ! পরমাণু! সবই ম্যাটার।

হাসল লিওনার্দো, কথাটা কি নিজে নিজে বের করেছ?

স্মার্ট না?

আমার ছোট্ট আইনস্টাইন!

তার চুলের কোন ছিরি নেই। আমি ছবি দেখেছি।

কিন্তু তার মাথার শ্রী আছে। কী প্রমাণ করেছেন তিনি বলেছি না তোমাকে?

ড্যাড! না! তুমি প্রমিজ করেছিলে!

ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার! বলল লিওনার্দো হাসতে হাসতে, ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার!

কোন ম্যাথ নয়। আমি বলেছি না তোমাকে? ঘৃণা করি।

আমি খুশি হয়েছি যে তুমি অঙ্ক ঘৃণা কর। মেয়েদের অঙ্ক কষা নিষেধ।

আসলেই?

অবশ্যই। সবাই জানে। মেয়েরা পুতুলের সাথে খেলবে। ছেলেরা করবে গণিত। মেয়েদের জন্য অঙ্ক নয়। আমি ছোট মেয়েদের সাথে অঙ্ক নিয়ে কথা বলার অনুমতি পাইনি!

কেন! কিন্তু এতে অন্যায়!

নিয়ম নিয়মই। বাচ্চা মেয়েদের জন্য গণিত নয়।

কিন্তু পুতুল নিয়ে খেলা বিরক্তিকর।

স্যরি। আমি তোমার কাছে অঙ্কের অনেক মজার মজার খা বলতাম কি.. একবার যদি ধরা পড়ে যাই… তাকাল সে দুর্বলচিত্তে। চারপাশে।

ওকে! আমাকে আস্তে আস্তে বল!

***

এলিভেটরের দৃশ্য তাকে বাস্তবে টেনে আনল। চোখ খুলল ভিট্টোরিয়া। চলে গেছেন তিনি।

রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করল তার মনের কুঠুরিতে।

কোথায় এন্টিম্যাটার?

কোত্থেকে যেন সুড়সুড় করে এগিয়ে এল একটা আতঙ্কের অনুভূতি।

 

৩০.

মাক্সিমিলিয়ান কোহলার, দয়া করে আপনার অফিসের সাথে যোগাযোগ করুন! মাথার উপর থেকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়ার আওয়াজ হাওয়াতে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে চিৎকার জুড়ে দিল কোলারের সব যোগাযোগ যন্ত্র। তার পেজার। ফোন। ই-মেইল।

ডিরেক্টর কোহলার, দয়া করে অফিসের সাথে যোগাযোগ করুন!

তাকাল সে উপরে। এবং তারপর জমে গেল তারা সবাই।

হাতলের উপর থাকা সেলফোনটা তুলে নিল কোহলার।

দিস ইজ… ডিরেক্টর কোহলার। ইয়েস? আমি মাটির নিচে ছিলাম। কে? ইয়েস, পাখ ইট থ্রে। হ্যালো? দিস ইজ ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। আমিই সানের ডিরেক্টর। কার সাথে কথা বলছি?

ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কাজটা ঠিক হবে না। বলল সে অবশেষে, ফোনে কথা বলাটা ঠিক হবে না। চলে আসছি দ্রুত। কাশছে আবার কোহলার, ক্যানিস্টারের লোকেশন বের করুন। দ্রুত। আসছি আমি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে আমার সাথে দেখা করুন।

কথাটা বাজল দুজনের কানেই।

সব পরিষ্কার হয়ে এল ল্যাঙডনের সামনে। এম্বিগ্রাম, খুন হয়ে যাওয়া যাজক  বিজ্ঞানী এবং এবার, টার্গেটটা…

পাঁচ কিলোটন! লেট দেয়ার বি লাইট।

দুজন প্যারামেডিক এগিয়ে এল। তুলে দিল অক্সিজেন মাস্ক কোহলারের মুখে।

মাস্কের মধ্যে মুখ দিয়ে বার দুয়েক দম নিয়ে তাকাল কোহলার তাদের দিকে। মুখোশটাকে সরিয়ে নিয়ে।

রোম!

রোম? দাবি করল ভিট্টোরিয়া, এন্টিম্যাটার রোমে চলে গেছে? কে ফোন করেছিল?

সুইস…

আর বলতে পারল না কোহলার। ঢলে পড়ল। সে প্রচন্ড অসুস্থ এবং সময় মত ইঞ্জেকশন নেয়নি।

নড করল ল্যাওড়ন। বুঝতে পারছে কী বলে ডিরেক্টর।

যান… মাস্কের নিচে খাবি খাচ্ছে ডিরেক্টর, যান… গিয়ে আমাকে কল করুন।

তাকাল ভিট্টোরিয়া, রোম? কিন্তু সুইস আবার কী?

সুইস গার্ড। বলল ল্যাঙডন, দ্য সুইস গার্ড। ভ্যাটিকান সিটির অতন্দ্র, বাহিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *