০২. ভেবে পায় না কোহলার কী বলবে

১১.

শয়তানি? ভেবে পায় না কোহলার কী বলবে, এটা কোন শয়তানি সংঘের প্রতীক?

এতক্ষণে ঘরটাকে একটু উষ্ণ মনে হয় ল্যাঙড়নের। ইলুমিনেটি শয়তানি সংঘ ছিল ঠিকই। কিন্তু এখনকার বিবেচনায় নয়, আমরা শয়তানি সংঘ বলতে যা বুঝি তেমন নয়।

মানুষ শয়তানি সংঘ বলতে বোঝে কিম্ভুত সাজ-পোশাকের কিছু মানুষকে যারা শয়তানের পূজা করে আর বিচিত্র জীবন যাপন করে। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। চার্চ যাকে শয়তানি সংঘ বলে ঘোষণা করে তা তেমন হবে এমন কথা নেই। এ সম্পর্কে একটা ভীতি জুড়ে দেয়াই গির্জার আসল উদ্দেশ্য। শাইতোয়ান।

শয়তানি সংঘগুলো শয়তানের পূজা করে, আরাধনা করে, পশু বলি দেয়, রক্তপান করে, নেশা করে, ব্ল্যাক ম্যাজিক করে, পেন্টাগ্রাম ধারণ করে, এসবই চার্চের প্রচারণা। কিছু সত্যি যে নেই তা নয়। কিন্তু এসব খাটে না ইলুমিনেটির ব্যাপারে।

মানুষ চার্চের কথা আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে থাকে। ত্যাগ করতে থাকে। ইলুমিনেটিকে এবং এমন সব সংঘকে। সফল হয় চার্চের উদ্দেশ্য।

এ সবই পুরনো কাহিনী। আমি জানতে চাই এখানে কী করে এই সিম্বলটা এল!

একটা গভীর শ্বাস নিল ল্যাঙডন, গ্যালিলিও সমতা ভালবাসতেন। যে কোন ক্ষেত্রে। তার সেই অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েই ইলুমিনেটির কোন এক অজানা কিন্তু বিখ্যাত শিল্পী এই প্রতীকটা আবিষ্কার করেন। এই ডিজাইনটাকে ইলুমিনেটি গুপ্ত রেখেছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। তাদের একটা আশা ছিল, একদিন তারা শক্তি অর্জন করবে, সেদিন সগর্জনে বেরিয়ে আসবে। সেদিনই প্রথম দেখা যাবে তাদের সিম্বল। অর্জন করবে ফাইনাল গোল।

তার মানে, এই প্রতীকটা বলছে যে ইলুমিনেটি ব্রাদারহুড এবার বেরিয়ে আসবে?

ব্যাপারটা এক কথায় অসম্ভব। ইলুমিনেটির আরো একটা অধ্যায় থেকে যাচ্ছে যার ব্যাখ্যা আমি করিনি।

আলোকিত করুন আমাকে।

হাতের তালু একত্র করল ল্যাঙডন, মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে, যা লিখেছে এবং যা জানে, একত্র করছে সে, ইলুমিনেটি টিকে গিয়েছিল, রোমের বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে তারা সারা ইউরোপ চষে বেরিয়েছে। একটা নিরাপদ স্থানের খোঁজে। কালক্রমে তারা আরো একটা সিক্রেট সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। নাম তার। ফ্রিমেসন।

দ্য মেসনস?

মেসনদের সদস্য আধকোটিরও বেশি সারা পৃথিবীতে। অর্ধেক আছে আমেরিকায়, আর এক মিলিয়ন ইউরোপে।

মেসনরা আর যাই হোক, শয়তানি সংঘ নয়। বলল কোহলার।

অবশ্যই নয়। বিজ্ঞানীদের তাদের দলে যুক্ত করে নিয়ে মেসনরা একটা ছদ্ম আবরণ এনে দিল ইলুমিনেটির জন্য। এটাই প্রয়োজন ছিল। আস্তে আস্তে পরজীবীর মত একে একে এর বড় বড় পোস্টগুলো দখল করে নেয় ইলুমিনেটি। সবার অজান্তে। সেই সতেরশ সাল থেকে। একটা সোসাইটির ভিতরে গজিয়ে ওঠে অন্য। সিক্রেট সোসাইটি। মূল আদর্শে তারা একই রকম। শুধু ইলুমিনেটির লক্ষ্য ধ্বংস বয়ে আনা। তাদের আদর্শ আস্তে আস্তে ভর করে মেসনের উপর।

আস্তে আস্তে মেসনকে বোঝানো হয়, চার্চ যে খড়গহস্ত হয়ে আছে সেটা সবার জন্য খারাপ। বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা থেমে যাবে, থমকে যাবে মানবজাতির পথচলা। পিছিয়ে পড়বে একটা অবৈজ্ঞানিক পথে! শুরু হবে ধর্মযুদ্ধ।

ঠিক যেমনটা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।

মানল ল্যাঙডন। কথা সত্যি, আজো ক্রুসেড হচ্ছে। আজো সেই আদর্শ বয়ে চলছে ধর্ম থেকে ধর্মে। আমার ঈশ্বর তোমারটার চেয়ে বড়।

বলে যান। বলল কোহলার।

ভাবনাগুলোকে আবার গুছিয়ে নিল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি আস্তে আস্তে ইউরোপে বিস্তৃত হয়ে ওঠে। তারপর দৃষ্টি দেয় আমেরিকার উপর। এমন এক দেশ, যেখানে অনেক হর্তাকর্তারাই ছিল মেসনিক–জর্জ ওয়াশিংটন, বেন ফ্র্যাঙ্কলিন। সৎ, ধর্মভীরু মানুষগুলো, যারা জানে না মেসনদের উপর ছায়া পড়েছে ইলুমিনেটির। শেষ লক্ষ্য অর্জন করার জন্য জাঁকিয়ে বসে ইলুমিনেটি। সামরিক পথে নয়, ব্যাঙ্ক, ইউনিভার্সিটি, ইন্ডাস্ট্রি দখলের মাধ্যমে। তাদের লক্ষ্য একটাই, এক, অভিন্ন দুনিয়া সৃষ্টি করা। এক ভুবন, এক রাষ্ট্র, এক আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন পৃথিবী। এ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

নড়ছে না কোহলার।

এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা, যার পিছনে আলো দিবে একটা মাত্র ব্যাপার। বিজ্ঞান। তারা তাদের লুসিফারিয় আদর্শে, লুসিফারিয়ান ডকট্রিনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গির্জা বলে, লুসিফার শয়তানের নাম। কিন্তু ইলুমিনেটি গোড়ার দিকে তাকায়। লুসিফার মানে শয়তান নয়, লুসিফার মানে আলোক আনয়নকারী। দ্য ইলুমিনেটর।

শ্বাস গোপন করল না কোহলার। মিস্টার ল্যাঙডন, প্লিজ সিট ডাউন।

পাতলা তুষারের পরত দেয়া চেয়ারে বসে পড়ে ল্যাঙডন।

আমি নিশ্চিত নই আপনার বলা প্রতিটা কথা বুঝতে পারছি কিনা। কিন্তু একটা ব্যাপার ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি। লিওনার্দো ভেট্রা ছিলেন সার্নের সবচে মূল্যবান লোকদের একজন। তিনি আমার এক বন্ধুও ছিলেন। আমি চাই আপনি ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করার কাজে আমাকে সহায়তা করবেন।

ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করা?

বাচ্চাদের মত কথা বলছে নাকি লোকটা?

আমি দুঃখিত স্যার। এ কাজটা করা একেবারে অসম্ভব।

ভাঁজ পড়ল কোহলারের প্রতে, কী বলতে চান আপনি? আপনি নিশ্চই

মিস্টার কোহলার, ভেবে পায় না সে কী করে যা ভাবছে তা বলবে, আমার কাহিনী এখনো শেষ হয়নি। এখানে, এ লোকটার বুকে একটা চিহ্ন আছে। এই তো? গত আধ শতাব্দি ধরে ইলুমিনেটির মাথার টিকিটারও খোঁজ নেই। আর বেশিরভাগ স্কলার একমত যে ইলুমিনেটি অনেক বছর আগেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে।

কী করে আপনি এ কথা বলেন? যেখানে এই লোকটার বুকে তাদের দেয়া পোড়া ছাপ মারা আছে!

এই একই প্রশ্ন ল্যাঙডনকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে গত ঘণ্টাখানেক ধরে।

সিম্বল থাকলেই বোঝা সম্ভব নয় যে তাদের আসল স্রষ্টারা এখনো টিকে আছে।

এ কথার কী মানে হবার কথা?

আমি বলতে চাই, যদি ইলুমিনেটির তরী ডুবে গিয়েও থাকে, তাদের প্রতীকটা ঠিকই থাকবে… অন্য গ্রুপগুলো সেটা তুলে নিতে পারবে সহজেই। এর নাম ট্রান্সফারেন্স। সিম্বলজিতে এমন নজিরের কোন অভাব নেই। নাজিরা স্বস্তিকা নিয়েছে হিন্দুদের কাছ থেকে। খ্রিস্টানরা ক্রুসিফর্ম নিয়েছে মিশরিয়দের কাছ খেকে আর–

এই সকালে, আজ, আমি যখন ইলুমিনেটি টাইপ করছিলাম, বর্তমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত হাজার হাজার ব্যাপারের সাথে এটার যোগসূত্র পাওয়া যায়। অনেক মানুষ মনে করে সেই গ্রুপটা আজো বিদ্যমান।

ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা।

মানুষ এখনো আশায় আছে, এখনো ভয়ে আছে, একদিন ঠিক ঠিক ইলুমিনেটি উঠে আসবে। ঝাঁপিয়ে পড়বে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার উপর। তৈরি করবে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

কিছুদিন আগেও নিউ ইয়র্ক টাইমস অনেক বিখ্যাত মেসনিক দিকপালের কথা বলেছে–স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, ডিউক অব কেন্ট, পিটার সেলার্স, আরভিউ বার্লিন, প্রিন্স ফিলিপ, লুইস আর্মস্ট্রঙ! সেই সাথে আছে আধুনিক লোকজন। ব্যাঙ্কার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।

তাকাল কোহলার মরদেহটার দিকে, তারপর একটু দম নিয়ে বলল, এ প্রতীক দেখে আমার মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রের কথা ভুল নয়।

আমি বুঝতেই পারছি ব্যাপারটা কীভাবে আসছে আপনার কাছে, যথা সম্ভব কূটনৈতিকভাবে বলল কথাটা, তবু এ কথাটাও ফেলে দেয়া যায় না যে অন্য কোন সংস্থা ইলুমিনেটির দখল নিয়ে নিয়েছে এবং তাদের মত করে ব্যাপারটাকে ব্যবহার করছে।

কোন লক্ষ্য? এই খুনটার কী মানে হয়?

ভাল প্রশ্ন।

চারশো বছর আগের সংস্থা কী করে একজন বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানের নাম নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না ল্যাঙডনও।

আমি আপনাকে একটা কথা বলতে পারি, ইলুমিনেটি যদি আজো সক্রিয় থাকে, আমি যা মনে করি, তারা সক্রিয় নেই, তবু, যদি থাকে, তারা কখনোই লিওনার্দো ভুেট্টার খুনের সাথে জড়িত হবে না।

না?

না। ইলুমিনেটি ক্রিশ্চিয়ানিটির বিলুপ্তিতে বিশ্বাস করলেও তাদের ক্ষমতা বেড়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর শিক্ষাগত দিকে, সামরিক দিক দিয়ে নয়। তার উপর, ইলুমিনেটির কঠিন একটা আদর্শ ছিল, কী করে তারা শত্রুদের দেখবে সে সম্পর্কিত একটা আদর্শ ছিল। তাদের কাছে ম্যান অব সায়েন্স হল সবচে উঁচু পদ। লিওনার্দো ভেট্রার মত একজন বিজ্ঞানীকে খুন করার কোন উপায় নেই তাদের হাতে।

কোহলারের চোখ বন্ধ হয়ে গেল। একটু থেমে সে বলল, আমার হয়ত আরো একটা ব্যাপার দেখাতে হবে আপনাকে।

মিস্টার কোহলার, আমি মানি, লিওনার্দো ট্রোর নানামুখী দক্ষতা থাকতে পারে, কিন্তু তাকে খুন করবে না ইলুমিনেটি কখনোই

কোনরকম আভাস না দিয়েই কোহলার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঝট করে বেরিয়ে গেল লিভিঙরুম থেকে। এগিয়ে গেল একটা হলওয়ে ধরে।

ফর দ্য লাভ অফ গড, ভাবল ল্যাঙডন। হলওয়ের শেষ প্রান্তে তার জন্য অপেক্ষা রছিল কোহলার।

এ হল লিওনার্দোর স্টাডি। বলল ডিরেক্টর। আপনি ভিতরটা দেখার পর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাববেন।

এগিয়ে গেল ল্যাঙডন। তারপর ভিতরটা দেখেই পাক খেয়ে উঠল তার ভিতর। হোলি মাদার অব জেসাস! বলল সে আপন মনে।

 

১২.

এক অন্য দেশে, ভরুণ এক গার্ড বসে আছে ঘরভর্তি মনিটরের সামনে। ভেসে যাচ্ছে ইমেজ, তাকিয়ে আছে সেদিকে নিশ্চিন্তে। বিচিত্র আর জটিল ভবনগুলোর ভিতরে রাখা শত শত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে সে। অশেষ মহড়া চালাচ্ছে ছবিগুলো।

এক হলওয়ে।

একটা অফিস ঘর।

বিশালবপু কিচেন।

হবিগুলো চলে যাচ্ছে। কোনক্রমে দিবান্দ্রিা ঠেকিয়ে রেখেছে গার্ড ধৈর্য ধরে। শিফট শেষ হবার সময়টাতেও বসে আছে সে। এখানে কাজ করতে পারাই এক প্রকার সম্মানের ব্যাপার। একদিন এজন্য সে পুরস্কার পাবে। অনেক দামি পুরস্কার।

একটা ছবির সামনে তার চোখ ঠেকে গেল। আর ঠেকে যাবার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠল সে। চাপ দিল একটা বাটনে। ছবিটা স্থির হল সাথে সাথে। ধ্বক ধ্বক করে উঠল তার ভিতরটা। বুকে এল সামনে। সামনের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা নাম্বার ছিয়াশি থেকে আসছে সেটা। এটার কোন এক হলওয়ের উপর নজর রাখার কথা।

কিন্তু সামনে যে ছবি ভেসে উঠেছে সেটা আর যেখানকারই হোক না কেন, কোন হলওয়ের নয়।

 

১৩.

সামনের স্টাডির দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছে ল্যাঙন। এ আবার কেমন জায়গা!

কোন জবাব দিল না কোহলার।

ঘরের দিকে বিমূঢ় দৃষ্টি ফেলে লাঙডন। মুখে কিছুই বলে না। এখানে তার জীবনে দেখা সবচে বিচিত্র আর্টিফ্যাক্ট ঠাসা। সামনে, বিশাল কাঠের কুসিফর্ম, দেখেই তার অভিজ্ঞ চোখ বলে দেয় জিনিসটা প্রাচীণ স্প্যানিশ। চতুর্দশ শতকের। কুসিফর্মের উপরে ছাদ থেকে ঝুলছে একটা বিশাল মডেল। সৌর জগতের মডেল। ডানে কিশোরি। মেরির শুয়েল পেইন্টিং।

অন্যপ্রান্তে দুটা ক্রুশ ঝুলছে, মাঝখানে আইনস্টাইনের ছবি, ছবির নিচে সেই বিখ্যাত উক্তি। ঈশ্বর সৃষ্টি জগৎ নিয়ে ছেলেখেলা খেলেন না।

ঘরের ভিতরে চলে এল সে। তাকাল চারধারে, সবিস্ময়ে। ডেস্কের উপর চামড়ায় মোড়া মূল্যবান একটা বাইবেল, বাইবেলের পাশে বোরের পরমাণু মডেলের প্লস্টিক সংস্করণ এবং সেইসাথে মাইকেলেঞ্জেলোর সেই বিখ্যাত কীর্তির রেপ্লিকা। মোজেস। মুসা।

ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল সে ঘরের উষ্ণতা থাকা সত্ত্বেও। এ কী! দিক-দর্শনের দু বিপরীত মেরু এক হয়ে গেছে লোকটার ঘরে। বুকসেলফের বইয়ের নামের দিকে চোখ ফেরাল সে।

দ্য গড পার্টিকেল
দ্য টাও অব ফিজিক্স
গডঃ দ্য এভিডেন্স

এক জায়গায় বইয়ের তালিকার সাথে লেখা :

সত্যিকার বিজ্ঞান ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে
যিনি প্রতিটা দরজার পিছনে অপেক্ষা করছেন
–পোপ দ্বাদশ পিউস

লিওনার্দো একজন ক্যাথলিক যাজক ছিল… বলল কোহলার।

সাথে সাথে চমকে গেল ল্যাঙডন, বলল, একজন যাজক? আমার মনে হয় আপনি বলছিলেন তিনি একজন পদার্থবিদ।

সে দুটাই ছিল। ইতিহাসে বিজ্ঞান আর ধর্মের লোক অনেক পাওয়া যায়। লিওনার্দো তাদের একজন। সে পদার্থবিজ্ঞানকে ঈশ্বরের প্রাকৃতিক আইন বলে মনে করত। সব সময় একটা কথা বলত সে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের হাতের লেখা পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে সে ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা শতমুখে প্রচার করতে চাইত। এখানে থেকে তার অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করতে চাইত। নিজেকে মনে করত একজন থিয়ো-ফিজিসিস্ট।

পার্টিকেল ফিজিক্সের ভূমিতে, বলছে কোহলার, সম্প্রতি কিছু চমকে দেয়া আবিষ্কার এসেছে। এমন সব আবিষ্কার যা পিলে চমকে দেয়। মানুষকে ধর্মের সামনে নতজানু করে তোলে। তেমন অনেক আবিষ্কারের দায় ছিল লিওনার্দোর।

স্পিরিচুয়ালিটি আর ফিজিক্স? জানে ল্যাঙডন, এরই নাম তেল-জুল। কখনো একে অন্যের সাথে মিশে যাবে না। কশ্মিন কালেও না।

পার্টিকেল ফিজিক্সের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল ভেট্রা। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে মেলবন্ধন গডতে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। একেবারে অপ্রত্যাশিত পথে এ দু জগৎ একে অন্যকে জাপ্টে ধরে আছে, সেটাই দেখাতে চাচ্ছিল সে। এই ক্ষেত্রকে ডাকত নিউ ফিজিক্স।

একটা বই বের করল কোহলার। এগিয়ে দিল ল্যাঙডনের দিকে, গড, মিরাকল এ্যান্ড নিউ ফিজিক্স-লিওনার্দো ট্রো।

ফিল্ডটা এখনে তেমন বাড়েনি। বলল কোহলার, কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু আছে যার উত্তর আমরা খুঁজে চলেছি প্রথম থেকেই। সৃষ্টিজগতের শুরু আর আমাদের সবাইকে এক করে রাখা শক্তির ব্যাপারে এখানে পিলে চমকে দেয়া কয়েকটা তথ্য আছে। লাখ লাখ লোককে ধর্মের দিকে নিয়ে আসবে তার আবিষ্কার, এমনি বিশ্বাস ছিল। লিওনার্দো ভেট্রার। গত বছরই সে এমন এক আবিষ্কার করে যা বলছে যে একটা অচেনা শক্তি আছে যা আমাদের সবাইকে ধরে রাখে। রাখে একত্র করে… আপনার। শরীরের পরমাণুগুলো আমার শরীরের অণু-পরমাণুর সাথে যুক্ত… ফলে, একটা অবিচ্ছিন্ন শক্তি বয়ে চলছে আমাদের সবার ভিতরে।

চমকে উঠল কথাটা শুনে ল্যাঙডন, আর ঈশ্বরের শক্তিই আমাদের সবাইকে একত্র করবে! মিস্টার ট্রো প্রমাণ করতে যাচ্ছিলেন যে আমাদের সবাই, সব বস্তু একে অন্যের সাথে জড়িত?

প্রমাণ সহ। সায়েন্টিফিক আমেরিকানের এক নতুন সংখ্যায় নিউ ফিজিক্সকে আখ্যায়িত করা হয় ধর্মের পথে নয়, ঈশ্বরের পথে পথচলা হিসাবে।

থেমে গেল কোহলার। থমকে গেল ল্যাঙডন। আর ধর্মবিরুদ্ধ ইলুমিনেটি এমন কিছু ঘটতে দিবে না। এই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি চিন্তা হয়ে যাচ্ছে কি? ইলুমিনেটি এখানে হাত লাগাবে! সম্ভব! ইলুমিনেটির স্থান এখন শুধুই বই পত্রে। এর কোন অস্তি ত্ব নেই মোটেও। সব এ্যাকাডেমিকই তা জানে!

বৈজ্ঞানিক জগতে ট্রোর শক্রর কোন অভাব নেই। বলল কোহলার, অনেক বৈজ্ঞানিক বিশুদ্ধতাবাদী তাকে উপড়ে ফেলতে চায়। এমনকি এই সার্নেও। এ্যানালিটিক্যাল ফিজিক্সকে ব্যবহার করে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানকে মিশিয়ে ফেলার বিরোধী তারা।

কিন্তু আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা কি চার্চ থেকে অনেক বেশি প্রভাবমুক্ত নয়? তারা কি আর ধর্মের ব্যাপারগুলোকে ভয় করে?

কেন পাব আমরা? এখন আর চার্চ বিজ্ঞানীদের জ্যান্ত ধরে ধরে পোড়ায় না ঠিক, কিন্তু বিজ্ঞানের ভিতরে হাত ঢোকানের চেষ্টায় তাদের কোন অন্ত নেই। বলুনতো দেখি, আপনার দেশের অর্ধেক বিদ্যালয়ে কেন আজো বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষেধ? কেন আপনাদের দেশের ক্যাথলিক লবি পৃথিবীতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে থমকে দেয়? বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে যুদ্ধ এখনো চলছে পুরোদমে, মিস্টার ল্যাওড়ন। এখন আর এসব নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র বেঁধে যায় না, বেঁধে যায় না কুরুক্ষেত্র, কিন্তু তা এখনো চলছে।

টের পেল ল্যাঙডন, লোকটার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে কেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চলছে তা জানার জন্য এই সেদিনও যুক্তরাষ্ট্রে হাভার্ড স্কুল অব ডিভাইনিটি থেকে বায়োলজি বিল্ডিংয়ের দিকে মিছিল ছুটে গিয়েছিল। বায়ো ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান বিখ্যাত অর্নিথোলজিস্ট রিচার্ড এ্যারোনিয়ান তার ঘরের ভিতর থেকে একটা বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দেন আমেরিকান লাঙফিল যেভাবে মাটিতে উঠে এসেছে, যেভাবে তার পা গজিয়েছে, তেমন একটা ছবি। সেইসাথে সেখানে জিসাস না লেখা থেকে লেখা ছিল ডারউইন।

একটা তীক্ষ্ণ্ণ বিপবিপ শব্দে কান ঝালাপালা হবার আগেই মেসেজটা পড়তে শুরু করুল কোইলার।

ভাল। আসছে লিওনার্দো ভেট্রার মেয়ে। এখনি সে হেলিপ্যাডে ল্যান্ড করবে। সেখানেই তার সাথে দেখা করব আমরা। এটাই ভাল হয়। এখানে উঠে এসে তার বাবাকে এ অবস্থায় দেখার চেয়ে অনেক ভাল হয়।

রাজি হল ল্যাঙডন। এ এমন এক আঘাত যা কোন মেয়ের পক্ষে সহ্য কর অসম্ভব।

আমি মিস ভেট্রাকে চাপ দিব সে আর তার বাবা মিলে কী প্রজেক্ট করছিল সেটা খুলে বলার জন্য। হয়ত খুনের ব্যাপারটার উপর একটু আলোকপাত হবে।

আপনি কি মনে করেন কাজের জন্য ট্রো খুন হয়েছেন?

অবশ্যই। লিওনার্দো বলেছিল যে সে কাজ করছে দুনিয়া কাঁপানো একটা ব্যাপারে। এরচে বেশি কিছু তার মুখ দিয়ে বেরোয়নি। প্রজেক্টের ব্যাপারে কাক পক্ষীকেও জানতে দিতে নারাজ সে। সে একটা প্রাইভেট ল্যাব আর সিকিউরিটি ব্যবস্থা। চেয়েছিল। আমি খুশি মনেই তা দিয়েছি তার মেধার কথা মনে করে। শেষের দিকে তার কাজে অনেক অনেক ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমি ভুলেও জিজ্ঞাসা করিনি কী করছে সে এত পাওয়ার দিয়ে। স্টাডি ডোরের দিকে এগিয়ে গেল। কোহলার, এখানে আরো একটা ব্যাপার আছে যা আপনার জানা প্রয়োজন।

আর কী শুনতে হবে ভেবে পায় না ল্যাঙডন।

ভো মারা যাবার পর একটা জিনিস চুরি গেছে।

একটা জিনিস?

ফলো মি।

কুয়াশায় মোড়া লিভিঙরুমে ঢুকল কোহলার হুইলচেয়ার নিয়ে। পিছন পিছন এ আড়ষ্ট হয়ে ওঠা ল্যাঙডন। আর কী দেখতে হবে একদিনে! স্ট্রোর শরীরের কাছাকাছি এসে সে থামল। সামনে আসবে ল্যাঙডন, এমন প্রত্যাশা দেখা গেল তার চোখেমুখে। প্রত্যাশা পূরণ কবল সে। খুন হয়ে যাওয়া বিজ্ঞানীর কাছে বুকে এলে জমে যাওয়া ইউরিনের গন্ধ পেল ল্যাঙডন।

তার চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকান। বলল কোহলার।

তার চেহারার দিকে তাকান? বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল ল্যাওডন। আমার মনে হয় আপনি বলছিলেন যে কিছু একটা চুরি গেছে!

একটু ইতস্তত করে হাটু গেড়ে বসল ল্যাংডন। চেষ্টা করল লিওনার্দো স্ট্রোর চেহারা দেখার কিন্তু সেটা একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানো ও কার্পেটের দিকে ফিরানো।

শারীরিকভাবে অক্ষম কোহলার কষ্ট করে এগিয়ে এল সামনে। তারপর ঘোরাল ভেট্রার মাথা। শব্দ করে লাশটার মাথা ঘুরে এল সামনে। এক মুহূর্ত ধরে রাখল সে মাথাটাকে। তারপর ছেড়ে দিল।

সুইট জিসাস! চিৎকার করে উঠল ল্যাঙডন। আতঙ্কে। ট্রোর সারা মুখ ভরে গেছে রক্তে। একটা চোখ তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অন্য চোখটার কোটর শূণ্য।

তারা লোকটার চোখ চুরি করে নিয়ে গেছে?

 

১৪.

লাঙডন বিল্ডিং সি থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল খোলা বাতাসে। মনের ভিতরে বসত করা খালি চোখের মর্মান্তিক দৃশ্য চলে যাচ্ছে খোলা সূর্যের রশ্মিতে।

এ পথে, প্লিজ। বলল কোহলার, এগিয়ে যেতে যেতে, মিস ট্রেী যে কোন সময় চলে আসতে পারে।

গতি ধরে রাখার জন্য তারাহুড়া করতে হল ল্যাঙডনকে।

তাহলে? বলল কোহলার, এখনো আপনার মনে কোন সন্দেহ আছে যে এটার সাথে ইলুমিনেটি যুক্ত?

চুপ করে থেকে আবার ইলুমিনেটির কথা ভাবল সে। আমার মনে হয়, এখনো মনে হয়, ইলুমিনেটি এর সাথে যুক্ত নয়। খোয়া যাওয়া চোখই তার প্রমাণ।

কী?

অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি, বলল সে কোনক্রমে, ইলুমিনেটির স্বভাব নয়। সত্যিকার শয়তানি সংঘগুলো এসব করতে পারে, কিন্তু ইলুমিনেটির মত একটা দল এমন পৈশাচিকতা করতে পারবে না।

পৈশাচিকতা? একটা লোকের চোখ তুলে নেয়ার চেয়ে বড় পৈশাচিকতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?

এ দিয়ে একটা ব্যাপারই বলা চলে। কোন বিকৃত মনের মানুষ এ কাজ করেছে। ইলুমিনেটির মত সংস্থা নয়।

কোহলারের হুইলচেয়ার পাহাড়ের উপরে উঠে থামল। মিস্টার ল্যাঙডন, বিশ্বাস করুন, সেই হারানো চোখটা আরো বড় একটা লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক বড়।

 

দুজন এগিয়ে গেছে হেলিপ্যাডের দিকে। এগিয়ে আসছে একটা চপার দূর থেকে। উপত্যকাটাকে চিরে দিয়ে।

নামার সাথে সাথে বেরিয়ে এল পাইলট। শুরু করল আনলোডিং গিয়ার। অনেক কিছু বেরিয়ে আসছে ভিতর থেকে। স্কুবা ডাইভিঙয়ের সাজ সরঞ্জাম এবং সমুদ্র সম্পর্কিত আরো অনেক যন্ত্রপাতি। দেখে মনে হয় হাইটেক ডাইভিং ইকুইপমেন্ট।

বিভ্রান্ত দেখাল এবারো ল্যাঙডনকে। এগুলো কি মিস ভেট্রার জিনিসপত্র।

সে ব্যালিয়ারিক সিতে বায়োলজিক্যাল রিসার্চ চালাচ্ছিল।

আপনি বলেছিলেন যে সে একজন ফিজিসিস্ট!

সে তাই। সে একজন বায়ো এন্টাঙ্গলমেন্ট ফিজিসিস্ট। লাইফ সিস্টেমের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে রিসার্চ করছিল। এ কাজের সাথে তার বাবার পার্টিকেল ফিজিক্সের কাজ ওতপ্রেতভাবে জড়িত। টুনা ফিসের একটা ঝাকের উপর কাজ করে সে সম্প্রতি আইনস্টাইনের একটা ফান্ডামেন্টাল থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করেছে।

ঠাট্টা করছে কিনা লোকটা তা বোঝার চেষ্টা করছে ল্যাঙডন। আইনস্টাইনের সাথে টুনা মাছ? ভেবে পায় না সে, এক্স থার্টি থ্রি প্লেন তাকে ভুল করে অন্য কোন দুনিয়ায় নামিয়ে দিয়ে যায়নিতো?

ফিউজিলাজ থেকে এক মুহূর্ত পরে বেরিয়ে এল ভিট্টোরিয়া! ল্যাওডন বুঝতে শুরু করল আজকের দিনটা হাজার সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে। সাদা স্লিভলেস টপ আর ছোট খাকি শর্টস পরে নেমে আসছে মেয়েটা। যেমন বইপোকা চশমা পরা ফিজিসিস্টের কথা তার মনে পড়ে তার সাথে এ মেয়ের কোন মিল নেই। চেস্টনার্টের মত গায়ের রঙ তার, চুলের রঙ একেবারে কালো। সেগুলো উড়ছে পিছনে পিছনে। রোটোরের বাতাসে। কোন ভুল নেই, তার চেহারা একেবারে ইতালিয়। কোন বাড়তি চটক নেই, কিন্তু শতভাগ সৌন্দর্য উপচে পড়ছে। কেমন একটা খাঁটি, কাচা সৌন্দর্য, তার সাথে বন্যতা মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। বাতাসের প্রভাবে তার শরীরের সমস্ত পোশাক নড়ছিল, দেখা যাচ্ছিল চিকণ কোমর, ছোট স্তন।

মিস ভেট্রার শক্তির কোন শেষ নেই। ভয়ানক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মাসের পর মাস ধারে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে সে। পারে যে কোন কাজে পড়ে থাকতে। একই সাথে সে সার্নের আবাসিক গুরু। হাত যোগব্যায়ামের গুরু। নিরামিষাশী।

হাত যোগ? ভেবে পায় না ল্যাঙডন। একজন ক্যাথলিক যাজকের মেয়ে, পদার্থবিদ, কাজ করছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র নিয়ে, সার্নে থাকার সময় সে হয়ে যায় প্রাচীণ  বৌদ্ধদের ব্যায়ামের শিক্ষক!

রোদপোড়া চামড়া মেয়েটার। চোখগুলো ফোলা ফোলা। এখনো কাঁদছে সে।

ভিট্টোরিয়া, মেয়েটা এগিয়ে এলে বলল কোহলার, আমার গভীরতম বেদনা… এখানে, সার্নের ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানের… আমি…

নড করল মেয়েটা। তারপর যখন কথা বলল, ব্যক্তিত্ব আর শক্তিমত্তা ফুটে উঠল তার কণ্ঠে, কে দায়ী তা কি জানা গেছে?

এখনো এ নিয়ে কাজ করছি।

ফিরল সে ল্যাঙডনের দিকে, আমার নাম ভিট্টোরিয়া ভেট্রা, হাত বাড়িয়ে দিল, মনে হয় আপনি ইন্টারপোল থেকে এসেছেন?

হাতটা তুলে নিল সে হাতে। বলল, রবার্ট ল্যাঙডন। আর কী বলবে ভেবে পেল না।

মিস্টার ল্যাঙডন অথরিটির সাথে যুক্ত নন, বলল কোহলার, ব্যাখ্যা করল, তিনি আমেরিকা থেকে আসছেন। একজন স্পেশালিস্ট। কে দায়ী সে ব্যাপারে সাহায্য করবেন তিনি আমাদের।

আর পুলিশ?

চুপ করে থাকল কোহলার।

বডি কোথায়? দাবি করল মেয়েটা।

কাজ চলছে। বলল কোহলার।

সাদা নির্জলা মিথ্যা শুনে ভড়কে গেল ল্যাঙডন।

আমি তাকে দেখতে চাই, সোজা দাবি করল মেয়েটা আবারো।

ভিট্টোরিয়া, বলল অবশেষে কোহলার, তোমার বাবা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। যেমন স্মৃতি তোমার মনে আছে তেমনটা মনে রাখাই ভাল।

কথা শুরু করল ডিট্টোরিয়া কিন্তু তা থেমে গেল একটা শব্দে।

হেই! ভিট্টোরিয়া! দূর থেকে একজন বলে উঠল, ওয়েলকাম হোম!

হেলিপ্যাডের কাছ দিয়ে যেতে থাকা একদল বিজ্ঞানী উৎফুল্লভাবে হাত নাড়ল।

আইনস্টাইনের আর কোন তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে এলে নাকি? বলল একজন।

আরেক জন কথা বলে উঠল সাথে সাথে, তোমার ড্যাড অনেক খুশি হবেন। গর্বিত হবেন তিনি।

কোনমতে একটু হাসির মত দিতে পারল ভিট্টোরিয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে। অনেক কষ্টে। তারপর ফিরল ডিরেক্টরের দিকে। এখনো কেউ জানে না?

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা এখনি না জানানো ভাল।

আপনি স্টাফদের জানাননি যে আমার বাবা খুন হয়ে গেছেন?

হয়ত ভুলে যাচ্ছ মিস ভেট্রা, আমি যখনি তোমার বাবার খুনের ব্যাপারে একটা ঘোষণা দিব সাথে সাথে সার্নে একটা তদন্ত হবে। তার ল্যাবের ব্যাপারটাও বাদ পড়বে না। তোমার বাবার প্রাইভেসির ব্যাপারটায় আমি সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি। তোমাদের বর্তমান প্রজেক্ট নিয়ে তিনি আমাকে মাত্র দুটা ব্যাপার জানিয়েছেন। এক, এর এত গুরুত্ব আছে যে সার্ন অসম্ভব পরিমাণের আর্থিক লাভের সম্মুখীন হবে। পরের দশকে এর টাকা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে হবে না। আর দুই, তিনি সেটাকে সবার সামনে প্রকাশ করতে চান না কারণ প্রযুক্তিটা এখনো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ দুটা ব্যাপার নিয়ে আমি ভাবছি। ভাবছি, যদি লোকজন তার ল্যাবের ভিতরে ঘোরে আর কিছু সরিয়ে ফেলে অথবা অসাবধানে চুন থেকে পান খসে যায় তাহলে সার্ন দায়ী থাকবে। মারাও পড়তে পারে তারা। আমি কি ভুল কিছু বলছি? পরিষ্কার করতে পারছি নিজেকে তোমার সামনে?

কিছু বলল না ভিট্টোরিয়া। ল্যাঙডনও মনে মনে তারিফ করল কোহলারের যুক্তির।

কোন অথরিটির কাছে ধণা দেয়ার আগে আমি জানতে চাই তোমরা দুজন কী নিয়ে কাজ করছিলে। যেতে চাই তোমাদের ল্যাবে।

ল্যাবের সাথে এর সম্পর্ক থাকার কথা নয়। আমি আর বাবা মিলে কী করছিলাম সেটার খবর আর কেউ জানে না।

প্রমাণে অন্য কথা মনে হয়।

প্রমাণ? কী প্রমাণ?

একই কথা গুমরে মরছে ল্যাঙউনের ভিতরেও।

তোমার আমাকে শুধু বিশ্বাস করতে হবে। কথা বলার প্রয়োজন নেই।

ভিট্টোরিয়ার চোখের দৃষ্টি দেখে ঠিক ঠিক বোঝা যায় এখন সে কাউকে বিশ্বাস করে না।

 

১৫.

ল্যাঙডন চুপচাপ তাদের দুজনের পিছনে পিছনে যাচ্ছে। মেয়েটা আশ্চর্য শান্ত। যোগব্যায়ামের ফল কিনা কে জানে! কিন্তু একটু পর পর ফোঁপানোর শব্দ যে আসছে না তা নয়।

কিছু একটা বলতে চায় ল্যাঙডন মেয়েটাকে একটু সহানুভূতি। বাবা বা মাকে হারানো কতটা বেদনার সেটা সে ঠিক ঠিক জানে।

তার বারোতম জন্মদিনের দুদিন পরে। মনে পড়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানটার কথা। বৃষ্টি পড়ছে। চারদিক ধূসর। এসেছিল অনেকেই। আন্তরিক ভঙ্গিতে তার হাত ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল। কার্ডিয়াক, স্ট্রেস ধরনের কয়েকটা কথা বারবার তারা বলছিল। তার মা তাকিয়ে ছিল অশ্রুতে ভরা চোখ নিয়ে।

একবার, যখন তার বাবা জীবিত ছিল, মাকে বলতে শুনেছিল, থাম, আর গোলাপের সুগন্ধ নাও।

এক ক্রিসমাসে সে বাবার জন্য একটা গোলাপ কিনে আনে। বাবা চুমু দেয় তার কপালে, তারপর সেটাকে রেখে দেয় ঘরের অন্ধকারতম কোণায়, ধূলিভরা একটা শেলফে। দুদিন পরে সে কৃত্রিম গোলাপটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসে স্টোরে। টের পায়নি বাবা কখনো।

একটা লিফটের সামনে এসে বাস্তবে ফিরে এল ল্যাঙডন। ভিতরে চলে গেছে কোহলার আর ভিট্টোরিয়া। বাইরে ইতস্তত করছে সে।

কোন সমস্যা? প্রশ্ন করল কোহলার। সে সমস্যার কথা জানতে রাজি নয়। এমনি ভাব।

নট এট অল। বলল সে অবশেষে, ছোট খুপরিটার দিকে নিজেকে ঠেলে দিতে দিতে। কখনো সে পারতপক্ষে যায় না লিফটের দিকে। তারচে বরং খোলা প্রশস্ত সিঁড়িই ভাল।

ডক্টর ভেট্রার ল্যাব মাটির নিচে। বলল কোহলার।

ভিতরে আসতে আসতে মনে মনে ভাবল ল্যাঙডন, চমৎকার। ঢোকার সাথে সাথে কারটা নামতে শুরু করল নিচে।

ছতলা।

দেখল এলিভেটরের মার্কারে দিকে। সেখানে মাত্র দুটা তলার কথা লেখা আছে। গ্রাউন্ড লেভেল আর এল এইচ সি।

এল এইচ সি কী?

লার্জ হ্যাড্রন লিডার বলল কোহলার, একটা পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর? এ শব্দটার সাথে খুব একটা পরিচিত নয় ল্যাঙডন। এ রাতে তার এক ফিজিসিস্ট বন্ধু তাদের পার্টিতে এসেছিল।

বেজন্মার দল ব্যাপারটা ক্যানসেল করে দিল। গাল ঝাড়ছিল ব্রাউনওয়েল।

ক্যানসেল করল কী? জিজ্ঞেস করল তারা।

এস এস সি।

কী?

সুপারকন্ডাক্টিং সুপার কলিডার।

একজন শ্রাগ করল। আমি জানতামই না যে হার্ভার্ড এমন কিছু বানাচ্ছে।

হার্ভার্ড নয়! বলল সে তেতে উঠে, আমেরিকা। এটা পৃথিবীর সবচে বড় পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর হতে পারত! দেশের সবচে বড় সায়েন্টিফিক প্রজেক্ট। দু বিলিয়ন ডলার নিয়ে বসে ছিল তারা এমন সময় সিনেট বাতিল করে দিল। মরার বাইবেল-বেল্ট লবিয়িস্টদের কাজ?

শান্ত হয়ে আসার পর ব্রাউনওয়েল আস্তে আস্তে বলল, যে পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর হল এমন এক যন্ত্র যেটা গোলাকার, একেবারে সুবিশাল। এর ভিতর দিয়ে পরমাণুর একেবারে ক্ষুদ্রতম কণাগুলো ছুটে চলে অকল্পনীয় গতিতে। কয়েলের চারদিকের চুম্বকগুলো এই গতি বাড়ায়। বাড়তে বাড়তে সেকেন্ডে এক লক্ষ আশি হাজার মাইলে চলে যায়।

এ গতিতে আলোর গতির কাছাকাছি! বলল এক প্রফেসর।

ড্যাম রাইট! ব্রাউনওয়েল বলল সাথে সাথে। ব্যাখ্যা করল, কী করে দুটা পার্টিকেলকে দুদিকে ঘোরানো হয়। ঘোরানো চলতে চলতে গতি বাড়ে। চরম গতিতে তাদের সংঘর্ষ করানো হয়। তখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে জানা যাবে সৃষ্টির পূঢ় রহস্য।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটরগুলো, বলেছিল ব্রাউনওয়েল, বিজ্ঞানের আগামী নির্দেশ করে। এ থেকেই ইউনিভার্সের বিল্ডিং ব্লকের খোঁজ পাওয়া যাবে।

হার্ভার্ডের পয়েট ইন রেসিডেন্স, শান্ত লোক, নাম তার চার্লস ভ্যাট, খুব বেশি উফুল্ল মনে হল না তাকে, এটা আমার কাছে বিদঘুটে লাগে, বলেছিল সে, বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে আসার চেয়ে প্রাচীণযুগে ফিরে যাবার মত… ঘড়িগুলোকে একটার সাথে আরেকটাকে ঠুকে দিয়ে ভেঙে তারপর সেটার ভিতরের কলকজা দেখে বোঝার চেষ্টা করা সময় কী করে চলে।

ব্রাউনওয়েল সাথে সাথে তার কাঁটাচামচ ফেলে দেয়, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

 

তার মানে সার্নের একটা পার্টিকেল এক্সিলারেটর আছে? ভাবল ল্যাঙডন, বস্তুকণা গুড়িয়ে দেয়ার মত গোলাকার একটা যন্ত্র! ভেবে পায় না সে কী কারণে তারা সেটাকে একেবারে মাটির নিচে কবর দিল।

যখন লিফটটা নামছে, পায়ের নিচে একটা কম্পন টের পেল সে। তারপর আবার তলায় গিয়ে হতাশ হয় সে। আবারো দাড়িয়ে আছে একটা একেবারে অচেনা এলাকায়। অচেনা দুনিয়ায়।

ডানে-বামে অসীম হয়ে মিশে গেছে করিডোরটা। এটা একেবারে নিখুঁত সিমেন্টের পথ। এখানে একটা আঠারো চাকার যান বিনা দ্বিধায় চলতে পারবে, এতটাই প্রশস্ত। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা, সে জায়গাটা ভালভাবেই আলোকিত। তারপর দুদিকে শেষ বিন্দুতে একেবারে পিচকালো অন্ধকার। একটা বদ্ধ বাতাস মনে করিয়ে দেয় তাদের যে তারা এখন মাটির নিচে। মাথার উপরে নিই মাটির অনেক পরত আছে। আছে নুড়ি আর পাথর। হঠাৎ করেই সে আবার ফিরে গেল ন বছর বয়সে। চারধারে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার… অন্ধকারে থাকার সেই পাঁচটা ঘণ্টার কথা এখনো তার ভিতরে গুমরে মরে।

এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া তাদের ছেড়ে। সামনের দিকে। যত এগিয়ে গেল সে, তত আলোকিত হয়ে উঠল টানেল। তারপর নিভে গেল মাঝখানের বাতিগুলো। ল্যাঙডনের মনে হল সুড়ঙ্গটা জীবিত।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর, আমতা আমতা করে বলল ল্যাঙডন, এটা কি নিচে, এই সুড়ঙ্গ ধরে কোথাও?

এটাই পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর। দেখাল কোহলার পিছনদিকে। ভিতরদিকের দেয়ালে।

ল্যাঙডনের চোখ কুঁচকে উঠল। দেয়ালের দিকে দেখাচ্ছে কেন লোকটা! এটাই এ্যাক্সিলারেটর? অবাক হয়ে দুদিকে তাকাল সে, আমি মনে করেছিলাম জিনিসটা গোলাকার।

এই এ্যাক্সিলারেটরও গোলাকার। বলল কোহলার, দেখতে সোজা। কিন্তু একেই বলে চোখের ধাঁধা। মোটেও সোজা নয়। এর গোলাকৃতিটা এত কম মাত্রায় বেড়েছে যে তা দেখে গোল হবার কথাটা মনে পড়ে না। অনেকটা পৃথিবীর মত।

এটা এক বৃত্ত! কী বলে! কত বড় হবার কথা, এই সোজা লাইন যদি একটা বৃত্ত হয়…

এল এইচ সি পৃথিবীর সবচে বড় মেশিন।

সার্ন ড্রাইভার বলেছিল যে মাটির নিচে পৃথিবীর সবচে বড় মেশিনটা লুকানো আছে, কিন্তু–

ব্যাসে এটা আট মাইল। আর পরিধিতে সাতাশ কিলোমিটার।

কী! সাতাশ কিলোমিটার? এই টানেলটা সাতাশ কিলোমিটার লম্বা? এতো… এতো ষোল মাইলের চেয়েও বেশি!

নড করল কোহলার। একে একেবার নিখুঁত বৃত্তাকারে খোড়া হয়েছিল। এখানে ফিরে আসার আগে ফ্রান্সের সীমান্তে ঢু মারে এটা। একত্র হয়ে যাবার আগে, পরিপূর্ণ গতিপ্রাপ্ত পার্টিকেল সেকেন্ডে দশ হাজার বারেরও বেশিবার ঘুরবে এটাকে কেন্দ্র করে।

আপনি বলছেন যে সার্ন কোটি টন মাটি খুড়েছে শুধু ছোট্ট পার্টিকেল গুঁড়া করার জন্য?

কখনো কখনো সত্যি বের করার জন্য মানুষকে পাহাড় ডিঙাতে হয়।

 

১৬.

শত শত মাইল দূরে, একজন বলল, ওয়াকিটকিতে, ওকে, আমি হলওয়েতে।

টেকনিশিয়ান বলল অন্য প্রান্ত থেকে, আপনি ক্যামেরা নম্বর ছিয়াশির খোঁজে গিয়েছেন। এটার শেষ প্রান্তে থাকার কথা।

রেডিওতে অনেকক্ষণ নিরবতা উঠল। ঘাম মুছল টেকনিশিয়ান। কেন যেন দরদর করে ঘামছে সে। তারপর সচল হল তার রেডিও।

ক্যামেরা এখানে নেই। বলল কটা, যেখানে আটকানো ছিল সে জায়গাটা দেখা যায়। কেউ না কেউ জিনিসটাকে সরিয়ে নিয়েছে।

বড় করে শ্বাস নিল টেকনিশিয়ান, ভাল, এক সেকেন্ড থাকুন।

সামনের স্ক্রিনের দঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আবার ঘামতে শুরু করল লোকটা। এর আগেও ক্যামেরা খোয়া গেছে। বিচিত্র কিছু নয়। পাওয়া গেছে অহরহ। কিন্তু এবার কিছু একটা অমঙ্গলের ব্যাপার টের পাওয়া যায় এখানে। যখনি ক্যামেরাটা কমপ্লেক্স ছেড়ে বেরুবে, চলে যাবে রেঞ্জের বাইরে, সাথে সাথে সেই স্ক্রিনটা কালো হয়ে যাবে। মনিটরের দিকে আরো একবার তাকায় টেকনিশিয়ান। ক্যামেরা নং ছিয়াশি থেকে এখনো ছবি আসছে স্পষ্ট।

বোঝাই যাচ্ছে, ক্যামেরাটা কমপ্লেক্সের ভিতরেই আছে। এবং কেউ একজন সেটাকে চুরি করে হাপিস হয়ে গেছে। কে? এবং কেন?

সিঁড়ির কাছে কি কোন অন্ধকার কোণ আছে? কোন খুপরি বা এমন কোন জায়গা যেখানটায় একটা ক্যামেরা লুকানো সম্ভব?

না। কেন?

নেভার মাইন্ড। সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।

বন্ধ করে দিল সে ওয়াকিটকি। তারপর চেপে ধরল ঠোঁট।

এই সুরক্ষিত এলাকার ভিতরেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে ক্যামেরাটা। এখানেই কোথাও। নিশ্চিত। আধমাইল ব্যাসের বিশাল এলাকার বত্রিশটা ভুবনের কোথাও। একটা মাত্র ক্লু আছে, ক্যামেরাটা এমন কোথাও বসানো আলো যায় না যেখানে। এই কমপ্লেক্সে অন্ধকার এলাকার কোন অভাব নেই। মেইনটেন্যান্স ক্লজেট, হিটিং ডাক্ট, গার্ডেনিং শেড, বেডরুম ওয়ার্ডরোব, আর আছে মাটির নিচের সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা। কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে ক্যামেরা নাম্বার ছিয়াশি বের করতে।

কিন্তু এটা আমার মাথাব্যাথা নয়। ভাবল সে।

এখনো হারানো ঝামেরাটা ট্রান্সমিট করছে। তাকাল সে সেদিকে। একটা আধুনিক গডনের কিছু দেখা যাচ্ছে সেখানে যেটার সাথে মোটেও পরিচিত নয় টেকনিশিয়ান। এবং এ ব্যাপারটাই ঘামাচ্ছে তাকে। এর গোড়ায় বসানো ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লে দেখল সে।

যদিও গার্ডরা তাকে চরম মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখার নানা কৌশল শিখিয়েছে, তবু, দরদর করে ঘামছে সে। নিজেকে শান্ত থাকতে বলল সে। কোন না কোন ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। জিনিসটা এত বড় নয় যে তা নিয়ে ঘাবড়াতে হবে। তবু, কমপ্লেক্সের ভিতর এটার অস্তিত্ব ঠিক ঠিক সমস্যায় ফেলে দেয় তাকে। খুব সমস্যায়, অবশ্যই।

সব বাদ দিয়ে আজকের দিনে… ভাবে সে।

তার চাকরিদাতার কাছে সিকিউরিটিই সবচে বড় ব্যাপার। কিন্তু আজকের দিনে…। গত বারো বছরের যে কোন দিন থেকে আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। আজ এখানকার নিরাপত্তাই সবচে বড় ব্যাপার। আবার তাকাল সে জিনিসটার দিকে। দেখতে নিরীহ। কিন্তু, কোথায় বসানো আছে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করতে পারে।

সিদ্ধান্ত নিল সে, ডাকবে উপরের কাউকে।

 

১৭.

খুব বেশি বাচ্চা মনে করতে পারবে না সে কখন প্রথম তার বাবার সাথে দেখা করেছিল কিন্তু ভিট্টোরিয়া ভেট্রা ঠিকঠিক মনে করতে পারে।

বয়স ছিল আট বছর। ছিল সে সেখানেই, যেখানে সব সময় ছিল। অরফ্যানোট্রোফিও ডি সিয়েনা। ফ্লোরেন্সের কাছে একটা ক্যাথলিক এতিমখানায়। মা বাবা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল কিনা সে জানে না। মা-বাবা আছে কিনা জানত না তাও।

সেদিন বৃষ্টি ছিল সেখানে। নার্স দুবার তাকে ডেকেছে খাবার খেয়ে যেতে। কিন্তু বরাবরের মত শুনেও না শোনার ভাণ করেছে সে। বসে আছে বাইরে… বৃষ্টির ফেঁটাগুলোকে পড়তে দিচ্ছে গায়ে… চেষ্টা করছে পরের ফোঁটাটা কোথায় পড়বে তা বোঝার।

আবার ডাকল নার্স। বারবার বলছিল, প্রকৃতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় যে বাচ্চারা, বৃষ্টিতে ভেজে, তাদের কপালে নিউমোনিয়ার দুঃখ আছে।

তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না… ভাবল ভিট্টোরিয়া।

যখন তরুন প্রিস্ট তার জন্য এসেছিল, ভিজে একসা হয়ে গিয়েছিল সে। চেনে না লোকটাকে। নতুন এসেছে এখানে। ভিট্টোরিয়া অপেক্ষা করল। কখন লোকটা ধৈর্য হারিয়ে তাকে খপ করে ধরবে, তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে ভিতরে, কিন্তু এমন কিছুই করল না লোকটা। অবাক করে দিয়ে সেও শুয়ে পড়ল মেয়েটার পাশে। তার বোব ছড়িয়ে আছে ঘাসের উপর।

তারা বলল তুমি নাকি প্রশ্ন করতে করতে তাদের নাস্তানাবুদ করে দাও? বলল লোকটা, খাতির জমানোর মত করে।

সাথে সাথে ফুঁসে উঠল ভিট্টোরিয়া, প্রশ্ন করা কি দোষের?

হাসল লোকটা সাথে সাথে। প্রাণখোলা হাসি। মন উজাড় করা হাসি। মনে হয়। তাদের কথাই ঠিক।

কী করছ তুমি এখানে, বৃষ্টির মধ্যে?

যা তুমি করছ… ভাবছি, ভেবে মরছি বৃষ্টি কেন পড়ে!

আমি এ কথা চিন্তা করছি না। আমি জানি ঠিক ঠিক কীজন্যে বৃষ্টি পড়ে।

সাথে সাথে অবাক চোখে তার দিকে তাকাল প্রিস্ট, তুমি জান?

সিস্টার এ্যাঞ্জেলিনা বলে বৃষ্টির ফোঁটা হল ফেরেশতাদের কান্না। আমাদের পা বুয়ে মুছে দেয়ার জন্য নামে।

ওয়াও! এই তাহলে ব্যাখ্যা?

না, এতে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না! বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে কারণ সবই পড়ে। সব পড়ে ধু বৃষ্টির ফোঁটা নয়!

জান, ইয়ং লেডি, তোমার কথাই ঠিক। সব পড়ে। এরই নাম গ্রাভিটি।

এরই নাম কী?

তুমি মাধ্যাকর্ষণের কথা শোননি?

না।

খুব খারাপ কথা। গ্রাভিটি অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়।

সাথে সাথে আগ্রহে অত্যুজ্বল হয়ে উঠল ভিট্টোরিয়ার চোখমুখ, গ্রাভিটি কী? বোঝাও আমাকে!

যাই জিজ্ঞেস কর না কেন, সব প্রশ্নের জবাব দিব ডিনারের পর।

তরুণ প্রিস্টের নাম লিওনার্দো স্ট্রো। নানদের নিঃসঙ্গ ভুবনে মেয়েটা আকড়ে ধরে তাকে। লিওনার্দোকে হাসায় ভিট্টোরিয়ার উজ্জ্বলতা, ভিট্টোরিয়াকে সে জানায় নানা রহস্য। রঙধনুর রহস্য, নদী আর ঝর্ণার রহস্য।

আলো, গ্রহ, তারকারাজি, আকাশ, সবকিছুর ব্যাখ্যা দেয় সে ঐশ্বরিক আবহে, বৈজ্ঞানিক ভাবধারায়।

আনন্দিত ভিট্টোরিয়াও। বাবা থাকার কী যে মজা তা সে আগে জানত না। তারপর তার সবচে বড় দুঃস্বপ্ন চলে এল। যাবার সময় হয়েছে লিওনার্দোর।

সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি। জেনেভা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা স্টাইপেন্ড পেয়েছি। ফিজিক্স পড়ব।

ফিজিক্স? আমি মনে করেছিলাম তুমি ঈশ্বরকে ভালবাস!

অবশ্যই! তাইত তার স্বর্গীয় আইনগুলো জানতে চাই।

থামল সে। মুষড়ে পড়েছে ভিট্টোরিয়া!

আমি তোমাকে পালিত কন্যা হিসাবে নিলে তুমি খুশি হবেতো?

পালিত মানে কী?

বলল ফাদার লিওনার্দো।

কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তাকে ছোট্ট মেয়েটা, ওহ্! ইয়েস! ইয়েস!

জেনেভায় চলে গেল তারা। ছমাস আগে গেছে লিওনার্দো এবার গেল ভিট্টোরিয়াও। সেখানে জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যোগ দিল। রাতে শিখতে লাগল বাবার কাছ থেকে।

তিন বছর পরেই লিওনার্দো ভেট্রাকে সার্ন নিয়ে নেয়।

 

ব্যালেরিক আইল্যান্ডে কাজ করছিল ভিট্টোরিয়া! এমন সময় ম্যাসেজ এল।

তোমার বাবা খুন হয়েছেন। তাড়াতাড়ি ফিরে এস।

ডাইভ বোটের ডেকে বসে বসে তরঙ্গের দোলায় একেবারে কাঠ হয়ে বসে থাকল ভিট্টোরিয়া।

বাড়ি ফিরে এল সে। কিন্তু এখানে আর বাড়ি বাড়ি ভাব নেই। যে লোকটার জন্য ফিরে আসা সেই নেই।

কে তার বাবাকে খুন করেছে? কেন? আর কে এই আমেরিকান স্পেশালিস্ট? ল্যাব দেখার জন্য পীড়াপীড়ি করছে কেন কোহলার সব বাদ দিয়ে?

কোন্ প্রমাণ আছে? কেউ জানত না কী কাজ করছি আমরা। আর কেউ যদি জেনেও ফেলে, তাকে খুন করার মত কী হল?

এগিয়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়া। তার বাবার সবচে বড় কীর্তি উন্মোচিত করতে। যে কাজটা বাবাকে নিয়ে করার কথা ছিল তার। সাথে থাকত ডাকসাইটে সব বিজ্ঞানী। বিস্ময়ে ঝুলে পড়ত তাদের চোয়াল।

এখন, মানুষের সামনে তাদের কীর্তি ঠিক ঠিক প্রকাশিত হচ্ছে যখন তার বাবা নেই।

সাথে আছে ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। ডের কোনিং। আর আছে একজন অপরিচিত আমেরিকান।

কোহলারকে একেবারে বাল্যকাল থেকেই দুচোখে দেখতে পারে না সে। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখে যায় যে লোকটা কাজের। কিন্তু তার শিতল চোখের সামনে লিওনার্দো ভেট্রার উষ্ণতা, তার নিছক গাণিতিক বিজ্ঞানের সামনে বাবার আত্মিকতার

কোন তুলনা নেই।

এগিয়ে গেল তারা একটা টাইল বাধানো পথের দিকে। সেখানে সারা দেয়াল জুড়ে বিচিত্র সব ছবি আটকানো। কোনটারই কোন মানে বোঝা যাচ্ছে না। মডার্ন আর্ট? হতে পারে।

স্ক্যাটার প্লট, বলল ভিট্টোরিয়া, পার্টিকেলের সংঘর্ষের ছবি। কম্পিউটারের। এটা জেড পার্টিকেল। পাঁচ বছর আগে বাবা এটাকে আবিষ্কার করেন। পিওর এনার্জি। কোন ভর নেই।

বস্তু এনার্জি?

বিষম খেল ল্যাঙডন।

ভিট্টোরিয়া, বলছে কোহলার, আমার বলা দরকার যে তোমার বাবার খোঁজে এসেছিলাম আজ সকালে।

এসেছিলেন?

আর তারপর আমার বিস্ময়ের কথাটা একবার ভাব। তিনি সার্নের স্ট্যান্ডার্ড কিপ্যাড সিকিউরিটি সিস্টেম বাদ দিয়ে অন্য কাজ করেছেন।

আমি ক্ষমা চাইছি। আপনি ভাল করেই জানেন নিরাপত্তার ব্যাপারে বাবা কত খুতখুতে। তিনি আমাদের দুজন ছাড়া আর কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চাননি।

ভাল। দরজা খোল।

এরপর কী হবে সে ব্যাপারে ল্যাঙডনের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া।

একটা টেলিস্কোপের দৃষ্টি দেয়ার অংশের মত জায়গায় সে ডান চোখ রাখল। তারপর চেপে দিল একটা বাটন। ফটোকপি মেশিনের মত আলো উপর নিচ, উপর নিচ করে স্ক্যান করে নিল তার রেটিনা।

এটা রেটিনা স্ক্যান। আমার আর বাবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সাথে সাথে জমে গেল রবার্ট ল্যাঙডন। সব পরিষ্কার হয়ে গেল মুহূর্তে।

তাকাল সে সাদা টাইলের উপর। দেখতে পেল একটা জমাট বিন্দু। রক্ত।

ভাগ্য ভাল, ভিট্টোরিয়া দেখেনি।

খুলে গেল দরজা। ভিতরে যাবার সময় বোঝা গেল, কোহলারের দৃষ্টিতে। সে যেন বলছেঃ।

যা বলেছিলাম… হারানো চোখের আরো বড় উদ্দেশ্য আছে।

 

১৮.

মেয়েটার হাত বাঁধা। তার মেহগনি রঙা চামড়া দেখে মনে আগুন ধরে যায় হ্যাসাসিনের।

সে কিছুই কেয়ার করে না। পাপ-পুণ্যের কথা ভাবার সময় নেই। তাকায় সে।

তার দেশে, মহিলারা সম্পদ। দুর্বল। ভোগের বস্তু। কিন্তু এখানে, ইউরোপে, মেয়েরা তেজস্বী। ব্যাপারটা তাকে আনন্দ দেয়।

আজ রাতে হ্যাসাসিন খুন করেছে। আর তার বদলে উপভোগ করবে তার পুরস্কার।

অনেকক্ষণ পরে! শুয়ে আছে হ্যাসাসিন তার পুরষ্কারের কাছে। হাত চালাচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়েটার গলায়। মেরে ফেললে কী? ও তো একটা উপমানব ভোগের বস্তু। অসাড়।

আরো অনেক কাজ পড়ে আছে। তার নিজের কামনার চেয়ে বড় ব্যাপার নিয়ে কাজ করতে হবে।

বিছানায় উঠে বসে সে। তারপর ভেবে পায় না, সেই জ্যাসান লোকটার প্রভাব কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। বুঝতে পারে না কী করে ইলুমিনেটি তার খোঁজ পেল। যতই ভাবে সে, ততই সশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। তাদের মূল অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত!

এখন, তারা তাকে নির্বাচিত করেছে। সেই তাদের কণ্ঠ, তাদের হাত। এ এক অনির্বচনীয় সুসংবাদ। সম্মান। তাদের লোক এ প্রতিনিধিকে বলে মালাক-আল-হক। দ্য এ্যাঞ্জেল অব ট্রুথ।

 

১৯.

ভেট্রার ল্যাব একেবারেই ভবিষ্যৎমুখী।

কম্পিউটার আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। দেখতে অনেকটা অপারেশন রুমের মত। এখানে কী এমন থাকতে পারে যার জন্য একজন মানুষের চোখ তুলে ফেলতে হবে।

একটু থমকে গেল কোহলার। তাকাল চারপাশে। ভিট্টোরিয়ার চলনও অনেক ধীর। যেন বাবাকে ছাড়া এখানে এসে সে বিরাট কোন পাপ করে বসেছে।

ঘরের মধ্যখানে চলে গেল ল্যাঙডনের চোখ। একদল ছোট পিলার উঠেছে মেঝে থেকৈ। একটা ছোট স্টোনহেঞ্জের ডজনখানেক পালিশ করা কলাম উঠে আছে উপরে। ফুট তিনেক লম্বা। প্রতিটায় একটা করে লম্বা ক্যানিস্টার বসানো আছে। টেনিসবল ক্যানের মত। ভিতরটা খালি।

সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি দিল কোহলার, চুরি যায়নিতো কিছু?

চুরি যাবে কী করে? বলল ভিট্টোরিয়া, এখানে ঢুকতে হলে রেটিনা স্ক্যান করতে হবে।

একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নাও।

সবই ঠিক মনে হচ্ছে। ঠিক যেভাবে বাবা রেখে যেত।

ভাবিত হল কোহলার। যেন ভাবছে কতটা বলবে ভিট্টোরিয়াকে। তারপর যেন ছেড়ে দিল হাল।

চলে এল সে ঘরের ভিতরে।

গোপনীয়তা, বলছে ডিরেক্টর, এমন এক বিলাস যা করা আমাদের আর সাজে না।

নড করল ভিট্টোরিয়া। যেন আবার কেঁদে ফেলবে।

এক মিনিট সময় দাও মেয়েটাকে! ভাবছে ল্যাঙডন।

যেন কী শুনবে সে কথা ভাবতে না পেরে চোখ বুজল ভিট্টোরিয়া ও শ্বাস নিল পরপর।

ঠিক আছে তো মেয়েটা?

তাকাল ল্যাঙডন কোহলারের দিকে। ডিরেক্টর নির্ভাবনার অভয় দিল চোখের ইশারায়।

তারপর, ঝাড়া দশ সেকেন্ড বন্ধ রেখে, খুলল চোখ সে।

যে ভিট্টোরিয়া ট্রোকে সে দেখল, তাতে বিষম খেতে হল ল্যাঙডনের। এক নতুন মানুষ। শরীরের প্রতিটা পেশীকে ভবিতব্য মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছে।

কোত্থেকে শুরু করব… বলল মেয়েটা।

প্রথমে তোমার বাবার পরীক্ষা সম্পর্কে বল।

বিজ্ঞানকে ধর্মের আলোয় অত্যুজ্জ্বল করা আমার বাবার সারা জীবনের স্বপ্ন। তিনি সব সময় প্রমাণ করতে চাইতেন যে ধর্ম আর বিজ্ঞান পরস্পরের পরিপূরক। আর সম্প্রতি… তিনি তা প্রমাণ করার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

কিছুই বলল না কোহলার।

তিনি এমন এক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন যেটা থেকে বিজ্ঞান আর ধর্মকে একত্রিত করা সম্ভব। ইতিহাসে প্রথমবারের মত।

কোন কোন প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুরাহা করে? নিজেকেই প্রশ্ন করে ল্যাওড়ন।

ক্রিয়েশনিজম! কীভাবে সৃষ্টি জগৎ তৈরি হল সে রহস্যের দুয়ারে করাঘাত করেন।

ও! সেই বিতর্ক!

বাইবেল বলে, ঈশ্বর এই ইউনিভার্সকে তুলে এনেছেন মহা শূণ্যতা থেকে। বলেছেন, লেট দেয়ার বি লাইট। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পদার্থবিদ্যা বলে, বস্তু কখনোই একেবারে শূণ্য থেকে উঠে আসতে পারে না।

একেবারে শূণ্যতা থেকে উঠে আসা সমর্থন করে না বিজ্ঞান।

মিস্টার ল্যাঙডন, বলছে ভিট্টোরিয়া, মনে হয় আপনি বিগ ব্যাঙ থিওরির সাথে পরিচিত।

মোটামুটি।

ল্যাঙডন জানে, বিগ ব্যাঙ হল এই ইউনিভার্সের সৃষ্টির তত্ত্ব। কোন এক ঘনবিন্দুতে সন্নিবিষ্ট হওয়া শক্তির বিস্ফোরণ। বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সেটা। এই হল ইউনিভার্সের গল্প।

বলে চলেছে ভিট্টোরিয়া, ক্যাথলিক উনিশো সাতাশে প্রথম বিগব্যাঙ থিওরি প্রস্তাব করে

আই এ্যাম স্যরি! বলল ল্যাঙডন, আপনি বলছেন যে বিগ ব্যাঙ থিওরি ক্যাথলিক চার্চের অবদান!

অবশ্যই। একজন ক্যাথলিক, জর্জ লেমিত্রে, উনিশো সাতাশে।

কিন্তু আমি মনে করেছিলাম… বিগ ব্যাঙ তত্ত্বটা কি হার্ভার্ডের এডউইন হাবলের প্রস্তাবনা নয়?

কোহলার এবার কথা বলে উঠল, আবারো, আমেরিকানদের ভুল ধারণা। হাবলের প্রস্তাবনাটা ওঠে উনিশো উনত্রিশে। লেমিত্রের দু বছর পর।

কিন্তু এর নাম হাবল টেলিস্কোপ। আমি কোন লেমিত্রে টেলিস্কোপের কথা শুনিনি কশ্মিন কালেও!

মিস্টার কোহলারের কথাই সত্যি। প্রস্তাব করেছিলেন লেমিত্রে। হাবল পরে প্রমাণ সংগ্রহ করেন।

ওহ।

ভেবে পায় না ল্যাঙডন, হার্ভার্ডের হাবল-পাগলা লেকচারাররা কি কখনো ভুলেও লেমিত্রের কথা তুলেছে?

লেমিত্রে যখন প্রথম বিগ ব্যাঙ থিওরির কথা প্রকাশ করলেন, বলছে ভিট্টোরিয়া, তখন সমস্বরে ভেঙচি কাটলেন বিজ্ঞানীরা। বস্তু, বললেন তারা, কখনোই তৈরি হতে পারে না শূণ্যতা থেকে। তারপর যখন প্রমাণ হাজির করলেন হাবল, শতকণ্ঠে গির্জা বিজয় দাবি করল। প্রমাণিত হয়ে গেল বাইবেলের কথা বৈজ্ঞানিক।

নড করল ল্যাঙডন, ব্যাপারটার উপর এতোক্ষণে তার নজর পড়ল।

অবশ্যই, বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারকে ধর্ম প্রচারের ঝান্ডা হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে চাইলেন না। সুতরাং তারা সাথে সাথে বিগ ব্যাঙ থিওরিকে গাণিতিক রূপ দিলেন। এখনো, সেই গাণিতিক হিসাবের পরও, চার্চ উপরে আছে একটা দিক দিয়ে।

মাথা নাড়ল কোহলারও, দ্য সিঙ্গুলারিটি।

ইয়েস, দ্য সিঙ্গুলারিটি। বলছে ভিট্টোরিয়া, টাইম জিরো। সে সময়টাকে ব্যাখ্যা করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল বিজ্ঞানীদের জন্য। গণিত এগিয়ে যায় টাইম জিরো পর্যন্ত। তার পরই খেই হারিয়ে পড়ে।

ঠিক, বলল কোহলার, সেখানে একটা প্রভাবকের প্রয়োজন পড়ে।

বিগ ব্যাঙের সাথে ঈশ্বরের সম্পৃক্ততার কথা বলেন আমার বাবা। বিজ্ঞান আজ বোঝ না সে মুহূর্তটাকে। একদিন বুঝতে পারবে, এটাই তার আশা ছিল।

মেসেজটা পড়ল ল্যাঙডন :

বিজ্ঞান আর ধর্ম বিপবীত নয়।
বিজ্ঞান এত নবীন যে সে বুঝতে পারে না।

বাবা বিজ্ঞানকে আরো উচ্চতর একটা স্তরে পৌঁছে দিতে চান, যেখানে বিজ্ঞান মেনে নিবে ঈশ্বরকে। তিনি সে প্রমাণ আনার জন্য এমন এক পথ বেছে নিলেন যেটার কথা কোন বিজ্ঞানী ভাবেনি। নেই তাদের সেই টেকনোলজি। তিনি এমন এক পরীক্ষা করার কথা ভাবলেন যা মানুষকে জানাবে যে জেনেসিস সম্ভব।

জেনেসিস প্রমাণ করা? লেট দেয়ার বি লাইট শূণ্য থেকে বস্তু?

ঘরের উপর আলসে দৃষ্টি পড়ল কোহলারের, মাফ করবে!

আমার বাবা একটা সৃষ্টি জগত তৈরি করেছেন… শূণ্যতা থেকে।

কী!

বলা ভাল, তিনি বিগ ব্যাঙ তৈরি করেছিলেন। অবশ্য একেবারে ছোট পরিমাণে… পদ্ধতিটা একেবারেই সরল। এ্যাক্সিলারেটর টিউবের ভিতর থেকে পার্টিকেলের দুটা অতি পাতলা প্রবাহ বইয়ে দিলেন। প্রবাহর একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সমস্ত ক্ষমতা একত্র করল একটা মাত্র বিন্দুতে। সেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী এ্যানার্জি তৈরি হল।

ফলাফল খুব বেশি বিস্ময়কর নয়। তার কাছে। কিন্তু যখন সেটা প্রকাশিত হবে, কেঁপে যাবে আধুনিক ফিজিক্সের ভিত্তিমূল। এ অবস্থায়, বস্তুর কণা জন্মাতে শুরু করল শূণ্য থেকে।

বলল না কিছু কোহলার। তাকিয়ে থাকল ফাঁকা দৃষ্টিতে।

বস্তু প্রস্ফুটিত হল একেবারে শূণ্য থেকে। সাব এটমিক ফুলঝুরির এক অসাধারণ প্রদর্শনী। শুধু তাই নয়, তিনি প্রমাণ করলেন, এই সবই ঘটেছে এক অবিশ্বাস্য শক্তির সান্নিধ্যে।

তার মানে ঈশ্বর? দাবি করল কোহলার।

গড, ঈশ্বর, বুদ্ধ, দ্য ফোর্স, ইয়াহওয়েহ, দ্য সিঙ্গুলারিটি, একীভুত বিন্দু–যে নামেই ডাকুন না কেন, ফলাফল একই–বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথা বলে, পিওর এনার্জিই সৃষ্টির মূল।

প্রমাণ?

এ ক্যানিস্টারগুলো। সেগুলোর স্পেসিমেন তিনিই তৈরি করেছেন।

কীভাবে প্রমাণ করবে? যে কোন স্থান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব।

সম্ভব নয়। এই পার্টিকেলগুলো ইউনিক। তারা এমন এক বস্তু যা পৃথিবীর বুকে কোথাও পাওয়া যাবে না।

কোহলার বলল, ভিট্টোরিয়া, কী করে তুমি বল যে বিশেষ ধরনের পদার্থ? পদার্থ সবই–

আপনি এর মধ্যেই এ বিষয়ে কথা বলে ফেলেছেন, ডিরেক্টর। সৃষ্টি জগতে দু ধরনের পদার্থ আছে। বৈজ্ঞানিক তথ্য।

মিস্টার ল্যাঙডন, বাইবেল সৃষ্টির ব্যাপারে কী বলে?

বলে… ঈশ্বর তৈরি করলেন আলো এবং অন্ধকার, স্বর্গ এবং নরক।

ঠিক তাই। তিনি সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করলেন।

ডিরেক্টর, বিজ্ঞানও একই কথা বলে, এই ইউনিভার্সেরও বৈপরীত্য আছে…

বস্তুর ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য… ফিসফিস করল কোহলার।

তাই, বাবা তার পরীক্ষা চালানোর সাথে সাথে দু প্রকারের বস্তু তৈরি হল।

যে বস্তুর কথা তুমি বলছ সেটা ইউনিভার্সের অন্য কোন প্রান্তে আছে। নেই আমাদের সৌর জগতে। সম্ভবত আমাদের গ্যালাক্সিতেও নেই।

তাতেই প্রমান হয়ে যাচ্ছে যে, ঐ ক্যানিস্টারের জিনিসগুলো আনা হয়েছে শূণ্য থেকে।

তুমি নিশ্চই বলবে না যে ঐ স্পেসিমেনগুলো–

তাই বলব, ডিরেক্টর! আপনি পৃথিবীর প্রথম এন্টিম্যাটার স্পেসিমেনের দিতে তাকিয়ে আছেন।

 

২০.

দ্বিতীয় ধাপ, ভাবল ত্যাসাসিন, অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে।

তার হাতের মশালটা নিভু নিভু হয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে সময়। ভয়, তার আজীবনের সঙ্গি, পিছু ছাড়ছে না। যে কোন যুদ্ধের চেয়ে ভয় এগিয়ে থাকবে সব সময়।

সামনের আয়নাটা জানাচ্ছে তাকে যে সে একেবারে নিখুঁত। ছদ্মবেশে কোন ভুল নেই। রোব আকড়ে ধরল সে।

দু সপ্তাহ আগে হলেও বলা যেত এর অপর নাম মরণ। বলা যেত নাঙা দেহে সিংহের খাঁচায় চলে যাওয়া আর এখানে আসা সমান।

কিন্তু সব ব্যাপারকে পাল্টে দিয়েছে জ্যানাস।

এখন একটা চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, জ্যানাসের কথামত তারা শান্তি থাকবে তো? নিশ্চিন্তে সারা যাবে তো কাজ?

যাবে।

ভিতর থেকে সাহায্য আসছে, বলেছিল জ্যানাস।

ভিতর থেকে? অসম্ভব। অবিশ্বাস্য।

যত ভিতরে যাচ্ছে সে ততই বুঝতে পারছে, এ যেন ছেলেখেলা।

ওয়াহাদ… তিন্তাইন… সালাসা… আরবাআ… শেষপ্রান্তে চলে যাবার আগে আরবিতে বলল।

এক… দুই… তিন… চার…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *