০১. গিজার বিশাল পিরামিড

০১.

গিজার বিশাল পিরামিডের উপরের ধাপে উঠে গিয়ে এক তরুণী মেয়ে তাকে ডাকে, নিচের দিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি কর, রবার্ট! আমি জানতাম, আরো কম বয়েসি কাউকে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। হাসিতে তার জাদু ঝরে।

শ্রাগ করে সে, গতি বাড়াতে চায়। কিন্তু পা যেন গেঁথে গেছে পাথরের মত। সবুর কর! বলে সে, মিনতি করে, প্লিজ…।

যত উপরে উঠছে ততই আচ্ছন্ন হয়ে আসছে দৃষ্টি। কানে বজ্রপাতের শব্দ। আমাকে অবশ্যই মেয়েটার কাছে পৌঁছতে হবে। কিন্তু আবার যখন সে উপরে তাকায়, স্রেফ ভোজবাজির মত উবে যায় মেয়েটা। তার স্থলে দাড়িয়ে আছে দন্তহীন এক বুড়ো। লোকটা তাকিয়ে আছে নিচের দিকে, ঠোঁট ভাঁজ করে। সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে ল্যাঙডন, নিরব মরুর বুকে সেই আওয়াজের প্রতিধ্বণি বাজে।

দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠল রবার্ট ল্যাঙডন। বিছানার পাশের ফোন কর্কশ কন্ঠে চেঁচামেচি করছে। মোহাবিষ্ট হয়ে রিসিভারটা তুলে নেয় সে।

হ্যালো?

আমি রবার্ট ল্যাঙডনের খোঁজ করছিলাম, এক লোকের কণ্ঠ বলল।

খালি বিছানায় উঠে বসল ল্যাঙডন, চেষ্টা করল মনটাকে পরিষ্কার করার। দিস… ইজ রবার্ট ল্যাঙডন। তাকাল সে ঘড়ির দিকে। ডিজিটাল ঘড়িটায় সকাল পাঁচটা আঠারো উঠে আছে।

আপনার সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা হওয়া দরকার।

কে বলছেন?

আমার নাম ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। আমি ডিসক্রিট পার্টিকল ফিজিসিস্ট।

আপনি… কী? কথা কি বুঝতে পারছে না ল্যাঙডন? আপনি কি নিশ্চিত যে ল্যাঙডনের খোঁজ করছেন আপনি আমিই সেই লোক?।

আপনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিয়াস আইকোনলজির প্রফেসর। আপনি সিম্বলজির উপর বই লিখেছেন এবং—

আপনি কি জানেন কটা বাজে এখন?

ক্ষমা চাচ্ছি। আমার কাছে এমন কিছু আছে যেটা আপনি দেখতে চাইতে পারেন। কথাটা ফোনে বলা সম্ভব নয়।

একটা বাঁকা হাসি উঠে এল ল্যাঙডনের ঠোঁটে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিছুদিন আগেও তার লেখা বইয়ের এক পাঠক তাদের দলের পক্ষ থেকে ফোন করেছিল, ঈশ্বর তাদের কাছে যে প্রমাণ পাঠিয়েছেন সেটা দেখানোর জন্য। আরেক মেয়েলোক তাকে ওকলাহোমা থেকে ফোন করে সেরা সেক্স অফার করেছিল যদি সে দয়া করে উড়ে গিয়ে সেখানে তার বেডশিটের উপরে লেখা ওঠা দৈবাবণী দেখে।

আমার নাম্বার পেলেন কোত্থেকে? এই সময়টাতেও ল্যাঙডন চেষ্টা করল একটু নরম হয়ে কথা বলার।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে। আপনার বইয়ের ওয়েবসাইটে।

এবার গুঙিয়ে উঠল ল্যাঙডন। সে নিশ্চিত, তার ওয়েবসাইটে আর যাই থাক বাসার ফোন নাম্বার থাকবে না কশ্মিনকালেও। লোকটা অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছে।

আপনার সাথে দেখা হওয়া দরকার, চাপ দিল কলার, আমি আপনাকে যথেষ্ট পে করব।

এবার পাগল হবার দশা ল্যাঙড়নের, দুঃখিত। কিন্তু আমি আসলেই বুঝে উঠতে পারছি না…

এখনি যদি আপনি রওনা দেন তাহলে এখানে পৌঁছতে পারবেন।

কোথাও যাচ্ছি না আমি। এখন সকাল পাঁচটা বাজে! তুলে রাখল রিসিভারটা ল্যাঙডন, ফিরে গেল বিছানায়। বন্ধ করল চোখ, চেষ্টা করল আবার ঘুমের রাজ্যে ফিরে যেতে। কোন কাজে লাগল না চেষ্টাটা। স্বপ্নটা মনে গাঁথা হয়ে গেছে। না পেরে অবশেষে সে রোবটা চাপাল গায়ে, তারপর নেমে গেল নিচে।

 

রবার্ট ল্যাঙডন খালিপায়ে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল তার ম্যাসাচুসেটস ভিট্টোরিয়ান বাসায়। এখন ইনসমনিয়া থেকে বেঁচে যাবার আশায় এক মগ ধূমায়িত কফি হাতে তুলে নিল। এপ্রিলের চাদ বাইরে থেকে আলো পাঠাচ্ছে, ওরিয়েন্টাল কার্পেটের উপর আকা হচ্ছে বিচিত্র সব নকশা। কলিগরা প্রায়ই ঠাট্টা করে, তার বাসা নাকি বসতবাড়ি নয়, একটা পুরাকীর্তির আখড়া। জাদুঘর। তার বাসা আসলেই ঠাসা হয়ে আছে নানা জায়গা থেকে আসা ধর্মীয় আর্টিফ্যাক্টে। ঘানা থেকে একটা ইকুয়াবা, স্বর্ণের তৈরি ক্রস এসেছে স্পেন থেকে এমনকি বোনিওর একটা বোক্কাসও আছে, একজন তরুণ যোদ্ধার চির তারুণ্যের প্রতীক।

মহাঋষির চেয়ারে বসে সে চকলেটের স্বাদ নিতে নিতে টের পেল বাইরের বে উইন্ডো দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ইমেজটা ম্লান… যেন কোন ভূত। বয়েসি কোন ভূত, ভাবল সে। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল, আসলে তার এই তারুণ্য আর বেশিদিন থাকছে না। এই শরীরটা একটা বাসা বৈ কিছু নয়।

যদিও এই চল্লিশ বছর বয়সে সে একেবারে ওভার স্মার্ট নয়, তবু তার মহিলা সহকর্মীরা তাকে আড়ালে আবডালে প্রাচীণ এ্যাপিল যুক্ত বলে থাকে–তার ধূসর, ঢেউ খেলানো চুল, তীক্ষ্ণ্ণ নীল চোখ, দৃষ্টি কেড়ে নেয়া গভীর কণ্ঠস্বর এবং শক্তিমান, বেপরোয়া মুচকি হাসি যে কারো মনোযোগ আকৃষ্ট করবে, কোন সন্দেহ নেই। স্কুল, আর কলেজ থেকেই ডাইভার হিসাবে সুনাম কুড়িয়ে আসছে আর এই বয়সে শত কাজের মাঝেও অভ্যাসটা ধরে রেখেছে ঠিক ঠিক। তাই শরীর এখনো নিখুঁত, এখনো, সাঁতারুর চিহ্ন সারা গায়ে, এখনো অবিরাম পঞ্চাশ ল্যাপ করে সাঁতরায় সে ইউনিভার্সিটির সুইমিং পুলে।

ল্যাঙডন তার বন্ধুদের কাছে সব সময় বিবেচিত হয় একটা কিংবদন্তী হিসাবে। এমন এক লোক যে শতাব্দিগুলোর মাঝে ধরা পড়ে গেছে। উইকএন্ডে তাকে নীল জিন্স পরা অবস্থায় দেখা যাবে ঠিকই, কাজ করছে সে, কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাথে সাথে লেকচার দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে, রিলিজিয়াস আর্টের বিষয়ে। কিন্তু আর সব সময় দেখা যাবে হ্যারিস টুইড আর ভেস্ট পরা অবস্থায়। ছবি আসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, যেখানে সেই বিখ্যাত পপাশাক আর সেই সাথে কোন জাদুঘরের উদ্বোধনে বক্তৃতা দিচ্ছে পটু কণ্ঠে।

একজন কঠিন শিক্ষক আর কড়া শৃঙ্খলার লোক হলেও ছাত্রমহলে তুমুল জনপ্রিয়তা আছে তার। দ্য লস্ট আর্ট অব গুড ক্লিন ফান এর ব্যাপারে সব সময় সে কঠিন। ক্যাম্পাসে তার ডাকনাম দ্য ডলফিন এটা শুধু সাঁতারে অবিশ্বাস্য দক্ষতার জন্য আসেনি, এসেছে ওয়াটার পোলো খেলায় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার কারণেও।

একা একা বসে আছে ল্যাঙডন, রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে না মোটেও। এবার ঘাপলা বাঁধাল তার ফ্যাক্স মেশিনের রিংটোন। বিরক্ত হতে গিয়েও হল না সে। হাসল কোনক্রমে।

ঈশ্বরের লোকজন! ভাবল সে, দু হাজার বছর ধরে মেসিয়াহর জন্য প্রতীক্ষা! কিন্তু আজও তাদের আশা ফুরায় না।

ওক প্যানেলের স্টাড়ির দিকে সে আলসে ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, হাতের খালি মগটা রেখে। ফ্যাক্সের ছবিটা পড়ে আছে ট্রে তে।

সাথে সাথে একটা ধাক্কা খেল সে।

এখানে একটা নগ্ন লাশের ছবি দেখা যাচ্ছে। লোকটার ঘাড় পুরোপুরি পিছনে ফিরাননা। তার বুকে একটা চিহ্ন আকা। লোকটার বুকের এই ব্র্যান্ডটা… একটা মাত্র শব্দ। এই শব্দটাকে ল্যাঙডন জানে। ভাল করেই জানে। অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে লেখাটার দিকে কিছুক্ষণ।

ইলুমিনেটি, বলল সে জোরে জোরে। ধ্বক ধ্বক করছে বুক। এ হতে পারে না…

ফ্যাক্সটাকে ভয়ে ভয়ে সে একশো আশি ডিগ্রি ঘোরায়। দেখল পাতাটার উপর দিক নিচে চলে এসেছে।

ঠিক সে মুহূর্তে, চলে গেল শ্বাস প্রশ্বাস। আবার সে অবিশ্বাস নিয়ে ঘুরিয়ে যায় পাতাটাকে।

ইলুমিনেটি! ফিসফিস করে সে।

উপর এবং নিচ থেকে একই লেখা দেখা যাচ্ছে। স্থাণুর মত পড়ে গেল ল্যাঙডন চেয়ারের উপরে। তারপর ফ্যাক্স মেশিনের জ্বলতে নিভতে থাকা লাইটের দিকে চোখ যায়। এখনো যে পত্রটা পাঠিয়েছে অপেক্ষা করছে ফোন লাইনে।

ল্যাঙডন তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, তারপর তুলল রিসিভার।

 

০২.

আমরা এবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি কি? লাইনের জবাব দেয়ার  সাথে সাথে লোকটার কণ্ঠ শোনা গেল।

ইয়েস, স্যার। আপনি খুব ভাল করেই পেরেছেন। নিজের কথা ব্যাখ্যা করতে চান নাকি?

আগেই আপনাকে বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি একজন ফিজিসিস্ট। একটা রিসার্চ ফ্যাসিলিটি চালাই। একটা খুন হয়েছে এখানে। মরদেহটা ভাল করেই দেখেছেন বোধ করি।

কী করে আমাকে পেলেন?

এরিমধ্যে বলেছি আপনাকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। দ্য আর্ট অব দ্য ইলুমিনেটি বইটার সাইটে।

ভাল করেই জানে সে, সাহিত্যের মূল ধারায় তার বইটা কল্কে পায়নি ঠিক, কিন্তু মোটামুটি সাড়া জাগাতে পেরেছে। কিন্তু তাতেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে না। পেজে কোন কন্টাক্ট নাম্বার ছিল না। আমি নিশ্চিত।

ওয়েব থেকে তথ্য নিয়ে চমকে দেয়া লোজনের কোন অভাব নেই আমার ল্যাবগুলোয়।

মনে হচ্ছে আপনার ল্যাবগুলো ওয়েবের ব্যাপারে অনেক বেশি জানে?

আমাদের জানা উচিৎ, বলল লোকটা, কারণ এটা আমাদেরই আবিষ্কার।

লোকটার কন্ঠে এমন কিছু ছিল যাতে ঠিক ঠিক বোঝা যায় ঠাট্টা করছে না সে–আর যাই করুক।

আপনার সাথে আমার এক্ষুণি দেখা হওয়া দরকার। মিনতি ঝরে পড়ল লোকটার কণ্ঠে, বোস্টন থেকে ল্যাবের দূরত্ব বেশি নয়, এক ঘণ্টার পথ।

তাকিয়ে আছে ল্যাঙডন একাধারে, হাতের ফ্যাক্সটার দিকে খুব জরুরি, চাপ দিল লাইনে থাকা কণ্ঠ।

ইলুমিনেটি! তাকিয়ে আছে সে একদৃষ্টে। প্রাচীণ চিহ্ন আর প্রতীক নিয়েই তার কায়কারবার। আর বিশেষ করে ইলুমিনেটি নিয়ে। কিন্তু যে কোন ভূতত্ত্ববিদ যদি জলজ্যান্ত ডায়নোসরের সামনাসামনি হয় তাহলে যেমন ভড়কে যাবে তেমনি ভড়কাচ্ছে সে আজকের দিনে ইলুমিনেটির ছাপ দেখে।

আমি আপনাকে না-জানিয়েই একটা প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বিশ মিনিটের মধ্যে সেটা বোস্টনের মাটি কামড়ে ধরবে।

ল্যাঙডন এখনো যেন স্বপ্ন দেখছে। কোথায় হতে পারে? উড়ে যেতে এক ঘন্ট সাগবে…

আমার ধৃষ্টতা ক্ষমার চোখে দেখবেন প্লিজ, বলছে কণ্ঠটা, আর কোন উপায় ছিল। আপনাকে এখানে চাই-ই চাই।

একবার তাকাল ল্যাঙডন হাতের ফ্যাক্সটার দিকে। তাকাল বাইরের কোমল প্রকৃতির দিকে। না, আর দেরি করা যায় না। তার প্রাচীণ সাধনার নূতন নমুনা দেখা দিয়েছে।

আপনিই জিতলেন, বলল সে, বলুন কোথায় আপনার প্লেনের সাথে দেখা করতে হবে।

 

০৩.

হাজার হাজার মাইল দূরে, দুজন মানুষ দেখা করছিল। চেম্বারটা অন্ধকারাচ্ছন্ন,  পুরনোদিনের, মধ্যযুগীয়।

বেনভেনিউটো, দায়িত্বে থাকা লোকটা বলল, দেখা যাচ্ছে না তাকে। ইচ্ছা করেই সে আড়ালে থাকছে। তোমার কাজ কি ভালমত শেষ হয়েছে?

সি, বলল অপরজন, পারফেট্টামেন্টে। কণ্ঠ তার পাথরের মতই নিখাদ।

আর কোন সন্দেহ থাকবে না কে দায়ী সে বিষয়ে?

না।

সুপার্ব। তোমার কাছে কি আমার চাওয়ার জিনিসটা আছে?

খুনির চোখ চকচক করে উঠল। তেলের মত কালো। একটা ভারি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সে টেনে তুলল। তারপর রেখে দিল টেবিলের উপরে, সশব্দে।

ছায়ার লোকটাকে যেন তুষ্ট মনে হল, ভাল কাজ করেছ।

ব্রাদারহুডের কাজে লাগা এক সম্মান বৈ কিছু নয়। বলল খুনি।

পরের ধাপ শুরু হতে যাচ্ছে অচিরেই। একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আজ রাতে আমরা দুনিয়ার খোল নলচে পাল্টে দিতে যাচ্ছি।

 

০৪.

রবার্ট ল্যাঙডনের সাব নাইন হান্ড্রেড এস কালাহান সুরঙ্গ থেকে তীরবেগে বেরিয়ে  এল। বোস্টন হারবার সামনেই, তার পরই লোগান এয়ারপোর্ট। তিনশ গজ সামনে যেতেই একটা আলোকিত হ্যাঙ্গার পাওয়া গেল। একটা বিশাল চার জ্বলজ্বল করছে এটার উপর। বেরিয়ে এল সে।

ভবনের পিছন থেকে গোলগাল চেহারার এক লোক এগিয়ে এল। পরনে তার নীল ইউনিফর্ম। রবার্ট ল্যাঙডন?

দ্যাটস মি, বন্ধুসুলভ কণ্ঠের জবাবে বলল সে গাড়িটার চাবি লাগাতে লাগাতে।

পারফেক্ট টাইমিং, বলল পাইলট লোকটা, আমার পিছনে পিছনে আসুন, প্লিজ।

বিল্ডিং পেরিয়ে যেতে যেতে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে ল্যাঙডন। এমন সব ব্যাপারের সাথে সে মোটেও পরিচিত নয়। একজোড়া চিননা, একটা টার্টলনেক আর হ্যারিস টুইডের স্যুট জ্যাকেট নিয়ে সে ঘর ছেড়েছে কোথায় যেতে হবে তা না জেনেই। পকেটের ছবিটার ব্যাপার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

ল্যাঙডন যে একটু অস্থির সেটা টের পেল পাইলট, ওড়াটা আপনার জন্য কোন সমস্যা নয়, তাই না স্যার?

আসলেই। বলল সে, ব্র্যান্ড বসানো মরদেহ আমার জন্য সমস্যা। উড়ে চলা? সেটাকে ঠিক সামলে নিতে পারব।

লোকটা হ্যাঁ ঙ্গারের কোণা ঘুরে গিয়ে একটা রানওয়ের দিতে তাকাল।

আবার স্থবির হয়ে গেল ল্যাঙন, সামনের দৃশ্য দেখে, আমরা ঐ জিনিসটায় চেপে বসতে যাচ্ছি?

একটা আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিল লোকটা, পছন্দ হয়?

পছন্দ হয়? কোন্ চুলা থেকে উঠে এসেছে এটা?

 

তাদের সামনের ক্র্যাফটটা আকারে আকৃতিতে বিশালবপু। দেখে এক পলে মনে পড়ে যায় যে কোন স্পেস শাটলের কথা। শুধু পার্থক্য একটাই, সামনের দিকটা চেছে দেয়া হয়েছে, করা হয়েছে সমান।

ল্যাঙডন প্রথমেই যা ভাবল, নিশ্চই স্বপ্ন দেখছে সে। যানটাকে বরং বুইক বলে ভুল হয়। কোন আকাশ রথ নয়। অবশ্য ফিউজিলাজের গোড়ায় দুটা ছোট ছোট ডানা দেখা যাচ্ছে। ঐ পর্যন্তই। বাকিটার পুরোটাই খোলস। পিছনের জায়গা থেকে একেবারে সামনে পর্যন্ত নিরেট খোলস। কোন জানালা নেই, নেই কোন চিহ্ন।

আড়াই লাখ কিলো পুরোপুরি ভরা আছে, বলল পাইলট, যেমন করে কোন বাবা। তার নতুন জন্মানো শিশুর জন্য মায়া নিয়ে কথা বলে, স্ন্যাস হাইড্রোজেনে চলে। সিলিকন কার্বাইড ফাইবারে মোড়া, বিশ অনুপাত এক হল এটার থ্রাস্ট/ওয়েট রেশিও। বেশিরভাগ জেই চলে সাত অনুপাত একে। ডিরেক্টর নিশ্চই আপনাকে দেখার জন্য প্রাণ পাত করছে। প্রয়োজন বিশেষ না হলে কখনো বিগ বয়কে বাইরে পাঠানো হয় না।

এই জিনিসটা উড়ে চলতে জানে? এখনো বিস্ময় কাটেনি ল্যাঙডনের।

হাসল পাইলট, ওহ্ ইয়া! দেখতে একটু জবুথবু, কিন্তু আপনার জেনে রাখা ভাল, যত তাড়াতাড়ি এতে অভ্যস্ত হবেন ততই মঙ্গল। আজ থেকে পাঁচ বছর পর আপনি যত বিমান দেখবেন তার সবই এ রকম। এইচ এস সি টি–হাই স্পিড সিভিল ট্রান্সপোর্ট। আমাদের ল্যাব এ জিনিস কিনেছে একেবারে প্রথমবারেই।

নিশ্চই নরক গুলজার করা ল্যাব তাদেরটা! ভাবল ল্যাঙডন।

এ হল বোয়িং এক্স থার্টি থ্রির প্রোটোটাইপ। বলেই যাচ্ছে পাইলট, কিন্তু এমন, আরো ডজন ডজন আছে এরিমধ্যে, দ্য ন্যাশনাল এ্যারো স্পেস প্লেন, রাশিয়ানদের আছে স্ক্যাম জেট, ব্রিটিশদের আছে হোটেল। এখানেই গুমরে মরছে ভবিষ্যত। শুধু পাবলিক সেক্টরে আসার আগে একটু স্বস্তিতে দিন গুজরান করছে এই বিভিন্ন মডেলের প্লেনগুলো। এগুলোর জাত আলাদা হলেও তাল ঠিক। প্রচলিত জেটগুলোকে আপনি বিনা বিদায় চুম্বন দিতে পারেন অনায়াসে।

আমার মনে হয় প্রচলিত জেটগুলোতেই অনেক বেশি স্বস্তি বোধ করব।

এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাইলট, এদিক দিয়ে, মিস্টার ল্যাঙডন, সাবধানে পা ফেলুন, প্লিজ।

 

কয়েক মিনিট বাদে, খালি কেবিনের ভিতরে জেকে বসেছে ল্যাঙডন। পাইলট তাকে সামনের দিকের একটা সিটে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়ে সামনের দিকে উধাও হয়ে গেল।

ভিতরের সমস্ত দৃশ্য প্রচলিত বাণিজ্যিক এয়ারলাইনের মত, শুধু পার্থক্য এক জায়গায়, এখানে কোন জানালা নেই। ভাবনাটা মোটেও স্বস্তি দিল না ল্যাঙডনকে। একটু ক্ল্যাস্ট্রোফোবিয়া তার সারা জীবন ধরে তাড়িয়ে ফিরছে। বাল্যকালের অযাচিত এক ঘটনার পর থেকে কোন পরিস্থিতিতেই সে আবদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না।

আবদ্ধ জায়গা থেকে দূরে থাকার জন্য যথাসম্ভব সব করে সে, বদ্ধ জায়গার খেলাগুলোকে এড়িয়ে চলে, যখন তখন ভোলা জায়গার জন্য আইঢাই করে তার প্রাণ। এমনকি এই বিশাল ভিট্টোরিয়ান বাসাটাও সেজন্যেই এত খোলামেলা।

ইঞ্জিন গর্জে উঠছে তার নিচে। জ্যান্ত হয়ে উঠছে তাবৎ প্লেন। সে কোনমতে গলাধঃকরণ করল ব্যাপারটাকে। টের পেল সে ঠিক ঠিক, ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে যাচ্ছে আজব প্লেনটা। উপরে হালকা কান্ট্রি মিউজিক বাজছে।

সিটের পাশের একটা ফোন বিপবিপ করে উঠল। হাত বাড়াল ল্যাঙডন।

হ্যালো?

আরামদায়ক, মিস্টার ল্যাঙডন?

মোটেও নয়।

রিলাক্স করুন। এক ঘণ্টার মধ্যে জায়গামত পৌঁছে যাচ্ছি।

আর সেখানটা কোথায়? কোথায় যাচ্ছে তার বিন্দুবিসর্গ জানা নেই দেখে আশ্চর্যান্বিত হল সে।

জেনেভা। ইঞ্জিন চালু করতে করতে জবাব দিল পাইলট, ল্যাবটা জেনেভায়।

জেনেভা! একটু যেন স্বস্তি পেল ল্যাঙডন, নিউ ইয়র্কের উপরদিকটায়? সেনেকা লৈকের কাছে আমার পরিবার আছে। জানতাম নাতো জেনেভায় একটা ফিজিক্স ল্যাব আছে!

হাসল পাইলট, নিউ ইয়র্কের জেনেভা নয়, মিস্টার ল্যাঙডন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড।

কথাটা কানে প্রবেশ করতে যেন অনেকটা সময় নিল।

সুইজারল্যান্ড? মনে হয় আপনি বলেছিলেন জায়গাটা মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে,

ঠিক তাই, মিস্টার ল্যাঙডন, মুচকে হাসছে পাইলট, এই প্লেন ম্যাক ফিফটিনে চলে। শব্দেরচে পনেরগুণ গতিতে।

 

০৫.

ব্যস্ত ইউরোপিয়ান পথে খুনি সাপের মত একেবেকে এগিয়ে যায় হাজার মানুষের  ভিতর দিয়ে। সে শক্তিশালী, কালো এবং নিষ্ঠুর। এখনো তার মাংসপেশী আড়ষ্ট। হয়ে আছে সেই দেখা হবার পর থেকেই।

ভালভাবেই এগিয়ে গেল ব্যাপারটা, ভাবল সে আপন মনে, যদিও কখনো তার চাকরিদাতা মুখ উন্মোচিত করেনি, তবু খুনি মনে মনে আহ্লাদে আটখানা হয় তার উপস্থিতির কথা ভেবে, মাত্র পনেরদিন ধরে কি তার চাকরিদাতা তার সাথে যোগাযোগ করছে?

সেই কলের প্রত্যেকটা কথা তার এখনো অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে…

আমার নাম জানাস, বলেছিল কলার, আমরা একই পথের পথিক। আমাদের দুজনেরই অভিন্ন এক শত্রু আছে। শুনেছি তোমার দক্ষতা ভাড়া করা যায়।

নির্ভর করে আপনি কার পক্ষ থেকে কথা বলছেন তার উপর, সাথে সাথে চট করে জবাব দেয় সে।

জবাব দেয় কলারও।

আমি ঠাট্টা তামাশা তেমন পছন্দ করি না।

তুমি আমাদের নাম শুনেছ, আমি খুশি। বলল কলার।

অবশ্যই, ভাতৃসংঘ এক ঐতিহাসিক ব্যাপার।

আর এখনো তুমি নিশ্চিত হতে পারছ না আমি সত্যি বলছি নাকি মিথ্যা।

সবাই জানে যে ব্রাদাররা ধূলিতে মিশে গেছে।

একটা চাতুরি। অজানা শত্রুই সবচে বড় শত্রু।

একটা ছোটমত ধাক্কা খেল খুনি, এখনো টিকে আছে ব্রাদারহুড?

চিরকালের চেয়ে অনেক বেশি গোপনে। যা তুমি দেখতে পাও, তার সবখানেই আমাদের মূল প্রবেশ করেছে সংগোপনে… এমনকি আমাদের সবচে বড় শত্রুর অজেয় কেল্লাতেও।

অসম্ভব। তাদের কোন ছিদ্র নেই।

আমাদের হাত অনেক লম্বা।

কারো হাত এত লম্বা নয়।

খুব দ্রুত তুমি বিশ্বাস করবে। ব্রাদারহুডের অপ্রতিরোধ্য এক মহড়া খুব দ্রুত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এমন এক মহড়া যাতে সারা দুনিয়ার লোক কেঁপে উঠবে, সত্যিটা জানতে পারলে।

কী করেছেন আপনারা?

বলল সে।

বড় বড় হয়ে গেল খুনির চোখ। অসম্ভব!

পরদিন সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রে একই খবর বেরুল।

বিশ্বাস করল খুনি।

আর এখন, পনেরদিন পর, তার বিশ্বাসের ভিত্তিমূল প্রোথিত হয়ে আছে অনেক অনেক গভীরে। ভাতৃসঘ এখনো টিকে আছে, ভাবে সে। আজ রাতে তারা মাথা উঁচু করে তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণ করবে।

সে গর্বিত বোধ করে, তারা তাকে নির্বাচিত করে। একই সাথে এ-ও জানে, সে ছাড়া নির্বাচিত করার মত দক্ষ লোক খুব কমই আছে।

এ পর্যন্ত ঠিক ঠিক সব কাজ করেছে সে। খুন করেছে, জ্যানাসের হাতে তুলে দিয়েছে জিনিসটা। এখন জায়গামত বসানো বাকি।

জায়গামত…

কিন্তু কীভাবে? ভিতরে খুব শক্ত সমর্থন থাকতে হবে। আসলেই, ব্রাদারহুডের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

জ্যানাস, ভাবে খুনি, একটা কোড নেম।

সে জানে, রোমান এই দুই মুখের দেবতার নাম নিয়ে ভুল করেনি তার চাকরিদাতা। নাকি শনির চাঁদের নামে নাম নিয়েছে? যে জন্যই নামটা নেয়া হোক না কেন, তাতে আর কোন পার্থক্য নেই। লোকটার ক্ষমতা যে অসীম তা ঠিক ঠিক বোঝা হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে খুনি তার পূর্বপুরুষদের কথা কল্পনা করল। তারা নিশ্চই তার প্রতি স্নেহাশীষ পাঠাচ্ছে। আজ সে তাদের যুদ্ধে নেমেছে। সেই একাদশ শতাব্দি থেকে। একটা শত্রুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর ঘৃণা পুষে রেখেছে তারা… যখন থেকে ক্রুসেডাররা তাদের ভূমিতে পা রাখে, খুন আর ধর্ষণের বন্যা বইয়ে দেয়, তাদের অপবিত্র ঘোষণা করে, বিলুপ্ত করে দেয় তাদের মন্দির আর ঈশ্বরের চিহ্ন, তখন থেকে।

নিজেদের রক্ষার জন্য তার পূর্বপুরুষরা একটা ছোট কিন্তু ভয়ানক বাহিনী গড়ে তোলে। সারা ভূমি জুড়ে তাদের নাম ছিল রক্ষক–তারা থাকত গোপনে। সংগোপনে। কিন্তু খুন করতে দ্বিধা করত না মোটেও। সামনে যে শক্রই পড়ক খুন হয়ে যেতে বিন্দুমাত্র সময় নিত না। হত্যাকান্ডের জন্যই তারা শুধু বিখ্যাত ছিল না, খ্যাতনামা ছিল অবসর সময় কাটানোর পদ্ধতির জন্যও। তাদের ড্রাগটা ছিল অনেক বেশি বিষাক্ত, নাম ছিল তার হাসিস।

আস্তে আস্তে তাদের বিস্তৃতি যখন ঘটে, নামটাও মুখে মুখে রটে যায়–হ্যাসাসি ন–হাসিসের অনুসরণকারী। আস্তে আস্তে হ্যাসাসিনের সাথে মৃত্যুর একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা ভাষায় হ্যাসাসিন মৃত্যুর অপর নাম। এ নামটা আজো পৃথিবীতে প্রচলিত, এমনকি আধুনিক ইংরেজিতেও… কিন্তু খুনের পদ্ধতির সাথে সাথে নামটাও পাল্টে গেছে অনেকটা।

এখন সেটাকে বলা হয় এ্যাসাসিন।

 

০৬.

চৌষট্টি মিনিট পরে সূর্যের আলোয় বিধৌত রানওয়ের উপর আছড়ে পড়ে জেটটা। বাইরের খোলা আবহাওয়া একেবারে লা জওয়াব। চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ আর কালচে পাহাড়, মাথায় তাদের শুভ্র বরফের টোপর।

স্বপ্ন দেখছি আমি, বলল রবার্ট ল্যাঙডন নিজেকে শুনিয়ে, যে কোন মুহূর্তে জেগে উঠব।

সুইজারল্যান্ডে স্বাগতম, বলল পাইলট।

হাতের ঘড়ি দেখে নিল ল্যাঙডন, এখানে সাতটা সাত দেখাচ্ছে।

আপনি ছটা টাইম জোন পেরিয়ে এসেছেন। এখানে এখন মাত্র একটা বেজেছে। দুপুর একটা।

সাথে সাথে ঘড়ি রিসেট করল ল্যাঙডন।

কেমন বোধ করছেন আপনি?

পাকস্থলি চেপে ধরল ল্যাঙডন, যেন আমি এইমাত্র এত্তোগুলো স্টিরোফোম খেয়ে উঠেছি।

নড করল পাইলট, উচ্চতা-অসুখ। আমরা ষাট হাজার ফিট উপরে ছিলাম। সেখানে ওজন কমে যায় ত্রিশভাগ। কপাল ভাল, আমরা কম দূরত্ব পেরিয়ে এসেছি। : যদি টোকিওতে যেতে হত তাহলে আর কোন কথাই নেই। শত মাইল উপরে উঠতে হত।

একটা উষ্ণ নড় করে ল্যাঙডন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করল টোকিও না যেতে হওয়ায়। টেক অফের সময় হাড়ভাঙা ত্বরণের কথা বাদ দিলে এ যাত্রা যাত্রাটা খারাপ হয়নি। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে, এগারো হাজার মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে ঘুরে এসেছে তারা এইমাত্র।

এক্স থার্টি থ্রির যত্ন আত্তি করার জন্য কয়েকজন এগিয়ে গেল রানওয়ের দিকে। পার্কিঙয়ে রাখা একটা কালো পিউগট সিডানে নিয়ে গেল পাইলট তাকে। ভ্যালির ভিতর দিয়ে একটা আকাবাকা পথে চলে গেল তারা। মাঝে মধ্যে একটু দুটা বিল্ডিং দেখা যায়, বাকিটা সবুজ ঘাসে মোড়া।

অবিশ্বাসের সাথে সে দেখল, পাইলট বিনা দ্বিধায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় একশো শত্ত্বর কিলোমিটার তুলে ফেলল।

এই লোকটার সাথে গতির কী সম্বন্ধ? ভেবে পায় না সে।

ল্যাব থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছি। সেখানে নিয়ে যাব আপনাকে দু মিনিটের মধ্যে।

সাথে সাথে সিটবেল্টে নিজেকে আরো শক্ত করে গুটিয়ে নেয় সে।

কেন, সময়টাকে তিন মিনিট বানিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনকেই সেখানে জ্যান্ত পৌঁছানো যায় না?

গতি বাড়িয়েই চলল গাড়িটা।

টেপ ডেকে একটা ক্যাসেট ঢোকাতে ঢোকাতে জিজ্ঞাসা করল পাইলট, আপনি কি রেবা পছন্দ করেন?

এক মহিলা গাওয়া শুরু করল, এ হল একা থাকার ভয়…

এখানে কোন ভয় নেই, অন্যমনস্কভাবে ভাবে ল্যাঙডন, তার মেয়ে সহকর্মীরা নিশ্চিন্তে বলে বেড়ায় যে বাসার সারাটা জায়গাকে একেবারে জাদুঘর বানিয়ে রাখাটা আসলে একটা ছলনা। যেন খালি খালি না লাগে সে চেষ্টা।

হেসে উড়িয়ে দিত ল্যাঙডন সেসব কথা। তার জীবনে এরই মধ্যে তিনটা ভালবাসা দানা বেঁধেছে, সিম্বলজি, ওয়াটারপোলো আর কৌমার্য।

তার জীবনে ফিরে এসেছে আনন্দ, সে চাইলেই দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে, করতে পারে যা খুশি। রাতের নিস্তব্ধতায় চাওয়া মাত্র একটা বই হাতে নিয়ে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি তুলে নিতে পারে বিনা দ্বিধায়।

আমরা আসলে একটা ছোটখাট মহানগরী, বলল পাইলট, শুধু ল্যাব নয়, আমাদের আছে সুপারমার্কেট, একটা হাসপাতাল এমনকি পুরোদস্তুর একটা সিনেমা।

নড করল ল্যাঙডন। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

সত্যি বলতে গেলে, আমাদের হাতে আছে এ দুনিয়ার সবচে বড় যন্ত্র।

তাই নাকি?

ঠিক তাই। এটা মাটির নিচে, ছতলা নিচে বসানো।

কোন কথা না বলে তাকিয়ে রইল ল্যাঙডন এবারো।

হঠাৎ ঘ্যাচ করে থামিয়ে দিল পাইলট গাড়িটাকে। সামনে লেখা, সিকুরিটে, এ্যারেন্টেজ। এবার হঠাৎ করে সে টের পায় কোথায় আছে এখন।

মাই গড! আমি পাসপোর্ট আনিনি!

পাসপোর্ট একটা বাহুল্য। আমাদের সাথে সুইস সরকারের একটা সমঝোতা আছে।

দেখল ল্যাঙডন, একটা কার্ড এগিয়ে দিল পাইলট। সেন্টি সেটাকে নিয়ে ঢোকায় অথোরাইজেশন ডিভাইসের ভিতর। জ্বলে উঠল সবুজ বাতি।

যাত্রির নাম?

রবার্ট ল্যাঙডন। বলল পাইলট।

কার অতিথি?

ডিরেক্টরের।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেল সেন্ট্রির। সে তাকাল সামনের দিকে, একবার তাকাল হাতের লিস্টে, আরেকবার কম্পিউটার স্ক্রিনে। তারপর এগিয়ে এল জানালার কাছে, এঞ্জয় ইউর স্টে, মিস্টার ল্যাঙডন।

এগিয়ে গেল গাড়ি আরো দুশ গজ। সামনে একটা চতুষ্কোণ, অতি আধুনিক স্থাপত্য চোখে পড়ে, কাচ আর স্টিল দিয়ে গড়া। ভবনটার অসাধারণ স্বচ্ছতা,দেখে সে যার পর নেই আমোদিত হল। সব সময় ল্যাঙডন স্থাপত্যশৈলির সমঝদার।

দ্য গ্লাস ক্যাথেড্রাল। বলল লোকটা।

গির্জা?

আরে না! এখানে একটা জিনিসই নেই। গির্জা। এখানকার ধর্মের নাম ফিজিক্স। পদার্থবিদ্যাই এখানকার চালিকা শক্তি। যত খুশি ঈশ্বর নাম মুখে আনুন, শুধু কোয়ার্ক আর মেসন সম্পর্কে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখালেই হল।

কোয়ার্ক আর মেসন? কোন বর্ডার সিকিউরিটি নেই? ম্যাক ফিফটিক জেট? কোন নরক থেকে উঠে এসেছে এই লোকগুলো?

সামনের একটা বিশাল কাচের ভবন। সেখানে থেমে জবাব পেয়ে গেল সে।

(সার্ন)
কাউন্সেল ইউরোপিন পুর লা
রিসার্চে নিউক্লিয়ারে

নিউক্লিয়ার রিসার্চ? পুরোপুরি নিশ্চিত সে, অনুবাদ ঠিক ঠিক হয়েছে।

কোন জবাব দিল না ড্রাইভার। এখানেই নামতে হচ্ছে আপনাকে। ডিরেক্টর এখানেই দেখা করছেন।

একজন লোককে হুইল চেয়ারে বসে বেরিয়ে আসতে দেখল ল্যাঙডন। লোকটা এগিয়ে আসছে, চোখে মুখে প্রৌঢ়ত্বের ছাপ, বয়স হবে ষাটের কোঠার প্রথমদিকে। এখনো শক্ত চোয়াল। এত দূর থেকেও তার চোখ দুটাকে একেবারে নিপ্রাণ বলে মনে হয়। যেন পাথরের টুকরা।

তিনিই সেই লোক?

যাক, আমিও একদিন হব। বলল পাইলট, নির্মল একটা হাসি দিয়ে, শয়তানের কথা আরকী!

এগিয়ে গেল সে লোকটার দিকে। বাড়িয়ে দিল লোকটা কৃশ একটা হাত।

মিস্টার ল্যাঙডন? আমি ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। ফোনে কথা হয়েছে আমাদের।

 

০৭.

ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার, ডিরেক্টর জেনারেল অব সার্ন, পিছন থেকে তাকে ডাকা হয় কোনিং-কিং। একটা হুইল চেয়ারের সিংহাসনে থেকে সে শক্ত হাতে চালায় সার্নকে।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত ধরে লোকটার সান্নিধ্যে থেকেও ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে ল্যাঙডন, দূরত্ব বজায় রাখতে ওস্তাদ এই প্রবীণ বিজ্ঞানী।

হুইল চেয়ারের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে রীতিমত ঘেমে নেয়ে উঠতে হচ্ছে ল্যাঙডনকে। এমন চেয়ার সে কস্মিনকালেও দেখেনি। হাজারটা বিদঘুটে যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। একটা মাল্টি লাইন ফোন সেট আছে, আছে পেজিং সিস্টেম, কম্পিউটার স্ক্রিন, এমনকি একটা ছোট, ডিটাচেবল ভিডিও ক্যামেরা।

এ হল কিং কোহলারের মোবাইল কমান্ড সেন্টার।

সার্নের বিরাটাকায় মূল লবিতে প্রবেশ করল ল্যাঙডন একটা যান্ত্রিক দরজা পেরিয়ে।

দ্য গ্লাস ক্যাথেড্রাল, মনে মনে আউড়ে গেল সে, উপরের দিকে তাকিয়ে।

উপর থেকে নীলচে কাচে পড়ছে পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি, এগিয়ে আছে একটা অনির্বচনীয় আবহ। বাতাসে পরিচ্ছন্নতার গন্ধ, কয়েকজন বিজ্ঞানী এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের পদশব্দ পাওয়া যায় সব সময়।

এ পথে, প্লিজ, মিস্টার ল্যাঙডন। বলল কোহলারের কণ্ঠস্বর। একেবারে কম্পিউটারাইজড। দ্রুত করুন প্লিজ, মরা চোখ তুলে তাকাল সে ল্যাঙডনের দিকে।

মূল আর্টিয়াম থেকে অযুত হলওয়ে চলে গেছে চারদিকে। প্রতিটায় জীবনের উৎসব।

যে-ই দেখছে কোহলারকে, থমকে যাচ্ছে। তারপর চোখ তুলে তাকাচ্ছে ল্যাঙডনের দিকে। কে লোকটা, যে ডিরেক্টরকে খাচা থেকে বের করে আনল!

আমি বলতে লজ্জা পাচ্ছি যে কখনো সার্নের নামটা পর্যন্ত শুনিনি।

স্বাভাবিক। বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করে বিজ্ঞানের আধুনিক সূতিকাগার তাদের দেশ। ইউরোপ নয়। তারা আমাদের এলাকাকে শুধু মাত্র একটা শপিং ডিস্ট্রিক্ট মনে করে। তারা ভুলেই যায়, এখানেই জন্মেছিলেন আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, নিউটন।

পকেট থেকে ছবিটা বের করে কাজের কথায় চলে এল ল্যাঙডন, ছবির লোকটা, আপনি কি-

প্লিজ। এখানে নয়। আমি আপনাকে তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। হাত বাড়াল সে, মনে হয় জিনিসটা হাতে নিয়ে নেয়াই ভাল।

বিনা বাক্যব্যায়ে ল্যাঙডন তার হাতের ছবিটা তুলে দিল ডিরেক্টরের হাতে।

হঠাৎ বাঁয়ে মোড় নিয়ে কোহলার একটা চওড়া হলওয়েতে ঢুকল যেটা ছেয়ে আছে নানা আকার আর প্রকারের বিচিত্র সব এ্যাওয়ার্ডে। বড় একটার সামনে দিয়ে যেতে যেতে লেখাটা পড়ল ল্যাঙডন।

আর্স ইলেক্ট্রনিকা এ্যাওয়ার্ড
ডিজিটাল যুগে কালচারাল আবিষ্কারের জন্য
পুরস্কারটা যাচ্ছে টিম বার্নার্ড লি এবং সার্নের কাছে
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব,
আবিষ্কারের কারণে

সব সময় ল্যাঙডন ভেবে এসেছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আমেরিকার কীর্তি।

ওয়েবটা, বলছে কোহলার, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে একটু কেশে নিয়ে, এখানে প্রথম তৈরি করা হয় ভিতরের কম্পিউটারের যোগাযোগ যন্ত্র হিসাবে। যাতে যে কোন বিজ্ঞানী সার্নের যে কোন তথ্য পেতে পারে সহজেই। কিন্তু দুনিয়া মনে করে এটা আমেরিকার আবিষ্কার।

কেন সঠিক তথ্যটা জানানো হয় না?

সাধারণ একটা ভুল শোধারাবার গরজ সার্নের নেই। কম্পিউটারের পৃথিবীব্যাপি কানেকশনের তুলনায় সার্ন অনেক বেশি বড়। আমাদের বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন জাদু দেখায়।

জাদু?

আপনাকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমার ধারণা ছিল আপনি রিলিজিয়াস সিম্বলজিস্ট। আপনি কি জাদুমন্ত্রে বিশ্বাস করেন না? অলৌকিকে?

আমি অলৌকিকে ঠিক ভরসা রাখি না। এ ব্যাপারে কোন স্থির বিশ্বাস নেই আমার।

সম্ভবত অলৌকিক ভুল শব্দ। আমি আপনার ভাষায় কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

আমার ভাষায়? একটু তেতে উঠল ল্যাঙডন, আপনাকে দুঃখ দেয়ার জন্য বলছি, স্যার। আমি রিলিজিয়াস সিম্বলজি স্টাডি করি-আমি একজন এ্যাকাডেমিক, কোন যাজক নই।

একটু যেন লজ্জা পেল সার্নের ডিরেক্টর, অবশ্যই, কী বোকা আমি! ক্যান্সারের লক্ষণ বিচারের জন্য ডাক্তারের ক্যান্সার রোগি হতে হবে এমন কোন কথা নেই।

এত স্পষ্টভাবে আগে ভাবেনি ল্যাঙডন ব্যাপারটা নিয়ে।

এগিয়ে যেতে যেতে একটা হলওয়ে ধরে কোহলার বলল, আশা করি আমি আর আপনি পরস্পরকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারব।

কেন যেন কথাটা সত্যি বলে মনে হল না ল্যাঙডনের।

 

এগিয়ে যেতে যেতে সে টের পেল, সামনে থেকে তাদের পায়ের প্রতিধ্বনি উঠছে। বুঝতে পারল, টানেলের শেষ মাতা চলে এল। তারপর এমন কিছু দেখল যেটার সাথে। অভিজ্ঞতা খাপ খায় না।

এটা আবার কী?

ফ্রি ফল টিউব। মুক্ত পতন টিউব। এটুকুই বলল কোহলার। যেন আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

আর কোন আগ্রহ দেখাল না ল্যাঙডন। কিন্তু মনে মনে একটু তেতে উঠল। কোহলার লোকটা আর যে পুরষ্কারই পাক না কেন, আতিথেয়তার জন্য কোন উপহার সে পাবে না।

আমার কী! ভাবে সে। আমি এখানে এসেছি অন্য কোন কারণে। ইলুমিনেটি।

এখানেই কোথাও একটা খুন হয়ে যাওয়া দেহ পড়ে আছে। এটা চোখের নজরে দেখার জন্য সে পেরিয়ে এসেছে তিন হাজার মাইল।

প্রফেসর রবার্ট ল্যাঙডন এক জীবনে কম বস্তু দেখেনি। কম বিস্মিত হয়নি। কিন্তু এখন যা দেখতে পেল তার কোন ব্যাখ্যা আপাতত নেই। একটা কাচের ঘরের চারধারে দর্শকদের সারি। ভিতরে কয়েকজন লোক ওজনশূণ্যভাবে ভেসে আছে। তিনজন। একজন হাত নাড়ল ভিতর থেকে।

মাই গড! ভাবে সে, আমি রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছি।

রুমের ফ্লোরটা একেবারে নিখুঁত। সেখানে পাতলা একটা আবরণ আছে যেন পড়লেও খুব বেশি আঘাত না পায় লোকে। তার নিচে আছে একটা দানবীয় প্রোপেলার।

ফ্রি ফল টিউব, বলল কোহলার আবার। ইনডোর স্কাই ডাইভিং। ক্লান্তির হাত থেকে বেঁচে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য ব্যবস্থাটা করা হয়েছে। নিচে আছে কৃত্রিম উইন্ড টানেল।

একজন মহিলা ভিতর থেকে হাসি দিল। এগিয়ে আনল তার বুড়ো আঙুল। দেখাল। সেটা। ভেবে পায় না ল্যাঙডন, এই মহিলা কি জানে এ এ প্রতীক ছিল আসলে প্রাচীণ ফ্যালিক ঐতিহ্যে এবং এ দিয়ে পুরুষের কদর্যতা প্রকাশ করা হয়।

মহিলাটা একটু মোটাসোটা। তাই ঘরের আর সবাই প্যারাস্যুট ছাড়াই ভাসলেও সে একটা পিচ্চি স্যুট পরে আছে। মোটা মানুষের জন্য এগুলো দরকার ফ্রি ফল ডাইভে। বোঝাই যায়।

ব্যাপারটা যে এই রাতেই, শত শত কিলোমিটার দূরের কোন এক দেশে তার জীবন রক্ষা করবে তা সে এখন বুঝতেও পারছে না।

 

০৮.

যখন কোহলার সার্নের মূল কমপ্লেক্সের পিছন দিয়ে বেরিয়ে এল, তাদের চোখে আঘাত করল সুইজারল্যান্ডের সূর্যের আলো। চারধারে সবুজ ঘাসের ভিতর দিয়ে পায়চলা পথ। সুন্দর সুন্দর লন। দুজন হিপ্পি ফ্রিসবি ছোড়াছুড়ি করছিল একে অপরের দিকে। শুনছিল মাহলারের ফোর্থ সিম্ফনি।

এখানে চারটা রেসিডেন্সিয়াল ডর্ম আছে, এগিয়ে যেতে যেতে বলল কোহলার, এখানে তিন হাজারেরও বেশি ফিজিসিস্ট আছেন। সার্ন একাই পৃথিবীর বেশিরভাগ পার্টিকেল ফিজিসিস্টকে চাকরি দেয়। পৃথিবীর বুকের সবচে মেধাবী মুখগুলোকে–জার্মান, জাপানি, ইতালিয়, ডাচ, নানা ভাষার, নানা দেশের মানুষ পাঁচশতাধিক ইউনিভার্সিটি আর ষাটটার উপর দেশ থেকে আমাদের পদার্থবিদরা এসেছেন।

আপনারা সবাই যোগাযোগ করেন কী করে?

ইংরেজি, অবশ্যই, বিজ্ঞানের সর্বগামি ভাষা।

ল্যাঙডন জানত গণিত হল বিজ্ঞানের সর্বগামি ভাষা। কিন্তু যুক্তি দেখানোর মত এনার্জি নেই তার। এগিয়ে গেল সে ডিরেক্টরের পিছন পিছন।

নিচে এক লোক জগিং করছিল। তার গেঞ্জিতে লেখা, নো গাট, নো গ্লোরি।

গাট?

জি ইউ টি। জেনারেল ইউনিফাইড থিওরি। জাগতিক, এবং অজাগতিক সব ব্যাপারকে এক সূত্রে গাঁথার তত্ত্ব।

আই সি সবজান্তার ভাব নিল ল্যাঙডন, বুঝল না কিছুই।

আপনি কি পার্টিকেল ফিজিক্স সম্পর্কে জানেন, মিস্টার ল্যাঙডন?

আমি জেনারেল ফিজিক্স সম্পর্কে একটু একটু জানি। পড়ন্ত বস্তু আরও কী সব যেন… সে সব সময় পানিতে হাই জাম্প করে। গতি বাড়ার হার বা তৃরণ দেখে দেখে। সে পদার্থবিদ্যাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। কণা-পদার্থবিদ্যা হল আণবিক বিদ্যা, তাই নয় কি?

মাথা নাড়াল কোহলার, আমরা যা নিয়ে কায় কারবার করি তার কাছে একটা পরমাণু হল একেবারে গ্রহের সমান। আমাদের আগ্রহ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাপারে। কেন্দ্রবিন্দু। পুরো পরমাণুর দশ হাজার ভাগের একভাগ এলাকা। সার্নের হাজার হাজার মেধাবী মুখ এখানে একত্র হয়েছে সেই প্রশ্নের জবাব পাবার জন্য যেটার, পিছনে ছুটছে তারা অনন্তকাল ধরে। যে রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে মানুষ নিয়েছে নানা সংস্কার আর ধর্মের আশ্রয়। আমরা কী দিয়ে গড়া?

এই সব প্রশ্নের উত্তর একটা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে পাওয়া যাবে?

মনে হয় অবাক হলেন?

আমি তাই হয়েছি। উত্তরটা আত্মিক নয় কি?

মিস্টার ল্যাঙডন, এককালে সব প্রশ্নের উত্তরই ছিল আধ্যাত্মিক। বিজ্ঞান যেটাকে বুঝতে পারেনি,সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে ধর্ম আদ্যিকাল থেকে। সূর্য আর চন্দ্রের ওঠানামা এককালে দেবতা হেলিওসের অগ্নিরথের সাথে যুক্ত ছিল। পোসাইডনের জন্যই হত ভূমিকম্প আর জলোচ্ছ্বাস। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সেসব ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। আস্তে আস্তে প্রমাণিত হবে কোন ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব কোনকালে ছিল না। বিজ্ঞান এর মধ্যে মানুষের করার মত প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বসেছে। আর মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন বাকি। এবং এগুলোই সবচে বেশি অবাক করা। কোত্থেকে এলাম আমরা? কী করছি এখানে? জীবন আর এ সৃষ্টিজগতের মানে কী?

বিস্ময় লুকানোর চেষ্টা করল না ল্যাঙন, আর এসব প্রশ্নের জবাবই দেয়ার চেষ্টা করছে সান?

ঠিক করে নিতে হবে কথাটা। চেষ্টা করছি না শুধু, জবাব দিচ্ছিও।

এগিয়ে যেতে যেতে দুজন লোককে ফ্রিসবি খেলতে দেখল তারা। তাদের একজন ফ্রিসবি ছুড়ে মারলে সেটা সোজা এসে পড়ে তাদের সামনে। কোহলার না দেখার ভাণ করল।

আওয়াজ উঠল সেদিক থেকে, সিল ভৌস প্লেট! এস

তাকাল ল্যাঙডন সেদিকে। একজন শুভ্র কেশের বুড়ো লোক পরে আছে সোয়েট শার্ট, হাত নাড়ছে তার দিকে। ছুড়ে মারল সে ফ্রিসবিটা। কৃতজ্ঞতায় আঙুল দেখাল লোকটা। চিৎকার করে বলল, মার্সি! এই

অভিনন্দন! বলল কোহলার, আপনি এইমাত্র একজন নোবেল বিজয়ীর দেখা পেলেন। জর্জ চারপ্যাক। তিনি মাল্টিওয়্যার প্রোপোর্সনাল চেম্বারের আবিষ্কারক।

নড করল ল্যাঙডন। আজ দিনটাই আমার জন্য শুভ।

 

জায়গামত পৌঁছতে আরো তিন মিনিট লেগে গেল। সেখানে একটা বিলাসবহুল ডর্মিটরি দেখা যাচ্ছে। আর বাকিগুলোর তুলনায় সুন্দর। লেখা, বিল্ডিং সি।

এর স্থাপত্য রক্ষণশীল এবং কঠিন।

একজোড়া মার্বেলের কলামের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা দেখতে পায় কেউ একজন লিখেছে কী যেন।

এই কলামগুলো আয়নিক

আমি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত যে বড় বড় মেধাবী ফিজিসিস্টরাও ভুল করে।

কী বলতে চান আপনি?

এই নোটটা যেই লিখে থাক না কেন, একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। এ কলামটা আয়নিক নয়। আয়নিক কলামগুলোর আকৃতি একেবারে এক রকম। এটা ডোরিক–গ্লিক ঐতিহ্য। এ ভুলটা অনেকেই করে।

হাসল না কোহলার, কথাটা ঠাট্টা করে লিখেছে যেই লিখে থাকুক। আয়নিক মানে আয়ন সম্পন্ন। বেশিরভাগ পদার্থেই আয়ন থাকে। ধনাত্বক বা ঋণাত্বক আয়ন থাকতেই পারে।

সাথে সাথে পিছনের কলামটার দিকে চোখ তুলে আরেকবার তাকাশ ল্যাঙডন।

***

একটা লিফট বেয়ে উঠে এসে পায়চলা পথে এসেও সে মনে মনে নিজেকে বেকুব ঠাউরে রেখেছে। সামনের সাজসজ্জা চমকে দিল তাকে। ফ্রান্সের কলোনিয়াল যুগের আদল। একটা ফ্লাওয়ার ভাস আছে, আছে চেরি ডিভান।

আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের একটু আরামে রাখতে ভালবাসি। ব্যাখ্যা করল কোহলার।

তার মানে ছবির লোকটা এখানেই থাকে? আপনার আপার লেভেল এমপ্লয়ি?

অনেকটাই। আজ সকালে আমার সাথে একটা মিটিং ছিল, সেটাকে মিস করে সে। তারপর আমার পেজেরও কোন জবাব দেয় না। আমি নিজে উঠে আসি এখানে, তারপর তার লিভিঙরুমে মরদেহ দেখতে পাই।

একটা লাশ দেখবে ভেবেই ভিতরে পাক দিয়ে উঠল ল্যাঙডনের কী করে যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি লাশ কাটাছেঁড়া করে তারপর মানুষের দেহ আকত আল্লা মালুম।

এগিয়ে গেল তারা তারপর দেখতে পেল একটা লেখা!

লিওনার্দো ভেট্রা

লিওনার্দো ভেট্রা! বলল কোহলার, আগামি সপ্তাহে তার আটান্ন হবার কথা ছিল। আমাদের কালের সবচে মেধাবী বিজ্ঞানীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তার মৃত্যু বিজ্ঞানের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হল কোহলারের মুখাবয়বে ব্যাথার একটা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে যত দ্রুত ব্যাপারটা এসেছিল তত দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পকেটে হাত ডুবিয়ে একটা বড় চাবির রিঙ বের করল লোকটা।

একটা চিন্তা হঠাৎ পাক খেয়ে উঠল ল্যাঙডনের মনে। এ বিল্ডিংটায় আর কেউ নেই। কোথায় গেল সবাই?

ল্যাবে।

আমি বলছি, পুলিশ… তারা কি এরমধ্যেই চলে গেছে?

পুলিশ?।

অবশ্যই। পুলিশ। আপনি আমাকে একটা হত্যাকান্ডের ছবি পাঠিয়েছেন। অবশ্যই পুলিশকে ডাকার কথা।

আমি অবশ্যই তেমন কিছু করিনি।

কী?

কোহলারের ধূসর চোখ একটু সূক্ষ্ম হয়ে উঠল, পরিস্থিতি অনেক জটিল, মিস্টার ল্যাঙডন।

কিন্তু অবশ্যই কেউ না কেউ এ ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে…

জানে। লিওনার্দোর পালক কন্যা। সেও সার্নের একজন পদার্থবিজ্ঞানী। সে আর তার বাবা একটা ল্যাব শেয়ার করে। তারা পার্টনার। ফিল্ড রিসার্চের জন্য মিস ট্রো এ সপ্তাহে বাইরে আছে। আমি তার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়েছি। আসছে সে যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি। কথা বলতে বলতেই এসে হাজির হবে।

কিন্তু একজন মানুষ খুন হয়ে–

একটা ফরমাল ইনভেস্টিগেশন ঠিকই নেয়া হবে। আর একই আঁথে লিওনার্দো আর তার মেয়ের ল্যাবে যাব আমরা। এই একটা ব্যাপারকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে তারা। এজন্যই মিস ভেট্রা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি।

কোহলার চাবি ঘোরাল।

ল্যাঙডনের মুখে সাথে সাথে একটা বরফ শিতল বাতাস লাগল।সে যেন ফিরে গেছে। সারা ঘর ছেয়ে আছে থিকথিকে কুয়াশায়। আর কী ঠান্ডা!

কী ব্যাপার… বলতে পারল না বাকি কথাটা ল্যাঙডন।

ফ্রিয়ন কুলিং সিস্টেম। জবাব দিল কোহলার, মৃতদেহটা রক্ষা করার জন্য পুরো ঘরকে শিতল করতে হয়েছে।

কী ধাঁধায় পড়লাম আমি! ভেবে পায় না ল্যাঙডন।

 

০৯.

নীলচে কালো হয়ে আছে লিওনার্দো স্ট্রোর মরদেহ। সারা গায়ে কোন আবরণ নেই। মাথাটা একেবারে পিছনদিকে ফিরানো। নিজের জমে যাওয়া প্রস্রাবের মধ্যে পড়ে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক বিজ্ঞানী। তার যৌনাঙ্গের রোমগুলো পর্যন্ত শক্ত হয়ে আছে।

বিভ্রান্ত হয়ে ল্যাঙডন দৃষ্টি দেয় লোকটার বুকের দিকে। যদিও কয়েক ডজন বার সে ছবিটা দেখেছে, তবু কেমন যেন করে উঠল বুকের পোড় চিস্টা দেখে ল্যাঙডনের নি। একটা নিখুন সিল জুড়ে আছে তার বুক।

চারপাশে একবার ঘুরে এল ল্যাঙডন। না, অন্যদিক থেকেও লেখাটা একই রকম।

মিস্টার ল্যাঙডন?

শুনতে পায়নি ল্যাঙড। অন্য কোন এক জগতে চলে গেছে সে… তার জগৎ তার কন, যেখানে ইতিহাস, মিথ, পুরাণ, আর সত্যি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

মিস্টার ল্যাঙডন?

চোখ তুলে এবারও তাকাল না সে। আপনারা কতটুকু জানতে পারলেন এ পর্যন্ত।

আমি আপনার ওয়েবসাইট পড়ে যেটুকু জানতে পারলাম, ব্যস, এটুকুই। এমিনেটি শব্দের মানে আলোকিত ব্যাক্তি। এটা কোন এক প্রাচীণ ব্রাদারহুডের নাম।

আপনি কি আগে নামটা শুনেছেন?

মিস্টার ভেট্রার বুকে দেখার আগে নয়।

তার মানে আপনি এর উপর একটা ওয়েব সার্চ চালালেন?

হ্যাঁ।

সাথে সাথে শব্দটার শত শত রেফারেন্স চলে এল, তাই না?

হাজার হাজার।বলল কোহলার, আপনারটায় হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড আর পরিচিত টারের নাম ছিল। আপনারটাই সবচে বেশি তথ্যবহুল বলে মনে হল।

এখনো ল্যাঙডন চোখ ফিরাতে পারছে না মৃতদেহটা থেকে।

এরচে বেশি কিছুই বলল না কোহলার। যেন অপেক্ষা করছে ল্যাংডন আরো কিছু কবে এর উপর। একটা সুরাহা হবে রহস্যের।

কোন উষ্ণতর জায়গায় বসে এ নিয়ে কথা বললে কেমন হয়? জিজ্ঞাসা করল নন।

এ ঘরটা মন্দ নয়। এখানেই কথা বলছি আমরা।

ভেবে পায় না সে, কোথা থেকে শুরু করে। ইলুমিনেটির কাহিনী সরল নয়। এতে যজারটা বাঁক আছে, আছে অনেক মোড়। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি ঘেমে নেয়ে উঠব।

ইলুমিনেটির সেই বিখ্যাত সিম্বলের কথা সব সিম্বলজিস্ট জানলেও কেউ আসলে স্বচক্ষে দেখেনি এটাকে। আদ্যিকালের বইগুলোয় এটাকে এ্যাম্বিগ্রাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এ্যাম্বি মানে উভয়, বোঝা যায়, এটাকে উপর নিচ দু দিক দিয়ে একই ভাবে পড়া যাবে।

স্বস্তিকা, যিন ইয়াঙ, ইহুদিদের তারকা, সরল ক্রস–সবই এক একটা এ্যাগ্রিাম। আধুনিক কালের সিম্বলজিস্টর এই ইলুমিনেটি শব্দটাকে এ্যাম্বিগ্রামে বসাতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছে। কেউ পারেনি। ফলে আধুনিক সিম্বলজিস্টরা মনে করে এটা আসলে একটা মিথ।

তাহলে? ইলুমিনেটি কারা?
তাইতো! কারা?
শুরু করল ল্যাঙডন তার গল্প।

ইতিহাসের শুরু থেকে, ব্যাখ্যা করছে ল্যাঙডন, বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে একটা গভীর রেষারেষি ছিল। কোপার্নিকাসের মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা

খুন হয়ে গিয়েছিলেন। নাক গলাল কোহলার, সায়েন্টিফিক টুথ উদ্ধারের দায়ে চার্চের কোপানলে পড়েছিলেন। ধর্ম সব সময় বিজ্ঞানের পিছু ধাওয়া করে চলে।

ঠিক তাই। কিন্তু যোড়শ শতকে একদল লোক গির্জার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। ইতালির সবচে আলোকিত লোকগুলো–পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, এ্যাস্ট্রোনোমার সবাই একত্রে গোপনে দেখা করতে শুরু করেন। চার্চের একমাত্র সত্যি সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানকে অবলীলায় পদদলিত করছে। বিজ্ঞান সত্যিকার সত্যিকে তুলে আনতে পারছিল না। তারা পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাক্তি, যা একত্র হয়, নাম নেয় আলোকিত।

দ্য ইলুমিনেটি।

তাই। ইউরোপের সবচে জ্ঞানী গুণী লোকগুলো… একত্র হয় বৈজ্ঞানিক সূত্র রক্ষার কাজে, বিজ্ঞানকে ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে।

একেবারে চুপ মেরে গেল কোহলার।

অবশ্যই, হন্যে হয়ে তাদের খুঁজে বেড়ায় চার্চ। যেখানে যেভাবে পায়, হত্যা করে। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিজেদের রক্ষা করে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ইলুমিনেটি। ইউরোপ তার সূতিকাগার। সেখানকার সবচে ডাকসাইটে জ্ঞানী লোকগুলো একত্র হয়। এক অতি গোপনীয় এলাকায় তারা একত্র হয়। রোমের কোথাও। নাম তার চার্চ অব ইলুমিনেশন।

এখনো চুপ করে আছে ডিরেক্টর।

ইলুমিনেটির বেশিরভাগ চায় গির্জার বিরুদ্ধে লড়তে। কিন্তু তারা ছিল মধ্যমপন্থী। আর তাদের বাধা দেয় একজন। বিশ্বের সবচে দামি মানুষগুলোর একজন।

ল্যাঙডন আশা করে এবার নামটা না বলতেই বুঝে ফেলবে কোহলার। এ এমন এক মানুষ, যাকে নিয়ে মিথের অন্ত নেই, যার আবিষ্কারের কোন তুলনা নেই। যিনি বড়াই করে ভোলা মনে প্রথমবার বলতে পেরেছিলেন, পৃথিবী নয়, আমাদের চেনা সৃষ্টি জগতের কেন্দ্র সূর্য। যদিও তিনি সোজা বলে দিতে পারতেন, তবু একটু ঘুরিয়ে বলেন। বলেন, ঈশ্বর তার সৃষ্টি জগতের কেন্দ্রে না রেখে মানুষকে একটু দূরে স্থাপন করেছেন।

নাম তার গ্যালিলিও গ্যালিলি। বলল ল্যাঙডন অবশেষে। চোখ তুলে তাকাল কোহলার, গ্যালিলিও?

হু। গ্যালিলিও ছিলেন একজন ইলুমিনেটাস। বলা ভাল ইলুমিনেটির জ্ঞানগুরু। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্যাথলিক। তিনি বিজ্ঞানের উপর থেকে ধর্মের, বিশেষ করে খ্রিস্টবাদের রোষ কষায়িত দৃষ্টি সরানোর জন্য বললেন, বিজ্ঞান ঈশ্বরের উপস্থিতি অস্বীকার করে না।

এমনকি সবার মনকে বুঝ দেয়ার জন্য বলেছেন, টেলিস্কোপে করে বিভিন্ন গ্রহ দেখার সময় শুনতে পেয়েছেন ঈশ্বরের জয়গান। বলতেন, বিজ্ঞান আর ধর্ম শত্রু নয়, বরং পরস্পরের বন্ধু। বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথা দু পথে বলে। সমতার গল্প…

স্বর্গ আর নরক, রাত আর দিন, উষ্ণতা আর শিতলতা, ঈশ্বর আর শয়তান। বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথার জয়জয়কার করে যায়, ঈশ্বর আর খারাপের পার্থক্য, আলো আর আঁধারের পার্থক্য…

হুইল চেয়ারে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কোহলার।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, চার্চ কখনো চায়নি ধর্মের সাথে বিজ্ঞান মিশে যাক।

অবশ্যই নয়, এবার বলে উঠল কোহলার, তা হয়নি বলে কল্যাণ হয়েছে। বিজ্ঞান ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এর সাথে খ্রিস্টবাদ মিলে যেতে পারেনি। কিন্তু তেতে উঠল চার্চ। গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন করল, সাব্যস্ত করল দোষী, বন্দি করে রাখল বাসায়। সায়েন্টিফিক হিস্টোরি সম্পর্কে ভালই জানি, মিস্টার ল্যাঙডন। কিন্তু এ সবই মধ্যযুগের কথা। কয়েক শতাব্দি আগের কথা। এর সাথে লিওনার্দো ট্রোর কী সম্বন্ধ?

মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

গ্যালিলিওর আটকে থাকাতে তেতে উঠল ইলুমিনেটি। ছোট কোন ভুল হয়ে গেল। চার্চ পেয়ে গেল চার ইলুমিনেটি বিজ্ঞানীকে। ধরে আনল তাদের, করল জিজ্ঞাসাবাদ। এমনকি সেই চারজন কোন কথাই বলল না–সয়ে গেল নরক যন্ত্রণা।

নরক যন্ত্রণা?

নড করল ল্যাঙডন, জীবিত অবস্থায় তাদের বুকে ছাপ মেরে দেয়া হয়। একটা ক্রসের সিম্বল।

বড় বড় হয়ে গেল কোহলারের চোখ।

তারপর সে বিজ্ঞানীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাদের মৃতদেহ ফেলে রাখা হয় রোমের পথে পথে। যারা ইলুমিনেটিতে যোগ দিতে চায় তাদের সামনে পরিবেশন করা হয় হুমকি। চার্চের অব্যাহত চাপের মুখে ইতালি থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে যায় ইলুমিনেটি।

ইলুমিনেটি চলে যায় একেবারে আন্ডারগ্রাউন্ডে। ক্যাথলিকদের হাতে হেনস্থা হওয়া অন্য গ্রুপগুলোর সাথে তাদের মিশে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই। মিস্টিক, এ্যালকেমিস্ট, অকাল্টিস্ট, মুসলিম, ইহুদি। বছরের পর বছর ধরে ইলুমিনেটি দল ভারি হতে থাকে।

এক নূতন ইলুমিনেটির উদয় হয়। অ ইলুমিনেটি। এক গতী, হিস্ত্র ইলুমিনেটি, খ্রিস্টবাদ বিরোধী ইলুমিনেটি। তারা অপেক্ষা করতে থাকে, শক্তি জড়ো করতে থাকে, এগিয়ে যাবার প্রেরণী একত্র করতে থাকে, ক্যাথলিক চার্চের উপর প্রতিশোধ নেয়ার বাসনা তাদের অন্তরে। একদিন উঠে আসবে তারা। তাদের শক্তি এত বেড়ে যায় যে গির্জা তাদেরকে পৃথিবীর একক, সর্ববৃহৎ এন্টি-ক্রিশ্চিয়ান দল হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে। ভ্যাটিকান এবার ঘোষণা করে ইলুমিনেটিতে একটা শাইতোয়ান হিসাবে।

শাইতোয়ান?

শব্দটা ইসলামি। এর মানে শত্রু। ঈশ্বরের শত্রু। অমান্যকারী চার্চ ইসলামকেই বেছে নিল কারণ এ ধর্মের ভাষা আর সব ব্যাপারকেই তারা চরম নোংরা বলে মনে করত। শাইতোয়ান হল ইংরেজি শব্দ স্যাটানের মূল।

কোহলারের চেহারায় ফুটে উঠল অস্বস্তি।

আরো বেড়ে যাচ্ছে ল্যাঙনের কণ্ঠের তেজ, মিস্টার কোহলার, আমি জানি না কী করে এই চিহ্ন এ লোকে বুকে এল। কিমা কেন এল। কিন্তু আপনি তাকিয়ে আছেন পৃথিবীর সবচে বড় আর ক্ষমতাবান আন্ডারগ্রাউন্ড শয়তানি সংঘের প্রতীকের দিকে।

 

১০.

গলিটা একেবারে চিকন। জনশূণ্য। দাঁড়িয়ে আছে হ্যাসাসিন। তার কালো চোখ চকচক করছে কী এক অজানা লালসায়। সে জায়গা মত এগুনোর সাথে সাথে জ্যানাসের শেষ কথাগুলো কানে বেজে ওঠে। পরের ধাপ শুরু হতে যাচ্ছে। একটু আয়েশ করে নাও।

ঘুমের অভাব আছে হ্যাসাসিনের চোখে। কিন্তু তার পূর্বপুরুষরা একবার কোন যুদ্ধে নেমে পড়লে ঘুম কাকে বলে বুঝত না। এ যুদ্ধ ঠিক ঠিক শুরু হয়ে গেছে। আর সে প্রথম রক্তপাতের কাজটা করতে পারছে। এখন কাজে ফিরে যাবার আগে হাতে মৌজ করার মত দুটা ঘণ্টা সময় থাকছে।

ঘুম? রিল্যাক্স করার মত আরো ভাল কত পথ আছে…

হাসিস? না। পূর্বপুরুষের মত কোন ড্রাগ নিবে না সে। তারচে অনেক আনন্দদায়ক উৎস আছে আশপাশে। নিজের শরীর নিয়ে গর্বিত সে। গর্বিত খুন করার ক্ষমতা নিয়ে।

গলির পথ ধরে একটা দরজায় হাজির হয় সে। সেখানে ডোরবেল বাজিয়ে ভিতরে ঢোকে।

স্বাগতম! সুন্দর পোশাক পরা রমণী তাকে অভ্যর্থনা জানায়।

একটা ছবির এ্যালবাম তুলে দেয় আধো আলো ছায়াতে মহিলা বলে, মন স্থির হলে আমাকে রিঙ কবুলেই চলবে।

হাসল হ্যাসাসিন।

যদিও তাদের জানি ক্রিসমাস উপভোগ করে না, কিন্তু সে আশা করে এখানে কোন এক খ্রিস্টান বালিকা অপেক্ষা করবে তার জন্য। ভিতরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে তার শরীর জেগে ওঠে। এক জীবনে উপভোগ করার মত ছবি ভেসে ওঠে সামনে।

মারিসা, ইতালিয় দেবী।

ফিয়েরি, তরুণী সোফিয়া লরেন।

সাকহিকো, জাপানি পুতুল।

লিথ, কোন সন্দেহ নেই, পাকা।

কানারা, সুন্দর, পেশীবহুল, আদিরসাত্বক।

দুবার পুরো এ্যালবাম চষে দেখল সে। তারপর টেবিলের পাশের বোতামে চাপ দিল। এগিয়ে এল সেই মহিলা, বলল, ফলো মি।

এগিয়ে গেল সে। চাহিদা মত সব ব্যাপার ঠিকঠাক করতে করতে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হল তাকে। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। একটা সুন্দর হলওয়ে। শেষের সোনালি দরজা। তোমার স্বাদ দামি।

উচিৎ।

একটা চিতা যেভাবে বুভুক্ষু থেকে থেকে অবশেষে শিকারের সন্ধান পায়, যেভাবে এগিয়ে যায়, সেভাবে এগোয় সে।

দরজায় ধাক্কা দেয়। খুলে যায় সেটা।

যখন সে তার সিলেকশন দেখতে পায়, চোখের সামনে খুলে যায় চিন্তার ভাঁজ।, ভুল হয়নি। তার অনুরোধ মত সাজানো আছে মেয়েটা… নগ্ন, উপুর হয়ে শুয়ে আছে, পুরু ভেলভেটের কর্ড দিয়ে স্ট্যান্ডের সাথে বাঁধা দু হাত।

ঘরটা কোনক্রমে পেরিয়ে যায় সে। তারপর হাত রাখে নগ্ন, উত্তেজক নিম্নাঙ্গে, পিছন থেকে। আমি কাল রাতে খুন করেছি একটা। আর তুমি আমার পুরস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *