১৭. রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর

রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর তিনজনে গাছতলায় শুয়ে ঘুম দিলেন। তার আগে অবশ্য ভালো করে চারদিক দেখে নেয়া হলো ধারে-কাছে অন্য-কোনো জীবজন্তু আছে কি না। যখন আর-কোনো জন্তু-জানোয়ার দেখা গেলো না, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সবাই ভীষণ অবসাদের পর গভীর সুপ্তির হাতে নিজেদের সমর্পণ করে দিলেন। ঘুম খুব ভালো হয়েছিলো, কেননা সকালে বেশ ঝরঝরে লাগলো শরীর, বেশ চাঙা লাগলো।

বিশ্রামেই কাটিয়ে দেয়া হলো সারা দিন। ফার্গুসন স্থির করেছিলেন, অনুকূল বাতাস না-পাওয়া পর্যন্ত এখানেই বিশ্রাম করবেন। কিন্তু তাতেও আবার ভয় আছে। যদি এভাবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে তো সব খাবার ফুরিয়ে যাবে, এবং অনাহারে মৃত্যু বরণ করতে হবে। এক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে কিনা আরেক মৃত্যুর হাতে গিয়ে পড়তে হবে!

পিপেভর্তি জল নেয়া হলো। এখন মোটেই বাতাস নেই বটে, কিন্তু যখনই বাতাস আসে তখনই যাতে রওনা হওয়া যায় তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকা ভালো।

ক্রমে সন্ধে হলো, তারপরে ধীরে-ধীরে রাত। জো পাহারা দিচ্ছিলো, হঠাৎ সে দেখলো অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে আসছে। তৎক্ষণাৎ সে চীৎকার করে উঠলো,শিগগির উঠুন শিগগির! বাতাস আসছে-ঐ দেখুন, বাতাস!

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন ফার্গুসন আর কেনেডি। মিথ্যে বলেনি জো, সত্যিই ভীষণ ঝড় আসছে। চটপট তিনজনে বেলুনে উঠে বসলেন। একটুও অপেক্ষা করতে হলো না, উঠতে-না-উঠতেই কে যেন বেলুনের ঝুঁটি ধরে ওপরে টেনে নিলে, তারপর—দু-শো ফিট ওপর দিয়ে-ঝড়ের তোড়ে উল্কার মতো ছুটে চললো ভিক্টরিয়া! হাওয়ার গতি এত ভীষণ যে, তিনজনে দোলনার রেলিঙ সজোরে আঁকড়ে ধরে রইলেন, নাহলে এই পুবমুখো ঝড় হয়তো উলটে ফেলে দেবে। জ্যা-মুক্ত ধনুঃশরের মতো ছুটে যাচ্ছে বেলুন, মনে হচ্ছে সে যেন যত তাড়াতাড়ি পারে এই মরুভূমি থেকে পালাতে চাচ্ছে।

সকালবেলার দিকে সামান্য ঘাস দেখা গেলো নিচে, নানারকম গুল্ম, লতা-পাতা, তার পরে আরো-কিছু উদ্ভিদ। ধীরে-ধীরে মরুভূমির একঘেয়ে বালুকাময় বিস্তার অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো, খানিক বাদেই দেখা গেলো কিছু ছোটোখাটো গাছপালা।

কেনেডি বলে উঠলেন, যাক, শেষটায় প্রাণের রাজ্যে এসে পৌঁছুনো গেলো তাহলে?

কই, এখানে তো কোনো জনমানব দেখতে পাচ্ছি না! জো বললে।

ফার্গুসন বললেন, শিগগিরই দেখতে পাবে, কেননা আমরা খুব দ্রুতগতিতে এগুচ্ছি। এখন। মাঝখানে যে-কদিন অনড় গেছে, হাওয়ারা এখন তা সুদে-আসলে পুষিয়ে দিতে চাচ্ছে যেন।

হ্যাঁ। তবে শিগগিরই আমরা আরব-বেদুইনদের দেশে প্রবেশ করবো।

বাতাস অনুকূল ছিলো বলে বেশ ভালো ভাবেই ভেসে যাচ্ছিলো ভিক্টরিয়া। কম্পাস অনুযায়ী বোঝা গেলো বরাবর উত্তর-মুখো যাচ্ছে বেলুন।

অদৃষ্ট তো এখন সুপ্রসন্ন দেখছি, ফার্গুসন বললেন, এভাবে চললে আজকেই আমরা চাড় হ্রদের কাছে পৌঁছুতে পারবো।

চাড হ্রদ হলো মস্ত এক জলাশয়। বর্ষার সময় এর দৈর্ঘ্য হয় একশো কুড়ি মাইল; তবে গ্রীষ্মের খর তাপে কোনো-কোনো জায়গা শুকিয়ে গিয়ে আয়তনে যৎকিঞ্চিৎ ছোটো হয়ে যায়।

শা-কুরু নদীর গতিপথ ধরে চলতে লাগলো বেলুন। কালো বনে ঢাকা দুই তীর, মাঝে-মাঝে দেখা যায় অসংখ্য কুমির নদীর চড়ায় গা এলিয়ে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে, কোথাও-বা আবার নদীর জলে পিঠ ভাসিয়ে দিয়ে ভেসে চলেছে।

অবশেষে চাড় হ্রদের দক্ষিণ প্রান্তে এসে পৌঁছুলো বেলুন। ইয়োরোপে যেমন কাস্পিয়ান সাগর, আফ্রিকায় তেমনি চাড় হ্রদ। এতকাল ধরে লোকে তাকে ভাবতে কোনো অলীক কল্পনা বলে, কেননা অতি দুর্গম এলাকায় তার অবস্থান-জনবসতির বাইরে। প্রতিদিনই এর তীরভূমির পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, কখনও বাড়ছে কখনও কমছে, আর এর তীরভূমি এমন দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও জলাভূমির দ্বারা আবৃত যে এর মানচিত্র নিখুঁত করে আকা প্রায় অসম্ভব ছিলো।

হ্রদের ভিতর ছোটা-বড়ো দ্বীপ অনেক আছে। এইসব দ্বীপে দুর্ধর্ষ হিংস্র বোম্বেটেরা বাস করে। তারা যখন ভিক্টরিয়াকে দেখলো, তখন ক্রোধে ও কৌতূহলে ফেটে পড়ে ওপর দিকে বিষের তীর ছুঁড়তে শুরু করে দিলে। বেলুন অবশ্য তাদের তীরের অনে ওপর দিয়েই নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে উড়ে চলে গেলো।

হঠাৎ জো চেঁচিয়ে বললে, ঐ দেখুন, মস্ত সব পাখিরা উড়ে আসছে এদিকে–সংখ্যায়ও নেহাৎ কম নয় তারা, দল বেঁধে আসছে সবাই।

পাখি? কোথায়? ফার্গুসন চোখ ফিরিয়ে দেখলেন কী সর্বনাশ! এই সেরেছে।

কেন? পাখিদের কাছে আবার কোনো ভয়ের কারণ আছে নাকি?

নিশ্চয়ই! ওগুলো ঈগল-কী মস্ত একেকটা, দেখছো! ওরা যদি বেলুন আক্রমণ করে, তাহলে আর রক্ষে নেই আমাদের!

তাতে আর ভয়ের কী! আমাদেরও হাতে বন্দুক রয়েছে।

মিনিট-কয়েকের মধ্যেই ঈগলগুলি বেলুনের কাছে এসে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগলো। অতিকায় সব ঈগল, বোদ পড়ে সোনার মতো ঝকঝক করছে তাদের গা, বাঁকা চোখা নিষ্ঠুর চঞ্চু তার তীক্ষ্ণ্ণ ঠোকরে যে-কোনো পোক্ত জিনিশকেও ফুটো করে দিতে পারে। ভয় বলে কিছুই যেন তারা জানে না-রকম-শকম দেখে মনে হলো তারা যেন সব ভীষণ রেগে আছে। ভীষণ ডানা মেলে প্রায় ছো মারার ভঙ্গি করে মুখ বেঁকিয়ে বারেবারে ঘুরে-ফিরে বেলুনের আরোহীদের দেখে যাচ্ছে। ভাবখানা, এরা আবার কে এলো আকাশের স্বত্বে ভাগ বসাতে। দু-একটা তত বন্দুকের পাল্লার ভেতরেই এসে গেলো। কেনেডি তো বন্দুক তাগ করে গুলি করবার জন্যে উশখুশ করতে লাগলেন, কিন্তু ফার্গুসন নিষেধ করলেন, খামকা ওদের চটিয়ো না, বরং তৈরি হয়ে থাকো। দেখাই যাক না, শেষ অব্দি কী হয়। আমি বললে তবে গুলি ছুঁড়বে। ওরা আহত হলে কিন্ত মারাত্মক হয়ে ওঠে।

কর্কশ কান-ফাটা চীৎকার করে ঈগলগুলি বেলুনকে প্রদক্ষিণ করে চাকার মতো ঘুরতে লাগলো। কয়েকটা পাখি প্রায় তিন ফিট লম্বা। হঠাৎ একটা ঈগল তার বিরাট বাঁকা ঠোঁট আর তীক্ষ্ণ্ণ নখর নিয়ে বেলুনটার দিকে ছোঁ মারার ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। অমনি ফার্গুসনের ইঙ্গিতে কেনেডির বন্দুক অগ্নিবর্ষণ করে গর্জে উঠলো। সৌভাগ্যবশত পাখিটার এমন জায়গায় গুলি লেগেছিলো যে সে প্রাণ হারিয়ে কাটা ঘুড়ির মতো পাক খেতে-খেতে মাটির দিকে পড়ে গেলো।

ঈগলেরা একটু ভয় পেয়ে তখনকার মতো দূরে সরে গেলো বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার দ্বিগুণ বিক্রমে বেলুনকে আক্রমণ করলে, অনেকে মিলে একসঙ্গে, এবং জো আর কেনেডির বন্দুক গর্জন করে উঠলো : অব্যর্থ একেকজনের টিপ, দুটো পাখি মরে গেলো, ঘুরতে-ঘুরতে মাটিতে পড়ে গেলো তারা।

এবারে ঈগলেরা আক্রমণের কৌশল পালটে নিলে। সোজা উঠে গেলো তারা বেলুনের ওপর, তারপরে তীক্ষ্ণ্ণ চঞ্চু দিয়ে ভীষণ ছোঁ মারলে বেলুনের গায়ে। প্রক্ষণেই দেখা গেলো বেলুন নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে।

সর্বনাশ! ঈগলগুলো বেলুন ছ্যাঁদা করে ফেলেছে! জো, শিগগির বালির বস্তা কটা ছুঁড়ে ফেলে দাও—ভার না-কমালে বেলুন এক্ষুনি নিচে পড়ে যাবে।

নির্দেশ মতো কাজ করতে একটুও দেরি হলো না। কিন্তু তবুও বেলুন কেবল নেমেই চললো।

তাড়াতাড়ি আরো হালকা করে বেলুন! জলের পিপে ফেলে দাও। কী সর্বনাশ–আমরা যে সোজা হ্রদের দিকে নেমে যাচ্ছি।

জলের পিপে ফেলে দেয়া হলো, কিন্তু বেলুন তবু নামছে। ফার্গুসন সভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ক্রমশ যেন বিশাল জলরাশি বেলুনের দিকে উঠে আসছে। আরো হ্রাস পেলো তার দূরত্ব, আরো, আরো প্রায় দুশো ফিটের মধ্যে নেমে পড়েছে বেলুন। এবারে সব খাবার-দাবার ফেলে দেয়া হলো। বেলুনের নিচের দিকে ধেয়ে আসা খানিকটা কমলো বটে, কিন্তু তবু নিচের দিকেই নেমে চলেছে।আর তবে রক্ষা নেই! শোঁ-শোঁ শব্দ করে সব গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে ছ্যাদা দিয়ে। যখনই তারা পরপর কতগুলি বিপদের হাত থেকে দৈবের অসীম দয়ায় নিষ্কৃতি পেয়ে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন, তখনই কিনা ঈগলগুলি এলো নাছোড় এক অভিসম্পাতের মতো!

আরো-কিছু ফ্যালো! আর কিছু কি নেই ফেলে দেবার মতো? আর তো কিছুই ফেলে দেবার নেই।

কে বলে নেই? এখনও আছে, বলে জো কাউকে কোনো কথা বলার অবসর–দিয়ে চট করে দোলনা থেকে শূন্যে লাফিয়ে পড়লো।

এ কী করলে, জো! এ কী?

কিন্তু জো তখন সেই মস্ত হ্রদের দিকে, কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মতো, প্রচণ্ড বেগে নেমে যাচ্ছে। আর তাকে দেখা গেলো না।

এবারে কিন্তু ভিক্টরিয়া অনেক হালকা হয়ে যাওয়ায় ফের আকাশ উঠতে শুরু করে দিয়েছে। প্রায় হাজার ফিট ওপরে উঠে গেলো বেলুন, আর হাওয়া তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো হ্রদের উত্তর তীরের দিকে।

প্রথমটায় কিছুক্ষণ কোনো কথা জোগালো না দুই বন্ধুর মুখে। দু-জনেরই চোখ জলে ভরে ঝাঁপসা হয়ে গেলো। প্রবল এক খেদের ভাব ছেয়ে রইলো দু-জনকে–শোকে তারা স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তাদেরই বাঁচাবার জন্যে জো কিনা এইভাবে অবধারিত মৃত্যুর দিকে লাফিয়ে পড়লো! ঝাঁপসা চোখে নিচের দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছুই দেখা গেলো না, বেলুন ততক্ষণে অনেক দূরে সরে এসেছে।

শেষে একসময়ে কেনেডি জিগেস করলেন, এখন তাহলে আমরা কী করবো?

যত তাড়াতাড়ি পারি নেমে পড়ে তার জন্যে খোঁজ করবো।

প্রায় ষাট মাইল যাবার পর ভিক্টরিয়া চাড হ্রদের উত্তর তীরে এক জায়গায় এসে মাটি স্পর্শ করলে। নিচু একটি গাছে নোঙার ফেললেন ফার্গুসন।

বেলা গড়িয়ে গেলো—দিগন্তের শেষ রশ্মিটুকু মিলিয়ে যাবার পরে কালো একটি রাত্রি নেমে এলো উষ্ণ জঙ্গলের হ্রদের উপর।

সেই রাতে ফার্গুসন বা ডিক—কেউই একবারও চোখের পাতা এক করতে পারেননি।