২.০৩ তরাইয়ের রানী

২.০৩ তরাইয়ের রানী

পর-পর কয়েকদিন ধরে এমন একটানা বৃষ্টি পড়লো যে শেষটায় আমাদের বিরক্তি বোধ হতে লাগলো। আকাশে সূর্যের দেখা নেই; ছাইরঙা ভারি নিচু মেঘ ঝুলে আছে। সারাদিন, মাঝে-মাঝে বাজ পড়ছে, অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে–হুডের শিকারে যাবার পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেলো বলে তার সে কী বিষম রাগ! শেষটায় জুন মাসের শেষদিনে আকাশ একটু পরিষ্কার হবার লক্ষণ দেখালো। হুড, ফক্স, গৌমি আর আমি ঠিক করলুম বৃষ্টি থামলেই ক্রাল-এ গিয়ে হাজির হবো—সেখান থেকে ফান খোইতের সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে অবশেষে বেরুবো বাঘের খোঁজে।

বৃষ্টি থামতেই সেদিন আমরা তাই বেরিয়ে পড়লাম।

খানিকক্ষণ যাবার পর সেই বাঘ-ধরা-ফঁদটার কাছে এসে দেখি খোদ ফান খোইত। সশরীরে কালোগনি ও আরো পাঁচ-ছজন অনুচরসহ সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। রাত্তিরে ফাদে একটা বাঘ পড়েছিলো, কালোগনিরা সেটাকে মোয-টানা-খাঁচায় তুলতে শশব্যস্ত।

বাঘটা সত্যি রাজার মতো। পেশল বলিষ্ঠ শরীর; দেখেই তো হুডের ঈর্ষা হতে লাগলো। আরো একটা কমলো তরাই থেকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফক্সকে সে জনান্তিকে জানালে।

ফান খোইত কিন্তু কথাটা শুনে ফেলেছিলেন। তিনি বলে বসলেন, আরো-একটা বাড়লো আমার সংগ্রহে। এখনও আরো-দুটো বাঘ, একটা সিংহ, দুটো চিতাবাঘ চাই আমার–না-হলে সব চাহিদার জোগান দেয়া যাবে না। তা, আপনারা কি আমার সঙ্গে ক্রাল-এ যাবেন নাকি?

ধন্যবাদ, হুড বললে, কিন্তু আজকে আমরা নিজেদের হাতের কাজেই ব্যস্ত থাকবো।

তাহলে কালোগনিকে সঙ্গে নিতে পারেন, বললেন ফান খোইত, এখানকার জঙ্গল ওর নখদর্পণে—হয়তো আপনাদের কাজে লাগবে।

পথ দেখাবার জন্যে ওকে আমরা সানন্দেই নেবো।

তাহলে আমি বাঘটাকে নিয়ে এখন চলি। আশা করি আপনাদের নিরাশ হতে হবে না—তবে জঙ্গল থেকে সবগুলো জানোয়ারই সাবাড় করে দেবেন না যেন। এই বলে মাতিয়াস ফান খোইত অনেকটা নিচু হয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাদের অভিবাদন করে খাঁচায় গর্জাতে-থাকা বাঘটাকে নিয়ে সদলবলে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, কেবল কালোগনি রয়ে গেলো আমাদের জঙ্গলের মধ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে।

তাহলে, মোক্লের, চলো এবার আমার বিয়াল্লিশ নম্বরের সন্ধানে।

আপনার বিয়াল্লিশ, আর আমার আটত্রিশ, তক্ষুনি ফক্স পুরো হিশেবটা জানিয়ে দিলে।

শুনে আমিও বললুম, এবং আমার এক নম্বর-কিন্তু আমার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হুড একেবারে হেসে ফেললে; স্পষ্ট বোঝা গেলো, আমার কণ্ঠস্বরে তার মতো দিব্য আগুনের ছোঁয়াচ ছিলো না।

কালোগনির দিকে ফিরে হুড জিগেস করলে, তাহলে এখানকার জঙ্গল তুমি ভালো করে চেনো?

অন্তত কুড়িবার, দিনে-রাতে, এই জঙ্গল দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে, বললে কালোগনি।

সেদিন ফান খোইত বলছিলেন ক্রাল-এর আশপাশে নাকি একটা বাঘকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে। তুমি সেটাকে দেখেছিলে?

দেখেছি, কিন্তু সেটা বাঘ নয়, বাঘিনী। এখান থেকে মাইল দু-এক দূরে তাকে দেখা গিয়েছিলো। কয়েক দিন ধরে সবাই সেটাকে পাকড়াবার চেষ্টা করছে। আপনারা যদি চান তো তার ডেরার–

ঠিক তা-ই আমরা চাই, হুড আর কালোগনিকে তার কথা শেষ করতে দিলে।

কালোগনিকে অনুসরণ করে আমরা গভীরতর জঙ্গলে প্রবেশ করলুম। কারণ সাধারণত ক্ষুধায় কাতর না-হলে বাঘ কখনও সহজে গভীর জঙ্গল ছেড়ে বেরোয় না। সেইজন্যেই অনেকে হয়তো কোনো বাঘের মুখোমুখি না-পড়েও এই অঞ্চলে এসে বেড়িয়ে যেতে পারেন। শিকারের উদ্যোগ করলে সেইজন্যেই প্রথমে খবর নিতে হবে জঙ্গলের কোথায়-কোথায় বাঘের উপদ্রব বেশি। বিশেষ করে খোঁজ নিতে হয় বাঘ কোথায় জল খেতে যায়—সেই ঝরনা বা ছোট্ট জলস্রোতটি বার করতে পারলেই অনেকটা সন্ধান মিলে গেলো—তারপরে কেবল সুযোগের অপেক্ষা। তবে অনেক সময় তা অবিশ্যি আদৌ যথেষ্ট হয় না, টোপ ফেলেই তাকে কজিতে আনতে হয়। অনেক সময় গোরুর মাংস গাছতলায় ফেলে রেখে গাছের উপরে শিকারিরা ওৎ পেতে থাকে। অন্তত ঘন জঙ্গলে সাধারণত এই উপায়ই গ্রহণ করা হয়।

সমতলভূমিতে অবিশ্যি ব্যবস্থা অন্য। সেখানে মানুষের এই সবচেয়ে বিপজ্জনক খেলায় হাতি সবচেয়ে কাজে লাগে। অবশ্য হাতিদের এই জন্যে ভালো করে শিখিয়ে নিতে হয়। তবু সবচেয়ে শিক্ষিত হাতিরাও অনেক সময় বাঘের মুখোমুখি পড়ে গেলে ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে এমনভাবে দৌড়ুতে থাকে যে হাওদায় বসে-থাকা শিকারির পক্ষে তখন হাতির পিঠে বসে-থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। মাঝে-মাঝে আবার বাঘেরাও দুঃসাহসে ভর করে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে হাতির পিঠে-সেই বিশাল জন্তুর পিঠেই তখন বাঘে-মানুষে ভীষণ লড়াই বেধে যায়, আর বেশির ভাগ সময়েই সেই লড়াই শিকারির পক্ষে মারাত্মক হয়ে ওঠে।

অন্তত এইভাবেই ভারতের রাজা-বাদশারা শিকারে বেরোন, জমকালো ভঙ্গিতে, জাঁকজমক সহকারে—কিন্তু ক্যাপ্টেন হুডের শিকার করার পদ্ধতি মোটেই এ-রকম নয়। হুড বরং পায়ে হেঁটে বাঘের খোঁজে বনে-বনে ঘুরে বেড়াবে, সে বরং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঘের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করবে, কিন্তু তবু কখনও হাতির পিঠে চড়ে শিকারে বেরুবে না।

আমরা কালোগনিকে অনুসরণ করে এগুচ্ছি বনের মধ্যে। সাধারণত হিন্দুরা একটু চাপা স্বভাবের হয়, কালোগনিও তাদের মতোই-পারতপক্ষে কোনো বাক্যব্যয় করতে চায় না—কোনো প্রশ্ন করলেও অতি সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে দেবার পক্ষপাতী।

ঘণ্টাখানেক হেঁটে আসার পর একটি প্রখর স্রোতস্বিনীর কাছে এসে আমরা থামলুম। জলের ধারে মাটির ওপর নানা ধরনের জন্তুর পায়ের ছাপ–ছাপগুলো বেশ টাটকা। পাশেই একটা গাছের গুড়ির সঙ্গে মস্ত একখণ্ড গোমাংস টোপ হিশেবে বেঁধে রাখা হয়েছিলো—টোপটা, স্পষ্ট বোঝা গেলো, কোনো জন্তু আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিলো বোধহয় কতগুলো শেয়াল মাংসের টুকরোটাকে নিয়ে টানাটানি করেছিলো, যদিও আদৌ তাদের জন্যে এই টোপ ফেলা হয়নি। আমরা কাছে যেতেই গোটা কয়েক শেয়াল হুড়মুড় করে ছুটে পালিয়ে গেলো।

ক্যাপ্টেন, কালোগনি বললে, এখানেই বাঘিনীটার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। দেখতেই পাচ্ছেন, এখানে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে কত সুবিধে হবে।

কালোগনি ঠিকই বলেছিলো। আমরা বন্দুক উঁচিয়ে ঢ্যাঙা গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সেই মাংসের টুকরোটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলুম। গৌমি আর আমি রইলুম একটা গাছের আড়ালে, হুড আর ফক্স দুটো মুখোমুখি দাঁড়ানো মস্ত, ওকগাছের ডালে উঠে বসে তৈরি হয়ে রইলো। কালোগনি লুকোলো একটা মস্ত পাথরের আড়ালে-বিপদ দেখলে সে পাথরের চুড়োয় উঠে পড়বে। এইভাবে ছড়িয়েথাকার ফলে সুবিধেটা হলো এই যে জন্তুটাকে একেবারে ঘিরে ধরা যাবে—কিছুতেই যাত সে পালাতে না-পারে, সেইজন্যেই এই ব্যবস্থা।

এখন কেবল অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই আমাদের। আশপাশের ঝোঁপের আড়ালে শেয়ালগুলো তখনও ডাকাডাকি করছিলো কিন্তু আমাদের ভয়ে সেগুলো আর মাংসের দিকে এগিয়ে আসতে পারছিলো না।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ আচম্বিতে শেয়ালের ডাক থেমে গেলো। পরক্ষণেই হুড়মুড় করে গোটা কয়েক শেয়াল ল্যাজ গুটিয়ে সেখান থেকে ঊধ্বশ্বাসে ছুটে পালালো। কালোগনির শরীরটা তখন টান হয়ে উঠেছে ধনুকের ছিলার মতো, ইঙ্গিতে সে আমাদের সাবধান হতে বলে দিলে। বুঝতে পারলুম, শেয়ালদের ওই পলায়ন আসলে কোনো হিংস্র জন্তুর আবির্ভাবের পূর্বাভাস। সম্ভবত ওই বাঘিনীরই আবির্ভাব হয়েছে বনের মধ্যে।

আমরা বন্দুক উঁচিয়ে আছি। ঝোঁপের যেদিক থেকে শেয়ালগুলো ছুটে পালিয়েছিলো, হুড আর ফক্স বন্দুক তুলে সেই দিকটায় তাগ করে আছে। তার পরেই হঠাৎ দেখলুম সেই ঝোঁপের একটা দিক আচমকা ভীষণভাবে নড়ে উঠলো। শুনতে পেলুম শুকনো ডালপালা গুড়িয়ে যাবার শব্দ। আস্তে, অতি মন্থর কিন্তু নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে, কোনো জন্তু গুঁড়ি মেরে এগুচ্ছে নিশ্চয়ই। যদিও জন্তুটা শিকারিদের কোথাও দেখতে পাচ্ছে না, তবু কেমন করে যেন সে টের পেয়ে গেছে যে জায়গাটা তার পক্ষে আদৌ নিরাপদ নয়। জন্তুরা এ-সব বিষয় কেমন করে যেন টের পেয়েই যায়। নিশ্চয়ই ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর না-হয়ে পড়লে, এবং সেই মাংসের গন্ধে আকৃষ্ট না-হলে, সে আর এক পাও এগুতো না।

অবশেষে ডালপালার আড়ালে তাকে দেখা গেলো—কেমন যেন সন্দিহান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশালসুন্দর বাঘিনী। তারপরে আস্তে সাবধানে গুঁড়ি মেরে সে এগুতে থাকলো আবার—শরীরের মধ্যে কোথাও তার বোধহয় কোনো স্প্রিং আছে, কোনো বেগতিক দেখলেই সে ঝটকা মেরে লাফিয়ে পালাবে।

আমরা তাকে টোপটা পর্যন্ত এগুতে দিলুম। মস্ত একটা শিকারি বেড়াল শিকারের উপর লাফাবার আগে ঘাড় ও পিঠ যেমনভাবে বাঁকিয়ে টান করে নেয়, তার শরীরটাও ঠিক তেমনি হয়ে উঠলো।

হঠাৎ সেই ছমছমে স্তব্ধ বন যুগপৎ দুটি বন্দুকের গুলিতে থরথর করে কেঁপে উঠলো;

বিয়াল্লিশ নম্বর, চেঁচিয়ে উঠলো হুড।

আটত্রিশ, ততোধিক উঁচু গলার স্বর ফক্সের!

হুড আর ফক্স একই সঙ্গে গুলি করেছিলো; আর এমনি তাদের অব্যর্থ লক্ষ্য যে বাঘিনার হৃৎপিণ্ড তৎক্ষণাৎ ফুটো হয়ে গিয়েছে। এখন সে পড়ে আছে মাটিতে–নিস্পন্দ ও নিঃসাড়।

কালোগনি চটপট ছুটে গেলো তার দিকে। আমরা তাড়াতাড়ি যে-যার গাছ থেকে নেমে এলুম। বাঘিনীটা আর একটুও নড়ছে না।

কিন্তু, সত্যি, কার গুলিতে মরেছে তরাইয়ের এই রানীবাঘ? ক্যাপ্টেন হুড, না ফক্স—কার গুলি ভেদ করেছে লক্ষ্য। পরীক্ষা করে দেখা হলো বাঘটাকে; দেখা গেলো তার বুকে স্পষ্ট দুটি গুলির দাগ!

যাক, হুডের গলায় কিঞ্চিৎ ক্ষোভ শোনা গেলো, আমরা দু জনেই তাহলে আধখানা করে বাঘ পেলুম-সাড়ে-একচল্লিশ হলো তাহলে আমার।

অর্থাৎ আমার হিশেব দাঁড়ালো সাড়ে-সাঁইত্রিশ, ফক্সের গলাতেও সেই একই ক্ষোভ।

কিন্তু তারা দুজনে যতই ক্ষুব্ধ হোক না কেন, বাঘিনীটা যে তক্ষুনি মরেছে, এটা আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। আহত বাঘিনীর মতো ভয়ংকর জন্তু আর-কিছুই হতে পারে না—নিজেদের ভাগ নিয়ে তারা দুজনে যতই ক্ষুব্ধ হোক না কেন, একবারেই একটা বাঘ মেরে ফেলা মোটেই কম কৃতিত্বের কাজ নয়।

ফক্স আর গৌমি বাঘিনীর সেই চমৎকার ছালটি ছাড়াবার জন্যে সেখানেই থেকে গেলো, আর আমি হুডের সঙ্গে ফিরে এলুম স্টীম হাউসে। সারা রাস্তা হুড বেশ মনমরা হয়ে রইলো-ভাগে মাত্তর আধখানা বাঘ পড়ায় সে কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি।

+

তরাইয়ের জঙ্গলে ক্যাপ্টেন হুডের প্রতিটি অভিযানের বর্ণনা দেবার কোনো প্রয়োজন দেখছি না, কারণ আসলে হয়তো প্রতিটি শিকার-অভিযানের ধরনই একরকম-বৈচিত্র্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত, একইরকমভাবে সবকিছুরই পুনরাবৃত্তি হয়। তেমনি সন্তর্পণে যেতে হয় জঙ্গলের মধ্যে, টোপ ফেলা হয় জন্তুটির জন্যে, তারপর লুকিয়ে থেকে একইরকমভাবে জন্তুটির আবির্ভাবের জন্য বসে-থাকা, অপেক্ষা-করা। সেইজন্যেই এখানে কেবল এটুকু বলাই নিশ্চয়ই যথেষ্ট হবে যে তরাই অন্তত হুড আর ফক্সের নালিশ করার মতো কোনো কারণ দেয়নি।

এরই মধ্যে একবার ফান খোইতও আমাদের সঙ্গে শিকারে বেরিয়েছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন যে কোনো আধমরা বাঘকে তিনি ক্রাল-এ নিয়ে গিয়ে সারিয়ে তুলবেন, এবং তার তালিকা বিস্ফারিত হয়ে উঠবে। সেদিন আমাদের তিনটি বাঘের পাল্লায় পড়তে হয়েছিলো। দুটি বাঘ, ফান খাইতের তীব্র বিরাগ সত্ত্বেও, হুড আর ফক্সের গুলিতে প্রথম বারেই মারা পড়লো—কিন্তু তৃতীয় বাঘটির কাঁধে গুলি লাগার পর সে একটি প্রচণ্ড লাফ দিয়ে আমাদের মাঝখানে এসে পড়েছিলো।

এই বাঘটাকে মারবেন না, ফান খোইত চীৎকার করে জানালেন, এ-বাঘটাকে জ্যান্ত পাকড়াতে চাই।

কিন্তু প্রাণতাত্ত্বিকের মুখের কথা শেষ হবার আগেই আহত বাঘটি প্রায় তাঁরই উপর এসে পড়লো। এক ধাক্কায় ফান খাইত কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন—ঠিক তক্ষুনি ক্যাপ্টেন হুড গুলি না-করলে এই উড়ো ওলন্দাজটিকে আর বেঁচে থাকতে হতো না।

ক্যাপ্টেন, আপনার আরেকটু অপেক্ষা করা উচিত ছিলো। শেষ পর্যন্ত না-হয় দেখতেন-

কী দেখতাম? বাঘের থাবায় কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান, সেই দৃশ্য?

একটু নখের আঁচড় লাগলেই যে মরতুম, তা আপনাকে কে বললে?

বেশ, হুড শান্ত গলায় বললে, এর পরের বারে আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সব দেখবো।–কোনো বাধা দেবো না।

পশুশালায় দাঁড়িয়ে গর্জন করার বরাত ছিলো না বাঘটার, বরং বৈঠকখানার দেয়ালের শোভা বর্ধন করাই ছিলো তার নিয়তি। কিন্তু তার ফলে হুডের সংগ্রহ দাঁড়ালো তেতাল্লিশ, আর ফক্সের আটত্রিশ-আগের দিনের আধখানা বাঘ আমরা আর হিশেবেই ধরলুম না।

হঠাৎ তেইশে জুলাই কয়েকজন পাহাড়ি এসে হাজির স্টীম হাউসে। আমাদের শিবির থেকে মাইল পাঁচেক দূরে তাদের ছোট্ট গ্রামটি—তরাইয়ের জঙ্গলের উপর দিকটায়। তারা তড়বড় করে আমাদের যা বললে তার সারমর্ম দাঁড়ালো এইরকম : গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি বাঘিনী নাকি পুরো অঞ্চলটায় সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে চলেছে। ছাগল-ভেড়া উধাও হচ্ছে প্রতিদিন, মানুষের প্রাণও মোটেই নিরাপদ নয়। বসতি তুলে অন্য-কোথাও চলে যাবে কিনা ভাবছে তারা। ফাঁদ পেতে তারা ধরবার চেষ্টা করেছিলো বাঘিনীটিকে, কিন্তু বাঘিনীর গায়ে তাতে আঁচড়টিও পড়েনি। গাঁও-বুড়োরা বলছে এ-বাঘিনী নাকি সর্বনাশের দূত-শিগগিরই এখান থেকে বসতি না-তুলে দিলে সব ছারখার করে দিয়ে যাবে।

কাহিনীটি শুনেই ক্যাপ্টেন হুড প্রায় লাফিয়ে উঠলো। তক্ষুনি সে পাহাড়িদের প্রস্তাব করে বসলো যে সে তাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে গিয়ে সব সরেজমিন তদন্ত করে দেখতে রাজি আছে। এ-রকম একটি দুর্ধর্ষ বাঘিনীর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার সাধ নাকি তার অনেক দিনের।

তুমিও আসবে না কি, মোক্লের? আমাকে হুড জিগেস করলে।

নিশ্চয়ই, আমি বলে উঠলুম, এ-রকম একটা রোমহর্ষক অভিযান আমি ছাড়তে রাজি নই।

ব্যাঙ্কস বললে, এবার কিন্তু আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে হুড কেমন করে শিকার করে, তা দেখে এই চর্মচক্ষু সার্থক করি।

ক্যাপ্টেন, আপনি আমাকে যেতে বলবেন না? জিগেস করলে ফক্স।

সে কী হে? এই তো তোমার বাকি আধখানা বাঘিনী মারার সুযোগ! হুড হেসে উঠলো, এই সুযোগ কি কখনও ছাড়া চলে?..না, না, তোমাকেও যেতে হবে।

আমাদের যেহেতু তিন-চার দিন একটানা স্টীম হাউসের বাইরে থাকতে হবে, সেইজন্যে ব্যাঙ্কস সার এডওয়ার্ডকেও জিগেস করে নিলে তিনি আমাদের সঙ্গে পাহাড়িদের গ্রামে যেতে চান কিনা। সার এডওয়ার্ড অবশ্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, এই সুযোগে তিনি সার্জেন্ট ম্যাক-নীল আর গৌমিকে নিয়ে আশপাশের অঞ্চলটা একবার টহল দিয়ে ঘুরে আসবেন। আমরা যেন তার জন্যে খামকা কোনো চিন্তা না-করি।

ব্যাঙ্কস আর তাকে বিশেষ পিড়াপিড়ি করলে না। চটপট তৈরি হয়ে নিয়েই আমরা প্রথমে ক্রাল-এর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লুম।

ক্রাল-এ যখন পৌঁছুলুম তখন বেলা দুপুর। ফান খোইতকে আমরা আমাদের। অভিপ্রায় জানাতেই তিনি কালোগনি ছাড়াও আরো-তিনজন ভারতীয়কে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন। শুধু একটা চুক্তি করে নিলেন তার আগে-যদি দৈবাৎ কোনো কারণে বাঘিনীটিকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তাকে ক্রাল-এ দিয়ে যেতে হবে; কারণ কোনো চিড়িয়াখানায় যদি এ-রকম একটা প্ল্যাকার্ড লটকে দিয়ে জানানো যায়, তরাইয়ের এই সম্রাজ্ঞী একদা একটা পুরো গ্রাম ছারখার করে দিয়েছিলো, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই একটা মস্ত আকর্ষণ হয়ে উঠবে।

ক্রাল থেকে বেরিয়ে আমরা যখন পাহাড়িদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছুলুম, তখন বেলা চারটে বাজে। গিয়ে দেখি, গ্রামবাসীদের আতঙ্ক সেখানে অসীমে পৌঁছেছে। ঠিক সেইদিনই সকালবেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে বাঘিনীটি নাকি একটি যুবককে ধরে নিয়ে গেছে।

আমরা সেই গ্রামে পৌঁছুতেই আমাদের মহাসমাদর করে গ্রামের সবচেয়ে সম্রান্ত ব্যক্তিটির কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যক্তিটি একজন ইংরেজ, সেখানে পাহাড়িদের সঙ্গে থেকে তিনি চাষবাস করেন। তার পক্ষে এই বাঘিনী আরো সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে : দু-একদিনের মধ্যে বাঘিনীটিকে বধ করা না-গেলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাকে আবার নতুন করে অন্য জায়গায় গিয়ে চাষবাসের উদ্যোগ করতে হবে। এবং সেটা তার মোটেই অভিপ্রেত নয়। ওই বাঘিনীটিকে কেউ যদি ঘায়েল করতে পারে, তাহলে তিনি বরং কয়েক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন, তবু এখানকার বাস ওঠাবেন না। কারণ —তিনি বললেন-একবার যদি এই আতঙ্ককে বাড়তে দেয়া যায়, তাহলে আশপাশের চোদ্দ-পনেরোটা গ্রাম একেবারে ছারখার হয়ে যাবে।

কয়েক বছর আগে, তিনি বললেন, আরেকটি বাঘিনীর জন্যে তেরোটি গ্রামের লোক গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলো—আর তার ফলে প্রায় দেড়শো মাইল উর্বর জমি পতিত পড়ে থাকে। এবারও যদি এ-রকম কোনো ব্যাপার ঘটে, তাহলে পুরো এলাকাটাই আমাদের ছেড়ে যেতে হবে!

বাঘিনীটাকে মারবার চেষ্টা করেছেন আপনারা? ব্যাঙ্কস জিগেস করলে।

সম্ভব-অসম্ভব সব উপায়ই প্রয়োগ করা হয়েছে। ফাঁদ পাতা হয়েছে, মস্ত গর্ত করে উপরে ডালপালা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে, স্ত্রিকনিন-মাখানো মাংস দিয়ে টোপ ফেলে দেখা হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

আপনাকে অবশ্য এমন কথা দিতে পারবো না যে আমরা বাঘিনীটিকে ঘায়েল করবো, বললে হুড, তবে এইটুকু বলতে পারি যে আমরা চেষ্টার কোনোই ত্রুটি করবো না।

সেই দিনই সব তোড়জোড় . রে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের দলের সঙ্গে, যোগ দিলে আরো কুড়িজন পাহাড়ি। ব্যাঙ্কস যদিও আদৌ শিকারি নয়, তবু সে উচ্ছলভাবে অত্যন্ত আগ্রহসহকারে আমাদের সঙ্গে সফরিতে বেরুলো।

তিনদিন ধরে অহোরাত্র খোঁজা হলো সেই বাঘিনীকে—কিন্তু তার কোনো পাত্তাই পাওয়া গেলো না; গোটা তল্লাট থেকেই সে যেন একেবারে উবে গিয়েছে। মাঝখান থেকে হুড়ের পাল্লায় পড়লো আরো-দুটি বাঘ, এবং হুড কেবল গুনে শেষ হিশেব জানালে আমাদের : পয়তাল্লিশ।

অবশেষে আমরা যখন সেই নরখাদক বাঘিনীর আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি, তখন হঠাৎ এক নতুন দুষ্কর্ম সাধন করে সে তার আগমনবার্তা জানালে আমাদের। আমরা যে-ইংরেজ ভদ্রলোকের অতিথি হয়েছিলুম, তারই একটি মোষ হঠাৎ একদিন খোঁয়াড় থেকে উধাও হয়ে গেলো–এবং তার ভুক্তাবশেষ ও হাড়গোড় পাওয়া গেলো গ্রাম থেকে মাইল দু-এক দূরে। হত্যাকাণ্ডটি-আইনের ভাষায়-বলা যায়, সুপরিকল্পিত। সকলের আগেই মোষটিকে নিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। নানা চিহ্ন দেখে বোঝা গেলো আততায়ী খুব-একটা দূরে নেই—ওই ভুজ্ঞাবশেষেরই আশপাশে কোথাও লুকিয়ে আছে।

আমরা অবিশ্যি তবু উটকো একটা প্রশ্ন করলুম, এটা কি সেই বাঘিনীরই কাজ বলে মনে হয়? না কি অন্যকোনো বাঘের কীর্তি?

পাহাড়িদের দেখা গেলো এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। সবাই একবাক্যে জানালে ওটা তারই কাজ। তাদের দ্বিধাহীন রায় শুনে আমরা আর রাতের অপেক্ষা না-করে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লুম। কারণ রাতের অন্ধকারে এই ধূর্ত, ক্ষিপ্র ও ভীষণ বাঘিনী একেবারে বেমালুম নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। খেয়ে-দেয়ে এখন সে নিশ্চয়ই তার ডেরায় গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে-দু-তিন দিনের মধ্যে হয়তো আর বেরুবেই না।

যেখান থেকে মোষটাকে বাঘিনীটি টেনে নিয়ে গিয়েছিলো, সেখানে চাপচাপ রক্ত পড়ে আছে। সেই রক্তের দাগ লক্ষ করে এগিয়েই আমরা বাঘিনীর ডেরার উদ্দেশে চলতে লাগলুম। রক্তের দাগ গিয়ে শেষ হলো একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে। এই ঝেপটাকে এর আগে খেদা দিয়ে বহুবার ঘেরাও করা হয়েছে—কিন্তু বাঘের ল্যাজের ডগাটিরও দেখা যায়নি। এবার আমরা চারপাশ দিয়ে গোল করে ঝোপটাকে ঘিরে ধরলুম, যাতে কিছুতেই সেই নরখাদক আর পালাতে না-পারে।

আস্তে আস্তে সেই গোল মনুষ্যবেড়া ছোটো হয়ে আসতে লাগলো। আমি, কালোেগনি আর ক্যাপ্টেন হুড রইলুম একদিকে-অন্যদিকে রইলো ফক আর ব্যাঙ্কস। কিন্তু দু-দলের মধ্যে যোগাযোগ আমরা একটুও ছিন্ন করিনি-প্রতি মুহূর্তেই সংবাদ আদান-প্রদান করা হচ্ছিলো।

বাঘটা যে ঝোঁপের মধ্যেই আছে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। কারণ রক্তের দাগ গিয়ে শেষ হয়েছে ঝোঁপের মধ্যে, অথচ অন্য পাশে আর কোনো রক্তের দাগ নেই। অবশ্য তার মানে এই নয় যে বাঘটার ডেরা এই ঝোপে, কারণ আগে যখন ঝোপটা খোঁজা হয় তখন বাঘটাকে এখানে পাওয়া যায়নি। হয়তো এটা তার সাময়িক বিশ্রামের স্থান।

বেলা তখন মাত্র আটটা। সাড়ে আটটার মধ্যেই আমাদের গণ্ডি আরো ছোটো হয়ে এলো। পাশের লোকটিকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, এত ছোটো হয়েছে গণ্ডি। কিন্তু ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই-ঝোঁপের মধ্যটা অদ্ভুতরকম স্তব্ধ হয়ে আছে। শেষটায় আমার মনে হতে লাগলো বাঘটা হয়তো ঝোঁপের মধ্যে আর নেই-আমরা মিছিমিছি এইভাবে সময় নষ্ট করছি।

আরো-ছোটো হয়ে এলো আমাদের গণ্ডি–আর তারপরেই হঠাৎ ঝোঁপের মধ্য থেকে একটা চাপা রাগি গর্জন উঠলো। শব্দ শুনে বোঝা গেলো কতগুলো পাথর আর গাছের আড়ালে বাঘটা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে।

হুড, ব্যাঙ্কস, ফক্স, কালোগনি ও আরো-কয়েকজন পাহাড়ি তখন ঝোঁপের মুখটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভিতরেই ঢুকে পড়ি এবার, হুড পরামর্শ দিলে।

সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে–বিশেষ করে প্রথমে যে যাবে, তার পক্ষে, বললে ব্যাঙ্কস।

হাতের রাইফেলটা তুলে হুড বললে, তবু আমি যাবো—

আমি আগে যাবো, ক্যাপ্টেন, ফক্স ঝোঁপের দিকে পা বাড়ালো।

না, না, ফক্স—এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার, হুড বাধা দিলে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন, আমি আপনার চেয়ে ছটা বাঘ পিছিয়ে আছি–

তক্ষুনি ব্যাঙ্কস ফতোয়া জারি করলে, উঁহু, তোমাদের দুজনের কাউকেই আমি ঝোঁপের মধ্যে ঢুকতে দেবো না।—কিছুতেই না।

ঝোপে ঢোকবার কী দরকার? আরো তো একটা উপায় আছে, কললে কালোগনি।

কী?

ও-পাশে আগুন দিয়ে দিলেই হয়–ধোঁয়া আর আগুনের জন্যে বাধ্য হয়ে তাকে বেরুতেই হবে! আর একবার গাছের আড়াল থেকে বেরুলে বাঘটাকে মারাও অনেক সহজ হয়ে উঠবে।

কালোগনি ঠিকই বলেছে, ব্যাঙ্কস সায় দিলে, এসো, চটপট কিছু শুকনো ভালপালা ও নন-পাতা একজায়গায় জড়ো করো-তারপর তাতে আগুন দাও। তাতে হয় তাকে জান্ত ঝলসে মরতে হবে নয়তো বেরুতেই হবে বাইরে।

বেরিয়ে যদি পালিয়ে যায়, পাহাড়িরা আপত্তি করলে।

তাহলে তার আগেই তাকে আমরা অভিনন্দন জানাবো, হুড তার রাইফেল তুলে দেখলে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুকনো পাতা, ঘাস, ডালপালা জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো–অমনি কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠলো-আর হাওয়ার তোড়ে সেই ধোঁয়া ঢুকতে লাগলো ঝোঁপের মধ্যে। এবার আরেকটা রাগি, হিংস্র গর্জন উঠলো ঝোপ থেকে বোঝা গেলো, অচিরেই বাঘটা ঝোপ থেকে লাফিয়ে বেরুবে।

উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত ভাবে আমরা ঝোঁপের দিকে তাকিয়ে রইলুম, আর হুড পছন্দসই একটা জায়গা বেছে নিয়ে রাইফেল তুলে ধরলো { হঠাৎ ঝোঁপের মধ্যটা প্রচণ্ডভাবে নড়ে উঠলো। হাঁটু গেড়ে বসলো হুড, রাইফেল তাগ-করা ঝোঁপের দিকে, সমস্ত শরীর তার ধনুকের ছিলার মতো টান-করা।

হঠাৎ ধোঁয়ার মধ্য থেকে একটা প্রকাণ্ড জন্তু সবেগে বেরিয়ে এলো।

একসঙ্গে গর্জে উঠলো দশটি বন্দুক–কিন্তু, আশ্চর্য, বাঘের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত পড়লো না। হুড তখনও হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেল তাগ করে আছে–বাঘিনীটা যেই আরেকটু এগুলো, অমনি তার কাধ লক্ষ্য করে হুডের রাইফেল গর্জে উঠলো। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্র সেই বাঘিনী লাফিয়ে পড়লে হুডের উপর। থাবার একটা আঘাতে এক্ষুনি তার মাথার খুলি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে

কিন্তু পরমুহূর্তে তীক্ষ্ণ্ণ ছুরি হাতে কালোগনি লাফিয়ে পড়লো বাঘের উপর। হঠাৎ এমনভাবে আক্রান্ত হয়ে বাঘিনী এবার তার দিকেই ফিরলো।

সেই ফাঁকে হুড ক্ষিপ্রভাবে লাফিয়ে উঠলো। কালোগনির হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গিয়েছিলো—সেটা তুলে বাঘিনীর বুকে বসিয়ে দিলো আস্ত, একেবারে বাঁটশুদ্ধু বাঘিনীটা গড়িয়ে পড়ে গেলো।

পরক্ষণেই পাহাড়িদের সমস্বর উল্লাস শোনা গেলো : শের মর গিয়া! শের মর। গিয়া।

সত্যি, মরে গিয়েছে! দশ ফিট লম্বা, ল্যাজ সমেত-চিক্কণ, নধর, পেশল সম্রাজ্ঞীর মতোই, সত্যি!

পাহাড়িরা যখন সেই রানীবাঘকে ঘিরেই উল্লাসে নৃত্য করছে, কালোগনি আস্তে হুডের দিকে এগিয়ে গেলো। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, সাহেব।

ধন্যবাদ কীসের! আমিই তো উলটে তোমাকে ধন্যবাদ দেবো-তুমি না-থাকলে এতক্ষণে আমি অক্কা পেতুম?

কিন্তু আপনি বাঘটা না-মারলে আমাকেও মরতে হতো, ঠাণ্ডা গলায় বললে কালোগনি, আপনার ছেচল্লিশ নম্বর এটা! আমি আর কীই-বা করেছি।

হুড আর কোনো দ্বিরুক্তি না-করে কালোগনির হাত ধরে কৃতজ্ঞতাভরে ঝাঁকুনি দিলে।

ব্যাঙ্কস বললে, কালোগনি, চলে এসো আমাদের স্টীম হাউসে, বেহেমথে। তোমার কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে—ওষুধ লাগিয়ে দেবো।

কালোগনি কোনো আপত্তি করলে না। পাহাড়িদের সমস্বর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে আমরা স্টীম হাউসের দিকে রওনা হয়ে পড়লুম। ফান খোইতের অন্যান্য অনুচরেরা কালের দিকে ফিরে গেলো।

বেহেমথে ফিরে এলুম দুপুর নাগাদ। এসে দেখি, সার্জেন্ট ম্যাক-নীল আর গৌমিকে নিয়ে কর্নেল মানরো বেরিয়ে গেছেন; ছোট্ট একটা চিরকুটে লিখে গেছেন, তিনি নানাসাহেবের সন্ধানে চললেন—নানাসাহেব নেপালে আছেন কিনা, এটা তিনি সঠিক জানতে চান।

চিরকুটটা যখন পড়া হচ্ছিলো, তখন হঠাৎ আমি তাকিয়ে দেখলুম কালোগনির মুখের ভাব যেন আচমকা কী-রকম অদ্ভুত হয়ে উঠলো! কেন? নানাসাহেবের নাম শুনে? কিছুই ঠিক বুঝতে পারলুম না।