১২. জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

১২. জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

আমাদের এই অবিস্মরণীয় ভ্রমণ যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, পাতালে প্রবেশ করবার পর থেকে এভোব আশ্চর্য ব্যাপার দেখে আসছি যে, ভেবেছিলাম আমাকে স্তম্ভিত করতে পারে এমন বোধহয় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু যখন দেখলাম এই গভীর পাতালে, এই অন্য পৃথিবীতেও আর সাক্‌ন্যুউজম বিরাজ করছেন, তখন একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। যে-ছোরাটা নিয়ে আমরা এতক্ষণ মাথা ঘামাচ্ছিলাম, সেটি যে তারই তা স্পষ্টই বোঝা গেলো, কেননা পাথর কেটে নাম লেখবার দরুন এর ফলা স্থানে-স্থানে ভেঙে গিয়েছিলো।

সঙ্গে-সঙ্গে ভেলায় ফিরে গেলাম আমরা। ভেলাটা তাড়াতাড়ি মেরামত করে ঘণ্টাখানেক পরে সেখানটায় আবার ফিরে এলাম। বাতাস অনুকূল না থাকলে হয়তো আরো দেরি হতো। তেলাটা ঐ সুড়ঙ্গের কাছে নিয়ে আসবার কারণ হলো, একবার ঐ সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকে কী কী জিনিশ সুড়ঙ্গ-অভিযানে দরকার হতে পারে তা সঙ্গে নিয়ে বাকি সবকিছু ভেলায় রেখে যাওয়া যেতে পারে।

তখনি টর্চ জ্বেলে সেই অজানা সুড়ঙ্গের অন্ধকারে পদার্পণ করলাম। কাকামণি আর হান্‌স্‌, এবার আমার পিছনে পড়লেন, স্যামউজমের নাম আমার মনে এবার সত্যি সত্যি উদ্দীপার মশাল জ্বেলে দিয়েছিলো। কাকামণির হিশেবমতো তখনো পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছুতে সাড়ে চার হাজার মাইল বাকি ছিলো। সেটুকুই বা আর বাকি থাকে কেন? একেবারে শেষ দেখে যাওয়াই ভালো। এবং সেই শেষের পথ যে এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই এগিয়েছে, তা সুড়ঙ্গের বাইরে ঐ নাম খোদাই দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।

সুড়ঙ্গের পথ চওড়ায় হাত-চারেক হবে,-দুধারে সুদৃঢ় পাথরের দেয়াল। একটু এগোতে-না-এগোতেই আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। দেখতে পেলাম, সুড়ঙ্গ-পথের মুখ বন্ধ করে একটি বিরাট পাথর সামনে পড়ে আছে। সে পাথর সরানো মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

হতাশ হয়ে আমরা সেই সুড়ঙ্গের মেঝেয় বসে পড়লাম।

সাক্‌ন্যুউজম্‌ নিশ্চয়ই এখান থেকে ফিরে যাননি। পাতালে তিনি শেষাবধি নিশ্চয়ই পৌঁছেছিলেন, আর পৌঁছেছিলেন এই সুড়ঙ্গপথ ধরে এগিয়েই। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পরে বোধহয় কোনো ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতে পাথর পড়ে এই পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ আমার চোখে আশার আলো বিকিয়ে উঠলো। বললাম : কাকামণি, বারুদ দিয়ে এই পাথরটা উড়িয়ে দিলে হয় না?

সঙ্গে-সঙ্গে উল্লসিত হয়ে উঠলেন কাকামণি : ঠিক বলেছিস!

তখনি বারুদ ঢালবার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করে দিলাম। পঁচিশ সের বারুদে আগুন দেবার ব্যবস্থা করতে অনেক সময় লাগলো। নাইট্রিক অ্যাসিড আর সালফিউরিক অ্যাসিডে তুলো ভিজিয়ে বারুদ তৈরি করেছিলাম আমরা। সাধারণ বারুদের চেয়ে এই বারুদের শক্তি অনেক বেশি। হান্‌স্‌ গর্ত করতে লাগলো। আমি আর কাকামণি বারুদে আগুন দেবার জন্যে লম্বা শলতে তৈরি করতে লাগলাম। ক্রমে রাত্রি হয়ে এলো। তারপর যখন সকল আয়োজন শেষ করে বারুদ দিয়ে গর্ত ভরাট করে শলতের এক প্রান্ত বারুদের মধ্যে রেখে অন্য প্রান্ত সুড়ঙ্গের বাইরে আনলাম, তখন কাকামণি বললেন : আজ আর কাজ নেই, কাল দিনের আলোয় শলতে আগুন দেয়া যাবে।

পরদিন সকালবেলা ছটার সময় আমরা তৈরি হয়ে সুড়ঙ্গের মুখে এসে দাঁড়ালাম, কাকামণিকে বলেকয়ে শলতেয় আগুন দেবার ভারটা আমিই নিলাম। কাকামণি আমাকে বারবার সতর্ক করে দিলেন : সাবধান, এক সেকেণ্ডও যেন দেরি না হয়, আগুন দিয়েই প্রাণপণে দৌড়ে এসে ভেলায় উঠবি! তুই ভেলায় এলেই আমরা সমুদ্রের মধ্যে ভেলা ঠেলে দেবে। পাহাড় যে কততখানি ধ্বসে যাবে, কে জানে! শলতের আগুন বারুদের কাছে যেতে লাগবে প্রায় দশ মিনিট। এর মধ্যেই আমাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হবে।

আমাকে এইভাবে বারবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাসকে নিয়ে কাকামণি ভেলায় গিয়ে উঠলেন। ভেলাকে সমুদ্রপথে ঠেলে দেবার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন ওঁরা। একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে আমি শলতের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর একহাতে লণ্ঠন ধরে অন্য হাতে শলতের আগা ধরলাম। একবার হাত কাঁপলো। কাকামণি হাঁকলেন : হুঁশিয়ার! দাও আগুন!

তক্ষুনি শলতেয় আগুন দিলাম। দপ করে জ্বলে উঠলো শলতোট, তীব্রবেগে অগ্নিশিখা অগ্রসর হল সুড়ঙ্গের দিকে। আমিও বিদ্বেগে ভেলায় এসে উঠলাম। সঙ্গে-সঙ্গে কাকামণি আর হস, কোনোরকমে ভেলাটিকে তীর থেকে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে সরিয়ে নিলেন। আর, ঠিক তখনি–

ঠিক তখনি আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠলো। বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম কি না মনে নেই, শুধু এইটুকুই মনে আছে যে, যেখানে পাথর ছিলো, পলকের মধ্যেই সেখানে একটি অতল গহ্বর দেখা দিল। সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে ফুশে উঠলো। যে সাংঘাতিক ধাক্কায় আমরা তিনজনেই ভেলার উপরে ছিটকে পড়লাম, আর নিবিড় অন্ধকার এসে আমাকে ঢেকে ফেলবার আগে শুধু এটুকুই বুঝতে পারলাম যে, আমরা নিচের দিকে নামছি।

সম্বিত যখন ফিরলো, তখন বুঝতে পারলাম যে ঐ বিপুল পাথরটার ওপাশে ছিলো একটি অতল গহ্বর। বিস্ফোরণের ফলে পাথরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলে বিপুল একটি আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং সেই কারণেই সমুদ্রের জল প্রবল একটি জলপ্রপাতের মতো সেই গহ্বরটির ভিতর প্রবেশ করতে থাকে। স্রোতের সেই প্রবল আকর্ষণ আমাদের ভেলাটিকেও রেহাই দেয়নি। জলস্রোতের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের ভেলাও গহ্বরের ভিতর দিয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছে। এবার যে আর বাঁচোয়া নেই, সে-কথা বুঝতে পেরে ভয়ে চোখ বুজে রইলাম। দুপাশের পাথরের গায়ে ঘা লাগলে ভেলার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও নিঃসন্দেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো।

প্রচণ্ড বেগে পাতালে নামতে লাগলাম। আশ্চর্য যে, একবারো পাথরের দেয়ালের সঙ্গে ভেলার সংঘর্ষ বাংলো না। বুঝলাম যে, গহ্বরের বিস্তার বিরাট বলেই এমন কোনো সংঘর্ষ ঘটলো না। স্যামুউজমের পাতালের পথে আমাদের দুবুদ্ধি একটি তীব্র জলস্রোতকে আমাদের অদৃষ্টের সঙ্গে গেঁথে নিয়ে এলো! যেরকম প্রবল বেগে হাওয়া আমাদের ঝাঁপটা মারছিলো, তাতে বুঝতে পারছিলাম যে দ্রুততম যানের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগতিতে আমরা পাতালের দিকে নামছি। টর্চটা ভেঙে গিয়েছিলো বলে গহ্বরটা পরীক্ষা করতে পারছিলাম না অন্ধকারে।

কতোক্ষণ ধরে যে নেমেছিলাম, আজকে তা আমি সঠিক বলতে পারবো না, তবে এ-কথা মনে আছে যে, অনেক-অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেয়ে ভেলাটা থেমে গেলো, তারপর একটা জলধারা তীব্রবেগে আমাদের উপর পড়তে লাগলো। বোধহয় মিনিটখানেক পড়েছিলো সেই জলধারা, তারপরেই আবার ভেলাটা চলতে শুরু করে দিলে। এবার কিন্তু জলের গর্জন আর শোনা গেলো না।

এমন সময় কাকামণি আমাকে ডেকে বললেন : অ্যাকজেল, আমরা কিন্তু নামছি না, উপরে উঠছি।

বিস্মিত হয়ে শুধোলাম : উপরে উঠছি। কোথায়? কী করে?

কী করে জানি নে, কিন্তু সত্যিই উপরে উঠছি। বললেন কাকামণি। কোনোমতে যদি একটা আলো জ্বালা যায়, তবেই ভালো করে বোঝা যাবে,

একটামাত্র টর্চলাইটই তখন সম্বল ছিলো ভেলায়। হান্‌স্‌ অনেক চেষ্টা করে হাতড়ে হাতড়ে সেটা বার করে জ্বাললে। একটুখানি আলো অনেকখানি আশা আনলে মনে।

কাকামণি বললেন : যা ভেবেছিলাম! জলে গহ্বরের তলা ভরে যাওয়ায় জল এবারে অন্য পথ দিয়ে উপরে উঠছে, আমরাও সেই জলের সঙ্গে-সঙ্গে উপরে উঠছি। কিন্তু হুঁশিয়ার, প্রতি মুহুর্তেই একটা-না-একটা বিপদ আসতে পারে। এখন বোধহয় আমরা ঘণ্টায় দশ মাইল বেগে উঠছি। যদি এইভাবে উঠতে থাকি–

আর যদি এই সুড়ঙ্গের একটা বহির্মুখ থাকে–

তাহলে ভালোই হয়। কিন্তু না থাকলে পাথরে ঘা লেগে চূর্ণ হয়ে যাবো, বললেন কাকামণি। কিন্তু সে তো আরো খানিকক্ষণ পরের ব্যাপার। এখন তো খেয়ে নিই কিছু!

এতোক্ষণ খবরটা চেপে রেখেছিলাম, কিন্তু এবার খুলে বলতে হলো। আগেই আমি লক্ষ্য করে দেখেছিলাম, ভেলায় কোনো বাবার নেই, সব জ্বলে ছিটকে পড়ে গেছে। খুঁজে পেতে দু-এক টুকরো শুকনো মাংস পাওয়া যেতে পারে হয়তো।

এই কথা শুনে শূন্য চোখে আমার নিকে তাকালেন কাকামণি।

যেমন বেগে উঠছিলাম, তেমনি উঠতে লাগলাম। ক্রমশ যেন উত্তাপ বাড়ছে বলে মনে হলো। হঠাৎ এমনটা কেন হলো বুঝতে পারছিলাম না। এতোদিন তো পাতালে কেটেছে, তবু কখনো এতে উত্তাপ দেখিনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উত্তাপ ভয়ানক বেড়ে গেলো। আমি শুধু কাকামণিকে একবার বললাম : নেহাৎ যদি ড়ুবে না মরি, পাথরের সঙ্গেও যদি ঘা না খাই, খিদের হাত থেকেও যদি রেহাই পেয়ে যাই,—তবু বাঁচবো বলে তো আশা হচ্ছে না। হয়তোবা পুড়েই মরতে হবে আমাদের।

কাকামণির চোখে-মুখে এই প্রথমবার ভয়ের চিহ্ন দেখলাম। কোনো কথা বললেন না তিনি, শুধু তার ঠোঁটদুটো একবার কাঁপলো।

আরো এক ঘণ্টা কাটলো। উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তারপর হঠাৎ হু-হু করে আরো বেড়ে গেলো অনেকখানি। সঙ্গে সঙ্গে ভেলার গতিও যেন অনেকখানি বেড়ে গেল। ভেলার চারপাশে টগবগ করে জল ফুটতে লাগলো। উত্তাপ ক্রমশ সহাতীত হয়ে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলে আমার। গন্ধকের উগ্র গন্ধে ভরে উঠলো চারপাশ। আগুনের চেয়েও গরম যেন গহ্বরটি! কাকামণির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার ভুরু কুঁচকে গেছে, কপালে পড়েছে চিন্তার রেখা। বুঝলাম, সাংঘাতিক একটি অনর্থ আসন্ন।

আর তার প্রমাণও পেলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মশালের ক্ষীণ, চঞ্চল আলোয় দেখলাম, দেয়াল ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, আর সেই ফাটল থেকে বেরুচ্ছে গ্যাস। আর তখন শুনতে পেলাম একটা গুরু-গুরু গর্জন।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিবর্ণ, নিরুত্তাপ একটি হাসি ফুটলে কাকামণির ঠোটে। বললেন : সুড়ঙ্গপথে অগ্ন্যুদ্গার শুরু হয়েছে, অ্যাকজেল, এ-সব তারই অগ্রদূত। আগ্নেয়গিরির উদগার আমাদের ঠেলে উপরের দিকে তুলছে।

সর্বনাশ! ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। তাহলে কি আমরা অগ্নিময় তরল ধাতুস্রোতের মধ্যে এসে পড়েছি?

আবার কাকামণির ঠোঁটে সেই প্রাণহীন হাসিটা দেখলাম।

ভয়ংকর তীব্রবেগে উঠছে আমাদের ভেলা। একটি জ্বলন্ত ধাতুস্রোত তাকে ঠেলে তুলছে উপরে। পাথরের দেয়াল তখন একবার ফাটছে, আবার পরমুহূর্তেই জোড়া লাগছে। সবকিছু ছাপিয়ে উঠছে একটা প্রলয়-গর্জনের শব্দ।

এত দ্রুতবেগে আমাদের ভেলা উপরের দিকে উঠছিল যে, আমরা আগুনে ঝলসে যাইনি। ক্রমশ যেন ভেলার গতিবেগ প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হচ্ছিলো।

তারপর যে কী হয়েছিলো, মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগের মুহূর্তে শুধু এইটুকুই দেখেছিলাম যে, হানুসের সুগঠিত গ্রীক স্ট্যাচুর মতো দেহ আগুনের লালে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমার মস্তিষ্কের মধ্যে একাকার হয়ে গেলো জীবন আর মৃত্যু, আর তার পরক্ষণেই কে যেন আমাকে কামানের মুখে বেঁধে কামান দাগলো। অমনি আমি মহাশূন্যে উড়ে গেলাম।