০৮. ইচ্ছে থাকলে উপায়ও থাকে

এদিকে চখানায় যখন ফিলিয়াস ফগের ভবিষ্যৎ ও আশা সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো, তখন তিনি নিশ্চিন্ত মনে আউদাকে নিয়ে হংকঙের সাহেব-পাড়ায় বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তার অনুরোধে আউদা ইওরোপে যেতে রাজি হয়ে পড়ায় এতদূর পথ পাড়ি দেয়ার জন্যে কতগুলো জিনিশ কেনাকাটা করা দরকার হয়ে পড়েছিলো। ফগের মতো কোনো ইংরেজ হয়তো একটা ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারেন, কিন্তু কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষে তো সেভাবে বেড়ানো সম্ভব নয়।

কেনাকাটা সারা হলে পর হোটেলে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফগ দ্য টাইমস আর ইলাস্ট্রেটেড লণ্ডন নিউজ পড়তে লাগলেন। পাসপার্তু এত রাতেও ফিরে না-আসায় ফগ মোটেই চিন্তিত হলেন না, কারণ তিনি জানতেন ইয়োকোহামার জাহাজ আগামীকাল ভোরের আগে ছাড়বে না। কাজেই পাসপার্তুকে দেখতে না-পেলেও সে নিয়ে তেমনএকটা মাথা ঘামালেন না। কিন্তু পরদিন ভোরে যখন পাসপার্তুকে তিনি ডাকলেন, তখনও তার কোনো পাত্তা পাওয়া গেলো না। ফগ অবিশ্যি তখনই প্রথম শুনলেন যে আগের দিন রাত্রেও সে আসেনি। তিনি এ-সম্বন্ধে কী ভাবলেন, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন, কারণ তিনি এ নিয়ে কোনো কথাটি না-কয়ে, বিনাবাক্যব্যয়ে, জিনিশপত্র গুছিয়ে আউদাকে সঙ্গে নিয়ে কনাটিক জাহাজে যাবার জন্যে রাস্তায় এসে নামলেন। জেটিতে এসে শোনা গেলো আগের দিন রাত্রেই কনাটিক বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছে। ফগ একথা শুনে শুধু তার স্বাভাবিক গলায় আউদাকে বললেন : এ নিয়ে অযথা বিচলিত হবেন না আপনি। মোটেই হতাশ হবেন না। ইচ্ছে থাকলে একটা উপায় হবেই হবে।

ফিল্ম ওদের কাছে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে সব দেখছিলেন। এবার তিনি ফগের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আপনিই তো কাল আমাদের সঙ্গে রেঙ্গুনে করে এসেছেন, না?

ফগ বললেন : হা-কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…

মাপ করবেন, ভেবেছিলুম পাসপার্তুকেও আপনাদের সঙ্গে দেখতে পাবো।

আউদা ব্যগ্রকণ্ঠে শুধোলেন : সে কোথায় আছে আপনি কি জানেন মিস্টার…

আমার নাম ফিক্স। অবাক হবার ভান করলেন তিনি। সে-কী? ও কি আপনাদের সঙ্গে আসেনি?

না। কাল থেকেই তো তার পাত্তা পাচ্ছিনে! আইদা বললেন : আমি ভাবছি সে কি কর্নাটিক জাহাজেই চলে গেলো?

ও কি আপনাদের ফেলে রেখেই চলে যাবে? মাপ করবেন—আপনারাও বুঝি ঐ জাহাজে যেতে চেয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

আমিও যাবো বলে মনে করছিলুম। জাহাজখানা হঠাৎ চলে যাওয়াতে বড় অসুবিধেয় পড়লুম। খবর নিয়ে শুনলুম, মেরামতের কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে বারোঘন্টা আগেই জাহাজটা হংকং ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখন তো হপ্তা-খানেকের মধ্যে আর জাহাজও পাওয়া যাবে না। দেখুন দেখি, কী মুশকিলেই না পড়লুম! ফিক্সের চোখে একটি ধূর্ত-কুটিল হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। একেই কি শয়তানের হাসি বলে? তিনি ভাবছিলেন, আর একহপ্তা—তার মধ্যেই ওয়ারেন্ট এসে পড়বে। তারপর ব্যাংককে গ্রেপ্তার করার গৌরব ও ইনাম তারই ওপর বর্তাবে। আর ভয় কীসের!

কিন্তু ফগ যখন তার স্বাভাবিক শান্তগলায় বললেন, কর্নাটিক ছাড়াও তো হংকং বন্দরে আরো-অনেক জাহাজ রয়েছে, তখন সে-যে কী তিনি রকম আঘাত পেলেন, পাঠক তা নিশ্চয়ই সহজে অনুমান করতে পারছেন। ফগ আর কালবিলম্ব না-করে আউদাকে নিয়ে জাহাজগুলোর পানে চললেন। ফিক্স চক্ষু ছানাবড়া করে অবাক হয়ে। তাদের অনুসরণ করলেন। কিন্তু ফিক্সের উপরই বোধহয় অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন, নইলে ঘুরতেঘুরতে ঘণ্টা-তিনেক কেটে গেলো, কিন্তু এতগুলো জাহাজের মধ্যে কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেনই ইয়োকোহামা যেতে রাজি হলো না। ফিক্সের মুখে ফের সেই ধূর্ত-কুটিল হাসিটা ফুটে উঠলো।

কিন্তু ফিলিয়াস ফগ নাছোড়বান্দা। তিনি তখনও জাহাজ-ঘাটায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। পথে এক জাহাজির সঙ্গে দেখা। জাহাজি শুধোলে : সাহেব কি বিশেষ কোনো জাহাজের খোঁজ করছেন?

এক্ষুনি ছাড়তে পারে এমন কোনো স্টীম-বোটের কথা কি জানা আছে তোমার?

আছে, সাহেব। তেতাল্লিশ নম্বর পাইলট-বোটই আমার। এ-বছরে ওর চেয়ে ভালো নৌকো আর এ-তল্লাটে পাবেন না।

খুব স্পীডে যেতে পারবে তো?

ঘণ্টায় আট-ন মাইল করে চলে, সাহেব। আসুন-না, একবার চাক্ষুষ দেখবেন। দেখলেই আপনার পছন্দ হবে, সাহেব। সমুদ্রের মাঝে একটু বেড়ানো-টেড়ানোর জন্যেই বুঝি নৌকোটা চাই?

ঠিক তা নয়। এই, ধরো, সমুদ্রে পাড়ি দেয়া আর-কী! আমি ইয়োকোহামা যেতে চাই, অবিশ্যি তুমি রাজি হলে।

নাবিক হতভম্ব হয়ে ফগের পানে তাকালে। আপনি তামাশা করছেন না তো? একটা পাইলট-বোট নিয়ে ইয়োকোহামা?

তামাশা? না-না, তামাশা কেন? আমি কশাটিক জাহাজ ধরতে পারিনি। অথচ চোদ্দ তারিখের মধ্যে আমাকে ইয়োকোহামা পৌঁছুতেই হবে, দেরি হলে চলবে না। সেখানে গিয়ে আমাকে সান-ফ্রান্সিসকোর জাহাজ ধরতে হবে কি-না।

খুব দুঃখিত হলাম, সাহেব, কিন্তু, সে অসম্ভব?

আমি দিনে একশো পাউণ্ড করে ভাড়া দেবো। ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারলে আরো দুশো পাউণ্ড বখশিশ পাবে।

আপনি কি সত্যিই যাবেন, সাহেব? নাৰিকটি জিগেস করলে।

ফিলিয়াস ফগ উত্তর করলেন : নিশ্চয়ই যাবো।

নাবিক একবার আকাশের দিকে তাকালে, তারপর আবার তাকালে সেই নিঃসীম সমুদ্রের দিকে। শেষে দোটানায় পড়ে ভাবতে-ভাবতে পায়চারি করতে লাগলো : একদিকে অতগুলো টাকা, অন্যদিকে জীবনের আশঙ্কা! জীবন যদি নাও যায়, নৌকোটা বেঘোরে খোয়াবার ভয়।

ফিক্স তো ব্যাপার-স্যাপার দেখে একেবারে থ! এই বুঝি গেলো সর্বনাশ হয়ে।

ফিলিয়াস ফগ আউদার দিকে তাকালেন। ছোট্ট নৌকো আপনার ভয় করবে না তো?

না। আপনার সঙ্গে যেতে আর ভয় কীসের?

অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে নাবিক বললে : আমার ছোটো নৌকো, অত-দূর পাড়ি দিতে তাই সাহস করিনে—বিশেষ করে এই ঝড়-তুফানের সময়। সকলেরই প্রাণ যেতে পারে বেঘোরে। তাছাড়া ইয়োকোহামাও তো এখান থেকে কম-দূর নয়—যোলোশো মাইল। সময়-মতো বোধহয় পৌঁছুনোও যাবে না। তবে এক কাজ করা যেতে পারে। নাগাসিকি এখান থেকে এগারোশো মাইল, শাংহাই আটশো। শাংহাই পৌঁছুলে আমরা তীরের কাছ দিয়েই যেতে পারবো, স্রোতের টানটাও পাবো।

কিন্তু, আমাকে যে ইয়োকোহামার আমেরিকার ডাক-জাহাজ ধরতে হবে!

বেশ-ত, তা-ই হবে। সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ তো আর ইয়োকোহামা থেকে ছাড়ে না—শাংহাই থেকেই ছাড়ে। যেতে-যেতে ইয়োকোহামা আর নাগাসিকিতে দাঁড়ায়।

তুমি ঠিক জানো তো?

ঠিক জানি। এগারোই নভেম্বর সন্ধ্যাবেলা শাংহাই থেকে জাহাজ ছাড়বে। তাহলে চারদিন সময় আছে হাতে-মানে, ছিয়ানব্বই ঘণ্টা। যদি ঘণ্টায় আট মাইল করে যেতে পারি আর অনুকূল হাওয়া থাকে, তবে ঠিক সময়েই শাংহাই পৌঁছুতে পারবো।

ফিক্সের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। ঘটনাস্রোত এবার যেভাবে যেদিকটায় মোড় নিচ্ছে, তাতে দস্যুকে পাকড়াও করবার তো আর কোনো সুযোগই নেই!

ফগ নাবিকটিকে শুধোলেন : তোমরা কখন রওনা হতে পারবে?

একঘণ্টার মধ্যেই। কিছু খাবার কিনে নৌকোর পালটা বাঁধবো-এই-যা দেরি।

তবে এই কথাই রইলো। তোমারই তো নৌকো? হ্যাঁ, আমারই নৌকো। আমার নাম জন বুবি, নৌকোর নাম তংকাদিরি।

এই নাও, তোমার সুবিধের জন্যে দু-শো পাউণ্ড আগাম দিচ্ছি। ফগ নাবিকের হাতে একতাড়া নোট গুঁজে দিলেন। ফিক্স কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে

ফগ বললেন : আপনি যদি ইচ্ছে করেন, তবে–

অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। আমিই আপনার কাছে কথাটা পাড়বো বলে মনে করেছিলুম।

তাহলে আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের তৈরি হয়ে নিতে হবে।

আউদা বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন : কিন্তু পাসপার্তুর যে কী হলো—

তাকে আশ্বস্ত করলেন ফগ। আমার যা সাধ্য, তা আমি করবো।

পুলিশ-আপিশে গিয়ে পাসপার্তুর চেহারা বর্ণনা করে তার অনুসন্ধানের খরচ ও বিলেতে ফিরে আসবার জন্যে কিছু টাকা জমা রেখে এলেন ফগ।

বেলা তিনটের সময় সমুদ্রে পাড়ি দেয়ার জন্যে তৈরি হলো তংকাদিরি। ছোটোখাটো নৌকো হলেও খুব-মজবুত আর দ্রুতগামী। বুনসবির অধীনে আরো-চারজন নাবিক ছিলো। বুবি বেশ দৃঢ়-গঠন, অত্যুৎসাহী ও সুদক্ষ নাবিক! তংকাদিরির জন্যে তার একটা অহংকার ছিলো।

ফগ আর আউদা মালপত্র নিয়ে নৌকোয় উঠলেন। ফিক্স আগেই এসে হাজির হয়েছিলেন। তাকে দেখে ফগ বললেন : আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এ-নৌকোয় আপনার থাকার কোনো ভালো বন্দোবস্ত করতে পারছিনে। চোখ-কান বুজে কোনোরকমে এরই মধ্যে কাটিয়ে দিতে হবে।

ফিল্ম মনে-মনে একটু লজ্জা পেলেন। দস্যুর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বলে নিজের কাছেই নিজেকে বড়ো খাটো বলে মনে হলো তার। মনে-মনে ভাবলেন : লোকটা। দই হোক, আর–ই হোক, খুব বিনয়ী আর ভদ্র। প্রতিমুহূর্তেই তার আশঙ্কা হতে লাগলো, যদি হঠাৎ পাসপার্তু এসে হাজির হয়, তবেই সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কিন্তু ফিক্সের বরাত ভালো। পাসপার্তুর কোনো পাত্তাই নেই। নোঙর তুলে দেখতেদেখতে তংকাদিরি বন্দর ছেড়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো, নীল দরিয়ার জল কেটে কেটে।

অমন-একটা ছোটো নৌকোয় করে সেই ঝড়-তুফানের সময় আটশো মাইল সমুদ্রপাড়ি দেয়া নিঃসন্দেহে খুব বিপজ্জনক ছিলো। জন বুনসবি টাকার লোভে আর ফিলিয়াস ফগ বাজি জেতবার জন্যে সে-বিপদ গ্রাহ্যই করলেন না। ফগের কথার জবাবে বুবি একবার শুধু বললে : আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। বুনসবির ওপর আপনি নির্ভর করতে পারেন। আমার যথাসাধ্য আমি করবো।

তাংকাদিরি বেশ দ্রুতবেগেই চলতে লাগলো। ফগ নোকোয় বসে সেই অথৈ অকূল সাগরের এলোমেলো উথালপাথাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আউদা সেই সীমাহীন সমুদ্রের পানে তাকিয়ে একটু ভয় পেলেও মুখে বা হাবেভাবে তা প্রকাশ করলেন না।

একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। এদিকে আকাশেও তখন অল্প-অল্প কালো মেঘ জমছিলো। প্রবল বেগে হাওয়া বইলো। তবু তংকাদিরি দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে দেখে ফগ একটু আশ্বস্ত হলেন। পুরস্কারের লোভে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো নাবিকেরা।

প্রথম দু-দিন ভালোভাবেই কেটে গেলো, কিন্তু তৃতীয় দিন ভোর থেকেই আকাশের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠলো। বিপুল উচ্ছ্বাসে ফুসে উঠলো দক্ষিণদিকের সমুদ্র। বুবি ভালো করে চারদিক দেখে ফগকে বললে : আমার আশঙ্কা হচ্ছে এক্ষুনি সাংঘাতিক ঝড় শুরু হবে। মনে হচ্ছে দক্ষিণদিক থেকেই আসবে ঝড়–একটা ঘূর্ণি-বাতাস আসছে।

ভালোই হলো। দক্ষিণের ঝড়ে আরো-দ্রুত যাওয়া যাবে উত্তরদিকে।

আপনি যদি এ-কথা বলেন, তবে আমার আর কিছু বলবার নেই।

শেষটায় বুনসবির আশঙ্কাই সত্যি হয়ে উঠলো। রাত আটটার সময় দক্ষিণদিক থেকে সাংঘাতিক ঝড় ছুটে এলো সমুদ্র উথালপাথাল করে। যেমন ভীষণ ঝড়, তেমনি মুষলধারে বৃষ্টি। রাগে খেপে উঠলো সমুদ্র। প্রচণ্ড ঝড় তংকাদিরির ঝুঁটি ধরে নাড়াতে লাগলো। যেন দুরন্ত আক্রোশে একটা ক্রুদ্ধ বাঘ শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে! রব উঠলো, শামাল, শামাল? কিন্তু আশ্চর্য বলতে হবে বুবির নৌকা-চালানোর দক্ষতা। এই সাংঘাতিক ঝড়ে তংকাদিরি এ-কাৎ ও-কাৎ হলো বটে, কিন্তু ড়ুবলো না, ঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যে তীরের মতো ছুটে চললো সামনের দিকে।

ফিক্স আকাশের অবস্থা দেখে মনে-মনে ভাবছিলেন, কেন যে মরতে এই খ্যাপা দস্যুটার সঙ্গে এলাম! না-এলেই ভালো ছিলো! আউদা খুব ভয় পেলেও ফিলিয়াস ফগের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকে সাহস আনবার চেষ্টা করছিলেন। আর ফগ ভাবছিলেন, এমন না-হলে নৌকো এত দ্রুত যেতো কী করে! ঝড় তো আমার উপকারই করছে।

এতক্ষণ ঝড়ের বেগ ছিলো উত্তরদিকে, এবার হলো উত্তর-পশ্চিমে। ঝড়ের তাণ্ডব এত বেড়ে গেলো যে বুনবি অন্যান্য নাবিকের সঙ্গে পরামর্শ করে ফাকে জানালে : আমার মনে হয় কাছাকাছি কোনো বন্দরের দিকে না-গেলে সাংঘতিক বিপদ ঘটবে।

আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।

কোন বন্দরের দিকে যাবো তবে?

আমি তো শুধু একটাই চিনি।

সেটার নাম কী।

শাংহাই।

জবাব শুনে বুনসবি স্তম্ভিত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। তারপর বললে : বেশ। তা-ই হবে। আমরা শাংহাই বন্দরেই যাবো।

তংকাদিরি যেমন চলছিলো, তেমনি এগুতে লাগলো। রাত ঘন হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো তুফান। এমন দুর্যোগ বোধহয় কেউ আরকখনও দ্যাখেনি! সমুদ্রের সে-কী আক্রোশ, সে-কী পাখসাট! তংকাদিরি যে কেন ড়ুবলো না, সে-ই আশ্চর্য!

তংকাদিরি দু-বার ড়ুবতে-ড়ুবতে বেঁচে গেলো বটে, কিন্তু নৌকোর মাস্তুল, ছাদ ইত্যাদি সবই উড়ে গেলো। সকালের দিকে হাওয়ার বেগ কিছু কমলো বটে, কিন্তু এবার হাওয়া বইতে লাগলো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। নৌকো প্রতিকূল হাওয়া কেটে চালানো বিষম কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। দুপুরবেলার দিকে কিন্তু আচমকা থেমে গেলো তুফান, আকাশ হলো অনাবিল নীল। বুনসবি শুধু হিশেব করে দেখলো শাংহাই তখনও প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে। হাতে প্রায় ছ-ঘণ্টা সময় আছে। এই পঞ্চাশ মাইল ছ-ঘণ্টায় পেরুতে না-পারলে জাহাজ ধরা অসম্ভব। বুনসবি চিন্তিত হয়ে পড়লো।

এদিকে সমুদ্র তখন নিস্তরঙ্গ। হাওয়ার কোনো চিহ্নই নেই। পালে আর হাওয়া লাগে। শাংহাই তখনও পঁয়তাল্লিশ মাইল দুরে, আর হাতে মাত্র পাঁচঘণ্টা সময়!

হাওয়া, হাওয়া—একটু হাওয়া! কাল এত ঝড় বয়েছিলো, হাওয়া ছিলো তীব্রতম, আজ আর কি তার এককণাও থাকতে নেই। তংকাদিরির গতি হলো অত্যন্ত শ্লথ। ফিলিয়াস ফগের যথাসর্বস্ব নির্ভর করছে তংকাদিরির উপর। কিন্তু ফগ নির্বিকারভাবে চুপ করে বসে রইলেন।

দেখতে-দেখতে বাজলো সন্ধ্যা ছ-টা। সূর্য ড়ুবলো দিগন্তের সমুদ্রে। শাংহাই তখনও তিন মাইলের পথ। বুনসবি আর্তনাদ করে উঠলো, আর হলো না! পুরস্কার পেয়েও হারালুম! কাতর চোখে সে তাকালে ফগের দিকে। ফগ নিরুদ্বেগ নির্বিকার চোখে বুনসবির দিকে তাকালেন।

অনতিদূরে দেখা গেলো একটা জাহাজের চোঙ-ভলকে-ভলকে ধোঁয়া উঠছে সেই চোঙ দিয়ে। জাহাজ দেখেই চিনতে পারলো বুনবি। আমেরিকাগামী জাহাজ। সে রোষেক্ষোভে বলে উঠলো : জাহাজ অথৈ জলে ড়ুবে যাক!

ফগ শান্তগলায় বললেন : সংকেত করে সাহায্য চেয়ে জাহাজ ডাকো।

কুয়াশার মধ্যে সংকেত করবার জন্যে তংকাদিরিতে পেতলের-যে কামানটা ছিলো, ক্ষিপ্রহাতে বারুদ ঢেলে তার নল ভরে তুললো বুনসবি। মাস্তুলে বিপদজ্ঞাপক সাংকেতিক নিশান তুলে বারুদে আগুন দিলে সে।

তংকাদিরির ছোট্ট পেতলের কামান সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ শান্তিকে ভেঙেচুরে গর্জন করে উঠলো।