১৫. সোনার সিন্দুক

সোনার সিন্দুক

ক্যাপ্টেন নেমো যে কেমন লোক, বোঝ শক্ত। এই বেশ হাসিখুশি, তারপরেই আবার গম্ভীর ও নিজের মধ্যে তন্ময়। যেমন চোদ্দোই ফেব্রুআরিতে তাকে দেখলুম তার সেলুনে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। তার সেই ব্যাকুল, গম্ভীর ও সমাহিত মৃতি দেখে কোনো কথা বলা সংগত বোধ করলুম না। নটিলাস তখন গ্রীসের সমুদ্রে, ক্রীট দ্বীপের পাশে রয়েছে। আর সেই জন্যই হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছিলো। আমি যখন আব্রাহাম লিঙ্কন-এ আমেরিকা ত্যাগ করে অতিকায় সিন্ধুদানবের বিরুদ্ধে অভিযানে বেরোই, তখন ক্রীটের বাসিন্দারা তুর্কি শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। এই বিদ্রোহ কি আদৌ সফল হয়েছে, না কি তা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে, তা আমি জানতুম না। সেদিন ক্যাপ্টেন নেমোকে দেখেই কেন যেন এই বিদ্রোহের ফলাফল জানবার জন্য কৌতূহল বোধ করলুম। কিন্তু তার ওই গম্ভীর মূর্তি দেখে কোনো প্রশ্ন জিগেস করার সাহস আর হলো না।

মানুষটিকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি, ততই আমার মূল ধরে টান দিচ্ছেন তিনি। গোপন সাধক বলে মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁকে-যেন লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো-এক দুর তপশ্চর্যায় লিপ্ত। যুগপৎ সারল্য আর জটিলতার প্রতীক–যাবতীয় বিরোধের সমন্বয়েই যেন তার আশ্চর্য অস্মিতা গড়ে উঠেছে। আমার পরিচিত কোন লোকের সঙ্গেই তার কিছু মেলে না, কোন কিছু না।

হঠাৎ উঠে গিয়ে একটি জানলা খুলে বাইরের চঞ্চল জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন নেমো, আর ওই জলের পাশে তাঁকে দণ্ডায়মান দেখে আমার হঠাৎ মনে হলো একমাত্র সমুদ্রের সঙ্গেই বুঝি তার তুলনা হতে পারে। সমুদ্রের মততই অতলস্পর্শী তার ব্যক্তিত্ব—তেমনি রহস্যময় ও জটিল; তেমনি চঞ্চল অধীর ও ক্ষিপ্র, তেমনি শান্ত সুনীল ও দিগন্তচুম্বী; সমুদ্রের মতোই যেন হিংস্র, সমুদ্রের মতোই যেন প্রবল, আবার সমুদ্রের মতোই স্নিগ্ধ-সুষমায় সমাকুল।

হঠাৎ পাশের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি জলের মধ্যে একজন ডুবুরি নেমে এসেছে। প্রবল বেগে সাতার কাটছিলো লোকটি, আবার মাঝে-মাঝে নিশ্বাস নেবার জন্যে ভেসে উঠছিলো জলের উপর। তারপরেই আবার ডুব দিয়ে নেমে আসছিলো জানলার কাছে।

ক্যাপ্টেন নেমো দাড়িয়েছিলেন অন্য একটি জানলার কাছে। আমার চিৎকার শুনে এই জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ডুবুরিটি আরো কাছে এগিয়ে এলো। অবাক হয়ে লক্ষ করলুম, জানলার এ-পাশ থেকে হাত তুলে কী-একটা ইঙ্গিত করলেন ক্যাপ্টেন, উত্তরে লোকটা হাত নেড়ে উপরে উঠে গেলো-আর ফিরে এলো না। এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন, বললেন, ভয় পাবেন না। ও হচ্ছে মাটাপান অন্তরীপের নিকোলাস-যদিও সবাই ওকে পেসকে বা মাছ বলে ডাকে। আশপাশের সব কটা দ্বীপ ওর চেনা। অমন সাহসী ডুবুরি বোধহয় আর নেই।

আপনি ওকে চেনেন, ক্যাপ্টেন? কেন চিনবো না, মঁসিয় আরোনা?

এই কথা বলে ঘরের এক কোনায় গিয়ে একটা মস্ত সিন্দুকের ডালা খুললেন ক্যাপ্টেন নেমো। ডালার উপর তামার পাতে নটিলাস-এর নাম লেখা, আর লেখা তার মূলমন্ত্র, চলার মধ্যে চলা। (Mobilis in Mobili.)

সিন্দুকটার ভিতরে রাশি-রাশি সোনার ডেলা সাজানো। এত সোনা তিনি পেলেন কোত্থেকে? তা ছাড়া এখন এত সোনা দিয়ে কীই বা করবেন তিনি?

কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে দেখলুম একটা-একটা করে সোনার ডেলা তুলে তিনি একটি বাক্সে বোঝাই করতে লাগলেন। যখন পুরো বাটা বোঝাই হয়ে গেলো তখন শক্ত তালা লাগিয়ে বাক্সটার উপর আধুনিক গ্রীক হরফে কার যেন ঠিকানা লিখলেন তিনি। তারপর একটা হাতল ধোরাতেই বাইরে ঘুষ্টির আওয়াজ হলো, অমনি চারজন অনুচর এসে অতি কষ্টে বাক্সটাকে টেনে-টেনে সেলুনের বাইরে নিয়ে গেলো। তারপরে কপিকল দিয়ে বাক্সটাকে লোহার সিঁড়ি দিয়ে টেনে তোলার শব্দও পেলুম।

এতক্ষণ পরে বোধহয় হঠাৎ আমাকে নেমোর মনে পড়লো। আপনি কিছু বলছিলেন, প্রফেসর?

কই, না তো।

তাহলে শুভরাত্রি রইলো।

ক্যাপ্টেন নেমো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমিও অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলুম। ওই ডুবুরিটির ইঙ্গিত আর বাক্সভতি সোনার ডেলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, ভাবতে লাগলুম আমি। অনেক রাত্রেও আমি যখন জেগে-জেগে এসম্বন্ধে নানা কথা ভাবছি, তখন নানা আন্দোলন ও আওয়াজ শুনে বুঝলুম নটিলাস ধীরে-ধীরে জলের উপর ভেসে উঠলো। তারপরে প্ল্যাটফর্মে অনেক পায়ের শব্দ শোনা গেলো। আওয়াজ শুনে বুঝলুম নৌকো নামানো হলো সমুদ্রে।

ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার প্ল্যাটফর্মে নৌকো টেনে-তোলার শব্দ শোনা গেলো। নটিলাস আবার জলের তলায় ডুব দিলে।

শোনা তাহলে যথা-ঠিকানায় পৌঁছে গেলো? কোন সে ঠিকানা? কার কাছে এত সোনা পাঠালেন ক্যাপ্টেন নেমো?

হিংটিংছট প্রশ্নের মতো এই সব কথা ভাবতে-ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, জানি না। সকালে উঠে দেখি আমরা গ্রীসের উপকূল পিছনে ফেলে এসেছি।

যে প্রবল বেগে নটিলাস ভূমধ্য সাগর পেরিয়ে এলো, তাতে মনে হলো ক্যাপ্টেন নেমো কোনো কারণে বোধহয় এই অঞ্চলকে পছন্দ করেন না। হয়তো সমুদ্রের এই অঞ্চলে অনেক দুঃখের স্মৃতি জড়ানো আছে, তাই নটিলাস-এর গতি তিনি মন্থর করতে চাননি। শুধু সিসিলির কাছে একটু সময় বোপাহাড়ের প্রাচুর্যের জন্য মন্থর হয়েছিলো গতি, তারপর আবার জিবরাল্টার প্রণালীতে পড়েই গতি অনেক বৃদ্ধি পেলে। যাবার সময় কেবল চকিতে একটুক্ষণের জন্য দেখা গেলো হারকিউলিসের সেই প্রাচীন মন্দির, এখন যা সিন্ধুতলের শ্যাওলায় সমাকীর্ণ। আর

তারপরেই আমরা অতলান্তিক মহাসাগরে এসে পৌঁছোলুম।