২.২১ সারারাত ঘুম হয়নি তার

সারারাত ঘুম হয়নি তার। ভোরের ঘন্টা দুয়েক আগে পাশে শোয়া আরেক ছেলেকে জাগিয়ে ফাতিমার থাকার জায়গার কথা জিজ্ঞেস করে।

ফাতিমার তাবুর কাছে যাবার পর ছেলেটাকে সোনার একটা টুকরা দেয়, যা দিয়ে অবলীলায় কিনে ফেলা যাবে একটা ভেড়া।

এবার যেতে বলে ফাতিমার তাবুতে। তাকে জাগাতে হবে। বলতে হবে বাইরে অপেক্ষা করছে সান্তিয়াগো। আবার কথামত কাজ করে তরুণ আরব। আবার তাকে আরো একটা ভেড়া কেনার মত টাকা দেয় ছেলেটা।

এবার আমাদের একা থাকতে দাও।

চলে যায় ছেলেটা। গর্বে বুক ফুলে উঠেছে, কারণ সে উপদেষ্টাকে সাহায্য করেছে। কারণ সে পেয়েছে কয়েকটা ভেড়া কিনে নেয়ার মত স্বর্ণ।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ফাতিমা। দুজনে মিলে চলে যায় খেজুর বাগানের কাছে। সান্তিয়াগো জানে, নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। হোক। এখন এসবে কিছু এসে যায় না।

চলে যাচ্ছি, বলে সে অবশেষে, তোমাকে জানিয়ে রাখি, ফিরে আসব। আর ভালবাসি কারণ…

কোন কথা বলোনা। কেউ ভালবাসা পায় কারণ সে ভালবাসা পায়। ভালবাসার জন্য কোন কারণ দর্শানোর দরকার নেই।

কিন্তু একগুয়ের মত বলেই চলেছে ছেলেটা, স্বপ্নের পর দেখা হল এক রাজার সাথে। তারপর বিকিকিনি করেছি অনেক স্ফটিক, পেরিয়ে এসেছি তেপান্তর। তারপর যুদ্ধ ঘোষণা করল গোত্রগুলো। আমি এ্যালকেমিস্টের খোঁজে সব চষে ফেলে অবশেষে গেলাম কুয়ার ধারে। আর, তোমাকে ভালবাসি কারণ পুরো সৃষ্টি জগত ফিসফিস করে। ফিসফিস করে তোমাকে আমার করে পাইয়ে দিতে।

জড়িয়ে ধরে তারা পরস্পরকে। এই প্রথম স্পর্শ করল।

ফিরে আসব কিছু! বলে ছেলেটা।

এর আগে আমি শূণ্য অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম মরুর দিকে। বলে ফাতিমা, এখন সেখানে থাকবে আশা। বাবাও চলে গিয়েছিল একদিন। তারপর ফিরে এসেছিল মায়ের কাছে। তারপর যতবার গেছে ততবারই ফিরে এসেছে।

আর কোন কথা নেই। দুজনেই ঘুরে বেড়ায় গাছের নিচে। তারপর ছেলেটা ফাতিয়াকে এগিয়ে দেয় তাবুর কাছে।

ফিরে আসব আমি। ফিরে আসব তোমার বাবা যেমন তোমার মায়ের কাছে ফিরে এসেছিলেন, সেভাবে। বলে সান্তিয়াগো।

তারপর চাঁদের জ্ঞান আলোয় সে দেখে, ফাতিমার চোখে অশ্রু। তুমি কাদছ?

আমি মরুর দেশের মেয়ে, চোখ মুছতে মুছতে বলে সে, এবং আমি একটা মেয়ে।

পরদিন পানি আনতে গিয়েছিল ফাতিমা। সেখানে কেউ অপেক্ষা করছে না। এখানে আছে পঞ্চাশ হাজার গাছ। আছে তিনশ কুয়া। আছে হজযাত্রিদের আনাগোনা, ব্যবসার ব্যস্ততা, যুদ্ধের ডামাডােল। সব আছে, তবু শূণ্য মনে হচ্ছে এই মরুদ্যানটাকে।

এখন থেকে মরুভূমির দিকে তাকানোর পালা। তাকানোর পালা আকাশের দিকে। কোন তারাটা অনুসরণ করবে সান্তিয়াগো? সে অপেক্ষা করছে। এক নারী অপেক্ষা করছে তার সাহসি পুরুষের জন্য।

 

২.২২

পিছনে ফেলে আসা কোন ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না। ঘোড়ার পিঠে চড়া শুরু করার সময় বলে উঠেছিল এ্যালকেমিস্ট, ভুবনের রুহে সব লেখা আছে। থাকবে সব সময়ের জন্য।

লোকে কিন্তু চলে যাবার কথা বেশি ভাবে না, ভাবে ঘরে ফেরার কথা।

কেউ যদি খাটি পদার্থে তৈরি কিছু পায়, তা কখনো ক্ষয়ে যাবে না। যে কোন কিছু সব সময় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সে ফিরে আসাটা কোন বেশে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

লোকটা এ্যালকেমির ভাষায় কথা বললেও যা বোঝার বুঝে নেয় ছেলেটা।

পিছনে ফেলে আসা ব্যাপারগুলো ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। মরুদ্যানে অনেক কিছু ফেলে এসেছে সে। অনেককে। হয়ত এ এ্যালকেমিস্ট কখনো ভালবাসেনি, ভাবে ছেলেটা।

সামনে চড়ে বসে এ্যালকেমিস্ট। কাধে তার পুরনো বন্ধু বাজপাখি। মরুর ভাষা ভালই বোঝে বাজটা। একটু থামলেই এক চক্কর ঘুরে আসে চারধারে। প্রথমদিন এনেছিল একটা ইদুর। পরদিন একজোড়া পাখি।

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সাবধানে আগুন নিভিয়ে দেয় তারা, হোক শীত, থাকুক চাঁদ ক্ষীণ হয়ে যাবার ফলে আসা অন্ধকার। দিনের বেলায় চলে টগবগিয়ে। কথা বলে শুধু যুদ্ধ এড়িয়ে কীভাবে যাওয়া যায় সে বিষয়ে। সামনে চুলার সময় বাতাসে ভর করে ভেসে আসে রক্তের মিষ্টি গন্ধ। ধারেকাছেই কোথাও যুদ্ধ হয়েছিল। এসবই লক্ষণ।

সপ্তম দিনের কথা। এ্যালকেমিস্ট আগেভাগেই আজকের মত থেমে যাবার বন্দোবস্ত করতে চায়। বাজপাখি উড়ে যাবার পর নিজের ভাগ থেকে ছেলেটাকে একটু পানি সাধে সে।

তোমার যাত্রার শেষপ্রান্তে চলে এসেছ, এ্যালকেমিস্ট বলছে, লক্ষ্যের পিছুধাওয়া করায় অভিনন্দন।

কিন্তু সারা পথে আমাকে কিছুই বলোনি তুমি। আমি মনে করেছিলাম রসায়নের কিছু কিছু ব্যাপার শিখাবে। কিছুদিন আগে এ্যালকেমির উপর তাল তাল বই আছে এমন এক লোকের সাথে মরুভূমি পার হয়েছিলাম। কিন্তু বই দেখে কিছু বুঝিনি।

শিখার একটাই পথ, জবাব দেয় এ্যালকেমিস্ট, কাজের মাধ্যমে। যাত্রাপথে যা জানার সব জেনে গেছ। আর একটা ব্যাপার বাকি।

ছেলেটা উসখুস করছে জানার জন্য। এদিকে এ্যালকেমিস্ট তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তে, বাজপাখির খোঁজে।

তোমাকে এ্যালকেমিস্ট বলে কেন লোকে?

কারণ আমি তাই।

তাহলে আর সব এ্যালকেমিস্ট কেন সোনা বানাতে পারে না?

তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য স্বর্ণ, জবাব দিল সফরসঙ্গি, তারা তাদের লক্ষ্যের গুপ্তধন খুজে যাচ্ছে, লক্ষ্য নিয়ে বাচার চেষ্টা করছে না।

আমার আর কী জানা এখনো বাকি? কথা তোলে ছেলেটা।

কিন্তু দিগন্তে তাকিয়ে আছে এলকেমিস্ট। ফিরে আসছে পাখিটা শিকার নিয়ে। তারা মরুর বুকে গর্ত খোড়ে। তারপর সেখানে আগুন জ্বালায় যাতে বাইরে থেকে শিখা না দেখা যায়।

আমি একজন এ্যালকেমিস্ট, কারণ আমি এ্যালকেমিস্ট। বিজ্ঞানটা শিখেছিলাম দাদার কাছে, সে শিখেছিল তার বাবার কাছে। এভাবে চলে গেছে ভুবন সৃষ্টির শুরুতে। তখনকার দিনে মাস্টার ওয়ার্কের কথা লেখা যেত শুধু এ্যামারাল্ডের বুকে। কিন্তু মানুষ সরল ব্যাপারগুলোকে বাদ দিয়ে লেখা শুরু করল বিস্তারিত। শুরু করল অনুবাদ, দর্শন। তারা মনে করতে শুরু করল, অন্যদের থেকে ভাল জানে। এদিকে সেই আসল এ্যামার কিন্তু নষ্ট হয়নি।

এ্যামারাল্ডে কী লেখা ছিল?

সাথে সাথে বালিতে আকা শুরু করল এ্যালকেমিস্ট। কাজটা ফুরিয়ে যায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। এ অঙ্কন দেখে ছেলেটার মনে পড়ে সেই নগর চত্বরের কথা, মনে পড়ে রাজার কথা। যেন কত যুগ আগের ঘটনা!

এটুকুই লেখা ছিল এ্যামারাল্ডে।

সাথে সাথে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করে সান্তিয়াগো।

এটাতো কোড! অখুশি হয় সে, এমনি একটা লেখা ছিল ইংরেজ লোকটার বইয়ে।

না। জবাব দেয় এলকেমিস্ট, এ হল ঐ শিকারি পাখি দুটার উড়ে যাবার মত। শুধু কারণ দিয়ে বোঝা যাবে না। সেই এ্যামারাল্ডের টুকরা আসলে ভুবনের আত্মার প্রতি সোজা এক পথ।

জ্ঞানী লোকটা বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে এ প্রাকৃতিক পৃথিবী স্বর্গের প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছু নয়। এ ভুবনের অস্তিত্বের মানে এমন কোন ভুবন আছে যা একেবারে নিখুত। ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এজন্য যে, এর দৃশ্যমান জিনিসের ভিতর দিয়ে মানুষ আসলে তার আত্মিক শিক্ষা আর অসাধারণ সৃষ্টির ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আমি আসলে ঠিক সে ব্যাপারটাই বোঝাতে চাচ্ছি।

আমার কি এ্যামারল্ডের টুকরাটা বোঝা উচিত?

হয়ত। তুমি এ্যালকেমির ল্যাবরেটরিতে থাকলে পারা উচিত ছিল, তাহলে ঠিক এখন তুমি বুঝে যেতে এ্যামারাল্ডের গৃঢ় তত্ত্ব। কিন্তু তুমিতো সেখানে নেই। আছ মরুভূমিতে। আর মরুভূমির বুকেও লুকিয়ে আছে সেটা। তোমাকে পুরো মরুভূমি ছানতে হবে না। স্রেফ একটা বালুকণা নাও। তারপর সেটাকে বিশ্লেষণ কর। সৃষ্টির বিস্ময় চিনে ফেলবে এক পলকে।

আমি মরুভূমির বুকে নিজেকে মানিয়ে নিব কী করে?

তোমার হৃদয়ের কথা শোন। সে সব জানে, কারণ, এসেছে ভুবনের আত্মার কাছ থেকে। একদিন ফিরে যাবে সেখানেই।

 

২.২৩

নিরবে আরো দুদিন তারা এগিয়ে যায়। এখন খুব সাবধান থাকে এ্যালকেমিস্ট। সর্বক্ষণ চোখকান খোলা রাখে। এ এলাকায় সবচে ভয়ানক যুদ্ধগুলো হচ্ছে।

এগিয়ে যাবার সাথে সাথে হৃদয়ের কথা শোনার চেষ্টা করে ছেলেটা।

কাজটা মোটেও সহজ নয়, আগেকার দিনে হৃদয় সব সময় কাহিনী। শোনাতে প্রস্তুত ছিল, পরে আর সে কথা খাটে না। মাঝে মাঝে হৃদয় শুধু দুঃখের কথা শোনায়। কখনো কখনো মরুভূমিতে সূর্যোদয়ের সময় ছেলেটাকে সাবধানে চোখের পানি লুকাতে হয়।

কষ্টের সময় হৃদপিন্ড ধ্বক ধ্বক করে অনেক বেশি। শান্ত সময়ে থাকে শান্ত। কিন্তু সে কখনো চুপ করে থাকে না।

আমাদের কেন হৃদয়ের কথা শুনতে হবে? সেদিন ক্যাম্প করার সময় প্রশ্ন করে বসে ছেলেটা।

কারণ, হৃদয় যেখানে আছে সেখানেই পাবে গুপ্তধন।

কিন্তু হৃদয় তো আমার কথা শোনে না। কোন এক মরুদ্যানের কথা বলে। বলে কোন এক ফেলে আসা মেয়ের কথা।

ভালতো! তোমার হৃদয় বেচে আছে। শোনার চেষ্টা কর অষ্টপ্রহর।

পরের তিন দিনে দুজন সশস্ত্র মানুষের পাশ দিয়ে যায়। দূরপ্রান্তে দেখে আরেক দল। এখন ছেলেটার হৃদয় ভয়ের কথা বলছে। সে বলছে ভুবনের আত্মার কাছ থেকে জানা কথা। এমন সব লোকের কথা বলছে যারা গুপ্তধনের খোঁজে বেরিয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি; এমনকি সফলও হয়নি। অন্য সময় শোনায় তুষ্টির কথা। আনন্দের কথা।

আমার হৃদয় দেখি দারুণ বিশ্বাসঘাতক, এ্যালকেমিস্টকে উদ্দেশ্য করে গলা চড়ায় ছেলেটা ঘোড়াগুলোকে একটু বিশ্রাম দিতে থামার সময়, এগিয়ে যেতে দিতে চায় না।

বুঝতেই পারছ। সাফ জবাব এ্যালকেমিস্টের।

তাই বলে বেড়াচ্ছে যে তুমি স্বপ্নের পিছুধাওয়া করতে গিয়ে সব খুইয়ে বসতে পার।

তাহলে আমার মনের কথা শোনার দরকার কী?

কারণ আর কখনো তাকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবে না। চাও বা না চাও, সে তোমাকে নানা কথা বলেই যাবে। বলে যাবে তোমার মনের অবস্থার ব্যাপারে।

তার মানে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমাকে শুনে যেতে হবে?

বিশ্বাসঘাতকতা হঠাৎ করে আসে। তুমি যদি হৃদয়ের কথা শোন, তাহলে বুঝতে পারবে, সে কখনো তা করতে পারছে না। কারণ তুমি স্বপ্ন আর ইচ্ছার কথা জান, জান কী করে তা সত্যি করতে হয়।

হৃদয়ের কাছ থেকে কখনো চলে যেতে পারবে না বলেই যা বলছে শুনে যাওয়া ভাল। তখন অপ্রত্যাশিত আঘাতের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

এক বিকালে ছেলেটার হৃদয় জানিয়ে দেয়, সে সুখি। সাথে সাথে পিছুটান হয়ে পড়ে দুর্বল। মাঝে মাঝে আমি নানা অভাব অভিযোগ তুলি, বলে সেটা, কারণ আমি কোন একজনের হৃদয়। লোকে স্বপ্নের পিছুধাওয়া করতে চায় না কারণ সব মানুষের হৃদয় একই রকম। আর সে ভয় পায় বেশি। প্রিয়জনকে হারানোর ভয়। এদিকে স্বপ্নের পিছুধাওয়া না করলে সারা জীবনের জন্য তা তলিয়ে যেতে পারে বালির নিচে। তখন আমরা খুব ভুগি।

তাহলে, আমার হৃদয় ভোগান্তির ভয় পায়, সে চাঁদহীন নিকষ কালো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে এক রাতে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে এ্যালকেমিস্টকে।

হৃদয়কে জানিয়ে দাও, ভোগান্তির ভয় আসল ভোগান্তিরছে কষ্টকর। আর স্বপ্নের পথে কাজ করে যেগুলো, সেগুলোর কোন ভোগান্তি নেই, কারণ তারা প্রতি মুহূর্তে ঈশ্বর আর মহাকালের সাথে লেনদেন করে।

খোঁজ চালানোর সময় প্রতিটা মুহূর্ত আসলে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগের নামান্তর। নিজের হৃদয়কে বোঝায় ছেলেটা, সম্পদ পাবার কথা ভাবলে তখন মনে চলে আসে পাবার আশা। তাই থাকে অনেক আনন্দ।

সারা বিকাল চুপ করে থাকে হৃদয়। সে রাতে ভাল ঘুম হয় তার। ঘুম। থেকে জাগার পর ভুবনের আত্মা থেকে কথা এনে বলতে থাকে হৃদয়, মানুষ কাজ করতে থাকলে ঈশ্বর বসত করেন তার ভিতরেই। পৃথিবীর বুকে যত মানুষ আছে তাদের সবার জন্য আছে কোন না কোন গুপ্তধন। আমরা, মানুষের হৃদয়ের সেসব ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বলি না, কারণ লোকে আর সেসবের খোঁজে বের হবে না। ছেলেবেলায় তাদের সাথে কথা বলি। তারপর বেড়ে চলে বয়স, সেই সাথে বেড়ে যায় আমাদের চুপ করে থাকার সময়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খুব কম লোকই তাদের জন্য পাতা পথে পা বাড়ায়। বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৃথিবী হল হুমকির জায়গা, আর তাদের বিশ্বাসের কারণেই বেরিয়ে পড়ে জগতের বীভৎস সব রূপ।

আর তাই, আমরা, তাদের হৃদয়ের কথা বলি আরো আরো কোমল ভাষায়। কথা বন্ধ করতে পারি না, শুধু আশা করি, সেটা শোনা যাবে না।

তাহলে লোকের হৃদয় তাদের স্বপ্নের পথে যাবার কথা বলে না কেন? না পেরে এ্যালকেমিস্টকে প্রশ্ন করে ছেলেটা।

কারণ এ একটা পথে সবচে বেশি ভোগান্তি হয়। আর হৃদয়েরা ভোগান্তি পছন্দ করে না।

তখন থেকেই ছেলেটা হৃদয়ের ব্যাপারগুলো বুঝতে শিখে। জানিয়ে দেয়, লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেলে চাপ দিতে হবে তাকে। চাপ দিতে হবে পথে ফিরিয়ে আনার জন্য।

সে রাতে এ্যালকেমিস্টকে এসব খুলে বলার পর এ্যালকেমিস্ট বুঝাতে পারে সান্তিয়াগোর হৃদয় ফিরে গেছে ভুবনের আত্মার কাছে।

এখন? কী করব আমি? প্রশ্ন তোলে ছেলেটা।

এগিয়ে যাবে পিরামিড়ের দিকে। যথাযথ সম্মান জানাবে লক্ষণগুলোকে। গুপ্তধনটা কোথায় আছে তা জানানোর ক্ষমতা আছে হৃদয়ের। এখনো।

এ ব্যাপারটা জানা বাকি ছিল আমার?

না। জবাব দেয় এ্যালকেমিস্ট, যা জানতে হবে তা হল, কোন স্বপ্ন বুঝতে পারার আগে বিশ্বের আত্মা আগের সব অভিজ্ঞতার আলোকে যাচাই করে। খারাপ কোন উদ্দেশে নয়, আমরা যেন লক্ষ্যের দিকে ঠিকভাবে চলতে পারি সেজন্য। ঠিক এখানেই হাল ছেড়ে দেয় বেশিরভাগ মানুষ। মরুর ভাষায় আমরা বলি, খেজুর গাছের সারি চোখে পড়ার পর মারা গেল তৃষ্ণায়

সব খোঁজ শুরু হয় শুরু যে করেছে তার সৌভাগ্যের সাথে। শেষ হয় বিজয়ী বারবার পরীক্ষিত হবার পর।

ছেলেটারও মনে পড়ে যায় দেশের সেই প্রবাদের কথা। সূর্য উদিত হবার আগের প্রহর সবচে বেশি অন্ধকার।

 

২.২৪

পরদিন বিপদের গন্ধ টের পায় তারা। তিনজন সশস্ত্র অশ্বারোহী এগিয়ে এল। প্রশ্ন করল ছেলেটা আর এ্যালকেমিস্ট কী করছে।

বাজ নিয়ে শিকার করছি আমি। এ্যালকেমিস্টের সাফ জবাব।

আমরা আপনাদের পরখ করে দেখব। দেখতে হবে কোন অস্ত্র আছে কিনা। বলে ওঠে একজন।

আস্তে আস্তে নেমে আসে এ্যালকেমিস্ট। ছেলেটাও একই পথ ধরে।

টাকা নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ছেলেটার ব্যাগ খোজার পর জিজ্ঞেস করে।

পিরামিডের দিকে যেতে হত, তাই।

আরেকজন এ্যালকেমিস্টকে পরীক্ষা করে তরল ভরা ক্রিস্টালের একটা ফ্লাস্ক পায়। পায় মুরগির ডিমেরচে সামান্য বড় হলদে ডিম্বাকার একটা কাচ।

এগুলো কী?

ফিলোসফারস স্টোন আর অমৃত। এ্যালকেমিস্টদের মাস্টারওয়ার্ক। একবার এ অমৃত পান করলে কখনো অসুখ হবে না। আর ঐ পাথরের টুকরা থেকে একটু অংশ নিলে যে কোন ধাতুকে স্বর্ণ করে ফেলা যায়।

এবার আরবরা তাকে নিয়ে তামাশা শুরু করে। সাথে সাথে হেসে ওঠে এ্যালকেমিস্টও। জবাব শুনে ভাল লাগে তাদের, মনে হয় মজা করেছে এ্যালকেমিস্ট। দুজনকেই চলে যেতে দেয়।

আপনি পাগল নাকি? যেতে যেতে কথাটা তোলে ছেলেটা, কোন দুঃখে করলেন কাজটা?

তোমাকে জীবনের এক সাধারণ শিক্ষা দেয়ার জন্য। তোমার ভিতরে অসাধারণ কোন সম্পদ থাকলে তা লোককে বলে বেড়ালে খুব বেশি মানুষ। বিশ্বাস করবে না।

এগিয়ে যায় তারা। যত এগিয়ে যায় তত নিপ হয়ে পড়ে ছেলেটার হৃদয়। এখন আর তা খুব বেশি কিছু জানতে চায় না। হৃদয় শুধু ভুবনের আত্মর কাছ থেকে শিখতে থাকে। ছেলে আর তার হৃদয় এখন বন্ধু। বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

একবার কথা বলে ওঠে হৃদয়। জানায়, মরুভূমির নৈঃশব্দ নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। বলে, ছেলেটার সবচে বড় সম্পদ হল, সে সব ভেড়া বিকিয়ে দিয়ে লক্ষ্যের পথ ধরতে পেরেছিল, কাজ করেছিল স্ফটিকের দোকানে।

আরো একটা কথা বলে যা সে কখনো খেয়াল করেনি: বাবার কাছ থেকে নেয়া রাইফেলটা হৃদয় লুকিয়ে ফেলেছিল যাতে সে নিজের ক্ষতি করে না ফেলে। আরেকবার আরো একটা কান্ত করে বসে সে। ছেলেটার মনে আছে কিনা জানে না, একবার মাঠের ভিতরেই বমি করে করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ব্যাপারটা খারাপ মনে হলেও আসলে পথে অপেক্ষা করছিল দুজন চোর। তারা ছেলেটাকে একেবারে মেরে ফেলে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল ভেড়ার পাল। কি অজ্ঞান হয়ে থাকায় তার আর সময়মত যাওয়া হয়নি। চোররা ভেবে বসে আছে সে অন্য পথ ধরেছে।

মানুষের হৃদয় কি সব সময় তাকে সহায়তা করে? প্রশ্ন তোলে ছেলেটা এ্যালকেমিস্টের কাছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু তাদের হৃদয়, যারা লক্ষ্য লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। কিন্তু তারা সব সময় সহায়তা করে বাচ্চাদের, মাতালদের আর বয়েসিদের।

তার মানে আমি কখনো হুট করে বিপদে পড়ব না?

মানে হল, হৃদয় তাই করে যা পারে। জানিয়ে দেয় এ্যালকেমিস্ট।

আরেক বিকালে তারা সৈন্যদের তাবুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘাটির প্রত্যেক পাশে সাদা আলখেল্লায় সজ্জিত সৈনিক। অস্ত্র তাক করা। কিন্তু তারা। যুদ্ধের খোশগল্প আর হুকা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে দুজনকে দেখেনি।

আর ভয় নেই, এলাকাটা পেরিয়ে যাবার পর বলে ছেলে।

এবার রেগে ওঠে এ্যালকেমিস্ট, তোমার হৃদয়ের উপর বিশ্বাস রাখ, ভুলে যেও না যে আসলে আছ এক মরুভূমির মাঝখানে। লোকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর আত্মা যুদ্ধের চিকার শুনতে পায়। এক সূর্যের নিচে কেউ ঘটনার সূত্র থেকে আসা সমস্যার বাইরে নয়।

সব আসলে একই, ভাবে ছেলেটা। তারপর, মরুভূমির যেন ইচ্ছা হল এ্যালকেমিস্টের কথা সত্যি করে দেখানোর। পিছন থেকে ধেয়ে এল দুজন ঘোসওয়ার।

আর যেতে পারবে না তোমরা, বলল একজন, যুদ্ধক্ষেত্রে আছ এখন।

খুব বেশি দূরে যাচ্ছি না। জবাব দিল এ্যালকেমিস্ট, সেই লোকটার চোখে চোখে তাকিয়ে। তারা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর জানায়, যেতে পারবে।

তুমি চোখের দৃষ্টি দিয়ে ঘোরসওয়ারদের কুপোকাৎ করে দিয়েছ। যেভাবে তাকিয়েছ তাকেই তাদের দৃষ্টিরচে তোমার দৃষ্টির প্রখরতা বেশি মনে হয়। বলল ছেলেটা অবাক হয়ে।

চোখ আসলে আত্মার শক্তি প্রদর্শন করে।

আসলেই, অনুভব করে ছেলেটা, সেই প্রহরীদের মধ্যে একজন এত দূর থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

অবশেষে পুরো দিগন্তজুড়ে হাজির হয়েছে পর্বতমালা। পিরামিড়ে যেতে আর মাত্র দুদিন বাকি।

আমরা যদি আলাদা পথে সরে যাই, বলে ছেলেটা, তাহলে আমাকে এ্যালকেমি থেকে কিছু শিক্ষা দাও।

তুমি এর মধ্যেই এ্যালকেমি শিখে গেছ। ব্যাপারটা হল, বিশ্বের আত্মার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করতে হবে, তারপর আবিষ্কার করতে হবে ভিতরে তোমার জন্য রাখা সম্পদটুকু।

না, তা বলছি না। শীসাকে সোনায় রূপান্তরের কথা বলছি।

মরুভূমির মত চুপ হয়ে যায় এ্যালকেমিস্ট। খাবার জন্য থামার পর জবাব দেয়।

সৃষ্টি জগতের সবকিছুই আসলে তৈরি হয়েছে, আর জ্ঞানীদের জন্য সবচে বেশি বেড়েছে যেটা তা হল স্বর্ণ। কেন? জিজ্ঞেস করোনা। জানি না আমি। শুধু জানি, ঐতিহ্য সব সময় ঠিক।

মানুষ কখনো জ্ঞানীদের কথা বোঝে না। তাই বিবর্তনের একটা ধারা হিসাবে প্রকাশ পাবে স্বর্ণ, তা না, প্রকাশ পেল সংঘাতের মূলসূত্র হিসাবে।

কিন্তু জিনিসের নানা ভাষায় কথা বলে, বলল ছেলেটা, এককালে আমার কাছে উটের ডাক সামান্য এক ডাক ছাড়া আর কিছু ছিল না। পরে এটাই হয়ে উঠল বিপদের গন্ধ। সবশেষে আবার সামান্য এক ডাক।

তারপর সে চুপ হয়ে যায়। এসব কথা এ্যালকেমিস্টের অজানা নয়।

আমি সত্যিকার এ্যালকেমিস্টদের চিনতাম, বলে এ্যালকেমিস্ট, তারা। নিজেদের সর্বক্ষণ ল্যাবরেটরিতে আবদ্ধ করে রাখে, চায় স্বর্ণের মত বিবর্তিত হতে। তার পরই তারা আবিষ্কার করে ফিলোসফারস স্টোন। কারণ যখন কোনকিছু বিবর্তিত হয়, বিবর্তিত হয় আশপাশের সবকিছু নিয়ে।

বাকিরা হঠাৎ করে পরশ পাথরের সন্ধান পেয়েছে। আগেভাগে পেয়ে বসেছিল উপহারটা। কিন্তু তাদের আত্মা অন্যদের আত্মারচেও বেশি দামি কিছুর অপেক্ষা করছে। এমনধারা লোক পাওয়া খুব মুশকিল।

আরো এক ধরনের এ্যালকেমিস্ট আছে। তাদের একমাত্র কামনা স্বর্ণ। কখনো পায়নি রহস্যের সন্ধান। ভুলে গেছে যে সীসা, তামা আর লোহাকে তাদের নিজ নিজ লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। আর যখন কেউ অন্যের লক্ষ্যে হস্ত ক্ষেপ করে তারা কখনো নিজেরটুকু পূরণ করতে পারে না।

বাতাসে বাতাসে এ্যালকেমিস্টের কথাটুকু অভিসম্পাতের মত ধ্বর্ণিত প্রতিধ্বণিত হয়। এগিয়ে যায় তারা সামনে। মাটি থেকে কুড়িয়ে নেয় একটা খোলস।

এ মরুভূমি আসলে এককালে সাগর ছিল। বলে সে।

খেয়াল করেছি।

কানের উপর খোলসটা বসিয়ে নিতে বলে এ্যালকেমিস্ট। ছেলেবেলায় এমন কাজ অনেকবার করেছে সে। শুনেছে সাগরের ডাক।

এই সামান্য খোলের ভিতরে বেচে আছে সমুদ্র। কারণ এটাই তার লক্ষ্য। এখানে আবার সাগর আসা পর্যন্ত এ শব্দ চলতেই থাকবে।

তারা উঠে বসে ঘোড়ার উপরে। তারপর যেতে থাকে মিশরের পিরামিডের দিকে।

 

২.২৫

মনে বিপদের কথা আসার সময় সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। হঠাৎ ছেলেটা টের পায়, চারপাশে বিশাল সব বালির ঢিবি। এ্যালকেমিস্ট খেয়াল করেছে নাকি ব্যাপারটা? কিন্তু তাকে একটুও বিচলিত মনে হয় না। পাঁচ মিনিট পর দেখা গেল সামনের চিবিতে অপেক্ষা করছে দুজন ঘোরসওয়ার। এ্যালকেমিস্টের উদ্দেশে কিছু বলার আগে তাদের সংখ্যা দাড়ায় দশজনে। তারপর একশ। তারপর ঢিবির চারপাশে।

এ গোত্রের মানুষ নীল জামা পরে যুদ্ধ করতে নেমেছে। মুখও নীল পর্দায় ঢাকা, খোলা আছে শুধু চোখজোড়া।

এত দূর থেকেও তাদের চোখের স্থির সঙ্কল্প ধরা যায়। সেখানে মৃত্যুর ছায় আকা।

 

২.২৬

দুজনকে নিয়ে যাওয়া হল কাছের সামরিক ঘাটিতে। নিয়ে গেল সেনাপতির তাবুতে। সেনাপতি তার দলবল নিয়ে আলোচনা করছিল।

এরাই গুপ্তচর। বলল একজন।

আমরা শুধু ভ্রমণকারী, জবাব দিল এ্যালকেমিস্ট।

তিন দিন আগে তোমাদেরকে শত্রু ক্যাম্পে দেখা গেছে। তাদের একজনের সাথে কথা বলছিলে তুমি।

আমি শুধু মরুর বুকে ঘুরে বেড়ানো আর আকাশ পর্যবেক্ষণ করা এক লোক। আমার কাছে সৈন্যদল বা গোত্রের কোন খবর পাওয়া যাবে না। বন্ধুর সফরসঙ্গি হিসাবে কাজ করছিলাম।

তোমার বন্ধুটা কে? প্রশ্ন করল সেনাপতি।

একজন এ্যালকেমিস্ট, এ্যালকেমিস্ট বলছে, যিনি প্রকৃতির শক্তি বোঝেন। আপনাদের দেখাতে চান তার অলৌকিক ক্ষমতা।

শান্ত হয়ে কথাগুলো শুনে যায় ছেলেটা। শুনে যায় ভয়ার্তভাবে।

এ এলাকায় বিদেশি কী করছে? প্রশ্ন করল আরেকজন।

আপনাদের গোত্রে দেয়ার জন্য টাকা নিয়ে এসেছেন তিনি। ছেলেটাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয় না এ্যালকেমিস্ট। হাত থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে দেখায় স্বর্ণমুদ্রাগুলো।

কোন কথা ছাড়াই সেগুলো নিয়ে নেয় আরব। এ দিয়ে অনেক অস্ত্র কেনা। যাবে।

এ্যালকেমিস্ট কী? প্রশ্ন করে অবশেষে।

এমন এক মানুষ যিনি প্রকৃতিকে বোঝেন, বোঝেন বিশ্বকে। চাইলে তিনি শুধু বাতাসের শক্তি দিয়ে এ ঘাটি তছনছ করে দিতে পারতেন।

হেসে ফেলল লোকগুলো।

তারা যুদ্ধের কানাঘুষা সম্পর্কে ভালভাবেই জানে। জানে, এ ঘাটি তছনছ করার মত বাতাস ওঠার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তার পরও, সবার হৃদস্পন্দন কেমন যেন বেড়ে গেছে। তারা মরুর দেশের মানুষ, জাদুকরদের ভয় পায়।

আমি চাই তিনি তা করে দেখাবেন। সেনাপতি বলল।

তিনদিন সময় লাগবে। বলল এ্যালকেমিস্ট, প্রথমে তিনি নিজেকে বাতালে রূপান্তরিত করবেন, শুধু ক্ষমতা দেখানোর জন্য। আর যদি তা করতে না পারেন তাহলে আমাদের জীবন সমর্পণ করছেন আপনাদের গোত্রের। সম্মানে।

আমার হয়ে গেছে এমন কিছু তুমি আমার কাছে সমর্পণ করতে পার না, রাজকীয়ভাবে বলল সেনাপতি। সেইসাথে তিনদিন সময় মঞ্জুর করল।

ভয়ে পাতার মত কাপছে ছেলেটা। হাতে ধরে তাকে বাইরে নিয়ে আসে। এ্যালকেমিস্ট।

ভয় পাবার কথা কিছুতেই বুঝতে দিও না, এ্যালকেমিস্ট বলল, তারা সাহসী, ভিতুদের ঘৃণার চোখে দেখে।

কিন্তু ছেলেটার কথা বলার সাহসটুকুও নেই। ঘাটির মাঝামাঝি জায়গা ছেড়ে যাবার পর কথা ফুটল মুখে। তাদের বন্দি করে রাখার কোন দরকার নেই। সোজা ব্যাপার, ছিনিয়ে নিয়েছে ঘোড়াগুলো। তাই, আবারো পৃথিবী তার বিচিত্র ক্ষমতার প্রকাশ দেখায়। একটু আগেও মরুভূমি ছিল খোলা, বিশাল। এখন নিশ্চিদ্র এক দেয়াল।

আমার সমস্ত সম্পদ দিয়ে দিলে তাদের প্রশ্ন করে ছেলেটা, আমার জীবনের সমস্ত সম্পদ!

আচ্ছা! তাহলে মরে গেলে সেগুলো কোন কাজে লাগত? তোমার টাকাটা আমাদের জীবন আরো তিন দিনের জন্য বাঁচিয়ে দিয়েছে। টাকা কিন্তু সব সময় প্রাণ বাচাতে পারে না।

কিন্তু ছেলেটা এত ভয় পেয়ে গেছে যে জ্ঞানের কথা শোনার মত অবস্থা নেই। কী করে যে নিজেকে বাতাসে রূপান্তরিত করবে কে জানে! আর যাই হোক, সে এ্যালকেমিস্ট নয়!

এক প্রহরীকে একটু চা আনতে বলল এ্যালকেমিস্ট। তারপর ঢালল ছেলেটার কজিতে। কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করল আর কিছুই বুঝতে পারে না ছেলেটা।

ভয়ের কাছে মাথা পেতে দিও না, এ্যালকেমিস্ট বলছে খুব সহজ ভাষায়, দিলে হৃদয়ের সাথে আর কথা বলতে পারবে না।

কিন্তু নিজেকে কীভাবে বাতাস বানিয়ে ছাড়ব তাতো বুঝতে পারলাম না।

কোন মানুষ লক্ষ্য নিয়ে জীবন কাটালে সে প্রয়োজনীয় প্রতিটা ব্যাপার জানে। স্বপ্নকে অসম্ভব করে তোলে মাত্র একটা ব্যাপার: বার্থ হবার ভয়।

আমি ব্যর্থ হবার ভয় পাচ্ছি না। সমস্যা হল, কী করে নিজেকে বাতাস বানিয়ে নিতে হয় সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

শিখতে হবে। জীবন নির্ভর করছে এর উপর।

আর যদি না পারি?

তখন তুমি লক্ষ্য বুঝতে শুরু করে মাঝপথে মারা যাবে। তবু ভাল, আরো কোটি মানুষের মত জীবনের লক্ষ্য কী সেটা না জেনে মরবে না।

কি চিন্তা করেনা, আশ্বাস দেয় এ্যালকেমিস্ট, সাধারণত মৃত্যুর হুমকি মানুষের মনে বেচে থাকার আশা বাড়িয়ে তোলে।

 

২.২৭

কেটে গেছে প্রথম দিন। সাতিক এক যুদ্ধ হয়েছে কাছে কোথাও। অনেকে আহত হয়ে ফিরে এসেছে। মৃতদের জায়গা দখল করে নিয়েছে জীবিতরা। ছেলেটা ভাবে, মৃত্যু আসলে কিছু বদলে দেয় না।

তোমরা আরো পরে মারা যেতে পারতে, এক সৈনিক মৃতদেহগুলোর পাশে বলছে, মারা যেতে পারতে শান্তি ঘোষিত হবার পর। কিন্তু যাই হোক না কেন, তোমাদের ভাগ্যে মৃত্যুই লেখা ছিল।

দিনের শেষে বেরিয়ে পড়ে ছেলেটা। বাজ নিয়ে শিকারে গিয়েছিল এলকেমিস্ট।

আমি এখনো মাথামুন্ডু কিছু বুঝছি না, কী করে নিজেকে বাতাসে পরিণত করব! আবার বলে যায় সে।

কী বলেছি মনে আছে তো? পৃথিবী আসলে ঈশ্বরের দৃশ্যমান অংশ। এ্যালকেমিস্টের কাজ হল বস্তুজগতে অলৌকিকের ছোয়া আনা।

কী করছ তুমি?

বাজটাকে খাওয়াচ্ছি।

আমি নিজেকে বাতাসে পরিণত করতে না পারলে মরতে হবে, বলে সে নাছোড়বান্দার মত, আর তুমি বাজপাখিকে খাওয়াচ্ছ?

মারা গেলে তুমি যাবে, বলে এ্যালকেমিস্ট, কী করে নিজেকে বাতাসে পরিণত করতে হয় তা আমি ভালভাবেই জানি।

 

২.২৮

দ্বিতীয় দিন ছেলেটা ঘাটির কাছে এক পাথুরে উঁচু জায়গায় ওঠে। প্রহরীরা

কোন বাধা দেয়নি। এর মধ্যেই শুনে বসে আছে যে এমন এক জাদুকর এসেছে এখানে যে লোকটা নিজেকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে জানে। তাকে ঘাটানোর সাহস নেই কারো। মরুভূমি বড় বিচিত্র জায়গা। এখানে সব সম্ভব।

দ্বিতীয় দিনের পুরো বিকাল কেটে যায় মরুভূমির দিকে তাকিয়ে থেকে। নিজের হৃদয়ের কথা শুনে শুনে। ছেলেটা জানে, মরুভূমি তার ভয়ের ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে।

তারা দুজনে একই ভাষায় কথা বলে।

 

২.২৯

তৃতীয় দিন।

আর সব অধিনায়কের সাথে দেখা করে সেনাপতি। এ্যালকেমিস্টকে ডাকে সভায়। তারপর বলে, চল, সেই ছেলেটার সাথে দেখা করা যাক যে নিজেকে বাতাসে মিলিয়ে ফেলতে পারে।

চল। সুর মিলায় এ্যালকেমিস্ট।

আগেরদিন যেখানে সময় কাটিয়েছে, সেই পাথরচূড়ায় সবাইকে নিয়ে যায় ছেলেটা। বসতে বলে সবাইকে।

সময় লাগবে একটু।

আমাদের কোন তাড়া নেই, জবাব দেয় সেনাপতি, আমরা মরুর দেশের লোক।

ছেলেটা দিগন্তে তাকায়। দূর দিগন্তে অনেক পাহাড় আছে। আছে বালির বিশাল বিশাল ঢিবি, পাথরের চাই, আর আছে ছোটখাট ঝোপঝাড়। যেখানে জীবন ধারনের সামন্যতম উপকরণ, সেখানেই প্রাণ। এ মরুভূমির কথা বহু মাস ধরে তার মনে ছিল; এতকিছুর পরও সে এর খুব সামান্য অংশ চিনতে পেরেছে। সে সামান্য অংশে দেখা দেখেছে এক ইংরেজকে। দেখেছে মরুবহর, গোত্ৰযুদ্ধ আর পঞ্চাশ হাজার গাছ ও তিনশ কুয়া ওয়ালা এক আস্ত মরুদ্যান।

আজ কী চাও তুমি? প্রশ্ন করে ধূ ধূ বালুকাবেলা, কাল কি চেয়ে থেকে অনেক সময় কাটাওনি?

তোমার কোথাও লুকিয়ে আছে আমার ভালবাসার মানুষ, বলে ছেলেটা, তাই যখন তোমার বালির দিকে তাকাই, যেন তাকাই তার দিকেই। আমাকে তার কাছে ফিরে যেতে হবে। নিজেকে বাতাসে পরিণত করার জন্য তোমার সহায়তা দরকার।

ভালবাসা কী? প্রশ্ন করে মরুভূমি।

তোমার বালুর উপর দিয়ে বাজ পাখির উড়ে যাওয়া হল ভালবাসা। কারণ তার জন্যই তুমি সবুজ প্রান্তর, যেখান থেকে সে ফিরে আসে খেলা শেষে। সব সময়। সে তোমার পাথরগুলো চিনে, চেনে বালির ঢেউ, সব পাহাড়। এসব কারণে তুমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

বাজপাখি আমার খুব বেশি উপকার করে না, সাথে সাথে জবাব দেয় মরুভূমি, বছরের পর বছর ধরে তার খেলার সাথি হই আমি, সামান্য যা পানি আছে তা পান করাই, তারপর দেখিয়ে দিই খেলার অবস্থান। তারপর একদিন হঠাৎ টের পাই, আমার বালির উপর তার খেলে যাওয়ার পর সে তীব্র বেগে উপরে তুলে নিয়ে যায় যা তৈরি করেছি আমি নিজে।

আর সে কারণেই তুমি তৈরি করেছ খেলাটা, জবাব দেয়, ছেলে, বাজপাখিকে পুষ্ট করার জন্য। তখন বাজ পুষ্ট করে মানুষকে। মানুষ আস্তে আস্তে পুষ্ট করবে তোমার বালুময় প্রান্তর। এভাবে আবার শুরু হবে খেলা। এভাবেই চলে পুরো জগত।

তাহলে এই হল ভালবাসা?।

হ্যাঁ। এই হল ভালবাসা। এভাবেই চক্র পূর্ণ হয়। সীসা পরিণত হয় স্বর্ণে, স্বর্ণ চলে যায় মাটির গভীরে।

জানি না কী কথা বলছ। বলে ওঠে মরুভূমি।

কিন্তু তুমি এটুকু বুঝতে পার যে সেখানে, বালির ভিতরে কোথাও এক মেয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। আর সেজন্য আমার নিজেকে বাতাসে। পরিণত করা দরকার।

কিছুক্ষণ কোন জবাব আসে না মরুভূমির পক্ষ থেকে।

তারপর বলে ওঠে, আমি বালি পাঠাতে পারি, যেন বাতাস বয়। এর বেশি কিছু করতে পারব না। বাকিটার জন্য তোমাকে বাতাসের কাছে যেতে হবে।

মৃদুমন্দ বাতাস উঠছে। দূর থেকে ছেলেটাকে দেখছে গোত্রের লোকজন। এমন ভাষায় কথা বলছে নিজেদের মধ্যে যার কিছুই বুঝতে পারে না ছেলেটা।

মৃদু হাসি এ্যালকেমিস্টের ঠোঁটে।

বাতাস এগিয়ে এল। স্পর্শ করল ছেলেটার মুখ। এটা মরুভূমির সাথে ছেলেটার কথা বলার ব্যাপার জানে। কারণ বাতাসের সব শুনতে পায়। কোন জন্মভূমি ছাড়াই ভেসে বেড়ায় সারা দুনিয়াজুড়ে। তারপর তাদের মৃত্যুর কোন স্থান নেই।

সহায়তা কর, বলে ছেলেটা, একদিন তুমি আমার ভালবাসার মানুষের কণ্ঠ বহন করেছিলে।

কে তোমাকে মরুভূমি আর বাতাসের ভাষা শিখাল?

আমার হৃদয়।

বাতাসের অনেক নাম আছে। পৃথিবীর এ অংশে নাম হল সিরোক্কৈা। কারণ সাগর থেকে শিতলতা নিয়ে আসে এটা। দূরের যে দেশ থেকে তারা এসেছে সেখানে এর নাম ল্যাভেন্টার, কারণ বলা হয় এ বাতাসই বয়ে আনে মরুর বালি। আর তার এলাকায় লোকে মনে করত বাতাস আসে আন্দালুসিয়া থেকে। কিন্তু আসলে বাতাস কোথাও থেকে আসে না। যায় না হারিয়ে। তাই এর শক্তি মরুভূমিরচেও বেশি। মানুষ মরুর বুকে গাছ বুনতে পারে, পারে ভেড়ার পাল চড়াতে। কিন্তু বাতাস আটকাতে পারবে না।

তুমি নিশ্চই বাতাস নও, আমরা ভিন্ন জিনিস। বাতাস বলে।

সত্যি নয়। চলার পথে আমি এ্যালকেমিস্টের রহস্য জেনেছি। আমার ভিতরেই আছে বাতাসেরা, সব মরুভূমি, সাগরের দল, নক্ষত্রবীথি, সৃষ্টি জগতের প্রতিটা জিনিস। আমরা সবাই তৈরি হয়েছি এক হাতে। একই আত্মা আমাদের।

আমি তোমার মত হতে চাই। যেতে চাই সাগর পাহাড় বন জঙ্গল আর মরুর উপর দিয়ে। বালি দিয়ে ঢেকে দিতে চাই আমার গুপ্তধন। বয়ে নিতে চাই ভালবাসার মানুষের কণ্ঠস্বর।

শুনলাম তুমি এ্যালকেমিস্টের সাথে আরেক দিনের কথা বলছিলে, সে বলেছিল যে সবার নিজের নিজের গন্তব্য আছে। তাই বলে তো মানুষ নিজেকে বাতাসে পরিণত করতে পারে না!

আমাকে সামান্য সময়ের জন্য বাতাস হয়ে যেতে শিখাও, যাতে আমি আর তুমি বাতাস আর মানুষের অসীম সম্ভাবনার কথা বলতে পারি।

এবার উৎসাহী হয়ে ওঠে বাতাস। আগে কখনো এমন হয়নি। নানা কথা বলে সে। বলে অনেক কাজের কথা। বাতাসই তৈরি করেছিল মরুভূমি, ডুবিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য জাহাজ, বয়ে গেছে বনের উপর দিয়ে, প্রবেশ করেছে বিচিত্র আওয়াজ আর সঙ্গীতে ভরা শহরের ভিতরে। এদিকে একটা ছেলে বলছে যে বাতাসের করার মত আরো অনেক ব্যাপার আছে।

এটাকে আমরা বলি ভালবাসা। তুমি এ ব্যাপারটা শিখলে সৃষ্টির যে কোন কিছু শিখে যাবে। ভালবাসলে আর কোন কিছু বোঝার দরকার পড়ে না, কারণ যা হয় সব হয় তোমার ভিতরে। মানুষ বাতাসে পরিণত হতে পারে, যদি বাতাস সহায়তা করে।

বাতাস অহঙ্কারি। ছেলেটার এত কথা তার কাছে ভাল ঠেকে না। রেগে যায়। উড়িয়ে নেয় মরুর বালি। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারে, সে চাইলেই মানুষকে বাতাসে পরিণত করতে পারবে না। জানে না ভালবাসা ব্যাপারটা কী।

পৃথিবীর পথে চলার সময় দেখেছি লোকে ভালবাসার কথা বলে আকাশের দিকে তাকায়। তারচে চল, স্বৰ্গকে প্রশ্ন করা যাক।

তাহলে সে কাজে হাত লাগাও। এখানে এত তীব্র মরুঝড় সৃষ্টি কর যেন সূর্যটা ঢাকা পড়ে। তখন আমি স্বর্গের দিকে তাকাতে পারব চোখের কোন ক্ষতি না করে।

তীব্র বেগে বাতাস বইতে থাকে। আকাশ ঢেকে যায় বালিকণায়। সূর্যটাকে সামান্য এক সোনালি থালার মত দেখায়।

এদিকে ঘাটির ভিতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মরুর মানুষ এমন বাতাস দেখে অভ্যস্ত। ডাকে সাইমুম নামে। এটা সাগরের ঝড়ের তুলনায় অনেক ভয়ানক। চিৎকার করে ওঠে ঘোড়াগুলো, বালু ঢুকে যায় সব অস্ত্রে।

এদিকে একজন সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের মনে হয় এখানেই ব্যাপারটার ইতি ঘটানো উচিত।

চোখে নীল পর্দা আর মনে ভয় নিয়ে তারা ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করে।

বন্ধ করা যাক। বলে ওঠে আরেক অধিনায়ক।

আমি আল্লাহর মহত্ত দেখতে চাই, অবশেষে মুখ খুলল সেনাপতি, দেখতে চাই কী করে একজন মানুষ নিজেকে বাতাসে পরিণত করে।

কিন্তু মনে মনে সে একটা হিসাব করে নিয়েছে। যে দুজন প্রতিবাদ করেছিল তারা সত্যিকার সাহসী নয়। মরুর দেশের সাহসী মানুষ হলে তারা মৃত্যুকে ভয় পেত না। সরিয়ে দেয়া হবে তাদের, ঝড় থামার পর পরই।

বাতাস বলেছে যে তুমি ভালবাসার কথা জান, এবার সূর্যকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটা, ভালবাসার কথা জানলে তুমি নিশ্চই ভুবনের আত্মার কথাও জান, কারণ তা ভালবাসায় গড়া।

আমি যেখানে আছি, জবাব দেয় সূর্য, সেখান থেকে তুবনের আত্মা দেখা যায়। এটা আমার আত্মার সাথে মিলে গেলে আমরা গড়ে তুলি গাছ, ভেড়াদের জন্য নিয়ে আসি ছায়া। এত উপরে থেকে থেকে আমি পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। জানি, ভালবাসা কী।

জানি, একটু সামনে এলেই পৃথিবীর বুকের সবকিছু ছারখার হয়ে যাবে। তখন পৃথিবীর কোন আত্মা থাকবে না। তাই আমরা একে অন্যকে সাহায্য করি, একে অন্যকে ভালবাসি এবং এভাবেই বয়ে আনি জীবনের বন্যা। দিই তাপ আর আলো, আর সে আমাকে দেয় বাচার কারণ।

তাহলে, তুমি জান ভালবাসা কী।

এবং আমি জানি পৃথিবীর আত্মাকে। সৃষ্টিজগতের পথে পথে চলার সময় আমরা অনেক কথা বলেছি। বলেছিল যে তার সবচে বড় সমস্যা হল শুধু খনিজ আর সজিরা জানে সবাই এক। যেমন, লোহাকে কখনো তামার মত হতে হবে না, তামাও হবে না স্বর্ণের মত। প্রত্যেকে যার যার কাজ করে যায়। নির্দিষ্ট জনের জন্য নির্দিষ্ট কাজ। এসবই দারুণ এক লয়ে থাকত যদি সে হাত সৃষ্টির পঞ্চম দিনে থেমে যেতেন।

কিন্তু ষষ্ঠ দিন এল, বলে যায় সূর্য।

তুমি জ্ঞানী, কারণ দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ কর। কিন্তু ভালবাসা কী তা তুমি জান না। ষষ্ঠ দিন না থাকলে মানুষ সৃষ্টি হত না; তামা পড়ে থাকত তামার মত, সীসা সীসার মত। কথা সত্যি, সবারই একটা গন্তব্য আছে, আর একদিন সে গন্তব্য চেনা যাবে। তাই প্রত্যেককেই আরো ভাল কিছুতে পরিণত হতে হয়। যেতে হয় ভাল কোন পথে, যেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বের আত্মাই একমাত্র হতে পারে।।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে সূর্য। তারপর আরো জ্বলজ্বলে হয়ে জ্বলে ওঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এতক্ষণ কথা শুনছিল বাতাস। এবার আরো তীব্রবেগে বইতে শুরু করে যেন ছেলেটার কোন ক্ষতি না হয়।

এজন্যই এ্যালকেমির অস্তিত্ব, বলে চলে ছেলেটা, যেন সবাই যার যার গুপ্তধনের খোঁজ করতে পারে, আগের জীবনেরচে ভাল কিছুতে পরিণত হতে পারে। দস্তা সে পর্যন্ত কাজ করবে যে পর্যন্ত তাকে প্রয়োজন। তারপর পরিণত হবে স্বর্ণে।

এ কাজ করে এ্যালকেমিস্টরা। তারা প্রমাণ করে যে যখন আমরা বর্তমানেরচে ভাল হতে চাই, আমাদের চারপাশের সবকিছুও তার সাথে ভাল হয়ে যায়।

তাহলে কেন বললে যে আমি ভালবাসার ব্যাপারটা জানি না?

কারণ ভালবাসা মরুর মত এক জায়গায় পড়ে থাকবে না, ঘুরে বেড়াবে বাতাসের মত, দূর থেকে সব দেখবে না তোমার মত। ভালবাসা হল সে শক্তি যা পরিণত হয় বিশ্বের আত্মায়। সমৃদ্ধ করে পৃথিবীর আত্মাকে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল বিশ্বের আত্মা নিখুত। পরে দেখলাম আসলে এটা সৃষ্টির আর সব বিষয়ের মতই। অপূর্ণ। আছে নিজের ভাল এবং মন্দ। আমরাই পৃথিবীর আত্মাকে সমৃদ্ধ করি, আর পৃথিবী ভাল হবে কি মন্দ হবে তা নির্ভর করে আমরা ভাল হব কি মন্দ হব তার উপর। এখানেই ভালবাসার শক্তি। ভালবাসার সময় আমরা আগেরচে ভাল হতে চেষ্টা করি।

তো? আমার কাছে কী চাও?

আমি তোমার সহায়তা চাই, যেন আমাকে বাতাসে পরিণত করতে পারি।

প্রকৃতি আমাকে সৃষ্টির সবচে জ্ঞানী হিসাবে জানে, আর আমি জানি না কী করে তোমাকে বাতাসে পরিণত করা যায়।

তাহলে, কাকে জিজ্ঞেস করব?

একটু ভাবে সূর্য। খেয়াল করে শুনছে বাতাস। কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে সূর্যের জ্ঞানে কাতি আছে। সারা পৃথিবীতে কানাকানি পড়ে যাবে তাহলে।

সে হাতের সাথে কথা বল যে এসব লিখেছে, অবশেষে বলল সূর্য।

আনন্দে চিৎকার করে ওঠে বাতাস। বইতে থাকে সবচে জোরে। উড়ে গেছে তাবু, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সব প্রাণি। পাথরের সামনে সবাই হাতে হাত রেখে পড়ে থাকে যেন উড়ে যেতে না হয়।

এবার ছেলেটা ফিরে তাকায় সে হাতের দিকে যে সব লিখেছে। সাথে সাথে টের পায়, নিশ্ৰুপ হয়ে গেছে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। সিদ্ধান্ত নেয় সে, কথা বলবে না।

ভালবাসার এক তীব্র প্রবাহ আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। শুরু করে প্রার্থনা। এমন প্রার্থনা এর আগে কখনো করেনি সে। কারণ এখানে কোন শব্দ নেই, নেই বাঙ্কার।

এ প্রার্থনায় ভেড়াগুলোর নতুন মালিক জুটে যাওয়ার কারণে ধন্যবাদ নেই, নেই আরো স্ফটিক বিক্রি করিয়ে দেয়ার আবেদন, নেই সে মেয়ের কাছে ফিরে যাবার আকুতি। একেবারে চুপ করে থাকে ছেলেটা। চুপ করে থেকে টের পায়, আসলে বাতাস, মরুভূমি আর সূর্যও জীবনের সেই লেখা বোঝার চেষ্টা করছে।

সে দেখেছে, পৃথিবীর সর্বত্র লক্ষণ ছড়ানো। আর সে হাত এসব তৈরি করেছে কোন না কোন উদ্দেশ্যে। শুধু সেই হাতই পারে অলৌকিক ঘটাতে, পারে সাগরকে মরুভূমি আর মরুভূমিকে সাগর বানাতে… অথবা মানুষকে বাতাস।

কারণ শুধু সে হাতই জানে কোন মহাসূত্র দিয়ে এ দু দিনে তৈরি করা হয়েছিল মহাকর্ম।

পৃথিবীর আত্মার ভিতর দিয়ে সে দেখতে পায়, এটা আসলে ঈশ্বরের আত্মরি এক অংশ। দেখতে পায়, তার নিজের আত্মাটাও তার আত্মার একটা অংশ। আর তাই সে, সামান্য এক ছেলে, করতে পারবে অলৌকিক সব কান্ড।

 

২.৩০

সেদিনের মত করে আর কখনো সাইমুম বয়নি। তারপর, যুগ যুগ ধরে আরবরা বলে বেড়ায় যে তারা এক ছেলেকে বাতাস হয়ে যেতে দেখেছে। দেখেছে মরুর সবচে ভয়ানক সেনাপতিকে তার সব সহ বিদ্ধস্ত হয়ে যেতে।

মরুঝড় থেমে গেলে সবাই ছেলেটার দিকে তাকায়। সে তখন সেখানে নেই। দাড়িয়ে আছে এক বালুচাকা প্রহরীর পাশে, ঘাটির অন্য প্রান্তে।

এ বিস্ময় দেখে থ বনে যায় সবাই। শুধু হাসছিল দুজন। সেই এ্যালকেমিস্ট, যে তার উত্তরাধীকারী দেখা পেয়েছে আর সে সেনাপতি যে ঈশ্বরের মহত্তের দেখা পেয়েছে।

পরদিন। ছেলে আর এ্যালকেমিস্টকে বিদায় জানায় সেনাপতি। তারা প্রহরী হিসাবে যতদূর খুশি নিয়ে যেতে পারে একদল সৈনিককে।

 

২.৩১

সারাদিন চড়ে বেড়ায় তারা। বিকালের শেষভাগে চলে আসে এক ধর্মশালায়। ঘোড়া থেকে নেমে এ্যালকেমিস্ট সৈন্যদের পাঠিয়ে দেয়।

এখান থেকে তুমি একা যাবে, বলল এ্যালকেমিস্ট, পিরামিড আর মাত্র তিন ঘন্টার পথ।

ধন্যবাদ, তুমিই আমাকে বিশ্বের ভাষা শিখিয়েছ।

আমি শুধু তোমার জানা ব্যাপারটা জাগিয়ে তুলেছি, ব্যস।

ধর্মশালার দরজায় কড়ানাড়ে এ্যালকেমিস্ট, তারপর কালো কাপড় পরা সন্যাসীর সাথে কথা বলে কপটিক ভাষায়। ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দেয় ভিতরে।

আমি তার কাছে রান্নাঘর ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলাম। হাসে এ্যালকেমিস্ট।

ধর্মশালার পিছনের রান্নাঘরে গিয়ে আগুন জ্বালায় সে, সন্যাসী একটু সিসা নিয়ে আসে, লোহার পাতে বসায় সে সেটুকু। সিসা গরম হয়ে এলে ঝোলা থেকে বের করে রহস্যময় হলদ ডিমটা। তারপর সেখান থেকে চুলের মত সরু একটু অংশ তুলে নেয়। মোমে মুড়িয়ে নিয়ে দিয়ে দেয় গলিত সিসার সাথে।

মিশ্রণটার রঙ লালচে হয়ে গেছে। অনেকটা রক্তের মত। সরিয়ে আনে সে সেটাকে। তারপর ঠান্ডা হতে দেয়। এসব কাজ করতে করতে সন্যাসীর সাথে গোত্রযুদ্ধ নিয়েও কথোপকথন করে।

বিরক্ত হয়ে গেছে সন্যাসী। গিজার সামনে ক্যারাভান থেমেছিল একটু সময়ের জন্য, যুদ্ধ থামার জন্য।

কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাই সফল হবে। বলে সন্যাসী।

সত্যি।

পাত্রটা ঠান্ডা হবার পর অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সন্যাসী ছেলেটা দুজনেই। সীসা জমে গেছে। কিন্তু আর সীমা নেই। হয়ে গেছে স্বর্ণ।

আমি কি কোনদিন কাজটা শিখতে পারব? প্রশ্ন তোলে ছেলেটা।

এটা আমার জীবনের লক্ষ্য, তোমার নয়। শুধু তোমাকে দেখানোর ইচ্ছা। ছিল যে কাজটা করা সম্ভব।

ধর্মশালার দরজার দিকে চলে আসে তারা। সেখানে এ্যালকেমিস্ট চারটা ভাগে ভাগ করে চাকতিটাকে।

এটা আপনার জন্য, বাড়িয়ে দেয় সন্যাসীর দিকে। ধর্মশালায় তীর্থযাত্রিদের সাথে যে ভাল ব্যবহার করেন, সেজন্য।

কিন্তু আমার ভাল ব্যবহারের বিনিময়ে ভাল সম্মানীও পাওয়া যায়। জবাব দেয় সন্যাসী।

আর বলবেন না কথাটা। জীবন হয়ত শুনে ফেলছে। পরেরবার আর এত নাও পেতে পারেন।

এবার ফিরে তাকায় ছেলেটার দিকে, এটা তোমাকে দিচ্ছি। সেনাপতির কাছে যে জিনিসটুকু হারিয়েছ তার বিনিময়ে।

সে বলতে নিয়েছিল যে আসলে এত স্বর্ণ দেয়নি সে। বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।

আর এটা আমার জন্য, বলে একটা টুকরা ঢুকিয়ে ফেলে পকেটে, যুদ্ধের সময় আমাকে মরুভূমির ভিতর দিয়ে মরুদ্যানে পৌঁছতে হবে।

চতুর্থ টুকরাটা বাড়িয়ে দেয় সন্যাসীর দিকে।

আর এটা ছেলেটার জন্য। যদি কখনো দরকার পড়ে।

কিন্তু আমিতো গুপ্তধনের সন্ধানে বের হব। প্রতিবাদ করল ছেলেটা, খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।

আর আমি ভাল করেই জানি তুমি তা পাবে।

কেন?

কারণ এর মধ্যেই তুমি দুবার সব টাকাকড়ি খুইয়ে বসেছ। আমি বয়েসি সংস্কারাচ্ছন্ন আরব, বিশ্বাস করি আমাদের প্রবাদে। একবার যা হয় তা আর কখনো হতে পারে না। কিন্তু যা দুবার হয় তা তৃতীয়বার হবেই।

ঘোড়ার কাছে চলে যায় তারা।

 

২.৩২

আমি তোমাকে একটা স্বপ্নের গল্প বলতে পারি। বলল এ্যালকেমিস্ট। ছেলেটা ঘোড়া আরো কাছে নিয়ে আসে।

আদ্যিকালের রোমে, সম্রাট টিবেরিয়াসের সময়ে এক ভাল লোকের দু ছেলে ছিল। একজন সেনাবাহিনীতে কাজ করে বলে তাকে সব সময় দুর দূরান্তে থাকতে হত। আরেকজন কবি। মাতিয়ে রাখত পুরো রোম, দারুণ দারুণ কবিতায়।

এক রাতে বাবা স্বপ্ন দেখে। এক দেবদূত এসে জানায় যে তাদের ছেলের কথা জানবে এবং পৃথিবীর মানুষ তার কথা বলে বেড়াবে অহর্নিশি। বাবা গর্বে উঠে বসে। সে এমন এক স্বপ্ন দেখেছে যা যে কোন বাবার কাছে আরাধ্য।

কিছুদিন পর বাবা ভেঙে যাওয়া রথের হাত থেকে একটা বাচ্চা ছেলেকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যায়। স্বর্গে গিয়ে দেবদূতকে প্রশ্ন করে স্বপ্নের ব্যাখ্যার ব্যাপারে।

আপনি খুব ভালমানুষ, বলে দেবদূত, জীবন চালিয়েছেন ভালভাবে। মারা গেছেন সম্মানের সাথে। এখন আপনার যে কোন একটা কথা রাখতে পারি।

আপনারা স্বপ্নে দেখা দিলে আমার জীবনটা আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। মনে হয়, আমার কষ্টের ফলেই আমার ছেলের কবিতা যুগ যুগ ধরে পড়া হবে। আমি আর কোন পুরস্কার চাই না। চাই ছেলের অক্ষরগুলো দেখতে।

দেবদূত লোকটার কাধ স্পর্শ করে, দুজনেই চলে যায় অনেক অনেক ভবিষ্যতে। সেখানে অতিকায় সব গড়ন আর আছে হাজার হাজার মানুষ। কথা বলছে বিচিত্র সব ভাষায়।

আনন্দে ডুকরে কেদে ওঠে লোকটা।

জানতাম, আমার ছেলের কবিতা অমর হবে। বিশ্বাস ছিল মনে। কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রশ্ন করে দেবদূতকে, দয়া করে বলবেন কি আমার ছেলের কোন গানটা গাইছে তারা?

কাছে যায় ফেরেস্তা, তারপর কোমল গলায় কথা বলে নিয়ে যায় পাশের এক বেঞ্চিতে।

আপনার যে ছেলে কবি ছিলেন তার কবিতা ছিল রোমে খুব বিখ্যাত, সবাই ভালবাসত। উপভোগ করত মন খুলে। কিন্তু টাইবেরিয়াসের সাম্রাজ্যের  পতন হলে হারিয়ে যায় কবিতাগুলোও। এখন যার লেখা শুনছেন তিনি। আপনার যোদ্ধা ছেলে।

অবাক হয়ে দেবদূতের দিকে তাকায় লোকটা।

অনেক দূরে কাজ করতে গিয়েছিলেন সে ছেলে। পরে প্রাশাসক হন। হন ন্যায়বিচারক আর ভাল মানুষ। এক বিকালে তার এক চকির অসুস্থ হয়ে পড়ে। মনে হয় মারা যাবে সে। আপনার ছেলে এক রাব্বির কথা শোনেন। লোকটা অসুস্থদের সুস্থ করে তুলতে পারেন, এমনি বলা হত। পথে জানতে পারেন, যে লোকের খোঁজে যাচ্ছে সে আসলে তিনি ঈশ্বরের পুত্র। আরো অনেক লোক তার কল্যানে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তারা আপনার পুত্রকে সেই অবাক করা চিকিৎসকের দীক্ষায় দীক্ষিত করে। রোমান শাসক হয়েও তিনি গ্রহণ করেন নতুন ধর্ম। তারপর যান সেখানে, যেখানে তাকে পাওয়া যাবে।

জানালেন তার ভূতের অসুস্থতার কথা। রাব্বি সাথে সাথে তার বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুত। এদিকে রাব্বির চোখে চোখ রেখে দক্ষ শাসক আপনার ছেলে বুঝে যান তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ঈশ্বরের পুত্র।

আর আপনার ছেলে এ কথাগুলো বলেছিলেন- এ হল রাব্বির কাছে বলা তার কথা, আর কখনো সে কথা ভুলে যাওয়া হয়নি: হে প্রভু আমার, আমার ছাদের তলায় আসবেন, সে সৌভাগ্য নেই। নাহয় একটু কথা বলুন, তাতেই সুস্থ হয়ে উঠবে আমার ভৃত্য।

এ্যালকেমিস্ট বলল, যাই করুক না কেন, পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ এ গ্রহের ইতিহাসে একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। সাধারণত নিজেও তা জানে না।

হাসল ছেলেটা। এক রাখাল ছেলের কাছে জীবনের প্রশ্নগুলো এত বড় হয়ে দেখা দিবে আগে কখনো ভাবেনি সে।

বিদায়। বলে এলকেমিস্ট।

বিদায় জানায় ছেলেটাও।

 

২.৩৩

মরুভূমির বুকে কয়েক ঘন্টা ঘুরে ঘুরে হৃদয়ের সব উপদেশ অনুসরণ করে মনে করে কথাগুলো যে আসলে তার হৃদয়ই বলে দিবে কোথায় আছে গুপ্তধন।

যেখানেই তোমার গুপ্তধন থাক না কেন, সেইসাথে থাকবে তোমার হৃদয়ও। বলেছিল এ্যালকেমিস্ট।

কিন্তু তার হৃদয় অন্য কোন কথা বলছে। হৃদয় বলছে এক রাখাল ছেলের কথা যে সব ছেড়েছুড়ে অন্য মহাদেশে চলে গিয়েছিল। বলে লক্ষ্যের কথা যা। অনেকে দূর দূরান্তে ঘুরে, বহু শ্রম করেও পায় না। বলে ভ্রমণ, আবিষ্কার, বই আর পরিবর্তনের কথা।

আরো একটা চিবিতে ওঠার সময় কথা বলে উঠল হৃদয়, যে জায়গা চোখে অশ্রু আনে সে জায়গার ব্যাপারে সাবধান থেক। এখানেই আছি আমি, আর সেখানেই তোমার গুপ্তধন।

ধীর গতিতে ছোটখাট পাহাড়ে ওঠে ছেলেটা। তাকায় সামনে। আকাশে গোল একটা চাঁদ ঝুলে আছে। এক মাস হয়ে গেল, রওনা দিয়েছে সে। সামনের অংশটুকু যেন সমুদ্র। সাগরের মত ঢেউ খেলানো বালিময় প্রান্তর। এ্যালকেমিস্টের সাথে দেখা হবার রাতের কথা মনে পড়ে যায় তার। চাদটা একেবারে নিশ্ৰুপ। নিশ্ৰুপ পুরো মরুভূমি।

আরেকটা ঢিবির উপরে উঠেই চনমন করে উঠল মনটা। সামনে ছড়িয়ে আছে মিশরিয় পিরামিড।

হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে ছেলেটা। কান্না শুরু করে দেয়। এ লক্ষ্যের জন্য ধন্যবাদ জানায় ঈশ্বরকে জানায় রাজার কাছে নিয়ে যাবার জন্য, বণিক ইংরেজ-এলকেমিস্টের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। ধন্যবাদ জানায় এমন এক মেয়ের দেখা পাইয়ে দেয়ার জন্য যে বলেছিল, ভালবাসা কখনো কাউকে লক্ষ্য থেকে সরাতে পারে না।

এখন সে চাইলেই চলে যেতে পারে মরুদ্যানে। ফাতিমাকে বিয়ে করে আবার হয়ে যেতে পারে রাখাল। সেই এ্যালকেমিস্টও সীসাকে স্বর্ণ বানানোর ধারা জানত, তারপরও সে থেকে গেছে মরুদ্যানের বুকে। যা জানা প্রয়োজন। সব জেনে নিয়েছে সে। চাওয়ার মত সব পেয়েছে।

কিন্তু এখনো একটা ব্যাপার বাকি। উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ না হলে কখনো কোন পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখে না। চারপাশের বালিতে চোখ বুলায় ছেলেটা। দেখে, যেখানে চোখের পানি পড়েছিল, একজোড়া কাকড়া ঝগড়া করছে সেখানে। জানে, মিশরে কাকড়ার যুদ্ধ ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে।

আরো এক লক্ষণ। ছেলেটা ঢিবি খুঁড়তে শুরু করে। মনে পড়ে সেই স্ফটিকওয়ালার কথা। কেউ চাইলে বাড়ির পিছনেই একটা পিরামিড বানাতে পারে। আসলে কখনোই সম্ভব নয়। সারা জীবন ধরে পাথরের উপর পাথর বসালেও সম্ভব নয়।

খুঁড়েই যাচ্ছে সে। খুঁড়ে যাচ্ছে। কিছু পাওয়া যায় না। মনে পড়ে যায়, অনেক শতাব্দি আগে তৈরি হত পিরামিড। আরো খুঁড়ে চলে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়েও থামে না সে। যেখানে অশ্রু পড়েছে সেখানে বালি সরিয়ে যায় অবিরাম।

কিন্তু নেমে যাবার আগে তাকে সম্পদ পেতে হবে। কয়েকজন মানুষের পায়ের আওয়াজ পায় সে। যারা এসেছে তাদের জামা তো দেখা যায়ই না, চোখেও কাপড় বাধা।

কী করছ এখানে? অবশেষে প্রশ্ন তোলে তাদের একজন।

কিছু বলে না ছেলেটা। সে পেয়ে গেছে গুপ্তধন। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

আমরা হলাম গোত্রের উদ্বাস্তু। যুদ্ধ সব কেড়ে নিয়েছে। এখন, টাকা দরকার আমাদের। কী লুকাচ্ছ এখানে?

কিছুই লুকাচ্ছি না।

কিন্তু একজন তাকে ধরে ফেলল। আরেকজন পকেট হাতড়ে বের করল সোনার সেই পাতটা।

স্বর্ণ আছে এখানে। বলে সে।

চাঁদের আলোয় দেখা যায়, তাকে ধরে রাখা লোকটার চোখেমুখে মৃত্যু খেলা করছে।

সে মনে হয় আরো স্বর্ণ লুকিয়ে রেখেছে মাটির নিচে।

তারা ছেলেটাকে খুঁড়ে যেতে বাধ্য করে, সে আর কিছু পায় না। বিকাল নামতে না নামতেই তারা সবাই মিলে মারা শুরু করে তাকে। ছিড়ে যায় কাপড় চোপড়। একটু পর তার মনে হয়, মারা যাবে।

মারা গেলে টাকা কোন কাজে লাগবে? টাকা সব সময় প্রাণ বাচায় না। বলেছিল এ্যালকেমিস্ট।

অবশেষে সে লোকগুলোকে শুনিয়ে বলে, আমি গুপ্তধনের আশায় বালি খুঁড়ছি!

দুজনকে চেপে ধরার সময় এখান থেকে গুপ্তধন পাবার ইচ্ছা প্রবল হয়। এ পিরামিডের দেশে তার ভাবনারচেও বেশি গুপ্তধন আছে।

এবার দলপতি এগিয়ে আসে, ছেড়ে দাও। ওর কাছে আর কিছু নেই। কে জানে কোথেকে চুরি করে এনেছিল সোনার টুকরাটা!

বালির উপর পড়ে যায় ছেলেটা। আর যাবার সময় দলনেতা চুল টেনে বলে, চলে যাচ্ছি আমরা।। সবশেষে ফিরে আসে এখানে। তারপর বলা শুরু করে এক আজব কাহিনী, স্বপ্নে বিশ্বাস কর কেন এত! প্রায় দু বছর আগে এখানে শুয়ে শুয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। দেখেছিলাম যে আন্দালুসিয়ায় আছে একটা ভাঙা গির্জা। সেই গির্জার ভিতর থেকে উঠে গেছে বড়সড় একটা গাছ। গাছের তলায় পাওয়া যাবে গুপ্তধন। কিন্তু আমি এত বোকা না যে সামান্য এক স্বপ্নের জন্য পুরো মহাদেশ পাড়ি দিয়ে মরুভূমি, জঙ্গল, সাগর পাড়ি দিয়ে হন্যে হয়ে মরব। এসব আজেবাজে স্বপ্নের কোন মূল্য দিও না কখনো।

তারপর চলে গেল তারা।

কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাড়ায় ছেলেটা। আবার তাকায় পিরামিডের দিকে। যেন দাতমুখ খিচিয়ে পিরামিডগুলো হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। সেও একটা হাসি ফিরিয়ে দেয়।

মন এখন পরিপূর্ণ। কারণ সে জানে, কোথায় আছে গুপ্তধন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *