২.১১ এরা এত জটিল জিনিস বানায় কেন

এরা এত জটিল জিনিস বানায় কেন? একরাতে সান্তিয়াগো জিজ্ঞেস করে ইংরেজকে।

যেন যাদের বোঝার দায় পড়েছে তারা বুঝে নেয়, একবার দেখ, সবাই যদি পারদকে স্বর্ণ করতে জানে তাহলে স্বর্ণের দামটা থাকবে কোথায়?

কিন্তু শুধু কাগজে কলমে কাজ করলে হবে না, অনেক জানলেও হবে না, হলে আমি চলে আসতাম না এখানে, এ মরুভূমির মধ্যে। একজন সত্যিকার এ্যালকেমিস্টের খোঁজে আছি যে কোডগুলো ভেঙে দিবে।

কখন লেখা হয় বইগুলো?

অনেক শতক আগে।

তখনকার দিনে ছাপাখানা ছিল না, যুক্তি দেখায় ছেলেটা, সবাই যে এ্যালকেমি জানতে পারবে সে আশাতেও গুড়ে বালি। তাহলে কেন শুধু শুধু এত জটিল সব আকাআকি আর অঙ্ক করেছে?

সরাসরি জবাব দেয় না ইংরেজ। গত কয়েকদিন ধরে সে ক্যারাভান চালানোর রীতিনীতি দেখছে। কিন্তু শিখতে পারেনি নতুন কোনকিছু। শুধু যুদ্ধের কথায় কীভাবে সাবধান হতে হয় সেটাই শিখে নেয়ার বিষয়।

 

২.১২

বইটা ইংরেজের কাছে জমা দিতে গেল সান্তিয়াগো।

শিখেছ নাকি কিছু?

ইংরেজ আসলে যুদ্ধের কথায় অস্থির বোধ করছে। তার মনে হয় এ্যালকেমির মত মজার বিষয় নিয়ে কথা বললে মনের অস্থিরতা দূর হবে।

ছেলেটা বলল, দুনিয়ার একটা আত্মা আছে, যে আত্মা চিনতে পারে, সে বিভিন্ন বিষয়ের ভাষাও চিনতে পারবে। শিখলাম, অনেক এ্যালকেমিস্ট তাদের জীবনের লক্ষ্যটা অর্জন করে ফিলোসফারস স্টোন আর জীবনের অমৃত নিয়ে।

কিন্তু, সবচে বড় কথা হল, এ কথাগুলো এত সরল যে লিখে ফেলা যায় একটা এ্যামারান্ডের উপর।

হতাশ হয় ইংরেজ লোকটা। সারা জীবনের হাড়ভাঙা ল্যাবরেটরির কাজ, শিক্ষা ও গবেষণার প্রণালী, নতুন নতুন প্রযুক্তি কিছুই রাখাল ছেলেটার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না, হয়ত এজন্য যে তার আত্মা একেবারে আদ্যিকালের।

বই নিয়ে সে ব্যাগে পুরে ফেলে। তুমি বরং ক্যারাভান দেখতে ফিরে যাও, আমি এসব দেখে কিস্যু শিখতে পারিনি।

ফিরে যায় ছেলেটা। তারপর নিজেকে শোনায়, সবারই নিজের নিজের শিখে নেয়ার পদ্ধতি আছে। আমারটার সাথে তারটা মিলবে না। কিন্তু দুজনেই জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেরিয়েছি। শ্রদ্ধা করি তাকে।

 

২.১৩.

রাতদিন চলবে ক্যারাভান এখন থেকে। হুড় পরা বেদুইনরা যখন তখন দেখা দেয়। উটচালক বন্ধু এগিয়ে এসে জানায়, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ক্যারাভানের কপাল খুব ভাল থাকলে মরুদ্যানে পৌঁছতে পারবে।

প্রাণিগুলো মুষড়ে পড়ে, মানুষে মানুষে কথা বলা কমে যায়। রাতে উটের গরগর আওয়াজে সবার পিলে চমকে ওঠে। কে জানে, আক্রমণ হয়ে গেল কিনা!

এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই উটওয়ালার।

বেচে আছি আমি। খাবার সময় সে কথাটাই ভাবি শুধু। পথচলার সময় পথের কথা আর যদি যুদ্ধ বেধে যায়, আর কারোচে কম লড়ব না।

যেহেতু আমার নির্ভরতা নেই অতীত-ভবিষ্যতের উপর, শুধু বর্তমান নিয়ে বাচতে চাই। বর্তমানে যত মনোযোগ দিবে তত সুখি হবে তুমি। দেখো, মরুর বুকেও প্রাণ আছে। আকাশে আছে তারার দল। গোত্রগুলো লড়ে যায় কারণ তারা মানুষ। জীবন আসলে তোমার কাছে এক চমক্কার পার্টি। যেখানে আছি, সেখানে টিকে থাকাই হল জীবন।

এক রাতে, যে তারা দেখে দেখে তারা এগিয়ে যেত সেদিকে তাকায় সান্তিয়াগো। তারপর বুঝতে পারে, কেন যেন দিগন্ত উঠে এসেছে। নাকি নেমে এসেছে তারার দল? না, সামনেই মরুদ্যান।

মরুদ্যান! বলে ওঠে উটচালক।

চল এখনি যাই! যাচ্ছি না কেন আমরা?

কারণ, ঘুমাতে হবে।

 

২.১৪

সূর্য ওঠার সাথে সাথে জেগে উঠল ছেলেটা। যেখানে ছিল রাতের তারা, সেখানে এখন দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি খেজুর গাছ।

আগেই জেগে ওঠা ইংরেজ কথা বলে ওঠে খুশির সুরে, পেরেছি! আমরা পেরেছি!

চুপ করে থাকে সান্তিয়াগো। তার লক্ষ্য এখনো দূরে। পিরামিড এখনো দূরে। কিন্তু আজ সকাল, দিগন্ত ছোয়া খেজুর গাছের সারি, সব রয়ে যাবে স্মৃতিতে। মানুষের বাস বর্তমানে, ভবিষ্যতের স্বপ্নে।

কাল একটা উটের আওয়াজ পেয়ে সবাই ভড়কে গিয়েছিল, আজ খেজুর গাছ শোনায় আশ্বাসের বাণী।

পৃথিবীর ভাষা আসলে অনেক ধরনের।

 

২.১৫

সময় বয়ে যায়, আর বয়ে যায় ক্যারাভান, ভাবে এ্যালকেমিস্ট। লোকজন চিৎকার চেচামেচি করছে, উড়ছে মরুর বালি, বাচ্চারা নতুন মানুষ দেখে উৎসাহে টগবগ করছে। দেখল, উপজাতিয় নেতারা ক্যারাভানের নেতার সাথে কথা বলছে অনেক সময় ধরে।

কিন্তু এসবে এ্যালকেমিস্টের কিস্যু এসে যায় না। সে অনেক ক্যারাভান আসতে যেতে দেখেছে, দেখেছে মরুর বুকে রাজা আর ভিখারিকে হাটতে, ধু, ধূ প্রান্তর যেমন ছিল থেকে গেছে ঠিক তেমনি।

সে ছেলেবেলা থেকে একটা ব্যাপার দেখে দেখে অভ্যস্ত। ভ্রমণ করতে আসা লোকজন সপ্তাহের পর সপ্তাহ মরুভূমিতে হলুদ বালি আর নীল আকাশ দেখে দেখে হঠাৎ সবুজ খেজুরের সারি দেখলে পাগলের মত হয়ে যায়।

কে জানে, মানুষ যাতে গাছের মূল্য দেয় এজন্যই হয়ত ঈশ্বর মরুভূমি সৃষ্টি করেছেন।

তাকে আরো বাস্তব কিছু ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এখানে, এ বহারে আছে এক লোক যাকে কিছু শিখাতে হতে পারে। লক্ষণগুলো এমনি বলে। সে এখনো দেখেনি লোকটাকে, কিন্তু অভ্যস্ত চোখ এক মুহূর্তে চিনে ফেলে।

তার একটাই আশা, আগের শিক্ষার্থীর মত যোগ্য যাতে হয়।

জানি না এসব কথা মুখের ভাষায় বদলে নেয়ার দরকারটা কী? ঈশ্বর তার সব সৃষ্টিতে এসব রহস্য রেখেছে।

তবু, এসব জ্ঞানকে কথায় রূপান্তর করার কারণ অন্য। মানুষের জন্য। সবাই মহাজাগতিক ভাষা পারে না।

 

২.১৬

ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হয় না সান্তিয়াগোর। তার মনে হয়েছিল মরুদ্যান জিনিসটা আসলে সামান্য কিছু খেজুর গাছের সারি- ভূগোল বইতে যেমন দেখেছিল তেমন কিন্তু আসলে স্পেনের অনেক শহরেরচে বড় এ জায়গাটা। কুয়া আছে তিনশ। আছে পঞ্চাশ হাজার খেজুর গাছ। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রঙ বেরঙের হাজারো তাবু।

দেখে আরব্যরজনীর কথা মনে পড়ে যায়, তাই না? প্রশ্ন তোলে ইংরেজ লোকটা। এ্যালকেমিস্টের সাথে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে আছে।

বাচ্চারা ঘিরে আছে তাদের। পুরুষরা জানতে চায় যুদ্ধের ব্যাপারে আর মহিলারা নিয়ে আসা রত্ন দেখতে ব্যস্ত।

মরুর নিরবতা থেমে গেছে। একসাথে সবাই গোলমাল পাকাতে শুরু করে। যেন জীবন ফিরে এসেছে এখন, তারা চলে এসেছে আত্মার জগত থেকে মানুষের জগতে।

অনেকে ভয়ে ভয়ে ছিল। তখন বাকিরা জানায়, যুদ্ধের জন্য মরুদ্যান খারাপ জায়গা নয়, সাহারার বুকে মরুদ্যান অনেক আছে। কিন্তু এগুলোয় বাস করে মূলত শিশু আর নারীরা। তাই যুদ্ধ হয় মরুভূমির বুকে।

বহরের নেতা সবাইকে কোনক্রমে জড়ো করে জানাল যে যুদ্ধ থামা পর্যন্ত তারা এখানেই অপেক্ষা করবে। তারপর জানাল, আরবের রীতি অনুযায়ী, সবাই থাকবে এখানে। এখানকার মানুষের বাসায় আতিথেয়তা নিবে।

কিন্তু সশস্ত্র লোক আর তার পাহারাদারদের তুলে দিল গোত্রপতির হাতে।

এই হল যুদ্ধের নিয়ম, বলল সে, যোদ্ধারা যুদ্ধের সময় মরুদ্যানে। থাকতে পারবে না।

অবাক করে দিয়ে একটা কোল্ট রিভলভার বের করে ইংরেজ। তারপর তুলে দেয় গোত্রপতিদের হাতে।

রিভলভার কেন?

এটা মানুষের উপর বিশ্বাস আনতে সাহায্য করে আমাকে।

এখন সান্তিয়াগোর মনে পড়ে যায় গুপ্তধনের কথা। যত কাছে যাচ্ছে ততই কঠিন হয়ে উঠছে যেন। যে শুরু করে তার ভাল ভাগ্যের ব্যাপারটা আর নেই।

পথে পথে আছে লক্ষণ। ঈশ্বর আমার জন্য পাঠিয়েছে। হঠাত তার মনে হয় আসলে লক্ষণগুলো পার্থিব বিষয়। খাওয়া ঘুমানোর মত নিত্যদিনের ব্যাপার।

ধৈর্য হারিও না, নিজেকে শোনায় সান্তিয়াগো। সেই উট চালকের কথাই যেন সত্যি, খাবার সময় খাও, চলার সময় এগিয়ে চল।

প্রথমদিন সবাই পাড়ি মাতালের মত পড়ে পড়ে ঘুমায়। প্রায় সমবয়সি আরো পাঁচজনের সাথে ছেলেটা আর তার উটওয়ালা বন্ধু শুয়েছে।

সে তাদের শোনার জীবনের কথা। কী করে রাখাল হল, স্ফটিকের দোকানদার হল, তারপর বলল ইংরেজ লোকটার কথা।

চলে এল ইংরেজ একটু পরই, তুমি এখানে! আর আমার অবস্থা খারাপ। আচ্ছা, একটু সহায়তা কর। এ্যালকেমিস্ট কোথায় থাকে খুজে বের করতে হবে।

তারা নিজেরাই বের করবে, ঠিক করে নেয়। মরুদ্যানের আর দশজনের মত করে একজন এ্যালকেমিস্ট বাস করবে তা তো হবে না। হয় তার তাবু হবে গোল, নাহয় অষ্টপ্রহর সেখানে আগুন জ্বলবে।

সবখানে খোজার পর একটা সিদ্ধান্তে আসে তারা। মরুদ্যানটা অনেক বেশি বড়। হাজার তাবু আছে এখানে।

সারাটা দিন মাটি হয়ে গেল, কুয়ার পাশে বসে বলতে থাকে ইংরেজ।

তারচে চুল কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

কিন্তু ইংরেজ এখানে আসার কারণ জানাতে চায় না কাউকে। সব ভেস্তে যেতে পারে। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টায় সে।

ছাগলের চামড়ায় পানি নিতে আসা এক মহিলাকে প্রশ্ন করে শুরু করবে সান্তিয়াগো।

শুভসন্ধ্যা, ম্যাডাম। আমি এ মরুদ্যানের এ্যালকেমিস্টকে খুজে বের করার চেষ্টা করছি।

মহিলা কশ্মিনকালেও এমনধারা শব্দ শোনেনি জানিয়ে চট জলদি চলে গেল। আরো জানিয়ে গেল যে কালো পোশাক পরা মহিলাদের সাথে কথা বলতে চাওয়া উচিত নয়। তারা বিবাহিত। রীতিনীতি মেনে চলা সবার দরকার।

হতাশ হয় ইংরেজ। হয়ত ভুল করছে। কিন্তু সান্তিয়াগোর মনে কোন হতাশা নেই। সে জানে, যখন কেউ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে তখন সারা জগৎ তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে।

আমি আগে কখনো এ্যালকেমিস্টের কথা শুনিনি। হয়ত এখানকার কেউ শোনেনি।

জ্বলে উঠল ইংরেজ লোকটার চোখের তারা, তাইতো! হয়ত এখানকার কেউ জানেই না এ্যালকেমিস্ট আসলে কী! খুজে বের কর কে লোকের অসুখ বিসুখ সারায়।

এখন শুধু কালো পোশাকে শরীর ঢাকা মহিলারা আসছে কুয়ার কাছে।

অবশেষে একজন পুরুষ এলে সান্তিয়াগো জিজ্ঞেস করল, লোকের রোগ হলে প্রতিকার করে এমন কাউকে চেনেন নাকি আপনি?

আমাদের অসুস্থতা সারান আল্লাহ। দেখেই বোঝা যায়, নবাগতকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে, কোন ডাক্তারকে খুঁজছেন?

কোরান থেকে কয়েকটা আয়াত পড়েই চলে গেল সে।

আরো পরে আরেকজন আসে। বয়স একটু বেশি। কাধে বালতি। একই প্রশ্ন করে ছেলেটা।

এমন লোক দিয়ে কী করবে তুমি?

কারণ এখানে আমার বন্ধু অনেক মাস ধরে কষ্ট করে এসেছে, তার সাথে দেখা করার জন্য।

যদি এমন কেউ এ মরুদ্যানে থেকে থাকে তো সে নিশ্চই খুব শক্তিমান, ভাবে লোকটা একটু সময় ধরে, এমনকি গোত্রপতিরাও চাইলেই হুটহাট তার সাথে দেখা করতে পারে না। তিনি যদি চান তো দেখা হবে।

যুদ্ধ শেষ হোক, তারপর ক্যারাভানের সাথে চলে যাবেন। মরুর জীবনে ঢোকার চেষ্টা করা ভাল নয়। চলে গেল বয়স্ক লোকটাও।

এদিকে কিছুতেই হাল ছাড়বে না ইংরেজ। এখনো পথে আছে তারা।

অবশেষে কমবয়সি এক মেয়ে হাজির হল। কালো কাপড় নেই তার। শরীরে। কাধে পাত্র ঝোলানো, মাথা কাপড়ে ঢাকা। মুখটা শুধু খোলা।

এগিয়ে যায় ছেলেটা। জিজ্ঞেস করে এ্যালকেমিস্টের কথা।

ঠিক তখনি কেমন যেন ধাক্কা লাগে তার বুকে। সারা দুনিয়ার আত্মার যেন আঘাত করছে। মেয়েটার গহিন চোখ, হাসি আর নিরবতার মাঝামাঝি থাকা ঠোঁট তাকে সব ভাষার সেরা ভাষার কথা শিখিয়ে ছাড়ে। ভালবাসা। মানবজাতিরচেও পুরনো, মরুভূমিরচেও পুরনো। চোখে চোখে কী করে যেন সে ভাষার খানিকটা চলে যায়। তারপর হেসে ফেলে মেয়েটা।

লক্ষণ। হয়ত এ মেয়ে তার নিজের অজান্তেই সারা জীবন তার জন্য অপেক্ষা করেছে। এমন সব লক্ষণ ছড়িয়ে আছে আন্দালুসিয়ার পাহাড়ে পাহাড়ে, সাহারার মরুভূমিতে, সাগরের বুকে।

এ হল পৃথিবীর শুদ্ধতম ভাষা। হঠাৎ সান্তিয়াগোর মনে হয় সে পৃথিবীর একমাত্র নারীর সামনে দাড়িয়ে আছে আর মেয়েটাও টের পাচ্ছে, একই অনুভূতি, কোন কথা নয়, শুধু অনুভূতি।

সে সব সময় বলে এসেছে যে অচেনা কাউকে হঠাৎ বিয়ে করে বসার আগে তাকে প্রেমে পড়তে হবে। কিন্তু অচেনা কাউকে এমন হঠাৎ করে ভাল লেগে যাবে তা ভাবাও কঠিন। আসলেই, পৃথিবীর সবকিছু এক হাতে লেখা। আর সব হৃদয়ে ভালবাসা দিয়ে পাঠান তিনি।

মাকতুব, ভাবে ছেলেটা।

ধরে একটু ঝাকায় ইংরেজ লোকটা, আরে! জিজ্ঞেস কর!

সামনে এগিয়ে যায় সান্তিয়াগো, তারপর মেয়েটা যখন আবার হাসে, হেসে ওঠে সেও।

নাম কী তোমার?

ফাতিমা। চোখের পলক পড়ে মেয়েটার।

আমাদের দেশে কোন কোন মেয়েকে লোকে এ নামেই ডাকে।

নবির মেয়ের নাম। বলল ফাতিমা, দিগ্বিজয়ীরা সবখানে নামটাকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

সুন্দর মেয়েটা যখন যোদ্ধাদের কথা বলে, তখন গর্ব ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে। তাই আরো সুন্দর দেখায়।

ইংরেজ লোকটার তাড়া খেয়ে অবশেষে আসল প্রসঙ্গে আসে সান্তিয়াগো। লোকের অসুখ সারায় যে, সে কোথায়।

এ লোকটা জীবনের সব রহস্যের কথা জানে। বলল মেয়েটা, যোগাযোগ করতে পারে মরুভূমির জিনদের সাথেও।

জিন হল ভাল আর মন্দে মিশানো এক ধরনের আত্মিক অবয়ব। দক্ষিণে দেখায় মেয়েটা। সেখানে আছে অদ্ভুত সেই লোক। তারপর পাত্র ভরে নিয়ে রওনা দেয়।

সাথে সাথে রওনা দেয় ইংরেজও। কোন একদিন, কুয়ার পাশে বসে বসে আপনমনে নিজেকে শোনায় সান্তিয়াগো, আমি তারিফায় বসে ছিলাম। আর বাতাস এসেছিল দূর আফ্রিকার বুক থেকে। সুন্দর মেয়ের সুঘ্রাণ নিয়ে এসেছিল।

বুঝতে পারে সে, দেখার আগে থেকেই ভালবাসে এ মেয়েকে। জানে, এ মেয়ের জন্য থাকা ভালবাসাই তাকে পৃথিবীর সব গুপ্তধন আবিষ্কারের পথে রাহ খরচ যোগাবে।

পরদিন সে আবার ফিরে যায় সেই কুয়ার কাছে। অবাক ব্যাপার, ইংরেজ লোকটা সেখানে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে মরুভুমির দিকে।

আমি সারাটা বিকাল আর সন্ধ্যা অপেক্ষা করলাম। সে এল সন্ধ্যার প্রথম তারা উঠে আসার সাথে সাথে। জানালাম কী খোঁজ করছি সে কথা।

প্রশ্ন করল কখনো অন্য কোন ধাতুকে সোনা বানিয়েছি কিনা।

বললাম, এসব জানতেই এসেছি। আমাকে তখন বলল, আগে বানাতে জানতে হবে। এটুকুই সব, যাও আর চেষ্টা কর।

কোন জবাব নেই ছেলেটার মুখে। বেচারা ইংরেজ সারাটা পথ পেরিয়ে এসেছে এ কথা শোনার জন্য যে সে যে চেষ্টা করে আসছে অনেক আগে থেকে সেটাই করে যেতে হবে।

তাহলে… চেষ্টা কর।

তাই করব। শুরু করব এখনি।

ইংরেজ চলে যাবার পর এল ফাতিমা। ভরে নিল তার পানির পাত্র।

একটা কথা বলার জন্য এসেছি এখানে, ফাতিমা। তোমাকে স্ত্রী করে পেতে চাই। ভালবাসি।

মেয়েটা সাথে সাথে পাত্র ফেলে দেয় হাত থেকে। ছিটকে পড়ে পানি।

প্রতিদিন এখানে অপেক্ষা করব তোমার জন্য। সাগর আর মরুভূমি পেরিয়ে এসেছি এখানে, পিরামিডের দেশে, একটা গুপ্তধনের সন্ধানে। আমার কাছে যুদ্ধটা রীতিমত অভিশাপ। কিন্তু এখন তাই আবার আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কারণ দেখা পেয়েছি তোমার।

এক সময় থেমে যাবে যুদ্ধ।

আশপাশে, খেজুর বনে তাকায় সান্তিয়াগো। নিজেকে শোনায়, সে একজন রাখাল ছেলে, আর চাইলেই আবারো রাখাল হয়ে যেতে পারবে। শুধু এসেছে গুপ্তধনের খোঁজে। আর তার কাছে গুপ্তধনেরচে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফাতিমা।

গোত্রের লোকেরা সব সময় গুপ্তধনের তালাশে থাকে, যেন মেয়েটা ধরে ফেলেছে সান্তিয়াগোর চিন্তা, আর মরুর মেয়েরা তাদের গোত্রের ছেলেদের নিয়ে গর্ব করে।

পাত্র ভরে নিয়ে ফিরে গেল সে।

প্রতিদিন সান্তিয়াগো যায় সেই কুয়ার কাছে। দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষায় থাকে। তারপর একটু একটু করে শোনায় নিজের জীবনের কাহিনী।

ফাতিমার সাথে কাটানো দিনের পনেরটা মিনিট ছাড়া বাকি সময় যেন কাটতেই চায় না।

মাস খানেক পেরিয়ে যাবার পর দলনেতা ক্যারাভানের সবাইকে ডাকল।

কে জানে কখন থামবে যুদ্ধ, আর কে জানে কখন বেরিয়ে পড়ব আমরা! যুদ্ধ চলতে পারে অনেক সময় ধরে। হয়ত এক বছর। হয়ত আরো বেশি। দু। পক্ষের শক্তি অনেক। তাদের কাছে যুদ্ধের গুরুত্বও অনেক। এটা কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ নয়। দু পক্ষই শক্তির ভারসাম্যের জন্য লড়ছে, আর যখন এমনধারা যুদ্ধ একবার শুরু হয়, তখন চলতেই থাকে। কারণ এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ দু পক্ষকেই মদদ দেন।

সবাই চলে যায় যার যার থাকার জায়গায়। ছেলেটা যায় ফাতিমার জন্য। সেদিন বিকালে তার কথা হয় কারিভানের ব্যাপারে।

আমাদের দেখা হবার পরদিন বলেছিলে না, ভালবাস আমাকে? তারপর শিখিয়ে দিলে মহাজাগতিক ভাষার ব্যাপারে, শিখালে বিশ্বের আত্মার কথা। এসব মিলিয়ে আমি কেমন যেন তোমারি অংশ হয়ে গেছি।

ফাতিমার রিনরিনে কণ্ঠ টের পায় সান্তিয়াগো। তার কাছে খেজুরগাছে বাতাসের হুটোপুটির শব্দ আর তেমন ভাল লাগে না।

এ মরুদ্যানে তোমার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছি। ভুলে গেছি অতীতের কথা, আমার রীতিনীতির কথা, ভুলে গেছি মরুর বুকে পুরুষ নারীকে কীভাবে চায় সে কথাও। ছেলেবেলার পর থেকে মনে হত মরুভূমি আমাকে দারুণ কোন উপহার দিবে। পেয়ে গেছি সেটা।

সান্তিয়াগো চায় একটা হাত তুলে নিতে। কিন্তু ফাতিমা আকড়ে আছে পানির পাত্র।

তুমি স্বপ্নের কথা বলেছ, বলেছ বুড়ো রাজা আর নানা কথা। বলেছ লক্ষণের কথা। আমিতো ভয় পাই না। কারণ লক্ষণ টেনে এনেছে তোমাকে। আমার কাছে। এখন আমি তোমার স্বপ্নের অংশ, তোমার লক্ষ্যের অংশ।

তাই আমার মনে হয়, তোমার উচিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। যুদ্ধ থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলে কর। কি আগে যাবার কথা ভাবলে এগিয়ে যাও। যাও লক্ষ্যের দিকে। মরুর বুকের ঢেউগুলো হররোজ বাতাসে বাতাসে বদলে যায়। বদলায় না শুধু মরুভূমি। এভাবেই বদলাবে না আমাদের ভালবাসা।

মাকতুব, বলে সে, আমি সত্যি তোমার স্বপ্নের অংশ হয়ে থাকলে একদিন ফিরে আসবে তুমি আমার কাছে।

তার মন খারাপ হয়ে যায়। বিয়ে করা সব ক্লাখালের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের স্ত্রীদের বোঝাতে হয় কেন দূরের মাঠে যেতে হবে। ভালবাসা তাদের একত্রে রাখতে চায়।

পরের দেখায় সে কথা জানাল সান্তিয়াগো ফাতিমাকে।

মরুভূমি আমাদের কাছ থেকে আপনজন কেড়ে নেয়, মাঝে মাঝে আর ফিরে আসে না তারা। আমরাও জানি। যারা আর ফেরে না, হয়ে যায় মেঘের অংশ। তারা আমাদের জীবগুলোর অংশ হয়ে যায়, হয়ে যায় পৃথিবীর আত্মা।

কেউ কেউ সত্যি ফিরে আসে। তখন আশায় বুক বাধে অন্যেরা। আমি হিংসা করতাম সেসব মেয়েকে। এখন থেকে আমিও একজনের অপেক্ষায় থাকব।

আমি মরুর মেয়ে, গর্ব করি ব্যাপারটা নিয়ে। চাই, আমার স্বামীও বাতাসের মত, মরুভূমির বালির ঢেউয়ের মত এগিয়ে যাক। আর যদি সে ফিরে না আসে, ধরে নিব, হয়ে গেছে মাটি পানি মেঘের অংশীদার।

ফাতিমার ব্যাপারে বলার জন্য সান্তিয়াগো ইংরেজ লোকটার খোঁজ করে। অবাক হয়ে দেখে, তাবুর বাইরে একটা ফার্নেস বানিয়ে বসে আছে সে। নিচে কাঠখড়ের আগুন, উপরে স্বচ্ছ এক ফ্লাস্ক। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে মরুভূমির দিকে, মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে।

এ হল কাজের প্রথম ধাপ। প্রথমে সালফার সরিয়ে ফেলতে হবে। কঠিন কাজ। করতে হলে ব্যর্থতার ভয় আছে। তবু করব। দশ বছর আগে ভয় পেয়ে যে কাজ বন্ধ করেছিলাম, আবার শুরু করব সেটা। তবু, বিশ বছর যে অপেক্ষা করিনি তাতেই মহাখুশি।

আস্তে আস্তে সূর্য নেমে যায়। সান্তিয়াগো ভাবে, নিজের প্রশ্নগুলোর কথা জিজ্ঞেস করতে হবে মরুভূমিকে।

ভাবতে ভাবতেই টের পায়, কিসের যেন ছায়া পড়েছে তার উপর। উপরে তাকিয়ে এক জোড়া শিকারি পাখি দেখে।

পাখিগুলো যুদ্ধ করছে। তাকিয়ে থাকে সে। কে জানে, তারা হয়ত বেদখল ভালবাসার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারবে।

কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে সান্তিয়াগোর। ইচ্ছা হয় জেগে থাকতে, আবার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়ে এখনি।

আমি বিশ্বের ভাষা শিখছি, আর তাই পৃথিবীর প্রতিটা বিষয় খোলাসা হয়ে যাচ্ছে আমার সামনে… এমনকি লড়তে থাকা শিকারী পাখিরাও।

কেন যেন তার প্রেমে পড়াটা ভাল লাগতে শুরু করে। তুমি যখন কাউকে ভালবাসবে, অনেক ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যাবে তোমার সামনে।

একটা পাখি আরেকটার উপর নেমে আসে এক পলকে। তীব্র বেগে। হঠাৎ মরুভূমির দিকে তাকিয়ে সে যেন দেখতে পায় একদল যোদ্ধাকে। দেখে তাদের তলোয়ারের ঝলকানি। মনে বিবশতা চলে আসে। এক মুহূর্তের জন্য। মরিচিকা হবে হয়ত। আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছে সে। সেনাদল আসবে কোন দুঃখে!

সব সময় লক্ষণ অনুসরণ কর। বলেছিল বয়েসি রাজা। এবার বুঝতে পারে সে, কল্পনায় যে দৃশ্য দেখেছে বাস্তবে তাই হবে।

উঠে দাড়ায়। চলতে শুরু করে খেজুর বনের ভিতরে। এখন মরুভূমি নিরাপদ, আর বিপদ আছে মরুদ্যানেই।

এক গাছের নিচে বসে ছিল উটওয়ালা। সান্তিয়াগো তার দিকে এগিয়ে যায়।

সেনাবাহিনী আসবে। জেনেছি। মানে দেখেছি মনের চোখে।

মরুভূমি এমনি এক জায়গা যেখানে মানুষ চোখে অনেক কিছু দেখে।

তখন সান্তিয়াগো সবকিছু খুলে বলে।

মাঝে মাঝে মানুষের কাছে পুরো সময় হয়ে যায় একটা বই। দমকা হাওয়ায় সে বইয়ের কোন কোন পাতা খুলে যায়। পৃথিবীর সব বিষয় মাঝে মাঝে এভাবে খুলে যায়।

মরুভূমিতে এমন মানুষ আছে যারা বিশ্বের আত্মায় প্রবেশ করতে পারে। নাম তাদের সির। তাদেরকে সবাই ভয় পেয়ে চলে। তারা সাবধানে তাদের কথাও জেনে নেয়, কারণ যুদ্ধে কে মরবে আর কে বাচবে কেউ জানে না। গোত্রের মানুষ যুদ্ধ করতে চায়। চায় অনিশ্চয়তার স্বাদ পেতে। ভবিষ্যত তো আল্লাহই লিখে রেখেছেন। আর যা তিনি লিখে রেখেছেন তা মানুষের ভালর জন্য করা।

তাই গোত্রের লোকজন দল বেধে বাস করে। তারা চায় যুদ্ধ করতে। বর্তমান নিয়ে থাকতে। অনেক ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জানতে চায় কোথায় শক্রর তলোয়ার, কোথায় ঘোড়া। পরের বার কোন আঘাত করলে মারা যাবার সম্ভাবনা থাকবে না?

উটচালক যোদ্ধা না হলেও সিরদের সাথে উঠাবসা ছিল। অনেকের কথা সত্যি হয়, কারো কারো কথা হয় ভুল। সবচে বেশি বয়েসি এবং সবচে বেশি ভয় পাওয়া হয় যাকে, সেই বয়েসি সির তাকে অনেক কথা শোনায় একদিন। জানায় কেন উটচালক ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত বেশি উৎসুক।

কেন আবার, যেন কাজ করতে পারি, জবাব দেয় উট চালক, যেন যেসব ব্যাপার চাই না সেগুলো এড়িয়ে যেতে পারি।

তখনি এড়িয়ে যেতে পারবে যখন সেগুলো তোমার ভবিষ্যতের অংশ হবে না।

হয়ত আমি ভবিষ্যত জানতে চাই এজন্য যে যাই আসুক না কেন সামনে, সেটার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

ভাল ব্যাপার আসলে তা হবে দারুণ চমক। আর যদি খারাপ খবর আসে, তাহলে আসার আগেই তুমি মুষড়ে পড়বে। কারণ তুমি আগে থেকেই ভোগান্তির কথা জান।

ভবিষ্যত জানতে চাই কারণ আমি একজন মানুষ। আর মানুষ সব সময় ভবিষ্যতের উপর ভর করে জীবন চালায়।

লোকটার বিশেষ গুণ হল, মাটিতে একতাল ছক্কা ফেলে সেগুলো দেখে মানুষের ভবিষ্যত বলা। এবার সে আর সে কাজটা করে না। ছক্কাগুলো হাতে নিয়ে পেচিয়ে ফেলে কাপড়ে।

আমি লোকের জীবনের ভবিষ্যদ্বাণী করে বেড়াই, এভাবেই জীবন চালাই। জানি কী করে ছক্কাগুলোকে মারতে হয়। কী করে তাদের ঢোকাতে হয় মহাকালের বইয়ের ভিতরে যেখানে লেখা আছে সব কথা। এভাবে আমি ভবিষ্যত পড়ি, দেখতে পাই ভুলে যাওয়া অতীত আর চিনতে পারি সুলক্ষণ।

লোকে আমার কাছে কাজের জন্য এলে আমি যে ভবিষ্যত দেখতে পাই একেবারে স্পষ্ট এমন নয়। অনুমান করি হিসাবের উপর নির্ভর করে। আর সবকিছুর মত ভবিষ্যতও ঈশ্বরের, তিনি বিচিত্র সব উপায়ে হাজির করেন আমাদের ভবিষ্যতের সামনে। কী করে ভবিষ্যত নিরুপণ করি? বর্তমানের লক্ষণ বিচার করে। বর্তমানে মনোযোগ দাও, ভবিষ্যত বদলে যাবে। সব ভুলে গিয়ে বরং প্রতিদিন সুন্দরভাবে কাটানোর চেষ্টা কর। ঈশ্বর তার সৃষ্টিকে অনেক ভালবাসেন। প্রতিদিন দিন শুরু হয় অসীম সম্ভাবনা নিয়ে।

কোন পরিস্থিতিতে স্রষ্টা তাকে ভবিষ্যত জানার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন?

শুধু তখনি, যখন স্বয়ং তিনি সেটাকে তোমার সামনে হাজির করবেন। তিনি তা করেন শুধু এজন্য যে এ ভবিষ্যতটা সত্যি ভবিষ্যত, কিন্তু লেখা হয়েছে বদলে দেয়ার জন্য।

ঈশ্বর ছেলেটাকে ভবিষ্যতের এক ঝলক দেখিয়েছেন, ভাবে উটচালক। যদি তিনি সত্যি সত্যি ছেলেটাকে তার পক্ষ হয়ে সেবা করতে পাঠিয়ে থাকেন?

যাও, আর কথা বল গোত্রপতিদের সাথে। জানিয়ে দাও যে সেনাদল আসছে।

হাসবে তো!

তারা মরুর মানুষ। আর মরুর মানুষ লক্ষণ বিচার করে সব সময়।

তাহলে তারা এর মধ্যেই হয়ত জেনে গেছে।

কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা বিশ্বাস করে যদি সত্যি আল্লাহ চান তারা ভবিষ্যত সম্পর্কে জানুক, তাহলে অন্য কেউ তাদের জানাবে। আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। এবার যে জানে সে হলে তুমি।

ফাতিমার কথা মনে পড়ে যায় ছেলেটার। সিদ্ধান্ত নেয়, দেখা করবে গোত্রপতিদের সাথে।

 

২.১৭

মরুদ্যানের কেন্দ্রে থাকা বিশাল সাদা তাবুর দিকে এগিয়ে গেল সান্তিয়াগো। প্রহরীকে পাশ কাটিয়ে।

আমি গোত্রপতিদের সাথে দেখা করতে চাই। মরুভূমি থেকে লক্ষণ পেয়েছি।

কোন সাড়া না দিয়ে প্রহরী ঢুকে যায় তাবুর ভিতরে। বেরিয়ে আসে সাদা আর সোনালি পোশাক পরা এক তরুণ আরবকে নিয়ে।

সব খুলে বলল ছেলেটা। লোকটা অপেক্ষা করতে বলে আবার চলে যায় ।

নেমে আসে রাত। একে একে উত্তেজিত সেনারা আসা যাওয়া করতে থাকে তাবুতে। তারপর নিভিয়ে দেয়া হয় মরুদ্যানের সব আলো। আলো জ্বলছে শুধু বড় তাবুতে।

এই পুরো সময় জুড়ে সান্তিয়াগো শুধু ফাতিমার কথা ভেবেছে। শেষ কথাগুলোর অর্থ বের করার চেষ্টা করেছে।

অবশেষে প্রহরীরা তাকে ভিতরে যেতে বলে। ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় সান্তিয়াগো। মরুভূমির মাঝখানে এত সুন্দর তাবু থাকতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। জীবনে দেখেনি, এত সুন্দর গালিচায় পা রেখে এগিয়ে যায় সে। খাটি সোনার তৈরি বাতিদান ঝুলছে উপর থেকে। প্রত্যেকটায় একটা করে মোমবাতি। গোত্রপতিরা বসে আছে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে। দামি বিছানা আর কাজ করা লম্বা বালিশে ঠেস দিয়ে। মসলা আর চা নিয়ে যাতায়ত করছে চাকর বাকরের দল। বাকিরা ঠিক করছে হুকার আগুন। বাতাসে ধোয়ার মৃদু সুগন্ধ।

সব মিলিয়ে আটজন গোত্রপতি। এক মুহূর্তেই সবচে গুরুত্বপূর্ণ কে তা বোঝা যায়। সাদা আর সোনায় মোড়ানো এক আরব। অর্ধবৃত্তের একেবারে মাঝখানে বসে আছে। একটু আগে কথা বলেছে যে তরুণ আরবের সাথে সেও আছে সেখানে।

লক্ষণ নিয়ে কথা বলে, কে এ নবাগত? এক গোত্রপতি বলে সান্তি রাগেীকে দেখতে দেখতে।

আমি। বলে সে। তারপর জানায় সে সময়ের ঘটনাটুকু।

মরুভুমি সবাইকে বাদ দিয়ে এক নবাগতকে এসব কথা কেন জানাবে? আমরা তো এখানে বাস করি অনেক পুরুষ ধরে। বলে ওঠে আরেক গোত্রপতি।

কারণ আমার চোখ এখনো মরুর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। আমি এমন সব ব্যাপার দেখতে পাব যা মরুভূমিতে থাকা অভ্যস্ত চোখ দেবে না।

আর এজন্যও যে, আমি বিশ্বের আত্মার কথা জানি। নিজেকে বলে সান্তি গো।

মরুদ্যান হল নিরপেক্ষ এলাকা। কেউ এখানে আক্রমণ করে না। বলল তৃতীয় গোত্রপতি।

আমি যা দেখেছি শুধু তাই বলেছি। বিশ্বাস না করলে এসব নিয়ে কোন কিছু করবেন না।

তারপর আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আরবির এমন এক উচ্চারণে কথা বলে তারা যে ছেলেটা বুঝতে পারে না একটুও।

সবাই চলে যেতে ধরলেও প্রহরী তাকে থাকতে বলে। লক্ষণ ভাল নয়। এসব কথা উটওয়লাকে না বললেই হত। ভয় করছে।

তারপর হঠাৎ করে একটু আশ্বাসের হাসি দেয় মাবোর গোত্রপতি। ভাল লাগে সান্তিয়াগোর। এতক্ষণ সে কথায় যোগ দেয়নি। না দিক, বিশ্বের ভাষা সম্পর্কে তার একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। টের পায় তাবুর বাইরে ছোটাছুটির কম্পন। বুঝতে পারে, এসে ভালই করেছে।

শেষ হল আলোচনা। বুড়ো লোকটার কথা শুনে সেই লোক তাকায় সান্তি। য়াগোর দিকে। এবার তার দৃষ্টি শিতল।

দু হাজার বছর আগে, অনেক দূরের এক দেশে, স্বপ্নে বিশ্বাস করা এক ছেলেকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। সেখান থেকে বিক্রি করে দেয়া হয় দাস হিসাবে। বলছে বুড়ো লোকটা, এখন এমন এক উচ্চারণে যা বোঝা সম্ভব, আমাদের ব্যবসায়িরা সেই লোককে কিনে আনে। নিয়ে আসে মিশরে। আমাদের সবাই জানে যে যে লোক স্বপ্ন চেনে সে স্বপ্ন ব্যাখ্যাও করতে পারে।

বলে যাচ্ছে বয়েসি লোকটা এখনো, যখন ফারাও মোটা গরুর স্বপ্ন দেখল, এ লোকটা তাদের দেশকে, মিশরকে বাচিয়েছিল। নাম তার ইউসুফ। সে নিজেও ছিল নতুন দেশে নতুন মানুষ। এবং সম্ভবত তার বয়সও ছিল তোমার মতই।

থামল সে। এখনো চোখের দৃষ্টি ঠিক বন্ধুসুলভ নয়।

আমরা সব সময় ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি রাখি। মিশরকে বাচানোর সেই ইতিহাসের কথা মনে রাখি। এ ঐতিহ্যেই লেখা আছে কী করে মরুভূমি পার হতে হয়, কার সাথে বিয়ে দিতে হয় সন্তানকে। ঐতিহ্য বলে, একটা মরুদ্যান আসলে নিরপেক্ষ এলাকা। দু পক্ষেরই মরুদ্যান আছে আর দু পক্ষই সাজ্জাতিক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

বয়োবৃদ্ধের কথায় কেউ বাধা দিচ্ছে না।

আবার ঐতিহ্য আমাদের শিখায় যে মরুভূমির কথা বিশ্বাস করতে হয়। যা জানি, সব শিখিয়েছে মরুভূমিগুলো।

বয়েসি লোকটার এক ইশারায় দাড়িয়ে গেল সবাই। সমাবেশ শেষ। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হুকাগুলো। সার বেধে দাড়িয়ে আছে সৈন্যরা। যাবার জন্য প্রস্তুত হল সান্তিয়াগো। কথা বলে উঠল লোকটা আবার

কাল আমরা সে নিয়ম ভাঙব যেটায় বলা আছে যে মরুদ্যানে কেউ অস্ত্রপাতি বহন করতে পারবে না। সারাদিন তন্ন তন্ন করে খুজব শত্রুদের। সূর্যাস্তের পর আবার সবাই যার যার অস্ত্র জমা দিবে। প্রতি দশজন খতম হওয়া শক্রর জন্য তুমি পাবে একটা করে সোনার মোহর।

কিন্তু তারাও যুদ্ধে যাবার আগ পর্যন্ত অস্ত্র সংবরণ করা যাবে না। অস্ত্র। মরুর মতই। ব্যবহার না করলে পরে আর কাজে লাগানো যায় না। কাল সন্ধ্যার মধ্যে কোনটাই যদি ব্যবহার না করা যায়, অন্তত একটা ব্যবহার করা হবে তোমার উপর।

তাবু ছেড়ে সান্তিয়াগো বাইরে এসে দেখে মরুদ্যানে শুধু উঁদের আলো। নিজের তাবুতে যেতে মিনিট বিশেক সময় লাগবে। রওনা হয়ে গেল সে।

যা করার করতে পেরেছে সে। পেরেছে বিশ্বের আত্মায় ঢুকতে। আর এর বিনিময়ে তাকে এখন জীবনের মূল্য দিতে হবে। ভয়ানক বাজি। কিন্তু সেই ভেড়াগুলো বিকিয়ে দেয়ার পর থেকে তার ভয়ানক বাজির শুরু।

ঊটওয়ালা বলেছিল সেদিন, কাল মারা যাওয়া আর যে কোন একদিন মারা যাওয়া একই কথা। সব নির্ভর করছে একটা শব্দের উপর: মাকতুব।

একা পথ চলতে চলতে তার মোটেও খারাপ লাগে না। কাল যদি মারা যায় তো যাবে ঈশ্বর ভবিষ্যত বদলাতে চাননি বলে। মারা যাবার আগে তার অনেক অর্জন হয়েছে। দেখেছে আন্দালুসিয়ার দিগন্ত, সাগর, পাহাড়, মরুভূমি, দুটা মহাদেশ, করেছে নানা কাজ, দেখেছে ফাতিমার রহস্যময় চোখ। বহুদিন আগে বাসা ছেড়ে আসার পর থেকে বেচে নিয়েছে ইচ্ছামত। আনন্দে। কাল মারা গেলেই কী, আর সব রাখালেরচে অনেক বেশি দেখা হয়েছে এ ছোট জীবনে।

হঠাৎ তীব্র একটা শব্দ। তারপর পড়ে যায় সে কীসের যেন ধাক্কায়। ধুলি উড়ে অন্ধকার হয়ে যায় আশপাশ।

এরপর দেখতে পায় অতিকায় এক আরবি ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ঘোড়ার সওয়ারির সারা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা।

সম্ভবত মরুভূমি থেকে এসেছে গুপ্তচর। সংবাদবাহক। কিন্তু তার উপস্থিতি সংবাদ বাহকেরচেও শক্তিময়।

কোমর থেকে বের করে ঝকঝকে বাকানো আরবি তলোয়ার।

কে উড়ন্ত শিকারি পাখির অর্থ বলার স্পর্ধা দেখায়। চিৎকার করে ওঠে সর্বশক্তিতে। তার সেই আওয়াজ যেন আল ফাইডমের পঞ্চাশ হাজার খেজুরগাছে তোলে আলোড়ন।

সান্তিয়াগো মাতামারোসের কথা মনে পড়ে যায় সান্তিয়াগোর। একই রকম বিশাল ঘোড়ায় চড়ে ছিলেন তিনি। শুধু পরিস্থিতি এখন বিপরীত।

সে স্পর্ধা আমি দেখিয়েছি!

আবার মনের পর্দায় ভেসে ওঠেন সান্তিয়াগো মাতামারোস।

সে স্পর্ধা আমি দেখিয়েছি বলে আবার। নুইয়ে দেয় মাথাটা, যেন তলোয়ারের আঘাত পড়তে পারে, বেচে যাবে অনেক প্রাণ, কারণ আমি সৃষ্টিজগতের প্রাণের ভিতর দিয়ে দেখতে পেরেছিলাম।

তীব্র বেগে নেমে আসেনি তলোয়ারটা। বরং নেমে আসে ধীরে। অনেক ধীরে। আস্তে করে স্পর্শ করে সান্তিয়াগোর কপাল। এক ফোটা রক্ত ঝরে পড়ে সেখান থেকে।

একটুও নড়ছে না ঘোরসওয়ার। নড়ছে না ছেলেটাও। মনে কেন যেন এক বিন্দু ভয় নেই। সে স্বপ্নের পথ চলতে চলতে মারা যাবে আজ। কী আনন্দ মনের গভীরে। আনন্দ ফাতিমার জন্য। অবশেষে লক্ষণগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হল।

ভয়ের কিছু নেই। আর একটু পরই সে বিশ্ব-আত্মার অংশ হয়ে যাবে। হবে তার শত্রুরাও। আগামিকাল।

এখনো তলোয়ার ধরে রেখেছে আগন্তুক, কেন উড়ন্ত শিকারি পাখির লক্ষণ পড়লে?

আমি পড়েছি শুধু তাই যা পাখিরা বলতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল মরুদ্যানকে বাচাতে। কাল মারা যাবে তোমরা সবাই, কারণ এ মরুদ্যানে। তোমাদেরচে বেশি লোক আছে।

আল্লাহ যা চেয়েছেন তা বদলানোর কে তুমি?

তলোয়ার এখনো আগের জায়গায় ঠেকানো।

আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বাহিনীকে, যেমন সৃষ্টি করেছেন ঐ পাখির জোড়া। তিনি আল্লাহ, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন পাখির ভাষা। সবকিছু এক হাতে লেখা, মনে পড়ে যায় আবার সেই উটচারীর কথা।

সরে গেল তরবারি। কেমন এক মুক্তির স্বাদ ছড়িয়ে যায় সান্তিয়াগোর প্রাণে। এখনো নড়তে পারছে না।

তোমার ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে সাবধান থেক। লেখা হয়ে গেলে তা আর বদলানো যায় না।

আমি শুধু একটা বাহিনী দেখেছি। যুদ্ধের ফল দেখিনি।

উত্তর শুনে যেন তুষ্ট হল ঘোরসওয়ারি। এখনো হাতে অস্ত্র।

আজব দেশে আজব ছেলের কী দরকার?

আমি লক্ষ্য লক্ষ্য করে এগুচ্ছি। আমাকে তুমি বুঝে উঠতে পারবে না। এক পলকে।

তলোয়ার সরিয়ে নিল মুখটাকা লোকটা। ভরে ফেলল খাপে।

আরো একটু স্বস্তি হয় সান্তিয়াগোর।

তোমার সাহস পরখ করতে হত আমাকে, বলে আগন্তুক, উৎসাহ আর সাহস হল পৃথিবীর ভাবা বোঝার সবচে কার্যকর উপায়।

অবাক হয় ছেলেটা। সে এমন কোন ব্যাপারে কথা বলছে যা খুব কম মানুষই বোঝে।

এত দূরে আসার পর তোমার হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। কিন্তু মনে রেখ, মরুভূমিকে ভালবাসতে পার, বিশ্বাস করতে পার না। কারণ মরুভূমি সবার সাহস খতিয়ে দেখে। প্রতি পদে পদে চ্যালেঞ্জ করে, যার সাহস হারায়। হারিয়ে দেয় তাদের চিরতরে।

কথাটুকু শুনে আবার মনের ভিতরে চলে আসে বয়েসি রাজার কথা।

যদি যোদ্ধারা এখানে আসার পরও তোমার মাথা ধড়ে থাকে, কাল সন্ধ্যার পর আমাকে খুজে বের করো। বলে সওয়ারি।

তলোয়ার খাপ থেকে খুলে নিয়ে সে পা দিয়ে আঘাত করে ঘোড়ার পেটে। টগবগিয়ে ছুটতে থাকে শ্বেতঅশ্ব অন্ধকারের দিকে।

কোথায় থাক তুমি? চিৎকার করে প্রশ্ন তোলে ছেলেটা যেতে থাকা আরোহীর উদ্দেশে।

দক্ষিণে আঙুল তোলে লোকটা।

দেখা পেয়েছে সে।

সান্তিয়াগো দ্য এ্যালকেমিস্টের দেখা পেয়েছে।

 

২.১৮

পরদিন সকাল। আল ফাইউমের খেজুর গাছগুলোর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে দু হাজার সশস্ত্র মানুষ।

মাথার উপর সুর্য উঠে আসার আগেই পাচশ গোত্রিয় মানুষ হাজির দেখা দেয় দিগন্তরেখায়। উত্তর থেকে এগিয়ে আসে দলটা। দেখে মনে হয় তারা যুদ্ধের জন্য আসেনি। কিন্তু আলখেল্লার নিচে লুকানো আছে অস্ত্র। ধারালো অস্ত্র।

আল ফাহউমের কেন্দ্রে পৌছে সাদা তাবুটার কাছে যায় তারা। তারপর বের করে রাইফেলগুলো। তলোয়ারগুলো। আক্রমণ করে একইসাথে।

তাবুতে কেউ ছিল না।

বাচ্চাদের আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে মরুদ্যান থেকে দূরে এক ঝোপঝাড়ওয়ালা এলাকায়। কিছু দেখেনি তারা। নারীরা বসে ছিল তাবুগুলোয়। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিল স্বামীর জন্য। তারাও যুদ্ধের কোন নিশানা দেখতে পায়নি।

এদিকে চারপাশ থেকে, সেই মরুভূমি থেকেই আক্রমণকারীদের ঘিরে ছিল অন্য এক দল। আধঘন্টা পেরিয়ে যেতে না যেতেই মারা পড়ে আক্রমণকারীদের একজন ছাড়া সবাই।

সব মিলিয়ে, এখানে সেখানে লাশ পড়ে না থাকলে আর সব দিন থেকে আল ফাইউমের আজকের দিনটাকে আলাদা করা যেত না।

মারা হয়নি শুধু ব্যাটেলিয়নের কমান্ডারকে। সেদিন বিকালে তাকে হাজির করা হয় গোত্রপতিদের সামনে। প্রশ্ন ওঠে ঐতিহ্য ভঙ্গের ব্যাপারে। চিরাচরিত রীতি ভঙ্গের ব্যাপারে।

সেনাপতি জানায়, তার লোকজন ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর ছিল। যুদ্ধের জন্য দিনের পর দিন মরুভূমিতে থেকে থেকে একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে মরুদ্যানটা দখল করে আবার যুদ্ধে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

গোত্রপতিরা বলে যে তারা এ কথা শুনে দুঃখ পাচ্ছে, কিন্তু পবিত্র রীতি ভাঙা উচিত হয়নি। সব ধরনের সম্মান তুলে নিয়ে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তলোয়ার বা গুলির বদলে তাকে মারা হয় মৃত খেজুরগাছ থেকে ফাসিতে ঝুলিয়ে। সেখানেই, মরুভূমির বাতাসে তার দেহ বারবার নড়েচড়ে উঠছিল।

গোত্রপ্রধান ডেকে পাঠায় সান্তিয়াগোকে। তুলে দেয় পঞ্চাশ টুকরা স্বর্ণ। আবার শোনায় মিশরে আসা ইউসুফের গল্প। ছেলেটাকে মরুদ্যানের প্রধান হতে বলে।

Done page 34

২.১৯

সূর্য ডুবে গেছে। প্রথম তারা উঠতে না উঠতে দক্ষিণে যাত্রা করে ছেলেটা। একটা মাত্র তবু আছে সেখানে। পাশ দিয়ে যেতে থাকা লোকজন সাবধান। করে দেয়, জিনের বাস এখানে।

তবু যাবে না সান্তিয়াগো। বসে পড়ে।

চাঁদ বেশি উপরে উঠে আসার আগেই আসতে থাকে ঘোরসওয়ার। কাধে দুটা মৃত শিকারি পাখি ঝোলানো।

এসেছি। বলে ছেলেটা।

তোমার এখানে থাকা উচিত নয়, বলে ওঠে এ্যালকেমিস্ট, নাকি লক্ষ্যই তোমাকে এখানে টেনে এনেছে?

গোত্রে গোত্রে যুদ্ধের সময় মরুভূমি পার হওয়া অসম্ভব। তাই এসেছি।

মোড় থেকে নামে এ্যালকেমিস্ট। ইশারায় তার সাথে ভাবুর ভিতরে যেতে বলে। মরুভূমির আর দশটা তাবুর মত দেখতে জায়গাটা। এ্যালকেমিতে ব্যবহৃত আর সব জিনিসের জন্য তাকায় সে এদিক সেদিক। কিছু নেই। শুধু একতাল বই, কয়েকটা রান্নার সরঞ্জাম, আর রহস্যময় ডিজাইনে ভরা গালিচা।

বসে পড়। পান করতে হবে কিছু। খেতে হবে পাখিগুলোকে। এ্যালকেমিস্ট বলল।

মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, কালকে দেখা সেই পাখি এগুলো। কিছু বলে না সান্তিয়াগো। বরং চুপচাপ দেখে যায়। রান্না শুরু হলে আস্তে আস্তে তার ভরে ওঠে সুগন্ধে। অন্তত হুকারচে ভাল ঘ্রাণ আছে।

আমাকে দেখতে চেয়েছিলে কেন? প্রশ্ন করে ছেলেটা অবশেষে।

লক্ষণের জন্য। কাটা কাটা জবাব দেয় এ্যালকেমিস্ট, বাতাস বলেছিল আসবে তুমি। বলেছিল, তোমার প্রয়োজন পড়বে সাহায্যের।

বাতাস আমার ব্যাপারে বলেনি। যার কথা বলেছে সেও চলছে সঠিক পথে। আরেক ভিনদেশি। জাতে ইংরেজ। সেই তোমার খোঁজে বের হয়েছে।

তাকে আগে বেশ কিছু কাজ শেষ করতে হবে। কথা সত্যি, সেও চলছে সঠিক পথে। বুঝতে শিখছে মরুভূমিকে।

আর আমি?

যখন কেউ সত্যি সত্যি কিছু চায়, পুরো বিশ্বব্রহ্মান্ড তাকে সেটা পাইয়ে দেয়ার জন্য ফিসফাস শুরু করে দেয়, এ্যালকেমিস্টের কণ্ঠ চিরে বেরুল কথাগুলো, সেই বয়েসি রাজার মত করে। বুঝতে পারে ছেলেটা। এখানে আরো একজন তার পথ চলতে সহায়তা করবে।

তাহলে তুমি আমাকে শিক্ষা দিবে?

না। যা জানার সবটুকুই জেনে বসে আছ। তোমাকে শুধু তোমার গুপ্তধনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দিব, ব্যস।

কিন্তু যুদ্ধের ঘনঘটা লেগে গেছে যে!

মরুভূমির কাহিনী আমি ভালভাবেই জানি।

আর আমি এর মধ্যেই পেয়ে গেছি সেই গুপ্তধন। উট আছে একটা, আছে স্ফটিকের দোকান দেয়ার টাকা, আছে অর্ধশত সোনার টুকরা। আমার দেশে প্রায় রাজার হালে থাকতে পারব।

কিন্তু এসবের কিছুই তুমি পিরামিড় থেকে পাওনি। ভুল ধরিয়ে দেয় এ্যালকেমিস্ট।

আর আছে ফাতিমা। সে আর যে কোন সম্পদেরচে আমার কাছে বেশি মূল্যবান। পিরামিডের দেশের মেয়ে।

কিন্তু তাকে পিরামিডে পাওনি।

এরপর তারা নিরবে খেয়ে চলে। বোতল খুলে লালচে একটা তরল ঢেলে দেয় এ্যালকেমিস্ট সান্তিয়াগোর কাপে। এত স্বাদের মদ এর আগে কখনো। খায়নি সে।

এখানে না মদ নিষিদ্ধ?

মানুষের মুখে যা ঢোকে তা খারাপ নয়, বলে এ্যালকেমিস্ট, মুখ থেকে যা বেরোয় তা খারাপ।

খাবার শেষ হলে তারা বেরিয়ে আসে বাইরে। বসে পড়ে খোলা আকাশের নিছে। এমন এক ছাদের নিচে যা তারাগুলোকে একেবারে স্নান করে দিয়েছে।

পান কর, আর উপভোগ কর। এ্যালকেমিস্ট বলে, ছেলেকে খুশি দেখে, আজ রাতে ভালভাবে বিশ্রাম করে নাও, যেন তুমি কোন যোদ্ধা, যেন প্রস্তুত হচ্ছ যুদ্ধের জন্য। মনে রেখ, যেখানেই তোমার গুপ্তধন থাক না কেন, তোমার হৃদয় ঠিক ঠিক তা খুজে বের করবে। তোমাকে সেই লুকানো সম্পদ উদ্ধার করতে হবে কারণ তোমার চলার পথে সবকিছু হতে হবে অর্থবহ।

কাল, উট বেচে দিয়ে কিনে নিও একটা ঘোড়া। উটগুলো খানিকটা বিশ্বাসঘাতক। হাজার কদম চলার পরও যেন শ্রান্ত হয় না। তারপর, হঠাৎ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। মুখ থুবড়ে নেতিয়ে পড়ে মারা যায়। এদিকে ঘোড়ারা ক্লান্ত হয় আস্তে আস্তে। সব সময় বুঝতে পারবে তাদের কাছে কতটুকু চাওয়া যাবে। জানতে পারবে কখন তাদের মারা যাবার কথা।

 

২.২০

পরদিন রাতে একটা ঘোড়া নিয়ে এ্যালকেমিস্টের তাবুতে হাজির হয় ছেলেটা। এ্যালকেমিস্ট প্রস্তুত হয়ে রওনা দেয় তার সাথে। তারপর বলে, মরুর বুকে কোথায় কোথায় প্রাণ আছে, একবার দেখিয়ে দাও। যারা এসব চিনতে পারে তারাই শুধু গুপ্তধন পেতে পারে।

আকাশের চাঁদ আলো দিচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে তারা মরুভূমির বুকে।

ভাবে সান্তিয়াগো, আলো না থাকলে এখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর। আমি এখনো মরুভূমিকে ঠিকমত চিনে উঠতে পারিনি।

কথাটা এ্যালকেমিস্টকে বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। এখনো ভয় পায়। তাকে। আকাশের পাখিগুলো যেখানে দেখেছিল, সেই পাথুরে জায়গায় হাজির হয় তারা। এখন এখানে শুধুই বাতাসের হাহাকার।

মরুতে প্রাণ চিনতে শিখিনি এখনো। জানি, আছে কোথাও না কোথাও। কোথায়, তা জানি না।

জীবন আকর্ষণ করে জীবনকে।

বুঝতে পারে সান্তিয়াগো। আলগা করে দেয় ঘোড়ার লাগাম। টগবগিয়ে ঘোড়াটা খামে পাথরের উপর। প্রায় আধঘন্টার জন্য ছুটে চলে ঘোড়া। সেইসাথে পাশে পাশে ছুটে চলে এ্যালকেমিস্ট। দূরের মরুদ্যান এখন আর দেখা যায় না। দেখা যায় শুধু বিচিত্র রঙের মলিন মরুভূমি আর আকাশের চাদ।

তারপর, একেবারে কারণ ছাড়াই ধীর হতে শুরু করে ঘোড়ার গতি।

জীবন আছে এখানে, এ্যালকেমিস্টকে বলে ছেলেটা, মরুর ভাষা, এখনো আয়ত্ত করতে পারিনি, কিন্তু আমার ঘোড়া তা জানে।

নেমে পড়ে তারা। কোন কথা নেই এ্যালকেমিস্টের মুখে। ধীরে এগুতে এগুতে তারা পাথরের দিকে তাকায়। হঠাৎ থেমে পড়ে এ্যালকেমিস্ট। নিচু হয়। পাথরের খাজে ছোটখাট এক গর্ত আছে। হাত পুরে দেয় এলিকেমিস্ট, পুরোটা, কাধ পর্যন্ত। কিছু নড়ছে সেখানে। দেখা যাচেছু, এ্যালকেমিস্টের চোখ। শুধু চোখ। গর্তে যাই থাক না কেন, সেটা দখলের জন্য চেষ্টা করছে সে।

তারপর, ঝড়ের গতিতে বের করে আনে হাত। লাফিয়ে উপরে উঠে যায়। হাতে লেজের দিকে ধরা একটা গ্রাসপেড সাপ।

একই সাথে লাফিয়ে ওঠে সান্তিয়াগো। সরে যায় এ্যালকেমিস্টের কাছ থেকে দূরে। সাপটা জীতে গোক্ষুর। আর গোখরার মুখ থেকে যে বিষ বের হচ্ছে তা এক মিনিটের মধ্যে তরতাজা মানুষকে মেরে ফেলতে পারবে।

বিষের দিকে নজর রাখ, বলে ওঠে সান্তিয়াগো, কিন্তু এ্যালকেমিস্টের চোখেমুখে কোন ভাবান্তর নেই। গর্তে হাত ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেছে এটাকে বের করার। এমন জাতসাপ যে কাটেনি তা বলা যায় না। আর কামড় খেয়ে থাকলে… দুশ বছর বয়স হয়েছে এ্যালকেমিস্টের, বলেছিল ইংরেজ লোকটা। সে নিশ্চই মরুর সাপ নিয়ে কাজ করতে জানে।

ঝোলার ভিতর থেকে একটা জিনিস বের করে আনে এ্যালকেমিস্ট। তারপর বালিতে বৃত্ত একে ছেড়ে দেয় সাপটাকে। একেবারে শান্ত হয়ে আসে সেটা।

ভয়ের কিছু নেই। সে আর বৃত্ত ছেড়ে বের হবে না। তুমি মরুর বুকে জীবন খুজে পেয়েছ। ভাল নিদর্শন। ভাল লক্ষণ।

এত গুরুত্বপূর্ণ কেন ব্যাপারটা?

কারণ পিরামিডের চারপাশে মরুভূমি। বলে এ্যালকেমিস্ট।

কাল রাত থেকে সান্তিয়াগোর মন ভাল নেই। পিরামিড নিয়ে আর কোন কথা তুলতে চায় না সে নতুন করে। এখন গুপ্তধনের সন্ধানে বের হওয়া আর

ফাতিমাকে ছেড়ে যাওয়া একই কথা।

মরুভূমি পেরুনোর পথে আমি তোমাকে পথ দেখাব। বলল। এ্যালকেমিস্ট।

আমিতো মরুদ্যানে থেকে যেতে চাই। ফাতিমাকে পেয়ে গেছি। আর যতদূর মনে হয়, সে গুপ্তধনেরচেও বেশি মূল্যবান।

ফাতিমা মরুর দেশের মেয়ে, পাল্টা জবাব দেয় এ্যালকেমিস্ট, সে জানে, পুরুষদের যেতে হয় ফিরে আসার জন্য। আর সে তার গুপ্তধন এর মধ্যেই পেয়ে গেছে। তোমাকে। এখন তার কামনা যেন তুমি তোমার চাওয়াটা পাও।

কিন্তু, আমি যদি থেকে যেতে চাই?

তাহলে বলি কী হবে? তুমি হবে মরুদ্যানের উপদেষ্টা। স্বর্ণ দিয়ে কিনে ফেলবে অনেক ভেড়া আর উট। বিয়ে করে ফেলবে ফাতিমাকে। সুখে থাকবে বছরখানে। তুমি ভালবাসবে মরুভূমিকে, চিনতে শিখবে অর্ধলক্ষ খেজুরগাছের প্রতিটাকে। দেখবে, কী করে মরুভূমির বুকে বেড়ে ওঠে গাছগুলো। কী করে ক্ষয়ে যায়। আর শিখবে অনেক কিছু, কারণ এখানে সবচে বড় শিক্ষক হল স্বয়ং সাহারা।

তারপর, দ্বিতীয় বছরের কোন এক সময় মনে পড়ে যাবে গুপ্তধনের কথা। এতদিনে তোমার লক্ষণ বিচারের ব্যাপারগুলো আরো ধারালো হবে। সেগুলো অষ্টপ্রহর বলে যাবে গোপন সম্পদের ব্যাপারে। এদিকে চোখ পড়বে না। কল্যান করতে থাকবে পুরো মরুদ্যানের। গোত্রপতিরা সমস্বরে তোমার জ্ঞানে পঞ্চমুখ হয়ে পড়বে। উটের সাথে আসবে সম্পদ, সম্পদের সাথে ক্ষমতা।

এবার তৃতীয় বছরের কথা বলি। তখন তুমি শুরু করে দিয়েছ গুপ্তধন আর স্বপ্নের কথা। জীবনের লক্ষ্যের কথা। ঘুরে বেড়াবে, রাতের পর রাত, মরুর বুকে, মরুদ্যানের বুকে, একা একা। ফাতিমা ভাববে তার জন্য আজ এ অবস্থা। কিন্তু তোমার ভালবাসা তার কাছ থেকে ভালবাসা আদায় করে নিচ্ছে। কড়ায় গন্ডায়। খেয়াল করো, কখনো সে থাকতে বলছে না তোমাকে, কারণ বালির দেশের মেয়েরা সব সময় স্বামীর অপেক্ষায় থাকতে পছন্দ করে।

রাতের পর রাত ঘুরে বেড়াচ্ছি তুমি মনের অস্থিরতা নিয়ে। এদিকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে গুপ্তধন।

তারপর, চতুর্থ বছরের কোন এক সময় হারিয়ে যাবে লক্ষণগুলোও। কারণ তুমি তাদের কথায় কান দাও না। গোত্রপতিরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে সব ব্যাপার। তোমাকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতা থেকে, কারণ তোমার নিজের ক্ষমতা নেই। কিন্তু ততদিনে তোমার টাকা পয়সা বেড়ে অনেক হয়ে যাবে। থাকবে অনেক কর্মচারী। বাকি জীবনটা কাটাবে এই ভেবে যে তুমি তোমার লক্ষ্যের পিছুধাওয়া করনি। আর দেরি হয়ে গেছে এতদিনে। অনেক দেরি।

মনে রেখ। সব সময় মনে রেখ, ভালবাসা কখনো কাউকে লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিতে চায় না। কেউ যদি লক্ষ্য ছেড়ে দেয়, বুঝতে হবে সে ভালবাসা সত্যি নয়… সে ভালবাসা, যা জগতের ভাষায় কথা বলে।

এবার বালু থেকে বৃত্তটা সরিয়ে দেয় এ্যালকেমিস্ট। চট করে সাপটা চলে যায় আগের জায়গায়। সাথে সাথে সান্তিয়াগোর মনে পড়ে সেই স্ফটিক ব্যবসায়ির কথা যে অহর্নিশি মক্কা যাবার কথা ভাবে। সেই ইংরেজের কথাও মনে পড়ে যে খুঁজছে এ্যালকেমিস্টকে। সে মেয়ের কথা মনে পড়ে যে বিশ্বাস করে মরুভূমিকে। মনে পড়ে যায় সে মরুভূমির কথা যে এনে দিয়েছে ভালবাসার মেয়েটাকে।

আবার ঘোড়ায় চড়ে তারা। এবার এ্যালকেমিস্টকে অনুসরণ করে ছেলেটা। ফিরে যাচ্ছে মরুদ্যানে। সেখানকার কলরব তুলে আনে হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাস। কান পেতে আছে সান্তিয়াগো। কান পেতে আছে ফাতিমার কণ্ঠ শোনার জন্য।

আমি তোমার সাথে যাচ্ছি। অবশেষে বলে সে। কোথেকে যেন হুড়মুড় করে শান্তি এসে ভরিয়ে দেয় তার বুক।

মাত্র একটা কথাই বলে এ্যালকেমিস্ট।

আমরা কাল সূর্যোদয়ের আগে রওনা দিচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *